প্রসঙ্গ : শিল্পকলা একাডেমি
মামুনুর রশীদ | ২০ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
বেশ কিছুদিন ধরেই শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকিকে নিয়ে নানা ধরনের সংবাদ পত্রপত্রিকা এবং মিডিয়ায় সংবাদ আসছে। লিয়াকত আলী লাকি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ছাড়াও শিল্পের জগতে একটি পরিচিত নাম। তিনি চল্লিশ বছর ধরে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল পরে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তারও আগে তিনি ডাকসু’র সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন এবং দীর্ঘদিন সে দায়িত্বও পালন করেছেন। নাটক ছাড়াও সংগীতেও তার পারদর্শিতা রয়েছে।
এখন লিয়াকত আলী লাকির নামে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এসেছে। অভিযোগগুলো প্রমাণ সাপেক্ষ। কিন্তু অভিযোগগুলো দু’একদিনের নয় বেশ অনেক দিন ধরেই বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এ কথা ঠিক, অতীতের চাইতে অনেক বেশি কর্মকা-ে শিল্পকলা নানান কাজে জড়িয়ে গেছে। শুধু তাই নয় নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই বিষয়, প্রচুর জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। সেই জনবল নিয়োগ নিয়েও নানা কথা শোনা যাচ্ছিল। যেসব কথা শোনা যাচ্ছিল সেসব বাংলাদেশে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার এবং তা কখনোই প্রমাণ করা যায় না। তবে জেলায় জেলায় যেসব কালচারাল অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে সে সম্পর্কে অভিযোগগুলো নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে। লাকি নিজেও একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। কালচারাল অফিসাররা কেমন হবেন তা তার ধারণায় আছে। বেশ কয়েকজন কালাচারাল অফিসারের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে, তাদের সঙ্গে কথাবার্তায় এবং একটু অনুসন্ধান করে দেখেছি যে শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাদের কোনো ধারণাই নেই। জেলা প্রশাসকের অধীনে এবং জেলার কর্মকর্তাদের আদেশে এরা কাজ করে থাকেন। জেলা শিল্পকলার উন্নতির ব্যাপারে তাদের কোনো উদ্যোগই নেই। এরকম কথাও শোনা গেছে নানা ধরনের তদবিরে এদের চাকরি হয়েছে।
শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নানান ধরনের প্রকল্পে বেশ সরকারি অর্থ বিনিয়োগ করেছেন, বিশেষ করে বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর পূর্তি এবং মুজিব শতবর্ষে ব্যাপক কর্মকা- হাতে নিয়েছেন। কর্মকা-গুলোর ধরন অনেকটাই সৃজনশীল এবং দেশের গুণী ব্যক্তিদের সংযুক্ত করে করা হয়নি। এইসব প্রকল্পের পরিকল্পনা এবং মূল ভাবনা তার নিজের। আজকাল টেলিভিশনের মালিকদের দেখা যায় তারাও এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। লাকির কী প্রয়োজন আছে এসব করার? দেশে কি যোগ্য লোকের এতই অভাব হয়ে গেছে? শিল্পকলার অধ্যাদেশের মধ্যে একথা স্পষ্ট উল্লেখ ছিল যে, গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত একটি পরিষদ শিল্পকলা একাডেমির কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
লাকি নিজে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সুদীর্ঘ দিন অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি শিল্পকলা একাডেমিকে গণতান্ত্রিক উপায়ে পরিচালনা করার জন্য এতদিন মহাপরিচালক থেকেও কোনো ব্যবস্থা নিলেন না কেন? কেন শিল্পকলা পরিষদের সদস্যরা মন্ত্রণালয় দ্বারা মনোনীত হন? এক সময় বাংলা একাডেমিতে নির্বাচন হতো এবং নির্বাচনের মাধ্যমে একাডেমির নির্বাহী কমিটি গঠিত হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করত। বেশ কিছুদিন হলো সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। মহাপরিচালকরাই এইসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ডের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। শিল্পকলা একাডেমির কাজ সংগীত, চারুকলা, নাটক, চলচ্চিত্র, নৃত্য, যাত্রা
