সরকারি চাকরির মোহ
চিররঞ্জন সরকার | ১৫ মে, ২০২২ ০০:০০
আমাদের দেশে সরকারি চাকরির প্রতি আকর্ষণ দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। ১০ বছর বা ১৫ বছর আগেও সরকারি চাকরিতে এত বেশি প্রতিযোগী ছিল না। কিন্তু বর্তমানে সরকারি চাকরি আক্ষরিক অর্থেই যেন সোনার হরিণ। একটি পদের বিপরীতে হাজার হাজার আবেদন জমা পড়ে। ১১ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের নিয়োগে আবেদন জমা পড়ে প্রায় ২৬ লাখ। খাদ্য অধিদপ্তরের ১ হাজার ১০০ জন নিয়োগের বিপরীতে আবেদন জমা পড়ে প্রায় ১৫ লাখ। দেশের বেশিরভাগ মানুষের আকাক্সক্ষা এখন একটা সরকারি চাকরি। সরকারি চাকরির প্রতি কেন এই মোহ? বেতন বৃদ্ধিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সরকারি চাকরিতে আগ্রহ বেড়েছেÑএকথা ঠিক। তবে সরকারি চাকরির প্রতি আকর্ষণের আরও নানা কারণ আছে।
একটা ঘটনা উল্লেখ করা যাক। পরিচিত একজন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো কাজ করেন, বেশ মোটা অংকের মাইনে পান। তিনি হঠাৎ সিটি করপোরেশন অফিসে একটা পদে চাকরি করার পরীক্ষায় বসলেন। কেন তিনি এখানে চাকরির আবেদন করছেন, জিজ্ঞেস করায় বললেন, সরকারি চাকরি, তাই পেনশন পাবেন। তা ছাড়া, প্রতিদিন যেতে হবে না, দেরি করে গেলেও চলবে, কাজ না করলে চাকরি যাবে না। আর শুনেছেন ‘উপরি রোজগারের’ সুযোগ আছে। সরকারি চাকরির এমন অনেক জ্ঞাত-অজ্ঞাত ‘আকর্ষণ’ রয়েছে। সরকারি চাকরির মস্ত সুবিধা হলো, সেখানে চাকরি যাওয়ার ঝুঁকি কম। রাষ্ট্র দীর্ঘকাল ধরে এই মানসিকতাকে সযতেœ লালন-পালন করেছে এবং করছে। একটি সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করা দশ হাজার জনের সবাই যে কেবল বেকার বলে সরকারি চাকরির পেছনে দৌড়াচ্ছেন, তা নয়। যাতে বেশি কাজ করতে না হয় সেই আশায় সরকারি চাকরি খুঁজছেন। এমন মানুষও একেবারে কম নয়।
আমার পরিচিত একজন পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করেন। তার সঙ্গে একদিন কথা হচ্ছিল। তিনি জানতে চান, আমি কখন অফিসে যাই। আমি তাকে জানালাম যে, আমাকে সাড়ে আটটার মধ্যে অফিসে যেতে হয় এবং সোয়া পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করতে হয়। এতে তিনি খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা যা বলেছেন তাতে আমি বিস্মিত। তিনি ফ্রি-স্টাইলে অফিস করেন। যখন মনে হয়, তখন যান, আবার যখন ইচ্ছে বের হয়ে পড়েন। তাকে কেউ ঘাঁটাতে সাহস পান না। বর্তমানে তিনি সরকারি দলের সিবিএ-র নেতা হয়েছেন। বড় কর্তাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে দেনদরবার করেন। সবাই তাকে সমীহ করে চলেন। অফিসের কাজ করার ক্ষেত্রে তার বড় ‘সময়াভাব’, কারণ তাকে ‘সংগঠন’-এর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। তার বক্তব্য শুনে খুবই ‘হিংসে’ হয়েছে। এমন সরকারি চাকরি কে না চাইবে? তা ছাড়া বর্তমানে সরকারি চাকরিতে বেতন স্কেল সুবিধা যথেষ্ট বাড়নো হয়েছে। এর পাশাপাশি প্রতি বছর পাঁচ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি, পদোন্নতির সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, চাকরির নিরাপত্তা, পর্যাপ্ত ছুটি, পরিবহন ও আবাসন সুবিধা, সন্তানদের স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার, অবসরকালীন সুবিধার পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদাও সরকারি চাকরির অন্যতম ভালো দিক।
প্রথম শ্রেণির পাশাপাশি দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতেও এখন বেতন কাঠামো আকর্ষণীয়। এই পদগুলোতে যারা যোগ দেন, তাদের সমান শিক্ষাগত এবং অন্যান্য যোগ্যতা নিয়ে বেসরকারি চাকরিতে এসব সুযোগ-সুবিধা অনেক কম। সেখানে সুনির্দিষ্ট কাঠামো না থাকা, পদোন্নতির জন্য কাজের চেয়ে নিয়োগকর্তার সুনজরে পড়ার বিষয়ও থাকে। এর বাইরেও বেশকিছু বিষয় রয়েছে। যেমন মাতৃত্বকালীন ছুটি বেশিরভাগ বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য চার মাস হলেও সরকারি চাকরিজীবীরা এই ছুটি পান ছয় মাসের। নৈমিত্তিক ছুটি সরকারি চাকুরেরা ইচ্ছা অনুযায়ী কাটাতে পারলেও বেসরকারি চাকুরেরা সে সুবিধা পান না অনেক ক্ষেত্রেই। অসুস্থতাজনিত ছুটির ক্ষেত্রেও বৈষম্য রয়েছে। আবার সরকারি চাকুরেদের অর্জিত ছুটি জমলে এর বিনিময়ে টাকার জন্য দুশ্চিন্তা করতে হয় না, কিন্তু বেসরকারি চাকরির অনেক ক্ষেত্রেই এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। সরকারি চাকরিতে আগ্রহের সবচেয়ে বড় কারণ চাকরির নিশ্চয়তা। এটা বেসরকারি খাতের চাকরিতে নেই। কারণ বেসরকারি খাতে সহজেই চাকরিচ্যুত করা যায়। কিন্তু সরকারি চাকরি সহজে যায় না। সামাজিক স্বীকৃতিও অন্যতম একটা বড় কারণ। এছাড়া রয়েছে ক্ষমতা ব্যবহারের চর্চা। একজন সরকারি কর্মকর্তা ক্ষমতা চর্চা করতে পারেন। কিন্তু বেসরকারি খাতে একজন সর্বোচ্চ পদধারী ব্যক্তিও ক্ষমতা চর্চা করতে পারেন না।
সরকারি চাকরিতে সময় দেওয়ার নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা আছে। কিন্তু বেসরকারি খাতে সেটা নেই। এসব মিলিয়ে তরুণদের প্রথম পছন্দ থাকে সরকারি চাকরির দিকে। সময় মাপা কাজ কে না করতে চায়! এ ছাড়া বেসরকারি চাকরির তুলনায় সরকারি চাকরি করলে লোন পেতে বেশি সুবিধা পাওয়া যায়। তাই লোন পাওয়া নিয়ে বেশি ছুটোছুটি করতে হয় না। আর ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই, আছে পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটির ব্যাপারটাও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অনেক বড় একটি কাক্সিক্ষত বিষয়।
সরকারি চাকরির প্রতি এই মোহ কিন্তু আমাদের সমাজ-জীবনে একেবারে গা-সওয়া ঘটনা। যে কোনো কাগজের পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনেই এর প্রমাণ মিলবে। যেখানে সদর্পে ঘোষণা করা হয় যে, কেবলমাত্র সরকারি চাকুরে পাত্রের তরফেই যেন যোগাযোগ করা হয়! তাইতো সরকারি চাকরির প্রতি সমাজের সব মানুষেরই প্রবল মোহ। বেশিরভাগ ছাত্রই পড়াশুনার শেষে, বা তার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক, পোস্ট অফিস, রেল, এলআইসি, ইত্যাদি নানা চাকরির পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। যারা আরও ভালো, তাদের অনেকের আবার পছন্দ বিসিএস, যার গ্ল্যামার, ক্ষমতা এবং মাইনে বেশ ওপরের দিকে।
এমনিতে সরকারি চাকরির মাইনে আকাশছোঁয়া সাংঘাতিক কিছু না-হলেও মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার নিরিখে বেশ ভালোই। কিন্তু আসল কথা হলো ‘উপরি উপার্জনের সুযোগ’, নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা, চিকিৎসা এবং অবসরকালীন বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। আর সেই সঙ্গে অগণিত মানুষ মনে করে, সরকারি চাকরি যেন পাওয়াটাই কঠিন, পেয়ে গেলে কাজ বিশেষ না করলেও চলে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি কয়েক দশক ধরে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে, অথচ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের জন্য যথেষ্ট কাজ তৈরি হয়নি। এর জন্য সরকারি নীতি কতটা দায়ী, চেষ্টা করলে সরকার শিল্পপতিদের কতটা প্রভাবিত করতে পারত, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু যেটুকু সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেটুকু কি করতে পেরেছে? চুক্তিতে নিয়োগের নীতি গ্রহণ করে সরকার শিক্ষিত কর্মপ্রার্থীকে আরও কোণঠাসা করছে। বহু কর্মীকে অতি সামান্য বেতনে কাজ করাচ্ছে। অনেক সময়েই তা এমন কাজ, যা এক জন পুরো সময়ের কর্মীর করার কথা। শিক্ষানবিশ বা সহকারী শিক্ষক পুরো স্কুল চালাচ্ছেন, পিয়ন করছেন কেরানির কাজ, স্বাস্থ্যকর্মী চিকিৎসা চালাচ্ছেন। স্বল্প টাকা মাইনের অস্থায়ী কর্মী দিয়েই যখন দপ্তর চলছে, তখন নতুন নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া কেন? বেকারের তো অভাব নেই। স্থায়ীকর্মীর চাইতেও কয়েক গুণ বেশি খাটিয়ে অফিসে, স্কুলে, আদালতে, থানায় নামমাত্র বেতনের লোক পুষছে সরকার।
ফলে সমান কাজ করেও সমান বেতন জুটছে না। রোজগারে অসাম্য বাড়ছে, যা সমাজে অস্থিরতার এক প্রধান কারণ। কিন্তু আরও বড় ক্ষতি হচ্ছে ভেতরে ভেতরে। পড়াশোনা করলে, পরিশ্রম করলে, নিজেকে তৈরি করতে পারলে জীবনে উন্নতি হবে এই বিশ্বাস জীবনের ভিত্তি। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে যুদ্ধাপরাধী-সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন, বহু সংকটের সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রত্যয়ে বাংলার কিশোর-তরুণ প্রজন্ম ভেঙে না পড়ে, ভেসে না গিয়ে, এগিয়ে গিয়েছে। এই আস্থা যদি টলে যায়, যদি মনে হয় যে পরিশ্রম তার উচিত মূল্য পাবে না বাজার বা রাষ্ট্রের থেকে, তখন অন্য এক সংকট জন্ম নেয়। তার চিহ্ন আজ চারদিকে। যথেষ্ট কাজ তৈরি না করা, কিংবা নামমাত্র বেতনে কাজ করানোর কী মূল্য দিতে হবে দেশকে, তার হিসাব কে কষবে?
