ওঠানামার চক্কর
মঈদুল ইসলাম | ৬ জুলাই, ২০২২ ০০:০০
(দ্বিতীয় কিস্তির পর)
হুজুরের ওপর আর কি কথা খাটে! হাতে ধরে বুঝিয়ে দিলেন যুক্তিসহকারে! কোর্টের ওঠানামার পালাটা চলবে ভাগীদারদের ভাওমতো টাইমে! আর, কেতাবে বাঁধা টাইমটা রোজ রোজ লিখতে হবে ডায়েরির কাগজে! সত্যিটা লিখলেই খেতে হবে ধরা! মিথ্যে লিখলে মেলা যুক্তি খাওয়ানোর থাকে! ব্রিটিশের বুদ্ধির চাল বানচাল বাঙালির যুক্তির প্যাঁচে! এজলাসে ওঠানামা আমার থাকল আগের সেই ভাওমতো টাইমে। শুরু করলাম কেতাবে বাঁধা টাইমগুলো ডায়েরিতে লিখে খাসকামরাতে অপেক্ষার পালা, না জানি কখন আবার হুজুরের কথামতো শুনানির প্রার্থনা নিয়ে বিচারপ্রার্থী চলে আসে! কোর্টে কাজ মিটেছে উকিল সাহেবদের, মক্কেলের অপেক্ষায় থাকার তাদের সেরেস্তা আছে বাড়িতেই। উকিল না নিয়ে শুনানির প্রার্থনা নিয়ে দেওয়ানিতে কোন বেআক্কেল আসে! আসেওনি মক্কেল-বেআক্কেল কেউ আর চিলমারীতে এজলাস থেকে আমার নামার পরে। রাজিবপুর কোর্টে গিয়ে দেখি ওঠানামার পালা চলে না কোনো টাইমেই!
চিলমারীতে থাকতেই আমার সার্কিট ডিউটি পড়ল চর-রাজিবপুর কোর্টে। মাসে টানা ছয় দিন একবারে। বিশাল প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে যাব কী করে! তাতে আবার নতুন বউ নবীন সহকারী জজের কোয়ার্টারে! একেলা একেবারে। রেখে যাই, না সঙ্গে নিই একাকিনীকে! পড়লাম মহা-ফাঁপরে। উদ্ধার করলেন উপজেলা প্রকৌশলী কৌশল খাটিয়ে! মাসে-দুমাসে এক-আধবার তারও যেতে হয় সেখানে অতিরিক্ত দায়িত্বের টানে, ফেরেন অবশ্য দিনে দিনেই। দোতলা-নিচতলায় একই ভবনবাসী বলে টান তার আমার ওপরেও। ভাওমতো আগাম খবরও ছিল তার কাছে! রাজিবপুরের পিআইও (প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টশন অফিসার) সপরিবারেই থাকেন রাজিবপুরে কোয়ার্টার নিয়ে। পরিবার তার গেছে বাপের বাড়ি। পরিবার আনতে যাওয়া উপলক্ষে নাকি দিন পনেরো পরে তার দিন সাতেকের ছুটির দরকার আছে! ব্যাস, হয়ে গেল ফিট! কোয়ার্টারের চাবি রেখে রাজিবপুরের পিআইও গেল পরিবার আনতে, আর পরিবার নিয়ে আমরা চললাম রাজিবপুরে!
প্রকৌশলী ভাবিরও এবার শখ হলো চর-রাজিবপুর উপজেলা বেড়ানোর। আমার তো ঠেকা ছিলই একাকিনীকে নেওয়ার! প্রকৌশলী ভাবির কোলে শিশুপুত্র একজনই। আমাদের দুজনের কোল খালি, পূরণের টাইম তখনো হয়নি! থানাহাট থেকে ব্রহ্মপুত্রের পাড় পাঁচ কিলোমিটার পথ তখনো কাঁচা মাটির। উপজেলা পরিষদের জিপে করে গিয়ে দুই পরিবার উঠলাম ছইওয়ালা এক শ্যালো নৌকায়। ডিঙি থেকে গহনা, কিছু নৌকায় চড়া ছিল আগে। শ্যালো ইঞ্জিনের নৌকায় এটাই প্রথম। শ্যালো নৌকা বাঙালি তখন সবেমাত্র নামিয়েছে। বিশাল বিশাল ঢেউয়ের ফণায় গেলাম গেলাম করে, ছোট-বড় কয়েকটা চর কাটিয়ে, সাড়ে তিন ঘণ্টার একটানা ভটভট শব্দে নৌকা ভ্রমণ পানি করে নামলাম গিয়ে চর-রাজিবপুরে। উঠলাম উপজেলা পরিষদ ক্যাম্পাসে পিআইওর কোয়ার্টারে।
এক ঘরে প্রকৌশলী ফ্যামিলি, আরেক ঘরে আমি আর গিন্নি। ঢুকে দেখি বিদ্যুৎ নেই ঘরে। চিলমারীতে তবু তো ফ্যান ঘুরত একটু-আধটু, দীর্ঘক্ষণ পর একটুক্ষণের জন্য বিদ্যুৎ এলো! সন্ধ্যায় কুপিবাতির মতো মিটমিটে আলো তবু তো জ্বলত বাল্বে! গভীর রাতে তবু তো ভোল্টেজ ঠিক হতো! এখানে দেখি বিদ্যুতের লাইনই আসেনি উপজেলা পরিষদ চত্বরটুকুতেও। শীত চলে গেলেও গরমের তেজ বাড়েনি বলে রক্ষা ওই দুপুরে। বিকেলে উপজেলা পরিষদের জিপে করে বেরোলাম ঘুরতে। ঘণ্টাখানেকের ঘোরাতেই চারি সীমা শেষ! তারপরে খানিক গ্রামের রাস্তা, তারপরে অথই পানি। পুবদিকে দৃষ্টির শেষ সীমায় ভারতের মেঘালয়! ওই দেখা যায় দূর-আকাশে আবছায়া একফালি পাহাড়ের! দেখার কিছু নেই আর। যাওয়ার কোনো পথ নেই আর। ফিরে এসে সন্ধ্যায় শুয়ে পড়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। কালাপানি পাড়ি দিয়ে নির্বাসন খাটতে এলাম যেন দ্বীপান্তরে বাবারে!
পরদিন শনিবার সকালে কোর্টে গিয়ে দেখি সবেজন কর্মচারী শুধু এক পেশকার বেচারি! সেরেস্তাদার, নাজির, কেরানি সবটারই চার্জে একা সে। কালাপানি পানিশমেন্ট পোস্টিংয়ে পড়ে ভুগছে ভূরুঙ্গামারী থেকে এসে! পিয়ন-পেয়াদা কে জানি ছিল একজনে, বাড়ি যার সে-চরেই। উকিল নেই কোনো জনে। একজন নাকি আছেন মোটে এখানে! শুধু ওকালতিতে পোষায় না বলে বাড়তি পেশা নিয়েছেন রাজনীতি। ভোটে লড়ে হতে চান এমপি। মামলা লড়ার চেয়ে কম কি! এটাই তার কনস্টিটিউয়েন্সি। কুড়িগ্রামে প্র্যাকটিস আর পার্টির কাজে কুড়িগ্রাম-ঢাকা করার পর সময় বাঁচলে ভোট-এলাকায় আসেন। ফেরার সময় মাঝে-সাঝে একটা-দুটো মামলা ঠুঁকে যান ভোটারের স্বার্থে! এই করে সহকারী জজ কোর্টে মামলা জমেছে গোটা বিশেক মোট্টে। বিবাদীপক্ষে লড়ার একজনও নেই এ-চরে। উকিল আনতে হবে কুড়িগ্রাম সদর থেকে। সারা দিন পানি করে বিশাল ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে কালাপানি খাটতে রাজি উকিল পাওয়া কি চাট্টিখানি! নিমরাজিকেও আনার যে বিশাল খরচা তার চেয়ে পড়তা ছিল আগেকার দিনের সেই সদরেই মামলা লড়া।
লাভ হয়েছে পুরো শুধু কর্তৃপক্ষের! পানিশমেন্ট দেওয়ার কাউকে পেলেই কালাপানি পোস্টিং লাগায় চর-রাজিবপুরে! জয়েনিংয়ের আগেই সেজন ধরেন ওঠার তদবির ওই কর্তৃপক্ষেরই দ্বারে। এই করে থাকেন বড়জোর মাস ছয়, বেশির ভাগটুকু তার শুধু কাগজেই। তার পরেই উঠে পড়েন। পদ ফাঁকা পড়ে থাকে চরে, যত দিন না পানিশমেন্ট লাগানোর আরেকজন জোটে! সহকারী জজ একজনে কিছুদিন কালাপানি খেটে উঠে গেছেন প্রায় ছ-মাস আগে। সহসা কাউকে পাওয়ার নেই ধরে আমাকে লাগিয়েছে বদলি খাটতে! প্রকৌশলীর পদ ফাঁকা, বদলি তো খাটতে এসেছেন আমার সঙ্গেই। ম্যাজিস্ট্রেট (জুডিশিয়াল হওয়ার কথাই তখন ওঠেনি), ইউএনও পদও ছিল ফাঁকা। বদলিদের সঙ্গে দেখা আমার ভাগে মেলেনি।
ওঠানামা হলো না মোটে রাজিবপুর কোর্টে। কোট-গাউন বেকার বয়ে আনা! দুপুরবেলা ফিরে এলাম পিআইওর কোয়ার্টারে। শুনানির প্রার্থনা নিয়ে বিচারপ্রার্থীর আসার অপেক্ষায় থাকা চিলমারীতে যদি চলে খাসকামরায় থাকলে তবে চর-রাজিবপুরে সেটা চলে কোয়ার্টারে থাকলেই! বিকেলে ঘুরতে বেরিয়ে আবার সেই দূর-পাহাড়ের আবছায়ার স্থানটি! দুই বিকেলেই প্রকৌশলী ভাবির বেড়ানো কমপ্লিট! ফিরে গেলেন তারা রবিবার সকালেই। আমার তো আরও সাড়ে চার দিন খাটা বাকি! দিন পার করি কখন সন্ধ্যা নামবে করে, আর রাত কাটাই কখন সূর্য উঠবে করে। সঙ্গে গিন্নি না থাকলে (আমার পাল্লায় পড়ে ফেঁসেছে নিরাপরাধিনী) এসব ওঠানো নামানো কি সহজ কম্ম ছিল! আমার চেয়ে সেটা ঢের বেশি টের পেয়েছে পিআইও! এই চরান্তরে কোয়ার্টার ফেলে বেচারি পরিবার আনতে ছুটেছে যে কেন তার কিছুটা অন্তত টের পেয়েছি!
অবশেষে এলো প্রতীক্ষিত সেই বৃহস্পতিবার। দুপুর হতেই চর ছেড়ে উঠে পড়লাম শ্যালো নৌকায়। আবার সেই সাড়ে তিন ঘণ্টার একটানা ভটভট শব্দের নৌকা ভ্রমণ পানি করা জার্নি! চিলমারীতে ফিরে হাঁপ ছাড়ব কী! সামনের মাসে আবার তো যেতে হবে! মনে হতেই শরীরের পানি শুকিয়ে আসে! বারবার তো আর জোট হবে না প্রকৌশলীর সঙ্গে! এক পিআইওর কোয়ার্টার ফাঁকা থাকবে আর কতবার! ডাকবাংলো তখনো চর-রাজিবপুরে হয়ইনি, দেখে এসেছি নিজের চোখে। যাই যদিবা ভটভট সয়ে তো ছয়-ছয়টা রাত দুজনাতে (একাকিনীকে ফেলে একা যাওয়া যায় নাকি চরে!) কাটাব কোন কুটিরে! ওঠানামার আসল কামটা তো নাই-ই। টিএ বিল বানাতে গিয়ে দেখি শুধু যাওয়ার পথের শ্যালোর খরচাই ওঠে না! সরকার অনুমোদিত লঞ্চ-স্টিমার না হলে নৌপথে ভাড়া নাই সরকারি সার্কুলারে! ভেলা-ডিঙি-শ্যালো সবটারই এক রেট, এক টাকা মাইলেজ! মাইলটা আবার নটিক্যালে নয়, হবে স্থলের মাপে! মুসিবতের আর বাকি কিছু আছে!
বুদ্ধি কষে তাই রিপ্রেজেন্টশন দিলাম একাকিনীর কঠিন কারণ ফেঁদে! সদ্যবিবাহিত আমি, কোয়ার্টারে একাকিনী তিনি, টানা ছয় দিন তাকে ফেলে আমি একা চর-রাজিবপুরে থাকতে গেলে অনুরাগ থেকে রাগ উঠে রাগারাগি বেধে সংসারই ভেঙে যায় যায়, সার্কিট ডিউটিটা থেকে আমাকে অব্যাহতি দিয়ে রক্ষা করুন হুজুর এই নতুন সংসারটিকে! খবরই এলো না তার। তাহলে আর চরে যাই কী করে! মাস-তিনেক পরে হলো আমারই বদলি। না, চর-রাজিবপুরে নয়! রাজারহাটে। তারও মাস কয়েক পর আমার পরের ব্যাচের এক ভদ্রমহিলা শিক্ষানবিসি সেরে প্রথম পোস্টিং নিয়ে আসেন চিলমারী সহকারী জজ কোর্টে। শুনেছিলাম, চর-রাজিবপুরের ওই টানা ছ-দিন সার্কিট ডিউটিটা পড়ে তার ওপরে। ডিউটি না টেনে তার উপায় আছে! একাকিনীর কারণ নেই তার কোয়ার্টারে! তার একা তিনি ভদ্রলোক (বিসিএসে আমারই ব্যাচের), পাশের উপজেলা উলিপুরে সার্কেল এএসপি। শ্যালো নৌকা নয়, ভদ্রমহিলার ছিল স্পিড বোট ম্যানেজ করার শক্তি! জজের আসল পাওয়ার পুলিশই! চর-রাজিবপুরে ছ-রাত থাকার সমস্যা তার শুনিনি। শুনেছি, ওঠানামার পালাটা নাকি বলতে গেলে হয়ইনি।
রেলস্টেশন ছিল রাজারহাটেও। কুড়িগ্রামের কাছেই। সকালে রমনা ট্রেনের ঘণ্টাটা তাই চিলমারীর রমনা স্টেশনের অনেক আগেই পড়ে এখানে। কিন্তু, কোর্টের ওঠার পালাটা শুরু হয় না চিলমারীর সেই টাইমের আগে। কপালের ফের আমার! কোর্টের ওঠানামার পালাটা এখানেও আগে চলছিল শুধু বৃহস্পতিবারে আধা বেলার সার্কিট ডিউটিতে। আমি এসে টেনেটুনেও দেখি ওঠার পালাটা আনাই যায় না ধরাবাঁধা টাইমের কাছে! জ্বালাটা কি উপজেলা কোর্টে! জুনিয়রগিরিকালে তো দেখতাম, সিনিয়র বাড়ি থেকে গরম ভাত খেয়ে বেরিয়েও সকালে জজ কোর্টে ঠিকই হাজির হতেন সাড়ে দশটা বাজতেই!
