
গত মাসে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের বিদ্রোহীদের সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের সময় একাধিকবার বেশ কিছু গোলা বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরেও এসে পড়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান বাংলাদেশের আকাশসীমাও লঙ্ঘন করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই গোলা ছুড়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এমনকি গোলাগুলোর কয়েকটি ইচ্ছাকৃতভাবেই ছোড়া হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা হয়তো বাংলাদেশকে বিশেষ কোনো বার্তা দিতে চায়। হতে পারে রাখাইনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির ব্যাপারে বাংলাদেশকে সাবধান করতে চায় এবং রাখাইন ও চীন প্রদেশের গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশকে কঠোরভাবে নিরপেক্ষ থাকার জন্য বলছে। কারণ, সম্প্রতি আরাকান আর্মি ইঙ্গিত দিয়েছে, বাংলাদেশ যদি তাদের স্বীকৃতি দিয়ে সহযোগিতা করে তাহলে তারাও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সহায়তা করবে।
তবে, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশ নিরপেক্ষই রয়েছে। এমন কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই যে, রাখাইনের ভেতরের ঘটনাবলিতে বা চীন প্রদেশের বিদ্রোহেও বাংলাদেশ কোনো পদক্ষেপ বা ভূমিকা নিয়েছে। ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার পরও বাংলাদেশ রাখাইন থেকে দূরে এবং নিরপেক্ষ অবস্থানেই রয়েছে। তার পরও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এমন উসকানিমূলক আচরণ করছে। এ থেকে স্পষ্ট যে, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের উত্তাপ বাংলাদেশেও এসে পড়বে। আর এখন শুধু বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন বা চীন প্রদেশেই নয় বরং পুরো মিয়ানমারেই রীতিমতো গৃহযুদ্ধ চলছে। সেনা শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থিদের সঙ্গে দেশটির বিভিন্ন প্রদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গড়ার জন্য এক হয়ে লড়াই শুরু করেছে।
অনেক বিশ্লেষক আবার বলছেন, এই উসকানির পেছনে চীন দেশের হাতও থাকতে পারে। একদিকে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কোয়াড জোটে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। অন্যদিকে, চীন চায় বাংলাদেশ যেন তাদের নেতৃত্বাধীন গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) এবং গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভে (জিএসআই) যোগ দেয়। এখন মিয়ানমারকে দিয়ে বাংলাদেশে গোলাবর্ষণের মাধ্যমে চীন হয়তো ইঙ্গিত দিচ্ছে, অবাধ্য হলে তারা চাইলে বাংলাদেশের জন্য আরও বড় সমস্যাও তৈরি করতে পারে।
তবে চলমান এই ভূরাজনৈতিক খেলার আরও বহু বছর আগে থেকেই মিয়ানমার ভূ-অর্থনৈতিক দিক থেকেও বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠছিল। এমনকি ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগরে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে মিয়ানমার বাংলাদেশের স্বার্থের বিপরীতে ব্যবহৃত হওয়ার ক্ষেত্র প্রায় প্রস্তুত। ফলে মিয়ানমার ইস্যুতে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আমরা এখন অনেক বেশি নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছি। কারণ মিয়ানমারের মোকাবিলায় বাংলাদেশ প্রায় বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে।
রাখাইন প্রদেশসহ পুরো মিয়ানমারেই চীন ও ভারতের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। রাখাইন প্রদেশে গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পে চীন হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। ভারতও এর ভাগীদার হতে চায়। ভারত অবশ্য, ২০১৬ সালেই রাখাইনের রাজধানী সিত্তের উপকূলে একটি সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করেছে। চীন ও ভারত উভয় দেশই বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগর হয়ে রপ্তানি ও আমদানি বাণিজ্যের জন্য মিয়ানমারের বন্দরগুলো ব্যবহার করছে। রাখাইন প্রদেশে তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সড়ক এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পেও তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এ ছাড়া, জাপান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরেরও মিয়ানমারে বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। সম্প্রতি মিয়ানমার রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক গভীর করেছে। ফলে জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক বা আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক কোনো বহুজাতিক ফোরামের কাছ থেকেও বাংলাদেশ সামান্যতম সাহায্যও আশা করতে পারে না।
মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা চীনের সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ক। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার আগে থেকেই মিয়ানমার ও চীন পরস্পরকে ‘সহোদর’ ভাই বলে সম্বোধন করত; যা থেকে তাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা অনুমান করা যায়। মিয়ানমারের দিক থেকে ঐতিহাসিকভাবেই চীন তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। কারণ চীনের সঙ্গে দেশটির রয়েছে ১৩৪৮ মাইলের এক বিশাল সীমান্ত। মিয়ানমারে সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও অন্যান্য বহুমুখী দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উন্নয়ন সহযোগিতা প্রত্যাহার করে নেয় এবং পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধও আরোপ করে। ফলে মিয়ানমার তার টিকে থাকার জন্য আরও বেশি চীনমুখী নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের দুই লাইনের সম্পর্ক ছিল, দ্বিরাষ্ট্রিক সম্পর্ক এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্ক। চীনে ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর চীন মিয়ানমারেও কমিউনিস্টদের ক্ষমতায় আনতে চাইলে দেশ দুটির দ্বিরাষ্ট্রিক সম্পর্কে অবনতি ঘটে। তবে ১৯৮৫ সালে চীন মিয়ানমারের কমিউনিস্টদের সহায়তা দেওয়ার নীতি ত্যাগ করে এবং ১৯৮৯ সালে এক অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টিও খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়। এই সুযোগে মিয়ানমারের সামরিক সরকার চীন সীমান্তবর্তী কমিউনিস্ট গ্রুপগুলোর সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে সমর্থ হয়। রাস্তাঘাট নির্মাণ, বিদ্যুৎকেন্দ্র, স্কুল, হাসপাতাল তৈরি, বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান এবং সীমান্ত-বাণিজ্য প্রভৃতি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহযোগিতার বিনিময়ে কমিউনিস্টরাও তাদের সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে। এরপর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা থান শুয়ে ১৯৮৯ সালের অক্টোবরে চীন ভ্রমণ করেন এবং চীনের সঙ্গে গভীর ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক স্থাপন করেন।
তারপর থেকেই মূলত মিয়ানমার পরাশক্তিগুলোর কাছ থেকে অস্ত্র আমদানি না করে নিরপেক্ষ থাকার নীতি ত্যাগ করে এবং চীনের অস্ত্র দিয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলে। একই সঙ্গে চীনের কাছ থেকে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সহায়তাও আদায় করে নেয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মিয়ানমার চীনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়। চীনের সঙ্গে সুদৃঢ় অর্থনৈতিক সম্পর্কের ফলেই মিয়ানমারের বর্তমান সেনা সরকারও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখেও টিকে থাকতে পারছে। এমনকি মাঝখানের অং সান সু চির কথিত বেসামরিক সরকারও টিকে থাকার জন্য সম্পূর্ণতই চীনের ওপরই নির্ভরশীল ছিল। কারণ পর্দার আড়ালে সেনাবাহিনীই সব কলকাঠি নাড়ছিল।
চীন মিয়ানমারের তিনটি ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়Ñ অবকাঠামো উন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অর্থনৈতিক উদ্যোগ এবং জ্বালানি খাত। এর মধ্যে ‘আইয়েয়াওয়াদ্দা সড়ক প্রকল্প’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনের ইউনান থেকে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনের থিলওয়া বন্দর পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এই প্রকল্পের লক্ষ্য। এর অধীনে ভামো পর্যন্ত নদী পথের ড্রেজিং, ভামোতে একটি কনটেইনার পোর্ট নির্মাণ এবং সেখান থেকে চীনের সীমান্ত বন্দর মুজে বা লিউজেল পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ। যার মূল উদ্দেশ্য, মিয়ানমারের ওপর দিয়ে সরাসরি বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান সাগরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা। এতে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সঙ্গে চীনাদের বাণিজ্যের পরিবহন খরচ ও সময় অনেক বেঁচে যাবে এবং মালাক্কা প্রণালির সংঘাত এড়িয়ে চলা যাবে। তা ছাড়া বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও সহজেই প্রবেশ করা যাবে। সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধের ক্ষেত্রে চীন যেই কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে, তার পেছনে এটি এবং রাখাইনের গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পটিও অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এদিকে, বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণ এখনো মূলত যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের হাতেই রয়েছে। চীনও সেখানে ভাগীদার হতে চায়। ফলে এক মহাপ্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে গেছে। এখন এই তিন শক্তির কার কী অবস্থান এবং কার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো কী সেসবের ওপর আমাদের অবিলম্বে গভীরভাবে মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের রাজনীতিক বিশ্লেষণে অতিসরলীকরণ আর গৎবাঁধা সূত্র দিয়ে সবকিছু বোঝাপড়ার চেষ্টার যে ধরাবাঁধা একটা প্রকট প্রবণতা আছে, সেখান থেকেও বের হয়ে এসে বাস্তব তথ্য-উপাত্তনির্ভর বিশ্লেষণের সঙ্গে পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা এবং দ্বন্দ্বের মধ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে নিজেদের বিপদগুলো কী তা নির্মোহভাবে শনাক্ত করাটাও জরুরি।
