
প্রখ্যাত বাঙালি কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মতিলাল চট্টোপাধ্যায়। শরৎচন্দ্রের কৈশোর ও প্রথম যৌবন কাটে ভাগলপুরের নানাবাড়িতে। এন্ট্রান্স পাসের পর কলেজে এফএ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন। অর্থাভাবে পড়াশোনা বন্ধ করে দেন এবং বনেলি স্টেটে সেটেলমেন্ট কর্মকর্তার সহকারীর চাকরি নেন। পরে কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক ও মিয়ানমারে (তৎকালীন বার্মা) রেলওয়ের হিসাব দপ্তরে কেরানি পদেও কাজ করেছেন। একসময় তিনি সন্ন্যাসী দলেও যোগ দেন এবং গান ও নাটক পরিবেশন করেন। শরৎচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস ‘বড়দিদি’ ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হলে সাহিত্যজগতে পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। তার উপন্যাসের সংখ্যা অনেক। এর মধ্যে ‘শ্রীকান্ত’, ‘চরিত্রহীন’, ‘গৃহদাহ’, ‘দেনা-পাওনা’ ও ‘পথের দাবি’ খুবই জনপ্রিয়। বিপ্লবীদের সমর্থন করছে এই অভিযোগ তুলে তার ‘পথের দাবী’ উপন্যাসটি ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। তার উপন্যাসে ব্যক্তিমানুষের ইচ্ছা ও মুক্তি মূলত সমাজই নিয়ন্ত্রণ করে থাকেএমনটা প্রকাশ পেয়েছে। এ কারণে তাকে রক্ষণশীলও বলা হয়ে থাকে। শরৎচন্দ্র ছবি আঁকায়ও দক্ষ ছিলেন। মিয়ানমারে বসবাসকালে তিনি ‘মহাশ্বেতা’ নামে একটি অসাধারণ তৈলচিত্র অঙ্কন করেছেন। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য শরৎচন্দ্র কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সদস্যপদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি-লিট উপাধি (১৯৩৬) লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন, দেশে চলমান করোনার টিকাদান কর্মসূচি, করোনা সংক্রমণ ও টিকাসংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তরের সম্পাদকীয় বিভাগের এহ্্সান মাহমুদ
দেশ রূপান্তর : দেশে করোনা সংক্রমণের দুই বছরের কাছাকাছি সময় অতিক্রম করছি আমরা। এই সময়ে এসে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন নিয়ে নতুন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এর আগে ডেল্টা ধরন নিয়েও দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছিল। কিছুদিন আগে করোনা শনাক্তের হার ১ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছিল। কিন্তু এখন আবার পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার বেড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। মহামারীর বর্তমান পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন?
ডা. এ কে আজাদ খান : এই মুহূর্তে করোনা পরিস্থিতির দিন দিন অবনতি হচ্ছে সত্যি। আবার ওমিক্রনে যত লোক আক্রান্ত হচ্ছেন তার তুলনায় হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যুর সংখ্যা কম। এটা হচ্ছে আশার কথা। তবে এখনো করোনা পরিস্থিতি সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই আছে। অনেক মানুষের কাছে ওমিক্রন সাধারণ ঠান্ডাজনিত অসুখের মতো মনে হবে। আক্রান্ত হওয়ার পর কারও কারও গলা শুকিয়ে যায়, সর্দি হয়, শরীরের জয়েন্টে ব্যথা বা মাথাব্যথা হতে পারে।
ওমিক্রনের লক্ষণগুলো খুবই হালকা হয়। ডেল্টা বা অন্য ধরনগুলোর মতো অতটা প্রকট নয়। অনেকের ফুসফুসের ওপরের দিকে ব্যথা হতে পারে। করোনার লক্ষণ দেখা গেলে যেসব সতর্কতা অবলম্বনের কথা আগে বলা হয়েছে, এখন সবাইকে সেগুলো মানতে হবে। ওমিক্রনের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার নেই। অনেকে করোনায় আক্রান্ত হলে দেখা গেছে, স্বাদ বা গন্ধের অনুভূতি চলে যায়। কাশি এবং উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর হয় কারও কারও। এখনো করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এই তিনটি প্রধান লক্ষণই দেখা যাচ্ছে। ওমিক্রনে আক্রান্ত হলে অনেক সময় হালকা ঠান্ডা লাগা বা সাধারণ অসুস্থতা মনে হতে পারে।
ওমিক্রনের সংক্রমণের যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে বুকের ওপরের অংশে ব্যথা, মাথাব্যথা, জ্বর, ক্লান্ত লাগা, শরীরে ব্যথা, গলা শুকিয়ে যাওয়া। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ওমিক্রন অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়লেও এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্তে জানা যাচ্ছে, ওমিক্রন একটু হালকা ধরনের। ডেল্টায় আক্রান্তদের মতো গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া বা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংখ্যা কম। এর ধরন ভালোভাবে জানার জন্য আমাদের আরও বেশি সিকোয়েন্সিং করতে হবে। তাহলে ধরনটা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে। আমাদের দেশে এটি কম হচ্ছে। তবে ওমিক্রন যে করোনার অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে কম ক্ষতিকর, তা নিশ্চিত করে বলার মতো যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। করোনার সব ধরনের ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত নিজেদের বিস্তার করছে। এ কারণেই করোনার এরকম নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের জন্ম হচ্ছে। অনেক ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাসকে আরও বেশি ক্ষতিকর করে তুলতে পারে। আবার অনেকগুলো শুধু নিজেকে বিস্তার করে বা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তবে ওমিক্রন অতটা ক্ষতিকারক নয়। করোনার শুরুর দিকে যেভাবে লোকজন শ্বাসকষ্টে ভুগেছে এবার তা কম হচ্ছে। তাই হাসপাতালে যেতে হচ্ছে কম ও মৃত্যুর হারও কম। এটা সত্যি যে, করোনার ডেল্টা বা অন্য ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ওমিক্রন খুব দ্রুত ছড়ায়। এটাও ঠিক, ওমিক্রন ততটা প্রাণঘাতী নয়। বিশ্বব্যাপী দেখা গেছে, এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও অন্যগুলোর তুলনায় রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার হার অনেক কম।
এখন কেউ ওমিক্রন নাকি ডেল্টায় আক্রান্ত হয়েছেন, সেটা নিয়ে ভাবনার চেয়ে বরং করোনায় যাতে আক্রান্ত না হন, সবাইকে সে চেষ্টা করতে হবে। সেজন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। মাস্ক পরতে হবে। কোনোভাবে আক্রান্ত হয়ে গেলে আইসোলেশনসহ চিকিৎসার যেসব পদ্ধতি আছে, সেগুলোই অনুসরণ করতে হবে।
দেশ রূপান্তর : করোনার ডেল্টা ধরনের দাপটে গত বছরের মাঝামাঝি দেশে করোনায় মৃত্যু, রোগী শনাক্ত ও শনাক্তের হার বেড়েছিল। তবে আগস্টে দেশব্যাপী করোনার গণটিকা দেওয়ার পর সংক্রমণ কমতে থাকে। গত ডিসেম্বরের প্রথম দিকেও দেশে করোনা শনাক্তের হার ১ শতাংশের ঘরেই ছিল। এখন নতুন করে বৃদ্ধির কারণ কী?
ডা. এ কে আজাদ খান : আগেই বলেছি ওমিক্রন যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে সে হারে কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে না। মৃত্যুও তুলনামূলক কম। তবে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এখন যে হারে শনাক্ত হচ্ছে, সেগুলো হচ্ছে পরীক্ষার বিপরীতে। করোনার যে ধরনটি এখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, সেটি আমাদের দেশে আসার আগে প্রতিবেশী দেশে এসেছে। ইউরোপে এবং আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ছে। এই ভাইরাসটি দেশে প্রবেশের পরেই দ্রুত বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের সীমান্ত এলাকায় স্ক্রিনিং বাড়াতে পারিনি। বিমানবন্দরসহ দেশে প্রবেশের অন্য ক্ষেত্রগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। ভাইরাসটি তাই প্রবেশ করতে পেরেছে এবং ছড়িয়ে পড়েছে।
দেশ রূপান্তর : এর আগে আমরা করোনার শুরুর বছর লকডাউনের নানা ধরন দেখলাম। কঠোর লকডাউন, কঠোরতম লকডাউন থেকে শুরু করে শিথিল লকডাউনের দেখা মিলেছে। এমন পরিস্থিতিতে এবার সরকার ১১টি বিধিনিষেধ দিয়েছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ডা. এ কে আজাদ খান : এখন দেশে করোনার যে সার্বিক পরিস্থিতি তাতে চলমান বিধিনিষেধ যা ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে যে কোনো ধরনের শিথিলতাই ঝুঁকি বয়ে আনবে। এখন সরকার নানা দিক বিবেচনা করে, বিচার-বিশ্লেষণ করে যেটি প্রয়োজনীয় ও লাভজনক মনে করছে, সেটিই করবে। জনস্বাস্থ্যের বিবেচনায় এখন এই বিধিনিষেধ শিথিল করার সুযোগ নেই।
আমি বরং বাইরের একটি দেশের কথা বলতে পারি। যেমনএকটি দেশে যেখানে ধূমপান যারা করেন, তারা সরকারকে সে জন্য বাড়তি ট্যাক্স প্রদান করেন। কারণ, ধূমপান যিনি করেন তিনি তার নিজের ক্ষতির পাশাপাশি তার আশপাশের লোকজনের ক্ষতি করছেন। সেই ক্ষতিপূরণ করতে অর্থাৎ, তার চিকিৎসায় সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হয়। তাই যিনি ধূমপান করেন, তার অতিরিক্ত ট্যাক্স আদায় করতে হয়।
এখন আমাদের দেশেও যারা মাস্ক পরিধান করতে আপত্তি তাদের সাজার আওতায় আনা যেতে পারে। তবে আমাদের দেশের যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা সেটি করার আগে জনসাধারণকে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ করা যেতে পারে। আমাদের যে পোশাক কারখানা রয়েছে তাদের ব্যবহার করে সরকার চাইলে যাদের মাস্ক কেনার সক্ষমতা নেই তাদের কাপড়ের মাস্ক যেটি বারবার ব্যবহার করা যায় তা দেওয়া যেতে পারে। যাতে করে পরে কেউ মাস্ক ব্যবহার করতে আপত্তি জানালে তখন তাকে শাস্তির আওতায় আনা যায়। সরকার চাইলে এটি সহজেই করতে পারে।
দেশ রূপান্তর : আমাদের দেশের যে সরকারি ওয়েবসাইট সেখানে দেখা গেল ঢাকা ও রাঙ্গামাটি জেলা করোনা সংক্রমণের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। এটি কেন বলে মনে করেন?
ডা. এ কে আজাদ খান : এই অঞ্চলে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, তাই এমনটা হয়েছে। ঢাকা একটি জনবহুল শহর এখানে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে নতুন ধরন দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। আর রাঙ্গামাটি যেহেতু পর্যটন এলাকা, এমন হতে পারে কেউ ভাইরাসটি বহন করে সেখানে গিয়েছে। আর দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়েছে।
দেশ রূপান্তর : দেশে করোনার এই বিরাজমান ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতিতে আপনার পরামর্শ কী?
ডা. এ কে আজাদ খান : এখন প্রথম যেটি করতে হবে, টিকার জন্য নিজস্ব উৎপাদনে যেতে হবে। দেশের ১৭ কোটি জনসাধারণ, এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য আমদানিনির্ভর টিকার দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী টিকা উৎপাদনের কথা ঘোষণা দিলেও সরকার কেন সেদিকে অগ্রসর হচ্ছে না, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের দেশে টিকা উৎপাদনের সব ব্যবস্থাই আছে। তবুও শুরু করা যাচ্ছে না। এখন বিশে^র করোনার যে পরিস্থিতি তাতে করোনা আরও কিছুকাল স্থায়ী হবে বলেই মনে হয়। তাই করোনো মোকাবিলায় নিজেদের টিকা উৎপাদনের দিকেই মনোযোগী হতে হবে।
দেশ রূপান্তর : আপনি একজন ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞ। করোনার এই সময়ে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য কেমন ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করেন?
