রবীন্দ্র স্থাপত্য ও পরিবেশ চিন্তনের গবেষণা
সজল চৌধুরী | ১৭ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
(প্রথম কিস্তির পর)
ছেলেবেলার রবীন্দ্রনাথের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথে রূপান্তরের পরিবেশ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় লাল ইটের বাড়িগুলো, তার দেয়ালগুলো, বড় বড় জানালার ধার কিংবা টালির ছাদযুক্ত বড় বারান্দা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল কবিগুরুর চিন্তাশীল মননে। নিচতলা থেকে ওপরে উঠে যাওয়া সিঁড়ি ধরে বারান্দা, বারান্দা দিয়ে উঠে যাওয়া সবুজ বৃক্ষরাজি, ছাদের ওপর বেষ্টনী, আয়তাকার কাঠের জানালা, পাথরে আবৃত দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা কলাম এসব চিরচেনা স্থাপত্য জগতের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। আর তাই তো বারেবারে ফিরে ফিরে গিয়েছেন তাদের কাছে চিরচেনা পরিবেশে। গঙ্গার পাশ দিয়ে পদ্মাবতী ঘুরে বেড়ানোর সময় তিনি বিশেষ কিছু বাগানবাড়িতে জীবনের বিভিন্ন সময় অবস্থান করেছেন। তাদের স্থাপত্য-শৈলীর অনেকটা কাছাকাছি থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল তার। এসব তথ্যচিত্র আমরা দেখতে পাই সুরঞ্জনা ভট্টাচার্যের লেখা কবির আবাস প্রথম এবং দ্বিতীয় খণ্ডে। লাল ইটের একতলা এবং দোতালা বাড়িগুলো দীর্ঘ হয়ে গঙ্গার পাড় ঘেঁষে গিয়েছে। যে দিকে রয়েছে ঘন বন জঙ্গল। এমন বাড়ি এবং তার পরিবেশ কবিগুরুর সাহিত্যচর্চার আধার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেমনটি কুঠিবাড়ির সবচেয়ে ওপরের তলায় চারদিক থেকে খোলা গোলাকৃতির ঘরটি যেখানে তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য কবিতা। যেখানে বসে বসে সবুজ গাছের দিগন্তবিস্তৃত চূড়াগুলো প্রত্যক্ষ করেছেন এবং খোলা আকাশ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি। সন্ধ্যাসংগীতের পালা চলেছে এই ঘরটিতে। এই ঘরটির প্রতি লক্ষ্য করেই কবি লিখেছিলেন, অনন্ত আকাশে মেঘে থাকার গল্প। তার ভাষায় এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর কবিতা। এমনকি ঘরের মধ্যে টানানো রঙিন ছবি, দেয়াল, কাচ কবিকে নিয়ে যেত অচিনপুরে, যেমনটি দেখা গেছে শাহজাদপুরের কুঠিবাড়িতে।
এই ঘরটির চারপাশে ছিল বকুলগাছ। আর মাথায় খেলা করত আলোর ঝলকানি। পত্র-পল্লবে চারদিকে চলছিল অপ্রতিরোধ্য বাতাসের খেলা। বাঁধা ছাদের ওপর থেকে দেখা যেত মেঘের খেলা। আর এভাবেই বৃষ্টি শুরুর দিনগুলো হয়ে উঠত স্মৃতির আঙিনায় আরও রঙিন। জানালায় আরেকটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জানালাগুলো থাকত একটু ভেতরের দিকে ঠেলে দেওয়া। ঠিক যেমনটা পর্দার মতো। যেন প্রাণের সূর্যের আলো সরাসরি ঢুকতে না পারে। জানালাগুলো দেখে মনে হতো সেগুলোর উৎপত্তি মাটি থেকে কেননা জানালাগুলো ছিল বড় আকৃতির। জানালার পাল্লাগুলোকে সহজেই লম্বালম্বিভাবে ভাঁজ করা যেত। উপরিতলে