
বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা কী? প্রশ্নটির সহজ উত্তর, ‘রাজনৈতিক’। রাজনৈতিক সমস্যা অস্বীকার করা যাবে না। পাশাপাশি বহু নিপীড়নমূলক সমস্যার জালে দেশবাসী জড়িয়ে পড়েছে। সেসব সমস্যাও অগুরুত্বপূর্ণ নয়। সব সমস্যার মূলেই রাজনৈতিক সমস্যা; সেটা স্বীকার করতেই হবে। রক্তাক্ত একাত্তরের বিজয়ের পর কেটে গেল পঞ্চাশ বছর। যুদ্ধ শেষে দেশবাসী যে স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার পূর্ণতার সম্ভাবনা দেখেছিল আমাদের জাতীয়তাবাদী শাসকরা, তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলেছে। জনগণ মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে মুক্তি পাবে বলে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। বাস্তবে জনগণের সেই কাক্সিক্ষত স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে। সাবেকি ব্যবস্থা তো বদল হলোই না। বিপরীতে আরও আঁটসাঁট বেঁধে গণবিরোধী সেই ব্যবস্থা জাতির স্কন্ধে জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেপে বসেছে। শাসক বদল ছাড়া রাষ্ট্রযন্ত্র অপরিবর্তিত থাকায় রাষ্ট্রের চরম প্রতিপক্ষ এখন জনগণ। যদিও আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রের একচ্ছত্র মালিকানা জনগণের ওপর ন্যস্ত। বাস্তবতা ঠিক বিপরীত। জনগণ এই রাষ্ট্র ব্যবস্থাধীনে প্রজা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। তাই প্রজা শোষণ চলছে অবিরাম, অব্যাহত গতিতে।
স্বাধীন রাষ্ট্রে সাবেকি ব্যবস্থার অধীনে জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক অধিকার কোথায় সুরক্ষা পেয়েছে? মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে জাতীয়তাবাদীদের প্রয়োজন-গুরুত্ব দুই-ই ফুরিয়েছিল। দেশ ও জনগণের স্বপ্নপূরণে জাতীয়তাবাদীদের ব্যর্থতা এবং সমাজতন্ত্রের অভিমুখে অগ্রযাত্রায় সব সম্ভাবনাকে পিষ্ট করে জাতীয়তাবাদীরা শাসনক্ষমতার লাগাম নিজেদের অধীনে টেনে ধরে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষারই কবর রচনা করেছে। শোষণ-বঞ্চনার শিকার দেশবাসী ধারাবাহিকভাবে ৫০ বছর ধরে শোষণ-নিপীড়নের শিকার হয়ে এসেছে। ক্ষমতা এবং একমাত্র ক্ষমতা পেয়েই জাতীয়তাবাদীরা মহানন্দে দেশ-জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার তোয়াক্কা না করে শ্রেণি স্বার্থকে প্রধান করে তুলেছে। আমাদের পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতার বদৌলতে নানা ঘৃণিত পন্থায় অর্থ-বিত্তের বৈভবে বুর্জোয়ায় পরিণত হয়েছে সত্য। তবে বুর্জোয়া ব্যবস্থাধীনে যে প্রক্রিয়ায় বুর্জোয়াদের বিকাশ ঘটে আমাদের দেশে কিন্তু সে রূপে বুর্জোয়া বিকাশ ঘটেনি। লুণ্ঠন, দখলদারি এবং সীমাহীন দুর্নীতির আশ্রয়ে শাসক শ্রেণির ছাতার নিচে নিরাপদ আশ্রয়ে আমাদের দেশে বুর্জোয়া বিকাশ ঘটেছে। যাদের অনায়াসে লুণ্ঠনকারীই বলা যায়।
রাজনৈতিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ঘটেনি বলেই সেই সমস্যা ক্রমেই বহু সমস্যার জন্ম দিয়েছে। আর সব সমস্যার খেসারত দিয়ে যাচ্ছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। আমাদের শাসকশ্রেণি মাত্রই জাতীয়তাবাদী রূপে নিজেদের অভিহিত করে থাকে। নির্বাচিত এবং উর্দিধারী প্রতিটি শাসকই নিষ্পত্তি হওয়া তথাকথিত জাতীয়তাবাদের মোড়কে-আশ্রয় নিয়েছে। একাত্তরে জাতীয়তাবাদীদের প্রয়োজনীয়তা শেষ হলেও ক্ষমতার জোরে জাতীয়তাবাদের রক্ষাকবচ ঢাল শাসকদের প্রত্যেকের কাছে শোভা পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে মৌলিক অবস্থানে তাদের ভিন্নতা নেই। অথচ প্রকৃত জাতীয়তাবাদী মাত্রই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। কিন্তু আমাদের জাতীয়তাবাদী শাসক দলগুলো চরমভাবে সাম্রাজ্যবাদের আনুগত্যের নজির স্থাপন করেছে। দেশ-জনগণের এবং জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে; সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রতিনিধি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে। এই হেন ও হীন জাতীয়তাবাদী নামধারী শাসকগোষ্ঠী পৃথিবীতে কমই দেখা যাবে। সাম্রাজ্যবাদীদের অনুগ্রহ পেতে পরস্পর প্রতিযোগিতায় পর্যন্ত লিপ্ত। কে কত বেশি আনুগত্যে দেশের স্বার্থ বিকোতে সক্ষম এ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাদের সামান্য দ্বিধা সংকোচ নেই।
সম্প্রদায়গত চেতনায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধীনতা বরণ করে নেওয়া তৎকালীন পূর্ববাংলার মানুষের দ্রুতই স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছিল। তেইশ বছরের লাঞ্ছনা-বঞ্চনার অবসানে প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা। দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ, আত্মদানে পাকিস্তানি সামরিক শক্তিকে পরাভূত করে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হলো তার প্রধান ও একমাত্র উপলক্ষ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা। অথচ সম্প্রদায়গত চেতনা ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার চেতনায় এই ভূখণ্ড দুবার স্বাধীন হলেও, জনগণের মুক্তি অর্জন অধরাই রয়ে গেছে। সম্প্রদায় এবং জাতীয়তা আমাদের মুক্তি দিতে ব্যর্থ সেটা তো প্রমাণিত। সশস্ত্র বিজয় অর্জনের পর সমাজতন্ত্রের অভিমুখে আমাদের অগ্রযাত্রার সম্ভাবনা অঙ্কুরেই ক্ষমতাসীন জাতীয়তাবাদীরা বিনাশ করে জাতির অগ্রযাত্রাকে নষ্ট করেছে। সমাজতন্ত্রের পথেই আমাদের মুক্তি লাভ সম্ভব। অন্য কোনো উপায়ে যে নয়; তা-বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অথচ সমাজতন্ত্রের উপযোগী-উর্বর এই দেশে সমাজতন্ত্রের বিকাশ লাভ সম্ভব হলো না। কেন হলো না? এ প্রশ্নও অমূলক নয়।
সমাজতন্ত্রের অভিযাত্রায় সমাজতান্ত্রিক দল-সংগঠনের গুরুত্ব সর্বাধিক। সমাজতান্ত্রিক দলের পক্ষেই সম্ভব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে অগ্রগামী করে তোলা। জনগণকে আন্দোলনের পক্ষে এককাতারে নিয়ে আসা। আমাদের দেশে সমাজতান্ত্রিক দলের তালিকা ক্ষুদ্র নয়। বরং তালিকা দীর্ঘ। কিন্তু সাংগঠনিক আকারে-আয়তনের ক্ষেত্রে হতাশাজনক পরিস্থিতি বিরাজমান। এক ব্যক্তি বিশিষ্ট সমাজতান্ত্রিক দলও দেশে রয়েছে। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে প্রমাণ দেওয়াও অসাধ্য নয়। প্রশ্ন থেকে যায়, সবার লক্ষ্য যদি জনগণের মুক্তিই হয়ে থাকে; তবে কেন এই বিভক্তি? প্রকৃত কারণটি আমার ক্ষুদ্র চিন্তায়এক, আমাদের সমাজতান্ত্রিক নেতৃত্ব মধ্যবিত্তের শ্রেণি-চেতনায় নিমজ্জিত। তারা শ্রেণিচ্যুত হতে পারেনি। দুই, নেতৃত্বের লোভে দল ভেঙে দল গড়ার প্রবণতাও প্রবলভাবে দৃশ্যমান। নিজে দলনেতা হওয়ার অভিলাষে দল ভাঙে-গড়ে। দলের শক্তিমত্তার প্রশ্নে নির্লজ্জতা তাদের চিন্তাজগতে সামান্যতম রেখাপাত করে না। তিন, জনসম্পৃক্ততার বিপরীতে জনবিচ্ছিন্ন প্রবণতাকেও দায়ী করা যায়। দোকান খুলে পসরা সাজিয়ে ব্যবসা করার ন্যায় অফিস ভাড়া করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে ব্যাঙের ছাতার ন্যায় দেশে সমাজতান্ত্রিক দলের তালিকা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সংকীর্ণ বৃত্তে হাবু-ডুবু খাচ্ছে। আন্দোলনের কর্মপন্থাসহ ক্ষুদ্র বিষয়ে মতপার্থক্য থাকতেই পারেসেটা বৃহত্তর ক্ষেত্রে বা প্রধান বিষয়ে নিশ্চয় নয়। কিন্তু ক্ষুদ্র মতপার্থক্য এড়িয়ে বৃহত্তর বাম আন্দোলন গড়ে তোলা অসম্ভবও নয়।
আমাদের বামপন্থিদের একটি বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে; আমাদের শাসক বুর্জোয়া দল কখনো বামপন্থিদের শত্রু ছাড়া বন্ধু নয়। দক্ষিণপন্থিদের বন্ধু ভাবা মানেই সমাজ বিপ্লবের চরম শত্রুদের কাছে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ করা। এমন আত্মসমর্পণকারী কোনো বাম দলই প্রকৃত বামপন্থি নয়। তারা ডানপন্থিদের চেয়েও অধিক প্রতিক্রিয়াশীল। আমাদের পতিত বামদের শাসক দলে যুক্ততায় বাম আন্দোলনের ক্ষতি নিশ্চয় হয়েছে। তবে পতিতদের শেষ সীমা ওই পর্যন্তই তার বেশি নয়। ওখানেই তাদের সলিলসমাধি।
বিভেদ-মতপার্থক্য এড়িয়ে মতাদর্শিক ঐক্যেই সমাজ বিপ্লব সম্ভব। যারা নিজেদের বিপ্লবী-সমাজতন্ত্রী মনে করেন; তাদের সমাজ বিপ্লবে দ্বিধা থাকলে তো সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের ভবিষ্যৎ আলোর পথে কখনো অগ্রসর হবে না। জাতীয়তাবাদী ডানপন্থি-ধর্মান্ধ মৌলবাদী অপশক্তি যূথবদ্ধভাবেই শাসনক্ষমতায় নিরঙ্কুশ থাকবে। এদের পরাভূত করার জন্য নিজেদের প্রস্তুতির প্রধান লক্ষ্য মতাদর্শিক ঐক্য। এই ঐক্যই শাসক শ্রেণিকে পরাভূত করে গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ সমতার বাংলাদেশের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হবে। আমরা দেশপ্রেমিক সেই শক্তিসমূহের ঐক্য প্রত্যাশা করি। প্রত্যাশা করি বিদ্যমান ব্যবস্থা বদলে জনগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রকৃত মুক্তি। সেই মুক্তি না-ঘটলে আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থার জাঁতাকলে পেষণের হাত থেকে মুক্তির আর উপায় থাকবে না।
বিপ্লবে আস্থাবান, মতাদর্শে অবিচল বৃহত্তর বাম ঐক্যেই বিদ্যমান অপব্যবস্থার বদল সম্ভব। ভোটের রাজনীতি অনিবার্যরূপে শাসক শ্রেণির রাজনীতি। সে রাজনীতি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার নয়। ক্ষমতার হাত বদলের রাজনীতি। সেটাও তথাকথিত জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া দলের অর্থ, পেশিশক্তি, রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় দল ও শ্রেণির ক্ষমতা লাভের রাজনীতি। জনগণের ভোটের প্রয়োজন ছিল; এখন সেটিরও প্রয়োজন নেই। ক্ষমতায় থেকে ভোট বা নির্বাচন প্রহসনের নাটক চলছে দেশের প্রতিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। নির্বাচনে অতীতে কিংবা অদূর ভবিষ্যতে জনগণের মুক্তি আসেনি। আসবেও না। একমাত্র বিকল্প পথটি হচ্ছে জনসম্পৃক্ত সমাজ বিপ্লব। সে পথটিই জনগণের মুক্তির একমাত্র পথ। সে পথেই বামপন্থি-সমাজতন্ত্রীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তার আগে চিনতে হবে প্রকৃত শত্রু এবং মিত্রকে। শত্রু-মিত্র চেনার ক্ষেত্রে ভুল করলে সমাজ বিপ্লব কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। তাই ঐক্য যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি শত্রু ও মিত্র চিহ্নিতকরণও।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক নতুন দিগন্ত
