সিনেমার এস্থেটিকে ব্রাত্য হয়ে পড়া লুঙ্গি
সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ | ৬ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০
ওয়েব সিরিজের ভাষা ও দর্শক এবং গতানুগতিক সিনেমা হলের সিনেমার ভাষা ও দর্শকের তুলনা করে একটা বিশ্লেষণধর্মী লেখা লিখব বলে বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম। ভাবছিলাম কীভাবে আরবান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের মধ্যে দেয়াল তৈরি হচ্ছে সব রকম পাবলিক স্পেসে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বেশ কিছু সিনেমা ফেইসবুক ও অভিজাত সিনেমা হলগুলোতে বিপুল আলোড়ন তোলায় লেখাটার তাগিদ বাড়িয়ে দিচ্ছিল। তবে, লেখাটা একদম ট্রিগার করল একটা ভিডিও দেখে সনি সিনেমা হলে এক বৃদ্ধ সিনেমা দেখতে পারেননি, তার অপরাধ তিনি লুঙ্গি পরে হলে গেছেন। আমাদের কালচারাল স্পেস, তথাকথিত সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পতন ও নব-উত্থানের স্বপ্ন, মিডিয়ার ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভ আর এগুলোকে টেনে নিয়ে পপুলিস্ট রাজনীতি ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে ক্রমেই বাড়তে থাকা বৈষম্যের কারণ ও অবস্থা এ ঘটনাগুলোর মাধ্যমে পর্যালোচনা করা যায়।
ভারতের পর বাংলাদেশেও এখন ওয়েব সিরিজগুলো খুবই জনপ্রিয়। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে এগুলো বিনোদনের দারুণ সুযোগ এনে দিয়েছে। একে তো হাতের মুঠোতেই এগুলো দেখা যাচ্ছে, তদুপরি কনটেন্টগুলোও তাদের টার্গেট করেই বানানো। বিশ্বায়নের কল্যাণে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা মধ্যবিত্ত নেটফ্লিক্স, আমাজনের পর নিজের ভাষায় এসব কনটেন্ট দেখে ভীষণভাবে তৃপ্ত হচ্ছে। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই এর ভাষাটা শহুরে মধ্যবিত্তের মতোই। ভারতের কোনো একটা ওয়েব সিরিজ দেখলে আমরা দেখতে পাই সেটা ইংরেজির আধিক্য মেশানো শহুরে হিন্দি। শুধু শব্দ নয়, কালচারাল আবহটাও পুরোপুরি আর্বান। ফলত, একজন অল্পশিক্ষিত কিংবা আরবান সেট-আপের বাইরে থাকা মানুষের পক্ষে এর সঙ্গে কানেক্ট করা মুশকিল। বাংলাদেশেও ঠিক তাই।
অর্থনৈতিক বিচারে, এহেন নির্মাণ মোটেই দোষণীয় নয়। বরং নিওলিবারেল ব্যবস্থায়, বিনোদন পণ্যগুলোকে শ্রেণি হিসেবে একদম আলাদা আলাদা ভাগ করে, টার্গেট অডিয়েন্স মাথায় রেখে সর্বোচ্চ ব্যবসা করাটাই যৌক্তিক। টার্গেট অডিয়েন্সের বাইরে কেউ দেখল কি না দেখল, তা নিয়ে সিরিজ নির্মাতাদের ভাবার কোনো কারণ নেই। এখানে সিরিজ বললেও, একই যুক্তি খাটে সিনেমার বেলাতেও। এমনকি তা যদি প্রথাগত সিনেমা হলগুলোতে মুক্তি পায় তাও। নির্মাতারা যদি মনে করেন, নির্দিষ্ট অডিয়েন্সকে টার্গেট করে তারা ব্যবসা করবেন, তবে সেটা একান্তই তাদের ব্যাপার।
কিন্তু আলাপটা জরুরি হয়ে দাঁড়ায় গণমাধ্যমের, পাবলিক পলিসিমেকার আর জনগণের রাজনীতি কিংবা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে, যারা কর্মী বলে দাবি করেন তাদের ভূমিকা কী তা নিয়ে।