বাতাস চলাচলের জন্য ভেন্টিলেটর থাকত। বারান্দায় সূর্যের খেলা কবিগুরুর বিশেষ পছন্দের ছিল। চেয়ার পেতে টানা বারান্দা থেকে গঙ্গার দৃশ্য অবলোকন ছিল তার সহজাত প্রবৃত্তি। এসব অভ্যাস তার দৈনন্দিন স্বভাবের মধ্যেই দৃশ্যমান হতো। স্থাপত্য ও পরিবেশ কবিকে সৃষ্টির মধ্যে টেনে দেয়। তার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ইট কাঠের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে নতুন এক ভাবাবেগের প্রকাশে। কবির ভাষায় সদর স্ট্রিটের রাস্তাটা যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে সেইখানে বোধকরি ফুলের বাগানের গাছ দেখা যেত। একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কবি যখন সেদিকে তাকালেন তখন সেই গাছগুলোর অন্তরাল থেকে সূর্য উদয় হচ্ছিল। সেই দিকে নির্বাক মনে কবি চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটি মুহূর্তের মধ্যে কবির চোখের ওপর থেকে যেন এক একটি পর্দা সরে গেল। কবি উপলব্ধি করতে পারলেন একটি অপরূপ মহিমা বিশ্বসংসারকে অসামান্য আনন্দে এবং সৌন্দর্যে তরঙ্গায়িত করেছে। তার এই উপলব্ধি থেকে সহজেই অনুমান করা যায় ইট কাঠের অবকাঠামো যদি প্রকৃতির আলো বাতাসের সঠিক ব্যবহারে আসে তাহলে দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয় নতুন এক সৃষ্টিতে। আর মানব মনকে তাড়িত করে নতুন কোনো সৃষ্টির নেশায় প্রাণহীন অবকাঠামোতে নতুন প্রাণের সন্ধানে।
স্থাপত্যের নিজস্ব একটি পরিভাষা বর্তমান এবং কবিগুরু তার জীবনে বহুবার তা আস্বাদন করেছেন। স্থাপত্যরীতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কাছে তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছেন বারবার নিজের খেয়াল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে গতানুগতিকতা পরিহার করে নতুন পরিবেশের অলক্ষ্যে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি বাড়ি নিয়ে ইন্দিরা দেবীর লেখা পড়লেই বোঝা যায় তার ভাষায় একটা বিশেষ বাড়ি যেন প্রকাণ্ড ফোটার মতো! জীবনের একটা নির্দিষ্ট সময়ের ঘটনাবলি চার দেয়ালের মধ্যে ধরে রাখে। কথায় বলে দেয়ালেরও কান আছে। শুধু কান কেন সেই উপমা টেনে বাড়িয়ে বলা যেতে পারে দেয়ালের চোখ কান সবই আছে। কেবল কথা বলতে পারে না। নইলে কত লোকের কত কালের কাহিনী শোনা যেত! তিনি আবার বলেছেন বাড়ির বোধকরি জন্ম আছে। তিনি আরও উপলব্ধি করেছেন বাড়ির মনে হয় জন্মান্তর আছে। তার ভাষায় তাদের সেই নড়বড়ে তিন কাল গত পুরনো বাড়ির ইট কাঠ কিছুই আর এখনো অবশিষ্ট নেই। কিন্তু সেই দিঘির ওপর আপাতত মহামহিমান্বিত ক্যালকাটা ক্লাব বিরাজ করছে। যতদূর জানা যায় এ যেন কালান্তর। উক্তিটির মধ্যে স্থানের হাজারো পরিভাষা আছে। এই পরিভাষাকে অন্তর দিয়ে বুঝতে হয়। উপলব্ধি করতে হয় এর জীবনকে। এই হলো স্থাপত্য ও পরিবেশ। যা আমরা কবিকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে সহজেই উপলব্ধি করতে পারি।