প্রভৃতি বিষয়কে ঘিরে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গত পঞ্চাশ বছরে একটা বিপুল অগ্রগতি হয়েছে। সৃজনশীল কাজের মানুষের অভাব নেই। সবার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে এই বিষয়গুলোতে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত না? শিল্পকলা পরিষদ আছে, তার সদস্যরাও অনেকেই যোগ্য। কিন্তু মন্ত্রী, আমলারাও আছেন সেখানে। যেহেতু শিল্পকলা একাডেমি স্বায়ত্তশাসিত থাকতে পারেনি যেমন থাকতে পারেনি কোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানই। তাই মহাপরিচালকের উচিত ছিল ওই শিল্পকলা পরিষদকে সব কর্মকান্ডের অংশীদার করা। আজ যখন শুধু তারই ওপর সব অভিযোগ আসছে শিল্পকলা পরিষদ যুক্ত থাকলে অভিযোগটা সবার ওপরেই আসত। এ কথাও জানা গেছে শিল্পকলা পরিষদের সঙ্গেও তার দ্বন্দ্ব আছে। শিল্পকলা পরিষদের সুপারিশমালা তিনি গ্রহণ করেন না।
আমি বহুবার বলার চেষ্টা করেছি শিল্পকলা একাডেমির কাজ নিজেরা না করে যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে দেওয়া উচিত। তাহলেও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মহাপরিচালক অনেকটাই মুক্ত হতে পারেন। তাই বলে এ কথা বলতে চাইছি না যে, অন্যের কাঁধে দায়িত্ব চাপিয়ে তিনি তার আকাক্সক্ষাকে অবদমিত করবেন। তিনি সবার প্রস্তাব শুনবেন এবং সর্বশ্রেষ্ঠ প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তগুলো তিনি শিল্পকলা পরিষদ থেকেই অনুমোদন করে নেবেন। তিনি শুধু শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকই নন, বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনেরও সভাপতি। তার গৌরব-অগৌরবের অংশীদার শত শত নাট্যকর্মীও। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না।
আমাদের দেশের মানুষের একাংশের মধ্যে সব কিছুতে একটা নেতিবাচক মনোভাব আছে। কোনো নেতিবাচক ঘটনা পেলে তাকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা, গবেষণা চলতেই থাকে। আবার যদি কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার সুযোগ থাকে তাহলে তার পরিণতি ঘোলাটেই হতে থাকে। বর্তমানে মিডিয়া অত্যন্ত সচেতন। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে নেমে পড়ে তারা। নামতে গিয়ে কখনো মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে যায়। অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষ হলেও তার যেন একটা সিদ্ধান্ত এসে যায়। শিল্পকলা একাডেমির কর্মকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত তারা সবাই শিল্পী, শিল্পীরা সমাজের সবচেয়ে সচেতন মানুষ। এর আগেও বেশ কিছু শিল্পীকে নিয়ে আমি বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি। এক ধরনের মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে গেছে তাদের নামে। সেগুলোকে শেষ পর্যন্ত প্রমাণের জন্য কাউকে অপেক্ষা করাতে পারিনি। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তারা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। শিল্পকলা একাডেমি সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করা, গবেষণা এবং নানা ধরনের শিল্পীদের নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান।
প্রতিদিন সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণে শত শত মানুষ শিল্পের সন্ধানে ঘুরে বেড়ান। শিল্পীদের জন্য তো বটেই একাডেমির প্রতিও মানুষের উচ্চ ধারণা। সেখানে খাবারের ক্ষেত্রে ভুয়া রসিদ বা নানা ধরনের অভিযোগ আসে তার দায়ভার সব শিল্পী সমাজের ওপরই পড়ে। যেভাবে অভিযোগগুলো আসছে তাতে মনে হয় শিল্পকলার নীতিনির্ধারণী এবং অর্থ ব্যয়ের জন্য একমাত্র মহাপরিচালক ছাড়া আর কেউ নেই। একাডেমির আরও অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা সরাসরি সরকারি কর্মকর্তা। দেখা যাচ্ছে কোথাও তাদের নামও আসছে না বা অভিযুক্তও হচ্ছেন না, তাহলে কী দাঁড়ায়? সিদ্ধান্তগুলো তিনি একাই নিয়েছেন। কিন্তু এটা কি সম্ভব? দেখা গেল শিল্পীদের খাবার পছন্দ হয়নি, এগুলো কি মহাপরিচালকের পক্ষে দেখা সম্ভব? এইসব অত্যন্ত তুচ্ছ, অবমাননাকর অভিযোগও মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে আসছে।