উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন
রায়হান আহমেদ তপাদার | ৯ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০
করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) নতুন ভ্যারিয়েন্টকে উদ্বেগ সৃষ্টিকারী ধরন ঘোষণা করার পাশাপাশি এর নতুন নামও নির্ধারণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। নতুন ধরনের এই করোনাভাইরাস ভ্যারিয়েন্টের নাম দেওয়া হয়েছে ওমিক্রন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, এই ভ্যারিয়েন্টটির বিপুল সংখ্যক মিউটেশন রয়েছে এবং প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে যে এই ভ্যারিয়েন্টে পুনঃসংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। প্রথমবার ২৪ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার খবর জানতে পারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি ভাইরাসের পরিবর্তন বা মিউটেটেড হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে সেটি তখনই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় যখন ঐ মিউটেশন সংক্রমণের ক্ষমতা, তীব্রতা অথবা টিকার কার্যকারিতার ওপর প্রভাব ফেলে। করোনাভাইরাসের নতুন একটি ভ্যারিয়েন্ট, যেটির উৎপত্তি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, মারাত্মক হুমকি তৈরি করতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্টটি ব্যাপকভাবে মিউটেট (আচরণ পরিবর্তন) করেছে। এখনো পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েকটি প্রদেশে কিছু মানুষ এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাস্তবে এটি আরও ছড়িয়ে গেছে। এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ঠেকাতে যুক্তরাজ্য এরই মধ্যে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের ছয়টি দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, বতসোয়ানা, জিম্বাবুয়ে, লেসোথো, এসওয়াতিনি থেকে সব ফ্লাইট বাতিল ঘোষণা করেছে। এই ভ্যারিয়েন্টটি কতটা দ্রুত ছড়াতে পারে, প্রচলিত টিকার মাধ্যমে এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে কতটা রক্ষা পাওয়া সম্ভব এবং এই ভ্যারিয়েন্ট থেকে সুরক্ষা পেতে কী করা যেতে পারে তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। করোনাভাইরাসের নতুন একটি ভ্যারিয়েন্ট মারাত্মক হুমকি তৈরি করতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান মিলেছে। বিশেষজ্ঞরা এর নাম দিয়েছেন বি.১.১.৫২৯। এই ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টার চেয়েও পাঁচ গুণ শক্তিশালী। নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে তারা বিশেষ সতর্কতা জারি করেছেন। এটি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
ব্রিটেনের স্বাস্থ্য বিভাগের সংক্রামক রোগবিষয়ক সংস্থা ইমপেরিয়াল ডিপার্টমেন্ট অব ইনফেকশাস ডিজিজের একজন ভাইরোলজিস্ট নতুন এই ভ্যারিয়েন্টকে ভয়াবহ ও এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে খারাপ ধরন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সেনটার ফর এপিডেমিক রেসপন্স অ্যান্ড ইনোভেশনের পরিচালক টুলিও ডি অলিভিয়েরা বলেছেন, নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের মিউটেশনের ধারা অস্বাভাবিক এবং অনেক ভিন্ন। এর ৫০টি মিউটেশন রয়েছে, যার মধ্যে ৩০টি স্পাইক প্রোটিন। ভাইরাসের যে অংশটি শরীরের কোষের সঙ্গে সংযোগ ঘটায়, নতুন ভ্যারিয়েন্টে তার ১০টি মিউটেশন রয়েছে। ডেল্টার মিউটেশন ছিল মাত্র ২টি। এর অর্থ হচ্ছে, করোনার মূল ধরন অনুযায়ী যে টিকা তৈরি হয়েছে, তা নতুন ধরনে অকার্যকর হতে পারে। নিঃসন্দেহে এটি এক ভয়াবহ দুঃসংবাদ। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, এজন্য ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য আফ্রিকার ৬টি দেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, বতসোয়ানা, জিম্বাবুয়ে, লেসোথো ও এসওয়াতিনি থেকে সব ফ্লাইট বাতিল করেছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা শীতপ্রধান দেশ হওয়ায় সেখানে এর দ্রুত সংক্রমণ ঘটে। আমাদের দেশে মার্চ-এপ্রিলে এর বিস্তারের ট্রেন্ড রয়েছে। গত দুই বছরে তা পরিলক্ষিত হয়েছে। বর্তমানে দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা নিম্নগামী। ইতিমধ্যে ভারতের ৫টি রাজ্যে নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ শুরু হয়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে হংকং, দক্ষিণ আফ্রিকা ও বতসোয়ানা থেকে আগতদের মাধ্যমে এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ঘটেছে। বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ যখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে এবং মৃত্যুশূন্য দিনও পার করেছে, তখনই কয়েকটি দেশে রোগটির নতুন ধরন ওমিক্রন সংক্রমণের খবর নিঃসন্দেহে আমাদের উৎকণ্ঠায় ফেলেছে।