বিগত কয়েক দশকে আমরা দেখি আমাদের দেশের সিনেমা হলগুলো একে একে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সেসব জায়গায় অধিক লাভজনক শপিং কমপ্লেক্স বা অন্যান্য ব্যবসা গড়ে উঠেছে। এর বিপরীতে আধুনিক কিছু সিনেপ্লেক্স তৈরি হয়েছে, তবে সেগুলো একেবারেই আরবান, শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের জন্য। ফলে, সিনেমার মতো একটা পাবলিক কালচারাল স্পেস থেকে বাকি শ্রেণির লোকজন, বিশেষত নিম্নবিত্তরা প্রবেশাধিকার হারাচ্ছেন।
মিডিয়ার ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভে বছরের পর বছর বলা হয়েছে অশ্লীল সিনেমায় দেশ ছেয়ে গেছে, ফলত জনগণের, বিশেষত তরুণ সমাজের ‘মূল্যবোধ’ রক্ষার্থে এগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অশ্লীলতা কি আসলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের রুচি অনুসারে নির্ধারিত হবে? ভারতের কথা বলছিলাম, সেখানে কিন্তু আরবান মধ্যবিত্তের বাইরে বিপুল পরিমাণ অল্পশিক্ষিত, নিম্নবিত্তের জন্য সিনেমা নির্মাণ থামেনি।
সিনেমায় কী ধরনের ‘অশ্লীলতা’ দেখানো হয়? বিদ্যমান সমাজের চিত্রই তো, তাই না? বিদ্যমান সমাজের রাজনীতি আর চর্চা যদি ‘অশ্লীল’ হয়, তাহলে সেটাকে ‘শ্লীল’ভাবে দেখানোও তো কাজের কথা না। এখন গালাগালকে যদি আমরা অশ্লীলতা ধরি, তবে দেখতে পাব, আরবান রুচির সিনেমাতেও এর ছড়াছড়ি, যদিও মধ্যবিত্ত মানসে তা হয়ে ওঠে ‘আর্ট’।
আচ্ছা, ধরেই নিলাম, খুবই ‘ক্ষতিকর অশ্লীলতা’ হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব কি নয় সিনেমাশিল্পকে টিকিয়ে রাখা? বাস্তবতা হচ্ছে, দখলদারত্ব যখন স্বাভাবিক হয়ে যায়, জবাবদিহি যখন না থাকে, সমাজে যখন প্রতিষ্ঠা হয় অর্থ, আর ক্ষমতার দাপটই সব, তখন এগুলো হয়।
এ ব্যাপারটাকে বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দখলের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অশ্লীলতার ধোয়া তুলে মধ্যবিত্তকে এখানে এক ধরনের গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অবশ্য এখানে আরেকটা সূক্ষ্ম রাজনীতি করা হয়। নিওলিবারেল সময়ে মধ্যবিত্ত তার রাজনৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এখন মধ্যবিত্তের সংগঠিত রাজনীতি নেই, শুধু অর্থ আর ক্ষমতাই সবকিছুর পরিমাপক হয়ে পড়ায়, মধ্যবিত্ত হারিয়ে ফেলেছে কালচারাল স্পেসে তার আধিপত্য।
এ মধ্যবিত্ত তার শিক্ষা ও অর্জিত রুচি দিয়ে সংস্কৃতির টেম্পো সেট করে দিত, কিন্তু এখন সে পরাস্ত। উচ্চবিত্ত, বিশেষ করে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের বাধ্যগত দাস হওয়া ছাড়া তার গতি নেই। কিন্তু, ক্ষমতা হারানো জমিদারের মতো তার ইগো আছে। আর সে ইগোর জোরে সে আত্মতৃপ্তি লাভ করে যে, অশ্লীলতা ঠেকিয়ে সে আসলে কালচারাল মোড়লের ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে। এ এক বিভ্রম।
এ বিভ্রমের ফলে সে মনে করে, তার রুচির আলোকে কিছু সিনেমার নির্মাণ এ দেশের সিনেমাশিল্পের আবার পুনরুত্থান ঘটাবে। ইগোর চোটে সে দেখতে পায় না যে, বিদেশি পুরস্কারপ্রাপ্ত, এস্থেটিক ধারায় নির্মিত বিশ্বমানের চলচ্চিত্র হয়তো দেশের সিনেমাবৃক্ষের আগায় প্রচুর প্রশংসা বৃষ্টি আনবে, কিন্তু এর গোড়াটা কাটা থাকলে, তার টিকে থাকার সম্ভাবনা থাকবে না।
সিনেমাকে বাঁচাতে হলে, তাই একে একেবারে গণমানুষের মাধ্যমে পরিণত করতে হবে। ওটিটির মতো মাধ্যমের সেই দায় নেই, সিনেমার আছে। আর, সিনেমাশিল্প কখনোই খুব একটা লাভজনক কিছু না, এর তুলনায় অন্য ব্যবসায় লাভ বেশি, কিন্তু কালচারাল স্পেস তৈরিতে, জনতার বিনোদন মেটাতে এর যে জরুরত তাই একে টিকিয়ে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
একই কথা বলা চলে খেলাধুলার ক্ষেত্রেও। এই আলাপে বিশদে যাওয়ার সুযোগ নেই, কিন্তু সিনেমার মতো আমাদের ক্লাব সংস্কৃতিও ধ্বংস হয়েছে জুয়া খেলা আর দখলের কারণে। এখানেও মধ্যবিত্ত নিজের অথরিটি ছেড়ে দিয়ে, নিজেকে বিযুক্ত করে ফেলেছে। নিজেদের পাশাপাশি ক্ষতি করেছে নিম্নবিত্ত মানুষ আর কালচারাল স্পেসকে। কালচারাল স্পেস ধ্বংস হওয়ায় মানুষে মানুষে দূরত্ব আর অবিশ্বাস বেড়েছে, এর ফলে দখলদার রাজনীতি আরও অবাধ হয়েছে।
এখন মধ্যবিত্তের বিনোদন সিনেপ্লেক্স, যেখানে দেখানো হয় আরবান শিক্ষিতের মনের মতো সিনেমা। সে ফুটবল বলতে বোঝে ইউরোপীয় লিগ। এসব জায়গায় তাই লুঙ্গি পরাদের স্থান হয় না। ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের কাছে পরাস্ত মধ্যবিত্ত, এই জায়গায় ব্রাহ্মণ সাজার আত্মশ্লাঘা লাভ করে।
তাহলে, দেশের নিম্নবিত্তরা কীভাবে বিনোদন পাবে? তাদের জন্য কনটেন্ট বানাবে কে? আর ধরলাম, আমার মতো রুচিশীল মধ্যবিত্ত, যে কি না এই গভীর রাতে ‘এ হাওয়া’ নামের দারুণ এক গান শুনতে শুনতে এই লেখাটা লিখছে, তারা সেই দায়িত্ব নেবে না। ঠিক আছে, তাহলে বাপু কোনটা শ্লীল আর কোনটা অশ্লীল এই বিচারের অধিকার কীভাবে থাকে? কে রবীন্দ্রনাথের গান বিকৃতি করে গাইল তাই বা ঠিক করে দেওয়ার কে? আর সংস্কৃতির ‘অবক্ষয়ে’ ধীরে ধীরে দেশে উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়েই মতামত দেওয়ার অধিকারই বা কীভাবে থাকে?
সত্যি কথা বলতে কি, পরাজিত মধ্যবিত্ত নিজের একটা বলয় তৈরি করে সেখানে কালচারাল জমিদারি অক্ষুণœ রাখার ভাব অব্যাহত রাখার যে আত্মতৃপ্তি, তা বালিতে চোখ বন্ধ রাখা কাকের মতো।
পৃথিবীর মোট সম্পদের অর্ধেকই আটজন মানুষের দখলে। মধ্যবিত্তের মাথায় কীভাবে জানি ঢুকে গেছে, দিনমান পুঁজিবাদের সেবা করলেও তারও লটারি লাগতে পারে। আর তা করতে গিয়ে, সে মনেপ্রাণে ‘গরিব কালচার’, আর দরিদ্রদের থেকে যে করেই হোক আলাদা থাকতে চাইছে। আগের প্রজন্মের মতো বুঝছে না যে, দরিদ্রদের সঙ্গে নিয়ে সাংস্কৃতিক আর রাজনৈতিক লড়াইই বরং তাকে সাম্যতা আর অধিকার দেবে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা জাগে, যারা নিজেদের সংস্কৃতির ধ্বজাধারী ভাবেন তারাও কি ভাবনা বাদ দিয়ে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম আর নিওলিবারেলের ফাঁদে আটকা পড়লেন? একসঙ্গে সিনেমা, ফুটবল দেখা আর পাবলিক স্পেসে নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার না হলে যে মুক্তি আসবে না, তা কি ভোগবাদের বিষে ডিপ্রেশনে পড়া, সিসিফাসের মতো হতাশার চক্রে আটকে পড়ারা বুঝবে না?
লেখক ক্রীড়া সাংবাদিক ও অনুবাদক
শেয়ার করুন
সৈয়দ ফায়েজ আহমেদ | ৬ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০

ওয়েব সিরিজের ভাষা ও দর্শক এবং গতানুগতিক সিনেমা হলের সিনেমার ভাষা ও দর্শকের তুলনা করে একটা বিশ্লেষণধর্মী লেখা লিখব বলে বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম। ভাবছিলাম কীভাবে আরবান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের মধ্যে দেয়াল তৈরি হচ্ছে সব রকম পাবলিক স্পেসে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বেশ কিছু সিনেমা ফেইসবুক ও অভিজাত সিনেমা হলগুলোতে বিপুল আলোড়ন তোলায় লেখাটার তাগিদ বাড়িয়ে দিচ্ছিল। তবে, লেখাটা একদম ট্রিগার করল একটা ভিডিও দেখে সনি সিনেমা হলে এক বৃদ্ধ সিনেমা দেখতে পারেননি, তার অপরাধ তিনি লুঙ্গি পরে হলে গেছেন। আমাদের কালচারাল স্পেস, তথাকথিত সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পতন ও নব-উত্থানের স্বপ্ন, মিডিয়ার ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভ আর এগুলোকে টেনে নিয়ে পপুলিস্ট রাজনীতি ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে ক্রমেই বাড়তে থাকা বৈষম্যের কারণ ও অবস্থা এ ঘটনাগুলোর মাধ্যমে পর্যালোচনা করা যায়।
ভারতের পর বাংলাদেশেও এখন ওয়েব সিরিজগুলো খুবই জনপ্রিয়। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে এগুলো বিনোদনের দারুণ সুযোগ এনে দিয়েছে। একে তো হাতের মুঠোতেই এগুলো দেখা যাচ্ছে, তদুপরি কনটেন্টগুলোও তাদের টার্গেট করেই বানানো। বিশ্বায়নের কল্যাণে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা মধ্যবিত্ত নেটফ্লিক্স, আমাজনের পর নিজের ভাষায় এসব কনটেন্ট দেখে ভীষণভাবে তৃপ্ত হচ্ছে। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই এর ভাষাটা শহুরে মধ্যবিত্তের মতোই। ভারতের কোনো একটা ওয়েব সিরিজ দেখলে আমরা দেখতে পাই সেটা ইংরেজির আধিক্য মেশানো শহুরে হিন্দি। শুধু শব্দ নয়, কালচারাল আবহটাও পুরোপুরি আর্বান। ফলত, একজন অল্পশিক্ষিত কিংবা আরবান সেট-আপের বাইরে থাকা মানুষের পক্ষে এর সঙ্গে কানেক্ট করা মুশকিল। বাংলাদেশেও ঠিক তাই।
অর্থনৈতিক বিচারে, এহেন নির্মাণ মোটেই দোষণীয় নয়। বরং নিওলিবারেল ব্যবস্থায়, বিনোদন পণ্যগুলোকে শ্রেণি হিসেবে একদম আলাদা আলাদা ভাগ করে, টার্গেট অডিয়েন্স মাথায় রেখে সর্বোচ্চ ব্যবসা করাটাই যৌক্তিক। টার্গেট অডিয়েন্সের বাইরে কেউ দেখল কি না দেখল, তা নিয়ে সিরিজ নির্মাতাদের ভাবার কোনো কারণ নেই। এখানে সিরিজ বললেও, একই যুক্তি খাটে সিনেমার বেলাতেও। এমনকি তা যদি প্রথাগত সিনেমা হলগুলোতে মুক্তি পায় তাও। নির্মাতারা যদি মনে করেন, নির্দিষ্ট অডিয়েন্সকে টার্গেট করে তারা ব্যবসা করবেন, তবে সেটা একান্তই তাদের ব্যাপার।
কিন্তু আলাপটা জরুরি হয়ে দাঁড়ায় গণমাধ্যমের, পাবলিক পলিসিমেকার আর জনগণের রাজনীতি কিংবা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে, যারা কর্মী বলে দাবি করেন তাদের ভূমিকা কী তা নিয়ে।