এ ছাড়া পরাশক্তিগুলোর সম্পর্কে মোড় বদল বা নতুন উপাদান যুক্ত হলে কী ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে তাও আগাম আন্দাজ করতে না পারলে আমাদের নিরাপত্তা ভাবনা এবং পররাষ্ট্রনীতির সঠিক অভিমুখ নির্ণয় করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। অনেকেই প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্রনীতির ভারসাম্য আর ভরকেন্দ্রের জায়গাগুলো গুলিয়ে ফেলছেন। বাস্তব স্বার্থগত সম্পর্কের জড়াজড়ি আর শক্তির মেরুকরণের গতি প্রক্রিয়ায় নতুন যে উপাদানগুলো যুক্ত হতে পারে বা হচ্ছে তার দিকেও নজর রাখছেন না। একই সঙ্গে সম্ভাব্য মিত্র অনুসন্ধান ও নিরাপত্তা ভারসাম্যের অনুকূল পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের কাজও করতে হবে এই বাস্তব পরিস্থিতির নিরিখেই। আর কূটনীতির পাশাপাশি সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, জনগণকে সমগ্র পরিস্থিতি জানিয়ে এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তুতি শুরু করা। কারণ, দিন শেষে নিজের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের লড়াইটা বাংলাদেশকে একাই লড়তে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক
বড় সংখ্যার গণিতটাই বড় নয়, আসলটা হচ্ছে যোগফলটা নির্ভুল কি না। বলা হলো এ কারণে যে, স্বাধীনতা-উত্তর ঢাকা শহরে অসংখ্য বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় বেসরকারি বাণিজ্য পুঁজির হাত ধরে জন্ম নিয়েছে। চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় তো বটেই, প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয় ও হোটেল ম্যানেজমেন্টের মতো সেবামূলক উচ্চতর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রের ‘জাতে ওঠার’ চেষ্টায় রত। অন্যদিকে উপনিবেশ যুগের অন্তিম পর্বে শিক্ষা-সুযোগ বঞ্চিত কৃষিনির্ভর পূর্ববঙ্গীয় ‘বাঙাল’ রক্তে সামন্তবাদী জীবনচর্চার বাইরে আধুনিকতার হিমোগ্লোবিন বয়ে দেওয়ার জন্য তৈরি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ তকমা দেনেওয়ালাদের উদ্দেশ্য যে খুব মহৎ ছিল তা বলা যাবে না। সরকারি অর্থের সঙ্গে নবাব-জমিদার-ব্যবসায়ীদের দানে গড়ে ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অখণ্ড দু-এক দশক শিক্ষার্থী হিসেবে ধারণ করেছিল পূর্ববঙ্গের শহর, উপশহর এবং কৃষ্টিভিত্তিক গ্রামের হিন্দু-মুসলমান অভিজাত শ্রেণির সন্তানদের। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির বদল ঘটে। শিক্ষার্থীদের বড় অংশটিই হয়ে ওঠে গ্রামের শিক্ষাবঞ্চিত কৃষক পরিবারের। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ণবাদ অর্থাৎ উচ্চবর্গীয় হিন্দু শিক্ষক ও ছাত্রদের যে দাপট টিকে ছিল দীর্ঘদিন, এই অভিশাপমুক্ত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিরদিনই।
হিন্দু-মুসলমান শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা ছাত্রাবাস থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে হিন্দু উচ্চবর্গীয় ছাত্রদের অত্যাচারে তিতিবিরক্ত হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মতো পৃথক ছাত্রাবাস তৈরির দাবি তোলার প্রয়োজন। তৎকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে বর্ণবাদের শিকার হয়েছিলেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। অপমানের কারণেই নিজের নামের বানান বদলে ‘মেঘনাথ’-এর বদলে ‘মেঘনাদ’ অর্থাৎ মেঘের গর্জন রেখেছিলেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এর সাক্ষী ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল শুধু মুসলিম সমাজে শিক্ষা বিস্তার নয়, উচ্চতর দর্শন সৃষ্টি। উচ্চতর মানবিক দর্শন, আধুনিকতা, বিজ্ঞান-মনস্কতা, আধুনিক অর্থনীতি, কল্পিত নয়, বাস্তব ইতিহাসচর্চা। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্ররাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন রাষ্ট্রের দাপুটে আমলা হওয়ার লোভ পরিহার করে। এসব কারণেই আজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মানুষ পূর্ববঙ্গের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক নবজাগরণের ধাত্রীভূমি হিসেবে সালাম জানায়। অথচ এই মহান বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে ঘিরে আজ কী হচ্ছে?