স্থাপত্যের সঙ্গে প্রতিদিনের জীবন ও ভাবধারার একটি অন্তর মিল আছে। সেটি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতেন কবি। তাই তো সার্কুলার রোডের বাড়ির বারান্দা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে খুব সূক্ষ্মভাবে অবলোকন করতেন মানুষের চলাফেরা, সারা দিনের কাজ, খেলা করা আর এর বৈচিত্র্যের মধ্যেই খুঁজে ফিরতেন নতুন কোনো গল্প। তবে এ কথা উল্লেখ্য যে, সেই সময় কবিগুরু এমন কিছু প্রাসাদতুল্য ভবনে অনেক সময় কাটিয়ে ছিলেন যেগুলোর বৈশিষ্ট্য প্রায় একই ধরনের। তার লেখনীর মাধ্যমে সেগুলোর বর্ণনা অনেক ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায়। বৈঠকখানা ও তার চারপাশে লম্বা ও চওড়া থাকার ঘরগুলোর ছাদ প্রায় বিশ ফুটের মতো উচ্চতা। অনেক ক্ষেত্রে ভাস্কর্য তার বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে সাবধানতা অবলম্বন করা বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য। বাংলার প্রকৃতি সর্বদা কবিকে বিমোহিত করত। তাই তো লিখেছিলেন ‘বাংলাদেশের এবং তার প্রান্তবর্তী গাছপালার মধ্যে সূর্যাস্ত যে কি সুন্দর সে আমি কিছুতেই বলিতে পারি না!’ এক বিশাল শান্তি এবং করুণা ঘন সবুজ বনের মধ্যে বাড়িটিকে রবীন্দ্রনাথের নিঃসন্দেহে এতটাই ভালো লেগেছিল যে এই বাড়ির বারান্দায় সারা দিন বসে পাহাড়ি গান, শ্যামল বৃক্ষের ওপর মেঘ বৃষ্টি আর রোদ্রের খেলা দেখতে দেখতে সময় যে কখন পার হয়ে যেত তার ঠিক ছিল না। কবির ভাষায় এই রকম জায়গায় সুদীর্ঘকাল একলা থাকলে অনেক লাভ হতো। কলকাতায় অনেক সময় থেকে নিজেকে সরিয়ে সাহিত্যচর্চার নেশায় অনেক সময় জোড়াসাঁকোতে না থেকে রবিঠাকুর অন্যত্র নিরিবিলি গৃহে সময় কাটাতেন। যেন কেউ তাকে বিরক্ত না করে। এমনি একটি গৃহ আলিপুরের প্রশান্তচন্দ্র গৃহ। যে ঘরটিতে কবি থাকতেন। জানালা দিয়ে বাগান দেখা যেত। বড় বড় গাছগুলো কবিকে জানালার ধারে নিবিড়ভাবে বসিয়ে রাখত। ঘরের জানালার সঙ্গে কবির অন্তরের যোগসূত্র ছিল।
সামাজিক অপরাধে তলিয়ে যাওয়া শহরের স্থাপত্য তিনি নির্ণয় করেছেন ফুলের গন্ধ, পাখির ডাক, জল পড়ার শব্দ সব কিছুর মধ্য দিয়েই। একটি শহরের পথ চলা যেন অগ্রসরমান এক নতুন কম্পোজিশন। কলকাতা আর্ট কলেজে থাকা অবস্থায় তার লেখার মধ্যে এ প্রসঙ্গে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, এ জায়গাটি খুব সুন্দর। একটি বড় পুকুর, বড় বড় গাছ, চাঁপাফুলের গন্ধ আর নিরন্তর পাখির ডাক কলকাতা সমস্ত অপরাধ চাপা দিয়ে রেখেছে। শহরের পাথুরে রাস্তা বেয়ে ওইখানে এসে বসন্ত ঋতু হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। কবি ছিলেন ঋতুরাজের সহচর। একটু ভালো করে দেখলে বোঝা যায় কবিগুরু বাগান অনেক পছন্দ করতেন। আর সেই বাগানে যদি থাকে ম্যাগনেসিয়া, চাঁপা, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, নাগকেশর, গোলাপ, ডালিয়া, লিলি আর থাকে জলের সংস্পর্শ সেই সঙ্গে বাগানে যদি থাকে হাঁটার পথ সেটি