
১৮৮৯ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন অভিনেতা, নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী। তিনি বঙ্গবাসী স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিএ এবং ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করেন। মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউট ও বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি তার প্রবল ঝোঁক ছিল। প্রথম অভিনয় ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ নাটকে। ১৯২১ সালে পেশাদার অভিনেতা হিসেবে ম্যাডান থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হন। পরে মঞ্চ ছেড়ে চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেন। শরৎচন্দ্রের ‘আঁধারে আলো’ ও ‘চন্দ্রনাথ’-এর চিত্রায়ণে একই সঙ্গে পরিচালক ও অভিনেতার ভূমিকায় কাজ করেন। একটি নাট্যদল গঠন করে ১৯২৩ সালে শিশিরকুমার নাট্যমঞ্চে ফিরে আসেন। দ্বিজেন্দ্রলালের সীতা নাটকে রামচন্দ্রের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেন। তার অভিনয়ে অভিভূত হয়ে অমৃতলাল বসু তাকে থিয়েটারের নবযুগের প্রবর্তক বলে ঘোষণা করেন। এ নাটকে তিনি কনসার্টের বদলে রোশনচৌকি, আসনব্যবস্থায় বাংলা অক্ষর, প্রবেশপথে আলপনা ও পূর্ণকলস, প্রেক্ষাগৃহে চন্দন-অগরু-ধূপের গন্ধ, পাদপ্রদীপের পরিবর্তে আলোক-সম্পাত এবং সিনের পরিবর্তে বক্সসেট প্রয়োগ করেন। তিনি ১৯৪২ সালে ‘শ্রীরঙ্গমনামে একটি রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে ‘বিশ্বরূপা থিয়েটার’ নামে পরিচিত। অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৫৯ সালে ভারত সরকার তাকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করতে চাইলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এ বছরেরই ৩০ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
একটি দেশ বা সমাজ কতটা উন্নত তা বোঝা যায় প্রবীণদের প্রতি আচরণে। প্রবীণদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে তা কেবল সাংস্কৃতিক প্রশ্ন নয়। প্রশ্নটা গভীরভাবে অর্থনৈতিকও। দেশের জন্য শ্রম দিয়ে অবসরে যাওয়া প্রবীণদের সুরক্ষায় রাষ্ট্র কতটা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে সেটাই সেই রাষ্ট্রের সামাজিক উন্নতির পরিচায়ক। বাংলাদেশে প্রবীণদের সুরক্ষায় রাষ্ট্রের আরও বেশি দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়টি এখন জরুরি হয়ে পড়ছে। বিশ্বজুড়েই জনসংখ্যায় প্রবীণতার হার আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি এবং দ্রুত তা ঘটছে। এ প্রবণতা এখন শুধু ইউরোপ বা উন্নত অর্থনীতির দেশে সীমিত নয়। প্রবীণতা সব জনসংখ্যাকেই আচ্ছন্ন করছে, তবে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়। বাংলাদেশও প্রবীণ লোকের দেশের তালিকায় ঢুকতে যাচ্ছে। দুই যুগ পরেই বাংলাদেশ রূপান্তরিত হবে ‘প্রবীণের সমাজে’। কিন্তু একটা প্রবীণপ্রধান সমাজে প্রবীণদের সুরক্ষার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছি।
কোনো দেশের মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশের বয়স যদি ৬৫ বা তার বেশি হয়, তাহলে সেই দেশকে ‘প্রবীণের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই হিসেবে ২০৪৭ সালে বাংলাদেশ ‘প্রবীণের সমাজ’ বা ‘প্রবীণপ্রধান দেশ’-এ রূপান্তরিত হবে। এই প্রক্রিয়া শুরু হবে মাত্র সাত বছর পর। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২০২৯ সালে প্রবীণমুখিতার পর্যায়ে পৌঁছাবে। ‘বৃদ্ধ বা প্রবীণ’ পর্যায়ে রূপান্তরিত হতে বাংলাদেশের মাত্র ১৮ বছর লাগবে। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ যে গতিতে ‘বয়স্ক’ থেকে ‘বার্ধক্য’ পর্যায়ে পৌঁছবে তা উন্নত এশীয় ও সমৃদ্ধ ইউরোপীয় দেশগুলোর গতির চেয়ে বেশি হবে। এই রূপান্তরে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দ্রুত রূপান্তরশীল সমাজ হবে। উন্নতির অনেক নিচের ধাপে থেকে জনসংখ্যা-রূপান্তরের এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু দেশ গঠনে অবদান রাখা প্রবীণ নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার যতটা ব্যবস্থা রয়েছে বাংলাদেশে তা দেখা যায় না। মাসিক ৫০০ টাকা বয়স্ক ভাতা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে সরকার। তবে অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ একটি সর্বজনীন পেনশন নীতি গ্রহণ করেছে, যা এখনো প্রক্রিয়াধীন। অন্যদিকে, ‘বয়স্ক’ জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের কর্মক্ষম লোকসংখ্যা কমবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নতির পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা ও সঞ্চয় বাড়াতে বেশি জোর দিতে হবে। তা না হলে ‘বৃদ্ধ’ বা ‘প্রবীণ’দের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিয়ে নাগরিক অধিকারসহ সামাজিক জীবনে অংশগ্রহণ অসম্ভব হয়ে পড়বে।
খেয়াল করা দরকার, প্রবীণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় অনেক দেশেরই স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সুরক্ষায় ব্যয় বাড়ছে। বিপরীতে পেনশন ব্যবস্থার আওতায় লোক কম। আইএমএফের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত অর্থনীতিতে বেসরকারি ও সরকারি উভয় খাতে সঞ্চয় কমে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। অর্থাৎ এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় যুগপৎ সর্বজনীন পেনশন সুবিধার মতো অর্থনৈতিক সুরক্ষা এবং প্রবীণদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে সরকারকে। কিন্তু আমাদের ‘বয়স্ক ভাতা’ ও ‘পেনশন’ সুবিধা যেমন অপ্রতুল তেমনি স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অবস্থাও করুণ। বাংলাদেশে জিডিপির এক শতাংশেরও কম ব্যয় হয় স্বাস্থ্য খাতে। সিঙ্গাপুর, চীনসহ অনেক দেশ বয়স্কদের স্বাস্থ্যসেবায় আলাদা ব্যবস্থা নিলেও বাংলাদেশের এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা খাতে জিডিপির দুই শতাংশ বরাদ্দের পরিকল্পনা রয়েছে। একইভাবে আবাসনের সংকটও প্রবীণদের এক বড় সমস্যা। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো এ বিষয়ে মোটেই প্রস্তুত নয়। বাংলাদেশে প্রবীণদের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিচালিত ছয়টি প্রবীণ নিবাস আছে, যেগুলোতে ৫০ জন করে থাকতে পারে। বেসরকারি উদ্যোগে বেশ কয়েকটি বৃদ্ধাশ্রম আছে সাভার, গাজীপুরসহ কয়েকটি এলাকায়। এই বাস্তবতায় প্রবীণদের জন্য মানসম্মত নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও বিনিয়োগে উৎসাহিত করা দরকার।
সরকারের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে একজন নির্ভরশীল প্রবীণের বিপরীতে ১৩ জন কর্মক্ষম ব্যক্তি ছিল। কিন্তু ২০৪০ সালে প্রতি ৬ জন কর্মক্ষম ব্যক্তির বিপরীতে একজন প্রবীণ নির্ভরশীল থাকবে। আর ২০৬৫ সালে প্রতি তিনজন সমর্থ ব্যক্তির বিপরীতে একজন নির্ভরশীল প্রবীণ থাকবে। একই রকম বাস্তবতা মোকাবিলায় বহু উন্নত দেশ এখন প্রবীণদের সুস্থ রাখার পাশাপাশি সমর্থ প্রবীণদের কাজে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশও আগামীতে অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর চিন্তা করছে। অন্যদিকে, নির্ভরশীল প্রবীণদের সুরক্ষায় সন্তানদের দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়ে আইন থাকলেও সেটা মানছেন না অনেকেই। ২০১৩ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পিতা-মাতার ভরণপোষণের আইন করে সরকার। কিন্তু এই আইনের সমস্যা হলো ভরণপোষণের দাবিতে সন্তানের বিরুদ্ধে বাবা-মাকেই মামলা করতে হবে। কিন্তু আত্মসম্মান খুইয়ে সন্তানের বিরুদ্ধে মা-বাবা সাধারণত মামলা করেন না। এই দায়িত্ব রাষ্ট্রেরও। প্রবীণ নাগরিকদের ভরণপোষণ ও সুরক্ষার জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে।
আসিফ নজরুল লেখক, ঔপন্যাসিক, রাজনীতি-বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি ও সাম্প্রতিক নানা সংকট নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : ছাত্ররাজনীতি দেশের শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন কি?
আসিফ নজরুল : খুবই কম। কয়েকটি বাম দল এবং ‘ছাত্র অধিকার পরিষদ’ কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের ওপর কিছুটা চাপ সৃষ্টি করতে পারছে। বাম ছাত্র সংগঠনগুলা বা ছাত্র অধিকার পরিষদ না থাকলে ছাত্ররাজনীতির নামে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন যে অর্গানাইজড এবং সহিংস আধিপত্য বজায় রেখেছে সেটা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করত। ছাত্রদের জীবনের অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার বজায় রাখার জন্য ছাত্ররাজনীতি কিছুটা ভূমিকা রাখছে। শিক্ষার অধিকার যদি বলেন, এটা এখন আর ছাত্ররাজনীতির ফোকাসে নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের অত্যাচার, দুর্নীতি এবং অনাচার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এর থেকে সাধারণ ছাত্রদের বেঁচে থাকাই এখন ছাত্ররাজনীতির মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে কিছু কিছু সংগঠন কিছু ভূমিকা রাখছে, কিন্তু সেটাও পর্যাপ্তভাবে রাখতে পারছে না।
দেশ রূপান্তর : দেশের বিদ্যমান শিক্ষাকাঠামো এবং উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে ছাত্ররাজনীতির কি কোনো ভূমিকা রয়েছে?
আসিফ নজরুল : উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে তো ছাত্ররাজনীতি সেভাবে ভূমিকা রাখে না। এর মূল দায়িত্ব হচ্ছে ইউনিভার্সিটি জয়েন্ট কমিশন এবং বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনগুলোর। এখন ছাত্রদের তো সাধারণ পড়াশোনা করারই পরিবেশ নেই। হলের মধ্যে তাদের গণরুমে রাখা হয়, জোরপূর্বক কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়, তাদের এক ধরনের দাসত্বের জীবন বেছে নিতে হয়। তো এই দাসত্বের জীবন নিয়ে তারা বর্তমান যে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা আছে সেটা বজায় রাখতেই তো হিমশিম খায়। শিক্ষার্থীদের ট্রান্সপোর্ট, লাইব্রেরি ফেসিলিটিজ, আবাসন ইত্যাদি এসবের অপ্রতুলতা রয়েছেই। তবে এখন তো শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে এগুলো আর আগের মতো বড় ইস্যু হয়ে নেই। আপনি দেখেন কিছুদিন আগে ছাত্রদলের পক্ষ থেকে শিক্ষা অধিকার সংক্রান্ত কিছু দাবি পেশ করার জন্য উপাচার্য মহোদয়ের কাছে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে প্রকাশ্যে তাদের পেটানো হলো। স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি থেকেই তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। ছাত্রলীগের একটা ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষার অধিকার তো দূরের কথা শিক্ষাঙ্গনে কোনো রকম মতভিন্নতা বা ভিন্নমত, সমালোচনা, তৎপরতা কোনো কিছুই তারা করতে দেবে না। তারা একটা অ্যাবস্যুলুট আধিপত্য বজায় রেখে সরকারি দলের ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করবে। এর বিনিময়ে তারা সাধারণ ছাত্রদের ওপর অত্যাচার করবে, সুযোগ-সুবিধা আদায় করবে আর স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে, নানা রকম পদ বিক্রি করার খবরও পত্র-পত্রিকায় দেখছি।
দেশ রূপান্তর : পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের পাশাপাশি এখন বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোতেও ছাত্ররাজনীতি চালুর চেষ্টাকে কীভাবে দেখছেন?
আসিফ নজরুল : বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের যারা স্টেকহোল্ডার আছে, তারা তো সবাই বলছে এখানে কোনোভাবেই তারা ছাত্ররাজনীতি চায় না। আপনি যদি ইউজিসির বিধান দেখেন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের ছাত্র সংগঠন করা কিংবা সো-কল্ড ছাত্ররাজনীতির স্কোপ নেই। ছাত্ররাজনীতির নামে বর্তমানে যে অত্যাচার-অনাচার, নির্মম নির্যাতন, সহিংসতা চলছে এটাকে ছাত্ররাজনীতি বলা যায় কি না আগে সেই ডিবেটে আসেন। ওরা যেগুলো করে, সেসব তো ক্রিমিনাল অপরাধ। কিছু ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধ। তো এই ফৌজদারি অপরাধ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে আপনি অ্যালাউ করবেন কি না, এটাই প্রশ্ন। ছাত্ররাজনীতির নামে তারা এসব ফৌজদারি অপরাধের পরিধি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চায়।
দেশ রূপান্তর : ইডেনে সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? এই ঘটনা কি মেয়েদের রাজনীতিতে আসাকে বাধাগ্রস্ত করবে না?
আসিফ নজরুল : রাজনীতিতে আসা তো পরের কথা, কথা হচ্ছে যে অভিযোগটা উঠেছে জোর করে কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করা এটা তো কমন, সবাই জানে; কিন্তু জোর করে তাদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করা এটা সিরিয়াস অভিযোগ, এটা যদি দুই/চারজন মেয়ের সঙ্গেও হয়ে থাকে, সরকারের উচিত ছিল সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া।
দেশ রূপান্তর : যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। আমরা ছাত্রদল এবং ছাত্রলীগ উভয়ের আচরণই দেখেছি। বিশ^বিদ্যালয়ের হলগুলো কার্যত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলোর হাতে জিম্মি। তাদের নির্যাতনে সাধারণ ছাত্রদের মৃত্যুও হয়েছে। মুক্তির উপায় কী?
আসিফ নজরুল : যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ এটা বর্তমান সরকারকে জাস্টিফাই করতে ব্যবহার করা হয়। দালালরা, পেইড লোকরা এসব বলে। শোনেন, একটা সময় পর্যন্ত এটা প্রযোজ্য ছিল। একসময় ছাত্রদল অত্যাচার করত ছাত্রলীগের ওপর, আবার ছাত্রলীগ করত ছাত্রদলের ওপর এটুকু পর্যন্ত আপনার কথা ঠিক আছে। কিন্তু এখন যে পর্যায়ে গেছে, এখন তো সাধারণ ছাত্রদের, ছাত্রীদের ওপর অত্যাচার করে। বিশ^বিদ্যালয়ের হল প্রশাসনকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। এটা আর একটা রাবণ পর্যায়ে নেই, তিনটা রাবণের সমান হয়ে গেছে। সে যদি পাঁচ বছরের জন্য থাকে সে আর কত বড় রাবণ হয়, কিন্তু সে যদি ১৫ বছর থাকে, তাহলে সেই রাবণের সাইজটা চিন্তা করেন। আগের যে কোনো সময়ের সঙ্গে এটা আর তুলনীয় না।
দেশ রূপান্তর : ছাত্ররাজনীতির চলমান ধরন কি নতুন প্রজন্মকে রাজনীতিবিমুখ করে তুলছে?
আসিফ নজরুল : ছাত্ররাজনীতি যে শব্দটা আমরা ব্যবহার করছি, এটা তো এখন আর ছাত্ররাজনীতি না। ছাত্ররাজনীতির নামে অত্যাচার, নিপীড়নমূলক আধিপত্য যেটা চলছে, এর প্রতি তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ না থাকলেই তো ভালো। কিন্তু সুস্থধারার যে ছাত্ররাজনীতি আছে, বাম সংগঠনগুলো যেটা করে বা কোটা সংস্কার আন্দোলনে, সড়ক আন্দোলনে যেটা দেখেছেন... সেটার প্রতি তো তরুণ প্রজন্মের আগ্রহের কমতি নেই। যেসব ব্যাপারে মানুষের অধিকার, জীবন-জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত সেখানে তরুণ প্রজন্ম কীভাবে সাড়া দেয়।
দেশ রূপান্তর : ২৯ বছর পর সম্প্রতি ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। তখন অন্য বড় বিশ্ববিদ্যলয়গুলোতেও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি উঠেছিল। কিন্তু আবারও সব বন্ধ হয়ে গেল। ছাত্র সংসদ কেন কার্যকর করা যাচ্ছে না?
আসিফ নজরুল : ডাকসু নির্বাচনের পরই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত সরকারবিরোধী বা সরকারের সঙ্গে নেই এমন ছাত্র সংগঠনগুলার কিছুটা সহাবস্থানের জায়গা তৈরি হয়েছিল। এখানে নিয়ম আছে ডাকসু নির্বাচন করার, চাহিদা আছে, সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে একটা এক্সপেক্টেশন আছে, এর একটা ইতিবাচক ফল আছে... এসবের পর তো এটা আর না করার কোনো যুক্তি আমি দেখতে পাই না। একটাই যুক্তি হতে পারে যে, সরকার চায় না। ডাকসু হলে সরকার সমর্থক দলের যে একাধিপত্য সেটা কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন হয়।
দেশ রূপান্তর : সাম্প্রতিককালে দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল ‘নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন’ এবং ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’। এই দুটি আন্দোলন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
আসিফ নজরুল : সাধারণ ছাত্ররা যে তাদের অধিকার সচেতন, তারা যে তাদের জীবন ও জীবিকা নিয়ে ভাবে, দেশ নিয়ে ভাবে এসবের রিফ্লেকশন। বিশেষ করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন যে নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে, সেই বিভীষিকা আমি ভুলতে পারি না। এই আন্দোলনটার যে সম্ভাবনা ছিল সেটা শক্তি প্রয়োগ করে, গুন্ডাপান্ডা এবং পুলিশ লাগিয়ে, বিভিন্ন মামলা দিয়ে সরকার দমন করেছে...। ইস্যুটা কিন্তু দমন হয়নি, আন্দোলনটাকে দমন করা হয়েছে।
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক। পাশাপাশি তিনি সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষা এবং সমকালীন বিষয়াবলি নিয়ে লেখালেখি করেন। দেশে চলমান ছাত্ররাজনীতি ও এ বিষয়ের নানা সংকট নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : ছাত্ররাজনীতি দেশের শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন কি?
ড. কামরুল হাসান মামুন : বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যা হচ্ছে তাকে কি ছাত্ররাজনীতি বলা যায়? বরং বলা যায় অসভ্য রাজনীতি। ছাত্ররা রাজনীতি করবে ছাত্রদের মঙ্গলের জন্য। শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি, আবাসিক হলে সুশৃঙ্খল জীবন এবং সুন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য। ছাত্ররাজনীতি হবে শিক্ষা গবেষণার মান বৃদ্ধির জন্য। লাইব্রেরিতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা স্থাপন করে উচ্চ মানের বই এবং জার্নালের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য। এর বদলে আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ হত্যা করা হয়। ছাত্র হয়ে ছাত্রদের জোর করে মিছিলে নেওয়া, রাজনীতিতে যেতে বাধ্য করা, এই রাজনীতি কি পৃথিবীর কোনো দেশে হয়?
দেশ রূপান্তর : দেশের বিদ্যমান শিক্ষাকাঠামো এবং উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে ছাত্ররাজনীতির কোনো ভূমিকা রয়েছে কি?
ড. কামরুল হাসান মামুন : অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু সেটা মারাত্মক নেতিবাচক। বর্তমানে যাকে ছাত্ররাজনীতি বলছি সেটা আসলে ক্রিমিনাল এবং স্বার্থপরদের রাজনীতি। আমরা যেই গৌরবোজ্জ্বল ছাত্ররাজনীতির কথা বলি সেই রাজনীতি কারা করত? নির্বাচিত হল সংসদের প্রায় সব সদস্য একেকটি ক্লাসের সেরা ছাত্র ছিল। সাধারণ ছাত্ররাও ভালো ছাত্র এবং ভালো মানুষ না হলে ভোট দিত না। এখন ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্রটা ছাত্ররাজনীতি করে। বছরের পর বছর ফেল করে আর বিশেষ পরীক্ষা, বিশেষের বিশেষ পরীক্ষা দিতেই থাকে। এই করে তারা মেধাবীদের মেধাকে হত্যা করে। দুঃখজনক হলো এদেরই নেতা হিসেবে আখ্যা দিতে হয়। আমরা ভালো নেতা তৈরির জায়গাটা নষ্ট করে ফেলেছি বলে দেশে ভালো মানের জাতীয় নেতাও পাচ্ছি না। সবকিছু এখন নষ্টদের দখলে। রাজনৈতিক দল এই নষ্টদের একত্রিত হওয়ার প্লাটফর্ম দেয়। নষ্টদের হাতে ক্ষমতা যাওয়াটা এখন প্রায় গ্লোবাল ফেনোমেনা। তবে সভ্য দেশে ভালো সিস্টেম আছে বলে নষ্টরাও তেমন ক্ষতি করতে পারে না, যেটা আমাদের দেশে পারে।
দেশ রূপান্তর : যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। আমরা ছাত্রদল এবং ছাত্রলীগ উভয়ের আচরণই দেখেছি। বিশ^বিদ্যালয়ের হলগুলো কার্যত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলোর হাতে জিম্মি। তাদের নির্যাতনে সাধারণ ছাত্রদের মৃত্যুও হয়েছে। মুক্তির উপায় কী?
ড. কামরুল হাসান মামুন : ৯০-এর অভ্যুথানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারকে হটিয়ে তথাকথিত গণতন্ত্রের জন্মের পরের ঘটনা কী? মাঝে তত্ত্বাবধায়ক ও সেনাশাসন বাদ দিলে বিএনপি, আওয়ামী লীগ যখন যেই ক্ষমতায় সেই দলের ছাত্র সংগঠনের দখলেই ক্যাম্পাস চলে যায়। অন্য ছাত্র সংগঠন যারা ক্যাম্পাসে থাকে তাদের ছোটখাটো হয়েই থাকতে হয়। সুতরাং এই দুই দলের কেউই সুশাসনের উদাহরণ রাখতে পারেনি। শুধু তাই না, ক্যাম্পাস যখন যাদের দখলে আবাসিক হলগুলোও তাদের দখলে চলে যায় এবং সময়ের সঙ্গে এর মাত্রা বেড়েছে।
আমাদের দেশে যা হচ্ছে এই ফর্মে ছাত্ররাজনীতি বিশ্বে কোথাও নেই। কল্পনা করা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একদল ছাত্র আরেক দল ছাত্রের ওপর হামলা করতে পারে! এই রাজনীতি করে বা শিখে এরা কেমন নাগরিক হবে তার প্রতিফলন তো আমরা আমলাদের মধ্যে দেখছি, পুলিশের মধ্যে দেখছি, শিক্ষকদের মধ্যে দেখছি। ছাত্ররাজনীতির এই ভয়ংকর রূপের আছর আজ দেশের সব সেক্টরে বিদ্যমান।
দেশ রূপান্তর : পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের পাশাপাশি এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছাত্ররাজনীতি চালুর চেষ্টাকে কীভাবে দেখছেন?
ড. কামরুল হাসান মামুন : বাংলাদেশের অনেক পরিবার সন্তানদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে চান না যার অন্যতম কারণ ছাত্ররাজনীতি। যারা মোটামুটি ভালো ছাত্র অথবা সচ্ছল তাদের একটা বড় অংশ বিদেশে চলে যাচ্ছে। যারা এই ব্যয় বহন করতে পারবে না, তারা দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখনো শিশুকাল পার হয়নি। মাত্রই র্যাংকিং-এ আসা শুরু করেছে। এই অবস্থাতেই যদি ছাত্ররাজনীতি চালু করে দিই তাহলে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে কী দেখব? প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষমতা নেই রাজনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার। চোখ বন্ধ করলে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কী অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হবে। সুসংবাদ হলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন একমত হয়েছে যে তারা কোনোভাবেই তথাকথিত ছাত্ররাজনীতি ঢুকতে দেবে না। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কাছে অনুরোধ তারা যেন আমাদের এই ক্ষতিটা না করেন। তা নাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
দেশ রূপান্তর : ছাত্ররাজনীতির চলমান ধরন কি নতুন প্রজন্মকে রাজনীতিবিমুখ করে তুলছে?
ড. কামরুল হাসান মামুন : ছাত্রদের রাজনীতিতে রিক্রুট তো কম হচ্ছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনীতিতে হাতেখড়িটা ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের ইচ্ছেয় হয় না। এখন রাজনীতিতে রিক্রুট একটি ট্র্যাপ। ইচ্ছে করে আবাসিক সিটের ক্রাইসিস তৈরি করে, একে পুঁজি করে রাজনীতির ছত্রছায়ায় গণরুমে ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়। বিনিময়ে ছাত্রদের মিছিল মিটিং-এ যেতে বাধ্য করা হয়। এইভাবে কেউ কেউ দলবদ্ধ হয়ে চলার ক্ষমতার একটা স্বাদ পায়। সেই ক্ষমতা দিয়ে অনেক অনৈতিক কাজেও হাতেখড়ি হয়। এদের মধ্য থেকে কেউ কেউ নেতা হয়। এখনকার ছাত্রনেতারা দারুণভাবে ভোগবাদী।
দেশ রূপান্তর : ২৯ বছর পর সম্প্রতি ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। তখন অন্য বড় বিশ^বিদ্যলয়গুলোতেও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি উঠেছিল। কিন্তু আবারও সব বন্ধ হয়ে গেল। ছাত্র সংসদ কেন কার্যকর করা যাচ্ছে না?
ড. কামরুল হাসান মামুন : ছোট করে বললে এর উত্তর হলো এক ডাকসু নির্বাচন দিয়েই সরকারের শিক্ষা হয়ে গেছে। সবগুলোতে যদি সরকারি দল হেরে যায় সেটা সরকার কোনো অবস্থাতেই হজম করতে প্রস্তুত না, কারণ এর ফলাফল সরকারি দলকে অনেক মূল্য দিয়ে চুকাতে হতে পারে। এক ডাকসুর ভিপিকেই সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই এই রাস্তা আপাতত বন্ধ।
দেশ রূপান্তর : সাম্প্রতিককালে দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল ‘নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন’ এবং ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’। এই দুটি আন্দোলন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
ড. কামরুল হাসান মামুন : স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্সের পার্কোলেশন তত্ত্বের মাধ্যমে দেখানো যায় যে, মানুষের মধ্যে খ- খ- বিভাজিত ক্ষোভ পুঞ্জীভূত অবস্থায় বিচ্ছিন্ন ক্লাস্টার হিসেবে থাকে। যতক্ষণ ক্লাস্টারগুলো বিচ্ছিন্ন থাকে সরকারের জন্য উদ্বেগের কারণ নেই। কিন্তু সরকার যদি এর বিরুদ্ধে নানা বাহিনী ও মেকানিজম ব্যবহার করে তাহলে ক্লাস্টারের সংখ্যা বাড়তেই থাকে এবং একটা ক্রিটিক্যাল অবস্থায় পৌঁছায় যাকে বলে পাউডার-কেগ ইফেক্ট। যেখানে সামান্য একটু স্পার্ক কোথাও হলে মুহূর্তের মধ্যে ছোট ছোট ক্লাস্টারগুলো একত্রিত হয়ে হঠাৎ ক্ষোভের বিশাল একটি ক্লাস্টারে পরিণত হতে পারে। ‘নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন’ এবং ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ একটি বড় আন্দোলনেরই প্রিকার্সর। যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
দেশের উত্তরের জনপদ পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় আমার জন্ম, বড় হওয়া। ছেলেবেলায় আমাদের গাঁয়ে কোনো বারোয়ারি দুর্গাপূজা হতো না। গোটা এলাকাজুড়ে কেবল থানা সদরে অবস্থিত গোবিন্দ-জিওয়ের মন্দিরে হতো দুর্গাপূজা। সত্যি কথা বলতে কি, দুর্গাপূজাটা গাঁয়ের অধিকাংশ মানুষের কাছেই কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না।
তখন আশ্বিন কিংবা কার্তিক মাসে দুর্গাপূজা হতো। কৃষিনির্ভর ওই এলাকায় বেশিরভাগই ছিল বর্গাচাষি। তাদের বৈশাখ মাসের মধ্যেই ধান-চাল ফুরিয়ে যেত। তখন তারা দিনমজুরি করে, বড় কৃষকের কাছে ঋণ নিয়ে কোনো রকমে দিন চালাত। আষাঢ়ের মাঝামাঝি থেকে ভাদ্রের মাঝামাঝি অবধি চাষের জমিতে কাজ জুটত মজুরদের। দিনান্তে আধপেটা হলেও খাবার জুটত। ভাদ্রের মাঝামাঝি থেকে কর্মহীন হয়ে পড়ত বারো আনা মানুষ। তারপর আসত সেই ঘোর আশ্বিন ও কার্তিক। মানুষের ঘরে একদানাও ধান-চাল নেই। মাঠেঘাটে কাজও নেই তিলমাত্র। গোটা ছেলেবেলা জুড়েই দেখেছি, ওই দুটো মাস আমাদের এলাকায় নেমে আসত পুরোপুরি দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া। যাকে ‘মঙ্গা’ বলা হতো। এলাকার বারো আনা মানুষ বলা যায় তখন অর্ধাহারেই দিন কাটাত। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে দেখেছি, কোনোমতে কিছু টাকা সংগ্রহ করে পরিবারের কর্তাটি দিনান্তে এক সের (তখনো কেজি বা কিলোগ্রাম চালু হয়নি) আটা নিয়ে বাড়ি ফিরল। সেই আটা এক হাঁড়ি জলে ফুটিয়ে একটু লবণ দিয়ে বাড়িসুদ্ধ মানুষ এক বাটি করে পেটে পুরে খিদে মেটাল। মনে পড়ে, ওই দিনগুলোতে রোজ দিনই গ্রামের কোনো না কোনো প্রান্ত থেকে কান্নার রোল উঠত। কখনো ঘোষ পাড়ায়, কখনো কুড়–লিয়ায়, কখনো নয়নকার বা অন্য কোনো পাড়ায় শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কখনো একনাগাড়ে পাঁচদিন অনাহারে থেকে ওপারে পাড়ি জমাতেন। বাস্তবিক, আমাদের ছেলেবেলায় ফি-বছরই ওই দু-আড়াই মাস ভয়াল হয়ে দেখা দিত গোটা এলাকায়।
ঠিক তেমনই পরিস্থিতিতে ফি-বছর আশ্বিন মাসের শেষে বেজে উঠত পূজার ঢাক। উপোসি অর্ধচেতন মানুষগুলো সেই ঢাকের আওয়াজে নিভু নিভু চোখ দুটিকে অতি কষ্টে খুলত। পরমুহূর্তে আবার বুজে আসত চোখ দুটি। বলাই বাহুল্য, ওই পূজায় যোগ দেওয়ার মতো অবস্থায় থাকত না গাঁয়ের বারো আনা মানুষ। তাদের তখন অষ্টপ্রহর চলছে একপেট খিদের সঙ্গে নখে-দাঁতে লড়াই। ঘোষপাড়ার দয়ালপ্রসাদ শাস্ত্র পুরাণের গল্প-টল্প অল্পবিস্তর জানত। একান্তে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলত, এমন ঘোর দুর্দিনে পূজা? উৎসব? এটা তো আসল দুর্গাপূজাই লয়। রামচন্দর রাবণ-রাজাকে হারাবার তরে, লঙ্কার বালুচরে অকালবোধন করেছিল। তা, রামচন্দর ছিল রাজার ব্যাটা, তার পক্ষে বছরের সব মাসই পৌষ মাস। একালেও, তার সমকক্ষ যারা, রাজা, জমিদার তারাই কেবল এমন অসময়ে মেতে উঠতে পারে উৎসবে। এটা হইল রাজা-রাজড়াদের দু¹াপূজা। তবে যারা কিছুটা সম্পন্ন তাদের কাছে দুর্গাপূজা ছিল বিরাট আনন্দের উপলক্ষ। দেখেছি, মহালয়ার পর থেকেই ছকবাঁধা গরুর গাড়িতে চড়ে রোজদিন আসছে সুবর্ণ-বর্ণা, সালঙ্কারা নারীর দল, সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়ির বউ-ঝি, আত্মীয়-কুটুমের দল। মেঠোপথে গরুর গাড়ির ঢকচানিতে তাদের সোনার অঙ্গে স্বর্ণালংকারগুলো সুরেলা হয়ে বাজত অবিরাম। অন্তঃপুরচারিণী যুবতীদের কলহাস্য, নিজেদের মধ্যে আড্ডা খুনসুটি করতে করতে মাঝে মাঝেই সুরেলা হাসিতে ভেঙে পড়তেন তারা। এসব দৃশ্য দেখে এলাকার কিশোর-যুবারা স্বপ্ন-মদির চোখে ভাবালুপ হয়ে যেত। অনেকে দেবদাসের মতো দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেন।
ছেলেবেলায় পূজার ক’দিন আমাদের জীবনে ভারী মিষ্টি সুবাস বয়ে আনত। ফি-বছরই পূজার আগে সাধ্যমতো নতুন জামা-কাপড়ের ব্যবস্থা হতো। বাবা আমাদের সামনে সদ্য কেনা জামা-কাপড়গুলো বের করে ধরে দিতেন। আমরা যে যার জামা-কাপড়গুলোকে নিজে নিজের গায়ের সঙ্গে লটকে দিয়ে মাপটা দেখে নিতাম। তারপর, যে যার বিছানায় ওগুলোকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। ষষ্ঠী থেকেই শুরু হয়ে যেত আমাদের পূজা-উন্মাদনা। কিছুক্ষণ পর পরই আমরা ঢুঁ-মারতাম মন্দিরে। প্রতিমা এত আশ্চর্য সুন্দর হয়। পূজার তিনদিন সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত অব্দি চলতে ধূপ-ধুনা-প্রদীপসহ আরতি! সেটাও ছিল একটা বড় আকর্ষণ। তখনকার পূজার মূল আকর্ষণ ছিল প্রতিমা, কিছুটা প্যান্ডেল, আলো ও আরতি। সেই সময় ছেলেদের আর মেয়েদের লাইনের মধ্যে যে বাঁশের বেড়াটা থাকত সেটার ‘বাঁশত্ব’ ছিল নির্ভেজাল। সেই বেড়া কেউ কখনো অতিক্রম করত না। বড়জোর প্রতিমার মুখ আর ভিড়ে আবছা দেখা কারও মুখের আদল নিয়ে অনেকে মনে মনে কবি হয়ে যেত। অথবা স্বপ্নে সেই মুখ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করত! কালের বিবর্তনে দেশের চালচিত্র বদলেছে। উত্তরবঙ্গসহ সারা দেশের মানুষেরই আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও অবস্থানও বদলেছে। একসময় যারা বর্গাচাষি বা দিনমুজর ছিল এখন তারা ব্যবসাসহ নানা ধরনের পেশায় যুক্ত হয়েছে। এলাকায় কাজের সুযোগ বেড়েছে। উপার্জনও বেড়েছে। গরিব মানুষ সেখানে এখনো আছে। তবে পরিমাণে কমেছে। মানুষ এখন আর দিনের পর দিন অনাহার বা অর্ধাহারে দিন কাটায় না। এখন সেখানে দুর্গাপূজার সংখ্যা ও সমারোহও অনেক বেড়েছে।