প্রাণজগতে শোক কিংবা সুখ সকলি স্মৃতি-বিস্মৃতির পাঠ। সেই তিন লাখ থেকে তিরিশ হাজার বছর ধরে প্রজাতি হিসেবে মানুষ স্মৃতি আঁকড়ে বা মুছে বড় হয়েছে। বিবর্তনের দীর্ঘধারায় সব মানুষের সমাজই শোকবিহ্বল হয়েছে। ইরেকটাস, ডেনিসোভান, ফ্লোরিয়েনসিস, নিয়ানডার্থাল কিংবা আজকের এই স্যাপিয়েন্স আমরা সবাই অগণিত শোকের সাক্ষ্য বহন করে চলেছি। শুধু কী মানুষ; শামুক, মৌমাছি, বনরুই, তরুলতা কিংবা তিমিরও আছে শোক-দিনলিপি। মানুষ কত কী কারণে শোককাতর হয়, তবে সব শোকের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কোনো না কোনো স্মৃতি। চলতি আলাপখানিও এক গাছের স্মৃতিকে ঘিরে শোকগাথা। গাছটির জন্ম বা নিবাস এই ভূগোলে নয়।
প্রাকৃতিকভাবে এর বিস্তারও ঘটেনি বাংলাদেশে। কিন্তু দীর্ঘসময় এই গাছ বনের ভেতর দাঁড়িয়ে ছিল একা। গড়ে তুলেছিল কত কল্পকথা কী স্মৃতিভা-। ‘আফ্রিকান টিক ওক’ নামে এই গাছ টিকে ছিল লাউয়াছড়া বনে। বনবিভাগের সূত্র উল্লেখ করে সম্প্রতি গণমাধ্যম জানাচ্ছে শেষ গাছটিও মরে গেছে। জানা মতে, লাউয়াছড়া বনে এই গাছ ছিল দুটি। ২০০৬ সালের ঝড়ে অন্যটি নিহত হয়। সদ্যপ্রয়াত এই গাছটির সঙ্গে আমার কিশোর ও তরুণ বয়সের বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। একটা লম্বা সময় পর্যন্ত গাছটি ‘ক্লোরোফরম গাছ’ হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। লম্বা এই গাছের তলে গেলে মাথা ঝিম ঝিম করে কিংবা এর পাতা নাকে-মুখে লাগলে মানুষ অচেতন হয়ে যায়, এমন কল্পকথা প্রচলিত হয়েছিল গাছটি ঘিরে। তখনো লাউয়াছড়ায় পর্যটকের ঢল নামেনি। শ্রীমঙ্গল বা তার আশপাশের কিছু উৎসাহী পরিবার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাসফরে আসা মানুষদের কাছে এই গাছ ছিল লাউয়াছড়ার অন্যতম নিদর্শন। লাউয়াছড়া বনের বুক ফালি করে যাওয়া রেললাইন পেরিয়ে বামের মোড়ের গাছটি নিয়েই ছিল সবার উৎসাহ। আর সদ্যপ্রয়াত লাউয়াছড়ার রাস্তার ছড়ার ধারের গাছটি যেন অনেকটাই ছিল আড়ালে। ডাকবাংলো, বন গবেষণার নার্সারি বা লাউয়াছড়া খাসিপুঞ্জি যতবার গেছি এই গাছ সাক্ষী হয়েছিল।
গাছটির সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ১৯৯২ সালের দিকে। আমরা জানতাম এটি ক্লোরোফরম গাছ। এমনকি টিনের পাতে এমন নামও লেখা ছিল। বহুবার গাছের তলে গিয়ে পরীক্ষা করেছি। কুড়িয়ে নিয়েছি ঝরাপাতা। বহুবার মনে হয়েছে শরীর ঝিমঝিম করছে, হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাব। কিন্তু কখনো তা ঘটেনি, কারও কখনো ঘটেছে কি না তাও শুনিনি। অনেক পরে গাছটির সঠিক উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম টানানো হয়েছিল। গাছটিকে ‘ক্লোরোফরম গাছ’ ভাবার একটা কারণ ছিল বৈকি। এমনিতেও এক অচেনা গাছ, তার ওপর এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ‘ক্লোরোফ্লোরা একসেলসা’। শুনেছি বনবিভাগের স্থানীয় প্রতিনিধিরা গাছটির উদ্ভিদতাত্ত্বিক নামের প্রথম অংশকে ভুল করে ‘ক্লোরোফরম’ করে ফেলেন আর গাছটিও ‘ক্লোরোফরম গাছ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। মাত্র দুটি হলেও সব বিবেচনায় ভিনদেশি এই গাছ দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি হয়ে ওঠে। এখন লাউয়াছড়া বন ১৬৭টি প্রজাতি থেকে একটি প্রজাতি হারাল। একটি প্রাণপ্রজাতির মৃত্যু মানে বাস্তুতন্ত্রের এক বিশাল শূন্যতা। লাউয়াছড়া বনের ক্ষেত্রে এই গাছের পরিবেশগত অবদান কতখানি তা আমরা খতিয়ে দেখিনি, কিন্তু এর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তৈরি হয়েছিল। জানা যায়, ১৯৩০ সালের দিকে এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা নাকি গাছটির চারা লাউয়াছড়াতে নিয়ে আসেন। সে সময় প্রাকৃতিক বনের অনেক গাছ কেটে চাপালিশ, সেগুন, গর্জন, লোহাকাঠ, রক্তন চারাও লাগানো হয়। তার মানে এই গাছ ছিল লাউয়াছড়ার শত বছরের সাক্ষী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, নানকার বিদ্রোহ, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে। শত বছরের মহামারী দেখেছে। জুলভার্নের ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’ কিংবা হুমায়ূন আহমেদের ‘আমার আছে জল’ সিনেমার শ্যুটিং দেখেছে। ১৯৯৭ সালে লাউয়াছড়া বনে অক্সিডেন্টালের অগ্নিকা- সয়েছে। দেখেছে গ্যাস জরিপের নামে ইউনোকল কী শেভরন কীভাবে লন্ডভন্ড করেছে লাউয়াছড়া বন। বাংলাদেশে এমন প্রজাতি আর কটিই বা আছে, যা কোনো প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রে স্মৃতিময় হয়ে দীর্ঘজীবন পার করছে। দেশের শেষ ‘আফ্রিকান টিক ওক’ গাছটির মৃত্যুর খবর বহু প্রশ্নকে সামনে টেনে এনেছে। মানুষ বা বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হলে চিকিৎসক বা অভিজ্ঞজন পরীক্ষা করে মৃত্যুর খবর জানান। কিন্তু একটি গাছের মৃত্যু বিষয়ে আমরা কীভাবে নিশ্চিত হই? হাতি, বাঘ, ডলফিন, কুমির বন্যপ্রাণী মারা গেলে ময়নাতদন্ত হয়। কিন্তু গাছের কী ময়নাতদন্ত হয়? তাহলে আমরা নিশ্চিত হই কীভাবে একটি গাছ মারা গেছে। গণমাধ্যমে প্রচারিত লাউয়াছড়ার শেষ ‘আফ্রিকান টিক ওক’ গাছটির মৃত্যুর খবরও এসব চিন্তাকে সামনে আনছে। কে, কারা, কীভাবে কোন পরীক্ষা-পদ্ধতির মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছেন গাছটি মারা গেছে তা জানা এবং এর কারিগরি জানা জরুরি। একটি গাছে হয়তো পচন ধরেছে বা রোগাক্রান্ত হয়েছে, ডালপালা শুকিয়ে যাচ্ছে, আগা মরে যাচ্ছে, পুষ্প-পল্লব ঝরে পড়ছে এসব হয়তো সেই গাছটির মরণের দিকে যাওয়ার কিছু দৃশ্যমান নির্দেশনা। বইয়ের ভাষায় অঙ্গসংস্থানিক বৈশিষ্ট্য। একটি গাছের জীবনচক্রে বীজ থেকে অংকুরোগদম হয়ে শিশু চারাগাছ থেকে যৌবনকাল, বার্ধক্য ও মৃত্যুপর্যায় থাকে। একবর্ষজীবী, বহুবর্ষজীবী কিংবা প্রজাতিভেদে এই জীবনকাল ও চক্র ভিন্ন হয়। কিন্তু ‘আফ্রিকান টিক ওকের’ মতো কোনো বৃহৎ বহুবর্ষজীবী বৃক্ষের ক্ষেত্রে এর মৃত্যু সম্পর্কে কীভাবে আমরা নিশ্চিত হতে পারি? আবার এটি যখন দেশের কোনো পাবলিক বনের কোনো পাবলিক প্রাণসম্পদ হয়। আলোচ্য শেষ গাছটি কী মৃত্যুর দিকে যাত্রা করেছে নাকি তার মৃত্যু হয়েছে? তাহলে গণমাধ্যম কীভাবে এই গাছের ‘মৃত্যুসংবাদ’ প্রচার করছে? একটি হাতি বা তিমির ক্ষেত্রে প্রামাণ্য দলিল নিয়ে বেশ সতর্কতার সঙ্গে মৃত্যুসংবাদ পরিবেশিত হয়। তাহলে একটি গাছের মৃত্যুসংবাদের ক্ষেত্রে কেন এমন সতর্কতা ও প্রামাণ্য দলিল থাকবে না? তো আমরা প্রাণজগতের এক এক প্রাণপ্রজাতির সঙ্গে কেন একেক রকমের আচরণ করি? সকল প্রাণসত্তার বিকাশ ও বিস্তারের সমান অধিকার থাকলেও মানুষ কেবল তার প্রয়োজনকে বিবেচনা করে কোনো প্রজাতিকে বেশি মনোযোগ দেয় এবং কোনো প্রজাতি মনোযোগের বাইরে থেকে যায়। পরিবেশ-দর্শনে এ ধরনের চিন্তাপদ্ধতিকে বলে ‘প্রাণকেন্দ্রিক বা বায়োসেন্ট্রিক মতবাদ’। দেশের শেষ আফ্রিকান টিক ওকগাছের মৃত্যুসংবাদ পরিবেশনে আমাদের মনোজগতে প্রবল হয়ে থাকা বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। আশা করি দেশের প্রবীণ, স্মৃতিময় এবং স্মারকবৃক্ষের মৃত্যু নিশ্চিত ও এর সংবাদ পরিবেশনে আমরা প্রতিবেশ-পরায়ণ হব।
আফ্রিকা থেকে আসা
মোরাসি পরিবারের একটি গোত্র হলো মিলিশিয়া। আর এই গোত্রে দুনিয়ায় দুটি মাত্র প্রজাতি আছে। একটি হলো মিলিশিয়া এক্সসেলসা এবং অন্যটি মিলিশিয়া রেজিয়া। আফ্রিকায় এই গাছ ইরুকু, ইনটুলে, কামবালা, মোরেইরা, এমভুলে, ওডাম ও টুলে নামে পরিচিত। আর ‘মিলিসিয়া এক্সসেলসারই’ আগের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ছিল ‘ক্লোরোফ্লোরা এক্সসেলসা’। বৃহৎ এই পত্রঝরা গাছটি প্রায় ১৬০ ফুট দীর্ঘ হতে পারে। গাছের বাকল ধূসর রঙের এবং চিরলে দুধের মতো কষ গড়িয়ে পড়ে। পুরুষ গাছে সাদা ক্যাটকিন ও স্ত্রী গাছে পুষ্পকা- থাকে। ফল লম্বা ও ভেতরে ছোট ছোট বীজ থাকে। গাছটি মধ্য আফ্রিকার নানা অঞ্চলে জন্মে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাটির বৈশিষ্ট্য, বৃষ্টিপাত এবং আবহাওয়া গাছের ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গসংস্থানিক বৈশিষ্ট্য প্রদান করে। আফ্রিকার গিনিবিসাউ, মোজাম্বিক, অ্যাংগোলা, বেনিন, বুরুন্ডি, ক্যামেরুন, কঙ্গো, গিনি, ইথিওপিয়া, গ্যাবন, ঘানা, আইভরি কোস্ট, কেনিয়া, মালাউয়ি, নাইজেরিয়া, রুয়ান্ডা, সাউতমে প্রিন্সপে, সিয়েরালিওন, সুদান, তাঞ্জানিয়া, টোগো, উগান্ডা ও জিম্বাবুয়িতে বেশি দেখা যায়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে গাছে ফুল ফোটে। বাদুড়, কাঠবিড়ালি ও পাখি এই গাছের ফল খেয়ে বীজ বিসরণ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, বাদুড়সহ বন্যপ্রাণীর মাধ্যমে খাওয়া ফলের বীজ থেকেই এই গাছের বেশি অংকুরোদগম হয় এবং এসব চারা বেশ রোগ প্রতিরোধী হয়। প্রাকৃতিকভাবে এক গুরুত্বপূর্ণ কার্বন-আধার হিসেবে কাজ করে এই গাছ। আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ জোট আইইউসিএন ‘সংকটাপন্ন প্রায়’ হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। মূলত বাসস্থান হারানোর কারণেই গাছটি দুনিয়া থেকে উধাও হচ্ছে।
আফ্রিকা অঞ্চলে গরষরপরধ বীপবষংধ এবং গরষরপরধ ৎবমরধ এই উভয় বৃক্ষপ্রজাতির কাঠ ‘আফ্রিকান টিক’ নামে পরিচিত। যেমন আমরা সেগুন কাঠকে বলি ‘বার্মিজ টিক’। এই কাঠ খুব শক্তিশালী ও গাঢ় বাদামি বর্ণের। উইপোকা-প্রতিরোধী বলে স্থাপনা নির্মাণ, আসবাব, নৌযান, মেঝেতে ব্যবহৃত হয়। মাটির ক্ষয়রোধে এই গাছ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নাইট্রোজেন উৎপাদনকারী এ গাছের পাতা জৈব মালচিং হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গাছের বাকল কফ নিবারণী, হৃদরোগের চিকিৎসায়ও ব্যবহৃত হয়। গাছের কষ টিউমার, পাকস্থলী ও গলার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর কাছে এটি এক পবিত্র বৃক্ষ। সংরক্ষিত এই গাছের তলে উৎসর্গ ও সমর্পণমূলক কৃত্য পালিত হয়। বিশেষ করে গাছটি উর্বরতা ও নতুন জন্ম সম্পর্কিত কৃত্যের সঙ্গে জড়িত। দক্ষিণ নাইজেরিয়ার ইবো আদিবাসীরা বিশ্বাস করে এই গাছ নবজাতকের আত্মাকে সজ্জিত ও বিন্যস্ত করে। ঘানার হো অঞ্চলে এই গাছ বামনদের বাসস্থান হিসেবে গণ্য এবং এর তলে কৃত্য পালিত হয়। এই গাছের কাঠ পবিত্র বাদ্যযন্ত্র ও মৃতদেহের কফিন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। আইভরি কোস্টের গুয়েরে ও ঔবি আদিবাসীরা এই গাছের নিচে বলিদান করে। বাংলাদেশের লাউয়াছড়ায়ও কিন্তু এই গাছ ‘ক্লোরোফরম গাছ’ নামের এক কল্পকথার জন্ম দিয়েছিল। লাউয়াছড়ার পর্যটনে ভূমিকা রেখেছিল।
আহারে নিঃসঙ্গ গাছ!
বাংলাদেশে এমন বহু নিঃসঙ্গ গাছ আছে। কোনোটা অচিন আবার কোনোটা জানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি ভবনে যেমন টিকে আছে দেশের একমাত্র তালিপাম গাছ। বাইরে থেকে আসা কোনো প্রজাতি যদি কোনো বাস্তুতন্ত্রে প্রতিবেশগত বিশৃঙ্খলা তৈরি করে এবং স্থানীয় খাদ্যচক্রে সংকট ঘটায় তখন সেই প্রজাতিটি ‘ইনভেসিভ/এলিয়েন’ হিসেবে পরিগণিত হয়। আমি একে ‘আগ্রাসী প্রজাতি’ নাম দিই। ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২’ ‘আগ্রাসী’ প্রত্যয়টি গ্রহণ করেছে। ইউক্যালিপটাস, ম্যাঞ্জিয়াম, একাশিয়া, শিশু এমন আগ্রাসী প্রজাতির বিরুদ্ধে আমরা বহু বছর ধরে লড়ছি। নেত্রকোনায় ‘মেনকীফান্দা আন্দোলনের’ নেতা অজিত রিছিল আগ্রাসী জাতের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে জেল-জুলুম খেটেছেন। প্রতিটি প্রজাতিরই একটি জন্মভূমি বা ‘সেন্টার অব অরিজিন’ থাকে। যেমন বেগুনের জন্মভূমি বাংলাদেশ, আলুর পেরু, কৃষ্ণচূড়ার মাদাগাস্কার। দীর্ঘসময় কোনো প্রজাতি বাইরে থেকে এসে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রে খাপ খাইয়ে নেয় এবং খাদ্যশেকলের সহায়ক হয়ে ওঠে। আফ্রিকা থেকে এলেও আফ্রিকান টিক ওকগাছটি কোনোভাবেই একাশিয়া বা ইক্যালিপটাসের মতো এই দেশের বাস্তুতন্ত্রে আগ্রাসী নয়। তবে বন্যপ্রাণীর সঙ্গে এর সম্পর্ক এবং প্রতিবেশগত অবদান কতখানি তা গভীর অনুসন্ধান ও মূল্যায়নের বিষয়। বন্যপ্রাণী আইনে এ ধরনের গাছকে ‘স্মারকবৃক্ষ’ বলা হয়েছে এবং এর সংরক্ষণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
চিহ্ন সংরক্ষিত হোক
৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ গণমাধ্যমে গাছটির মৃত্যুর কিছু খবর প্রকাশিত হয়। ২০২২ সালের শুরুর দিকে ছড়ার পাড়ে টিকে থাকা এই গাছটির পাতা ঝরে যায় ও গোড়ায় পচন ধরে। আর এতেই ধারণা করা হচ্ছে গাছটি মারা গেছে। বনবিভাগ জানায়, বহু চেষ্টা করেও এর বংশবিস্তার করা সম্ভব হয়নি। গাছটির কোনো বীজ ছিল না এবং ফুল ধরলেও ঝরে পড়ে যেত। কাটিং করেও সফল হওয়া যায়নি। শেষ গাছটি মরে গেছে নাকি মরণের প্রান্তে এটি জানা জরুরি। আশা করি রাষ্ট্র দেশের শেষ আফ্রিকান টিক ওকগাছটি বিষয়ে মনোযোগী হবে। ২০০৬ সালে ঝড়ে উপড়ে পড়ার পর প্রথম মৃত গাছটির গুঁড়ি বনবিভাগ বেশ যতœ করে দর্শনার্থীদের জন্য রক্ষা করেছে। লাউয়াছড়ার পাশাপাশি জাতীয় জাদুঘর ও পাবলিক সংগ্রহশালায় শেষ গাছটির অংশবিশেষ স্মৃতিস্মারক হিসেবে সংরক্ষণ করা জরুরি।
লেখক : প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ গবেষক ও লেখক
আবুল মনসুর আহমদের যখন জন্ম তখন (১৮৯৮) এই অঞ্চলের মানুষ ধর্ম ও আত্মপরিচয় নিয়ে ছিল দ্বিধান্বিত। কে কোথা থেকে এসেছে, কী করবে, কী তার পরিচয়সেসব ভাবনার দোলাচলে বিশাল এক জনগোষ্ঠী। ফলত বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে আবুল মনসুরের জীবন ও কর্ম পরস্পর হাত ধরাধরি করে আছে শত বছর। তার সামাজিক রাজনৈতিক চিন্তাধারা জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রচিন্তাকে এগিয়ে নিতে সব সময় ভূমিকা রেখে আসছে। দেখা যায়, তৎকালীন সময়ে অনেক শিক্ষিত মুসলমানের মতোই বাংলার আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যময় পটভূমির সন্তান তিনি। স্বভাবতই দুই স্রোতে অবগাহন তার জন্য ভবিতব্যই হয়ে ওঠে। মেধার বিকাশ ঘটান প্রধানত সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও রাজনীতির ত্রিধারায়। তবে সাহিত্য ছিল তার রক্তে। হয়তো তাই এর প্রকাশ পায় কৈশোরে-তারুণ্যে।
রাজনৈতিক সচেতনতা, সমাজ ভাবনা, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার চোখ আবুল মনসুর আহমদকে দিয়েছে অনন্যতা। তাই তিনি রচনা করতে পেরেছেন ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’-এর মতো অসামান্য ইতিহাস। এটি ১৯২০ থেকে ১৯৭০ দশকের মধ্যবর্তী সময়ের একটি দলিল। তবে বইটি লেখা শেষ হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। স্বাধীনতার পর আরও কয়েকটি অধ্যায় জুড়ে দিয়ে ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত সময়টিকে ধরে রেখেছেন বইতে। এটা আমাদের দূর অতীতে নিয়ে যায়টানাপড়েনের দশকগুলোতে, যখন অবিরাম রাজনীতিতে ভাঙাগড়ার খেলা চলছিল।
এই বইয়ে আবুল মনসুর আহমদের অনেক ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং শ্রেণি-অবস্থানের জানান থাকলেও তা এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। তিনি এতটা নিখুঁতভাবে সময়কে তুলে এনেছেন তা খুব রাজনৈতিকই করেছেন। ফলে বাংলাদেশের শতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাস হোক কি কেবল গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস হোক, সূত্রগ্রন্থ হিসেবে ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ কাছে না পেলে ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি আসলে অনুসন্ধিৎসু ভাষ্যকার। তিনি সময়ের ইতিহাস লিখেছেন, দিয়েছেন নিজস্ব ভাবনাযোগে টীকা-টিপ্পনী।
বিশেষ করে পাকিস্তান কেমন রাষ্ট্র হবে তার স্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন পাকিস্তান জন্মের অনেক আগেই। ১৯৪৪ সালে আনুষ্ঠানিক সভায় সভাপতি হিসেবে তিনি বলেছিলেন : ‘পাকিস্তান দাবিটা প্রধানত কালচারাল অটনমির দাবি। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার চেয়ে কালচারাল অটনমি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই দিক হইতে পাকিস্তানের দাবি শুধু মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক দাবি নয়, এটা গোটা ভারতের কালচারাল মাইনরিটির দাবি। ভারতীয় মুসলমানরা হিন্দু হইতে আলাদা জাত তো বটেই, বাংলার মুসলমানরাও পশ্চিমা মুসলমানদের হইতে পৃথক জাত। শুধুমাত্র ধর্ম জাতীয়তার বুনিয়াদ হইতে পারে না।’ তার এই চিন্তাটি সাতচল্লিশে নয়, একাত্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে আমাদের কালক্রমে ঘটে যাওয়া বড় ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপট যার জানার জন্য বইটি দরকার।
অন্যদিকে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবুল মনসুর আহমদের পর্যবেক্ষণ ছিল একেবারে আলাদা। যেমন তিনি বলেছেন‘তিনশ পনেরো সদস্যের পার্লামেন্টে জনা-পঁচিশেক অপজিশন মেম্বার থাকিলে সরকারি দলের কোনোই অসুবিধা হইত না। বরঞ্চ ওইসব পার্লামেন্টারিয়ান অপজিশনে থাকিলে পার্লামেন্টের সৌষ্ঠব ও সজীবতা বৃদ্ধি পাইত।...বাংলাদেশের পার্লামেন্ট পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের একটা ট্রেনিং কলেজ হইয়া উঠিত। আর এসব শুভ পরিণামের সমস্ত প্রশংসা পাইতেন শেখ মুজিব।’ গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ লিখছেন‘স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদের মন্তব্য বেশ চাঁছাছোলা। বইজুড়ে আবুল মনসুর আহমদ এ ধরনের অনেক রূঢ় সত্য উচ্চারণ করেছেন সহজ-সরলভাবে’ বাংলাদেশের স্বাধীনতায় দ্বি-জাতিতত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, এমনটা তিনি মনে করেন না।
আবুল মনসুর আহমদের মতে, ‘এক পাকিস্তানের জায়গায় দুই পাকিস্তান হইয়াছে। ভারত সরকার লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নে আমাদের সাহায্য করিয়াছেন।...লাহোর প্রস্তাবে “পাকিস্তান” শব্দটার উল্লেখ নাই, শুধু মুসলিম মেজরিটি রাষ্ট্রের উল্লেখ আছে। তার মানে রাষ্ট্রের নাম পরে জনগণের দ্বারাই নির্ধারিত হওয়ার কথা। পশ্চিমা জনগণ তাদের রাষ্ট্র-নাম রাখিয়াছে “পাকিস্তান”। আমরা পুরবীরা রাখিয়াছি “বাংলাদেশ”। এতে বিভ্রান্তির কোনো কারণ নাই।’ এ রকম অসংখ্য তিক্ত সত্য তিনি বলেছেন। অন্যদিকে দেখা যায়, রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদের রাজনৈতিক জীবনকাল প্রায় চার দশক। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে ছিলেন। তবে শৈশবেই তার সাংবাদিকতা ও রাজনীতির হাতেখড়ি হয়। এতে ত্রিকালদর্শী জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে যশ ও খ্যাতি যেমন ছিল, তেমনি জুটেছিল সামরিক শাসনের কারা যন্ত্রণা। কর্মজীবনে তিনি মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নেতাজি সুভাষ বসু, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর, সৈয়দ নওশের আলী, খাজা নাজিমুদ্দিন, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মিঞা ইফতেখার উদ্দিন, মিঞা মাহমুদ আলী কাসুরী, জি এম সৈয়দ, মিঞা মমতাজ দৌলতনা, আবুল হাশিম প্রমুখ এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও নেতাদের সঙ্গে ছিল তার ব্যক্তিগত পরিচয় ও হৃদ্যতার সম্পর্ক। জনশ্রুতি আছে নেতাজি সুভাষ বসুর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল ‘তুমি’-‘তুমি’ পর্যায়ের। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শ্রদ্ধাস্পদ নেতা ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু সগৌরবে আবুল মনসুর আহমদকে ‘লিডার’ বলতেন এবং কলেজ জীবন থেকে নিজেকে তার শিষ্য বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
বিশ শতকের ষাটের দশকে আবুল মনসুর আহমদ সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও একজন রাজনৈতিক-বিশ্লেষক হিসেবে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতাকে বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। দেশের সংকট-সম্ভাবনায় এগিয়ে যাওয়ার নানান দিক গবেষণামূলক প্রবন্ধে অসামান্যভাবে তুলে ধরেছেন। ঐতিহাসিক সেসব প্রবন্ধ আজও প্রাসঙ্গিক রাষ্ট্রের প্রয়োজনে। তার আত্মজীবনীমূলক রচনাদি দেশীয়-আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-অধ্যয়নের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ টেক্সট হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ফলে আবুল মনসুর আহমদের জীবন থেকে দেখি : দেশপ্রেম বুকে নিয়ে সারাজীবন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন। তার দেখা সমাজের প্রতিটি অসংগতি নিয়েই কলম ধরেছেন। সময়ের বুকে পা রেখে কুয়াশা ভেদ করে দেখেছেন আলো। সর্বত্র বিচরণে দিনে দিনে তার কলম হয়ে উঠছে দুর্ধর্ষ। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের প্রেরণা জুগিয়ে, সবার মধ্যে দিয়েছে শুদ্ধচিন্তার খোরাক। স্বতন্ত্র কালচারের স্বপ্ন দেখে একাধিক গ্রন্থও রচনা করেন।
সর্বোপরি, গত শতকের সমাজ রাজনীতি বুঝতে ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি আবুল মনসুর আহমদের চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে দেখা। আর তাকে পাঠ করার মধ্য দিয়ে আমরা অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ পেতে পারি। আমাদের সমাজ-রাজনীতির চেহারা কেমন ছিল, কতটা পরিবর্তন হয়েছেপরিষ্কার ধারণা পাওয়া প্রয়োজন।
লেখক : কবি ও গবেষক
প্রতিদিনই সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। এসবে প্রাণ ও অঙ্গহানির তথ্য উদ্বেগজনক। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনা। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত আগস্ট মাসে সারা দেশে ৪৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫১৯ জন ও আহত হয়েছে ৯৬১ জন। সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনার পর অনেকরই রাগ ক্ষোভ গিয়ে পড়ে পরিবহন শ্রমিকদের ওপর। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা ও নানা সংকটের পেছনে আসলে শ্রমিকদের দায় কতটা সে বিবেচনা যেমন জরুরি, তেমনি পরিবহন শ্রমিকরা কতটা মানবেতর জীবনযাপন করেন এবং কতভাবে অধিকার বঞ্চিত হন সেই আলোচনাও জরুরি। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ চালকের অসুস্থতা হলেও বিষয়টি বরাবর উপেক্ষিত। শুধু প্রাণহানি নয়, কোটি কোটি টাকার গাড়িও নষ্ট হচ্ছে। তারপরও পরিবহন-মালিকদের এই বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। চালকদের স্বাস্থ্যগত বিষয়ে খোঁজ রাখেন না তারা। শ্রমিক নেতারা দায় চাপান সরকার ও গাড়ির মালিকদের ওপর।
বুধবার দেশ রূপান্তরে “৩৯ ভাগ গাড়িচালক ‘অসুস্থ’” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায়, দেশের পরিবহন-চালকদের ৩৯.৩৩ ভাগই রক্তে মাত্রাতিরিক্ত সুগার ও উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছে। সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ এটা। বিআরটিএ ও ঢাকা আহছানিয়া মিশনের উদ্যোগে ১৫০ জন বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার ও সিএনজি অটোরিকশাচালকের ওপর চালানো পরীক্ষায় জানা যায়, তাদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে মালিক বা শ্রমিক কোনো পক্ষেরই সচেতনতা নেই। চালকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফল ঘেঁটে দেখা গেছে, ৩৬ ভাগ চালকের রক্তে মাত্রাতিরিক্ত সুগার আর ২৪ ভাগের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। ১১ ভাগ চালকের মাত্রাতিরিক্ত সুগার ও উচ্চ রক্তচাপ উভয়ই রয়েছে। ৬০.৬৭ ভাগ চালকের রক্তের সুগার ও রক্তচাপ স্বাভাবিক ছিল। বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘আমাদের দেশের চালকরা বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যসমস্যা নিয়ে গাড়ি চালান। এটি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।’ চিকিৎসকরা বলেছেন, ‘কারও রক্তে সুগার মাত্রাতিরিক্ত কমে গেলে সেই ব্যক্তি হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে। রক্তচাপের সমস্যা থাকলে মাথা ঘুরতে পারে ও দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। রক্তচাপ খুব বেশি হলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ পর্যন্ত হতে পারে।’ আশঙ্কার কথা হচ্ছে, শারীরিক জটিলতার কথা এসব চালক পরীক্ষার আগে জানতেনই না। তারা না জেনেই গাড়ি চালাচ্ছেন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পরিবহন চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের শরীরে জটিলতা দেখা দিলে বিশেষ করে ঘাড়-মাথাব্যথা করলে তাদের ঘুম ভালো হয় না। গাড়ি চালানো অবস্থায় তাদের অনেকের ঝিম ধরে। অনেক চালক গাড়ি চালানো অবস্থায় ক্লান্ত হয়ে দুর্ঘটনায়ও পড়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চালকদের শরীর গাড়িচালানোর উপযোগী আছে কিনা তা দেখার কোনো সিস্টেম নেই। বিষয়টি দেখে বিআরটিএ ও শ্রমিক ফেডারেশন।’ অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় চালকদের দায়ী করা হলেও তাতে মাদকাসক্তিকেই কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিআরটিএও চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার সময় ডোপটেস্ট নিয়েই দায় সারে। জাতীয় সড়ক পরিবহন মোটর শ্রমিক ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট মোস্তাকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা বাংলাদেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। সরকার বা গাড়ির মালিকরা এই বিষয়ে কখনো ব্যবস্থা নেয়নি।’
দুয়েকটি পরিবহন কোম্পানির ছাড়া বাসচালক-শ্রমিকদের প্রায় কারোই নির্দিষ্ট বেতনভাতা নেই, নেই নিয়োগপত্র কিংবা চাকরির অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা। বেতন না থাকায় মালিকের বেঁধে দেওয়া আয়ের লক্ষ্য পূরণে দৈনিক প্রায় ১৮-২০ ঘণ্টার বিশ্রামহীন কাজের চাপ, শরীর চাঙ্গা রাখতে মাদকে জড়ানো, নিম্ন মজুরি, কাজের অনিশ্চয়তা, মালিক-যাত্রী-প্রশাসনের লাঞ্ছনা, অর্থকষ্ট, অনিশ্চিত জীবন, শেষ জীবনে দুর্গতি, পারিবারিক অশান্তিসহ এক টালমাটাল জীবন পার করে থাকে দেশের কয়েক লাখ গণপরিবহন শ্রমিক। ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও কর্মপরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গরম ইঞ্জিনের ওপর টানা ১৮ ঘণ্টা গাড়ি চালালে চোখ, কাঁধ, পিঠ ও পেশির ব্যাপক ক্ষতি হয়। শরীরে দৈনিক তিন হাজার ক্যালরির বেশি তাপ এদের উৎপাদন করতে হয়। এজন্য সুষম খাবার ও কমপক্ষে আট ঘণ্টা বিশ্রামের প্রয়োজন। এসব না পাওয়ায় পরিবহন শ্রমিকরা কম বয়সে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন সড়কের নৈরাজ্য আর বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে পরিবহন শ্রমিকদের এই মানবেতর অনিশ্চিত জীবনের বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। চালক ও সহকারীসহ পরিবহনের শ্রমিকদের বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দিলে এই খাতের শ্রমিকদের প্রশিক্ষিত করে তোলা এবং নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ হবে।
১৯০২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন ফরাসি ঔপন্যাসিক এমিল জোলা। তার জন্ম ১৮৪০ সালের ২ এপ্রিল প্যারিসে। প্রকৃতিবাদী চিন্তাধারার অন্যতম প্রবক্তা এমিল ‘তাত্ত্বিক প্রকৃতিবাদ’ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি রাজনৈতিক উদারীকরণের পক্ষে কথা বলতেন। তার রচনাসমূহ তৎকালীন ফ্রান্সের রাজনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলে। জোলার বাবা ফ্রাংকোয়িজ জোলা ছিলেন ইতালীয় বংশোদ্ভূত প্রকৌশলী। মা ছিলেন ফরাসি। জোলার আট বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। এরপর ১৮৫৮ সালে তাদের পরিবার ফ্রান্সে চলে আসে। মায়ের ইচ্ছা, ছেলে আইন বিষয়ে পড়বে। কিন্তু লেখালেখিতে বেশি সময় দেওয়ায় জোলা স্নাতক পরীক্ষায় ফেল করেন। আইন পড়াও আর হয়ে ওঠেনি। ফ্রান্সে তিনি বন্ধু হিসেবে পান বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পল সেজানকে। লেখক হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার আগে তিনি কাজ করতেন একটি জাহাজ কোম্পানির করণিক হিসেবে। তখন তিনি পত্রিকায় সাহিত্য ও শিল্প সমালোচনা লিখতেন। জোলার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য আর্থ’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৪ সালে। ১৮৬৭ সালে প্রকাশিত হয় তার আরেক উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘থেরেস রিকুইন’। তিনি সব সময় একটি নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতেন। ১৮৯৮ সালের ১৩ জুলাই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ করে তিনি একটি খোলা চিঠি লেখেন। দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় তা প্রকাশিত হয়। এই লেখার কারণে তিনি সরকারের রোষানলে পড়েন। ফলে প্রায় এক বছর তিনি ইংল্যান্ডে আত্মগোপনে ছিলেন। দেশে ফিরে তিনি ফের লিখতে শুরু করেন। ‘দ্য জার্মিনাল’ তার কালজয়ী আরেক উপন্যাস। উপন্যাস ছাড়াও তিনি বেশ কিছু ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও নাটক লিখেছেন। দুবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেও তিনি শেষ পর্যন্ত পুরস্কার পাননি। তাকে ঔপন্যাসিকদের ঔপন্যাসিক বলা হয়।
বুধবার বগুড়া-৪ আসনের উপনির্বাচনে মাত্র ৮৩৪ ভোটে হেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম। এর প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, স্যার ডাকতে হবে এ জন্য কিছু শিক্ষিত মানুষ আমাকে হারিয়ে দিয়েছে।
হিরো আলম বলেন, এমপি হলে আমাকে স্যার বলতে হবে। এ জন্য কিছু শিক্ষিত মানুষ আমাকে আগে থেকেই মানতে পারছিলো না। আমাকে স্যার বলতে কষ্ট হবে এমন লোকেরাই ফলাফল পাল্টে আমাকে পরাজিত করেছেন। তারা আমাকে ইভিএম কারসাজিতে হারিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া আমি এমপি হলে নাকি বাংলাদেশের সম্মানহানী হবে। এমন ভাবনা থেকেও আমাকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। মশাল মার্কার অস্তিত্ব ছিল না। আমি কাহালু-নন্দীগ্রাম আসন থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছি। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের জোগসাজশে গণনায় আমাকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি এ ফলাফল মানি না।
হিরো আলম বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় বগুড়া সদরের এরুলিয়া নিজ বাড়িতে গণমাধ্যমকর্মীদের এসব বলেন।
তিনি আরো বলেন, সারাদিন মাঠে ভোটারের উপস্থিতি তেমন ছিল না। হঠাৎ এত ভোট কোথা থেকে এল বুঝতে পারছি না। মশাল মার্কার অস্তিত্ব ছিল না। তাদের নির্বাচনী প্রচার ছিল না। মানুষের তাদের আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে। তারপর কীভাবে আমার চেয়ে বেশি ভোট পেল বিষয়টি পরিস্কার নয়।বগুড়া সদর আসন সম্পর্কে তিনি বলেন, সেখানে অনেক কেন্দ্রে তার এজেন্টকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তার কর্মীদের মারধর করা হয়েছে। ফলে সকালেই ওই আসনের ভরসা ছেড়ে দিই।
ফলাফল নিয়ে নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে এখন কোনো কথা বলব না। পরে জানান হবে।
তিনি ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেন, যারা আমাকে নির্বাচনে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমি ভোটে হারলেও সারাজীবন মানুষের পাশে ছিলাম, শেষ পর্যন্ত থাকব।
শ্রম পরিদর্শক পদে যোগ দেওয়ার ৩৪ বছর পর পদোন্নতি পেলেন মাহমুদুল হক। স্বপ্ন দেখতেন পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে একসময় প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে যাবেন। সেই স্বপ্ন আট বছরেই লুটিয়ে পড়ল জ্যেষ্ঠতার তালিকায়।
১৯৮৮ সালে যোগ দেওয়ায় ’৯৫ সালেই পদোন্নতি পাওয়ার কথা ছিল মাহমুদুল হকের। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অদূরদর্শিতা সে স্বপ্ন শুরুতেই বাধা পেল। এন্ট্রি পোস্টে যোগ দেওয়ার পর তার মতো অন্য কর্মচারীরা যখন পদোন্নতির স্বপ্নে বিভোর, তখন তাতে গা-ই করলেন না সেই সময়ের প্রতিষ্ঠানপ্রধান।
মাহমুদুল অপেক্ষায় রইলেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য। সেই পরিবর্তন আসতে আসতে চাকরিতে কেটে গেল আঠারো বছর। আঠারোতে মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হয়। তিনিও ভাবলেন আঠারোতে তিনি না হয় ‘জব ম্যাচিউরিটি’তে পৌঁছালেন। চাকরির আঠারো বছরে পদোন্নতি পেলেও মন্দ হয় না।
কিন্তু অবাক ব্যাপার, কর্তৃপক্ষ পদোন্নতি দিল, তবে মাহমুদুলকে ছাড়া। পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনে কোথাও তার নাম নেই। হতাশায় মুষড়ে পড়লেন তিনি। জুনিয়র কর্মকর্তারদের নাম আছে, অথচ তার নাম নেই। প্রতিষ্ঠানের নীতি-নির্ধারকদের দরজায় দরজায় ঘুরলেন ন্যায়বিচারের আশায়। কিন্তু তারা পাত্তাই দিলেন না বিষয়টি।
তারা আমলে না নিলেও মাহমুদুলের স্বপ্ন তো সেখানেই থেমে যাওয়ার নয়। সেই স্বপ্ন পুঁজি করে তিনি গেলেন আদালতে। সেই ভিন্ন জগৎটাও কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তার পক্ষে রায় দিল। মাহমুদুল আনন্দে আত্মহারা হলেন। কিন্তু সেই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। সরকার আপিল করল প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলার ফল উল্টে গেল। হতাশায় ভেঙে না পড়ে তিনি গেলেন উচ্চ আদালতে। আপিল বিভাগে সিভিল আপিল মামলা করলে প্রশাসনিক আপিল আদালতের রায় বাতিল হয়। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল থাকে।
জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করার মতো মাহমুদুল হকও যেন সরকারের সঙ্গে লড়াই করতে নামলেন। আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন করল সরকারপক্ষ। একপর্যায়ে সরকার বুঝতে পারল কোনোভাবেই তারা এ মামলায় জিততে পারবে না। সরকারপক্ষে রিভিউ পিটিশন প্রত্যাহার করা হলো। আদালত সরকারের পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনকে আইনের কর্তৃত্ববহির্ভূত বলে ঘোষণা করল। জুনিয়র কর্মকর্তাকে যেদিন থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে এবং যতবার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, একইভাবে মাহমুদুল হককে পদোন্নতি দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। বকেয়া বেতন-ভাতাসহ সব পাওনা কড়ায়-গ-ায় পরিশোধের নির্দেশনা আসে।
আদালতের এই নির্দেশনা দেওয়া হয় ২০১৮ সালে। এরপর আদেশ বাস্তবায়ন করতে সরকারের লেগে যায় প্রায় চার বছর। ২০২২ সালের ১১ মে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ৩৪ বছর পর পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মাহমুদুল হক। আবারও তাকে ঠকিয়েছে সরকার। জুনিয়র কর্মকর্তা যুগ্ম মহাপরিদর্শক হলেও তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয় তার দুই ধাপ নিচের সহকারী মহাপরিদর্শক পদে। উপমহাপরিদর্শক ও যুগ্ম মহাপরিদর্শক আরও ওপরের পদ। আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
কখনোই প্রজ্ঞাপন মাহমুদুল হকের জন্য ভালো বার্তা বয়ে আনেনি। পুরো চাকরিজীবন আদালতের বারান্দায় ঘুরে তিনি পৌঁছেছেন অবসরের প্রান্তসীমায়। আর তিন মাস পরে তিনি অবসরে যাবেন। যৌবন ও মধ্য বয়সের দিনগুলোতে আদালতে ঘুরে বেড়ানোর শক্তি ও সাহস থাকলেও মাহমুদুল হক এখন সেই সাহস দেখাতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করছেন। পারবেন তো শেষ সময়ে এসে সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে?
মাহমুদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, তিনি আদালতের কাছেই জানতে চাইবেন, আদালতের বিচার না মানার শাস্তি কী।
পুরো ঘটনা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা শুনিয়ে জানতে চাইলেন, কতজনের পক্ষে মাহমুদুল হকের মতো লড়াকু মনোভাব দেখানো সম্ভব?
সীমাহীন আনন্দ নিয়ে মানুষ সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়। এরপরই তার মধ্যে যে স্বপ্নটি দানা বাঁধে তা হচ্ছে পদোন্নতি। কার কীভাবে পদোন্নতি হবে তা আইনকানুন, নিয়ম-নীতি দিয়ে পোক্ত করা। পুরো বিষয়টি কাচের মতো স্বচ্ছ। এরপরও পদোন্নতি হয় না। দিন, মাস, বছর পার হয়ে যায়, কাক্সিক্ষত পদোন্নতির দেখা মেলে না।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ক্যাডারে নিয়মিত পদোন্নতি হয়। বাকি ক্যাডারে হতাশা। তার চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি নন-ক্যাডারে। ক্যাডার কর্মকর্তারা নিজের পদোন্নতির ষোলো আনা বুঝে নিয়ে ঠেকিয়ে দেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি। সংখ্যায় বেশি হওয়ায় নন-ক্যাডাররা একজন আরেকজনকে নানা ইস্যুতে আটকাতে গিয়ে পুরো প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেন। সরকারের মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কর্মচারী। সেই হিসেবে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনবলের পদোন্নতি হয় না। পে-কমিশন হলেই কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য করুণা উথলে ওঠে। এমনকি ব্লকপোস্টে যারা আছেন, তাদের জন্যও পদোন্নতির বিকল্প সুবিধা বাতলে দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কর্মচারীদের পদোন্নতি উপেক্ষিতই থাকে।
যখন সময়মতো পদোন্নতি হয় না, তখন নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে থাকে। এসব সমস্যা সংশ্লিষ্ট দপ্তর-অধিদপ্তরের চৌহদ্দি পেরিয়ে আমজনতাকেও প্রভাবিত করে। নন-ক্যাডার কর্মকর্তা আর সঙ্গে কর্মচারীরা যখন বুঝতে পারেন পদোন্নতির আশা তাদের নেই, তখন তারা দুহাতে টাকা কামানোর ধান্দায় মেতে ওঠেন। এতে করে ঘুষের সংস্কৃতি সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। অকার্যকর পথে হাঁটে রাষ্ট্র। সাধারণ মানুষ টাকা ছাড়া তাদের কাছ থেকে কোনো সেবা পায় না, ব্যবসায়ীরা নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে ব্যবসায় আসেন না, ব্যবসাবান্ধব পরিস্থিতি না থাকায় মুখ ফিরিয়ে নেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। প্রধানমন্ত্রীর বারবার আহ্বানেও বিনিয়োগকারীরা সাড়া দেন না। সাধারণ মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে সেবা দেওয়ার বাণীতেও উদ্বুদ্ধ হন না সংশ্লিষ্টরা।
এই পরিস্থিতিতে অনিয়ম আটকে রাখার সব কৌশলই ব্যর্থ হচ্ছে। যথাযথ তদারকি না থাকায় বিভাগীয় ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে। ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫০টি অডিট আপত্তি ঝুলে থাকায় অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোও আগ্রহ হারিয়ে নিজেরাই জড়িয়ে পড়ছে অনিয়মে। দন্তহীন বাঘে পরিণত হওয়ার তথ্য সাংবাদিকদের জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান নিজেই।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদোন্নতির বড় একটা অংশ আটকে রাখে মন্ত্রণালয়গুলো। এই আটকে রাখার কারণ হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের স্বার্থ। বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তরে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিলে নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতিপ্রাপ্তদের ওপরের পদে বসাতে হবে। এতে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের এককালীন লাভ; অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে একবার পদোন্নতি দেওয়া যাবে। কিন্তু পদোন্নতি না দিয়ে সংশ্লিষ্টদের চলতি দায়িত্ব দিলে বছরজুড়ে টাকা আয় করতে পারেন নীতিনির্ধারকরা। দপ্তর, অধিদপ্তরে বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। চলতি দায়িত্বপ্রাপ্তদের আয় অনুসারে নীতিনির্ধারকদের মাসোহারা দিতে হয়। নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া হলে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের নিয়মিত আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে আইন বা বিধি-বিধানের ফাঁকফোকর গলিয়ে নন-ক্যাডার এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি আটকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়।
সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদের সভাপতি নিজামুল ইসলাম ভূঁইয়া মিলন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সচিবালয় এবং সারা দেশের সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতির মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। নন-ক্যাডারের কিছু বিষয় ছাড়া সচিবালয়ের কর্মচারীরা সময়মতো পদোন্নতি পায়। কিন্তু সচিবালয়ের বাইরে পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। সচিবালয়ে মাত্র ১০ হাজার কর্মচারী আছেন। সচিবালয়ের বাইরে আছেন ১০ লাখের বেশি। এসব কর্মচারীর পদোন্নতি নিয়ে বহু বছর ধরে চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনো ফল পাইনি। সর্বশেষ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সমস্যা নিয়ে কাজ করার জন্য একটি কমিটি করে দিয়েছে। কমিটি কিছু সুপারিশ করেছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। এরপর এর কোনো অগ্রগতি নেই। যেখানে সরকারপ্রধান বলেন, চাকরিজীবনে সবাই যেন কমপক্ষে একটি পদোন্নতি পায়। সেখানে বহু কর্মচারী কোনো পদোন্নতি ছাড়াই অবসরে যাচ্ছেন। সরকারপ্রধানের নির্দেশনা উপেক্ষা করেন আমলারা। তাদের আগ্রহ কেনা-কাটায়, বিদেশ ভ্রমণে, নতুন জনবল নিয়োগে। এসব করলে তাদের লাভ। কর্মচারী পদোন্নতি দিতে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এর নিশ্চয়ই একটা শেষ আছে। বৈষম্যের পরিণতি কী হয়, তা অনেক দাম দিয়ে বিডিআর বিদ্রোহে আমরা দেখেছি।’
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি ঝুলছে বছরের পর বছর। এই অধিদপ্তরের কয়েক শ কর্মকর্তা পাঁচ বছর আগেই পদোন্নতির যোগ্য হয়েছেন। নানা কায়দা-কানুন করে তাদের পদোন্নতি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সংশ্লিষ্টদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করে তাদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া এগিয়ে নিলেও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নতুন করে জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার নামে সময়ক্ষেপণ করছে। জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার পর এখন তাদের পারিবারিক সদস্যদের তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই সংস্থা নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদেরও তথ্য তালাশ করছে। তাদের আত্মীয়দের মধ্যে কে কোন দলের সমর্থক তার তথ্য নিচ্ছেন সংস্থার কর্মকর্তারা।
গত মাসে শেষ হওয়া জেলা প্রশাসক সম্মেলনে দায়িত্ব পালন করছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সুরম্য ভবনে দায়িত্ব পালন করলেও ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তার মনের অবস্থাটা মনোহর ছিল না। কেমন আছেন জানতে চাইলে ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তা বলেন, ‘ভালো নেই। চাকরি করছি, পদোন্নতি নেই। ২০১৫ সালের আগে পদোন্নতি না পেলেও টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড ছিল। তাও তুলে দেওয়া হয়েছে। তুলে দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল সময়মতো পদোন্নতি হবে, ব্লকপোস্টধারীদের দেওয়া হবে বিশেষ আর্থিক সুবিধা। এসবের কোনোটাই হয়নি।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে একটি প্রশাসনিক আদেশ খুবই পরিচিত। সেই প্রশাসনিক আদেশ ১৬/২০১৮ অনুযায়ী ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগ হবে। আর ৩০ ভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগের ফলে বিমানে বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় কর্মকর্তা বেশি। নীতিনির্ধারকদের নতুন জনবল নিয়োগে আগ্রহ বেশি। পুরনোদের পদোন্নতি দিয়ে ওপরের পদ পূরণের চেয়ে তারা নতুন নিয়োগে যান। ফলে কারও চাকরিজীবনে একবারও পদোন্নতি হয় না। নামমাত্র যে পদোন্নতি হয় তা অনিয়মে ভরপুর।
নন-ক্যাডার ছাড়াও ১৩তম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। প্রতিটি দপ্তরে এসব গ্রেডের পদোন্নতি আটকে আছে। অথচ এসব গ্রেডেই বেশি লোক চাকরি করছেন। সরকারের মোট জনবল প্রায় ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ২৩ শতাংশ পদের মধ্যেও নন-ক্যাডার রয়েছেন। এ ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৭৭ শতাংশ পদই ১৩তম থেকে তার পরের গ্রেডের। এতে করে সহজেই বোঝা যায় সরকারের জনবলের বড় অংশই পদোন্নতির চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। সরকারের জনবলের এই বিশাল অংশ যখন পদোন্নতি নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগেন, তখন তারা নানা অনিয়মে ঝুঁকে পড়েন।
বেশির ভাগ দপ্তর, অধিদপ্তর পরিচালনা করেন বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা তাদের প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে ক্যাডার কর্মকর্তাদের দপ্তর, অধিদপ্তরে পাঠান। প্রেষণে গিয়ে অনেক কর্মকর্তা শুধু রুটিন কাজটুকুই করতে চান। শূন্যপদে জনবল নিয়োগ বা পদোন্নতি রুটিন কাজ না হওয়ায় তা উপেক্ষিত থাকে। তা ছাড়া পদোন্নতি দিতে গিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়; বিশেষ করে মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রী বা সচিব তাদের পছন্দের লোককে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য সংস্থার প্রধানকে চাপ দেন। এই চাপ উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ না থাকায় অযোগ্য লোককে পদোন্নতি দিতে হয় সংস্থার প্রধানকে। এই জটিলতা থেকে দূরে থাকার জন্য সংশ্লিষ্টদের পদোন্নতি দেওয়া থেকেও দূরে থাকেন সংস্থার প্রধানরা।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের ১৪ গ্রেডের একজন কর্মচারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাইরের লোকের ইচ্ছাটাই জাগে না আমাদের পদোন্নতি দিতে। আমাদের দপ্তরপ্রধান মহাপরিচালক প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। অতিরিক্ত মহাপরিচালকও অনেক সময় প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রেষণে আসেন। তাদের কেন ইচ্ছা জাগবে আমাদের পদোন্নতি নিয়ে। যদি এসব পদে ফুড ক্যাডারের কর্মকর্তা থাকতেন, তাহলে তারা খাদ্য বিভাগের সমস্যা বুঝতেন। তা ছাড়া নিয়োগ বিধি সংশোধনের নামে আমরা দীর্ঘদিন একই পদে আটকে আছি।’
গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে এক আবেদনে জানান, ‘বর্তমানে সচিবালয়ে প্রায় দুই হাজারের বেশি প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা কর্মরত। এর বিপরীতে ক্যাডারবহির্ভূত সংরক্ষিত পদের সংখ্যা ২৬৭টি, যা খুবই নগণ্য। ফলে একই পদে ২০-২২ বছরের বেশি সময় কর্মরত থাকার পরও অনেকে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। পদোন্নতি না পাওয়ায় সৃষ্ট হতাশার ফলে কর্মস্পৃহা নষ্ট হচ্ছে।’
সরকার এ সমস্যা থেকে কীভাবে বের হতে পারে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এসব সমস্যা সমাধানে সরকার সব সময়ই কাজ করে। কিন্তু এ চেষ্টা জটিলতার তুলনায় কম। এ বিষয়ে আরও এফোর্ট দিতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধে এমনটা যে ঘটবে তার আলামত কিন্তু যুদ্ধের সময়েই টের পাওয়া গিয়েছিল। এই যুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ ঘটেছে। নেতৃত্ব ছিল নির্বাচনে-জেতা জাতীয়তাবাদীদের হাতে। ভারত সরকার তাদের সাহায্য করেছে। জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতার হস্তান্তর চেয়েছে, রূপান্তর চায়নি। তারা লড়ছিল হস্তান্তরের লক্ষ্যেই। জনগণ কিন্তু তত দিনে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে, তারা শুধু যে ক্ষমতার হস্তান্তর চেয়েছে তা নয়, চেয়েছে রাষ্ট্র ক্ষমতার বিচূর্ণকরণ। বস্তুত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধ এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে যে চেতনাটি অগ্রসর হচ্ছিল সেটা ছিল সমাজবিপ্লবী। এই চেতনা ঠিকই বুঝেছে যে পুরাতন রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রেখে মুক্তি আসবে না। রাষ্ট্রকে ভাঙতে হবে, যাতে করে রাষ্ট্র জনগণের শত্রু না হয়ে মিত্র হয়; শুধু মিত্রও নয়, জনগণের সেবক হয়। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের মূল আকাক্সক্ষাটা ছিল ওই রকম রাষ্ট্রের। কথা ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ওই আকাক্সক্ষাটাকে বাস্তবায়িত করবে।
কিন্তু যুদ্ধ সেদিকে এগোয়নি। নেতৃত্বে রয়ে গেছে জাতীয়তাবাদীই। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের জায়গায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ স্থাপিত হয়েছে। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। দুই জাতীয়তাবাদের ভেতর পার্থক্যটাও সুস্পষ্ট, কিন্তু দুয়ের ভেতর মিল এইখানে যে, উভয়েই পুঁজিবাদী। এই মিলটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। জাতীয়তাবাদী নেতারা ব্যক্তিমালিকানার বিরোধী ছিলেন না, যেমন ছিলেন না তারা সামাজিক মালিকানার পক্ষে। বস্তুত পুরাতন ধ্যানধারণাই নতুন রাষ্ট্রে কার্যকর হয়েছে। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যাভিমুখী যাত্রার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু সেদিকে যাবে কী, রাষ্ট্র অচিরেই তার পুরাতন পথে ফিরে গেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তিমালিকানায় চলে গেছে। রাষ্ট্রীয়করণ ছিল ব্যক্তিমালিকানা স্থাপনের মধ্যবর্তী ধাপ। আদমজী জুট মিলস পাকিস্তান আমলে ছিল, এখন নেই। এটা কেবল ঘটনা নয়, একটা প্রতীকও বটে।
যুদ্ধের শুরুতেই কিন্তু বোঝা গিয়েছিল যে বিপ্লবী উপাদান থাকা সত্ত্বেও এ যুদ্ধ বিপ্লবী হবে না। ধরা যাক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ঘটনা। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে প্রান্তিকভাবে যুক্ত তিনজন দুঃসাহসী তরুণ স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ নিয়ে ওই গোপন বেতার কেন্দ্রটি স্থাপন করেন, কালুরঘাট ট্রান্সমিটার কেন্দ্রটিকে ব্যবহার করে। নাম দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। ২৬ মার্চ ওই নামেই বেতার কেন্দ্রটি চালু হয়। কিন্তু তার বিপ্লবী নামটি ধরে রাখা যায়নি। বিপ্লবী নাম ধরে রাখবে কী, ৩০ তারিখ দুপুরে কেন্দ্রটিই সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংসের কাজটি করে পাকিস্তানি হানাদাররা। তারা বিমান আক্রমণ চালায়। ওটিই ছিল বাংলাদেশে তাদের যুদ্ধবিমানের প্রথম আক্রমণ। বেতার কেন্দ্রটি ধ্বংস না করে তাদের স্বস্তি ছিল না, কারণ সেখান থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধের সংবাদ সম্প্রচারিত হয়েছিল। তারা লড়ছে, বিশ্ববাসী জেনেছিল, সবচেয়ে বেশি করে জেনেছিল বাঙালিরা, দেশে যেমন, বিদেশেও তেমনি। তারা উদ্দীপ্ত হয়েছে, ভরসা পেয়েছে, সাহস পেয়েছে রুখে দাঁড়ানোর। হানাদাররা অস্থির হয়েছে। খুঁজে খুঁজে বের করেছে বেতার কেন্দ্রের ঠিকানা, বোমাবর্ষণ করেছে মহোৎসাহে।
এরপরও কেন্দ্রটি চালু ছিল। প্রথমে গেছে সে আগরতলায়, সেখান থেকে কলকাতায়। কিন্তু ‘বিপ্লবী’ আর থাকেনি। ওই পরিচয় বিলুপ্ত করা হয়েছিল কিন্তু মেজর জিয়ার নির্দেশেই। পরে আওয়ামী লীগের প্রবাসী সরকার যে বিপ্লবীকে ফেরত এনেছে তা মোটেই নয়, বেতার কেন্দ্রটি বিপ্লবহীন ‘স্বাধীন’ অবস্থায় রয়ে গেছে। যুদ্ধটা তো ছিল পুরোপুরি জনযুদ্ধ, কিন্তু ওই শব্দটি একবার মাত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তারপর নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ‘জনযুদ্ধ’ মাওবাদের গন্ধ আছে বলে। বেতার অনুষ্ঠানের শেষে একটি সিগনেচার টিউন বাজানো হতো, সে গানটির শুরু ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ দিয়ে, শেষে ছিল ভুখা বেকার মানুষদের কথা, আপত্তিকর বিবেচনায় গানটি বাদ দেওয়া হয়। বেকারদের দায়িত্ব স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র কেন নিতে যাবে? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ওপর চাপ ছিল আওয়ামী লীগের খবরকে বেশি বেশি প্রচার করার, পারলে মুক্তিযুদ্ধকে একদলীয় ঘটনা হিসেবে চিত্রিত করার। কলকাতায় কেন্দ্রটি সম্পূর্ণরূপে প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। শেষের দিকে ভারত সরকারের একজন প্রতিনিধিও অনুষ্ঠানসূচির ওপর চোখ রাখতেন। স্বাধীনতার পরপর ইনি ঢাকাতেও এসেছিলেন, বাংলাদেশ বেতারের দেখভাল করার জন্য। ডিসেম্বরের ৬ তারিখে ভারত সরকার যখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় সেই ক্ষণ থেকেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তার নাম বদলে ফেলে বাংলাদেশ বেতার হয় অর্থাৎ একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়ে যায়। বিপ্লবীত্ব আগেই গিয়েছিল এবার গেল স্বাধীনতাটুকুও। যেন বাংলাদেশেরই প্রতীক। পাকিস্তানি বেতারের মতোই স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠানও কিন্তু কোরআন পাঠ ও ব্যাখ্যা দিয়েই শুরু হতো। সপ্তাহে ছয় দিন ইসলামের দৃষ্টিতে বলে একটি অনুষ্ঠান থাকত।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা; ওই ঘটনার ভেতরে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের মোড়বদলের কালে সংগ্রামের শক্তি ও সীমা দুটোই প্রতিফলিত হয়েছে। কেন্দ্রের গঠনে উদ্যোগী তিন তরুণের সঙ্গে বেগম মুশতারী শফীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। যুদ্ধের শুরুতেই তিনি তার স্বামী এবং সহোদর একমাত্র ভাইটিকে হারান; তার বড় বোনের স্বামীও শহীদ হয়েছেন। অবিশ্বাস্য কষ্টের ভেতর দিয়ে সাত সন্তানের ছয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ভাসতে ভাসতে সম্পূর্ণরূপে সর্বহারা দশায় আগরতলায় উপস্থিত হয়ে কোনো মতে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরে তার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তিনি ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ (১৯৮৯) নামে একটি বই লিখেছেন, তার অভিজ্ঞতার ভেতর ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন হবে তার লক্ষণ বিলক্ষণ ফুটে উঠেছিল। আগরতলায় গিয়ে যেসব ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছেন তাতে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ সম্পর্কে ভরসা রীতিমতো বিচলিত রয়েছে। আগরতলা পৌঁছে তিনি জানতে পেরেছেন যে চট্টগ্রামের এমএনএ এমপিএরা একটি ভবনে রয়েছেন। শুনে আশান্বিত হয়ে তিনি গেছেন তাদের খোঁজে। ভবনে গিয়ে পৌঁছান সকাল সাড়ে দশটায়। নেতাদের সন্ধান পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু দরজার সামনে কাজের ছেলেটি বলেছে দেখা করা যাবে না। কেন? কারণ ওনারা একটু বেসামাল আছেন। দরজাটা ভেজানো ছিল। মুশতারী শফী লিখেছেন, ‘আমি যেখানে বসেছি সেখান থেকে দরজার ফাঁক দিয়ে আরেকটি রুম দেখা যায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে চিৎ হয়ে উপুড় হয়ে মেঝেতেই দু-তিনজন শুয়ে আছে।’ তিনি ভেবেছিলেন ঘুমোচ্ছে। পরে জানলেন নেতারা রাতে ড্রিংক করেছেন, সেজন্য সকালে তাদের ওই করুণদশা। মুশতারী শফীর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া : ‘আমি অবাক। এখানে ড্রিংক? এরাই না জাতীয় নেতা? মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছেন?’ (পৃ. ১৩৭-৩৮)
অবাক হওয়াটা ওখানেই শেষ হয়নি। তার জন্য আরও একটি ‘বিস্ময়-মহাবিস্ময়’ অপেক্ষা করছিল। তিনি লিখেছেন, ‘এখানে এসে একটা বিষয় লক্ষ করলাম, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির রিক্রুট-করা মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা প্রবাসী সরকার করছে না। যেমন আওয়ামী লীগের যে কেউ যে-কাউকে রিক্রুট করলে তার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি খরচে ট্রেনিং এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, বামপন্থি দলের কাউকেই সে রকমটি করা হচ্ছে না। কোথাও পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কোথাও সরাসরি নাকচ করা হচ্ছে। ফলে বামপন্থিরা ভারত সরকারের দুয়ারে দুয়ারে ধাক্কা দিয়ে এবং নিজেদের পার্টির খরচে সম্পূর্ণ আলাদা ট্রানজিট ক্যাম্প এবং যুবকদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ (পৃ. ১৫৪)
তার মনে প্রশ্ন জেগেছে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম যেখানে চলছে, সেখানে বাম-ডান আবার কী, সবাই তো মুক্তিযোদ্ধা। তার মতো মানুষদের কাছে সব মুক্তিযোদ্ধাই যে এক, এটা ঠিক, কিন্তু নেতৃত্ব তো ছিল পুঁজিবাদী ঘরানার, তারা বামপন্থির গন্ধ পেলেই সতর্ক হতো। ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির মতো নরম বামদের তবু সহ্য করত, তাড়িয়ে দিত না। শক্ত বামপন্থিদের দেখা মাত্র ধাওয়া করত। শক্ত বামপন্থিদের কাউকে কাউকে তাই প্রাণ ভয়ে আগরতলার মুক্তভূমি থেকে আবার হানাদারকবলিত পাকিস্তানে পালিয়ে আসতে হয়েছে। কেউ কেউ নিহতও হয়েছে, আগরতলাতেই। মুশতারী শফীর আরেক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোনো-মতো তৈরি করা ফিল্ড হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবক সবাই কাজ করছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আহত যোদ্ধারা দিন গুনছেন কখন উঠে দাঁড়াতে পারবেন, এবং পুনরায় যুদ্ধে যাবেন। স্বেচ্ছাসেবকদের ভেতর মুশতারী শফীও ছিলেন।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভারতের কর্নাটকের রাজধানী বেঙ্গালুরুতে বান্ধবীর সাড়ে তিন বছর বয়সী মেয়েকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগে উঠেছে এক ব্যক্তির (২৬) বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে বেঙ্গালুরু পুলিশ।
বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) এ খবর জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
জানা গেছে, একটি তৈরি পোশাক কারখানার কর্মী ওই নারী বাড়িতে তার তিন বছরের মেয়েকে রেখে কাজে যেতেন। সেই সময় শিশুটিকে দেখভাল করতেন তার প্রেমিক। সোমবার (৩০ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় বান্ধবীর অনুপস্থিতিতে ওই ব্যক্তি বাড়ি এসে শিশুটিকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ।
পুলিশ বলছে, শিশুটির মায়ের সঙ্গে অভিযুক্তের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কাজ শেষে শিশুটির মা বাড়ি ফিরলে তার মেয়েকে অচেতন অবস্থায় দেখতে পান। এরপর তিনি এবং ওই ব্যক্তি মেয়েটিকে কাছের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকরা শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ সময় ওই নারী মেয়ের মৃত্যু নিয়ে প্রেমিককে প্রশ্ন করলে তিনি তাকে মারধর করেন। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুলিশকে খবর দেয়। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওই ব্যক্তি শিশুটিকে ধর্ষণ ও হত্যার কথা স্বীকার করেছে। এ ঘটনায় ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা হয়েছে।
বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের উপনির্বাচনে বেসরকারিভাবে ১১২ কেন্দ্রের ফলাফলে ৯৫১ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন বহুল আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম। একতারা প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ১৯ হাজার ৪৮৬ ভোট। এ আসনে জয় পেয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ (ইনু) সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম তানসেন। মশাল প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ২০ হাজার ৪৩৭ ভোট।
বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে বগুড়ার দুইটিসহ মোট ৬ আসনে উপনির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হয়। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির এমপিরা পদত্যাগের ঘোষণা দিলে এ আসনগুলো শূন্য হয়।
তখন, বগুড়া-৬ (সদর) এবং বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন হিরো আলম। নির্বাচন কমিশন একদফা তার প্রার্থিতা বাতিল করলেও পরে আদালতে গিয়ে প্রার্থিতা ফিরে পান তিনি।
নাগরিকত্ব বিষয়ক জটিলতার জেরে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে দেশের উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ ও পার্লামেন্টে আসন হারিয়েছেন নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী রবি লামিছানে। শুক্রবারের রায়ে আদালত জানিয়েছে, এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকত্বও নেই তার।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র বিমল পৌদেল বার্তা সংস্থা এএফপিকে এ সম্পর্কে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় অনুযায়ী, ২০২২ সালের জাতীয় নির্বাচনে নাগরিকত্ব বিষয়ক আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে রবি লামিছানের বিরুদ্ধে। এ কারণে এখন থেকে আর পার্লামেন্টের সদস্য নন তিনি।’
নেপালের এক সময়ের জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব রবি লামিছানে দেশটির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ইনডিপেনডেন্ট পার্টির শীর্ষ নেতা। ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর নেপালের পার্লামেন্ট প্রতিনিধিসভার নির্বাচনে তার দল ২০টি আসনে জয়ী হয়েছে। তারপর গত ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন জোট সরকারে নিজের দলসহ যোগ দিয়ে নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন লামিছান।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিত্ব ছিল লামিছানের; কিন্তু নেপালের সংবিধানে দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বীকৃত না হওয়ায় ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। শুক্রবারের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, নিয়ম অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর নেপালের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার কথা ছিল লামিছানের; কিন্তু তা করেননি তিনি। ফলে এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকও নন লামিছান। এদিকে, শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর লামিছানের প্রতিক্রিয়া জানতে তার মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে গিয়েছিলেন সাংবাদিকরা; কিন্তু লামিছানে তাদের বলেন, ‘যেহেতু এই মুহূর্তে আমি কোনো দেশেরই নাগরিক নই, তাই আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করা আমার পক্ষে উচিত নয়, সম্ভবও নয়।’
তার কলাম মানেই সেদিন বাংলার বাণী অফিস সরগরম। সকাল থেকেই ফোন আসত। বিভিন্ন আড্ডায়ও আলোচনা হতো সেই কলাম নিয়ে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়-আশয় এবং দেশের সমসাময়িক বিষয়গুলো আকর্ষণীয় এবং সহজ করে পাঠকের কাছে তুলে ধরতেন এই সাংবাদিক। এর বাইরে প্রকৃতি, পাহাড়, নদী ও দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে লিখতেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের লাল পাহাড়ের মানুষের জীবনের গল্পও তুলে আনতেন। প্রায় দেড় দশক নিরবচ্ছিন্নভাবে তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। লিখেছেন অসংখ্য কলাম।
যখন সাংবাদিকতা করতেন তখন তার কাজের জায়গাটিতে তিনি ছিলেন সেরা। ছাত্ররাজনীতির জন্য যেমন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, ছাত্রনেতা হিসেবেও পেয়েছেন তুমুল জনপ্রিয়। সফল হয়েছেন প্রতিমন্ত্রী এবং মন্ত্রী হিসেবে। দেশের ঐতিহ্যবাহী এবং ইতিহাসসমৃদ্ধ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও তিনি সফল। তৃতীয়বারের মতো দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি হলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। রাজনীতির বাইরে তার আরও অনেক পরিচয়ের মধ্যে সাংবাদিক পরিচয়টাও অনেক বেশি উজ্জ্বল।
ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন স্পষ্টবাদী, সাহসী ও দেশপ্রেমিক। পাকিস্তান আমলে ছাত্র ও গণআন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা এ নেতা ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং কোম্পানীগঞ্জ থানা মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) অধিনায়ক ছিলেন।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। ওই ভয়াল রাতে নিহত হন তার ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি। তিনি তখন দৈনিক বাংলার বাণীর সম্পাদক। ফলে পত্রিকাটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ১৯৮১ সালে পত্রিকাটি আবার ছাপার অনুমতি পায়। ওই সময় ওবায়দুল কাদের জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। সেই সঙ্গে লেখালেখি। দ্বিতীয়বার শেখ ফজলুল করিম সেলিমের (বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য) সম্পাদনায় বাংলার বাণী পত্রিকার ছাপা শুরু হওয়ার পর যুক্ত হন ওবায়দুল কাদের। তিনি পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য ও পরে ক্রীড়া ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের আগপর্যন্ত তিনি সাংবাদিকতা করেছেন।
টানা ১৫ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে ওবায়দুল কাদের অসংখ্য কলাম লিখেছেন বাংলার বাণীতে। ‘ও কাদের’ নামে তিনি কলাম লিখতেন। প্রতিদিন সকালে অফিসে আসতেন। সম্পাদকীয় বিভাগ ও অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে মিটিং করতেন। সম্পাদকীয় বিভাগের বাইরে সেই সময় তিনি বাংলার বাণীর আন্তর্জাতিক পাতাটি নিজের দায়িত্বে বের করতেন। আন্তর্জাতিক বিষয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সমসাময়িক বিষয়ে তিনি খুব বেশি সচেতন ও আগ্রহী ছিলেন।
ওবায়দুল কাদেরের সেই সময়কার সহকর্মীরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সহকর্মী হিসেবে তিনি চমৎকার ছিলেন। তাছাড়া সাংবাদিক হিসেবেও খুব পেশাদার ছিলেন। তিনি যদি রাজনীতি না করে সাংবাদিক থাকতেন, তার অনেক লেখা এবং অসংখ্য বই আমরা পেতাম। যদিও তিনি এখন রাজনীতিতে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছেন। কিন্তু আমরা যারা তাকে পেয়েছি, তারা তার লেখা মিস করছি। তার লেখার জন্য অপেক্ষা করতাম। যেহেতু বাংলার বাণী ছিল বিরোধী ঘরানার পত্রিকা, তাই সাধারণ মানুষেরও আগ্রহ থাকত।
ওবায়দুল কাদেরের লেখালেখি ও তার কলাম সম্পর্কে জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত কবীর চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘যখনি সংকট, যখনই এক অপয়া অন্ধকার ওঁৎ পেতে আসে, যখনই সমাজ ধূসরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, যখনই মিথ্যা ও ইতিহাস বিকৃতির গোলকধাঁধায় নয়া প্রজন্মকে দিগভ্রান্ত করার অপচেষ্টা, যখনই রাজনীতির গৌরব কলুষতায় ঢেকে দেওয়ার অপপ্রয়াস তখনই ওবায়দুল কাদেরের এই জীবন ঘনিষ্ঠ, সত্য ও সুন্দরের আরাধনাময় সাহসী রচনা সমাজকে আলোর ইতিহাস শোনাতে পারে।’
ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকতা জীবনে সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয়, রাজনৈতিক কলাম লিখেছেন অসংখ্য। কবি নির্মলেন্দু গুণ তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘বাংলার বাণী পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে আমার সহকর্মী ছিলেন, কলাম লেখক হিসেবেও জনপ্রিয় হয়েছিলেন।... আমি তার অলংকৃত কাব্যিক ভাষায় বক্তৃতার একজন ভক্তশ্রোতা।’
প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের মূল্যায়ন ছিল, ‘ওবায়দুল কাদের শুধু রাজনীতিক নন, তিনি সাংবাদিক, তিনি বাগ্মী, তিনি লেখক। বক্তৃতায় বাংলা শব্দ উচ্চারণ, ছন্দের ব্যবহারে চারণকবি তিনি। নিবন্ধ লেখক হিসেবে যুক্তি ও বিশ্লেষণে তীব্র লক্ষ্যভেদী তিনি।’
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন তার সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন বাংলার বাণীতে। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১৯৮৯ সালে বাংলার বাণীতে যখন জয়েন করি তখন সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাদের ভাইকে পাই। আমরা বার্তাকক্ষে বসতাম আর তিনি তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটরদের রুমে বসতেন। ওনাদের আলাদা রুম ছিল। তিনি রুম থেকে বের হয়ে সবসময় আমাদের খোঁজখবর নিতেন। মাঝেমধ্যে আমাদের এখানে এসে গল্প করতেন। তিনি সহকর্মী হিসেবে খুবই আন্তরিক ও সহকর্মীবান্ধব ছিলেন।’
সেই সময়ে বাংলার বাণীতে ওবায়দুল কাদেরের আরেক সহকর্মী ও পাক্ষিক ক্রীড়াজগৎ পত্রিকার সম্পাদক দুলাল মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি তাকে ১৯৮৫ সালে পেয়েছি। আমি তখন সহ-সম্পাদক হিসেবে জয়েন করেছি বাংলার বাণীতে। ওবায়দুল কাদের তখন সহকারী সম্পাদক ছিলেন। তিনি কলাম লিখতেন। তার কলাম পাঠকের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল। তার লেখার মধ্যে সাহিত্য ছিল। লেখা খুব আকর্ষণীয় ছিল। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন জায়গায় যেতেন, সেসব বিষয় নিয়েও লিখতেন। তার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা ছিল চট্টগ্রাম, পাহাড়-সমুদ্র খুব পছন্দ করতেন এবং এসব নিয়েও তিনি লেখালেখি করতেন। তিনি খুব আবেগী লোক ছিলেন এবং লেখার মধ্যে সেটা ফুটে উঠত। তার লেখা পাঠক পড়তে বাধ্য হতেন।’
তিনি বলেন, ‘রাজনীতির মানুষ হলেও অফিসে ঢুকলে একজন সংবাদকর্মী হিসেবেই থাকতেন ওবায়দুল কাদের। রাজনীতির বিষয়টা বাইরে রাখতেন। বরাবরই তিনি শৌখিন টাইপের লোক ছিলেন। ভালো কাগজ-কলম ব্যবহার করতেন লেখার সময়। লেখার সময় আলাদা একটা মেজাজে থাকতেন। তখন খুব জরুরি না হলে কোনো বিষয় অ্যালাউ করতেন না। লেখা শেষ করলে বেশ ফুরফুরে থাকতেন। তখন আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন, গল্প করতেন। পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে তার মনোভাব আমরা দেখতে পেয়েছি।’
সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাংবাদিক সুভাষ চন্দ বাদল বাংলার বাণী পত্রিকায় ওবায়দুল কাদেরের সহকর্মী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘কাদের ভাইকে ছাত্ররাজনীতি থেকেই চিনতাম। ১৯৭৫ সালের পর যখন তিনি কারাগারে যান তখন আমিও কারাগারে। তাকে কারাগারে দেখেছি বই নিয়ে ডুবে থাকতে। বাংলার বাণীতে এসে তাকে নতুন করে পেয়েছি। সেই সময় আজিজ মিসির ও তার কলাম ছিল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। তিনি সাংবাদিকবান্ধব। বাংলার বাণী অফিসেও সহকর্মীদের সবসময় সহযোগিতা করতেন। আমি রিপোর্টার হিসেবে যদি কখনো কোথাও আটকে যেতাম তিনি সহযোগিতা করতেন। কাদের ভাই সাংবাদিক হিসেবে ছিলেন মেধাবী ও জ্ঞানী। তার সাহসের ঘাটতি ছিল না। তার কলামেও এর প্রভাব দেখেছি।’
ওবায়দুল কাদের ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানার বড় রাজাপুর গ্রামে জন্ম নেন। বাবা মোশারফ হোসেন সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা শুরু করেন। মা ফজিলাতুন্নেছা। ওবায়দুল কাদের বসুরহাট সরকারি এএইচসি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি ও নোয়াখালী কলেজ থেকে মেধা তালিকায় স্থান পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি কলেজজীবন থেকে ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন।
১৯৭৫-এর পর একনাগাড়ে দীর্ঘ আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং পরপর দুবার সভাপতি ছিলেন।
তার সেই সময়ের সহকর্মীরা বলেন, সাংবাদিক ওবায়দুল কাদের তথা কাদের ভাই মানেই অন্যরকম। তিনি ছিলেন খুব সংবেদনশীল। সবাইকে মেনে নেওয়ার একটা ক্ষমতা ছিল। তিনি যে এত বড় একজন রাজনীতিক ও মুক্তিযোদ্ধা, এত বড় ছাত্রনেতা, তা কখনই সাংবাদিকদের কাছে মনে হতো না। মনে হতো, কাদের ভাই যেন সাংবাদিকতার মধ্যেই ডুবে আছেন। কোনো রিপোর্টার বা সাব-এডিটর অনুবাদ করতে সমস্যায় পড়েছেÑ কাদের ভাইয়ের কাছে গেলেই সমাধান। নিজের রুমে, ডেস্কে বসিয়ে বুঝিয়ে দিতেন। আর তার টেবিলে ছিল সবসময়ই গাদা গাদা বই।
বাংলার বাণীর সেই সময়ের একাধিক সাংবাদিক ওবায়দুল কাদের সম্পর্কে দেশ রূপান্তরকে বলেন, কাদের ভাই ছিলেন সাংবাদিকতার প্রতি পুরো নিষ্ঠাবান। তার কাছে অনেক কিছু শিখেছি। তিনি দীর্ঘক্ষণ কোথাও বসে থাকতেন না। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই তিনি রুম থেকে বেরিয়ে অন্য সহকর্মীদের টেবিলে টেবিলে আড্ডা দিতেন। সেখানে হয়তো আমরা চায়ের অর্ডার দিয়েছি। চা আসতে না আসতেই তিনি উঠে যেতেন। তারপর আবার তাকে চায়ের কাপ নিয়ে খুঁজতে হতো কাদের ভাই কই...।
আজ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়ে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের প্রতিবাদে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের উদ্যোগে শান্তি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্ পরশ। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট তারানা হালিম। আর অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন যুবলীগ সম্পাদক মো. মাইনুল হোসেন খান নিখিল।
সভাপতির বক্তব্যে যুবলীগ চেয়ারম্যান বলেন, বিএনপির মুখে গণতন্ত্রের কথা, মানবাধিকারের কথা মানায় না। আপনাদের হিংসাত্মক রাজনীতি আর সন্ত্রাসের কারণে নতুন প্রজন্ম রাজনীতি করতে চায় না। যারা একুশে আগস্ট ঘটিয়েছে, নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে, কৃষকের বুকে গুলি চালিয়েছে, জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটিয়েছে, তাদের সকল অপকর্মের মেডেল আছে। আমি বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপির প্রধান শত্রু এ দেশের সাধারণ জনগণ। যারা একাত্তরে হাতিয়ার তুলে নিয়েছিল দেশকে স্বাধীন করার জন্য, একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আপনারা বার বার তাদেরকেই আক্রমণ করেন। আওয়ামী লীগ আপনাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে আসে বলেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপনাদের বিরোধ ঘটে। সব সময় এ দেশের সাধারণ মানুষকে আপনাদের ষড়যন্ত্রের শিকার বানান, হত্যার শিকার বানান এবং আপনাদের সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের শিকার বানান।
পরশ আরও বলেন, এ বছরটা নির্বাচনের বছর। আমাদের রাজপথে থাকতে হবে। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। শুধু নেতাকর্মী দ্বারা আবর্ত থাকলে চলবে না, আমাদের চলে যেতে হবে সাধারণ মানুষের কাছে। গত ১৪ বছরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অর্জনের কথা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। যদি সাধারণ মানুষ উন্নয়নের সুফল না পায় তাহলে সেই উন্নয়নের কোনো মূল্য থাকে না। যখন আমাদের সকল উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যেতে পারব তখনই জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।
তিনি যুবলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, যুবলীগের ভাই ও বোনেরা- আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকবেন, আপনারা ধৈর্যশীল থাকবেন। ওদের কৌশল আমাদের সন্ত্রাসী হিসাবে উপস্থাপন করা। ওরা পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করতে চাইবে। আপনারা ওদের ফাঁদে পা দেবেন না। কিন্তু রাজপথ আমরা ছেড়ে দেব না। ভুলে যাবেন না, ওরা কিন্তু দিনকে রাত এবং রাতকে দিন বানাতে পারদর্শী। মিথ্যার ওপরই দলটার সৃষ্টি। ওরা জাতির পিতার নাম মুছে ফেলেছিল, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছিল। সুতরাং মিথ্যা চর্চার ক্ষেত্রে এই দলকে দুর্বল ভাবার কোনো সুযোগ নেই।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, যখন জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, যখন বাংলাদেশের জিডিপি সিংগাপুর, মালয়েশিয়ার উপরে, যখন বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ঠিক সেই মুহূর্তে বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশকে পেছনের দিকে নেওয়ার জন্য নানামুখী ষড়যন্ত্র করছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক তারা সবাই ভবিষ্যদ্বণী করছে, বাংলাদেশ যেভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যদি এভাবে এগিয়ে যায় তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৭তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে। আর এটা সম্ভব শুধুমাত্র রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে।
তিনি যুবলীগের উদ্দেশে বলেন, বিএনপি-জামায়াত আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারা নানা মিথ্যা প্রচারণা ও গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রতিটি জেলায়, উপজেলায়, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড এবং ইউনিটে জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। বলতে হবে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়নি, বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আপনারা শেখ হাসিনার পাশে থাকুন, নৌকার পাশে থাকুন, নৌকায় ভোট দিন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট তারানা হালিম বলেন, যারা স্যাংশন নিয়ে কথা বলেন তাদের দলের প্রধান খালেদা জিয়া তৎকালীন আমেরিকার পরারাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে স্যাংশন চেয়েছেন। যাতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ভাবে ভেঙে পড়ে, দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়, খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়, বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায়, মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। এটাই হলো বিএনপির আসল চেহারা। তারা কখনোই এ দেশের মানুষের ভালো চায় না। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতা আছে কিভাবে অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে তোলা যায়। সামনের যে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কথা বলা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ তা কাটিয়ে উঠতে পারবে। আগামী নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিলে বঙ্গবন্ধুকন্যা তার দূরদর্শী নেতৃত্বে একটি উন্নত-সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবে।
সঞ্চালকের বক্তব্যে যুবলীগ সম্পাদক নিখিল বলেন, রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঢাকার রাজপথে আপনারা পোস্টার হয়েছেন। নুর হোসেন, ফাত্তাহ বাবুল হয়েছেন। তারপরেও দেশের স্বার্থে সংগঠনের স্বার্থে, বঙ্গবন্ধুকন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার প্রশ্নে যুবলীগ আপস করেনি, যুবলীগ আপস করতে জানে না। তিনি যুবলীগের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, যেমনি করে বিগত দিনে কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাজপথ আগলে রেখে প্রিয় নেত্রীর নির্দেশিত পথে মানুষের কল্যাণে, মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য আপনারা সব সময় কাজ করেছেন। আগামী নির্বাচনেও সেই সাহসিকতা আর বীরত্বের সাথে রাজপথে থাকবেন। বিএনপি-জামায়াতের সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আবারও রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে ঘরে ফিরবেন।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. হাবিবুর রহমান পবন, মো. নবী নেওয়াজ প্রমুখ।
বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) ও বগুড়া-৬ (সদর) আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আশরাফুল হোসেন হিরো আলম বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) দুপুর পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘সদরের কেন্দ্র সব দখল হয়্যা গ্যাছে। ডিসি-এসপিক কয়্যাও কোনো কাম হচ্চে না। সদরের আশা সব শ্যাষ। কাহালু-নন্দীগামের অনেক কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে দেকছি। ভোট খুব সুষ্ঠু হচ্চে। মাঠের অবস্থা ভালো। কাহালু-নন্দীগ্রামে নিশ্চিত এমপি হচ্চি।’
এর আগে, সকালে সদর উপজেলার এরুলিয়া উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে যান তিনি। ভোট দেওয়ার পর হিরো আলম বলেন, ‘বগুড়া-৬ আসনে আগে থেকেই গোলযোগের আশঙ্কা করেছিলাম, সেটাই সত্যি হয়েছে। নির্বাচনি এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তবে বগুড়া-৪ আসনে ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে। এভাবে সুষ্ঠু ভোট হলে এই আসনে আমিই বিজয়ী হবো।’
এদিকে বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে কয়েকটি কেন্দ্রে নৌকা প্রার্থীর এজেন্ট বাদে অন্য এজেন্টদের ভোটকক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আজ সকালে হিরো আলমসহ তিনজন প্রার্থী এ অভিযোগ করেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাদের এজেন্টদের বের করে দিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করা হয়।