
১৮৯৩ সালের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ মেঘনাদ সাহা। তার বাবা জগন্নাথ সাহা ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ১৯০৫ সালে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। তবে বঙ্গভঙ্গের (১৯০৫-১৯১১) প্রতিবাদ সভায় যোগ দেওয়ায় স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর ঢাকা জুবিলী স্কুলে ভর্তি হন। ১৯০৯ সালে তিনি পূর্ববঙ্গের ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান পেয়ে এন্ট্রান্স পাস করেন। পরে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসিতে তৃতীয় এবং কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে অনার্সসহ বিএসসিতে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১৫ সালে ফলিত গণিতে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯১৮ সালে তিনি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে যোগ দেন। আলোর চাপের ওপর গবেষণা করে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ‘অ্যাস্ট্রাফিজিকস’-এর ওপর গবেষণা করে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি পান ১৯২০ সালে। ১৯২৩ সালে তিনি এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। একই বছর তিনি কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। তাপের প্রভাবে কীভাবে বৈদ্যুতিক শক্তিসম্পন্ন অণু গঠিত হয় তত্ত্বটি তার। পরমাণুবিজ্ঞান, আয়নমণ্ডল, পঞ্জিকা সংস্কার, বন্যার প্রতিরোধ ও নদী পরিকল্পনা-সংক্রান্ত বিষয়ে তার গবেষণা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ‘সায়েন্স অ্যান্ড কালচার’ নামক বিজ্ঞানবিষয়ক মাসিক পত্রিকার অন্যতম প্রকাশক। কলকাতায় ‘ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিকস’ (১৯৪৮) তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর পর এটির নামকরণ হয় ‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিকস’। তার লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ‘The Principle of Relativity, Treatise on Heat, Treatise on Modern Physics’ ইত্যাদি। ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বড় সংখ্যার গণিতটাই বড় নয়, আসলটা হচ্ছে যোগফলটা নির্ভুল কি না। বলা হলো এ কারণে যে, স্বাধীনতা-উত্তর ঢাকা শহরে অসংখ্য বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় বেসরকারি বাণিজ্য পুঁজির হাত ধরে জন্ম নিয়েছে। চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় তো বটেই, প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয় ও হোটেল ম্যানেজমেন্টের মতো সেবামূলক উচ্চতর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রের ‘জাতে ওঠার’ চেষ্টায় রত। অন্যদিকে উপনিবেশ যুগের অন্তিম পর্বে শিক্ষা-সুযোগ বঞ্চিত কৃষিনির্ভর পূর্ববঙ্গীয় ‘বাঙাল’ রক্তে সামন্তবাদী জীবনচর্চার বাইরে আধুনিকতার হিমোগ্লোবিন বয়ে দেওয়ার জন্য তৈরি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ তকমা দেনেওয়ালাদের উদ্দেশ্য যে খুব মহৎ ছিল তা বলা যাবে না। সরকারি অর্থের সঙ্গে নবাব-জমিদার-ব্যবসায়ীদের দানে গড়ে ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অখণ্ড দু-এক দশক শিক্ষার্থী হিসেবে ধারণ করেছিল পূর্ববঙ্গের শহর, উপশহর এবং কৃষ্টিভিত্তিক গ্রামের হিন্দু-মুসলমান অভিজাত শ্রেণির সন্তানদের। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির বদল ঘটে। শিক্ষার্থীদের বড় অংশটিই হয়ে ওঠে গ্রামের শিক্ষাবঞ্চিত কৃষক পরিবারের। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ণবাদ অর্থাৎ উচ্চবর্গীয় হিন্দু শিক্ষক ও ছাত্রদের যে দাপট টিকে ছিল দীর্ঘদিন, এই অভিশাপমুক্ত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিরদিনই।
হিন্দু-মুসলমান শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা ছাত্রাবাস থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে হিন্দু উচ্চবর্গীয় ছাত্রদের অত্যাচারে তিতিবিরক্ত হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মতো পৃথক ছাত্রাবাস তৈরির দাবি তোলার প্রয়োজন। তৎকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে বর্ণবাদের শিকার হয়েছিলেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। অপমানের কারণেই নিজের নামের বানান বদলে ‘মেঘনাথ’-এর বদলে ‘মেঘনাদ’ অর্থাৎ মেঘের গর্জন রেখেছিলেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এর সাক্ষী ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল শুধু মুসলিম সমাজে শিক্ষা বিস্তার নয়, উচ্চতর দর্শন সৃষ্টি। উচ্চতর মানবিক দর্শন, আধুনিকতা, বিজ্ঞান-মনস্কতা, আধুনিক অর্থনীতি, কল্পিত নয়, বাস্তব ইতিহাসচর্চা। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্ররাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন রাষ্ট্রের দাপুটে আমলা হওয়ার লোভ পরিহার করে। এসব কারণেই আজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মানুষ পূর্ববঙ্গের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক নবজাগরণের ধাত্রীভূমি হিসেবে সালাম জানায়। অথচ এই মহান বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে ঘিরে আজ কী হচ্ছে?
