ময়ূর আবার পেখম মেলবে কবে
| ৬ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০
প্রায় ১৬ লাখ মানুষের বসবাস খুলনা নগরীতে। নগরীর পূর্ব পাশে আছে প্রবহমান ভৈরব ও রূপসা নদী। কিন্তু পশ্চিমে একসময়ের পেখম ছড়ানো ময়ূর নদ এখন প্রায় বন্ধ। নদটি মরতে বসেছে। ময়ূর নদের ওপর অপরিকল্পিত বাঁধ, ব্রিজ-কালভার্ট তৈরি করা হয়েছে। এর সংযোগ খালগুলো দখল করে আবাসন ব্যবসা চলছে। এসব কারণে উজানের সঙ্গে ময়ূরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রায় দুই দশক ধরে এই নদ উদ্ধার করা নিয়ে নাগরিক সমাজের দাবির মুখে খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) একটি মহাপরিকল্পনা নিয়েছিল। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে উদ্ধার অভিযান চালিয়ে ৫৮ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার পর আবারও মুখ থুবড়ে পড়েছে ময়ূর নদ উদ্ধার ও খুলনা নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন কার্যক্রম। অন্যদিকে, প্রতিনিয়তই মহানগীরর বিপুল আবর্জনা ফেলা হচ্ছে এই নদে। এতে বিষাক্ত হচ্ছে নদের পানি। ময়ূরের পানি এখন কালো রঙের হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ময়ূর নদ কার্যত এখন কেসিসির ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে।
খুলনা নগরীর পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত ময়ূর নদের দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ কিলোমিটার। আগে রূপসা নদীর সঙ্গে ময়ূরের সরাসরি সংযোগ ছিল। লবণচরা এলাকার আলুতলায় এসে ময়ূর রূপসা নদীর সঙ্গে মিশেছে। কিন্তু আশির দশকের শুরুর দিকে নগরের নিম্নাঞ্চলকে জোয়ারের পানি থেকে রক্ষায় সেখানে সুইসগেট স্থাপন করার মধ্য দিয়ে ময়ূরের প্রাকৃতিক প্রবাহ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। একদিকে প্রাকৃতিক প্রবাহ বন্ধ করা, অন্যদিকে দখল-ভরাটের পাশাপাশি খুলনা নগরীর ময়লা-আবর্জনা ফেলার ভাগাড়ে পরিণত করায় নদটি কার্যত মরে গেছে। ময়ূরের এই মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর বড় একটি কারণ নগরীর নালা-নর্দমা। কেসিসির তৈরি নগরের গুরুত্বপূর্ণ ২০টির বেশি নালার মুখ সরাসরি ময়ূর নদের সঙ্গে যুক্ত। সরেজমিনে দেখা যায়, গল্লামারী এলাকায় পাশাপাশি দুটি সেতুর নিচে রাশি রাশি বর্জ্য। দুর্গন্ধে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। গল্লামারী বাজারের ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে স্থানটি। পাড়ে জন্মানো আগাছা একেবারে মাঝনদীতে চলে গেছে। নর্দমার আবর্জনাময় পানি এসে পড়ছে নদে। কচুরিপানায় ঢাকা নদের যতটুকু অংশে পানির দেখা মেলে, তা কুচকুচে কালো। আরেকটু উজানে সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের কাছেও অনেকখানি এলাকায় একইভাবে ভরাট হয়ে আছে ময়ূর নদ। নদে বর্জ্য ফেলা বন্ধ না করার বিষয়ে খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান কনজারভেশন কর্মকর্তা আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, শহরের সব বর্জ্য সংগ্রহের জন্য তাদের পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট ও কর্মী নেই। নগরবাসীর উচিত ড্রেনে বা ফাঁকা জমিতে ময়লা না ফেলে কেসিসির সেকেন্ডারি ট্রান্সপোর্ট স্টেশনে ময়লা ফেলা। কেসিসি একদিকে ময়ূর নদ উদ্ধার নিয়ে কোটি কোটি টাকার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলছে, অন্যদিকে নিজেরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব না নিয়ে নগরবাসীকে দোষারোপ করছে। প্রশ্ন হলো, কেসিসি কেন এখনো তাদের ২০টি নালার আর সøুইসগেটের ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা দেখাতে পারছে না? কেসিসির উচিত হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে অতিদ্রুত ময়ূর নদকে ময়লা-আবর্জনামুক্ত করতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া।
আমরা যেন ভুলে না যাই ২০১৯ সালে তুরাগ নদকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ও ‘আইনি সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করে দেওয়া উচ্চ আদালতের রায়ে দেশের সব নদ-নদী-খাল-বিল-জলাশয়কেও পরস্পর সম্পৃক্ত বা একটি অঙ্গীভূত একক সত্তা হিসেবে একই সাংবিধানিক অধিকার ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই রায় বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তরেরই কোনো দৃঢ়তা দেখা যাচ্ছে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনার কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ময়ূর নদ থেকে পরিবেশ তাদের সংগ্রহ করা নমুনার জরিপ থেকে দেখা যায়, নদের পানি বিশুদ্ধতার মানদ-ের তুলনায় প্রায় তলানিতে। ময়ূর নদের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা রয়েছে এখন প্রতি লিটারে দশমিক ২ থেকে দশমিক ৬ মিলিগ্রাম। অথচ আদর্শ মাত্রায় তা প্রতি লিটারে অন্তত ৫ মিলিগ্রামের বেশি হওয়া উচিত। খুলনা শহরের জলাবদ্ধতা দূর করা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে ৮২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে। কিন্তু প্রায় সাড়ে তিন বছর অতিবাহিত হলেও এর কাজই শুরু হয়নি। আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে ৩৯৩ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে ২০২০ সালের নভেম্বরে। এই প্রকল্পের আওতায় সারা বছর নদ খননের জন্য ভাসমান এক্সকাভেটর, কচুরি অপসারণের জন্য যন্ত্র, খালের মুখে পরিশোধন নেটসহ বিভিন্ন যন্ত্র কেনার কথা রয়েছে। কিন্তু দেড় বছর পার হলেও এর কোনোটিই হয়নি। এই পরিস্থিতি স্পষ্টতই কেসিসির অদক্ষতা এবং গাফিলতির পরিচায়ক। নাগরিকদের সুস্থ জীবনযাপন ও পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে ময়ূর নদ পুনরুদ্ধার প্রকল্প অবশ্যই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা দরকার।
শেয়ার করুন
| ৬ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০

প্রায় ১৬ লাখ মানুষের বসবাস খুলনা নগরীতে। নগরীর পূর্ব পাশে আছে প্রবহমান ভৈরব ও রূপসা নদী। কিন্তু পশ্চিমে একসময়ের পেখম ছড়ানো ময়ূর নদ এখন প্রায় বন্ধ। নদটি মরতে বসেছে। ময়ূর নদের ওপর অপরিকল্পিত বাঁধ, ব্রিজ-কালভার্ট তৈরি করা হয়েছে। এর সংযোগ খালগুলো দখল করে আবাসন ব্যবসা চলছে। এসব কারণে উজানের সঙ্গে ময়ূরের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রায় দুই দশক ধরে এই নদ উদ্ধার করা নিয়ে নাগরিক সমাজের দাবির মুখে খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) একটি মহাপরিকল্পনা নিয়েছিল। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে উদ্ধার অভিযান চালিয়ে ৫৮ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার পর আবারও মুখ থুবড়ে পড়েছে ময়ূর নদ উদ্ধার ও খুলনা নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন কার্যক্রম। অন্যদিকে, প্রতিনিয়তই মহানগীরর বিপুল আবর্জনা ফেলা হচ্ছে এই নদে। এতে বিষাক্ত হচ্ছে নদের পানি। ময়ূরের পানি এখন কালো রঙের হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ময়ূর নদ কার্যত এখন কেসিসির ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে।
খুলনা নগরীর পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত ময়ূর নদের দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ কিলোমিটার। আগে রূপসা নদীর সঙ্গে ময়ূরের সরাসরি সংযোগ ছিল। লবণচরা এলাকার আলুতলায় এসে ময়ূর রূপসা নদীর সঙ্গে মিশেছে। কিন্তু আশির দশকের শুরুর দিকে নগরের নিম্নাঞ্চলকে জোয়ারের পানি থেকে রক্ষায় সেখানে সুইসগেট স্থাপন করার মধ্য দিয়ে ময়ূরের প্রাকৃতিক প্রবাহ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। একদিকে প্রাকৃতিক প্রবাহ বন্ধ করা, অন্যদিকে দখল-ভরাটের পাশাপাশি খুলনা নগরীর ময়লা-আবর্জনা ফেলার ভাগাড়ে পরিণত করায় নদটি কার্যত মরে গেছে। ময়ূরের এই মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর বড় একটি কারণ নগরীর নালা-নর্দমা। কেসিসির তৈরি নগরের গুরুত্বপূর্ণ ২০টির বেশি নালার মুখ সরাসরি ময়ূর নদের সঙ্গে যুক্ত। সরেজমিনে দেখা যায়, গল্লামারী এলাকায় পাশাপাশি দুটি সেতুর নিচে রাশি রাশি বর্জ্য। দুর্গন্ধে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। গল্লামারী বাজারের ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে স্থানটি। পাড়ে জন্মানো আগাছা একেবারে মাঝনদীতে চলে গেছে। নর্দমার আবর্জনাময় পানি এসে পড়ছে নদে। কচুরিপানায় ঢাকা নদের যতটুকু অংশে পানির দেখা মেলে, তা কুচকুচে কালো। আরেকটু উজানে সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের কাছেও অনেকখানি এলাকায় একইভাবে ভরাট হয়ে আছে ময়ূর নদ। নদে বর্জ্য ফেলা বন্ধ না করার বিষয়ে খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান কনজারভেশন কর্মকর্তা আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, শহরের সব বর্জ্য সংগ্রহের জন্য তাদের পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট ও কর্মী নেই। নগরবাসীর উচিত ড্রেনে বা ফাঁকা জমিতে ময়লা না ফেলে কেসিসির সেকেন্ডারি ট্রান্সপোর্ট স্টেশনে ময়লা ফেলা। কেসিসি একদিকে ময়ূর নদ উদ্ধার নিয়ে কোটি কোটি টাকার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলছে, অন্যদিকে নিজেরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব না নিয়ে নগরবাসীকে দোষারোপ করছে। প্রশ্ন হলো, কেসিসি কেন এখনো তাদের ২০টি নালার আর সøুইসগেটের ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা দেখাতে পারছে না? কেসিসির উচিত হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে অতিদ্রুত ময়ূর নদকে ময়লা-আবর্জনামুক্ত করতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া।
আমরা যেন ভুলে না যাই ২০১৯ সালে তুরাগ নদকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ও ‘আইনি সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করে দেওয়া উচ্চ আদালতের রায়ে দেশের সব নদ-নদী-খাল-বিল-জলাশয়কেও পরস্পর সম্পৃক্ত বা একটি অঙ্গীভূত একক সত্তা হিসেবে একই সাংবিধানিক অধিকার ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই রায় বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তরেরই কোনো দৃঢ়তা দেখা যাচ্ছে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনার কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ময়ূর নদ থেকে পরিবেশ তাদের সংগ্রহ করা নমুনার জরিপ থেকে দেখা যায়, নদের পানি বিশুদ্ধতার মানদ-ের তুলনায় প্রায় তলানিতে। ময়ূর নদের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা রয়েছে এখন প্রতি লিটারে দশমিক ২ থেকে দশমিক ৬ মিলিগ্রাম। অথচ আদর্শ মাত্রায় তা প্রতি লিটারে অন্তত ৫ মিলিগ্রামের বেশি হওয়া উচিত। খুলনা শহরের জলাবদ্ধতা দূর করা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে ৮২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে। কিন্তু প্রায় সাড়ে তিন বছর অতিবাহিত হলেও এর কাজই শুরু হয়নি। আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে ৩৯৩ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে ২০২০ সালের নভেম্বরে। এই প্রকল্পের আওতায় সারা বছর নদ খননের জন্য ভাসমান এক্সকাভেটর, কচুরি অপসারণের জন্য যন্ত্র, খালের মুখে পরিশোধন নেটসহ বিভিন্ন যন্ত্র কেনার কথা রয়েছে। কিন্তু দেড় বছর পার হলেও এর কোনোটিই হয়নি। এই পরিস্থিতি স্পষ্টতই কেসিসির অদক্ষতা এবং গাফিলতির পরিচায়ক। নাগরিকদের সুস্থ জীবনযাপন ও পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে ময়ূর নদ পুনরুদ্ধার প্রকল্প অবশ্যই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা দরকার।