
প্রবৃদ্ধি সংগঠিত হয় শ্রমশক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদ, ভৌত ও মানব পুঁজি সঞ্চয়, প্রযুক্তির পরিবর্তন ইত্যাদির অবদানের কারণে। অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে, উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি ঘটলে মানুষের কর্মসংস্থান, আয় ও জীবনকুশলতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা জাগে এবং এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আবার মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ঘটায়। সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি স্থির থাকলে জাতীয় আয় বৃদ্ধিসাপেক্ষে সমাজে সবারই কিছু না কিছু আয় বৃদ্ধি ঘটে, যা অন্য অনেক সমস্যার সমাধানে সহায়তা করে। উন্নয়নের জন্য অবশ্যই আয় বৃদ্ধি দরকার, যদিও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ঘটলেই জনগণের উন্নয়ন ঘটবে, এটা নিশ্চিত নয়। এজন্যই বলা হয়ে থাকে যে, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি উন্নয়নের দরকারি শর্ত পূরণ করে, তবে যথেষ্ট শর্ত পূরণ করে না। এজন্য কেবল উন্নয়ন নয় টেকসই উন্নয়নের কথা বলা হয়। কিন্তু উন্নয়ন যাত্রায় ব্যাপক অগ্রগতি সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে এখনো অনেক বাধা রয়ে গেছে। একইভাবে টেকসই উন্নয়নের পথেও রয়ে যাচ্ছে অনেক বাধা।
বিশ্বব্যাংক বৃহস্পতিবার ঢাকায় ‘লঞ্চ অব দ্য বাংলাদেশ কান্ট্রি ইকোনমিক মেমোরেন্ডাম’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন অগ্রগতি অর্জন করেছে। এই প্রবৃদ্ধির গতিপথ ধরে রাখতে এবং দীর্ঘমেয়াদে বৃদ্ধির হারকে আরও ত্বরান্বিত করতে এখন একটি শক্তিশালী সংস্কার এজেন্ডা প্রয়োজন। এজন্য প্রবৃদ্ধির কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে বলেও মনে করছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের অ্যাক্টিং ডিরেক্টর ড্যান্ড্যান চেন বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০টি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে রয়েছে। তবে এতে বাংলাদেশের আত্মতুষ্টির কোনো অবকাশ নেই বলে মন্তব্য করে চেন বলেন, নতুন এবং উদীয়মান চ্যালেঞ্জগুলোসহ প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং জলবায়ু পরিবর্তন একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির পরিবর্তনশীল মনোযোগের জন্য নতুন নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ভাবনের দাবি রাখে। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের রূপকল্প অর্জনের জন্য বাংলাদেশের শক্তিশালী এবং রূপান্তরমূলক নীতি পদক্ষেপের প্রয়োজন হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবিলা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকার উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, বৃহত্তর ঢাকা দেশের জিডিপির এক-পঞ্চমাংশ এবং আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের প্রায় অর্ধেক উৎপন্ন করে। কিন্তু জলবায়ু অভিবাসীদের সমস্যা সমাধানের জন্য ঘনবসতিপূর্ণ এই রাজধানী এখনো অপ্রস্তুত। বিশ^ব্যাংক মনে করছে, উন্নত নগরায়ণ এবং সংযোগ জলবায়ু অভিবাসীদের সুরক্ষা দেওয়া এবং দ্রুত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। আর তাই সফল নগরায়ণের অর্থ হবে ছোট এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে আকৃষ্ট করা। মাঝারি আকারের শহরগুলোকে দক্ষ কর্মীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনসহ অবকাঠামো বিনিয়োগ এবং পরিষেবার বিধানের জন্য শহরগুলোকে তাদের নিজস্ব রাজস্ব বাড়াতে হবে। অন্যদিকে, অর্থনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির বিপরীতে আশা দেখাচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন। তাই দ্রুত ব্রডব্যান্ড গতি বৃদ্ধি করা এবং মৌলিক পরিষেবাগুলো আরও সহজলভ্য করতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তিনটি প্রধান বাধা উল্লেখ করে বিশ^ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য বেসরকারি খাতে অর্থায়ন বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। সম্পদের গুণমান উন্নত করা, ব্যাংকের মূলধন বৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান নন-পারফর্মিং লোন মোকাবিলা করা, আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং ঋণ বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা জরুরি প্রয়োজন। উদাহরণ দিয়ে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। কিন্তু এ দেশে অশুল্ক বাধা ২০০ শতাংশের বেশি। এ ছাড়া এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনসের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের রপ্তানির হার কমে যাবে ২০ শতাংশ। এগুলো নিয়ে এখনই কাজ শুরু করতে হবে। রাজনৈতিক অর্থনীতিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় আনতে হবে। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। এটি সরাসরি পার ক্যাপিটা জিডিপির সঙ্গে জড়িত। তাই ব্যাংকগুলোকে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি আরও বাড়াতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে, প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা এবং টেকসই উন্নয়নের পথের বাধাগুলো দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। খেয়াল করা দরকার, জিডিপি বা অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে, অথচ সক্ষম সব করদাতা এবং প্রযোজ্য সব খাত করজালের আওতায় আসেনি। ফলে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়েনি। যেকোনো দেশে জিডিপির অন্তত ১৫-১৬ শতাংশ কর হিসেবে আহরিত হয়। কিন্তু এ দেশে কর-জিডিপির অনুপাত ১০-১১ শতাংশের মধ্যে দীর্ঘদিন ঘোরাফেরা করছে। বিদ্যমান নানা অশুল্ক বাধা দূর করা এবং কর-জিডিপি অনুপাত কাম্য মাত্রায় আনতে পারলে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে। অন্যদিকে, দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান এখনো বেশি। সাম্প্রতিক অতীতের সিডর, আইলা কিংবা করোনা মহামারীর কালেও কৃষি প্রবৃদ্ধি সচল রাখায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করে উন্নয়ন টেকসই করতে হলেও কৃষিতে বিশেষ নজর দিতে হবে।
বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ইডেন মহিলা কলেজ। ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কী হচ্ছে বা কী হয়েছে ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে? এটা এখন মানুষের মুখে মুখে। কেউ জানতে চান ব্যঙ্গের হাসি হেসে পাশের অপরিচিত নারীর দিকে তাকিয়ে, কেউ জানতে চান উৎকণ্ঠা থেকে কারণ তার কোনো স্বজন পড়ছেন ইডেনে অথবা কেউ জানতে চান একটা বুকভাঙা বেদনা নিয়ে, কারণ তাদের স্মৃতিতে আছে ইডেনের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস।
সেপ্টেম্বর মাসে দুটো খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন আছে। একটি হলো ১৭ সেপ্টেম্বর। ১৯৬২ সালের এই দিনে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে এসেছিল, ‘শিক্ষা সস্তায় পাওয়া যাইবে না’, এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে। শিক্ষার অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না, শিক্ষাকে ব্যবসার পণ্য বানানো যাবে না এই দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিল মোস্তফা, বাবুল ও ওয়াজিউল্লাহ। পরে এই দিনকে অভিহিত করা হয়েছে ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে। আর একটি দিন হলো ২৪ সেপ্টেম্বর। এই দিন দেশের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রথম নারী শহীদ ছিলেন তিনি। ছাত্রসমাজের কাছে এই দিন দুটোর তাৎপর্য ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে শাসকগোষ্ঠী। দেশকে ভালোবেসে সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করতে নারীরাও পিছিয়ে থাকবে না এই চেতনা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, প্রীতিলতা ছিলেন ইডেন কলেজের ছাত্রী। ছাত্রদের জন্য সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের সেপ্টেম্বর মাসে ইডেন কলেজে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে এ ধরনের কথা শুনতে তো খারাপ লাগারই কথা। দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে অনেকে বলছেন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে ইডেন কলেজের ছাত্রীদের ভূমিকা, ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্রীদের ভূমিকা আর এখন ছাত্রলীগের নেত্রীদের ভূমিকা কোনোভাবেই মেলানো যায় না।
বাংলাদেশে মেয়েদের সর্ববৃহৎ কলেজ এই ইডেন কলেজ। কলেজের শিক্ষার্থীসংখ্যা ৩৫ হাজার কিন্তু এর বিপরীতে আবাসিক সিট আছে মাত্র ৩ হাজার ৩১০টি। ফলে সিটের ভীষণ সংকট। মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের যে মেয়েরা অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে ইডেনে পড়তে আসে তারা ঢাকায় থাকবে কোথায়? একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নামে প্রশাসন থেকে কোনো সিট বরাদ্দ করা হয় না। এই সুযোগে ইডেন কলেজে ছাত্রলীগ টাকার বিনিময়ে সিট দিয়ে থাকে, যেসব কক্ষে চারজন শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা, সেখানে ১০ জন পর্যন্ত ওঠানো হয়। প্রত্যেক ছাত্রীর কাছ থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার করে টাকা নেওয়া হয়, এরপর প্রতি মাসে আবার টাকা দিতে হয়। থাকার জন্য টাকা তো দিতেই হবে আবার দলীয় কর্মসূচিতেও যেতে হবে। কেউ কোনো কারণে কর্মসূচিতে যেতে না পারলে বা না চাইলে তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে ছাত্রলীগ নেত্রীদের এই চাঁদাবাজির তথ্য প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন মাসে নেত্রীরা একেকজন ৬ লাখ থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন। ভাবুন একবার! কলেজে পড়তে এসে নেত্রী হওয়ার সুবাদে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করা!