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন কাজ শুরু করেছে, তদন্ত নয়। দুদকের সিনিয়র আইনজীবীর কাছ থেকে জানা গেল এটি একেবারেই প্রাথমিক একটি পর্যায়ে। কিন্তু পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রাথমিক পর্যায় থেকে শেষ পর্যন্ত ধৈর্য রক্ষা করতে পারবে? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা পারে না। তাই মিডিয়া মিডিয়ার মতোই চলবে। আবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে মিডিয়ার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাও আছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখেছি একজন শিক্ষক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে মানুষ প্রথমে বিশ্বাস করল, শেষ পর্যন্ত কিছু প্রমাণিত না হলেও কালিমাটুকু থেকেই গেল। এ কথাও সত্যি যার ক্ষমতা থাকে তার শত্রু-মিত্রও থাকে।
আমাদের দেশের সরকারি অফিসগুলোতে গোপনীয়তা বলতে কিছু নেই আবার জবাবদিহিও নেই। আমি বিশ্বাস করি সত্যের মতো নিরাপদ কিছু নেই। কাজেই সেই নিরাপদ পথেই আমাদের সবাইকেই হাঁটা উচিত। আমাদের শিল্পীদের প্রাণের প্রতিষ্ঠান এই শিল্পকলা একাডেমি। আমাদের চাওয়া-পাওয়া, অভাব, অভিযোগ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও শিল্পকলা একাডেমির। আমরা চাই না এখানে শীর্ষ পদে যিনি থাকবেন, তিনি বিতর্কিত হন, বিব্রত হন বা কোনো কারণে অভিযুক্ত হন। বিশেষ করে, তিনি যখন আমাদের প্রিয় সহকর্মী, একজন শিল্পী লিয়াকত আলী লাকি।
আমি আবারও বলতে চাই, লাকি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করুক এবং দেশের শত শত শিল্পীকে একটা অস্বস্তিকর, বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করুক।
লেখক নাট্যকার ও অভিনেতা
শেয়ার করুন
মামুনুর রশীদ | ২০ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

বেশ কিছুদিন ধরেই শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকিকে নিয়ে নানা ধরনের সংবাদ পত্রপত্রিকা এবং মিডিয়ায় সংবাদ আসছে। লিয়াকত আলী লাকি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ছাড়াও শিল্পের জগতে একটি পরিচিত নাম। তিনি চল্লিশ বছর ধরে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল পরে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তারও আগে তিনি ডাকসু’র সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন এবং দীর্ঘদিন সে দায়িত্বও পালন করেছেন। নাটক ছাড়াও সংগীতেও তার পারদর্শিতা রয়েছে।
এখন লিয়াকত আলী লাকির নামে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এসেছে। অভিযোগগুলো প্রমাণ সাপেক্ষ। কিন্তু অভিযোগগুলো দু’একদিনের নয় বেশ অনেক দিন ধরেই বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এ কথা ঠিক, অতীতের চাইতে অনেক বেশি কর্মকা-ে শিল্পকলা নানান কাজে জড়িয়ে গেছে। শুধু তাই নয় নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই বিষয়, প্রচুর জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। সেই জনবল নিয়োগ নিয়েও নানা কথা শোনা যাচ্ছিল। যেসব কথা শোনা যাচ্ছিল সেসব বাংলাদেশে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার এবং তা কখনোই প্রমাণ করা যায় না। তবে জেলায় জেলায় যেসব কালচারাল অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে সে সম্পর্কে অভিযোগগুলো নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে। লাকি নিজেও একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। কালচারাল অফিসাররা কেমন হবেন তা তার ধারণায় আছে। বেশ কয়েকজন কালাচারাল অফিসারের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে, তাদের সঙ্গে কথাবার্তায় এবং একটু অনুসন্ধান করে দেখেছি যে শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাদের কোনো ধারণাই নেই। জেলা প্রশাসকের অধীনে এবং জেলার কর্মকর্তাদের আদেশে এরা কাজ করে থাকেন। জেলা শিল্পকলার উন্নতির ব্যাপারে তাদের কোনো উদ্যোগই নেই। এরকম কথাও শোনা গেছে নানা ধরনের তদবিরে এদের চাকরি হয়েছে।
শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নানান ধরনের প্রকল্পে বেশ সরকারি অর্থ বিনিয়োগ করেছেন, বিশেষ করে বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর পূর্তি এবং মুজিব শতবর্ষে ব্যাপক কর্মকা- হাতে নিয়েছেন। কর্মকা-গুলোর ধরন অনেকটাই সৃজনশীল এবং দেশের গুণী ব্যক্তিদের সংযুক্ত করে করা হয়নি। এইসব প্রকল্পের পরিকল্পনা এবং মূল ভাবনা তার নিজের। আজকাল টেলিভিশনের মালিকদের দেখা যায় তারাও এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। লাকির কী প্রয়োজন আছে এসব করার? দেশে কি যোগ্য লোকের এতই অভাব হয়ে গেছে? শিল্পকলার অধ্যাদেশের মধ্যে একথা স্পষ্ট উল্লেখ ছিল যে, গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত একটি পরিষদ শিল্পকলা একাডেমির কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
লাকি নিজে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সুদীর্ঘ দিন অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি শিল্পকলা একাডেমিকে গণতান্ত্রিক উপায়ে পরিচালনা করার জন্য এতদিন মহাপরিচালক থেকেও কোনো ব্যবস্থা নিলেন না কেন? কেন শিল্পকলা পরিষদের সদস্যরা মন্ত্রণালয় দ্বারা মনোনীত হন? এক সময় বাংলা একাডেমিতে নির্বাচন হতো এবং নির্বাচনের মাধ্যমে একাডেমির নির্বাহী কমিটি গঠিত হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করত। বেশ কিছুদিন হলো সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। মহাপরিচালকরাই এইসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ডের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। শিল্পকলা একাডেমির কাজ সংগীত, চারুকলা, নাটক, চলচ্চিত্র, নৃত্য, যাত্রা
প্রভৃতি বিষয়কে ঘিরে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গত পঞ্চাশ বছরে একটা বিপুল অগ্রগতি হয়েছে। সৃজনশীল কাজের মানুষের অভাব নেই। সবার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে এই বিষয়গুলোতে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত না? শিল্পকলা পরিষদ আছে, তার সদস্যরাও অনেকেই যোগ্য। কিন্তু মন্ত্রী, আমলারাও আছেন সেখানে। যেহেতু শিল্পকলা একাডেমি স্বায়ত্তশাসিত থাকতে পারেনি যেমন থাকতে পারেনি কোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানই। তাই মহাপরিচালকের উচিত ছিল ওই শিল্পকলা পরিষদকে সব কর্মকান্ডের অংশীদার করা। আজ যখন শুধু তারই ওপর সব অভিযোগ আসছে শিল্পকলা পরিষদ যুক্ত থাকলে অভিযোগটা সবার ওপরেই আসত। এ কথাও জানা গেছে শিল্পকলা পরিষদের সঙ্গেও তার দ্বন্দ্ব আছে। শিল্পকলা পরিষদের সুপারিশমালা তিনি গ্রহণ করেন না।
আমি বহুবার বলার চেষ্টা করেছি শিল্পকলা একাডেমির কাজ নিজেরা না করে যোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে দেওয়া উচিত। তাহলেও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মহাপরিচালক অনেকটাই মুক্ত হতে পারেন। তাই বলে এ কথা বলতে চাইছি না যে, অন্যের কাঁধে দায়িত্ব চাপিয়ে তিনি তার আকাক্সক্ষাকে অবদমিত করবেন। তিনি সবার প্রস্তাব শুনবেন এবং সর্বশ্রেষ্ঠ প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তগুলো তিনি শিল্পকলা পরিষদ থেকেই অনুমোদন করে নেবেন। তিনি শুধু শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকই নন, বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনেরও সভাপতি। তার গৌরব-অগৌরবের অংশীদার শত শত নাট্যকর্মীও। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না।