(চলবে)
লেখক প্রবন্ধকার ও আইন গ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক
শেয়ার করুন
মঈদুল ইসলাম | ৬ জুলাই, ২০২২ ০০:০০

(দ্বিতীয় কিস্তির পর)
হুজুরের ওপর আর কি কথা খাটে! হাতে ধরে বুঝিয়ে দিলেন যুক্তিসহকারে! কোর্টের ওঠানামার পালাটা চলবে ভাগীদারদের ভাওমতো টাইমে! আর, কেতাবে বাঁধা টাইমটা রোজ রোজ লিখতে হবে ডায়েরির কাগজে! সত্যিটা লিখলেই খেতে হবে ধরা! মিথ্যে লিখলে মেলা যুক্তি খাওয়ানোর থাকে! ব্রিটিশের বুদ্ধির চাল বানচাল বাঙালির যুক্তির প্যাঁচে! এজলাসে ওঠানামা আমার থাকল আগের সেই ভাওমতো টাইমে। শুরু করলাম কেতাবে বাঁধা টাইমগুলো ডায়েরিতে লিখে খাসকামরাতে অপেক্ষার পালা, না জানি কখন আবার হুজুরের কথামতো শুনানির প্রার্থনা নিয়ে বিচারপ্রার্থী চলে আসে! কোর্টে কাজ মিটেছে উকিল সাহেবদের, মক্কেলের অপেক্ষায় থাকার তাদের সেরেস্তা আছে বাড়িতেই। উকিল না নিয়ে শুনানির প্রার্থনা নিয়ে দেওয়ানিতে কোন বেআক্কেল আসে! আসেওনি মক্কেল-বেআক্কেল কেউ আর চিলমারীতে এজলাস থেকে আমার নামার পরে। রাজিবপুর কোর্টে গিয়ে দেখি ওঠানামার পালা চলে না কোনো টাইমেই!
চিলমারীতে থাকতেই আমার সার্কিট ডিউটি পড়ল চর-রাজিবপুর কোর্টে। মাসে টানা ছয় দিন একবারে। বিশাল প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে যাব কী করে! তাতে আবার নতুন বউ নবীন সহকারী জজের কোয়ার্টারে! একেলা একেবারে। রেখে যাই, না সঙ্গে নিই একাকিনীকে! পড়লাম মহা-ফাঁপরে। উদ্ধার করলেন উপজেলা প্রকৌশলী কৌশল খাটিয়ে! মাসে-দুমাসে এক-আধবার তারও যেতে হয় সেখানে অতিরিক্ত দায়িত্বের টানে, ফেরেন অবশ্য দিনে দিনেই। দোতলা-নিচতলায় একই ভবনবাসী বলে টান তার আমার ওপরেও। ভাওমতো আগাম খবরও ছিল তার কাছে! রাজিবপুরের পিআইও (প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টশন অফিসার) সপরিবারেই থাকেন রাজিবপুরে কোয়ার্টার নিয়ে। পরিবার তার গেছে বাপের বাড়ি। পরিবার আনতে যাওয়া উপলক্ষে নাকি দিন পনেরো পরে তার দিন সাতেকের ছুটির দরকার আছে! ব্যাস, হয়ে গেল ফিট! কোয়ার্টারের চাবি রেখে রাজিবপুরের পিআইও গেল পরিবার আনতে, আর পরিবার নিয়ে আমরা চললাম রাজিবপুরে!
প্রকৌশলী ভাবিরও এবার শখ হলো চর-রাজিবপুর উপজেলা বেড়ানোর। আমার তো ঠেকা ছিলই একাকিনীকে নেওয়ার! প্রকৌশলী ভাবির কোলে শিশুপুত্র একজনই। আমাদের দুজনের কোল খালি, পূরণের টাইম তখনো হয়নি! থানাহাট থেকে ব্রহ্মপুত্রের পাড় পাঁচ কিলোমিটার পথ তখনো কাঁচা মাটির। উপজেলা পরিষদের জিপে করে গিয়ে দুই পরিবার উঠলাম ছইওয়ালা এক শ্যালো নৌকায়। ডিঙি থেকে গহনা, কিছু নৌকায় চড়া ছিল আগে। শ্যালো ইঞ্জিনের নৌকায় এটাই প্রথম। শ্যালো নৌকা বাঙালি তখন সবেমাত্র নামিয়েছে। বিশাল বিশাল ঢেউয়ের ফণায় গেলাম গেলাম করে, ছোট-বড় কয়েকটা চর কাটিয়ে, সাড়ে তিন ঘণ্টার একটানা ভটভট শব্দে নৌকা ভ্রমণ পানি করে নামলাম গিয়ে চর-রাজিবপুরে। উঠলাম উপজেলা পরিষদ ক্যাম্পাসে পিআইওর কোয়ার্টারে।
এক ঘরে প্রকৌশলী ফ্যামিলি, আরেক ঘরে আমি আর গিন্নি। ঢুকে দেখি বিদ্যুৎ নেই ঘরে। চিলমারীতে তবু তো ফ্যান ঘুরত একটু-আধটু, দীর্ঘক্ষণ পর একটুক্ষণের জন্য বিদ্যুৎ এলো! সন্ধ্যায় কুপিবাতির মতো মিটমিটে আলো তবু তো জ্বলত বাল্বে! গভীর রাতে তবু তো ভোল্টেজ ঠিক হতো! এখানে দেখি বিদ্যুতের লাইনই আসেনি উপজেলা পরিষদ চত্বরটুকুতেও। শীত চলে গেলেও গরমের তেজ বাড়েনি বলে রক্ষা ওই দুপুরে। বিকেলে উপজেলা পরিষদের জিপে করে বেরোলাম ঘুরতে। ঘণ্টাখানেকের ঘোরাতেই চারি সীমা শেষ! তারপরে খানিক গ্রামের রাস্তা, তারপরে অথই পানি। পুবদিকে দৃষ্টির শেষ সীমায় ভারতের মেঘালয়! ওই দেখা যায় দূর-আকাশে আবছায়া একফালি পাহাড়ের! দেখার কিছু নেই আর। যাওয়ার কোনো পথ নেই আর। ফিরে এসে সন্ধ্যায় শুয়ে পড়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। কালাপানি পাড়ি দিয়ে নির্বাসন খাটতে এলাম যেন দ্বীপান্তরে বাবারে!
পরদিন শনিবার সকালে কোর্টে গিয়ে দেখি সবেজন কর্মচারী শুধু এক পেশকার বেচারি! সেরেস্তাদার, নাজির, কেরানি সবটারই চার্জে একা সে। কালাপানি পানিশমেন্ট পোস্টিংয়ে পড়ে ভুগছে ভূরুঙ্গামারী থেকে এসে! পিয়ন-পেয়াদা কে জানি ছিল একজনে, বাড়ি যার সে-চরেই। উকিল নেই কোনো জনে। একজন নাকি আছেন মোটে এখানে! শুধু ওকালতিতে পোষায় না বলে বাড়তি পেশা নিয়েছেন রাজনীতি। ভোটে লড়ে হতে চান এমপি। মামলা লড়ার চেয়ে কম কি! এটাই তার