
সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও পরিব্রাজক প্রবোধকুমার সান্যাল ১৯০৫ সালের ৭ জুলাই উত্তর কলকাতার চোরবাগানে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের আদিনিবাস ছিল ফরিদপুরে এবং স্থায়ী নিবাস কলকাতার বালিগঞ্জে। তার সাহিত্যিক ছদ্মনাম ‘কীর্তনীয়া’। তিনি যুগান্তর পত্রিকার রবিবাসরীয় সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক (১৯৩৭-৪১) ছিলেন এবং স্বদেশ পত্রিকার সম্পাদক থাকাকালে একবার রাজদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হন। প্রবোধকুমার দেশভ্রমণ পছন্দ করতেন। তিনি মানস সরোবর, কৈলাস পর্বত ও হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চলসহ ছয়বার সমগ্র ভারতবর্ষ ভ্রমণ করেন। ভারতবর্ষ ও নেপাল ছাড়াও তিনি এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও রাশিয়ার বহু অঞ্চল ভ্রমণ করেন। এসব ভ্রমণের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি মহাপ্রস্থানের পথে (১৯৩৭), রাশিয়ার ডায়েরী, দেবতাত্মা হিমালয় (দুই খন্ড), ‘উত্তর হিমালয় চরিত’ প্রভৃতি ভ্রমণকাহিনী রচনা করে বাংলা ভ্রমণ-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। কল্লোল যুগের খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক হিসেবেই প্রবোধকুমারের প্রধান পরিচয়। তার প্রথম উপন্যাস ‘যাযাবর’ প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে। ‘প্রিয়বান্ধবী’, ‘অগ্রগামী’, ‘আঁকাবাঁকা’, ‘পুষ্পধনু’, ‘বিবাগী ভ্রমর’, ‘হাসুবানু’, ‘বনহংসী’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘নিশিপদ্ম’ ইত্যাদি উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ রচনা করেন তিনি। প্রবোধকুমার তার সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদক (১৯১১), শিশির কুমার পুরস্কার, মতিলাল পুরস্কার (১৯১০), শরৎ পুরস্কার এবং আনন্দ পুরস্কার (১৯৮০) লাভ করেন। ১৯৮৩ সালের ১৭ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এবার সিলেট-সুনামগঞ্জসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহতম বন্যা ও জলাবদ্ধতার ঘটনায় মেঘনা অববাহিকার পানি ও পলি নিষ্কাশনের মারাত্মক সংকটের বিষয়টি অনেকেরই দৃষ্টিগোচর হয়েছে। দেশ-বিদেশের জল-ভূতত্ত্ববিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এই সংকটের নানা দিক বিশ্লেষণ করে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন এবং সম্ভাব্য সমাধানের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এসব পর্যবেক্ষণ বিবেচনা করলে দেখা যায়, একটা বিষয়ে সবাই একমত যে, মেঘনা অববাহিকার উজান থেকে আসা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থায় হাওরসহ ওই অঞ্চলের নদ-নদী-খাল-ঝিরি সবই একটা একক সত্তার মতো একে অন্যের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন এক জলপ্রকৃতি হওয়ায় খ-িত বা আংশিক কোনো পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এই সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। এজন্য হাওর অঞ্চলের যেকোনো পরিকল্পনা হতে হবে সমন্বিত জলব্যবস্থাপনার ভিত্তিতে। কিন্তু আমরা যে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও সেই পথে হাঁটছি না তার দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি। এখন যেমন দেখা যাচ্ছে ‘হাওর এলাকায় আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রায় এক দশক ধরে যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে তা কোনো কাজেই আসছে না। প্রশ্ন হলো, আমরা কি এই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে আগামীতে কোনো সমন্বিত পরিকল্পনার দিকে যাব নাকি আগের মতোই সমন্বয়হীনভাবে নানা খ-িত প্রকল্পে বিপুল অর্থ ব্যয়ের ধারাবাহিকতাতেই চলতে থাকব?
দেশ রূপান্তরে বুধবার ‘৫৮৭ কোটি টাকার বাঁধ অকারণ!’ শিরোনামের প্রতিবেদনে হাওরের ছয়টি জেলার মোট ২৯টি উপজেলায় পাউবো’র আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও পানি নিষ্কাশন উন্নয়নের জন্য বাস্তবায়ন করা প্রকল্পের অসারতা তুলে ধরা হয়। ২০১১ সালে গ্রহণ করা প্রকল্পটি কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৯ সালে শেষ করা হয়। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার মাত্র তিন বছরের মধ্যেই গত মাসের ভয়াবহ বন্যায় প্রকল্পটির অধীনে তৈরি করা বাঁধসহ সংশ্লিষ্ট সবকিছু কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। প্রতিবেদনটি থেকে জানা গেছে, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পর্যালোচনাতেই বলা হয়েছে যে, প্রকল্পটির আওতায় নির্মিত ফসল রক্ষা বাঁধ থেকে শুরু করে অনেক কিছুই এখন আর কাজে আসছে না। অথচ প্রকল্পটির মূল লক্ষ্যে বলা হয়েছিল, আগাম বন্যার কবল থেকে হাওর এলাকার বোরো ফসল রক্ষা, মূল নদীগুলোর পরিবহন ক্ষমতা বাড়ানো, অভ্যন্তরীণ খালগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো এবং দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নাব্য সংকট দূর করতে ভূমিকা রাখবে এই প্রকল্প। কিন্তু আইএমইডি তাদের বিশ্লেষণে বলেছে, প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাজ শেষ হওয়ার পরবর্তী তিন বছরে বন্যায় পলি জমে অভ্যন্তরীণ খালগুলোর গভীরতা কমাসহ নিষ্কাশন ব্যবস্থা অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে হাওর হয়ে যাচ্ছে পানিশূন্য। পানির অভাবে বোরো উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠছে প্রকল্পটি অনুমোদনের আগে হাওরের মতো একটি বিশেষায়িত জলপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্যসহ সেখানকার পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা সম্পর্কে যথাযথ বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা করা হয়েছিল কি? এই প্রশ্নও করা যেতে পারে যে, এ ধরনের প্রকল্প আদৌ কাজে লাগবে কি না সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত সরকার নিয়েছিল কি?
খেয়াল করা দরকার, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ তাদের সুপারিশে আরও বলছে, হাওরের সব পানি ভৈরব বাজার চ্যানেল দিয়ে মেঘনা নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। কিন্তু সেখানে এখন তিনটি সেতুর পিলার এবং সেগুলোর সুরক্ষার জন্য নদীর তলদেশে প্রতিরক্ষা সামগ্রী থাকায় পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই হাওরের পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে হবে। উল্লেখ্য দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত একাধিক সাক্ষাৎকার ও সম্পাদকীয়তে ভৈরব চ্যানেলের এই ‘বোটলনেক প্রবলেম’ বা সরু হয়ে যাওয়া পানি নিষ্কাশন পথের সংকটের কথা তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু এ জাতীয় সংকটগুলো সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তর আমলে নেয় বলে মনে হয় না। এছাড়া এই প্রশ্নও জরুরি যে, দুই দশক আগে প্রতিষ্ঠিত হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড যা ২০১৬ সাল থেকে ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর’ নামে পুনর্গঠিত হয়েছে তারা হাওর রক্ষায় কী করছে? হাওর মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে এখন অধিদপ্তরের ৩৬টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। কিন্তু এসব প্রকল্প পরস্পরের সঙ্গে কতটা সম্পর্কিত এবং সমন্বিতÑ সেই মূল্যায়ন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা, হাওর বেদখল হয়ে গেলে, হাওরের বিশেষ জল-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য টিকে না থাকলে এই অধিদপ্তরের কর্মকা- থেকে দেশ কীভাবে উপকৃত হবে? বর্তমান বাস্তবতায় তাই এমন প্রকল্পই গ্রহণ করা উচিৎ যা হাওরের বিশেষ জলপ্রকৃতির মূল বৈশিষ্ট্যগুলোকে বাধাগ্রস্ত করবে না। একইসঙ্গে এই বিশেষ জলভূগোলের সঙ্গে অভিযোজনের মধ্য দিয়ে হাওরের কৃষি ও নদনদী-খাল-জলাশয়ের নাব্য রক্ষায় সরকারের বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন, তিনি খুব মজা করে রোল কল করতেন। ছাত্রদের নাম উচ্চারণের সময় একটা বিশেষ ভঙ্গি প্রয়োগ করতেন। রোল কল শুরু হওয়ার দু-তিন মিনিট পর যে ছাত্ররা ক্লাসে ঢুকত তাদের দিকে তাকিয়ে একটু বিশেষ ভঙ্গিমায় বলতেন, তুমি লেট প্রেজেন্ট। আর যারা দশ মিনিট পরে ঢুকত তাদের দিকে তাকিয়ে বলতেন তুমি প্রেজেন্ট নও, লেট প্রেজেন্টও নও, তুমি লেট অ্যাবসেন্ট। দু-একজন ছাত্র প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে বলত, স্যার আমি তো প্রেজেন্ট। স্যার আবারও দৃঢ়ভঙ্গিতে বলতেন, তুমি লেট অ্যাবসেন্ট। দশ মিনিট বিলম্বে যদি ট্রেনকে লেট বলা হয় তাহলে স্যারের ভাষায় ট্রেনটি লেট অ্যাবসেন্ট। এমনি লেট অ্যাবসেন্টের হাজারো আবর্তে পড়ে আছে শতবর্ষের ট্রেন। ব্রিটিশ আমলে এই ট্রেন লেটের জন্য সবাইকে জবাবদিহি করতে হতো। এবং কারণ দর্শানোর জন্য রেল কর্মকর্তাদের হিমশিম খেতে হতো। আমার ওই শিক্ষক হয়তো বেঁচে নেই। তাহলে তার হিসাবে দশ মিনিট পর থেকেই ট্রেনকে আর লেট বলতেন না। বলতেন ট্রেন আসেইনি।
পাকিস্তান আমলে যখন থেকে রেলকে সংকুচিত করার চেষ্টা চলছিল, তখন থেকেই ট্রেনের বিলম্বে আসাকে খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়নি। আর বাংলাদেশ আমলে প্রথমত, ট্রেনকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়েছিল। ভারতীয় কিছু ট্রেনবিশেষজ্ঞ এ দেশে এসে নানান রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন। ট্রেনের জন্য একটা সুদিন আসবে বলে আমরা আশাও করেছিলাম। ভারতের ট্রেনব্যবস্থা সাতচল্লিশের পর থেকে দুর্বার হয়ে উঠতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতা এখনো অক্ষুণœ আছে। এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে বিশেষ করে জাপান ও চীনে ট্রেন একটি প্রধান পরিবহন। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যে সামরিক সরকারগুলো আসে তারা ট্রেনব্যবস্থাকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে বাস, মিনিবাস, মালামাল পরিবহনের জন্য ট্রাক এবং রাস্তাঘাটের উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করে। নব্বই দশক পর্যন্ত হাইওয়ের প্রতিষ্ঠা হতে থাকে। এরই মধ্যে কতগুলো ট্রেন দ্রুতগামী করা হয়েছে, যার ফলে মাঝারি পাল্লার ও লোকাল ট্রেনগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষ ট্রেনে চলাচলের অভ্যাস ত্যাগ করে বাসকেই ব্যবহার করতে থাকে। ওই সময় ট্রেন লেট বা ট্রেন দুর্ঘটনা, ট্রেনের রক্ষণাবেক্ষণ স্বাভাবিক কারণেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এরপর শুরু হয় ট্রেনের স্থাপনার ওপর নানান ধরনের জবর-দখল। রেলের জায়গাগুলো অবলীলায় বেদখল হতে থাকে এবং রেলের প্রধান কার্যালয়গুলো সরিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। রেলকে আঞ্চলিকভাবে বিভক্ত করে আরও দুর্বল ব্যবস্থাপনার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। এর মধ্যে পৃথিবীতে রেলের প্রযুক্তিগত অনেক উন্নতি হয়ে গেছে। বিশেষ করে ট্রেন এখন ডিজেলের ওপর মুখাপেক্ষী নয়। ট্রেন চলে বিদ্যুতের সাহায্যে। রেলকে কম্পিউটার সিস্টেমের আওতায় আনা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের রেল সেই সবুজ আর লালবাতি এবং পয়েন্টসম্যানের হাতে হাতে চলতে থাকে। রেল আর তখন লেট নয় একেবারে লেট অ্যাবসেন্টের জায়গায় পৌঁছায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাত্রীদের হয় অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় স্টেশনে কিংবা ট্রেনের ভেতর বসে থাকতে হয় প্রচন্ড গরমে।
রেলের মালামাল পরিবহনের ব্যবস্থাটিও চলে যায় ট্রাকের হাতে। ঐতিহ্যগতভাবে মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে নদীপথ একদা প্রধান পথ হিসেবেই চিহ্নিত ছিল। সেই নদীপথও ক্রমে সংকুচিত হয়ে আসে। ফেরিঘাটগুলোতে ট্রাকের দীর্ঘ যানজট দৃশ্যমান হতে থাকে আর মাঝখান থেকে ট্রেনে মালামাল পরিবহনের ব্যাপারটি গৌণ হয়ে ওঠে। নদীর দুপাশ যেমন অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে যায়, তেমনি রেলের জায়গাও চলে যায় সেসব রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তি ও ভূমিদস্যুদের হাতে। নদীকে মুক্ত করার জন্য মাঝেমধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও রেলের জায়গাকে দখলমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রেলকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য একটা ব্যবস্থায় হাত দিয়েছে। গঠন করা হয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এ কথা সত্য যে, দেশের জনসংখ্যা বিবেচনায় রেলের কোনো বিকল্প নেই। ঈদে অগ্রিম টিকিট দেওয়া হয় এবং তাতে যে পরিমাণ মানুষ একটি টিকিটের জন্য হাহাকার করে, তাতে আর সন্দেহ থাকে না যে, দূরপাল্লায় গমনের জন্য ট্রেনই একমাত্র উপায়। রেলযাত্রা যানজটমুক্ত, ভ্রমণ আরামদায়ক আর রেল পরিবহনের সংস্কৃতিও প্রাচীন। এই সংস্কৃতির কারণেই রেলকে কেন্দ্র করে অনেক ভ্রমণকাহিনী, গল্প, কবিতা ও উপন্যাস লেখা হয়েছে।
রেলপথের কাছাকাছি আছে নৌপরিবহনের অভিজ্ঞতা। কিন্তু সেই নৌপরিবহন ব্যবসায়ীদের হাতে পড়ে নানা ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। দুর্ঘটনায় বাস, মোটরসাইকেল এবং আরও ছোট ছোট যান দুর্ঘটনার শীর্ষে। দ্বিতীয় স্থানে আছে নৌ-দুর্ঘটনা। সেদিক থেকে রেল একেবারে পিছিয়ে। রেলে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে তা নিতান্তই অবহেলার কারণে। যেহেতু রেলের সংস্কারকাজ চলে ধীরগতিতে। তাই অবকাঠামো ত্রুটিও তার মধ্য থেকে যায়। আমাদের দেশে রেলের ব্যবস্থাপনাও শতাব্দী প্রাচীন। তেমন কোনো জনবলবিষয়ক সংস্কার রেলে হয়নি। কখনো কখনো দেখা যায় দূরপাল্লার ট্রেনে কিছু ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিকে যাত্রী ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে ব্যবস্থাটাও খুব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। দূরপাল্লার ট্রেনগুলোতে যে একটা বিশেষ ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার তারও কোনো উদ্যোগ রেল কর্তৃপক্ষ নেয় না।
রেলে একটা মজার বিষয় হচ্ছে ডিজেল ব্যবস্থাপনা। এর মধ্যে রেল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একটা বড় ধরনের স্বার্থ লুকায়িত আছে। একবার এক লোকাল ট্রেনে আমি লালমনিরহাট থেকে পাটগ্রাম যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পথিমধ্যে ট্রেনটি থামল, দেখি আর ট্রেন চলে না। হঠাৎ আওয়াজ উঠল যে, ড্রাইভার ডিজেল বিক্রি করছে। যাত্রীদের চিৎকার-চেঁচামেচি ও যাত্রীদের এক ধরনের ধাওয়ার পর ডিজেল চোররা সটকে পড়ল, ট্রেন আবার চলতে শুরু করল। ওই এলাকাতেই ট্রেনকে চালু রেখে ড্রাইভার কী কারণে নেমে গিয়েছিল। এরপর ট্রেন চালকবিহীন হয়ে চলতে শুরু করে। এটা বুঝতে পেরে অন্য স্টেশনগুলো ক্লিয়ারেন্সের ব্যবস্থা করে এবং একজন সাহসী ড্রাইভার ট্রেনের ছাদের ওপর উঠে ড্রাইভারের কক্ষে প্রবেশ করে ট্রেনটি রক্ষা করে। এ রকম হাজারো ঘটনা ট্রেনকে ঘিরে পাওয়া যায়। আন্দোলনের সময় ট্রেন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়, ফিশপ্লেট খুলে দেয়, ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়ে যায়। এবারে কোনো একটি এলাকায় একটা ভালো ট্রেন সার্ভিস হয়েছিল কিন্তু বাস পরিবহন মালিকরা ট্রেন চালুর পর ট্রেনের ওপর ইট, পাথর নিক্ষেপ করে গতি রুদ্ধ করে দেয়। যাত্রীরা শেষ পর্যন্ত ওই দুষ্কৃতকারী বাস মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে আর পেরে উঠে না।
ট্রেনের যাত্রীদেরও একটা সংস্কৃতির সংকট আছে। যেহেতু ট্রেনের একটা টয়লেটের ব্যবস্থা আছে, যদিও তা অপ্রতুল, সেই টয়লেট প্রায় সব সময়ই ব্যবহারের অযোগ্য থাকে। অথচ রেল তার জন্মলগ্ন থেকেই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের নিয়োগ করেছে, তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু তাদের যথার্থ তদারকির ব্যবস্থা নেই। বর্তমানে এ ব্যবস্থাটি একটা নাজেহাল অবস্থার মধ্যে রয়েছে। ট্রেনের দুর্নীতি সর্বজনবিদিত। ট্রেনে টিকিট না কেটে ওঠা, মালামাল পরিবহনে ওজনে ফাঁকি দেওয়া এবং টিকিটের বিনিময়ে কিছু উৎকোচের ব্যবস্থা বহু দিন আগে থেকেই চালু আছে। দেশ স্বাধীনের পর একটা সময় গেছে টিকিট করাটাকে কেউ কেউ অবমাননা মনে করত। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এবং আত্মীয়স্বজন-চেলাচামু-ারা ট্রেনকে ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করত। বর্তমানে তার কিছুটা পরিবর্তন হলেও সম্পূর্ণভাবে এই অনিয়ম বন্ধ করা যায়নি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের দ্বারা এটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। টিকিট করাটাকে যাত্রীদের একটা সংস্কৃতির মধ্যে নিয়ে আসা জরুরি, বর্তমানে সেই অবস্থার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে।
অত্যন্ত আশার কথা, যেখানেই বড় সেতু হচ্ছে সেখানেই যুক্ত হচ্ছে রেললাইন। এতে প্রতীয়মান হয় সরকার রেলের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। মেট্রোরেলও তারই একটা বহিঃপ্রকাশ। সেই সঙ্গে পাতাল রেললাইনটা চালু হলে মানুষ এই অসহ্য যানজটের হাত থেকে রক্ষা পাবে। সেই সঙ্গে ডিজেলচালিত ট্রেন আর নয় এ বিষয়টিরও একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রেলের জন্য আলাদা পাওয়ার স্টেশন নির্মাণ খুবই জরুরি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। কারণ সেখানে বিরতিহীন বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকতে হবে।
ট্রেন লেট দিয়ে শুরু করেছিলাম, লেটটা লেট লতিফ থেকে শুরু। এ যেন বাঙালির জীবনে এক অনতিক্রান্ত বৃত্ত। তাই ঈদযাত্রা শুরুর দিনই তিনটি ট্রেন লেট হয়ে গেল। আর লেটের কারণ ব্যাখ্যা করতে বাঙালির মতো এত পারদর্শী লোক পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যাবে না। তাই লেটকে আর প্রশ্রয় নয়, দেরি হলে তাকে অনুপস্থিত বিবেচনা করা হবে।
লেখক নাট্যকার, অভিনেতা ও কলামিস্ট
মহাবিশ্বে রয়েছে শতকোটি ছায়াপথ। ছায়াপথে আছে শতকোটি গ্রহ। কিন্তু আমাদের পৃথিবী মাত্র একটাই। বোমা হামলায়, গোলাগুলির বিকট শব্দে, মুমূর্ষু মানুষের আর্তনাদে প্রকম্পিত হচ্ছে পৃথিবী নামের গ্রহটি। বোমার আগুনে শুধু মানুষই নয়, দগ্ধ হচ্ছে মাটি। মরছে মাটিতে বসবাসকারী অণুজীব। মানুষের বাড়িঘর, বসতভিটা, গৃহপালিত প্রাণী। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। বিষাক্ত হচ্ছে পরিবেশ। শুধু কি তাই? কল-কারখানা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, রান্নাবান্নার কাজে জীবাশ্ম জ¦ালানির অবাধ ব্যবহার, ইটভাটার পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকা-, নির্বিচারে গাছপালা নিধন, বন্যপ্রাণী হত্যা, কৃষিজমিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের ব্যবহার, মানুষের ভোগবাদী জীবনযাপন, নদী-নালা, খাল-বিলসহ প্রাকৃতিক জলাশয় দখল, দূষণ ও ভরাট, পাহাড় কাটা, শব্দদূষণ প্রভৃতির মাধ্যমে আমাদের প্রিয় পৃথিবীর প্রতি আমরা করছি চরম নিষ্ঠুর আচরণ। আমরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসের কবর রচনা করছি। এতে বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ফলে কোথাও খরা, অনাবৃষ্টিতে মরুময় হয়ে উঠছে প্রকৃতি। অসময়ে অতিবৃষ্টি, বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ফলে কৃষি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলের পাকা ধান পানিতে ডুবে পচে নষ্ট হয়ে যায়। বছরের একটি মাত্র ফসল নষ্ট হওয়ার কারণে হাওরবাসীর জীবনে নেমে আসে মহাদুর্যোগ। চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য। এ বছরও আগাম অতিবৃষ্টি ও ব্লাস্ট রোগের কারণে হাওরসহ সারা দেশের নিচু অঞ্চলে বোরো ধানের ক্ষতি হয় প্রচুর। কৃষিশ্রমিকের মজুরি বেড়ে যায় অস্বাভাবিকভাবে। গত বছর বোরো ধান কাটার মৌসুমে যেখানে একজন কৃষিশ্রমিকের মজুরি ছিল ৮০০ টাকা, এ বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা। এর ফলে বোরো ধান চাষ অলাভজনক হয়ে পড়েছে। একজন বোরো ধানচাষি কান ধরে বলেছেন, তিনি আর কোনো দিন বোরো ধান চাষ করবেন না। কারণ, বোরো ধান চাষে এবার তার বিঘাতে লোকসান হয়েছে ২ হাজার টাকা।
বিশ্বব্যাংক গত প্রায় চার দশকে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, ১৯৭৬ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে বাংলাদেশ আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সে সময় সারা দেশে তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি থেকে শূন্য দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু দেশের জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক ৮ থেকে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিকে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ১ থেকে ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা বৈশি^ক গড় তাপমাত্রার তুলনায় অনেক বেশি। বিজ্ঞানীদের মতে, ১৯৭৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে গড় তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৫ থেকে শূন্য দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়ে বাংলাদেশ আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০০০ সাল থেকে আবহাওয়া-সংক্রান্ত দুর্যোগের পরিমাণ প্রায় ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। গত ২০ বছরে ঘূর্ণিঝড়ে বিশ্বব্যাপী যত মৃত্যু ঘটেছে, তার ৬০ শতাংশ ছিল বাংলাদেশে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মানুষের ওপর যে শারীরিক ও মানসিক চাপ তৈরি হয়, তাতে কর্মক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী অতিরিক্ত গরমের কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে জনপ্রতি আনুমানিক ১৪৮ কর্মঘণ্টার বিনষ্ট হয়েছে, যা দেশের ১ হাজার ৮২০ কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট করেছে। অতিরিক্ত গরমের কারণে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে নষ্ট হয়েছিল ১ হাজার ৩৩০ কোটি শ্রমঘণ্টা।