হতো কবির অতি পছন্দের স্থান। এ কারণেই হয়তো দীর্ঘদিনের ক্লান্তি দূর করতে হাওয়া বদলের জন্য প্রায় দুই বছরের মতো গঙ্গার তীরে খড়দহের বাগানবাড়িতে নিজে গিয়েছিলেন থাকবেন বলে। শান্তিনিকেতনের স্থাপত্য ও পরিবেশ ভাবনায় কবিগুরুর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মতো। সেখানকার স্থাপনাগুলো এবং সেই স্থাপনাগুলোকে ঘিরে সেখানকার পরিবেশ যেন শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন একটি সময়ের সূচনা করেছিল। সেখানকার কালোবাড়ি, দক্ষিণ দিকের দেয়ালের রিলিফ ভাস্কর্যের ছবি, ভেতরের দেয়াল এবং বারান্দার আর্টওয়ার্ক, শ্যামলী বাড়ি থেকে শুরু করে শ্রীনিকেতন সবক্ষেত্রেই ছিল কবির মনে লুকিয়ে থাকা স্থাপত্য ও পরিবেশ ভাবনার সমসাময়িক প্রতিচ্ছবি। এই সব স্থাপনার প্রত্যেকটির দেয়াল কবির স্থাপত্য এবং পরিবেশ চিন্তনের নতুন একটি মতাদর্শের দুয়ার খুলে দেয়। যা এই সীমিত পরিসরে ব্যাখ্যা করা মোটেই সম্ভব নয়। যার জন্য প্রয়োজন বিস্তর গবেষণা এবং সেই গবেষণার মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে পারে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্থাপত্য এবং পরিবেশ ভাবনার বিভিন্ন দিক। যাকে কাজে লাগিয়ে সমসাময়িক দেশীয় স্থাপত্যে নতুন একটি মাত্রা যুক্ত হতে পারে এবং স্থাপত্যগুলো আরও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর হতে পারে।(সমাপ্ত)
লেখক শিক্ষক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত।
শেয়ার করুন
সজল চৌধুরী | ১৭ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

(প্রথম কিস্তির পর)
ছেলেবেলার রবীন্দ্রনাথের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথে রূপান্তরের পরিবেশ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় লাল ইটের বাড়িগুলো, তার দেয়ালগুলো, বড় বড় জানালার ধার কিংবা টালির ছাদযুক্ত বড় বারান্দা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল কবিগুরুর চিন্তাশীল মননে। নিচতলা থেকে ওপরে উঠে যাওয়া সিঁড়ি ধরে বারান্দা, বারান্দা দিয়ে উঠে যাওয়া সবুজ বৃক্ষরাজি, ছাদের ওপর বেষ্টনী, আয়তাকার কাঠের জানালা, পাথরে আবৃত দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা কলাম এসব চিরচেনা স্থাপত্য জগতের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। আর তাই তো বারেবারে ফিরে ফিরে গিয়েছেন তাদের কাছে চিরচেনা পরিবেশে। গঙ্গার পাশ দিয়ে পদ্মাবতী ঘুরে বেড়ানোর সময় তিনি বিশেষ কিছু বাগানবাড়িতে জীবনের বিভিন্ন সময় অবস্থান করেছেন। তাদের স্থাপত্য-শৈলীর অনেকটা কাছাকাছি থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল তার। এসব তথ্যচিত্র আমরা দেখতে পাই সুরঞ্জনা ভট্টাচার্যের লেখা কবির আবাস প্রথম এবং দ্বিতীয় খণ্ডে। লাল ইটের একতলা এবং দোতালা বাড়িগুলো দীর্ঘ হয়ে গঙ্গার পাড় ঘেঁষে গিয়েছে। যে দিকে রয়েছে ঘন বন জঙ্গল। এমন বাড়ি