কনস্টিটিউয়েন্সি। কুড়িগ্রামে প্র্যাকটিস আর পার্টির কাজে কুড়িগ্রাম-ঢাকা করার পর সময় বাঁচলে ভোট-এলাকায় আসেন। ফেরার সময় মাঝে-সাঝে একটা-দুটো মামলা ঠুঁকে যান ভোটারের স্বার্থে! এই করে সহকারী জজ কোর্টে মামলা জমেছে গোটা বিশেক মোট্টে। বিবাদীপক্ষে লড়ার একজনও নেই এ-চরে। উকিল আনতে হবে কুড়িগ্রাম সদর থেকে। সারা দিন পানি করে বিশাল ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে কালাপানি খাটতে রাজি উকিল পাওয়া কি চাট্টিখানি! নিমরাজিকেও আনার যে বিশাল খরচা তার চেয়ে পড়তা ছিল আগেকার দিনের সেই সদরেই মামলা লড়া।
লাভ হয়েছে পুরো শুধু কর্তৃপক্ষের! পানিশমেন্ট দেওয়ার কাউকে পেলেই কালাপানি পোস্টিং লাগায় চর-রাজিবপুরে! জয়েনিংয়ের আগেই সেজন ধরেন ওঠার তদবির ওই কর্তৃপক্ষেরই দ্বারে। এই করে থাকেন বড়জোর মাস ছয়, বেশির ভাগটুকু তার শুধু কাগজেই। তার পরেই উঠে পড়েন। পদ ফাঁকা পড়ে থাকে চরে, যত দিন না পানিশমেন্ট লাগানোর আরেকজন জোটে! সহকারী জজ একজনে কিছুদিন কালাপানি খেটে উঠে গেছেন প্রায় ছ-মাস আগে। সহসা কাউকে পাওয়ার নেই ধরে আমাকে লাগিয়েছে বদলি খাটতে! প্রকৌশলীর পদ ফাঁকা, বদলি তো খাটতে এসেছেন আমার সঙ্গেই। ম্যাজিস্ট্রেট (জুডিশিয়াল হওয়ার কথাই তখন ওঠেনি), ইউএনও পদও ছিল ফাঁকা। বদলিদের সঙ্গে দেখা আমার ভাগে মেলেনি।
ওঠানামা হলো না মোটে রাজিবপুর কোর্টে। কোট-গাউন বেকার বয়ে আনা! দুপুরবেলা ফিরে এলাম পিআইওর কোয়ার্টারে। শুনানির প্রার্থনা নিয়ে বিচারপ্রার্থীর আসার অপেক্ষায় থাকা চিলমারীতে যদি চলে খাসকামরায় থাকলে তবে চর-রাজিবপুরে সেটা চলে কোয়ার্টারে থাকলেই! বিকেলে ঘুরতে বেরিয়ে আবার সেই দূর-পাহাড়ের আবছায়ার স্থানটি! দুই বিকেলেই প্রকৌশলী ভাবির বেড়ানো কমপ্লিট! ফিরে গেলেন তারা রবিবার সকালেই। আমার তো আরও সাড়ে চার দিন খাটা বাকি! দিন পার করি কখন সন্ধ্যা নামবে করে, আর রাত কাটাই কখন সূর্য উঠবে করে। সঙ্গে গিন্নি না থাকলে (আমার পাল্লায় পড়ে ফেঁসেছে নিরাপরাধিনী) এসব ওঠানো নামানো কি সহজ কম্ম ছিল! আমার চেয়ে সেটা ঢের বেশি টের পেয়েছে পিআইও! এই চরান্তরে কোয়ার্টার ফেলে বেচারি পরিবার আনতে ছুটেছে যে কেন তার কিছুটা অন্তত টের পেয়েছি!