তবে একথা সত্যি যে, সমাজ বদলাবে। আমি বা আপনি চাইলেও, কিংবা গভীরভাবে বিরোধিতা করলেও। সরকারি বা আধা-সরকারি চাকরির নিরাপত্তার চক্রব্যূহ ক্রমশ ভঙ্গুর হয়ে পড়বে এবং তা দ্রুতগতিতে। গোটা পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক ধরনের ভবিষ্যৎই গড়ে উঠবে। হয়তো একসময় আমরা দেখব, চাকরি বাঁচাতে গড়পড়তা সরকারি চাকুরেদেরও খাটতে হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরেদের মতো। সরকারি চাকরির নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের নিরাপত্তার ‘মিথ’ ভেঙে চুরমার হয়ে পড়বে। এবং সে-পথ ধরেই ক্রমে বিদায় নেবে পাত্রপাত্রী চাই-এর বিজ্ঞাপন থেকে ‘সরকারি চাকরি’ নামক অ্যাক্রোনিম।
এই সামাজিক পরিবর্তনগুলো ভালো না মন্দ, সে প্রসঙ্গ অবশ্য ভিন্ন।
লেখক কলামনিস্ট ও লেখক
শেয়ার করুন
চিররঞ্জন সরকার | ১৫ মে, ২০২২ ০০:০০

আমাদের দেশে সরকারি চাকরির প্রতি আকর্ষণ দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। ১০ বছর বা ১৫ বছর আগেও সরকারি চাকরিতে এত বেশি প্রতিযোগী ছিল না। কিন্তু বর্তমানে সরকারি চাকরি আক্ষরিক অর্থেই যেন সোনার হরিণ। একটি পদের বিপরীতে হাজার হাজার আবেদন জমা পড়ে। ১১ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের নিয়োগে আবেদন জমা পড়ে প্রায় ২৬ লাখ। খাদ্য অধিদপ্তরের ১ হাজার ১০০ জন নিয়োগের বিপরীতে আবেদন জমা পড়ে প্রায় ১৫ লাখ। দেশের বেশিরভাগ মানুষের আকাক্সক্ষা এখন একটা সরকারি চাকরি। সরকারি চাকরির প্রতি কেন এই মোহ? বেতন বৃদ্ধিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সরকারি চাকরিতে আগ্রহ বেড়েছেÑএকথা ঠিক। তবে সরকারি চাকরির প্রতি আকর্ষণের আরও নানা কারণ আছে।
একটা ঘটনা উল্লেখ করা যাক। পরিচিত একজন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো কাজ করেন, বেশ মোটা অংকের মাইনে পান। তিনি হঠাৎ সিটি করপোরেশন অফিসে একটা পদে চাকরি করার পরীক্ষায় বসলেন। কেন তিনি এখানে চাকরির আবেদন করছেন, জিজ্ঞেস করায় বললেন, সরকারি চাকরি, তাই পেনশন পাবেন। তা ছাড়া, প্রতিদিন যেতে হবে না, দেরি করে গেলেও চলবে, কাজ না করলে চাকরি যাবে না। আর শুনেছেন ‘উপরি রোজগারের’ সুযোগ আছে। সরকারি চাকরির এমন অনেক জ্ঞাত-অজ্ঞাত ‘আকর্ষণ’ রয়েছে। সরকারি চাকরির মস্ত সুবিধা হলো, সেখানে চাকরি যাওয়ার ঝুঁকি কম। রাষ্ট্র দীর্ঘকাল ধরে এই মানসিকতাকে সযতেœ লালন-পালন করেছে এবং করছে। একটি সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করা দশ হাজার জনের সবাই যে কেবল বেকার বলে সরকারি চাকরির পেছনে দৌড়াচ্ছেন, তা নয়। যাতে বেশি কাজ করতে না হয় সেই আশায় সরকারি চাকরি খুঁজছেন। এমন মানুষও একেবারে কম নয়।
আমার পরিচিত একজন পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করেন। তার সঙ্গে একদিন কথা হচ্ছিল। তিনি জানতে চান, আমি কখন অফিসে যাই। আমি তাকে জানালাম যে, আমাকে সাড়ে আটটার মধ্যে অফিসে যেতে হয় এবং সোয়া পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করতে হয়। এতে তিনি খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা যা বলেছেন তাতে আমি বিস্মিত। তিনি ফ্রি-স্টাইলে অফিস করেন। যখন মনে হয়, তখন যান, আবার যখন ইচ্ছে বের হয়ে পড়েন। তাকে কেউ ঘাঁটাতে সাহস পান না। বর্তমানে তিনি সরকারি দলের সিবিএ-র নেতা হয়েছেন। বড় কর্তাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে দেনদরবার করেন। সবাই তাকে সমীহ করে চলেন। অফিসের কাজ করার ক্ষেত্রে তার বড় ‘সময়াভাব’, কারণ তাকে ‘সংগঠন’-এর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। তার বক্তব্য শুনে খুবই ‘হিংসে’ হয়েছে। এমন সরকারি চাকরি কে না চাইবে? তা ছাড়া বর্তমানে সরকারি চাকরিতে বেতন স্কেল সুবিধা যথেষ্ট বাড়নো হয়েছে। এর পাশাপাশি প্রতি বছর পাঁচ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি, পদোন্নতির সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, চাকরির নিরাপত্তা, পর্যাপ্ত ছুটি, পরিবহন ও আবাসন সুবিধা, সন্তানদের স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার, অবসরকালীন সুবিধার পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদাও সরকারি চাকরির অন্যতম ভালো দিক।
প্রথম শ্রেণির পাশাপাশি দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতেও এখন বেতন কাঠামো আকর্ষণীয়। এই পদগুলোতে যারা যোগ দেন, তাদের সমান শিক্ষাগত এবং অন্যান্য যোগ্যতা নিয়ে বেসরকারি চাকরিতে এসব সুযোগ-সুবিধা অনেক কম। সেখানে সুনির্দিষ্ট কাঠামো না থাকা, পদোন্নতির জন্য কাজের চেয়ে নিয়োগকর্তার সুনজরে পড়ার বিষয়ও থাকে। এর বাইরেও বেশকিছু বিষয় রয়েছে। যেমন মাতৃত্বকালীন ছুটি বেশিরভাগ বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য চার মাস হলেও সরকারি চাকরিজীবীরা এই ছুটি পান ছয় মাসের। নৈমিত্তিক ছুটি সরকারি চাকুরেরা ইচ্ছা অনুযায়ী কাটাতে পারলেও বেসরকারি চাকুরেরা সে সুবিধা পান না অনেক ক্ষেত্রেই। অসুস্থতাজনিত ছুটির ক্ষেত্রেও বৈষম্য রয়েছে। আবার সরকারি চাকুরেদের অর্জিত ছুটি জমলে এর বিনিময়ে টাকার জন্য দুশ্চিন্তা করতে হয় না, কিন্তু বেসরকারি চাকরির অনেক ক্ষেত্রেই এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। সরকারি চাকরিতে আগ্রহের সবচেয়ে বড় কারণ চাকরির নিশ্চয়তা। এটা বেসরকারি খাতের চাকরিতে নেই। কারণ বেসরকারি খাতে সহজেই চাকরিচ্যুত করা যায়। কিন্তু সরকারি চাকরি সহজে যায় না। সামাজিক স্বীকৃতিও অন্যতম একটা বড় কারণ। এছাড়া রয়েছে ক্ষমতা ব্যবহারের চর্চা। একজন সরকারি কর্মকর্তা ক্ষমতা চর্চা করতে পারেন। কিন্তু বেসরকারি খাতে একজন সর্বোচ্চ পদধারী ব্যক্তিও ক্ষমতা চর্চা করতে পারেন না।
সরকারি চাকরিতে সময় দেওয়ার নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা আছে। কিন্তু বেসরকারি খাতে সেটা নেই। এসব মিলিয়ে তরুণদের প্রথম পছন্দ থাকে সরকারি চাকরির দিকে। সময় মাপা কাজ কে না করতে চায়! এ ছাড়া বেসরকারি চাকরির তুলনায় সরকারি চাকরি করলে লোন পেতে বেশি সুবিধা পাওয়া যায়। তাই লোন পাওয়া নিয়ে বেশি ছুটোছুটি করতে হয় না। আর ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই, আছে পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটির ব্যাপারটাও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অনেক বড় একটি কাক্সিক্ষত বিষয়।
সরকারি চাকরির প্রতি এই মোহ কিন্তু আমাদের সমাজ-জীবনে একেবারে গা-সওয়া ঘটনা। যে কোনো কাগজের পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনেই এর প্রমাণ মিলবে। যেখানে সদর্পে ঘোষণা করা হয় যে, কেবলমাত্র সরকারি চাকুরে পাত্রের তরফেই যেন যোগাযোগ করা হয়! তাইতো সরকারি চাকরির প্রতি সমাজের সব মানুষেরই প্রবল মোহ। বেশিরভাগ ছাত্রই পড়াশুনার শেষে, বা তার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক, পোস্ট অফিস, রেল, এলআইসি, ইত্যাদি নানা চাকরির পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। যারা আরও ভালো, তাদের অনেকের আবার পছন্দ বিসিএস, যার গ্ল্যামার, ক্ষমতা এবং মাইনে বেশ ওপরের দিকে।
এমনিতে সরকারি চাকরির মাইনে আকাশছোঁয়া সাংঘাতিক কিছু না-হলেও মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার নিরিখে বেশ ভালোই। কিন্তু আসল কথা হলো ‘উপরি উপার্জনের সুযোগ’, নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা, চিকিৎসা এবং অবসরকালীন বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। আর সেই সঙ্গে অগণিত মানুষ মনে করে, সরকারি চাকরি যেন পাওয়াটাই কঠিন, পেয়ে গেলে কাজ বিশেষ না করলেও চলে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি কয়েক দশক ধরে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে, অথচ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের জন্য যথেষ্ট কাজ তৈরি হয়নি। এর জন্য সরকারি নীতি কতটা দায়ী, চেষ্টা করলে সরকার শিল্পপতিদের কতটা প্রভাবিত করতে পারত, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু যেটুকু সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেটুকু কি করতে পেরেছে? চুক্তিতে নিয়োগের নীতি গ্রহণ করে সরকার শিক্ষিত কর্মপ্রার্থীকে আরও কোণঠাসা করছে। বহু কর্মীকে অতি সামান্য বেতনে কাজ করাচ্ছে। অনেক সময়েই তা এমন কাজ, যা এক জন পুরো সময়ের কর্মীর করার কথা। শিক্ষানবিশ বা সহকারী শিক্ষক পুরো স্কুল চালাচ্ছেন, পিয়ন করছেন কেরানির কাজ, স্বাস্থ্যকর্মী চিকিৎসা চালাচ্ছেন। স্বল্প টাকা মাইনের অস্থায়ী কর্মী দিয়েই যখন দপ্তর চলছে, তখন নতুন নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া কেন? বেকারের তো অভাব নেই। স্থায়ীকর্মীর চাইতেও কয়েক গুণ বেশি খাটিয়ে অফিসে, স্কুলে, আদালতে, থানায় নামমাত্র বেতনের লোক পুষছে সরকার।
ফলে সমান কাজ করেও সমান বেতন জুটছে না। রোজগারে অসাম্য বাড়ছে, যা সমাজে অস্থিরতার এক প্রধান কারণ। কিন্তু আরও বড় ক্ষতি হচ্ছে ভেতরে ভেতরে। পড়াশোনা করলে, পরিশ্রম করলে, নিজেকে তৈরি করতে পারলে জীবনে উন্নতি হবে এই বিশ্বাস জীবনের ভিত্তি। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে যুদ্ধাপরাধী-সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন, বহু সংকটের সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রত্যয়ে বাংলার কিশোর-তরুণ প্রজন্ম ভেঙে না পড়ে, ভেসে না গিয়ে, এগিয়ে গিয়েছে। এই আস্থা যদি টলে যায়, যদি মনে হয় যে পরিশ্রম তার উচিত মূল্য পাবে না বাজার বা রাষ্ট্রের থেকে, তখন অন্য এক সংকট জন্ম নেয়। তার চিহ্ন আজ চারদিকে। যথেষ্ট কাজ তৈরি না করা, কিংবা নামমাত্র বেতনে কাজ করানোর কী মূল্য দিতে হবে দেশকে, তার হিসাব কে কষবে?
তবে একথা সত্যি যে, সমাজ বদলাবে। আমি বা আপনি চাইলেও, কিংবা গভীরভাবে বিরোধিতা করলেও। সরকারি বা আধা-সরকারি চাকরির নিরাপত্তার চক্রব্যূহ ক্রমশ ভঙ্গুর হয়ে পড়বে এবং তা দ্রুতগতিতে। গোটা পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক ধরনের ভবিষ্যৎই গড়ে উঠবে। হয়তো একসময় আমরা দেখব, চাকরি বাঁচাতে গড়পড়তা সরকারি চাকুরেদেরও খাটতে হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরেদের মতো। সরকারি চাকরির নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের নিরাপত্তার ‘মিথ’ ভেঙে চুরমার হয়ে পড়বে। এবং সে-পথ ধরেই ক্রমে বিদায় নেবে পাত্রপাত্রী চাই-এর বিজ্ঞাপন থেকে ‘সরকারি চাকরি’ নামক অ্যাক্রোনিম।
এই সামাজিক পরিবর্তনগুলো ভালো না মন্দ, সে প্রসঙ্গ অবশ্য ভিন্ন।
লেখক কলামনিস্ট ও লেখক