বিগত কয়েক দশকে আমরা দেখি আমাদের দেশের সিনেমা হলগুলো একে একে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সেসব জায়গায় অধিক লাভজনক শপিং কমপ্লেক্স বা অন্যান্য ব্যবসা গড়ে উঠেছে। এর বিপরীতে আধুনিক কিছু সিনেপ্লেক্স তৈরি হয়েছে, তবে সেগুলো একেবারেই আরবান, শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের জন্য। ফলে, সিনেমার মতো একটা পাবলিক কালচারাল স্পেস থেকে বাকি শ্রেণির লোকজন, বিশেষত নিম্নবিত্তরা প্রবেশাধিকার হারাচ্ছেন।
মিডিয়ার ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভে বছরের পর বছর বলা হয়েছে অশ্লীল সিনেমায় দেশ ছেয়ে গেছে, ফলত জনগণের, বিশেষত তরুণ সমাজের ‘মূল্যবোধ’ রক্ষার্থে এগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অশ্লীলতা কি আসলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের রুচি অনুসারে নির্ধারিত হবে? ভারতের কথা বলছিলাম, সেখানে কিন্তু আরবান মধ্যবিত্তের বাইরে বিপুল পরিমাণ অল্পশিক্ষিত, নিম্নবিত্তের জন্য সিনেমা নির্মাণ থামেনি।
সিনেমায় কী ধরনের ‘অশ্লীলতা’ দেখানো হয়? বিদ্যমান সমাজের চিত্রই তো, তাই না? বিদ্যমান সমাজের রাজনীতি আর চর্চা যদি ‘অশ্লীল’ হয়, তাহলে সেটাকে ‘শ্লীল’ভাবে দেখানোও তো কাজের কথা না। এখন গালাগালকে যদি আমরা অশ্লীলতা ধরি, তবে দেখতে পাব, আরবান রুচির সিনেমাতেও এর ছড়াছড়ি, যদিও মধ্যবিত্ত মানসে তা হয়ে ওঠে ‘আর্ট’।
আচ্ছা, ধরেই নিলাম, খুবই ‘ক্ষতিকর অশ্লীলতা’ হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব কি নয় সিনেমাশিল্পকে টিকিয়ে রাখা? বাস্তবতা হচ্ছে, দখলদারত্ব যখন স্বাভাবিক হয়ে যায়, জবাবদিহি যখন না থাকে, সমাজে যখন প্রতিষ্ঠা হয় অর্থ, আর ক্ষমতার দাপটই সব, তখন এগুলো হয়।
এ ব্যাপারটাকে বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দখলের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অশ্লীলতার ধোয়া তুলে মধ্যবিত্তকে এখানে এক ধরনের গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অবশ্য এখানে আরেকটা সূক্ষ্ম রাজনীতি করা হয়। নিওলিবারেল সময়ে মধ্যবিত্ত তার রাজনৈতিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এখন মধ্যবিত্তের সংগঠিত রাজনীতি নেই, শুধু অর্থ আর ক্ষমতাই সবকিছুর পরিমাপক হয়ে পড়ায়, মধ্যবিত্ত হারিয়ে ফেলেছে কালচারাল স্পেসে তার আধিপত্য।
এ মধ্যবিত্ত তার শিক্ষা ও অর্জিত রুচি দিয়ে সংস্কৃতির টেম্পো সেট করে দিত, কিন্তু এখন সে পরাস্ত। উচ্চবিত্ত, বিশেষ করে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের বাধ্যগত দাস হওয়া ছাড়া তার গতি নেই। কিন্তু, ক্ষমতা হারানো জমিদারের মতো তার ইগো আছে। আর সে ইগোর জোরে সে আত্মতৃপ্তি লাভ করে যে, অশ্লীলতা ঠেকিয়ে সে আসলে কালচারাল মোড়লের ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে। এ এক বিভ্রম।
এ বিভ্রমের ফলে সে মনে করে, তার রুচির আলোকে কিছু সিনেমার নির্মাণ এ দেশের সিনেমাশিল্পের আবার পুনরুত্থান ঘটাবে। ইগোর চোটে সে দেখতে পায় না যে, বিদেশি পুরস্কারপ্রাপ্ত, এস্থেটিক ধারায় নির্মিত বিশ্বমানের চলচ্চিত্র হয়তো দেশের সিনেমাবৃক্ষের আগায় প্রচুর প্রশংসা বৃষ্টি আনবে, কিন্তু এর গোড়াটা কাটা থাকলে, তার টিকে থাকার সম্ভাবনা থাকবে না।
সিনেমাকে বাঁচাতে হলে, তাই একে একেবারে গণমানুষের মাধ্যমে পরিণত করতে হবে। ওটিটির মতো মাধ্যমের সেই দায় নেই, সিনেমার আছে। আর, সিনেমাশিল্প কখনোই খুব একটা লাভজনক কিছু না, এর তুলনায় অন্য ব্যবসায় লাভ বেশি, কিন্তু কালচারাল স্পেস তৈরিতে, জনতার বিনোদন মেটাতে এর যে জরুরত তাই একে টিকিয়ে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
একই কথা বলা চলে খেলাধুলার ক্ষেত্রেও। এই আলাপে বিশদে যাওয়ার সুযোগ নেই, কিন্তু সিনেমার মতো আমাদের ক্লাব সংস্কৃতিও ধ্বংস হয়েছে জুয়া খেলা আর দখলের কারণে। এখানেও মধ্যবিত্ত নিজের অথরিটি ছেড়ে দিয়ে, নিজেকে বিযুক্ত করে ফেলেছে। নিজেদের পাশাপাশি ক্ষতি করেছে নিম্নবিত্ত মানুষ আর কালচারাল স্পেসকে। কালচারাল স্পেস ধ্বংস হওয়ায় মানুষে মানুষে দূরত্ব আর অবিশ্বাস বেড়েছে, এর ফলে দখলদার রাজনীতি আরও অবাধ হয়েছে।
এখন মধ্যবিত্তের বিনোদন সিনেপ্লেক্স, যেখানে দেখানো হয় আরবান শিক্ষিতের মনের মতো সিনেমা। সে ফুটবল বলতে বোঝে ইউরোপীয় লিগ। এসব জায়গায় তাই লুঙ্গি পরাদের স্থান হয় না। ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের কাছে পরাস্ত মধ্যবিত্ত, এই জায়গায় ব্রাহ্মণ সাজার আত্মশ্লাঘা লাভ করে।
তাহলে, দেশের নিম্নবিত্তরা কীভাবে বিনোদন পাবে? তাদের জন্য কনটেন্ট বানাবে কে? আর ধরলাম, আমার মতো রুচিশীল মধ্যবিত্ত, যে কি না এই গভীর রাতে ‘এ হাওয়া’ নামের দারুণ এক গান শুনতে শুনতে এই লেখাটা লিখছে, তারা সেই দায়িত্ব নেবে না। ঠিক আছে, তাহলে বাপু কোনটা শ্লীল আর কোনটা অশ্লীল এই বিচারের অধিকার কীভাবে থাকে? কে রবীন্দ্রনাথের গান বিকৃতি করে গাইল তাই বা ঠিক করে দেওয়ার কে? আর সংস্কৃতির ‘অবক্ষয়ে’ ধীরে ধীরে দেশে উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়েই মতামত দেওয়ার অধিকারই বা কীভাবে থাকে?
সত্যি কথা বলতে কি, পরাজিত মধ্যবিত্ত নিজের একটা বলয় তৈরি করে সেখানে কালচারাল জমিদারি অক্ষুণœ রাখার ভাব অব্যাহত রাখার যে আত্মতৃপ্তি, তা বালিতে চোখ বন্ধ রাখা কাকের মতো।
পৃথিবীর মোট সম্পদের অর্ধেকই আটজন মানুষের দখলে। মধ্যবিত্তের মাথায় কীভাবে জানি ঢুকে গেছে, দিনমান পুঁজিবাদের সেবা করলেও তারও লটারি লাগতে পারে। আর তা করতে গিয়ে, সে মনেপ্রাণে ‘গরিব কালচার’, আর দরিদ্রদের থেকে যে করেই হোক আলাদা থাকতে চাইছে। আগের প্রজন্মের মতো বুঝছে না যে, দরিদ্রদের সঙ্গে নিয়ে সাংস্কৃতিক আর রাজনৈতিক লড়াইই বরং তাকে সাম্যতা আর অধিকার দেবে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা জাগে, যারা নিজেদের সংস্কৃতির ধ্বজাধারী ভাবেন তারাও কি ভাবনা বাদ দিয়ে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম আর নিওলিবারেলের ফাঁদে আটকা পড়লেন? একসঙ্গে সিনেমা, ফুটবল দেখা আর পাবলিক স্পেসে নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার না হলে যে মুক্তি আসবে না, তা কি ভোগবাদের বিষে ডিপ্রেশনে পড়া, সিসিফাসের মতো হতাশার চক্রে আটকে পড়ারা বুঝবে না?
লেখক ক্রীড়া সাংবাদিক ও অনুবাদক