নারায়ণগঞ্জ : নির্বাচনে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ
সায়ন্থ সাখাওয়াৎ | ২০ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনটি কাউকে কাউকে হয়তো কিছুটা নস্টালজিক করে তুলেছে। অনেকেই মনে করার চেষ্টা করেছেন, শেষ কবে এমন নির্বাচন দেখেছেন যেখানে মানুষ নির্বিঘেœ ভোট দিতে পেরেছে। যে নির্বাচনে নিহত বা তেমন কোনো আহত হওয়ার মতো সংঘর্ষ হয়নি। যে নির্বাচন শেষে পরাজিত প্রার্থী কিছু অনিয়ম এবং ইভিএম জালিয়াতির সন্দেহ প্রকাশ করলেও ফলাফল মেনে নিয়েছেন। যে নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী পরাজিত প্রার্থীর বাসায় মিষ্টি নিয়ে গেছেন এবং পরাজিত প্রার্থী তার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করেছেন। এমন নির্বাচনই তো মানুষ চায়। কিন্তু সে নির্বাচন তো এ দেশে পুরোপুরি নির্বাসনে।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, তাদের পাঁচ বছরে কুমিল্লার একটি ও নারায়ণগঞ্জের এ নির্বাচনটি সেরা। নারায়ণগঞ্জ একটি বিশেষ এলাকা যা দেশের অনেক এলাকার সঙ্গেই মিলবে না। এ সিটির নির্বাচনে ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী চিন্তা দলের ও মার্কার চেয়েও বেশি প্রাধান্য পাওয়ার নজির আছে। এখানে শামীম ওসমান এমপি ও মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভির পারিবারিক ও ব্যক্তিদ্বন্দ্ব সব সময়ই প্রকট। তিনি প্রকাশ্যেই শামীম ওসমানকে একজন গডফাদার বলেন। আর শামীম ওসমান আইভীকে বলেন, গডমাদার। নির্বাচনের শুরুতেই সেলিনা হায়াৎ আইভী তার চির প্রতিপক্ষ শামীম ওসমানকে ঠেলে দিয়েছেন বিএনপি থেকে অব্যাহতি দেওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের দিকে। ‘ওসমানকার্ড’ দারুণ খেলেছেন আইভী এবং দিন শেষের হিসাবে দেখা যাচ্ছে তা কাজেও লেগেছে। তিনি শামীম ওসমানকে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের দিকে ঠেলে দিয়ে ‘গডফাদার’বিরোধী ভোটের একচেটিয়া মালিক হওয়ার চেষ্টায় অনেকটা সফল হয়েছেন।
শামীম ওসমানবিরোধী শিবিরের অন্তর্ভুক্ত বিএনপি-জামায়াতের অনেকের ভোটও ব্যক্তি সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাক্সে গেছে বলে অনেকেই মনে করেন। অনেকে বলেন, এই নির্বাচনে শুধু তৈমূর আলম খন্দকার হারেননি, হেরেছেন শামীম ওসমানও। শামীম ওসমান প্রকাশ্যে প্রেস কনফারেন্স করে নৌকার পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করলেও তিনি আইভীর পক্ষে ছিলেন না বলেই প্রচার আছে। তার প্রমাণ হিসেবে কেউ কেউ মনে করিয়ে দেন, শামীম ওসমানের কেন্দ্রে আইভীর নৌকা ৩৬২ ভোট পেলেও তৈমূর আলম খন্দকারের হাতি পেয়েছে ৬৮০ ভোট!