অবশেষে এলো প্রতীক্ষিত সেই বৃহস্পতিবার। দুপুর হতেই চর ছেড়ে উঠে পড়লাম শ্যালো নৌকায়। আবার সেই সাড়ে তিন ঘণ্টার একটানা ভটভট শব্দের নৌকা ভ্রমণ পানি করা জার্নি! চিলমারীতে ফিরে হাঁপ ছাড়ব কী! সামনের মাসে আবার তো যেতে হবে! মনে হতেই শরীরের পানি শুকিয়ে আসে! বারবার তো আর জোট হবে না প্রকৌশলীর সঙ্গে! এক পিআইওর কোয়ার্টার ফাঁকা থাকবে আর কতবার! ডাকবাংলো তখনো চর-রাজিবপুরে হয়ইনি, দেখে এসেছি নিজের চোখে। যাই যদিবা ভটভট সয়ে তো ছয়-ছয়টা রাত দুজনাতে (একাকিনীকে ফেলে একা যাওয়া যায় নাকি চরে!) কাটাব কোন কুটিরে! ওঠানামার আসল কামটা তো নাই-ই। টিএ বিল বানাতে গিয়ে দেখি শুধু যাওয়ার পথের শ্যালোর খরচাই ওঠে না! সরকার অনুমোদিত লঞ্চ-স্টিমার না হলে নৌপথে ভাড়া নাই সরকারি সার্কুলারে! ভেলা-ডিঙি-শ্যালো সবটারই এক রেট, এক টাকা মাইলেজ! মাইলটা আবার নটিক্যালে নয়, হবে স্থলের মাপে! মুসিবতের আর বাকি কিছু আছে!
বুদ্ধি কষে তাই রিপ্রেজেন্টশন দিলাম একাকিনীর কঠিন কারণ ফেঁদে! সদ্যবিবাহিত আমি, কোয়ার্টারে একাকিনী তিনি, টানা ছয় দিন তাকে ফেলে আমি একা চর-রাজিবপুরে থাকতে গেলে অনুরাগ থেকে রাগ উঠে রাগারাগি বেধে সংসারই ভেঙে যায় যায়, সার্কিট ডিউটিটা থেকে আমাকে অব্যাহতি দিয়ে রক্ষা করুন হুজুর এই নতুন সংসারটিকে! খবরই এলো না তার। তাহলে আর চরে যাই কী করে! মাস-তিনেক পরে হলো আমারই বদলি। না, চর-রাজিবপুরে নয়! রাজারহাটে। তারও মাস কয়েক পর আমার পরের ব্যাচের এক ভদ্রমহিলা শিক্ষানবিসি সেরে প্রথম পোস্টিং নিয়ে আসেন চিলমারী সহকারী জজ কোর্টে। শুনেছিলাম, চর-রাজিবপুরের ওই টানা ছ-দিন সার্কিট ডিউটিটা পড়ে তার ওপরে। ডিউটি না টেনে তার উপায় আছে! একাকিনীর কারণ নেই তার কোয়ার্টারে! তার একা তিনি ভদ্রলোক (বিসিএসে আমারই ব্যাচের), পাশের উপজেলা উলিপুরে সার্কেল এএসপি। শ্যালো নৌকা নয়, ভদ্রমহিলার ছিল স্পিড বোট ম্যানেজ করার শক্তি! জজের আসল পাওয়ার পুলিশই! চর-রাজিবপুরে ছ-রাত থাকার সমস্যা তার শুনিনি। শুনেছি, ওঠানামার পালাটা নাকি বলতে গেলে হয়ইনি।
রেলস্টেশন ছিল রাজারহাটেও। কুড়িগ্রামের কাছেই। সকালে রমনা ট্রেনের ঘণ্টাটা তাই চিলমারীর রমনা স্টেশনের অনেক আগেই পড়ে এখানে। কিন্তু, কোর্টের ওঠার পালাটা শুরু হয় না চিলমারীর সেই টাইমের আগে। কপালের ফের আমার! কোর্টের ওঠানামার পালাটা এখানেও আগে চলছিল শুধু বৃহস্পতিবারে আধা বেলার সার্কিট ডিউটিতে। আমি এসে টেনেটুনেও দেখি ওঠার পালাটা আনাই যায় না ধরাবাঁধা টাইমের কাছে! জ্বালাটা কি উপজেলা কোর্টে! জুনিয়রগিরিকালে তো দেখতাম, সিনিয়র বাড়ি থেকে গরম ভাত খেয়ে বেরিয়েও সকালে জজ কোর্টে ঠিকই হাজির হতেন সাড়ে দশটা বাজতেই!
(চলবে)
লেখক প্রবন্ধকার ও আইন গ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক