করোনার আঘাত আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে
দেশে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আবারও স্কুল, কলেজ ও সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। পাশাপাশি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে। প্রজ্ঞাপনে করোনার বিস্তার বন্ধে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ১০০ জনের বেশি মানুষের সমাবেশ নিষিদ্ধ, সরকারি, বেসরকারি অফিস এবং শিল্পকারখানায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টিকা সনদ, বাজার, শপিং মল, মসজিদ, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশনসহ সাধারণ লোকসমাগমের স্থানে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার, যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণসহ মোট পাঁচ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শুরু হয় গত ২০২০ সালের ৮ মার্চ। পরে ওই বছরের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে দেড় বছর পর গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর খুলে দেওয়া হয় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। পর্যায়ক্রমে বিশ^বিদ্যালয়সহ অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খুলে দেওয়া হয়। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সীমিত পরিসরে ক্লাস হয়েছে এবং প্রতিদিন সব শ্রেণিতে ক্লাসও নেওয়া হয়নি। ইউনিসেফের তথ্যমতে, বাংলাদেশ ছাড়া আরও ১৩টি দেশে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে লাগাতার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে অব্যাহতভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক বছরের বেশি বন্ধ রাখা হয়েছিল। এমন অবস্থায় চার মাসের মাথায় ফের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হলে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণায় শিক্ষার্থী-অভিভাবক মহলে হতাশা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষোভও লক্ষ করা গেছে।
এর আগে এক বছরেরও বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষতি আমাদের তেমন ভাবিয়ে তুলেছে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, এ ক্ষতি কলকারখানা, রাস্তাঘাট, গণপরিবহন, হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র কিংবা বইমেলা বন্ধ থাকার যে ক্ষতি, তার মতো সহজে প্রকাশ করা যায় না। করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির যে হিসাব আমরা বিভিন্ন সূত্রে জেনেছিলাম, তাতে কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ক্ষতির হিসাব বিবেচনায় আনা হয়নি। শিক্ষার বহুমাত্রিক দিক থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষতি সহজে পরিমাপ করা যায় না। ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপ করা হয় যে জিডিপির সূচকে সেখানে ক্ষতির হিসাব করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বড় কোনো ক্ষতি হয়েছে, এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত আমরা পাই না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষতি একদিকে যেমন ধীরগতি, অন্যদিকে তেমনই সুদূরপ্রসারী। আর তাই দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের প্রভাব হয়তো এখন আমরা পরিমাপ করতে পারছি না। তাই বলে এটা যে অনুপস্থিত, এমনটা ভাবার কোনো যুক্তি নেই। করোনার সময়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার কথা আমরা খুব জেনেছি। শহরে না হয় অনলাইনের কল্যাণে স্কুলের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীরা সংযুক্ত হতে পেরেছিল। কিন্তু লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী যারা গ্রামে বসবাস করে, তাদের কথা কেউ কি কখনো ভেবে দেখেছি? বেশির ভাগ নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানেরা হয়তো আর স্কুলেই ফিরতে পারেনি। অনেকেই উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে মুঠোফোনসহ বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হয়েছে। এর সামাজিক ক্ষতির দিকগুলোও সহজেই অনুমেয়।
তাই নতুন করে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার শুরুতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দেশের সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রমকে পিছিয়ে দেবে বলেই সংশ্লিষ্টরা মতামত দিয়েছেন। সরকারের টিকাদান কর্মসূচি বিভিন্ন মহলে বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। তাই দ্রুত টিকা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা দরকার ছিল। যদিও শিক্ষার্থীদের টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।
সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, জীবন যতখানি স্বাভাবিক রেখে করোনাকে মোকাবিলা করা যায়, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। আবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, সরকার বিধিনিষেধ দিলেও মানুষ সেভাবে মানছে না বলেই সংক্রমণ বাড়ছে। স্কুলের শিক্ষার্থীরাও আক্রান্ত হচ্ছে। এ কারণেই ফের স্কুল বন্ধের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মানুষ মানছে না বলে যে কথা মন্ত্রী বলছেন, তা দেশের বর্তমান বাস্তবতায় বেমানান। মানুষকে মানতে বাধ্য করা কিংবা প্রয়োজনে কঠোর হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে গুরুত্বারোপ করা যেত।
দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে শিক্ষার্থীদের সামাজিকভাবে গড়ে না ওঠার ক্ষতি এবং মানসিক ক্ষতি বিবেচনায় এনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার নতুন করে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত তাই যুক্তিযুক্ত বলা যায় না। শিক্ষকদের যেহেতু করোনা টিকার আওতায় আনা হয়েছে এবং বেশির ভাগ শিক্ষকই ইতিমধ্যে টিকা গ্রহণ করেছেন, তাই স্কুল ও কলেজ খোলা রাখার বিষয়ে একটি বড় বাধা অপসারিত হয়েছে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। করোনার সংক্রমণ কীভাবে বাড়ছে, সেসব নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল। শুরুতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরও বিবেচনার প্রয়োজন ছিল।
শেয়ার করুন

দেশে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আবারও স্কুল, কলেজ ও সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। পাশাপাশি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে। প্রজ্ঞাপনে করোনার বিস্তার বন্ধে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ১০০ জনের বেশি মানুষের সমাবেশ নিষিদ্ধ, সরকারি, বেসরকারি অফিস এবং শিল্পকারখানায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টিকা সনদ, বাজার, শপিং মল, মসজিদ, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশনসহ সাধারণ লোকসমাগমের স্থানে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার, যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণসহ মোট পাঁচ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শুরু হয় গত ২০২০ সালের ৮ মার্চ। পরে ওই বছরের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে দেড় বছর পর গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর খুলে দেওয়া হয় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। পর্যায়ক্রমে বিশ^বিদ্যালয়সহ অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খুলে দেওয়া হয়। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সীমিত পরিসরে ক্লাস হয়েছে এবং প্রতিদিন সব শ্রেণিতে ক্লাসও নেওয়া হয়নি। ইউনিসেফের তথ্যমতে, বাংলাদেশ ছাড়া আরও ১৩টি দেশে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে লাগাতার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে অব্যাহতভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক বছরের বেশি বন্ধ রাখা হয়েছিল। এমন অবস্থায় চার মাসের মাথায় ফের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হলে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণায় শিক্ষার্থী-অভিভাবক মহলে হতাশা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষোভও লক্ষ করা গেছে।
এর আগে এক বছরেরও বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষতি আমাদের তেমন ভাবিয়ে তুলেছে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, এ ক্ষতি কলকারখানা, রাস্তাঘাট, গণপরিবহন, হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র কিংবা বইমেলা বন্ধ থাকার যে ক্ষতি, তার মতো সহজে প্রকাশ করা যায় না। করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির যে হিসাব আমরা বিভিন্ন সূত্রে জেনেছিলাম, তাতে কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ক্ষতির হিসাব বিবেচনায় আনা হয়নি। শিক্ষার বহুমাত্রিক দিক থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষতি সহজে পরিমাপ করা যায় না। ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপ করা হয় যে জিডিপির সূচকে সেখানে ক্ষতির হিসাব করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বড় কোনো ক্ষতি হয়েছে, এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত আমরা পাই না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষতি একদিকে যেমন ধীরগতি, অন্যদিকে তেমনই সুদূরপ্রসারী। আর তাই দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের প্রভাব হয়তো এখন আমরা পরিমাপ করতে পারছি না। তাই বলে এটা যে অনুপস্থিত, এমনটা ভাবার কোনো যুক্তি নেই। করোনার সময়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার কথা আমরা খুব জেনেছি। শহরে না হয় অনলাইনের কল্যাণে স্কুলের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীরা সংযুক্ত হতে পেরেছিল। কিন্তু লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী যারা গ্রামে বসবাস করে, তাদের কথা কেউ কি কখনো ভেবে দেখেছি? বেশির ভাগ নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানেরা হয়তো আর স্কুলেই ফিরতে পারেনি। অনেকেই উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে মুঠোফোনসহ বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হয়েছে। এর সামাজিক ক্ষতির দিকগুলোও সহজেই অনুমেয়।
তাই নতুন করে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার শুরুতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ঘোষণা দেশের সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রমকে পিছিয়ে দেবে বলেই সংশ্লিষ্টরা মতামত দিয়েছেন। সরকারের টিকাদান কর্মসূচি বিভিন্ন মহলে বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। তাই দ্রুত টিকা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা দরকার ছিল। যদিও শিক্ষার্থীদের টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।
সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, জীবন যতখানি স্বাভাবিক রেখে করোনাকে মোকাবিলা করা যায়, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। আবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, সরকার বিধিনিষেধ দিলেও মানুষ সেভাবে মানছে না বলেই সংক্রমণ বাড়ছে। স্কুলের শিক্ষার্থীরাও আক্রান্ত হচ্ছে। এ কারণেই ফের স্কুল বন্ধের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মানুষ মানছে না বলে যে কথা মন্ত্রী বলছেন, তা দেশের বর্তমান বাস্তবতায় বেমানান। মানুষকে মানতে বাধ্য করা কিংবা প্রয়োজনে কঠোর হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে গুরুত্বারোপ করা যেত।
দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে শিক্ষার্থীদের সামাজিকভাবে গড়ে না ওঠার ক্ষতি এবং মানসিক ক্ষতি বিবেচনায় এনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার নতুন করে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত তাই যুক্তিযুক্ত বলা যায় না। শিক্ষকদের যেহেতু করোনা টিকার আওতায় আনা হয়েছে এবং বেশির ভাগ শিক্ষকই ইতিমধ্যে টিকা গ্রহণ করেছেন, তাই স্কুল ও কলেজ খোলা রাখার বিষয়ে একটি বড় বাধা অপসারিত হয়েছে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। করোনার সংক্রমণ কীভাবে বাড়ছে, সেসব নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল। শুরুতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরও বিবেচনার প্রয়োজন ছিল।