কিন্তু ইতিপূর্বে নেওয়া টিকা ওমিক্রন প্রতিরোধে কার্যকর হবে কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে। ওমিক্রনের ঝুঁকি বিষয়ে আলোচনা করতে জেনেভায় জরুরি বৈঠকে বসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটি মনে করে, করোনা থেকে সেরে ওঠা রোগীদেরও আবার ওমিক্রনে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ জন্য দেশগুলোকে নজরদারি বাড়ানো, ধরন শনাক্ত করার জন্য জিনোম সিকোয়েন্স কার্যক্রম চালু করা, শনাক্ত হলে প্রতিবেদন পেশ করতে বলা হয়েছে, সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে ভাইরাসটি সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে তারা। করোনার নতুন ধরন মোকাবিলায় ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশ পদক্ষেপ নিয়েছে। যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও জাপান কোয়ারেন্টাইন জোরদারের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা ও আশপাশের দেশগুলো থেকে ফ্লাইট নিষিদ্ধ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাদের জোটভুক্ত সব দেশে দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ওই অঞ্চলের সঙ্গে ফ্লাইট চলাচল বন্ধের প্রস্তাব করেছে।
বিবিসির খবরে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা মোকাবিলায় ঝুঁকিভিত্তিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের পরামর্শ দিচ্ছে। এ অবস্থায় আমাদের করণীয় কী? স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে আমরা অবহিত হয়েছি। এই ভেরিয়েন্ট খুবই অ্যাগ্রেসিভ। এ কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ এখনই স্থগিত করা হচ্ছে।’ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখার সুপারিশ করেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশের ফ্লাইট স্থগিত বা বন্ধ করাই একমাত্র প্রতিকার নয়। কারণ, অন্য অনেক দেশেই এই ধরন পাওয়া যাচ্ছে এবং ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে যে খুব সময় লাগে না, সেটা আমরা অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখছি।
বাংলাদেশের প্রথম কর্তব্য হবে বিমানবন্দরসহ সব প্রবেশপথে স্ক্রিনিং বাড়ানো, আগত ব্যক্তিদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, তারা যেন দেশের ভেতরে কোনো মানুষের সঙ্গে মেলামেশা না করতে পারেন। প্রবেশপথে শনাক্ত করতে না পারা ও ঢিলেঢালা কোয়ারেন্টাইনের কারণেই ডেলটা ধরন দ্রুত দেশের ভেতরে ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশে টিকাদানের চিত্র হতাশাজনক। মাত্র ২০-২২ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে, যদিও সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮০ শতাংশ। এ অবস্থায় করোনার ধরন পরীক্ষা করতে দ্রুত জিনোম সিকোয়েন্সিং নিশ্চিত করতে হবে। অবিলম্বে টিকার সংগ্রহ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে যে শৈথিল্য লক্ষ করা যাচ্ছে, তা-ও দূর করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে নাগরিক সচেতনতার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে হবে। যে টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে এবং প্রয়োগ করা হচ্ছে, এ টিকা নতুন ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধে অকার্যকর হওয়ার বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কাজেই করোনার নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উপায় আগাম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া। আমাদের এখন থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার সেন্টার ফর এপিডেমিক রেসপন্স অ্যান্ড ইনোভেশনের পরিচালক অধ্যাপক টুলিও ডি অলিভিয়েরা বলেন, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট মিউটেট করেছে ৫০ বার। এর স্পাইক প্রোটিন বদলেছে ৩০ বার। মানুষের দেহের মধ্যে ঢুকতে কভিড ভাইরাস এই স্পাইক প্রোটিন ব্যবহার করে। আর করোনার টিকা সাধারণত এই স্পাইক প্রোটিনকে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়। ভাইরাসের যে অংশটি প্রথম মানুষের দেহকোষের সঙ্গে সংযোগ ঘটায় তার নাম রিসেপ্টার বাইন্ডিং ডোমেইন। অথচ ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট সেই রিসেপ্টার বাইন্ডিং ডোমেইনে মিউটেশন ঘটিয়েছে ১০ বার। সেই তুলনায় করোনার ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে এই পরিবর্তন হয়েছে মাত্র দুই বার। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই ধরনের মিউটেশন সম্ভবত রোগীর দেহের জীবাণু থেকে এসেছে, যিনি এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে পারেননি। দক্ষিণ আফ্রিকার কোয়াজুলু-নাটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড লেসেলস বলেন, এই ভাইরাসটির সংক্রমণের ক্ষমতা শঙ্কার মধ্যে ফেলেছে। গত ১৬ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনাভাইরাসের নতুন রূপে সংক্রমিতের সংখ্যা ছিল ৩০০-এর কাছাকাছি। ২৫ নভেম্বর বেড়ে তা ১ হাজার ২০০ জনে পৌঁছায়। সংক্রমণ বৃদ্ধির এই হার উদ্বেগজনক। ওমিক্রন অন্য দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্য, ইতালি, জার্মানি, বেলজিয়াম, ইসরায়েল, বতসোয়ানা ও হংকংয়ে ধরনটি শনাক্ত করা গেছে।
নেদারল্যান্ডস জানিয়েছে, শুক্রবার সাউথ আফ্রিকা থেকে আগত দুটি ফ্লাইটের ৬১ জন যাত্রীর করোনা শনাক্ত হয়েছে। তাদের এখন আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। চেক রিপাবলিক নামিবিয়া থেকে আগত একজনের শরীরে করোনার নতুন ধরন শনাক্ত করেছে। সেটি ওমিক্রনের কি না তা নিয়ে পরীক্ষা চলছে। ইউরোপীয় সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল জানিয়েছে, ইউরোপে করোনার নতুন এই ধরন ছড়িয়ে পড়ার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেছেন, করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন আরও ভালোভাবে বুঝতে এবং এটি মোকাবিলায় প্রয়োজন পড়লে টিকার ধরনে বদল আনতে পুরো বিশ্বকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে। উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেন, এই ওমিক্রন ধরনটির অভিযোজন চরিত্র সম্পর্কে জানতে বিজ্ঞানী এবং (ভ্যাকসিন) উৎপাদকদের দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় প্রয়োজন। এসময় মানুষকে টিকা নিতে, মাস্ক পরতে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
লেখক গবেষক ও কলামিস্ট
শেয়ার করুন
রায়হান আহমেদ তপাদার | ৯ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০

করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) নতুন ভ্যারিয়েন্টকে উদ্বেগ সৃষ্টিকারী ধরন ঘোষণা করার পাশাপাশি এর নতুন নামও নির্ধারণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। নতুন ধরনের এই করোনাভাইরাস ভ্যারিয়েন্টের নাম দেওয়া হয়েছে ওমিক্রন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, এই ভ্যারিয়েন্টটির বিপুল সংখ্যক মিউটেশন রয়েছে এবং প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে যে এই ভ্যারিয়েন্টে পুনঃসংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। প্রথমবার ২৪ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার খবর জানতে পারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি ভাইরাসের পরিবর্তন বা মিউটেটেড হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে সেটি তখনই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় যখন ঐ মিউটেশন সংক্রমণের ক্ষমতা, তীব্রতা অথবা টিকার কার্যকারিতার ওপর প্রভাব ফেলে। করোনাভাইরাসের নতুন একটি ভ্যারিয়েন্ট, যেটির উৎপত্তি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, মারাত্মক হুমকি তৈরি করতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্টটি ব্যাপকভাবে মিউটেট (আচরণ পরিবর্তন) করেছে। এখনো পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েকটি প্রদেশে কিছু মানুষ এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাস্তবে এটি আরও ছড়িয়ে গেছে। এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ঠেকাতে যুক্তরাজ্য এরই মধ্যে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের ছয়টি দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, বতসোয়ানা, জিম্বাবুয়ে, লেসোথো, এসওয়াতিনি থেকে সব ফ্লাইট বাতিল ঘোষণা করেছে। এই ভ্যারিয়েন্টটি কতটা দ্রুত ছড়াতে পারে, প্রচলিত টিকার মাধ্যমে এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে কতটা রক্ষা পাওয়া সম্ভব এবং এই ভ্যারিয়েন্ট থেকে সুরক্ষা পেতে কী করা যেতে পারে তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। করোনাভাইরাসের নতুন একটি ভ্যারিয়েন্ট মারাত্মক হুমকি তৈরি করতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান মিলেছে। বিশেষজ্ঞরা এর নাম দিয়েছেন বি.১.১.৫২৯। এই ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টার চেয়েও পাঁচ গুণ শক্তিশালী। নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে তারা বিশেষ সতর্কতা জারি করেছেন। এটি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
ব্রিটেনের স্বাস্থ্য বিভাগের সংক্রামক রোগবিষয়ক সংস্থা ইমপেরিয়াল ডিপার্টমেন্ট অব ইনফেকশাস ডিজিজের একজন ভাইরোলজিস্ট নতুন এই ভ্যারিয়েন্টকে ভয়াবহ ও এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে খারাপ ধরন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সেনটার ফর এপিডেমিক রেসপন্স অ্যান্ড ইনোভেশনের পরিচালক টুলিও ডি অলিভিয়েরা বলেছেন, নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের মিউটেশনের ধারা অস্বাভাবিক এবং অনেক ভিন্ন। এর ৫০টি মিউটেশন রয়েছে, যার মধ্যে ৩০টি স্পাইক প্রোটিন। ভাইরাসের যে অংশটি শরীরের কোষের সঙ্গে সংযোগ ঘটায়, নতুন ভ্যারিয়েন্টে তার ১০টি মিউটেশন রয়েছে। ডেল্টার মিউটেশন ছিল মাত্র ২টি। এর অর্থ হচ্ছে, করোনার মূল ধরন অনুযায়ী যে টিকা তৈরি হয়েছে, তা নতুন ধরনে অকার্যকর হতে পারে। নিঃসন্দেহে এটি এক ভয়াবহ দুঃসংবাদ। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, এজন্য ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য আফ্রিকার ৬টি দেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, বতসোয়ানা, জিম্বাবুয়ে, লেসোথো ও এসওয়াতিনি থেকে সব ফ্লাইট বাতিল করেছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা শীতপ্রধান দেশ হওয়ায় সেখানে এর দ্রুত সংক্রমণ ঘটে। আমাদের দেশে মার্চ-এপ্রিলে এর বিস্তারের ট্রেন্ড রয়েছে। গত দুই বছরে তা পরিলক্ষিত হয়েছে। বর্তমানে দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা নিম্নগামী। ইতিমধ্যে ভারতের ৫টি রাজ্যে নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ শুরু হয়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে হংকং, দক্ষিণ আফ্রিকা ও বতসোয়ানা থেকে আগতদের মাধ্যমে এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ঘটেছে। বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ যখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে এবং মৃত্যুশূন্য দিনও পার করেছে, তখনই কয়েকটি দেশে রোগটির নতুন ধরন ওমিক্রন সংক্রমণের খবর নিঃসন্দেহে আমাদের উৎকণ্ঠায় ফেলেছে।
কিন্তু ইতিপূর্বে নেওয়া টিকা ওমিক্রন প্রতিরোধে কার্যকর হবে কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে। ওমিক্রনের ঝুঁকি বিষয়ে আলোচনা করতে জেনেভায় জরুরি বৈঠকে বসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটি মনে করে, করোনা থেকে সেরে ওঠা রোগীদেরও আবার ওমিক্রনে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ জন্য দেশগুলোকে নজরদারি বাড়ানো, ধরন শনাক্ত করার জন্য জিনোম সিকোয়েন্স কার্যক্রম চালু করা, শনাক্ত হলে প্রতিবেদন পেশ করতে বলা হয়েছে, সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে ভাইরাসটি সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে তারা। করোনার নতুন ধরন মোকাবিলায় ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশ পদক্ষেপ নিয়েছে। যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও জাপান কোয়ারেন্টাইন জোরদারের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা ও আশপাশের দেশগুলো থেকে ফ্লাইট নিষিদ্ধ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাদের জোটভুক্ত সব দেশে দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ওই অঞ্চলের সঙ্গে ফ্লাইট চলাচল বন্ধের প্রস্তাব করেছে।
বিবিসির খবরে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা মোকাবিলায় ঝুঁকিভিত্তিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের পরামর্শ দিচ্ছে। এ অবস্থায় আমাদের করণীয় কী? স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে আমরা অবহিত হয়েছি। এই ভেরিয়েন্ট খুবই অ্যাগ্রেসিভ। এ কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ এখনই স্থগিত করা হচ্ছে।’ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখার সুপারিশ করেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশের ফ্লাইট স্থগিত বা বন্ধ করাই একমাত্র প্রতিকার নয়। কারণ, অন্য অনেক দেশেই এই ধরন পাওয়া যাচ্ছে এবং ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে যে খুব সময় লাগে না, সেটা আমরা অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখছি।
বাংলাদেশের প্রথম কর্তব্য হবে বিমানবন্দরসহ সব প্রবেশপথে স্ক্রিনিং বাড়ানো, আগত ব্যক্তিদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, তারা যেন দেশের ভেতরে কোনো মানুষের সঙ্গে মেলামেশা না করতে পারেন। প্রবেশপথে শনাক্ত করতে না পারা ও ঢিলেঢালা কোয়ারেন্টাইনের কারণেই ডেলটা ধরন দ্রুত দেশের ভেতরে ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশে টিকাদানের চিত্র হতাশাজনক। মাত্র ২০-২২ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে, যদিও সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮০ শতাংশ। এ অবস্থায় করোনার ধরন পরীক্ষা করতে দ্রুত জিনোম সিকোয়েন্সিং নিশ্চিত করতে হবে। অবিলম্বে টিকার সংগ্রহ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে যে শৈথিল্য লক্ষ করা যাচ্ছে, তা-ও দূর করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে নাগরিক সচেতনতার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে হবে। যে টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে এবং প্রয়োগ করা হচ্ছে, এ টিকা নতুন ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধে অকার্যকর হওয়ার বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কাজেই করোনার নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উপায় আগাম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া। আমাদের এখন থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার সেন্টার ফর এপিডেমিক রেসপন্স অ্যান্ড ইনোভেশনের পরিচালক অধ্যাপক টুলিও ডি অলিভিয়েরা বলেন, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট মিউটেট করেছে ৫০ বার। এর স্পাইক প্রোটিন বদলেছে ৩০ বার। মানুষের দেহের মধ্যে ঢুকতে কভিড ভাইরাস এই স্পাইক প্রোটিন ব্যবহার করে। আর করোনার টিকা সাধারণত এই স্পাইক প্রোটিনকে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়। ভাইরাসের যে অংশটি প্রথম মানুষের দেহকোষের সঙ্গে সংযোগ ঘটায় তার নাম রিসেপ্টার বাইন্ডিং ডোমেইন। অথচ ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট সেই রিসেপ্টার বাইন্ডিং ডোমেইনে মিউটেশন ঘটিয়েছে ১০ বার। সেই তুলনায় করোনার ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে এই পরিবর্তন হয়েছে মাত্র দুই বার। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই ধরনের মিউটেশন সম্ভবত রোগীর দেহের জীবাণু থেকে এসেছে, যিনি এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে পারেননি। দক্ষিণ আফ্রিকার কোয়াজুলু-নাটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড লেসেলস বলেন, এই ভাইরাসটির সংক্রমণের ক্ষমতা শঙ্কার মধ্যে ফেলেছে। গত ১৬ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনাভাইরাসের নতুন রূপে সংক্রমিতের সংখ্যা ছিল ৩০০-এর কাছাকাছি। ২৫ নভেম্বর বেড়ে তা ১ হাজার ২০০ জনে পৌঁছায়। সংক্রমণ বৃদ্ধির এই হার উদ্বেগজনক। ওমিক্রন অন্য দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্য, ইতালি, জার্মানি, বেলজিয়াম, ইসরায়েল, বতসোয়ানা ও হংকংয়ে ধরনটি শনাক্ত করা গেছে।
নেদারল্যান্ডস জানিয়েছে, শুক্রবার সাউথ আফ্রিকা থেকে আগত দুটি ফ্লাইটের ৬১ জন যাত্রীর করোনা শনাক্ত হয়েছে। তাদের এখন আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। চেক রিপাবলিক নামিবিয়া থেকে আগত একজনের শরীরে করোনার নতুন ধরন শনাক্ত করেছে। সেটি ওমিক্রনের কি না তা নিয়ে পরীক্ষা চলছে। ইউরোপীয় সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল জানিয়েছে, ইউরোপে করোনার নতুন এই ধরন ছড়িয়ে পড়ার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেছেন, করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন আরও ভালোভাবে বুঝতে এবং এটি মোকাবিলায় প্রয়োজন পড়লে টিকার ধরনে বদল আনতে পুরো বিশ্বকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে। উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেন, এই ওমিক্রন ধরনটির অভিযোজন চরিত্র সম্পর্কে জানতে বিজ্ঞানী এবং (ভ্যাকসিন) উৎপাদকদের দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় প্রয়োজন। এসময় মানুষকে টিকা নিতে, মাস্ক পরতে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
লেখক গবেষক ও কলামিস্ট