এবং তার পরিবেশ কবিগুরুর সাহিত্যচর্চার আধার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেমনটি কুঠিবাড়ির সবচেয়ে ওপরের তলায় চারদিক থেকে খোলা গোলাকৃতির ঘরটি যেখানে তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য কবিতা। যেখানে বসে বসে সবুজ গাছের দিগন্তবিস্তৃত চূড়াগুলো প্রত্যক্ষ করেছেন এবং খোলা আকাশ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি। সন্ধ্যাসংগীতের পালা চলেছে এই ঘরটিতে। এই ঘরটির প্রতি লক্ষ্য করেই কবি লিখেছিলেন, অনন্ত আকাশে মেঘে থাকার গল্প। তার ভাষায় এইখানে বাঁধিয়াছি ঘর কবিতা। এমনকি ঘরের মধ্যে টানানো রঙিন ছবি, দেয়াল, কাচ কবিকে নিয়ে যেত অচিনপুরে, যেমনটি দেখা গেছে শাহজাদপুরের কুঠিবাড়িতে।
এই ঘরটির চারপাশে ছিল বকুলগাছ। আর মাথায় খেলা করত আলোর ঝলকানি। পত্র-পল্লবে চারদিকে চলছিল অপ্রতিরোধ্য বাতাসের খেলা। বাঁধা ছাদের ওপর থেকে দেখা যেত মেঘের খেলা। আর এভাবেই বৃষ্টি শুরুর দিনগুলো হয়ে উঠত স্মৃতির আঙিনায় আরও রঙিন। জানালায় আরেকটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জানালাগুলো থাকত একটু ভেতরের দিকে ঠেলে দেওয়া। ঠিক যেমনটা পর্দার মতো। যেন প্রাণের সূর্যের আলো সরাসরি ঢুকতে না পারে। জানালাগুলো দেখে মনে হতো সেগুলোর উৎপত্তি মাটি থেকে কেননা জানালাগুলো ছিল বড় আকৃতির। জানালার পাল্লাগুলোকে সহজেই লম্বালম্বিভাবে ভাঁজ করা যেত। উপরিতলে বাতাস চলাচলের জন্য ভেন্টিলেটর থাকত। বারান্দায় সূর্যের খেলা কবিগুরুর বিশেষ পছন্দের ছিল। চেয়ার পেতে টানা বারান্দা থেকে গঙ্গার দৃশ্য অবলোকন ছিল তার সহজাত প্রবৃত্তি। এসব অভ্যাস তার দৈনন্দিন স্বভাবের মধ্যেই দৃশ্যমান হতো। স্থাপত্য ও পরিবেশ কবিকে সৃষ্টির মধ্যে টেনে দেয়। তার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ইট কাঠের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে নতুন এক ভাবাবেগের প্রকাশে। কবির ভাষায় সদর স্ট্রিটের রাস্তাটা যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে সেইখানে বোধকরি ফুলের বাগানের গাছ দেখা যেত। একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কবি যখন সেদিকে তাকালেন তখন সেই গাছগুলোর অন্তরাল থেকে সূর্য উদয় হচ্ছিল। সেই দিকে নির্বাক মনে কবি চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটি মুহূর্তের মধ্যে কবির চোখের ওপর থেকে যেন এক একটি পর্দা সরে গেল। কবি উপলব্ধি করতে পারলেন একটি অপরূপ মহিমা বিশ্বসংসারকে অসামান্য আনন্দে এবং সৌন্দর্যে তরঙ্গায়িত করেছে। তার এই উপলব্ধি থেকে সহজেই অনুমান করা যায় ইট কাঠের অবকাঠামো যদি প্রকৃতির আলো বাতাসের সঠিক ব্যবহারে আসে তাহলে দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয় নতুন এক সৃষ্টিতে। আর মানব মনকে তাড়িত করে নতুন কোনো সৃষ্টির নেশায় প্রাণহীন অবকাঠামোতে নতুন প্রাণের সন্ধানে।
স্থাপত্যের নিজস্ব একটি পরিভাষা বর্তমান এবং কবিগুরু তার জীবনে বহুবার তা আস্বাদন করেছেন। স্থাপত্যরীতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কাছে তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছেন বারবার নিজের খেয়াল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে গতানুগতিকতা পরিহার করে নতুন পরিবেশের অলক্ষ্যে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি বাড়ি নিয়ে ইন্দিরা দেবীর লেখা পড়লেই বোঝা যায় তার ভাষায় একটা বিশেষ বাড়ি যেন প্রকাণ্ড ফোটার মতো! জীবনের একটা নির্দিষ্ট সময়ের ঘটনাবলি চার দেয়ালের মধ্যে ধরে রাখে। কথায় বলে দেয়ালেরও কান আছে। শুধু কান কেন সেই উপমা টেনে বাড়িয়ে বলা যেতে পারে দেয়ালের চোখ কান সবই আছে। কেবল কথা বলতে পারে না। নইলে কত লোকের কত কালের কাহিনী শোনা যেত! তিনি আবার বলেছেন বাড়ির বোধকরি জন্ম আছে। তিনি আরও উপলব্ধি করেছেন বাড়ির মনে হয় জন্মান্তর আছে। তার ভাষায় তাদের সেই নড়বড়ে তিন কাল গত পুরনো বাড়ির ইট কাঠ কিছুই আর এখনো অবশিষ্ট নেই। কিন্তু সেই দিঘির ওপর আপাতত মহামহিমান্বিত ক্যালকাটা ক্লাব বিরাজ করছে। যতদূর জানা যায় এ যেন কালান্তর। উক্তিটির মধ্যে স্থানের হাজারো পরিভাষা আছে। এই পরিভাষাকে অন্তর দিয়ে বুঝতে হয়। উপলব্ধি করতে হয় এর জীবনকে। এই হলো স্থাপত্য ও পরিবেশ। যা আমরা কবিকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে সহজেই উপলব্ধি করতে পারি।
স্থাপত্যের সঙ্গে প্রতিদিনের জীবন ও ভাবধারার একটি অন্তর মিল আছে। সেটি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতেন কবি। তাই তো সার্কুলার রোডের বাড়ির বারান্দা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে খুব সূক্ষ্মভাবে অবলোকন করতেন মানুষের চলাফেরা, সারা দিনের কাজ, খেলা করা আর এর বৈচিত্র্যের মধ্যেই খুঁজে ফিরতেন নতুন কোনো গল্প। তবে এ কথা উল্লেখ্য যে, সেই সময় কবিগুরু এমন কিছু প্রাসাদতুল্য ভবনে অনেক সময় কাটিয়ে ছিলেন যেগুলোর বৈশিষ্ট্য প্রায় একই ধরনের। তার লেখনীর মাধ্যমে সেগুলোর বর্ণনা অনেক ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায়। বৈঠকখানা ও তার চারপাশে লম্বা ও চওড়া থাকার ঘরগুলোর ছাদ প্রায় বিশ ফুটের মতো উচ্চতা। অনেক ক্ষেত্রে ভাস্কর্য তার বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে সাবধানতা অবলম্বন করা বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য। বাংলার প্রকৃতি সর্বদা কবিকে বিমোহিত করত। তাই তো লিখেছিলেন ‘বাংলাদেশের এবং তার প্রান্তবর্তী গাছপালার মধ্যে সূর্যাস্ত যে কি সুন্দর সে আমি কিছুতেই বলিতে পারি না!’ এক বিশাল শান্তি এবং করুণা ঘন সবুজ বনের মধ্যে বাড়িটিকে রবীন্দ্রনাথের নিঃসন্দেহে এতটাই ভালো লেগেছিল যে এই বাড়ির বারান্দায় সারা দিন বসে পাহাড়ি গান, শ্যামল বৃক্ষের ওপর মেঘ বৃষ্টি আর রোদ্রের খেলা দেখতে দেখতে সময় যে কখন পার হয়ে যেত তার ঠিক ছিল না। কবির ভাষায় এই রকম জায়গায় সুদীর্ঘকাল একলা থাকলে অনেক লাভ হতো। কলকাতায় অনেক সময় থেকে নিজেকে সরিয়ে সাহিত্যচর্চার নেশায় অনেক সময় জোড়াসাঁকোতে না থেকে রবিঠাকুর অন্যত্র নিরিবিলি গৃহে সময় কাটাতেন। যেন কেউ তাকে বিরক্ত না করে। এমনি একটি গৃহ আলিপুরের প্রশান্তচন্দ্র গৃহ। যে ঘরটিতে কবি থাকতেন। জানালা দিয়ে বাগান দেখা যেত। বড় বড় গাছগুলো কবিকে জানালার ধারে নিবিড়ভাবে বসিয়ে রাখত। ঘরের জানালার সঙ্গে কবির অন্তরের যোগসূত্র ছিল।
সামাজিক অপরাধে তলিয়ে যাওয়া শহরের স্থাপত্য তিনি নির্ণয় করেছেন ফুলের গন্ধ, পাখির ডাক, জল পড়ার শব্দ সব কিছুর মধ্য দিয়েই। একটি শহরের পথ চলা যেন অগ্রসরমান এক নতুন কম্পোজিশন। কলকাতা আর্ট কলেজে থাকা অবস্থায় তার লেখার মধ্যে এ প্রসঙ্গে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, এ জায়গাটি খুব সুন্দর। একটি বড় পুকুর, বড় বড় গাছ, চাঁপাফুলের গন্ধ আর নিরন্তর পাখির ডাক কলকাতা সমস্ত অপরাধ চাপা দিয়ে রেখেছে। শহরের পাথুরে রাস্তা বেয়ে ওইখানে এসে বসন্ত ঋতু হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। কবি ছিলেন ঋতুরাজের সহচর। একটু ভালো করে দেখলে বোঝা যায় কবিগুরু বাগান অনেক পছন্দ করতেন। আর সেই বাগানে যদি থাকে ম্যাগনেসিয়া, চাঁপা, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, নাগকেশর, গোলাপ, ডালিয়া, লিলি আর থাকে জলের সংস্পর্শ সেই সঙ্গে বাগানে যদি থাকে হাঁটার পথ সেটি হতো কবির অতি পছন্দের স্থান। এ কারণেই হয়তো দীর্ঘদিনের ক্লান্তি দূর করতে হাওয়া বদলের জন্য প্রায় দুই বছরের মতো গঙ্গার তীরে খড়দহের বাগানবাড়িতে নিজে গিয়েছিলেন থাকবেন বলে। শান্তিনিকেতনের স্থাপত্য ও পরিবেশ ভাবনায় কবিগুরুর বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মতো। সেখানকার স্থাপনাগুলো এবং সেই স্থাপনাগুলোকে ঘিরে সেখানকার পরিবেশ যেন শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন একটি সময়ের সূচনা করেছিল। সেখানকার কালোবাড়ি, দক্ষিণ দিকের দেয়ালের রিলিফ ভাস্কর্যের ছবি, ভেতরের দেয়াল এবং বারান্দার আর্টওয়ার্ক, শ্যামলী বাড়ি থেকে শুরু করে শ্রীনিকেতন সবক্ষেত্রেই ছিল কবির মনে লুকিয়ে থাকা স্থাপত্য ও পরিবেশ ভাবনার সমসাময়িক প্রতিচ্ছবি। এই সব স্থাপনার প্রত্যেকটির দেয়াল কবির স্থাপত্য এবং পরিবেশ চিন্তনের নতুন একটি মতাদর্শের দুয়ার খুলে দেয়। যা এই সীমিত পরিসরে ব্যাখ্যা করা মোটেই সম্ভব নয়। যার জন্য প্রয়োজন বিস্তর গবেষণা এবং সেই গবেষণার মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে পারে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্থাপত্য এবং পরিবেশ ভাবনার বিভিন্ন দিক। যাকে কাজে লাগিয়ে সমসাময়িক দেশীয় স্থাপত্যে নতুন একটি মাত্রা যুক্ত হতে পারে এবং স্থাপত্যগুলো আরও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর হতে পারে।(সমাপ্ত)
লেখক শিক্ষক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত।