সালামের মাজেজা
| ২৭ মে, ২০২২ ০০:০০
সালাম বিনিময় আমাদের সংস্কৃতিতে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও কুশল বিনিময়ের সাধারণ কেতা হলেও অনেক ক্ষেত্রে একটা সালাম দেওয়া বা না দেওয়া একেবারেই উল্টো অর্থ বহন করতে পারে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনটা মারাত্মক পরিণতিও বয়ে আনতে পারে। যেমনটা ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সাজ্জাদুল হকের ক্ষেত্রে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ছাত্রলীগের এক কর্মীকে সালাম দিতে দেরি হওয়ায় তার হাতে চড়-থাপ্পড়-কিল-ঘুষি-লাথির শিকার হয়েছেন সাজ্জাদুল। গত মঙ্গলবার রাতে মাস্টার দা সূর্য সেন হলে এ ঘটনা ঘটে। প্রাধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগে সাজ্জাদুল জানিয়েছেন, নিজের কক্ষে বসে অনলাইনে টিউশনের ক্লাস নেওয়ার সময় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগকর্মী মানিকুর রহমান ওরফে মানিক কয়েকজন সঙ্গীসহ তার কক্ষে প্রবেশ করেন। এ সময় সালাম দিতে দেরি হওয়ার ‘অপরাধে’ তাকে মারধর করেন ছাত্রলীগকর্মী মানিক। প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, সাজ্জাদুলকে মারধরের অভিযোগ অস্বীকার না করে সূর্য সেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিয়াম রহমান জানিয়েছেন, সাজ্জাদুলকে মারধরের ঘটনায় অভিযুক্ত মানিকুর রহমান ‘দুঃখ প্রকাশ’ করেছেন। এ ঘটনা সাক্ষ্য দিচ্ছে, আমাদের শিক্ষাঙ্গনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সালাম এখন আর কেবল সৌহার্র্দ্যরে সংস্কৃতি নয় সালাম এখন ক্ষমতাবানের প্রাপ্য আর ক্ষমতাহীনের কর্তব্য। প্রশ্ন হলো, সালামের সংস্কৃতির এ রূপান্তরকে আমরা ক্ষমতার রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ করছি কি না।
এই সালাম-সংস্কৃতি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, সারা দেশের প্রায় সব শিক্ষাঙ্গনে চলমান ছাত্ররাজনীতির এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাবানের প্রাপ্য আর ক্ষমতাহীনের কর্তব্যের এই সাধারণ সূত্র শুধু সালামেই নয়, মতপ্রকাশ থেকে শুরু করে প্রায় সব ক্ষেত্রেই ক্ষমতাচর্চার এক অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। ঠিক যে কারণে কর্মীরা নেতাদের, নেতারা বড় নেতাদের, বড় নেতারা শীর্ষ নেতাদের যেকোনো কথায় যেকোনো অবস্থানে প্রশ্নহীনভাবে ‘সহমত ভাই’ বলে থাকেন। রাজনৈতিক বড় ভাই বা কোনো নেতা নির্দেশ দিলে, সহপাঠী ছাত্র কিংবা ছাত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য থাকতে হয় কর্মিবাহিনী রাজনৈতিক ছোট ভাইবোনদের। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি ছাত্রাবাস এবং ক্যাম্পাসে সব শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ ও অধিকারের গণতান্ত্রিক চর্চা প্রতিষ্ঠা করতে পারত তাহলে এমন বলপ্রয়োগ ও ক্ষমতাচর্চার অপরাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটাই সহজ হতো। কিন্তু সেই বাস্তবতা যে সুদূরপরাহত তা এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত দুদিন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের সংঘাত-সহিংসতার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। দুদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যেভাবে বিরোধী দল বিএনপির সহযোগী ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হয়েছে এবং পুলিশের উপস্থিতিতে নির্বিচারে সহিংসতা চালিয়েছে তা ন্যক্কারজনক। অবশ্য যে কেউ বলতেই পারেন যে, ক্ষমতাসীনরা আজ যেমন শিক্ষাঙ্গনগুলোতে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে এখনকার বিরোধী দলও ক্ষমতায় থাকাকালে একই কাজ করেছে। আসলে এ তুলনাও এমনই এক ফাঁদ যা ক্ষমতার রাজনীতির এই খাদ থেকে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে কখনোই তুলে আনবে না।
