আলুর দাম, প্রক্রিয়াকরণ ও মূল্য কমিশন
নিতাই চন্দ্র রায় | ২৩ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, লালমনিহাট ও কুড়িগ্রামের কৃষক লাভের আশায় আগাম আমন ধান কেটে এবার ওই জমিতে আগাম গ্র্যানুলা জাতের আলু রোপণ করেন। আগাম আলু চাষের সুবিধা হলো, আলু স্বল্প সময়ের ফসল। রোপণের ৭৫ থেকে ৮০ দিনের মধ্যে তা তুলে বাজারে বিক্রি করা যায়। আগাম আলুর দাম থাকে বেশি। কখনো কখনো এক কেজি নতুন আলু ৬০ থেকে ৭০ টাকা বিক্রি হয়। অন্যদিকে বগুড়া, জয়পুরহাট অঞ্চলের কৃষক পাকড়ি জাতের লাল আলুর আগাম চাষ করেন। কৃষক আগাম জাতের এসব আলু বিক্রি করে প্রচুর লাভবান হন। কিন্তু এ বছর আলু উৎপাদনকারী অঞ্চলে ঘটেছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা। দিনাজপুর জেলার আবহাওয়া ও বেলে দোআঁশ মাটি আলু চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। লাভের আশায় দিনাজপুর সদর উপজেলার এক কৃষক অন্যের জমি লিজ নিয়ে ছয় একর জমিতে আলুর চাষ করেন। এতে জমি লিজের টাকাসহ তার খরচ হয় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। কৃষক তার আলু উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামে বিক্রি করে দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে দুর্বিষহ দিন যাপন করছেন। প্রতি কেজি আলু তিনি মাত্র ৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে চোখের জলে বুক ভাসিয়েছেন।
এক বিঘা জমিতে আগাম আলু উৎপাদন করতে সাধারণত ২০ থেকে ২৪ হাজার টাকা খরচ হয়। আর এক বিঘা জমি থেকে ৫৫ থেকে ৬০ মণ আলু পাওয়া যায়। সে হিসেবে প্রতি কেজি আগাম আলুর উৎপাদন খরচ পড়ে ১০ টাকা। এবার এভাবে প্রতি কেজি আলুতে কৃষকের লোকসান হচ্ছে ৪ টাকা। এক বিঘাতে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৬০০ টাকা। তাহলে কৃষক বাঁচবে কীভাবে? বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার আরেকজন প্রগতিশীল আলু চাষি তার তিন বিঘা জমিতে আলু উৎপাদন করছেন ২০০ মণ। ৮০ হাজার টাকা খরচ করে তিনি আলু বিক্রি করে পেয়েছেন মাত্র ৫৬ হাজার টাকা। লোকসান হয়েছে ২৪ হাজার টাকা। একই রকম অবস্থা বিরাজ করছে মুন্সীগঞ্জ, লালমনিরহাট, যশোর, বগুড়া, জয়পুরহাট, হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন আলু উৎপাদন এলাকায়। অসময়ে বৃষ্টির কারণে শীতকালীন সবজি নষ্ট হওয়ায় এবার সবজির দাম বেশ চড়া। বর্তমানে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে প্রতিকেজি বেগুন ও টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। মাঝারি ধরনের ফুলকপি, বাঁধাকপি প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। করলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮০ টাকা। লাউ বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। সাধারণত দেখা যায় অন্যান্য সবজির দাম বেশি থাকলে আলুর দামও বেশি থাকে।
কিন্তু বর্তমানে বাজারে গত বছরের পুরনো আলু ও নতুন আলু বিক্রি হচ্ছে একই সময়ে। এখনো বগুড়ার বেশ কিছু হিমাগারে পুরনো আলু মজুদ আছে। সেই আলুগুলো ২০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। কিছু ব্যাপারী লাভের আশায় সেই সব আলু ধুয়ে বাইরের জেলাগুলোতে নিয়ে যাচ্ছেন। এজন্যই নতুন আলু বিক্রিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। বগুড়ার বিখ্যাত মহাস্থান পাইকারি বাজারে বর্তমানে নতুন আলু সাত থেকে আট টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। অথচ দুই সপ্তাহ আগেও এই আলু বিক্রি হয়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি দরে। হঠাৎ আলুর দরপতনে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষক। লোকসানের ভয়ে অনেক কৃষক জমি থেকে আলু তোলার সাহস পাচ্ছেন না। মহাস্থান হাটে গ্র্যানুলা জাতের সাদা আলু বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৬০ টাকা মণ দরে। আর অ্যাস্ট্রারিক, ডায়মন্ড, ক্যারেট জাতের আলু বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা মণ দরে। নতুন আলু বাজারে উঠলেও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন হিমাগারে প্রচুর পুরনো আলু মজুদ রয়েছে। এই সব হিমাগারে থাকা ৫০ কেজি বস্তার আলু পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১৫০ টাকায়। সে হিসেবে প্রতি কেজি আলুর দাম পড়ছে মাত্র তিন টাকা। প্রতি কেজি গ্র্যানুলা জাতের আলু ত্রিশাল, ফুলবাড়িয়া ও ভালুকা উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা কেজি দরে। কার্ডিনাল জাতের আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা কেজি দরে। অথচ গত বছর এই সময়ে নতুন জাতের আলু বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে। এক বছর আলুর দাম বাড়লেও পরের বছর দরপতন ঘটে। কৃষককে লোকসান দিয়ে আলু বিক্রি করতে হয়। লাভ-লোকসানের এই চক্রের সঙ্গে কৃষক আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকারী কৃষকের যদি কৃষিপণ্য উৎপাদন করে লোকসান দিতে হয়, ঋণে জর্জরিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়, তাহলে কেন তারা করতে যাবেন কৃষিকাজ? বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে দেশের নীতিনির্ধারকদের। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতে, দেশে আলুর চাহিদা বছরে ৮০ থেকে ৯০ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু ২০২১ সালে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৬ লাখ মেট্রিক টন। এ বছর ৪ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর জমি থেকে আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ কোটি ৬ লাখ ৫১ হাজার মেট্রিক টন। ২০২০ সালে দেশে ৯৫ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়। করোনাকালে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সারা দেশে ত্রাণ কাজে অনেক আলু বিতরণ করা হয়। ফলে শেষের দিকে আলু সংকট দেখা দেয়। হু হু করে বেড়ে যায় বাজারে আলুর দাম। ওই সময় রাজধানী ঢাকা শহরে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজিতে। সরকার আলুর দাম ২৭ থেকে ৩৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও আলু ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকরা তখন তাতে কর্ণপাত করেননি। কৃষি বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন, উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের বহুমুখীকরণ না হওয়ায় উৎপাদিত আলুর একটি বড় অংশ প্রতি বছর নষ্ট হয়ে যায়। কৃষকও বঞ্চিত হন ন্যায্যমূল্য থেকে। এ জন্য রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি আলু উৎপাদন এলাকায় আলু প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন করা প্রয়োজন। প্রয়োজন কৃষিপণ্যের একটি জাতীয় মূল্য কমিশন গঠন করা।
২০২০ সালে কৃষক আলুর ভালো দাম পেয়েছিলেন। তাই পরেরর বছর বেশি আবাদ করেছেন। কিন্তু গত বছরের মতো এবারও আলুর দাম নিম্নমুখী। গত বছর প্রায় ২০ লাখ টন আলু হিমাগারগুলোতে উদ্বৃত্ত থেকে যায়। এবারও সংরক্ষিত আলু সময়মতো বাজারজাত করতে না পারলে বিপুল পরিমাণ আলু অবিক্রীত থেকে যাবে। ন্যায্যমূল্য না পেয়ে কৃষক আগামীতেও আলু চাষে নিরুৎসাহিত হতে পারেন। কৃষকের আলুর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে প্রক্রিয়াজাত কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি ও রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এক লাখ দুই হাজার টন আলু রপ্তানি হয়। করোনাসহ বিভিন্ন কারণে আলু রপ্তানি হ্রাস পেয়ে সেটি ২০২০-২১ অর্থবছরে দাঁড়ায় ৫৬ হাজার মেট্রিক টনে। উৎপাদিত এক কোটি টন আলুর মধ্যে মাত্র ৫৬ হাজার মেট্রিক টন আলু রপ্তানিতে, কতটুকুই বা প্রভাব পড়ে পণ্যটির বাজারমূল্যে? রাশিয়াতে আলু রপ্তানি কৃষকের মধ্যে সামান্য আশা জাগালেও আলুতে ব্রাউন রট নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের কারণে দেশটিতে আলু রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। যদিও রাশিয়ার সেই আপত্তি নিরসন হয়েছে এবং ব্যাকটেরিয়ামুক্ত আলু উৎপাদনের বিষয়টি ইতিমধ্যে রাশিয়াকে জানানো হয়েছে। এ মুহূর্তে একলাখ টন আলু রপ্তানির কথা ভাবছে সরকার। বিশ্বের কোন কোন দেশে বাংলাদেশি আলুর চাহিদা রয়েছে, তা জানতে সব দেশের মিশনগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা: নতুন আলু বাজারে আসতে শুরু করায় আলুর দাম কিছুটা কমেছে, যার মূল্য অচিরেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার মনে হয়, কিছুদিন আগে অসময়ে বৃষ্টি ও তীব্র ঠান্ডা ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে আলু ক্ষেতে বিলম্বধসা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এবং এক সঙ্গে বিপুল পরিমাণ আলু কৃষক উত্তোলন করতে বাধ্য হন। আলুর অস্বাভাবিক দরপতনের এটিও একটি কারণ হতে পারে।
আলুর মূল্য সংকট দূর করতে ২০২৫ সাল নাগাদ আড়াই লাখ টন আলু রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে খসড়া পথনকশা তৈরি করেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। পথনকশায় বলা হয়, নিম্নমানের আলু উৎপাদন, যথোপযুক্ত প্রত্যয়ন ও অ্যাক্রিডিটেড ল্যাবের অভাব, পরিবহন সমস্যা, আলু রপ্তানিতে উচ্চ হারে ভ্যাট ও ট্যাক্স আদায় এবং কুলিং চেম্বার, কোল্ডস্টোরেজ ও কুলিং ভ্যানের অপ্রতুলতার কারণে উৎপাদনের সঙ্গে সংগতি রেখে পণ্যটির রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের কথা হলো, ইতিমধ্যে বিদেশ থেকে আলুর অনেকগুলো উন্নত জাত আনা হয়েছে। জাত নিয়ে আর সমস্যা হবে না। রপ্তানি উপযোগী ১৮টি আলুর উন্নত জাতের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, উত্তম কৃষিচর্চা মেনে কৃষক পর্যায়ে এইসব জাতের আলুর চাষ সম্প্রসারিত হলে একদিকে রপ্তানি বাড়বে অন্যদিকে কৃষক তার উৎপাদিত আলুর ন্যায্যমূল্য পাবেন।
লেখক সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশেন
শেয়ার করুন
নিতাই চন্দ্র রায় | ২৩ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, লালমনিহাট ও কুড়িগ্রামের কৃষক লাভের আশায় আগাম আমন ধান কেটে এবার ওই জমিতে আগাম গ্র্যানুলা জাতের আলু রোপণ করেন। আগাম আলু চাষের সুবিধা হলো, আলু স্বল্প সময়ের ফসল। রোপণের ৭৫ থেকে ৮০ দিনের মধ্যে তা তুলে বাজারে বিক্রি করা যায়। আগাম আলুর দাম থাকে বেশি। কখনো কখনো এক কেজি নতুন আলু ৬০ থেকে ৭০ টাকা বিক্রি হয়। অন্যদিকে বগুড়া, জয়পুরহাট অঞ্চলের কৃষক পাকড়ি জাতের লাল আলুর আগাম চাষ করেন। কৃষক আগাম জাতের এসব আলু বিক্রি করে প্রচুর লাভবান হন। কিন্তু এ বছর আলু উৎপাদনকারী অঞ্চলে ঘটেছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা। দিনাজপুর জেলার আবহাওয়া ও বেলে দোআঁশ মাটি আলু চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। লাভের আশায় দিনাজপুর সদর উপজেলার এক কৃষক অন্যের জমি লিজ নিয়ে ছয় একর জমিতে আলুর চাষ করেন। এতে জমি লিজের টাকাসহ তার খরচ হয় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। কৃষক তার আলু উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামে বিক্রি করে দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে দুর্বিষহ দিন যাপন করছেন। প্রতি কেজি আলু তিনি মাত্র ৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে চোখের জলে বুক ভাসিয়েছেন।
এক বিঘা জমিতে আগাম আলু উৎপাদন করতে সাধারণত ২০ থেকে ২৪ হাজার টাকা খরচ হয়। আর এক বিঘা জমি থেকে ৫৫ থেকে ৬০ মণ আলু পাওয়া যায়। সে হিসেবে প্রতি কেজি আগাম আলুর উৎপাদন খরচ পড়ে ১০ টাকা। এবার এভাবে প্রতি কেজি আলুতে কৃষকের লোকসান হচ্ছে ৪ টাকা। এক বিঘাতে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৬০০ টাকা। তাহলে কৃষক বাঁচবে কীভাবে? বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার আরেকজন প্রগতিশীল আলু চাষি তার তিন বিঘা জমিতে আলু উৎপাদন করছেন ২০০ মণ। ৮০ হাজার টাকা খরচ করে তিনি আলু বিক্রি করে পেয়েছেন মাত্র ৫৬ হাজার টাকা। লোকসান হয়েছে ২৪ হাজার টাকা। একই রকম অবস্থা বিরাজ করছে মুন্সীগঞ্জ, লালমনিরহাট, যশোর, বগুড়া, জয়পুরহাট, হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন আলু উৎপাদন এলাকায়। অসময়ে বৃষ্টির কারণে শীতকালীন সবজি নষ্ট হওয়ায় এবার সবজির দাম বেশ চড়া। বর্তমানে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে প্রতিকেজি বেগুন ও টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। মাঝারি ধরনের ফুলকপি, বাঁধাকপি প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। করলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮০ টাকা। লাউ বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। সাধারণত দেখা যায় অন্যান্য সবজির দাম বেশি থাকলে আলুর দামও বেশি থাকে।
কিন্তু বর্তমানে বাজারে গত বছরের পুরনো আলু ও নতুন আলু বিক্রি হচ্ছে একই সময়ে। এখনো বগুড়ার বেশ কিছু হিমাগারে পুরনো আলু মজুদ আছে। সেই আলুগুলো ২০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। কিছু ব্যাপারী লাভের আশায় সেই সব আলু ধুয়ে বাইরের জেলাগুলোতে নিয়ে যাচ্ছেন। এজন্যই নতুন আলু বিক্রিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। বগুড়ার বিখ্যাত মহাস্থান পাইকারি বাজারে বর্তমানে নতুন আলু সাত থেকে আট টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। অথচ দুই সপ্তাহ আগেও এই আলু বিক্রি হয়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি দরে। হঠাৎ আলুর দরপতনে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষক। লোকসানের ভয়ে অনেক কৃষক জমি থেকে আলু তোলার সাহস পাচ্ছেন না। মহাস্থান হাটে গ্র্যানুলা জাতের সাদা আলু বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৬০ টাকা মণ দরে। আর অ্যাস্ট্রারিক, ডায়মন্ড, ক্যারেট জাতের আলু বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা মণ দরে। নতুন আলু বাজারে উঠলেও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন হিমাগারে প্রচুর পুরনো আলু মজুদ রয়েছে। এই সব হিমাগারে থাকা ৫০ কেজি বস্তার আলু পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১৫০ টাকায়। সে হিসেবে প্রতি কেজি আলুর দাম পড়ছে মাত্র তিন টাকা। প্রতি কেজি গ্র্যানুলা জাতের আলু ত্রিশাল, ফুলবাড়িয়া ও ভালুকা উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা কেজি দরে। কার্ডিনাল জাতের আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা কেজি দরে। অথচ গত বছর এই সময়ে নতুন জাতের আলু বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে। এক বছর আলুর দাম বাড়লেও পরের বছর দরপতন ঘটে। কৃষককে লোকসান দিয়ে আলু বিক্রি করতে হয়। লাভ-লোকসানের এই চক্রের সঙ্গে কৃষক আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকারী কৃষকের যদি কৃষিপণ্য উৎপাদন করে লোকসান দিতে হয়, ঋণে জর্জরিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়, তাহলে কেন তারা করতে যাবেন কৃষিকাজ? বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে দেশের নীতিনির্ধারকদের। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতে, দেশে আলুর চাহিদা বছরে ৮০ থেকে ৯০ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু ২০২১ সালে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৬ লাখ মেট্রিক টন। এ বছর ৪ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর জমি থেকে আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ কোটি ৬ লাখ ৫১ হাজার মেট্রিক টন। ২০২০ সালে দেশে ৯৫ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়। করোনাকালে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সারা দেশে ত্রাণ কাজে অনেক আলু বিতরণ করা হয়। ফলে শেষের দিকে আলু সংকট দেখা দেয়। হু হু করে বেড়ে যায় বাজারে আলুর দাম। ওই সময় রাজধানী ঢাকা শহরে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজিতে। সরকার আলুর দাম ২৭ থেকে ৩৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও আলু ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকরা তখন তাতে কর্ণপাত করেননি। কৃষি বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন, উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের বহুমুখীকরণ না হওয়ায় উৎপাদিত আলুর একটি বড় অংশ প্রতি বছর নষ্ট হয়ে যায়। কৃষকও বঞ্চিত হন ন্যায্যমূল্য থেকে। এ জন্য রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি আলু উৎপাদন এলাকায় আলু প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন করা প্রয়োজন। প্রয়োজন কৃষিপণ্যের একটি জাতীয় মূল্য কমিশন গঠন করা।
২০২০ সালে কৃষক আলুর ভালো দাম পেয়েছিলেন। তাই পরেরর বছর বেশি আবাদ করেছেন। কিন্তু গত বছরের মতো এবারও আলুর দাম নিম্নমুখী। গত বছর প্রায় ২০ লাখ টন আলু হিমাগারগুলোতে উদ্বৃত্ত থেকে যায়। এবারও সংরক্ষিত আলু সময়মতো বাজারজাত করতে না পারলে বিপুল পরিমাণ আলু অবিক্রীত থেকে যাবে। ন্যায্যমূল্য না পেয়ে কৃষক আগামীতেও আলু চাষে নিরুৎসাহিত হতে পারেন। কৃষকের আলুর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে প্রক্রিয়াজাত কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি ও রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এক লাখ দুই হাজার টন আলু রপ্তানি হয়। করোনাসহ বিভিন্ন কারণে আলু রপ্তানি হ্রাস পেয়ে সেটি ২০২০-২১ অর্থবছরে দাঁড়ায় ৫৬ হাজার মেট্রিক টনে। উৎপাদিত এক কোটি টন আলুর মধ্যে মাত্র ৫৬ হাজার মেট্রিক টন আলু রপ্তানিতে, কতটুকুই বা প্রভাব পড়ে পণ্যটির বাজারমূল্যে? রাশিয়াতে আলু রপ্তানি কৃষকের মধ্যে সামান্য আশা জাগালেও আলুতে ব্রাউন রট নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের কারণে দেশটিতে আলু রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। যদিও রাশিয়ার সেই আপত্তি নিরসন হয়েছে এবং ব্যাকটেরিয়ামুক্ত আলু উৎপাদনের বিষয়টি ইতিমধ্যে রাশিয়াকে জানানো হয়েছে। এ মুহূর্তে একলাখ টন আলু রপ্তানির কথা ভাবছে সরকার। বিশ্বের কোন কোন দেশে বাংলাদেশি আলুর চাহিদা রয়েছে, তা জানতে সব দেশের মিশনগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা: নতুন আলু বাজারে আসতে শুরু করায় আলুর দাম কিছুটা কমেছে, যার মূল্য অচিরেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার মনে হয়, কিছুদিন আগে অসময়ে বৃষ্টি ও তীব্র ঠান্ডা ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে আলু ক্ষেতে বিলম্বধসা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এবং এক সঙ্গে বিপুল পরিমাণ আলু কৃষক উত্তোলন করতে বাধ্য হন। আলুর অস্বাভাবিক দরপতনের এটিও একটি কারণ হতে পারে।
আলুর মূল্য সংকট দূর করতে ২০২৫ সাল নাগাদ আড়াই লাখ টন আলু রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে খসড়া পথনকশা তৈরি করেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। পথনকশায় বলা হয়, নিম্নমানের আলু উৎপাদন, যথোপযুক্ত প্রত্যয়ন ও অ্যাক্রিডিটেড ল্যাবের অভাব, পরিবহন সমস্যা, আলু রপ্তানিতে উচ্চ হারে ভ্যাট ও ট্যাক্স আদায় এবং কুলিং চেম্বার, কোল্ডস্টোরেজ ও কুলিং ভ্যানের অপ্রতুলতার কারণে উৎপাদনের সঙ্গে সংগতি রেখে পণ্যটির রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের কথা হলো, ইতিমধ্যে বিদেশ থেকে আলুর অনেকগুলো উন্নত জাত আনা হয়েছে। জাত নিয়ে আর সমস্যা হবে না। রপ্তানি উপযোগী ১৮টি আলুর উন্নত জাতের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, উত্তম কৃষিচর্চা মেনে কৃষক পর্যায়ে এইসব জাতের আলুর চাষ সম্প্রসারিত হলে একদিকে রপ্তানি বাড়বে অন্যদিকে কৃষক তার উৎপাদিত আলুর ন্যায্যমূল্য পাবেন।
লেখক সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশেন