
প্রতিদিনই সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। এসবে প্রাণ ও অঙ্গহানির তথ্য উদ্বেগজনক। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনা। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত আগস্ট মাসে সারা দেশে ৪৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫১৯ জন ও আহত হয়েছে ৯৬১ জন। সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনার পর অনেকরই রাগ ক্ষোভ গিয়ে পড়ে পরিবহন শ্রমিকদের ওপর। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা ও নানা সংকটের পেছনে আসলে শ্রমিকদের দায় কতটা সে বিবেচনা যেমন জরুরি, তেমনি পরিবহন শ্রমিকরা কতটা মানবেতর জীবনযাপন করেন এবং কতভাবে অধিকার বঞ্চিত হন সেই আলোচনাও জরুরি। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ চালকের অসুস্থতা হলেও বিষয়টি বরাবর উপেক্ষিত। শুধু প্রাণহানি নয়, কোটি কোটি টাকার গাড়িও নষ্ট হচ্ছে। তারপরও পরিবহন-মালিকদের এই বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। চালকদের স্বাস্থ্যগত বিষয়ে খোঁজ রাখেন না তারা। শ্রমিক নেতারা দায় চাপান সরকার ও গাড়ির মালিকদের ওপর।
বুধবার দেশ রূপান্তরে “৩৯ ভাগ গাড়িচালক ‘অসুস্থ’” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায়, দেশের পরিবহন-চালকদের ৩৯.৩৩ ভাগই রক্তে মাত্রাতিরিক্ত সুগার ও উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছে। সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ এটা। বিআরটিএ ও ঢাকা আহছানিয়া মিশনের উদ্যোগে ১৫০ জন বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার ও সিএনজি অটোরিকশাচালকের ওপর চালানো পরীক্ষায় জানা যায়, তাদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে মালিক বা শ্রমিক কোনো পক্ষেরই সচেতনতা নেই। চালকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফল ঘেঁটে দেখা গেছে, ৩৬ ভাগ চালকের রক্তে মাত্রাতিরিক্ত সুগার আর ২৪ ভাগের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। ১১ ভাগ চালকের মাত্রাতিরিক্ত সুগার ও উচ্চ রক্তচাপ উভয়ই রয়েছে। ৬০.৬৭ ভাগ চালকের রক্তের সুগার ও রক্তচাপ স্বাভাবিক ছিল। বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘আমাদের দেশের চালকরা বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যসমস্যা নিয়ে গাড়ি চালান। এটি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।’ চিকিৎসকরা বলেছেন, ‘কারও রক্তে সুগার মাত্রাতিরিক্ত কমে গেলে সেই ব্যক্তি হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে। রক্তচাপের সমস্যা থাকলে মাথা ঘুরতে পারে ও দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। রক্তচাপ খুব বেশি হলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ পর্যন্ত হতে পারে।’ আশঙ্কার কথা হচ্ছে, শারীরিক জটিলতার কথা এসব চালক পরীক্ষার আগে জানতেনই না। তারা না জেনেই গাড়ি চালাচ্ছেন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পরিবহন চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের শরীরে জটিলতা দেখা দিলে বিশেষ করে ঘাড়-মাথাব্যথা করলে তাদের ঘুম ভালো হয় না। গাড়ি চালানো অবস্থায় তাদের অনেকের ঝিম ধরে। অনেক চালক গাড়ি চালানো অবস্থায় ক্লান্ত হয়ে দুর্ঘটনায়ও পড়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চালকদের শরীর গাড়িচালানোর উপযোগী আছে কিনা তা দেখার কোনো সিস্টেম নেই। বিষয়টি দেখে বিআরটিএ ও শ্রমিক ফেডারেশন।’ অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় চালকদের দায়ী করা হলেও তাতে মাদকাসক্তিকেই কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিআরটিএও চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার সময় ডোপটেস্ট নিয়েই দায় সারে। জাতীয় সড়ক পরিবহন মোটর শ্রমিক ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট মোস্তাকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা বাংলাদেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। সরকার বা গাড়ির মালিকরা এই বিষয়ে কখনো ব্যবস্থা নেয়নি।’
দুয়েকটি পরিবহন কোম্পানির ছাড়া বাসচালক-শ্রমিকদের প্রায় কারোই নির্দিষ্ট বেতনভাতা নেই, নেই নিয়োগপত্র কিংবা চাকরির অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা। বেতন না থাকায় মালিকের বেঁধে দেওয়া আয়ের লক্ষ্য পূরণে দৈনিক প্রায় ১৮-২০ ঘণ্টার বিশ্রামহীন কাজের চাপ, শরীর চাঙ্গা রাখতে মাদকে জড়ানো, নিম্ন মজুরি, কাজের অনিশ্চয়তা, মালিক-যাত্রী-প্রশাসনের লাঞ্ছনা, অর্থকষ্ট, অনিশ্চিত জীবন, শেষ জীবনে দুর্গতি, পারিবারিক অশান্তিসহ এক টালমাটাল জীবন পার করে থাকে দেশের কয়েক লাখ গণপরিবহন শ্রমিক। ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও কর্মপরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গরম ইঞ্জিনের ওপর টানা ১৮ ঘণ্টা গাড়ি চালালে চোখ, কাঁধ, পিঠ ও পেশির ব্যাপক ক্ষতি হয়। শরীরে দৈনিক তিন হাজার ক্যালরির বেশি তাপ এদের উৎপাদন করতে হয়। এজন্য সুষম খাবার ও কমপক্ষে আট ঘণ্টা বিশ্রামের প্রয়োজন। এসব না পাওয়ায় পরিবহন শ্রমিকরা কম বয়সে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন সড়কের নৈরাজ্য আর বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে পরিবহন শ্রমিকদের এই মানবেতর অনিশ্চিত জীবনের বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। চালক ও সহকারীসহ পরিবহনের শ্রমিকদের বেতনভুক্ত কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দিলে এই খাতের শ্রমিকদের প্রশিক্ষিত করে তোলা এবং নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ হবে।
প্রাণজগতে শোক কিংবা সুখ সকলি স্মৃতি-বিস্মৃতির পাঠ। সেই তিন লাখ থেকে তিরিশ হাজার বছর ধরে প্রজাতি হিসেবে মানুষ স্মৃতি আঁকড়ে বা মুছে বড় হয়েছে। বিবর্তনের দীর্ঘধারায় সব মানুষের সমাজই শোকবিহ্বল হয়েছে। ইরেকটাস, ডেনিসোভান, ফ্লোরিয়েনসিস, নিয়ানডার্থাল কিংবা আজকের এই স্যাপিয়েন্স আমরা সবাই অগণিত শোকের সাক্ষ্য বহন করে চলেছি। শুধু কী মানুষ; শামুক, মৌমাছি, বনরুই, তরুলতা কিংবা তিমিরও আছে শোক-দিনলিপি। মানুষ কত কী কারণে শোককাতর হয়, তবে সব শোকের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কোনো না কোনো স্মৃতি। চলতি আলাপখানিও এক গাছের স্মৃতিকে ঘিরে শোকগাথা। গাছটির জন্ম বা নিবাস এই ভূগোলে নয়।
প্রাকৃতিকভাবে এর বিস্তারও ঘটেনি বাংলাদেশে। কিন্তু দীর্ঘসময় এই গাছ বনের ভেতর দাঁড়িয়ে ছিল একা। গড়ে তুলেছিল কত কল্পকথা কী স্মৃতিভা-। ‘আফ্রিকান টিক ওক’ নামে এই গাছ টিকে ছিল লাউয়াছড়া বনে। বনবিভাগের সূত্র উল্লেখ করে সম্প্রতি গণমাধ্যম জানাচ্ছে শেষ গাছটিও মরে গেছে। জানা মতে, লাউয়াছড়া বনে এই গাছ ছিল দুটি। ২০০৬ সালের ঝড়ে অন্যটি নিহত হয়। সদ্যপ্রয়াত এই গাছটির সঙ্গে আমার কিশোর ও তরুণ বয়সের বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। একটা লম্বা সময় পর্যন্ত গাছটি ‘ক্লোরোফরম গাছ’ হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। লম্বা এই গাছের তলে গেলে মাথা ঝিম ঝিম করে কিংবা এর পাতা নাকে-মুখে লাগলে মানুষ অচেতন হয়ে যায়, এমন কল্পকথা প্রচলিত হয়েছিল গাছটি ঘিরে। তখনো লাউয়াছড়ায় পর্যটকের ঢল নামেনি। শ্রীমঙ্গল বা তার আশপাশের কিছু উৎসাহী পরিবার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাসফরে আসা মানুষদের কাছে এই গাছ ছিল লাউয়াছড়ার অন্যতম নিদর্শন। লাউয়াছড়া বনের বুক ফালি করে যাওয়া রেললাইন পেরিয়ে বামের মোড়ের গাছটি নিয়েই ছিল সবার উৎসাহ। আর সদ্যপ্রয়াত লাউয়াছড়ার রাস্তার ছড়ার ধারের গাছটি যেন অনেকটাই ছিল আড়ালে। ডাকবাংলো, বন গবেষণার নার্সারি বা লাউয়াছড়া খাসিপুঞ্জি যতবার গেছি এই গাছ সাক্ষী হয়েছিল।
গাছটির সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ১৯৯২ সালের দিকে। আমরা জানতাম এটি ক্লোরোফরম গাছ। এমনকি টিনের পাতে এমন নামও লেখা ছিল। বহুবার গাছের তলে গিয়ে পরীক্ষা করেছি। কুড়িয়ে নিয়েছি ঝরাপাতা। বহুবার মনে হয়েছে শরীর ঝিমঝিম করছে, হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাব। কিন্তু কখনো তা ঘটেনি, কারও কখনো ঘটেছে কি না তাও শুনিনি। অনেক পরে গাছটির সঠিক উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম টানানো হয়েছিল। গাছটিকে ‘ক্লোরোফরম গাছ’ ভাবার একটা কারণ ছিল বৈকি। এমনিতেও এক অচেনা গাছ, তার ওপর এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ‘ক্লোরোফ্লোরা একসেলসা’। শুনেছি বনবিভাগের স্থানীয় প্রতিনিধিরা গাছটির উদ্ভিদতাত্ত্বিক নামের প্রথম অংশকে ভুল করে ‘ক্লোরোফরম’ করে ফেলেন আর গাছটিও ‘ক্লোরোফরম গাছ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। মাত্র দুটি হলেও সব বিবেচনায় ভিনদেশি এই গাছ দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি হয়ে ওঠে। এখন লাউয়াছড়া বন ১৬৭টি প্রজাতি থেকে একটি প্রজাতি হারাল। একটি প্রাণপ্রজাতির মৃত্যু মানে বাস্তুতন্ত্রের এক বিশাল শূন্যতা। লাউয়াছড়া বনের ক্ষেত্রে এই গাছের পরিবেশগত অবদান কতখানি তা আমরা খতিয়ে দেখিনি, কিন্তু এর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব তৈরি হয়েছিল। জানা যায়, ১৯৩০ সালের দিকে এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা নাকি গাছটির চারা লাউয়াছড়াতে নিয়ে আসেন। সে সময় প্রাকৃতিক বনের অনেক গাছ কেটে চাপালিশ, সেগুন, গর্জন, লোহাকাঠ, রক্তন চারাও লাগানো হয়। তার মানে এই গাছ ছিল লাউয়াছড়ার শত বছরের সাক্ষী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, নানকার বিদ্রোহ, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে। শত বছরের মহামারী দেখেছে। জুলভার্নের ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’ কিংবা হুমায়ূন আহমেদের ‘আমার আছে জল’ সিনেমার শ্যুটিং দেখেছে। ১৯৯৭ সালে লাউয়াছড়া বনে অক্সিডেন্টালের অগ্নিকা- সয়েছে। দেখেছে গ্যাস জরিপের নামে ইউনোকল কী শেভরন কীভাবে লন্ডভন্ড করেছে লাউয়াছড়া বন। বাংলাদেশে এমন প্রজাতি আর কটিই বা আছে, যা কোনো প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রে স্মৃতিময় হয়ে দীর্ঘজীবন পার করছে। দেশের শেষ ‘আফ্রিকান টিক ওক’ গাছটির মৃত্যুর খবর বহু প্রশ্নকে সামনে টেনে এনেছে। মানুষ বা বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হলে চিকিৎসক বা অভিজ্ঞজন পরীক্ষা করে মৃত্যুর খবর জানান। কিন্তু একটি গাছের মৃত্যু বিষয়ে আমরা কীভাবে নিশ্চিত হই? হাতি, বাঘ, ডলফিন, কুমির বন্যপ্রাণী মারা গেলে ময়নাতদন্ত হয়। কিন্তু গাছের কী ময়নাতদন্ত হয়? তাহলে আমরা নিশ্চিত হই কীভাবে একটি গাছ মারা গেছে। গণমাধ্যমে প্রচারিত লাউয়াছড়ার শেষ ‘আফ্রিকান টিক ওক’ গাছটির মৃত্যুর খবরও এসব চিন্তাকে সামনে আনছে। কে, কারা, কীভাবে কোন পরীক্ষা-পদ্ধতির মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছেন গাছটি মারা গেছে তা জানা এবং এর কারিগরি জানা জরুরি। একটি গাছে হয়তো পচন ধরেছে বা রোগাক্রান্ত হয়েছে, ডালপালা শুকিয়ে যাচ্ছে, আগা মরে যাচ্ছে, পুষ্প-পল্লব ঝরে পড়ছে এসব হয়তো সেই গাছটির মরণের দিকে যাওয়ার কিছু দৃশ্যমান নির্দেশনা। বইয়ের ভাষায় অঙ্গসংস্থানিক বৈশিষ্ট্য। একটি গাছের জীবনচক্রে বীজ থেকে অংকুরোগদম হয়ে শিশু চারাগাছ থেকে যৌবনকাল, বার্ধক্য ও মৃত্যুপর্যায় থাকে। একবর্ষজীবী, বহুবর্ষজীবী কিংবা প্রজাতিভেদে এই জীবনকাল ও চক্র ভিন্ন হয়। কিন্তু ‘আফ্রিকান টিক ওকের’ মতো কোনো বৃহৎ বহুবর্ষজীবী বৃক্ষের ক্ষেত্রে এর মৃত্যু সম্পর্কে কীভাবে আমরা নিশ্চিত হতে পারি? আবার এটি যখন দেশের কোনো পাবলিক বনের কোনো পাবলিক প্রাণসম্পদ হয়। আলোচ্য শেষ গাছটি কী মৃত্যুর দিকে যাত্রা করেছে নাকি তার মৃত্যু হয়েছে? তাহলে গণমাধ্যম কীভাবে এই গাছের ‘মৃত্যুসংবাদ’ প্রচার করছে? একটি হাতি বা তিমির ক্ষেত্রে প্রামাণ্য দলিল নিয়ে বেশ সতর্কতার সঙ্গে মৃত্যুসংবাদ পরিবেশিত হয়। তাহলে একটি গাছের মৃত্যুসংবাদের ক্ষেত্রে কেন এমন সতর্কতা ও প্রামাণ্য দলিল থাকবে না? তো আমরা প্রাণজগতের এক এক প্রাণপ্রজাতির সঙ্গে কেন একেক রকমের আচরণ করি? সকল প্রাণসত্তার বিকাশ ও বিস্তারের সমান অধিকার থাকলেও মানুষ কেবল তার প্রয়োজনকে বিবেচনা করে কোনো প্রজাতিকে বেশি মনোযোগ দেয় এবং কোনো প্রজাতি মনোযোগের বাইরে থেকে যায়। পরিবেশ-দর্শনে এ ধরনের চিন্তাপদ্ধতিকে বলে ‘প্রাণকেন্দ্রিক বা বায়োসেন্ট্রিক মতবাদ’। দেশের শেষ আফ্রিকান টিক ওকগাছের মৃত্যুসংবাদ পরিবেশনে আমাদের মনোজগতে প্রবল হয়ে থাকা বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। আশা করি দেশের প্রবীণ, স্মৃতিময় এবং স্মারকবৃক্ষের মৃত্যু নিশ্চিত ও এর সংবাদ পরিবেশনে আমরা প্রতিবেশ-পরায়ণ হব।
আফ্রিকা থেকে আসা
মোরাসি পরিবারের একটি গোত্র হলো মিলিশিয়া। আর এই গোত্রে দুনিয়ায় দুটি মাত্র প্রজাতি আছে। একটি হলো মিলিশিয়া এক্সসেলসা এবং অন্যটি মিলিশিয়া রেজিয়া। আফ্রিকায় এই গাছ ইরুকু, ইনটুলে, কামবালা, মোরেইরা, এমভুলে, ওডাম ও টুলে নামে পরিচিত। আর ‘মিলিসিয়া এক্সসেলসারই’ আগের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ছিল ‘ক্লোরোফ্লোরা এক্সসেলসা’। বৃহৎ এই পত্রঝরা গাছটি প্রায় ১৬০ ফুট দীর্ঘ হতে পারে। গাছের বাকল ধূসর রঙের এবং চিরলে দুধের মতো কষ গড়িয়ে পড়ে। পুরুষ গাছে সাদা ক্যাটকিন ও স্ত্রী গাছে পুষ্পকা- থাকে। ফল লম্বা ও ভেতরে ছোট ছোট বীজ থাকে। গাছটি মধ্য আফ্রিকার নানা অঞ্চলে জন্মে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাটির বৈশিষ্ট্য, বৃষ্টিপাত এবং আবহাওয়া গাছের ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গসংস্থানিক বৈশিষ্ট্য প্রদান করে। আফ্রিকার গিনিবিসাউ, মোজাম্বিক, অ্যাংগোলা, বেনিন, বুরুন্ডি, ক্যামেরুন, কঙ্গো, গিনি, ইথিওপিয়া, গ্যাবন, ঘানা, আইভরি কোস্ট, কেনিয়া, মালাউয়ি, নাইজেরিয়া, রুয়ান্ডা, সাউতমে প্রিন্সপে, সিয়েরালিওন, সুদান, তাঞ্জানিয়া, টোগো, উগান্ডা ও জিম্বাবুয়িতে বেশি দেখা যায়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে গাছে ফুল ফোটে। বাদুড়, কাঠবিড়ালি ও পাখি এই গাছের ফল খেয়ে বীজ বিসরণ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, বাদুড়সহ বন্যপ্রাণীর মাধ্যমে খাওয়া ফলের বীজ থেকেই এই গাছের বেশি অংকুরোদগম হয় এবং এসব চারা বেশ রোগ প্রতিরোধী হয়। প্রাকৃতিকভাবে এক গুরুত্বপূর্ণ কার্বন-আধার হিসেবে কাজ করে এই গাছ। আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ জোট আইইউসিএন ‘সংকটাপন্ন প্রায়’ হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। মূলত বাসস্থান হারানোর কারণেই গাছটি দুনিয়া থেকে উধাও হচ্ছে।
আফ্রিকা অঞ্চলে গরষরপরধ বীপবষংধ এবং গরষরপরধ ৎবমরধ এই উভয় বৃক্ষপ্রজাতির কাঠ ‘আফ্রিকান টিক’ নামে পরিচিত। যেমন আমরা সেগুন কাঠকে বলি ‘বার্মিজ টিক’। এই কাঠ খুব শক্তিশালী ও গাঢ় বাদামি বর্ণের। উইপোকা-প্রতিরোধী বলে স্থাপনা নির্মাণ, আসবাব, নৌযান, মেঝেতে ব্যবহৃত হয়। মাটির ক্ষয়রোধে এই গাছ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নাইট্রোজেন উৎপাদনকারী এ গাছের পাতা জৈব মালচিং হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গাছের বাকল কফ নিবারণী, হৃদরোগের চিকিৎসায়ও ব্যবহৃত হয়। গাছের কষ টিউমার, পাকস্থলী ও গলার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর কাছে এটি এক পবিত্র বৃক্ষ। সংরক্ষিত এই গাছের তলে উৎসর্গ ও সমর্পণমূলক কৃত্য পালিত হয়। বিশেষ করে গাছটি উর্বরতা ও নতুন জন্ম সম্পর্কিত কৃত্যের সঙ্গে জড়িত। দক্ষিণ নাইজেরিয়ার ইবো আদিবাসীরা বিশ্বাস করে এই গাছ নবজাতকের আত্মাকে সজ্জিত ও বিন্যস্ত করে। ঘানার হো অঞ্চলে এই গাছ বামনদের বাসস্থান হিসেবে গণ্য এবং এর তলে কৃত্য পালিত হয়। এই গাছের কাঠ পবিত্র বাদ্যযন্ত্র ও মৃতদেহের কফিন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। আইভরি কোস্টের গুয়েরে ও ঔবি আদিবাসীরা এই গাছের নিচে বলিদান করে। বাংলাদেশের লাউয়াছড়ায়ও কিন্তু এই গাছ ‘ক্লোরোফরম গাছ’ নামের এক কল্পকথার জন্ম দিয়েছিল। লাউয়াছড়ার পর্যটনে ভূমিকা রেখেছিল।
আহারে নিঃসঙ্গ গাছ!
বাংলাদেশে এমন বহু নিঃসঙ্গ গাছ আছে। কোনোটা অচিন আবার কোনোটা জানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি ভবনে যেমন টিকে আছে দেশের একমাত্র তালিপাম গাছ। বাইরে থেকে আসা কোনো প্রজাতি যদি কোনো বাস্তুতন্ত্রে প্রতিবেশগত বিশৃঙ্খলা তৈরি করে এবং স্থানীয় খাদ্যচক্রে সংকট ঘটায় তখন সেই প্রজাতিটি ‘ইনভেসিভ/এলিয়েন’ হিসেবে পরিগণিত হয়। আমি একে ‘আগ্রাসী প্রজাতি’ নাম দিই। ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২’ ‘আগ্রাসী’ প্রত্যয়টি গ্রহণ করেছে। ইউক্যালিপটাস, ম্যাঞ্জিয়াম, একাশিয়া, শিশু এমন আগ্রাসী প্রজাতির বিরুদ্ধে আমরা বহু বছর ধরে লড়ছি। নেত্রকোনায় ‘মেনকীফান্দা আন্দোলনের’ নেতা অজিত রিছিল আগ্রাসী জাতের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে জেল-জুলুম খেটেছেন। প্রতিটি প্রজাতিরই একটি জন্মভূমি বা ‘সেন্টার অব অরিজিন’ থাকে। যেমন বেগুনের জন্মভূমি বাংলাদেশ, আলুর পেরু, কৃষ্ণচূড়ার মাদাগাস্কার। দীর্ঘসময় কোনো প্রজাতি বাইরে থেকে এসে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রে খাপ খাইয়ে নেয় এবং খাদ্যশেকলের সহায়ক হয়ে ওঠে। আফ্রিকা থেকে এলেও আফ্রিকান টিক ওকগাছটি কোনোভাবেই একাশিয়া বা ইক্যালিপটাসের মতো এই দেশের বাস্তুতন্ত্রে আগ্রাসী নয়। তবে বন্যপ্রাণীর সঙ্গে এর সম্পর্ক এবং প্রতিবেশগত অবদান কতখানি তা গভীর অনুসন্ধান ও মূল্যায়নের বিষয়। বন্যপ্রাণী আইনে এ ধরনের গাছকে ‘স্মারকবৃক্ষ’ বলা হয়েছে এবং এর সংরক্ষণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
চিহ্ন সংরক্ষিত হোক
৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ গণমাধ্যমে গাছটির মৃত্যুর কিছু খবর প্রকাশিত হয়। ২০২২ সালের শুরুর দিকে ছড়ার পাড়ে টিকে থাকা এই গাছটির পাতা ঝরে যায় ও গোড়ায় পচন ধরে। আর এতেই ধারণা করা হচ্ছে গাছটি মারা গেছে। বনবিভাগ জানায়, বহু চেষ্টা করেও এর বংশবিস্তার করা সম্ভব হয়নি। গাছটির কোনো বীজ ছিল না এবং ফুল ধরলেও ঝরে পড়ে যেত। কাটিং করেও সফল হওয়া যায়নি। শেষ গাছটি মরে গেছে নাকি মরণের প্রান্তে এটি জানা জরুরি। আশা করি রাষ্ট্র দেশের শেষ আফ্রিকান টিক ওকগাছটি বিষয়ে মনোযোগী হবে। ২০০৬ সালে ঝড়ে উপড়ে পড়ার পর প্রথম মৃত গাছটির গুঁড়ি বনবিভাগ বেশ যতœ করে দর্শনার্থীদের জন্য রক্ষা করেছে। লাউয়াছড়ার পাশাপাশি জাতীয় জাদুঘর ও পাবলিক সংগ্রহশালায় শেষ গাছটির অংশবিশেষ স্মৃতিস্মারক হিসেবে সংরক্ষণ করা জরুরি।
লেখক : প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ গবেষক ও লেখক
আবুল মনসুর আহমদের যখন জন্ম তখন (১৮৯৮) এই অঞ্চলের মানুষ ধর্ম ও আত্মপরিচয় নিয়ে ছিল দ্বিধান্বিত। কে কোথা থেকে এসেছে, কী করবে, কী তার পরিচয়সেসব ভাবনার দোলাচলে বিশাল এক জনগোষ্ঠী। ফলত বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে আবুল মনসুরের জীবন ও কর্ম পরস্পর হাত ধরাধরি করে আছে শত বছর। তার সামাজিক রাজনৈতিক চিন্তাধারা জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রচিন্তাকে এগিয়ে নিতে সব সময় ভূমিকা রেখে আসছে। দেখা যায়, তৎকালীন সময়ে অনেক শিক্ষিত মুসলমানের মতোই বাংলার আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যময় পটভূমির সন্তান তিনি। স্বভাবতই দুই স্রোতে অবগাহন তার জন্য ভবিতব্যই হয়ে ওঠে। মেধার বিকাশ ঘটান প্রধানত সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও রাজনীতির ত্রিধারায়। তবে সাহিত্য ছিল তার রক্তে। হয়তো তাই এর প্রকাশ পায় কৈশোরে-তারুণ্যে।
রাজনৈতিক সচেতনতা, সমাজ ভাবনা, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার চোখ আবুল মনসুর আহমদকে দিয়েছে অনন্যতা। তাই তিনি রচনা করতে পেরেছেন ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’-এর মতো অসামান্য ইতিহাস। এটি ১৯২০ থেকে ১৯৭০ দশকের মধ্যবর্তী সময়ের একটি দলিল। তবে বইটি লেখা শেষ হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। স্বাধীনতার পর আরও কয়েকটি অধ্যায় জুড়ে দিয়ে ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত সময়টিকে ধরে রেখেছেন বইতে। এটা আমাদের দূর অতীতে নিয়ে যায়টানাপড়েনের দশকগুলোতে, যখন অবিরাম রাজনীতিতে ভাঙাগড়ার খেলা চলছিল।
এই বইয়ে আবুল মনসুর আহমদের অনেক ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং শ্রেণি-অবস্থানের জানান থাকলেও তা এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। তিনি এতটা নিখুঁতভাবে সময়কে তুলে এনেছেন তা খুব রাজনৈতিকই করেছেন। ফলে বাংলাদেশের শতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাস হোক কি কেবল গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস হোক, সূত্রগ্রন্থ হিসেবে ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ কাছে না পেলে ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি আসলে অনুসন্ধিৎসু ভাষ্যকার। তিনি সময়ের ইতিহাস লিখেছেন, দিয়েছেন নিজস্ব ভাবনাযোগে টীকা-টিপ্পনী।
বিশেষ করে পাকিস্তান কেমন রাষ্ট্র হবে তার স্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন পাকিস্তান জন্মের অনেক আগেই। ১৯৪৪ সালে আনুষ্ঠানিক সভায় সভাপতি হিসেবে তিনি বলেছিলেন : ‘পাকিস্তান দাবিটা প্রধানত কালচারাল অটনমির দাবি। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার চেয়ে কালচারাল অটনমি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই দিক হইতে পাকিস্তানের দাবি শুধু মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক দাবি নয়, এটা গোটা ভারতের কালচারাল মাইনরিটির দাবি। ভারতীয় মুসলমানরা হিন্দু হইতে আলাদা জাত তো বটেই, বাংলার মুসলমানরাও পশ্চিমা মুসলমানদের হইতে পৃথক জাত। শুধুমাত্র ধর্ম জাতীয়তার বুনিয়াদ হইতে পারে না।’ তার এই চিন্তাটি সাতচল্লিশে নয়, একাত্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে আমাদের কালক্রমে ঘটে যাওয়া বড় ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপট যার জানার জন্য বইটি দরকার।
অন্যদিকে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবুল মনসুর আহমদের পর্যবেক্ষণ ছিল একেবারে আলাদা। যেমন তিনি বলেছেন‘তিনশ পনেরো সদস্যের পার্লামেন্টে জনা-পঁচিশেক অপজিশন মেম্বার থাকিলে সরকারি দলের কোনোই অসুবিধা হইত না। বরঞ্চ ওইসব পার্লামেন্টারিয়ান অপজিশনে থাকিলে পার্লামেন্টের সৌষ্ঠব ও সজীবতা বৃদ্ধি পাইত।...বাংলাদেশের পার্লামেন্ট পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের একটা ট্রেনিং কলেজ হইয়া উঠিত। আর এসব শুভ পরিণামের সমস্ত প্রশংসা পাইতেন শেখ মুজিব।’ গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ লিখছেন‘স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদের মন্তব্য বেশ চাঁছাছোলা। বইজুড়ে আবুল মনসুর আহমদ এ ধরনের অনেক রূঢ় সত্য উচ্চারণ করেছেন সহজ-সরলভাবে’ বাংলাদেশের স্বাধীনতায় দ্বি-জাতিতত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, এমনটা তিনি মনে করেন না।
আবুল মনসুর আহমদের মতে, ‘এক পাকিস্তানের জায়গায় দুই পাকিস্তান হইয়াছে। ভারত সরকার লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নে আমাদের সাহায্য করিয়াছেন।...লাহোর প্রস্তাবে “পাকিস্তান” শব্দটার উল্লেখ নাই, শুধু মুসলিম মেজরিটি রাষ্ট্রের উল্লেখ আছে। তার মানে রাষ্ট্রের নাম পরে জনগণের দ্বারাই নির্ধারিত হওয়ার কথা। পশ্চিমা জনগণ তাদের রাষ্ট্র-নাম রাখিয়াছে “পাকিস্তান”। আমরা পুরবীরা রাখিয়াছি “বাংলাদেশ”। এতে বিভ্রান্তির কোনো কারণ নাই।’ এ রকম অসংখ্য তিক্ত সত্য তিনি বলেছেন। অন্যদিকে দেখা যায়, রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদের রাজনৈতিক জীবনকাল প্রায় চার দশক। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে ছিলেন। তবে শৈশবেই তার সাংবাদিকতা ও রাজনীতির হাতেখড়ি হয়। এতে ত্রিকালদর্শী জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে যশ ও খ্যাতি যেমন ছিল, তেমনি জুটেছিল সামরিক শাসনের কারা যন্ত্রণা। কর্মজীবনে তিনি মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নেতাজি সুভাষ বসু, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর, সৈয়দ নওশের আলী, খাজা নাজিমুদ্দিন, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মিঞা ইফতেখার উদ্দিন, মিঞা মাহমুদ আলী কাসুরী, জি এম সৈয়দ, মিঞা মমতাজ দৌলতনা, আবুল হাশিম প্রমুখ এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও নেতাদের সঙ্গে ছিল তার ব্যক্তিগত পরিচয় ও হৃদ্যতার সম্পর্ক। জনশ্রুতি আছে নেতাজি সুভাষ বসুর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল ‘তুমি’-‘তুমি’ পর্যায়ের। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শ্রদ্ধাস্পদ নেতা ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু সগৌরবে আবুল মনসুর আহমদকে ‘লিডার’ বলতেন এবং কলেজ জীবন থেকে নিজেকে তার শিষ্য বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
বিশ শতকের ষাটের দশকে আবুল মনসুর আহমদ সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও একজন রাজনৈতিক-বিশ্লেষক হিসেবে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতাকে বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। দেশের সংকট-সম্ভাবনায় এগিয়ে যাওয়ার নানান দিক গবেষণামূলক প্রবন্ধে অসামান্যভাবে তুলে ধরেছেন। ঐতিহাসিক সেসব প্রবন্ধ আজও প্রাসঙ্গিক রাষ্ট্রের প্রয়োজনে। তার আত্মজীবনীমূলক রচনাদি দেশীয়-আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-অধ্যয়নের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ টেক্সট হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ফলে আবুল মনসুর আহমদের জীবন থেকে দেখি : দেশপ্রেম বুকে নিয়ে সারাজীবন দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন। তার দেখা সমাজের প্রতিটি অসংগতি নিয়েই কলম ধরেছেন। সময়ের বুকে পা রেখে কুয়াশা ভেদ করে দেখেছেন আলো। সর্বত্র বিচরণে দিনে দিনে তার কলম হয়ে উঠছে দুর্ধর্ষ। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের প্রেরণা জুগিয়ে, সবার মধ্যে দিয়েছে শুদ্ধচিন্তার খোরাক। স্বতন্ত্র কালচারের স্বপ্ন দেখে একাধিক গ্রন্থও রচনা করেন।
সর্বোপরি, গত শতকের সমাজ রাজনীতি বুঝতে ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি আবুল মনসুর আহমদের চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে দেখা। আর তাকে পাঠ করার মধ্য দিয়ে আমরা অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ পেতে পারি। আমাদের সমাজ-রাজনীতির চেহারা কেমন ছিল, কতটা পরিবর্তন হয়েছেপরিষ্কার ধারণা পাওয়া প্রয়োজন।
লেখক : কবি ও গবেষক
বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা কী? প্রশ্নটির সহজ উত্তর, ‘রাজনৈতিক’। রাজনৈতিক সমস্যা অস্বীকার করা যাবে না। পাশাপাশি বহু নিপীড়নমূলক সমস্যার জালে দেশবাসী জড়িয়ে পড়েছে। সেসব সমস্যাও অগুরুত্বপূর্ণ নয়। সব সমস্যার মূলেই রাজনৈতিক সমস্যা; সেটা স্বীকার করতেই হবে। রক্তাক্ত একাত্তরের বিজয়ের পর কেটে গেল পঞ্চাশ বছর। যুদ্ধ শেষে দেশবাসী যে স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার পূর্ণতার সম্ভাবনা দেখেছিল আমাদের জাতীয়তাবাদী শাসকরা, তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলেছে। জনগণ মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে মুক্তি পাবে বলে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। বাস্তবে জনগণের সেই কাক্সিক্ষত স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে। সাবেকি ব্যবস্থা তো বদল হলোই না। বিপরীতে আরও আঁটসাঁট বেঁধে গণবিরোধী সেই ব্যবস্থা জাতির স্কন্ধে জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেপে বসেছে। শাসক বদল ছাড়া রাষ্ট্রযন্ত্র অপরিবর্তিত থাকায় রাষ্ট্রের চরম প্রতিপক্ষ এখন জনগণ। যদিও আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রের একচ্ছত্র মালিকানা জনগণের ওপর ন্যস্ত। বাস্তবতা ঠিক বিপরীত। জনগণ এই রাষ্ট্র ব্যবস্থাধীনে প্রজা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। তাই প্রজা শোষণ চলছে অবিরাম, অব্যাহত গতিতে।
স্বাধীন রাষ্ট্রে সাবেকি ব্যবস্থার অধীনে জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক অধিকার কোথায় সুরক্ষা পেয়েছে? মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে জাতীয়তাবাদীদের প্রয়োজন-গুরুত্ব দুই-ই ফুরিয়েছিল। দেশ ও জনগণের স্বপ্নপূরণে জাতীয়তাবাদীদের ব্যর্থতা এবং সমাজতন্ত্রের অভিমুখে অগ্রযাত্রায় সব সম্ভাবনাকে পিষ্ট করে জাতীয়তাবাদীরা শাসনক্ষমতার লাগাম নিজেদের অধীনে টেনে ধরে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষারই কবর রচনা করেছে। শোষণ-বঞ্চনার শিকার দেশবাসী ধারাবাহিকভাবে ৫০ বছর ধরে শোষণ-নিপীড়নের শিকার হয়ে এসেছে। ক্ষমতা এবং একমাত্র ক্ষমতা পেয়েই জাতীয়তাবাদীরা মহানন্দে দেশ-জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার তোয়াক্কা না করে শ্রেণি স্বার্থকে প্রধান করে তুলেছে। আমাদের পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতার বদৌলতে নানা ঘৃণিত পন্থায় অর্থ-বিত্তের বৈভবে বুর্জোয়ায় পরিণত হয়েছে সত্য। তবে বুর্জোয়া ব্যবস্থাধীনে যে প্রক্রিয়ায় বুর্জোয়াদের বিকাশ ঘটে আমাদের দেশে কিন্তু সে রূপে বুর্জোয়া বিকাশ ঘটেনি। লুণ্ঠন, দখলদারি এবং সীমাহীন দুর্নীতির আশ্রয়ে শাসক শ্রেণির ছাতার নিচে নিরাপদ আশ্রয়ে আমাদের দেশে বুর্জোয়া বিকাশ ঘটেছে। যাদের অনায়াসে লুণ্ঠনকারীই বলা যায়।
রাজনৈতিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ঘটেনি বলেই সেই সমস্যা ক্রমেই বহু সমস্যার জন্ম দিয়েছে। আর সব সমস্যার খেসারত দিয়ে যাচ্ছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। আমাদের শাসকশ্রেণি মাত্রই জাতীয়তাবাদী রূপে নিজেদের অভিহিত করে থাকে। নির্বাচিত এবং উর্দিধারী প্রতিটি শাসকই নিষ্পত্তি হওয়া তথাকথিত জাতীয়তাবাদের মোড়কে-আশ্রয় নিয়েছে। একাত্তরে জাতীয়তাবাদীদের প্রয়োজনীয়তা শেষ হলেও ক্ষমতার জোরে জাতীয়তাবাদের রক্ষাকবচ ঢাল শাসকদের প্রত্যেকের কাছে শোভা পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে মৌলিক অবস্থানে তাদের ভিন্নতা নেই। অথচ প্রকৃত জাতীয়তাবাদী মাত্রই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। কিন্তু আমাদের জাতীয়তাবাদী শাসক দলগুলো চরমভাবে সাম্রাজ্যবাদের আনুগত্যের নজির স্থাপন করেছে। দেশ-জনগণের এবং জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে; সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রতিনিধি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছে। এই হেন ও হীন জাতীয়তাবাদী নামধারী শাসকগোষ্ঠী পৃথিবীতে কমই দেখা যাবে। সাম্রাজ্যবাদীদের অনুগ্রহ পেতে পরস্পর প্রতিযোগিতায় পর্যন্ত লিপ্ত। কে কত বেশি আনুগত্যে দেশের স্বার্থ বিকোতে সক্ষম এ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাদের সামান্য দ্বিধা সংকোচ নেই।
সম্প্রদায়গত চেতনায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধীনতা বরণ করে নেওয়া তৎকালীন পূর্ববাংলার মানুষের দ্রুতই স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছিল। তেইশ বছরের লাঞ্ছনা-বঞ্চনার অবসানে প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা। দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ, আত্মদানে পাকিস্তানি সামরিক শক্তিকে পরাভূত করে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হলো তার প্রধান ও একমাত্র উপলক্ষ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা। অথচ সম্প্রদায়গত চেতনা ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার চেতনায় এই ভূখণ্ড দুবার স্বাধীন হলেও, জনগণের মুক্তি অর্জন অধরাই রয়ে গেছে। সম্প্রদায় এবং জাতীয়তা আমাদের মুক্তি দিতে ব্যর্থ সেটা তো প্রমাণিত। সশস্ত্র বিজয় অর্জনের পর সমাজতন্ত্রের অভিমুখে আমাদের অগ্রযাত্রার সম্ভাবনা অঙ্কুরেই ক্ষমতাসীন জাতীয়তাবাদীরা বিনাশ করে জাতির অগ্রযাত্রাকে নষ্ট করেছে। সমাজতন্ত্রের পথেই আমাদের মুক্তি লাভ সম্ভব। অন্য কোনো উপায়ে যে নয়; তা-বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অথচ সমাজতন্ত্রের উপযোগী-উর্বর এই দেশে সমাজতন্ত্রের বিকাশ লাভ সম্ভব হলো না। কেন হলো না? এ প্রশ্নও অমূলক নয়।
সমাজতন্ত্রের অভিযাত্রায় সমাজতান্ত্রিক দল-সংগঠনের গুরুত্ব সর্বাধিক। সমাজতান্ত্রিক দলের পক্ষেই সম্ভব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে অগ্রগামী করে তোলা। জনগণকে আন্দোলনের পক্ষে এককাতারে নিয়ে আসা। আমাদের দেশে সমাজতান্ত্রিক দলের তালিকা ক্ষুদ্র নয়। বরং তালিকা দীর্ঘ। কিন্তু সাংগঠনিক আকারে-আয়তনের ক্ষেত্রে হতাশাজনক পরিস্থিতি বিরাজমান। এক ব্যক্তি বিশিষ্ট সমাজতান্ত্রিক দলও দেশে রয়েছে। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে প্রমাণ দেওয়াও অসাধ্য নয়। প্রশ্ন থেকে যায়, সবার লক্ষ্য যদি জনগণের মুক্তিই হয়ে থাকে; তবে কেন এই বিভক্তি? প্রকৃত কারণটি আমার ক্ষুদ্র চিন্তায়এক, আমাদের সমাজতান্ত্রিক নেতৃত্ব মধ্যবিত্তের শ্রেণি-চেতনায় নিমজ্জিত। তারা শ্রেণিচ্যুত হতে পারেনি। দুই, নেতৃত্বের লোভে দল ভেঙে দল গড়ার প্রবণতাও প্রবলভাবে দৃশ্যমান। নিজে দলনেতা হওয়ার অভিলাষে দল ভাঙে-গড়ে। দলের শক্তিমত্তার প্রশ্নে নির্লজ্জতা তাদের চিন্তাজগতে সামান্যতম রেখাপাত করে না। তিন, জনসম্পৃক্ততার বিপরীতে জনবিচ্ছিন্ন প্রবণতাকেও দায়ী করা যায়। দোকান খুলে পসরা সাজিয়ে ব্যবসা করার ন্যায় অফিস ভাড়া করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে ব্যাঙের ছাতার ন্যায় দেশে সমাজতান্ত্রিক দলের তালিকা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সংকীর্ণ বৃত্তে হাবু-ডুবু খাচ্ছে। আন্দোলনের কর্মপন্থাসহ ক্ষুদ্র বিষয়ে মতপার্থক্য থাকতেই পারেসেটা বৃহত্তর ক্ষেত্রে বা প্রধান বিষয়ে নিশ্চয় নয়। কিন্তু ক্ষুদ্র মতপার্থক্য এড়িয়ে বৃহত্তর বাম আন্দোলন গড়ে তোলা অসম্ভবও নয়।
আমাদের বামপন্থিদের একটি বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে; আমাদের শাসক বুর্জোয়া দল কখনো বামপন্থিদের শত্রু ছাড়া বন্ধু নয়। দক্ষিণপন্থিদের বন্ধু ভাবা মানেই সমাজ বিপ্লবের চরম শত্রুদের কাছে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ করা। এমন আত্মসমর্পণকারী কোনো বাম দলই প্রকৃত বামপন্থি নয়। তারা ডানপন্থিদের চেয়েও অধিক প্রতিক্রিয়াশীল। আমাদের পতিত বামদের শাসক দলে যুক্ততায় বাম আন্দোলনের ক্ষতি নিশ্চয় হয়েছে। তবে পতিতদের শেষ সীমা ওই পর্যন্তই তার বেশি নয়। ওখানেই তাদের সলিলসমাধি।
বিভেদ-মতপার্থক্য এড়িয়ে মতাদর্শিক ঐক্যেই সমাজ বিপ্লব সম্ভব। যারা নিজেদের বিপ্লবী-সমাজতন্ত্রী মনে করেন; তাদের সমাজ বিপ্লবে দ্বিধা থাকলে তো সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের ভবিষ্যৎ আলোর পথে কখনো অগ্রসর হবে না। জাতীয়তাবাদী ডানপন্থি-ধর্মান্ধ মৌলবাদী অপশক্তি যূথবদ্ধভাবেই শাসনক্ষমতায় নিরঙ্কুশ থাকবে। এদের পরাভূত করার জন্য নিজেদের প্রস্তুতির প্রধান লক্ষ্য মতাদর্শিক ঐক্য। এই ঐক্যই শাসক শ্রেণিকে পরাভূত করে গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ সমতার বাংলাদেশের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হবে। আমরা দেশপ্রেমিক সেই শক্তিসমূহের ঐক্য প্রত্যাশা করি। প্রত্যাশা করি বিদ্যমান ব্যবস্থা বদলে জনগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রকৃত মুক্তি। সেই মুক্তি না-ঘটলে আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থার জাঁতাকলে পেষণের হাত থেকে মুক্তির আর উপায় থাকবে না।
বিপ্লবে আস্থাবান, মতাদর্শে অবিচল বৃহত্তর বাম ঐক্যেই বিদ্যমান অপব্যবস্থার বদল সম্ভব। ভোটের রাজনীতি অনিবার্যরূপে শাসক শ্রেণির রাজনীতি। সে রাজনীতি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার নয়। ক্ষমতার হাত বদলের রাজনীতি। সেটাও তথাকথিত জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া দলের অর্থ, পেশিশক্তি, রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় দল ও শ্রেণির ক্ষমতা লাভের রাজনীতি। জনগণের ভোটের প্রয়োজন ছিল; এখন সেটিরও প্রয়োজন নেই। ক্ষমতায় থেকে ভোট বা নির্বাচন প্রহসনের নাটক চলছে দেশের প্রতিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। নির্বাচনে অতীতে কিংবা অদূর ভবিষ্যতে জনগণের মুক্তি আসেনি। আসবেও না। একমাত্র বিকল্প পথটি হচ্ছে জনসম্পৃক্ত সমাজ বিপ্লব। সে পথটিই জনগণের মুক্তির একমাত্র পথ। সে পথেই বামপন্থি-সমাজতন্ত্রীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তার আগে চিনতে হবে প্রকৃত শত্রু এবং মিত্রকে। শত্রু-মিত্র চেনার ক্ষেত্রে ভুল করলে সমাজ বিপ্লব কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। তাই ঐক্য যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি শত্রু ও মিত্র চিহ্নিতকরণও।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক নতুন দিগন্ত
১৯০২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন ফরাসি ঔপন্যাসিক এমিল জোলা। তার জন্ম ১৮৪০ সালের ২ এপ্রিল প্যারিসে। প্রকৃতিবাদী চিন্তাধারার অন্যতম প্রবক্তা এমিল ‘তাত্ত্বিক প্রকৃতিবাদ’ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি রাজনৈতিক উদারীকরণের পক্ষে কথা বলতেন। তার রচনাসমূহ তৎকালীন ফ্রান্সের রাজনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলে। জোলার বাবা ফ্রাংকোয়িজ জোলা ছিলেন ইতালীয় বংশোদ্ভূত প্রকৌশলী। মা ছিলেন ফরাসি। জোলার আট বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। এরপর ১৮৫৮ সালে তাদের পরিবার ফ্রান্সে চলে আসে। মায়ের ইচ্ছা, ছেলে আইন বিষয়ে পড়বে। কিন্তু লেখালেখিতে বেশি সময় দেওয়ায় জোলা স্নাতক পরীক্ষায় ফেল করেন। আইন পড়াও আর হয়ে ওঠেনি। ফ্রান্সে তিনি বন্ধু হিসেবে পান বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পল সেজানকে। লেখক হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার আগে তিনি কাজ করতেন একটি জাহাজ কোম্পানির করণিক হিসেবে। তখন তিনি পত্রিকায় সাহিত্য ও শিল্প সমালোচনা লিখতেন। জোলার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য আর্থ’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৪ সালে। ১৮৬৭ সালে প্রকাশিত হয় তার আরেক উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘থেরেস রিকুইন’। তিনি সব সময় একটি নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতেন। ১৮৯৮ সালের ১৩ জুলাই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ করে তিনি একটি খোলা চিঠি লেখেন। দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় তা প্রকাশিত হয়। এই লেখার কারণে তিনি সরকারের রোষানলে পড়েন। ফলে প্রায় এক বছর তিনি ইংল্যান্ডে আত্মগোপনে ছিলেন। দেশে ফিরে তিনি ফের লিখতে শুরু করেন। ‘দ্য জার্মিনাল’ তার কালজয়ী আরেক উপন্যাস। উপন্যাস ছাড়াও তিনি বেশ কিছু ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও নাটক লিখেছেন। দুবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেও তিনি শেষ পর্যন্ত পুরস্কার পাননি। তাকে ঔপন্যাসিকদের ঔপন্যাসিক বলা হয়।
সরকারি হিসাবে চলতি বছরে বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা হবে প্রায় দ্বিগুণ। পরের দুই বছরে কিছু পুরনো ও অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা হলেও অতিরিক্ত সক্ষমতা হবে প্রায় দেড়গুণ। অথচ আদর্শ মান অনুযায়ী অতিরিক্ত সক্ষমতা সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ হওয়া উচিত। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ আমদানি ও নতুন কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি সংকট ও সঞ্চালন-বিতরণ লাইনের সীমাবদ্ধতার কারণে সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। ফলে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে।
তাদের মতে, সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে যত মনোযোগ দিয়েছে তার তুলনায় বিতরণ ও সঞ্চালন লাইন বাড়ানো হয়নি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাথমিক জ্বালানির সংস্থানও টেকসই করা হয়নি। অথচ কেন্দ্র ভাড়া বাড়ার পাশাপাশি সরকারের বিনিয়োগ অলস পড়ে থাকার মাত্রা বাড়ছে। এ অবস্থা চললে ভবিষ্যতে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও লোকসান কমানো কঠিন হয়ে পড়বে। এতে বিদ্যুৎ খাতের অস্থিরতা বাড়বে।
পিডিবির সূত্রমতে, দেশে গ্রিড বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ২৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ বিভাগ এটিকেই উৎপাদন ক্ষমতা বলে প্রচার করছে। প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিল সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। সাধারণত গড়ে ১১-১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। বর্তমানে ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির করা হচ্ছে। ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে আরও দেড় হাজার মেগাওয়াট আমদানি করা হবে আগামী মার্চে।
বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৪০ সালের মধ্যে ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ২০৩০ সাল নাগাদ নেপাল থেকে ৫০০ মেগাওয়াট আমদানির লক্ষ্যে কাজ করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
পিডিবির পরিচালক মোহাম্মদ শামীম হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রতি বছর বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। সে হিসাবে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন সক্ষমতা ও চাহিদার মধ্যে ফারাক বেশি মনে হলেও সক্ষমতা থাকার পরও জ্বালানি স্বল্পতার কারণে চাহিদার পুরো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। অনেক কেন্দ্র কারিগরি ত্রুটি ও মেইনটেনেন্সের কারণে বন্ধ রাখতে হয়। এসব বিবেচনায় নিলে সক্ষমতা বেশি নয়।’
বুয়েটের অধ্যাপক ড. ম তামিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় ১০ থেকে ২০ শতাংশ অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাই যথেষ্ট। এর বেশি সক্ষমতা মানে বিপুল আর্থিক বোঝা। কাগজে-কলমে যে সক্ষমতা এখন আছে সেটা অনেক বেশি। আরও বেশি হলে কীভাবে এফোর্ড করব। এর ফলে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বাড়বে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেমন বিদ্যুৎ নিতে না পারলেও ৫ হাজার কোটি টাকা “ক্যাপাসিটি পেমেন্ট” দিতে হয়েছে। ভারতের আদানিকেও মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘২০২৭ সাল নাগাদ প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। এসবের জ্বালানির পুরোটাই আমদানিনির্ভর। প্রশ্ন হলো, এ আমদানি ব্যয় কি বহন করা সম্ভব? যদি না পারি তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও এসব কেন্দ্রের জন্য ভাড়া গুনতে হবে। এ টাকা কে দেবে? গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েই কি তা সম্ভব? কার্যত নানাভাবে ভোক্তার পকেট থেকে এ টাকা যাবে।’
পিডিবির তথ্যমতে, সরকারি-বেসরকারি ও যৌথ উদ্যোগে ১৭টি কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে, যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট। ১০ হাজার ৮৬৯ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০২৫ সালের মধ্যে উৎপাদনে আসবে। ১৭টি কেন্দ্রের ১৩টি বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবে। এসবের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৬৫০ মেগাওয়াট। আরও ৬৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাঁচটি কেন্দ্র নির্মাণের দরপত্রের আওতায় রয়েছে। পরিকল্পনাধীন কেন্দ্রের মধ্যে ৫৮৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার আটটি কেন্দ্রে উৎপাদন শুরু করার কথা রয়েছে ২০২৫ সালের মধ্যে। এ ছাড়া ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে চলতি বছর ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে। অন্যদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট উৎপাদন শুরু হবে ২০২৫ সাল নাগাদ। সব মিলে দুই বছর পর দেশের মোট উৎপাদন সক্ষমতা অন্তত ৩৯ হাজার ৩০০ মেগাওয়াটে দাঁড়াবে। অথচ তখন বিদ্যুতের চাহিদা হবে ১৯ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট।
আগামী দুই-তিন বছরে ৭-৮ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কিছু পুরনো ও তেলবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা হলেও ২০২৫ সালে উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে প্রায় ৩৩ হাজার মেগাওয়াটে। বিভিন্ন ধরনের কারিগরি ক্ষতি ও কেন্দ্রের নিজের ব্যবহার্য বিদ্যুৎ বিবেচনায় নিলেও চাহিদার তুলনায় তখন বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা অন্তত ৫০ শতাংশ বেশি হবে। যদিও চাহিদা এর চেয়ে কম হবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। কারণ এর আগের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী চাহিদা কমেছে।
প্রক্ষেপণ অনুযায়ী চাহিদা কমলেও উৎপাদন কিন্তু বেড়েই চলেছে। যেমন চলতি বছর পর্যন্ত বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৩০৮ মেগাওয়াট ধরা হলেও পিডিবির হিসাবে তা দাঁড়াবে প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট। প্রক্ষেপণ অনুযায়ী চাহিদা কমে যাওয়া ও উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ার ফলে প্রায় অর্ধেক কেন্দ্র অলস বসে থাকবে।
ড. তামিম বলেন, ‘গত চার-পাঁচ বছরে শিল্পকারখানার সম্প্রসারণ আশানুরূপ হয়নি। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে শিল্পে গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুতের চাহিদা তেমন বাড়েনি। এ কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কম। সরকার বিদ্যুতের যে সক্ষমতার কথা বলছে তা আসলে কতটুকু সত্য আমরা জানি না। প্রকৃত চিত্র আমাদের দেখানো হয় না।’ তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালে বিদ্যুৎ নিয়ে যে প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল সে অনুযায়ী চাহিদা বাড়েনি। অথবা চাহিদা বেড়েছে কিন্তু সে অনুযায়ী সরবরাহ করতে না পারায় চাহিদা কম দেখানো হচ্ছে। ক্লিয়ার পিকচার আমরা পাচ্ছি না। পরিকল্পনা আরও সতর্কভাবে করা দরকার।’
নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র করার দরকার নেই এমন মন্তব্য করে ড. তামিম বলেন, ‘আমার জানামতে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে যেগুলো ঠিকমতো গ্যাস পেলেও উৎপাদন করতে পারবে না। এগুলো বন্ধ করে তেলবিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা কমানো দরকার। এতে বিদ্যুতের চাহিদাও মিটবে, উৎপাদন ব্যয়ও কম হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সত্যিকারের চাহিদার প্রক্ষেপণ করা। জাইকা পুরনো “জিডিপি গ্রোথ” ধরে একটা প্রক্ষেপণ করছে। আমি এটার বিরোধী। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। আমরা যে “ইকোনমিক গ্রোথ”-এর কথা বলছি সেটা কিন্তু পলিটিক্যাল গ্রোথ। বাস্তব নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে ৮-৯ শতাংশ সাসটেইনেবল গ্রোথ হয়েছে এমন নজির নেই। গত ছয়-সাত বছরে আমাদের যে সর্বোচ্চ ইকোনমিক গ্রোথ হয়েছে তা কি এনার্জি ইনটেনসিভ ইকোনমিক গ্রোথ? নাকি অন্য ফ্যাক্টর আছে এখানে? বিবেচনায় নিতে হবে। ২০১৭ সাল থেকে আমরা যে শিল্পপ্রবৃদ্ধি হিসাব করছি তা কিন্তু হয়নি। গত কয়েক বছরে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে আবাসিক খাতে। শিল্পে বেড়েছে খুবই কম।’
বিদ্যুতের চাহিদার প্রক্ষেপণ কঠিন নয় উল্লেখ করে অধ্যাপক তামিম বলেন, ‘আগামী পাঁচ বছরে কী পরিমাণ শিল্পকারখানা হবে, কত বিদ্যুৎ লাগবে তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকেই জানা সম্ভব। অন্যান্য খাতের তথ্যও জানা সম্ভব। ছড়িয়ে থাকা তথ্যগুলো একত্রিত করলেই আসল হিসাবটা পাওয়া সম্ভব। একটু সময় দিলে নিখুঁত চিত্র পাওয়া যাবে।’
বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির বড় একটি অংশ আমদানি করতে হয়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়া বা কমার প্রভাব পড়ে দেশের বিদ্যুৎ খাতে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে না এলে বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সমস্যা থেকেই যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অপরিকল্পনা, অদক্ষতা আর কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় কেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। সরকারের দাবি অনুযায়ী চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। তাহলে আমদানি কেন? বিদ্যুৎ আমদানি ও অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা দরকার। নইলে বিদ্যুতের দাম বেড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।’
তিনি বলেন, ‘উচ্চমূল্যে জ্বালানি আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে দাম বাড়তেই থাকবে। অথচ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে অনেক কম দামে টেকসই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। সরকারের কমদামি বিদ্যুতের চেয়ে বেশি দামের বিদ্যুতে আগ্রহ বেশি। কারণ গোষ্ঠী স্বার্থ।’
ইউক্রেনের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা এবং পশ্চিমা গণমাধ্যম বলছে খুব শিগগিরই বড় আকারে হামলা চালাতে যাচ্ছে রাশিয়া। জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে জানিয়েছে, চলতি মাসেই আরও সৈন্য ও সরঞ্জাম নিয়ে নতুন অভিযান শুরু হতে পারে। এদিকে আরও দ্রুত অস্ত্র সরবরাহের অনুরোধ নিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দপ্তর ব্রাসেলস যেতে পারেন।
ইউক্রেনের আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করতে রাশিয়া পূর্বের অধিকৃত এলাকায় আরও সৈন্য ও সরঞ্জাম জমা করছে বলে নানা সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে। ফলে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি হামলার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রুশ সেনাবাহিনী আরও বড় আকারের হামলা চালাতে পারে, এমন আশঙ্কা বাড়ছে। লুহানস্ক অঞ্চলের ইউক্রেন নিয়ন্ত্রিত এলাকার গভর্নর সেরহি হাইদাই বলেন, রাশিয়া থেকে রিজার্ভ বাহিনীর আরও সদস্য এবং সরঞ্জাম আসছে। নতুন ধরনের গোলাবারুদও আসতে দেখা যাচ্ছে। দিনরাত গোলাবারুদ নিক্ষেপ বন্ধ করে রুশ বাহিনী কোনো বড় অভিযানের জন্য সেগুলো প্রস্তুত রাখছে বলে হাইদাই মনে করেন। তার মতে, ১৫ ফেব্রুয়ারির পর যেকোনো সময়ে রাশিয়া আরও জোরালো হামলা শুরু করতে পারে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীও বসন্তকালে রাশিয়া অধিকৃত আরও এলাকা ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে, এমন ধারণা জোরালো হচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব থেকে ব্যাটেল ট্যাংকসহ আরও অস্ত্র, সরঞ্জাম ও গোলাবারুদ ঠিক সময়ে হাতে না পেলে এমন অভিযান কতটা কার্যকর হবে, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে। ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ইউক্রেন এলাকা পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে যে সাফল্য পেয়েছিল, তা বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে থমকে গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে জেলেনস্কি চলতি সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শীর্ষ সম্মেলনে সশরীরে যোগ দিতে পারেন বলে জল্পনা-কল্পনা চলছে। ইইউ জানিয়েছে, জেলেনস্কিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি সত্যি সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ব্রাসেলস গেলে সেটা হবে যুদ্ধ শুরুর পর দেশের বাইরে তার দ্বিতীয় সফর। গত বছর ওয়াশিংটনে গিয়ে জেলেনস্কি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনা করেন এবং দেশটির কংগ্রেসে ভাষণ দিয়ে আরও অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। ইউরোপের কাছ থেকেও তেমন সাড়া পেতে তিনি ঝুঁকি নিয়ে ব্রাসেলস যেতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চামেলী হলে শিক্ষামন্ত্রী ও সব বোর্ডের চেয়ারম্যানরা নিজ নিজ বোর্ডের ফলাফল প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন।
ফলাফল হস্তান্তরের সময় উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী।
বেলা সাড়ে ১১টা থেকে নিজ নিজ শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে ফলাফল আপলোড করা হবে। এ সময় থেকে যে কেউ রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে ওয়েবসাইট ও মোবাইলে এসএমএস করে ফল দেখতে পারবেন।
আজ দুপুর সাড়ে ১২টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত ফল প্রকাশ করবে। পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অনলাইনে একযোগে ফল প্রকাশ করা হবে বেলা একটায়।
করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ায় গত ৬ নভেম্বর সারা দেশে অনেকটা স্বাভাবিক পরিবেশে শুরু হয়েছিল এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ড মিলিয়ে ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীন মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন ১২ লাখ ৩ হাজার ৪০৭ জন।
ঢাকা ডমিনেটরসের ক্রিকেটাররা ৭৫ ভাগ পারিশ্রমিক বুঝে পেয়েছেন, বাকিটা টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যেই তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেছে ফ্র্যাঞ্চাইজিটি।
আজ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন দলটির অধিনায়ক নাসির হোসেন। এবারের বিপিএলে নিজেদের শেষ ম্যাচটি খেলেছে ঢাকা। চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের বিপক্ষে ১৫ রানের হার দিয়ে শেষ হয়েছে নাসিরের দলের এবারের বিপিএল মিশন।
ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে নাসির জানালেন, পারিশ্রমিক নিয়ে সংকট দূর হয়েছে। ‘আমার মনে হয়ে অনেক খেলোয়াড় ৭৫% পারিশ্রমিক পেয়েছে। আমিও পেয়েছি। ২৫% বাকি। চুক্তি অনুযায়ী টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যে বাকিটা পেয়ে যাওয়ার কথা। প্রথম পেমেন্টটা পেতে একটু দেরি হয়েছে। কিন্তু তারা সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে।’
আসরের মাঝপথে ঢাকার খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক সংক্রান্ত জটিলতার কথা জানা গেলেও নাসির আশ^স্ত করেছেন নিয়ম মেনেই এখন তিন-চতুর্থাংশ পারিশ্রমিক পরিশোধ করেছে ফ্র্যাঞ্চাইজি কর্র্তৃপক্ষ। তবে দল গঠন ও পরিচালনার ব্যপারে ফ্র্যাঞ্চাইজিকে ‘অনভিজ্ঞ’ বলে দাবি করেছেন নাসির।
তার সুপারিশ করা বেশ কয়েকজন বিদেশি ক্রিকেটারকে আনতে না পারার কথাও বলেছেন, ‘আমার কাছে মনে হয় বিদেশি খেলোয়াড়রা একটা বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমরা ভালো বিদেশি খেলোয়াড় আনতে পারিনি। তাছাড়া আমাদের টপ অর্ডার ভালো করেনি। ওরা ভালো করলে অন্যরকম হতো। আর মোমেন্টাম না পাওয়ায় আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। টিমটা শেষ মুহূর্তে হওয়ায় এরকম হতে পারে। আমার বিশ্বাস পরের বছরে এই দল থাকলে ভালো একটা দল হবে। বিদেশি লিগ চলায় খেলোয়াড় পাওয়া যায়নি। যাদের পেয়েছে তাদেরই তারা নিয়ে এসেছে। আরও কিছু বিদেশি খেলোয়াড় পেলে আমরা ভালো করতাম।’
গ্যারি ব্যালান্সের জন্মটা জিম্বাবুয়েতে। তবে স্কুলজীবনে স্বদেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। তবে মাতৃভূমির বয়সভিত্তিক বিশ্বকাপে খেলেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তার অভিষেক ইংলিশদের জার্সি গায়ে। যদিও সেখানেও অনেকদিন ধরে ব্রাত্য। তাই ক্রিকেটের টানে ঘরে ফিরেছেন তিনি। যা রাঙিয়েছেন অসাধারণ এক শতক হাঁকিয়ে।
বুলাওয়ের কুইন্স স্পোর্টস ক্লাব সাক্ষী হলো বিরল এই কীর্তির। ঘরে ফেরা গ্যারি ব্যালান্সকে কেপলার ওয়েসেলসের কীর্তি ছুঁতে দেখল কুইন্স স্পোর্টস ক্লাব। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক ওয়েসেলসের পর দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে যে টেস্ট ক্রিকেটে দুটি দেশের হয়ে সেঞ্চুরি পেলেন ব্যালান্স।
বর্ণবাদী নীতির কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকা নিষিদ্ধ থাকার সময় অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট খেলেছেন ওয়েসলস। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ২৪ টেস্টে চারটি সেঞ্চুরি করা ওয়েসেলস পরে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ১৬ টেস্টে করেন দুটি সেঞ্চুরি। ইংল্যান্ডের হয়ে চারটি টেস্ট সেঞ্চুরির মালিক ব্যালান্স জিম্বাবুয়ের হয়ে প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেই পেয়ে গেলেন সেঞ্চুরি।
স্কুলে পড়ার সময় জিম্বাবুয়ে ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছিলেন গ্যারি ব্যালান্স। তবে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক টিকে ছিল আরও অনেক দিন। ২০০৬ সালে তো ১৬ বছর বয়সী ব্যালান্স জিম্বাবুয়ের হয়ে খেলেন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। সেই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। যে ম্যাচে ৩ উইকেট নেওয়ার পর ব্যাট হাতে সর্বোচ্চ রান করেছিলেন দলের পক্ষে।
২০১৩ সালে ওয়ানডে দিয়ে ইংল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অভিষেক ব্যালান্সের। পরের বছর ইংল্যান্ডের দুর্দশার অস্ট্রেলিয়া সফরে টেস্ট অভিষেক। সিডনির সেই টেস্টে ১৮ ও ৭ রান করা ব্যালান্স ক্রিকেট তীর্থ লর্ডসে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টেই পেয়ে যান প্রথম সেঞ্চুরি। ক্যারিয়ারের প্রথম ১০ টেস্টের ১৭ ইনিংসেই চার সেঞ্চুরিতে ১ হাজার রান করে ফেলা ব্যালান্স খারাপ সময়টা দেখে ফেলেন তাড়াতাড়ি। পরের ১৩ টেস্টে মাত্র দুটি ফিফটি পাওয়া বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ২০১৭ সালের পর আর সুযোগ পাননি ইংল্যান্ড দলে।
ইংল্যান্ড দলে ফেরার স্বপ্ন বিসর্জন দেওয়া সেই ব্যালান্স জন্মভূমি জিম্বাবুয়ের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নিলেন গত বছর। এ বছরই জিম্বাবুয়ের হয়ে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি খেলার পর চলমান বুলাওয়ে টেস্টেই লাল বলের ক্রিকেটে জন্মভূমির হয়ে প্রথম খেলছেন ব্যালান্স। আর প্রথমবার ব্যাট করতে নেমেই সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে জানিয়ে দিলেন তাঁকে ফিরিয়ে ভুল করেনি জিম্বাবুয়ে।
ব্যালান্স যখন ব্যাটিংয়ে নামলেন জিম্বাবুয়ের রান ৩ উইকেটে ১১৪। ঘণ্টাখানেক পরই আরও ৩ উইকেট হারিয়ে ১৪৭ রান জিম্বাবুয়ের। ফলোঅনের শঙ্কায় পড়া দলের লেজে ব্যাটসম্যানদের নিয়ে এরপর কী লড়াইটাই না করলেন ব্যালান্স। সেই লড়াইয়ে উজ্জীবিত হয়ে ইনিংস ঘোষণার মতো বিলাসিতা করে নিলেন জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক ক্রেগ আরভিন।
৯ উইকেটে ৩৭৯ রান তুলে জিম্বাবুয়ে যখন ইনিংস ছাড়ে ব্যালান্স অপরাজিত ১৩৭ রানে। ব্রেন্ডন মাভুতাকে নিয়ে অষ্টম উইকেটে ১৩৫ রান যোগ করা ব্যালান্স খেলেছেন ২৩১ বল, মেরেছেন ১২টি চার ও ২টি ছক্কা। ৯ চারে ৫৬ রান করেছেন নয়ে নামা মাভুতা। জিম্বাবুয়ের অবশ্য লিড নিতে পারেনি। ৬৮ রানে পিছিয়ে ছিল ইনিংস শেষে। চতুর্থ দিন শেষে সেই ব্যবধানটাকে ৮৯ রানে নিয়ে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দ্বিতীয় ইনিংসে বিনা উইকেটে ২১ রান তুলেছে ক্যারিবীয়রা।
শ্রম পরিদর্শক পদে যোগ দেওয়ার ৩৪ বছর পর পদোন্নতি পেলেন মাহমুদুল হক। স্বপ্ন দেখতেন পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে একসময় প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে যাবেন। সেই স্বপ্ন আট বছরেই লুটিয়ে পড়ল জ্যেষ্ঠতার তালিকায়।
১৯৮৮ সালে যোগ দেওয়ায় ’৯৫ সালেই পদোন্নতি পাওয়ার কথা ছিল মাহমুদুল হকের। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অদূরদর্শিতা সে স্বপ্ন শুরুতেই বাধা পেল। এন্ট্রি পোস্টে যোগ দেওয়ার পর তার মতো অন্য কর্মচারীরা যখন পদোন্নতির স্বপ্নে বিভোর, তখন তাতে গা-ই করলেন না সেই সময়ের প্রতিষ্ঠানপ্রধান।
মাহমুদুল অপেক্ষায় রইলেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য। সেই পরিবর্তন আসতে আসতে চাকরিতে কেটে গেল আঠারো বছর। আঠারোতে মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হয়। তিনিও ভাবলেন আঠারোতে তিনি না হয় ‘জব ম্যাচিউরিটি’তে পৌঁছালেন। চাকরির আঠারো বছরে পদোন্নতি পেলেও মন্দ হয় না।
কিন্তু অবাক ব্যাপার, কর্তৃপক্ষ পদোন্নতি দিল, তবে মাহমুদুলকে ছাড়া। পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনে কোথাও তার নাম নেই। হতাশায় মুষড়ে পড়লেন তিনি। জুনিয়র কর্মকর্তারদের নাম আছে, অথচ তার নাম নেই। প্রতিষ্ঠানের নীতি-নির্ধারকদের দরজায় দরজায় ঘুরলেন ন্যায়বিচারের আশায়। কিন্তু তারা পাত্তাই দিলেন না বিষয়টি।
তারা আমলে না নিলেও মাহমুদুলের স্বপ্ন তো সেখানেই থেমে যাওয়ার নয়। সেই স্বপ্ন পুঁজি করে তিনি গেলেন আদালতে। সেই ভিন্ন জগৎটাও কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তার পক্ষে রায় দিল। মাহমুদুল আনন্দে আত্মহারা হলেন। কিন্তু সেই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। সরকার আপিল করল প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলার ফল উল্টে গেল। হতাশায় ভেঙে না পড়ে তিনি গেলেন উচ্চ আদালতে। আপিল বিভাগে সিভিল আপিল মামলা করলে প্রশাসনিক আপিল আদালতের রায় বাতিল হয়। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল থাকে।
জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করার মতো মাহমুদুল হকও যেন সরকারের সঙ্গে লড়াই করতে নামলেন। আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন করল সরকারপক্ষ। একপর্যায়ে সরকার বুঝতে পারল কোনোভাবেই তারা এ মামলায় জিততে পারবে না। সরকারপক্ষে রিভিউ পিটিশন প্রত্যাহার করা হলো। আদালত সরকারের পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনকে আইনের কর্তৃত্ববহির্ভূত বলে ঘোষণা করল। জুনিয়র কর্মকর্তাকে যেদিন থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে এবং যতবার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, একইভাবে মাহমুদুল হককে পদোন্নতি দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। বকেয়া বেতন-ভাতাসহ সব পাওনা কড়ায়-গ-ায় পরিশোধের নির্দেশনা আসে।
আদালতের এই নির্দেশনা দেওয়া হয় ২০১৮ সালে। এরপর আদেশ বাস্তবায়ন করতে সরকারের লেগে যায় প্রায় চার বছর। ২০২২ সালের ১১ মে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ৩৪ বছর পর পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মাহমুদুল হক। আবারও তাকে ঠকিয়েছে সরকার। জুনিয়র কর্মকর্তা যুগ্ম মহাপরিদর্শক হলেও তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয় তার দুই ধাপ নিচের সহকারী মহাপরিদর্শক পদে। উপমহাপরিদর্শক ও যুগ্ম মহাপরিদর্শক আরও ওপরের পদ। আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
কখনোই প্রজ্ঞাপন মাহমুদুল হকের জন্য ভালো বার্তা বয়ে আনেনি। পুরো চাকরিজীবন আদালতের বারান্দায় ঘুরে তিনি পৌঁছেছেন অবসরের প্রান্তসীমায়। আর তিন মাস পরে তিনি অবসরে যাবেন। যৌবন ও মধ্য বয়সের দিনগুলোতে আদালতে ঘুরে বেড়ানোর শক্তি ও সাহস থাকলেও মাহমুদুল হক এখন সেই সাহস দেখাতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করছেন। পারবেন তো শেষ সময়ে এসে সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে?
মাহমুদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, তিনি আদালতের কাছেই জানতে চাইবেন, আদালতের বিচার না মানার শাস্তি কী।
পুরো ঘটনা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা শুনিয়ে জানতে চাইলেন, কতজনের পক্ষে মাহমুদুল হকের মতো লড়াকু মনোভাব দেখানো সম্ভব?
সীমাহীন আনন্দ নিয়ে মানুষ সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়। এরপরই তার মধ্যে যে স্বপ্নটি দানা বাঁধে তা হচ্ছে পদোন্নতি। কার কীভাবে পদোন্নতি হবে তা আইনকানুন, নিয়ম-নীতি দিয়ে পোক্ত করা। পুরো বিষয়টি কাচের মতো স্বচ্ছ। এরপরও পদোন্নতি হয় না। দিন, মাস, বছর পার হয়ে যায়, কাক্সিক্ষত পদোন্নতির দেখা মেলে না।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ক্যাডারে নিয়মিত পদোন্নতি হয়। বাকি ক্যাডারে হতাশা। তার চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি নন-ক্যাডারে। ক্যাডার কর্মকর্তারা নিজের পদোন্নতির ষোলো আনা বুঝে নিয়ে ঠেকিয়ে দেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি। সংখ্যায় বেশি হওয়ায় নন-ক্যাডাররা একজন আরেকজনকে নানা ইস্যুতে আটকাতে গিয়ে পুরো প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেন। সরকারের মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কর্মচারী। সেই হিসেবে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনবলের পদোন্নতি হয় না। পে-কমিশন হলেই কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য করুণা উথলে ওঠে। এমনকি ব্লকপোস্টে যারা আছেন, তাদের জন্যও পদোন্নতির বিকল্প সুবিধা বাতলে দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কর্মচারীদের পদোন্নতি উপেক্ষিতই থাকে।
যখন সময়মতো পদোন্নতি হয় না, তখন নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে থাকে। এসব সমস্যা সংশ্লিষ্ট দপ্তর-অধিদপ্তরের চৌহদ্দি পেরিয়ে আমজনতাকেও প্রভাবিত করে। নন-ক্যাডার কর্মকর্তা আর সঙ্গে কর্মচারীরা যখন বুঝতে পারেন পদোন্নতির আশা তাদের নেই, তখন তারা দুহাতে টাকা কামানোর ধান্দায় মেতে ওঠেন। এতে করে ঘুষের সংস্কৃতি সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। অকার্যকর পথে হাঁটে রাষ্ট্র। সাধারণ মানুষ টাকা ছাড়া তাদের কাছ থেকে কোনো সেবা পায় না, ব্যবসায়ীরা নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে ব্যবসায় আসেন না, ব্যবসাবান্ধব পরিস্থিতি না থাকায় মুখ ফিরিয়ে নেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। প্রধানমন্ত্রীর বারবার আহ্বানেও বিনিয়োগকারীরা সাড়া দেন না। সাধারণ মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে সেবা দেওয়ার বাণীতেও উদ্বুদ্ধ হন না সংশ্লিষ্টরা।
এই পরিস্থিতিতে অনিয়ম আটকে রাখার সব কৌশলই ব্যর্থ হচ্ছে। যথাযথ তদারকি না থাকায় বিভাগীয় ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে। ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫০টি অডিট আপত্তি ঝুলে থাকায় অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোও আগ্রহ হারিয়ে নিজেরাই জড়িয়ে পড়ছে অনিয়মে। দন্তহীন বাঘে পরিণত হওয়ার তথ্য সাংবাদিকদের জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান নিজেই।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদোন্নতির বড় একটা অংশ আটকে রাখে মন্ত্রণালয়গুলো। এই আটকে রাখার কারণ হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের স্বার্থ। বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তরে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিলে নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতিপ্রাপ্তদের ওপরের পদে বসাতে হবে। এতে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের এককালীন লাভ; অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে একবার পদোন্নতি দেওয়া যাবে। কিন্তু পদোন্নতি না দিয়ে সংশ্লিষ্টদের চলতি দায়িত্ব দিলে বছরজুড়ে টাকা আয় করতে পারেন নীতিনির্ধারকরা। দপ্তর, অধিদপ্তরে বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। চলতি দায়িত্বপ্রাপ্তদের আয় অনুসারে নীতিনির্ধারকদের মাসোহারা দিতে হয়। নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া হলে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের নিয়মিত আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে আইন বা বিধি-বিধানের ফাঁকফোকর গলিয়ে নন-ক্যাডার এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি আটকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়।
সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদের সভাপতি নিজামুল ইসলাম ভূঁইয়া মিলন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সচিবালয় এবং সারা দেশের সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতির মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। নন-ক্যাডারের কিছু বিষয় ছাড়া সচিবালয়ের কর্মচারীরা সময়মতো পদোন্নতি পায়। কিন্তু সচিবালয়ের বাইরে পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। সচিবালয়ে মাত্র ১০ হাজার কর্মচারী আছেন। সচিবালয়ের বাইরে আছেন ১০ লাখের বেশি। এসব কর্মচারীর পদোন্নতি নিয়ে বহু বছর ধরে চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনো ফল পাইনি। সর্বশেষ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সমস্যা নিয়ে কাজ করার জন্য একটি কমিটি করে দিয়েছে। কমিটি কিছু সুপারিশ করেছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। এরপর এর কোনো অগ্রগতি নেই। যেখানে সরকারপ্রধান বলেন, চাকরিজীবনে সবাই যেন কমপক্ষে একটি পদোন্নতি পায়। সেখানে বহু কর্মচারী কোনো পদোন্নতি ছাড়াই অবসরে যাচ্ছেন। সরকারপ্রধানের নির্দেশনা উপেক্ষা করেন আমলারা। তাদের আগ্রহ কেনা-কাটায়, বিদেশ ভ্রমণে, নতুন জনবল নিয়োগে। এসব করলে তাদের লাভ। কর্মচারী পদোন্নতি দিতে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এর নিশ্চয়ই একটা শেষ আছে। বৈষম্যের পরিণতি কী হয়, তা অনেক দাম দিয়ে বিডিআর বিদ্রোহে আমরা দেখেছি।’
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি ঝুলছে বছরের পর বছর। এই অধিদপ্তরের কয়েক শ কর্মকর্তা পাঁচ বছর আগেই পদোন্নতির যোগ্য হয়েছেন। নানা কায়দা-কানুন করে তাদের পদোন্নতি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সংশ্লিষ্টদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করে তাদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া এগিয়ে নিলেও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নতুন করে জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার নামে সময়ক্ষেপণ করছে। জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার পর এখন তাদের পারিবারিক সদস্যদের তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই সংস্থা নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদেরও তথ্য তালাশ করছে। তাদের আত্মীয়দের মধ্যে কে কোন দলের সমর্থক তার তথ্য নিচ্ছেন সংস্থার কর্মকর্তারা।
গত মাসে শেষ হওয়া জেলা প্রশাসক সম্মেলনে দায়িত্ব পালন করছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সুরম্য ভবনে দায়িত্ব পালন করলেও ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তার মনের অবস্থাটা মনোহর ছিল না। কেমন আছেন জানতে চাইলে ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তা বলেন, ‘ভালো নেই। চাকরি করছি, পদোন্নতি নেই। ২০১৫ সালের আগে পদোন্নতি না পেলেও টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড ছিল। তাও তুলে দেওয়া হয়েছে। তুলে দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল সময়মতো পদোন্নতি হবে, ব্লকপোস্টধারীদের দেওয়া হবে বিশেষ আর্থিক সুবিধা। এসবের কোনোটাই হয়নি।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে একটি প্রশাসনিক আদেশ খুবই পরিচিত। সেই প্রশাসনিক আদেশ ১৬/২০১৮ অনুযায়ী ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগ হবে। আর ৩০ ভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগের ফলে বিমানে বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় কর্মকর্তা বেশি। নীতিনির্ধারকদের নতুন জনবল নিয়োগে আগ্রহ বেশি। পুরনোদের পদোন্নতি দিয়ে ওপরের পদ পূরণের চেয়ে তারা নতুন নিয়োগে যান। ফলে কারও চাকরিজীবনে একবারও পদোন্নতি হয় না। নামমাত্র যে পদোন্নতি হয় তা অনিয়মে ভরপুর।
নন-ক্যাডার ছাড়াও ১৩তম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। প্রতিটি দপ্তরে এসব গ্রেডের পদোন্নতি আটকে আছে। অথচ এসব গ্রেডেই বেশি লোক চাকরি করছেন। সরকারের মোট জনবল প্রায় ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ২৩ শতাংশ পদের মধ্যেও নন-ক্যাডার রয়েছেন। এ ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৭৭ শতাংশ পদই ১৩তম থেকে তার পরের গ্রেডের। এতে করে সহজেই বোঝা যায় সরকারের জনবলের বড় অংশই পদোন্নতির চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। সরকারের জনবলের এই বিশাল অংশ যখন পদোন্নতি নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগেন, তখন তারা নানা অনিয়মে ঝুঁকে পড়েন।
বেশির ভাগ দপ্তর, অধিদপ্তর পরিচালনা করেন বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা তাদের প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে ক্যাডার কর্মকর্তাদের দপ্তর, অধিদপ্তরে পাঠান। প্রেষণে গিয়ে অনেক কর্মকর্তা শুধু রুটিন কাজটুকুই করতে চান। শূন্যপদে জনবল নিয়োগ বা পদোন্নতি রুটিন কাজ না হওয়ায় তা উপেক্ষিত থাকে। তা ছাড়া পদোন্নতি দিতে গিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়; বিশেষ করে মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রী বা সচিব তাদের পছন্দের লোককে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য সংস্থার প্রধানকে চাপ দেন। এই চাপ উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ না থাকায় অযোগ্য লোককে পদোন্নতি দিতে হয় সংস্থার প্রধানকে। এই জটিলতা থেকে দূরে থাকার জন্য সংশ্লিষ্টদের পদোন্নতি দেওয়া থেকেও দূরে থাকেন সংস্থার প্রধানরা।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের ১৪ গ্রেডের একজন কর্মচারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাইরের লোকের ইচ্ছাটাই জাগে না আমাদের পদোন্নতি দিতে। আমাদের দপ্তরপ্রধান মহাপরিচালক প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। অতিরিক্ত মহাপরিচালকও অনেক সময় প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রেষণে আসেন। তাদের কেন ইচ্ছা জাগবে আমাদের পদোন্নতি নিয়ে। যদি এসব পদে ফুড ক্যাডারের কর্মকর্তা থাকতেন, তাহলে তারা খাদ্য বিভাগের সমস্যা বুঝতেন। তা ছাড়া নিয়োগ বিধি সংশোধনের নামে আমরা দীর্ঘদিন একই পদে আটকে আছি।’
গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে এক আবেদনে জানান, ‘বর্তমানে সচিবালয়ে প্রায় দুই হাজারের বেশি প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা কর্মরত। এর বিপরীতে ক্যাডারবহির্ভূত সংরক্ষিত পদের সংখ্যা ২৬৭টি, যা খুবই নগণ্য। ফলে একই পদে ২০-২২ বছরের বেশি সময় কর্মরত থাকার পরও অনেকে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। পদোন্নতি না পাওয়ায় সৃষ্ট হতাশার ফলে কর্মস্পৃহা নষ্ট হচ্ছে।’
সরকার এ সমস্যা থেকে কীভাবে বের হতে পারে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এসব সমস্যা সমাধানে সরকার সব সময়ই কাজ করে। কিন্তু এ চেষ্টা জটিলতার তুলনায় কম। এ বিষয়ে আরও এফোর্ট দিতে হবে।
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫০ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা খরচের হিসাব ধরে বাজেট প্রস্তাব প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে সরকার। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৭২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা বেশি। অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে খরচের বেশিরভাগ অর্থ জোগাড়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১৯ শতাংশ বাড়ানো হবে। আসছে জুনের প্রথমভাগে জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আগামী বাজেট হবে জাতীয় নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ বাজেট। তাই এখানে নেওয়া কোনো পদক্ষেপে যেন আওয়ামী লীগ সরকার সমালোচনার মুখে না পড়ে এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্টদের থাকছে বিশেষ নজর। এ ছাড়া রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। তাই সংকট ও নির্বাচন দুটোই মাথায় রাখতে হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে মোটাদাগে একটি রূপরেখা পাঠানো হয়েছে। নতুন পরিকল্পনার পাশাপাশি গত তিন মেয়াদে সরকার কী কী উন্নয়ন করেছে আগামী বাজেট প্রস্তাবে তা মনে করিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং উচ্চপর্যায়ের সরকারি নীতিনির্ধারকদের উপস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো আগামী বাজেটের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আর গত সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি পাঠিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণে কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে হিসাব ধরে অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট প্রস্তাব প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে তা কয়েক দফা খতিয়ে দেখা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। তিনি প্রয়োজনীয় সংশোধন, যোগ-বিয়োগ করে আবারও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার আগেও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে থাকে।
ডলার সংকটে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছেন না সাধারণ ব্যবসায়ীরা। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় পণ্যের দাম বাড়ছে। কাঁচামাল সংকটে বিপাকে শিল্প খাত। ব্যাংক খাতে অস্থিরতা। নতুন চাকরির সুসংবাদ নেই বললেই চলে। দফায় দফায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। খুব শিগগিরই এসব সংকট কেটে যাবে বলে মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে ঋণদাতা সংস্থার কঠিন শর্তের বেড়াজালে আছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতেই আগামী অর্থবছরের বাজেট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশি^ক অস্থিরতা মোকাবিলায় সরকার কী কী পদক্ষেপ নেবে তা আগামী বাজেটে স্পষ্ট করা হবে। দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথাও বলা হবে। তবে শত সংকটের মধ্যেও আগামী বাজেটে ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী যতটা সুবিধা দেওয়া সম্ভব তা দিতে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে বাজেট প্রস্তুত কমিটির কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে কাঁচামাল আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দিতে হিসাব কষা হচ্ছে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডলার সংকটে আমদানি রপ্তানি প্রায় বন্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্যে সংকটকাল চলছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটে আমাদের দাবি অনুযায়ী নগদ সহায়তা দিতে হবে। রাজস্ব ছাড় দিতে হবে। কর অবকাশ ও কর অব্যাহতি বাড়াতে দিতে হবে।’
ঋণদাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া সংস্কারের শর্ত মানার অঙ্গীকার করে সরকার ঋণ পেয়েছে। শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে ঋণের যেকোনো কিস্তি আটকে দিতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। পর্যায়ক্রমে প্রতি অর্থবছরের বাজেটে এসব সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়ন করা হবে। আসছে বাজেটে শর্ত মানার চেষ্টা থাকবে। বিশেষভাবে অতীতের মতো ঢালাওভাবে কর অব্যাহতি দেওয়া হবে না। আর্থিক খাতের সংস্কারের কিছু ঘোষণা থাকবে। বিশেষভাবে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দেওয়া হবে। আইএমএফের সুপারিশে এরই মধ্যে ভ্যাট আইন চূড়ান্ত হয়েছে। আয়কর আইন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন হয়েছে। শুল্ক আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ে আছে। এ তিন আইন অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণ করা হবে। আসছে বাজেটে টেকসই অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার কথা বলা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগের কথা শোনানো হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঋণদাতা সংস্থার শর্ত মানার কথা বলা হলেও সব আগামী বাজেটে একবারে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে অর্থনীতির গতি কমে যাবে।’
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এনবিআর-বহির্ভূত খাত এবং এনবিআর খাতের জন্য মোট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৪ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৯ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হতে পারে। এতে লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা হবে। এনবিআর এ লক্ষ্যমাত্রা কমানোর জোরালো আবেদন করেছে। কিন্তু তা আমলে আনেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) হিসেবে, ৩৪ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা আয়কর হিসেবে এবং ৩১ শতাংশ বা বাকি ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা শুল্ক হিসেবে সংগ্রহ করার কথা বলা হতে পারে বলে জানা গেছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রার কথা শুধু বললেই হবে না। কীভাবে অর্জিত হবে, সেটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা না থাকলে প্রতিবারের মতো ঘাটতি থাকবে। রাজস্ব ঘাটতি হলে অর্থনীতিতে আয় ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়। তাই এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত।’
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআর উৎসে করের আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। সম্পদশালীদের ওপর নজর বাড়ানো হবে। শুধু বেশি সম্পদ থাকার কারণে অতিরিক্ত কর গুনতে হবে। সারচার্জ বহাল রাখা হবে। সুপারট্যাক্স গ্রুপকে উচ্চহারে গুনতে হবে কর। আগামী অর্থবছরেও অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা থাকবে। অর্থ পাচারোধে আইনের শাসন কঠোর করা হবে। অর্থ পাচার আটকাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হবে। করপোরেট কর কমানোর দাবি থাকলেও তা মানা হবে না। অন্যদিকে নির্বাচনের আগের বাজেট হওয়ায় করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করতে খোদ অর্থমন্ত্রী বললেও রাজস্ব আদায় কমে যাবে এমন যুক্তি দেখিয়ে এনবিআর রাজি নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে। কমানো হবে শিল্পের অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি শুল্ক। ডলারের ওপর চাপ কমাতে বেশি ব্যবহৃত পণ্য আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দেওয়া হবে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানি কমাতে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হবে। তৈরি পোশাক খাতের সব সুবিধা বহাল রাখা হবে। শিল্পের অন্যান্য খাতেও কতটা সুবিধা বাড়ানো যায় তা নিয়ে এনবিআর হিসাব করছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বাজেট প্রস্তুতিবিষয়ক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্পে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি এবং ঘাটতি ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হতে পারে। আগামী অর্থবছরে জিডিপির ৬ শতাংশ ঘাটতি ধরে ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হতে পারে বলে জানা যায়। ঋণদাতা সংস্থার কাছ থেকে ভর্তুকি কমানোর চাপ থাকলেও আগামীবার এ খাতে বেশি ব্যয় ধরা হতে পারে। এ খাতে ১ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ব্যয় আছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, গত সোমবার রাতে আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ অনুমোদন করে। ঋণদাতা সংস্থাটির কাছ থেকে বাংলাদেশ ছয় কিস্তিতে তিন বছরে ৪৭০ কোটি ডলার পাচ্ছে। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের দিন আইএমএফ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে পূর্বাভাস দেয়। সংস্থাটি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হতে পারে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা হতে পারে ৭ দশমিক ১ শতাংশ।
এতে রিজার্ভ সম্পর্কে বলা হয়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ৩ হাজার কোটি ডলার। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বাড়বে এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় চলতি বোরো মৌসুমে সেচে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকার নানারকম প্রস্তুতি নিয়েছে বলে দাবি করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতের যে পরিস্থিতি তাতে গ্রীষ্মে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বেশি দাম দিয়েও কৃষক ঠিকমতো বিদ্যুৎ না পেলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। এতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়তে পারে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, জ্বালানি তেল, সার ও বীজের দাম বেড়েছে। এখন আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। তার মানে চারদিক থেকে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর ফলে কৃষকের ‘সিগনিফিকেন্ট লস’ হবে। এভাবে দাম বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বোরো উপকরণনির্ভর ফসল। কিন্তু উপকরণের দাম এভাবে বাড়তে থাকলে, কৃষক আগ্রহ হারিয়ে ফেললে; সে ঠিকমতো উপকরণ ব্যবহার করতে পারবে না। এতে উৎপাদন ব্যাহত হবে। উৎপাদন খারাপ হলে চালের ঘাটতি হবে। এমনিতেই এখন প্রায় ৭০ লাখ টন গম ও ভুট্টা আমদানি করতে হচ্ছে। এরমধ্যে যদি চাল আমদানি করতে হয়; তাহলে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
ড. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সারাবিশ্ব নানারকম সংকটে ভুগছে। এ অবস্থায় আমাদের অন্তত খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সুযোগ রয়েছে। সেজন্য যে পরিমাণ দাম বেড়েছে সে পরিমাণ নগদ অর্থ সহায়তা দিতে হবে কৃষককে। ২০০৯-১০ সালের দিকে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে এক কোটির বেশি কৃষককে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা সরাসরি নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। এজন্য তারা ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খুলেছিলেন। তাদের সেই অ্যাকাউন্ট এখনো আছে, কিন্তু সহায়তা দেওয়া হয় না। এখন যদি সেই সহায়তা দেওয়া হয় তাহলে কৃষক আবার উৎসাহ পাবে।’
বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, প্রতি বছর সেচ মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি থেকে মে) বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। গত মৌসুমে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। চলতি বছর সম্ভাব্য চাহিদা ধরা হয়েছে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। গত বছরের তুলনায় এ বছর সেচ সংযোগের সংখ্যা ১ হাজার ৯১টি বেড়ে মোট ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৪৫৯টি হয়েছে। এজন্য বিদ্যুৎ লাগবে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট।
সেচ মৌসুমে অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সম্প্রতি তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিদ্যুতের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে উৎপাদনও বাড়ানো হচ্ছে। সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গ্যাস, ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল সরবরাহ বৃদ্ধি করা, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস সরবরাহ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে পরিস্থিতি ভালো হবে।’
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে প্রতিদিন ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস, ৭৭ হাজার ৪০০ টন ফার্নেস অয়েল এবং ৬৬ হাজার ১০০ টন ডিজেলের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। সূত্রমতে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ করা বাস্তবে খুব কঠিন ব্যাপার। গত বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পিডিবির দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট ছিল। বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এ বছর জ¦ালানির ঘাটতি আরও বেশি। তবে সরকার খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি করে ঘাটতি মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু আমদানিকৃত গ্যাস দিয়ে চাহিদা অনুযায়ী কতটা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে তা নিয়ে কর্মকর্তাদের অনেকেই সন্দিহান।
পিডিবির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে ১০ হাজার থেকে ১০ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। গ্যাস ও কয়লা সংকটের কারণে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এ ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের কারণেও কিছু কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে।
দেশে নির্মাণাধীন ও আমদানিকৃত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আগামী মার্চের শেষ দিকে ভারতের আদানি থেকে অতি উচ্চ দামে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ছাড়া মে মাসের দিকে চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে ৬১২ মেগাওয়াট এবং অন্যান্য কিছু ছোট বা মাঝারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৫০ থেকে ২০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হতে পারে। এপ্রিল-মে মাসের দিকে বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি হবে। তখন এসব কেন্দ্র সময়মতো উৎপাদনে এলেও ১৩ হাজার মেগাওয়াটের জোগান দেওয়া সম্ভব হবে। এর বাইরে উচ্চ মূল্যের জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে কিছু কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম মনে করেন, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করার সক্ষমতা সরকারের নেই। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি সরবরাহ করতে সরকারের ডলার খরচের যে সক্ষমতা দরকার তা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘জ্বালানি খাতে সরকারের ভুলনীতি আর অন্যায্য ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয়ের কারণে দাম বেড়েই চলেছে। সেই ব্যয় মেটাতে এখন বিদ্যুৎ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করে ভর্তুকি সমন্বয় করতে চাইছে। এই পরিস্থিতিতে উচ্চ দামে বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা অসম্ভব ব্যাপার।’
এদিকে ডলার সংকট এবং ঋণপত্র (এলসি) খোলার বিলম্বের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। সরকারের কাছে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মোটা অঙ্কের বিল পাওনা থাকলেও তারা ঠিকমতো না পাওয়ার কারণে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করতে পারছেন না। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নির্মাণকাজ এবং জ্বালানি আমদানির যে অগ্রগতি তাতে চাহিদার তুলনায় আগামী গ্রীষ্মে বিদ্যুতের ঘাটতি হবে আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট। তবে সাশ্রয় নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে ১ হাজার মেগাওয়াট এবং উচ্চ মূল্যের জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে আরও ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণ করতে পারে সরকার। এরপরও অন্তত ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থাকবে।
এদিকে দাম সমন্বয়ের নামে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে গণশুনানি ছাড়াই নির্বাহী আদেশে জানুয়ারি মাসে ১৮ দিনে চার দফা গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করেছে সরকার। এর মধ্যে দু’দফায় অন্তত ১০ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর আগে গত বছরের আগস্টে সেচে ব্যবহৃত ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ২৯ টাকা দাম বাড়ানো হয়। বিদ্যুৎ ও জ¦ালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষিতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে।
কুমিল্লার নাঙলকোট উপজেলার বাসন্ডা গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম মজুমদার বলছিলেন, গত বছর এক বিঘা বা ৩৩ শতক জমিতে ধান চাষ করতে সেচের জন্য ২৭৫০ টাকা ব্যয় হয়েছে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চলতি বোরো মৌসুমে এ ব্যয় বেড়ে অন্তত ৪ হাজার টাকা হবে। এর বাইরে অন্যান্য খরচও আনুপাতিক হারে অনেক বেড়েছে। ফলে এখন ধান চাষ করলে প্রতি বিঘা জমিতে অন্তত দেড় থেকে দুই হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে।
ডিজেলচালিত ইঞ্জিনের মাধ্যমে জমিতে সেচ দেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর গ্রামের শিয়ালা গ্রামের কৃষক নাঈম। শনিবার রাতে টেলিফোনে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতিবিঘা জমিতে এ বছর সেচের ব্যয় বেড়েছে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা। সার, বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের দামও বেড়েছে।
এর আগে মূল্যবৃদ্ধির গণশুনানির সময় বিইআরসি কৃষক ও প্রান্তিক মানুষের কথা বিবেচনা করলেও নির্বাহী আদেশের সময় এসব কিছুই বিবেচনা করা হয় না।
অতীতে সামাজিক সুরক্ষার অংশ হিসেবে প্রতিমাসে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীকে লাইফলাইন বা প্রান্তিক ব্যবহারকারী হিসেবে বিবেচনা করে তাদের বিদ্যুতের দাম তুলনামূলক কম বাড়াত কমিশন। দেশে এ ধরনের গ্রাহক রয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ, যাদের অধিকাংশই কৃষক। কিন্তু সর্বশেষ বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আদেশে এ সুবিধা বাতিল করা হয়েছে।
লাইফ লাইন শ্রেণির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বিল ছিল ৩.৭৫ টাকা। গত ডিসেম্বরে তা বাড়িয়ে ৩.৯৪ টাকা করেছিল মন্ত্রণালয়। সেখান থেকে এবার আরেক দফা বাড়িয়ে ৪.১৪ টাকা করা হয়েছে। ফলে গত দুই মাসের ব্যবধানে দরিদ্র মানুষকে এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ৩৯ পয়সা বাড়তি ব্যয় করতে হবে।
কৃষকের কথা বিবেচনা করে আগে সেচে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম সবসময়েই তুলনামূলক সাশ্রয়ী রাখার চেষ্টা করা হতো। কিন্তু এখন কৃষকেরাও রেহাই পাচ্ছে না। গত ১২ ডিসেম্বর কৃষিতে ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ২১ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৩৭ টাকা করা হয়। সেখান থেকে এবার আরও ২২ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৫৯ টাকা করা হয়েছে।
রংপুরের একজন কৃষক আনোয়ার আলী খানিকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দফায় দফায় যেভাবে সবকিছুর দাম বাড়ছে তাতে চাষি তো আর বেশিদিন বাঁচতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘ধান চাষ করে এখন লাভ তো দূরের কথা খরচই ওঠে না। তাই আগের চেয়ে ধান চাষ কমিয়ে দিয়েছি। এখন সারা বছর খাওয়ার জন্য যতটুকু ধান দরকার ততটুকুই চাষ করি। তাতে লোকসান হলেও কী করব? ডাল-ভাত তো খাওয়া লাগবে।’
তাকে বলা হয় নাটকের রাণী। দীর্ঘ এক যুগের ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেছেন। নানামাত্রিক চরিত্রে হাজির হয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন, দু’হাতে কুড়িয়েছেন দর্শকদের ভালোবাসা। বলছিলাম, সুপারস্টার, দেশের সর্বাধিক দর্শকের তারকা মেহজাবীন চৌধুরীর কথা। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে তার ওয়েব সিরিজ ‘দ্য সাইলেন্স’। সিরিজ, নাটক, সিনেমা এবং সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তাকে নিয়ে লিখেছেন ইমরুল নূর।
সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘দ্য সাইলেন্স’ সিরিজটি থেকে দর্শকদের কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
অনেক ভালো সাড়া পাচ্ছি। শুধু যে আমি-ই পাচ্ছি, এমনটা নয়। প্রত্যেকটা সেক্টরের প্রশংসা হচ্ছে যেমন- নির্মাণ, আর্ট, সিনেমাটোগ্রাফি এবং যারা অভিনয় করেছেন এখানে সবার অভিনয়ের বিষয়ে অনেক পজেটিভ মন্তব্য দেখছি, শুনছি, পড়ছি। সব মিলিয়ে পুরো টিম প্রশংসা পাচ্ছে। অনেক ভালো লাগছে।
এমন একটা চরিত্র হয়ে উঠা কতটা চ্যালেঞ্জের? তার জন্য প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছিলেন?গল্পটা এত বেশি ইন্টারেস্টিং ছিলো যে শোনার পরই কাজটি করতে রাজি হয়ে যাই। আমার চরিত্রটাও ইন্টারেস্টিং যেখানে অভিনয়ের অনেক সুযোগ ছিল। আমার কাছে মনে হয়েছে, যদি চরিত্রটা সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারি তাহলে দর্শকদের মায়াও লাগবে আবার রাগও হবে। তখন তাদের মনে প্রশ্ন জাগবে, এরকম কেন চরিত্রটা? তাই এমন একটা চরিত্র পেয়ে সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। পরিচালক ভিকি জাহেদ গল্পের রুবি চরিত্রটি কীভাবে দেখতে চায়, সেসব নিয়ে তার কাছ থেকে শুনি এরপর আমার মত করে চরিত্রটিকে গুছিয়ে নেই।
লুকের দিক থেকে হালকা একটু পরিবর্তন আনা হয়েছে। যারা আমাকে চেনেন তারা সেটা দেখলেই বুঝতে পারবেন।
চরিত্রটির জন্য আপনাকে আলাদা দাঁত ব্যবহার করতে হয়েছিলো। জানা মতে, মুখে অতিরিক্ত জিনিস ব্যবহার করে অভিনয় করা কিংবা এক্সপ্রেশন প্রকাশ করা খুবই কঠিন। সেটা কীভাবে সামলেছেন?
হ্যাঁ, একদমই তাই। আমি আমার মতই কিন্তু একটু আলাদা, অন্যরকম দেখানোর জন্যই এরকমটা করা হয়েছে। ফেসিয়াল স্ট্রাকচারের মধ্যে পরিবর্তন আনতে আলাদা দাঁত ব্যবহার করতে হয়েছে। এটা আসলেই অনেক কঠিন ছিল আমার জন্য। দাঁতের ওপর দাঁত ব্যবহার করে কথা বলা, এক্সপ্রেশন দেওয়া আমার জন্য সহজ ছিলো না। আমি একটু কঠিন কিছু করতেই পছন্দ করি সবসময়। তাই চেয়েছিলাম কথা বলা, এক্সপ্রেশন থেকে ভঙ্গি কিছুটা আলাদা-ই হোক। সহজ ছিলো না, কথা বলতে গিয়ে অনেক সময় জড়িয়ে যেত তারপরও যতটুকু সম্ভব ওভারকাম করার চেষ্টা করেছি।
আর এই সিরিজটিতে নিজেকে সুন্দর কিংবা পরিপাটি দেখানোর কোন ইচ্ছেই ছিলো না। চাচ্ছিলাম আমাকে যেন আমার মত না লাগে।
যতটুকু প্রত্যাশা নিয়ে কাজটি করেছিলেন, তার কতটুকু পূরণ হয়েছে ?
টিমের একজন সদস্য হিসেবে কাজটি নিয়ে প্রত্যাশার চেয়ে ভয় ছিল বেশি। কারণ, এরকম একটা কনসেপ্ট নিয়ে কাজ- সেটা দর্শকরা গ্রহণ করবে কিনা, যেটা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে সেটা বুঝবে কিনা! কি হলো, কেন হলো, কিভাবে হলো, মূল ম্যাসেজটা সবাই ধরতে পারবে কিনা এই ভয়টা ছিল।
সবার এত মন্তব্য, রিভিউ পড়ে মনে হলো যে আমরা সাকসেসফুল। দর্শকদেরকে ম্যাসেজটা বুঝাতে পেরেছি। সেই জায়গা থেকে পুরো টিম প্রশংসা পাচ্ছে। আমার মনে হয়েছিলো, কাজটা হয়তো খুব বেশি দর্শক দেখবে না কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এত এত মন্তব্য দেখছি যেটা আসলে ভালো লাগা অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ আবার এমন মন্তব্যও করেছেন যে, কিছুক্ষণ দেখার পর ভয়ে নাকি বন্ধ করে দিয়েছেন (হাহাহা)। আসলে ভয়ে বন্ধ করে দিলেই তো হবে না। আমরা চাই একদম শেষ পর্যন্ত দর্শকরা কাজটি দেখুক। এই গল্পের শেষ দেখাটা খুব জরুরি।
যার মাসের ত্রিশ দিনই সময় কাটতো শুটিং ফ্লোরে, এখন তার ব্যস্ততা কি নিয়ে?
আগে তো নাটকে নিয়মিত ছিলাম কিন্তু এখন অন্যান্য কাজের কারণে নাটকে সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নাটকের স্ক্রিপ্টের মধ্যে নতুনত্ব, আলাদা কিছু খুঁজছি। সবসময়ই যে আলাদা গল্প পাবো, এমনটাও তো সম্ভব না। তবে স্ক্রিপ্টে যেন সৌন্দর্যতা থাকে, গল্পটা সুন্দর হয় কিংবা দর্শকদের সাথে কানেক্ট হবে; এরকম স্ক্রিপ্টেই কাজ করার ইচ্ছে আছে। নয়তো বা আমার অনেক ভালো লাগতে হবে এমন গল্প হলে আবারও নাটকে দেখা যাবে।
আপনার দর্শকদের জন্য সামনে নতুন কি চমক থাকছ?
আগে থেকে বলে ফেললে সেটা তো আর চমক থাকে না। তাই আপাতত কিছু না-ই বলি।
লাক্স সুন্দরী প্রতিযোগিতা থেকে বের হওয়ার পর আপনার একটি সিনেমা করার কথা ছিলো কিন্ত সেটি আর হয় নি। এটা আসলে কেন? সিনেমা দিয়েই যার অভিষেক ঘটার কথা তার ব্যস্ততা বাড়লো নাটকে..
হ্যাঁ। লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার থেকে বের হওয়ার পরপই ‘ওয়ারিশ’ নামে একটা সিনেমার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলাম। এটাতে আমার সঙ্গে ছিলেন আরিফিন শুভ ভাইয়া। আমরা রিহার্সেলও করেছিলাম এটার কিন্তু এরপর নানা কারণে সে কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ঐ সিনেমাটি-ই আর হয়নি।
যেহেতু সিনেমা দিয়ে অভিষেক হয়নি তাই আমি চেয়েছিলাম নাটকেই কাজ শুরু করি কারণ, এতে করে অভিনয়ের অনেক কিছু শিখতে পারবো। এরপর প্রস্তুত হয়ে নাহয় সিনেমা করবো। পরে নাটকেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এরপর তো ওয়েব সিনেমা, সিরিজ করছি। যদি মেইনস্ট্রিম সিনেমা বা বড় পর্দায় কাজ এখন পর্যন্ত না করার সবচেয়ে বড় কারণ হলো, সঠিক গল্প, ভালো স্ক্রিন-প্লে এবং একটা ভালো টিম না পাওয়া। এক কথায় যদি বলি, মনের মত করে পাইনি এখনও। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি কোনো কাজ করতে চাচ্ছি না। নাটক আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমার পরিচিতি, দর্শকের ভালোবাসা- সবকিছুই নাটকের মাধ্যমে। নাটক দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করে আজকে আমি এই জায়গায়। আমি এই বিষয়টা অনেক বেশি উপভোগ করি। আমি শুধু ভালো কাজ করতে চাই। এটা দর্শক কোন মাধ্যমে দেখছে তার চেয়ে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ- আমি তাদের কতটা ভালো কাজ দিতে পারছি, ভালো অভিনয় দিতে পারছি কিনা! দর্শক আমাকে ভালোবাসলে তারা নিজের মত করে দেখে নেবে। সেটা নাটকে, ওটিটিতে অনলাইন মাধ্যমে নাহয় টিকিট কেটে সিনেমাহলে দেখবে; আমার দর্শকদের প্রতি এটুক বিশ্বাস আছে।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় টেলিভিশনের প্রায় সব শিল্পীই এখন ওটিটিতে ঝুঁকছে। এতে করে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে শিল্পী সংকট তৈরি হয়েছে বলে অনেক পরিচালকের অভিমত। তাদের ভাষ্য, সুযোগ থাকলেও প্রথম সারির শিল্পীদের এখন পাওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?
দেখুন, এই মুহূর্তটাতে আমি নাটকে কাজ কমিয়েছি আমার নিজের জন্য। এটা আমার নিজের সিদ্ধান্ত। নাটক ছেড়ে দিয়েছি, বিষয়টা কিন্তু তেমন না। আমি জানিয়েছি, ভালো স্ক্রিপ্ট হলে আমি অবশ্যই করবো। সে জায়গা থেকে আমার নিজের কাজ, নিজেকে আরও অনেক উপরে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য ঠিক সেরকম গল্পও তো লাগবে নাকি! তা নাহলে তো সেই একইরকমের কাজ করার পর দর্শকরাই বিরক্ত হবে আর বলবে, মেহজাবীন একইরকম কাজ করছে!
আমি নিজেকে আলাদা করার জন্য এবং দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য নিজের মত করে কাজ করার চেষ্টা করছি। দর্শকরা তো এটাই চাইতো, কাজ কম হোক কিন্তু সেটা যেন ভালো হয়। আমি এখন সেটাই করছি। আর একজন শিল্পী হিসেবে আমিও তো চাইবো, আমার প্রত্যেকটা কাজ খুবই এক্সক্লুসিভ হোক, আলাদা হোক। আগের করা কোন চরিত্রের সাথে মিলে না যাক। দর্শকদের সেই প্রত্যাশা পূরণ করার চেষ্টাতেই এই সময়ে এসে কাজ কমিয়ে দেওয়া।
আর শিল্পীদের ওটিটিতে আগ্রহী হওয়ার অনেক কারণ আছে। এখানে শিল্পীরা নিজেদেরকে ফুটিয়ে তুলতে সব ধরণের স্বাধীনতা পাচ্ছে যেটা টেলিভিশনে সম্ভব হয় না। এটা একটা ক্রিয়েটিভ জায়গা। যেকোন ক্রিয়েটিভ কাজ ভালো করতে হলে সময়ের দরকার। ওটিটিতে শিল্পীরা ভালো গল্প পাচ্ছে, চরিত্র নিয়ে ভাবার সময় পাচ্ছে, সময় নিয়ে কাজ করতে পারছে। এটাই তো চায় সবাই।
তাছাড়া এখন আমাদের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি অনেক বড়। এখানে অনেক শিল্পী রয়েছেন তাছাড়া যারা নতুন আছেন তারাও অনেক ট্যালেন্টেড। তাদের এখন সুযোগ দরকার ভালো পরিচালকদের সঙ্গে, ভালো গল্পে কাজ করার। এখন তাদেরকে সেই সুযোগটা দেওয়া হোক এবং তারা নিজেদের মত করে এগিয়ে যাক। একটা ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু গুটিকয়েক জনের উপর নির্ভর করে চলবে না এবং উচিতও না। এখানে প্রত্যেকটা মানুষের সেই সুযোগটা পাওয়া উচিত। আবার যখন কারও মনে হবে যে আমি এখান থেকে অন্য জায়গায় যাবো, সে স্বাধীনতাও তার থাকা উচিত। কারণ, আমরা যারা শিল্পী তারা কিন্তু অভিনয়টা বেছেই নিয়েছি ভালো সুযোগ, ভালো কাজ, ভালো চরিত্রের জন্য। যেখানে সে সুযোগটা পাবে, সেটা বেছে নেওয়ার অধিকার একজন শিল্পীর আছে। এতদিন আমি নাটকে অভিনয় করেছি, এখন একটু কম করছি; এটা একান্তই আমার সিদ্ধান্ত। সেই স্বাধীনতা তো একজন শিল্পীর অবশ্যই থাকা উচিত।
যারা এখন নতুন কাজ করছে, তাদের জন্য আমার পক্ষ থেকে অনেক অনেক শুভকামনা। তারা যে চেষ্টা করছে এটা খুব ভালো লাগছে। দর্শকদের উচিত তাদেরকে সাপোর্ট করা। কারণ, একটা সময় সেই সাপোর্টটুকু আমরাও পেয়েছিলাম যখন একেবারেই নতুন ছিলাম। আমাদেরকে যেই ভালোবাসাটা দিয়েছিলেন সেই ভালোবাসাটুকু এখন নতুনদেরকে দিন, এটাই আমি চাইবো।