সাতচল্লিশের বাংলা ভাগের সময় ঢাকা ছিল খুবই ছোট একটি শহর। তার চারপাশ ঘিরে ছিল না ছিন্নমূল মানুষে ঠাসা বস্তি। দরিদ্র মানুষের বস্তিতে ঢাকা ঘেরাও হতে থাকে দেশ ভাগের পর। এর আগে অল্প আয়ের দরিদ্রদের বসবাস মূল শহরের সীমানা কাঠামোর ভেতর ছিল। শ্রেণির ভাগাভাগি থাকলেও এত স্পষ্ট ছিল না। নগর ঢাকার শ্রেণি ভাগাভাগিটা বেআব্রু হয়ে ওঠে একাত্তরের স্বাধীনতা-উত্তর। সারা বাংলায় যুদ্ধের ধ্বংসলীলা আর চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ কর্মহীন ক্ষুধার্ত মানুষকে বাধ্য করে বাস্তুভিটা ফেলে রাজধানী শহরে ছুটে আসতে। আর ঠিক তখনই নাগরিকের শ্রেণি-পরিচয়টা ব্যাপক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালির একাংশের ধনী হওয়ার প্রবণতা নীতিহীন প্রতিযোগিতা শ্রেণি-বদলকে উসকে দেয়। রাখঢাক নয়, ঝলমল করে ওঠে দরিদ্রের ঢাকা শহর, ধনীর শহর, মধ্যবিত্তের শহর ও ছিন্নমূলের শহর। দ্রুত ঢাকার জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। নানা পেশার শ্রমজীবীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে রূপান্তরিত ঢাকায় বৃদ্ধি পায় ধনী আর উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে দরিদ্রের সংখ্যা।
উন্নত বিশ্ব ইউরোপ-আমেরিকা তো বটেই, এশিয়ার ধনী দেশগুলোতেও দারিদ্র্য আছে, দরিদ্র আছে, কিন্তু বোঝা যায় না। লজ্জাটা নানা কৌশলে ঢাকা থাকে। ঢাকার লজ্জা কিন্তু আড়াল থাকে না। আড়ালের রাজনীতিটা জানা নেই নগর ঢাকার। কেননা অনন্ত সমস্যা তার। ঢাকার ভূতলে পানীয় জল নেই। শুষে নিয়েছে নগর তৃষ্ণা। সেই কবে ভূভাগের ওপরে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ মরণদশায় চলে গেছে। নগর তৃষ্ণার ড্রাগনের মতো দীর্ঘ জিহ্বা পৌঁছে গেছে পদ্মায়। পদ্মাকে শুধু ইলিশ জোগালেই হয় না, তৃষ্ণাও মেটাতে হয়। নগর ঢাকার সেসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। পূর্বপাশের জলাভূমি গিলে নদী শীতলক্ষ্যাকে জাপটে ধরে পূর্বতীরের ফসল ভূমি ডিঙিয়ে ছুটছে আরও আগে। পদ্মা নদীটা শীতলক্ষার মতো ছোট নয় বলে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। দখলদারির দায়িত্ব পেয়েছে এবার পদ্মা সেতু। মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুরে গিলবে ঢাকা শহর। মেট্রোরেল বা পাতাল রেল নগরীর নিজের বুক খুঁড়ে পাতালে যেতে পারছে না বলে মাথার ওপরে উঠে আকাশ দখল নিচ্ছে। মেট্রোরেল বাঙালির মাথার ওপর দিয়ে ছুটবে, আর কী চাই উন্নয়ন বাঙালির?
ঐতিহাসিক কারণেই ইংরেজরা ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির আদলে গড়ে তুলেছিল কলকাতাকে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে কিছু বাঙালিকে সঙ্গী করে ইংরেজরা ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিচর্চা শুরু করে কলকাতায়। সেই সংস্কৃতির ভেতর লুকিয়েছিল আধিপত্যবাদ, আনুগত্য আর শাসকের প্রতি মুগ্ধতা। সঙ্গে ছিল তাদের শিল্প-সাহিত্য, ঐতিহ্য, সংগীত, কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান ইত্যাদির প্রতি মুগ্ধতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলে অনিবার্য হয়ে ওঠে ঔপনিবেশিক আর উত্তর-ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব। সেই দ্বান্দ্বিক বাস্তবতা যত তীব্র ছিল নগর কলকাতায়, ততটা ছিল না ঢাকায়। স্বাধীন পূর্ববঙ্গবাসীর নগর ঢাকা তখন গঠন-পুনর্গঠনে ব্যস্ত। মুসলিম লীগের ভাঙন, আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্ভব, পূর্ববঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের বিপর্যয়, কমিউনিস্ট পার্টির নিষিদ্ধকরণ ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বেরই ফল। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, এর সবকিছুরই ধাত্রীভূমি ছিল নবাবি বাংলা আর কোম্পানি বাংলার এই ঢাকা শহর।
সাতচল্লিশের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে থেকেই পূর্ববঙ্গের বাঙালির রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক রাজধানী হয়ে ওঠে নগর ঢাকা। এ ক্ষেত্রে সংকট ছিল সংস্কৃতির। প্রশ্নগুলো ছিল বাঙালি নাকি মুসলমান? ‘বাঙালি’ সংস্কৃতিটা কত পার্সেন্ট মুসলিম আর কত পার্সেন্ট হিন্দু? নির্মম সত্য এই যে, একাত্তরের শ্রদ্ধাটাও এর মীমাংসা ষোলোআনা করতে পারল না। পারার কথাও নয়। জাতীয়তাবাদ এর মীমাংসা করতে পারে না। পারে একমাত্র সমাজতন্ত্র। বাঙালিরা অনেক কিছুই করেছে। ভাষার জন্য লড়াই করেছে, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে, যা অসমাপ্ত রেখেছে তা পাশ কেটে গেছে তার নাম সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সাংস্কৃতিক বিপ্লব তো দূর-অস্ত।
একাত্তরের চেতনা-স্নাত এবং দর্শনজাত বাঙালি আজ নগর ঢাকায় দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে। বিবর্তনবাদে প্রজাতি বিলুপ্তের দশা যেন। কয়েকজন ক্ষমতালোভী সেনানায়ক আর ক্ষুদ্র স্বার্থান্বেষী মহলের সামরিক অভ্যুত্থান কি লড়াকু জাতির সব অর্জন ধ্বংস করে দিতে পারে? পারে না তো! অথচ পঁচাত্তরে পারল। কেন পারল? পারল, কেননা সাংস্কৃতিক চর্চাবর্জিত কোনো জাতীয়তাবাদই টেকসই হয় না। ক্ষণভঙ্গুর হতে বাধ্য। বাঙালি জাতীয়তাবাদে শুধু ছিল রাজনীতি। ছিল না শক্ত ভিতের সাংস্কৃতিক শক্তি। রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক খুঁটিগুলো দাঁড়িয়ে থাকে যে সংস্কৃতির পোক্ত ভিতের ওপর তা না থাকলে সামান্য চাপেই পুরো কাঠামো ভেঙে পড়ে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের হিসাব দরকার। দেখতে হবে কীভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে একাত্তরের বাঙালিত্ব। শূন্যস্থান পূর্ণ করছে যুদ্ধের ভেতর দিয়ে পরিত্যাগ করা বা বর্জন করা বর্জ্যপদার্থ। মৌলবাদ।
রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক দর্শন নড়বড়ে হয়ে যায় যদি সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র গড়ে না ওঠে। অন্যদিকে চর্চার কেন্দ্রগুলোর দুয়ার বন্ধ করে দিলে একসময় অন্ধকার ঘরটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে ইঁদুর-উই পোকার দাপটে। যেমনটা ঘটেছিল সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার পতনের আগেই। সংস্কৃতি শুধু তো নাচ-গান-যাত্রাপালা চর্চা বা উপভোগ করা নয়, মূল চর্চাটা হচ্ছে মৌলবিজ্ঞানচর্চা, বস্তুবাদী দর্শনচর্চা। জ্ঞানচর্চার সর্বক্ষেত্রে নিত্যনতুন জিজ্ঞাসা ও উত্তরের জন্য গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা একটি আধুনিক নগরের লক্ষণ। ইউরোপ-আমেরিকার বড় বড় শহরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমনি গবেষণা কেন্দ্র আছে। ওসবেই তৈরি হয় নোবেল বিজয়ীদের। সংস্কৃতি ক্ষেত্রের নানা অভিনতুন তত্ত্বও সৃষ্টি হয় তাতে। একটি নগর সেই কেন্দ্রগুলোকে লালন-পালন করে। অন্যদিকে নগর ঢাকা? দেখেশুনে মনে হচ্ছে পুরো ঢাকা শহরটাকেই দখল করে আছেন রাজনীতি আর রাজনীতিবিদরা। গলি, রাজপথ যেখানেই চোখ যায় শুধু রাজনৈতিক দলের ছোট-বড় ক্লাব-অফিস, নেতা-পাতি নেতা। দেয়ালগুলো ভরে আছে ভুল বানানে লেখা রাজনৈতিক সেøাগান। অন্যদিকে ইউরোপ-আমেরিকার শহরে হেঁটে হেঁটে কালঘাম ছুটে যাবে রাজনৈতিক দলের কার্যালয় খুঁজে পেতে।
ইউরোপের নগরগুলোকে কেন্দ্র করে যেমনি মধ্যযুগ, তেমনি আধুনিক যুগেও বিশ্বসভ্যতার চিন্তা ও মতবাদের উদ্ভব ঘটেছে। আশ্চর্য এটাও যে পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক ধর্মীয় অবতারদের জন্মও নগরে। আসলে নগরকেন্দ্রিক সমাজ ও জীবনসভ্যতার বিকাশের অন্যতম উচ্চস্তর। শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে বিজ্ঞান মনস্কতার চর্চা, সমাজচিন্তার নানা রকম মতবাদের উদ্ভব ঘটে নগর জীবনকে কেন্দ্র করে। বাস্তব সত্য হচ্ছে বাঙালির কাছে শিল্পবিপ্লবের কনসেপ্টটাই অনার্জিত এবং অজানা। স্বাধীন বাঙালির নব নব গবেষণার নগরী হয়ে উঠল না। ঢাকা শুধু শাসকশ্রেণির বসবাসের নগরী, লুটেরা নব্য ধনীদের ভোগবাদের নগরী হয়েই রইল। প্রাচীন এথেন্স কিংবা আধুনিক লন্ডন এবং আরও অনেক নগরীর দূরবর্তী এক নগরের নাম ঢাকা। বাঙালিকে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক যুগ ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছিল বিদ্যাসাগর, রামমোহন, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জগদীশ বসু, সত্যেন বসু, কাজী আবদুল ওদুদের মতো মহান ব্যক্তিদের পেতে। বিশ্ব যেমনি অপেক্ষা করেছিল সক্রেটিস, মার্কস, লেনিন, নিউটন, আইনস্টাইন, শেক্সপিয়ারকে পেতে। কোথায় বসে? নিশ্চয়ই কোনো না কোনো নগর ঠিকানায়। বাঙালিরাও কি নগর ঢাকায় বসে এমনি কারও অপেক্ষায় আছে? কে বা কারা এবং কত দিন?
লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক
‘মধ্যবিত্ত’ শুধু মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাকে নির্দেশ করে না, বরং, মধ্যবিত্ত একটা কালচার বা সংস্কৃতিকে প্রকাশ করে। মধ্যবিত্ত কালচারের ওপর ভিত্তি করে ইউরোপে রেনেসাঁর জন্ম হয়েছিল। উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও ছিল মধ্যবিত্তদের নেতৃত্ব আর মনস্তত্ত্ব। এ দেশের মধ্যবিত্তদের রাজনৈতিক চেতনা বা আন্দোলনের শক্তি অত জোরদার না হলেও, সামাজিক কালচারে তারা কিন্তু কখনোই পিছিয়ে ছিল না। কিন্তু, বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনমনে, বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সবচেয়ে দুশ্চিন্তায় আর ঝুঁকিতে মধ্যবিত্তরাই।
দেশব্যাপী দ্রব্যমূল্য নিয়ে মারাত্মক আলোচনা আর সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কিছু জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে বা ভবিষ্যতে আরও হবে, যার সুফল দেশের দরিদ্র মানুষ পেলেও মধ্যবিত্তরা খুব একটা পাবে না। তৃতীয় বিশ্বের দেশের সরকাররা সাধারণত খুব একটা বেশি জনকল্যাণমূলক সরকার হয় না। হলেও তাদের গৃহীত স্কিমগুলো বড়জোর দরিদ্র শ্রেণি পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে।
এ দেশের মধ্যবিত্ত কারা? এ দেশে এই প্রশ্নের উত্তর বহু দিন ধরেই ফয়সালা হয়নি। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন সময়ে, ‘মধ্যবিত্ত’দের সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেসব সংজ্ঞা ত্রুটিমুক্ত নয়। অর্থনীতি যেহেতু আমার বিষয় নয়, তাই আমার বাস্তবিক জ্ঞান থেকে, আমি আমার এই লেখাতে মধ্যবিত্তদের সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা ‘মধ্যবিত্ত’ বলতে সাধারণত বুঝি, যারা কিছুটা বা ক্ষেত্রবিশেষে খানিকটা শিক্ষিত; মাঝারি বা স্বল্প বেতনের চাকরি অথবা ব্যবসা করে; অথবা চাকরি থেকে অবসরে গিয়ে, পেনশনের টাকাগুলো দিয়ে বিভিন্নভাবে জীবিকা নির্বাহ করে। এই ধরনের সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থাসম্পন্ন মানুষগুলো আমাদের সমাজে সংখ্যায় যদিও অনেক, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে অবহেলিত। সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এদের জীবনকে শুধু জীবিকার ক্ষেত্রেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলেনি, বরং এদের অনেক সামাজিক লাইফস্টাইলকে বিপন্ন করছে। কিন্তু, এ বিষয়টাকে এত হেলাফেলা করে দেখার কিছু নেই। কারণ মধ্যবিত্তদের ব্যবহারিক জীবনযাপন রাষ্ট্রের অর্থনীতি, রাজনীতি ও মূল্যবোধকেও প্রভাবিত করে।
এবার দেখা যাক, মধ্যবিত্তদের ব্যবহারিক জীবনযাপন কেমন হয়? গত ২০১৫ সাল থেকে মধ্যবিত্তদের লাইফস্টাইল একটা মাত্রা পেয়েছিল। কারণ, সরকার তখন বাজার মূল্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাধারণ মানুষের সুবিধার জন্য নতুন পে-স্কেল ঘোষণা করেছিল। এর ফলে, সরকারি ও বেসরকারি খাতে চাকুরেদের বেতন বাড়ে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এবং তাদের বহুদিনের রুচির বাস্তবায়ন ঘটানোর সুবিধা হয়। গণপরিবহনের যাচ্ছেতাই অবস্থার কারণে মধ্যবিত্তরা মেল বা লোকাল ট্রেন ছেড়ে, ইন্টারসিটির তাপানুকূল কম্পার্টমেন্টে চড়া শুরু করে। এদের কল্যাণে দূরপাল্লায় বহু এসি বাসের সূচনা হয়। এরা দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে বিমানে চড়ে সেলফি তোলা শুরু করে। ছুটি-ছাঁটাতে এরা কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ির হোটেলগুলো ভরিয়ে ফেলে। সরকারি হসপিটালের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে দেড় মিনিটের সেবা নেওয়া থেকে নিজেদের সরিয়ে এনে, প্রাইভেট হসপিটালে সেবা নেওয়া শুরু করে। এরাই লোকাল বাস আর লেগুনা ছেড়ে, পুরো সিএনজি বা ইজিবাইক ভাড়া নিয়ে আত্মীয়বাড়িতে দাওয়াত খেতে যায়। এরা স্যাঁতসেঁতে আর দুর্গন্ধময় কাঁচাবাজার ছেড়ে, কিছুটা বাড়তি দাম দিয়েও সুপার স্টোরে গিয়ে বাজার করা শুরু করেছিল। তীব্র গরম থেকে মুক্তি পেতে এরা কিস্তিতে এসি আর আইপিএস কিনেছিল। মাসের কোনো এক ছুটির দিনে এরা পুরো পরিবার নিয়ে বাইরে যেত, সিনেমা দেখত, রেস্টুরেন্টের বিরিয়ানি কিনে খেত। এরাই ছিল বইমেলার আর বাণিজ্য মেলার সবচেয়ে বড় ক্রেতা গোষ্ঠী। তারপরও এরা মাস শেষে কিছুটা অর্থ সঞ্চয় করে, নিজেদের ছোট ছোট সাধ পূরণের চেষ্টায় ছিল।
কিন্তু অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মধ্যবিত্তদের যাপিত জীবনের অনেক কিছুকেই আজ ব্যাহত করেছে। এরাই সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত। এরা পারছে না রাতারাতি এদের জীবনের অনেক চর্চাকে ত্যাগ করতে, না পারছে ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে তাল মেলাতে। এদের জন্য নেই কোনো রেশন কার্ড, ফেয়ার প্রাইস কার্ড, ভিজিএফ কার্ড, কিছুই। এরা চাইলেও দৌড়াতে পারে না টিসিবির ট্রাকের পেছনে। দিনে দিনে অনেক সাধ-আহ্লাদ ত্যাগ করে, এরা আজ ক্ষুব্ধ রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে। কোনো সন্দেহ নেই যে, সাম্প্রতিক মহামারি ও যুদ্ধের বৈশি^ক প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি এই হঠাৎ দ্রব্যমূল্যের পেছনে আছে রাষ্ট্রের আর্থিক খাতে অনেক দিনের জমে থাকা দুর্নীতি, অনিয়ম আর জবাবদিহিহীনতা। তাই তো প্রতিনিয়ত অনিয়মের বিরুদ্ধে আজ এরা সজাগ সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিভিন্ন অনাচারের ওপর ট্রল ভিডিও, প্যারোডি আর গান বানিয়ে, এরা এদের প্রতিবাদের জানান দিচ্ছে। মধ্যবিত্তরা এমনিতেই এদের অবস্থানের কারণেই প্রাকৃতিকভাবে খানিকটা ক্রিয়েটিভ থাকে। রাজপথে নামার মতো তীব্র সাহস আর তেজ যদিও এরা দেখাচ্ছে না, কিন্তু তাই বলে এদের আওয়াজ বন্ধ নেই। মানুষের সাধারণত পেটে খেলে, পিঠে সয়; কিন্তু পেটের খাবারেই যদি টান পড়ে, তখন আর তার হারানোর কোনো ভয় থাকে না। মধ্যবিত্তদের এই সামাজিক মাধ্যমের আওয়াজ যদি রাজপথে নেমে আসে, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।
অনতিবিলম্বে সরকারের উচিত হবে, মধ্যবিত্তদের বাছাই করে, তাদের জন্য কিছু প্রণোদনা ঘোষণা করা। সরকারের উচিত নতুন পে-স্কেল প্রদান করা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ওপর ভর্তুকি দেওয়া। মধ্যবিত্তদের জন্য ফেয়ার প্রাইস কার্ড চালু করা বা রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করা। মধ্যবিত্তদের অবহেলা করা উচিত নয়। দেশে এবং বিদেশে বেশির ভাগ রাজনৈতিক আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ মধ্যবিত্তদের মধ্য থেকে উত্থিত হতে দেখা গেছে।
লেখক : শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এক মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের মুখে পড়ল দেশ। আমরা যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি তা সাধারণত বিদ্যুৎকেন্দ্র, সোলার প্ল্যান্ট, জলবিদ্যুৎ, বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন করা হয়। বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ একই জায়গায় যুক্ত করা হয়, যা গ্রিড নামে পরিচিত। এই গ্রিড বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আগত বিদ্যুৎকে ম্যানেজ করে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়। প্রয়োজন অনুযায়ী বণ্টন নিশ্চিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। আর জাতীয় গ্রিড হলো প্রতিটি গ্রিডের সঙ্গে অন্য একটি গ্রিডকে যুক্ত করে রাখা, যা পরিচালনা করে সরকারি সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। কোনো কারণে জাতীয় গ্রিড ফেইল করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত অসংখ্যবার নানা মাত্রায় ঘটনাটি ঘটেছে। ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর সারা দেশে বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল। যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে দেয়। ২০১৭ সালের ৩ মে আকস্মিক গ্রিড বিপর্যয়ে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমের ৩২টি জেলা কয়েক ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় গ্রিডের আরেকটি সঞ্চালন লাইনের বিভ্রাটে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল বিভাগসহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ৪০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকে। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় গ্রিডের একটি সঞ্চালন লাইনে বিভ্রাট দেখা দেওয়ায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহসহ দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ৩২টি জেলায় ৪ থেকে ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। এতে মানুষের ভোগান্তির পাশাপাশি কলকারখানায় উৎপাদন ও অফিস-আদালতে কাজকর্ম বিঘ্নিত হয়। হাসপাতালগুলোতে সেবা ব্যাহত হয়। জেনারেটর চালাতে জ্বালানি তেল কিনতে পেট্রোলপাম্পগুলোতে ভিড় করে মানুষ। মোবাইল সেবা বিঘিœত, ব্যাংকের এটিএম বুথ বন্ধ হয়ে যায়। পূজামণ্ডপে নিতে হয় বাড়তি সতর্কতা।
এ কথা ঠিক যে, বিদ্যুৎ গ্রিডে সমস্যা হতে পারে। বিদ্যুৎসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরনো ও জরাজীর্ণ সঞ্চালন লাইনে (গ্রিড) ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হলে গ্রিডের সার্কিট পুড়ে বিপর্যয় ঘটতে পারে। সঞ্চালন লাইনে ছিদ্র দেখা দিলে, তা থেকে স্পার্ক করে গ্রিড বন্ধ হতে পারে। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ফ্রিকোয়েন্সিতে হেরফের হলে গ্রিড বন্ধ হতে পারে। এমনকি চালু বা সক্রিয় অবস্থায় সঞ্চালন লাইনে কোনো পাখি বসলে কিংবা কোনো গাছ বা গাছের ডালপালা ভেঙে পড়লেও গ্রিড বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ ছিল লাইনের নিচে বেড়ে ওঠা একটি গাছ সঞ্চালন লাইনটি স্পর্শ করা। ২০১২ সালে ভারতের গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ পাঞ্জাব রাজ্যের কৃষকরা সেচের জন্য অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছিল। ফলে সঞ্চালন লাইন ওভারলোডেড হয়ে বিপর্যয় ঘটে। বাংলাদেশে গত ৬ সেপ্টেম্বর সঞ্চালন লাইনে বিভ্রাটের কারণ জানা যায়নি। ২০১৪ সালের জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে বিদ্যুৎ কর্র্তৃপক্ষ জাতীয় বিদ্যুৎ ‘সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি’ কমে যাওয়ার কথা বলে। কিন্তু গ্রিডের কোথায়, কী কারণে এ সমস্যা হয়েছিল সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গতকালের ঘটনার সূত্রে বারবার কেন জাতীয় গ্রিডে সমস্যা হচ্ছে জানতে চাইলে পিজিসিবির নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, ‘কারিগরি ত্রুটির কারণেই এমনটি হয়েছে বলে আমরা মনে করি। ওভারলোডের কারণে সমস্যা হয়নি। তবে আরও কোনো কারণ আছে কি না, তা বুঝতে সময় প্রয়োজন।’ ঘটনা অনুসন্ধানে দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। আশা করি, তদন্ত কমিটি এবার কী এবং কোথায় সমস্যা হয়েছিল, তা জানাবে।
গ্রিডে সমস্যা হলেও তার তীব্রতা নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি রয়েছে। যেমনÑ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে গ্রিডের সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত করা যায়, যাতে গ্রিড বন্ধ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গ্রিড থেকে বিযুক্ত হয়ে যাবে। এর ফলে গ্রিড বন্ধ হলেও কেন্দ্রটি বন্ধ হবে না। গ্রিড মেরামতের পর কেন্দ্রটি আবার গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করা যাবে। এই ব্যবস্থায় গ্রিডে সমস্যার কারণে কখনোই বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে না। দেশে এখন এ ব্যবস্থাটি সক্রিয় নেই। বারবার জাতীয় গ্রিডে ছোট-বড় বিপর্যয়ের ঘটনার পরও এ ব্যবস্থাটি কেন এখনো সক্রিয় করার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না, তা একটি বড় প্রশ্ন। স্বয়ংক্রিয় গ্রিড না থাকায় বিপর্যয়ের উৎস খুঁজে পেতেও দেরি হচ্ছে পিজিসিবির। দ্রুত মানোন্নয়ন করা না হলে সামনে আরও বড় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। দেশের বিদ্যুৎ সঞ্চালন অবকাঠামো অনেক পুরনো। এতে বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। এটার আধুনিকায়নের কথা দীর্ঘদিন ধরে বলা হলেও কাজ হচ্ছে না।
১৮৯৩ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ মেঘনাদ সাহা। তার বাবা জগন্নাথ সাহা ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ১৯০৫ সালে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। তবে বঙ্গভঙ্গের (১৯০৫-১৯১১) প্রতিবাদ সভায় যোগ দেওয়ায় স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর ঢাকা জুবিলী স্কুলে ভর্তি হন। ১৯০৯ সালে তিনি পূর্ববঙ্গের ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান পেয়ে এন্ট্রান্স পাস করেন। পরে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসিতে তৃতীয় এবং কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে অনার্সসহ বিএসসিতে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১৫ সালে ফলিত গণিতে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯১৮ সালে তিনি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে যোগ দেন। আলোর চাপের ওপর গবেষণা করে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ‘অ্যাস্ট্রাফিজিকস’-এর ওপর গবেষণা করে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি পান ১৯২০ সালে। ১৯২৩ সালে তিনি এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। একই বছর তিনি কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। তাপের প্রভাবে কীভাবে বৈদ্যুতিক শক্তিসম্পন্ন অণু গঠিত হয় তত্ত্বটি তার। পরমাণুবিজ্ঞান, আয়নমণ্ডল, পঞ্জিকা সংস্কার, বন্যার প্রতিরোধ ও নদী পরিকল্পনা-সংক্রান্ত বিষয়ে তার গবেষণা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ‘সায়েন্স অ্যান্ড কালচার’ নামক বিজ্ঞানবিষয়ক মাসিক পত্রিকার অন্যতম প্রকাশক। কলকাতায় ‘ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিকস’ (১৯৪৮) তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর পর এটির নামকরণ হয় ‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিকস’। তার লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ‘The Principle of Relativity, Treatise on Heat, Treatise on Modern Physics’ ইত্যাদি। ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।