সালামের মাজেজার এই রূপক যেমন পাঠ করা জরুরি, একইভাবে জরুরি হাতে হাতে লাঠি-বাঁশ-রড-আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের দুই দলের সংঘাত-সহিংসতার নির্মম ছবি পাঠ করা। শিক্ষা-সংস্কৃতিক কর্মকা-ের বদলে শিক্ষাঙ্গনের এই রণক্ষেত্র রূপের তরজমা যদি আজ আমরা না করি তাহলে তা যে ভয়াবহ আত্মঘাতী পরিণতি বয়ে আনবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ সংবাদপত্রের পাতায়, টেলিভিশনে এই দৃশ্য নির্বিকারভাবে দেখছে প্রশাসন, সরকার আর জনসাধারণ। যেন এটি খুবই সাধারণ কোনো ঘটনা। জাতির যে সন্তানদের আজ জ্ঞানচর্চা আর মেধামননের বিকাশে নিমগ্ন থাকার কথা সেই শিক্ষার্থীদের শুধুই ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে সন্ত্রাসী বানিয়ে ফেলা পুরো জাতির জন্যই লজ্জার। প্রশ্ন হলো, এই লজ্জা আমরা অনুধাবন করি কি না? দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর এ পরিণতির দায় স্বীকার করতে আমরা প্রস্তুত কি না? মনে রাখা দরকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য জ্ঞানচর্চা করা, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিবিড় আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে সেই জ্ঞানের চর্চা হবে, নতুন জ্ঞান বিকাশের পথ তৈরি হবে। এজন্য শ্রেণিকক্ষের মতো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও মুক্ত পরিসর সমান জরুরি। এই মুক্ত পরিসর শুধু ভৌত অর্থে স্থান নয় বরং সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক জ্ঞানতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিসর। কি শ্রেণিকক্ষে, কি ছাত্রাবাসে, কি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা যদি মুক্তপরিসরের এই গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় আর নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি এভাবে জ্ঞানচর্চার বদলে ক্ষমতাচর্চার রণক্ষেত্র হয়ে উঠে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য কীভাবে সফল হবে?
শেয়ার করুন
| ২৭ মে, ২০২২ ০০:০০

সালাম বিনিময় আমাদের সংস্কৃতিতে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও কুশল বিনিময়ের সাধারণ কেতা হলেও অনেক ক্ষেত্রে একটা সালাম দেওয়া বা না দেওয়া একেবারেই উল্টো অর্থ বহন করতে পারে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনটা মারাত্মক পরিণতিও বয়ে আনতে পারে। যেমনটা ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সাজ্জাদুল হকের ক্ষেত্রে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ছাত্রলীগের এক কর্মীকে সালাম দিতে দেরি হওয়ায় তার হাতে চড়-থাপ্পড়-কিল-ঘুষি-লাথির শিকার হয়েছেন সাজ্জাদুল। গত মঙ্গলবার রাতে মাস্টার দা সূর্য সেন হলে এ ঘটনা ঘটে। প্রাধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগে সাজ্জাদুল জানিয়েছেন, নিজের কক্ষে বসে অনলাইনে টিউশনের ক্লাস নেওয়ার সময় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগকর্মী মানিকুর রহমান ওরফে মানিক কয়েকজন সঙ্গীসহ তার কক্ষে প্রবেশ করেন। এ সময় সালাম দিতে দেরি হওয়ার ‘অপরাধে’ তাকে মারধর করেন ছাত্রলীগকর্মী মানিক। প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, সাজ্জাদুলকে মারধরের অভিযোগ অস্বীকার না করে সূর্য সেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিয়াম রহমান জানিয়েছেন, সাজ্জাদুলকে মারধরের ঘটনায় অভিযুক্ত মানিকুর রহমান ‘দুঃখ প্রকাশ’ করেছেন। এ ঘটনা সাক্ষ্য দিচ্ছে, আমাদের শিক্ষাঙ্গনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সালাম এখন আর কেবল সৌহার্র্দ্যরে সংস্কৃতি নয় সালাম এখন ক্ষমতাবানের প্রাপ্য আর ক্ষমতাহীনের কর্তব্য। প্রশ্ন হলো, সালামের সংস্কৃতির এ রূপান্তরকে আমরা ক্ষমতার রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ করছি কি না।
এই সালাম-সংস্কৃতি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, সারা দেশের প্রায় সব শিক্ষাঙ্গনে চলমান ছাত্ররাজনীতির এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাবানের প্রাপ্য আর ক্ষমতাহীনের কর্তব্যের এই সাধারণ সূত্র শুধু সালামেই নয়, মতপ্রকাশ থেকে শুরু করে প্রায় সব ক্ষেত্রেই ক্ষমতাচর্চার এক অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। ঠিক যে কারণে কর্মীরা নেতাদের, নেতারা বড় নেতাদের, বড় নেতারা শীর্ষ নেতাদের যেকোনো কথায় যেকোনো অবস্থানে প্রশ্নহীনভাবে ‘সহমত ভাই’ বলে থাকেন। রাজনৈতিক বড় ভাই বা কোনো নেতা নির্দেশ দিলে, সহপাঠী ছাত্র কিংবা ছাত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য থাকতে হয় কর্মিবাহিনী রাজনৈতিক ছোট ভাইবোনদের। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি ছাত্রাবাস এবং ক্যাম্পাসে সব শিক্ষার্থীর জন্য সমান সুযোগ ও অধিকারের গণতান্ত্রিক চর্চা প্রতিষ্ঠা করতে পারত তাহলে এমন বলপ্রয়োগ ও ক্ষমতাচর্চার অপরাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটাই সহজ হতো। কিন্তু সেই বাস্তবতা যে সুদূরপরাহত তা এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত দুদিন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের সংঘাত-সহিংসতার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। দুদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যেভাবে বিরোধী দল বিএনপির সহযোগী ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হয়েছে এবং পুলিশের উপস্থিতিতে নির্বিচারে সহিংসতা চালিয়েছে তা ন্যক্কারজনক। অবশ্য যে কেউ বলতেই পারেন যে, ক্ষমতাসীনরা আজ যেমন শিক্ষাঙ্গনগুলোতে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে এখনকার বিরোধী দলও ক্ষমতায় থাকাকালে একই কাজ করেছে। আসলে এ তুলনাও এমনই এক ফাঁদ যা ক্ষমতার রাজনীতির এই খাদ থেকে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে কখনোই তুলে আনবে না।
সালামের মাজেজার এই রূপক যেমন পাঠ করা জরুরি, একইভাবে জরুরি হাতে হাতে লাঠি-বাঁশ-রড-আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের দুই দলের সংঘাত-সহিংসতার নির্মম ছবি পাঠ করা। শিক্ষা-সংস্কৃতিক কর্মকা-ের বদলে শিক্ষাঙ্গনের এই রণক্ষেত্র রূপের তরজমা যদি আজ আমরা না করি তাহলে তা যে ভয়াবহ আত্মঘাতী পরিণতি বয়ে আনবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ সংবাদপত্রের পাতায়, টেলিভিশনে এই দৃশ্য নির্বিকারভাবে দেখছে প্রশাসন, সরকার আর জনসাধারণ। যেন এটি খুবই সাধারণ কোনো ঘটনা। জাতির যে সন্তানদের আজ জ্ঞানচর্চা আর মেধামননের বিকাশে নিমগ্ন থাকার কথা সেই শিক্ষার্থীদের শুধুই ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে সন্ত্রাসী বানিয়ে ফেলা পুরো জাতির জন্যই লজ্জার। প্রশ্ন হলো, এই লজ্জা আমরা অনুধাবন করি কি না? দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর এ পরিণতির দায় স্বীকার করতে আমরা প্রস্তুত কি না? মনে রাখা দরকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য জ্ঞানচর্চা করা, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিবিড় আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে সেই জ্ঞানের চর্চা হবে, নতুন জ্ঞান বিকাশের পথ তৈরি হবে। এজন্য শ্রেণিকক্ষের মতো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও মুক্ত পরিসর সমান জরুরি। এই মুক্ত পরিসর শুধু ভৌত অর্থে স্থান নয় বরং সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক জ্ঞানতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিসর। কি শ্রেণিকক্ষে, কি ছাত্রাবাসে, কি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা যদি মুক্তপরিসরের এই গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় আর নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি এভাবে জ্ঞানচর্চার বদলে ক্ষমতাচর্চার রণক্ষেত্র হয়ে উঠে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য কীভাবে সফল হবে?