‘আসকে আমার মন ভালো নেই’
সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ | ৩০ জুন, ২০২২ ০০:০০
প্রাচীন যুগের মানুষ কেমন ছিল তা বুঝতে প-িতরা কী করেন? চেষ্টা করেন তাদের দৈনন্দিন জীবনের কার্যকলাপ খুঁজে বের করতে, প্রতœতাত্ত্বিকরা খুঁড়ে বের করার চেষ্টা করেন তারা কী পরতেন, কী খেতেন, কীভাবে উৎসব করতেন? ইতিহাসবিদরা এসব আবিষ্কারকে নানা রকম সামাজিক-নৃতাত্ত্বিক আলোকে ব্যাখ্যা দিয়ে সেসব সমাজের একটা ছবি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। আর আধুনিক ইতিহাসবিদরা এই কথা মানেন যে, রাজাগজা আর যুদ্ধের ইতিহাসের থেকে সাধারণ মানুষের অসাধারণ জীবনযাপনের লিপি পড়তে পারা কম তো নয়-ই, বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই মিসরের পিরামিড আমাদের কাছে বিস্ময় মনে হলেও, প্রাচীন মিসরের একটা সাধারণ গ্রাম দেইর-আল-মদিনার আবিষ্কার প-িতদের কাছে সমানভাবে দরকারি।
কিন্তু আমাদের সময়ের দেইর-আল-মদিনা হয়ে উঠবে কোনগুলো? শত শত কিংবা হাজার বছর পর, আমাদের সময়কে পাঠ করার দর্পণগুলো কীভাবে চেনা যাবে? সোশ্যাল মিডিয়া। ভাইরাল পোস্ট। এটা খুবই সাধারণ দুটো শব্দ, ম্যাজিকের মতো কাজ করবে।
প্রলম্বিত ভূমিকার জন্য দুঃখিত, আজকের দিনে যেখানে মানুষের কোনো কিছুতে মনোযোগ ধরে রাখার গড় সময় ৪৫ সেকেন্ডে নেমে এসেছে, সেখানে এই অর্বাচীনতা বিরক্তির উদ্রেক করারই কথা। কিন্তু ‘আসকে আমার মন ভালো নেই’, তাই হাজেরানে মজলিশের কাছে একটু সময় প্রার্থনা করার আগে একটু বুঝিয়ে বলা যে, বিষয়টা খুব জরুরি। আলাপটা সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ‘আসকে আমার মন ভালো নেই’ নিয়েই, কী কারণে ‘দুই হলুদ কুত্তার’ (ইন্টারনেটের ভাষায় ‘ডজি’) চাটগাঁয়ের ভাষায় পরস্পরের কথোপকথন সবার মুখে মুখে ফিরল?
জোকস বিষয়ে তত্ত্বগুলোর সাহায্য নেওয়া যাক। সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই দার্শনিকরা চেষ্টা করেছেন রসিকতা কী এবং এর প্রভাব কীভাবে পড়ে তা খুঁজে বের করতে। অ্যারিস্টটল আর প্লেটোর ধারণা ছিল রসিকতা হয় আসলে অপরকে ‘তুচ্ছ’ করতে, নিজেকে ‘সুপিরিয়র’ ভাবার কারণে। থমাস হবস, লেভিথিয়ানে এই ব্যাপারটাকে আখ্যা দেন ‘সাডেন গ্লোরি’ হিসেবে। গ্রিক দার্শনিকরা ‘প্লে থিওরি’ দিয়েও রসিকতাকে ব্যাখ্যা করতেন। তারা বলতেন, তামাশার মাধ্যমে মানুষ মানসিক ক্রীড়া সম্পন্ন করে। ফলত, থমাস একিউনিয়ার মতো ধর্মতাত্ত্বিক মধ্যযুগে হাসিতামাশাকে ‘অখ্রিস্টীয়’ বলে আখ্যা দেন।
অন্যদিকে, আরেক দল দার্শনিকের বক্তব্য ছিল, তামাশা আসলে ‘প্রেশার রিলিজ’ করে, এর মাধ্যমে, মানুষ নিজের ওপরে থাকা সব ধরনের চাপ হালকা করে। দীর্ঘদিন এই তত্ত্ব সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হলেও, আধুনিক যুগে মানা হয় যে ‘ইনকনগ্রিউটি থিউরি’ হচ্ছে তামাশাকে ব্যাখ্যা করার সবচেয়ে জুতসই তত্ত্ব। তবে, এই তত্ত্বটা বেশ খানিকটা জটিল ও বিস্তৃত। সহজ ভাষায় বললে, ইনকনগ্রিউটি মানে হচ্ছে ‘স্বাভাবিক অবস্থা থেকে বিচ্যুতি’। যিনি তামাশা বা জোকসটা শুনছেন, তিনি একেবারেই আশা করছেন না বা খুবই হতভম্ব হচ্ছেন এমন একটা অবস্থা তৈরি করতে পারলেই সেটা ভালো জোকস্ হয়। শোপেনহাওয়ার এ ব্যাপারটাকে বলেন ‘ক্রিয়েটিং কন্ট্রাডিকশন’।
আলাপ হচ্ছে এই কন্ট্রাডিকশন তৈরি করা। এর জন্য রসিকতায় নানা কৌশল কাজে লাগানো হয়, এর সবচেয়ে শক্তিশালীটা হচ্ছে জবরদশত পাঞ্চলাইন। শ্রোতাকে বেভুল বানিয়ে, সম্মোহন করে, শেষমেশ একটা এ্যয়সা ধাক্কা!
কিন্তু, পাঞ্চলাইন আর আনপ্রেডেকটিবিলিটি ছাড়াও আরেকটা আপাতত ম্যাড়মেড়ে কিন্তু ভীষণ কার্যকর কৌশল আছে, আর তা হচ্ছে ‘রিপিটেশন’। মানব মস্তিষ্ক রিপিটেশনকে প্রচ- রকম গুরুত্ব দেয়। এ কারণে শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থায় একে ব্যবহার করা হয়। গানের সঙ্গে মানুষের মস্তিষ্কের সম্পর্ক শক্ত করে একই লাইন বা শব্দের রিপিটেশন। সিনেমার আবহ সংগীত বা স্কোর তো দাঁড়িয়েই আছে এর ওপর! একই সুর বারবার ফিরিয়ে এনে শ্রোতাকে যে পরিচিত আবহ দেওয়া, একটা স্বস্তি কিংবা ধাক্কা দেওয়া, একে পোশাকি ভাষায় বলে ‘লেটমোটিফ’। তামাশার জগতে এই লেটমোটিফও খুব কার্যকর। আর একটা ব্যাপার খুব কার্যকর, সেটা হচ্ছে সহজবোধ্যতা। বিশেষত, এখনকার মতো ফোকাস হারিয়ে ফেলা, অতি ব্যস্ত সমাজে। সেই আলাপ একটু পরে আসছি।
আপাতত, তাহলে আমরা দেখি যে, সার্থক জোকসের মতো ‘আসকে আমার মন ভালো নেই’-তে ওপরের আলোচিত সব ব্যাপারগুলোই আছে। একটা ‘সিরিয়াস’ আবহ তৈরি করে, ফোনদাতা, ফোনগ্রহীতাকে বলে ওঠেন, ‘আসকে আমার মন ভালো নেই’। ব্যাপারটা সম্ভবত কেউই আশা করে নাই। বক্তার কণ্ঠের আকুতি বা অভিব্যক্তির কারণে তা আরও ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে।
এই পাঞ্চলাইন আর রিপিটেশনটা আবার এসে ধাক্কা দেয়, সঙ্গে থাকে এর সহজবোধ্যতা। ইনকনগ্রিউটি, স্ট্রেস রিলিজ, প্লেফুলনেস, আর লেটমোটিফের দুর্দান্ত সংশ্লেষ। চার্লি চ্যাপলিন যেমনটা বলতেন যে, আপাত সবচেয়ে সহজ মনে হওয়া, বোকা বোকা রসিকতাটার পেছনেই সবচেয়ে বড় চতুরতা থাকে। কিংবদন্তি কৌতুক অভিনেতা গ্রাউচো মার্ক্স যেমন বলতেন, তুমি দেখতে বোকা, তোমার কথা বোকা বোকা, কিন্তু আমি এতে বিভ্রান্ত হচ্ছি না, কারণ তুমি আসলেই বোকা। গ্রাউচোর আলাপে পড়ে আসছি।
এ তো গেল, গাঠনিক দিক, শুধু গঠন দিয়ে তো রসিকতা হয় না, কনটেন্টটাও গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে সংক্ষেপে আলোকপাত করা যাক। আর সেজন্য মাথায় যে শব্দগুলো রাখতে হবে তা হচ্ছে ‘নিওলিবারেলিজম’, ‘ডিপ্রেশন’, ‘ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন’। নিওলিবারেলিজমের দুনিয়ায় প্রতিটা মানুষকে আলাদা এনটিটি হিসেবে দেখানো হয়। কনজ্যুমারিজম আর ওপেন মার্কেটের আদরণীয় নিওলিবারেলিজমে সামাজিক বন্ধন কিংবা হায়ারার্কিকে উচ্ছেদ করে মার্কেট তথা বাজারকে একচ্ছত্র দায়িত্ব দেওয়া হয় মানুষের সব ধরনের চাহিদা মেটানোর একমাত্র অবলম্বন হিসেবে।