এই টাকা আয় করতে গিয়ে সিট-বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি নিয়ে ছাত্রলীগ নেত্রী কেমন ‘অপ্রতিরোধ্য’ হয়ে উঠেছিলেন, সেটি প্রকাশ পায় তার ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ড থেকে। গত আগস্টে কলেজের হলের এক রুমে ছাত্রীদের এভাবে হুমকি দিয়েছিলেন, ‘বেশি চ্যাটাং চ্যাটাং করতেছিস। এক পায়ে পাড়া দিমু, আরেক পা টাইনা ধইরা ছিঁড়া ফেলমু। ...কে কে টাকা জমা দিছিস? আমারে দিছিস? আমি যদি একটা সিট না দিই, তোদের কোন বাপ সিট দেবে? ম্যাডামরা (হল প্রশাসন) দেবে? ক্ষমতা আছে ম্যাডামদের? কে কে টাকা জমা দিছিস? আমারে দিছিস?’ এই অডিও রেকর্ড কে করেছে তা জানা না গেলেও একে অস্বীকার করেননি তামান্না। বরং এই অডিও রেকর্ড ফাঁস হওয়ার কারণে সমালোচনার মুখে পড়ায় দুই ছাত্রীকে মানসিক নির্যাতন করে আবারও খবর হন তিনি। নির্যাতনের একপর্যায়ে বিবস্ত্র করে সেই ভিডিও অনলাইনে ভাইরাল করার হুমকিও দেন তিনি। পরে সাধারণ ছাত্রীদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন কিন্তু কাজ বন্ধ রাখেননি।
এতে বাঁধ ভেঙে যাওয়া স্রোতের মতো একের পর এক খবর বেরিয়ে আসতে থাকে। একটার চেয়ে আরেকটি ভয়াবহ। সবগুলো ঘটনাই টাকা এবং ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু আর একটি অভিযোগ লজ্জা, অপমান এবং ঘৃণাই শুধু নয় ভাবিয়ে তুলেছে জনসাধারণকে, উদ্বিগ্ন করে তুলেছে নৈতিকভাবে। তা হলো, ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের শীর্ষ নেত্রীদের বিরুদ্ধে ক্যান্টিনের চাঁদাবাজি, ইন্টারনেট সার্ভিস থেকে চাঁদাবাজি, কলেজের মুদি দোকানে চাঁদাবাজির চেয়েও ভয়াবহ অভিযোগ হচ্ছে বিভিন্নভাবে ছাত্রীদের কুপ্রস্তাব দেওয়া। সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সামিয়া আক্তারের (বৈশাখী) একটি বক্তব্য ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভীষণ আলোড়ন তৈরি করে। যেখানে তিনি বলছেন, সুন্দরী মেয়েদের রুমে ডেকে নিয়ে জোর করে আপত্তিকর ছবি তুলে রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে সেগুলো ব্যবহার করে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করতে তাদের বাধ্য করা হয়। আর এক সংবাদ সম্মেলনে কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুস্মিতা বাড়ৈ বলছেন, ‘আমাদের কানে বারবার আসে যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তাদের (তামান্না ও রাজিয়া) মেয়েরা নাকি কাজ নিয়ে আসে, বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করে...।’
অন্য কেউ বললে হয়তো সমস্বরে সবাই বলতেন, এসব বিরোধীদের ষড়যন্ত্র, ভাবমূর্তি ধ্বংসের চক্রান্ত। কিন্তু যখন ছাত্রলীগের অভ্যন্তর থেকেই এসব অভিযোগ আসছে তখন এটা ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে সহ্য করতে করতেও কখনো কখনো সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায়। এখন মনে হয় একটা বাঁধ ভাঙার কাল চলছে। ধৈর্যের বাঁধ, লজ্জার বাঁধ ভেঙে অপমানের স্রোত যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অতীতের সব অর্জন আর ভবিষ্যতের স্বপ্নকে। কীভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার রাজনীতি, দখল করার, দখলে রাখার মানসিকতা তৈরি হলো ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে? কীভাবে ছাত্রনেতা হওয়ার সঙ্গে টাকা রোজগারের অনৈতিক পথে যুক্ত হলো ছাত্রছাত্রীরা সে প্রশ্ন তুললে বলা শুরু হবে, আমরা নই ওরা প্রথম শুরু করেছে। কিন্তু ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে যে আওয়ামী লীগ তাদের ছাত্র সংগঠন যখন এসব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে আছে তখন অতীতের উদাহরণ দিয়ে দায় এড়ানো যাবে কি? বিশেষ করে ২০১১ সালেও ইডেন কলেজের তৎকালীন নেত্রীদের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক অভিযোগ ও আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সে ব্যাপারে কী ভূমিকা নেওয়া হয়েছিল সে প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে। ইডেন কলেজের প্রিন্সিপালের কি কোনো দায় আছে? নিশ্চয়ই আছে। কারণ তাকে সব সময় দেখা গেছে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে সাফাই গাইতে। বিশেষ করে হল প্রশাসনকে তাচ্ছিল্য করে অডিও ফাঁস হওয়ার পরও তাদের সম্মানে বা আত্মমর্যাদায় এতটুকু আঘাত লাগল না দেখে বিস্ময় জাগে।
শুধু কি ইডেন কলেজ? কত উদাহরণ চারপাশে। কোনটা ছেড়ে কোন উদাহরণটা নেবেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা, গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা, ইসলামীসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একের পর এক সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। এসব সংবাদ শিক্ষা গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য নয়। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে সংঘাত, সংঘর্ষ নিয়ে। সেই সংঘাত আবার আদর্শগত বিষয় নিয়ে নয়। প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে অবধারিতভাবে যুক্ত আছে আর্থিক ভাগবাটোয়ারা। প্রথমে বিরোধী সংগঠন ও মতকে দমন করো, তারপর নিজেরা সংঘাতে লিপ্ত হও, এই নীতিতেই চলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দখলদারিত্ব। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রতীকী অর্থেই বলেছেন, ১৮ জনের কাছে জিম্মি ২৮ হাজার ছাত্রছাত্রী। তিনি উচ্চারণ করেছেন, কিন্তু এটা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে অনুচ্চারিত সত্য। আবার দেশের ৫২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন ইউজিসি। তাহলে কী দেখছে এবং কী শিখছে আমাদের শিক্ষার্থীরা? জাতীয় ক্ষেত্রে দুর্নীতি, লুটপাট, ক্ষমতার দম্ভ, ভোট নিয়ে জালিয়াতি, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ, বাণিজ্যিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বানিয়ে মুনাফা, যাদের কাছে নীতিকথা শোনে তারাই যখন আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার জন্য দলাদলি এমনকি ছাত্রনেতাদের দ্বারস্থ হওয়ার ঘটনা, তখন তার প্রভাব কি পড়ে না শিক্ষার্থীদের মধ্যে?
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জীবন ও জগৎ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিগ্রাহ্য জ্ঞানে শিক্ষার্থীদের সমৃদ্ধ করে। ফলে সেখানে যুক্তি এবং সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে প্রতিযোগিতা তো থাকতেই হবে। তা না হলে সমাজের ও ব্যক্তির অগ্রগতি হবে কীভাবে? কিন্তু দমন, দখলদারিত্ব, দুর্নীতি শিক্ষার মূল মর্মবস্তুকে ধ্বংস করে দেয়। যার কুফল হয় সুদূরপ্রসারী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুক্তির পরিবর্তে কর্র্তৃত্ব বা ক্ষমতা দেখানোর পরিবেশ তৈরি হলে লোভ আর ভয়ের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে একটি অনুগত জনগোষ্ঠী তৈরি হতে পারে কিন্তু আধুনিক মানুষ তৈরি হবে না। ইডেনসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যা চলছে তা দেখে মন খারাপ করে বসে থাকলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। এগুলো হচ্ছে লক্ষণ। এর কারণ আছে রাজনীতিতে। যে রাজনীতি একটা সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীকে অনৈতিক মানুষে পরিণত করে তার পাল্টা রাজনীতি গড়ে তুলতেই হবে।
দেশি-বিদেশি শোষণ আর স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এক দিন ছাত্র আন্দোলনে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচিত হয়েছিল। আজ দেশের প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত চলছে শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা। ফলে ছাত্ররাজনীতিকে যদি কলুষমুক্ত করতে হয় তাহলে শিক্ষা-বাণিজ্য, দেশের সম্পদ লুণ্ঠন আর ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট
১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। বাংলাদেশে প্রবীণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। চলতি বছর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। যার মধ্যে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষ ৯৭ লাখ ২৭ হাজারের কিছু বেশি। আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে প্রবীণদের সংখ্যা হবে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ। আর আগামী ২০৫০ সালে এই সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ কোটি এবং ২০৬১ সালে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি প্রবীণ জনগোষ্ঠী হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে পরিবার/খানাপ্রতি লোকসংখ্যা প্রায় ৪.০৩ জন, যার মধ্যে প্রায় ০.২৪ জন প্রবীণ মানুষ আছে। আমরা তাদের ভরণপোষণ করতে পারছি না। ২০৫০ ও ২০৬১ সালে খানাপ্রতি হবে যথাক্রমে ১.১১ জন ও ১.৩৫ জন। তখন কী হবে? এখন অনেকেই যে সমস্যাকে পারিবারিক মনে করছেন, তখন তা হবে রাষ্ট্রীয় মহাদুর্যোগ!
বার্ধক্য আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য আজ একটি মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, প্রবীণ পুরুষের তুলানায় প্রবীণ নারীরা বেশি দিন বাঁচেন। অধিকাংশই আবার বিধবা হয়ে! আমাদের সমাজে তারা বেশি মাত্রায় অবহেলা, দুর্ব্যবহার এবং বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এমনকি নিজের ভাই, স্বামী, সন্তানদের কাছ থেকেই!
বাংলাদেশের সংবিধানে প্রবীণদের সামাজিক নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। আমাদের দেশে প্রবীণদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কল্যাণমূলক কার্যক্রম রয়েছে বটে কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। প্রবীণদের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রবীণরা বৃদ্ধ নয়, মানসিক দিক দিয়ে অনেক সক্ষম, দেশ গঠনে তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। দেশের সমাজ পরিবর্তনে এবং উন্নয়নে প্রবীণদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। প্রবীণরা আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র, সমাজের পথপ্রদর্শক। প্রবীণদের সম্মান দেওয়া ও যত্ন নেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কাউকে ফেলে রেখে নয়, বরং সবাকে নিয়ে বিশ্বসমাজের প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির অভিযাত্রা চলমান রাখতে হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা দলিলের মাহাত্ম্য এখানেই। পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবীণদের অবদান অপরিসীম। পরিবারের গঠন, উন্নয়ন ও সমাজের কল্যাণে কর্মময় জীবন ব্যয় করে একসময় তারা বার্ধক্যে উপনীত হন। তখন প্রবীণদের সার্বিক কল্যাণ ও সুরক্ষা করা সমাজের আবশ্যিক কর্তব্য। প্রবীণদের সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সবার সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। আধুনিক সমাজে অনেক ক্ষেত্রে প্রবীণরা শুধুই অবহেলিত এবং বঞ্চিত। মানবিক ও ধর্মীয় বিবেচনাতেই প্রবীণদের অবস্থান অত্যন্ত সম্মানের।
বিশ্বের অনেক দেশসহ সার্কভুক্ত কোনো কোনো দেশে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে। এদিক থেকে আমাদের দেশ এখনো পিছিয়ে আছে। প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩ এবং পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩ প্রণয়ন করা হলেও এ আইন ও নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন তেমনভাবে হচ্ছে না। এক সমীক্ষায় জানা যায়, পারিবারিক সহায়তা, পেনশন ও বয়স্ক-ভাতার আওতার বাইরেও দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ প্রবীণ অবহেলা ও অযত্নের শিকার। এ জনগোষ্ঠী তাদের জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম। ফলে অনেকেই ভিক্ষাবৃত্তির মতো পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে ষাটোর্ধ্বদের প্রবীণ বলা হলেও ২০১৯ সালের পর থেকে ৬৫ ঊর্ধ্বদের প্রবীণ বলে ঘোষণা করা হয়। দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী প্রবীণ হলেও তাদের কল্যাণে তেমন কোনো সুব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই প্রবীণ জনগোষ্ঠী ষাটোর্ধ্ব বয়স থেকে কর্মহীনতা, আর্থিক প্রবঞ্চনা, পুষ্টিহীনতা, নিরাপদ পানি ও বর্জ্যব্যবস্থার অভাব, পারিবারিক অবহেলা, নিঃসঙ্গতাসহ নানা জটিল পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে দিনযাপন করেন। শহুরে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মধ্যে এ অবস্থা তেমন একটা পরিলক্ষিত না হলেও নিম্নবিত্ত ও গরিব জনগোষ্ঠীর মধ্যে বঞ্চনার এই মাত্রা প্রবলভাবেই দৃশ্যমান।
অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নই প্রবীণদের অবস্থার উন্নতির ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, হাতে টাকা থাকলেই একজন প্রবীণ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন। অন্যদিকে, সব ষাটোর্ধ্ব নাগরিকদের জন্য বিশেষজ্ঞরা ১০টি পরামর্শ দিয়েছেন, যা নিজের ভালো থাকার জন্য আবশ্যকীয়। বয়স ৬০ পেরিয়ে গিয়েছে? তাহলে মনে রাখতে হবে আপনার শরীর এবার বদলাচ্ছে। বহু ধরনের হরমোনের তারতম্য হতে পারে এবার। শুধু তা-ই নয়, এবার পেশির ক্ষমতাও কমতে পারে। তাই এবার থেকে আলাদা করে নজর দিতে হবে স্বাস্থ্যের দিকে। এই বয়সে পৌঁছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে শুরু করে। তাই যতদূর সম্ভব সাবধানে থাকুন। যাতে সংক্রামক রোগ থেকে দূরে থাকতে পারেন, এর ব্যবস্থা নিন। ষাটোর্ধ্ব বয়সে এসে খাবার থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ সংগ্রহ করার ক্ষমতাও কমে। তাই এ সময় আলাদা করে ভিটামিন বা মিনারেল সাপ্লিমেন্ট খাওয়াও দরকার। তবে সেটি অবশ্যই চিকিৎসকদের জিজ্ঞাসা করে। তাদের পরামর্শমতো মাল্টিভিটামিন খেতে পারেন এ সময়। কাজকর্ম একেবারে বন্ধ করে দেবেন না। কায়িক পরিশ্রম না করলেও নিজের মতো ‘অ্যাক্টিভ’ থাকার চেষ্টা করুন। যতটা সম্ভব চনমনে থাকুন। তাতে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে। হালে করোনা তো বটেই আরও নানা ধরনের সংক্রামক রোগের হার বেড়েছে। যাদের বয়স ৬০-এর ওপরে উঠে গিয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের বেশি সমস্যা সৃষ্টি করছে। তাই এমন ধরনের রোগ থেকে দূরে থাকুন। কেউ অসুস্থ এ কথা জানতে পারলে, তিনি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তার আশপাশে যাবেন না। ভিড় এড়িয়ে চলুন। নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে যান। প্রয়োজনীয় যা যা চেকআপ করানোর আছে, সেগুলো করিয়ে ফেলুন। এতে আপনার শরীর কেমন থাকছে, তার স্পষ্ট ছবিটি দেখতে পাবেন। মানসিক চাপ থেকে যত দূরে থাকা যায়, তত দূরে থাকুন। দরকার হলে পছন্দের গান শুনুন, বই পড়ুন। এগুলো মন ভালো রাখতে সাহায্য করবে, মানসিক চাপ কমাবে। এ সময় ডায়েটে নজর দেওয়া খুব দরকারি। প্রয়োজনীয় সব কটি খাদ্যগুণ শরীরে যাচ্ছে কি না, সেটি দেখা যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি হলো যে খাবারগুলো খাচ্ছেন, সেগুলো আপনার শরীরের জন্য ভালো কি না, তা বোঝা। সেই বুঝে বিশেষজ্ঞের থেকে ডায়েট চার্ট বানিয়ে নিন। শেষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা। মনে রাখবেন, এ বয়সে বিশ্রাম খুব দরকারি। তাই নিয়ম করে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমান। তাতে শরীর ভালো থাকবে।
লেখক : সহকারী মহাব্যবস্থাপক, ফরিদপুর ইন্টারন্যাশনাল নার্সিং কলেজ, ফরিদপুর
শরতের শান্ত নদীর চরে যখন সাদা কাশকন্যারা নৃত্য করে, শেফালির শুভ্রতা ও মোহনীয় গন্ধে প্রকৃতি যখন আনন্দে আত্মহারা, যখন বিলের জলে পাখা মেলে লালপদ্ম, ঠিক তখনই মা দুর্গার আগমন ঘটে শস্যের সবুজ সংগীতে, বৃক্ষের বন্দনায়, ঢাকের শব্দে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার বাংলায়, নজরুলের বাংলাদেশ ও জীবনানন্দের রূপসী বাংলায়।
দুর্গা হিন্দুধর্মের জনপ্রিয় দেবী। মা দুর্গাকে হিন্দুধর্মে দেবী পার্বতী এবং মহাশক্তির এক অনন্য শক্তিরূপ হিসেবে মনে করা হয়। দুর্গা শব্দের অর্থ হলো যিনি দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করেন। দেবী পার্বতীর নানা রূপ রয়েছে, তার মধ্যে দশভুজা অধিক জনপ্রিয়। সিংহকে দেবী দুর্গার বাহন হিসেবে মান্য করা হয়। দুর্গম নামে এক অসুরকে বধ করেছিলে পার্বতী এজন্যই দেবী পার্বতীকে দেবী দুর্গা নামে অভিহিত করা হয়। দেবী দুর্গার অস্ত্র হিসেবে ধরা হয় ত্রিশূল, চক্র, গদা, শঙ্খ, ধনুক ইত্যাদি। দেবী দুর্গার পিতা হলেন হিমালয় এবং মা হলেন মেনুকা রানী। কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতী হলেন মা দুর্গার সন্তান।
দুর্গাপূজার নিয়ম অনুযায়ী, আশ্বিন মাসের প্রথমে যে অমাবস্যা হয় সেটি মহালয়া। এরপর যে চাঁদ ওঠে, সেই চাঁদের ষষ্ঠ দিনে দেবীর বোধন বা মহাষষ্ঠীর মাধ্যমে দুর্গাপূজার শুরু হয়। পুরাণ অনুযায়ী, মহাষষ্ঠীর দিনে দেবী পৃথিবীতে নেমে আসেন। ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর অমর হয়ে উঠেছিলেন। তবে সেই বরে বলা হয়েছিল, শুধু নারীশক্তির কাছে তার পরাজয় হবে। ফলে অসুরদের কারণে যখন দেবতারা অতিষ্ঠ, তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর মিলে দেবী দুর্গাকে সৃষ্টি করেন। দেবতার দেওয়া অস্ত্র দিয়ে তিনি অসুরকে বধ করে স্বর্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
বাংলার কৃষির সঙ্গে দুর্গাপূজার রয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক। মন্ত্রে বলা আছে, বর্ষার শেষে কৃষক যখন নতুন শস্য উৎপাদন শুরু করেন, সেই শস্যের ওপর ভিত্তি করেই দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। কারণ, জগতের মা যিনি, তিনি শস্যরূপেই আমাদের জীবন রক্ষা করেন। দুর্গাপূজা বাঙালি সনাতনী সমাজে একটি অন্যতম বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। সাধারণত আশি^ন মাসের শুল্কপক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁটটি দিন যথাক্রমে ‘দুর্গা ষষ্ঠী’, ‘দুর্গা সপ্তমী’, ‘দুর্গাষ্টমী’, ‘মহানবমী’ ও ‘বিজয়া দশমী’। আশি^ন মাসের শুল্কপক্ষটিকে বলা হয় ‘দেবীপক্ষ’। দেবীপক্ষের সূচনায় অমাবস্যারটির নাম মহালয়া। এই দিনে হিন্দুরা তর্পণ করে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইংরেজ দুঃশাসন ছিন্ন করে স্বাধীনতার জন্য মা দুর্গাকে আহ্বান জানিয়েছেন তার ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতায়। সেই বিখ্যাত কবিতায় তিনি বলেন : ‘আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল? স্বর্গ যে, আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল/দেব-শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি/ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?’ এ বছর মা দুর্গা আসবেন ১৪ আশ্বিন শনিবার এবং শ্বশুরালয়ে ফিরে যাবেন ১৮ আশি^ন বুধবার। তিনি এবার গজে আসবেন, যাবেন নৌকায়।
সম্প্রতি ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মিলনায়তনে সাংবাদিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দুর্গাপূজা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য গুজব রটালে ৯৯৯ নম্বরে ফোন দেওয়া, মন্ডপে সিসিটিভির ব্যবস্থা করা, ষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবকের ব্যবস্থা করাসহ ২১ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা জানান, গত বছর সারা দেশে ৩২ হাজার ১১৮টি মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর সারা দেশে পূজা হবে ৩২ হাজার ১৬৮টি মন্ডপে, এ সংখ্যা গতবারের চেয়ে ৫০টি বেশি। এবার ঢাকা মহানগরে ২৪১টি মন্ডপে পূজা হবে, যা গতবারের চেয়ে ৬টি বেশি। তারা আরও বলেন, গত বছর কুমিল্লার একটি মন্ডপে প্রতিমার ওপর কোরআন শরিফ রাখার অভিযোগে বিভিন্ন মন্দির ও পূজামন্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনার জের ধরে দেশের আরও কয়েকটি জেলায়ও হামলার ঘটনা ঘটে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই বারবার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি। তাই আগামী নির্বাচনের আগেই এটি বাস্তবায়ন করতে হবে।
ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় এবার ৭১টি ম-পে অনুষ্ঠিত হবে শারদীয় দুর্গাপূজা। শান্তিপূর্ণ ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপনের জন্য সম্প্রতি উপজেলা প্রশাসন এবং থানা-পুলিশের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় দুটি মতবিনিময় সভা। সভায় ৭১টি মন্দিরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদ, উপজেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সাংবাদিক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ছাড়াও বিদ্যুৎ, ফায়ার সার্ভিস, আনসার-ভিডিপি এবং থানা-পুলিশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ওই সভা দুটিতে শান্তিপূর্ণ, সুন্দর-সুষ্ঠুভাবে ও আনন্দঘন পরিবেশে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানের জন্য বেশ কিছু পরামর্শ ও দিকনিদের্শনা দেওয়া হয়। সেগুলো হলো ১. প্রতিটি মন্দিরে সিসিটিভি স্থাপন করতে হবে। যেসব মন্দিরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই বা মন্দির কর্তৃপক্ষের সিসিটিভি কেনার সামর্থ্য নেই, সেসব মন্দিরে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টা পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। ২. এ বছর প্রতিটি মন্দিরে সার্বক্ষণিক আনসার পাহারার ব্যবস্থা থাকবে। ৩. প্রতিটি মন্দিরে থানা-পুলিশের পক্ষ থেকে পুলিশ কর্মকর্তাদের নাম, মন্দিরের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের নাম ও মোবাইল ফোন নম্বর-সংবলিত একটি রেজিস্টার দেওয়া হয়েছে। থানা-পুলিশের কর্মকর্তারা মন্দির পরিদর্শনকালে ওই রেজিস্টারে তাদের মতামত লিপিবদ্ধ করবেন। অন্যদিকে পূজা মন্দিরে কোনো গন্ডগোল হওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে মন্দির কমিটির সভাপতি/সাধারণ সম্পাদককে ওই নম্বরে অথবা ৯৯৯ নম্বরে পুলিশকে জানাতে হবে। ৪. নামাজ চলার সময় কোনো অবস্থাতেই মাইক বা ঢাকঢোল বাজানো যাবে না। ৫. স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি; বিশেষ করে পৌরসভার কাউন্সিলর, মেয়র এবং ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ও চেয়ারম্যানদের তার নিজ এলাকার পূজামন্ডপ নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে এবং এ কাজে গ্রাম-পুলিশদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে। ৬. পূজামন্ডপ এলাকার আশপাশের মসজিদের মাইক যাতে চক্রান্তকারীরা ব্যবহার করে পূজানুষ্ঠানের কোনো ক্ষতি করতে না পারে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার, কাউন্সিলর ও মেয়রদের মসজিদের ইমাম সাহেবকে অনুরোধ করতে হবে। ৭. পূজা এলাকার কোনো ব্যক্তি যাতে ফেইসবুকের মাধ্যমে উসকানিমূলক বক্তব্য পরিবেশন করে পূজার পরিবেশ নষ্ট করতে না পারে সে ব্যাপারে সবাইকে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। ৯. রাত ১২টার পর থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত অপরাধ সংঘটনের জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত সময়। এ সময় ডিউটি রোস্টার করে স্বেচ্ছাসেবক ও মন্দির কমিটির সদস্যদের মাধ্যমে মন্দির ও মূর্তির সুরক্ষার জন্য পাহারার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ১০. দুর্গাপূজা করতে হবে সাত্ত্বিকভাবে। কোনো ব্যক্তি নেশা করে বা মাদক সেবন করে মন্দির এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে না। প্রবেশ করলে তাকে পুলিশে সোপর্দ করতে হবে। ১১. অগ্নিকান্ডের মতো কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাতে দ্রুত মন্দির এলাকায় প্রবেশ করতে পারে সেজন্য বিদ্যুতের তার ১২ থেকে ১৪ ফুট ওপরে লাগাতে হবে এবং একই উচ্চতায় মন্দিরে গেট নির্মাণ করতে হবে। সম্ভব হলে প্রতিটি মন্দিরে একটি করে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র এবং আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে। এসব পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা যদি যথাযথভাবে পালন করা হয়, আমাদের বিশ্বাস এ বছর গতবারের মতো দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে কোনো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো সম্ভব হবে না। সারা দেশে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উদযাপিত হবে শারদীয় দুর্গোৎসব।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান, বাংলাদেশে যারা বাস করেন, তারা সবাই এ দেশের নাগরিক। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা সম-অধিকার ভোগ করবেন। তিনি আরও বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে কুমিল্লার নানুয়া দিঘীর পাড়ের মতো, পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের বটতলার মাঝিপাড়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। যে দেশের মাটিতে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত মিশে আছে, যে দেশে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছেন দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা, জিসিদেব, মুনীর চৌধুরী, শহিদুল্লা কায়সার, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সে দেশে কেন পূজার মন্দিরে হামলা হবে? হিন্দুদের বাড়িঘর, দোকান-পাট লুটপাট হবে? অগ্নিসংযোগ হবে? তা আমাদের বোধগম্য নয়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে দেশের আপামর জনসাধারণ বিশেষ করে যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে দেবী দুর্গা পরম ভক্তিময়। তার এক রূপ অসুর বিনাশী, আরেক রূপ মমতাময়ী মাতার। তিনি অশুভর প্রতীক অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেন। এর মধ্য দিয়ে অন্যায় অশুভর বিপরীতে ন্যায় ও শুভশক্তির জয় ঘোষিত হয়। তিনি কেবল সৌন্দর্য-মমতা-সৃজনের আধারই নন, অসহায় ও নিপীড়িতের আশ্রয়দানকারী এবং নির্যাতিত-নিপীড়িতের নির্ভরযোগ্য ভরসাস্থল।
লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন
১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন প্রখ্যাত বাঙালি সংগীতশিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালক শচীন দেব বর্মণ। শচীনকর্তা নামে তিনি সুপরিচিত। তার বাবা মহারাজকুমার নবদ্বীপচন্দ্র বাহাদুর। শচীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ত্রিপুরার রাজদরবারে চাকরি নেন। শৈশবকাল থেকেই তিনি ছিলেন সংগীতের প্রতি অনুরক্ত। পরে চাকরি ত্যাগ করে সংগীতের জন্য কলকাতায় যান। ওস্তাদ বাদল খাঁ, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁসহ সে সময়ের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞদের কাছে রাগসংগীতের তালিম নেন। কাব্যসংগীত ও লোকসংগীতের সুর ও লয়কে সমন্বিত করে কণ্ঠসংগীতের এক স্বকীয় শৈলী উদ্ভাবন করেন তিনি। লোকসংগীত ও রাগসংগীত নিজস্ব ঢঙে গেয়ে প্রচুর সুনাম অর্জন করেন। ১৯২৩ সালে কলকাতা বেতারে তার গান প্রথম পরিবেশিত হয়। ১৯৩৭ সালে ‘রাজগী’ চলচ্চিত্রে প্রথম সংগীত পরিচালনা করেন। ৮০টিরও বেশি বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে তিনি সংগীত পরিচালনা করেন। ১৯৪৪ সাল থেকে স্থায়ীভাবে মুম্বাইয়ে বসবাস শুরু করেন। সেখানকার চলচ্চিত্র ‘শিকারী’, ‘দেবদাস’, ‘সুজাতা’, ‘বন্দিনী আরাধনা’, ‘পিয়াসা’ প্রভৃতিতে সুরযোজন করেন। গ্রামোফোন রেকর্ডে প্রকাশিত তার কণ্ঠসংগীতের সংখ্যা ১৩১, একক কণ্ঠে ১২৭টি ও মীরা দেব বর্মণের সঙ্গে চারটি দ্বৈতসংগীতের রেকর্ড রয়েছে। ১৯৫৮ সালে সংগীত-নাটক আকাদেমি ও লন্ডনের এশিয়ান ফিল্ম সোসাইটি পদক এবং ১৯৬৯ সালে ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কার পান তিনি। ‘সরগমের নিখাদ’ শিরোনামে দেশ পত্রিকায় সংগীত বিষয়ে তার সাধনা ও অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশিত হয়েছে। চলচ্চিত্র সংগীতশিল্পী মীরা দেবী তার স্ত্রী ও সুরকার রাহুল দেব বর্মণ তার ছেলে। ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
রাজধানীর মিরপুরের একটি মাধ্যমিক-সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সিফাত। একই এলাকায় বসবাসকারী তার বন্ধু সিয়াম পড়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে। সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার থেকে রোজার ছুটি। আর সরকারি প্রাথমিকে ছুটি ১৫ রোজা অর্থাৎ ৭ এপ্রিল থেকে।
এক দেশে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন নিয়মে ছুটি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে লেখাপড়ায় কেউ এগিয়ে যাবে, আবার কেউ পিছিয়ে পড়বে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার বা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে ভেবেচিন্তেই নেয়। তবে সব ধরনের স্কুলে একটা কো-অর্ডিনেশন থাকলে ভালো হয়। আমরা ছুটির ব্যাপারে আরও আলাপ-আলোচনা করব।’
জানা গেছে, চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে আগামী শুক্রবার শুরু হতে পারে রমজান মাস। বছরের শুরুতেই স্কুলগুলোর ছুটির তালিকা অনুমোদন করা হয়। সে অনুযায়ী পবিত্র রমজান, স্বাধীনতা দিবস, ইস্টার সানডে, বৈসাবি, নববর্ষ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা ও টিটি (টিচার্স ট্রেনিং) কলেজেও একই সময়ে ছুটির ঘোষণা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছুটির তালিকা ভিন্ন। তারা পবিত্র রমজান, ইস্টার সানডে, চৈত্র-সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আগামী ৭ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ প্রায় ১৫ রমজান পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা থাকবে।
রাজধানীসহ বড় বড় শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকের মতোই তাদের ছুটি থাকবে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রোজার ছুটিও একই। তবে মাদ্রাসায় রোজার ছুটি শুরু এক দিন আগেই অর্থাৎ আজ বুধবার, ২২ মার্চ।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। তাই বুধবার ক্লাস করে বৃহস্পতিবার রোজার ছুটি শুরু হবে। তবে সব স্কুলে একই ধরনের ছুটি থাকা জরুরি। এতে একই সময়ে সিলেবাস শেষ করা যাবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সন্তুষ্ট থাকবে।’
রমজানে মাধ্যমিকে স্কুল বন্ধ আর প্রাথমিকে খোলা রাখায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষকের মধ্যে। তারা বলছেন, যেসব অভিভাবকের সন্তান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্কুলেই পড়ে তাদের সমস্যা হবে। রমজান মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও রোজা রাখেন। তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিল রেখে প্রাথমিকের ছুটি নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগাঠনিক সম্পাদক জুলফিকার আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকারি ছুটি ৭৬ দিন, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৫৪ দিন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিন্ন ছুটি নির্ধারণের যুক্তি তুলে ধরে আমরা ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছি। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো সাড়া পাইনি।’
'স্যার নয় আপা ডাকলেই চলবে' রংপুরের জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীনের এমন বক্তব্যের পর রাত ৯ টার দিকে আন্দোলন সমাপ্ত করে ক্যাম্পাসে ফিরে গেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এর আগে চিত্রলেখা নাজনীনের বিরুদ্ধে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে বুধবার (২২ মার্চ) বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে একাই অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন উমর ফারুক। এর পর তার সাথে একাত্মতা জানিয়ে আন্দোলনে যুক্ত হন বেরোবির বাংলা বিভাগের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা।
তুহিন ওয়াদুদ তার ফেসবুক পোস্টে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান।
জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, বেরোবির একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে উমর ফারুক আমার কাছে এসেছিলেন। এ সময় আমি বাইরে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম। তখন ওই শিক্ষক আমাকে দেখে আপা বলে ডাক দেন। আমি তাকে স্যার না বলে আপা কেন ডাকছেন জানতে চাই। আমার জায়গায় একজন পুরুষ দায়িত্বে থাকলেও কি তিনি স্যার না বলে ভাই ডাকতেন?
জেলা প্রশাসক জানান, রাতে তিনি ওই শিক্ষক ও আন্দোলনকারীদের স্যার ডাকতে হবে না, আপা ডাকলেই চলবে বলে জানান। এরপর তারা আন্দোলন বন্ধ করে দেন এবং ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে চলে যান।