এই নির্বাচনে ইভিএম জটিলতা মানুষকে ভুগিয়েছে। এমনিতেই ২০১৪ সালের পর থেকে সারা দেশের নির্বাচন দেখে ভোটে মানুষের অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। তার ওপর ইভিএম বিড়ম্বনা। তাই ভোটের হার কম। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ভোট পড়েছে ৫০ শতাংশ। যেখানে ২০১১ সালে পড়েছিল ৭৩ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ছিল ৬২ শতাংশ। স্বতন্ত্র, নৌকা মার্কা ছাড়া আওয়ামী লীগ ও নৌকার আওয়ামী লীগ এই তিনভাবেই মেয়র আইভী প্রমাণ করেছেন তিনি নারায়ণগঞ্জ শহরের যোগ্য ও জনপ্রিয় নেতা। ২০১১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভী ১,৮০,০৪৮ ভোট ও আওয়ামী লীগ প্রার্থী শামীম ওসমান ৭৮,৭০৫ ভোট পেয়েছিলেন। ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আইভী নৌকা মার্কা ছাড়াই ১,৭৫,৬১১ ভোট ও বিএনপি প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন ৯৬,০৪৪ ভোট পেয়েছিলেন। আর ২০২২ সালে নৌকা মার্কা নিয়ে আইভী ১,৫৯,০৯৭ ভোট ও হাতি মার্কা নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার ৯২,৫৬২ ভোট পেয়েছেন। ভোটের এই ধারাবাহিক হিসাব বলে দেয় ব্যক্তি মেয়র আইভীর জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক কারিশমার কথা।
ভোটের ফলাফল যাই হোক সেটা সাধারণ মানুষের জন্য বড় ইস্যু নয়। নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবেই। কিন্তু এই নির্বাচনটি কেন কীভাবে এতটা গ্রহণযোগ্য হলো সেই প্রশ্নই ব্যাপক আলোচনার বিষয়। সেই একই নির্বাচন কমিশন, একই সরকার, একই প্রশাসন। কিন্তু নির্বাচনটি ২০১৪-পরবর্তী নির্বাচনী সংস্কৃতির বাইরের বিচ্ছিন্ন একটি বিষয় হয়ে গেল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের কথা মানুষ কোনো দিন ভুলবে না। যে নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টিতে কোনো নির্বাচনের দরকারই হয়নি। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৫১ আসনের চেয়েও অতিরিক্ত তিনটি আসনে অটো এমপি হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল তাতে। আর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের রাতে ও দিনে অনুষ্ঠিত বিশেষ নির্বাচন নিয়ে অনেক বিদেশি গণমাধ্যমের মতো প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকোনমিস্টও এই নির্বাচনকে বলেছে একটি স্বচ্ছ জালিয়াতির নির্বাচন। ‘অবিচুয়ারি অব এ ডেমোক্রেসি : বাংলাদেশ’ নিবন্ধে পত্রিকাটি বাংলাদেশের সে নির্বাচনকে বলেছে একটি ‘ফ্রডুলেন্টলি ট্রান্সপারেন্ট ইলেকশন’। সে নির্বাচনে গোপালগঞ্জ-১ আসনের ফারুক খান ছাড়াও ৯৯ শতাংশ ভোট পাওয়া প্রার্থীর মধ্যে আছেন সিরাজগঞ্জ-১ আসনে মোহাম্মদ নাসিম (প্রয়াত), গোপালগঞ্জ-২ আসনে শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মাদারীপুর-১ আসনে নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন, শরীয়তপুর-১ আসনে ইকবাল হোসেন। এসব আসনে ধানের শীষের প্রার্থীরা ১ শতাংশের কম ভোট পেয়েছেন। নির্বাচনে ৪১ হাজারের বেশি কেন্দ্রে ভোট হয়। এতে ২১৩ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ৭ হাজার ৬৮৯ কেন্দ্রে ৯০ থেকে ৯৯.৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। সংসদ নির্বাচনে গড় ভোট পড়েছে ৭৯.৩৬ শতাংশ।
কিন্তু কেন এতটা অস্বাভাবিক ফলাফল হয়েছিল সে নির্বাচনে? তার একটা ধারণা পাওয়া যায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির দেওয়া তথ্যেও। ‘একাদশ সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা’ শীর্ষক গবেষণার প্রাথমিক প্রতিবেদনে টিআইবি জানায়, ৩০০ আসনের মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে বেছে নেওয়া ৫০টি আসনের ৪৭টিতে নির্বাচনের দিন কোনো না কোনো অনিয়ম হয়েছে। ৩৩টি আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারার ঘটনা পেয়েছে বলে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়।
নির্বাচনটি এতটাই বাজে হয়েছে যে, শুধু বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, সিপিবিসহ সরকারবিরোধী অংশই নয়, সরকারের শরিক দলগুলো থেকেও জালিয়াতির অভিযোগ বা দায় স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা নৌকার এমপি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘বিগত নির্বাচনে আমিও নির্বাচিত (এমপি) হয়েছি। তার পরও আমি সাক্ষ্য দিয়ে বলছি, গত নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। জাতীয়, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কোথাও ভোট দিতে পারেনি দেশের মানুষ।’
এই দুটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যবর্তী ও ২০১৮ সালের পর অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো হয়েছে ব্যাপক বিতর্কিত, সহিংস ও একপেশে। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে দেশের প্রথমসারির সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম ছিল এ রকম ভোটারদের অপেক্ষায় সাংবাদিকরা, রোদ উঠলেও ভোটার নেই, ভোটারের লাইন সাজিয়ে হঠাৎ উধাও তারা, ব্যালট বাক্স খালি কর্মকর্তা বললেন ‘ভোট পড়েছে’, কত ভোট পড়েছে জানাতে চাচ্ছেন না প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা, দুই কেন্দ্রে আড়াই ঘণ্টায় একটিও ভোট পড়েনি, কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঘুরেও ভোটারদের দেখা পাইনি : শাফিন, ভোটার ৯ হাজার : চার ঘণ্টায় ভোট ১৫৮, ‘দেরি করে এলেও আমি প্রথম ভোটার’, DNCC by polls : Officials, agents spend layy time, যদি একটা ভোটও পড়ত! আক্ষেপ নির্বাচন কর্মকর্তার, ভোটারের জন্য দিনভর অপেক্ষা, টিভির সম্প্রচার শেষ তো লাইনও শেষ! এ ধরনের অসংখ্য শিরোনাম ছিল প্রায় সবগুলো সংবাদপত্রেই। সে নির্বাচনে কমিশন প্রদত্ত ভোটের হার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ দেখালেও মানুষ প্রদত্ত ভোট কোনোভাবেই ৩ থেকে ৫ শতাংশের বেশি হবে না বলেই অনেকে বলেছিলেন। একই বছর অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনেও দেশের প্রথমসারির সংবাদমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম ছিল এমন ভোটগ্রহণের দায়িত্বে ৩৬, ভোট পড়েছে ৬৭ (প্রথম আলো), ভোটারের দেখা নেই কেন্দ্রে (জাগো নিউজ), বগুড়ায় ভোটার কম দোলনায় আনসারদের খেলা (যুগান্তর), বগুড়ার শেরপুরে এক কেন্দ্রে ৪১ ভোট (যুগান্তর), তিন হাজার ভোটে ভোট পড়েছে ৪১ ভোট! (যুগান্তর), প্রার্থী নেই, ভোটহীন ৩০ উপজেলা (প্রথম আলো), মৌলভীবাজারের এক বুথে একটিও ভোট পড়েনি (যুগান্তর), দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনেও নেই ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ (যমুনা টিভি), ফরিদপুরে ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার নেই (বাংলাদেশ প্রতিদিন), ভোটার ৭৬১ দুই কক্ষে ভোট পড়েনি একটিও (মানবজমিন), দায়িত্বে ছিলেন ৪১ জন ভোটও পড়েছে ৪১টি (এনটিভি), ভোটার ৫৩৬০ জন, ৫ ঘণ্টায় আসেনি একজনও (নয়া দিগন্ত), ভোটারের অপেক্ষায় (দেশ রূপান্তর)। পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত ৪৭৩টি উপজেলার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ১০৯টিতে চেয়ারম্যান পদে ভোটেরই প্রয়োজন হয়নি। অন্তত ৩৪টি উপজেলার সব কটি পদ অর্থাৎ চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন।
সাম্প্রতিককালে সারা দেশে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও চলছে ব্যাপক সহিংস ও একতরফা নির্বাচন। বিএনপির বয়কট করা এ নির্বাচনে এরই মধ্যে প্রায় দেড় হাজার প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন। নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন শতাধিক মানুষ। সারা দেশে গত এক দশকের যে নির্বাচন চিত্র তার সঙ্গে কিছুতেই মিলছে না নারায়ণগঞ্জ। এখানে নৌকার প্রার্থী আইভীর মতো জনপ্রিয় ও ক্যারিশমেটিক নেতা হওয়ায় এবং বিএনপি বয়কট করায় আওয়ামী লীগ নিশ্চিত ছিল যে ‘ট্রান্সপারেন্টলি ফ্রডুলেন্ট’ নির্বাচন করার দরকার হবে না। আর রেজাল্টে আশানুরূপ ফল না দেখলে ইভিএম তো আছেই, যাতে ফল ঘুরিয়ে দেওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। তাই হয়তো সরকারের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বৈরী সময়ে কোনো প্রকাশ্য দৃষ্টিকটু জালিয়াতি করা হয়নি এ নির্বাচনে। তাই বলে কেউ দয়া করে ভাববেন না যে, দেশ থেকে ভোট ডাকাতি উঠে গেছে।
লেখক চিকিৎসক ও কলামনিস্ট
শেয়ার করুন
সায়ন্থ সাখাওয়াৎ | ২০ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনটি কাউকে কাউকে হয়তো কিছুটা নস্টালজিক করে তুলেছে। অনেকেই মনে করার চেষ্টা করেছেন, শেষ কবে এমন নির্বাচন দেখেছেন যেখানে মানুষ নির্বিঘেœ ভোট দিতে পেরেছে। যে নির্বাচনে নিহত বা তেমন কোনো আহত হওয়ার মতো সংঘর্ষ হয়নি। যে নির্বাচন শেষে পরাজিত প্রার্থী কিছু অনিয়ম এবং ইভিএম জালিয়াতির সন্দেহ প্রকাশ করলেও ফলাফল মেনে নিয়েছেন। যে নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী পরাজিত প্রার্থীর বাসায় মিষ্টি নিয়ে গেছেন এবং পরাজিত প্রার্থী তার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করেছেন। এমন নির্বাচনই তো মানুষ চায়। কিন্তু সে নির্বাচন তো এ দেশে পুরোপুরি নির্বাসনে।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, তাদের পাঁচ বছরে কুমিল্লার একটি ও নারায়ণগঞ্জের এ নির্বাচনটি সেরা। নারায়ণগঞ্জ একটি বিশেষ এলাকা যা দেশের অনেক এলাকার সঙ্গেই মিলবে না। এ সিটির নির্বাচনে ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী চিন্তা দলের ও মার্কার চেয়েও বেশি প্রাধান্য পাওয়ার নজির আছে। এখানে শামীম ওসমান এমপি ও মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভির পারিবারিক ও ব্যক্তিদ্বন্দ্ব সব সময়ই প্রকট। তিনি প্রকাশ্যেই শামীম ওসমানকে একজন গডফাদার বলেন। আর শামীম ওসমান আইভীকে বলেন, গডমাদার। নির্বাচনের শুরুতেই সেলিনা হায়াৎ আইভী তার চির প্রতিপক্ষ শামীম ওসমানকে ঠেলে দিয়েছেন বিএনপি থেকে অব্যাহতি দেওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের দিকে। ‘ওসমানকার্ড’ দারুণ খেলেছেন আইভী এবং দিন শেষের হিসাবে দেখা যাচ্ছে তা কাজেও লেগেছে। তিনি শামীম ওসমানকে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের দিকে ঠেলে দিয়ে ‘গডফাদার’বিরোধী ভোটের একচেটিয়া মালিক হওয়ার চেষ্টায় অনেকটা সফল হয়েছেন।
শামীম ওসমানবিরোধী শিবিরের অন্তর্ভুক্ত বিএনপি-জামায়াতের অনেকের ভোটও ব্যক্তি সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাক্সে গেছে বলে অনেকেই মনে করেন। অনেকে বলেন, এই নির্বাচনে শুধু তৈমূর আলম খন্দকার হারেননি, হেরেছেন শামীম ওসমানও। শামীম ওসমান প্রকাশ্যে প্রেস কনফারেন্স করে নৌকার পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করলেও তিনি আইভীর পক্ষে ছিলেন না বলেই প্রচার আছে। তার প্রমাণ হিসেবে কেউ কেউ মনে করিয়ে দেন, শামীম ওসমানের কেন্দ্রে আইভীর নৌকা ৩৬২ ভোট পেলেও তৈমূর আলম খন্দকারের হাতি পেয়েছে ৬৮০ ভোট!
এই নির্বাচনে ইভিএম জটিলতা মানুষকে ভুগিয়েছে। এমনিতেই ২০১৪ সালের পর থেকে সারা দেশের নির্বাচন দেখে ভোটে মানুষের অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। তার ওপর ইভিএম বিড়ম্বনা। তাই ভোটের হার কম। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ভোট পড়েছে ৫০ শতাংশ। যেখানে ২০১১ সালে পড়েছিল ৭৩ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ছিল ৬২ শতাংশ। স্বতন্ত্র, নৌকা মার্কা ছাড়া আওয়ামী লীগ ও নৌকার আওয়ামী লীগ এই তিনভাবেই মেয়র আইভী প্রমাণ করেছেন তিনি নারায়ণগঞ্জ শহরের যোগ্য ও জনপ্রিয় নেতা। ২০১১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভী ১,৮০,০৪৮ ভোট ও আওয়ামী লীগ প্রার্থী শামীম ওসমান ৭৮,৭০৫ ভোট পেয়েছিলেন। ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আইভী নৌকা মার্কা ছাড়াই ১,৭৫,৬১১ ভোট ও বিএনপি প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন ৯৬,০৪৪ ভোট পেয়েছিলেন। আর ২০২২ সালে নৌকা মার্কা নিয়ে আইভী ১,৫৯,০৯৭ ভোট ও হাতি মার্কা নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার ৯২,৫৬২ ভোট পেয়েছেন। ভোটের এই ধারাবাহিক হিসাব বলে দেয় ব্যক্তি মেয়র আইভীর জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক কারিশমার কথা।
ভোটের ফলাফল যাই হোক সেটা সাধারণ মানুষের জন্য বড় ইস্যু নয়। নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবেই। কিন্তু এই নির্বাচনটি কেন কীভাবে এতটা গ্রহণযোগ্য হলো সেই প্রশ্নই ব্যাপক আলোচনার বিষয়। সেই একই নির্বাচন কমিশন, একই সরকার, একই প্রশাসন। কিন্তু নির্বাচনটি ২০১৪-পরবর্তী নির্বাচনী সংস্কৃতির বাইরের বিচ্ছিন্ন একটি বিষয় হয়ে গেল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের কথা মানুষ কোনো দিন ভুলবে না। যে নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টিতে কোনো নির্বাচনের দরকারই হয়নি। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৫১ আসনের চেয়েও অতিরিক্ত তিনটি আসনে অটো এমপি হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল তাতে। আর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের রাতে ও দিনে অনুষ্ঠিত বিশেষ নির্বাচন নিয়ে অনেক বিদেশি গণমাধ্যমের মতো প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকোনমিস্টও এই নির্বাচনকে বলেছে একটি স্বচ্ছ জালিয়াতির নির্বাচন। ‘অবিচুয়ারি অব এ ডেমোক্রেসি : বাংলাদেশ’ নিবন্ধে পত্রিকাটি বাংলাদেশের সে নির্বাচনকে বলেছে একটি ‘ফ্রডুলেন্টলি ট্রান্সপারেন্ট ইলেকশন’। সে নির্বাচনে গোপালগঞ্জ-১ আসনের ফারুক খান ছাড়াও ৯৯ শতাংশ ভোট পাওয়া প্রার্থীর মধ্যে আছেন সিরাজগঞ্জ-১ আসনে মোহাম্মদ নাসিম (প্রয়াত), গোপালগঞ্জ-২ আসনে শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মাদারীপুর-১ আসনে নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন, শরীয়তপুর-১ আসনে ইকবাল হোসেন। এসব আসনে ধানের শীষের প্রার্থীরা ১ শতাংশের কম ভোট পেয়েছেন। নির্বাচনে ৪১ হাজারের বেশি কেন্দ্রে ভোট হয়। এতে ২১৩ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ৭ হাজার ৬৮৯ কেন্দ্রে ৯০ থেকে ৯৯.৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। সংসদ নির্বাচনে গড় ভোট পড়েছে ৭৯.৩৬ শতাংশ।
কিন্তু কেন এতটা অস্বাভাবিক ফলাফল হয়েছিল সে নির্বাচনে? তার একটা ধারণা পাওয়া যায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির দেওয়া তথ্যেও। ‘একাদশ সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা’ শীর্ষক গবেষণার প্রাথমিক প্রতিবেদনে টিআইবি জানায়, ৩০০ আসনের মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে বেছে নেওয়া ৫০টি আসনের ৪৭টিতে নির্বাচনের দিন কোনো না কোনো অনিয়ম হয়েছে। ৩৩টি আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারার ঘটনা পেয়েছে বলে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়।
নির্বাচনটি এতটাই বাজে হয়েছে যে, শুধু বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, সিপিবিসহ সরকারবিরোধী অংশই নয়, সরকারের শরিক দলগুলো থেকেও জালিয়াতির অভিযোগ বা দায় স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা নৌকার এমপি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘বিগত নির্বাচনে আমিও নির্বাচিত (এমপি) হয়েছি। তার পরও আমি সাক্ষ্য দিয়ে বলছি, গত নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। জাতীয়, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কোথাও ভোট দিতে পারেনি দেশের মানুষ।’
এই দুটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যবর্তী ও ২০১৮ সালের পর অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো হয়েছে ব্যাপক বিতর্কিত, সহিংস ও একপেশে। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে দেশের প্রথমসারির সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম ছিল এ রকম ভোটারদের অপেক্ষায় সাংবাদিকরা, রোদ উঠলেও ভোটার নেই, ভোটারের লাইন সাজিয়ে হঠাৎ উধাও তারা, ব্যালট বাক্স খালি কর্মকর্তা বললেন ‘ভোট পড়েছে’, কত ভোট পড়েছে জানাতে চাচ্ছেন না প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা, দুই কেন্দ্রে আড়াই ঘণ্টায় একটিও ভোট পড়েনি, কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঘুরেও ভোটারদের দেখা পাইনি : শাফিন, ভোটার ৯ হাজার : চার ঘণ্টায় ভোট ১৫৮, ‘দেরি করে এলেও আমি প্রথম ভোটার’, DNCC by polls : Officials, agents spend layy time, যদি একটা ভোটও পড়ত! আক্ষেপ নির্বাচন কর্মকর্তার, ভোটারের জন্য দিনভর অপেক্ষা, টিভির সম্প্রচার শেষ তো লাইনও শেষ! এ ধরনের অসংখ্য শিরোনাম ছিল প্রায় সবগুলো সংবাদপত্রেই। সে নির্বাচনে কমিশন প্রদত্ত ভোটের হার ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ দেখালেও মানুষ প্রদত্ত ভোট কোনোভাবেই ৩ থেকে ৫ শতাংশের বেশি হবে না বলেই অনেকে বলেছিলেন। একই বছর অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনেও দেশের প্রথমসারির সংবাদমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম ছিল এমন ভোটগ্রহণের দায়িত্বে ৩৬, ভোট পড়েছে ৬৭ (প্রথম আলো), ভোটারের দেখা নেই কেন্দ্রে (জাগো নিউজ), বগুড়ায় ভোটার কম দোলনায় আনসারদের খেলা (যুগান্তর), বগুড়ার শেরপুরে এক কেন্দ্রে ৪১ ভোট (যুগান্তর), তিন হাজার ভোটে ভোট পড়েছে ৪১ ভোট! (যুগান্তর), প্রার্থী নেই, ভোটহীন ৩০ উপজেলা (প্রথম আলো), মৌলভীবাজারের এক বুথে একটিও ভোট পড়েনি (যুগান্তর), দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনেও নেই ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ (যমুনা টিভি), ফরিদপুরে ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার নেই (বাংলাদেশ প্রতিদিন), ভোটার ৭৬১ দুই কক্ষে ভোট পড়েনি একটিও (মানবজমিন), দায়িত্বে ছিলেন ৪১ জন ভোটও পড়েছে ৪১টি (এনটিভি), ভোটার ৫৩৬০ জন, ৫ ঘণ্টায় আসেনি একজনও (নয়া দিগন্ত), ভোটারের অপেক্ষায় (দেশ রূপান্তর)। পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত ৪৭৩টি উপজেলার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ১০৯টিতে চেয়ারম্যান পদে ভোটেরই প্রয়োজন হয়নি। অন্তত ৩৪টি উপজেলার সব কটি পদ অর্থাৎ চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন।
সাম্প্রতিককালে সারা দেশে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও চলছে ব্যাপক সহিংস ও একতরফা নির্বাচন। বিএনপির বয়কট করা এ নির্বাচনে এরই মধ্যে প্রায় দেড় হাজার প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন। নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন শতাধিক মানুষ। সারা দেশে গত এক দশকের যে নির্বাচন চিত্র তার সঙ্গে কিছুতেই মিলছে না নারায়ণগঞ্জ। এখানে নৌকার প্রার্থী আইভীর মতো জনপ্রিয় ও ক্যারিশমেটিক নেতা হওয়ায় এবং বিএনপি বয়কট করায় আওয়ামী লীগ নিশ্চিত ছিল যে ‘ট্রান্সপারেন্টলি ফ্রডুলেন্ট’ নির্বাচন করার দরকার হবে না। আর রেজাল্টে আশানুরূপ ফল না দেখলে ইভিএম তো আছেই, যাতে ফল ঘুরিয়ে দেওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। তাই হয়তো সরকারের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বৈরী সময়ে কোনো প্রকাশ্য দৃষ্টিকটু জালিয়াতি করা হয়নি এ নির্বাচনে। তাই বলে কেউ দয়া করে ভাববেন না যে, দেশ থেকে ভোট ডাকাতি উঠে গেছে।
লেখক চিকিৎসক ও কলামনিস্ট