কিন্তু, শুধু বস্তুগত চাহিদা দিয়ে তো মানুষের মনকে তুষ্ট করা যায় না, মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তিই তার সামষ্টিকতা, আর পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মন খুলে আলাপ করা, ভরসা করা, এসবই মানুষের লাখ লাখ বছরের অভ্যাস। ফলত নিওলিবারেল দুনিয়ায় ছোট ছোট দ্বীপের মতো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া মানুষ অতি সহজে ডিপ্রেশনে চলে যায়। ডিপ্রেশনে যাওয়া মানুষ যাতে বাজারের কাছেই নানা রকম সমাধান খোঁজে, রাষ্ট্রব্যবস্থা সে তো নিশ্চিত করেই বটে; একই সঙ্গে এও প্রচার করে যে এই ডিপ্রেশন আসলে ব্যক্তিগত সমস্যা।
ফলত, ‘বদ্দার’ কাছে ‘মন ভালো নেই’-এর উপাখ্যান নিওলিবারেল ডকট্রিনকে পাশ কাটানোর একটা দারুণ উদাহরণ। এই বদ্দা ব্যস্ত মানুষ, তিনি এই মন খারাপের ‘তামাশায়’ বিরক্ত হলেও কিন্তু ‘সামাজিক মানুষ’, নিওলিবারেল নন। আর তাই তিনি, দুটা গালি দিয়ে হলেও আলাপটা চালায়ে যান। এ ব্যাপারটা আমাদের স্বস্তি দেয়।
বর্তমানের গোটা দুনিয়া শুধু অসীম সম্পদের আলেয়াকে ধাওয়া করার অসম্ভব নেশায় মত্ত তাই নয়, দুনিয়া ভীষণভাবে পোলারাইজড। নিওলিবারেল মানুষ হাসিঠাট্টা আর ‘স্বাভাবিক’ সামাজিক যোগাযোগের অভাবে যার যার মতবাদে ভীষণ উগ্র। গোদের উপর বিষফোঁড়া হচ্ছে ‘কথা না বলতে পারার স্বাধীনতা’।
এর ফলে রসিকতাগুলোও হয়ে পড়ে স্থূল, উৎকট। মানুষ স্ট্রেস রিলিফ চায়, সুররিয়াল দুনিয়ায় সবকিছুকেই ইনকনগ্রিউটি মনে হয়। কিন্তু, এর মধ্যেও ঘুরে দাঁড়ানোর আকুল আশা থাকে। পারস্পরিকতাকে উদযাপনের বিদ্রোহ থাকে।
দ্বীপের মতো নিঃসঙ্গ মানুষ সব ছাপিয়ে ‘আসকে আমার মন ভালো নেই’ এই কথাটা এমন কাউকে বলতে চায়, যে দরদ দিয়ে শুনবে। আমাদের সময়ে এই আলাপটাই, এই চাহিদাটাই সবচেয়ে জরুরি।
কিন্তু কৌতুকাভিনেতা গ্রাউচো মার্ক্স যেমন বলেছিলেন যে ‘তুমি আমাকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না, কারণ তুমি আসলেই বোকা’ সেই সূত্র ধরে আমরা কি বুঝতে পারছি, যে বা যারা বলছেন ‘আসকে আমার মন ভালো নেই’, আজকের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তার বা তাদের কিংবা আমাদের কারুরই আসলেই আজ ‘মন ভালো নেই’।
লেখক : ক্রীড়া সাংবাদিক ও অনুবাদক
শেয়ার করুন
সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ | ৩০ জুন, ২০২২ ০০:০০

প্রাচীন যুগের মানুষ কেমন ছিল তা বুঝতে প-িতরা কী করেন? চেষ্টা করেন তাদের দৈনন্দিন জীবনের কার্যকলাপ খুঁজে বের করতে, প্রতœতাত্ত্বিকরা খুঁড়ে বের করার চেষ্টা করেন তারা কী পরতেন, কী খেতেন, কীভাবে উৎসব করতেন? ইতিহাসবিদরা এসব আবিষ্কারকে নানা রকম সামাজিক-নৃতাত্ত্বিক আলোকে ব্যাখ্যা দিয়ে সেসব সমাজের একটা ছবি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। আর আধুনিক ইতিহাসবিদরা এই কথা মানেন যে, রাজাগজা আর যুদ্ধের ইতিহাসের থেকে সাধারণ মানুষের অসাধারণ জীবনযাপনের লিপি পড়তে পারা কম তো নয়-ই, বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই মিসরের পিরামিড আমাদের কাছে বিস্ময় মনে হলেও, প্রাচীন মিসরের একটা সাধারণ গ্রাম দেইর-আল-মদিনার আবিষ্কার প-িতদের কাছে সমানভাবে দরকারি।
