পূর্বাচলে নগর বসতি হবে কবে
| ২৬ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং দ্রুত বিস্তার লাভ করতে থাকা মহানগরের মধ্যে অন্যতম। ঢাকা মহানগরের আয়তন সমগ্র দেশের আয়তনের মাত্র ১ শতাংশ হলেও দেশের প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ বসবাস করে ঢাকায়। শুধু জনবসতির দশ ভাগের এক ভাগই নয় দেশের মোট জিডিপির এক-দশমাংশও জোগান দেয় রাজধানী ঢাকা। কিন্তু ঢাকা মহানগরের আগামী বিস্তার এবং বর্তমান সংকটগুলো দূর করার জন্য যে পরিকল্পনাগুলো সামনে আসছে তার কোনোটিই যথাসময়ে শেষ হচ্ছে না। বড় পরিসরের নগর পরিকল্পনা কিংবা অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পিত নগরায়ণ দুই ক্ষেত্রেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নই এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানী ঢাকার জনবসতি বিস্তারে পরিকল্পিত পূর্বাচল নতুন শহরের ক্ষেত্রেও এই সংকট দেখা যাচ্ছে। রাজউকের তথ্যানুসারে, ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে শুরু হয় পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। তিন দফা সময় বাড়িয়ে ২০১০ সালে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু পরে আরও দুই দফা সময় বাড়িয়ে ২০১৫ সালে সময়সীমা নির্ধারণ করা হলে সেটাও সম্ভব হয়নি। সবশেষ আরও দুই দফা সময় বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুনে কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু পরিকল্পনা, প্লট বরাদ্দ দেওয়ার ত্রুটি এবং দফায় দফায় নকশা পরিবর্তনসহ নানা অনিয়মের কারণে সেখানে জনবসতি শুরুর কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।
মঙ্গলবার দেশ রূপান্তরে ‘ভুল মানুষের হাতে পূর্বাচল’ শিরোনামের প্রতিবেদনে প্রকল্পটির বর্তমান নানা অসংগতি ও অচলাবস্থার কথা তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, পূর্বাচল প্রকল্পে থাকা ২৫ হাজার ১৬টি আবাসিক প্লটের মধ্যে ১০ হাজার প্লট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতে। আর ৪ হাজার পেয়েছেন প্রবাসীরা। এই ১৪ হাজার প্লট গ্রহীতার কেউ পূর্বাচলে থাকার তাগিদ অনুভব করছেন না। তারা এগুলো হাতবদল করে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। এছাড়া যেসব সরকারি-বেসরকারি বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে জমি দেওয়া হয়েছে তারাও সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করছেন না। অন্যদিকে বরাদ্দ পেয়েছেন এমন অনেকের দাবি, পূর্বাচল প্রকল্পের প্রথম দিকের কিছু সেক্টরের প্লট রাস্তাঘাটসহ বাসযোগ্য হয়েছে বটে কিন্তু বেশির ভাগ জায়গায় পানি সরবরাহ এবং ড্রেনেজ, স্যুয়ারেজ লাইন নেই। নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। ফলে একজন বরাদ্দপ্রাপ্ত চাইলেও সেখানে বাড়ি বানিয়ে থাকতে পারবেন না। কিন্তু নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন পূর্বাচল প্রকল্পের বেশিরভাগ প্লটই ভুল ব্যক্তিদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও প্রবাসীরা মূল শহর ছেড়ে সেখানে থাকতে চান না বলেই সেখানে বসতি হচ্ছে না।
খেয়াল করা দরকার রাজউক প্রকারান্তরে প্লট বরাদ্দে ভুল গ্রহীতাদের নির্বাচনের এই ত্রুটির কথা স্বীকার করে নিচ্ছে। রাজউক চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, ‘যাদের হাতে রাজউকের প্লটগুলো গেছে তারা বাড়ি করছেন না। তাদের বাড়ি করার প্রয়োজন নেই। তাদের মূল শহরে থাকার ব্যবস্থা আছে। তাই তারা এসব প্লট কেনাবেচার মধ্যে রয়েছেন।’ তিনি বলছেন প্লট বরাদ্দের অন্যতম শর্ত ছিল নির্ধারিত সময়ে স্থাপনা নির্মাণ করা। ফলে এখন তারা বাড়ি নির্মাণ না করলে প্রয়োজনে বরাদ্দ বাতিল করার পথে হাঁটতে পারে রাজউক। কিন্তু প্রশ্ন হলো রাজউক যথাসময়ে বাড়ি নির্মাণ না করার জন্য প্লট গ্রহীতাদের যে দায় দিচ্ছে তা ধোপে টিকবে কি না। কেননা, রাজউক নিজেই যথাসময়ে পূর্বাচল প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন এবং রাস্তাঘাট নির্মাণসহ প্লট বিভাজনের কাজ শেষ করেনি। রাজউকের নথিপত্রে এখন পুরো প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন কাজ ৯৫ ভাগ শেষ করার কথা বলা হলেও অভ্যন্তরীণ রাস্তা ও সারফেস ড্রেন নির্মাণ, ৬৫টি ব্রিজ, লেক উন্নয়ন, সেন্ট্রাল আইল্যান্ড, ড্রেনেজ সিস্টেম, ফুটপাত নির্মাণে আশানুরূপ অগ্রগতি নেই বলে জানা গেছে। অন্যদিকে, নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিযোগ, ভুল ব্যক্তিদের বরাদ্দ দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাজউক আসলে ধনীদের হাতে সাজিয়ে-গুছিয়ে জমি তুলে দিয়েছে। ফলে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে আর নিঃস্ব হচ্ছে প্রকল্প এলাকায় থাকা জমির আদিনিবাসীরা। তাদের এই অভিযোগ অবশ্যই আমলে নেওয়া দরকার।
এই অবস্থায় রাজউক সব গ্রহীতাকে আগাম নোটিস দিয়ে বাড়ি নির্মাণের নকশা অনুমোদন ও নির্মাণকাজ শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দিতে পারে। যারা এই সময়ে তা করবে না তাদের বরাদ্দ বাতিলের শর্তও থাকতে পারে। কিন্তু আগের বরাদ্দ বাতিল করে নতুন বরাদ্দ দিতে গেলে মুশকিল হবে প্লটগুলো মূল বরাদ্দ মূল্যে ফিরিয়ে আনা। কেননা, দফায় দফায় হাতবদল হওয়া প্লটগুলোর দাম এখন আকাশছোঁয়া। এছাড়া পূর্বাচল প্রকল্পে জলাধার আইন লঙ্ঘন ও বনভূমি নষ্ট করাসহ পরিবেশ ধ্বংসের যেসব অভিযোগ আছে তারও সুরাহা দরকার। এটা মাথায় রাখতে হবে যে, প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকার ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষের জন্য পরিকল্পিত বসতি নির্মাণে হেলাফেলার কোনো সুযোগ নেই।
শেয়ার করুন
| ২৬ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং দ্রুত বিস্তার লাভ করতে থাকা মহানগরের মধ্যে অন্যতম। ঢাকা মহানগরের আয়তন সমগ্র দেশের আয়তনের মাত্র ১ শতাংশ হলেও দেশের প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ বসবাস করে ঢাকায়। শুধু জনবসতির দশ ভাগের এক ভাগই নয় দেশের মোট জিডিপির এক-দশমাংশও জোগান দেয় রাজধানী ঢাকা। কিন্তু ঢাকা মহানগরের আগামী বিস্তার এবং বর্তমান সংকটগুলো দূর করার জন্য যে পরিকল্পনাগুলো সামনে আসছে তার কোনোটিই যথাসময়ে শেষ হচ্ছে না। বড় পরিসরের নগর পরিকল্পনা কিংবা অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পিত নগরায়ণ দুই ক্ষেত্রেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নই এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানী ঢাকার জনবসতি বিস্তারে পরিকল্পিত পূর্বাচল নতুন শহরের ক্ষেত্রেও এই সংকট দেখা যাচ্ছে। রাজউকের তথ্যানুসারে, ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে শুরু হয় পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। তিন দফা সময় বাড়িয়ে ২০১০ সালে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু পরে আরও দুই দফা সময় বাড়িয়ে ২০১৫ সালে সময়সীমা নির্ধারণ করা হলে সেটাও সম্ভব হয়নি। সবশেষ আরও দুই দফা সময় বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুনে কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু পরিকল্পনা, প্লট বরাদ্দ দেওয়ার ত্রুটি এবং দফায় দফায় নকশা পরিবর্তনসহ নানা অনিয়মের কারণে সেখানে জনবসতি শুরুর কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।