এ ছাড়া বায়ুদূষণে শ্বাসতন্ত্রীয় রোগ বাড়ছে এবং উচ্চশব্দের কারণে শ্রবণক্ষমতা কমছে বলে জানান বিএসএমএমইউর নাক-কান-গলা বিভাগের বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা শরীরে ঢুকে কিডনি, ফুসফুসের মতো অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। হাসপাতালের আশপাশে শব্দ সংবেদনশীল পরিবেশের কথা থাকলেও তা নেই। শব্দদূষণের কারণে রোগী সুস্থ হতে দীর্ঘ সময় লাগে। রোগীকে ঘুম পাড়াতে ঘুমের ওষুধ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বিশ্বের ধনী দেশগুলোর অবহেলা-অনীহার বিরুদ্ধে যে ছাত্রীটির প্রতিবাদ পৃথিবীতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে, মানুষের মুখে মুখে ভালোবাসার বর্ণমালায় উচ্চারিত হয় যার নাম, তিনি হলেন সুইডেনের গ্রেটা থুনবার্গ। তিনি সুইডেনের একজন স্কুলশিক্ষার্থী। তিনি মাত্র ১৫ বছর বয়সে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সুইডেন সংসদের বাইরে প্রতিবাদ শুরু করেন। তখন থেকে তিনি জলবায়ু কর্মী হিসেবে পরিচিত। ২০১৮ সালে তিনি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় স্কুল অবরোধের ডাক দেন। একই বছর ডিসেম্বরে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের পর এ আন্দোলন আরও বেগবান করেন। ২০১৮ সালের আগস্টে তিনি ব্যক্তিগতভাবে এ প্রতিবাদ শুরু করেন। বিষয়টি ওই সময় মিডিয়ায় প্রচুর সাড়া ফেলে। ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ ১১২টি দেশের আনুমানিক ১৪ বিলিয়ন শিক্ষার্থী তার ডাকে সাড়া দিয়ে জলবায়ু প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। থুনবার্গ তার এ কার্যক্রমের জন্য অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। ২০১৯ সালের মার্চে নরওয়ের তিনজন সংসদ সদস্য তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার জন্য মনোনীত করেন।
মানবজাতির অস্তিত্বের স্বার্থে সুন্দর এই পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখতে হবে। পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে মানুষকে তার পরিবেশবিধ্বংসী কর্মকা-, আচার অনুষ্ঠান প্রভৃতি বিষয়ে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবর্তনগুলোর মধ্যে রয়েছে ১. কল-কারখানা ও যানবাহনে জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার কমিয়ে জৈব জ্বালানির ব্যবহার করতে হবে। ২. কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে সৌরবিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ, পারমাণবিক বিদ্যুৎ ব্যবহারের দিকে নজর দিতে হবে। ৩. মোটর গাড়ি ও কৃষি যন্ত্রপাতি জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমে না চালিয়ে বিকল্প পন্থায় চালানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ৪. নিজের জমি/বসতবাড়িতে লাগানো গাছপালা কাটতে হলেও বনবিভাগের অনুমতি দিতে হবে। ৫. পরিকল্পিত, পরিবেশবান্ধব নগর ও শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হবে। শিল্প-কারখানা যেখানে-সেখানে স্থাপন না করে নির্দিষ্ট শিল্পপার্ক বা অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থাপন করতে হবে এবং তরলশিল্প বর্জ্য পরিশোধনের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ করতে হবে। ৬. নিজের বাড়িঘর ও অফিস-আদালতের কঠিন বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। ৭. প্রতিটি বহুতলের ভবনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা পুনরায় ব্যবহার করতে হবে। ৮. নগর সবুজায়নের অংশ হিসেবে বসতবাড়ির জমির কমপক্ষে শতকরা ২০ ভাগে সবুজ বৃক্ষ রোপণের জন্য জায়গা রাখতে হবে। ৯. নদী ভরাট, দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জাতীয় নদী কমিশনকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিতে হবে। ১০. বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস ব্যবহারে প্রতিটি নাগরিককে মৃতব্যয়ী হতে হবে। ১১. নদী দখলকারীদের স্থানীয় সরকার ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে। ১২. বহুতল ভবনে ছাদবাগান তৈরি বাধ্যতামূলক করতে হবে। ১৩. মাটির ওপরের স্তরের উর্বর অংশ কেটে ইট তৈরির মতো পরিবেশবিধ্বংসী কাজ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। ১৪. বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। ১৫. প্রতিটি নগর ও তার আশপাশে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরীয় কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ১৬. গ্রেটা থুনবার্গের পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনকে সাড়া পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং এটিকে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে।
লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন
ছোটবেলায় কোরবানির মাংস বিতরণ করাটা দারুণ উপভোগ্য একটা ব্যাপার। আর সবার মতো সেই আগ্রহটা আমারও ছিল। একবার কোরবানির মাংস বিতরণ করতে গিয়ে দেখি নিচে অনেক ভিড়। আমার এক বড় ভাই সেই ভিড়ে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। কাজটা সহজ হচ্ছে না, সবাই সামনে আসতে চায়, অভিজ্ঞতা থেকে ওরা জানে পেছনে পড়লে শেষ পর্যন্ত মাংস না-ও মিলতে পারে। অনেক চেষ্টায় একসময় তাদের একটা লাইনে আনাও গেল। নিয়ম করা হলো, লাইনের সামনে থেকে একেকজন করে মাংস নিয়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে যাবে। সবাই শর্ত মেনে নিয়ে লাইনে দাঁড়াচ্ছে, পেছনে দাঁড়ানো একজনকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার ক্লাসমেট রফিক। চোখে চোখ পড়তেই মাথা নিচু করে ফেলল। ওর এই মাথা নিচু করাটা চোখে পড়ল সঙ্গে থাকা বড় ভাইয়ের। তিনি ইঙ্গিতে ঘটনাটা জানতে চাইলেন সম্ভবত। রফিক কী যেন বলল আর শুনে বড় ভাইয়ের চেহারায় হাসি।
একটু কান পেতে শুনলাম তিনি বলছেন, ‘ভালোই তো হলো। তোকে বেশি করে দেবে।’
রফিক শুনে আরও মিইয়ে যায়। মাথা আরও নিচু।
আমার বিস্ময় তখনো কাটছে না। রফিক স্কুলে মাঝেমধ্যে খালি পায়ে আসে। ওরা দরিদ্র জানতাম, তাই বলে কোরবানির দিনে মাংস জোগাড়ের লাইনে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা যে জানতাম না।
আস্তে আস্তে লাইন এগোল। রফিক সামনে এসে দাঁড়ায়। ভাই হাসিমুখে বলল, ‘একটু বেশি করে দিও। তোমার বন্ধু!’
রফিক অবাক হয়ে তাকায়। মাংস-ভিক্ষুক জেনেও আমি বন্ধুত্বটা স্বীকার করি কি না বুঝতে চায় যেন।
আমি মাংস দিলাম। বাড়িয়েই দিলাম। বড় ভাইয়ের মুখের হাসি আরও বিস্তৃত। আর রফিক কেঁদে দিল। আমার উচিত ছিল ওকে সান্ত¡না দেওয়া কিন্তু ওই বয়সে অন্যের কষ্ট ঠিক আন্দাজ করা যায় না। তা ছাড়া রফিকের এই অবস্থান জেনে আমার মধ্যেও একটা দ্বিধা তৈরি হয়েছিল বোধহয়।
রফিক কান্নাভেজা গলায় বলল, ‘একটা অনুরোধ। ক্লাসের কাউকে এটা বলো না। তোমার বাসা জানলে আমি ঢুকতাম না।’
কথাটা রাখিনি। তখন অল্প বয়স। বন্ধুদের কাছে কোনো গল্প চেপে যেতে গেলে পেটে ব্যথা হয়।
বহু বছর পেরিয়ে গেছে। রফিক কোথায় কে জানে। কিন্তু কোরবানির দিনে মাংস বিতরণের সময় এলেই রফিক উঠে আসে স্মৃতির দেয়াল ভেঙে। ওর করুণ অনুরোধটা কানে বাজে, ‘ক্লাসের কাউকে বলো না। ওরা শুনলে আর আমার সঙ্গে মিশবে না।’ একটা অপরাধবোধ মনকে বিষণ্ন মনে করে দেয়।
গল্পটা আগেও বলে থাকতে পারি। তবু কোরবানি-সংক্রান্ত যেকোনো লেখায় সুযোগ পেলেই বলি। অপরাধবোধ কমানোর জন্য! হতে পারে। তবে এর চেয়েও বেশি করে এজন্য যেন আমাদের অসতর্কতায় কারও মনে কষ্ট না লাগে। যেন ধুলো না লাগে কোরবানির ত্যাগের মহিমায়।
মন কি একটু খারাপ হয়ে গেল! তাহলে এবার কোরবানি নিয়ে একটা আনন্দের গল্প বলি। এক প্রবীণ মানুষ কোরবানির বাজারে যেতেন খুব আগ্রহ করে। নিজের শুধু নয়, অন্যের গরু কেনাতেও তার তুমুল উৎসাহ। এই দক্ষতার কারণে তার বেশ চাহিদা ছিল, লোকজন সঠিক গরু কেনার জন্য চা-পান খাইয়ে সঙ্গে নিয়ে যেত তাকে।
বাজারে গিয়ে গরু দেখে তিনি বলতেন, ‘না, এটা হবে না। দেখতে ভালো না।’
গরুকে ঠিক কী রকম হলে দেখতে ভালো বলা যায়, এটা বেশির ভাগই বুঝতে পারত না। তাকে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘চোখ থাকতে হয়। চোখ।’ তিনি আরও চলেন। আরও ঘোরেন।
একজন বিরক্ত হয়ে বলল, ‘সেই তো দুদিন পর জবাই করে ফেলবেন, তার জন্য সুন্দর হওয়ার দরকার কী?’
তিনি জিভ কেটে বললেন, ‘ওরে অর্বাচীন, যা বোঝো না, তা নিয়ে কথা বলো না। সুন্দর গরু দেখো।’
শেষ পর্যন্ত তার বিবেচনায় সুন্দর একটা গরু কিনে আনা হলো। এবার শুরু হলো অন্য কা-। তিনি গরুর গায়ে হাত বোলান। আদর করে দেন। খাবারের প্রতি বিশেষ যতœ নেন।
প্রশ্ন করলে উত্তর হলো, ‘আরে কোরবানি মানে ত্যাগ। ত্যাগের আগে সৃষ্টি করতে হয় মায়া। গরুর সঙ্গে পেয়ার হতে হবে।’
তিনি পেয়ার তৈরির জন্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখলেন না। গরুর চেহারার মধ্যেও কেমন যেন পেয়ারের ভঙ্গি। সব ঠিক ছিল। গোলমাল হলো ঈদের আগের রাতে। গরুটা হাওয়া। এত পেয়ারের বিনিময়ে এই ধোঁকায় ভদ্রলোক বাকরুদ্ধ।
শুরু হলো খোঁজাখুঁজি। গরু খোঁজা বলতে একটা কথা আছে। সবাই বইটই পড়ে জানে। আমরা সেদিন নিজের চোখে ব্যাপারটা দেখেছিলাম।
লোকজন খুঁজছে। আমরা বসলাম তাকে সান্ত¡না দিতে। বললাম, ‘আপনার সঙ্গে পেয়ার হয়েছে। গরু আপনার ফিরে আসবেই।’
তিনি বললেন, ‘ফিরে যদি আসে, তাহলে বুঝতে হবে সেটা আমার সততার জোরে। সৎ পয়সায় কেনা জিনিস।’
সততার শক্তি না পেয়ার কোনটার জোরে জানি না, তবে গরুটা পাওয়া গিয়েছিল। তুমুল উৎসাহে কোরবানি হলো। চাচা উপস্থিত থেকে কাটাকাটিতে শরিক হলেন। মাথাটা থেকে মগজ বের করার কৌশল কসাইকে দেখিয়ে দিলেন। সেই মগজ ভাজা দিয়ে দুপুরের খাবার খেলেন মহানন্দে।
আমার এক চাচা ছিলেন, যিনি কোরবানির পুরো প্রক্রিয়া খুব উপভোগ করতেন। সারা বছর বাজারে যাওয়ার নাম নেই কিন্তু কোরবানির মাস দেড় মাস আগে থেকেই উত্তেজনা শুরু। কী সাইজের গরু হলে ভালো হয়? রং কেমন হওয়া উচিত? গবেষণায় আমরাও গরুর প্রকারভেদ-গুণাগুণ জেনে যেতাম। যাই হোক, অক্লান্তে গরু কাটাকাটি শেষ করে বিতরণের নেতৃত্বেও তিনি। সবাই জানে, এই ক্ষেত্রে একা সামাল দেওয়া মুশকিল। কিন্তু অভিজ্ঞতা এবং আত্মবিশ্বাস বেশি ছিল বলে নিজেই সব করতেন। একবার মাংস বিতরণের সময় খেয়াল করলেন লাইনটা কোনোভাবেই শেষ হচ্ছে না। একটু দেখেই বুঝলেন যারা নিচ্ছে তারা আবার পেছন থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি এই অনিয়মে গর্জে উঠে বললেন, ‘তোমাদের আর মাংস দেওয়া হবে না। তোমরা আমার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছো।’
বলেই মাংসের বালতি নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলেন। অনেকে অনিয়ম করেছে বটে কিন্তু সবাই তো আর করেনি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মাংস পাবে না জেনে অনুনয়-বিনয় শুরু করল। চাচা খুব কঠোর। ‘নো। তোমাদের আর দেওয়া হবে না’ ঘোষণা করে তিনি বেরিয়ে যাচ্ছেন এ সময় পেছন থেকে কেউ একজন একটা মাংসের দলা ছুড়ে মারল তার দিকে। বঞ্চিতদের পক্ষে দারুণ প্রতিবাদ। আর সাহস করে ওদের কেউ প্রতিবাদ শুরু করলে সবাই তাতে অংশ নিতে চায়। কম-বেশি প্রত্যেকের ব্যাগেই কিছু মাংস আছে, এর থেকে দু-এক টুকরো ঢিল হিসেবে ব্যয় করলে এমন কিছু ক্ষতি হয় না, অতএব শুরু হয় ঢিলের ঝড়। চাচা শুরুতে প্রতিবাদ করেছিলেন। ‘এত বড় সাহস’ ‘কে মারলি’ ‘সামনে আয়’ এসব আওয়াজ করছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আর আওয়াজ থাকল না। মিলিত আক্রমণে নেতিয়ে গেলেন। আমরা দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম বোধহয় কোনো সন্ত্রাসী ছুরি-টুরি মেরে গেছে। আসল ঘটনা জেনে খুব কষ্ট পেলাম কিন্তু হাসলামও। যাক, এবার থেকে চাচার কোরবানি নিয়ে বাড়াবাড়ি শেষ হবে। হয়েছিল। এরপর এই জীবনে কোরবানি নিয়ে আর কথা বলেননি।
এর মানে কোরবানি নিয়ে দুটো জিনিস করা যাবে না। প্রথমটা অহংকার। দ্বিতীয়টা হলো বাড়াবাড়ি। শিক্ষাটা ত্যাগের। সেটা কোনোভাবে যেন ভোগের না হয়।
কিন্তু হয়ে যায়। ফ্রিজের বিক্রি বাড়ে। ফ্রিজ কোম্পানি বড় বড় বিজ্ঞাপন দেয়। এটা যে কী বিশ্রী ধরনের লজ্জার বিষয় সেই বোধটা হারিয়ে গেছে জেনে বিপন্ন বোধ করি। আর বিষণœ বোধ করি তাদের কথা ভেবে, এই দিনটাতে যারা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দু-এক টুকরা মাংসের জন্য ছোটাছুটি করে। দিনটা হওয়ার কথা তাদের। আমরা অনেকেই বানিয়ে নিয়েছি ফ্রিজের। হওয়ার কথা ত্যাগ। হয়ে যায় ভোগ। হওয়া উচিত ভাগ। হয় যোগ।
লেখক সাংবাদিক ও লেখক
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষে থাকা আর্সেনালের সঙ্গে পয়েন্ট ব্যবধান কমিয়ে আনার সুযোগ ছিল ম্যানচেস্টার সিটির। আজ বড় সেই সুযোগটা তারা হাতছাড়া করেছে। হ্যারি কেইনের রেকর্ড গড়া গোলে টটেনহামের বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরে গেছে পেপ গার্দিওলার শিষ্যরা।
বল দখলে সিটি শুরু থেকে একচেটিয়া আধিপত্য দেখিয়ে আসছিল। তবে ম্যাচের ১৫ মিনিটে সিটির রক্ষণের ভুলে বল পেয়ে টটেনহামকে এগিয়ে দেন কেইন। সিটির ডিফেন্ডার মানুয়েল আকনজির দুর্বল পাসে বল পেয়ে বক্সে ঢুকে পিয়া-এমিল হয়বিয়া বাড়ান কেইনকে। প্রথম স্পর্শে ডান পায়ের শটে গোলটি করেন ইংলিশ ফরোয়ার্ড।
এই গোলে তিনি টটেনহামের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলের মালিক হয়ে গেছেন। ২৬৭ গোল করে তিনি পেছনে ফেলেছেন টটেনহাম কিংবদন্তি জিমি গ্রিভসকে। ১৯৭০ সাল থেকে এই রেকর্ড নিজের করে রেখেছিলেন গ্রিভস।
ছন্দে থাকা সিটির তরুণ ফরোয়ার্ড আর্লিং হলান্ড এ দিন পুরোটা সময় নিজের ছায়া হয়ে ছিলেন। তার দিনটা আজ ভালো কাটেনি। গোল করার তেমন কোনো সুযোগই পাননি সিটির এই নরওয়েজিয়ান স্ট্রাইকার।
এই হারে যদিও লিগ টেবিলে সিটির অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে আজ জিতে গেলে আর্সেনালের সঙ্গে পয়েন্টের ব্যবধানটা কমিয়ে আনতে পারত তারা। ২১ ম্যাচ খেলে ম্যানচেস্টার সিটির পয়েন্ট ৪৫। একটি ম্যাচ কম খেলে আর্সেনালের পয়েন্ট ৫০। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে ম্যানচেস্টার সিটির মুখোমুখি হবে আর্সেনাল। ২২ ম্যাচে ৩৯ পয়েন্ট নিয়ে টটেনহামের অবস্থান পঞ্চম। তৃতীয় স্থানে আছে নিউক্যাসল ইউনাইটেড (৪০ পয়েন্ট)।
অপেক্ষার অবসান হলো। হ্যারি কেইনের হাত ধরে যেন জিমি গ্রিভস সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্যের পতন হলো। ৫৩ বছর ধরে যে রেকর্ড তিনি দখল করে রেখেছিলেন। সেটাই আজ ভাঙলেন হ্যারি কেইন। প্রিমিয়ার লিগের ইংলিশ ক্লাব টটেনহামের সর্বোচ্চ গোলের মালিক এখন হ্যারি।
রাতে ম্যানচেস্টার সিটিকে ১-০ গোলে হারিয়েছে টটেনহাম। জয়সূচক একমাত্র গোলটি করেছেন ইংলিশ অধিনায়ক কেইন। ম্যাচের ১৫ মিনিটে সিটির ডিফেন্ডার মানুয়েল আকনজির দুর্বল পাসে বল পেয়ে বক্সে ঢুকে পিয়া-এমিল হয়বিয়া বাড়ান কেইনকে। প্রথম স্পর্শে ডান পায়ের শটে গোলটি করেন ইংলিশ ফরোয়ার্ড।
আর এই গোলে তিনি টটেনহামের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলের মালিক হয়ে গেছেন। ২৬৭ গোল করে তিনি পেছনে ফেলেছেন টটেনহাম কিংবদন্তি জিমি গ্রিভসকে। ১৯৭০ সাল থেকে এই রেকর্ড নিজের করে রেখেছিলেন গ্রিভস।
লন্ডনের ক্লাব টটেনহাম হটস্পার দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে কোনো শিরোপা জেতে না। তবুও ইংলিশ লিগে তারাই সেরা দল। দলটির অন্যতম ভরসার নাম হ্যারি কেইন। ইংলিশ এই স্ট্রাইকার ২০০৯ সালে যোগ দেওয়া ক্লাবটির হয়ে গড়ে চলেছেন একের পর এক রেকর্ড।
গত বছরের আগস্টে সার্জিও আগুয়েরোকে টপকে প্রিমিয়ার লিগে এক ক্লাবের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের কীর্তি গড়েন কেইন। গত ২৩ জানুয়ারি তিনি স্পর্শ করেছিলেন জিমি গ্রিভসকে। আজ ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে গোল করে তাকে ছাঁড়িয়ে যান তিনি। ভেঙে ফেলেন পাঁচ দশকের রেকর্ড।
রেকর্ডগড়া গোলে ম্যানসিটির বিপক্ষে টটেনহামকে জিতিয়ে ক্লাবটির ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা বনে যান কেইন। তিনি ছাড়িয়ে যান জিমি গ্রিভসকে। কেইনের বর্তমান গোল সংখ্যা ২৬৭। সঙ্গে লন্ডন ডার্বিতে সবচেয়ে বেশি গোলের (৪৮) রেকর্ডও তার দখলে।
এই ম্যাচে প্রিমিয়ার লিগে ৩০০ ম্যাচ খেলার রেকর্ডও ছুঁয়ে ফেলেছেন তিনি। সিটির বিপক্ষে গোল করে এই লিগে তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে ২০০ গোল করার মাইলফলক স্পর্শ করেছেন কেইন। তার ওপরে আছেন শুধু অ্যালান শিয়ারার (২৬০) ও ওয়েন রুনি (২০৮)।
টটেনহাম ইতিহাসের শীর্ষ ৭ গোলদাতা
খেলোয়াড় |
গোল |
সময়কাল |
হ্যারি কেইন |
২৬৭ |
২০০৯-বর্তমান |
জিমি গ্রিভস |
২৬৬ |
১৯৬১-১৯৭০ |
ববি স্মিথ |
২০৮ |
১৯৫৫-১৯৬৪ |
মার্টিন গিভারস |
১৭৪ |
১৯৬৮-১৯৭৬ |
ক্লিফ জোন্স |
১৫৪ |
১৯৫৮-১৯৬৮ |
জারমেইন ডিফো |
১৪৩ |
২০০৩-২০০৮ |
সন হিউং-মিন |
১৩৯ |
২০১৫-বর্তমান |
শ্রম পরিদর্শক পদে যোগ দেওয়ার ৩৪ বছর পর পদোন্নতি পেলেন মাহমুদুল হক। স্বপ্ন দেখতেন পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে একসময় প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে যাবেন। সেই স্বপ্ন আট বছরেই লুটিয়ে পড়ল জ্যেষ্ঠতার তালিকায়।
১৯৮৮ সালে যোগ দেওয়ায় ’৯৫ সালেই পদোন্নতি পাওয়ার কথা ছিল মাহমুদুল হকের। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অদূরদর্শিতা সে স্বপ্ন শুরুতেই বাধা পেল। এন্ট্রি পোস্টে যোগ দেওয়ার পর তার মতো অন্য কর্মচারীরা যখন পদোন্নতির স্বপ্নে বিভোর, তখন তাতে গা-ই করলেন না সেই সময়ের প্রতিষ্ঠানপ্রধান।
মাহমুদুল অপেক্ষায় রইলেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য। সেই পরিবর্তন আসতে আসতে চাকরিতে কেটে গেল আঠারো বছর। আঠারোতে মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হয়। তিনিও ভাবলেন আঠারোতে তিনি না হয় ‘জব ম্যাচিউরিটি’তে পৌঁছালেন। চাকরির আঠারো বছরে পদোন্নতি পেলেও মন্দ হয় না।
কিন্তু অবাক ব্যাপার, কর্তৃপক্ষ পদোন্নতি দিল, তবে মাহমুদুলকে ছাড়া। পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনে কোথাও তার নাম নেই। হতাশায় মুষড়ে পড়লেন তিনি। জুনিয়র কর্মকর্তারদের নাম আছে, অথচ তার নাম নেই। প্রতিষ্ঠানের নীতি-নির্ধারকদের দরজায় দরজায় ঘুরলেন ন্যায়বিচারের আশায়। কিন্তু তারা পাত্তাই দিলেন না বিষয়টি।
তারা আমলে না নিলেও মাহমুদুলের স্বপ্ন তো সেখানেই থেমে যাওয়ার নয়। সেই স্বপ্ন পুঁজি করে তিনি গেলেন আদালতে। সেই ভিন্ন জগৎটাও কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তার পক্ষে রায় দিল। মাহমুদুল আনন্দে আত্মহারা হলেন। কিন্তু সেই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। সরকার আপিল করল প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলার ফল উল্টে গেল। হতাশায় ভেঙে না পড়ে তিনি গেলেন উচ্চ আদালতে। আপিল বিভাগে সিভিল আপিল মামলা করলে প্রশাসনিক আপিল আদালতের রায় বাতিল হয়। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল থাকে।
জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করার মতো মাহমুদুল হকও যেন সরকারের সঙ্গে লড়াই করতে নামলেন। আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন করল সরকারপক্ষ। একপর্যায়ে সরকার বুঝতে পারল কোনোভাবেই তারা এ মামলায় জিততে পারবে না। সরকারপক্ষে রিভিউ পিটিশন প্রত্যাহার করা হলো। আদালত সরকারের পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনকে আইনের কর্তৃত্ববহির্ভূত বলে ঘোষণা করল। জুনিয়র কর্মকর্তাকে যেদিন থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে এবং যতবার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, একইভাবে মাহমুদুল হককে পদোন্নতি দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। বকেয়া বেতন-ভাতাসহ সব পাওনা কড়ায়-গ-ায় পরিশোধের নির্দেশনা আসে।
আদালতের এই নির্দেশনা দেওয়া হয় ২০১৮ সালে। এরপর আদেশ বাস্তবায়ন করতে সরকারের লেগে যায় প্রায় চার বছর। ২০২২ সালের ১১ মে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ৩৪ বছর পর পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মাহমুদুল হক। আবারও তাকে ঠকিয়েছে সরকার। জুনিয়র কর্মকর্তা যুগ্ম মহাপরিদর্শক হলেও তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয় তার দুই ধাপ নিচের সহকারী মহাপরিদর্শক পদে। উপমহাপরিদর্শক ও যুগ্ম মহাপরিদর্শক আরও ওপরের পদ। আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
কখনোই প্রজ্ঞাপন মাহমুদুল হকের জন্য ভালো বার্তা বয়ে আনেনি। পুরো চাকরিজীবন আদালতের বারান্দায় ঘুরে তিনি পৌঁছেছেন অবসরের প্রান্তসীমায়। আর তিন মাস পরে তিনি অবসরে যাবেন। যৌবন ও মধ্য বয়সের দিনগুলোতে আদালতে ঘুরে বেড়ানোর শক্তি ও সাহস থাকলেও মাহমুদুল হক এখন সেই সাহস দেখাতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করছেন। পারবেন তো শেষ সময়ে এসে সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে?
মাহমুদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, তিনি আদালতের কাছেই জানতে চাইবেন, আদালতের বিচার না মানার শাস্তি কী।
পুরো ঘটনা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা শুনিয়ে জানতে চাইলেন, কতজনের পক্ষে মাহমুদুল হকের মতো লড়াকু মনোভাব দেখানো সম্ভব?
সীমাহীন আনন্দ নিয়ে মানুষ সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়। এরপরই তার মধ্যে যে স্বপ্নটি দানা বাঁধে তা হচ্ছে পদোন্নতি। কার কীভাবে পদোন্নতি হবে তা আইনকানুন, নিয়ম-নীতি দিয়ে পোক্ত করা। পুরো বিষয়টি কাচের মতো স্বচ্ছ। এরপরও পদোন্নতি হয় না। দিন, মাস, বছর পার হয়ে যায়, কাক্সিক্ষত পদোন্নতির দেখা মেলে না।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ক্যাডারে নিয়মিত পদোন্নতি হয়। বাকি ক্যাডারে হতাশা। তার চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি নন-ক্যাডারে। ক্যাডার কর্মকর্তারা নিজের পদোন্নতির ষোলো আনা বুঝে নিয়ে ঠেকিয়ে দেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি। সংখ্যায় বেশি হওয়ায় নন-ক্যাডাররা একজন আরেকজনকে নানা ইস্যুতে আটকাতে গিয়ে পুরো প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেন। সরকারের মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কর্মচারী। সেই হিসেবে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনবলের পদোন্নতি হয় না। পে-কমিশন হলেই কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য করুণা উথলে ওঠে। এমনকি ব্লকপোস্টে যারা আছেন, তাদের জন্যও পদোন্নতির বিকল্প সুবিধা বাতলে দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কর্মচারীদের পদোন্নতি উপেক্ষিতই থাকে।
যখন সময়মতো পদোন্নতি হয় না, তখন নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে থাকে। এসব সমস্যা সংশ্লিষ্ট দপ্তর-অধিদপ্তরের চৌহদ্দি পেরিয়ে আমজনতাকেও প্রভাবিত করে। নন-ক্যাডার কর্মকর্তা আর সঙ্গে কর্মচারীরা যখন বুঝতে পারেন পদোন্নতির আশা তাদের নেই, তখন তারা দুহাতে টাকা কামানোর ধান্দায় মেতে ওঠেন। এতে করে ঘুষের সংস্কৃতি সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। অকার্যকর পথে হাঁটে রাষ্ট্র। সাধারণ মানুষ টাকা ছাড়া তাদের কাছ থেকে কোনো সেবা পায় না, ব্যবসায়ীরা নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে ব্যবসায় আসেন না, ব্যবসাবান্ধব পরিস্থিতি না থাকায় মুখ ফিরিয়ে নেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। প্রধানমন্ত্রীর বারবার আহ্বানেও বিনিয়োগকারীরা সাড়া দেন না। সাধারণ মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে সেবা দেওয়ার বাণীতেও উদ্বুদ্ধ হন না সংশ্লিষ্টরা।
এই পরিস্থিতিতে অনিয়ম আটকে রাখার সব কৌশলই ব্যর্থ হচ্ছে। যথাযথ তদারকি না থাকায় বিভাগীয় ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে। ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫০টি অডিট আপত্তি ঝুলে থাকায় অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোও আগ্রহ হারিয়ে নিজেরাই জড়িয়ে পড়ছে অনিয়মে। দন্তহীন বাঘে পরিণত হওয়ার তথ্য সাংবাদিকদের জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান নিজেই।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদোন্নতির বড় একটা অংশ আটকে রাখে মন্ত্রণালয়গুলো। এই আটকে রাখার কারণ হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের স্বার্থ। বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তরে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিলে নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতিপ্রাপ্তদের ওপরের পদে বসাতে হবে। এতে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের এককালীন লাভ; অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে একবার পদোন্নতি দেওয়া যাবে। কিন্তু পদোন্নতি না দিয়ে সংশ্লিষ্টদের চলতি দায়িত্ব দিলে বছরজুড়ে টাকা আয় করতে পারেন নীতিনির্ধারকরা। দপ্তর, অধিদপ্তরে বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। চলতি দায়িত্বপ্রাপ্তদের আয় অনুসারে নীতিনির্ধারকদের মাসোহারা দিতে হয়। নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া হলে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের নিয়মিত আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে আইন বা বিধি-বিধানের ফাঁকফোকর গলিয়ে নন-ক্যাডার এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি আটকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়।
সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদের সভাপতি নিজামুল ইসলাম ভূঁইয়া মিলন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সচিবালয় এবং সারা দেশের সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতির মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। নন-ক্যাডারের কিছু বিষয় ছাড়া সচিবালয়ের কর্মচারীরা সময়মতো পদোন্নতি পায়। কিন্তু সচিবালয়ের বাইরে পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। সচিবালয়ে মাত্র ১০ হাজার কর্মচারী আছেন। সচিবালয়ের বাইরে আছেন ১০ লাখের বেশি। এসব কর্মচারীর পদোন্নতি নিয়ে বহু বছর ধরে চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনো ফল পাইনি। সর্বশেষ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সমস্যা নিয়ে কাজ করার জন্য একটি কমিটি করে দিয়েছে। কমিটি কিছু সুপারিশ করেছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। এরপর এর কোনো অগ্রগতি নেই। যেখানে সরকারপ্রধান বলেন, চাকরিজীবনে সবাই যেন কমপক্ষে একটি পদোন্নতি পায়। সেখানে বহু কর্মচারী কোনো পদোন্নতি ছাড়াই অবসরে যাচ্ছেন। সরকারপ্রধানের নির্দেশনা উপেক্ষা করেন আমলারা। তাদের আগ্রহ কেনা-কাটায়, বিদেশ ভ্রমণে, নতুন জনবল নিয়োগে। এসব করলে তাদের লাভ। কর্মচারী পদোন্নতি দিতে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এর নিশ্চয়ই একটা শেষ আছে। বৈষম্যের পরিণতি কী হয়, তা অনেক দাম দিয়ে বিডিআর বিদ্রোহে আমরা দেখেছি।’
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি ঝুলছে বছরের পর বছর। এই অধিদপ্তরের কয়েক শ কর্মকর্তা পাঁচ বছর আগেই পদোন্নতির যোগ্য হয়েছেন। নানা কায়দা-কানুন করে তাদের পদোন্নতি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সংশ্লিষ্টদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করে তাদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া এগিয়ে নিলেও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নতুন করে জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার নামে সময়ক্ষেপণ করছে। জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার পর এখন তাদের পারিবারিক সদস্যদের তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই সংস্থা নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদেরও তথ্য তালাশ করছে। তাদের আত্মীয়দের মধ্যে কে কোন দলের সমর্থক তার তথ্য নিচ্ছেন সংস্থার কর্মকর্তারা।
গত মাসে শেষ হওয়া জেলা প্রশাসক সম্মেলনে দায়িত্ব পালন করছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সুরম্য ভবনে দায়িত্ব পালন করলেও ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তার মনের অবস্থাটা মনোহর ছিল না। কেমন আছেন জানতে চাইলে ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তা বলেন, ‘ভালো নেই। চাকরি করছি, পদোন্নতি নেই। ২০১৫ সালের আগে পদোন্নতি না পেলেও টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড ছিল। তাও তুলে দেওয়া হয়েছে। তুলে দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল সময়মতো পদোন্নতি হবে, ব্লকপোস্টধারীদের দেওয়া হবে বিশেষ আর্থিক সুবিধা। এসবের কোনোটাই হয়নি।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে একটি প্রশাসনিক আদেশ খুবই পরিচিত। সেই প্রশাসনিক আদেশ ১৬/২০১৮ অনুযায়ী ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগ হবে। আর ৩০ ভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগের ফলে বিমানে বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় কর্মকর্তা বেশি। নীতিনির্ধারকদের নতুন জনবল নিয়োগে আগ্রহ বেশি। পুরনোদের পদোন্নতি দিয়ে ওপরের পদ পূরণের চেয়ে তারা নতুন নিয়োগে যান। ফলে কারও চাকরিজীবনে একবারও পদোন্নতি হয় না। নামমাত্র যে পদোন্নতি হয় তা অনিয়মে ভরপুর।
নন-ক্যাডার ছাড়াও ১৩তম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। প্রতিটি দপ্তরে এসব গ্রেডের পদোন্নতি আটকে আছে। অথচ এসব গ্রেডেই বেশি লোক চাকরি করছেন। সরকারের মোট জনবল প্রায় ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ২৩ শতাংশ পদের মধ্যেও নন-ক্যাডার রয়েছেন। এ ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৭৭ শতাংশ পদই ১৩তম থেকে তার পরের গ্রেডের। এতে করে সহজেই বোঝা যায় সরকারের জনবলের বড় অংশই পদোন্নতির চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। সরকারের জনবলের এই বিশাল অংশ যখন পদোন্নতি নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগেন, তখন তারা নানা অনিয়মে ঝুঁকে পড়েন।
বেশির ভাগ দপ্তর, অধিদপ্তর পরিচালনা করেন বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা তাদের প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে ক্যাডার কর্মকর্তাদের দপ্তর, অধিদপ্তরে পাঠান। প্রেষণে গিয়ে অনেক কর্মকর্তা শুধু রুটিন কাজটুকুই করতে চান। শূন্যপদে জনবল নিয়োগ বা পদোন্নতি রুটিন কাজ না হওয়ায় তা উপেক্ষিত থাকে। তা ছাড়া পদোন্নতি দিতে গিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়; বিশেষ করে মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রী বা সচিব তাদের পছন্দের লোককে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য সংস্থার প্রধানকে চাপ দেন। এই চাপ উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ না থাকায় অযোগ্য লোককে পদোন্নতি দিতে হয় সংস্থার প্রধানকে। এই জটিলতা থেকে দূরে থাকার জন্য সংশ্লিষ্টদের পদোন্নতি দেওয়া থেকেও দূরে থাকেন সংস্থার প্রধানরা।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের ১৪ গ্রেডের একজন কর্মচারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাইরের লোকের ইচ্ছাটাই জাগে না আমাদের পদোন্নতি দিতে। আমাদের দপ্তরপ্রধান মহাপরিচালক প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। অতিরিক্ত মহাপরিচালকও অনেক সময় প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রেষণে আসেন। তাদের কেন ইচ্ছা জাগবে আমাদের পদোন্নতি নিয়ে। যদি এসব পদে ফুড ক্যাডারের কর্মকর্তা থাকতেন, তাহলে তারা খাদ্য বিভাগের সমস্যা বুঝতেন। তা ছাড়া নিয়োগ বিধি সংশোধনের নামে আমরা দীর্ঘদিন একই পদে আটকে আছি।’
গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে এক আবেদনে জানান, ‘বর্তমানে সচিবালয়ে প্রায় দুই হাজারের বেশি প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা কর্মরত। এর বিপরীতে ক্যাডারবহির্ভূত সংরক্ষিত পদের সংখ্যা ২৬৭টি, যা খুবই নগণ্য। ফলে একই পদে ২০-২২ বছরের বেশি সময় কর্মরত থাকার পরও অনেকে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। পদোন্নতি না পাওয়ায় সৃষ্ট হতাশার ফলে কর্মস্পৃহা নষ্ট হচ্ছে।’
সরকার এ সমস্যা থেকে কীভাবে বের হতে পারে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এসব সমস্যা সমাধানে সরকার সব সময়ই কাজ করে। কিন্তু এ চেষ্টা জটিলতার তুলনায় কম। এ বিষয়ে আরও এফোর্ট দিতে হবে।
বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের উপনির্বাচনে বেসরকারিভাবে ১১২ কেন্দ্রের ফলাফলে ৯৫১ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন বহুল আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম। একতারা প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ১৯ হাজার ৪৮৬ ভোট। এ আসনে জয় পেয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ (ইনু) সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম তানসেন। মশাল প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ২০ হাজার ৪৩৭ ভোট।
বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে বগুড়ার দুইটিসহ মোট ৬ আসনে উপনির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হয়। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির এমপিরা পদত্যাগের ঘোষণা দিলে এ আসনগুলো শূন্য হয়।
তখন, বগুড়া-৬ (সদর) এবং বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন হিরো আলম। নির্বাচন কমিশন একদফা তার প্রার্থিতা বাতিল করলেও পরে আদালতে গিয়ে প্রার্থিতা ফিরে পান তিনি।
বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) ও বগুড়া-৬ (সদর) আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আশরাফুল হোসেন হিরো আলম বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) দুপুর পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘সদরের কেন্দ্র সব দখল হয়্যা গ্যাছে। ডিসি-এসপিক কয়্যাও কোনো কাম হচ্চে না। সদরের আশা সব শ্যাষ। কাহালু-নন্দীগামের অনেক কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে দেকছি। ভোট খুব সুষ্ঠু হচ্চে। মাঠের অবস্থা ভালো। কাহালু-নন্দীগ্রামে নিশ্চিত এমপি হচ্চি।’
এর আগে, সকালে সদর উপজেলার এরুলিয়া উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে যান তিনি। ভোট দেওয়ার পর হিরো আলম বলেন, ‘বগুড়া-৬ আসনে আগে থেকেই গোলযোগের আশঙ্কা করেছিলাম, সেটাই সত্যি হয়েছে। নির্বাচনি এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তবে বগুড়া-৪ আসনে ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে। এভাবে সুষ্ঠু ভোট হলে এই আসনে আমিই বিজয়ী হবো।’
এদিকে বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে কয়েকটি কেন্দ্রে নৌকা প্রার্থীর এজেন্ট বাদে অন্য এজেন্টদের ভোটকক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আজ সকালে হিরো আলমসহ তিনজন প্রার্থী এ অভিযোগ করেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাদের এজেন্টদের বের করে দিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করা হয়।
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫০ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা খরচের হিসাব ধরে বাজেট প্রস্তাব প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে সরকার। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৭২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা বেশি। অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে খরচের বেশিরভাগ অর্থ জোগাড়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১৯ শতাংশ বাড়ানো হবে। আসছে জুনের প্রথমভাগে জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আগামী বাজেট হবে জাতীয় নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ বাজেট। তাই এখানে নেওয়া কোনো পদক্ষেপে যেন আওয়ামী লীগ সরকার সমালোচনার মুখে না পড়ে এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্টদের থাকছে বিশেষ নজর। এ ছাড়া রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। তাই সংকট ও নির্বাচন দুটোই মাথায় রাখতে হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে মোটাদাগে একটি রূপরেখা পাঠানো হয়েছে। নতুন পরিকল্পনার পাশাপাশি গত তিন মেয়াদে সরকার কী কী উন্নয়ন করেছে আগামী বাজেট প্রস্তাবে তা মনে করিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং উচ্চপর্যায়ের সরকারি নীতিনির্ধারকদের উপস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো আগামী বাজেটের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আর গত সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি পাঠিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণে কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে হিসাব ধরে অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট প্রস্তাব প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে তা কয়েক দফা খতিয়ে দেখা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। তিনি প্রয়োজনীয় সংশোধন, যোগ-বিয়োগ করে আবারও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার আগেও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে থাকে।
ডলার সংকটে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছেন না সাধারণ ব্যবসায়ীরা। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় পণ্যের দাম বাড়ছে। কাঁচামাল সংকটে বিপাকে শিল্প খাত। ব্যাংক খাতে অস্থিরতা। নতুন চাকরির সুসংবাদ নেই বললেই চলে। দফায় দফায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। খুব শিগগিরই এসব সংকট কেটে যাবে বলে মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে ঋণদাতা সংস্থার কঠিন শর্তের বেড়াজালে আছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতেই আগামী অর্থবছরের বাজেট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশি^ক অস্থিরতা মোকাবিলায় সরকার কী কী পদক্ষেপ নেবে তা আগামী বাজেটে স্পষ্ট করা হবে। দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথাও বলা হবে। তবে শত সংকটের মধ্যেও আগামী বাজেটে ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী যতটা সুবিধা দেওয়া সম্ভব তা দিতে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে বাজেট প্রস্তুত কমিটির কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে কাঁচামাল আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দিতে হিসাব কষা হচ্ছে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডলার সংকটে আমদানি রপ্তানি প্রায় বন্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্যে সংকটকাল চলছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটে আমাদের দাবি অনুযায়ী নগদ সহায়তা দিতে হবে। রাজস্ব ছাড় দিতে হবে। কর অবকাশ ও কর অব্যাহতি বাড়াতে দিতে হবে।’
ঋণদাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া সংস্কারের শর্ত মানার অঙ্গীকার করে সরকার ঋণ পেয়েছে। শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে ঋণের যেকোনো কিস্তি আটকে দিতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। পর্যায়ক্রমে প্রতি অর্থবছরের বাজেটে এসব সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়ন করা হবে। আসছে বাজেটে শর্ত মানার চেষ্টা থাকবে। বিশেষভাবে অতীতের মতো ঢালাওভাবে কর অব্যাহতি দেওয়া হবে না। আর্থিক খাতের সংস্কারের কিছু ঘোষণা থাকবে। বিশেষভাবে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দেওয়া হবে। আইএমএফের সুপারিশে এরই মধ্যে ভ্যাট আইন চূড়ান্ত হয়েছে। আয়কর আইন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন হয়েছে। শুল্ক আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ে আছে। এ তিন আইন অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণ করা হবে। আসছে বাজেটে টেকসই অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার কথা বলা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগের কথা শোনানো হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঋণদাতা সংস্থার শর্ত মানার কথা বলা হলেও সব আগামী বাজেটে একবারে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে অর্থনীতির গতি কমে যাবে।’
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এনবিআর-বহির্ভূত খাত এবং এনবিআর খাতের জন্য মোট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৪ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৯ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হতে পারে। এতে লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা হবে। এনবিআর এ লক্ষ্যমাত্রা কমানোর জোরালো আবেদন করেছে। কিন্তু তা আমলে আনেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) হিসেবে, ৩৪ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা আয়কর হিসেবে এবং ৩১ শতাংশ বা বাকি ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা শুল্ক হিসেবে সংগ্রহ করার কথা বলা হতে পারে বলে জানা গেছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রার কথা শুধু বললেই হবে না। কীভাবে অর্জিত হবে, সেটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা না থাকলে প্রতিবারের মতো ঘাটতি থাকবে। রাজস্ব ঘাটতি হলে অর্থনীতিতে আয় ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়। তাই এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত।’
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআর উৎসে করের আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। সম্পদশালীদের ওপর নজর বাড়ানো হবে। শুধু বেশি সম্পদ থাকার কারণে অতিরিক্ত কর গুনতে হবে। সারচার্জ বহাল রাখা হবে। সুপারট্যাক্স গ্রুপকে উচ্চহারে গুনতে হবে কর। আগামী অর্থবছরেও অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা থাকবে। অর্থ পাচারোধে আইনের শাসন কঠোর করা হবে। অর্থ পাচার আটকাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হবে। করপোরেট কর কমানোর দাবি থাকলেও তা মানা হবে না। অন্যদিকে নির্বাচনের আগের বাজেট হওয়ায় করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করতে খোদ অর্থমন্ত্রী বললেও রাজস্ব আদায় কমে যাবে এমন যুক্তি দেখিয়ে এনবিআর রাজি নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে। কমানো হবে শিল্পের অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি শুল্ক। ডলারের ওপর চাপ কমাতে বেশি ব্যবহৃত পণ্য আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দেওয়া হবে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানি কমাতে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হবে। তৈরি পোশাক খাতের সব সুবিধা বহাল রাখা হবে। শিল্পের অন্যান্য খাতেও কতটা সুবিধা বাড়ানো যায় তা নিয়ে এনবিআর হিসাব করছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বাজেট প্রস্তুতিবিষয়ক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্পে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি এবং ঘাটতি ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হতে পারে। আগামী অর্থবছরে জিডিপির ৬ শতাংশ ঘাটতি ধরে ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হতে পারে বলে জানা যায়। ঋণদাতা সংস্থার কাছ থেকে ভর্তুকি কমানোর চাপ থাকলেও আগামীবার এ খাতে বেশি ব্যয় ধরা হতে পারে। এ খাতে ১ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ব্যয় আছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, গত সোমবার রাতে আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ অনুমোদন করে। ঋণদাতা সংস্থাটির কাছ থেকে বাংলাদেশ ছয় কিস্তিতে তিন বছরে ৪৭০ কোটি ডলার পাচ্ছে। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের দিন আইএমএফ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে পূর্বাভাস দেয়। সংস্থাটি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হতে পারে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা হতে পারে ৭ দশমিক ১ শতাংশ।
এতে রিজার্ভ সম্পর্কে বলা হয়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ৩ হাজার কোটি ডলার। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বাড়বে এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।