
সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মুজীবুর রহমান খাঁ ১৯১০ সালের ২৩ অক্টোবর নেত্রকোনার উলুয়াটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে দৈনিক আজাদ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক (১৯৩৬-৩৯) এবং পরে যুগ্ম সম্পাদক (১৯৩৯-৬৫) হন। পরে তিনি সাপ্তাহিক কমরেড (কলকাতা), মাসিক মোহাম্মদী (ঢাকা) ও দৈনিক পয়গামের সম্পাদক (১৯৬৫-৭১) এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে আজাদ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হন। মুজীবুর রহমান খাঁ বিভিন্ন সামাজিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি অল বেঙ্গল অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট রাইটার্স গিল্ডের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির (১৯৪৪) সম্পাদক, ভারতের প্রথম গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্য (১৯৪৬), পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক (১৯৫৪), পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক এবং বুলবুল ললিতকলা অ্যাকাডেমির সহসভাপতিরূপে দায়িত্ব পালন করেন। ‘বিলাতে প্রথম ভারতবাসী’ (১৯৩৯) গ্রন্থে তিনি বিলাত সম্পর্কে ভারতীয়দের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য তিনি পাকিস্তান সরকারের ‘সেতারা-ই-কায়েদে আজম’ পদক লাভ করেন। ১৯৫৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হলে মুজীবুর রহমান খাঁ প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি নির্বাচিত হন। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত হন তিনি। মুজীবুর রহমান খাঁ ১৯৮৪ সালের ৫ অক্টোবর ঢাকায় নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন।
রাজস্ব আহরণের দুর্বলতা বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির এক বড় সংকট। দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়ে কথা হলেও রাজস্ব আহরণ বাড়েনি। কর-জিডিপি অনুপাত কাম্য মানের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। অন্যদিকে, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে নানা কাজে তহবিল সংকটে ভুগছে সরকার। এজন্য বিভিন্ন দেশে ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পাশাপাশি দেশের আর্থিক খাত থেকেও বিপুল পরিমাণ ঋণ করতে হচ্ছে সরকারকে। এই প্রেক্ষাপটে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশিদের কাছ থেকে প্রতিবছর সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারানোর খবর নিঃসন্দেহে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মঙ্গলবার দেশ রূপান্তরে ‘এক লাখ অবৈধ বিদেশি’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি থেকে এই বিপুল রাজস্ব হারানোর খবরের সঙ্গে জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৯৭ হাজার ৬৯৫ নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। বছরের পর বছর ধরে তারা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। এদের কেউ কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। আবার কেউ অপহরণ, ছিনতাই, প্রতারণাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এই অবৈধ বিদেশিরা অন্যান্য অপরাধের পাশাপাশি বিপুল রাজস্ব ফাঁকি দিয়েও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। প্রশ্ন হলো, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিনিয়োগ উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্র্তৃপক্ষের মতো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর নজরদারি এড়িয়ে এই অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলছে কীভাবে?
বিদেশি নাগরিকদের ভিসার শ্রেণিভিত্তিক অপব্যবহারের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি ও জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকি পর্যালোচনা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের এক সাম্প্রদিক প্রতিবেদনে বিদেশিদের অবৈধভাবে অবস্থান, অপরাধে জড়িয়ে পড়া এবং রাজস্ব ফাঁকির এই চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ২১২টি দেশের ২ লাখ ১২ হাজার ৬৭ জন বিদেশি নাগরিক অবস্থান করছে, যা ২০২১ সালের তুলনায় চারগুণ বেশি। এসব বিদেশির যথাযথ শ্রেণির ভিসা না দেওয়ায় গমনাগমনের তৎপরতা বিগত বছরগুলোর তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশি নাগরিকরা বাংলাদেশে কী কাজ করছে তা নিরীক্ষণের আওতায় আনা দুরূহ হওয়ায় বিদেশিদের অবৈধ অবস্থান দেশের অর্থনীতিকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করছে। ভয়াবহ বিষয় হলো দেশে অবস্থানকারী বিদেশিদের মধ্যে অবৈধভাবে অবস্থানকারীর সংখ্যা ৯৭ হাজার ৬৯৫ জন। অবৈধ অবস্থানকারীদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ৬৮ হাজার ৩০৫ জন, এরপর চীনের রয়েছে ১৬ হাজার ২৩১ জন, ফিলিপাইনের ৯ হাজার ৯১৫ জন, নাইজেরিয়ার ২ হাজার ৬৮ জন, সোমালিয়ার ১ হাজার ১৫ জন, কেনিয়ার ৭৯ জন এবং ক্যামেরুনের ৮২ জন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে অবৈধ বিদেশির তালিকা করার কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া দেশের সব বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনকে সতর্ক করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিটি জেলার পুলিশ সুপারকে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের টনক নড়েছে এটা আশাব্যঞ্জক। বিদেশিদের অবৈধভাবে অবস্থান নিয়ন্ত্রণ করা, অবৈধদের তালিকা করে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করার পাশাপাশি যেসব কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সেসব বন্ধ করা জরুরি। একই সঙ্গে প্রয়োজন বিদেশিদের রাজস্ব ফাঁকি ও অবৈধ অবস্থান নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়।
পুলিশের তথ্য মতে, ভিসা নীতিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশে ৩৭ ধরনের ভিসা শ্রেণি বিদ্যমান। এসব শ্রেণির মধ্যে বিজনেস, ট্যুরিস্ট, স্টুডেন্ট ও ভিসা অন-অ্যারাইভালএই চার ক্যাটাগরির ভিসাতেই ৫১ শতাংশ বিদেশি বাংলাদেশে অবস্থান করছে। আইন অনুসারে বাংলাদেশে বিদেশিদের ৩০ শতাংশ হারে আয়কর প্রদানের বিধান থাকলেও উল্লিখিত চার ক্যাটাগরির ভিসার কারণে সরকার বছরে ৪ হাজার ৫৪১ কোটি ৮৩ লাখ ২০ টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে, ভিসা নীতিমালা পরিপন্থী কার্যক্রম এবং অবৈধভাবে শিল্পকারখানাসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করার সুযোগ পাওয়ায় বাংলাদেশিদের কাজের সুযোগ কমে যাচ্ছে এবং বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সংকট নিরসনের জন্য বিজনেস ও অন-অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে আসার পর এদেশে উপার্জন করতে পারবে কিনা, পারলেও তারা কোন প্রক্রিয়ায় কতদিন পরে আয়কর দেবে সেটার সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অপ্রযোজ্য ভিসা নিয়ে আসা বিদেশিরা যাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে না পারে সেজন্য এ বিষয়ে ত্বরিৎ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। একইভাবে বিনিয়োগ উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্র্তৃপক্ষ এবং গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সমন্বয়ের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়ানো যেতে পারে। অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশিদের কাছ থেকে বিপুল রাজস্ব হারানোর বিষয়টিকে দেশের কর-সংস্কৃতির সামগ্রিক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। ভুলে গেলে চলবে না দেশে এখনো ভ্যাট ও কাস্টম ডিউটিই রাজস্বের প্রথম ও দ্বিতীয় শীর্ষ উৎস। কিন্তু প্রথম অবস্থানে থাকার কথা যে প্রত্যক্ষ আয়করের সেটা রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। এই বাস্তবতা পাল্টাতে হলে দেশের সামগ্রিক কর নীতিমালা সংস্কার করতে হবে এবং দেশ থেকে বিদেশিদের রাজস্ব ফাঁকি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
জন্ম ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯১০ ঢাকাতেই। পড়াশোনা স্কুল পর্ব ঢাকায়, কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় এবং লন্ডন বিশ^বিদ্যালয়ে। সেখানে অর্থনীতির অনার্সে ১৯৩০ সালে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলেন এবং পিএইচডি শুরু করলেন। ওদিকে বিলেতবাসী তার বন্ধুরা আইসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কোমর বেঁধে লেগেছেন। তারা পরীক্ষায় বসতে নবগোপাল দাসকেও প্ররোচিত করেছেন। বাকিটুকু নবগোপাল দাসের লেখা ‘মাই লাইফ ইন দ্য আইসিএস’ থেকে অনুসৃত হলো :
আইসিএসে আমার জীবন
‘দুর্ঘটনাক্রমে’ আমি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দিই। ১৯৩০-এর অক্টোবরে আমি জামসেদজি টাটা বৃত্তি নিয়ে বিলেতে রওনা হই এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সস-এ প্রোব্লেমস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট নিয়ে গবেষণা কর্মে যোগ দিই। বিলেতে আমার কিছু বন্ধু উন্মুক্ত আইসিএস পরীক্ষায় বসতে যাচ্ছে। তারা আমাকেও প্ররোচনা দিল। তাদের কারণে ১৯৩১-এর জুলাই পরীক্ষায় বসলাম এবং ফলাফলে আমি নিজেই বিস্মিত হলামপরীক্ষায় শুধু সফল হয়েছি তা-ই নয়, ভারতীয় পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছি। ভয়ংকর ঝড় ঘনিয়ে এলো যখন লন্ডন স্কুলের কর্তৃপক্ষের কানে গেল যে আমি আইসিএস দিয়েছি এবং টিকেই গেছি। প্রফেসর লায়োনেল (পরে লর্ড) রবিনস স্পষ্টই বিরক্ত হয়েছেন এবং রেগে গিয়ে অনেকটা স্থূলভাবে আমাকে নির্দেশ দিলেন কোন কাজটা করবে ঠিক করোআইসিএস না ডক্টরাল রিসার্চ। (প্রফেসর রবিনস ১৯৯৮-১৯৮৪ নিউ-ক্ল্যাসিক্যাল ঘরানার অর্থনীতিবিদ এবং খ্যাতিমান প্রফেসর)। তাকে সম্মত করাতে আমাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো যে চাকরি আর পড়াশোনার মধ্যে বড় কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আমি পাঁচ বছরের মধ্যে ফিরে এসে আমার ডক্টরাল থিসিস দাখিল করব কারণ আমি রিসার্চ সম্পন্ন করতে খুবই আগ্রহী কিন্তু সরকার বিলেতে আমার অবস্থানকাল বাড়াতে এখনই সম্মত হবে না। ফলে আমি আবার এসে নিয়মিত ছাত্র হয়ে কাজটা শেষ করব। আমি আমার কথা রেখেছি, পাঁচ বছর পেরোনোর আগেই আমি যুক্তরাজ্যে এসে স্কুলে যোগ দিই। থিসিস সম্পন্ন করে লন্ডন বিশ^বিদ্যালয়ের কাক্সিক্ষত অর্থনীতির পিএইচডি লাভ করি।
পাঁচ বছর আইসিএসে কাটিয়ে যুক্তরাজ্যে ফিরে গিয়ে থিসিসের কাজটা শেষ করি। এ সময় অল্প কিছুদিন বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েটে বাদ দিয়ে বাকিটা বাংলার এমনসব জায়গায় কাটাতে হয়েছে যেখানে সভ্যতা প্রবেশ করেনি বলা যায়। জীবন কঠিন ছিল, মজারও। পূর্ব সুন্দরবন বদ্বীপ অঞ্চলে (এখন তা অবশ্যই পূর্ব পাকিস্তানে) চার চাকার গাড়ি ব্যবহার করার কোনো সুযোগই ছিল না এমনকি ঘোড়ার গাড়িও না। এসডিও হিসেবে আমি নৌকা বা লঞ্চই ব্যবহার করেছি। ঘুমোনোর কেবিনসহ চমৎকার একটি ছোট লঞ্চ ছিল। লঞ্চ নিয়ে একবার বেরোলে বেশ কদিন সদর দপ্তর থেকে দূরে কেটে যেত। এসডিওর বোট কিংবা লঞ্চ আসছে মাত্রই সে অঞ্চলের কাজকর্মের ক্ষিপ্রতা ও তীব্রতা বেড়ে যেতসারা দিন কখনো রাতেও আমাকে স্থানীয় অভিযোগ শুনতে হতো। স্থানীয় রাজনীতি এবং দলাদলিও এখনকার মতোই (নবগোপাল দাসের লেখাটি ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত)। তবে প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আমার মনে আছে দুজন স্থানীয় খান সাহেব আমার দৃষ্টিতে আসার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেনএই আশায় যে আমার সুপারিশ গেলে খান বাহাদুর খেতাব পাবেন। এই প্রতিযোগিতায় একজন অন্যজন যে ব্রিটিশ রাজের অনুগত ননএটা প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগতেন। আনুগত্যের প্রশ্নে আমার চাওয়া কী সে কথা আমার অজান্তে আমার আগেই সেখানে গিয়ে পৌঁছেছে। দুজনের মধ্যে যিনি জ্ঞানী তিনি বাজে বিশেষণ ব্যবহার না করে কেবল কটাক্ষ করে গেছেন। সেই দিনগুলোতে (তিরিশ ও চল্লিশের দশকের প্রথম ভাগ) অবিভক্ত বাংলার জেলা কর্মকর্তার প্রধান সমস্যা ছিল ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে সহিংস ও তিক্ত গণ-উত্থান ঠেকানো। লন্ডনের হোয়াইট হল এবং দিল্লির কর্মকর্তারা সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি হাতে তুলে নিলেন। তারা আদাজল খেয়ে লেগেছেন মুসলমানদের হিন্দুদের কাছ থেকে এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে সরিয়ে নিতে হবে।
১৯৩৮ সালে আমাকে জেলা থেকে কলকাতায় সচিবালয়ে বদলি করা হলো। আমার দায়িত্ব বাংলার মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণদের বেকারত্ব নিয়ে কাজ করা (সে আমলে এই বয়সী নারীর বেকারত্বের সমস্যা কোনো দুর্ভাবনার বিষয় হয়ে ওঠেনি কারণ তাদের প্রায় সবাই বিয়ে করে সংসারী হওয়াতে সন্তুষ্ট থাকত।) এ কাজে চ্যালেঞ্জ ছিল। আমাকে বেকারত্বের প্রকৃতি ও বিস্তার নিয়ে সমীক্ষা চালাতে হতো এবং যত বেশি সম্ভব তরুণকে চাকরিতে অন্তর্ভুক্ত করার মতো পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হতো। দুবছর এই দায়িত্বে থাকাকালে আমি দুটো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন এবং বেশ কটি প্রকল্প দাখিল করি। কিন্তু এসব বাস্তবায়নের আগেই আমি বদলি হয়ে যাই। ১৯৪০-এ আমাকে ভারত সরকারের কৃষি বিপণন উপদেষ্টা করে দিল্লিতে পাঠানো হয়। যদিও আমার আগ্রহ তখন বেকার সমস্যা সমাধান। সে আগ্রহটি অব্যাহত থাকার কারণে ১৯৪৪ সালে আমি এ বিষয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করি। বইটি ভারতীয় পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটি বস্তুনিষ্ঠ কাজ বলে প্রশংসিত হয়। বেঙ্গল ক্যাডারের আরও অনেক অফিসারের সঙ্গে দিল্লিতে আমার তিন বছরের কিছু বেশি সময় কাটে। ১৯৪৩-এ মানবসৃষ্ট মন্বন্তরের মোকাবিলায় আমাকে আবার বাংলায় ডাকা হয়। দিল্লিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ভূমিতে কাজ করার সময় প্রায় দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করা কর্মকর্তারা আমার মতামত উড়িয়ে দিতে চাইতেন; আমি যখন মনে করতাম আমার প্রস্তাবই সঠিক, আমি আমার অবস্থান থেকে সরতাম না। মহীশুরের উন্নয়নমন্ত্রী আমাকে দেখে বিশ^াস করতে পারেননি যে আমি প্রদত্ত দায়িত্ব পালনের যোগ্য। অনেকটা নির্দয়ভাবেই তিনি এমন ‘অপরিপক্ব’ একজন অফিসারকে মহাযুদ্ধকালে পদায়ন করার সমালোচনা করলেন। আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম, অল ইন্ডিয়া প্যানেল থেকে আমাকে বেছে নেওয়া হয়েছে, তাদের চাহিদা পূরণ করতে পেরেছি বলেই আমাকে নিয়োগ দিয়েছে।
বাংলায় পদায়ন হলো সিভিল সাপ্লাই বিভাগে। আমার দায়িত্ব অনুমোদিত এজেন্টের মাধ্যমে অন্যান্য প্রদেশ থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা। কিন্তু আমার জন্য আসা আঘাতের একটি অভিজ্ঞতা হচ্ছে, অনুমোদিত ডিলাররা মিথ্যাচার করে নিরন্ন মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে সবচেয়ে কম সময়ে সর্বাধিক মুনাফা আদায় করে নিয়েছে। একাধিক ঘটনায় আমি এই সত্যটি ব্রিটিশ সিভিল সাপ্লাই কমিশনারকে জানালে তিনি তা শুধু উপেক্ষাই করেননি তাদের অসদুপায়ে প্রশ্রয় দিয়েছেন। বিশেষ করে মুশকিল লীগের সমর্থনপুষ্ট মুসলমান ডিলারদের ব্যাপারে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই তার চোখ বন্ধ রাখতেন। মুসলিম লীগকে সন্তুষ্ট করা ছিল তার জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শিগগিরই যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন বিভাগে উচ্চতর পদে বদলি হলে অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে রেহাই পাই।
নবসৃষ্ট এই বিভাগে আমার অবস্থান স্বল্পকালীন, যুদ্ধ শেষ হয়ে আসে (জার্মানি ও ইতালি আত্মসমর্পণ করে আর হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ জাপানকে হাঁটুগেড়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে)। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়লে বেসামরিক জীবনে তাদের পুনর্বাসন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। আমাকে পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ বাংলা, আসাম, মণিপুর ও ত্রিপুরার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা ও দেশভাগ এসে যায়। তুলনামূলকভাবে অনেক কম বয়সে (তখন আমার ৩৭ চলছে) আমাকে সর্বভারতীয় পুনর্সংস্থান ও কর্মনিয়োগের মহাপরিচালক করা হয় হেডকোয়ার্টার দিল্লিতে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ এই পাঁচ বছর আমর আইসিএস জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আমি অত্যন্ত সদয় মন্ত্রী ও সচিবদের পেয়েছি। আমি স্বাধীনভাবে পুনর্বাসন ও পুনঃবসতি স্থাপনের প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। এ সময়ই সারা ভারতে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ ও টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। ১৯৪৮-এ সানফ্রান্সিসকোতে এবং ১৯৪৯-এ জেনেভায় আমি ইন্টারন্যাশনাল লেবার কনফারেন্সে ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছি।
১৯৫১ ছিল আমার কর্মজীবনের জন্য একটি মোড় ঘোরানো বছর। পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায় আমাকে শিল্প ও বাণিজ্য বিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য ডাকলেন। ভারতের অন্যতম শিল্পায়িত এই রাজ্যে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ। আমার সময়ই ভারতের প্রথম তিনটি স্টিলমিলের একটি পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুরে স্থাপন করতে সক্ষম হই। (তারপরের পর্বটা সুখকর ছল না। পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি ও প্রশাসন তার মধ্যে অনিচ্ছাকেই করে তুলেছে। নিরপেক্ষ পরামর্শ নেতৃত্বের হাতে পড়ে তুচ্ছ প্রতিপন্ন হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের জন্য শাকদের এক ধরনের দৃঢ়তার প্রয়োজন ছিল সত্য কিন্তু তারা অধিকাংশ সময় নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। আশ্চর্যের কিছু নেই। ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের সঙ্গেই তার পরামর্শ ও মতামতের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং তা চলতে থাকে।) আমি যখন রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের স্পেশাল সেক্রেটারি, আমার দায়িত্ব অনুযায়ী দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে রিপোর্ট করে যাচ্ছি এবং কয়েকজনের বিরুদ্ধে প্রতিকারের নির্দেশনা চেয়েছি। আমাকে একটি কোমল সতর্ক বার্তা দিয়ে বলা হয় গো সেøাআস্তে চলো। একটু রয়ে সয়ে চললে আমাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদানের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। কিন্তু আমার ভেতরের গোঁয়ার্তুমি এতটাই যে আমি তাদের এসব পরামর্শ পাত্তা দিলাম না। ফলে বিভিন্ন জায়গায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হলো এবং আমার জন্য তা মানসিক যন্ত্রণা ও বিরক্তির কারণ হলো।
এ সময় একটি অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব আমাকে এই যাতনা থেকে রক্ষা করে। এমপ্লায়ার্স ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার মহাপরিচালক হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়, হেড অফিস বোম্বে (এখন মুম্বাই)। এই সংস্থা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই কিংবা এই সংস্থার প্রেসিডেন্ট বা পরিষদের কেউ আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেনও না। তবে তারা আমার কথা জানেন এবং তাদের প্রস্তাব লোভনীয় আইসিএস জীবন ছেড়ে তাদের সংস্থার প্রধান নির্বাহী হওয়া। আইসিএস ছাড়া কিংবা না ছাড়ার বিষয়ে আমার জন্য একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। যদি সময়ের কারণে পুরো পেনশন দাবি করতে পারি কিংবা এটাও সত্য যে আরও দশ বছর আইসিএস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রাখতে পারি। অন্যদিকে আমি এখনকার মতো যাতনা ভোগ করা অব্যাহত রাখতে পারি। আমার যেকোনো উদ্যোগে চিফ মিনিস্টার যা বলবেন সেটাই চূড়ান্ত, আবার এটাও সত্য তিনি চাইলে আমাকে অন্য কোথাও সরিয়ে দিয়ে তার ও আমার মাথাব্যথা অপসারণ করতে পারেন। শেষ পর্যন্ত এমপ্লায়ার্স ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট স্যার হোমি মোদির বশীকরণ ক্ষমতা আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করল। ৩১ ডিসেম্বর ১৯৫৮ থেকে আমি আইসিএস থেকে পদত্যাগ ও অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলাম এবং ব্যক্তিমালিকানা খাতে প্রথম চাকরিতে যোগ দিলাম। ১৯৫৯-এর ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৬৩-এর শেষ পর্যন্ত ৫ বছর আমি ওই ফেডারেশনের মহাপরিচালকের পদে ছিলাম।
আইসিএস ছেড়ে আসার পর থেকেই বন্ধু ও স্বজনদের অনেকেরই প্রশ্ন চাকরি জীবনের শীর্ষ অবস্থানে উঠে আইসিএস ছেড়ে দেওয়ার কোনো দুঃখ আমার আছে কি না? বরাবরই আমার একই জবাব ‘না’। কোন ‘না’, তার দুটি প্রধান কারণ। প্রথমত, আমি ভাগ্যবানদের একজন। চাকরি জীবনের প্রথম পর্যায়েই কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকারের সর্বোচ্চ সচিব পদে অধিষ্ঠিত হয়েছি। এসব পদ সিভিল সার্ভিসে যে কারোরই পরম প্রত্যাশিত। আমি জানি আমি যদি আইসিএস হিসেবে চাকরি চালিয়ে যেতাম তাহলে আরও বড় পদ পেতাম, বেশি বেতন, বেশি ক্ষমতা ও দায়িত্ব পেতাম। কিন্তু এজন্য এক ধরনের উদ্যোগ থাকতে হয় ও নাছোড়বান্দা টাইপের হতে হয়। এখানে আমি একেবারেই অক্ষম। দ্বিতীয়ত, আমার স্বাধীনতা লাভের বাসনা ছিল। শুধু স্বাধীন চিন্তা নয়, স্বাধীনভাবে নির্ভয়ে মনোভাব প্রকাশ করার ইচ্ছে ছিল। সরকারি চাকরি না ছাড়লে এই স্বাধীনতা উপভোগ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যদিও আইসিএস হিসেবে আমি যতটা স্বাধীনভাবে চলেছি, আমার চাকুরে বন্ধুরা তা কল্পনাও করতে পারেনি। এটা ঠিক সরকারি আইনকানুন সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। চাকরিতে নাম লেখানোর সঙ্গে সঙ্গে যে শৃঙ্খলার প্রতি আনুগত্য ঘোষিত হয়েছে সেখান থেকে আমাদের বের হওয়া সম্ভব ছিল না। আমি যুক্তি দেখাই আমি যদি চাকরি ছেড়ে দিই তাহলে ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে আমি অবাধে আমার চিন্তাধারা প্রকাশ করতে পারব।
২৬ বছর আইসিএস থাকার স্মৃতি আমি লালন করি। আমার অভিজ্ঞতা তুলনাহীন। আমি খুব কাছে থেকে কেন্দ্রীয় সরকার কেমন করে কাজ করে দিল্লিতে তার অংশ হয়ে অবলোকন করেছি। কলকাতায় থেকে দেখেছি রাজ্য সরকার। আমি ব্রিটিশ রাজের অধীনে পনেরো বছর এবং স্বাধীন ভারতে এগারো বছর চাকরি করেছি। প্রথম ভারতীয় আইসিস (১৮৬৩ সালে যোগদানকারী)। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা স্মরণ না করে পারি না। স্বাধীনতা ক্ষুণœ হয়ে যাচ্ছেএজন্য তিনিও আইসিএস ছেড়ে এসেছেন।
অনুসৃতি লেখক: সরকারের সাবেক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট
সাফ ফুটবলে বাংলাদেশের নারীদের সফলতার চমকে চারদিকে নারী ফুটবলারদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশংসার ছড়াছড়ি। এ দেশের নারী ফুটবলাররা আবারও তাদের সামর্থ্যরে প্রমাণ দিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার ভারতের মতো বড় দেশ এবং নেপালের মতো নারী ফুটবলের শক্তিশালী দেশকে পরাজিত করেছেন তারা। আজকে যাদের সফলতার গল্প বলা হচ্ছে এবং বিজয় উদযাপন করা হচ্ছে তাদের উঠে আসার গল্প কোনোভাবেই এত সহজ ও সরল ছিল না। এই ফুটবলারের অনেককেই পরিবার ও সামাজিক পর্যায় থেকে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। পাশাপাশি অবকাঠামোগত সমস্যা তো ছিলই। আমাদের দেশে যেখানে মেয়েদের স্কুল-কলেজে যেতে বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়, সেখানে মাঠে ফুটবল খেলা মোটেও কোনো সাধারণ বিষয় নয়। তথ্য মতে, শিশু অবস্থায় বিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীতে তৃতীয়। এখনো এ দেশে প্রায় ৬৬ শতাংশ কিশোরী বাল্যবিয়ের শিকার হয়। বলাবাহুল্য, এদের একটি বড় অংশ জোর করে বাল্যবিয়ের শিকার, এর বাইরেও আছে বিভিন্ন ধরনের বঞ্চনা, যৌন হয়রানি ও সামাজিক গঞ্জনা। এত কিছুর পর এই নারীদের সফলতা একদিকে যেমন তার সক্ষমতার প্রকাশ, অন্যদিকে তার অফুরন্ত প্রাণশক্তি ও অসীম সম্ভাবনার কথা সবার সামনে উন্মোচন করে। বাংলাদেশের সব অর্জনের পেছনে নারীদের অবদান কোনো অংশে কম নয় বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। এর মধ্যেই আমরা কলসিন্দুরের মেয়েদের উঠে আসার গল্প শুনেছি। একই সঙ্গে শুনেছি কোনো পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে এই নারীরা ফুটবলের মতো একটি খেলায় আগ্রহী উঠেছেন এবং কারা কারা এই পরিবর্তনের গল্পে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন ইত্যাদি।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির পেছনে রয়েছে নারীদের ক্ষমতায়ন। আজকে বাংলাদেশের যতটুকু সামাজিক অগ্রগতি ও অচলায়তন ভাঙার যে দৃষ্টান্ত তা নারীর ঐতিহাসিক ও ধারাবাহিক সংগ্রামে সমৃদ্ধ। শুধু সামাজিক অগ্রগতিই নয়, আধুনিক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনে যতগুলো ক্ষেত্র আছে নারী তার পেছনের প্রধানতম অনুঘটক। আমাদের দেশের কৃষিতে গ্রামীণ নারীর ভূমিকার কথা তো সবার জানা। যে ক্ষুদ্রঋণকে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় তার শুরুই হয় নারীদের হাত ধরে ও তার দক্ষ ব্যবস্থাপনায়। অন্যদিকে আজকে যা আমাদের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশ, সেই পোশাক খাত দাঁড়িয়ে আছে নারীদের দক্ষতা ও শ্রমশক্তির ওপর। যদিও নারীরা এ ক্ষেত্রে তার যোগ্য প্রতিদান পান না। আর এই রপ্তানিই জোগান দেয় মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা, যে বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে আমরা অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহ আমদানি করে থাকি। ভেবে দেখুন তো আজকে যদি নারীরা পোশাক খাতে ভূমিকা রাখা কমিয়ে দেন বা বন্ধ করেন, তাহলে কী হবে? যদিও এতসব অবদান রাখার পরও নারীকে পদে পদেই অনেক বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হতে হয়। শুধু রপ্তানি খাতই নয় সাম্প্রতিককালে অভিবাসী শ্রম থেকেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে নারীদের অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে বাড়ছে। তার পরও বাংলাদেশে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ এখনো সীমিত। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ৩৫ শতাংশ। এর মানে নারী কর্মশক্তির একটা বড় অংশ শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ করতে পারে না যতটা নিজের জন্য তার থেকে অনেক অনেক বেশি পারিপার্শ্বিক কারণে। আমাদের সমাজে এ রকম দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি যে বিয়ের আগে চাকরি করলেও বিয়ের পরে নারীরা শ্বশুরবাড়ির চাপে কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের মধ্যে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে এসব সামলিয়ে যারা শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন তাদের ৯০ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক, হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের পরিবারের একটু আর্থিক সচ্ছলতা আনতে সর্বদা সচেষ্ট। এসব দৃষ্টান্তই বলে দেয় অনেক প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের নারীরা তার সাধ্যের সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা করছেন; মেধা, প্রজ্ঞা, শৃঙ্খলা ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যবসায়ের মাধ্যমে। কিন্তু এই নারীদের জন্য যদি আরেকটু সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা যেত, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা নিশ্চিত করা যেত তাহলে তার ইতিবাচক ফলাফল আরও অনেক বেশি হতে পারত। অভিজ্ঞতায় বলে নারীদের ওপর স্বল্প বিনিয়োগেই প্রাপ্তি অনেক বেশি; তা যেমন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিম-লে, তেমনি অর্থনীতিতেও। তার সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে বাংলাদেশের নারী দলের সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়া!
এখন বাংলাদেশ উন্নয়নের একটি পথপরিক্রমায় আছে। আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে ও বাড়বে। কিন্তু উন্নয়নের একই অগ্রযাত্রাকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে হলে নারীদের ওপর বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। আর এই বিনিয়োগের ঝুঁকি একেবারেই নেই পক্ষান্তরে আছে অনেক অনেক সফলতার সম্ভাবনা, যেটা আজকের পৃথিবীতে শুধু কাম্যই না অবশ্য প্রয়োজনীয়। কারণ এই বিশ্বায়নের যুগে কোনো মানদণ্ডই শুধু নিজস্ব ব্যবস্থাপনার আলোকে নির্ধারিত হয় না, অধিকন্তু এখানে প্রতিযোগিতা হয় বৈশ্বিক পরিম-লে, তাই উন্নতিও করতে হয় বৈশ্বিক মানদণ্ডের আলোকে। ব্যবস্থাপনাটা নিজস্ব কিন্তু প্রতিযোগিতা বৈশ্বিক। তাই প্রথাগত ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা ছাড়া বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সুফল পাওয়া অনেক কষ্টসাধ্য। বাংলাদেশের নারীরা তার সম্ভাবনার বিচ্ছুরণ সবার সামনে দেখাতে পেরেছেন। এখন দরকার তাদের সম্ভাবনার ওপর ভরসা করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। আর এ ক্ষেত্রে তাদের যে যে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় তা দূর করা দরকার সবার আগে। আমরা জানি এই প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে রয়েছে নারীকে এখনো পারিবারিক পরিসরে আটকে রাখার প্রবণতা, নারীর জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ তৈরি করতে না পারা এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে না পারা। আশার কথা হচ্ছে, নারীর পথচলা মসৃণ করতে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের নীতি-আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। অনেক নীতি ও আইনপ্রণয়ন করা হলেও নানামুখী চাপে এদের মধ্যে কোনো কোনোটিকে আবার হিমাগারেও পাঠানো হয়েছে। তাই সব নীতিমালা বাস্তবায়নে এক ধরনের শিথিলতা দেখা যায় এবং এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য যে সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরি করার কথা সেখানেও খুব একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। প্রতি বছরের মতো এবারও দেশে পালিত হয়েছে ‘জাতীয় কন্যাশিশু দিবস’। এবারের কন্যাশিশু দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘সময়ের অঙ্গীকার, কন্যাশিশুর অধিকার’। ময়মনসিংহের কলসিন্দুরসহ সারা বাংলার যে মেয়েরা দেশ ও দক্ষিণ এশিয়া জয় করেছেন এবং এ ক্ষেত্রে তারা যে দক্ষতা, অধ্যবসায় ও সামর্থ্যরে পরিচয় দিয়েছেন, তা দেশের অন্যান্য প্রান্তেও ছড়িয়ে দিতে হবে। আর এজন্য দরকার আলোকিত কিছু মানুষ, সহায়ক পরিবেশ এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা।
লেখক : উন্নয়নকর্মী
আজ ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’। সারা বিশ্বে সরকারি উদ্যোগে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালিত হলেও বাংলাদেশে সরকারিভাবে পালনের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। তবে ইউনেসকো কমিশন, কিছু শিক্ষক সংগঠন ও দু-একটি এনজিও দিবসটি পালন করে থাকে। ১৯৬৬ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে এবং ইউনেসকোর তত্ত্বাবধানে প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধিদের এক সভায় এই দিনটিকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ওই সভায় শিক্ষকদের মর্যাদাবিষয়ক একটি সুপারিশমালা গৃহীত হয়। ‘আইএলও’ এই সুপারিশমালা অনুসমর্থন করে। এই সুপারিশমালাটি মূলত বিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য রচিত হয়েছিল। পরে ইউনেসকো ও আইএলওর ১৯৭৭ এবং ১৯৮৮ সালে শিক্ষকদের মর্যাদাবিষয়ক আরও দুটি ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে। ফলে সর্বস্তরের শিক্ষকের অধিকার, মর্যাদা ও কর্র্তৃত্ব সমন্বয়ে ইউনেসকো-আইএলও একটি অভিন্ন নীতিমালা তৈরি করে। এসব নীতিমালা বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তায় জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর।
ইউনেসকো দিবসটি উপলক্ষে প্রতি বছর ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে থাকে। এবারের প্রতিপাদ্যশিক্ষার রূপান্তর শুরু হয় শিক্ষকদের মাধ্যমে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানান আয়োজনে শিক্ষক দিবস উদযাপন করে থাকে। পাশের দেশ ভারতে একটি বিশেষ দিনে শিক্ষকদের সম্মানে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এদিন শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের মিষ্টিমুখ করান এবং বিভিন্ন উপহারসামগ্রী দেন। শিক্ষকরাও তা উপভোগ করেন এবং তাদের সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের আশীর্বাদ করেন। শিক্ষকদের সম্পর্কে এক জাপানির প্রবাদে বলা হয়‘সহস্র দিবসের পাঠচর্চা অপেক্ষা একজন মহান শিক্ষকের এক দিনের সান্নিধ্য অনেক ভালো।’ গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের মতে‘যারা শিশুদের শিক্ষাদানে ব্রত তারা অভিভাবকদের থেকেও অধিক সম্মানীয়।’ বাংলাদেশে শিক্ষার অধিকার ও শিক্ষকের মর্যাদার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। টানা ২০০ বছরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং তেইশ বছরের পাকিস্তানি শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন ও শিক্ষা-সংকোচননীতি শিক্ষা ও শিক্ষকের মর্যাদার ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ফলে শিক্ষা-দীক্ষায় আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ি। বাংলাদেশে একসময় শিক্ষকদের কোনো বেতনই দেওয়া হতো না। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৪৪ সালে শিক্ষকদের জন্য মাসিক ৫ টাকা ভাতা চালু হয়। তখন শিক্ষক বলতে বোঝাত জীর্ণশীর্ণ চেহারা, মলিন জামা, পায়ে ছেঁড়া জুতা, হাতে তালি দেওয়া ছাতা।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে বঙ্গবন্ধু সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষার ভিত রচনা করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে একসঙ্গে ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিলেন। তিনি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন পঁচাত্তর টাকা এবং কলেজ শিক্ষকদের বেতন একশ টাকা চালু করেছিলেন। তখন অনেকেই অর্থনৈতিক সংকটের কথা উল্লেখ করে ওই মুহূর্তে শিক্ষায় এত বিপুল পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি সোনার বাংলা গড়বএজন্য সোনার মানুষ চাই। সেই সোনার মানুষ তৈরি করবেন আমার শিক্ষকরা। তাদের পেটে ক্ষুধা রেখে সোনার মানুষ তৈরি করা সম্ভব নয়।’ শুধু তা-ই নয় দেশের শিক্ষানীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শিক্ষকদের মেধা মননের সৃজনশীল চিন্তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে গঠিত শিক্ষা কমিশন তার প্রমাণ। তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. এ আর মল্লিক ও অধ্যাপক কবির চৌধুরীকে স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষাসচিব করেছিলেন। শিক্ষকদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর এরূপ অনুরাগ, ভালোবাসা ও সম্মান জানানোর এ রকম অনেক নজির রয়েছে। কালের বিবর্তনে আমাদের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধাও বেড়েছে। বর্তমান সরকার শিক্ষার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তথাপিও শিক্ষা খাতে এখনো নানান সমস্যা বিরাজমান। শিক্ষকদের মর্যাদার ক্ষেত্রেও অনেক ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৯৮ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত। এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা ও গভর্নিং কমিটির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানসহ শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি নির্ভর করে এসব কমিটির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। কমিটিতে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অনেক অনাকাক্সিক্ষত ব্যক্তি অযাচিত হস্তক্ষেপ করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে শিক্ষকদের মর্যাদা ও শিক্ষার মানোন্নয়নে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। মর্যাদার সঙ্গে শিক্ষকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধার বিষয়টিও জড়িত। একজন শিক্ষক যদি তার জীবিকা নির্বাহের জন্য কর্র্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সাপোর্ট না পান তখন তিনি জীবিকা নির্বাহের জন্য টিউশনি বা পার্টটাইম অন্য কোনো পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে বাধ্য হন। অনেক ক্ষেত্রে সেটা তার শিক্ষকতা পেশা বা সম্মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আবার শুধু আর্থিক সচ্ছলতার ওপরই একজন শিক্ষকের মর্যাদা নির্ভর করে না। শিক্ষকতা পেশা যেহেতু জ্ঞানচর্চা বা জ্ঞান বিতরণের সঙ্গে জড়িত, তাই রাষ্ট্র বিনির্মাণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের কতটুকু ভূমিকা রাখার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে সেটাও বিবেচ্য বিষয়। একসময় বাংলাদেশে জাতীয় সংসদে শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান, অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ, সামসুল হকসহ অনেক শিক্ষকই জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বর্তমানে জাতীয় সংসদে শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব একেবারেই নগণ্য। জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ঘোষিত জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৮ শতাংশ এবং সর্বশেষ ডাকারে অনুষ্ঠিত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষামন্ত্রীদের সভায় আপাতত জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ সরকারও এই সিদ্ধান্তে স্বাক্ষরকারী দেশ। কিন্তু আমাদের সরকার শিক্ষা খাতে জিডিপির ২.০৮ শতাংশের বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
অথচ ১৯৭০ সালের এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সুষ্ঠু সমাজ গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর হইতে পারে না।’ বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করেছে। এই লক্ষ্য অর্জনে সরকার কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক ঘোষণা করেছে। এতে করে শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি আমূল পরিবর্তন ঘটবে বলে সবাই আশা প্রকাশ করছেন। তবে শিক্ষার নতুন ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জও সরকারকে মোকাবিলা করতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে এখন থেকেই সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য বাজেটে শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। শিক্ষকদের ব্যাপকভাবে ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি তাদের পর্যাপ্ত আর্থিক সুযোগ-সুবিধা এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে। দেশ গঠনে তাদের অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ সেক্রেটারি, ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব টিচার্স ইউনিয়ন
সরকারি হিসাবে চলতি বছরে বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা হবে প্রায় দ্বিগুণ। পরের দুই বছরে কিছু পুরনো ও অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা হলেও অতিরিক্ত সক্ষমতা হবে প্রায় দেড়গুণ। অথচ আদর্শ মান অনুযায়ী অতিরিক্ত সক্ষমতা সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ হওয়া উচিত। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ আমদানি ও নতুন কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি সংকট ও সঞ্চালন-বিতরণ লাইনের সীমাবদ্ধতার কারণে সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। ফলে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে।
তাদের মতে, সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে যত মনোযোগ দিয়েছে তার তুলনায় বিতরণ ও সঞ্চালন লাইন বাড়ানো হয়নি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাথমিক জ্বালানির সংস্থানও টেকসই করা হয়নি। অথচ কেন্দ্র ভাড়া বাড়ার পাশাপাশি সরকারের বিনিয়োগ অলস পড়ে থাকার মাত্রা বাড়ছে। এ অবস্থা চললে ভবিষ্যতে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও লোকসান কমানো কঠিন হয়ে পড়বে। এতে বিদ্যুৎ খাতের অস্থিরতা বাড়বে।
পিডিবির সূত্রমতে, দেশে গ্রিড বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ২৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ বিভাগ এটিকেই উৎপাদন ক্ষমতা বলে প্রচার করছে। প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিল সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। সাধারণত গড়ে ১১-১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। বর্তমানে ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির করা হচ্ছে। ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে আরও দেড় হাজার মেগাওয়াট আমদানি করা হবে আগামী মার্চে।
বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৪০ সালের মধ্যে ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ২০৩০ সাল নাগাদ নেপাল থেকে ৫০০ মেগাওয়াট আমদানির লক্ষ্যে কাজ করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
পিডিবির পরিচালক মোহাম্মদ শামীম হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রতি বছর বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। সে হিসাবে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন সক্ষমতা ও চাহিদার মধ্যে ফারাক বেশি মনে হলেও সক্ষমতা থাকার পরও জ্বালানি স্বল্পতার কারণে চাহিদার পুরো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। অনেক কেন্দ্র কারিগরি ত্রুটি ও মেইনটেনেন্সের কারণে বন্ধ রাখতে হয়। এসব বিবেচনায় নিলে সক্ষমতা বেশি নয়।’
বুয়েটের অধ্যাপক ড. ম তামিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় ১০ থেকে ২০ শতাংশ অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাই যথেষ্ট। এর বেশি সক্ষমতা মানে বিপুল আর্থিক বোঝা। কাগজে-কলমে যে সক্ষমতা এখন আছে সেটা অনেক বেশি। আরও বেশি হলে কীভাবে এফোর্ড করব। এর ফলে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বাড়বে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেমন বিদ্যুৎ নিতে না পারলেও ৫ হাজার কোটি টাকা “ক্যাপাসিটি পেমেন্ট” দিতে হয়েছে। ভারতের আদানিকেও মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘২০২৭ সাল নাগাদ প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। এসবের জ্বালানির পুরোটাই আমদানিনির্ভর। প্রশ্ন হলো, এ আমদানি ব্যয় কি বহন করা সম্ভব? যদি না পারি তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও এসব কেন্দ্রের জন্য ভাড়া গুনতে হবে। এ টাকা কে দেবে? গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েই কি তা সম্ভব? কার্যত নানাভাবে ভোক্তার পকেট থেকে এ টাকা যাবে।’
পিডিবির তথ্যমতে, সরকারি-বেসরকারি ও যৌথ উদ্যোগে ১৭টি কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে, যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট। ১০ হাজার ৮৬৯ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০২৫ সালের মধ্যে উৎপাদনে আসবে। ১৭টি কেন্দ্রের ১৩টি বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবে। এসবের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৬৫০ মেগাওয়াট। আরও ৬৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাঁচটি কেন্দ্র নির্মাণের দরপত্রের আওতায় রয়েছে। পরিকল্পনাধীন কেন্দ্রের মধ্যে ৫৮৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার আটটি কেন্দ্রে উৎপাদন শুরু করার কথা রয়েছে ২০২৫ সালের মধ্যে। এ ছাড়া ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে চলতি বছর ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে। অন্যদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট উৎপাদন শুরু হবে ২০২৫ সাল নাগাদ। সব মিলে দুই বছর পর দেশের মোট উৎপাদন সক্ষমতা অন্তত ৩৯ হাজার ৩০০ মেগাওয়াটে দাঁড়াবে। অথচ তখন বিদ্যুতের চাহিদা হবে ১৯ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট।
আগামী দুই-তিন বছরে ৭-৮ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কিছু পুরনো ও তেলবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা হলেও ২০২৫ সালে উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে প্রায় ৩৩ হাজার মেগাওয়াটে। বিভিন্ন ধরনের কারিগরি ক্ষতি ও কেন্দ্রের নিজের ব্যবহার্য বিদ্যুৎ বিবেচনায় নিলেও চাহিদার তুলনায় তখন বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা অন্তত ৫০ শতাংশ বেশি হবে। যদিও চাহিদা এর চেয়ে কম হবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। কারণ এর আগের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী চাহিদা কমেছে।
প্রক্ষেপণ অনুযায়ী চাহিদা কমলেও উৎপাদন কিন্তু বেড়েই চলেছে। যেমন চলতি বছর পর্যন্ত বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৩০৮ মেগাওয়াট ধরা হলেও পিডিবির হিসাবে তা দাঁড়াবে প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট। প্রক্ষেপণ অনুযায়ী চাহিদা কমে যাওয়া ও উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ার ফলে প্রায় অর্ধেক কেন্দ্র অলস বসে থাকবে।
ড. তামিম বলেন, ‘গত চার-পাঁচ বছরে শিল্পকারখানার সম্প্রসারণ আশানুরূপ হয়নি। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে শিল্পে গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুতের চাহিদা তেমন বাড়েনি। এ কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কম। সরকার বিদ্যুতের যে সক্ষমতার কথা বলছে তা আসলে কতটুকু সত্য আমরা জানি না। প্রকৃত চিত্র আমাদের দেখানো হয় না।’ তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালে বিদ্যুৎ নিয়ে যে প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল সে অনুযায়ী চাহিদা বাড়েনি। অথবা চাহিদা বেড়েছে কিন্তু সে অনুযায়ী সরবরাহ করতে না পারায় চাহিদা কম দেখানো হচ্ছে। ক্লিয়ার পিকচার আমরা পাচ্ছি না। পরিকল্পনা আরও সতর্কভাবে করা দরকার।’
নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র করার দরকার নেই এমন মন্তব্য করে ড. তামিম বলেন, ‘আমার জানামতে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে যেগুলো ঠিকমতো গ্যাস পেলেও উৎপাদন করতে পারবে না। এগুলো বন্ধ করে তেলবিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা কমানো দরকার। এতে বিদ্যুতের চাহিদাও মিটবে, উৎপাদন ব্যয়ও কম হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সত্যিকারের চাহিদার প্রক্ষেপণ করা। জাইকা পুরনো “জিডিপি গ্রোথ” ধরে একটা প্রক্ষেপণ করছে। আমি এটার বিরোধী। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। আমরা যে “ইকোনমিক গ্রোথ”-এর কথা বলছি সেটা কিন্তু পলিটিক্যাল গ্রোথ। বাস্তব নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে ৮-৯ শতাংশ সাসটেইনেবল গ্রোথ হয়েছে এমন নজির নেই। গত ছয়-সাত বছরে আমাদের যে সর্বোচ্চ ইকোনমিক গ্রোথ হয়েছে তা কি এনার্জি ইনটেনসিভ ইকোনমিক গ্রোথ? নাকি অন্য ফ্যাক্টর আছে এখানে? বিবেচনায় নিতে হবে। ২০১৭ সাল থেকে আমরা যে শিল্পপ্রবৃদ্ধি হিসাব করছি তা কিন্তু হয়নি। গত কয়েক বছরে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে আবাসিক খাতে। শিল্পে বেড়েছে খুবই কম।’
বিদ্যুতের চাহিদার প্রক্ষেপণ কঠিন নয় উল্লেখ করে অধ্যাপক তামিম বলেন, ‘আগামী পাঁচ বছরে কী পরিমাণ শিল্পকারখানা হবে, কত বিদ্যুৎ লাগবে তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকেই জানা সম্ভব। অন্যান্য খাতের তথ্যও জানা সম্ভব। ছড়িয়ে থাকা তথ্যগুলো একত্রিত করলেই আসল হিসাবটা পাওয়া সম্ভব। একটু সময় দিলে নিখুঁত চিত্র পাওয়া যাবে।’
বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির বড় একটি অংশ আমদানি করতে হয়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়া বা কমার প্রভাব পড়ে দেশের বিদ্যুৎ খাতে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে না এলে বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সমস্যা থেকেই যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অপরিকল্পনা, অদক্ষতা আর কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় কেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। সরকারের দাবি অনুযায়ী চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। তাহলে আমদানি কেন? বিদ্যুৎ আমদানি ও অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা দরকার। নইলে বিদ্যুতের দাম বেড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।’
তিনি বলেন, ‘উচ্চমূল্যে জ্বালানি আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে দাম বাড়তেই থাকবে। অথচ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে অনেক কম দামে টেকসই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। সরকারের কমদামি বিদ্যুতের চেয়ে বেশি দামের বিদ্যুতে আগ্রহ বেশি। কারণ গোষ্ঠী স্বার্থ।’
ইউক্রেনের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা এবং পশ্চিমা গণমাধ্যম বলছে খুব শিগগিরই বড় আকারে হামলা চালাতে যাচ্ছে রাশিয়া। জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে জানিয়েছে, চলতি মাসেই আরও সৈন্য ও সরঞ্জাম নিয়ে নতুন অভিযান শুরু হতে পারে। এদিকে আরও দ্রুত অস্ত্র সরবরাহের অনুরোধ নিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দপ্তর ব্রাসেলস যেতে পারেন।
ইউক্রেনের আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করতে রাশিয়া পূর্বের অধিকৃত এলাকায় আরও সৈন্য ও সরঞ্জাম জমা করছে বলে নানা সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে। ফলে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি হামলার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রুশ সেনাবাহিনী আরও বড় আকারের হামলা চালাতে পারে, এমন আশঙ্কা বাড়ছে। লুহানস্ক অঞ্চলের ইউক্রেন নিয়ন্ত্রিত এলাকার গভর্নর সেরহি হাইদাই বলেন, রাশিয়া থেকে রিজার্ভ বাহিনীর আরও সদস্য এবং সরঞ্জাম আসছে। নতুন ধরনের গোলাবারুদও আসতে দেখা যাচ্ছে। দিনরাত গোলাবারুদ নিক্ষেপ বন্ধ করে রুশ বাহিনী কোনো বড় অভিযানের জন্য সেগুলো প্রস্তুত রাখছে বলে হাইদাই মনে করেন। তার মতে, ১৫ ফেব্রুয়ারির পর যেকোনো সময়ে রাশিয়া আরও জোরালো হামলা শুরু করতে পারে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীও বসন্তকালে রাশিয়া অধিকৃত আরও এলাকা ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে, এমন ধারণা জোরালো হচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব থেকে ব্যাটেল ট্যাংকসহ আরও অস্ত্র, সরঞ্জাম ও গোলাবারুদ ঠিক সময়ে হাতে না পেলে এমন অভিযান কতটা কার্যকর হবে, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে। ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ইউক্রেন এলাকা পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে যে সাফল্য পেয়েছিল, তা বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে থমকে গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে জেলেনস্কি চলতি সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শীর্ষ সম্মেলনে সশরীরে যোগ দিতে পারেন বলে জল্পনা-কল্পনা চলছে। ইইউ জানিয়েছে, জেলেনস্কিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি সত্যি সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ব্রাসেলস গেলে সেটা হবে যুদ্ধ শুরুর পর দেশের বাইরে তার দ্বিতীয় সফর। গত বছর ওয়াশিংটনে গিয়ে জেলেনস্কি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনা করেন এবং দেশটির কংগ্রেসে ভাষণ দিয়ে আরও অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। ইউরোপের কাছ থেকেও তেমন সাড়া পেতে তিনি ঝুঁকি নিয়ে ব্রাসেলস যেতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চামেলী হলে শিক্ষামন্ত্রী ও সব বোর্ডের চেয়ারম্যানরা নিজ নিজ বোর্ডের ফলাফল প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন।
ফলাফল হস্তান্তরের সময় উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী।
বেলা সাড়ে ১১টা থেকে নিজ নিজ শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে ফলাফল আপলোড করা হবে। এ সময় থেকে যে কেউ রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে ওয়েবসাইট ও মোবাইলে এসএমএস করে ফল দেখতে পারবেন।
আজ দুপুর সাড়ে ১২টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত ফল প্রকাশ করবে। পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অনলাইনে একযোগে ফল প্রকাশ করা হবে বেলা একটায়।
করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ায় গত ৬ নভেম্বর সারা দেশে অনেকটা স্বাভাবিক পরিবেশে শুরু হয়েছিল এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ড মিলিয়ে ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীন মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন ১২ লাখ ৩ হাজার ৪০৭ জন।
ঢাকা ডমিনেটরসের ক্রিকেটাররা ৭৫ ভাগ পারিশ্রমিক বুঝে পেয়েছেন, বাকিটা টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যেই তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেছে ফ্র্যাঞ্চাইজিটি।
আজ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন দলটির অধিনায়ক নাসির হোসেন। এবারের বিপিএলে নিজেদের শেষ ম্যাচটি খেলেছে ঢাকা। চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের বিপক্ষে ১৫ রানের হার দিয়ে শেষ হয়েছে নাসিরের দলের এবারের বিপিএল মিশন।
ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে নাসির জানালেন, পারিশ্রমিক নিয়ে সংকট দূর হয়েছে। ‘আমার মনে হয়ে অনেক খেলোয়াড় ৭৫% পারিশ্রমিক পেয়েছে। আমিও পেয়েছি। ২৫% বাকি। চুক্তি অনুযায়ী টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যে বাকিটা পেয়ে যাওয়ার কথা। প্রথম পেমেন্টটা পেতে একটু দেরি হয়েছে। কিন্তু তারা সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে।’
আসরের মাঝপথে ঢাকার খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক সংক্রান্ত জটিলতার কথা জানা গেলেও নাসির আশ^স্ত করেছেন নিয়ম মেনেই এখন তিন-চতুর্থাংশ পারিশ্রমিক পরিশোধ করেছে ফ্র্যাঞ্চাইজি কর্র্তৃপক্ষ। তবে দল গঠন ও পরিচালনার ব্যপারে ফ্র্যাঞ্চাইজিকে ‘অনভিজ্ঞ’ বলে দাবি করেছেন নাসির।
তার সুপারিশ করা বেশ কয়েকজন বিদেশি ক্রিকেটারকে আনতে না পারার কথাও বলেছেন, ‘আমার কাছে মনে হয় বিদেশি খেলোয়াড়রা একটা বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমরা ভালো বিদেশি খেলোয়াড় আনতে পারিনি। তাছাড়া আমাদের টপ অর্ডার ভালো করেনি। ওরা ভালো করলে অন্যরকম হতো। আর মোমেন্টাম না পাওয়ায় আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। টিমটা শেষ মুহূর্তে হওয়ায় এরকম হতে পারে। আমার বিশ্বাস পরের বছরে এই দল থাকলে ভালো একটা দল হবে। বিদেশি লিগ চলায় খেলোয়াড় পাওয়া যায়নি। যাদের পেয়েছে তাদেরই তারা নিয়ে এসেছে। আরও কিছু বিদেশি খেলোয়াড় পেলে আমরা ভালো করতাম।’
গ্যারি ব্যালান্সের জন্মটা জিম্বাবুয়েতে। তবে স্কুলজীবনে স্বদেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। তবে মাতৃভূমির বয়সভিত্তিক বিশ্বকাপে খেলেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তার অভিষেক ইংলিশদের জার্সি গায়ে। যদিও সেখানেও অনেকদিন ধরে ব্রাত্য। তাই ক্রিকেটের টানে ঘরে ফিরেছেন তিনি। যা রাঙিয়েছেন অসাধারণ এক শতক হাঁকিয়ে।
বুলাওয়ের কুইন্স স্পোর্টস ক্লাব সাক্ষী হলো বিরল এই কীর্তির। ঘরে ফেরা গ্যারি ব্যালান্সকে কেপলার ওয়েসেলসের কীর্তি ছুঁতে দেখল কুইন্স স্পোর্টস ক্লাব। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক ওয়েসেলসের পর দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে যে টেস্ট ক্রিকেটে দুটি দেশের হয়ে সেঞ্চুরি পেলেন ব্যালান্স।
বর্ণবাদী নীতির কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকা নিষিদ্ধ থাকার সময় অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট খেলেছেন ওয়েসলস। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ২৪ টেস্টে চারটি সেঞ্চুরি করা ওয়েসেলস পরে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ১৬ টেস্টে করেন দুটি সেঞ্চুরি। ইংল্যান্ডের হয়ে চারটি টেস্ট সেঞ্চুরির মালিক ব্যালান্স জিম্বাবুয়ের হয়ে প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেই পেয়ে গেলেন সেঞ্চুরি।
স্কুলে পড়ার সময় জিম্বাবুয়ে ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছিলেন গ্যারি ব্যালান্স। তবে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক টিকে ছিল আরও অনেক দিন। ২০০৬ সালে তো ১৬ বছর বয়সী ব্যালান্স জিম্বাবুয়ের হয়ে খেলেন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। সেই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। যে ম্যাচে ৩ উইকেট নেওয়ার পর ব্যাট হাতে সর্বোচ্চ রান করেছিলেন দলের পক্ষে।
২০১৩ সালে ওয়ানডে দিয়ে ইংল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অভিষেক ব্যালান্সের। পরের বছর ইংল্যান্ডের দুর্দশার অস্ট্রেলিয়া সফরে টেস্ট অভিষেক। সিডনির সেই টেস্টে ১৮ ও ৭ রান করা ব্যালান্স ক্রিকেট তীর্থ লর্ডসে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টেই পেয়ে যান প্রথম সেঞ্চুরি। ক্যারিয়ারের প্রথম ১০ টেস্টের ১৭ ইনিংসেই চার সেঞ্চুরিতে ১ হাজার রান করে ফেলা ব্যালান্স খারাপ সময়টা দেখে ফেলেন তাড়াতাড়ি। পরের ১৩ টেস্টে মাত্র দুটি ফিফটি পাওয়া বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ২০১৭ সালের পর আর সুযোগ পাননি ইংল্যান্ড দলে।
ইংল্যান্ড দলে ফেরার স্বপ্ন বিসর্জন দেওয়া সেই ব্যালান্স জন্মভূমি জিম্বাবুয়ের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নিলেন গত বছর। এ বছরই জিম্বাবুয়ের হয়ে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি খেলার পর চলমান বুলাওয়ে টেস্টেই লাল বলের ক্রিকেটে জন্মভূমির হয়ে প্রথম খেলছেন ব্যালান্স। আর প্রথমবার ব্যাট করতে নেমেই সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে জানিয়ে দিলেন তাঁকে ফিরিয়ে ভুল করেনি জিম্বাবুয়ে।
ব্যালান্স যখন ব্যাটিংয়ে নামলেন জিম্বাবুয়ের রান ৩ উইকেটে ১১৪। ঘণ্টাখানেক পরই আরও ৩ উইকেট হারিয়ে ১৪৭ রান জিম্বাবুয়ের। ফলোঅনের শঙ্কায় পড়া দলের লেজে ব্যাটসম্যানদের নিয়ে এরপর কী লড়াইটাই না করলেন ব্যালান্স। সেই লড়াইয়ে উজ্জীবিত হয়ে ইনিংস ঘোষণার মতো বিলাসিতা করে নিলেন জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক ক্রেগ আরভিন।
৯ উইকেটে ৩৭৯ রান তুলে জিম্বাবুয়ে যখন ইনিংস ছাড়ে ব্যালান্স অপরাজিত ১৩৭ রানে। ব্রেন্ডন মাভুতাকে নিয়ে অষ্টম উইকেটে ১৩৫ রান যোগ করা ব্যালান্স খেলেছেন ২৩১ বল, মেরেছেন ১২টি চার ও ২টি ছক্কা। ৯ চারে ৫৬ রান করেছেন নয়ে নামা মাভুতা। জিম্বাবুয়ের অবশ্য লিড নিতে পারেনি। ৬৮ রানে পিছিয়ে ছিল ইনিংস শেষে। চতুর্থ দিন শেষে সেই ব্যবধানটাকে ৮৯ রানে নিয়ে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দ্বিতীয় ইনিংসে বিনা উইকেটে ২১ রান তুলেছে ক্যারিবীয়রা।
শ্রম পরিদর্শক পদে যোগ দেওয়ার ৩৪ বছর পর পদোন্নতি পেলেন মাহমুদুল হক। স্বপ্ন দেখতেন পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে একসময় প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে যাবেন। সেই স্বপ্ন আট বছরেই লুটিয়ে পড়ল জ্যেষ্ঠতার তালিকায়।
১৯৮৮ সালে যোগ দেওয়ায় ’৯৫ সালেই পদোন্নতি পাওয়ার কথা ছিল মাহমুদুল হকের। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অদূরদর্শিতা সে স্বপ্ন শুরুতেই বাধা পেল। এন্ট্রি পোস্টে যোগ দেওয়ার পর তার মতো অন্য কর্মচারীরা যখন পদোন্নতির স্বপ্নে বিভোর, তখন তাতে গা-ই করলেন না সেই সময়ের প্রতিষ্ঠানপ্রধান।
মাহমুদুল অপেক্ষায় রইলেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য। সেই পরিবর্তন আসতে আসতে চাকরিতে কেটে গেল আঠারো বছর। আঠারোতে মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হয়। তিনিও ভাবলেন আঠারোতে তিনি না হয় ‘জব ম্যাচিউরিটি’তে পৌঁছালেন। চাকরির আঠারো বছরে পদোন্নতি পেলেও মন্দ হয় না।
কিন্তু অবাক ব্যাপার, কর্তৃপক্ষ পদোন্নতি দিল, তবে মাহমুদুলকে ছাড়া। পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনে কোথাও তার নাম নেই। হতাশায় মুষড়ে পড়লেন তিনি। জুনিয়র কর্মকর্তারদের নাম আছে, অথচ তার নাম নেই। প্রতিষ্ঠানের নীতি-নির্ধারকদের দরজায় দরজায় ঘুরলেন ন্যায়বিচারের আশায়। কিন্তু তারা পাত্তাই দিলেন না বিষয়টি।
তারা আমলে না নিলেও মাহমুদুলের স্বপ্ন তো সেখানেই থেমে যাওয়ার নয়। সেই স্বপ্ন পুঁজি করে তিনি গেলেন আদালতে। সেই ভিন্ন জগৎটাও কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তার পক্ষে রায় দিল। মাহমুদুল আনন্দে আত্মহারা হলেন। কিন্তু সেই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। সরকার আপিল করল প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলার ফল উল্টে গেল। হতাশায় ভেঙে না পড়ে তিনি গেলেন উচ্চ আদালতে। আপিল বিভাগে সিভিল আপিল মামলা করলে প্রশাসনিক আপিল আদালতের রায় বাতিল হয়। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল থাকে।
জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করার মতো মাহমুদুল হকও যেন সরকারের সঙ্গে লড়াই করতে নামলেন। আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন করল সরকারপক্ষ। একপর্যায়ে সরকার বুঝতে পারল কোনোভাবেই তারা এ মামলায় জিততে পারবে না। সরকারপক্ষে রিভিউ পিটিশন প্রত্যাহার করা হলো। আদালত সরকারের পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনকে আইনের কর্তৃত্ববহির্ভূত বলে ঘোষণা করল। জুনিয়র কর্মকর্তাকে যেদিন থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে এবং যতবার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, একইভাবে মাহমুদুল হককে পদোন্নতি দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। বকেয়া বেতন-ভাতাসহ সব পাওনা কড়ায়-গ-ায় পরিশোধের নির্দেশনা আসে।
আদালতের এই নির্দেশনা দেওয়া হয় ২০১৮ সালে। এরপর আদেশ বাস্তবায়ন করতে সরকারের লেগে যায় প্রায় চার বছর। ২০২২ সালের ১১ মে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ৩৪ বছর পর পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মাহমুদুল হক। আবারও তাকে ঠকিয়েছে সরকার। জুনিয়র কর্মকর্তা যুগ্ম মহাপরিদর্শক হলেও তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয় তার দুই ধাপ নিচের সহকারী মহাপরিদর্শক পদে। উপমহাপরিদর্শক ও যুগ্ম মহাপরিদর্শক আরও ওপরের পদ। আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
কখনোই প্রজ্ঞাপন মাহমুদুল হকের জন্য ভালো বার্তা বয়ে আনেনি। পুরো চাকরিজীবন আদালতের বারান্দায় ঘুরে তিনি পৌঁছেছেন অবসরের প্রান্তসীমায়। আর তিন মাস পরে তিনি অবসরে যাবেন। যৌবন ও মধ্য বয়সের দিনগুলোতে আদালতে ঘুরে বেড়ানোর শক্তি ও সাহস থাকলেও মাহমুদুল হক এখন সেই সাহস দেখাতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করছেন। পারবেন তো শেষ সময়ে এসে সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে?
মাহমুদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, তিনি আদালতের কাছেই জানতে চাইবেন, আদালতের বিচার না মানার শাস্তি কী।
পুরো ঘটনা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা শুনিয়ে জানতে চাইলেন, কতজনের পক্ষে মাহমুদুল হকের মতো লড়াকু মনোভাব দেখানো সম্ভব?
সীমাহীন আনন্দ নিয়ে মানুষ সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়। এরপরই তার মধ্যে যে স্বপ্নটি দানা বাঁধে তা হচ্ছে পদোন্নতি। কার কীভাবে পদোন্নতি হবে তা আইনকানুন, নিয়ম-নীতি দিয়ে পোক্ত করা। পুরো বিষয়টি কাচের মতো স্বচ্ছ। এরপরও পদোন্নতি হয় না। দিন, মাস, বছর পার হয়ে যায়, কাক্সিক্ষত পদোন্নতির দেখা মেলে না।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ক্যাডারে নিয়মিত পদোন্নতি হয়। বাকি ক্যাডারে হতাশা। তার চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি নন-ক্যাডারে। ক্যাডার কর্মকর্তারা নিজের পদোন্নতির ষোলো আনা বুঝে নিয়ে ঠেকিয়ে দেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি। সংখ্যায় বেশি হওয়ায় নন-ক্যাডাররা একজন আরেকজনকে নানা ইস্যুতে আটকাতে গিয়ে পুরো প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেন। সরকারের মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কর্মচারী। সেই হিসেবে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনবলের পদোন্নতি হয় না। পে-কমিশন হলেই কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য করুণা উথলে ওঠে। এমনকি ব্লকপোস্টে যারা আছেন, তাদের জন্যও পদোন্নতির বিকল্প সুবিধা বাতলে দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কর্মচারীদের পদোন্নতি উপেক্ষিতই থাকে।
যখন সময়মতো পদোন্নতি হয় না, তখন নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে থাকে। এসব সমস্যা সংশ্লিষ্ট দপ্তর-অধিদপ্তরের চৌহদ্দি পেরিয়ে আমজনতাকেও প্রভাবিত করে। নন-ক্যাডার কর্মকর্তা আর সঙ্গে কর্মচারীরা যখন বুঝতে পারেন পদোন্নতির আশা তাদের নেই, তখন তারা দুহাতে টাকা কামানোর ধান্দায় মেতে ওঠেন। এতে করে ঘুষের সংস্কৃতি সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। অকার্যকর পথে হাঁটে রাষ্ট্র। সাধারণ মানুষ টাকা ছাড়া তাদের কাছ থেকে কোনো সেবা পায় না, ব্যবসায়ীরা নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে ব্যবসায় আসেন না, ব্যবসাবান্ধব পরিস্থিতি না থাকায় মুখ ফিরিয়ে নেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। প্রধানমন্ত্রীর বারবার আহ্বানেও বিনিয়োগকারীরা সাড়া দেন না। সাধারণ মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে সেবা দেওয়ার বাণীতেও উদ্বুদ্ধ হন না সংশ্লিষ্টরা।
এই পরিস্থিতিতে অনিয়ম আটকে রাখার সব কৌশলই ব্যর্থ হচ্ছে। যথাযথ তদারকি না থাকায় বিভাগীয় ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে। ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫০টি অডিট আপত্তি ঝুলে থাকায় অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোও আগ্রহ হারিয়ে নিজেরাই জড়িয়ে পড়ছে অনিয়মে। দন্তহীন বাঘে পরিণত হওয়ার তথ্য সাংবাদিকদের জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান নিজেই।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদোন্নতির বড় একটা অংশ আটকে রাখে মন্ত্রণালয়গুলো। এই আটকে রাখার কারণ হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের স্বার্থ। বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তরে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিলে নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতিপ্রাপ্তদের ওপরের পদে বসাতে হবে। এতে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের এককালীন লাভ; অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে একবার পদোন্নতি দেওয়া যাবে। কিন্তু পদোন্নতি না দিয়ে সংশ্লিষ্টদের চলতি দায়িত্ব দিলে বছরজুড়ে টাকা আয় করতে পারেন নীতিনির্ধারকরা। দপ্তর, অধিদপ্তরে বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। চলতি দায়িত্বপ্রাপ্তদের আয় অনুসারে নীতিনির্ধারকদের মাসোহারা দিতে হয়। নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া হলে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের নিয়মিত আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে আইন বা বিধি-বিধানের ফাঁকফোকর গলিয়ে নন-ক্যাডার এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি আটকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়।
সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদের সভাপতি নিজামুল ইসলাম ভূঁইয়া মিলন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সচিবালয় এবং সারা দেশের সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতির মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। নন-ক্যাডারের কিছু বিষয় ছাড়া সচিবালয়ের কর্মচারীরা সময়মতো পদোন্নতি পায়। কিন্তু সচিবালয়ের বাইরে পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। সচিবালয়ে মাত্র ১০ হাজার কর্মচারী আছেন। সচিবালয়ের বাইরে আছেন ১০ লাখের বেশি। এসব কর্মচারীর পদোন্নতি নিয়ে বহু বছর ধরে চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনো ফল পাইনি। সর্বশেষ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সমস্যা নিয়ে কাজ করার জন্য একটি কমিটি করে দিয়েছে। কমিটি কিছু সুপারিশ করেছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। এরপর এর কোনো অগ্রগতি নেই। যেখানে সরকারপ্রধান বলেন, চাকরিজীবনে সবাই যেন কমপক্ষে একটি পদোন্নতি পায়। সেখানে বহু কর্মচারী কোনো পদোন্নতি ছাড়াই অবসরে যাচ্ছেন। সরকারপ্রধানের নির্দেশনা উপেক্ষা করেন আমলারা। তাদের আগ্রহ কেনা-কাটায়, বিদেশ ভ্রমণে, নতুন জনবল নিয়োগে। এসব করলে তাদের লাভ। কর্মচারী পদোন্নতি দিতে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এর নিশ্চয়ই একটা শেষ আছে। বৈষম্যের পরিণতি কী হয়, তা অনেক দাম দিয়ে বিডিআর বিদ্রোহে আমরা দেখেছি।’
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি ঝুলছে বছরের পর বছর। এই অধিদপ্তরের কয়েক শ কর্মকর্তা পাঁচ বছর আগেই পদোন্নতির যোগ্য হয়েছেন। নানা কায়দা-কানুন করে তাদের পদোন্নতি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সংশ্লিষ্টদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করে তাদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া এগিয়ে নিলেও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নতুন করে জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার নামে সময়ক্ষেপণ করছে। জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার পর এখন তাদের পারিবারিক সদস্যদের তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই সংস্থা নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদেরও তথ্য তালাশ করছে। তাদের আত্মীয়দের মধ্যে কে কোন দলের সমর্থক তার তথ্য নিচ্ছেন সংস্থার কর্মকর্তারা।
গত মাসে শেষ হওয়া জেলা প্রশাসক সম্মেলনে দায়িত্ব পালন করছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সুরম্য ভবনে দায়িত্ব পালন করলেও ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তার মনের অবস্থাটা মনোহর ছিল না। কেমন আছেন জানতে চাইলে ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তা বলেন, ‘ভালো নেই। চাকরি করছি, পদোন্নতি নেই। ২০১৫ সালের আগে পদোন্নতি না পেলেও টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড ছিল। তাও তুলে দেওয়া হয়েছে। তুলে দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল সময়মতো পদোন্নতি হবে, ব্লকপোস্টধারীদের দেওয়া হবে বিশেষ আর্থিক সুবিধা। এসবের কোনোটাই হয়নি।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে একটি প্রশাসনিক আদেশ খুবই পরিচিত। সেই প্রশাসনিক আদেশ ১৬/২০১৮ অনুযায়ী ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগ হবে। আর ৩০ ভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগের ফলে বিমানে বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় কর্মকর্তা বেশি। নীতিনির্ধারকদের নতুন জনবল নিয়োগে আগ্রহ বেশি। পুরনোদের পদোন্নতি দিয়ে ওপরের পদ পূরণের চেয়ে তারা নতুন নিয়োগে যান। ফলে কারও চাকরিজীবনে একবারও পদোন্নতি হয় না। নামমাত্র যে পদোন্নতি হয় তা অনিয়মে ভরপুর।
নন-ক্যাডার ছাড়াও ১৩তম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। প্রতিটি দপ্তরে এসব গ্রেডের পদোন্নতি আটকে আছে। অথচ এসব গ্রেডেই বেশি লোক চাকরি করছেন। সরকারের মোট জনবল প্রায় ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ২৩ শতাংশ পদের মধ্যেও নন-ক্যাডার রয়েছেন। এ ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৭৭ শতাংশ পদই ১৩তম থেকে তার পরের গ্রেডের। এতে করে সহজেই বোঝা যায় সরকারের জনবলের বড় অংশই পদোন্নতির চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। সরকারের জনবলের এই বিশাল অংশ যখন পদোন্নতি নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগেন, তখন তারা নানা অনিয়মে ঝুঁকে পড়েন।
বেশির ভাগ দপ্তর, অধিদপ্তর পরিচালনা করেন বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা তাদের প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে ক্যাডার কর্মকর্তাদের দপ্তর, অধিদপ্তরে পাঠান। প্রেষণে গিয়ে অনেক কর্মকর্তা শুধু রুটিন কাজটুকুই করতে চান। শূন্যপদে জনবল নিয়োগ বা পদোন্নতি রুটিন কাজ না হওয়ায় তা উপেক্ষিত থাকে। তা ছাড়া পদোন্নতি দিতে গিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়; বিশেষ করে মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রী বা সচিব তাদের পছন্দের লোককে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য সংস্থার প্রধানকে চাপ দেন। এই চাপ উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ না থাকায় অযোগ্য লোককে পদোন্নতি দিতে হয় সংস্থার প্রধানকে। এই জটিলতা থেকে দূরে থাকার জন্য সংশ্লিষ্টদের পদোন্নতি দেওয়া থেকেও দূরে থাকেন সংস্থার প্রধানরা।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের ১৪ গ্রেডের একজন কর্মচারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাইরের লোকের ইচ্ছাটাই জাগে না আমাদের পদোন্নতি দিতে। আমাদের দপ্তরপ্রধান মহাপরিচালক প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। অতিরিক্ত মহাপরিচালকও অনেক সময় প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রেষণে আসেন। তাদের কেন ইচ্ছা জাগবে আমাদের পদোন্নতি নিয়ে। যদি এসব পদে ফুড ক্যাডারের কর্মকর্তা থাকতেন, তাহলে তারা খাদ্য বিভাগের সমস্যা বুঝতেন। তা ছাড়া নিয়োগ বিধি সংশোধনের নামে আমরা দীর্ঘদিন একই পদে আটকে আছি।’
গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে এক আবেদনে জানান, ‘বর্তমানে সচিবালয়ে প্রায় দুই হাজারের বেশি প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা কর্মরত। এর বিপরীতে ক্যাডারবহির্ভূত সংরক্ষিত পদের সংখ্যা ২৬৭টি, যা খুবই নগণ্য। ফলে একই পদে ২০-২২ বছরের বেশি সময় কর্মরত থাকার পরও অনেকে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। পদোন্নতি না পাওয়ায় সৃষ্ট হতাশার ফলে কর্মস্পৃহা নষ্ট হচ্ছে।’
সরকার এ সমস্যা থেকে কীভাবে বের হতে পারে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এসব সমস্যা সমাধানে সরকার সব সময়ই কাজ করে। কিন্তু এ চেষ্টা জটিলতার তুলনায় কম। এ বিষয়ে আরও এফোর্ট দিতে হবে।
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫০ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা খরচের হিসাব ধরে বাজেট প্রস্তাব প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে সরকার। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৭২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা বেশি। অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে খরচের বেশিরভাগ অর্থ জোগাড়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১৯ শতাংশ বাড়ানো হবে। আসছে জুনের প্রথমভাগে জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আগামী বাজেট হবে জাতীয় নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ বাজেট। তাই এখানে নেওয়া কোনো পদক্ষেপে যেন আওয়ামী লীগ সরকার সমালোচনার মুখে না পড়ে এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্টদের থাকছে বিশেষ নজর। এ ছাড়া রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। তাই সংকট ও নির্বাচন দুটোই মাথায় রাখতে হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে মোটাদাগে একটি রূপরেখা পাঠানো হয়েছে। নতুন পরিকল্পনার পাশাপাশি গত তিন মেয়াদে সরকার কী কী উন্নয়ন করেছে আগামী বাজেট প্রস্তাবে তা মনে করিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং উচ্চপর্যায়ের সরকারি নীতিনির্ধারকদের উপস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো আগামী বাজেটের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আর গত সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি পাঠিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণে কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে হিসাব ধরে অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট প্রস্তাব প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে তা কয়েক দফা খতিয়ে দেখা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। তিনি প্রয়োজনীয় সংশোধন, যোগ-বিয়োগ করে আবারও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার আগেও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে থাকে।
ডলার সংকটে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছেন না সাধারণ ব্যবসায়ীরা। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় পণ্যের দাম বাড়ছে। কাঁচামাল সংকটে বিপাকে শিল্প খাত। ব্যাংক খাতে অস্থিরতা। নতুন চাকরির সুসংবাদ নেই বললেই চলে। দফায় দফায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। খুব শিগগিরই এসব সংকট কেটে যাবে বলে মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে ঋণদাতা সংস্থার কঠিন শর্তের বেড়াজালে আছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতেই আগামী অর্থবছরের বাজেট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশি^ক অস্থিরতা মোকাবিলায় সরকার কী কী পদক্ষেপ নেবে তা আগামী বাজেটে স্পষ্ট করা হবে। দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথাও বলা হবে। তবে শত সংকটের মধ্যেও আগামী বাজেটে ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী যতটা সুবিধা দেওয়া সম্ভব তা দিতে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে বাজেট প্রস্তুত কমিটির কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে কাঁচামাল আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দিতে হিসাব কষা হচ্ছে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডলার সংকটে আমদানি রপ্তানি প্রায় বন্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্যে সংকটকাল চলছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটে আমাদের দাবি অনুযায়ী নগদ সহায়তা দিতে হবে। রাজস্ব ছাড় দিতে হবে। কর অবকাশ ও কর অব্যাহতি বাড়াতে দিতে হবে।’
ঋণদাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া সংস্কারের শর্ত মানার অঙ্গীকার করে সরকার ঋণ পেয়েছে। শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে ঋণের যেকোনো কিস্তি আটকে দিতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। পর্যায়ক্রমে প্রতি অর্থবছরের বাজেটে এসব সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়ন করা হবে। আসছে বাজেটে শর্ত মানার চেষ্টা থাকবে। বিশেষভাবে অতীতের মতো ঢালাওভাবে কর অব্যাহতি দেওয়া হবে না। আর্থিক খাতের সংস্কারের কিছু ঘোষণা থাকবে। বিশেষভাবে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দেওয়া হবে। আইএমএফের সুপারিশে এরই মধ্যে ভ্যাট আইন চূড়ান্ত হয়েছে। আয়কর আইন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন হয়েছে। শুল্ক আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ে আছে। এ তিন আইন অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণ করা হবে। আসছে বাজেটে টেকসই অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার কথা বলা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগের কথা শোনানো হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঋণদাতা সংস্থার শর্ত মানার কথা বলা হলেও সব আগামী বাজেটে একবারে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে অর্থনীতির গতি কমে যাবে।’
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এনবিআর-বহির্ভূত খাত এবং এনবিআর খাতের জন্য মোট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৪ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৯ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হতে পারে। এতে লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা হবে। এনবিআর এ লক্ষ্যমাত্রা কমানোর জোরালো আবেদন করেছে। কিন্তু তা আমলে আনেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) হিসেবে, ৩৪ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা আয়কর হিসেবে এবং ৩১ শতাংশ বা বাকি ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা শুল্ক হিসেবে সংগ্রহ করার কথা বলা হতে পারে বলে জানা গেছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রার কথা শুধু বললেই হবে না। কীভাবে অর্জিত হবে, সেটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা না থাকলে প্রতিবারের মতো ঘাটতি থাকবে। রাজস্ব ঘাটতি হলে অর্থনীতিতে আয় ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়। তাই এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত।’
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআর উৎসে করের আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। সম্পদশালীদের ওপর নজর বাড়ানো হবে। শুধু বেশি সম্পদ থাকার কারণে অতিরিক্ত কর গুনতে হবে। সারচার্জ বহাল রাখা হবে। সুপারট্যাক্স গ্রুপকে উচ্চহারে গুনতে হবে কর। আগামী অর্থবছরেও অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা থাকবে। অর্থ পাচারোধে আইনের শাসন কঠোর করা হবে। অর্থ পাচার আটকাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হবে। করপোরেট কর কমানোর দাবি থাকলেও তা মানা হবে না। অন্যদিকে নির্বাচনের আগের বাজেট হওয়ায় করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করতে খোদ অর্থমন্ত্রী বললেও রাজস্ব আদায় কমে যাবে এমন যুক্তি দেখিয়ে এনবিআর রাজি নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে। কমানো হবে শিল্পের অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি শুল্ক। ডলারের ওপর চাপ কমাতে বেশি ব্যবহৃত পণ্য আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দেওয়া হবে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানি কমাতে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হবে। তৈরি পোশাক খাতের সব সুবিধা বহাল রাখা হবে। শিল্পের অন্যান্য খাতেও কতটা সুবিধা বাড়ানো যায় তা নিয়ে এনবিআর হিসাব করছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বাজেট প্রস্তুতিবিষয়ক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্পে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি এবং ঘাটতি ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হতে পারে। আগামী অর্থবছরে জিডিপির ৬ শতাংশ ঘাটতি ধরে ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হতে পারে বলে জানা যায়। ঋণদাতা সংস্থার কাছ থেকে ভর্তুকি কমানোর চাপ থাকলেও আগামীবার এ খাতে বেশি ব্যয় ধরা হতে পারে। এ খাতে ১ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ব্যয় আছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, গত সোমবার রাতে আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ অনুমোদন করে। ঋণদাতা সংস্থাটির কাছ থেকে বাংলাদেশ ছয় কিস্তিতে তিন বছরে ৪৭০ কোটি ডলার পাচ্ছে। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের দিন আইএমএফ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে পূর্বাভাস দেয়। সংস্থাটি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হতে পারে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা হতে পারে ৭ দশমিক ১ শতাংশ।
এতে রিজার্ভ সম্পর্কে বলা হয়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ৩ হাজার কোটি ডলার। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বাড়বে এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় চলতি বোরো মৌসুমে সেচে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকার নানারকম প্রস্তুতি নিয়েছে বলে দাবি করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতের যে পরিস্থিতি তাতে গ্রীষ্মে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বেশি দাম দিয়েও কৃষক ঠিকমতো বিদ্যুৎ না পেলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। এতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়তে পারে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, জ্বালানি তেল, সার ও বীজের দাম বেড়েছে। এখন আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। তার মানে চারদিক থেকে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর ফলে কৃষকের ‘সিগনিফিকেন্ট লস’ হবে। এভাবে দাম বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বোরো উপকরণনির্ভর ফসল। কিন্তু উপকরণের দাম এভাবে বাড়তে থাকলে, কৃষক আগ্রহ হারিয়ে ফেললে; সে ঠিকমতো উপকরণ ব্যবহার করতে পারবে না। এতে উৎপাদন ব্যাহত হবে। উৎপাদন খারাপ হলে চালের ঘাটতি হবে। এমনিতেই এখন প্রায় ৭০ লাখ টন গম ও ভুট্টা আমদানি করতে হচ্ছে। এরমধ্যে যদি চাল আমদানি করতে হয়; তাহলে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
ড. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সারাবিশ্ব নানারকম সংকটে ভুগছে। এ অবস্থায় আমাদের অন্তত খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সুযোগ রয়েছে। সেজন্য যে পরিমাণ দাম বেড়েছে সে পরিমাণ নগদ অর্থ সহায়তা দিতে হবে কৃষককে। ২০০৯-১০ সালের দিকে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে এক কোটির বেশি কৃষককে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা সরাসরি নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। এজন্য তারা ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খুলেছিলেন। তাদের সেই অ্যাকাউন্ট এখনো আছে, কিন্তু সহায়তা দেওয়া হয় না। এখন যদি সেই সহায়তা দেওয়া হয় তাহলে কৃষক আবার উৎসাহ পাবে।’
বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, প্রতি বছর সেচ মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি থেকে মে) বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। গত মৌসুমে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। চলতি বছর সম্ভাব্য চাহিদা ধরা হয়েছে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। গত বছরের তুলনায় এ বছর সেচ সংযোগের সংখ্যা ১ হাজার ৯১টি বেড়ে মোট ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৪৫৯টি হয়েছে। এজন্য বিদ্যুৎ লাগবে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট।
সেচ মৌসুমে অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সম্প্রতি তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিদ্যুতের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে উৎপাদনও বাড়ানো হচ্ছে। সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গ্যাস, ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল সরবরাহ বৃদ্ধি করা, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস সরবরাহ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে পরিস্থিতি ভালো হবে।’
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে প্রতিদিন ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস, ৭৭ হাজার ৪০০ টন ফার্নেস অয়েল এবং ৬৬ হাজার ১০০ টন ডিজেলের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। সূত্রমতে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ করা বাস্তবে খুব কঠিন ব্যাপার। গত বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পিডিবির দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট ছিল। বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এ বছর জ¦ালানির ঘাটতি আরও বেশি। তবে সরকার খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি করে ঘাটতি মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু আমদানিকৃত গ্যাস দিয়ে চাহিদা অনুযায়ী কতটা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে তা নিয়ে কর্মকর্তাদের অনেকেই সন্দিহান।
পিডিবির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে ১০ হাজার থেকে ১০ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। গ্যাস ও কয়লা সংকটের কারণে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এ ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের কারণেও কিছু কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে।
দেশে নির্মাণাধীন ও আমদানিকৃত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আগামী মার্চের শেষ দিকে ভারতের আদানি থেকে অতি উচ্চ দামে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ছাড়া মে মাসের দিকে চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে ৬১২ মেগাওয়াট এবং অন্যান্য কিছু ছোট বা মাঝারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৫০ থেকে ২০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হতে পারে। এপ্রিল-মে মাসের দিকে বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি হবে। তখন এসব কেন্দ্র সময়মতো উৎপাদনে এলেও ১৩ হাজার মেগাওয়াটের জোগান দেওয়া সম্ভব হবে। এর বাইরে উচ্চ মূল্যের জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে কিছু কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম মনে করেন, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করার সক্ষমতা সরকারের নেই। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি সরবরাহ করতে সরকারের ডলার খরচের যে সক্ষমতা দরকার তা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘জ্বালানি খাতে সরকারের ভুলনীতি আর অন্যায্য ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয়ের কারণে দাম বেড়েই চলেছে। সেই ব্যয় মেটাতে এখন বিদ্যুৎ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করে ভর্তুকি সমন্বয় করতে চাইছে। এই পরিস্থিতিতে উচ্চ দামে বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা অসম্ভব ব্যাপার।’
এদিকে ডলার সংকট এবং ঋণপত্র (এলসি) খোলার বিলম্বের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। সরকারের কাছে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মোটা অঙ্কের বিল পাওনা থাকলেও তারা ঠিকমতো না পাওয়ার কারণে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করতে পারছেন না। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নির্মাণকাজ এবং জ্বালানি আমদানির যে অগ্রগতি তাতে চাহিদার তুলনায় আগামী গ্রীষ্মে বিদ্যুতের ঘাটতি হবে আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট। তবে সাশ্রয় নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে ১ হাজার মেগাওয়াট এবং উচ্চ মূল্যের জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে আরও ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণ করতে পারে সরকার। এরপরও অন্তত ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থাকবে।
এদিকে দাম সমন্বয়ের নামে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে গণশুনানি ছাড়াই নির্বাহী আদেশে জানুয়ারি মাসে ১৮ দিনে চার দফা গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করেছে সরকার। এর মধ্যে দু’দফায় অন্তত ১০ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর আগে গত বছরের আগস্টে সেচে ব্যবহৃত ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ২৯ টাকা দাম বাড়ানো হয়। বিদ্যুৎ ও জ¦ালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষিতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে।
কুমিল্লার নাঙলকোট উপজেলার বাসন্ডা গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম মজুমদার বলছিলেন, গত বছর এক বিঘা বা ৩৩ শতক জমিতে ধান চাষ করতে সেচের জন্য ২৭৫০ টাকা ব্যয় হয়েছে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চলতি বোরো মৌসুমে এ ব্যয় বেড়ে অন্তত ৪ হাজার টাকা হবে। এর বাইরে অন্যান্য খরচও আনুপাতিক হারে অনেক বেড়েছে। ফলে এখন ধান চাষ করলে প্রতি বিঘা জমিতে অন্তত দেড় থেকে দুই হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে।
ডিজেলচালিত ইঞ্জিনের মাধ্যমে জমিতে সেচ দেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর গ্রামের শিয়ালা গ্রামের কৃষক নাঈম। শনিবার রাতে টেলিফোনে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতিবিঘা জমিতে এ বছর সেচের ব্যয় বেড়েছে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা। সার, বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের দামও বেড়েছে।
এর আগে মূল্যবৃদ্ধির গণশুনানির সময় বিইআরসি কৃষক ও প্রান্তিক মানুষের কথা বিবেচনা করলেও নির্বাহী আদেশের সময় এসব কিছুই বিবেচনা করা হয় না।
অতীতে সামাজিক সুরক্ষার অংশ হিসেবে প্রতিমাসে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীকে লাইফলাইন বা প্রান্তিক ব্যবহারকারী হিসেবে বিবেচনা করে তাদের বিদ্যুতের দাম তুলনামূলক কম বাড়াত কমিশন। দেশে এ ধরনের গ্রাহক রয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ, যাদের অধিকাংশই কৃষক। কিন্তু সর্বশেষ বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আদেশে এ সুবিধা বাতিল করা হয়েছে।
লাইফ লাইন শ্রেণির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বিল ছিল ৩.৭৫ টাকা। গত ডিসেম্বরে তা বাড়িয়ে ৩.৯৪ টাকা করেছিল মন্ত্রণালয়। সেখান থেকে এবার আরেক দফা বাড়িয়ে ৪.১৪ টাকা করা হয়েছে। ফলে গত দুই মাসের ব্যবধানে দরিদ্র মানুষকে এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ৩৯ পয়সা বাড়তি ব্যয় করতে হবে।
কৃষকের কথা বিবেচনা করে আগে সেচে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম সবসময়েই তুলনামূলক সাশ্রয়ী রাখার চেষ্টা করা হতো। কিন্তু এখন কৃষকেরাও রেহাই পাচ্ছে না। গত ১২ ডিসেম্বর কৃষিতে ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ২১ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৩৭ টাকা করা হয়। সেখান থেকে এবার আরও ২২ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৫৯ টাকা করা হয়েছে।
রংপুরের একজন কৃষক আনোয়ার আলী খানিকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দফায় দফায় যেভাবে সবকিছুর দাম বাড়ছে তাতে চাষি তো আর বেশিদিন বাঁচতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘ধান চাষ করে এখন লাভ তো দূরের কথা খরচই ওঠে না। তাই আগের চেয়ে ধান চাষ কমিয়ে দিয়েছি। এখন সারা বছর খাওয়ার জন্য যতটুকু ধান দরকার ততটুকুই চাষ করি। তাতে লোকসান হলেও কী করব? ডাল-ভাত তো খাওয়া লাগবে।’
তাকে বলা হয় নাটকের রাণী। দীর্ঘ এক যুগের ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেছেন। নানামাত্রিক চরিত্রে হাজির হয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন, দু’হাতে কুড়িয়েছেন দর্শকদের ভালোবাসা। বলছিলাম, সুপারস্টার, দেশের সর্বাধিক দর্শকের তারকা মেহজাবীন চৌধুরীর কথা। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে তার ওয়েব সিরিজ ‘দ্য সাইলেন্স’। সিরিজ, নাটক, সিনেমা এবং সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তাকে নিয়ে লিখেছেন ইমরুল নূর।
সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘দ্য সাইলেন্স’ সিরিজটি থেকে দর্শকদের কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
অনেক ভালো সাড়া পাচ্ছি। শুধু যে আমি-ই পাচ্ছি, এমনটা নয়। প্রত্যেকটা সেক্টরের প্রশংসা হচ্ছে যেমন- নির্মাণ, আর্ট, সিনেমাটোগ্রাফি এবং যারা অভিনয় করেছেন এখানে সবার অভিনয়ের বিষয়ে অনেক পজেটিভ মন্তব্য দেখছি, শুনছি, পড়ছি। সব মিলিয়ে পুরো টিম প্রশংসা পাচ্ছে। অনেক ভালো লাগছে।
এমন একটা চরিত্র হয়ে উঠা কতটা চ্যালেঞ্জের? তার জন্য প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছিলেন?গল্পটা এত বেশি ইন্টারেস্টিং ছিলো যে শোনার পরই কাজটি করতে রাজি হয়ে যাই। আমার চরিত্রটাও ইন্টারেস্টিং যেখানে অভিনয়ের অনেক সুযোগ ছিল। আমার কাছে মনে হয়েছে, যদি চরিত্রটা সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারি তাহলে দর্শকদের মায়াও লাগবে আবার রাগও হবে। তখন তাদের মনে প্রশ্ন জাগবে, এরকম কেন চরিত্রটা? তাই এমন একটা চরিত্র পেয়ে সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। পরিচালক ভিকি জাহেদ গল্পের রুবি চরিত্রটি কীভাবে দেখতে চায়, সেসব নিয়ে তার কাছ থেকে শুনি এরপর আমার মত করে চরিত্রটিকে গুছিয়ে নেই।
লুকের দিক থেকে হালকা একটু পরিবর্তন আনা হয়েছে। যারা আমাকে চেনেন তারা সেটা দেখলেই বুঝতে পারবেন।
চরিত্রটির জন্য আপনাকে আলাদা দাঁত ব্যবহার করতে হয়েছিলো। জানা মতে, মুখে অতিরিক্ত জিনিস ব্যবহার করে অভিনয় করা কিংবা এক্সপ্রেশন প্রকাশ করা খুবই কঠিন। সেটা কীভাবে সামলেছেন?
হ্যাঁ, একদমই তাই। আমি আমার মতই কিন্তু একটু আলাদা, অন্যরকম দেখানোর জন্যই এরকমটা করা হয়েছে। ফেসিয়াল স্ট্রাকচারের মধ্যে পরিবর্তন আনতে আলাদা দাঁত ব্যবহার করতে হয়েছে। এটা আসলেই অনেক কঠিন ছিল আমার জন্য। দাঁতের ওপর দাঁত ব্যবহার করে কথা বলা, এক্সপ্রেশন দেওয়া আমার জন্য সহজ ছিলো না। আমি একটু কঠিন কিছু করতেই পছন্দ করি সবসময়। তাই চেয়েছিলাম কথা বলা, এক্সপ্রেশন থেকে ভঙ্গি কিছুটা আলাদা-ই হোক। সহজ ছিলো না, কথা বলতে গিয়ে অনেক সময় জড়িয়ে যেত তারপরও যতটুকু সম্ভব ওভারকাম করার চেষ্টা করেছি।
আর এই সিরিজটিতে নিজেকে সুন্দর কিংবা পরিপাটি দেখানোর কোন ইচ্ছেই ছিলো না। চাচ্ছিলাম আমাকে যেন আমার মত না লাগে।
যতটুকু প্রত্যাশা নিয়ে কাজটি করেছিলেন, তার কতটুকু পূরণ হয়েছে ?
টিমের একজন সদস্য হিসেবে কাজটি নিয়ে প্রত্যাশার চেয়ে ভয় ছিল বেশি। কারণ, এরকম একটা কনসেপ্ট নিয়ে কাজ- সেটা দর্শকরা গ্রহণ করবে কিনা, যেটা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে সেটা বুঝবে কিনা! কি হলো, কেন হলো, কিভাবে হলো, মূল ম্যাসেজটা সবাই ধরতে পারবে কিনা এই ভয়টা ছিল।
সবার এত মন্তব্য, রিভিউ পড়ে মনে হলো যে আমরা সাকসেসফুল। দর্শকদেরকে ম্যাসেজটা বুঝাতে পেরেছি। সেই জায়গা থেকে পুরো টিম প্রশংসা পাচ্ছে। আমার মনে হয়েছিলো, কাজটা হয়তো খুব বেশি দর্শক দেখবে না কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এত এত মন্তব্য দেখছি যেটা আসলে ভালো লাগা অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ আবার এমন মন্তব্যও করেছেন যে, কিছুক্ষণ দেখার পর ভয়ে নাকি বন্ধ করে দিয়েছেন (হাহাহা)। আসলে ভয়ে বন্ধ করে দিলেই তো হবে না। আমরা চাই একদম শেষ পর্যন্ত দর্শকরা কাজটি দেখুক। এই গল্পের শেষ দেখাটা খুব জরুরি।
যার মাসের ত্রিশ দিনই সময় কাটতো শুটিং ফ্লোরে, এখন তার ব্যস্ততা কি নিয়ে?
আগে তো নাটকে নিয়মিত ছিলাম কিন্তু এখন অন্যান্য কাজের কারণে নাটকে সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নাটকের স্ক্রিপ্টের মধ্যে নতুনত্ব, আলাদা কিছু খুঁজছি। সবসময়ই যে আলাদা গল্প পাবো, এমনটাও তো সম্ভব না। তবে স্ক্রিপ্টে যেন সৌন্দর্যতা থাকে, গল্পটা সুন্দর হয় কিংবা দর্শকদের সাথে কানেক্ট হবে; এরকম স্ক্রিপ্টেই কাজ করার ইচ্ছে আছে। নয়তো বা আমার অনেক ভালো লাগতে হবে এমন গল্প হলে আবারও নাটকে দেখা যাবে।
আপনার দর্শকদের জন্য সামনে নতুন কি চমক থাকছ?
আগে থেকে বলে ফেললে সেটা তো আর চমক থাকে না। তাই আপাতত কিছু না-ই বলি।
লাক্স সুন্দরী প্রতিযোগিতা থেকে বের হওয়ার পর আপনার একটি সিনেমা করার কথা ছিলো কিন্ত সেটি আর হয় নি। এটা আসলে কেন? সিনেমা দিয়েই যার অভিষেক ঘটার কথা তার ব্যস্ততা বাড়লো নাটকে..
হ্যাঁ। লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার থেকে বের হওয়ার পরপই ‘ওয়ারিশ’ নামে একটা সিনেমার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলাম। এটাতে আমার সঙ্গে ছিলেন আরিফিন শুভ ভাইয়া। আমরা রিহার্সেলও করেছিলাম এটার কিন্তু এরপর নানা কারণে সে কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ঐ সিনেমাটি-ই আর হয়নি।
যেহেতু সিনেমা দিয়ে অভিষেক হয়নি তাই আমি চেয়েছিলাম নাটকেই কাজ শুরু করি কারণ, এতে করে অভিনয়ের অনেক কিছু শিখতে পারবো। এরপর প্রস্তুত হয়ে নাহয় সিনেমা করবো। পরে নাটকেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এরপর তো ওয়েব সিনেমা, সিরিজ করছি। যদি মেইনস্ট্রিম সিনেমা বা বড় পর্দায় কাজ এখন পর্যন্ত না করার সবচেয়ে বড় কারণ হলো, সঠিক গল্প, ভালো স্ক্রিন-প্লে এবং একটা ভালো টিম না পাওয়া। এক কথায় যদি বলি, মনের মত করে পাইনি এখনও। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি কোনো কাজ করতে চাচ্ছি না। নাটক আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমার পরিচিতি, দর্শকের ভালোবাসা- সবকিছুই নাটকের মাধ্যমে। নাটক দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করে আজকে আমি এই জায়গায়। আমি এই বিষয়টা অনেক বেশি উপভোগ করি। আমি শুধু ভালো কাজ করতে চাই। এটা দর্শক কোন মাধ্যমে দেখছে তার চেয়ে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ- আমি তাদের কতটা ভালো কাজ দিতে পারছি, ভালো অভিনয় দিতে পারছি কিনা! দর্শক আমাকে ভালোবাসলে তারা নিজের মত করে দেখে নেবে। সেটা নাটকে, ওটিটিতে অনলাইন মাধ্যমে নাহয় টিকিট কেটে সিনেমাহলে দেখবে; আমার দর্শকদের প্রতি এটুক বিশ্বাস আছে।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় টেলিভিশনের প্রায় সব শিল্পীই এখন ওটিটিতে ঝুঁকছে। এতে করে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে শিল্পী সংকট তৈরি হয়েছে বলে অনেক পরিচালকের অভিমত। তাদের ভাষ্য, সুযোগ থাকলেও প্রথম সারির শিল্পীদের এখন পাওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?
দেখুন, এই মুহূর্তটাতে আমি নাটকে কাজ কমিয়েছি আমার নিজের জন্য। এটা আমার নিজের সিদ্ধান্ত। নাটক ছেড়ে দিয়েছি, বিষয়টা কিন্তু তেমন না। আমি জানিয়েছি, ভালো স্ক্রিপ্ট হলে আমি অবশ্যই করবো। সে জায়গা থেকে আমার নিজের কাজ, নিজেকে আরও অনেক উপরে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য ঠিক সেরকম গল্পও তো লাগবে নাকি! তা নাহলে তো সেই একইরকমের কাজ করার পর দর্শকরাই বিরক্ত হবে আর বলবে, মেহজাবীন একইরকম কাজ করছে!
আমি নিজেকে আলাদা করার জন্য এবং দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য নিজের মত করে কাজ করার চেষ্টা করছি। দর্শকরা তো এটাই চাইতো, কাজ কম হোক কিন্তু সেটা যেন ভালো হয়। আমি এখন সেটাই করছি। আর একজন শিল্পী হিসেবে আমিও তো চাইবো, আমার প্রত্যেকটা কাজ খুবই এক্সক্লুসিভ হোক, আলাদা হোক। আগের করা কোন চরিত্রের সাথে মিলে না যাক। দর্শকদের সেই প্রত্যাশা পূরণ করার চেষ্টাতেই এই সময়ে এসে কাজ কমিয়ে দেওয়া।
আর শিল্পীদের ওটিটিতে আগ্রহী হওয়ার অনেক কারণ আছে। এখানে শিল্পীরা নিজেদেরকে ফুটিয়ে তুলতে সব ধরণের স্বাধীনতা পাচ্ছে যেটা টেলিভিশনে সম্ভব হয় না। এটা একটা ক্রিয়েটিভ জায়গা। যেকোন ক্রিয়েটিভ কাজ ভালো করতে হলে সময়ের দরকার। ওটিটিতে শিল্পীরা ভালো গল্প পাচ্ছে, চরিত্র নিয়ে ভাবার সময় পাচ্ছে, সময় নিয়ে কাজ করতে পারছে। এটাই তো চায় সবাই।
তাছাড়া এখন আমাদের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি অনেক বড়। এখানে অনেক শিল্পী রয়েছেন তাছাড়া যারা নতুন আছেন তারাও অনেক ট্যালেন্টেড। তাদের এখন সুযোগ দরকার ভালো পরিচালকদের সঙ্গে, ভালো গল্পে কাজ করার। এখন তাদেরকে সেই সুযোগটা দেওয়া হোক এবং তারা নিজেদের মত করে এগিয়ে যাক। একটা ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু গুটিকয়েক জনের উপর নির্ভর করে চলবে না এবং উচিতও না। এখানে প্রত্যেকটা মানুষের সেই সুযোগটা পাওয়া উচিত। আবার যখন কারও মনে হবে যে আমি এখান থেকে অন্য জায়গায় যাবো, সে স্বাধীনতাও তার থাকা উচিত। কারণ, আমরা যারা শিল্পী তারা কিন্তু অভিনয়টা বেছেই নিয়েছি ভালো সুযোগ, ভালো কাজ, ভালো চরিত্রের জন্য। যেখানে সে সুযোগটা পাবে, সেটা বেছে নেওয়ার অধিকার একজন শিল্পীর আছে। এতদিন আমি নাটকে অভিনয় করেছি, এখন একটু কম করছি; এটা একান্তই আমার সিদ্ধান্ত। সেই স্বাধীনতা তো একজন শিল্পীর অবশ্যই থাকা উচিত।
যারা এখন নতুন কাজ করছে, তাদের জন্য আমার পক্ষ থেকে অনেক অনেক শুভকামনা। তারা যে চেষ্টা করছে এটা খুব ভালো লাগছে। দর্শকদের উচিত তাদেরকে সাপোর্ট করা। কারণ, একটা সময় সেই সাপোর্টটুকু আমরাও পেয়েছিলাম যখন একেবারেই নতুন ছিলাম। আমাদেরকে যেই ভালোবাসাটা দিয়েছিলেন সেই ভালোবাসাটুকু এখন নতুনদেরকে দিন, এটাই আমি চাইবো।