কিন্তু একটি ট্র্যাজিক ঘটনার কারণে এবার সেখানে দুর্গাপূজার চিরচেনা দৃশ্যটা বদলে গেছে। পঞ্চগড়ে এবার দুর্গাপূজার সমারোহ নেই। আনন্দ নেই। বরং বাজছে বিষাদের সুর। পূজা শুরুর আগেই ভারী হয়ে উঠেছে পঞ্চগড়ের বাতাস। সেখানের করতোয়া নদীর পাড়ে শুধুই হাহাকার। গত ২৫ সেপ্টেম্বর দুর্গাপূজার সূচনা অনুষ্ঠান মহালয়ার দিনে নৌকাডুবির ঘটনায় এখনো পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে ৬৯ জনের দেহ। এদের মধ্যে ১৮ জন পুরুষ, ৩০ জন নারী এবং ২১ জন শিশু। ওই ঘটনায় এখনো নিখোঁজ আছেন কয়েকজন। বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নে করতোয়া নদীর অন্য পাড়ে বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারও ধর্মসভার আয়োজন করা হয়। ওই ধর্মসভায় যোগ দিতে নৌকাতে নদী পার হচ্ছিলেন আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা। ওই নৌকায় ৫০ থেকে ৬০ জন উঠতে পারে। বিপুল যাত্রীর তুলনায় নৌকার সংখ্যা কম থাকায় ওই নৌকায় দেড় শতাধিক যাত্রী ছিলেন। অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে নদীর মাঝে গিয়ে নৌকাটি ডুবে যায়।
এমনিতেই গত কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে দুর্গাপূজার জৌলুশ ও সমারোহ নেই। করোনা মহামারীর কারণে সীমিত পরিসরে পূজা আয়োজন করতে হয়েছে দুই বছর। একই সঙ্গে নানাধরনের রটনা রটিয়ে বিভিন্ন মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর, ফেইসবুকে ধর্ম অবমাননার গুজব রটিয়ে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব সৃষ্টি ইত্যাদি কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্গাপূজা নিয়ে সমারোহ দিন দিন কমছে। আর এ বছর নৌ-দুর্ঘটনার ট্র্যাজেডি দুর্গাপূজার আনন্দকে মøান করে দিয়েছে। পঞ্চগড় মণ্ডপগুলোতে ঢাকের বাড়ি, শাঁখের আওয়াজ নেই, নেই উলুধ্বনি। আছে কেবল শোকস্তব্ধ স্বজনের গুমরে ওঠা আর ফোঁপানো কান্নার শব্দ। কেউ কেউ এখনো ছুটে বেড়াচ্ছেন নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে। ঝলমলে মণ্ডপগুলোতে ফিকে হয়ে গেছে উৎসবের রং। শোকার্ত মানুষের হৃদয়ে যে বিষাদ, তা ঢেকে দিয়েছে পূজার আনন্দ। পঞ্চগড়ের মানুষ একযোগে এত মানুষের মৃত্যু কখনো দেখেনি। এত বড় নৌ-দুর্ঘটনা বাংলাদেশে আর হয়নি। এই নৌকাডুবির ঘটনা কেন ঘটল, কেন ঘাট-ইজারাদার ও মন্দিরসংশ্লিষ্টরা আরও নৌকার ব্যবস্থা করলেন না, ঘাটে উপস্থিত পুলিশ ও দমকল বাহিনীর সদস্য ও নৌকার মাঝি কেন এত বেশি পরিমাণ যাত্রী নৌকায় উঠতে দিলেন, এসব প্রশ্ন আলোচিত হচ্ছে। ফি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষ মহালয়া ও দুর্গাপূজার সময় ওই মন্দিরে ভিড় জমান, বিষয়টি প্রশাসন জানার পরও কেন বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করল না, কেন যাত্রীরা জেনেশুনে ঝুঁকি নিয়ে গাদাগাদি করে ওই নৌকায় উঠল, সামান্য স্রোতের এই ‘মরা-নদী’তে ডুবে যাওয়া যাত্রীদের উদ্ধারে কেন এত দীর্ঘ সময় লাগল, কেন যাত্রীদের জীবিত উদ্ধার করা গেল না, এসব প্রশ্নও আলোচিত হচ্ছে। আলোচিত হচ্ছে এখানে দীর্ঘদিনেও একটি সেতু না হওয়ার বিষয়টিও। সবগুলো প্রশ্নেরই হয়তো উত্তর খুঁজে বের করা হবে, কিন্তু যারা গেছেন তারা আর কখনো ফিরে আসবেন না! এই ক্ষতিও আর পূরণ হবে না!
এই নৌকাডুবিতে যাদের মৃত্যু হয়েছে, সেইসব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কারোর জানা নেই। মৃত্যু অমোঘ অনিবার্য হলেও এই মৃত্যুকে মেনে নেওয়া কঠিন। উৎসবের সমারোহ কিছুটা কমিয়ে দেশের সবগুলো মণ্ডপের ব্যয় সংকোচন করে সেই টাকা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে যদি সাহায্য করা যায়, তাহলে সেটা হতে পারে নৌদুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর প্রতি শ্রেষ্ঠ কর্তব্য পালন।
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট
বুধবার বগুড়া-৪ আসনের উপনির্বাচনে মাত্র ৮৩৪ ভোটে হেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম। এর প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, স্যার ডাকতে হবে এ জন্য কিছু শিক্ষিত মানুষ আমাকে হারিয়ে দিয়েছে।
হিরো আলম বলেন, এমপি হলে আমাকে স্যার বলতে হবে। এ জন্য কিছু শিক্ষিত মানুষ আমাকে আগে থেকেই মানতে পারছিলো না। আমাকে স্যার বলতে কষ্ট হবে এমন লোকেরাই ফলাফল পাল্টে আমাকে পরাজিত করেছেন। তারা আমাকে ইভিএম কারসাজিতে হারিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া আমি এমপি হলে নাকি বাংলাদেশের সম্মানহানী হবে। এমন ভাবনা থেকেও আমাকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। মশাল মার্কার অস্তিত্ব ছিল না। আমি কাহালু-নন্দীগ্রাম আসন থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছি। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের জোগসাজশে গণনায় আমাকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি এ ফলাফল মানি না।
হিরো আলম বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় বগুড়া সদরের এরুলিয়া নিজ বাড়িতে গণমাধ্যমকর্মীদের এসব বলেন।
তিনি আরো বলেন, সারাদিন মাঠে ভোটারের উপস্থিতি তেমন ছিল না। হঠাৎ এত ভোট কোথা থেকে এল বুঝতে পারছি না। মশাল মার্কার অস্তিত্ব ছিল না। তাদের নির্বাচনী প্রচার ছিল না। মানুষের তাদের আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে। তারপর কীভাবে আমার চেয়ে বেশি ভোট পেল বিষয়টি পরিস্কার নয়।বগুড়া সদর আসন সম্পর্কে তিনি বলেন, সেখানে অনেক কেন্দ্রে তার এজেন্টকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তার কর্মীদের মারধর করা হয়েছে। ফলে সকালেই ওই আসনের ভরসা ছেড়ে দিই।
ফলাফল নিয়ে নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে এখন কোনো কথা বলব না। পরে জানান হবে।
তিনি ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেন, যারা আমাকে নির্বাচনে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমি ভোটে হারলেও সারাজীবন মানুষের পাশে ছিলাম, শেষ পর্যন্ত থাকব।
শ্রম পরিদর্শক পদে যোগ দেওয়ার ৩৪ বছর পর পদোন্নতি পেলেন মাহমুদুল হক। স্বপ্ন দেখতেন পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে একসময় প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে যাবেন। সেই স্বপ্ন আট বছরেই লুটিয়ে পড়ল জ্যেষ্ঠতার তালিকায়।
১৯৮৮ সালে যোগ দেওয়ায় ’৯৫ সালেই পদোন্নতি পাওয়ার কথা ছিল মাহমুদুল হকের। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অদূরদর্শিতা সে স্বপ্ন শুরুতেই বাধা পেল। এন্ট্রি পোস্টে যোগ দেওয়ার পর তার মতো অন্য কর্মচারীরা যখন পদোন্নতির স্বপ্নে বিভোর, তখন তাতে গা-ই করলেন না সেই সময়ের প্রতিষ্ঠানপ্রধান।
মাহমুদুল অপেক্ষায় রইলেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য। সেই পরিবর্তন আসতে আসতে চাকরিতে কেটে গেল আঠারো বছর। আঠারোতে মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হয়। তিনিও ভাবলেন আঠারোতে তিনি না হয় ‘জব ম্যাচিউরিটি’তে পৌঁছালেন। চাকরির আঠারো বছরে পদোন্নতি পেলেও মন্দ হয় না।
কিন্তু অবাক ব্যাপার, কর্তৃপক্ষ পদোন্নতি দিল, তবে মাহমুদুলকে ছাড়া। পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনে কোথাও তার নাম নেই। হতাশায় মুষড়ে পড়লেন তিনি। জুনিয়র কর্মকর্তারদের নাম আছে, অথচ তার নাম নেই। প্রতিষ্ঠানের নীতি-নির্ধারকদের দরজায় দরজায় ঘুরলেন ন্যায়বিচারের আশায়। কিন্তু তারা পাত্তাই দিলেন না বিষয়টি।
তারা আমলে না নিলেও মাহমুদুলের স্বপ্ন তো সেখানেই থেমে যাওয়ার নয়। সেই স্বপ্ন পুঁজি করে তিনি গেলেন আদালতে। সেই ভিন্ন জগৎটাও কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তার পক্ষে রায় দিল। মাহমুদুল আনন্দে আত্মহারা হলেন। কিন্তু সেই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। সরকার আপিল করল প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলার ফল উল্টে গেল। হতাশায় ভেঙে না পড়ে তিনি গেলেন উচ্চ আদালতে। আপিল বিভাগে সিভিল আপিল মামলা করলে প্রশাসনিক আপিল আদালতের রায় বাতিল হয়। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল থাকে।
জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করার মতো মাহমুদুল হকও যেন সরকারের সঙ্গে লড়াই করতে নামলেন। আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন করল সরকারপক্ষ। একপর্যায়ে সরকার বুঝতে পারল কোনোভাবেই তারা এ মামলায় জিততে পারবে না। সরকারপক্ষে রিভিউ পিটিশন প্রত্যাহার করা হলো। আদালত সরকারের পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনকে আইনের কর্তৃত্ববহির্ভূত বলে ঘোষণা করল। জুনিয়র কর্মকর্তাকে যেদিন থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে এবং যতবার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, একইভাবে মাহমুদুল হককে পদোন্নতি দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। বকেয়া বেতন-ভাতাসহ সব পাওনা কড়ায়-গ-ায় পরিশোধের নির্দেশনা আসে।
আদালতের এই নির্দেশনা দেওয়া হয় ২০১৮ সালে। এরপর আদেশ বাস্তবায়ন করতে সরকারের লেগে যায় প্রায় চার বছর। ২০২২ সালের ১১ মে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ৩৪ বছর পর পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মাহমুদুল হক। আবারও তাকে ঠকিয়েছে সরকার। জুনিয়র কর্মকর্তা যুগ্ম মহাপরিদর্শক হলেও তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয় তার দুই ধাপ নিচের সহকারী মহাপরিদর্শক পদে। উপমহাপরিদর্শক ও যুগ্ম মহাপরিদর্শক আরও ওপরের পদ। আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
কখনোই প্রজ্ঞাপন মাহমুদুল হকের জন্য ভালো বার্তা বয়ে আনেনি। পুরো চাকরিজীবন আদালতের বারান্দায় ঘুরে তিনি পৌঁছেছেন অবসরের প্রান্তসীমায়। আর তিন মাস পরে তিনি অবসরে যাবেন। যৌবন ও মধ্য বয়সের দিনগুলোতে আদালতে ঘুরে বেড়ানোর শক্তি ও সাহস থাকলেও মাহমুদুল হক এখন সেই সাহস দেখাতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করছেন। পারবেন তো শেষ সময়ে এসে সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে?
মাহমুদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, তিনি আদালতের কাছেই জানতে চাইবেন, আদালতের বিচার না মানার শাস্তি কী।
পুরো ঘটনা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা শুনিয়ে জানতে চাইলেন, কতজনের পক্ষে মাহমুদুল হকের মতো লড়াকু মনোভাব দেখানো সম্ভব?
সীমাহীন আনন্দ নিয়ে মানুষ সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়। এরপরই তার মধ্যে যে স্বপ্নটি দানা বাঁধে তা হচ্ছে পদোন্নতি। কার কীভাবে পদোন্নতি হবে তা আইনকানুন, নিয়ম-নীতি দিয়ে পোক্ত করা। পুরো বিষয়টি কাচের মতো স্বচ্ছ। এরপরও পদোন্নতি হয় না। দিন, মাস, বছর পার হয়ে যায়, কাক্সিক্ষত পদোন্নতির দেখা মেলে না।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ক্যাডারে নিয়মিত পদোন্নতি হয়। বাকি ক্যাডারে হতাশা। তার চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি নন-ক্যাডারে। ক্যাডার কর্মকর্তারা নিজের পদোন্নতির ষোলো আনা বুঝে নিয়ে ঠেকিয়ে দেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি। সংখ্যায় বেশি হওয়ায় নন-ক্যাডাররা একজন আরেকজনকে নানা ইস্যুতে আটকাতে গিয়ে পুরো প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেন। সরকারের মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কর্মচারী। সেই হিসেবে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনবলের পদোন্নতি হয় না। পে-কমিশন হলেই কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য করুণা উথলে ওঠে। এমনকি ব্লকপোস্টে যারা আছেন, তাদের জন্যও পদোন্নতির বিকল্প সুবিধা বাতলে দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কর্মচারীদের পদোন্নতি উপেক্ষিতই থাকে।
যখন সময়মতো পদোন্নতি হয় না, তখন নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে থাকে। এসব সমস্যা সংশ্লিষ্ট দপ্তর-অধিদপ্তরের চৌহদ্দি পেরিয়ে আমজনতাকেও প্রভাবিত করে। নন-ক্যাডার কর্মকর্তা আর সঙ্গে কর্মচারীরা যখন বুঝতে পারেন পদোন্নতির আশা তাদের নেই, তখন তারা দুহাতে টাকা কামানোর ধান্দায় মেতে ওঠেন। এতে করে ঘুষের সংস্কৃতি সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। অকার্যকর পথে হাঁটে রাষ্ট্র। সাধারণ মানুষ টাকা ছাড়া তাদের কাছ থেকে কোনো সেবা পায় না, ব্যবসায়ীরা নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে ব্যবসায় আসেন না, ব্যবসাবান্ধব পরিস্থিতি না থাকায় মুখ ফিরিয়ে নেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। প্রধানমন্ত্রীর বারবার আহ্বানেও বিনিয়োগকারীরা সাড়া দেন না। সাধারণ মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে সেবা দেওয়ার বাণীতেও উদ্বুদ্ধ হন না সংশ্লিষ্টরা।
এই পরিস্থিতিতে অনিয়ম আটকে রাখার সব কৌশলই ব্যর্থ হচ্ছে। যথাযথ তদারকি না থাকায় বিভাগীয় ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে। ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫০টি অডিট আপত্তি ঝুলে থাকায় অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোও আগ্রহ হারিয়ে নিজেরাই জড়িয়ে পড়ছে অনিয়মে। দন্তহীন বাঘে পরিণত হওয়ার তথ্য সাংবাদিকদের জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান নিজেই।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদোন্নতির বড় একটা অংশ আটকে রাখে মন্ত্রণালয়গুলো। এই আটকে রাখার কারণ হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের স্বার্থ। বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তরে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিলে নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতিপ্রাপ্তদের ওপরের পদে বসাতে হবে। এতে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের এককালীন লাভ; অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে একবার পদোন্নতি দেওয়া যাবে। কিন্তু পদোন্নতি না দিয়ে সংশ্লিষ্টদের চলতি দায়িত্ব দিলে বছরজুড়ে টাকা আয় করতে পারেন নীতিনির্ধারকরা। দপ্তর, অধিদপ্তরে বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। চলতি দায়িত্বপ্রাপ্তদের আয় অনুসারে নীতিনির্ধারকদের মাসোহারা দিতে হয়। নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া হলে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের নিয়মিত আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে আইন বা বিধি-বিধানের ফাঁকফোকর গলিয়ে নন-ক্যাডার এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি আটকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়।
সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদের সভাপতি নিজামুল ইসলাম ভূঁইয়া মিলন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সচিবালয় এবং সারা দেশের সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতির মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। নন-ক্যাডারের কিছু বিষয় ছাড়া সচিবালয়ের কর্মচারীরা সময়মতো পদোন্নতি পায়। কিন্তু সচিবালয়ের বাইরে পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। সচিবালয়ে মাত্র ১০ হাজার কর্মচারী আছেন। সচিবালয়ের বাইরে আছেন ১০ লাখের বেশি। এসব কর্মচারীর পদোন্নতি নিয়ে বহু বছর ধরে চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনো ফল পাইনি। সর্বশেষ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সমস্যা নিয়ে কাজ করার জন্য একটি কমিটি করে দিয়েছে। কমিটি কিছু সুপারিশ করেছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। এরপর এর কোনো অগ্রগতি নেই। যেখানে সরকারপ্রধান বলেন, চাকরিজীবনে সবাই যেন কমপক্ষে একটি পদোন্নতি পায়। সেখানে বহু কর্মচারী কোনো পদোন্নতি ছাড়াই অবসরে যাচ্ছেন। সরকারপ্রধানের নির্দেশনা উপেক্ষা করেন আমলারা। তাদের আগ্রহ কেনা-কাটায়, বিদেশ ভ্রমণে, নতুন জনবল নিয়োগে। এসব করলে তাদের লাভ। কর্মচারী পদোন্নতি দিতে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এর নিশ্চয়ই একটা শেষ আছে। বৈষম্যের পরিণতি কী হয়, তা অনেক দাম দিয়ে বিডিআর বিদ্রোহে আমরা দেখেছি।’
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি ঝুলছে বছরের পর বছর। এই অধিদপ্তরের কয়েক শ কর্মকর্তা পাঁচ বছর আগেই পদোন্নতির যোগ্য হয়েছেন। নানা কায়দা-কানুন করে তাদের পদোন্নতি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সংশ্লিষ্টদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করে তাদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া এগিয়ে নিলেও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নতুন করে জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার নামে সময়ক্ষেপণ করছে। জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার পর এখন তাদের পারিবারিক সদস্যদের তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই সংস্থা নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদেরও তথ্য তালাশ করছে। তাদের আত্মীয়দের মধ্যে কে কোন দলের সমর্থক তার তথ্য নিচ্ছেন সংস্থার কর্মকর্তারা।
গত মাসে শেষ হওয়া জেলা প্রশাসক সম্মেলনে দায়িত্ব পালন করছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সুরম্য ভবনে দায়িত্ব পালন করলেও ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তার মনের অবস্থাটা মনোহর ছিল না। কেমন আছেন জানতে চাইলে ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তা বলেন, ‘ভালো নেই। চাকরি করছি, পদোন্নতি নেই। ২০১৫ সালের আগে পদোন্নতি না পেলেও টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড ছিল। তাও তুলে দেওয়া হয়েছে। তুলে দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল সময়মতো পদোন্নতি হবে, ব্লকপোস্টধারীদের দেওয়া হবে বিশেষ আর্থিক সুবিধা। এসবের কোনোটাই হয়নি।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে একটি প্রশাসনিক আদেশ খুবই পরিচিত। সেই প্রশাসনিক আদেশ ১৬/২০১৮ অনুযায়ী ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগ হবে। আর ৩০ ভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগের ফলে বিমানে বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় কর্মকর্তা বেশি। নীতিনির্ধারকদের নতুন জনবল নিয়োগে আগ্রহ বেশি। পুরনোদের পদোন্নতি দিয়ে ওপরের পদ পূরণের চেয়ে তারা নতুন নিয়োগে যান। ফলে কারও চাকরিজীবনে একবারও পদোন্নতি হয় না। নামমাত্র যে পদোন্নতি হয় তা অনিয়মে ভরপুর।
নন-ক্যাডার ছাড়াও ১৩তম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। প্রতিটি দপ্তরে এসব গ্রেডের পদোন্নতি আটকে আছে। অথচ এসব গ্রেডেই বেশি লোক চাকরি করছেন। সরকারের মোট জনবল প্রায় ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ২৩ শতাংশ পদের মধ্যেও নন-ক্যাডার রয়েছেন। এ ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৭৭ শতাংশ পদই ১৩তম থেকে তার পরের গ্রেডের। এতে করে সহজেই বোঝা যায় সরকারের জনবলের বড় অংশই পদোন্নতির চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। সরকারের জনবলের এই বিশাল অংশ যখন পদোন্নতি নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগেন, তখন তারা নানা অনিয়মে ঝুঁকে পড়েন।
বেশির ভাগ দপ্তর, অধিদপ্তর পরিচালনা করেন বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা তাদের প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে ক্যাডার কর্মকর্তাদের দপ্তর, অধিদপ্তরে পাঠান। প্রেষণে গিয়ে অনেক কর্মকর্তা শুধু রুটিন কাজটুকুই করতে চান। শূন্যপদে জনবল নিয়োগ বা পদোন্নতি রুটিন কাজ না হওয়ায় তা উপেক্ষিত থাকে। তা ছাড়া পদোন্নতি দিতে গিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়; বিশেষ করে মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রী বা সচিব তাদের পছন্দের লোককে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য সংস্থার প্রধানকে চাপ দেন। এই চাপ উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ না থাকায় অযোগ্য লোককে পদোন্নতি দিতে হয় সংস্থার প্রধানকে। এই জটিলতা থেকে দূরে থাকার জন্য সংশ্লিষ্টদের পদোন্নতি দেওয়া থেকেও দূরে থাকেন সংস্থার প্রধানরা।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের ১৪ গ্রেডের একজন কর্মচারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাইরের লোকের ইচ্ছাটাই জাগে না আমাদের পদোন্নতি দিতে। আমাদের দপ্তরপ্রধান মহাপরিচালক প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। অতিরিক্ত মহাপরিচালকও অনেক সময় প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রেষণে আসেন। তাদের কেন ইচ্ছা জাগবে আমাদের পদোন্নতি নিয়ে। যদি এসব পদে ফুড ক্যাডারের কর্মকর্তা থাকতেন, তাহলে তারা খাদ্য বিভাগের সমস্যা বুঝতেন। তা ছাড়া নিয়োগ বিধি সংশোধনের নামে আমরা দীর্ঘদিন একই পদে আটকে আছি।’
গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে এক আবেদনে জানান, ‘বর্তমানে সচিবালয়ে প্রায় দুই হাজারের বেশি প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা কর্মরত। এর বিপরীতে ক্যাডারবহির্ভূত সংরক্ষিত পদের সংখ্যা ২৬৭টি, যা খুবই নগণ্য। ফলে একই পদে ২০-২২ বছরের বেশি সময় কর্মরত থাকার পরও অনেকে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। পদোন্নতি না পাওয়ায় সৃষ্ট হতাশার ফলে কর্মস্পৃহা নষ্ট হচ্ছে।’
সরকার এ সমস্যা থেকে কীভাবে বের হতে পারে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এসব সমস্যা সমাধানে সরকার সব সময়ই কাজ করে। কিন্তু এ চেষ্টা জটিলতার তুলনায় কম। এ বিষয়ে আরও এফোর্ট দিতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধে এমনটা যে ঘটবে তার আলামত কিন্তু যুদ্ধের সময়েই টের পাওয়া গিয়েছিল। এই যুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ ঘটেছে। নেতৃত্ব ছিল নির্বাচনে-জেতা জাতীয়তাবাদীদের হাতে। ভারত সরকার তাদের সাহায্য করেছে। জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতার হস্তান্তর চেয়েছে, রূপান্তর চায়নি। তারা লড়ছিল হস্তান্তরের লক্ষ্যেই। জনগণ কিন্তু তত দিনে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে, তারা শুধু যে ক্ষমতার হস্তান্তর চেয়েছে তা নয়, চেয়েছে রাষ্ট্র ক্ষমতার বিচূর্ণকরণ। বস্তুত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধ এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে যে চেতনাটি অগ্রসর হচ্ছিল সেটা ছিল সমাজবিপ্লবী। এই চেতনা ঠিকই বুঝেছে যে পুরাতন রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রেখে মুক্তি আসবে না। রাষ্ট্রকে ভাঙতে হবে, যাতে করে রাষ্ট্র জনগণের শত্রু না হয়ে মিত্র হয়; শুধু মিত্রও নয়, জনগণের সেবক হয়। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের মূল আকাক্সক্ষাটা ছিল ওই রকম রাষ্ট্রের। কথা ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ওই আকাক্সক্ষাটাকে বাস্তবায়িত করবে।
কিন্তু যুদ্ধ সেদিকে এগোয়নি। নেতৃত্বে রয়ে গেছে জাতীয়তাবাদীই। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের জায়গায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ স্থাপিত হয়েছে। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। দুই জাতীয়তাবাদের ভেতর পার্থক্যটাও সুস্পষ্ট, কিন্তু দুয়ের ভেতর মিল এইখানে যে, উভয়েই পুঁজিবাদী। এই মিলটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। জাতীয়তাবাদী নেতারা ব্যক্তিমালিকানার বিরোধী ছিলেন না, যেমন ছিলেন না তারা সামাজিক মালিকানার পক্ষে। বস্তুত পুরাতন ধ্যানধারণাই নতুন রাষ্ট্রে কার্যকর হয়েছে। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যাভিমুখী যাত্রার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু সেদিকে যাবে কী, রাষ্ট্র অচিরেই তার পুরাতন পথে ফিরে গেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তিমালিকানায় চলে গেছে। রাষ্ট্রীয়করণ ছিল ব্যক্তিমালিকানা স্থাপনের মধ্যবর্তী ধাপ। আদমজী জুট মিলস পাকিস্তান আমলে ছিল, এখন নেই। এটা কেবল ঘটনা নয়, একটা প্রতীকও বটে।
যুদ্ধের শুরুতেই কিন্তু বোঝা গিয়েছিল যে বিপ্লবী উপাদান থাকা সত্ত্বেও এ যুদ্ধ বিপ্লবী হবে না। ধরা যাক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ঘটনা। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে প্রান্তিকভাবে যুক্ত তিনজন দুঃসাহসী তরুণ স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ নিয়ে ওই গোপন বেতার কেন্দ্রটি স্থাপন করেন, কালুরঘাট ট্রান্সমিটার কেন্দ্রটিকে ব্যবহার করে। নাম দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। ২৬ মার্চ ওই নামেই বেতার কেন্দ্রটি চালু হয়। কিন্তু তার বিপ্লবী নামটি ধরে রাখা যায়নি। বিপ্লবী নাম ধরে রাখবে কী, ৩০ তারিখ দুপুরে কেন্দ্রটিই সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংসের কাজটি করে পাকিস্তানি হানাদাররা। তারা বিমান আক্রমণ চালায়। ওটিই ছিল বাংলাদেশে তাদের যুদ্ধবিমানের প্রথম আক্রমণ। বেতার কেন্দ্রটি ধ্বংস না করে তাদের স্বস্তি ছিল না, কারণ সেখান থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধের সংবাদ সম্প্রচারিত হয়েছিল। তারা লড়ছে, বিশ্ববাসী জেনেছিল, সবচেয়ে বেশি করে জেনেছিল বাঙালিরা, দেশে যেমন, বিদেশেও তেমনি। তারা উদ্দীপ্ত হয়েছে, ভরসা পেয়েছে, সাহস পেয়েছে রুখে দাঁড়ানোর। হানাদাররা অস্থির হয়েছে। খুঁজে খুঁজে বের করেছে বেতার কেন্দ্রের ঠিকানা, বোমাবর্ষণ করেছে মহোৎসাহে।
এরপরও কেন্দ্রটি চালু ছিল। প্রথমে গেছে সে আগরতলায়, সেখান থেকে কলকাতায়। কিন্তু ‘বিপ্লবী’ আর থাকেনি। ওই পরিচয় বিলুপ্ত করা হয়েছিল কিন্তু মেজর জিয়ার নির্দেশেই। পরে আওয়ামী লীগের প্রবাসী সরকার যে বিপ্লবীকে ফেরত এনেছে তা মোটেই নয়, বেতার কেন্দ্রটি বিপ্লবহীন ‘স্বাধীন’ অবস্থায় রয়ে গেছে। যুদ্ধটা তো ছিল পুরোপুরি জনযুদ্ধ, কিন্তু ওই শব্দটি একবার মাত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তারপর নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ‘জনযুদ্ধ’ মাওবাদের গন্ধ আছে বলে। বেতার অনুষ্ঠানের শেষে একটি সিগনেচার টিউন বাজানো হতো, সে গানটির শুরু ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ দিয়ে, শেষে ছিল ভুখা বেকার মানুষদের কথা, আপত্তিকর বিবেচনায় গানটি বাদ দেওয়া হয়। বেকারদের দায়িত্ব স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র কেন নিতে যাবে? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ওপর চাপ ছিল আওয়ামী লীগের খবরকে বেশি বেশি প্রচার করার, পারলে মুক্তিযুদ্ধকে একদলীয় ঘটনা হিসেবে চিত্রিত করার। কলকাতায় কেন্দ্রটি সম্পূর্ণরূপে প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। শেষের দিকে ভারত সরকারের একজন প্রতিনিধিও অনুষ্ঠানসূচির ওপর চোখ রাখতেন। স্বাধীনতার পরপর ইনি ঢাকাতেও এসেছিলেন, বাংলাদেশ বেতারের দেখভাল করার জন্য। ডিসেম্বরের ৬ তারিখে ভারত সরকার যখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় সেই ক্ষণ থেকেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তার নাম বদলে ফেলে বাংলাদেশ বেতার হয় অর্থাৎ একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়ে যায়। বিপ্লবীত্ব আগেই গিয়েছিল এবার গেল স্বাধীনতাটুকুও। যেন বাংলাদেশেরই প্রতীক। পাকিস্তানি বেতারের মতোই স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠানও কিন্তু কোরআন পাঠ ও ব্যাখ্যা দিয়েই শুরু হতো। সপ্তাহে ছয় দিন ইসলামের দৃষ্টিতে বলে একটি অনুষ্ঠান থাকত।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা; ওই ঘটনার ভেতরে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের মোড়বদলের কালে সংগ্রামের শক্তি ও সীমা দুটোই প্রতিফলিত হয়েছে। কেন্দ্রের গঠনে উদ্যোগী তিন তরুণের সঙ্গে বেগম মুশতারী শফীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। যুদ্ধের শুরুতেই তিনি তার স্বামী এবং সহোদর একমাত্র ভাইটিকে হারান; তার বড় বোনের স্বামীও শহীদ হয়েছেন। অবিশ্বাস্য কষ্টের ভেতর দিয়ে সাত সন্তানের ছয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ভাসতে ভাসতে সম্পূর্ণরূপে সর্বহারা দশায় আগরতলায় উপস্থিত হয়ে কোনো মতে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরে তার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তিনি ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ (১৯৮৯) নামে একটি বই লিখেছেন, তার অভিজ্ঞতার ভেতর ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন হবে তার লক্ষণ বিলক্ষণ ফুটে উঠেছিল। আগরতলায় গিয়ে যেসব ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছেন তাতে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ সম্পর্কে ভরসা রীতিমতো বিচলিত রয়েছে। আগরতলা পৌঁছে তিনি জানতে পেরেছেন যে চট্টগ্রামের এমএনএ এমপিএরা একটি ভবনে রয়েছেন। শুনে আশান্বিত হয়ে তিনি গেছেন তাদের খোঁজে। ভবনে গিয়ে পৌঁছান সকাল সাড়ে দশটায়। নেতাদের সন্ধান পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু দরজার সামনে কাজের ছেলেটি বলেছে দেখা করা যাবে না। কেন? কারণ ওনারা একটু বেসামাল আছেন। দরজাটা ভেজানো ছিল। মুশতারী শফী লিখেছেন, ‘আমি যেখানে বসেছি সেখান থেকে দরজার ফাঁক দিয়ে আরেকটি রুম দেখা যায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে চিৎ হয়ে উপুড় হয়ে মেঝেতেই দু-তিনজন শুয়ে আছে।’ তিনি ভেবেছিলেন ঘুমোচ্ছে। পরে জানলেন নেতারা রাতে ড্রিংক করেছেন, সেজন্য সকালে তাদের ওই করুণদশা। মুশতারী শফীর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া : ‘আমি অবাক। এখানে ড্রিংক? এরাই না জাতীয় নেতা? মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছেন?’ (পৃ. ১৩৭-৩৮)
অবাক হওয়াটা ওখানেই শেষ হয়নি। তার জন্য আরও একটি ‘বিস্ময়-মহাবিস্ময়’ অপেক্ষা করছিল। তিনি লিখেছেন, ‘এখানে এসে একটা বিষয় লক্ষ করলাম, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির রিক্রুট-করা মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা প্রবাসী সরকার করছে না। যেমন আওয়ামী লীগের যে কেউ যে-কাউকে রিক্রুট করলে তার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি খরচে ট্রেনিং এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, বামপন্থি দলের কাউকেই সে রকমটি করা হচ্ছে না। কোথাও পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কোথাও সরাসরি নাকচ করা হচ্ছে। ফলে বামপন্থিরা ভারত সরকারের দুয়ারে দুয়ারে ধাক্কা দিয়ে এবং নিজেদের পার্টির খরচে সম্পূর্ণ আলাদা ট্রানজিট ক্যাম্প এবং যুবকদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ (পৃ. ১৫৪)
তার মনে প্রশ্ন জেগেছে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম যেখানে চলছে, সেখানে বাম-ডান আবার কী, সবাই তো মুক্তিযোদ্ধা। তার মতো মানুষদের কাছে সব মুক্তিযোদ্ধাই যে এক, এটা ঠিক, কিন্তু নেতৃত্ব তো ছিল পুঁজিবাদী ঘরানার, তারা বামপন্থির গন্ধ পেলেই সতর্ক হতো। ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির মতো নরম বামদের তবু সহ্য করত, তাড়িয়ে দিত না। শক্ত বামপন্থিদের দেখা মাত্র ধাওয়া করত। শক্ত বামপন্থিদের কাউকে কাউকে তাই প্রাণ ভয়ে আগরতলার মুক্তভূমি থেকে আবার হানাদারকবলিত পাকিস্তানে পালিয়ে আসতে হয়েছে। কেউ কেউ নিহতও হয়েছে, আগরতলাতেই। মুশতারী শফীর আরেক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোনো-মতো তৈরি করা ফিল্ড হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবক সবাই কাজ করছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আহত যোদ্ধারা দিন গুনছেন কখন উঠে দাঁড়াতে পারবেন, এবং পুনরায় যুদ্ধে যাবেন। স্বেচ্ছাসেবকদের ভেতর মুশতারী শফীও ছিলেন।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভারতের কর্নাটকের রাজধানী বেঙ্গালুরুতে বান্ধবীর সাড়ে তিন বছর বয়সী মেয়েকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগে উঠেছে এক ব্যক্তির (২৬) বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে বেঙ্গালুরু পুলিশ।
বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) এ খবর জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
জানা গেছে, একটি তৈরি পোশাক কারখানার কর্মী ওই নারী বাড়িতে তার তিন বছরের মেয়েকে রেখে কাজে যেতেন। সেই সময় শিশুটিকে দেখভাল করতেন তার প্রেমিক। সোমবার (৩০ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় বান্ধবীর অনুপস্থিতিতে ওই ব্যক্তি বাড়ি এসে শিশুটিকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ।
পুলিশ বলছে, শিশুটির মায়ের সঙ্গে অভিযুক্তের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কাজ শেষে শিশুটির মা বাড়ি ফিরলে তার মেয়েকে অচেতন অবস্থায় দেখতে পান। এরপর তিনি এবং ওই ব্যক্তি মেয়েটিকে কাছের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকরা শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ সময় ওই নারী মেয়ের মৃত্যু নিয়ে প্রেমিককে প্রশ্ন করলে তিনি তাকে মারধর করেন। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুলিশকে খবর দেয়। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওই ব্যক্তি শিশুটিকে ধর্ষণ ও হত্যার কথা স্বীকার করেছে। এ ঘটনায় ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা হয়েছে।
বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের উপনির্বাচনে বেসরকারিভাবে ১১২ কেন্দ্রের ফলাফলে ৯৫১ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন বহুল আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম। একতারা প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ১৯ হাজার ৪৮৬ ভোট। এ আসনে জয় পেয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ (ইনু) সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম তানসেন। মশাল প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ২০ হাজার ৪৩৭ ভোট।
বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে বগুড়ার দুইটিসহ মোট ৬ আসনে উপনির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হয়। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির এমপিরা পদত্যাগের ঘোষণা দিলে এ আসনগুলো শূন্য হয়।
তখন, বগুড়া-৬ (সদর) এবং বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন হিরো আলম। নির্বাচন কমিশন একদফা তার প্রার্থিতা বাতিল করলেও পরে আদালতে গিয়ে প্রার্থিতা ফিরে পান তিনি।
নাগরিকত্ব বিষয়ক জটিলতার জেরে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে দেশের উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ ও পার্লামেন্টে আসন হারিয়েছেন নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী রবি লামিছানে। শুক্রবারের রায়ে আদালত জানিয়েছে, এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকত্বও নেই তার।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র বিমল পৌদেল বার্তা সংস্থা এএফপিকে এ সম্পর্কে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় অনুযায়ী, ২০২২ সালের জাতীয় নির্বাচনে নাগরিকত্ব বিষয়ক আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে রবি লামিছানের বিরুদ্ধে। এ কারণে এখন থেকে আর পার্লামেন্টের সদস্য নন তিনি।’
নেপালের এক সময়ের জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব রবি লামিছানে দেশটির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ইনডিপেনডেন্ট পার্টির শীর্ষ নেতা। ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর নেপালের পার্লামেন্ট প্রতিনিধিসভার নির্বাচনে তার দল ২০টি আসনে জয়ী হয়েছে। তারপর গত ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন জোট সরকারে নিজের দলসহ যোগ দিয়ে নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন লামিছান।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিত্ব ছিল লামিছানের; কিন্তু নেপালের সংবিধানে দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বীকৃত না হওয়ায় ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। শুক্রবারের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, নিয়ম অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর নেপালের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার কথা ছিল লামিছানের; কিন্তু তা করেননি তিনি। ফলে এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকও নন লামিছান। এদিকে, শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর লামিছানের প্রতিক্রিয়া জানতে তার মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে গিয়েছিলেন সাংবাদিকরা; কিন্তু লামিছানে তাদের বলেন, ‘যেহেতু এই মুহূর্তে আমি কোনো দেশেরই নাগরিক নই, তাই আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করা আমার পক্ষে উচিত নয়, সম্ভবও নয়।’
তার কলাম মানেই সেদিন বাংলার বাণী অফিস সরগরম। সকাল থেকেই ফোন আসত। বিভিন্ন আড্ডায়ও আলোচনা হতো সেই কলাম নিয়ে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়-আশয় এবং দেশের সমসাময়িক বিষয়গুলো আকর্ষণীয় এবং সহজ করে পাঠকের কাছে তুলে ধরতেন এই সাংবাদিক। এর বাইরে প্রকৃতি, পাহাড়, নদী ও দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে লিখতেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের লাল পাহাড়ের মানুষের জীবনের গল্পও তুলে আনতেন। প্রায় দেড় দশক নিরবচ্ছিন্নভাবে তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। লিখেছেন অসংখ্য কলাম।
যখন সাংবাদিকতা করতেন তখন তার কাজের জায়গাটিতে তিনি ছিলেন সেরা। ছাত্ররাজনীতির জন্য যেমন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, ছাত্রনেতা হিসেবেও পেয়েছেন তুমুল জনপ্রিয়। সফল হয়েছেন প্রতিমন্ত্রী এবং মন্ত্রী হিসেবে। দেশের ঐতিহ্যবাহী এবং ইতিহাসসমৃদ্ধ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও তিনি সফল। তৃতীয়বারের মতো দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি হলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। রাজনীতির বাইরে তার আরও অনেক পরিচয়ের মধ্যে সাংবাদিক পরিচয়টাও অনেক বেশি উজ্জ্বল।
ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন স্পষ্টবাদী, সাহসী ও দেশপ্রেমিক। পাকিস্তান আমলে ছাত্র ও গণআন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা এ নেতা ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং কোম্পানীগঞ্জ থানা মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) অধিনায়ক ছিলেন।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। ওই ভয়াল রাতে নিহত হন তার ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি। তিনি তখন দৈনিক বাংলার বাণীর সম্পাদক। ফলে পত্রিকাটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ১৯৮১ সালে পত্রিকাটি আবার ছাপার অনুমতি পায়। ওই সময় ওবায়দুল কাদের জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। সেই সঙ্গে লেখালেখি। দ্বিতীয়বার শেখ ফজলুল করিম সেলিমের (বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য) সম্পাদনায় বাংলার বাণী পত্রিকার ছাপা শুরু হওয়ার পর যুক্ত হন ওবায়দুল কাদের। তিনি পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য ও পরে ক্রীড়া ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের আগপর্যন্ত তিনি সাংবাদিকতা করেছেন।
টানা ১৫ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে ওবায়দুল কাদের অসংখ্য কলাম লিখেছেন বাংলার বাণীতে। ‘ও কাদের’ নামে তিনি কলাম লিখতেন। প্রতিদিন সকালে অফিসে আসতেন। সম্পাদকীয় বিভাগ ও অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে মিটিং করতেন। সম্পাদকীয় বিভাগের বাইরে সেই সময় তিনি বাংলার বাণীর আন্তর্জাতিক পাতাটি নিজের দায়িত্বে বের করতেন। আন্তর্জাতিক বিষয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সমসাময়িক বিষয়ে তিনি খুব বেশি সচেতন ও আগ্রহী ছিলেন।
ওবায়দুল কাদেরের সেই সময়কার সহকর্মীরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সহকর্মী হিসেবে তিনি চমৎকার ছিলেন। তাছাড়া সাংবাদিক হিসেবেও খুব পেশাদার ছিলেন। তিনি যদি রাজনীতি না করে সাংবাদিক থাকতেন, তার অনেক লেখা এবং অসংখ্য বই আমরা পেতাম। যদিও তিনি এখন রাজনীতিতে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছেন। কিন্তু আমরা যারা তাকে পেয়েছি, তারা তার লেখা মিস করছি। তার লেখার জন্য অপেক্ষা করতাম। যেহেতু বাংলার বাণী ছিল বিরোধী ঘরানার পত্রিকা, তাই সাধারণ মানুষেরও আগ্রহ থাকত।
ওবায়দুল কাদেরের লেখালেখি ও তার কলাম সম্পর্কে জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত কবীর চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘যখনি সংকট, যখনই এক অপয়া অন্ধকার ওঁৎ পেতে আসে, যখনই সমাজ ধূসরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, যখনই মিথ্যা ও ইতিহাস বিকৃতির গোলকধাঁধায় নয়া প্রজন্মকে দিগভ্রান্ত করার অপচেষ্টা, যখনই রাজনীতির গৌরব কলুষতায় ঢেকে দেওয়ার অপপ্রয়াস তখনই ওবায়দুল কাদেরের এই জীবন ঘনিষ্ঠ, সত্য ও সুন্দরের আরাধনাময় সাহসী রচনা সমাজকে আলোর ইতিহাস শোনাতে পারে।’
ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকতা জীবনে সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয়, রাজনৈতিক কলাম লিখেছেন অসংখ্য। কবি নির্মলেন্দু গুণ তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘বাংলার বাণী পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে আমার সহকর্মী ছিলেন, কলাম লেখক হিসেবেও জনপ্রিয় হয়েছিলেন।... আমি তার অলংকৃত কাব্যিক ভাষায় বক্তৃতার একজন ভক্তশ্রোতা।’
প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের মূল্যায়ন ছিল, ‘ওবায়দুল কাদের শুধু রাজনীতিক নন, তিনি সাংবাদিক, তিনি বাগ্মী, তিনি লেখক। বক্তৃতায় বাংলা শব্দ উচ্চারণ, ছন্দের ব্যবহারে চারণকবি তিনি। নিবন্ধ লেখক হিসেবে যুক্তি ও বিশ্লেষণে তীব্র লক্ষ্যভেদী তিনি।’
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন তার সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন বাংলার বাণীতে। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১৯৮৯ সালে বাংলার বাণীতে যখন জয়েন করি তখন সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাদের ভাইকে পাই। আমরা বার্তাকক্ষে বসতাম আর তিনি তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটরদের রুমে বসতেন। ওনাদের আলাদা রুম ছিল। তিনি রুম থেকে বের হয়ে সবসময় আমাদের খোঁজখবর নিতেন। মাঝেমধ্যে আমাদের এখানে এসে গল্প করতেন। তিনি সহকর্মী হিসেবে খুবই আন্তরিক ও সহকর্মীবান্ধব ছিলেন।’
সেই সময়ে বাংলার বাণীতে ওবায়দুল কাদেরের আরেক সহকর্মী ও পাক্ষিক ক্রীড়াজগৎ পত্রিকার সম্পাদক দুলাল মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি তাকে ১৯৮৫ সালে পেয়েছি। আমি তখন সহ-সম্পাদক হিসেবে জয়েন করেছি বাংলার বাণীতে। ওবায়দুল কাদের তখন সহকারী সম্পাদক ছিলেন। তিনি কলাম লিখতেন। তার কলাম পাঠকের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল। তার লেখার মধ্যে সাহিত্য ছিল। লেখা খুব আকর্ষণীয় ছিল। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন জায়গায় যেতেন, সেসব বিষয় নিয়েও লিখতেন। তার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা ছিল চট্টগ্রাম, পাহাড়-সমুদ্র খুব পছন্দ করতেন এবং এসব নিয়েও তিনি লেখালেখি করতেন। তিনি খুব আবেগী লোক ছিলেন এবং লেখার মধ্যে সেটা ফুটে উঠত। তার লেখা পাঠক পড়তে বাধ্য হতেন।’
তিনি বলেন, ‘রাজনীতির মানুষ হলেও অফিসে ঢুকলে একজন সংবাদকর্মী হিসেবেই থাকতেন ওবায়দুল কাদের। রাজনীতির বিষয়টা বাইরে রাখতেন। বরাবরই তিনি শৌখিন টাইপের লোক ছিলেন। ভালো কাগজ-কলম ব্যবহার করতেন লেখার সময়। লেখার সময় আলাদা একটা মেজাজে থাকতেন। তখন খুব জরুরি না হলে কোনো বিষয় অ্যালাউ করতেন না। লেখা শেষ করলে বেশ ফুরফুরে থাকতেন। তখন আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন, গল্প করতেন। পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে তার মনোভাব আমরা দেখতে পেয়েছি।’
সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাংবাদিক সুভাষ চন্দ বাদল বাংলার বাণী পত্রিকায় ওবায়দুল কাদেরের সহকর্মী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘কাদের ভাইকে ছাত্ররাজনীতি থেকেই চিনতাম। ১৯৭৫ সালের পর যখন তিনি কারাগারে যান তখন আমিও কারাগারে। তাকে কারাগারে দেখেছি বই নিয়ে ডুবে থাকতে। বাংলার বাণীতে এসে তাকে নতুন করে পেয়েছি। সেই সময় আজিজ মিসির ও তার কলাম ছিল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। তিনি সাংবাদিকবান্ধব। বাংলার বাণী অফিসেও সহকর্মীদের সবসময় সহযোগিতা করতেন। আমি রিপোর্টার হিসেবে যদি কখনো কোথাও আটকে যেতাম তিনি সহযোগিতা করতেন। কাদের ভাই সাংবাদিক হিসেবে ছিলেন মেধাবী ও জ্ঞানী। তার সাহসের ঘাটতি ছিল না। তার কলামেও এর প্রভাব দেখেছি।’
ওবায়দুল কাদের ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানার বড় রাজাপুর গ্রামে জন্ম নেন। বাবা মোশারফ হোসেন সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা শুরু করেন। মা ফজিলাতুন্নেছা। ওবায়দুল কাদের বসুরহাট সরকারি এএইচসি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি ও নোয়াখালী কলেজ থেকে মেধা তালিকায় স্থান পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি কলেজজীবন থেকে ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন।
১৯৭৫-এর পর একনাগাড়ে দীর্ঘ আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং পরপর দুবার সভাপতি ছিলেন।
তার সেই সময়ের সহকর্মীরা বলেন, সাংবাদিক ওবায়দুল কাদের তথা কাদের ভাই মানেই অন্যরকম। তিনি ছিলেন খুব সংবেদনশীল। সবাইকে মেনে নেওয়ার একটা ক্ষমতা ছিল। তিনি যে এত বড় একজন রাজনীতিক ও মুক্তিযোদ্ধা, এত বড় ছাত্রনেতা, তা কখনই সাংবাদিকদের কাছে মনে হতো না। মনে হতো, কাদের ভাই যেন সাংবাদিকতার মধ্যেই ডুবে আছেন। কোনো রিপোর্টার বা সাব-এডিটর অনুবাদ করতে সমস্যায় পড়েছেÑ কাদের ভাইয়ের কাছে গেলেই সমাধান। নিজের রুমে, ডেস্কে বসিয়ে বুঝিয়ে দিতেন। আর তার টেবিলে ছিল সবসময়ই গাদা গাদা বই।
বাংলার বাণীর সেই সময়ের একাধিক সাংবাদিক ওবায়দুল কাদের সম্পর্কে দেশ রূপান্তরকে বলেন, কাদের ভাই ছিলেন সাংবাদিকতার প্রতি পুরো নিষ্ঠাবান। তার কাছে অনেক কিছু শিখেছি। তিনি দীর্ঘক্ষণ কোথাও বসে থাকতেন না। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই তিনি রুম থেকে বেরিয়ে অন্য সহকর্মীদের টেবিলে টেবিলে আড্ডা দিতেন। সেখানে হয়তো আমরা চায়ের অর্ডার দিয়েছি। চা আসতে না আসতেই তিনি উঠে যেতেন। তারপর আবার তাকে চায়ের কাপ নিয়ে খুঁজতে হতো কাদের ভাই কই...।
আজ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়ে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের প্রতিবাদে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের উদ্যোগে শান্তি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্ পরশ। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট তারানা হালিম। আর অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন যুবলীগ সম্পাদক মো. মাইনুল হোসেন খান নিখিল।
সভাপতির বক্তব্যে যুবলীগ চেয়ারম্যান বলেন, বিএনপির মুখে গণতন্ত্রের কথা, মানবাধিকারের কথা মানায় না। আপনাদের হিংসাত্মক রাজনীতি আর সন্ত্রাসের কারণে নতুন প্রজন্ম রাজনীতি করতে চায় না। যারা একুশে আগস্ট ঘটিয়েছে, নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে, কৃষকের বুকে গুলি চালিয়েছে, জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটিয়েছে, তাদের সকল অপকর্মের মেডেল আছে। আমি বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপির প্রধান শত্রু এ দেশের সাধারণ জনগণ। যারা একাত্তরে হাতিয়ার তুলে নিয়েছিল দেশকে স্বাধীন করার জন্য, একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আপনারা বার বার তাদেরকেই আক্রমণ করেন। আওয়ামী লীগ আপনাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে আসে বলেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপনাদের বিরোধ ঘটে। সব সময় এ দেশের সাধারণ মানুষকে আপনাদের ষড়যন্ত্রের শিকার বানান, হত্যার শিকার বানান এবং আপনাদের সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের শিকার বানান।
পরশ আরও বলেন, এ বছরটা নির্বাচনের বছর। আমাদের রাজপথে থাকতে হবে। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। শুধু নেতাকর্মী দ্বারা আবর্ত থাকলে চলবে না, আমাদের চলে যেতে হবে সাধারণ মানুষের কাছে। গত ১৪ বছরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অর্জনের কথা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। যদি সাধারণ মানুষ উন্নয়নের সুফল না পায় তাহলে সেই উন্নয়নের কোনো মূল্য থাকে না। যখন আমাদের সকল উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যেতে পারব তখনই জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে।
তিনি যুবলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, যুবলীগের ভাই ও বোনেরা- আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকবেন, আপনারা ধৈর্যশীল থাকবেন। ওদের কৌশল আমাদের সন্ত্রাসী হিসাবে উপস্থাপন করা। ওরা পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করতে চাইবে। আপনারা ওদের ফাঁদে পা দেবেন না। কিন্তু রাজপথ আমরা ছেড়ে দেব না। ভুলে যাবেন না, ওরা কিন্তু দিনকে রাত এবং রাতকে দিন বানাতে পারদর্শী। মিথ্যার ওপরই দলটার সৃষ্টি। ওরা জাতির পিতার নাম মুছে ফেলেছিল, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছিল। সুতরাং মিথ্যা চর্চার ক্ষেত্রে এই দলকে দুর্বল ভাবার কোনো সুযোগ নেই।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, যখন জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, যখন বাংলাদেশের জিডিপি সিংগাপুর, মালয়েশিয়ার উপরে, যখন বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ঠিক সেই মুহূর্তে বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশকে পেছনের দিকে নেওয়ার জন্য নানামুখী ষড়যন্ত্র করছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক তারা সবাই ভবিষ্যদ্বণী করছে, বাংলাদেশ যেভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যদি এভাবে এগিয়ে যায় তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৭তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে। আর এটা সম্ভব শুধুমাত্র রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে।
তিনি যুবলীগের উদ্দেশে বলেন, বিএনপি-জামায়াত আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারা নানা মিথ্যা প্রচারণা ও গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রতিটি জেলায়, উপজেলায়, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড এবং ইউনিটে জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। বলতে হবে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়নি, বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আপনারা শেখ হাসিনার পাশে থাকুন, নৌকার পাশে থাকুন, নৌকায় ভোট দিন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট তারানা হালিম বলেন, যারা স্যাংশন নিয়ে কথা বলেন তাদের দলের প্রধান খালেদা জিয়া তৎকালীন আমেরিকার পরারাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে স্যাংশন চেয়েছেন। যাতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ভাবে ভেঙে পড়ে, দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়, খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়, বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায়, মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। এটাই হলো বিএনপির আসল চেহারা। তারা কখনোই এ দেশের মানুষের ভালো চায় না। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতা আছে কিভাবে অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে তোলা যায়। সামনের যে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কথা বলা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ তা কাটিয়ে উঠতে পারবে। আগামী নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিলে বঙ্গবন্ধুকন্যা তার দূরদর্শী নেতৃত্বে একটি উন্নত-সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবে।
সঞ্চালকের বক্তব্যে যুবলীগ সম্পাদক নিখিল বলেন, রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঢাকার রাজপথে আপনারা পোস্টার হয়েছেন। নুর হোসেন, ফাত্তাহ বাবুল হয়েছেন। তারপরেও দেশের স্বার্থে সংগঠনের স্বার্থে, বঙ্গবন্ধুকন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার প্রশ্নে যুবলীগ আপস করেনি, যুবলীগ আপস করতে জানে না। তিনি যুবলীগের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, যেমনি করে বিগত দিনে কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাজপথ আগলে রেখে প্রিয় নেত্রীর নির্দেশিত পথে মানুষের কল্যাণে, মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য আপনারা সব সময় কাজ করেছেন। আগামী নির্বাচনেও সেই সাহসিকতা আর বীরত্বের সাথে রাজপথে থাকবেন। বিএনপি-জামায়াতের সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আবারও রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে ঘরে ফিরবেন।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. হাবিবুর রহমান পবন, মো. নবী নেওয়াজ প্রমুখ।
বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) ও বগুড়া-৬ (সদর) আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আশরাফুল হোসেন হিরো আলম বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) দুপুর পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘সদরের কেন্দ্র সব দখল হয়্যা গ্যাছে। ডিসি-এসপিক কয়্যাও কোনো কাম হচ্চে না। সদরের আশা সব শ্যাষ। কাহালু-নন্দীগামের অনেক কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে দেকছি। ভোট খুব সুষ্ঠু হচ্চে। মাঠের অবস্থা ভালো। কাহালু-নন্দীগ্রামে নিশ্চিত এমপি হচ্চি।’
এর আগে, সকালে সদর উপজেলার এরুলিয়া উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে যান তিনি। ভোট দেওয়ার পর হিরো আলম বলেন, ‘বগুড়া-৬ আসনে আগে থেকেই গোলযোগের আশঙ্কা করেছিলাম, সেটাই সত্যি হয়েছে। নির্বাচনি এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তবে বগুড়া-৪ আসনে ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে। এভাবে সুষ্ঠু ভোট হলে এই আসনে আমিই বিজয়ী হবো।’
এদিকে বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে কয়েকটি কেন্দ্রে নৌকা প্রার্থীর এজেন্ট বাদে অন্য এজেন্টদের ভোটকক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আজ সকালে হিরো আলমসহ তিনজন প্রার্থী এ অভিযোগ করেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাদের এজেন্টদের বের করে দিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করা হয়।