বিপ্লবে ও সাহিত্যে সমর্পিত এক কমিউনিস্ট
সৌভিক রেজা | ২৭ মে, ২০২২ ০০:০০
সোমেন চন্দ জন্মেছিলেন শতবর্ষ আগে, আমাদের এই ঢাকা জেলাতেই। ঢাকা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বালিয়া গ্রামে। সোমেন চন্দ কে, কে এই সোমেন চন্দ? আমাদের সময়ের অন্যতম বিবেকবান মানুষ, প্রয়াত সরদার ফজলুল করিম একবার এইরকম একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে, অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছিলেন, ‘সোমেন চন্দকে একটা জেনারেশন চেনে না, কিন্তু একটা সময় আসছে যখন তরুণরা সোমেন চন্দকে মাটি খুঁড়ে বা’র করবে।’
২. আবারও সরদার ফজলুল করিমের কাছে যেতে হচ্ছে। তিনি লিখেছিলেন, ‘সোমেন কেবল সাহিত্যিক ছিলেন না। সোমেন ছিলেন জীবনের সৈনিক। বয়সের বিবেচনায় অত্যদ্ভুতভাবে সজ্ঞান, সতেজ আর সাহসী। সাহিত্যিক সৃষ্টি এসেছে তাঁর এই জীবনের অভিজ্ঞতা, অনুভূতি এবং উপলব্ধির ফসল নিয়ে।’ সেইসঙ্গে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘যুবক সোমেন যে-কয়টি গল্প লিখেছিলেন, তাঁর এই অল্প পরিসর জীবনে, তার সব কটিতে আছে দৃষ্টির স্বচ্ছতা আর অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর।’ এখন তো গবেষকদের কল্যাণে আমরা জানতে পারছি সোমেন চন্দ শুধুই গল্প লেখেননি; সেইসঙ্গে উপন্যাস, নাটিকা, কবিতাও রচনা করে গিয়েছেন। পবিত্র সরকার লিখেছিলেন, ‘প্রায় বাইশ বছরের জীবন ছিন্ন জীবন, তার মধ্যে সাহিত্য রচনা করেছেন শেষ চার-পাঁচ বছর মাত্র।’ পবিত্র সরকার সোমেন-প্রসঙ্গে এক ‘ছিন্ন জীবনে’র কথা বলেছিলেন। কেন এটা বলেছিলেন, সোমেনের জীবন আর রাজনৈতিক সংগ্রামের পর্বান্তরের দিকে তাকালেই তার একটা ব্যাখ্যা আমরা পেয়ে যাই। তারপরও সরদার ফজলুল করিম একটা ঐতিহাসিক আর তাৎপর্যময় বিশ্লেষণ আমাদের সামনে হাজির করেছিলেন, যেখানে প্রেক্ষাপটসহ সোমেনকে বুঝতে আমাদের সুবিধে হয়। সরদার ফজলুল করিম জানিয়েছিলেন, ‘সোমেন সাহিত্যিক ছিলেন, এটাই সোমেনের বড় পরিচয় নয়। বাইশ বছরের একটি যুবক। গরিব মধ্যবিত্ত মা-বাবা। অনেক ভাই-বোন। মিটফোর্ডে ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছে। কিন্তু ডাক্তারি পড়ার চেয়ে অধিক আগ্রহ মানুষের জীবনকে জানার, ইতিহাসের ঠিকানাকে উপলব্ধি করার।’ এরই সূত্র ধরে সরদার ফজলুল করিম যোগ করেছেন, ‘১৯৪২ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। ফ্যাসিস্ট আর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সেদিনকার একমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আঘাত হানছে। পরাধীন দেশের মানুষ শতধাবিভক্ত। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা চলছে। ভাই ভাইয়ের বুকে ছুরি হানছে। অসহায় আর নিষ্পাপের রক্তে মাটি লাল হচ্ছে। এখানে বলে রাখতে হচ্ছে, সেদিনের সেই হানাহানি থেকে সোমেন চন্দও রেহাই পাননি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে তিনিও খুন হলেন ৮ই মার্চ, ১৯৪২ সালে।’
৩. এটা ঠিক যে পড়াশোনা, লেখালেখি সবকিছুর সঙ্গেই নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন সোমেন চন্দ। কিন্তু তারচেয়েও বড় সত্যি এই যে, তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় বিপ্লবী। যে-কারণে রাজনীতিটাকে অগ্রগণ্য মনে করতেন। কথাসাহিত্যে তার সন্দেহাতীত সফলতা থাকা সত্ত্বেও তিনি রাজনীতিকে ত্যাগ করেননি। কোন রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন সোমেন? উত্তরে বলতে হয়, সে-দিনের কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে। যে-বছর সোমেন নিহত হলেন, ঠিক সেই বছরই, ১৯৪২ সালে, কমরেড মাও সে-তুঙ বলেছিলেন, ‘বিপ্লবী পার্টি অবশ্যই থাকতে হবে, কারণ দুনিয়াতে এমন শত্রু রয়েছে, যারা জনগণের ওপর নির্যাতান চালায় আর জনগণ চায় শত্রুর নির্যাতনকে উচ্ছেদ করতে।’ আর সে জন্যেই, মাওয়ের মতে, ‘পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের যুগে ঠিক কমিউনিস্ট পার্টির মতোই একটি বিপ্লবী পার্টির দরকার। এমন একটি পার্টি ছাড়া জনগণের পক্ষে শত্রুর নির্যাতনকে উচ্ছেদ করা একেবারে অসম্ভব।’ সোমেন চন্দ হয়তো তখনো মাও সে-তুঙ পড়েননি; কিন্তু মার্কস-লেনিন পাঠের পাশাপাশি বিপ্লবী সংগঠনে কাজের মধ্য দিয়ে জীবনের সেই সারসত্যকে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। এটাই হচ্ছে সেই বিপ্লবী-চেতনার সক্রিয়তা, যা ছাড়া বিপ্লবী সামর্থ্য কোনোভাবেই অর্জন করা যায় না। সোমেন চন্দ সেই সামর্থ্যটি আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার সেই সামর্থ্যরে বিষয়টি অভিব্যক্ত হয়েছে নির্মলকুমার ঘোষকে লেখা একটি চিঠিতে, যেখানে সোমেন বলেছিলেন, ‘আজ বিপ্লবের প্রয়োজন হয়েছে যে বিপ্লব দেবে আমূল সংস্কার...আশীর্বাদ করুন, আমার এই বিপ্লবের অনুভূতি আমার সাহিত্যসাধনার সর্বাঙ্গে যেন জড়িয়ে থাকে।’ (চিঠির তারিখ : ১৯৩৮)
৪. বিপ্লবী সক্রিয়তার সঙ্গে নিজের সাহিত্যসাধনাকে একত্রে মেলাতে চেয়েছিলেন সোমেন। আর সে-কারণেই তিনি গোর্কির কথা, র্যালফ ফক্সের কথা, কডওয়েলের কথা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা নানাভাবে বলেছেন। তাদের জীবন ও রচনাকর্ম পাঠ করে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। গোর্কি প্রসঙ্গে সোমেন চন্দ বলেছিলেন, বিপ্লবের জন্য একজন লেখক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আমাদের সেভাবে প্রস্তুত হতে হবে। গোর্কির কথাই চিন্তা করো। শৌখিন সাহিত্য করার আর সময় নেই।’ তো সেই গোর্কি দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করতেন যে, ‘আমার কাছে মানুষকে বাদ দিয়ে কোনো আদর্শভাবের অস্তিত্ব নেই।’ এরই সূত্র ধরে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমি মানুষকে শ্রদ্ধা করি; কারণ এই পৃথিবীতে আমি যা দেখি, তার সবই রূপ নিয়েছে মানুষের যুক্তিবোধ, কল্পনা আর অনুমানশক্তি থেকে।’ অন্যদিকে কমরেড মাও সে-তুঙের দিকে তাকিয়ে আমরা দেখতে পাই, তিনি সাধারণ মানুষ তথা জনসাধারণের মধ্যে এক ‘সীমাহীন সৃজনী শক্তি দেখতে পেয়েছিলেন। আর সেই কারণেই বলতে পেরেছিলেন, ‘জনগণ, কেবলমাত্র জনগণই হচ্ছেন বিশ্ব-ইতিহাস সৃষ্টির চালিকাশক্তি।’
সোমেন চন্দ নিজের বিষয়ে দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘লেখার জন্য একটুও সময় পাই না।’ আর তারপরেই যেন শরীর-ঝাড়া দিয়ে দৃপ্তকণ্ঠে জানিয়েছেন, ‘তবু লিখতে হবে, মেহনতি মানুষের জন্য, সর্বহারা মানুষের জন্য, আমাদের লিখতে হবে।’ জীবনের এইসব মুহূর্তে র্যালফ ফক্স, ক্রিস্টোফার কডওয়েলের মতো সাম্য-স্বাধীনতা ও মানুষের মুক্তির জন্য আত্মবিসর্জনকারী লেখকের দ্বারা যে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন, সেটি একেবারে অকপটে স্বীকার করেছিলেন। এরা দুজন সোমেনের কাছে ছিলেন ‘মহৎ সাহিত্যিক’। সোমেন বলছেন, ‘র্যালফ ফকসের বই পড়ে আমি অন্তরে অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। কডওয়েলের বইটিও আমাকে অনুপ্রাণিত করছে।’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে সোমেনের প্রতিক্রিয়া ছিল অনেকটা মিশ্র। তার মতে, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা...আমিও বলি, স্বীকার করি, শ্রেষ্ঠ গল্পলেখকের যা গুণ তার সবই আছে তার মধ্যে বিশিষ্ট রচনাভঙ্গি, অভিনব চরিত্র সৃষ্টি, অপূর্ব অভিজ্ঞতার উপলব্ধি, সবই আছে।’ আবার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পকের্, সেইসঙ্গে সোমেনের এটিও মনে হয়েছে যে, ‘রাজনীতির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ মনে হয় খুব ক্ষীণ, আর পড়ালেখাও কম।’ তাই বলে তিনি এই লেখকের প্রতি কোনো ধরনের অশ্রদ্ধার মনোভাব প্রকাশ করেননি। বরং এক চিঠিতে বন্ধুজনকে বলেছিলেন যে, ‘কলকাতা গেলে মানিকবাবুর সঙ্গে দেখা করব।’ এই যে মনের ঔদার্য, চেতনার অনুকম্পা এসবই লেনিন-কথিত কমিউনিস্ট নৈতিকতার এক অনবদ্য প্রকাশ; যে-নৈতিকতাকে সোমেন চন্দ আমৃত্যু অন্তরে ধারণ করেছিলেন।
৫. কথাসাহিত্যিক হিসেবে সোমেন ছোটগল্প রচনার মাধ্যমেই পাঠক-লেখক-সমালোচকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। গোপাল হালদারের মতো সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, সোমেনের ‘গল্পগুলিতে শুধু সাহিত্যের সোনার ছাপ নাই, আছে জীবন-প্রেমিকের প্রাণের ছাপ, আছে জীবনের স্বাক্ষর।’ এর সঙ্গে-সঙ্গে গোপাল হালদার এটিও মনে করতেন যে সাহিত্যের সোনার ছাপের চেয়ে জীবনের ছাপের মূল্য অনেক বেশি। সোমেনের রচনায় জীবনের সেই দামি স্বাক্ষরের দিকটিই নানাভাবে প্রকাশিত হতে পেরেছিল। এর কারণ, গোপাল হালদারের মতে, ‘সোমেন ছিল জীবনের সৈনিক।’ তিনি যে জীবনের সাহসী সৈনিক ছিলেন তার অন্য আরও গল্পের মতো ‘ইঁদুর’ গল্পেও সেই পরিচয় লিপিবদ্ধ আছে। লেখকের ভাষ্যমতে, ‘ইতিহাস যেমন আমাদের দিক নেয়, আমিও ইতিহাসের দিক নিলুম। আমি হাত প্রসারিত করে নিলুম জনতার দিকে, তাদের উষ্ণ অভিনন্দনে আমি ধন্য হলুম।’ তারপরই লেখক বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী তত্ত্ব আর সেই উৎস থেকে উদ্ভূত বৈপ্লবিক চেতনাকে আত্মস্থ করে বলেছেন, ‘ধন্যবাদ, ধন্যবাদ। সেবাব্রত নয়, মানবতা নয়, স্বার্থপরতা অথচ শ্রেষ্ঠ উদারতা নিয়ে এক ক্লান্তিহীন বৈজ্ঞানিক অনুশীলন।’ গল্পের শেষাংশে এসে কথক বলেছেন, ‘আমি ফিরে এলুম। সাম্যবাদের গর্ব, তার ইস্পাতের মতো আশা, তার সোনার মতো ফসল বুকে করে আমি ফিরে এলুম।’ খুবই সংগত কারণেই গোপাল হালদার বলতে অনেকটা বাধ্য হয়েছিলেন যে, ‘সোমেনের জীবন ও চেতনা যাহা বলিয়া গেল... সে-কথা এই যে, সে কম্যুনিস্ট, সে বিপ্লবী। কারণ, এ যুগে যাহা সত্য তাহা বিপ্লবের সত্য।’ সেই সত্যের তাৎপর্য জীবনে ও সাহিত্যে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন সোমেন। আর তাই তো গোপাল হালদার বলেছিলেন, ‘বিপ্লবের ও সাহিত্যের সৃষ্টিলোকে সোমেন এখন পর্যন্ত সোমেন-ই বোধহয় আমাদের সকলের অগ্রজ।’ অনেকটাই গোপাল হালদারের মতো, জীবনের সত্যটাকে সামনে টেনে এনে, সরদার ফজলুল করিম বলেছিলেন, ‘জীবনের যে ইঙ্গিত সোমেন তাহার জীবনে পাইয়াছিল আজ যাহার সুস্পষ্ট আভাস সোমেনের ও হাজার লক্ষ জনগণের রক্তের মধ্য দিয়া আমাদের দৃষ্টিপথে ভাসিয়া উঠিয়াছে, তাহার প্রতিষ্ঠা যেন আমরা করিতে পারি।’ তাতে ফলাফল কী হবে? সরদার ফজলুল করিমের মতে, ‘একমাত্র তাহার প্রতিষ্ঠাতেই হইবে সোমেনের জীবনের নবপ্রতিষ্ঠা।’ আর এই প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমাদের সবার জীবনে বিপ্লবের সত্য নতুন এক সমাজ, নতুন এক প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।
৬. সরদার ফজলুল করিম যেমন স্বপ্ন দেখেছিলেন, ‘সোমেন চন্দকে একটা জেনারেশন চেনে না, কিন্তু একটা সময় আসছে যখন তরুণরা সোমেন চন্দকে মাটি খুঁড়ে বা’র করবে।’ সেই স্বপ্নটা আজ আমাদেরও দেখতে হচ্ছে। গত ২৪শে মে ছিল সোমেন চন্দের জন্মদিন। সোমেন চন্দের জন্মদিন আমাদের কাছে এই বার্তাটিই নতুনভাবে জানিয়ে দিয়ে যায় যে, শেষ পর্যন্ত জীবনই জয়ী হবে; যে-জীবন সোমেনের মতো বিপ্লবে ও সাহিত্যে নিবিড়ভাবে সমর্পিত। সোমেনের স্মৃতির প্রতি জানাই শ্রদ্ধা।
লেখক অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
সৌভিক রেজা | ২৭ মে, ২০২২ ০০:০০

সোমেন চন্দ জন্মেছিলেন শতবর্ষ আগে, আমাদের এই ঢাকা জেলাতেই। ঢাকা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বালিয়া গ্রামে। সোমেন চন্দ কে, কে এই সোমেন চন্দ? আমাদের সময়ের অন্যতম বিবেকবান মানুষ, প্রয়াত সরদার ফজলুল করিম একবার এইরকম একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে, অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছিলেন, ‘সোমেন চন্দকে একটা জেনারেশন চেনে না, কিন্তু একটা সময় আসছে যখন তরুণরা সোমেন চন্দকে মাটি খুঁড়ে বা’র করবে।’
২. আবারও সরদার ফজলুল করিমের কাছে যেতে হচ্ছে। তিনি লিখেছিলেন, ‘সোমেন কেবল সাহিত্যিক ছিলেন না। সোমেন ছিলেন জীবনের সৈনিক। বয়সের বিবেচনায় অত্যদ্ভুতভাবে সজ্ঞান, সতেজ আর সাহসী। সাহিত্যিক সৃষ্টি এসেছে তাঁর এই জীবনের অভিজ্ঞতা, অনুভূতি এবং উপলব্ধির ফসল নিয়ে।’ সেইসঙ্গে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘যুবক সোমেন যে-কয়টি গল্প লিখেছিলেন, তাঁর এই অল্প পরিসর জীবনে, তার সব কটিতে আছে দৃষ্টির স্বচ্ছতা আর অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর।’ এখন তো গবেষকদের কল্যাণে আমরা জানতে পারছি সোমেন চন্দ শুধুই গল্প লেখেননি; সেইসঙ্গে উপন্যাস, নাটিকা, কবিতাও রচনা করে গিয়েছেন। পবিত্র সরকার লিখেছিলেন, ‘প্রায় বাইশ বছরের জীবন ছিন্ন জীবন, তার মধ্যে সাহিত্য রচনা করেছেন শেষ চার-পাঁচ বছর মাত্র।’ পবিত্র সরকার সোমেন-প্রসঙ্গে এক ‘ছিন্ন জীবনে’র কথা বলেছিলেন। কেন এটা বলেছিলেন, সোমেনের জীবন আর রাজনৈতিক সংগ্রামের পর্বান্তরের দিকে তাকালেই তার একটা ব্যাখ্যা আমরা পেয়ে যাই। তারপরও সরদার ফজলুল করিম একটা ঐতিহাসিক আর তাৎপর্যময় বিশ্লেষণ আমাদের সামনে হাজির করেছিলেন, যেখানে প্রেক্ষাপটসহ সোমেনকে বুঝতে আমাদের সুবিধে হয়। সরদার ফজলুল করিম জানিয়েছিলেন, ‘সোমেন সাহিত্যিক ছিলেন, এটাই সোমেনের বড় পরিচয় নয়। বাইশ বছরের একটি যুবক। গরিব মধ্যবিত্ত মা-বাবা। অনেক ভাই-বোন। মিটফোর্ডে ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছে। কিন্তু ডাক্তারি পড়ার চেয়ে অধিক আগ্রহ মানুষের জীবনকে জানার, ইতিহাসের ঠিকানাকে উপলব্ধি করার।’ এরই সূত্র ধরে সরদার ফজলুল করিম যোগ করেছেন, ‘১৯৪২ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। ফ্যাসিস্ট আর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সেদিনকার একমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আঘাত হানছে। পরাধীন দেশের মানুষ শতধাবিভক্ত। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা চলছে। ভাই ভাইয়ের বুকে ছুরি হানছে। অসহায় আর নিষ্পাপের রক্তে মাটি লাল হচ্ছে। এখানে বলে রাখতে হচ্ছে, সেদিনের সেই হানাহানি থেকে সোমেন চন্দও রেহাই পাননি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে তিনিও খুন হলেন ৮ই মার্চ, ১৯৪২ সালে।’
৩. এটা ঠিক যে পড়াশোনা, লেখালেখি সবকিছুর সঙ্গেই নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন সোমেন চন্দ। কিন্তু তারচেয়েও বড় সত্যি এই যে, তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় বিপ্লবী। যে-কারণে রাজনীতিটাকে অগ্রগণ্য মনে করতেন। কথাসাহিত্যে তার সন্দেহাতীত সফলতা থাকা সত্ত্বেও তিনি রাজনীতিকে ত্যাগ করেননি। কোন রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন সোমেন? উত্তরে বলতে হয়, সে-দিনের কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে। যে-বছর সোমেন নিহত হলেন, ঠিক সেই বছরই, ১৯৪২ সালে, কমরেড মাও সে-তুঙ বলেছিলেন, ‘বিপ্লবী পার্টি অবশ্যই থাকতে হবে, কারণ দুনিয়াতে এমন শত্রু রয়েছে, যারা জনগণের ওপর নির্যাতান চালায় আর জনগণ চায় শত্রুর নির্যাতনকে উচ্ছেদ করতে।’ আর সে জন্যেই, মাওয়ের মতে, ‘পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের যুগে ঠিক কমিউনিস্ট পার্টির মতোই একটি বিপ্লবী পার্টির দরকার। এমন একটি পার্টি ছাড়া জনগণের পক্ষে শত্রুর নির্যাতনকে উচ্ছেদ করা একেবারে অসম্ভব।’ সোমেন চন্দ হয়তো তখনো মাও সে-তুঙ পড়েননি; কিন্তু মার্কস-লেনিন পাঠের পাশাপাশি বিপ্লবী সংগঠনে কাজের মধ্য দিয়ে জীবনের সেই সারসত্যকে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। এটাই হচ্ছে সেই বিপ্লবী-চেতনার সক্রিয়তা, যা ছাড়া বিপ্লবী সামর্থ্য কোনোভাবেই অর্জন করা যায় না। সোমেন চন্দ সেই সামর্থ্যটি আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার সেই সামর্থ্যরে বিষয়টি অভিব্যক্ত হয়েছে নির্মলকুমার ঘোষকে লেখা একটি চিঠিতে, যেখানে সোমেন বলেছিলেন, ‘আজ বিপ্লবের প্রয়োজন হয়েছে যে বিপ্লব দেবে আমূল সংস্কার...আশীর্বাদ করুন, আমার এই বিপ্লবের অনুভূতি আমার সাহিত্যসাধনার সর্বাঙ্গে যেন জড়িয়ে থাকে।’ (চিঠির তারিখ : ১৯৩৮)
৪. বিপ্লবী সক্রিয়তার সঙ্গে নিজের সাহিত্যসাধনাকে একত্রে মেলাতে চেয়েছিলেন সোমেন। আর সে-কারণেই তিনি গোর্কির কথা, র্যালফ ফক্সের কথা, কডওয়েলের কথা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা নানাভাবে বলেছেন। তাদের জীবন ও রচনাকর্ম পাঠ করে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। গোর্কি প্রসঙ্গে সোমেন চন্দ বলেছিলেন, বিপ্লবের জন্য একজন লেখক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আমাদের সেভাবে প্রস্তুত হতে হবে। গোর্কির কথাই চিন্তা করো। শৌখিন সাহিত্য করার আর সময় নেই।’ তো সেই গোর্কি দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করতেন যে, ‘আমার কাছে মানুষকে বাদ দিয়ে কোনো আদর্শভাবের অস্তিত্ব নেই।’ এরই সূত্র ধরে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমি মানুষকে শ্রদ্ধা করি; কারণ এই পৃথিবীতে আমি যা দেখি, তার সবই রূপ নিয়েছে মানুষের যুক্তিবোধ, কল্পনা আর অনুমানশক্তি থেকে।’ অন্যদিকে কমরেড মাও সে-তুঙের দিকে তাকিয়ে আমরা দেখতে পাই, তিনি সাধারণ মানুষ তথা জনসাধারণের মধ্যে এক ‘সীমাহীন সৃজনী শক্তি দেখতে পেয়েছিলেন। আর সেই কারণেই বলতে পেরেছিলেন, ‘জনগণ, কেবলমাত্র জনগণই হচ্ছেন বিশ্ব-ইতিহাস সৃষ্টির চালিকাশক্তি।’
সোমেন চন্দ নিজের বিষয়ে দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘লেখার জন্য একটুও সময় পাই না।’ আর তারপরেই যেন শরীর-ঝাড়া দিয়ে দৃপ্তকণ্ঠে জানিয়েছেন, ‘তবু লিখতে হবে, মেহনতি মানুষের জন্য, সর্বহারা মানুষের জন্য, আমাদের লিখতে হবে।’ জীবনের এইসব মুহূর্তে র্যালফ ফক্স, ক্রিস্টোফার কডওয়েলের মতো সাম্য-স্বাধীনতা ও মানুষের মুক্তির জন্য আত্মবিসর্জনকারী লেখকের দ্বারা যে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন, সেটি একেবারে অকপটে স্বীকার করেছিলেন। এরা দুজন সোমেনের কাছে ছিলেন ‘মহৎ সাহিত্যিক’। সোমেন বলছেন, ‘র্যালফ ফকসের বই পড়ে আমি অন্তরে অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। কডওয়েলের বইটিও আমাকে অনুপ্রাণিত করছে।’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে সোমেনের প্রতিক্রিয়া ছিল অনেকটা মিশ্র। তার মতে, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা...আমিও বলি, স্বীকার করি, শ্রেষ্ঠ গল্পলেখকের যা গুণ তার সবই আছে তার মধ্যে বিশিষ্ট রচনাভঙ্গি, অভিনব চরিত্র সৃষ্টি, অপূর্ব অভিজ্ঞতার উপলব্ধি, সবই আছে।’ আবার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পকের্, সেইসঙ্গে সোমেনের এটিও মনে হয়েছে যে, ‘রাজনীতির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ মনে হয় খুব ক্ষীণ, আর পড়ালেখাও কম।’ তাই বলে তিনি এই লেখকের প্রতি কোনো ধরনের অশ্রদ্ধার মনোভাব প্রকাশ করেননি। বরং এক চিঠিতে বন্ধুজনকে বলেছিলেন যে, ‘কলকাতা গেলে মানিকবাবুর সঙ্গে দেখা করব।’ এই যে মনের ঔদার্য, চেতনার অনুকম্পা এসবই লেনিন-কথিত কমিউনিস্ট নৈতিকতার এক অনবদ্য প্রকাশ; যে-নৈতিকতাকে সোমেন চন্দ আমৃত্যু অন্তরে ধারণ করেছিলেন।
৫. কথাসাহিত্যিক হিসেবে সোমেন ছোটগল্প রচনার মাধ্যমেই পাঠক-লেখক-সমালোচকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। গোপাল হালদারের মতো সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, সোমেনের ‘গল্পগুলিতে শুধু সাহিত্যের সোনার ছাপ নাই, আছে জীবন-প্রেমিকের প্রাণের ছাপ, আছে জীবনের স্বাক্ষর।’ এর সঙ্গে-সঙ্গে গোপাল হালদার এটিও মনে করতেন যে সাহিত্যের সোনার ছাপের চেয়ে জীবনের ছাপের মূল্য অনেক বেশি। সোমেনের রচনায় জীবনের সেই দামি স্বাক্ষরের দিকটিই নানাভাবে প্রকাশিত হতে পেরেছিল। এর কারণ, গোপাল হালদারের মতে, ‘সোমেন ছিল জীবনের সৈনিক।’ তিনি যে জীবনের সাহসী সৈনিক ছিলেন তার অন্য আরও গল্পের মতো ‘ইঁদুর’ গল্পেও সেই পরিচয় লিপিবদ্ধ আছে। লেখকের ভাষ্যমতে, ‘ইতিহাস যেমন আমাদের দিক নেয়, আমিও ইতিহাসের দিক নিলুম। আমি হাত প্রসারিত করে নিলুম জনতার দিকে, তাদের উষ্ণ অভিনন্দনে আমি ধন্য হলুম।’ তারপরই লেখক বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী তত্ত্ব আর সেই উৎস থেকে উদ্ভূত বৈপ্লবিক চেতনাকে আত্মস্থ করে বলেছেন, ‘ধন্যবাদ, ধন্যবাদ। সেবাব্রত নয়, মানবতা নয়, স্বার্থপরতা অথচ শ্রেষ্ঠ উদারতা নিয়ে এক ক্লান্তিহীন বৈজ্ঞানিক অনুশীলন।’ গল্পের শেষাংশে এসে কথক বলেছেন, ‘আমি ফিরে এলুম। সাম্যবাদের গর্ব, তার ইস্পাতের মতো আশা, তার সোনার মতো ফসল বুকে করে আমি ফিরে এলুম।’ খুবই সংগত কারণেই গোপাল হালদার বলতে অনেকটা বাধ্য হয়েছিলেন যে, ‘সোমেনের জীবন ও চেতনা যাহা বলিয়া গেল... সে-কথা এই যে, সে কম্যুনিস্ট, সে বিপ্লবী। কারণ, এ যুগে যাহা সত্য তাহা বিপ্লবের সত্য।’ সেই সত্যের তাৎপর্য জীবনে ও সাহিত্যে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন সোমেন। আর তাই তো গোপাল হালদার বলেছিলেন, ‘বিপ্লবের ও সাহিত্যের সৃষ্টিলোকে সোমেন এখন পর্যন্ত সোমেন-ই বোধহয় আমাদের সকলের অগ্রজ।’ অনেকটাই গোপাল হালদারের মতো, জীবনের সত্যটাকে সামনে টেনে এনে, সরদার ফজলুল করিম বলেছিলেন, ‘জীবনের যে ইঙ্গিত সোমেন তাহার জীবনে পাইয়াছিল আজ যাহার সুস্পষ্ট আভাস সোমেনের ও হাজার লক্ষ জনগণের রক্তের মধ্য দিয়া আমাদের দৃষ্টিপথে ভাসিয়া উঠিয়াছে, তাহার প্রতিষ্ঠা যেন আমরা করিতে পারি।’ তাতে ফলাফল কী হবে? সরদার ফজলুল করিমের মতে, ‘একমাত্র তাহার প্রতিষ্ঠাতেই হইবে সোমেনের জীবনের নবপ্রতিষ্ঠা।’ আর এই প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমাদের সবার জীবনে বিপ্লবের সত্য নতুন এক সমাজ, নতুন এক প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।
৬. সরদার ফজলুল করিম যেমন স্বপ্ন দেখেছিলেন, ‘সোমেন চন্দকে একটা জেনারেশন চেনে না, কিন্তু একটা সময় আসছে যখন তরুণরা সোমেন চন্দকে মাটি খুঁড়ে বা’র করবে।’ সেই স্বপ্নটা আজ আমাদেরও দেখতে হচ্ছে। গত ২৪শে মে ছিল সোমেন চন্দের জন্মদিন। সোমেন চন্দের জন্মদিন আমাদের কাছে এই বার্তাটিই নতুনভাবে জানিয়ে দিয়ে যায় যে, শেষ পর্যন্ত জীবনই জয়ী হবে; যে-জীবন সোমেনের মতো বিপ্লবে ও সাহিত্যে নিবিড়ভাবে সমর্পিত। সোমেনের স্মৃতির প্রতি জানাই শ্রদ্ধা।
লেখক অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়