
লেখাটি আমার নামে ছাপা হলেও এটি আসলে আমার একার লেখা নয়। ১ অক্টোবর রাত ১২টার দিকে দেশ রূপান্তর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোস্তফা মামুন ফোন করে জানতে চাইলেন, আপনি তো কিছুদিন তোয়াব ভাইয়ের অধীনে কাজ করেছেন। তার সম্পর্কে এক কথায় আপনার মূল্যায়ন কী? আমি বললাম, সার্বক্ষণিক সাংবাদিক। ইদানীং আমরা যে টুয়েন্টি ফোর আওয়ার সেভেন ডেইজ (২৪/৭) বলি, তোয়াব খান ছিলেন তাই। মোস্তফা মামুন শুধু সাংবাদিক নন, দারুণ কথাসাহিত্যিকও বটে। কথাসাহিত্যিকরা অল্প কথায় অনেক কথা বলতে পারেন। আমরা পারি না। তাই তিনি তোয়াব ভাই সম্পর্কে এক কথায় মূল্যায়ন জানতে চাইলেও আমাদের আলাপ লম্বা হলো। অনেক স্মৃতি উসকে দিলেন। লম্বা আলাপ শেষে মামুন বললেন, এতক্ষণ যা আলাপ হলো, সেটাই আমাদের জন্য লিখে ফেলুন। সম্পাদকের নির্দেশ অমান্য করার সাধ্য আমার মতো ছা-পোষা সাংবাদিকের নেই। তাই এই লেখা এবং এটি আসলে আমাদের আলাপচারিতার লিখিত রূপ।
তোয়াব খান ৮৭ বছর বেঁচেছিলেন। এবং তিনি যাপন করে গেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন। আসলে একটি জীবন নয়। তিনি এক জীবনে যাপন করেছেন অনেক জীবন। তার প্রায় সাত দশকের ক্যারিয়ার আলো ঝলমলে। হীরার মতোই মূল্যবান। হীরা যেমন যত কাটবেন তত দ্যুতি ছড়ায়। তোয়াব খানের জীবন তেমন হীরার মতো দ্যুতিময় এবং নানামাত্রিক। সাংবাদিকতার আলাপে পরে আসছি। শেষ দিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর প্রেসসচিব ছিলেন। শেষ সময়টা বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখেছেন, তার আত্মজীবনীর নোট নিয়েছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়তে বঙ্গবন্ধুর লড়াইটা দেখেছেন। এই অভিজ্ঞতা অমূল্য। ছিলেন স্বৈরাচার এরশাদ এবং এরশাদের পতনের পর প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদেরও প্রেসসচিব। এত কাছ থেকে রাজনীতির অত উথালপাতাল দেখার অভিজ্ঞতার দামও তো কম নয়। সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ছিলেন, ছিলেন প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকও। এমন যেকোনো একটি অর্জন একজন মানুষের জন্য যথেষ্ট হতে পারে। তোয়াব খান ছিলেন একের ভেতরে অনেক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তার লেখা ও উপস্থাপনায় নিয়মিত প্রচারিত অনুষ্ঠান ‘পিন্ডির প্রলাপ’ও দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
এতক্ষণ তো গেল সাংবাদিকতার বাইরের আলাপ। কিন্তু তোয়াব খান আসলে ছিলেন একজন সাংবাদিক, যেটা মামুনকে বলেছিলাম সার্বক্ষণিক সাংবাদিক। একসময় বাংলাদেশের সংবাদপত্র ছিল বার্তা সম্পাদকনির্ভর। সম্পাদক থাকলেও বার্তা সম্পাদকই আসলে পত্রিকার প্রতিদিনকার নেতৃত্ব দিতেন। তোয়াব খানের মৃত্যুর পর আমার বন্ধু জাহিদ রেজা নূর ফেইসবুকে লিখেছিলেন, ‘স্বাধিকার আন্দোলনের সময় যে তুখোড় চার বার্তা সম্পাদক সংবাদপত্র মহল শাসন করতেন, তার শেষজন আজ চলে গেলেন। সিরাজুদ্দীন হোসেন, কেজি মুস্তাফা, এ বি এম মূসা এবং তোয়াব খান এই চার ডাকসাইটে সাংবাদিক তখন সাংবাদিকতা জগতের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেছেন। ‘সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে জাহিদ একদম ঠিক কথাটাই লিখেছেন। এই চার দাপুটে বার্তা সম্পাদকের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন গোলাম সারওয়ার এবং ফওজুল করিম তারা ভাই। তাদের অনেকেই পরে সম্পাদক হয়েছেন। কিন্তু তারা আসলে বার্তা সম্পাদকের কাজটা ছাড়েননি। ইত্তেফাকের ডাকসাইটে বার্তা সম্পাদক গোলাম সারওয়ার পরে দুটি সফল পত্রিকার নেতৃত্ব দিয়েছেন যুগান্তর ও সমকাল। কিন্তু সম্পাদক হয়েও তিনি বার্তা সম্পাদকের আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেননি। সারওয়ার ভাইকে রাতের টকশোতে পাওয়াই যেত না। বলতেন, তোমাদের টকশোর সময় তো আমার পত্রিকার মেকআপ করতে হয়। সারওয়ার ভাইকে তবু মাঝেমধ্যে টকশোতে পাওয়া যেত, তোয়াব ভাইকে একদমই না। একবার অনেক আয়োজন করে তোয়াব ভাইকে এটিএন নিউজের স্টুডিওতে আনতে পেরেছিলাম। ওই যে বারবার বলছি, তোয়াব খান ছিলেন সার্বক্ষণিক সাংবাদিক। কাছ থেকে না দেখলে বিষয়টা বোঝানো মুশকিল। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি অল্প কিছুদিন তার অধীনে কাজ করার। তাকে দেখে বুঝেছি, শিখেছি; সাংবাদিকতার প্যাশন কী জিনিস। আরেক লেখায় লিখেছি, তোয়াব খানের সংসার ছিল, সন্তান ছিল; কিন্তু আসলে তিনি জীবনভর সংসার করেছেন সাংবাদিকতার সঙ্গে। স্বাধীনতার পর দৈনিক পাকিস্তান থেকে দৈনিক বাংলায় বদলে যাওয়া সরকারি পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন তিনি। কিন্তু সরকারি পত্রিকাকেও যে জনপ্রিয়তা এবং উৎকর্ষের চূড়ায় তোলা যায় সেই ক্যারিশমা দেখিয়েছেন তোয়াব খান। সে সময়ও দৈনিক বাংলা ছিল আধুনিক সাংবাদিকতার প্রকাশ।
তবে তোয়াব খানের সবচেয়ে বড় ক্যারিশমা নিশ্চয়ই দৈনিক জনকণ্ঠ। ৯৩ সাল থেকে গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত জনকণ্ঠের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে চারটি বাঁকÑ ইত্তেফাক, আজকের কাগজ, জনকণ্ঠ এবং প্রথম আলো। এরশাদ পতনের পর আজকের কাগজ বাংলাদেশের সংবাদপত্রে আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে আসে। সেই আধুনিকতায় নতুন মাত্রা আনে জনকণ্ঠ। একটা সময় জাতীয় দৈনিক শুধু ঢাকায় ছাপা হতো। দুর্গম অঞ্চলে জাতীয় দৈনিক পৌঁছা তো বিকেলে বা কোনো কোনো এলাকায় পরদিন। জনকণ্ঠ এসে সেই ধারণাটাই বদলে দিল। একসঙ্গে চার জায়গা থেকে ছাপা হতো জনকণ্ঠ। ফলে দেশের সব এলাকার মানুষ সকালেই চায়ের টেবিলে জাতীয় দৈনিকের স্বাদ পেয়ে যান। শুধু আগে পৌঁছানো নয়, অন্যরকম গেটআপ-মেকআপ, বড় ছবি, পেছনের পাতার ফিচার, অনুসন্ধানী রিপোর্ট, খেলাধুলার জন্য পুরো পাতা, নানামাত্রিক ফিচার পাতাÑ সব মিলিয়ে জনকণ্ঠ ছিল দারুণ এক প্যাকেজ। অল্প সময়েই জনকণ্ঠ পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষস্থান দখল করে। একসময় দৈনিক পত্রিকার পেস্টিং হতো গভীর রাতে। সাংবাদিকদের বাড়ি ফিরতে ফিরতে মাঝরাত পেরিয়ে যেত। জনকণ্ঠ চার জায়গায় থেকে ছাপা শুরুর পর সেই সময়টা কমে আসে। জনকণ্ঠে যারা কাজ করেছেন, তারা তোয়াব খানের দৈনিক মিটিংয়ের সঙ্গে অভ্যস্ত প্রতিদিন সকাল ১০টায় রিপোর্টারদের মিটিংয়ে হাজির থাকতে হতো। সেই মিটিংয়ে সেদিনের পত্রিকার চুলচেরা বিশ্লেষণের পাশাপাশি পরদিনের পত্রিকার পরিকল্পনা হতো। তখন তোয়াব ভাইয়ের দৈনিক মিটিংয়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন রিপোর্টাররা। এখন নিশ্চয়ই সবাই স্বীকার করবেন, তোয়াব ভাইয়ের প্রতিটি মিটিং আসলে ছিল সাংবাদিকতার একেকটি মূল্যবান ক্লাস।
তোয়াব ভাই অফিসে আসতেন সবার আগে, যেতেন সবার শেষে। এ সময় সবার শিফট বদলে যেত। প্রিয়তম কন্যার মৃত্যুর পরদিন তার অফিসে আসা সংবাদপত্রের ইতিহাসে মিথ হয়ে আছে। শিরোনাম, মেকআপÑ সবকিছুর খুঁটিনাটি দেখতেন তিনি। আমি তখন খেলাধুলা পাতার পেস্টিং করতাম। পেস্টিং রুমে এসে তিনি সব পাতাই খুঁটিয়ে দেখতেন। ভয়ে থাকতাম, কখন কোনটা পাল্টে দেন। কারণ জনকণ্ঠের পেস্টিংয়ের প্রক্রিয়াটা একটু জটিল ছিল। যেহেতু চার জায়গা থেকে ছাপা হতো, তাই কোনো চেঞ্জ করতে হলে, সেটা চার জায়গায় জানাতে হতো। ভয়ে থাকতাম, বিরক্ত হতাম; কিন্তু তোয়াব ভাইয়ের একটু নজর বদলে দিত পাতার চেহারা।
এখন বাংলাদেশে ভূরি ভূরি সম্পাদক, বার্তা সম্পাদকের তো গোনাগুনতি নেই। তবে আমরা কাজের চেয়ে অকাজ বেশি করি। নানান ক্লাব, পার্টি, সেমিনার, এনজিও, টকশোতে কেটে যায় আমাদের অনেকটা সময়। কিন্তু তোয়াব ভাই ছিলেন ব্যতিক্রম। আমি চেনার পর থেকে তাকে অফিসের বাইরের কোনো আয়োজনে তেমন শামিল হতে দেখিনি। তার সার্বক্ষণিক ধ্যান-জ্ঞান ছিল পত্রিকা। একটা দারুণ নির্লিপ্ত ছিল তার, সাংবাদিক হওয়ার জন্য যেটা অতি জরুরি। বঙ্গবন্ধুর প্রেসসচিব থাকলেও তিনি আওয়ামী লীগার ছিলেন না, এরশাদের প্রেসসচিব থাকলেও তিনি স্বৈরাচারের দোসর ছিলেন না, বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের প্রেস সচিব থাকলেও তিনি সুশীল ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন পুরোদস্তুর সাংবাদিক। মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে, অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে, দেশপ্রেমের প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন।
তোয়াব খান জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। নতুন দৈনিক বাংলার প্রথম সম্পাদক তোয়াব খান নতুন আঙ্গিকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলারও সম্পাদক ছিলেন। তবে শারীরিক কারণে এই দৈনিক বাংলা তার ক্যারিশমার ছোঁয়াটা পায়নি। তোয়াব খান পূর্ণ জীবন পেয়েছেন। তবুও তার অভাব কখনো পূরণ হবে না। একটাই আফসোস এক জীবনে অনেক জীবনযাপন করা, বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ মানুষটি খুব বেশি লিখে যাননি। তাই তোয়াব খানের প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে ইতি ঘটল বাংলাদেশের সাংবাদিকতার এক স্বর্ণালি অধ্যায়েরও।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
শিশু এবং প্রতিবন্ধীদের যেকোনো উদ্যোগ এবং পরিকল্পনায় আমি যুক্ত হতাম। আমার কর্মপরিধি নাট্য-সংক্রান্ত কিন্তু এর বাইরেও কখনো যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতাম। শিশু-কিশোরদের নিয়ে আমি খুব একটা নাটক করতে পারিনি কিন্তু কেউ উদ্যোগ নিলে তার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতাম। কিছুদিন হলো জীবনের আরেকটি দিগন্ত আমার কাছে ধরা দেয়। আমি আবিষ্কার করি আমি নিজে প্রবীণ এবং আমার মতো লাখো কোটি প্রবীণেরও নানা সমস্যা আছে। তাই সেই সমস্যার দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করি।
এ সময় একটি প্রতিষ্ঠান আমাকে প্রবীণদের একটা কর্মস্থলে নিয়ে যায়। ঢাকা থেকে বেশ দূরে পিরোজপুরে। এও আমি আবিষ্কার করি প্রবীণদের একটা বড় সমস্যা নিঃসঙ্গতা। আবার এও তো স্বাভাবিক বাবা-মা সাধারণত কারও জীবিত থাকে না। কারও কারও ভাই-বোনদের সংসার গড়ে উঠেছে। ছেলেমেয়েরা তো আলাদাই হয়ে গেছে। কারও ছেলেমেয়ে প্রবাসে। ক্ষীণ যোগাযোগ শুধু হোয়াটসঅ্যাপ বা মেসেঞ্জারে। এই নিঃসঙ্গতা তো স্বাভাবিক। আমরা দেখেছি পাশ্চাত্য দেশগুলোতে বহু আগে থেকেই মানে প্রবীণ হওয়ার আগেই তারা নিঃসঙ্গ হয়ে গেছে। একের পর এক ছেলে বা মেয়ে বন্ধু অথবা একাধিক বিয়ের ফলে তাদের কোনো সামাজিক বন্ধন হচ্ছে না। একটা প্রবাদ আছে বাল্যকালে রাশিয়া, যৌবনে জাপান এবং বার্ধক্যে ভারতবর্ষ একটি আদর্শ জীবনযাপনের জায়গা। আমরা সেই প্রাচীন ভারতবর্ষ বা বর্তমানে এ উপমহাদেশের মানুষ। আমাদের পারিবারিক বন্ধন আছে। ছোটবেলা থেকেই অনেকগুলো ভাই-বোন একসঙ্গে বড় হয়েছি। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারেও এক চৌকিতে দ্-ুতিন ভাই ঘুমিয়েছি। এক ডিম দুভাগ করে খেয়েছি। পরবর্তীকালে বিবাহিত জীবনেও নিজের বাড়ি ও শ^শুরবাড়ি মিলে একটা যৌথ জীবনযাপন করেছি। একসময় এই যৌথ জীবন ভেঙে যায়। বড় পরিবারে থেকে আমরা একটি ছোট পরিবারে প্রবেশ করি। এক ছেলে এক মেয়ের পরিবার।
পরিবার ছোট হয়ে আসে, জীবনযাপনও আমাদের অজান্তেই সংকুচিত হয়ে যায়। ছেলেমেয়েরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পিতৃগৃহ ত্যাগ করে। মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের আবাস হয় অন্য দেশে হাজার হাজার মাইল দূরে। ওই যে পিরোজপুরের কথা বললাম, সেখানে গিয়ে প্রবীণদের এক আড্ডায় গিয়ে পড়লাম। সে আড্ডায় দেখলাম একটা আনন্দময় পরিবেশ। কেউ দাবা খেলছে, কেউবা লুডু, কেউ পত্রিকা পড়ছে আবার কেউ চায়ের কাপে ঝড় তুলছে। চায়ের কাপে ঝড় তোলা একটা আড্ডায় গিয়ে বসলাম, সেখানে পরিচয় হলো এক সাবেক সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে। প্রায় দশ বছর আগে তিনি অবসর নিয়েছিলেন। ছেলে আমেরিকায় এবং মেয়ে স্কটল্যান্ডে। সে দেশের শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে ছেলেমেয়ে এক মত হলো এবং বিপত্নীক বাবাকে পাঠিয়ে দিল বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রমের দিনগুলো দুঃসহ মনে হলো। তিনি আর থাকলেন না। চাকরি করা অবস্থাতেই গ্রামে একটা ছোট্ট বাড়ি করেছিলেন সন্ধ্যা নদীর পাড়ে। চারদিকে গাছপালা, সকালে পাখির কাকলিতে ঘুম ভাঙে কিন্তু রাতের অন্ধকারটা খুব তাড়াতাড়ি নেমে আসে। সারা জীবন সরকারি চাকরিতে থেকে ঢাকা শহরে জীবন কাটিয়ে রাত ৮টায় ঘুমিয়ে পড়া একেবারেই তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তার সান্ধ্যকালীন আশ্রয় মিলে যায় এই প্রবীণদের আড্ডায়। বেশ রাত পর্যন্ত আড্ডা চলে তারপর সন্ধ্যা নদী পেরিয়ে তার ছোট্ট ঘরটিতে ফিরে আসা। তার চেয়ে বয়সে কিছু ছোট একজন প্রবীণ তার দেখাশোনা করে। ওষুধ ঠিকমতো খাওয়ানো, প্রেশার দেখা এবং ডায়াবেটিস চেক করা কাজগুলোও তিনি জানেন। সস্ত্রীক, থাকেন পাশের বাড়িতে। এই ভদ্রলোকের উদ্যোগেই গ্রামটা জীবন্ত হয়ে ওঠে। সকালবেলায় স্কুলে যাওয়ার পথে একদল বালক-বালিকা এই দাদুর বাড়িটা ঘুরে যায়। বিভিন্ন ধরনের ফলগাছ লাগিয়েছেন। সে গাছের ফলগুলো শিশু-কিশোররা নিজ দায়িত্বে পেড়ে খেয়ে চলে যায়। মেয়েরা বকুলতলায় বসে বকুল ফুলের মালা গাঁথে। কখনো কখনো তিনি এবং আরও কিছু প্রবীণ মিলে ফুটবল খেলে কিশোর-যুবকদের সঙ্গে। মাঝেমধ্যে দু-একজনের পা ভেঙে যায়। এই ধরনের ভাঙা-ভাঙি বা অসুস্থতায় প্রবীণদের কাজ আরও বেড়ে যায়। যারা প্রবীণা তাদেরও কিছু আড্ডার জায়গা গড়ে উঠেছে। একেবারে বিত্তহীন প্রবীণরা ছোটখাটো দোকান দিয়ে জীবিকার ব্যবস্থা করেছেন এবং সব প্রবীণরা সেখানে নগদ টাকা দিয়ে চা, বিস্কুট খান। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাদের একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট দেখার, তরুণ বনাম প্রবীণদের এই খেলা জমে উঠেছিল চমৎকার। তরুণরা শেষ পর্যন্ত প্রবীণদের একটা গোল করার সুযোগ করে দেয়। স্বেচ্ছায় হেরে যায় তরুণরা। রাতের বেলায় এরা বাউল গানের আসর বসায়। সে আসরে প্রবীণ গায়ক কিন্তু দর্শকরা সবাই প্রবীণ নয়। গভীর রাত পর্যন্ত চলে বাউল গানের আসর। তারপর তরুণরা প্রবীণদের বাড়ি পৌঁছে দেয়। প্রবীণদের একটা বড় সমস্যা চোখ। এখানে চোখের একটা নিয়মিত আইক্যাম্প করা হয়। সেই আইক্যাম্পে প্রবীণরা স্বেচ্ছায় গিয়ে চোখ দেখান। চোখের ছানি অপারেশন করান এবং আরও জটিল কিছু হলে বড় হাসপাতালে যান। চোখ নিয়ে তারা অনিশ্চয়তায় থাকেন না।
এ তো গেল একটি এলাকায় বৃদ্ধাশ্রম না করে সামাজিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রবীণদের জীবন কাটানো। পাশ্চাত্যকে নকল না করে আমাদের সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে যদি প্রবীণদের জীবন কাটানো সহজ হয় সেটাই হবে একটা আদর্শ ব্যবস্থা। প্রবীণরা জাতীয় পর্যায়ে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে আসছেন কিন্তু তরুণরা সংখ্যায় বেশি। নানা ধরনের সমস্যা বিশেষ করে বেকারত্ব তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। এই দুর্বিষহ জীবনে একমাত্র সহায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে ডিজিটাল পৃথিবী। এই ডিজিটাল পৃথিবী এক অর্থে ভয়ংকর। তরুণদের এক ফ্যান্টাসির জগতে বসবাস করার সুযোগ করে দিয়েছে। সহজলভ্য সব অ্যাপসের মাধ্যমে জগৎটা আনন্দময় হয়ে উঠছে। গড়ে উঠছে ব্যাঙের ছাতার মতো ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। যার একমাত্র বিষয়বস্তু হচ্ছে ভায়োলেন্সের সঙ্গে সেক্সের একটা রসায়ন। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে এ সমস্যার শুরু। আমাদের মতো একটি ভদ্রসমাজে যেখানে নারী-পুরুষের সম্পর্কটা সহজ নয় সেখানে বিকৃতির পথটি সাধারণত খোলা থাকে। সেই বিকৃতির পথ ধরে আসে মাদক, ধর্ষণ এবং সহজে অর্থ উপার্জনের পথ। সামান্য কারণে মানুষকে হত্যা করার প্রবণতা বাড়তেই থাকে।
দুঃখজনক হলেও আমাদের রাষ্ট্র এসব বিষয়কে মানবিকভাবে বিশ্লেষণ করতে অক্ষম। দেশে সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে কোনো রাজনীতি নেই। রাজনীতির একটি স্বচ্ছ জায়গা ছিল ছাত্ররাজনীতি। সেই ছাত্ররাজনীতি এখন এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে ছাত্রীরাও সেই কলুষিত পথে পা দিয়েছে। আমাদের ছাত্রজীবন ছিল টাকাপয়সার দিক থেকে ভীষণ টানাপড়নের জায়গা। অনেক দিন সকালের নাশতা জুটত না। কি কষ্টে, কায়ক্লেশে ছাত্রজীবন পার করতে হয়েছে! আর এখন ছাত্রছাত্রীরাও টাকা চিনে ফেলেছে আবার সে টাকা কোনো কষ্ট করে উপার্জন নয়। ঠিকাদারের কাছ থেকে কমিশন, হলের সিট বরাদ্দ করার নামে উৎকোচ গ্রহণ এবং শিক্ষকদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে প্রশ্নপত্র ফাঁস, নকল সার্টিফিকেট প্রদান। এমন অবিশ্বাস্য বিষয়ও দেখা যায় একজনের নামে অন্যজনের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া। সারা দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রবল নৈরাজ্য তারুণ্যকে প্রবল ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে।
আগে যে প্রবীণটির কথা বলেছি তার সঙ্গে কথা বলে দেখেছি তিনি একটি এনসাইক্লোপিডিয়া, পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞান তার কাছে আছে। আবার তারই সমবয়সী একজন মানুষ সন্ধ্যা নদীর পাড়ে তার একটি দোকান আছে, আকাশে মেঘ করলেই তিনি নদীর পানি নিজের হাতের তালুতে নেন এবং বলে দিতে পারেন কখন ঝড় আসবে অথবা বৃষ্টি হবে। এই প্রবীণদের কথা এখন আর তরুণরা শোনে না। আপন মনে সেলফোনে ফেইসবুকিং, টিকটক অথবা গেম খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রবীণদের এই বিপুল অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর কথা একবারও এই তরুণরা ভাবে না। আজকাল কোনো প্রবীণ অতিথি এলে বাড়ির শিশু, কিশোর, তরুণরা কম্পিউটারে ব্যস্ত থাকে। অতিথি আগমনে তারা বিন্দুমাত্র আনন্দিত হয় না। এই যে তরুণদের সঙ্গে প্রবীণদের একটা দূরতিক্রম্য দেয়াল গড়ে উঠছে তা কিন্তু ভয়াবহ একটা পরিণতি বয়ে আনছে। প্রবীণরা শুধু উপদেশ দিয়ে যাবেন অথবা আপ্তবাক্য উচ্চারণ করবেন এটাও ঠিক নয়। তাদের জীবনেও রসবোধ আছে, জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতার গল্প আছে। সে গল্পগুলো শুনেও তরুণরা নিজেদের জন্য পথ তৈরি করতে পারে। যেমন আত্মজীবনী পড়ে আমরা অনেক কিছু শিখে থাকি। প্রবীণের আত্মজীবনী যদি শুধু প্রবীণই পড়ে তাহলে কোনো লাভ হবে না। গত শনিবার আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হয়ে গেল। জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো এই দিনটি উদযাপন করে তাদের দায়িত্ব শেষ করল কিন্তু সৃজনশীলতার সঙ্গে প্রবীণদের মধ্যে যারা বিজ্ঞ, প্রগতিশীল তাদের নিয়ে বসে সমাজকে একটা পথে নিয়ে আসার ভাবনাটাও খুবই জরুরি।
লেখক: নাট্যকার, অভিনেতা ও কলামিস্ট
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রসারের যুগে প্রচলিত সংবাদমাধ্যমগুলো এক অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী, নামকরা সংবাদমাধ্যমগুলোও এখন টিকে থাকার জন্য নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে। টিকে থাকতে না পেরে, ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার উদাহরণও কম নেই। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের মানুষের আস্থাভাজন বিবিসি রেডিওর বাংলা সম্প্রচার বন্ধ তারই সবশেষ সংযোজন। সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো আস্থার সংকট। মানুষ এখন সংবাদমাধ্যমে যা পড়ে বা দেখে, তার সবটাই বিশ্বাস করে না। সংবাদমাধ্যমের মান উন্নয়নে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা, এমআরডি আইয়ের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় আস্থার এ সংকটের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে। দেশের সব কটি বিভাগে পরিচালিত ওই জরিপে দেখা গেছে, পুরোপুরি আস্থা রাখতে না পারলেও, যেহেতু গুজব এবং ভুয়া তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই বেশি ছড়ায়, ফলে এখনো সঠিক তথ্য জানা ও যাচাইয়ের জন্য প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের ওপরেই ভরসা করে মানুষ। প্রয়োজনে একাধিক পত্রপত্রিকা বা টেলিভিশনের প্রতিবেদনের মধ্যে তুলনা করে তারা একটি ঘটনার সঠিক চিত্র বোঝার চেষ্টা করে।
সংবাদমাধ্যমের এই ভোক্তা অংশটির সঙ্গে কিন্তু সংবাদকর্মীদের তেমন কোনো যোগাযোগই নেই। ফলে পাঠক-দর্শকের সঙ্গে নিউজ রুমের একটি বিশাল দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সংবাদমাধ্যমগুলোর এই পরিস্থিতির পেছনে মালিকানার স্বার্থরক্ষা ও রাজনীতিকরণ, নিয়ন্ত্রণমূলক আইন, বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরতা, সর্বোপরি গণতান্ত্রিক চর্চার অভাবই দায়ী। এই পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যমগুলো যদি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়, তাহলে সেটা কী হতে পারে সম্প্রতি তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন সংবাদকর্মী, সংবাদমাধ্যমের উন্নয়নে কাজ করছেন এমন উন্নয়নকর্মী এবং সাংবাদিকতা বিষয়ে অধ্যাপনা করেন এমন কয়েকজনের একটি দল। সুইডেনভিত্তিক ফোয়ো মিডিয়া ইনস্টিটিউট এবং নিরাসের একটি ফেলোশিপের অংশ হিসেবে, ৬ সদস্যের এই দলটি এক বছর ধরে বিশ্বের চারটি দেশের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেছে, নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সিদ্ধান্ত গ্রহীতা এবং শিক্ষাবিদদের সঙ্গেও আলোচনা করেছে। তারই ভিত্তিতে তারা বর্তমান বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের সংকট মোকাবিলায় টেকসই সাংবাদিকতার কথা বলেছে।
টেকসই সাংবাদিকতার ধারণা পশ্চিমা দেশগুলোতে এক দশক ধরেই আলোচনা হচ্ছে। ফোয়ো ইনস্টিটিউটের লার টালার্ট সম্প্রতি এই ধারণাটিকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছেন। এটি মূলত টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত, যেখানে সাংবাদিকতা টেকসই উন্নয়নে সহযোগী ভূমিকা পালন করবে, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, পরিবেশবান্ধব জীবনাচারণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখে, সাংবাদিকতার মূলনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করে একে আর্থিকভাবে টেকসই করে গড়ে তোলা। আর বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই দ্বিতীয় অংশটিই হতে পারে চলমান সংকটের সমাধান। কেননা সংবাদমাধ্যমের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যাওয়ার একটা বড় কারণ, তারা সাংবাদিকতার মূলনীতি, অর্থাৎ জনগণের স্বার্থরক্ষার কাজটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে। আস্থার সংকটের কারণে, সংবাদমাধ্যমগুলো ব্যবসায়িকভাবেও লাভবান হতে পারছে না, তাদের নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞাপন, মালিক পক্ষের অনুদান ইত্যাদির ওপর। এ যেন এক দুষ্টচক্র। এই চক্র ভাঙার একটি অন্যতম উপায় হতে পারে গণমাধ্যমের স্ব-নিয়ন্ত্রণ, বা সেলফ-রেগুলেশন। আমাদের দেশে যার প্রচলন নেই বললেই চলে। সংবিধানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা আছে, আবার সংবাদমাধ্যমের জন্য বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় আইন রয়েছে, যার অনেকগুলো নিয়েই বিতর্ক রয়েছে। দেশে স্বাধীনতার এত বছরেও সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য কোনো কার্যকর সংস্থা গড়ে উঠতে পারেনি। প্রেস কাউন্সিলকে নখদন্তহীন বলে মনে করেন অনেকেই। সাংবাদিকদের নিয়ে, সম্পাদকদের নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের মধ্যেও রয়েছে বিভাজন। ফলে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে, সাংবাদিকরা তাদের নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের কোনো কাঠামোগত নির্দেশনা তৈরি করতে পারেনি, নিজেদের মূল্যায়নের তেমন কোনো ব্যবস্থারও রয়েছে অভাব। স্ব-নিয়ন্ত্রণের নামে যেটুকু যা আছে, তা হলো সেলফ সেন্সরশিপ, যা একেবারেই কাম্য নয়। টেকসই সাংবাদিকতা গালভরা কোনো তত্ত্ব নয়, এটি মূলত ভালো সাংবাদিকতা, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা, সাংবাদিকতার নৈতিকতা বজায় রাখা। একমাত্র বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার চর্চাই পারে সংবাদমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে। আর এই বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার চর্চা করতে হলে সংবাদমাধ্যমের নিজস্ব নীতি, অর্থাৎ স্ব-নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই। এটি কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের একক উদ্যোগেও হতে পারে।
আবারও সংবাদমাধ্যমের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নিয়ে এমআরডিআইয়ের সেই জরিপের প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়া যাক। জরিপে অংশগ্রহণকারী একটি ক্লাস্টার ছিল ঢাকার বাইরের একটি জেলা শহরের বিভিন্ন পেশাজীবী নারী। একটি প্রশ্নের জবাবে তাদের বেশির ভাগই বলেন, যেসব পত্রিকায় নারীদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন বেশি থাকে, নারীদের ইস্যু নিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করা হয়, সেসব পত্রিকার প্রতিই তাদের আস্থা বেশি। এখন, গণমাধ্যমে নারীর উপস্থাপন নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। তবে মোটের ওপর সবাই মানবেন, দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী হলেও, সংবাদমাধ্যমগুলো নিজেদের পাঠক-দর্শক হিসেবে মূলত বিবেচনা করে পুরুষকেই। এখনো অধিকাংশ সংবাদে নারীর উপস্থিতি ভিকটিম হিসেবে। নয়তো কাটতি বাড়ানোর জন্য ‘মুখরোচক’ প্রতিবেদনের উৎস হিসেবে। অথচ টেকসই সাংবাদিকতার চর্চায় সাংবাদিকরা সচেতনভাবেই এর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন। আর এর ফলে, নারীদের আস্থা অর্জন সহজ হয়। শেষ বিচারে ব্যবসায়িকভাবেও লাভবান হবে সংবাদমাধ্যম। কেননা যেহেতু দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাই নারী, পাঠক-দর্শক হিসেবেও সংবাদমাধ্যমের অর্ধেক ভোক্তা হয়ে উঠতে পারে নারী। টেকসই সাংবাদিকতার ধারণা সেই কথাই বলে। অবশ্য, সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুধু ব্যবসার কথা চিন্তা করলেই তো হবে না, জনরুচি তৈরিতে গণমাধ্যমের দায়িত্বের কথাও ভাবতে হবে। এটি এমন একটি শিল্প, যা একই সঙ্গে একটি সেবাও। এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখতেও সংবাদমাধ্যমের স্ব-নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
টেকসই সাংবাদিকতার আরেকটি সময়োপযোগী উদ্যোগ হতে পারে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন। মানুষের হাতে হাতে যখন স্মার্টফোন, তখন স্বাভাবিকভাবেই ছাপা পত্রিকা আর টেলিভিশনে কোনো নির্দিষ্ট চ্যানেলে সংবাদ দেখার প্রয়োজনীয়তা কমে এসেছে। দেশের তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশই এখন আর ছাপা পত্রিকা তেমন পড়ে না, টেলিভিশনের সংবাদ দেখে না। এই তরুণ সমাজের কাছে পৌঁছাতে হলে স্মার্টফোন, ইউটিউব কিংবা প্রয়োজনে টিকটকের সাহায্যই নিতে হবে মূলধারার গণমাধ্যমকে। এ বিষয়ে যত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর ততই মঙ্গল। এর জন্য প্রয়োজন নতুন ধরনের নিউজ রুম, ডিজিটাল ইকুইপমেন্ট ও প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ সাংবাদিক। কনটেন্টে বৈচিত্র্য আনতে সৃষ্টিশীলতাও লাগবে। সব মিলিয়ে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠতে হবে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোকে।
লেখক : মিডিয়াবিষয়ক উন্নয়নকর্মী
শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে প্রধান ভূমিকা রাখেন শিক্ষকরা। শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। একজন আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মাঝে যেমনি জ্ঞান বিতরণ করেন, তেমনি ন্যায়নীতি ও আদর্শেরও দীক্ষা দেন। মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে জাতি গঠনে প্রধান ভূমিকাই রাখেন শিক্ষকরা। যদি কোনো ভুল বা অমেধাবী এবং নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ এমন ব্যক্তিকে শিক্ষকতায় আনা হয়, যার শিক্ষকতায় আসার যোগ্যতা নেই, তাহলে তিনি যদি ৪০ বছর শিক্ষকতা করেন, এই পুরো সময়টাতেই শিক্ষার্থীরা তার কাছ থেকে কী ধরনের শিক্ষা ও নৈতিকতা অর্জন করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এজন্য শিক্ষককে নীতিনৈতিকতার দিক থেকে স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে হয়। কিন্তু শিক্ষকের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে তখন?
রবিবার দেশ রূপান্তরে ‘জাল সনদে হাজারো শিক্ষক’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে ১ হাজার ১০৮ শিক্ষক পাওয়া গেছে যারা জাল সনদে চাকরি করছেন বছরে পর বছর ধরে। গত ১০ বছরে ২৪ হাজার ১২৩টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে এসব জাল সনদধারী শিক্ষকদের শনাক্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ)। ভুয়া সনদ দিয়ে তারা চাকরি করে যাচ্ছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এর মধ্যে রাজধানীর নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকও রয়েছেন। জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটও জাল করেছেন তাদের কেউ কেউ। শিক্ষক নিবন্ধন ও কম্পিউটার সনদের পাশাপাশি বিএড, এমএডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডিপ্লোমা ও গ্রন্থাগার সনদও জাল পাওয়া গেছে। এসব শিক্ষক জাল সনদ দিয়ে চাকরি করে সরকারি কোষাগার থেকে এখন পর্যন্ত ৪৯ কোটি ৮২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৬০ টাকা অবৈধভাবে নিয়েছেন, যা ফেরতের সুপারিশ করা হয়েছে। অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে চাকরি করে যাওয়া এসব শিক্ষকের এমপিও বাতিলের সুপারিশও করেছে ডিআইএ। কিন্তু অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে গড়িমসির অভিযোগ পাওয়া গেছে। আবার যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাতেও রয়েছে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ। জাল সনদ ধরা পড়লেও কতজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে নেই তার কোনো হিসাব। শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির আগে তাদের সনদ যথাযথভাবে যাচাই করার কথা থাকলেও, অভিযোগ রয়েছে জাল সনদ জানার পরও ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে তা ছেড়ে দিচ্ছে আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো। তবে সম্প্রতি এনটিআরসিএর মাধ্যমে শিক্ষকরা নিয়োগ পাওয়ায় জাল সনদ নিয়ে চাকরিতে ঢোকার সুযোগ অনেকাংশেই কমে গেছে। ডিআইএর পরিদর্শনকালে কোনো শিক্ষকের জাল সনদ ধরা পড়লে বিষয়টি প্রতিবেদন আকারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় মাউশি অধিদপ্তরের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ডিআইএর পরিচালক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চিহ্নিত হওয়া জাল সনদধারী শিক্ষকদের কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, কারওটা আবার ঝুলে আছে। আমরা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের জবাব নেওয়া হয়। এরপর নানা মাধ্যম শেষে মন্ত্রণালয়ের মিটিংয়ে ওইসব শিক্ষকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা প্রতিষ্ঠান পর্যায় বা মাউশি অধিদপ্তরে ঝুলে থাকে।’
চাহিদার তুলনায় আমাদের দেশে গুণগত শিক্ষা ও শিক্ষক দুটোরই অভাব রয়েছে। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক ছাড়াও উচ্চশিক্ষার মান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কলেজ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। যে শিক্ষক ইন্টারমিডিয়েটে ক্লাস নেন, তিনি অনার্সের স্টুডেন্টদেরও পড়ান। শিক্ষক সংকটের কারণেও মান ঠিক রাখা যাচ্ছে না। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশকিছু পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে পিএইচডি থিসিসে নকল ও ডিগ্রি অর্জনে অনৈতিক পন্থা অবলম্বনের খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
দেশে শিক্ষার প্রসার ও বিস্তার ঘটেছে, লেখাপড়া মানুষের নাগালের মধ্যে এসেছে কিন্তু চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গুণগত শিক্ষার। আর গুণগত শিক্ষার জন্য দরকার ভালো শিক্ষক। একজন মেধাবী ছাত্র হতে পারেন, তবে ভালো শিক্ষক হওয়া এত সহজ নয়। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের একটি কারিগরি উল্লম্ফন প্রয়োজন। দরকার একটি বিজ্ঞানমনস্ক আগামী প্রজন্ম। এ জন্য দরকার অনুসন্ধিৎসু, আত্মবিশ্বাসী, বিজ্ঞানমনস্ক, নৈতিক ও মানবিক গুণসম্পন্ন মননশীল শিক্ষক। ফলে অনিয়ম, জাল সনদ, ভুয়া ডিগ্রিসহ নানা ধরনের অনৈতিকতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ শিক্ষকদের বিষয়ে ব্যবস্থাগ্রহণসহ মন্ত্রণালয়ের জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকতা পেশায় মেধাবী ও যোগ্য তরুণদের আনতে হলে কর্মপরিবেশ, তত্ত্বাবধান, বেতন, চাকরির নিরাপত্তা ইত্যাদির সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। উন্নত জাতি গঠনে মেধাবী ও যোগ্যদের শিক্ষকতা পেশায় নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নানামুখী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে সামগ্রিকভাবে লাভবান হবে বাংলাদেশ।
২০০১ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন রাগ সংগীতবিশারদ বারীণ মজুমদার। জন্ম ১৯২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পাবনার রাধানগরে। তার বাবার নাম নিশেন্দ্রনাথ মজুমদার ও মা মণিমালা মজুমদার। পারিবারিক পরিমণ্ডলে সংগীত শিক্ষার শুরু হলেও ১৯৩৮ সালে কলকাতায় ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছেই প্রথম রীতি অনুযায়ী সংগীতের তালিম নিতে শুরু করেন। পুত্রের সংগীতানুরাগ দেখে বাবা লক্ষেèৗ থেকে ওস্তাদ নিয়ে এসে নিয়োগ দেন। ১৯৩৯ সালে তিনি লক্ষেèৗর মরিস কলেজ অব মিউজিকে তৃতীয় বর্ষে ভর্তি হন এবং বি.মিউজ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি ওই কলেজ থেকে ‘সংগীতবিশারদ’ ডিগ্রি অর্জন করেন। এ ছাড়া তিনি অন্য অনেক পণ্ডিতের কাছে তালিম নেন। ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় তিনি পাবনায় চলে আসেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকায় আসেন এবং বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে উচ্চাঙ্গসংগীতের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। এ সময় তিনি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সংগীত বিষয়ে সিলেবাস প্রণয়ন করেন। পাশাপাশি তিনি ঢাকা বেতারে নিয়মিত রাগসংগীত পরিবেশন করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকার কাকরাইলের একটি বাসায় দেশের প্রথম ‘কলেজ অব মিউজিক’-এর কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৭০ সালে তাকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ পদক দেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে তাকে বাংলা একাডেমির ফেলোশিপ দেওয়া হয়। ২০০১ সালে তিনি মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক লাভ করেন।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইলেকট্রিক্যাল ও মেশিনারি পণ্য নিয়ে রাশিয়া থেকে আসা বিদেশি জাহাজ ‘এম,ভি আনকা সান’ ও ‘এম,ভি সাপোডিলা’ মোংলা বন্দরে ভিড়েছে। রবিবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে বন্দরের ৭ নম্বর জেটিতে ভিড়ে আনকা সান ও সন্ধ্যা ৭টায় ৮ নম্বর জেটিতে ভিড়ে সাপোডিলা।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার ক্যাপ্টেন শাহীন মজিদ জানান, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইলেকট্রিক্যাল মালামাল নিয়ে ভেনুটা পতাকাবাহী জাহাজ এম,ভি আনকা সান রবিবার বিকেল পৌনে ৫টায় মোংলা বন্দরের ৭ নম্বর জেটিতে ভিড়েছে। ১ হাজার ৯৭৯ প্যাকেজের ১ হাজার ৪শ মেট্রিক টন ইলেকট্রিক্যাল পণ্য নিয়ে গত ২৬ ডিসেম্বর রাশিয়ার নভরস্কি বন্দর থেকে ছেড়ে আসে এ জাহাজটি। এ ছাড়া রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ বন্দর থেকে ৪৩৬ প্যাকেজের ৫১৮ মেট্রিক টন মেশিনারি পণ্য নিয়ে সন্ধ্যা ৭টায় বন্দরের ৮ নম্বর জেটিতে ভিড়ে বিদেশি জাহাজ এম,ভি সাপোডিলা।
বিদেশি জাহাজ আনকা সান’র স্থানীয় শিপিং এজেন্ট কনভেয়ার শিপিং লাইনসের খুলনার ম্যানেজার (অপারেশন শিপিং) সাধন কুমার চক্রবর্তী ও সাপোডিলা’র স্থানীয় শিপিং এজেন্ট ইন্টারপোর্ট’র খুলনার ম্যানেজার অসিম মন্ডল জানান, বন্দর জেটিতে অবস্থান নেয়া এ জাহাজ দুটি থেকে রবিবার সন্ধ্যার পর অর্থাৎ রাত থেকে পণ্য খালাস শুরু হবে। এরপর জাহাজের এ পণ্য খালাস করে জেটিতে রাখা হবে। তারপর সোম বা মঙ্গলবার থেকে তা সড়ক পথে নেয়া হবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে।
এর আগে গত ২২ জানুয়ারি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল নিয়ে মোংলা বন্দরে এসেছিল বিদেশি জাহাজ এম,ভি কামিল্লা। এ জাহাজগুলো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত।
উল্লেখ্যে, সম্প্রতি ৭টি জাহাজ কোম্পানির ৬৯টি জাহাজে রূপপুরের মালামাল পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রেক্ষিতে রূপপুরের মালামাল নিয়ে রাশিয়া থেকে মোংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা এম,ভি উসরা মেজরকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তখন। ওই জাহাজটির ২৪ ডিসেম্বর মোংলা বন্দরে ভেড়ার শিডিউল ছিল। কিন্তু মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় তা আর সম্ভব হয়নি। পরে অবশ্য ওই জাহাজটি পণ্য খালাসে ভারতে গেলে সেখানেও পণ্য খালাস করতে না পারায় ফেরত যায় উসরা মেজর। যা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, বাংলাদেশ ও ভারতসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মহলে নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
চণতি বছর স্প্রিং সেমেস্টারে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (আইইউবি)-তে ভর্তি হওয়া প্রায় ৯০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪৪% নারী। বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত আইইউবির নিজস্ব ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত স্প্রিং ২০২৩ সেমেস্টারের ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়।
অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে আইইউবির অ্যাডমিশন্স অ্যান্ড ফিনানশিয়াল এইড অফিস।
একই অনুষ্ঠানে, ‘লুম্বিনি ফেলোশিপ’ শিরোনামের শিক্ষার্থী বিনিময় কর্মসূচির আওতায় দুই সেমেস্টারের জন্য আইইউবিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় বান্দরবান ইউনিভার্সিটির দুই শিক্ষার্থী প্রীতি তঞ্চঙ্গ্যা এবং আ আ মোই মারমা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম-ভিত্তিক তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লুম্বিনি লিমিটেড-এর আর্থিক সহায়তায় চার বছরের জন্য এই কর্মসূচির সূচনা করেছে আইইউবি এবং দেশের একমাত্র পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ ভিত্তিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশে পাবলিক এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এটিই প্রথম শিক্ষার্থী বিনিময় কর্মসূচি।
ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠানে গেস্ট অব অনার হিসেবে বক্তব্য রাখেন স্বনামধন্য লেখক এবং প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুল হক।
আরো বক্তব্য রাখেন আইইউবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সরকার; উপাচার্য তানভীর হাসান, পিএইচডি; উপউপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান, পিএইচডি; রেজিস্ট্রার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আনোয়ারুল ইসলাম; স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড এন্ট্রাপেনারশিপ-এর ডিন অধ্যাপক ড. মেহেরুন আহমেদ; স্কুল অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেস-এর ডিন অধ্যাপক ড. শাহ এম ফারুক; স্কুল অফ লিবারেল আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর ডিন অধ্যাপক ড. তৈয়েবুর রহমান; স্কুল অব ফার্মেসি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ-এর ডিন অধ্যাপক ড. জে এম এ হান্নান; এবং স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং, টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস-এর অন্তবর্তীকালীন ডিন ড. মাহাদী হাসান।
অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন অ্যাডমিশন্স অ্যান্ড ফিনানশিয়াল এইড-এর প্রধান লিমা চৌধুরী। সঙ্গীত পরিবশেন করে আইইউবি মিউজিক ক্লাবের সদস্যবৃন্দ।
৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন করল দেশের অন্যতম বিজ্ঞাপনী সংস্থা এক্সপ্রেশানস্ লিমিটেড। এ উপলক্ষে গত ২৭ জানুয়ারি রাজেন্দ্রপুরে অবস্থিত ব্র্যাক সিডিএম-এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে যোগ দেন এক্সপ্রেশানস্-এর অর্ধশতাধিক কর্মী।
এ দিন সকাল ১০টায় সম্মিলিতভাবে জাতীয় সংগীত গেয়ে শুরু হয় বার্ষিক সাধারণ সভা। সভায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের বিবরণ শেয়ার করেন বিভিন্ন বিভাগের প্রধানগণ।
বিকেলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীবৃন্দ ক্রিকেট, টেবিল টেনিসসহ নানা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেন এবং সন্ধ্যায় আয়োজিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সংগীত, অভিনয়, নৃত্য ও কবিতা আবৃত্তি শেষে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করা হয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান রামেন্দু মজুমদার।
তিনি বলেন, তিন দশক পেরিয়ে এক্সপ্রেশানস্ লিমিটেড আজ একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। জন্মলগ্ন থেকেই আমরা স্বাধীনতা, দেশ, মাটি ও মানুষের চেতনাকে ধারণ করে চলেছি। সম্প্রতি বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন আয়োজনে অফিশিয়াল লোগোটি তৈরি করতে পেরে আমরা, এক্সপ্রেশানস্ আনন্দিত ও গর্বিত।
এক্সপ্রেশানস্ লিমিটেড-এর প্রতিষ্ঠা ১৯৯৩ সালে, দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কৌশলকে সমন্বয় করে বিজ্ঞাপনের উৎকর্ষ অর্জনের প্রত্যয়ে।
ব্র্যান্ড সৃষ্টি, বিপণন ও উন্নয়ন যোগাযোগের লক্ষ্যে এটিএল, বিটিএল, ডিজিটাল ও ওটিটি সকল প্ল্যাটফর্মে ৩৬০ᵒ সমাধান দিতে অডিও, ভিডিও, প্রিন্ট বিজ্ঞাপন তৈরি থেকে শুরু করে যেকোনো ইভেন্ট, অ্যাকটিভেশন, মিডিয়া সলিউশন, ডিজিটাল কমিউনিকেশন করে থাকে এক্সপ্রেশানস্।
বিগত তিন দশক ধরে দেশীয় ও বহুজাতিক করপোরেট প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে সফলভাবে কাজ করার মাধ্যমে অর্জন করেছে অবিচল আস্থা। ডাবর বাংলাদেশ, পারটেক্স বেভারেজ লি., এসিআই লি., বেঙ্গল গ্রুপ, আনোয়ার গ্রুপ, আইএফআইসি ব্যাংক লি., নাভানা এলপিজি লি., ইগলু আইসক্রিম, লাভেলো আইসক্রিম, সেভয় আইসক্রিম, টিভিএস মোটর, সুপারস্টার গ্রুপ, প্রাণ-আরএফএল, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, এটুআই, তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বন অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, বিআরটিএ, ডিসিসি, বিশ্বব্যাংক, ইউনিসেফ, সেভ দ্য চিলড্রেন, ইউএনডিপি, ইউএসএইড, ইউএস অ্যাম্বাসি, টিআইবি, মেরি স্টোপস, স্টপ টোব্যাকো বাংলাদেশ, ব্র্যাক, আইএলও, আইওএম, ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন, ইপিআই ইত্যাদি সংস্থার যোগাযোগ ও প্রচারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে এক্সপ্রেশানস্ লিমিটেড।
উল্লেখ্য, এক্সপ্রেশানস্ লিমিটেড প্রতিদিন সকালে সম্মিলিতভাবে জাতীয় সংগীত গেয়ে তাদের দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু করে থাকে।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
প্রণয় রায়কে কোথায় পাব? ২০০০ সালের শুরুতে এরকম একটা জিজ্ঞাসা নিয়ে আমি তখন ফোন করেছিলাম এনডিটিভিরই এক স্পোর্টস রিপোর্টারকে, যে প্রণয় রায়কে ব্যক্তিগতভাবে বহু বছর খুব ভালো চেনে, তার প্রতিষ্ঠানে বহু বছর চাকরি করেছে। মনে রাখতে হবে, এমন একটা সময় তখন, যখন সেলফোন সবে এসেছে বা আসেনি, সেই সময় কাউকে ধরার জন্য, এখন যেরকম একটা যন্ত্রই সতেরো সেকেন্ডে কাউকে ধরিয়ে দেয়, তখন তা সম্ভব ছিল না। আর প্রণয় রায়ের মতো বিখ্যাত কেউ হলে তো সেটা প্রায় অসম্ভব। আমি এনডিটিভিতে কয়েকবার ফোন করে নিষ্ফল চেষ্টার পর এই রিপোর্টারের শরণ নেই। তখন সে খোঁজটোজ নিয়ে জানাল, প্রণয় রায় এখন ট্রেনে করে দিল্লি থেকে বোম্বে যাচ্ছেন। আমি সে সময় একটা বই লিখি, যে বইটা ছিল অনেক প্রফেশনালের লেখার সংকলন। বইটার নাম ছিল সেলিব্রেটি এখন আপনিও। আমার কোথাও মনে হয়েছিল যে, এই বইটা যেহেতু টেলিভিশন দুনিয়ায় কী করে সফল হতে হবে এবং সফল হয়ে কীভাবে চলতে হবে তার ওপর একটা কম্পাইলেশন, সেখানে প্রণয় রায়ের কোনো কিছু থাকবে না এটা হতেই পারে না এবং সেই বইটাতে অনেকেই লিখেছিলেন। রাজদীপ, অর্ণব গোস্বামী, রজত শর্মা, তখন খুব বিখ্যাত আরজে রুবি ভাটিয়া, প্রিয়া টেন্ডুলকার। আমার মনে হয়েছিল যে, এই বইটার মুখবন্ধ, তারই করা উচিত, যিনি ভারতীয় টেলিভিশনের জনক এবং সেই কাজটা প্রণয় রায় ছাড়া আর কে করতে পারেন! কিন্তু আমি খুব আশ্চর্য শুনে, যে এনডিটিভির মালিক, তিনি কি না দিল্লি থেকে মুম্বাই যাচ্ছেন ট্রেনে করে! এবং শুনলাম ট্রেন থেকে তিনি মুম্বাইতে নেমে, আবার নাকি ট্রেনে উঠবেন। অর্থাৎ সারমর্ম হচ্ছে, আগামী তিন দিনের মধ্যে আমি তাকে ধরতে পারব না। আমার জন্য যেটা তখনকার মতো সবচেয়ে অবাক লেগেছিল যে, টানা তিন দিন ট্রেনে চড়ে ভারতবর্ষ ঘুরছেন, এত বড় এমন একজন মানুষ যার কাছে প্রত্যেকটা সেকেন্ড দামি। তখন আমায় ওর সহকর্মীরা বললেন যে, উনি এরকমই মাঝেমধ্যে ট্রেনে করে ভারত দেখতে বেরিয়ে পড়েন। বহুকষ্টে প্রণয় রায়কে তারপর ধরা গিয়েছিল। মুখবন্ধটা উনিই লিখেছিলেন আমার বইয়ের। কিন্তু আমার বিস্ময় এখনো কাটেনি। এরকম একজন মিডিয়া ব্যারেন কী করে তার ব্যস্ততার মধ্যে ট্রেন ট্রাভেলের মতো একটা ইচ্ছাকৃত ঝুঁকি নিতে পারেন, ঝক্কি নিতে পারেন, যেখানে তিনি সহজেই দুই ঘণ্টায় মুম্বাই থেকে দিল্লি প্লেনে পৌঁছে যেতে পারেন। প্রণয় রায় নামটার সঙ্গে প্রথম পরিচয় আর সবার মতোই অনেক দূর থেকে। ‘ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ বলে একটা অনুষ্ঠান থেকে এবং তখন দেখেই মনে হয়েছিল যে, ফেলুদার কখনো ইংলিশ ভার্সন হলে, সেখানে তার রোলটা করার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রণয় রায়। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, হাইট; ফেলুদা অবশ্য কখনো ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখেননি, কিন্তু তিনি যে বাঙালি, ইন্টেলেকচুয়াল, যে মননের সঙ্গে ফেলুদাকে দেখতে অভ্যস্ত বা বাঙালি এক করে ফেলেছে, সেই পুরো ফেলুদার ভাবধারাটাই যেন প্রণয় রায় তার মধ্যে বহন করেন। অর্থাৎ তিনি অকুতোভয়। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি শিক্ষিত এবং তিনি খুব সচল, খুব অ্যালার্ট। ওয়ার্ল্ড দিস উইক-এ তাকে দেখে যেরকম সারা ভারতবর্ষ মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তারপর আমরা তাকে দেখলাম ইলেকশন অ্যানালাইসিস করতে এবং তখনই একটা নতুন টার্মের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটল। যার নাম হচ্ছে সেফোলজিস্টস অর্থাৎ যিনি ইলেকশন ট্রেন্ডস এবং স্ট্যাটিসটিকস বিশ্লেষণ করেন। ভারতবর্ষে তার আগে, প্রাক-প্রণয় রায় যুগে যেমন পেশাদার টেলিভিশন ছিল না, তেমনি সেফোলজিস্ট শব্দটাও শোনা যায়নি। যাই হোক, প্রণয় রায় তারপর আমাদের সঙ্গে, নির্বাচনের আগে প্রাক-নির্বাচনী সিট পোল করা শুরু করলেন। নির্বাচনের পর বিশ্লেষণ শুরু করলেন এবং নতুন একটা ঘরানা নিয়ে এলেন যেটা এর আগে ভারতীয় টেলিভিশনে কেউ দেখেনি। এবং যেটার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিতে অসম্ভব একটা আন্তর্জাতিকতা আছে। আমার তখন থেকেই মনে হতো যে, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে যে করে হোক, আলাপ করতে হবে, আবার একই সঙ্গে মনে হতো যে, আলাপ হলে যদি মুগ্ধতা কেটে যায় তাহলে আলাপ না হওয়াই ভালো। দূর থেকে তাকে দেখাটাই ভালো। দুরকম একটা, স্ববিরোধী একটা ভাবনা নিজের মনের মধ্যে ঘুরত। এরপর প্রণয় রায় দেখালেন যে, তিনি শুধু এককভাবে স্টার নন। অর্থাৎ তার শুধু স্টার হলেই চলছিল। স্টার প্রণয় রায়ই যথেষ্ট ছিলেন ভারতবর্ষের জন্য যেভাবে তিনি বিল গেটসকে ইন্টারভিউ করেছেন, যেভাবে তিনি নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে কথা বলেছেন, যেভাবে তার শোগুলো বিশ্লেষণ করেছেন, কখনো কখনো বড় শো করতে এসেছেন লাইভ শো, সেটাই যথেষ্ট ছিল টেলিভিশনের পৃথিবীতে, তাকে পাকাপাকিভাবে রেখে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি ঠিক করলেন যে, তাকে শুধু ভারতীয় টেলিভিশনের অমিতাভ বচ্চন হলেই চলবে না, তাকে একই সঙ্গে হতে হবে ভারতীয় টেলিভিশনের রাজ কাপুর। তাই এনডিটিভি প্রতিষ্ঠা করে নিলেন, তার আগপর্যন্ত তিনি অনুষ্ঠানগুলো স্টারে করছিলেন, অন্য চ্যানেলে করছিলেন, এবার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান নিয়ে এলেন এবং সেই প্রতিষ্ঠানে একটা, যেটাকে লেফট লিবারেল সেন্টিমেন্ট আমরা বলি, সেটার তো ধারক এবং বাহক হয়ে গেলেন গোটা ভারতবর্ষে, একই সঙ্গে অনেক তারার জন্ম দিলেন।
এ তারার জন্ম দেওয়া নিয়ে ভারতবর্ষের মিডিয়া জগতে দুই রকম মতবাদ আছে। বেশিরভাগ মিডিয়া ব্যারেন, তারা মনে করেন যে স্টার তৈরি করাটা বিপজ্জনক, কারণ স্টার আজ আছে, কাল অন্যের হয়ে তারাবাজি করবে। আমাকে ছেড়ে দেবে। তখন সেই তারাবাজির আলোটা আমাকে সহ্য করতে হবে। তার চেয়ে বাবা সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, আমি যদি কিছু স্ক্রিন প্রফেশনাল তৈরি করি যাদের বাহ্যিক সেরকম কোনো পরিচিতি নামডাক থাকবে না, কিন্তু যারা খুব এফিশিয়েন্ট হবে। যেটাকে আমরা অনেক সময় ক্রিকেটের ভাষায় বলি লাইন অ্যান্ড লেন বোলার। অর্থাৎ তার ফ্ল্যামবয়েন্স থাকবে না, সে অত্যন্ত পেশাদার হবে, মানে কাজটা তুলে দেবে। যদি সেরকম করি তাহলে সুবিধা হচ্ছে যে, সেই ধরনের পেশাদার সে যদি অন্য জায়গায় চলে যায় আমি আরেকটা পেশাদারকে নিয়ে আসতে পারব। কিন্তু যদি আমার এখান থেকে একটা রাজদীপ চলে যায়, কী অর্ণব চলে যায়, তাহলে আমার সমস্যা যে লোকে প্রতিনিয়ত জিজ্ঞেস করবে যে, ও চলে গেল কেন? ও নেই কেন? তখন অনেক রকম আমার সমস্যা দেখা দিতে পারে। বেশিরভাগ ভারতীয়, আবার বলছি, বেশিরভাগ ভারতীয় মিডিয়া ব্যারেন আজও তাই মনে করেন, ভারতের সবচেয়ে বড় খবরের কাগজ টাইমস অব ইন্ডিয়া তারা আজও ওই ঘরানায় বিশ্বাসী যে, স্টার তোলার দরকার নেই, তোলার দরকার আছে এফিশিয়েন্ট প্রফেশনাল, প্রণয় রায় এখানেও ইউনিক, তিনি এই ধারণাটা কমপ্লিটলি ভেঙে দিয়েছেন, এত সব স্তর তিনি তুলেছেন, যে ভারতীয় টেলিভিশনে সেকেন্ড কোনো নমুনাও নেই বোধহয়। এক থেকে দশ, দিকে দিকে কতগুলো নাম বলব? অর্ণব গোস্বামী, বরখা দত্ত, রাজদীপ, নিধি, রাজদান, রবিশ কুমার, শ্রীনিবাসন জৈন, বিক্রম চন্দ প্রত্যেকে একেকজন স্টার ভারতীয় মিডিয়া জগতের এবং ওদের প্রত্যেককে কিন্তু তুলেছেন প্রণয় রায়। অনেকেই ছেড়ে গেছেন, তাতে তার কিছু এসে যায়নি। তিনি স্টার তৈরির কারখানাতে একইরকমভাবে মনোনিবেশ করেছেন। পরের লোকটাকে বের করে আনার জন্য ইভেন এই চাপের মুখে অচঞ্চলতা এটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ ট্রেডমার্ক। আমি কখনো দেখিনি কোনো ছবিতে, কখনো শুনিনি যে তিনি অত্যন্ত স্ট্রেসড হয়ে আছেন, নিশ্চয়ই স্ট্রেসড হয়েছেন গত কিছুদিন, কয়েক মাসের ঘটনা যে রকম যখন তিনি এনডিটিভি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন, অবশ্যই স্ট্রেসের মুখে ছিলেন, কিন্তু কোথাও কখনো পাবলিকলি স্ট্রেসের ভাবটা দেখাননি, যাতে তার ডিগনিটিটা অক্ষুন্ন থাকে, এই পাবলিক লাইফে প্রচ- স্ট্রেসের মধ্যে ডিগনিটি বজায় রাখাটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ হিউজ ট্রেডমার্ক এবং এটা অনুকরণযোগ্য। আমার একটা সময় বারবার মনে হতো যে প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করছি না কেন? কেন প্রণয় রায়ের কোম্পানিতে কাজ করার চেষ্টা করছি না? তারপর সবাই বলত যে, একটু প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করতে হলে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ থেকে পাস করতে হবে অথবা তাদের বাবাদের হতে হবে আইএফএস কিংবা আইএস, প্রণয় যাদের রিক্রুট করেন তাদের যদি আমরা দেখি তারা কোথা থেকে এসেছে, তাহলে দেখা যাবে তারা অত্যন্ত উচ্চবিত্ত সমাজ থেকে এসেছে।
প্রণয় রায়ের ওখানে একেবারে লোয়ার মিডল ক্লাস কেউ নেই, হয়তো কথাটা কতটা অসত্য, হয়তো কথাটা কিছুটা সত্য। কিন্তু আমি সাম হাউ আর কখনো চেষ্টা করিনি। দূর থেকে সবসময় একটা অদ্ভুত রেসপেক্ট এনডিটিভি গ্রুপ সম্পর্কে আমার এবং অন্য অনেক সাংবাদিককুলের বজায় ছিল যে, এরা হয়তো চাপের মুখে তাদের টেকনিক চেঞ্জ করেনি। তারা হয়তো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলছে না, অনেকে বলত যে এনডিটিভিতে ডিসকাশনগুলো খুব বোরিং হয়ে যাচ্ছে। হতে পারে কিন্তু তারা সাবেকি যে ছাঁচটা সাংবাদিকতার, সেটা টেলিভিশনের ঢঙ্কানিনাদে এসেও কিন্তু বজায় রেখেছিল। এবং এই চিৎকার-চেঁচামেচি, মারদাঙ্গা যেটা আধুনিক ভারতীয় টেলিভিশনের ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে, সেটা থেকে বরাবর এনডিটিভি দূরে থেকেছে।
তাতে তাদের টিআরপি পড়েছে। তারা কেয়ারও করেনি। তারা মনে করেছে, আমরা এভাবে করতে চাই। এভাবেই করব। বাকি পৃথিবী যা ইচ্ছে বলুক, কিছু আসে যায় না। রাষ্ট্রপতি ভবনে এনডিটিভির একটা বিশাল অনুষ্ঠান হয়েছিল যখন প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি, সেটাতে অমিতাভ বচ্চন, শচীন টেন্ডুলকার, আশা ভোঁসলেসহ অনেকে এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানটা দেখতে দেখতে আমার মনে হচ্ছিল যে, একজন মানুষের কতটা হোল্ড থাকলে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠান করতে পারেন। পরবর্তীকালে সেটা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল।
প্রশ্ন উঠেছিল কী করে রাষ্ট্রপতি একটা প্রাইভেট চ্যানেলকে সেখানে অনুষ্ঠান করতে দিতে পারেন। কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে, শ্রদ্ধার কোন পর্যায়ে গেলে, কন্টাক্টস কোন পর্যায়ে থাকলে, তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার ব্যক্তিগত চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন! মহেন্দ্র সিং ধোনি একটা সময় এনডিটিভির সঙ্গে ছিলেন এবং তখন এনডিটিভির দু-একটা অনুষ্ঠান করেছিলেন। আমার মনে আছে, ধোনি একবার সাউথ আফ্রিকায় বললেন, আরে এনডিটিভি কী করে করছে! এটাই প্রণয় রায়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য এ কথাটা যে মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো মানুষ বলছেন! এটা ঠিক শোভা পায় না অর্থাৎ সবসময় এনডিটিভির একটা নির্দিষ্ট বেঞ্চমার্ক ছিল। সেটা হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই। প্রশ্ন তোলা। সাহসী প্রশ্ন তোলা। আবার চাপের মুখে মাথা না নামানো, ওই যে বললাম একটা বামপন্থি লেফট লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি।
অনেকেই বলত যে, প্রণয়ের স্ত্রী রাধিকা রায়ের বোন যেহেতু বৃন্দা কারাত, সেজন্যই এ দৃষ্টিভঙ্গি। আমার কখনো তা মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছিল প্রণয় রায়ের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি। একেবারে তিনি কলকাতায় হয়তো খুব বেশি সময় কাটাননি। কিন্তু কলকাতার ওই উদার বামপন্থি যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেই উদার বামপন্থার সঙ্গে তার মনোভাব একেবারে একরকম। এবং সে জন্যই, বদলে যাওয়া ভারতবর্ষে তার বারবার করে সমস্যা হচ্ছিল এবং সমস্যা হওয়ার বোধহয় কথাও ছিল। কারণ তিনি যেটা বলছিলেন, শাসকরা বলছিলেন কমপ্লিটলি তার বিপরীত কিছু। এখনকার ভারতবর্ষের মিডিয়ায় বিপরীতমুখী আওয়াজটা আর কিছুদিন বাদে আমার ধারণা একমাত্র ফিল্মেই দেখা যাবে, ভারতবর্ষের টেলিভিশনে দেখা যাবে না।
আমার তো মনে হয় যখন এই ছবিগুলো দেখানো হবে যে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কী রকম লড়াই করেছিল, এককালে আনন্দবাজার গ্রুপ কী লড়াই করেছিল, টাইমস নিয়ে মাঝখানে গিয়ে লড়াই করেছে, এনডিটিভি দীর্ঘদিন ধরে কী লড়াই করেছে সেগুলো বোধহয় ইতিহাসের পাতাতেই চলে গেল। তাই বলে প্রণয় রায়! যিনি কখনো ইতিহাসের কথায় যাবেন না। প্রণয় রায় ইতিহাস হয়ে ইতিহাসের পাতায় থাকবেন। আমার মনে হয়েছে যখন একটা সময় জগমোহন ডালমিয়া রবি শাস্ত্রীকে ইন্ডিয়ান টিমের কোচ হতে বলছিলেন এবং তিনি কোচ হব কি হব না এটা নিয়ে নানান কথা বলছিলেন। তখন আমায় শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, আমি তিনটে শর্ত দিয়েছি, একটা শর্ত যে টিম সিলেকশনের ভার আমাকে দিতে হবে। দুই, টিম সিলেকশনের ভার আমার যদি না থাকে, আমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মত থাকবে। তিন, চূড়ান্ত এগারোর ব্যাপারে আমার মতামত থাকবে। ফোর্থ, টিমের ফিটনেসের ব্যাপারে আমি কিছু কথা বলব। আমি তখন বলেছিলাম যে, আপনি ম্যানেজার হয়তো হবেন। কিন্তু আপনি থাকতে পারবেন না। কারণ আজাহারউদ্দিন। আপনি যদি এসব কথা বলেন তাহলে আজহারউদ্দিন আপনাকে ম্যানেজার রাখবেন না। উনি যেরকম পাওয়ারফুল, ডালমিয়ার সঙ্গে যেরকম সম্পর্ক, আপনাকে চলে যেতে হবে। তখন শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, চলে যেতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু গোটা ড্রেসিংরুম জানবে, আমায় কেন চলে যেতে হয়েছিল। ওই রেসপেক্টটাই আমার পাওনা হবে। শাস্ত্রী সেই সময় ভারতীয় দলের কোচ হননি এবং হন অনেক পরে, কিন্তু আজ কোথাও মনে হচ্ছে যে, প্রণয় রায়ের এনডিটিভি থেকে চলে যাওয়া তার অসম্মান, তার অমর্যাদা এসবকিছু ইতিহাসে থেকে গেল, এভাবে ইতিহাস জানল লোকটাকে কেন চলে যেতে হয়েছিল। আমি ইমরান খানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাকে এই যে জেলে পুরে অসম্মান করা হলো, আপনার কী মনে হয়েছিল সেই সময়? উনি বলেছিলেন, আমার কিছুই মনে হয়নি, আমার মনে হয়েছিল, গবেটগুলো যে ভুল করেছিল, সেগুলো ইতিহাসের পাতায় চলে গেল।
প্রণয় রায়ের কাহিনী সম্পর্কে আবার তাই মনে হয় যে, গবেটগুলো কী করে জানবে যে ওরা নিজেদেরও ইতিহাসের পাতায় নিয়ে চলে গেল। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই সাময়িক। আর তাই বলছি, প্রণয় রায় চলে যাবেন নতুন প্রণয় রায় নিশ্চয়ই ফেরত আসবেন, তাই এটা দীর্ঘকালীন হতে পারে না। এটা সাময়িক। তাই লেখাটার হেডিং বললাম, মেরুদণ্ডের টাইম আউট।
শ্রুতিলিপি : শিমুল সালাহ্উদ্দিন
প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার তালিকাভুক্ত। কিন্তু বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। অথচ সরকারি শুল্ক সুবিধার আওতায় বিদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এমন ৫৩টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থার প্রাথমিক তদন্তে ব্যাংকিং চ্যানেলে এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের তথ্যও মিলেছে। এ ছাড়া আরও ৭১টি প্রতিষ্ঠান একই সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করার মাধ্যমে আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ পাচারে যুক্ত বলে এনবিআরের তদন্তে জানা গেছে।
চিহ্নিত এই ১২৪টি প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তদন্ত শেষে পর্যায়ক্রমে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব জব্দ করা হয়। এ ছাড়া ব্যবসার লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। আমদানি-রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই তৈরি পোশাক শিল্প ও এর সহযোগী শিল্পের প্রতিষ্ঠান। তাদের পাচার করা অর্থের পরিমাণ চিহ্নিত করতে বিস্তারিত তদন্ত চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সদস্য এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, একেকটি প্রতিষ্ঠান একাধিক চালানে কম করেও ৫ কোটি থেকে ২৫ কোটি টাকার পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি করেছে। অন্যদিকে একেকটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের পরিমাণও ৮ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকা বা তার বেশি। এই হিসাবে ১২৪ প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার পণ্য এনে অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে এবং আরও প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। প্রাথমিক তদন্তে এসব পাওয়া গেলেও চূড়ান্ত হিসাবের কাজ চলছে। চূড়ান্ত হিসাবে অর্থের পরিমাণ বাড়তে বা কমতে পারে।
এভাবে শুল্ক সুবিধায় কাঁচামাল এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়ার কারণে দেশি শিল্পে কী ধরনের প্রভাব পড়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশি শিল্প সব ধরনের রাজস্ব পরিশোধ করে পণ্য উৎপাদন করে বলে তাদের উৎপাদন খরচ বেশি। অন্যদিকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য আমদানিতে শুল্ক দেওয়া লাগে না বলে খরচ কম হয়। তাই দাম কম থাকে। কম দামে পণ্য পাওয়ায় ক্রেতারা এসব পণ্য বেশি কেনে। অন্যদিকে দেশি পণ্য ন্যূনতম লাভ রেখে বিক্রি করলেও এর সঙ্গে পেরে ওঠে না। ফলে দেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ছে।
এনবিআর কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ১৭ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি ১২৪ প্রতিষ্ঠানের পাঁচ বছরের (২০১৭-২০২১) আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য খতিয়ে দেখেছে। বিশেষভাবে কী পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, কতটা উৎপাদন করা হয়েছে, রপ্তানির পরিমাণ কত, ব্যাংকে এলসি বা ঋণপত্রের মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ কোন কোন দেশের অনুকূলে পাঠানো হয়েছে, তদন্তে এসব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যে ৭১ প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে, তারা কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর্থিক অনিয়ম করেছে। যে পরিমাণের কাঁচামাল প্রয়োজন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। অন্যদিকে যা রপ্তানি করার কথা তার চেয়ে কম পরিমাণ এবং নামসর্বস্ব পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোও বাইরে থেকে কিনে নামমাত্র পণ্য রপ্তানি করেছে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক ও সহযোগী শিল্প কারখানা ছাড়াও ইলেকট্রিক, প্লাস্টিক খাতের প্রতিষ্ঠান আছে। কাঁচামাল হিসেবে তারা আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, মিডিয়াম পেপার, লাইনার পেপার, পলিপ্রোপাইলিন (পিপি), বিএপিপি ও এডহেসিভ টেপ, প্লাস্টিক দানা, হ্যাঙ্গার, পলিথিন, সুতা, কাপড়, তারসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম আমদানি করেছে। কিন্তু সেসব কাঁচামাল কারখানায় না নিয়ে রাজধানীর নয়াবাজার, বংশাল, বকশীবাজার, হাতেম টাওয়ার, ধোলাইখাল, টঙ্গীতে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিরপুর ২ নম্বরের বেলুকুচি নিট ওয়্যার, আদাবরের ঠিকানায় কভারস অ্যান্ড কভার ইন্ডাস্ট্রি, শ্যামপুর কদমতলীর ইমপেকস প্যাকেজিং লিমিটেড, টঙ্গীর এম এম ওয়াশিং প্ল্যান্ট লিমিটেড, বনানীর বিমানবন্দর সড়কের পারসা লিমিটেড, বনানী জি ও এইচ ব্লকে রাইন ফ্যাশন লিমিটেড, টঙ্গীর ওয়েলড ড্রেসেস লিমিটেড, মিরপুর পল্লবী সেকশন ৭-এর মারকাভ ডিজাইনারস লিমিটেড, ঢাকার কোতোয়ালির ঠিকানায় ম্যানিলা পলিমার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডসহ ১২৪ প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিকানায় গিয়ে ৫৩টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাস্তবে কোথাও দোকান, আবাসিক ভবন, শপিং মল, ছাত্রী হোস্টেল, স্কুল পাওয়া গেছে। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার ঠিকানায় আফট্যাকস লিমিটেড অবস্থিত বলা হলেও বাস্তবে সেখানে রয়েছে দোকান।
প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী হিসেবে ১২৪টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত। উৎপাদনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা পরিচালক হিসেবে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। তাদের দাবি, কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানিসংক্রান্ত একটি কাগজেও তাদের স্বাক্ষর নেই। তবে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এসব ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীর বাবুবাজারে বিক্রি করতে নেওয়ার সময় ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা বন্ড সুবিধা বা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাগজসহ একটি কাভার্ড ভ্যান আটক করে। এসব কাগজ এবি প্যাকেজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান বন্দর থেকে খালাস করে এনেছিল। আটক পণ্যের বাজারমূল্য প্রায় ১৪ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে শুল্ক-করসহ দাম হয় প্রায় ২৬ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন চালানে এক বছরে প্রায় ১২ কোটি টাকার পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করেছে।
শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের পণ্য উৎপাদনে সরকার কাঁচামাল আমদানিতে ‘বন্ড সুবিধা’ নামে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। এই সুবিধা নেওয়া প্রতিষ্ঠানকে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় না। এই সুবিধা পেতে হলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়। শর্তগুলোর অন্যতম হলো, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামালের সবটা উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে। উৎপাদিত সব পণ্য রপ্তানি করতে হবে এবং সামান্য কাঁচামালও খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না। এসব শর্ত ভঙ্গ করলে শাস্তি হিসেবে বন্ড সুবিধা বাতিল এবং ব্যবসায়ের লাইসেন্স স্থগিত হবে। আর্থিক অনিয়মের সমপরিমাণ অর্থ, রাজস্ব এবং জরিমানাসহ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। প্রয়োজনে কারখানার জমি, যন্ত্রপাতি জব্দ করা হবে। আমদানিকারকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার আইনি সুযোগ আছে। শাস্তি হিসেবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও এর সঙ্গে জড়িতদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা যাবে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১২৪টি প্রতিষ্ঠান আমদানিকৃত কাঁচামালের যে দাম উল্লেখ করে ঋণপত্র বা এলসি খুলে অর্থ পাঠিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে আমদানি করেছে তার চেয়ে কম দামের ও কম পরিমাণের পণ্য। আমদানিকারকরা গোপনে বিদেশে নিজস্ব মালিকানাধীন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান খুলে তার অনুকূলে দাম হিসেবে অর্থ পাঠিয়েছে। এ অবৈধ কারবারে ব্যাংক, বন্দর ও এনবিআরের কিছু অসাধু ব্যক্তিকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সাবেক কমিশনার এবং এনবিআর সদস্য ড. শহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করতে এনবিআর নজরদারি বাড়িয়েছে। তবে আইনি প্যাঁচে অনেক সময় তাদের শাস্তির আওতায় আনতে সময় লেগে যায়। এ বিষয়ে আরও কাজ করার সুযোগ আছে।
বন্ড দুর্নীতি চিহ্নিত করতে প্রিভেন্টিভ, নিয়মিত ও বিশেষ অডিট করা হয়। এসব অডিটে প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের পর চূড়ান্ত তদন্ত করা হয়। তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে মাস থেকে বছরও পার হয়ে যায়। এরপর শুনানির জন্য অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের তলব করা হয়। তারপর মামলা হয় এনবিআরের আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলা নিষ্পত্তিতে পার হয়ে যায় বছরের পর বছর। রায় হওয়ার পর যেকোনো পক্ষের উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। আটকে থাকা মামলার সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে বন্ড দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আইন সংশোধনসহ এনবিআরকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
আর কখনো রাজনীতিতে জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মুচলেকা দিয়ে এ কথা বলেছে তারা। সংগঠনটির নেতারা আরও বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের অংশও হবেন না তারা। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপন কোনো সম্পর্কেই জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম।
হেফাজতে ইসলাম বেশ কিছু শর্তও দিয়েছে। শর্তে তারা বলেছে, হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ যেসব নেতা কারাবন্দি রয়েছেন তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে এবং মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলাম গত বছর ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে এ মুচলেকা দেয় এবং এসব শর্ত বা দাবি জানায়।
আগে হেফাজত নেতারা তিন মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তারপর দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মুচলেকা দেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হেফাজতের মুচলেকা দেওয়ার কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। সরকারের সহযোগী হিসেবে থাকার অঙ্গীকার করেছে হেফাজত।
১৪ দলের অন্যতম শরিক তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভা-ারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়; তারা রাজনীতি করবে না। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধও হবে না।
হেফাজতে ইসলাম আরও কিছু শর্ত দিয়েছে, যেমন কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর বৃহত্তম বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশকে (বেফাক) সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার ও তাদের মুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে মামুনুল হক এবং আরও কয়েকজনকে এখনই মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে সরকারি মহল। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মামুনুলকে ছাড়তে হবে, যা সময়সাপেক্ষ।
সূত্রে আরও জানা গেছে, কাদিয়ানি সম্প্রদায় বিষয়ে হেফাজতের দাবি আপাতত আমলে নেওয়া হয়নি। কারণ, তাদের অমুসলিম ঘোষণা করা হলে বিদেশি চাপ আসবে। যে চাপ সামলানো প্রায় অসম্ভব। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ঝামেলায় জড়ানো যাবে না বলে হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে। বেফাক ইস্যুতেও আপাতত কোনো উদ্যোগ নিতে চায় না সরকার। বেফাককে সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মানাও আপাতত অসম্ভব, জানিয়েছে সরকার। তবে হেফাজত নেতাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, অন্য শর্তগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।
হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে, ধর্মীয় বিভিন্ন অপপ্রচার চলছে সরকারের বিরুদ্ধে; এসব ব্যাপারে কথা বলতে হবে তাদের। জামায়াতবিরোধী অবস্থান নিয়ে কাজ করতে হবে হেফাজতকে। হেফাজত নেতারা বলেছেন, জামায়াত ইস্যুতে তারা কোনো ছাড় দেবে না। জামায়াতকে তারা ইসলামের ধারক-বাহক মনে করে না।
বলা যায়, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক বোঝাপড়া হয়েছে। এটা একটা ‘পলিটিক্যাল ডিল অর আন্ডারস্ট্যান্ডিং’। জানা গেছে, এ সমঝোতার ভিত্তিতেই হেফাজতের বিরুদ্ধে ২০৩টি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে এবং নেতারা জামিন পেতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে পুলিশকে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে। হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার।
২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় এখনো তদন্ত হচ্ছে ২০৩টি মামলার। অনেক দিন ধরেই তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু সুরাহা করতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থাগুলো। হেফাজত নেতাকর্মীদের অনেকে কারাগারেও আছেন। তবে বেশিরভাগ আসামি প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন।
পুলিশের পাশাপাশি হেফাজত নেতারা মামলাগুলো নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা এগুলোর নিষ্পত্তি চান। এ নিয়ে কয়েক দফা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজত নেতারা। সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হয়েছে। বৈঠকে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীও তাদের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা পেয়ে পুলিশও কাজ শুরু করে দিয়েছে। গত এক মাসে অন্তত ১০ জন নেতা জামিন পেয়েছেন। তারা যেকোনো সময় কারামুক্ত হবেন। তবে মামুনুল হক আপাতত মুক্ত হচ্ছেন না।
হেফাজত নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তারা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন। তারা বলেন, এসবের জন্যই সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়েছি আমরা। তবে সমঝোতার কথা সবিস্তারে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে মৌখিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। হেফাজত নেতারা সরকারের অঙ্গীকার করেছে, তারা রাজনৈতিক কর্মকা- চালাবেন না। শুধু ইসলাম নিয়ে কথা বলবেন। জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা-ের সমালেচনাও করবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশ্বস্ত করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন তদন্তকারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা এসেছে। আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। মামলাগুলোর অনেক আসামি জামিনে আছে, কেউ কেউ জামিন ছাড়াই প্রকাশ্যে ঘুরছে। দীর্ঘদিন ধরে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়ায় সমালোচনাও হচ্ছে সবখানে। এগুলোর দ্রুত সুরাহা চাচ্ছি আমরাও।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ করে তারা। একপর্যায়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। সে সময় হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। তারা রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে যানবাহন ভাঙচুর করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সহিংসতায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
২০২১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরের বিরোধিতা করে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় তাদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয় এবং পুলিশসহ সহস্রাধিক হেফাজত নেতাকর্মী আহত হয়। হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায়। এসব ঘটনায় সারা দেশে ১৫৪টি মামলা হয়। ওইসব মামলার কোনোটাতেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
হেফাজত ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সবাই ছিলেন। বৈঠকে আমরা বলেছি, আমরা কোনো ধরনের রাজনীতি করি না। ইসলাম নিয়ে কাজ করি। একটি মহল আমাদের নামে অপবাদ দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, আমরা রাজনীতি করছি না, আর করবও না।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। আমরাও চাচ্ছি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। হেফাজতের কেন্দ্রীয় এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমরা গত ১৭ ডিসেম্বর বৈঠক করেছি। তাতে সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট বৈঠক হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। আমাদের শর্তও তাকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সমঝোতা ছাড়া কোনো কিছুরই সমাধান হয় না। আমরা চাই না সরকারের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হোক। আমরা কথা বলেছি। সরকারপ্রধান ইতিবাচক হিসেবে বিষয়টি আমলে নিয়েছেন।