মঙ্গলবার দেশ রূপান্তরে ‘ভুল মানুষের হাতে পূর্বাচল’ শিরোনামের প্রতিবেদনে প্রকল্পটির বর্তমান নানা অসংগতি ও অচলাবস্থার কথা তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, পূর্বাচল প্রকল্পে থাকা ২৫ হাজার ১৬টি আবাসিক প্লটের মধ্যে ১০ হাজার প্লট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতে। আর ৪ হাজার পেয়েছেন প্রবাসীরা। এই ১৪ হাজার প্লট গ্রহীতার কেউ পূর্বাচলে থাকার তাগিদ অনুভব করছেন না। তারা এগুলো হাতবদল করে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। এছাড়া যেসব সরকারি-বেসরকারি বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে জমি দেওয়া হয়েছে তারাও সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করছেন না। অন্যদিকে বরাদ্দ পেয়েছেন এমন অনেকের দাবি, পূর্বাচল প্রকল্পের প্রথম দিকের কিছু সেক্টরের প্লট রাস্তাঘাটসহ বাসযোগ্য হয়েছে বটে কিন্তু বেশির ভাগ জায়গায় পানি সরবরাহ এবং ড্রেনেজ, স্যুয়ারেজ লাইন নেই। নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। ফলে একজন বরাদ্দপ্রাপ্ত চাইলেও সেখানে বাড়ি বানিয়ে থাকতে পারবেন না। কিন্তু নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন পূর্বাচল প্রকল্পের বেশিরভাগ প্লটই ভুল ব্যক্তিদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও প্রবাসীরা মূল শহর ছেড়ে সেখানে থাকতে চান না বলেই সেখানে বসতি হচ্ছে না।
খেয়াল করা দরকার রাজউক প্রকারান্তরে প্লট বরাদ্দে ভুল গ্রহীতাদের নির্বাচনের এই ত্রুটির কথা স্বীকার করে নিচ্ছে। রাজউক চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, ‘যাদের হাতে রাজউকের প্লটগুলো গেছে তারা বাড়ি করছেন না। তাদের বাড়ি করার প্রয়োজন নেই। তাদের মূল শহরে থাকার ব্যবস্থা আছে। তাই তারা এসব প্লট কেনাবেচার মধ্যে রয়েছেন।’ তিনি বলছেন প্লট বরাদ্দের অন্যতম শর্ত ছিল নির্ধারিত সময়ে স্থাপনা নির্মাণ করা। ফলে এখন তারা বাড়ি নির্মাণ না করলে প্রয়োজনে বরাদ্দ বাতিল করার পথে হাঁটতে পারে রাজউক। কিন্তু প্রশ্ন হলো রাজউক যথাসময়ে বাড়ি নির্মাণ না করার জন্য প্লট গ্রহীতাদের যে দায় দিচ্ছে তা ধোপে টিকবে কি না। কেননা, রাজউক নিজেই যথাসময়ে পূর্বাচল প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন এবং রাস্তাঘাট নির্মাণসহ প্লট বিভাজনের কাজ শেষ করেনি। রাজউকের নথিপত্রে এখন পুরো প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন কাজ ৯৫ ভাগ শেষ করার কথা বলা হলেও অভ্যন্তরীণ রাস্তা ও সারফেস ড্রেন নির্মাণ, ৬৫টি ব্রিজ, লেক উন্নয়ন, সেন্ট্রাল আইল্যান্ড, ড্রেনেজ সিস্টেম, ফুটপাত নির্মাণে আশানুরূপ অগ্রগতি নেই বলে জানা গেছে। অন্যদিকে, নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিযোগ, ভুল ব্যক্তিদের বরাদ্দ দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাজউক আসলে ধনীদের হাতে সাজিয়ে-গুছিয়ে জমি তুলে দিয়েছে। ফলে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে আর নিঃস্ব হচ্ছে প্রকল্প এলাকায় থাকা জমির আদিনিবাসীরা। তাদের এই অভিযোগ অবশ্যই আমলে নেওয়া দরকার।
এই অবস্থায় রাজউক সব গ্রহীতাকে আগাম নোটিস দিয়ে বাড়ি নির্মাণের নকশা অনুমোদন ও নির্মাণকাজ শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দিতে পারে। যারা এই সময়ে তা করবে না তাদের বরাদ্দ বাতিলের শর্তও থাকতে পারে। কিন্তু আগের বরাদ্দ বাতিল করে নতুন বরাদ্দ দিতে গেলে মুশকিল হবে প্লটগুলো মূল বরাদ্দ মূল্যে ফিরিয়ে আনা। কেননা, দফায় দফায় হাতবদল হওয়া প্লটগুলোর দাম এখন আকাশছোঁয়া। এছাড়া পূর্বাচল প্রকল্পে জলাধার আইন লঙ্ঘন ও বনভূমি নষ্ট করাসহ পরিবেশ ধ্বংসের যেসব অভিযোগ আছে তারও সুরাহা দরকার। এটা মাথায় রাখতে হবে যে, প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকার ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষের জন্য পরিকল্পিত বসতি নির্মাণে হেলাফেলার কোনো সুযোগ নেই।