
১৯৮৯ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন সংগীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। জন্ম ১৯২০ সালের ১৬ জুন ভারতের কাশীতে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান। কিন্তু তিনি সংগীতের জন্য অধ্যয়ন ত্যাগ করেন। তার সাহিত্যিক হওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিছুদিন তিনি দেশ পত্রিকার জন্য লেখেন। শৈলেশ দাসগুপ্তর সাহায্যে হেমন্তর প্রথম গান করেন ১৯৩৫ সালে। ১৯৩৭ সালে তিনি গ্রামোফোন রেকর্ড ঈড়ষঁসনরধ লেবেলে জানিতে যদি গো তুমি ও বলো গো বলো মোরে গানগুলো করেন। এরপর থেকে প্রতি বছর তিনি গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়ার জন্য গান রেকর্ড করেছেন। ১৯৪০ সালে সংগীতপরিচালক কমল দাসগুপ্ত হেমন্তকে দিয়ে ফাইয়াজ হাস্মির কথায় কিতনা দুঃখ ভুলায়া তুমনে ও প্রীত নিভানেভালি গাওয়ান। প্রথম ছায়াছবির গান তিনি গেয়েছেন ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছবির জন্য। ১৯৪৭ সালে ‘অভিযাত্রী’ সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করেন। আধুনিক গান ছাড়াও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রসংগীত ও রজনীকান্তের গান গেয়েছেন। স্বীকৃতি হিসেবে বিভিন্ন পুরস্কারের পাশাপাশি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডি.লিট।
বাংলাদেশে সড়কে হত্যাকাণ্ড বাড়ছে। বাড়ছে গৃহের অভ্যন্তরে আত্মহত্যাও। প্রত্যেকটি আত্মহত্যাই একেকটি মর্মবিদারক ঘটনা, পরিবারের জন্য তো অবশ্যই, সমাজের জন্যও। বোঝা যায় মানুষ কতটা যন্ত্রণার ভেতর রয়েছে। ব্যবস্থাটা এমনই যে মানুষকে তার ন্যূনতম যে অধিকার বেঁচে থাকার অধিকার তারও নিশ্চয়তা দিতে সে ব্যর্থ হচ্ছে। একটি মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের বিশেষভাবে মর্মাহতও করেছে।
মেয়েটি খুবই প্রাণবন্ত ছিল। হাসিখুশি থাকত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছে; তারপর গেছে সাংবাদিকতায়। করোনাকালে সংবাদপত্র শিল্প পড়েছে বড় ধরনের ধাক্কার মুখে, সাংবাদিকদের অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। এই মেয়েটিও যে পত্রিকায় ছিল সেখানে থাকতে পারেনি; হাজির হয়েছে একটি অনলাইন পত্রিকায়। সেখানেও সুবিধা হয়নি। পরে যোগ দিয়েছিল একটি এনজিওতে; কিন্তু কাজটা তার পছন্দ হওয়ার মতো ছিল না। তারপর মেয়েটি একটি সাহসী পদক্ষেপ নেয়। দুঃসাহসিকও বলা চলে। অনলাইনে ব্যবসা শুরু করে। ঠিক করেছে রান্নার মসলা সরবরাহ করবে বাসায় বাসায়। টাকা বিনিয়োগ করেছিল, কিন্তু যতটা বিনিয়োগ প্রয়োজন ততটা করতে পারেনি। ফলে ব্যবসাটা জমছিল না। মেয়েটির বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী, মা অসুস্থ। একটি মাত্র ভাই, সে ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল, টেকেনি। ঢাকা শহরে থাকত সে বাসাভাড়া করে। একা। নিশ্চয়ই দায়িত্ববোধ ছিল; বাবা-মাকে সাহায্য করতে পারছে না, এই বোধ তাকে পীড়া না দিয়ে ছাড়বে কেন? জীবন অবশ্যই দুঃসহ এক বোঝা হয়ে উঠেছিল তার জন্য। ক্লান্ত অবস্থায় ভারমুক্ত হয়েছে আত্মহত্যা করে।
নাকি জোর পুলিশি তদন্ত শুরু হয়েছে, কেউ তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছিল কি না তা নিয়ে। তদন্তে কোনো রহস্য উদঘাটিত হয়েছে কি না তা আমরা জানি না, জানার কৌতূহলও নেই; কারণ এটা তো কোনো রহস্যই নয়, আমরা পরিষ্কারই জানি যে বিদ্যমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাই তাকে বেঁচে থাকতে দেয়নি। চেষ্টাও করেনি বাঁচিয়ে রাখতে। ওইখানে কোনো প্রকার রহস্য নেই। আর মেয়েটি একা তো নয়, এ রকম অসংখ্য মানুষ এখন বিষাদময় ও ক্লান্তিকর জীবনের ঘানি টানছে। আত্মহত্যা করছে না, আশা করি করবেও না, কিন্তু পৌঁছে গেছে একেবারে দ্বারপ্রান্তে।
আর এই বিষাদ ও হতাশা শুধু যে বাংলাদেশের ব্যাপার তাও তো নয়, এটি ঘটেছে বিশ্বময়। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। এর কারণকে ব্যক্তিগত বলে ধরে নিয়ে ব্যাপারটাকে খাটো করার উপায় নেই। ব্যক্তিগত কারণ নিশ্চয়ই আছে; একই দুর্দশায় পড়ে দুজন মানুষ একই ধরনের কাজ করে না, সমান মাত্রায় বিষন্নও হয় না। কিন্তু তার বাইরে সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ যে খুব ভালোভাবেই রয়ে গেছে সেটাকে উপেক্ষা করলে ঘটনা বোঝার ব্যাপারের ধারে-কাছেও পৌঁছাতে পারব না, তা যতই গবেষণা কিংবা তদন্ত করি না কেন।
আন্তর্জাতিক একটি গবেষণা সংস্থা তাদের এক প্রতিবেদনে মানসিক স্বাস্থ্যের ভেঙে পড়ার জন্য কয়েকটি রাজনৈতিক-সামাজিক কারণকে চিহ্নিত করেছে, দেখতে পেলাম। এক নম্বর কারণ দারিদ্র্য; দুই নম্বরে আছে সৎসঙ্গের দুর্লভতা। এরপর রয়েছে ক্ষুধা, একাকিত্ব, এবং ভালো কাজের নিশ্চয়তার অভাব। কারণগুলোর চিহ্নিতকরণ মনে হয় অযথার্থ নয়। অন্যগুলো তো রয়েছেই; কিন্তু ওই যে সৎসঙ্গের অভাব ও একাকিত্ব, এ দুটিকে বিশেষ রকমের গুরুত্ব দিতে হয়। মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে; কেউ কাউকে সঙ্গ দিতে চায় না, শুধু নিজের কথাই ভাবতে ভালোবাসে, ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়Ñ ক্লান্ত এবং আরও ক্লান্ত। এবং একা হয়ে পড়ে। জীবনের বোঝা বহন করাটা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।
এই ব্যাধির প্রতিকারের প্রশস্ত উপায় হচ্ছে আন্দোলন। সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন। এই কথাটি দিয়ে শেষ করা যায় আমাদের এই আলোচনা। কিন্তু তার আগে আরেকটি সাম্প্রতিক প্রসঙ্গের দিকে নজর দেওয়া যাক। সেটি হলো জনশুমারির প্রতিবেদন।
এবারের জনশুমারি একটি ভালো খবর দিচ্ছে। খবরটি জনসংখ্যার বৃদ্ধিতে নিম্নগতি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমান করা গিয়েছিল; অতটা বাড়েনি, সাড়ে ১৬ কোটিতে পৌঁছে ক্ষান্ত দিয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি না ঘটার একটি কারণ প্রজনন-হারের নিম্নগতি। অন্যটি (যেটা হয়তো সেভাবে উল্লিখিত হয়নি) মানুষের মৃত্যু। বহু মানুষ মারা গেছে। স্বাভাবিক মৃত্যু তো ছিলই, সেটা অবধারিত। কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যুও ঘটেছে। যেমন সড়ক দুর্ঘটনায়; বিদেশে যাওয়ার পথে পানিতে ডুবে। বজ্রাঘাতেও প্রাণহানি ঘটেছে। হত্যা, পারিবারিক সহিংসতা, চিকিৎসার অভাব এসব ছিল। করোনা ও ডেঙ্গু উভয়কেই তৎপর অবস্থায় দেখা গেছে। আগুনে পুড়েও অনেকে চলে গেছেন।
তবে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে এই সংবাদ যে, এই প্রথমবারের মতো সংখ্যার দিক থেকে মেয়েরা ছাড়িয়ে গেছে পুরুষদের। এর একাধিক কারণ নিশ্চয়ই রয়েছে। একটা হলো বহুবিধ কষ্ট সহ্য করেও আমাদের দেশের মেয়েদের টিকে থাকার ক্ষমতা। আরেকটা কারণ, বহু পুরুষ মানুষ বিদেশে চলে গেছে, কাজের খোঁজে। মেয়েরা রয়ে গেছে। স্কুল-কলেজেও তাই মেয়েদের সংখ্যা বছরে বছরে বেড়েছে। আর অর্থনৈতিক জীবনে মেয়েদের অংশগ্রহণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি ‘আদমশুমারি’কে যে এখন জনশুমারি বলা হচ্ছে সেটাও তাৎপর্যহীন নয়; শুমারিতে আদমদের গোনা হবে, হাওয়া’রা কি বাদ? ভাষাগত সমস্যাটার এই মীমাংসাও ভালো খবর। কিন্তু তাই বলে এ কথা বলার কোনো উপায়ই নেই যে, মেয়েদের এই সংখ্যানুপাতিক অগ্রগতি বিদ্যমান পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তনের বার্তা বহন করছে। না, মোটেই না। নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, বাল্যবিয়ে, মজুরি-বৈষম্য, মেয়েদের কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টাÑ সবকিছুই অব্যাহত থাকবে। অধ্যাপক যদি ছাত্রীকে বিয়ে করেন তবে সেটা কোনো খবর হবে না, কিন্তু কোনো অধ্যাপিকা যদি ছাত্রকে বিয়ে করেন তবে হইচই পড়ে যাবে, নাটোরে যেমনটা ঘটেছে। পুরুষতান্ত্রিক নানা প্রকারের চাপে ছাত্রকে বিয়ে-করা একজন অধ্যাপিকা শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে জীবনযন্ত্রণার হাত থেকে বেঁচেছেন। এর কারণ পিতৃতান্ত্রিকতা জিনিসটা বাইরের কোনো ব্যাপার নয়, ঘটনা নয় ওপর কাঠামোগত। রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার ভেতরই সে প্রোথিত; পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও মতাদর্শের সঙ্গে এর সম্পর্ক একেবারেই অবিচ্ছেদ্য।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সারা পৃথিবীতেই স্পষ্ট। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ পৃথিবীর সবকিছু যেন ওলটপালট করে দিচ্ছে, আর বারবারই মনে করিয়ে দিচ্ছে এ অবস্থার জন্য কারা দায়ী ও ক্ষতিগ্রস্ত কারা। ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীকে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি এজন্য প্রাসঙ্গিক যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো প্রতিনিয়ত তাদের জীবনকে যেমন দুর্বিষহ করে তুলছে, তেমনি ধীরে ধীরে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে দরিদ্রতার যোগ সরাসরি, এই রূঢ় বাস্তবতা অতিসম্প্রতি দেখতে পাচ্ছি সুনামগঞ্জ ও সিলেট অঞ্চলে। এবারের নজিরবিহীন বন্যা ওই অঞ্চলের মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনায় সাধারণত দুর্যোগ মোকাবিলায় অভিযোজন ও প্রশমন ইত্যাদি সম্পর্কিত আলোচনাই বেশি থাকে, যা পদ্ধতিগতভাবে বেশ কিছুটা তাত্ত্বিক কিন্তু বেশি আলোচিত হওয়া উচিত এর ফলাফল নিয়ে, এবং এর কেন্দ্রে থাকা মানুষদের নিয়ে, অবশ্যই যারা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী তাদের নিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় এই জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল, জীবন-জীবিকা ও জীবনধারায় ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসতে বাধ্য করে। আর প্রয়োজনীয় সহযোগিতার অভাবে ধীরে ধীরে তারা দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্রতর হয়। আর এ অবস্থাই তাকে সম্ভাবনাময় সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রাণীর পক্ষান্তরে জীবন রক্ষায় অর্থনৈতিক দাসে রূপান্তর করে। যার সহজ কিছু দৃষ্টান্ত নদীভাঙনের শিকার মানুষের শহরমুখিতায়, একইভাবে নোনাজলের প্রভাবে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর বাস্তুচ্যুত ও সহায়-সম্বলহীন হওয়া যেন এই বাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি। অন্যদিকে ঋতুচক্রের পরিবর্তন প্রচলিত কৃষি ও কৃষি-পদ্ধতির পরিবর্তন শুধু খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে না, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রান্তিকতা তৈরি করছে। আর এ বিষয়গুলো যতটা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত তার থেকে কোনো অংশে কম নয় মানবাধিকারের সঙ্গে এর যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া।
এ সময় সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে যাচ্ছে। এই পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে জলবায়ুগত পার্থক্য বিবেচনায় এগারোটি অঞ্চলে বিভক্ত এবং চৌদ্দটি বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ চিহ্নিত করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুনাম সারা পৃথিবীতে সমাদৃত। কিন্তু দুর্যোগ মোকাবিলা করে বেঁচে থাকা আর দুর্যোগ মোকাবিলা করে উত্তরোত্তর এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে কিছু সক্ষমতা ও সামর্থ্যগত পার্থক্য আছে। দুর্যোগ মোকাবিলা করে বেঁচে থাকাই যথেষ্ট না, বরং প্রশ্ন হচ্ছে দুর্যোগ মোকাবিলা করে মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকা যাচ্ছে কি না যেখানে এই জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় রসদ, সেবা ও এর কার্যকর ব্যবস্থাপনাই মুখ্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর যে অধিকারহীনতা তৈরি হয়, তার নিশ্চয়তা বিধান করাই জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আলোচনার মুখ্য বিষয় হওয়া উচিত। কারণ অধিকারহীনতাই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আরও বেশি প্রান্তিক করে তোলে। শুধু দুর্যোগের মধ্যে টিকে থাকা না, ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ আবাসন, কর্মসংস্থান ও কৃষি, সুপেয় পানি ইত্যাদির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে এবং এজন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। এখানেই ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর প্রতি ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সামনে চলে আসে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী না হলেও এরাই সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী।
আমরা সবাই জানি বিশ্বের ধনী দেশগুলো গত ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রকৃতির নির্বিচার শোষণের মাধ্যমে, শিল্পবিপ্লব নামক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনেছে। তাদের এই নির্বিচার
প্রকৃতিবিনাশী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন ত্বরান্বিত হচ্ছে এবং ভুক্তভোগী দেশগুলোর দরিদ্র জনগোষ্ঠী মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার শিকার হচ্ছে। আর এদের সহযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য দায়ী দেশগুলোকে জবাবদিহি করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো ক্ষতিপূরণ আদায়ে উন্নত দেশগুলোর কাছে দাবি করে আসছিল। এর অগ্রগতি সামান্য। তবে আশার কথা হলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর কিছুটা স্বীকৃতি আসতে শুরু করেছে। গত বছরের গ্লাসগো বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের সময়ে স্কটল্যান্ড সরকার সর্বপ্রথম ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সাহায্যের প্রস্তাব করে। সর্বশেষ অতিসম্প্রতি ডেনমার্ক জাতিসংঘের প্রথম সদস্য হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিপূরণ প্রদানে প্রতিশ্রুতি দেয়। তর পরও পুনঃপুন দাবি সত্ত্বেও উন্নত ও জীবাশ্ম জ্বালানি-সমৃদ্ধ দেশগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিযোজনে সহায়তার বিষয়টিতে যেমন সহযোগিতা করছে না, একই সঙ্গে ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টিও এড়িয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে এবারের (২০২২) সাধারণ পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনে জাতিসংঘের মহাসচিব তার ভাষণে উন্নত দেশগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোর ওপর বেশি বেশি কর আরোপের কথা বলেছেন, যাতে দুর্গত দেশগুলোকে সাহায্য করা যায়। তবে শুধু জীবাশ্ম কোম্পানিগুলোই একমাত্র সুফলভোগী না, ধনী দেশগুলোও এর সুফলভোগী। আবার এদের মধ্যে যে দেশগুলো ধীরে ধীরে কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বের হয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এদের অনেকেই আবার কয়লায় ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কয়লার মজুদ শুরু করেছে।
তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণে ধীরে ধীরে বহুপক্ষীয় উদ্যোগ কিছুটা হলেও সক্রিয় হচ্ছে। জাতিসংঘ এই প্রথম একজন বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়েছে যিনি জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মানবাধিকারের উন্নয়ন ও সুরক্ষা পর্যালোচনা করে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল এ প্রতিবেদন পেশ করবেন। গত ৪ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ এই বিশেষ প্রতিবেদক বাংলাদেশের বিভিন্ন জলবায়ু দুর্গত অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন। তিনি তার প্রাথমিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে তাদের বাড়িঘর ছাড়তে হচ্ছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য অঞ্চলে এবং আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করতে বাধ্য হচ্ছে। নারী, বয়স্ক ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তিনি তার প্রাথমিক প্রতিবেদনে যে সুপারিশ প্রদান করেছেন সেখানে বলেছেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কিত একটি তহবিল গঠন করা দরকার, পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে উন্নত দেশগুলো থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের পাশাপাশি এই জনগোষ্ঠীর প্রতি দেশ ও সরকারের ভূমিকাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আর এজন্য ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীকে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হচ্ছে সেটা যেমন বিবেচ্য, পাশাপাশি তাদের জন্য পরিকল্পনা কী তাও বিশেষভাবে বিবেচনা পাওয়ার দাবি রাখে। আর এখানেই তাদের জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের বিষয়টি সামনে চলে আসে। এবারের সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা কিংবা উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণে মানুষের সম্পদের যে ক্ষয়ক্ষতি তা মোকাবিলায় বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য ওই অঞ্চলের সেবা সংস্থাসমূহকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যে তারা জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে তো পারবেই পাশাপাশি প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে কাক্সিক্ষত পরিবর্তনের পথ নিশ্চিত করবে।
লেখক : উন্নয়নকর্মী
আমাকে যারা একটু-আধটু চেনেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে সামান্য হলেও আমার লেখালেখির সঙ্গে পরিচিত, তারা জানেন বাম রাজনীতির প্রতি আমার কিঞ্চিৎ দুর্বলতা আছে। আমি এখনো বিশ্বাস করি, পুঁজির বল্গাহীন অত্যাচারের বিরুদ্ধে একমাত্র বামপন্থাই জনতাকে স্বস্তি দিতে পারে।
তবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই, আমি যান্ত্রিকভাবে বামেদের যাবতীয় বিষয়কে মেনে নিই। বামেদের বলতে আপাতত আমি পশ্চিমবঙ্গের মূলধারার বামেদের কথা বলছি। কয়েক বছর আগে দেয়ালে লেখা হতো ‘মার্ক্সবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ ইহা বিজ্ঞান।’ এ ধরনের উদ্ভট স্লোগান দেওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই ৩৪ বছরের বাম শাসন আক্ষরিক অর্থেই তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল।
কিছুমাত্র রাজনৈতিক দিশা ছাড়াই রাজ্যের ক্ষমতা দখল করল কংগ্রেসের ভেতরের চরমপন্থি অংশ। তৃণমূল ক্ষমতায় এলো স্রেফ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তি ক্যারিশমা ও অন্ধ সিপিআই এম বিরোধিতাকে কাজে লাগিয়ে। এখনো তৃণমূল কংগ্রেসের মূল শক্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন মোহিনী ভাবমূর্তি। এবং নিশ্চিতভাবেই কিছু কিছু সামাজিক প্রকল্প গ্রাম স্তরে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু হালে মমতার অতি বড় সমর্থকও স্বীকার করবেন তৃণমূল কিছুটা হলেও আজ ব্যাকফুটে।
তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে, সিবিআই, ইডি, এনআইএ প্রমুখ কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্সি রাজনৈতিক স্বার্থে তৃণমূল দলকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে, যা কিছুটা ঠিক, তাহলেও গ্রামে-গঞ্জে, মফস্বলে তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতি যে চরমে উঠেছে তা একটু-আধটু খোঁজ করলেই জানা যায়। তার সঙ্গে প্রবল হয়ে উঠেছে ঔদ্ধত্য ও সীমাহীন স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা।
তার ওপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইদানীং অনেক কর্মসূচিতেই যেভাবে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি প্রকট হচ্ছে, তাতে তৃণমূলের বড় শক্তি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে এরই মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। মুসলমানদের আরও খারাপ লেগেছে ছাত্রনেতা আনিস খানকে যেভাবে রাতের অন্ধকারে বাড়ি ঢুকে খুন করা হলো, হিন্দু বা মুসলমান বলেও নয়, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে ভালো নয়, তা চোখ-কান খোলা রাখলে যে কেউই বুঝবেন।
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠবেই যে, পরের বিধানসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফের ক্ষমতায় আসতে পারবেন কি না! বিধানসভা ভোটের অবশ্য অনেক দেরি আছে। ছাব্বিশ সালে। তার আগে সেমিফাইনাল চব্বিশ সালে। লোকসভা ভোট। তারও আগে, সামনের বছর পঞ্চায়েত নির্বাচন। গ্রামের মানুষ যেদিকে, ক্ষমতাও সেদিকে; এ রকম একটা কথা অনেক দিন ধরেই এ রাজ্যে চালু রয়েছে। ফলে পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল আগামী দিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে অল্প হলেও একটা আভাস দেবে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে যদি তৃণমূল হারে তাহলে কি বিজেপি ক্ষমতায় আসবে! দেখুন, বহুদিন ধরে মিডিয়ায় আছি। ঠান্ডা ঘরে না বসে গ্রামে গ্রামে ঘুরে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে যেটুকু যা বুঝছি, তাতে বিজেপি এ রাজ্যে আসবে না। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারাও তা বোধহয় চান না। বরং ঔপনিবেশিক কায়দায় জো হুজুর কাউকে রাজ্যে বসিয়ে নিজেদের এজেন্ডা হাসিল করলে লাভ বেশি এটা বিজেপির মূল চালিকাশক্তি সংঘ পরিবারের নেতৃত্ব বোঝেন। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবির পরেও আরএসএস নেতারা খোলাখুলি বলেছিলেন যে বিজেপি না জিতলেও আমরা চিন্তিত না। দেখতে হবে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি জিতেছে কি না!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এরই মধ্যে বলতে শুরু করেছেন যে আরএসএসএ অনেক ভালো লোক আছেন। এমনকি নরেন্দ্র মোদি ভালো। অমিত শাহ খারাপ এসব ভুলভাল কথাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন। আবেগের তোড়ে অথবা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে তিনি ভুলে গেছেন ব্যক্তি নয়, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির কাছে বিপদ সংঘ পরিবারের মতাদর্শ।
তা ছাড়া বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে এখনো তেমন কোনো শক্তি নয়। তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিজেপি কাগুজে বাঘ। তাকে প্রবল পরাক্রমশালী আসল বাঘ করা দেখানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মিডিয়া। এ নিয়ে কোথাও কোনো সন্দেহ নেই। কোনোদিন কেউ শুনেছেন যে বিজেপির সামান্য আইন অমান্য কর্মসূচি বিভিন্ন চ্যানেলে লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে। পৃথিবীর কোথাও এমন হয়!
আসলে করপোরেট পুঁজি বিনিয়োগ করে মিডিয়াকে শাসকদের পুতুল করে তুলেছে। শাপে বর হয়েছে তৃণমূলের। বিজেপির জুজু দেখিয়ে মুসলিম ও ধর্মনিরপেক্ষ ভোটের একাংশকে সংহত করা সহজ হয়ে গেছে।
আমি দীর্ঘদিন অনেক বিষয়েই পশ্চিমবঙ্গের বামেদের সমালোচনা করি। তাদের অতিরিক্ত নরম সংসদনির্ভরতা বিরক্ত লাগে। তা ছাড়া তাদের, বিশেষ করে বামফ্রন্টের বড় শরিকের রাজত্বকালের শেষ দিকে অজস্র নেতিবাচক দিক জনমনে তাদের সম্পর্কে খুব খারাপ ইমেজ তৈরি করেছিল। আমার বাম বন্ধুরা ক্ষুব্ধ হবেন। তাও না বললে মিথ্যে বলা হবে যে নিজেদের কবর নিজেরাই না খুঁড়লে, হাজার যুক্তি থাকলেও বামেদের হটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রী হতে পারা সহজ ছিল না। বামেদের পাশ থেকে অনেক দিন ধরেই গরিব মানুষ মুখ ফেরাচ্ছিলেন। মুসলিম, আদিবাসী, দলিত জনগোষ্ঠীর বড় অংশ একদা ছিল সিপিআই এমের জন ভিত্তি। তাদের জায়গায় ক্রমে ক্রমে পার্টির নীতিনির্ধারক হয়ে উঠতে লাগল শহরের বাবু ভদ্দরলোকরা। পঞ্চায়েত, প্রশাসন হয়ে উঠল পার্টির কুক্ষিগত। পাড়ায় পাড়ায় পার্টি অফিস হয়ে উঠতে লাগল বিকল্প প্রশাসনিক দপ্তর।
তার সঙ্গে ছিল ছোট-বড়-মাঝারি নেতাদের অনেকের মধ্যে গগনচুম্বী অহংকার। পাশাপাশি আর এক বিষয় হয়ে উঠেছিল সিপিআই এমের পতনের কারণ। পার্টির মধ্যে রাজনৈতিক পড়াশোনা শিকেয় উঠেছিল। তৈলমর্দন ছিল দলে ওপরে ওঠার গুরুত্বপূর্ণ পথ। জনবিচ্ছিন্ন এই আমলাতান্ত্রিক দলকে সরাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব অসুবিধে হয়নি। পালাবদলের পরপরই রাতারাতি পার্টি কর্মী সমর্থক, এমনকি নেতাদের কেউ কেউ ভোল বদলে তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্য হয়ে গেলেন।
তাহলে দলে থাকলেন কারা? যারা পার্টি ও বাম মতাদর্শকে ভালোবাসেন তারা। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর যে বেনো জল চলে গেল তা একদিকে সিপিআই এমকে অনেক সংহত করেছে। গত নির্বাচনে বামেদের ভরাডুবি হয়েছে। তারা স্বাধীনতার পরে এই প্রথম একটি আসনেও জিততে পারেনি। তবুও আজ যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করেন, বামেদের অবস্থা কেমন! তারা কতটা রাজনৈতিক জমি পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে! আগামী নির্বাচনে তারা কতটা সফল হতে পারেন! জ্যোতিষী না। ওই বিদ্যের ওপর আস্থাও নেই, তাই সব প্রশ্নের উত্তর এখনই দিতে পারব না। কিন্তু এটা জোরের সঙ্গে বলতে পারি, এ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিরোধী পরিসরে ধীরে ধীরে উঠে আসছে সিপিআই এম ও তার জোট সঙ্গীরা।
মহম্মদ সেলিম সিপিআই এমের রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পরপরই দলটির মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সেলিমের নেতৃত্বে গোটা দল এখন যথেষ্ট উজ্জীবিত ভূমিকায় প্রায় প্রত্যেক দিন বহুবিধ কর্মসূচি নিয়ে জেলায় জেলায় প্রশাসনকে বেকায়দায় ফেলছে। মিছিল-মিটিংয়ে ভিড় হচ্ছে চোখে পড়ার মতো।
অনেক বামপন্থি বন্ধু আক্ষেপ করে বলেন, গ্রামের গরিবরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দান-খয়রাতির লোভে এখনো শত অন্যায় দেখেও ভোট দেবে সেই তৃণমূলকেই। ভুল। সম্পূর্ণ ভুল চিন্তা। শহরে বসে রাজনীতি করার ফলে জনচেতনা সম্পর্কে এই অজ্ঞতা। আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরি। গরিবের বড় অংশ মমতার দিক থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন। ভয়ে, আতঙ্কে তারা সেভাবে এখনো মুখ খুলতে পারছেন না। এমনকি মুসলিম ভোটারদের অনেকেই আজ বামমুখী হচ্ছেন। বিশেষ করে তরুণ, শিক্ষিত অংশ। মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে বুঝতে পেরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেশি বেশি করে চ-ীপাঠ থেকে দুর্গা পুজো, গঙ্গা সাগর মেলা, গণেশ চতুর্থী, রথযাত্রা, জগন্নাথ দেবের মূর্তি নির্মাণে মন দিচ্ছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অর্থনৈতিক নীতি আজ সব মহলেই সমালোচনার মুখে। ধমক-ধামক দিয়ে নিজেকে এখনো প্রাসঙ্গিক করে রাখলেও, ছবিটা বদলাচ্ছে। গ্রামে-গঞ্জে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া বৈছে, তা স্পষ্ট। এই মৃদু হাওয়াকে ঝড়ে পরিণত করতে সিপিআই এমকে আরও অনেক পথ যেতে হবে। পথ খুবই কঠিন। ভোট করতে তৃণমূল দেবে বলে মনে হয় না। তাদের হাতে আজ প্রচুর টাকা। এ দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় টাকা সময়ে নির্ণায়ক শক্তি হয়ে ওঠে। সিপিআই এমের সামনে নিরন্তর গণ-আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। আর দরকার লড়াকু কর্মীবাহিনী। ভোট লুট আটকাতে না পারলে হাজারো মিছিল-মিটিং কোনো কাজে আসবে না।
লেখক: ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক
বিভিন্ন সময় দেশে জনপরিসরে প্রশাসনিক নির্বাহী বা আমলাদের আচরণ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে কোনো কোনো ঘটনার খবর পরিবেশিত হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে নাগরিক পরিসর থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অঙ্গনেও তা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারকে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপর অনেকাংশেই নির্ভর করতে হয়। মূলত সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাদের ভূমিকাই থাকে মুখ্য। ফলে শাসনব্যবস্থায় দেশের রাজনৈতিক নির্বাহীরা বেশি মাত্রায় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওপর বা আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কাছাকাছি সময়েই দেশে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতিকদের সংঘাত নিয়েও রাজনীতিবিদ ও আমলাদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি দৃশ্যমান হয়েছে। এই বিভক্তি নিরসনে শীর্ষ পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ঘটনায় সাধারণ জনগণের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আচরণকে অনেকে ঔপনিবেশিক বলেও অভিযোগ করেন। ১৯৭৫ সালে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বলি, মনে রেখো এটা স্বাধীন দেশ। এটা ব্রিটিশের কলোনি নয়। পাকিস্তানের কলোনি নয়। ঘুণে ধরা ইংরেজ আমলের, পাকিস্তানি আমলের যে শাসনব্যবস্থা তা চলতে পারে না।’ মূলত আমলাদের সাধারণের সঙ্গে ঔদ্ধত্য ও দুর্নীতিগ্রস্ততার কারণে তিনি এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। সরকারি কর্তাব্যক্তিদের এসব আচরণ প্রকারান্তরে সরকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সম্প্রতি স্থানীয় প্রশাসনের বিশেষ করে কয়েকজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) আচরণ আবারও সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। রবিবার দেশ রূপান্তরে ‘টুর্নামেন্টের ট্রফি আছড়ে ভাঙলেন ইউএনও’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্রে জনপরিসরে সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণের বিষয়টি ফের সামনে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত শুক্রবার একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের সমাপনী বক্তব্যের সময় হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে উপস্থিত সবার সামনে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দলের ট্রফি আছড়ে ভেঙে ফেলেন আলীকদমের ইউএনও মেহরুবা ইসলাম। ঘটনার একটি ভিডিও ক্লিপ ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ইউএনওকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। এমন আচরণ করায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় একাধিক জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। যদিও ইউএনও দাবি করেছেন, ‘বক্তব্য রাখার সময় টাইব্রেকার নিয়ে হট্টগোল হচ্ছিল। ওরাই বলেছে ট্রফিটা ভেঙে ফেলা হোক। তাই ভেঙে ফেলা হয়েছে।’ পরিস্থিতি যাই হোক, প্রশ্ন হলো ইউএনও কি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জনসম্মুখে বক্তব্যদানরত অবস্থায় এ ধরনের আচরণ করতে পারেন? এই দৃশ্য কি সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরির শৃঙ্খলাবিধি ও ভাবমূর্তির সঙ্গে যায়? বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভীন তিবরীজি এ বিষয়ে বলেছেন, ‘এ রকম আচরণ করার কথা নয়। বিতর্ক থাকলে ট্রফি না ভেঙে নিজের হেফাজতে রেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারতেন।’ অন্যদিকে, বগুড়া সদরের ইউএনও সমর কুমার পালের বিরুদ্ধে এলজিইডির চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারীকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় এসএসসির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ইউএনও দীপক কুমার দেব শর্মাকে কারণ দর্শাও (শোকজ) নোটিস দেওয়া হয়েছে।
সরকারি কর্মকর্তারাই সময় ও প্রয়োজন অনুসারে তাদের চরিত্র এবং আচরণগত পরিবর্তন এনেছেন কালে কালে। অন্যদিকে, জনপ্রশাসনের সব ক্যাডার সার্ভিসের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের একাধিপত্য এবং অন্যান্য ক্যাডারের প্রতি বৈষম্যের বিষয়টি নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ ও হতাশা রয়েছে। এমন অভিযোগ রয়েছে যে, প্রশাসনের ক্যাডাররা অন্য ক্যাডার যেমন শিক্ষা, চিকিৎসা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মূল্যায়নই করেন না। অবশ্য দীর্ঘ ৩৯ বছর পর প্রশাসনিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে সব মন্ত্রণালয়ের অর্গানোগ্রাম হালনাগাদ করার প্রয়াস নিয়েছে সরকার। কিন্তু তার সুফল দৃশ্যমান নয়। যদিও আন্তঃক্যাডার তো বটেই, সেবা নিতে আসা সাধারণ জনগণ এবং জনপরিসরে আমলাদের বিশেষ করে স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের আচরণ কী হবে, সে বিষয়ে দেশে-বিদেশে তারা প্রশিক্ষণ নেন। তারপরও এসব প্রশিক্ষণ কেন ব্যর্থ হচ্ছে এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সৃষ্ট এসব আচরণগত সমস্যা বারবার কেন আলোচনায় আসছে তা নিয়ে ভাবতে হবে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্মকর্তাদের ‘আচার-ব্যবহারের’ বাস্তবভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে কেবল প্রশাসনের কিছু কর্তাব্যক্তির আচরণের জন্যই সরকারের অনেক ভালো উদ্যোগ নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে। ইউএনওদের অনেকে অভিযোগ করেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা শিক্ষা-সংস্কৃতি-আচরণে পশ্চাৎপদ। সেটা হতেই পারে, তবে কর্মকর্তাদের বুঝতে হবে জনপ্রতিনিধিরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত। ফলে তাদের সঠিক মূল্যায়ন করে এবং তাদের সঙ্গে নিয়েই সরকারের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম ঔপনিবেশিক মানসিকতামুক্ত, দক্ষ, মেধাসম্পন্ন ও সৃজনশীল জনপ্রশাসন গড়ার ওপর প্রধানমন্ত্রীও গুরুত্বারোপ করেছেন। মূলকথা হলো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নিজেদের ‘প্রশাসক’ আর জনগণকে তাদের প্রজা বা অধীনস্থ ভাবার মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে হবে। অন্য ক্যাডার, জনপ্রতিনিধি, সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলার মানসিকতা থাকতে হবে।
শনিবার ভয়াল ২৫ মার্চ, গণহত্যা দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে ১৯৭১ সালের এ দিন শেষে এক বিভীষিকাময় ভয়াল রাত নেমে এসেছিল। এদিন মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিট থেকে ১০টা ৩১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করা হবে।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন এবং সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে।
এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে গণহত্যা দিবসের ওপর আলোচনা সভা হবে। এ ছাড়াও সারা দেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গীতিনাট্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনের মিনিপোলগুলোতে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বাদ জোহর দেশের সব মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে সুবিধাজনক সময়ে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে।
বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মুছে দেওয়ার চেষ্টায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারপর ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে, তারই নাম অপারেশন সার্চলাইট।
এ অভিযানের নির্দেশনামা তৈরি করেন পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়। অনেক পরে, ২০১২ সালে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ নামে আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অ·ফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত সে আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়।
অপারেশন সার্চলাইট কীভাবে পরিকল্পিত হয়, ১৯৭১ সালের সেই স্মৃতিচারণ করে রাজা লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউজে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং সে অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। এ ছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চ‚ড়ান্ত করি।’ পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তার কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন অপারেশন সার্চলাইট।
যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সেই রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেপ্তার করা হলো আরও ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘরবাড়ি, দোকানপাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশান ভ‚মি।’
পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয় : ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত ১ লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্তে¡ও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সব সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। এদিন দুপুরের পর থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। হেলিকপ্টারযোগে তারা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস পরিদর্শন করে বিকেলের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসেন।
ঢাকার ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানাতে অবস্থানরত ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজীর জনসংযোগ অফিসারের দায়িত্বে থাকা সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থেও এ সংক্রান্ত একটি বিবরণ পাওয়া যায়। সিদ্দিক সালিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জেনারেল নিয়াজীর পাশেই ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অনুগত পাকিস্তানি হিসেবে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার চক্রান্ত তিনি খুব কাছে থেকেই দেখেছেন। ২৫ মার্চ, অপারেশন সার্চলাইট শুরুর মুহ‚র্ত নিয়ে তিনি লিখেন ‘নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এমন আঘাত হানার নির্ধারিত মুহ‚র্ত (এইচ-আওয়ার) পর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল। নরকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল।’
পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।