কিন্তু আমাদের সময়ের দেইর-আল-মদিনা হয়ে উঠবে কোনগুলো? শত শত কিংবা হাজার বছর পর, আমাদের সময়কে পাঠ করার দর্পণগুলো কীভাবে চেনা যাবে? সোশ্যাল মিডিয়া। ভাইরাল পোস্ট। এটা খুবই সাধারণ দুটো শব্দ, ম্যাজিকের মতো কাজ করবে।
প্রলম্বিত ভূমিকার জন্য দুঃখিত, আজকের দিনে যেখানে মানুষের কোনো কিছুতে মনোযোগ ধরে রাখার গড় সময় ৪৫ সেকেন্ডে নেমে এসেছে, সেখানে এই অর্বাচীনতা বিরক্তির উদ্রেক করারই কথা। কিন্তু ‘আসকে আমার মন ভালো নেই’, তাই হাজেরানে মজলিশের কাছে একটু সময় প্রার্থনা করার আগে একটু বুঝিয়ে বলা যে, বিষয়টা খুব জরুরি। আলাপটা সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ‘আসকে আমার মন ভালো নেই’ নিয়েই, কী কারণে ‘দুই হলুদ কুত্তার’ (ইন্টারনেটের ভাষায় ‘ডজি’) চাটগাঁয়ের ভাষায় পরস্পরের কথোপকথন সবার মুখে মুখে ফিরল?
জোকস বিষয়ে তত্ত্বগুলোর সাহায্য নেওয়া যাক। সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই দার্শনিকরা চেষ্টা করেছেন রসিকতা কী এবং এর প্রভাব কীভাবে পড়ে তা খুঁজে বের করতে। অ্যারিস্টটল আর প্লেটোর ধারণা ছিল রসিকতা হয় আসলে অপরকে ‘তুচ্ছ’ করতে, নিজেকে ‘সুপিরিয়র’ ভাবার কারণে। থমাস হবস, লেভিথিয়ানে এই ব্যাপারটাকে আখ্যা দেন ‘সাডেন গ্লোরি’ হিসেবে। গ্রিক দার্শনিকরা ‘প্লে থিওরি’ দিয়েও রসিকতাকে ব্যাখ্যা করতেন। তারা বলতেন, তামাশার মাধ্যমে মানুষ মানসিক ক্রীড়া সম্পন্ন করে। ফলত, থমাস একিউনিয়ার মতো ধর্মতাত্ত্বিক মধ্যযুগে হাসিতামাশাকে ‘অখ্রিস্টীয়’ বলে আখ্যা দেন।
অন্যদিকে, আরেক দল দার্শনিকের বক্তব্য ছিল, তামাশা আসলে ‘প্রেশার রিলিজ’ করে, এর মাধ্যমে, মানুষ নিজের ওপরে থাকা সব ধরনের চাপ হালকা করে। দীর্ঘদিন এই তত্ত্ব সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হলেও, আধুনিক যুগে মানা হয় যে ‘ইনকনগ্রিউটি থিউরি’ হচ্ছে তামাশাকে ব্যাখ্যা করার সবচেয়ে জুতসই তত্ত্ব। তবে, এই তত্ত্বটা বেশ খানিকটা জটিল ও বিস্তৃত। সহজ ভাষায় বললে, ইনকনগ্রিউটি মানে হচ্ছে ‘স্বাভাবিক অবস্থা থেকে বিচ্যুতি’। যিনি তামাশা বা জোকসটা শুনছেন, তিনি একেবারেই আশা করছেন না বা খুবই হতভম্ব হচ্ছেন এমন একটা অবস্থা তৈরি করতে পারলেই সেটা ভালো জোকস্ হয়। শোপেনহাওয়ার এ ব্যাপারটাকে বলেন ‘ক্রিয়েটিং কন্ট্রাডিকশন’।
আলাপ হচ্ছে এই কন্ট্রাডিকশন তৈরি করা। এর জন্য রসিকতায় নানা কৌশল কাজে লাগানো হয়, এর সবচেয়ে শক্তিশালীটা হচ্ছে জবরদশত পাঞ্চলাইন। শ্রোতাকে বেভুল বানিয়ে, সম্মোহন করে, শেষমেশ একটা এ্যয়সা ধাক্কা!
কিন্তু, পাঞ্চলাইন আর আনপ্রেডেকটিবিলিটি ছাড়াও আরেকটা আপাতত ম্যাড়মেড়ে কিন্তু ভীষণ কার্যকর কৌশল আছে, আর তা হচ্ছে ‘রিপিটেশন’। মানব মস্তিষ্ক রিপিটেশনকে প্রচ- রকম গুরুত্ব দেয়। এ কারণে শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থায় একে ব্যবহার করা হয়। গানের সঙ্গে মানুষের মস্তিষ্কের সম্পর্ক শক্ত করে একই লাইন বা শব্দের রিপিটেশন। সিনেমার আবহ সংগীত বা স্কোর তো দাঁড়িয়েই আছে এর ওপর! একই সুর বারবার ফিরিয়ে এনে শ্রোতাকে যে পরিচিত আবহ দেওয়া, একটা স্বস্তি কিংবা ধাক্কা দেওয়া, একে পোশাকি ভাষায় বলে ‘লেটমোটিফ’। তামাশার জগতে এই লেটমোটিফও খুব কার্যকর। আর একটা ব্যাপার খুব কার্যকর, সেটা হচ্ছে সহজবোধ্যতা। বিশেষত, এখনকার মতো ফোকাস হারিয়ে ফেলা, অতি ব্যস্ত সমাজে। সেই আলাপ একটু পরে আসছি।
আপাতত, তাহলে আমরা দেখি যে, সার্থক জোকসের মতো ‘আসকে আমার মন ভালো নেই’-তে ওপরের আলোচিত সব ব্যাপারগুলোই আছে। একটা ‘সিরিয়াস’ আবহ তৈরি করে, ফোনদাতা, ফোনগ্রহীতাকে বলে ওঠেন, ‘আসকে আমার মন ভালো নেই’। ব্যাপারটা সম্ভবত কেউই আশা করে নাই। বক্তার কণ্ঠের আকুতি বা অভিব্যক্তির কারণে তা আরও ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে।
এই পাঞ্চলাইন আর রিপিটেশনটা আবার এসে ধাক্কা দেয়, সঙ্গে থাকে এর সহজবোধ্যতা। ইনকনগ্রিউটি, স্ট্রেস রিলিজ, প্লেফুলনেস, আর লেটমোটিফের দুর্দান্ত সংশ্লেষ। চার্লি চ্যাপলিন যেমনটা বলতেন যে, আপাত সবচেয়ে সহজ মনে হওয়া, বোকা বোকা রসিকতাটার পেছনেই সবচেয়ে বড় চতুরতা থাকে। কিংবদন্তি কৌতুক অভিনেতা গ্রাউচো মার্ক্স যেমন বলতেন, তুমি দেখতে বোকা, তোমার কথা বোকা বোকা, কিন্তু আমি এতে বিভ্রান্ত হচ্ছি না, কারণ তুমি আসলেই বোকা। গ্রাউচোর আলাপে পড়ে আসছি।
এ তো গেল, গাঠনিক দিক, শুধু গঠন দিয়ে তো রসিকতা হয় না, কনটেন্টটাও গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে সংক্ষেপে আলোকপাত করা যাক। আর সেজন্য মাথায় যে শব্দগুলো রাখতে হবে তা হচ্ছে ‘নিওলিবারেলিজম’, ‘ডিপ্রেশন’, ‘ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন’। নিওলিবারেলিজমের দুনিয়ায় প্রতিটা মানুষকে আলাদা এনটিটি হিসেবে দেখানো হয়। কনজ্যুমারিজম আর ওপেন মার্কেটের আদরণীয় নিওলিবারেলিজমে সামাজিক বন্ধন কিংবা হায়ারার্কিকে উচ্ছেদ করে মার্কেট তথা বাজারকে একচ্ছত্র দায়িত্ব দেওয়া হয় মানুষের সব ধরনের চাহিদা মেটানোর একমাত্র অবলম্বন হিসেবে।
কিন্তু, শুধু বস্তুগত চাহিদা দিয়ে তো মানুষের মনকে তুষ্ট করা যায় না, মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তিই তার সামষ্টিকতা, আর পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মন খুলে আলাপ করা, ভরসা করা, এসবই মানুষের লাখ লাখ বছরের অভ্যাস। ফলত নিওলিবারেল দুনিয়ায় ছোট ছোট দ্বীপের মতো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া মানুষ অতি সহজে ডিপ্রেশনে চলে যায়। ডিপ্রেশনে যাওয়া মানুষ যাতে বাজারের কাছেই নানা রকম সমাধান খোঁজে, রাষ্ট্রব্যবস্থা সে তো নিশ্চিত করেই বটে; একই সঙ্গে এও প্রচার করে যে এই ডিপ্রেশন আসলে ব্যক্তিগত সমস্যা।
ফলত, ‘বদ্দার’ কাছে ‘মন ভালো নেই’-এর উপাখ্যান নিওলিবারেল ডকট্রিনকে পাশ কাটানোর একটা দারুণ উদাহরণ। এই বদ্দা ব্যস্ত মানুষ, তিনি এই মন খারাপের ‘তামাশায়’ বিরক্ত হলেও কিন্তু ‘সামাজিক মানুষ’, নিওলিবারেল নন। আর তাই তিনি, দুটা গালি দিয়ে হলেও আলাপটা চালায়ে যান। এ ব্যাপারটা আমাদের স্বস্তি দেয়।
বর্তমানের গোটা দুনিয়া শুধু অসীম সম্পদের আলেয়াকে ধাওয়া করার অসম্ভব নেশায় মত্ত তাই নয়, দুনিয়া ভীষণভাবে পোলারাইজড। নিওলিবারেল মানুষ হাসিঠাট্টা আর ‘স্বাভাবিক’ সামাজিক যোগাযোগের অভাবে যার যার মতবাদে ভীষণ উগ্র। গোদের উপর বিষফোঁড়া হচ্ছে ‘কথা না বলতে পারার স্বাধীনতা’।
এর ফলে রসিকতাগুলোও হয়ে পড়ে স্থূল, উৎকট। মানুষ স্ট্রেস রিলিফ চায়, সুররিয়াল দুনিয়ায় সবকিছুকেই ইনকনগ্রিউটি মনে হয়। কিন্তু, এর মধ্যেও ঘুরে দাঁড়ানোর আকুল আশা থাকে। পারস্পরিকতাকে উদযাপনের বিদ্রোহ থাকে।
দ্বীপের মতো নিঃসঙ্গ মানুষ সব ছাপিয়ে ‘আসকে আমার মন ভালো নেই’ এই কথাটা এমন কাউকে বলতে চায়, যে দরদ দিয়ে শুনবে। আমাদের সময়ে এই আলাপটাই, এই চাহিদাটাই সবচেয়ে জরুরি।
কিন্তু কৌতুকাভিনেতা গ্রাউচো মার্ক্স যেমন বলেছিলেন যে ‘তুমি আমাকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না, কারণ তুমি আসলেই বোকা’ সেই সূত্র ধরে আমরা কি বুঝতে পারছি, যে বা যারা বলছেন ‘আসকে আমার মন ভালো নেই’, আজকের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তার বা তাদের কিংবা আমাদের কারুরই আসলেই আজ ‘মন ভালো নেই’।
লেখক : ক্রীড়া সাংবাদিক ও অনুবাদক