দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা
শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন | ১৬ মে, ২০২২ ০০:০০
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতির মস্তিষ্ক। যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন আমরা দেখি, সে বাংলাদেশ গড়ে উঠবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীদের মেধার ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু সে তরুণদের গড়ে ওঠা কি ঠিকমতো হচ্ছে? শুধু র্যাগিং নয় মাদক, অনিরাপদ ও অস্বাস্থ্যকর হল, বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট, মানহীন খাবার, কোর্স শিক্ষকদের অদায়িত্বশীল আচরণ এবং নানা ধরনের বাজে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার হতে হয় আমাদের। ফলে একরাশ হতাশা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয় আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। আমাদের চেয়ে আরও বেশি সমস্যা ও সংকটে জর্জরিত। তবুও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্দীপ্ত রবির মতো দেশ গঠনে বের হচ্ছে হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষ করতে করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজে অভিজ্ঞতায় একবার হতাশায় ভুগেন। পড়াশোনা শেষ হলে তৈরি হয় বেকারত্বের হতাশা। এত হতাশায় শিক্ষার্থীরা হয়ে ওঠে আত্মকেন্দ্রিক, ক্ষুব্ধ ও আশাহীন। অথচ প্রত্যেক নবীন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে, উদ্দীপনা ও তারুণ্যের শক্তি নিয়ে। দেশে প্রতিবছর ১৪-১৫ লাখ শিক্ষার্থী এইচএসসি পাস করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট আছে ৬০ হাজারের মতো। তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আসন অর্জন করতে হয়। উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো যে শিক্ষার্থীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পছন্দের সাবজেক্ট পড়ার সুযোগ পায় না। অনেকটা লটারির মতো তার গ্র্যাজুয়েশন সাবজেক্ট ঠিক হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন চান্স পেলাম, ভর্তি হলাম সেদিন পর্যন্ত চোখেমুখে ছিল উদ্দীপ্ত স্বপ্ন। বড়দের কাছে শুনেছি, শুধু অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা নয় সহ-শিক্ষার প্রসারে বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য ভূমিকা রাখে। যেদিন একাদশ শ্রেণির প্রথম ক্লাস ছিল তার আগের রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। মাধ্যমিক শেষ করে কলেজের ক্লাস করতে যাব এই উত্তেজনা ছিল বাঁধভাঙা। ঠিক তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাসের আগের রাতও ছিল তেমন। চুল কেটে, প্যান্ট-শার্ট ইন করে ভদ্র ছেলের মতো প্রথম ক্লাসে গিয়ে উপস্থিত হলাম। বিভাগের শিক্ষকদের ওরিয়েন্টশনের পরে শুরু হয়েছিল কথিত বড় ভাইদের ওরিয়েন্টেশন। তারা এসেছেন ম্যানার শেখাতে! কী আশ্চর্য! বিশ্ববিদ্যালয় জেনেশুনে ‘ম্যানার’ শেখানো কোর্সের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন কথিত বড় ভাইদের হাতে। ম্যানার শিখে বিধ্বংস্ত হয়ে হলে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম। আমার হল ও রুম নম্বর জানার জন্য গেলাম বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে। সেখানে আমার নামের পাশে হলের নাম আছে কিন্তু রুম নম্বর নেই। রুম নম্বর জানার জন্য হল অফিসে গেলাম। কিন্তু একজন গার্ড আমাকে দেখিয়ে দিলেন একটি বৃহদাকারের রুম। যেখানে দু’শর মতো শিক্ষার্থী শুয়ে আছে। যেখানে কারও পা যেখানে শেষ সেখানে অন্যের মাথা শুরু। যেন শরণার্থী বহন করা ভূমধ্যসাগরের একটি জাহাজ। বড় রুমটিতে যারা আছেন তাদের চোখেমুখে ভয় আর আতঙ্ক। তখনো পরিস্থিতি বুঝতে পারিনি। রাতে ১১টা ছুঁই ছ্ুঁই। এলেন একদল বড় ভাই। মনে হলো আমরা সবাই আসামি, তারা সবাই পুলিশ। এরপর শুরু হলো ‘চ’ বর্গীয় গালি। প্রত্যেকটা গালি মা’কে উদ্দেশ্য করে। যেন মা আমাদের জনম দিয়ে বড় অন্যায় করে ফেলেছেন।
এভাবেই প্রথম বর্ষ শেষ হয়। দ্বিতীয় বর্ষে পাওয়া যায় আরেকটু ছোট রুম। ১৫/১০ ফুটের একটি রুম। থাকতে হবে ১২ জনকে। কারও ঘুমের ঠিক নেই। গোসলের ঠিক নেই। এসবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আমার গ্র্যাজুয়েশন জীবন অর্ধেক শেষ হয়। রাতে ঘুমাতে না পারা আমরা ঢুলুঢুলু চোখে সকালে ক্লাসে যাই। ক্লাসে শিক্ষক কী পড়ান বুঝি না। কিন্তু অ্যাটেন্ডেস না থাকলে পরীক্ষা দিতে দেবে না। ক্লাসে গিয়ে ঘুমালেও অ্যাটেনডেন্সে ১০ নম্বর পাওয়া যায়। স্কুল বা কলেজে যেখানে অ্যাটেনডেন্সের ওপর কোনো মার্কস পাইনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাটেনডেন্স মার্কস আছে সেটা দ্বিতীয় বর্ষের আগ পর্যন্ত বিশ্বাসই হচ্ছিল না। হলে খাবার পানি নিতে হয় ট্যাপ থেকে। বিশেষ বিশুদ্ধতার কোনো ব্যবস্থা নেই। পানির ট্যাংকে শ্যাওলা জমেছে। হলের ক্যান্টিনের খাবার মুখে দেওয়া যায় না। মেডিকেলে পেট খারাপের রোগীর লাইন। এরপর আসে বড় ভাইদের সঙ্গে ইন্টিমিসি তৈরির পালা। সে ইন্টিমিসি তৈরির বেড়াজালে হাতে ওঠে মাদক। যখন জীবনকে বুঝতে পারে সবাই তখন তৃতীয় বর্ষ শেষ। চরম হতাশা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা, টাকার সংকট, টিউশনি চলে যাওয়া নানা হতাশায় আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে সবাইকে।
এখন নয়াদিল্লির একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছি। যেদিন প্রথম হলে এলাম সেদিনই নিজের রুম বুঝিয়ে দিল হোস্টেল কর্তৃপক্ষ। ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পর একদিনও রুমে থাকা যাবে না। যদি কোনো সেমিস্টার ড্রপ যায় তাহলে তা শেষ করতে হবে নিজের আবাসন থেকে। এটা ভারতের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম। ক্যাম্পাসে শক্তিশালী ফ্রি ইন্টারনেট। আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোতে ফ্রি এক্সেস। গ্র্যাজুয়েশনে থাকা অবস্থায় ভারতীয় শিক্ষার্থীরা জার্নালে লেখাও শুরু করে। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার এমনভাবে মেন্যু সাজানো যেন শিক্ষার্থীদের পুষ্টির সংকট না হয়। মাসে ৩ হাজার টাকায় যে খাবার পাওয়া যায় তা বাংলাদেশের ১০ হাজারেও সম্ভব না। এখানে সম্ভব কারণ এখানে কোনো মেস বা ক্যান্টিন কর্তৃপক্ষকে ছাত্র নেতাদের চাঁদা দিতে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশুদ্ধ খাবার পানি নিশ্চিত করেছে বিভাগ ও হলের করিডরে। শিক্ষার্থীদের রয়েছে মানসম্মত স্বাস্থ্যবীমা। পড়ালেখা শেষ করে একবছর বেকার বসে থেকে চাকরির আবেদন করার চাপ নেই। শেষ সেমিস্টারের আগের সেমিস্টারগুলোর রেজাল্ট দিয়ে সম্ভাব্য গ্র্যাজুয়েটরা প্রায় সব চাকরির আবেদন করতে পারে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা, দুশ্চিন্তা নেই, ভগ্ন স্বাস্থ্য নেই।
কিন্তু আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে গিয়ে আমাদের শরীর ও মন দুটোই নষ্ট হয়ে যায়। সঙ্গে নষ্ট করে দেওয়া চিন্তার মস্তিষ্কও। বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন অবস্থায় রেখে আমরা বলছি উন্নতি করছি। সুউচ্চ ভবন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন নয়। শিক্ষা ও গবেষণাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল সমৃদ্ধির মাপকাঠি। রাতে ঘুমাতে পারে না, ঠিক মতো খেতে পারে না, থাকার জায়গা নেই, শিক্ষার্থীরা কীভাবে গবেষণা করবে? আমরা সবাই বলছি এগিয়ে যাচ্ছি এগিয়ে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি কেউ জানি না। যে উচ্চশিক্ষা জাতি গঠনের ভিত্তি হয়ে থাকার কথা সেখানে যখন এমন হতাশা তখন জাতি আশাবাদী হবে কীভাবে?
লেখক : শিক্ষার্থী, সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লি
শেয়ার করুন
শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন | ১৬ মে, ২০২২ ০০:০০

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতির মস্তিষ্ক। যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন আমরা দেখি, সে বাংলাদেশ গড়ে উঠবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীদের মেধার ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু সে তরুণদের গড়ে ওঠা কি ঠিকমতো হচ্ছে? শুধু র্যাগিং নয় মাদক, অনিরাপদ ও অস্বাস্থ্যকর হল, বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট, মানহীন খাবার, কোর্স শিক্ষকদের অদায়িত্বশীল আচরণ এবং নানা ধরনের বাজে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার হতে হয় আমাদের। ফলে একরাশ হতাশা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয় আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। আমাদের চেয়ে আরও বেশি সমস্যা ও সংকটে জর্জরিত। তবুও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্দীপ্ত রবির মতো দেশ গঠনে বের হচ্ছে হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষ করতে করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজে অভিজ্ঞতায় একবার হতাশায় ভুগেন। পড়াশোনা শেষ হলে তৈরি হয় বেকারত্বের হতাশা। এত হতাশায় শিক্ষার্থীরা হয়ে ওঠে আত্মকেন্দ্রিক, ক্ষুব্ধ ও আশাহীন। অথচ প্রত্যেক নবীন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে, উদ্দীপনা ও তারুণ্যের শক্তি নিয়ে। দেশে প্রতিবছর ১৪-১৫ লাখ শিক্ষার্থী এইচএসসি পাস করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট আছে ৬০ হাজারের মতো। তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আসন অর্জন করতে হয়। উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো যে শিক্ষার্থীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পছন্দের সাবজেক্ট পড়ার সুযোগ পায় না। অনেকটা লটারির মতো তার গ্র্যাজুয়েশন সাবজেক্ট ঠিক হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন চান্স পেলাম, ভর্তি হলাম সেদিন পর্যন্ত চোখেমুখে ছিল উদ্দীপ্ত স্বপ্ন। বড়দের কাছে শুনেছি, শুধু অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা নয় সহ-শিক্ষার প্রসারে বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য ভূমিকা রাখে। যেদিন একাদশ শ্রেণির প্রথম ক্লাস ছিল তার আগের রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। মাধ্যমিক শেষ করে কলেজের ক্লাস করতে যাব এই উত্তেজনা ছিল বাঁধভাঙা। ঠিক তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাসের আগের রাতও ছিল তেমন। চুল কেটে, প্যান্ট-শার্ট ইন করে ভদ্র ছেলের মতো প্রথম ক্লাসে গিয়ে উপস্থিত হলাম। বিভাগের শিক্ষকদের ওরিয়েন্টশনের পরে শুরু হয়েছিল কথিত বড় ভাইদের ওরিয়েন্টেশন। তারা এসেছেন ম্যানার শেখাতে! কী আশ্চর্য! বিশ্ববিদ্যালয় জেনেশুনে ‘ম্যানার’ শেখানো কোর্সের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন কথিত বড় ভাইদের হাতে। ম্যানার শিখে বিধ্বংস্ত হয়ে হলে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম। আমার হল ও রুম নম্বর জানার জন্য গেলাম বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে। সেখানে আমার নামের পাশে হলের নাম আছে কিন্তু রুম নম্বর নেই। রুম নম্বর জানার জন্য হল অফিসে গেলাম। কিন্তু একজন গার্ড আমাকে দেখিয়ে দিলেন একটি বৃহদাকারের রুম। যেখানে দু’শর মতো শিক্ষার্থী শুয়ে আছে। যেখানে কারও পা যেখানে শেষ সেখানে অন্যের মাথা শুরু। যেন শরণার্থী বহন করা ভূমধ্যসাগরের একটি জাহাজ। বড় রুমটিতে যারা আছেন তাদের চোখেমুখে ভয় আর আতঙ্ক। তখনো পরিস্থিতি বুঝতে পারিনি। রাতে ১১টা ছুঁই ছ্ুঁই। এলেন একদল বড় ভাই। মনে হলো আমরা সবাই আসামি, তারা সবাই পুলিশ। এরপর শুরু হলো ‘চ’ বর্গীয় গালি। প্রত্যেকটা গালি মা’কে উদ্দেশ্য করে। যেন মা আমাদের জনম দিয়ে বড় অন্যায় করে ফেলেছেন।
এভাবেই প্রথম বর্ষ শেষ হয়। দ্বিতীয় বর্ষে পাওয়া যায় আরেকটু ছোট রুম। ১৫/১০ ফুটের একটি রুম। থাকতে হবে ১২ জনকে। কারও ঘুমের ঠিক নেই। গোসলের ঠিক নেই। এসবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আমার গ্র্যাজুয়েশন জীবন অর্ধেক শেষ হয়। রাতে ঘুমাতে না পারা আমরা ঢুলুঢুলু চোখে সকালে ক্লাসে যাই। ক্লাসে শিক্ষক কী পড়ান বুঝি না। কিন্তু অ্যাটেন্ডেস না থাকলে পরীক্ষা দিতে দেবে না। ক্লাসে গিয়ে ঘুমালেও অ্যাটেনডেন্সে ১০ নম্বর পাওয়া যায়। স্কুল বা কলেজে যেখানে অ্যাটেনডেন্সের ওপর কোনো মার্কস পাইনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাটেনডেন্স মার্কস আছে সেটা দ্বিতীয় বর্ষের আগ পর্যন্ত বিশ্বাসই হচ্ছিল না। হলে খাবার পানি নিতে হয় ট্যাপ থেকে। বিশেষ বিশুদ্ধতার কোনো ব্যবস্থা নেই। পানির ট্যাংকে শ্যাওলা জমেছে। হলের ক্যান্টিনের খাবার মুখে দেওয়া যায় না। মেডিকেলে পেট খারাপের রোগীর লাইন। এরপর আসে বড় ভাইদের সঙ্গে ইন্টিমিসি তৈরির পালা। সে ইন্টিমিসি তৈরির বেড়াজালে হাতে ওঠে মাদক। যখন জীবনকে বুঝতে পারে সবাই তখন তৃতীয় বর্ষ শেষ। চরম হতাশা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা, টাকার সংকট, টিউশনি চলে যাওয়া নানা হতাশায় আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে সবাইকে।
এখন নয়াদিল্লির একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছি। যেদিন প্রথম হলে এলাম সেদিনই নিজের রুম বুঝিয়ে দিল হোস্টেল কর্তৃপক্ষ। ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পর একদিনও রুমে থাকা যাবে না। যদি কোনো সেমিস্টার ড্রপ যায় তাহলে তা শেষ করতে হবে নিজের আবাসন থেকে। এটা ভারতের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম। ক্যাম্পাসে শক্তিশালী ফ্রি ইন্টারনেট। আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোতে ফ্রি এক্সেস। গ্র্যাজুয়েশনে থাকা অবস্থায় ভারতীয় শিক্ষার্থীরা জার্নালে লেখাও শুরু করে। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার এমনভাবে মেন্যু সাজানো যেন শিক্ষার্থীদের পুষ্টির সংকট না হয়। মাসে ৩ হাজার টাকায় যে খাবার পাওয়া যায় তা বাংলাদেশের ১০ হাজারেও সম্ভব না। এখানে সম্ভব কারণ এখানে কোনো মেস বা ক্যান্টিন কর্তৃপক্ষকে ছাত্র নেতাদের চাঁদা দিতে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশুদ্ধ খাবার পানি নিশ্চিত করেছে বিভাগ ও হলের করিডরে। শিক্ষার্থীদের রয়েছে মানসম্মত স্বাস্থ্যবীমা। পড়ালেখা শেষ করে একবছর বেকার বসে থেকে চাকরির আবেদন করার চাপ নেই। শেষ সেমিস্টারের আগের সেমিস্টারগুলোর রেজাল্ট দিয়ে সম্ভাব্য গ্র্যাজুয়েটরা প্রায় সব চাকরির আবেদন করতে পারে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা, দুশ্চিন্তা নেই, ভগ্ন স্বাস্থ্য নেই।
কিন্তু আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে গিয়ে আমাদের শরীর ও মন দুটোই নষ্ট হয়ে যায়। সঙ্গে নষ্ট করে দেওয়া চিন্তার মস্তিষ্কও। বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন অবস্থায় রেখে আমরা বলছি উন্নতি করছি। সুউচ্চ ভবন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন নয়। শিক্ষা ও গবেষণাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল সমৃদ্ধির মাপকাঠি। রাতে ঘুমাতে পারে না, ঠিক মতো খেতে পারে না, থাকার জায়গা নেই, শিক্ষার্থীরা কীভাবে গবেষণা করবে? আমরা সবাই বলছি এগিয়ে যাচ্ছি এগিয়ে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি কেউ জানি না। যে উচ্চশিক্ষা জাতি গঠনের ভিত্তি হয়ে থাকার কথা সেখানে যখন এমন হতাশা তখন জাতি আশাবাদী হবে কীভাবে?
লেখক : শিক্ষার্থী, সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লি