আমাদের দেশের মানুষের একাংশের মধ্যে সব কিছুতে একটা নেতিবাচক মনোভাব আছে। কোনো নেতিবাচক ঘটনা পেলে তাকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা, গবেষণা চলতেই থাকে। আবার যদি কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার সুযোগ থাকে তাহলে তার পরিণতি ঘোলাটেই হতে থাকে। বর্তমানে মিডিয়া অত্যন্ত সচেতন। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে নেমে পড়ে তারা। নামতে গিয়ে কখনো মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে যায়। অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষ হলেও তার যেন একটা সিদ্ধান্ত এসে যায়। শিল্পকলা একাডেমির কর্মকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত তারা সবাই শিল্পী, শিল্পীরা সমাজের সবচেয়ে সচেতন মানুষ। এর আগেও বেশ কিছু শিল্পীকে নিয়ে আমি বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি। এক ধরনের মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে গেছে তাদের নামে। সেগুলোকে শেষ পর্যন্ত প্রমাণের জন্য কাউকে অপেক্ষা করাতে পারিনি। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তারা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। শিল্পকলা একাডেমি সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করা, গবেষণা এবং নানা ধরনের শিল্পীদের নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান।
প্রতিদিন সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণে শত শত মানুষ শিল্পের সন্ধানে ঘুরে বেড়ান। শিল্পীদের জন্য তো বটেই একাডেমির প্রতিও মানুষের উচ্চ ধারণা। সেখানে খাবারের ক্ষেত্রে ভুয়া রসিদ বা নানা ধরনের অভিযোগ আসে তার দায়ভার সব শিল্পী সমাজের ওপরই পড়ে। যেভাবে অভিযোগগুলো আসছে তাতে মনে হয় শিল্পকলার নীতিনির্ধারণী এবং অর্থ ব্যয়ের জন্য একমাত্র মহাপরিচালক ছাড়া আর কেউ নেই। একাডেমির আরও অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা সরাসরি সরকারি কর্মকর্তা। দেখা যাচ্ছে কোথাও তাদের নামও আসছে না বা অভিযুক্তও হচ্ছেন না, তাহলে কী দাঁড়ায়? সিদ্ধান্তগুলো তিনি একাই নিয়েছেন। কিন্তু এটা কি সম্ভব? দেখা গেল শিল্পীদের খাবার পছন্দ হয়নি, এগুলো কি মহাপরিচালকের পক্ষে দেখা সম্ভব? এইসব অত্যন্ত তুচ্ছ, অবমাননাকর অভিযোগও মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে আসছে।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন কাজ শুরু করেছে, তদন্ত নয়। দুদকের সিনিয়র আইনজীবীর কাছ থেকে জানা গেল এটি একেবারেই প্রাথমিক একটি পর্যায়ে। কিন্তু পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রাথমিক পর্যায় থেকে শেষ পর্যন্ত ধৈর্য রক্ষা করতে পারবে? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা পারে না। তাই মিডিয়া মিডিয়ার মতোই চলবে। আবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে মিডিয়ার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাও আছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখেছি একজন শিক্ষক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে মানুষ প্রথমে বিশ্বাস করল, শেষ পর্যন্ত কিছু প্রমাণিত না হলেও কালিমাটুকু থেকেই গেল। এ কথাও সত্যি যার ক্ষমতা থাকে তার শত্রু-মিত্রও থাকে।
আমাদের দেশের সরকারি অফিসগুলোতে গোপনীয়তা বলতে কিছু নেই আবার জবাবদিহিও নেই। আমি বিশ্বাস করি সত্যের মতো নিরাপদ কিছু নেই। কাজেই সেই নিরাপদ পথেই আমাদের সবাইকেই হাঁটা উচিত। আমাদের শিল্পীদের প্রাণের প্রতিষ্ঠান এই শিল্পকলা একাডেমি। আমাদের চাওয়া-পাওয়া, অভাব, অভিযোগ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও শিল্পকলা একাডেমির। আমরা চাই না এখানে শীর্ষ পদে যিনি থাকবেন, তিনি বিতর্কিত হন, বিব্রত হন বা কোনো কারণে অভিযুক্ত হন। বিশেষ করে, তিনি যখন আমাদের প্রিয় সহকর্মী, একজন শিল্পী লিয়াকত আলী লাকি।
আমি আবারও বলতে চাই, লাকি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করুক এবং দেশের শত শত শিল্পীকে একটা অস্বস্তিকর, বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করুক।
লেখক নাট্যকার ও অভিনেতা