ডা. এ কে আজাদ খান : অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। অতিরিক্ত ওজন, মেদবাহুল্য, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, উচ্চ শর্করা ও কম আঁশযুক্ত খাদ্যাভ্যাস থাকলে ডায়াবেটিস হতে পারে। এ ছাড়া পরিবারের কারও ডায়াবেটিস থাকলে অর্থাৎ, উত্তরাধিকারসূত্রে হতে পারে, জন্মের সময় ওজন কম থাকা, প্রবীণদের মধ্যেও ডায়াবেটিস দেখা যায়। ডায়াবেটিস রোগীরা হৃদযন্ত্র ও রক্তনালি, কিডনি, স্নায়ুতন্ত্র, অন্ধত্বসহ বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন। তাই ডায়াবেটিসের ঝুঁকি এড়াতে সুষম খাবার গ্রহণ, নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন, শারীরিক ব্যায়াম এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। এখন এই করোনা মহামারীর সময়ে ডায়াবেটিক রোগীদের নিয়মিত পরীক্ষা এবং ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ডায়াবেটিককে অনিয়ন্ত্রিত করা যাবে না। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিক রোগী করোনায় আক্রান্ত হলে তার ভয়াবহতা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ডা. এ কে আজাদ খান : আপনাকেও ধন্যবাদ।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুসারে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশে^ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে এখন ৬০ ধরনের ২০০ জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। ১ কোটি ৬২ লাখের মতো কৃষক পরিবার সবজি চাষের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বৈশি^কভাবে উৎপাদনে সেরা অবস্থানে থাকলেও সবজির বিপণন ও বাজার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে নানা প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। দুঃখজনক বিষয় হলো সেরা উৎপাদক হওয়া সত্ত্বেও দেশের কৃষকরা সবজির ন্যায্যমূল্য পান না। আবার শহুরে ভোক্তাদেরও উচ্চমূল্যে সবজি কিনতে হয়। একদিকে সবজি মজুদে কৃষকের অক্ষমতার সুযোগ নিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা তৃণমূল পর্যায় থেকে কম দামে সবজি কিনে নেন, আরেক দিকে আধুনিক বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা না থাকার কারণে দেশের বাজারে দফায় দফায় হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গে সবজির দাম বাড়তে থাকে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো জেলা পর্যায় থেকে রাজধানীসহ শহর-বন্দরগুলোতে পরিবহনের সময় নানারকম চাঁদাবাজির কারণে সবজির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। ভয়াবহ বিষয় হলো সড়ক-মহাসড়কে এই চাঁদাবাজি যাদের বন্ধ করার কথা সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা পুলিশের চাঁদাবাজিই এক্ষেত্রে এক বিরাট সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শনিবার দেশ রূপান্তরে ‘পুলিশের চাঁদাবাজির তথ্য পুলিশের প্রতিবেদনে’ শিরোনামের সংবাদে দেশে সবজি বিপণনের ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজির বিশদ তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, বগুড়া থেকে ঢাকায় আসতে অন্তত সাতটি স্থানে পণ্যবাহী ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় করা হয়। এর মধ্যে তিনটি স্থানে মাসিক হিসেবে পুলিশকে দিতে হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা। বাকি চারটি স্থানে প্রতি ট্রিপে সর্বোচ্চ সাড়ে ৮০০ টাকা দিতে হয়। সবজির বাজার নিয়ে সম্প্রতি দেওয়া পুলিশের একটি প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি স্বরাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে পুলিশের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন। পুলিশের ওই প্রতিবেদনে চাঁদাবাজিসহ নানা কারণে ভরা মৌসুমেও সবজির বাজার চড়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, প্রত্যন্ত এলাকা থেকে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত সবজি পরিবহনে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি চলছে। এতে পণ্যের দাম দুই থেকে তিন গুণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি বেড়েছে।
সবজির বাজার নিয়ে পুলিশের প্রতিবেদনে থাকা তালিকা অনুযায়ী, বগুড়ার মোকাম থেকে সবজি আনতে প্রতিটি ট্রাককে বগুড়া পৌরসভার ৫০ টাকা টোল দিয়ে যাত্রা শুরু করতে হয়। এরপর শেরপুরে ৫০, সিরাজগঞ্জ ট্রাক মালিক-শ্রমিক সমিতিকে ৫০, সিরাজগঞ্জ শহরে গাড়ি ঢুকলে ৫০, সিরাজগঞ্জ মোড় হাইওয়ে পুলিশকে (মাসিক) ৫০০, যমুনা সেতু গোল চত্বর হাইওয়ে পুলিশকে (মাসিক) ৫০০, টাঙ্গাইল মোড় হাইওয়ে পুলিশকে (মাসিক) ৫০০, সাভারের আমিনবাজারে (লাঠিয়াল বাহিনী) প্রতি ট্রিপ ১০০ থেকে ২০০, কারওয়ান বাজার পার্কিংয়ে ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়া প্রতি ট্রিপে যমুনা সেতুর টোল ১ হাজার ৪০০ টাকা রয়েছে। অন্যদিকে সম্প্রতি ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়েও পরিবহন মালিকরা অযৌক্তিক হারে পরিবহন ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন বলেও জানানো হয়েছে পুলিশের ওই প্রতিবেদনে। একটি ৫ টন ক্ষমতার ট্রাক বগুড়ার মহাস্থান হাট থেকে ২০২ কিলোমিটার দূরত্বে ঢাকায় আসতে গড়ে ডিজেল লাগে ৮০ লিটারের মতো। ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৬৫ থেকে ৮০ টাকা করায় এই দূরত্বে বর্তমানে ডিজেল বাবদ খরচ হয় ৬ হাজার ৪৬৪ টাকা। আগে খরচ হতো ৫ হাজার ২৫২ টাকা। অর্থাৎ ডিজেলের দাম বাবদ অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে ট্রাকপ্রতি ১ হাজার ২১২ টাকা। পুলিশ বলছে, ডিজেলের দাম বাড়ায় একটি ট্রাকের ভাড়া সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা বাড়ার কথা। অথচ ট্রিপপ্রতি ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা বেশি ভাড়া নিচ্ছেন পরিবহন মালিকরা।
লক্ষ করা দরকার, উত্তরবঙ্গ থেকে দেশের সবজির চাহিদার বড় অংশ পূরণ করা হলেও সেখানে তেমন বড় কোনো পাইকারি বাজার নেই। যার কারণে রংপুর, নাটোর, বগুড়াসহ আশপাশের জেলা থেকে সবজি গাড়িতে করে বড় পাইকারি বাজার কুমিল্লার নিমসার আড়তে আসে। এখান থেকে আবার হাতবদল হয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জেলা শহরে এসব সবজি নিয়ে যাওয়ার জন্য আরেক দফা অতিরিক্ত পরিবহন ব্যয় ও হাতবদলের কারণে খরচ বাড়ছে। এক্ষেত্রে অবশ্যই কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে সবজিসহ অন্যান্য কৃষিপণ্যের বিপণন প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য আঞ্চলিক বাজার প্রতিষ্ঠাসহ প্রাসঙ্গিক জরুরি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেলওয়ে ওয়াগনের মাধ্যমে স্বল্প ভাড়ায় সবজি পরিবহনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অন্যদিকে, এটা মন্দের ভালো যে, পুলিশের নিজস্ব প্রতিবেদনেই এখন পুলিশের চাঁদাবাজির কথা উঠে আসছে। সেক্ষেত্রে পথে পথে চাঁদাবাজি বন্ধের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবশ্যই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
বিশ্বের বড় শহরগুলোতে বায়ুদূষণ এখন অন্যতম সমস্যা। কয়েক বছর ধরে ঢাকা সবচেয়ে দূষিত বাতাসের পাঁচটি শহরের মধ্যে রয়েছে। তবে চলতি বছর বিশ্বের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার ভিজুয়ালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এক নম্বর হয়েছে। আর শহরের তালিকায় দিল্লির পরই রয়েছে ঢাকার নাম। সংস্থাটির হিসাবে ঢাকার বায়ু বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ২০০ দিনের চেয়েও বেশি সময়জুড়ে অনিরাপদ বা অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল। এটা ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছিল ১২০ থেকে ১৩০ দিন। আর গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর রাত ৮টায় ঢাকা শহর বায়ুদূষণে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল।
ঢাকার বায়ুদূষণের উৎস নিয়ে ২০২১ সালে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক জরিপ বলছে, রাজধানীর বাতাসকে এখন বিষিয়ে তুলছে যানবাহনের ধোঁয়া। বায়ুদূষণের অর্ধেকই (৫০ শতাংশ) মূলত তরল জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে তৈরি হওয়া। ১০ শতাংশ দূষিত বস্তুকণা আসে ইটভাটায় কয়লা পোড়ানোর ধোঁয়া থেকে। বাকিটা আসে অন্যান্য ধোঁয়ার মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক সংস্থা-নামবিও বছরে দুইবার জরিপ ফলাফল প্রকাশ করে। ২০২১ সালের এক জরিপে বেশি-যানজটের শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল নবম। যানজটের ফলে বায়ুতে দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ২০২১ সালে বসবাসযোগ্যতা নিয়ে যেসব জরিপ হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগেই ঢাকার অবস্থান ছিল তলানিতে। গত কয়েক বছর ধরে ঢাকার অবস্থান ক্রমাগত নিচে নেমেছে। কয়েকটি ইন্ডিকেটরের কথা উল্লেখ করছি। ঢাকা কম বসবাস-যোগ্যতা ও বায়ুদূষণে দ্বিতীয়, জনসংখ্যা ও কম নিরাপত্তায় ষষ্ঠ, যানজটে নবম এবং উদ্ভাবনে বিশ্বের ৫০০ শহরের মধ্যে ৪৪৯তম।
অন্যদিকে, এক হাজার পাঁচশ আটাশ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঢাকার জনসংখ্যা দুই কোটি পেরিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে বিশ্বের মেগাসিটিগুলোর মধ্যে ছয় নম্বরে অবস্থান করছে। বিভিন্ন কারণে বসবাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আগে ইটভাটাকে প্রধান ‘কালপ্রিট’ বললেও এখন (জরিপ মতে) প্রধান কারণ হচ্ছে যানবাহনের কালোধোঁয়া। গাড়িতে উন্নত জ্বালানির ব্যবহার, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা, উন্নত ইঞ্জিন ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে লক্ষ রাখলে যানবাহন থেকে দূষণের মাত্রা অনেক কম হয়। কিন্তু আমরা উল্টোটাই করি। ঢাকার চলাচলকারী যানবাহনগুলোর বেশিরভাগই ব্যবহারের অনুপযোগী। অনেকগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। গাড়িগুলোর যন্ত্রাংশের মেয়াদ শেষ হওয়ায় সেগুলো থেকে বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ হয়। উন্নত বিশ্ব ‘কন্ট্রোল ওয়ে’তে দূষণ কমাচ্ছে। তারা পুরনো গাড়ি বাতিল করে দেয়। গাড়িতে তারা উন্নতমানের ইঞ্জিন ব্যবহার করে। আমরা নিম্নমানের ইঞ্জিন ব্যবহার করি। তারা গাড়িতে যে জ্বালানি ব্যবহার করে এর সালফারের মাত্রা ৫০ এর নিচে; আমাদের দেশে সেই মাত্রা ২০০০-এর ওপরে।
এদিকে, বায়ুদূষণের ফলে ঢাকাবাসীর আয়ু কমে যাচ্ছে। গবেষণা বলছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী সব জেলাতেই বায়ুদূষণের হার স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত তিন গুণ বেশি। লাইফ ইনডেক্স অনুযায়ী, দেশের দূষিত শহরগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে অবস্থিত। আর ‘বস্তুকণা ২.৫’ বেশি রয়েছে যথাক্রমে নারায়ণগঞ্জ, যশোর, রাজশাহী, খুলনা, পাবনা, ঢাকা ও গাজীপুরে। দেশের অভ্যন্তরে ইটভাটা, শিল্পকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির কালো ধোঁয়া, বস্তিতে প্রায় চল্লিশ লাখ চুলায় আবর্জনা, কাঠ-কয়লা ও কেরোসিন দিয়ে রান্নার ধোঁয়া, ঢাকার বাইরে থেকে আসা হাজার হাজার ট্রাক ও দূরপাল্লার যানবাহনের ধুলা ও ধোঁয়া এবং রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজের ধুলার পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত বায়ুদূষণের জন্য এখানকার বায়ু দূষিত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ সরকারের পরমাণু শক্তি কেন্দ্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্লার্কসন বিশ্ববিদ্যালয় ও রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যৌথভাবে একটি গবেষণা করেছেন। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে যে বায়ুদূষণ ঘটছে, তার অন্যতম কারণ আন্তঃসীমান্ত বায়ুপ্রবাহ। ইরান, মঙ্গোলিয়া, আফগানিস্তানের শুষ্ক মরু অঞ্চল থেকে ধূলিকণা বাতাসে মিশে যায়। পশ্চিমা লঘুচাপের মাধ্যমে ওই ধূলিকণাসহ বাতাস ভারতে প্রবেশ করে। নভেম্বর থেকে ওই দূষিত বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এতে আরও বলা হয়েছে যে, ঢাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে মারাত্মক যানজট ও ধোঁয়া তৈরি হচ্ছে। অবকাঠামো নির্মাণের ফলে সেখানে প্রচুর পরিমাণে ধুলাবালিও বাতাসে মিশছে। এসব নিয়েই ঢাকার বাতাস বিষাক্ত হয়ে পড়েছে।
বসতিবিষয়ক জাতিসংঘের সংস্থা ইউএন হ্যাবিটেট-এর হিসাবে, একটি আদর্শ বড় শহরের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ এলাকা সবুজ এবং ১৫ শতাংশ এলাকা জলাভূমি থাকতে হবে। কিন্তু ঢাকার সবুজ, জলাশয় ক্রমশ উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। ১৯৮৯ সালেও ঢাকা শহরের ১৭ শতাংশ এলাকা ছিল সবুজ গাছপালায় ঘেরা। ২০২০ সালে ২ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ মাত্র ৩০ বছরে সবুজায়নের এত অধঃপতন। মূলত ২০০৯ সাল থেকে ঢাকার সবুজ ও জলাভূমি এলাকা সবচেয়ে দ্রুত হারে কমেছে। কিন্তু একই সময়ে উন্নত বিশ্বের অনেক শহরে পরিকল্পিত সবুজায়ন করা হচ্ছে। ইউএন হ্যাবিটেট-এর হিসাবে, একটি আদর্শ বড় শহরের কমপক্ষে সড়ক থাকতে হবে ২০ শতাংশ এলাকায়। ঢাকায় সড়ক আছে মাত্র ৮ শতাংশ এলাকাজুড়ে। আর উন্মুক্ত স্থান আছে মাত্র শহরের ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। ফলে এখানে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকার মোট আয়তনের ৮২ শতাংশ এখন কংক্রিটের ভবন আর পিচঢালা সড়কে ভরা। আর বিশ্বের বেশির ভাগ বড় শহরের তুলনায় এটা প্রায় দ্বিগুণ।
বলা যায়, শিল্পকারখানার বর্জ্য বা উপজাতসহ বিভিন্ন কারণে বড় শহরগুলোতে এ সমস্যা প্রকট। নদী হলো প্রকৃতির অন্যতম দান। নদীর প্রবাহ না থাকলে প্রকৃতিও বিরূপ হয়। পৃথিবীর বড় বড় শহর নদীর তীরেই অবস্থিত। নদীকে কেন্দ্র করেই শহরের উন্নতির গ্রাফ ওঠানামা করে। অথচ দেশের নদীগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। সারা দেশে প্রায় ২০০০টি শিল্পকারখানা আছে। অর্ধেকের বেশি ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন করেনি বা সবসময় চালু রাখে না বলে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। শিল্পবর্জ্যরে বড় শিকার হচ্ছে রাজধানী বা শিল্প এলাকার নদীগুলো। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু, হালদা, কর্ণফুলী, সুরমা, রূপসা কিংবা ব্রহ্মপুত্র কোনো নদীই রেহাই পাচ্ছে না এ দূষণের হাত থেকে। শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশে দূষণের ভয়াবহতাও বাড়ছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাত হচ্ছে বস্ত্র ও পোশাক খাত। পোশাক কারখানা বা এর সংশ্লিষ্ট কারখানাতেই দূষণ বেশি। সম্ভাবনাময় খাত হচ্ছে চামড়াশিল্প খাত। এখানেও দূষণের মাত্রা বেশি।
যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করে এবং পরিকল্পিত সবুজায়ন করে ঢাকাকে বাসযোগ্য করা যায়। ঢাকা শহরের জন্য মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা দরকার। উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের সময় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তর/কর্তৃপক্ষের মধ্যে আন্তঃসমন্বয় দরকার। উন্নয়ন কার্যক্রম এবং আবাসন ব্যবস্থাপনায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আরও কঠোর হওয়া জরুরি।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
দু’সপ্তাহ আগে ৩০ ডিসেম্বর ২০২১ এসএসসি ও সমমানের ২২ লাখের অধিক শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফলাফল প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রধানমন্ত্রী সেদিন সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্স করে মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি শিক্ষাবোর্ডের প্রধানদের কাছ থেকে ফলাফল গ্রহণ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাউস ক্লিক করে প্রযুক্তির উৎকর্ষে আলোকিত ডিজিটাল ফলাফল প্রকাশ করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষা বোর্ড ওয়েবসাইট ও মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ফল জানানো হয়। কিন্তু এই ফলাফলে ৯টি পেপারে ‘এ প্লাস’ পাওয়া একজন নারী শিক্ষার্থীকে ফেল দেখিয়ে তাকে আত্মহননের পথেই ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, তার ভাগ্য ভালো শুভানুধ্যায়ীর আশ্বাস তাকে সম্ভাব্য চূড়ান্ত পরিণতি থেকে রক্ষা করেছে।
বয়স এক বছরে পৌঁছার আগেই এই মেয়েটি পিতৃহীন হয়েছে, প্রতিকূলতার মধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে চলতি বছরের সদ্য প্রকাশিত এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ইংরেজি ও কম্পিউটার বিজ্ঞানসহ ৯টি বিষয়ে ‘এ প্লাস’ পেয়েছে, সেই মেয়েটির ফলাফল ছাপা হয়েছে ঋধরষ অর্থাৎ অনুত্তীর্ণ।
পিতৃহীন এই মেয়েটি আত্মহত্যা করলে সংবাদ হয়তো খবরের কাগজেও ছাপা হতো না, যদি হতো তা হলেও আমরা ধরে নিতাম, এমন তো হয়ই ব্যর্থতা ও হতাশা থেকে আত্মহত্যা করতেই পারে। কিন্তু যখন জানবেন মেয়েটি ৯টি বিষয়ে ‘এ প্লাস’ পেয়েছে তখন কি কারও বিশ্বাস হতে চাইবে যে সে এক বিষয়ে ফেল করে গোটা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে? যে বিষয়ে তাকে ফেল দেখানো হয়েছে তার নাম ‘বিল্ডিং মেইনটেন্যান্স’ প্রথমপত্র। একই বিষয়ের দ্বিতীয়পত্রে সে পেয়েছে ‘এ প্লাস’।
একজন অভিভাবকের হস্তক্ষেপ এই মেয়েটিকে অনাকাক্সিক্ষত সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত রেখেছে এবং সম্ভবত সরকারকেও অপর একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচিয়েছে। সরকার ঘোষিত ওয়েবসাইটটিতে প্রাপ্ত এসএসসি, দাখিল ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলটির ছায়ালিপিও মুদ্রিত হলো। মেয়েটির নাম ঝঐঅঐঊইঅ অকঞঊজ তার রোল নম্বর ৩১৫৩২৯; রেজিস্ট্রেশন নম্বর ২৭০০২২৭০৮২ তার প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলাদেশ নারী শিক্ষা টেকনিক্যাল কলেজ। যে বিষয়ের প্রথমপত্রে তাকে ‘ফেল’ দেখানো হয়েছে পরীক্ষার্থী মেয়েটির ভাষ্য এটি দ্বিতীয়পত্রের চেয়েও ভালো দিয়েছে। অথচ দ্বিতীয়পত্রে সে পেয়েছে ‘এ প্লাস’।
বরিশাল উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১৭ বছর বয়সী বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী সর্বোজিত ঘোষের আত্মহননের বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিস্মৃত হয়ে থাকতে পারে, কারণ সর্বোজিত ঘোষ তাদের কাছে একটি সংখ্যা মাত্র, সর্বোজিতের জন্য এটা তার জীবন, সর্বোজিতের হতভাগ্য পরিবারের কাছে এই ছেলেটিই তাদের সর্বস্ব। পরীক্ষার ফলাফলে তাকে এক বিষয়ে ফেল দেখানো হয়। আরোপিত এই ব্যর্থতার খবর জেনে সর্বোজিত ঘোষ সেদিনই তার বাড়ির কাছাকাছি নির্মাণাধীন একটি বহুতল ভবনের ছাদ থেকে আত্মহননের জন্য লাফিয়ে পড়ে। মৃতপ্রায় সর্বোজিতকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে আনা হলে কিছুক্ষণ পরই চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কান্নায় ভেঙে পড়া তার বাবা জানান, পরীক্ষায় ফেল করেছে জানতে পেরে তার ছেলে এভাবে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। বাবা শেখর ঘোষ ও মা শিলা ঘোষের আহাজারিতে বরিশালের গোটা কাঠপট্টি সড়ক তখন শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। কিন্তু পুনঃনিরীক্ষণের পর সংশোধিত ফলাফলে দেখা যায় সর্বোজিত ঘোষ কোনো বিষয়েই ফেল করেনি, সে জিপিএ ৪.৬৭ পেয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। সর্বোজিতের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর দায় কি তার নিজের? না তার মা-বাবার? নাকি রাষ্ট্রের? এটি কি দায়িত্বহীন কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও উপেক্ষাজনিত আরোপিত হত্যাকা- নয়? এই আত্মহননের অবহেলাজনিত প্ররোচনার (দ-বিধিতে এটি কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ) জন্য কেউ কি শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছেন?
লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা ৩০ ডিসেম্বরের ফলাফল ঘোষণার আগে প্রথম আলো পত্রিকায় কর্তৃপক্ষকে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু প্ররোচিত না করতে সতর্ক করে দিয়েছিলেন : ফলাফল প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই শোনা যাবে আত্মহননের সংবাদ। ‘গত তিন বছরে এসএসসি পরীক্ষার পর ১৫০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে, আর ৩ হাজার ৭৫০ জনের কিছু বেশি আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এর মধ্যে ৪০০ জন আবার দ্বিতীয়বার চেষ্টা করেছিল।’ তিনি আত্মহত্যা প্রবণতার কথা লিখেছেন : ‘অনেক সংবেদনশীল অভিভাবক, শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে তারাও বেশ চিন্তিত, উদ্বিগ্ন। আত্মহত্যা ঘটে যাওয়ার পর অনেক কথা হয়, কিন্তু আগে বিষয়টি আঁচ করে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা কেউ ভাবে না। মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, যদি পরীক্ষার্থীর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আগে থেকেই অনুভব করতে পারে যে কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আছে, তাহলে তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য আন্তরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর চেষ্টা করে জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে।’ কোনো সন্দেহ নেই এটি ভালো প্রেসক্রিপশন, কিন্তু সর্বোজিতের মতো শিক্ষার্থী তো আত্মহনন-প্রবণ নয়, তাকে কে মৃত্যুমুখী করল?
ফলাফলে ভ্রান্তি কেবল তারই নয়, তার মতো একই বিষয়ে ফেল করাদের মধ্য থেকে পাস করেছে ১ হাজার ১৪১ জন, ফেল করাদের মধ্য থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭৯ জন। ৯ বিষয়ে এ প্লাস পাওয়া রোল নম্বর ৩১৫৩২৯-কে কে ফেল করাল? সে যদি সর্বোজিতের পথ ধরত! হয়তো শোনা যাবে তাকে ফেল করিয়েছে কম্পিউটার।
বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের ফল বিভ্রাট বরগুনা সরকারি কলেজের এক মেধাবী ছাত্রী তাহিরার শিক্ষাজীবন অন্ধকার করে দিয়েছে, হরণ করে নিয়েছে একটি বছর। পরীক্ষার ঘোষিত ফলাফলে তাহিরা খানম জীববিজ্ঞান, রসায়ন ও উচ্চতর গণিতে অকৃতকার্য হয়েছে। এক বিষয়ে ফেল করলেও উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করতেন তার স্বজনরা। কিন্তু তিন বিষয়ে ফেল দেখে তারা পরীক্ষার খাতা পুনরায় মূল্যায়নে আগ্রহ দেখাননি। পরের বছর অর্থৎ ২০২০ সালের জন্য ফরম পূরণ করতে গিয়ে তাহিরা জানতে পারে সে কোনো বিষয়েই
অকৃতকার্য হয়নি, জিপিএ ৩.৮৩ পেয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। সদ্য বিবাহিত তাহিরা প্রকাশিত ফলের কারণে শ্বশুরবাড়িসহ সর্বত্র হেয়প্রতিপন্ন হয়েছে। স্থানীয় পত্রিকা থেকে জানা যায় তাহিরার ভাই শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে তার বোনের ফল পুনরায় পরীক্ষা করার অনুরোধ করলে চেয়ারম্যান নিজের মুঠোফোনে সার্চ করে জানিয়ে দিয়েছেন তাহিরা
অকৃতকার্য হয়েছে। অনুমান করি এই লেখাটি যদি শিক্ষামন্ত্রীর (তিনিও নারী) গোচরীভূত হয়, পিতৃহীন একটি মেয়ের কথা তিনি ভাববেন এবং তার মন্ত্রণালয়ের দায় কেবল কম্পিউটারের ওপর না চাপিয়ে প্রকৃত সমস্যাটি উদঘাটন করবেন এবং আগামী দিনের অসহায় ছাত্রী (এবং ছাত্ররাও) যাদের ৯ বিষয়ে এ প্লাস পাওয়ার পরও ফেল না করে সেদিকটাতে মনোযোগী হবেন।
এই মেয়েটির রেজাল্টও কোনো কর্মকর্তা, তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, সচিব, মন্ত্রী কেউই একনজর দেখার তাগিদ বোধ করেননি। একবারও যদি কেউ চোখ বুলাতেন তাদের মনেই প্রশ্ন জাগত এটা কেমন করে সম্ভব? এ ধরনের একটি রেজাল্টশিট কি শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কারও মনে কোনো প্রশ্ন জাগাত তাদের হাতে অকৃতকার্য এই ছাত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। এই ফলাফলটির যথার্থতা নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন না করেন, যদি কোনো ছাত্র বা ছাত্রীর এ নিয়ে প্রশ্ন করার কিংবা পুনঃনিরীক্ষণ করানো ফি জমা দিয়ে কর্তাব্যক্তিদের পেছনে ঘোরার সামর্থ্য না থাকে তাহলে এখানেই কি ঘটবে তার শিক্ষাজীবন ও নিজের জীবনের চূড়ান্ত পরিণতি? এই ছাত্রী জীবনহরণ ভাবনা থেকে ফিরে এসেছে পুনঃপরীক্ষণ পুনঃনিরীক্ষণের ফি জমা দিয়ে আবেদনও করেছে, তারও দু’সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে।
জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ‘পরীক্ষার খাতা দেখায় নৈরাজ্য’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বহু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার উল্লেখ করে এটাও বলা হয়, ফল বিপর্যয়ের শিকার হয়ে অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে, এমনকি আত্মহত্যাও করছে। কিন্তু যাদের কারণে এই বিপর্যয়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে মনজিল মোরসেদ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। আইনজীবী আদালতকে বলেন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর পুনর্মূল্যায়নে শত শত পরীক্ষার্থী বেশি নম্বর পাচ্ছে। এদিকে অকৃতকার্য হওয়ার কারণে অনেকে আত্মহত্যা করছে। হাইকোর্ট রুল জারি করে। রুলে এসএসসি ও এইচএসসির খাতা মূল্যায়নে দক্ষ শিক্ষক কেন নিয়োগ করা হবে না জানতে চাওয়া হয়। পরীক্ষার খাতা পুনঃনিরীক্ষা নামেও প্রতারিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরাএমন বিস্তারিত প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।
আদালতের নির্দেশের ফলাফল কী তা জানার জন্য সর্বোজিত কিংবা ৯ বিষয়ে এ প্লাস পাওয়া রোল নম্বর ৩১৫৩২৯-এর রেজাল্টশিট দেখাই যথেষ্ট, আদালতের নির্দেশ নিভৃতে কেঁদেছে।
বহু পণ্যের গায়ে লেখা থাকে ‘এতে ক্ষতিকারক ডিডিটি নেই’। ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে আমরা আশ্বস্ত হই। হয়তো আমাদের বহুজনের কাছেই ডিডিটির বিষয়টি স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে মশার স্প্রে, শুঁটকি মাছ বা কৃষিফসলে ডিডিটির ব্যবহারের কথা আমরা কমবেশি জানি। ‘ডাই ক্লোরো ডাই ফিনাইল ট্রাই ক্লোরো ইথেন’ বা ‘ডিডিটি’ হলো বিশ্বব্যাপী রাসায়নিক দূষণের জন্য দায়ী বিপজ্জনক রাসায়নিক।
কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার রাসায়নীকরণের বিরুদ্ধে একটা প্রবল জনভিত্তি বিস্তার লাভ করছে বিশ্বময়। দীর্ঘ করোনা মহামারী, যুদ্ধ ও বৈশ্বিক সংকট সবকিছু ছাপিয়ে রাসায়নিক কৃষিনির্ভর বাংলাদেশ এক বিরল উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। দীর্ঘ চার দশক পর বাংলাদেশ ডিডিটিমুক্ত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বের বৃহত্তম ডিডিটির মজুদটি ছিল বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। প্রায় চার দশক পর নিষিদ্ধ ঘোষিত এই মারাত্মক রাসায়নিক বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো। ২০২২ সালের ২ ডিসেম্বর ডিডিটির শেষ চালানটি ধ্বংস করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে ফ্রান্সে যায়। ডিডিটি অপসারণের কাজটি কোনোভাবেই সহজ ছিল না। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত সতর্কতা, নীতিগত প্রশ্ন, অর্থায়ন এবং সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক অঙ্গীকারÑসবকিছু এক কাতারে আসতে প্রায় চারটি দশক লেগেছে। জীবন ও প্রতিবেশের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই ডিডিটি অপসারণ ব্যবস্থাপনার নেতৃত্ব দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটির (জিইএফ) অর্থায়নে, বাংলাদেশ সরকার এবং এফএও এর সহ-অর্থায়নে ‘পেস্টিসাইড রিস্ক রিডাকশন ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় ডিডিটি অপসারণ ও নিষ্ক্রিয়করণের কাজটি সম্পন্ন হয়েছে।
গণমাধ্যম সূত্র জানায়, ডিডিটি পাউডার নিষ্ক্রিয়করণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৫৫ কোটি টাকা। ৩৫৫ কোটি টাকার এই প্রকল্পে সরকারের নিজের খরচ ২১৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। বাকি ৭০ কোটি ১০ লাখ গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটিজ এবং ৬৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ম্যালেরিয়া নির্মূলে ৫০০ টন ডিডিটি আমদানি করে এবং এর আগের আরও ৫০০ টনসহ এক হাজার টন ডিডিটি দীর্ঘ ৩৭ বছর চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের গোডাউনে পড়েছিল। ডিডিটি অপসারণ প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয় গ্রিসের একটি প্রতিষ্ঠান। বিশেষ পোশাক ও সতর্কতা অবলম্বন করে এসব রাসায়নিক কনটেইনারে ভরা হয় এবং পরিবহন করা হয়। অপসারণের সময় সমগ্র এলাকাকে রেড জোন বা বিপজ্জনক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। অপসারণ প্রক্রিয়ার পরিচালক গণমাধ্যমকে জানান, বিশেষ জাহাজের মাধ্যমে এই রাসায়নিক সমুদ্রপথে ১২টি বন্দর হয়ে ফ্রান্সে যাবে এবং সেখানে আন্তর্জাতিক আইন ও নীতি মেনে বিশেষ চুল্লিতে এসব নিষ্ক্রিয় করা হবে। বেশ কয়েক মাসের এ দীর্ঘ প্রক্রিয়ার সর্বত্র ঝুঁকি ও বিপদ রয়েছে। তারপরও বিশ্ব থেকে বিপজ্জনক ডিডিটির সবচেয়ে বড় মজুদটি অপসারণ করা গেছে।
বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের জন্য এটি একটি গুরুত্ববহ ঘটনা। অবিস্মরণীয় এই জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজটির সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। তবে ডিডিটি অপসারণের এই উদাহরণ বাংলাদেশকে আরও বেশি দায়িত্বশীল এবং দায়বদ্ধ করে তুলল। বিশেষত কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থায় রাসায়নিকের ব্যবহার এবং নিষিদ্ধকরণ বিষয়ে রাষ্ট্রকে এখন থেকেই আরও বেশি সতর্ক ও মনোযোগী হওয়ার বার্তা জানান দিল। ভাবলেই কেমন শিউরে ওঠে চারধার, দীর্ঘ ৩৭ বছর এক হাজার টন ডিডিটির সঙ্গে বসবাস করেছি আমরা। এমনকি এই মজুদ ছিল দেশের উপকূলের এক দুর্যোগপীড়িত ঘনবসতিপূর্ণ শিল্পাঞ্চল চট্টগ্রামে। ১৯৯১ সালের বন্যায় প্লাবিত হয় চট্টগ্রাম এবং বন্যার পানিতে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে ডিডিটি বিষ। এ ছাড়া কৃষিতে ব্যবহৃত ডিডিটির কারণে আমাদের বাস্তুতন্ত্র ও শরীরে মিশেছে এই ভয়াবহ বিষ। বাংলাদেশের মতো একটা ছোট্ট আয়তনের দেশে ৩৭ বছর ধরে এক হাজার টন ডিডিটি নিরাপদে মজুদ রাখা সবদিক থেকেই এক জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়।
ডিডিটি, অলড্রিন, ডাইএলড্রিন, ক্লোরডেন, এনড্রিন, হেপ্টাক্লোর, মিরেক্স, টক্সাফিন, পিসিবি, হেক্সাক্লোরোবেনজিন, ডাইঅক্সিন ও ফিউরান পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী এই ১২টি মারাত্মক বিষাক্ত রাসায়নিককে একত্রে ‘ডার্টি ডজন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ডার্টি ডজন সরাসরি মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতির জীবন ও জন্মপ্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব তৈরি করে, ক্যানসার, ত্রুটিপূর্ণ জন্ম থেকে শুরু করে নানান দুরারোগ্য মরণব্যাধি ও প্রতিবেশগত বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। মাছসহ জলজ প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাবের কারণে ১৯৬২ সালে এনড্রিন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ডিডিটির ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে ডিডিটি ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ২০০০ সালে জোহানেসবার্গে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১২২টি দেশ ডার্টি ডজনের ব্যবহার সীমিত করতে বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০১ সালে স্টকহোম সম্মেলনে ডিডিটিসহ ক্ষতিকারক জৈব দূষণকারী কীটনাশকের উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধকরণে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি গৃহীত হয়। ১৭১টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও ২০০১ সালের ২৩ মে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং এটি কার্যকর হয় ২০০৭ সালের ১২ মার্চ। চুক্তির ১৫ বছর পর বাংলাদেশ থেকে ডিডিটি অপসারণ প্রক্রিয়া শুরু হয়।
১৮৭৪ সালে ডিডিটি আবিষ্কৃত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তা ম্যালেরিয়া ও টাইফাস নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়। ১৯৩৯ সাল থেকে কীটনাশক হিসেবে এর ব্যবহার শুরু হয়। আর তখন থেকে ডিডিটির বহুল উৎপাদন ও বিশ্বব্যাপী ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত প্রতি বছর কৃষিক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০,০০০ টন ডিডিটি ব্যবহৃত হতো। কীটনাশক হিসেবে ডিডিটি আবিষ্কারের জন্য ১৯৪৮ সালে চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান পল হারম্যান মুলার। মার্কিন মনস্যান্টো, সিবা, মনট্রোজ কেমিক্যাল কোম্পানি, পেন্নাওয়াল্ট, ভেলসিকল কোম্পানিগুলো মূলত বৃহৎ ডিডিটি উৎপাদনকারী কোম্পানি। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০০৯ সালে ভারত ৩,৩১৪ টন ডিডিটি উৎপাদন করে এবং ২০০৭ সালে চীনে ডিডিটি উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা আনা হয়।
বাংলাদেশে ১৯৫৬ সাল থেকে কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়। তখন প্রতি বছর ৩ টন কীটনাশক এবং ৫০০ ¯েপ্র ব্যবহার করা হতো। প্রথমদিকে যখন কীটনাশকের ব্যবহার কৃষকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো তখন প্রথমত অধিকাংশ কৃষক বিশ্বাসই করতে পারল না উদ্ভিদের রোগবালাই দমনের জন্য বিষ ব্যবহার করা যায়। ক্রমান্বয়ে কৃষির ওপর চেপে বসা এই বিষ মানুষের প্রাণও সংহার করতে থাকল। কৃষিতে বিষের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু আত্মহত্যাই বাড়ল না, বরং এটি আরও নানা ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধি তৈরি করে প্রতিনিয়ত মানুষকে আরও বেশি সংকটাপন্ন করে তুলতে লাগল। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি হেক্টরে ৮৮২ টাকার কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে। যেখানে মাত্র ৯৮ টাকার কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত। বাংলাদেশের মাটিতে হিউমাসের সঙ্গে মিশে গেছে ১২.৫ শতাংশ ডিডিটি, যা ব্রিটেনের তুলনায় পাঁচ গুণ। এই সর্বনাশা বিষের ফলে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে জলাশয়সহ স্থানীয় অগণিত প্রাণবৈচিত্র্য আর মানুষের নানান রোগবালাই বাড়ছে। এই সর্বনাশা বিষের ব্যবহার ১ শতাংশ বাড়ার সঙ্গে কৃষকের চিকিৎসাব্যয় বেড়ে যাচ্ছে দশমিক ৭৪ শতাংশ। বাংলাদেশে বর্তমানে ৯২টি রাসায়নিক গ্রুপের প্রায় ৩৭৭টি বালাইনাশক বাজারজাতকরণের জন্য নিবন্ধনকৃত। প্রায় সব কীটনাশকের প্রয়োগের পর অপেক্ষাকাল তিন দিন থেকে ২১ দিন, কিন্তু বাস্তবতা হলো সকালে কীটনাশক স্প্রে করে বিকেলে বা বিকেলে স্প্রে করে পরদিন জমিন থেকে ফসল তুলে বাজারে বিক্রি করা হয়। বিশেষ করে শসা, টমেটো, ক্ষীরা বা অন্যান্য ফল, যা আমরা সাধারণত কাঁচা খেয়ে থাকি সেসব গ্রহণের মাধ্যমে সেসব ফসলে ব্যবহৃত কীটনাশক সরাসরি আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। কৃষিজমিতে ব্যবহৃত কীটনাশকের প্রায় ২৫ ভাগ আশপাশের জলাশয়ের পানিতে মিশে যায়।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়েই এক ডিডিটিমুক্ত বাংলাদেশে আমরা আজ নতুন প্রজন্মকে স্বাগত জানাতে পারছি। তবে ডিডিটি অপসারণের এই জটিল প্রক্রিয়া আমাদের আরও কী বার্তা দেয়? কেন বা কাদের কথায় আমরা এমন বিপজ্জনক রাসায়নিক আমদানি ও ব্যবহার করলাম? তথাকথিত সবুজবিপ্লব প্রকল্পের মাধ্যমে ডিডিটির মতো এমন বহু বিপদ আমাদের কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থায় শুধু মুনাফার জন্য তৈরি হয়েছে। কোম্পানিগুলো মুনাফার পাহাড় চাঙা করার পর যখন জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশে এসব চাপিয়ে দেওয়া বাণিজ্য কারবারগুলো চরম ক্ষতি তৈরি করছে, তখন সেসব বন্ধ করতে আমাদের দীর্ঘ সময় লড়াই করতে হচ্ছে। শুধু ডিডিটি নয়, আমাদের কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থা এখনো দখল করে আছে বহুজাতিক কোম্পানি ও এজেন্সির নানামুখী ব্যবস্থাপত্র। মাটি থেকে শুরু করে মায়ের দুধ সর্বত্র মিশে যাচ্ছে বিষ আর প্লাস্টিক কণা। এক ডিডিটি নিষিদ্ধ ও অপসারণে আমরা বহু বছর ও বিপুল বাজেট ব্যয় করেছি। জনগণের টাকায় বিষ কিনে সেই বিষে জনগণের সর্বনাশ করে আবার সেই বিষ তাড়াতে আবারও জনগণের টাকাই গেল। তাহলে আমরা কেন এমন বিষের ব্যবহার শুরু করলাম এই প্রশ্নটি তোলা জরুরি। বিশেষ করে নিরাপদ কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার প্রসঙ্গ যখন আমরা আলাপে তুলেছি বিশ্বময়।
এখনো সময় আছে শুধু ডিডিটি নয়; সব রাসায়নিকের বন্দিদশা থেকেই আমাদের উৎপাদনব্যবস্থাকে মুক্ত করা জরুরি। আর ডিডিটি অপসারণের মতো রাষ্ট্র যেভাবে নীতিগত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার করেছে সে রকম সব বিপজ্জনক রাসায়নিক বিষের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সমমনোযোগী হতে হবে। আমরা আশা করব রাষ্ট্র বিপজ্জনক রাসায়নিকমুক্ত কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে তৎপর ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার জোরালো করবে। শুধু ডিডিটিমুক্ত নয়, ক্ষতিকর রাসায়নিকমুক্ত এক নিরাপদ কৃষিভুবনে আমরা সবাইকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষা করছি।
লেখক: লেখক ও গবেষক
কেউ বলছেন- ‘জয় শাহরুখ’, আবার সিনেমা হলেই কেউ চিৎকার করে বলছেন- ‘হিন্দুস্তান কি শান, শাহরুখ খান’। চার বছর ধরে অপেক্ষার পর নতুন সূর্যোদয় শাহরুখের ক্যারিয়ারে। ‘পাঠান’-এর বক্স অফিস রিপোর্ট দেখে নিঃসন্দেহে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন শাহরুখ খান। গতকাল (বুধবার) বিশ্বের প্রায় ৮০০০ স্ক্রিনে মুক্তি পেয়েছে যশ রাজ ফিল্মসের ‘পাঠান’। প্রথম দিন একাধিক রেকর্ড গুঁড়িয়ে দিল পরিচালক সিদ্ধার্থ আনন্দের এই ছবি। প্রথম দিন কেবলমাত্র ভারতের বক্স অফিসেই ৫৩ কোটি টাকা কামাই করেছে এই ছবি।
হিন্দি, তামিল ও তেলুগু সংস্করণ মিলিয়ে মোট ৫৩ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে শাহরুখ খানের ছবি। এর সুবাদেই আমির খানের ‘ঠগস অফ হিন্দুস্তান’-এর রেকর্ড ভেঙে দিল বাদশার ছবি। প্রথম দিনের আয়ের নিরিখে বলিউডি ছবির মধ্যে এতদিন এক নম্বরে ছিল ‘ঠগস অফ হিন্দুস্তান’ (৫০ কোটি), এবার সেই রেকর্ড গেল ‘পাঠান’-এর ঝুলিতে।
শুধু ভারতের বক্স অফিসেই নয়, বিদেশের বক্স অফিসেও শাহরুখ খানের ধুম! ট্রেড অ্যানালিস্ট রমেশ বালা জানিয়েছেন প্রথম দিনই বিশ্বব্যাপী বক্স অফিসে ১০০ কোটির বেশি গ্রস কালেকশন করেছে ‘পাঠান’। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুরে পুরোনো সব বলিউডি ছবির রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন কিং খান। প্রথমদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১ মিলিয়ন ডলার কামিয়েছে এই ছবি।
বক্স অফিস বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেছিলেন পাঠান-এর প্রথম দিনের কালেকশন থাকবে ৩৫-৪০ কোটির আশেপাশে। তাদের ধারণাতীত পারফর্ম করে চমকে দিলেন শাহরুখ-দীপিকারা।
ফিল্ম এক্সবিটর অক্ষয় রাঠি জানিয়েছেন, ‘পাঠান কেবলমাত্র ইন্ডিয়াতেই প্রথম দিন ৫৩ কোটির ব্যবসা করেছে। ছবির প্রথম শো শেষ হওয়ার আগে থেকে আশ্চর্যজনকভাবে ছবির অ্যাডভ্যান্স বুকিং-এর মাত্রা দেশজুড়ে বেড়েছে। এটা একটা ঐতিহাসিক কামব্যাক, এই প্রত্যাবর্তনটা শুধু শাহরুখের নয়, সার্বিকভাবে হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির।’
শুধু ঠগস অফ হিন্দুস্তানই নয়, হৃতিকের ‘ওয়ার’-এর প্রথম দিনের আয়ের রেকর্ডও ভেঙে দিয়েছে ‘পাঠান’। কেবলমাত্র কেজিএফ টু-র হিন্দি ভার্সনের কালেকশনকে অল্পের জন্য পার করতে পারেননি শাহরুখ।
ছবির স্ক্রিনিং শুরুর পর টিকিটের চাহিদা দেখে আরও ৩০০টি অতিরিক্ত শো যোগ করা হয় প্রথম দিন। শাহরুখ ভক্তদের চাপে মধ্যরাতের পরেও থিয়েটারে ‘পাঠান’-এর শো চলছে।
একের পর এক ফ্লপের ভারে জর্জরিত শাহরুখ খান ‘জিরো’র (ডিসেম্বর, ২০১৮) পর লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের দুনিয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। দীর্ঘ তিন বছর পর ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে ‘পাঠান’-এর শ্যুটিং শুরু করেন শাহরুখ। ছবির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করতে আরও লম্বা সময় লাগিয়েছেন কিং খান। শাহরুখের রাজকীয় প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় ছিল ভক্তরা, সমালোচকরা আগেই বলেছিলেন ‘পাঠান’ শাহরুখের ক্যারিয়ারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছবি হতে চলেছে, প্রত্যাশার পারদ শুরু থেকেই চড়ছিল এই ছবিকে ঘিরে। সেই প্রত্যাশা পূরণে পুরোপুরি সফল শাহরুখ, এমনটা বলাই যায়।
সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস
গত ১০ বছরে দেশে জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে চারগুণের বেশি। বিপরীতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ব্যয় কমে অর্ধেকে নামলেও এ খাতের অগ্রগতি খুবই হতাশাজনক। বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজির দাম দেশীয় গ্যাসের চেয়ে অন্তত পাঁচ-সাতগুণ বেশি হলেও আমদানির তৎপরতা যে হারে বেড়েছে, সে হারে বাড়েনি দেশীয় জ্বালানির অনুসন্ধান কার্যক্রম।
গত ১৩ বছরে বিদ্যুতের দাম ১১ আর গ্যাসের দাম বেড়েছে ৬ বার। ধারাবাহিকভাবে দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে এ খাত মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ থাকলেও সরকার সেদিকে যাচ্ছে না। বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। পাশাপাশি দেশের জ্বালানি সম্পদের উন্নয়ন না করে এলএনজি আমদানি করছে। ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়ার সঙ্গে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। এর পরিণতি ভয়াবহ।’
তিনি বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি সমন্বয় করতে চাইছে সরকার। কিন্তু এ জন্য ৩০-৪০ হাজার কোটি টাকা দরকার। এ টাকা সমন্বয় করে গ্যাস-বিদ্যুতের যে দাম হবে তা সোনার চেয়েও দামি হবে।’ তার মতে, গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার কারণেই লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বাড়ছে। আর এটি চাপানো হচ্ছে ভোক্তার ওপর। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে এখন বিদ্যুতের দাম আবার বাড়ানো হচ্ছে। অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয় সমন্বয় না করে মূল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে। এর চেয়ে অন্যায় আর কিছু হতে পারে না।
সূত্রমতে, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ২ টাকা ৬১ পয়সা। এখন তা বেড়ে ১০ টাকা ছাড়িয়েছে। গত ১৮ জানুয়ারি বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম সর্বোচ্চ ১৭৯ শতাংশ বাড়ানোর ফলে ব্যয় আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ডিজেলে চালিত বিদ্যুকেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গড়ে ৪৩.৪২, ফার্নেস অয়েল থেকে ১৫.৫১, কয়লা থেকে ১২.৭৭, নবায়নযোগ্য জ্বালানি (সৌরবিদ্যুৎ) থেকে ১২.৬৪, গ্যাসে চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৩.৪৬, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২.৬৭ এবং আমদানি করা বিদ্যুতের জন্য ৫.৯৫ টাকা ব্যয় হয়েছে।
বর্তমানে দেশে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ছে ১৭.৬২ সেন্ট থেকে ২২.৭১ সেন্ট। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দামে অর্থাৎ ২২.৭১ সেন্ট দরে ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে যাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে নির্মিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে ১৮.৮৯ সেন্ট। বরিশাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম ১৭ দশমিক ৬২ সেন্ট এবং পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে ১৭.২০ সেন্ট।
পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়ার আগে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় গড়ে ২ টাকা বেড়ে প্রায় ১২ টাকায় দাঁড়াবে। তবে খোলাবাজার থেকে আমদানি করে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ালে এ ব্যয় আরও বাড়তে পারে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ১০ টাকার কাছাকাছি। তবে সৌরবিদ্যুতের যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক কমালে দাম আরও কমবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যতটুকু উৎপাদন ততটুকু বিল এ শর্তে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চুক্তি হওয়ায় শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেই তারা বিদ্যুৎ পাবে। কিন্তু তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও ‘ক্যাপাসিটি পেমেন্ট’ হিসেবে অর্থ পরিশোধ করতে হয় সরকারকে। সৌরবিদ্যুতে কোনো জ্বালানি লাগে না। অর্থাৎ জ্বালানি আমদানির জন্য ডলার প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতের দাম ক্রমে বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানদ-ে একটা দেশে চাহিদার তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি সক্ষমতা থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে প্রায় ৪০ শতাংশ বাড়তি সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। ভুল পরিকল্পনার কারণে প্রয়োজন ছাড়াই একের পর এক বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অতিরিক্ত সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া বা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বাবদ সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা গুনতে হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারকে কেন্দ্র ভাড়া দিতে হয়েছে ১৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি।
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলার পাশাপাশি বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য জ¦ালানিতে গুরুত্ব দিচ্ছে বিভিন্ন দেশ। উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও নবায়নযোগ্য জ¦ালানির ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশ সরকারও বিভিন্ন সময়ে নানা পরিকল্পনার কথা বললেও তার অগ্রগতি খুব সামান্য।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায় বলা হয়েছে, নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ৮৯ শতাংশ কমেছে। এ উৎস থেকে ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম বাংলাদেশ।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে তারা কাজ করছেন। সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যে অগ্রগতি, তাতে এ লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছে পৌঁছানো নিয়ে সংশয় রয়েছে বিশেষজ্ঞদের।
২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪৯৪২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো ২৩০ মেগাওয়াট। সে হিসাবে মোট বিদ্যুতের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিমাণ ছিল ৪.৬ শতাংশ। বর্তমানে দেশে গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসেবে গ্রিডভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ থেকে মাত্র ২৫৯ মেগাওয়াট এবং জলবিদ্যুৎ (২০০৯-এর আগে স্থাপিত) থেকে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। শতকরা হিসাবে এর পরিমাণ ২ শতাংশ। এর বাইরে অফগ্রিড সৌরবিদ্যুতের পরিমাণ ৪১৮ মেগাওয়াট। যদিও অফগ্রিড সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থার ৭০-৮০ শতাংশ অকেজো হয়ে রয়েছে বলে বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সাইফুল হক বলেন, ‘গত ১০ বছরে দেশে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। কিন্তু দেশে সৌরবিদ্যুতের আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। এ খাতে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার। তাহলে বিদ্যুৎ জ্বালানি সংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে।’
গত ১৩ বছরে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে ৪.৭৫ গুণ। এ সময়ে ১৮৫৪০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ গ্রিডে যোগ হয়েছে। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎ এসেছে মাত্র ২৩০ মেগাওয়াট।
জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতা বাড়ায় ব্যয় বাড়ছে। ২০০৯ সালে দেশে দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানি করা গ্যাসসহ মোট উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৩৭৬০ মিলিয়ন ঘনফুটে। কিন্তু গড়ে প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে ২৬০০-২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
জ্বালানি বিভাগের তথ্যমতে, গত ১৩ বছরে পাঁচটি নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার এবং কিছু কূপ সংস্কারের মাধ্যমে দেশীয় উৎস থেকে ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় দৈনিক ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করছে সরকার। পাশাপাশি সরকার খোলাবাজার থেকে বেশি দামের এলএনজি আমদানি করছে।
দেশে এলএনজি সরবরাহে দৈনিক ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের সরবরাহ ক্ষমতা এরই মধ্যে নেমে গেছে ৫০ শতাংশের নিচে। তবু আরও দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে চুক্তি করতে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা। যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি এবং বাংলাদেশের সামিট গ্রুপ এ টার্মিনাল নির্মাণে আগ্রহ দেখিয়েছে।
সূত্রমতে, দেশীয় কোম্পানির উৎপাদিত গ্যাসের খরচ প্রতি ইউনিটে ১ টাকা ২৭ পয়সা। আর দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে উৎপাদিত গ্যাসের খরচ ২ টাকা ৯১ পয়সা। আমদানি করা গ্যাসের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটে খরচ প্রায় ৫০ টাকা। বিশ্ববাজারের দামের সঙ্গে এ দাম কমবেশি হয়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম মনে করেন, আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ার কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ব্যয় বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘স্থলভাগে এখনো যে গ্যাস রয়েছে, তার একটি অংশ আমরা আবিষ্কার করে উত্তোলন করছি। বড় অংশের সন্ধান এখনো আমরা করিনি। আরও বেশি অনুসন্ধান করা দরকার। নিজেদের গ্যাস পেলে জ্বালানির দাম এভাবে বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না।’ বিদেশি কোম্পানি ও এলএনজি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে সরকার স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানে গুরুত্ব দিচ্ছে না বলে তিনি অভিযোগ করেন।
'বাদশা ইজ় ব্যাক'। বুধবার সারাদিন এমন কথাই বার বার শোনা গেল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকে বড় পর্দায় দেখেছেন আপামর দর্শক। এক-দু'বার নয়, অনেকে দেখেছেন তিন-তিন বার! কখনো সিঙ্গল স্ক্রিনে, কখনো আবার মাল্টিপ্লেক্সে পপকর্ন খেতে খেতে। পয়সা উসুল করা হুল্লোড়ে মেতেছেন দর্শক, লাভের মুখ দেখেছেন প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষ।
শাহরুখ খানের 'পাঠান'-এর প্রথম দিনের ব্যবসার ছবিটা স্পষ্ট। ছবিমুক্তির দিনেই প্রায় ৫৫ কোটির ব্যবসা করে ফেলেছে যশরাজ ফিল্মস প্রযোজিত ছবিটি।
এখনও পর্যন্ত প্রথম দিনে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করেছিল দক্ষিণী ছবি 'কেজিএফ-চ্যাপ্টার ২'- ৫৩ কোটি ৯৫ লাখ। ছবিমুক্তির দিনে দক্ষিণী মেগা হিটের ব্যবসাকে ছাপিয়ে গেল 'পাঠান'। শোনা যাচ্ছে, বুধবার প্রায় ৫৩-৫৫ কোটির ব্যবসা করেছে ছবিটি। যা ছাড়িয়ে গিয়েছে 'ওয়ার', 'থগস অব হিন্দুস্তান', 'ভারত' ছবির প্রথম দিনের উপার্জন।
প্রতিদ্বন্দীদের পরাস্ত করেই ক্ষান্ত নন 'পাঠান'। নিজের ছবি 'হ্যাপি নিউ ইয়ার', 'চেন্নাই এক্সপ্রেস'কেও হারালেন শাহরুখ। যাদের প্রথম দিনের ব্যবসার অঙ্ক ছিল ৪৪ কোটি ৯৭ লাখ ও ৩৩ কোটি ১২ লাখ।
দীর্ঘ ৪ বছর পরে বড় পর্দায় ফিরেছেন শাহরুখ খান। বলিউডের 'বাদশা'কে নিয়ে অনুরাগীদের উন্মাদনার ঝলক দেখা গিয়েছিল ট্রেলার মুক্তির পরেই। দুবাইয়ের বুর্জ খলিফাতেও শাহরুখের উপস্থিতিতে ট্রেলার প্রদর্শনের সময় ঢল নেমেছিল ভক্তদের। বক্স অফিসে যে ভালো অঙ্কের ব্যবসা করবে 'পাঠান', তার আভাস মিলেছিল অগ্রিম টিকিট বুকিংয়েই। দর্শকের উন্মাদনা দেখে সকাল ৬টা ও ৭টাতেও শো রেখেছিল বড় বড় শহরের একাধিক প্রেক্ষাগৃহ। এমনকি, দর্শকের চাহিদার কথা মাথায় রেখে মধ্যরাতেও শো চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রযোজনা সংস্থা ওয়াইআরএফ।তবে মুক্তির প্রথম দিন সব হিসেব গুলিয়ে দিল 'পাঠান'। হিন্দি ছবির ইতিহাসে ছবিমুক্তির দিনে 'পাঠান'-এর ব্যবসাই সর্বোচ্চ। ইতিমধ্যে ব্লকবাস্টার খেতাবও পেয়েছে ছবি। আর হবে না-ই বা কেন, এ যে রাজার প্রত্যাবর্তন।
আর্তমানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সোশ্যাল সার্ভিসেস ক্লাবের উদ্যোগে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পথশিশু ও বৃদ্ধদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে।
উক্ত শীতবস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইউনিভার্সিটি অ্যাডভাইজার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আনিসুর রহমান, সোশ্যাল সার্ভিসেস ক্লাবের উপদেষ্টা এবং স্কুল অব বিজনেসের সহযোগী অধ্যাপক রফিকুল হক এবং ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন।
দুঃস্থদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রমে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির কর্মকর্তা, ক্লাব সদস্য ও ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দ্বিতীয় মেয়াদ আগামী ২৩ এপ্রিল শেষ হচ্ছে। ১০ বছর পর নতুন রাষ্ট্রপতি পাচ্ছে দেশ। যদিও ২৩ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হবে, কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী দুই মাস আগে অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
সেই হিসেবে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগে বাকি আর ২২ দিন।
এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে নানা জল্পনাকল্পনা শুরু হয়েছে কে বসছেন রাষ্ট্রপতির চেয়ারে। বেশ কয়েকজন আছেন আলোচনায়। তবে এদের মধ্যে বর্তমান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন।
বিস্তারিত পড়ুন রবিবার দেশ রূপান্তরেরর প্রথম পাতায়।
প্রণয় রায়কে কোথায় পাব? ২০০০ সালের শুরুতে এরকম একটা জিজ্ঞাসা নিয়ে আমি তখন ফোন করেছিলাম এনডিটিভিরই এক স্পোর্টস রিপোর্টারকে, যে প্রণয় রায়কে ব্যক্তিগতভাবে বহু বছর খুব ভালো চেনে, তার প্রতিষ্ঠানে বহু বছর চাকরি করেছে। মনে রাখতে হবে, এমন একটা সময় তখন, যখন সেলফোন সবে এসেছে বা আসেনি, সেই সময় কাউকে ধরার জন্য, এখন যেরকম একটা যন্ত্রই সতেরো সেকেন্ডে কাউকে ধরিয়ে দেয়, তখন তা সম্ভব ছিল না। আর প্রণয় রায়ের মতো বিখ্যাত কেউ হলে তো সেটা প্রায় অসম্ভব। আমি এনডিটিভিতে কয়েকবার ফোন করে নিষ্ফল চেষ্টার পর এই রিপোর্টারের শরণ নেই। তখন সে খোঁজটোজ নিয়ে জানাল, প্রণয় রায় এখন ট্রেনে করে দিল্লি থেকে বোম্বে যাচ্ছেন। আমি সে সময় একটা বই লিখি, যে বইটা ছিল অনেক প্রফেশনালের লেখার সংকলন। বইটার নাম ছিল সেলিব্রেটি এখন আপনিও। আমার কোথাও মনে হয়েছিল যে, এই বইটা যেহেতু টেলিভিশন দুনিয়ায় কী করে সফল হতে হবে এবং সফল হয়ে কীভাবে চলতে হবে তার ওপর একটা কম্পাইলেশন, সেখানে প্রণয় রায়ের কোনো কিছু থাকবে না এটা হতেই পারে না এবং সেই বইটাতে অনেকেই লিখেছিলেন। রাজদীপ, অর্ণব গোস্বামী, রজত শর্মা, তখন খুব বিখ্যাত আরজে রুবি ভাটিয়া, প্রিয়া টেন্ডুলকার। আমার মনে হয়েছিল যে, এই বইটার মুখবন্ধ, তারই করা উচিত, যিনি ভারতীয় টেলিভিশনের জনক এবং সেই কাজটা প্রণয় রায় ছাড়া আর কে করতে পারেন! কিন্তু আমি খুব আশ্চর্য শুনে, যে এনডিটিভির মালিক, তিনি কি না দিল্লি থেকে মুম্বাই যাচ্ছেন ট্রেনে করে! এবং শুনলাম ট্রেন থেকে তিনি মুম্বাইতে নেমে, আবার নাকি ট্রেনে উঠবেন। অর্থাৎ সারমর্ম হচ্ছে, আগামী তিন দিনের মধ্যে আমি তাকে ধরতে পারব না। আমার জন্য যেটা তখনকার মতো সবচেয়ে অবাক লেগেছিল যে, টানা তিন দিন ট্রেনে চড়ে ভারতবর্ষ ঘুরছেন, এত বড় এমন একজন মানুষ যার কাছে প্রত্যেকটা সেকেন্ড দামি। তখন আমায় ওর সহকর্মীরা বললেন যে, উনি এরকমই মাঝেমধ্যে ট্রেনে করে ভারত দেখতে বেরিয়ে পড়েন। বহুকষ্টে প্রণয় রায়কে তারপর ধরা গিয়েছিল। মুখবন্ধটা উনিই লিখেছিলেন আমার বইয়ের। কিন্তু আমার বিস্ময় এখনো কাটেনি। এরকম একজন মিডিয়া ব্যারেন কী করে তার ব্যস্ততার মধ্যে ট্রেন ট্রাভেলের মতো একটা ইচ্ছাকৃত ঝুঁকি নিতে পারেন, ঝক্কি নিতে পারেন, যেখানে তিনি সহজেই দুই ঘণ্টায় মুম্বাই থেকে দিল্লি প্লেনে পৌঁছে যেতে পারেন। প্রণয় রায় নামটার সঙ্গে প্রথম পরিচয় আর সবার মতোই অনেক দূর থেকে। ‘ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ বলে একটা অনুষ্ঠান থেকে এবং তখন দেখেই মনে হয়েছিল যে, ফেলুদার কখনো ইংলিশ ভার্সন হলে, সেখানে তার রোলটা করার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রণয় রায়। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, হাইট; ফেলুদা অবশ্য কখনো ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখেননি, কিন্তু তিনি যে বাঙালি, ইন্টেলেকচুয়াল, যে মননের সঙ্গে ফেলুদাকে দেখতে অভ্যস্ত বা বাঙালি এক করে ফেলেছে, সেই পুরো ফেলুদার ভাবধারাটাই যেন প্রণয় রায় তার মধ্যে বহন করেন। অর্থাৎ তিনি অকুতোভয়। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি শিক্ষিত এবং তিনি খুব সচল, খুব অ্যালার্ট। ওয়ার্ল্ড দিস উইক-এ তাকে দেখে যেরকম সারা ভারতবর্ষ মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তারপর আমরা তাকে দেখলাম ইলেকশন অ্যানালাইসিস করতে এবং তখনই একটা নতুন টার্মের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটল। যার নাম হচ্ছে সেফোলজিস্টস অর্থাৎ যিনি ইলেকশন ট্রেন্ডস এবং স্ট্যাটিসটিকস বিশ্লেষণ করেন। ভারতবর্ষে তার আগে, প্রাক-প্রণয় রায় যুগে যেমন পেশাদার টেলিভিশন ছিল না, তেমনি সেফোলজিস্ট শব্দটাও শোনা যায়নি। যাই হোক, প্রণয় রায় তারপর আমাদের সঙ্গে, নির্বাচনের আগে প্রাক-নির্বাচনী সিট পোল করা শুরু করলেন। নির্বাচনের পর বিশ্লেষণ শুরু করলেন এবং নতুন একটা ঘরানা নিয়ে এলেন যেটা এর আগে ভারতীয় টেলিভিশনে কেউ দেখেনি। এবং যেটার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিতে অসম্ভব একটা আন্তর্জাতিকতা আছে। আমার তখন থেকেই মনে হতো যে, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে যে করে হোক, আলাপ করতে হবে, আবার একই সঙ্গে মনে হতো যে, আলাপ হলে যদি মুগ্ধতা কেটে যায় তাহলে আলাপ না হওয়াই ভালো। দূর থেকে তাকে দেখাটাই ভালো। দুরকম একটা, স্ববিরোধী একটা ভাবনা নিজের মনের মধ্যে ঘুরত। এরপর প্রণয় রায় দেখালেন যে, তিনি শুধু এককভাবে স্টার নন। অর্থাৎ তার শুধু স্টার হলেই চলছিল। স্টার প্রণয় রায়ই যথেষ্ট ছিলেন ভারতবর্ষের জন্য যেভাবে তিনি বিল গেটসকে ইন্টারভিউ করেছেন, যেভাবে তিনি নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে কথা বলেছেন, যেভাবে তার শোগুলো বিশ্লেষণ করেছেন, কখনো কখনো বড় শো করতে এসেছেন লাইভ শো, সেটাই যথেষ্ট ছিল টেলিভিশনের পৃথিবীতে, তাকে পাকাপাকিভাবে রেখে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি ঠিক করলেন যে, তাকে শুধু ভারতীয় টেলিভিশনের অমিতাভ বচ্চন হলেই চলবে না, তাকে একই সঙ্গে হতে হবে ভারতীয় টেলিভিশনের রাজ কাপুর। তাই এনডিটিভি প্রতিষ্ঠা করে নিলেন, তার আগপর্যন্ত তিনি অনুষ্ঠানগুলো স্টারে করছিলেন, অন্য চ্যানেলে করছিলেন, এবার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান নিয়ে এলেন এবং সেই প্রতিষ্ঠানে একটা, যেটাকে লেফট লিবারেল সেন্টিমেন্ট আমরা বলি, সেটার তো ধারক এবং বাহক হয়ে গেলেন গোটা ভারতবর্ষে, একই সঙ্গে অনেক তারার জন্ম দিলেন।
এ তারার জন্ম দেওয়া নিয়ে ভারতবর্ষের মিডিয়া জগতে দুই রকম মতবাদ আছে। বেশিরভাগ মিডিয়া ব্যারেন, তারা মনে করেন যে স্টার তৈরি করাটা বিপজ্জনক, কারণ স্টার আজ আছে, কাল অন্যের হয়ে তারাবাজি করবে। আমাকে ছেড়ে দেবে। তখন সেই তারাবাজির আলোটা আমাকে সহ্য করতে হবে। তার চেয়ে বাবা সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, আমি যদি কিছু স্ক্রিন প্রফেশনাল তৈরি করি যাদের বাহ্যিক সেরকম কোনো পরিচিতি নামডাক থাকবে না, কিন্তু যারা খুব এফিশিয়েন্ট হবে। যেটাকে আমরা অনেক সময় ক্রিকেটের ভাষায় বলি লাইন অ্যান্ড লেন বোলার। অর্থাৎ তার ফ্ল্যামবয়েন্স থাকবে না, সে অত্যন্ত পেশাদার হবে, মানে কাজটা তুলে দেবে। যদি সেরকম করি তাহলে সুবিধা হচ্ছে যে, সেই ধরনের পেশাদার সে যদি অন্য জায়গায় চলে যায় আমি আরেকটা পেশাদারকে নিয়ে আসতে পারব। কিন্তু যদি আমার এখান থেকে একটা রাজদীপ চলে যায়, কী অর্ণব চলে যায়, তাহলে আমার সমস্যা যে লোকে প্রতিনিয়ত জিজ্ঞেস করবে যে, ও চলে গেল কেন? ও নেই কেন? তখন অনেক রকম আমার সমস্যা দেখা দিতে পারে। বেশিরভাগ ভারতীয়, আবার বলছি, বেশিরভাগ ভারতীয় মিডিয়া ব্যারেন আজও তাই মনে করেন, ভারতের সবচেয়ে বড় খবরের কাগজ টাইমস অব ইন্ডিয়া তারা আজও ওই ঘরানায় বিশ্বাসী যে, স্টার তোলার দরকার নেই, তোলার দরকার আছে এফিশিয়েন্ট প্রফেশনাল, প্রণয় রায় এখানেও ইউনিক, তিনি এই ধারণাটা কমপ্লিটলি ভেঙে দিয়েছেন, এত সব স্তর তিনি তুলেছেন, যে ভারতীয় টেলিভিশনে সেকেন্ড কোনো নমুনাও নেই বোধহয়। এক থেকে দশ, দিকে দিকে কতগুলো নাম বলব? অর্ণব গোস্বামী, বরখা দত্ত, রাজদীপ, নিধি, রাজদান, রবিশ কুমার, শ্রীনিবাসন জৈন, বিক্রম চন্দ প্রত্যেকে একেকজন স্টার ভারতীয় মিডিয়া জগতের এবং ওদের প্রত্যেককে কিন্তু তুলেছেন প্রণয় রায়। অনেকেই ছেড়ে গেছেন, তাতে তার কিছু এসে যায়নি। তিনি স্টার তৈরির কারখানাতে একইরকমভাবে মনোনিবেশ করেছেন। পরের লোকটাকে বের করে আনার জন্য ইভেন এই চাপের মুখে অচঞ্চলতা এটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ ট্রেডমার্ক। আমি কখনো দেখিনি কোনো ছবিতে, কখনো শুনিনি যে তিনি অত্যন্ত স্ট্রেসড হয়ে আছেন, নিশ্চয়ই স্ট্রেসড হয়েছেন গত কিছুদিন, কয়েক মাসের ঘটনা যে রকম যখন তিনি এনডিটিভি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন, অবশ্যই স্ট্রেসের মুখে ছিলেন, কিন্তু কোথাও কখনো পাবলিকলি স্ট্রেসের ভাবটা দেখাননি, যাতে তার ডিগনিটিটা অক্ষুন্ন থাকে, এই পাবলিক লাইফে প্রচ- স্ট্রেসের মধ্যে ডিগনিটি বজায় রাখাটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ হিউজ ট্রেডমার্ক এবং এটা অনুকরণযোগ্য। আমার একটা সময় বারবার মনে হতো যে প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করছি না কেন? কেন প্রণয় রায়ের কোম্পানিতে কাজ করার চেষ্টা করছি না? তারপর সবাই বলত যে, একটু প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করতে হলে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ থেকে পাস করতে হবে অথবা তাদের বাবাদের হতে হবে আইএফএস কিংবা আইএস, প্রণয় যাদের রিক্রুট করেন তাদের যদি আমরা দেখি তারা কোথা থেকে এসেছে, তাহলে দেখা যাবে তারা অত্যন্ত উচ্চবিত্ত সমাজ থেকে এসেছে।
প্রণয় রায়ের ওখানে একেবারে লোয়ার মিডল ক্লাস কেউ নেই, হয়তো কথাটা কতটা অসত্য, হয়তো কথাটা কিছুটা সত্য। কিন্তু আমি সাম হাউ আর কখনো চেষ্টা করিনি। দূর থেকে সবসময় একটা অদ্ভুত রেসপেক্ট এনডিটিভি গ্রুপ সম্পর্কে আমার এবং অন্য অনেক সাংবাদিককুলের বজায় ছিল যে, এরা হয়তো চাপের মুখে তাদের টেকনিক চেঞ্জ করেনি। তারা হয়তো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলছে না, অনেকে বলত যে এনডিটিভিতে ডিসকাশনগুলো খুব বোরিং হয়ে যাচ্ছে। হতে পারে কিন্তু তারা সাবেকি যে ছাঁচটা সাংবাদিকতার, সেটা টেলিভিশনের ঢঙ্কানিনাদে এসেও কিন্তু বজায় রেখেছিল। এবং এই চিৎকার-চেঁচামেচি, মারদাঙ্গা যেটা আধুনিক ভারতীয় টেলিভিশনের ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে, সেটা থেকে বরাবর এনডিটিভি দূরে থেকেছে।
তাতে তাদের টিআরপি পড়েছে। তারা কেয়ারও করেনি। তারা মনে করেছে, আমরা এভাবে করতে চাই। এভাবেই করব। বাকি পৃথিবী যা ইচ্ছে বলুক, কিছু আসে যায় না। রাষ্ট্রপতি ভবনে এনডিটিভির একটা বিশাল অনুষ্ঠান হয়েছিল যখন প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি, সেটাতে অমিতাভ বচ্চন, শচীন টেন্ডুলকার, আশা ভোঁসলেসহ অনেকে এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানটা দেখতে দেখতে আমার মনে হচ্ছিল যে, একজন মানুষের কতটা হোল্ড থাকলে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠান করতে পারেন। পরবর্তীকালে সেটা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল।
প্রশ্ন উঠেছিল কী করে রাষ্ট্রপতি একটা প্রাইভেট চ্যানেলকে সেখানে অনুষ্ঠান করতে দিতে পারেন। কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে, শ্রদ্ধার কোন পর্যায়ে গেলে, কন্টাক্টস কোন পর্যায়ে থাকলে, তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার ব্যক্তিগত চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন! মহেন্দ্র সিং ধোনি একটা সময় এনডিটিভির সঙ্গে ছিলেন এবং তখন এনডিটিভির দু-একটা অনুষ্ঠান করেছিলেন। আমার মনে আছে, ধোনি একবার সাউথ আফ্রিকায় বললেন, আরে এনডিটিভি কী করে করছে! এটাই প্রণয় রায়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য এ কথাটা যে মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো মানুষ বলছেন! এটা ঠিক শোভা পায় না অর্থাৎ সবসময় এনডিটিভির একটা নির্দিষ্ট বেঞ্চমার্ক ছিল। সেটা হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই। প্রশ্ন তোলা। সাহসী প্রশ্ন তোলা। আবার চাপের মুখে মাথা না নামানো, ওই যে বললাম একটা বামপন্থি লেফট লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি।
অনেকেই বলত যে, প্রণয়ের স্ত্রী রাধিকা রায়ের বোন যেহেতু বৃন্দা কারাত, সেজন্যই এ দৃষ্টিভঙ্গি। আমার কখনো তা মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছিল প্রণয় রায়ের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি। একেবারে তিনি কলকাতায় হয়তো খুব বেশি সময় কাটাননি। কিন্তু কলকাতার ওই উদার বামপন্থি যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেই উদার বামপন্থার সঙ্গে তার মনোভাব একেবারে একরকম। এবং সে জন্যই, বদলে যাওয়া ভারতবর্ষে তার বারবার করে সমস্যা হচ্ছিল এবং সমস্যা হওয়ার বোধহয় কথাও ছিল। কারণ তিনি যেটা বলছিলেন, শাসকরা বলছিলেন কমপ্লিটলি তার বিপরীত কিছু। এখনকার ভারতবর্ষের মিডিয়ায় বিপরীতমুখী আওয়াজটা আর কিছুদিন বাদে আমার ধারণা একমাত্র ফিল্মেই দেখা যাবে, ভারতবর্ষের টেলিভিশনে দেখা যাবে না।
আমার তো মনে হয় যখন এই ছবিগুলো দেখানো হবে যে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কী রকম লড়াই করেছিল, এককালে আনন্দবাজার গ্রুপ কী লড়াই করেছিল, টাইমস নিয়ে মাঝখানে গিয়ে লড়াই করেছে, এনডিটিভি দীর্ঘদিন ধরে কী লড়াই করেছে সেগুলো বোধহয় ইতিহাসের পাতাতেই চলে গেল। তাই বলে প্রণয় রায়! যিনি কখনো ইতিহাসের কথায় যাবেন না। প্রণয় রায় ইতিহাস হয়ে ইতিহাসের পাতায় থাকবেন। আমার মনে হয়েছে যখন একটা সময় জগমোহন ডালমিয়া রবি শাস্ত্রীকে ইন্ডিয়ান টিমের কোচ হতে বলছিলেন এবং তিনি কোচ হব কি হব না এটা নিয়ে নানান কথা বলছিলেন। তখন আমায় শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, আমি তিনটে শর্ত দিয়েছি, একটা শর্ত যে টিম সিলেকশনের ভার আমাকে দিতে হবে। দুই, টিম সিলেকশনের ভার আমার যদি না থাকে, আমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মত থাকবে। তিন, চূড়ান্ত এগারোর ব্যাপারে আমার মতামত থাকবে। ফোর্থ, টিমের ফিটনেসের ব্যাপারে আমি কিছু কথা বলব। আমি তখন বলেছিলাম যে, আপনি ম্যানেজার হয়তো হবেন। কিন্তু আপনি থাকতে পারবেন না। কারণ আজাহারউদ্দিন। আপনি যদি এসব কথা বলেন তাহলে আজহারউদ্দিন আপনাকে ম্যানেজার রাখবেন না। উনি যেরকম পাওয়ারফুল, ডালমিয়ার সঙ্গে যেরকম সম্পর্ক, আপনাকে চলে যেতে হবে। তখন শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, চলে যেতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু গোটা ড্রেসিংরুম জানবে, আমায় কেন চলে যেতে হয়েছিল। ওই রেসপেক্টটাই আমার পাওনা হবে। শাস্ত্রী সেই সময় ভারতীয় দলের কোচ হননি এবং হন অনেক পরে, কিন্তু আজ কোথাও মনে হচ্ছে যে, প্রণয় রায়ের এনডিটিভি থেকে চলে যাওয়া তার অসম্মান, তার অমর্যাদা এসবকিছু ইতিহাসে থেকে গেল, এভাবে ইতিহাস জানল লোকটাকে কেন চলে যেতে হয়েছিল। আমি ইমরান খানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাকে এই যে জেলে পুরে অসম্মান করা হলো, আপনার কী মনে হয়েছিল সেই সময়? উনি বলেছিলেন, আমার কিছুই মনে হয়নি, আমার মনে হয়েছিল, গবেটগুলো যে ভুল করেছিল, সেগুলো ইতিহাসের পাতায় চলে গেল।
প্রণয় রায়ের কাহিনী সম্পর্কে আবার তাই মনে হয় যে, গবেটগুলো কী করে জানবে যে ওরা নিজেদেরও ইতিহাসের পাতায় নিয়ে চলে গেল। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই সাময়িক। আর তাই বলছি, প্রণয় রায় চলে যাবেন নতুন প্রণয় রায় নিশ্চয়ই ফেরত আসবেন, তাই এটা দীর্ঘকালীন হতে পারে না। এটা সাময়িক। তাই লেখাটার হেডিং বললাম, মেরুদণ্ডের টাইম আউট।
শ্রুতিলিপি : শিমুল সালাহ্উদ্দিন
প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার তালিকাভুক্ত। কিন্তু বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। অথচ সরকারি শুল্ক সুবিধার আওতায় বিদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এমন ৫৩টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থার প্রাথমিক তদন্তে ব্যাংকিং চ্যানেলে এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের তথ্যও মিলেছে। এ ছাড়া আরও ৭১টি প্রতিষ্ঠান একই সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করার মাধ্যমে আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ পাচারে যুক্ত বলে এনবিআরের তদন্তে জানা গেছে।
চিহ্নিত এই ১২৪টি প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তদন্ত শেষে পর্যায়ক্রমে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব জব্দ করা হয়। এ ছাড়া ব্যবসার লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। আমদানি-রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই তৈরি পোশাক শিল্প ও এর সহযোগী শিল্পের প্রতিষ্ঠান। তাদের পাচার করা অর্থের পরিমাণ চিহ্নিত করতে বিস্তারিত তদন্ত চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সদস্য এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, একেকটি প্রতিষ্ঠান একাধিক চালানে কম করেও ৫ কোটি থেকে ২৫ কোটি টাকার পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি করেছে। অন্যদিকে একেকটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের পরিমাণও ৮ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকা বা তার বেশি। এই হিসাবে ১২৪ প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার পণ্য এনে অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে এবং আরও প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। প্রাথমিক তদন্তে এসব পাওয়া গেলেও চূড়ান্ত হিসাবের কাজ চলছে। চূড়ান্ত হিসাবে অর্থের পরিমাণ বাড়তে বা কমতে পারে।
এভাবে শুল্ক সুবিধায় কাঁচামাল এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়ার কারণে দেশি শিল্পে কী ধরনের প্রভাব পড়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশি শিল্প সব ধরনের রাজস্ব পরিশোধ করে পণ্য উৎপাদন করে বলে তাদের উৎপাদন খরচ বেশি। অন্যদিকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য আমদানিতে শুল্ক দেওয়া লাগে না বলে খরচ কম হয়। তাই দাম কম থাকে। কম দামে পণ্য পাওয়ায় ক্রেতারা এসব পণ্য বেশি কেনে। অন্যদিকে দেশি পণ্য ন্যূনতম লাভ রেখে বিক্রি করলেও এর সঙ্গে পেরে ওঠে না। ফলে দেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ছে।
এনবিআর কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ১৭ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি ১২৪ প্রতিষ্ঠানের পাঁচ বছরের (২০১৭-২০২১) আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য খতিয়ে দেখেছে। বিশেষভাবে কী পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, কতটা উৎপাদন করা হয়েছে, রপ্তানির পরিমাণ কত, ব্যাংকে এলসি বা ঋণপত্রের মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ কোন কোন দেশের অনুকূলে পাঠানো হয়েছে, তদন্তে এসব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যে ৭১ প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে, তারা কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর্থিক অনিয়ম করেছে। যে পরিমাণের কাঁচামাল প্রয়োজন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। অন্যদিকে যা রপ্তানি করার কথা তার চেয়ে কম পরিমাণ এবং নামসর্বস্ব পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোও বাইরে থেকে কিনে নামমাত্র পণ্য রপ্তানি করেছে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক ও সহযোগী শিল্প কারখানা ছাড়াও ইলেকট্রিক, প্লাস্টিক খাতের প্রতিষ্ঠান আছে। কাঁচামাল হিসেবে তারা আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, মিডিয়াম পেপার, লাইনার পেপার, পলিপ্রোপাইলিন (পিপি), বিএপিপি ও এডহেসিভ টেপ, প্লাস্টিক দানা, হ্যাঙ্গার, পলিথিন, সুতা, কাপড়, তারসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম আমদানি করেছে। কিন্তু সেসব কাঁচামাল কারখানায় না নিয়ে রাজধানীর নয়াবাজার, বংশাল, বকশীবাজার, হাতেম টাওয়ার, ধোলাইখাল, টঙ্গীতে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিরপুর ২ নম্বরের বেলুকুচি নিট ওয়্যার, আদাবরের ঠিকানায় কভারস অ্যান্ড কভার ইন্ডাস্ট্রি, শ্যামপুর কদমতলীর ইমপেকস প্যাকেজিং লিমিটেড, টঙ্গীর এম এম ওয়াশিং প্ল্যান্ট লিমিটেড, বনানীর বিমানবন্দর সড়কের পারসা লিমিটেড, বনানী জি ও এইচ ব্লকে রাইন ফ্যাশন লিমিটেড, টঙ্গীর ওয়েলড ড্রেসেস লিমিটেড, মিরপুর পল্লবী সেকশন ৭-এর মারকাভ ডিজাইনারস লিমিটেড, ঢাকার কোতোয়ালির ঠিকানায় ম্যানিলা পলিমার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডসহ ১২৪ প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিকানায় গিয়ে ৫৩টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাস্তবে কোথাও দোকান, আবাসিক ভবন, শপিং মল, ছাত্রী হোস্টেল, স্কুল পাওয়া গেছে। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার ঠিকানায় আফট্যাকস লিমিটেড অবস্থিত বলা হলেও বাস্তবে সেখানে রয়েছে দোকান।
প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী হিসেবে ১২৪টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত। উৎপাদনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা পরিচালক হিসেবে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। তাদের দাবি, কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানিসংক্রান্ত একটি কাগজেও তাদের স্বাক্ষর নেই। তবে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এসব ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীর বাবুবাজারে বিক্রি করতে নেওয়ার সময় ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা বন্ড সুবিধা বা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাগজসহ একটি কাভার্ড ভ্যান আটক করে। এসব কাগজ এবি প্যাকেজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান বন্দর থেকে খালাস করে এনেছিল। আটক পণ্যের বাজারমূল্য প্রায় ১৪ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে শুল্ক-করসহ দাম হয় প্রায় ২৬ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন চালানে এক বছরে প্রায় ১২ কোটি টাকার পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করেছে।
শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের পণ্য উৎপাদনে সরকার কাঁচামাল আমদানিতে ‘বন্ড সুবিধা’ নামে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। এই সুবিধা নেওয়া প্রতিষ্ঠানকে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় না। এই সুবিধা পেতে হলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়। শর্তগুলোর অন্যতম হলো, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামালের সবটা উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে। উৎপাদিত সব পণ্য রপ্তানি করতে হবে এবং সামান্য কাঁচামালও খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না। এসব শর্ত ভঙ্গ করলে শাস্তি হিসেবে বন্ড সুবিধা বাতিল এবং ব্যবসায়ের লাইসেন্স স্থগিত হবে। আর্থিক অনিয়মের সমপরিমাণ অর্থ, রাজস্ব এবং জরিমানাসহ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। প্রয়োজনে কারখানার জমি, যন্ত্রপাতি জব্দ করা হবে। আমদানিকারকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার আইনি সুযোগ আছে। শাস্তি হিসেবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও এর সঙ্গে জড়িতদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা যাবে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১২৪টি প্রতিষ্ঠান আমদানিকৃত কাঁচামালের যে দাম উল্লেখ করে ঋণপত্র বা এলসি খুলে অর্থ পাঠিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে আমদানি করেছে তার চেয়ে কম দামের ও কম পরিমাণের পণ্য। আমদানিকারকরা গোপনে বিদেশে নিজস্ব মালিকানাধীন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান খুলে তার অনুকূলে দাম হিসেবে অর্থ পাঠিয়েছে। এ অবৈধ কারবারে ব্যাংক, বন্দর ও এনবিআরের কিছু অসাধু ব্যক্তিকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সাবেক কমিশনার এবং এনবিআর সদস্য ড. শহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করতে এনবিআর নজরদারি বাড়িয়েছে। তবে আইনি প্যাঁচে অনেক সময় তাদের শাস্তির আওতায় আনতে সময় লেগে যায়। এ বিষয়ে আরও কাজ করার সুযোগ আছে।
বন্ড দুর্নীতি চিহ্নিত করতে প্রিভেন্টিভ, নিয়মিত ও বিশেষ অডিট করা হয়। এসব অডিটে প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের পর চূড়ান্ত তদন্ত করা হয়। তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে মাস থেকে বছরও পার হয়ে যায়। এরপর শুনানির জন্য অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের তলব করা হয়। তারপর মামলা হয় এনবিআরের আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলা নিষ্পত্তিতে পার হয়ে যায় বছরের পর বছর। রায় হওয়ার পর যেকোনো পক্ষের উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। আটকে থাকা মামলার সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে বন্ড দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আইন সংশোধনসহ এনবিআরকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।