সাতচল্লিশের বাংলা ভাগের সময় ঢাকা ছিল খুবই ছোট একটি শহর। তার চারপাশ ঘিরে ছিল না ছিন্নমূল মানুষে ঠাসা বস্তি। দরিদ্র মানুষের বস্তিতে ঢাকা ঘেরাও হতে থাকে দেশ ভাগের পর। এর আগে অল্প আয়ের দরিদ্রদের বসবাস মূল শহরের সীমানা কাঠামোর ভেতর ছিল। শ্রেণির ভাগাভাগি থাকলেও এত স্পষ্ট ছিল না। নগর ঢাকার শ্রেণি ভাগাভাগিটা বেআব্রু হয়ে ওঠে একাত্তরের স্বাধীনতা-উত্তর। সারা বাংলায় যুদ্ধের ধ্বংসলীলা আর চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ কর্মহীন ক্ষুধার্ত মানুষকে বাধ্য করে বাস্তুভিটা ফেলে রাজধানী শহরে ছুটে আসতে। আর ঠিক তখনই নাগরিকের শ্রেণি-পরিচয়টা ব্যাপক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালির একাংশের ধনী হওয়ার প্রবণতা নীতিহীন প্রতিযোগিতা শ্রেণি-বদলকে উসকে দেয়। রাখঢাক নয়, ঝলমল করে ওঠে দরিদ্রের ঢাকা শহর, ধনীর শহর, মধ্যবিত্তের শহর ও ছিন্নমূলের শহর। দ্রুত ঢাকার জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। নানা পেশার শ্রমজীবীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে রূপান্তরিত ঢাকায় বৃদ্ধি পায় ধনী আর উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে দরিদ্রের সংখ্যা।
উন্নত বিশ্ব ইউরোপ-আমেরিকা তো বটেই, এশিয়ার ধনী দেশগুলোতেও দারিদ্র্য আছে, দরিদ্র আছে, কিন্তু বোঝা যায় না। লজ্জাটা নানা কৌশলে ঢাকা থাকে। ঢাকার লজ্জা কিন্তু আড়াল থাকে না। আড়ালের রাজনীতিটা জানা নেই নগর ঢাকার। কেননা অনন্ত সমস্যা তার। ঢাকার ভূতলে পানীয় জল নেই। শুষে নিয়েছে নগর তৃষ্ণা। সেই কবে ভূভাগের ওপরে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ মরণদশায় চলে গেছে। নগর তৃষ্ণার ড্রাগনের মতো দীর্ঘ জিহ্বা পৌঁছে গেছে পদ্মায়। পদ্মাকে শুধু ইলিশ জোগালেই হয় না, তৃষ্ণাও মেটাতে হয়। নগর ঢাকার সেসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। পূর্বপাশের জলাভূমি গিলে নদী শীতলক্ষ্যাকে জাপটে ধরে পূর্বতীরের ফসল ভূমি ডিঙিয়ে ছুটছে আরও আগে। পদ্মা নদীটা শীতলক্ষার মতো ছোট নয় বলে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। দখলদারির দায়িত্ব পেয়েছে এবার পদ্মা সেতু। মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুরে গিলবে ঢাকা শহর। মেট্রোরেল বা পাতাল রেল নগরীর নিজের বুক খুঁড়ে পাতালে যেতে পারছে না বলে মাথার ওপরে উঠে আকাশ দখল নিচ্ছে। মেট্রোরেল বাঙালির মাথার ওপর দিয়ে ছুটবে, আর কী চাই উন্নয়ন বাঙালির?
ঐতিহাসিক কারণেই ইংরেজরা ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির আদলে গড়ে তুলেছিল কলকাতাকে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে কিছু বাঙালিকে সঙ্গী করে ইংরেজরা ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিচর্চা শুরু করে কলকাতায়। সেই সংস্কৃতির ভেতর লুকিয়েছিল আধিপত্যবাদ, আনুগত্য আর শাসকের প্রতি মুগ্ধতা। সঙ্গে ছিল তাদের শিল্প-সাহিত্য, ঐতিহ্য, সংগীত, কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান ইত্যাদির প্রতি মুগ্ধতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলে অনিবার্য হয়ে ওঠে ঔপনিবেশিক আর উত্তর-ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব। সেই দ্বান্দ্বিক বাস্তবতা যত তীব্র ছিল নগর কলকাতায়, ততটা ছিল না ঢাকায়। স্বাধীন পূর্ববঙ্গবাসীর নগর ঢাকা তখন গঠন-পুনর্গঠনে ব্যস্ত। মুসলিম লীগের ভাঙন, আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্ভব, পূর্ববঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের বিপর্যয়, কমিউনিস্ট পার্টির নিষিদ্ধকরণ ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বেরই ফল। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, এর সবকিছুরই ধাত্রীভূমি ছিল নবাবি বাংলা আর কোম্পানি বাংলার এই ঢাকা শহর।
সাতচল্লিশের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে থেকেই পূর্ববঙ্গের বাঙালির রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক রাজধানী হয়ে ওঠে নগর ঢাকা। এ ক্ষেত্রে সংকট ছিল সংস্কৃতির। প্রশ্নগুলো ছিল বাঙালি নাকি মুসলমান? ‘বাঙালি’ সংস্কৃতিটা কত পার্সেন্ট মুসলিম আর কত পার্সেন্ট হিন্দু? নির্মম সত্য এই যে, একাত্তরের শ্রদ্ধাটাও এর মীমাংসা ষোলোআনা করতে পারল না। পারার কথাও নয়। জাতীয়তাবাদ এর মীমাংসা করতে পারে না। পারে একমাত্র সমাজতন্ত্র। বাঙালিরা অনেক কিছুই করেছে। ভাষার জন্য লড়াই করেছে, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছে, যা অসমাপ্ত রেখেছে তা পাশ কেটে গেছে তার নাম সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সাংস্কৃতিক বিপ্লব তো দূর-অস্ত।
একাত্তরের চেতনা-স্নাত এবং দর্শনজাত বাঙালি আজ নগর ঢাকায় দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে। বিবর্তনবাদে প্রজাতি বিলুপ্তের দশা যেন। কয়েকজন ক্ষমতালোভী সেনানায়ক আর ক্ষুদ্র স্বার্থান্বেষী মহলের সামরিক অভ্যুত্থান কি লড়াকু জাতির সব অর্জন ধ্বংস করে দিতে পারে? পারে না তো! অথচ পঁচাত্তরে পারল। কেন পারল? পারল, কেননা সাংস্কৃতিক চর্চাবর্জিত কোনো জাতীয়তাবাদই টেকসই হয় না। ক্ষণভঙ্গুর হতে বাধ্য। বাঙালি জাতীয়তাবাদে শুধু ছিল রাজনীতি। ছিল না শক্ত ভিতের সাংস্কৃতিক শক্তি। রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক খুঁটিগুলো দাঁড়িয়ে থাকে যে সংস্কৃতির পোক্ত ভিতের ওপর তা না থাকলে সামান্য চাপেই পুরো কাঠামো ভেঙে পড়ে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের হিসাব দরকার। দেখতে হবে কীভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে একাত্তরের বাঙালিত্ব। শূন্যস্থান পূর্ণ করছে যুদ্ধের ভেতর দিয়ে পরিত্যাগ করা বা বর্জন করা বর্জ্যপদার্থ। মৌলবাদ।
রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক দর্শন নড়বড়ে হয়ে যায় যদি সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র গড়ে না ওঠে। অন্যদিকে চর্চার কেন্দ্রগুলোর দুয়ার বন্ধ করে দিলে একসময় অন্ধকার ঘরটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে ইঁদুর-উই পোকার দাপটে। যেমনটা ঘটেছিল সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার পতনের আগেই। সংস্কৃতি শুধু তো নাচ-গান-যাত্রাপালা চর্চা বা উপভোগ করা নয়, মূল চর্চাটা হচ্ছে মৌলবিজ্ঞানচর্চা, বস্তুবাদী দর্শনচর্চা। জ্ঞানচর্চার সর্বক্ষেত্রে নিত্যনতুন জিজ্ঞাসা ও উত্তরের জন্য গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা একটি আধুনিক নগরের লক্ষণ। ইউরোপ-আমেরিকার বড় বড় শহরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমনি গবেষণা কেন্দ্র আছে। ওসবেই তৈরি হয় নোবেল বিজয়ীদের। সংস্কৃতি ক্ষেত্রের নানা অভিনতুন তত্ত্বও সৃষ্টি হয় তাতে। একটি নগর সেই কেন্দ্রগুলোকে লালন-পালন করে। অন্যদিকে নগর ঢাকা? দেখেশুনে মনে হচ্ছে পুরো ঢাকা শহরটাকেই দখল করে আছেন রাজনীতি আর রাজনীতিবিদরা। গলি, রাজপথ যেখানেই চোখ যায় শুধু রাজনৈতিক দলের ছোট-বড় ক্লাব-অফিস, নেতা-পাতি নেতা। দেয়ালগুলো ভরে আছে ভুল বানানে লেখা রাজনৈতিক সেøাগান। অন্যদিকে ইউরোপ-আমেরিকার শহরে হেঁটে হেঁটে কালঘাম ছুটে যাবে রাজনৈতিক দলের কার্যালয় খুঁজে পেতে।
ইউরোপের নগরগুলোকে কেন্দ্র করে যেমনি মধ্যযুগ, তেমনি আধুনিক যুগেও বিশ্বসভ্যতার চিন্তা ও মতবাদের উদ্ভব ঘটেছে। আশ্চর্য এটাও যে পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক ধর্মীয় অবতারদের জন্মও নগরে। আসলে নগরকেন্দ্রিক সমাজ ও জীবনসভ্যতার বিকাশের অন্যতম উচ্চস্তর। শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে বিজ্ঞান মনস্কতার চর্চা, সমাজচিন্তার নানা রকম মতবাদের উদ্ভব ঘটে নগর জীবনকে কেন্দ্র করে। বাস্তব সত্য হচ্ছে বাঙালির কাছে শিল্পবিপ্লবের কনসেপ্টটাই অনার্জিত এবং অজানা। স্বাধীন বাঙালির নব নব গবেষণার নগরী হয়ে উঠল না। ঢাকা শুধু শাসকশ্রেণির বসবাসের নগরী, লুটেরা নব্য ধনীদের ভোগবাদের নগরী হয়েই রইল। প্রাচীন এথেন্স কিংবা আধুনিক লন্ডন এবং আরও অনেক নগরীর দূরবর্তী এক নগরের নাম ঢাকা। বাঙালিকে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক যুগ ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছিল বিদ্যাসাগর, রামমোহন, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জগদীশ বসু, সত্যেন বসু, কাজী আবদুল ওদুদের মতো মহান ব্যক্তিদের পেতে। বিশ্ব যেমনি অপেক্ষা করেছিল সক্রেটিস, মার্কস, লেনিন, নিউটন, আইনস্টাইন, শেক্সপিয়ারকে পেতে। কোথায় বসে? নিশ্চয়ই কোনো না কোনো নগর ঠিকানায়। বাঙালিরাও কি নগর ঢাকায় বসে এমনি কারও অপেক্ষায় আছে? কে বা কারা এবং কত দিন?
লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক
‘মধ্যবিত্ত’ শুধু মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাকে নির্দেশ করে না, বরং, মধ্যবিত্ত একটা কালচার বা সংস্কৃতিকে প্রকাশ করে। মধ্যবিত্ত কালচারের ওপর ভিত্তি করে ইউরোপে রেনেসাঁর জন্ম হয়েছিল। উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও ছিল মধ্যবিত্তদের নেতৃত্ব আর মনস্তত্ত্ব। এ দেশের মধ্যবিত্তদের রাজনৈতিক চেতনা বা আন্দোলনের শক্তি অত জোরদার না হলেও, সামাজিক কালচারে তারা কিন্তু কখনোই পিছিয়ে ছিল না। কিন্তু, বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনমনে, বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সবচেয়ে দুশ্চিন্তায় আর ঝুঁকিতে মধ্যবিত্তরাই।
দেশব্যাপী দ্রব্যমূল্য নিয়ে মারাত্মক আলোচনা আর সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কিছু জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে বা ভবিষ্যতে আরও হবে, যার সুফল দেশের দরিদ্র মানুষ পেলেও মধ্যবিত্তরা খুব একটা পাবে না। তৃতীয় বিশ্বের দেশের সরকাররা সাধারণত খুব একটা বেশি জনকল্যাণমূলক সরকার হয় না। হলেও তাদের গৃহীত স্কিমগুলো বড়জোর দরিদ্র শ্রেণি পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে।
এ দেশের মধ্যবিত্ত কারা? এ দেশে এই প্রশ্নের উত্তর বহু দিন ধরেই ফয়সালা হয়নি। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন সময়ে, ‘মধ্যবিত্ত’দের সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেসব সংজ্ঞা ত্রুটিমুক্ত নয়। অর্থনীতি যেহেতু আমার বিষয় নয়, তাই আমার বাস্তবিক জ্ঞান থেকে, আমি আমার এই লেখাতে মধ্যবিত্তদের সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা ‘মধ্যবিত্ত’ বলতে সাধারণত বুঝি, যারা কিছুটা বা ক্ষেত্রবিশেষে খানিকটা শিক্ষিত; মাঝারি বা স্বল্প বেতনের চাকরি অথবা ব্যবসা করে; অথবা চাকরি থেকে অবসরে গিয়ে, পেনশনের টাকাগুলো দিয়ে বিভিন্নভাবে জীবিকা নির্বাহ করে। এই ধরনের সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থাসম্পন্ন মানুষগুলো আমাদের সমাজে সংখ্যায় যদিও অনেক, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে অবহেলিত। সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এদের জীবনকে শুধু জীবিকার ক্ষেত্রেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলেনি, বরং এদের অনেক সামাজিক লাইফস্টাইলকে বিপন্ন করছে। কিন্তু, এ বিষয়টাকে এত হেলাফেলা করে দেখার কিছু নেই। কারণ মধ্যবিত্তদের ব্যবহারিক জীবনযাপন রাষ্ট্রের অর্থনীতি, রাজনীতি ও মূল্যবোধকেও প্রভাবিত করে।
এবার দেখা যাক, মধ্যবিত্তদের ব্যবহারিক জীবনযাপন কেমন হয়? গত ২০১৫ সাল থেকে মধ্যবিত্তদের লাইফস্টাইল একটা মাত্রা পেয়েছিল। কারণ, সরকার তখন বাজার মূল্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাধারণ মানুষের সুবিধার জন্য নতুন পে-স্কেল ঘোষণা করেছিল। এর ফলে, সরকারি ও বেসরকারি খাতে চাকুরেদের বেতন বাড়ে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এবং তাদের বহুদিনের রুচির বাস্তবায়ন ঘটানোর সুবিধা হয়। গণপরিবহনের যাচ্ছেতাই অবস্থার কারণে মধ্যবিত্তরা মেল বা লোকাল ট্রেন ছেড়ে, ইন্টারসিটির তাপানুকূল কম্পার্টমেন্টে চড়া শুরু করে। এদের কল্যাণে দূরপাল্লায় বহু এসি বাসের সূচনা হয়। এরা দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে বিমানে চড়ে সেলফি তোলা শুরু করে। ছুটি-ছাঁটাতে এরা কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ির হোটেলগুলো ভরিয়ে ফেলে। সরকারি হসপিটালের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে দেড় মিনিটের সেবা নেওয়া থেকে নিজেদের সরিয়ে এনে, প্রাইভেট হসপিটালে সেবা নেওয়া শুরু করে। এরাই লোকাল বাস আর লেগুনা ছেড়ে, পুরো সিএনজি বা ইজিবাইক ভাড়া নিয়ে আত্মীয়বাড়িতে দাওয়াত খেতে যায়। এরা স্যাঁতসেঁতে আর দুর্গন্ধময় কাঁচাবাজার ছেড়ে, কিছুটা বাড়তি দাম দিয়েও সুপার স্টোরে গিয়ে বাজার করা শুরু করেছিল। তীব্র গরম থেকে মুক্তি পেতে এরা কিস্তিতে এসি আর আইপিএস কিনেছিল। মাসের কোনো এক ছুটির দিনে এরা পুরো পরিবার নিয়ে বাইরে যেত, সিনেমা দেখত, রেস্টুরেন্টের বিরিয়ানি কিনে খেত। এরাই ছিল বইমেলার আর বাণিজ্য মেলার সবচেয়ে বড় ক্রেতা গোষ্ঠী। তারপরও এরা মাস শেষে কিছুটা অর্থ সঞ্চয় করে, নিজেদের ছোট ছোট সাধ পূরণের চেষ্টায় ছিল।
কিন্তু অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মধ্যবিত্তদের যাপিত জীবনের অনেক কিছুকেই আজ ব্যাহত করেছে। এরাই সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত। এরা পারছে না রাতারাতি এদের জীবনের অনেক চর্চাকে ত্যাগ করতে, না পারছে ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে তাল মেলাতে। এদের জন্য নেই কোনো রেশন কার্ড, ফেয়ার প্রাইস কার্ড, ভিজিএফ কার্ড, কিছুই। এরা চাইলেও দৌড়াতে পারে না টিসিবির ট্রাকের পেছনে। দিনে দিনে অনেক সাধ-আহ্লাদ ত্যাগ করে, এরা আজ ক্ষুব্ধ রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে। কোনো সন্দেহ নেই যে, সাম্প্রতিক মহামারি ও যুদ্ধের বৈশি^ক প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি এই হঠাৎ দ্রব্যমূল্যের পেছনে আছে রাষ্ট্রের আর্থিক খাতে অনেক দিনের জমে থাকা দুর্নীতি, অনিয়ম আর জবাবদিহিহীনতা। তাই তো প্রতিনিয়ত অনিয়মের বিরুদ্ধে আজ এরা সজাগ সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিভিন্ন অনাচারের ওপর ট্রল ভিডিও, প্যারোডি আর গান বানিয়ে, এরা এদের প্রতিবাদের জানান দিচ্ছে। মধ্যবিত্তরা এমনিতেই এদের অবস্থানের কারণেই প্রাকৃতিকভাবে খানিকটা ক্রিয়েটিভ থাকে। রাজপথে নামার মতো তীব্র সাহস আর তেজ যদিও এরা দেখাচ্ছে না, কিন্তু তাই বলে এদের আওয়াজ বন্ধ নেই। মানুষের সাধারণত পেটে খেলে, পিঠে সয়; কিন্তু পেটের খাবারেই যদি টান পড়ে, তখন আর তার হারানোর কোনো ভয় থাকে না। মধ্যবিত্তদের এই সামাজিক মাধ্যমের আওয়াজ যদি রাজপথে নেমে আসে, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।
অনতিবিলম্বে সরকারের উচিত হবে, মধ্যবিত্তদের বাছাই করে, তাদের জন্য কিছু প্রণোদনা ঘোষণা করা। সরকারের উচিত নতুন পে-স্কেল প্রদান করা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ওপর ভর্তুকি দেওয়া। মধ্যবিত্তদের জন্য ফেয়ার প্রাইস কার্ড চালু করা বা রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করা। মধ্যবিত্তদের অবহেলা করা উচিত নয়। দেশে এবং বিদেশে বেশির ভাগ রাজনৈতিক আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ মধ্যবিত্তদের মধ্য থেকে উত্থিত হতে দেখা গেছে।
লেখক : শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
গত মাসে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের বিদ্রোহীদের সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের সময় একাধিকবার বেশ কিছু গোলা বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরেও এসে পড়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান বাংলাদেশের আকাশসীমাও লঙ্ঘন করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই গোলা ছুড়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এমনকি গোলাগুলোর কয়েকটি ইচ্ছাকৃতভাবেই ছোড়া হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা হয়তো বাংলাদেশকে বিশেষ কোনো বার্তা দিতে চায়। হতে পারে রাখাইনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির ব্যাপারে বাংলাদেশকে সাবধান করতে চায় এবং রাখাইন ও চীন প্রদেশের গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশকে কঠোরভাবে নিরপেক্ষ থাকার জন্য বলছে। কারণ, সম্প্রতি আরাকান আর্মি ইঙ্গিত দিয়েছে, বাংলাদেশ যদি তাদের স্বীকৃতি দিয়ে সহযোগিতা করে তাহলে তারাও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সহায়তা করবে।
তবে, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশ নিরপেক্ষই রয়েছে। এমন কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই যে, রাখাইনের ভেতরের ঘটনাবলিতে বা চীন প্রদেশের বিদ্রোহেও বাংলাদেশ কোনো পদক্ষেপ বা ভূমিকা নিয়েছে। ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার পরও বাংলাদেশ রাখাইন থেকে দূরে এবং নিরপেক্ষ অবস্থানেই রয়েছে। তার পরও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এমন উসকানিমূলক আচরণ করছে। এ থেকে স্পষ্ট যে, মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের উত্তাপ বাংলাদেশেও এসে পড়বে। আর এখন শুধু বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন বা চীন প্রদেশেই নয় বরং পুরো মিয়ানমারেই রীতিমতো গৃহযুদ্ধ চলছে। সেনা শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থিদের সঙ্গে দেশটির বিভিন্ন প্রদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গড়ার জন্য এক হয়ে লড়াই শুরু করেছে।
অনেক বিশ্লেষক আবার বলছেন, এই উসকানির পেছনে চীন দেশের হাতও থাকতে পারে। একদিকে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কোয়াড জোটে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। অন্যদিকে, চীন চায় বাংলাদেশ যেন তাদের নেতৃত্বাধীন গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) এবং গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভে (জিএসআই) যোগ দেয়। এখন মিয়ানমারকে দিয়ে বাংলাদেশে গোলাবর্ষণের মাধ্যমে চীন হয়তো ইঙ্গিত দিচ্ছে, অবাধ্য হলে তারা চাইলে বাংলাদেশের জন্য আরও বড় সমস্যাও তৈরি করতে পারে।
তবে চলমান এই ভূরাজনৈতিক খেলার আরও বহু বছর আগে থেকেই মিয়ানমার ভূ-অর্থনৈতিক দিক থেকেও বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠছিল। এমনকি ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগরে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে মিয়ানমার বাংলাদেশের স্বার্থের বিপরীতে ব্যবহৃত হওয়ার ক্ষেত্র প্রায় প্রস্তুত। ফলে মিয়ানমার ইস্যুতে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আমরা এখন অনেক বেশি নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছি। কারণ মিয়ানমারের মোকাবিলায় বাংলাদেশ প্রায় বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে।
রাখাইন প্রদেশসহ পুরো মিয়ানমারেই চীন ও ভারতের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। রাখাইন প্রদেশে গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পে চীন হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। ভারতও এর ভাগীদার হতে চায়। ভারত অবশ্য, ২০১৬ সালেই রাখাইনের রাজধানী সিত্তের উপকূলে একটি সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করেছে। চীন ও ভারত উভয় দেশই বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগর হয়ে রপ্তানি ও আমদানি বাণিজ্যের জন্য মিয়ানমারের বন্দরগুলো ব্যবহার করছে। রাখাইন প্রদেশে তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সড়ক এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পেও তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এ ছাড়া, জাপান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরেরও মিয়ানমারে বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। সম্প্রতি মিয়ানমার রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক গভীর করেছে। ফলে জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক বা আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক কোনো বহুজাতিক ফোরামের কাছ থেকেও বাংলাদেশ সামান্যতম সাহায্যও আশা করতে পারে না।
মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা চীনের সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ক। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার আগে থেকেই মিয়ানমার ও চীন পরস্পরকে ‘সহোদর’ ভাই বলে সম্বোধন করত; যা থেকে তাদের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা অনুমান করা যায়। মিয়ানমারের দিক থেকে ঐতিহাসিকভাবেই চীন তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। কারণ চীনের সঙ্গে দেশটির রয়েছে ১৩৪৮ মাইলের এক বিশাল সীমান্ত। মিয়ানমারে সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও অন্যান্য বহুমুখী দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উন্নয়ন সহযোগিতা প্রত্যাহার করে নেয় এবং পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধও আরোপ করে। ফলে মিয়ানমার তার টিকে থাকার জন্য আরও বেশি চীনমুখী নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের দুই লাইনের সম্পর্ক ছিল, দ্বিরাষ্ট্রিক সম্পর্ক এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্ক। চীনে ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর চীন মিয়ানমারেও কমিউনিস্টদের ক্ষমতায় আনতে চাইলে দেশ দুটির দ্বিরাষ্ট্রিক সম্পর্কে অবনতি ঘটে। তবে ১৯৮৫ সালে চীন মিয়ানমারের কমিউনিস্টদের সহায়তা দেওয়ার নীতি ত্যাগ করে এবং ১৯৮৯ সালে এক অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বার্মিজ কমিউনিস্ট পার্টিও খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়। এই সুযোগে মিয়ানমারের সামরিক সরকার চীন সীমান্তবর্তী কমিউনিস্ট গ্রুপগুলোর সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে সমর্থ হয়। রাস্তাঘাট নির্মাণ, বিদ্যুৎকেন্দ্র, স্কুল, হাসপাতাল তৈরি, বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান এবং সীমান্ত-বাণিজ্য প্রভৃতি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহযোগিতার বিনিময়ে কমিউনিস্টরাও তাদের সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে। এরপর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা থান শুয়ে ১৯৮৯ সালের অক্টোবরে চীন ভ্রমণ করেন এবং চীনের সঙ্গে গভীর ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক স্থাপন করেন।
তারপর থেকেই মূলত মিয়ানমার পরাশক্তিগুলোর কাছ থেকে অস্ত্র আমদানি না করে নিরপেক্ষ থাকার নীতি ত্যাগ করে এবং চীনের অস্ত্র দিয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলে। একই সঙ্গে চীনের কাছ থেকে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সহায়তাও আদায় করে নেয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মিয়ানমার চীনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়। চীনের সঙ্গে সুদৃঢ় অর্থনৈতিক সম্পর্কের ফলেই মিয়ানমারের বর্তমান সেনা সরকারও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখেও টিকে থাকতে পারছে। এমনকি মাঝখানের অং সান সু চির কথিত বেসামরিক সরকারও টিকে থাকার জন্য সম্পূর্ণতই চীনের ওপরই নির্ভরশীল ছিল। কারণ পর্দার আড়ালে সেনাবাহিনীই সব কলকাঠি নাড়ছিল।
চীন মিয়ানমারের তিনটি ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়Ñ অবকাঠামো উন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অর্থনৈতিক উদ্যোগ এবং জ্বালানি খাত। এর মধ্যে ‘আইয়েয়াওয়াদ্দা সড়ক প্রকল্প’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনের ইউনান থেকে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনের থিলওয়া বন্দর পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এই প্রকল্পের লক্ষ্য। এর অধীনে ভামো পর্যন্ত নদী পথের ড্রেজিং, ভামোতে একটি কনটেইনার পোর্ট নির্মাণ এবং সেখান থেকে চীনের সীমান্ত বন্দর মুজে বা লিউজেল পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ। যার মূল উদ্দেশ্য, মিয়ানমারের ওপর দিয়ে সরাসরি বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান সাগরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা। এতে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সঙ্গে চীনাদের বাণিজ্যের পরিবহন খরচ ও সময় অনেক বেঁচে যাবে এবং মালাক্কা প্রণালির সংঘাত এড়িয়ে চলা যাবে। তা ছাড়া বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও সহজেই প্রবেশ করা যাবে। সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধের ক্ষেত্রে চীন যেই কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে, তার পেছনে এটি এবং রাখাইনের গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পটিও অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এদিকে, বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণ এখনো মূলত যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের হাতেই রয়েছে। চীনও সেখানে ভাগীদার হতে চায়। ফলে এক মহাপ্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে গেছে। এখন এই তিন শক্তির কার কী অবস্থান এবং কার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো কী সেসবের ওপর আমাদের অবিলম্বে গভীরভাবে মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের রাজনীতিক বিশ্লেষণে অতিসরলীকরণ আর গৎবাঁধা সূত্র দিয়ে সবকিছু বোঝাপড়ার চেষ্টার যে ধরাবাঁধা একটা প্রকট প্রবণতা আছে, সেখান থেকেও বের হয়ে এসে বাস্তব তথ্য-উপাত্তনির্ভর বিশ্লেষণের সঙ্গে পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা এবং দ্বন্দ্বের মধ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে নিজেদের বিপদগুলো কী তা নির্মোহভাবে শনাক্ত করাটাও জরুরি।
এ ছাড়া পরাশক্তিগুলোর সম্পর্কে মোড় বদল বা নতুন উপাদান যুক্ত হলে কী ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে তাও আগাম আন্দাজ করতে না পারলে আমাদের নিরাপত্তা ভাবনা এবং পররাষ্ট্রনীতির সঠিক অভিমুখ নির্ণয় করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। অনেকেই প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্রনীতির ভারসাম্য আর ভরকেন্দ্রের জায়গাগুলো গুলিয়ে ফেলছেন। বাস্তব স্বার্থগত সম্পর্কের জড়াজড়ি আর শক্তির মেরুকরণের গতি প্রক্রিয়ায় নতুন যে উপাদানগুলো যুক্ত হতে পারে বা হচ্ছে তার দিকেও নজর রাখছেন না। একই সঙ্গে সম্ভাব্য মিত্র অনুসন্ধান ও নিরাপত্তা ভারসাম্যের অনুকূল পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের কাজও করতে হবে এই বাস্তব পরিস্থিতির নিরিখেই। আর কূটনীতির পাশাপাশি সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, জনগণকে সমগ্র পরিস্থিতি জানিয়ে এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তুতি শুরু করা। কারণ, দিন শেষে নিজের ন্যায্য হিস্যা আদায়ের লড়াইটা বাংলাদেশকে একাই লড়তে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক
এক মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের মুখে পড়ল দেশ। আমরা যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি তা সাধারণত বিদ্যুৎকেন্দ্র, সোলার প্ল্যান্ট, জলবিদ্যুৎ, বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন করা হয়। বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ একই জায়গায় যুক্ত করা হয়, যা গ্রিড নামে পরিচিত। এই গ্রিড বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আগত বিদ্যুৎকে ম্যানেজ করে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়। প্রয়োজন অনুযায়ী বণ্টন নিশ্চিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। আর জাতীয় গ্রিড হলো প্রতিটি গ্রিডের সঙ্গে অন্য একটি গ্রিডকে যুক্ত করে রাখা, যা পরিচালনা করে সরকারি সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। কোনো কারণে জাতীয় গ্রিড ফেইল করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত অসংখ্যবার নানা মাত্রায় ঘটনাটি ঘটেছে। ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর সারা দেশে বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল। যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে দেয়। ২০১৭ সালের ৩ মে আকস্মিক গ্রিড বিপর্যয়ে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমের ৩২টি জেলা কয়েক ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় গ্রিডের আরেকটি সঞ্চালন লাইনের বিভ্রাটে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল বিভাগসহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ৪০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকে। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় গ্রিডের একটি সঞ্চালন লাইনে বিভ্রাট দেখা দেওয়ায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহসহ দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ৩২টি জেলায় ৪ থেকে ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। এতে মানুষের ভোগান্তির পাশাপাশি কলকারখানায় উৎপাদন ও অফিস-আদালতে কাজকর্ম বিঘ্নিত হয়। হাসপাতালগুলোতে সেবা ব্যাহত হয়। জেনারেটর চালাতে জ্বালানি তেল কিনতে পেট্রোলপাম্পগুলোতে ভিড় করে মানুষ। মোবাইল সেবা বিঘিœত, ব্যাংকের এটিএম বুথ বন্ধ হয়ে যায়। পূজামণ্ডপে নিতে হয় বাড়তি সতর্কতা।
এ কথা ঠিক যে, বিদ্যুৎ গ্রিডে সমস্যা হতে পারে। বিদ্যুৎসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরনো ও জরাজীর্ণ সঞ্চালন লাইনে (গ্রিড) ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হলে গ্রিডের সার্কিট পুড়ে বিপর্যয় ঘটতে পারে। সঞ্চালন লাইনে ছিদ্র দেখা দিলে, তা থেকে স্পার্ক করে গ্রিড বন্ধ হতে পারে। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ফ্রিকোয়েন্সিতে হেরফের হলে গ্রিড বন্ধ হতে পারে। এমনকি চালু বা সক্রিয় অবস্থায় সঞ্চালন লাইনে কোনো পাখি বসলে কিংবা কোনো গাছ বা গাছের ডালপালা ভেঙে পড়লেও গ্রিড বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ ছিল লাইনের নিচে বেড়ে ওঠা একটি গাছ সঞ্চালন লাইনটি স্পর্শ করা। ২০১২ সালে ভারতের গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ পাঞ্জাব রাজ্যের কৃষকরা সেচের জন্য অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছিল। ফলে সঞ্চালন লাইন ওভারলোডেড হয়ে বিপর্যয় ঘটে। বাংলাদেশে গত ৬ সেপ্টেম্বর সঞ্চালন লাইনে বিভ্রাটের কারণ জানা যায়নি। ২০১৪ সালের জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে বিদ্যুৎ কর্র্তৃপক্ষ জাতীয় বিদ্যুৎ ‘সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি’ কমে যাওয়ার কথা বলে। কিন্তু গ্রিডের কোথায়, কী কারণে এ সমস্যা হয়েছিল সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গতকালের ঘটনার সূত্রে বারবার কেন জাতীয় গ্রিডে সমস্যা হচ্ছে জানতে চাইলে পিজিসিবির নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, ‘কারিগরি ত্রুটির কারণেই এমনটি হয়েছে বলে আমরা মনে করি। ওভারলোডের কারণে সমস্যা হয়নি। তবে আরও কোনো কারণ আছে কি না, তা বুঝতে সময় প্রয়োজন।’ ঘটনা অনুসন্ধানে দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। আশা করি, তদন্ত কমিটি এবার কী এবং কোথায় সমস্যা হয়েছিল, তা জানাবে।
গ্রিডে সমস্যা হলেও তার তীব্রতা নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি রয়েছে। যেমনÑ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে গ্রিডের সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত করা যায়, যাতে গ্রিড বন্ধ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গ্রিড থেকে বিযুক্ত হয়ে যাবে। এর ফলে গ্রিড বন্ধ হলেও কেন্দ্রটি বন্ধ হবে না। গ্রিড মেরামতের পর কেন্দ্রটি আবার গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করা যাবে। এই ব্যবস্থায় গ্রিডে সমস্যার কারণে কখনোই বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে না। দেশে এখন এ ব্যবস্থাটি সক্রিয় নেই। বারবার জাতীয় গ্রিডে ছোট-বড় বিপর্যয়ের ঘটনার পরও এ ব্যবস্থাটি কেন এখনো সক্রিয় করার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না, তা একটি বড় প্রশ্ন। স্বয়ংক্রিয় গ্রিড না থাকায় বিপর্যয়ের উৎস খুঁজে পেতেও দেরি হচ্ছে পিজিসিবির। দ্রুত মানোন্নয়ন করা না হলে সামনে আরও বড় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। দেশের বিদ্যুৎ সঞ্চালন অবকাঠামো অনেক পুরনো। এতে বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। এটার আধুনিকায়নের কথা দীর্ঘদিন ধরে বলা হলেও কাজ হচ্ছে না।
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভাড়া ৫৩ হাজার টাকা। এ রুটের অন্যসব এয়ারলাইনস আরও কম দামে যাত্রী বহন করলেও বিমান করে না। খালি যাবে, তাও কম ভাড়ায় যাত্রী নেয় না বিমান।
ঢাকা থেকে বিমান কত বেশি ভাড়া নেয় তা স্পষ্ট বোঝা যায় নিকটতম প্রতিবেশী শহর কলকাতার দিকে চোখ বোলালে। কলকাতার নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানের তিন ভাগের এক ভাগ ভাড়া দিয়ে কুয়ালালামপুর যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে উড়ে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে বিমানের ভাড়া বেশি। বিমানের ভাড়া শুধু বেশিই নয়, এই এয়ারলাইনস ভাড়া বাড়ানোর নেতৃত্ব দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রথমে বিমান ভাড়া বাড়ায় পরে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এয়ারলাইনসগুলো সেই সুযোগ নেয়।
অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় বিমানের ভাড়া বেশি এ অভিযোগ ছিল মূলত জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ট্রাভেল এজেন্টদের। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছেন সাধারণ যাত্রীরাও। কুয়ালালামপুর, রিয়াদ বা জেদ্দার মতো বাংলাদেশি শ্রমিকপ্রবণ শহরগুলোতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, দেশের বেসরকারি টেলিভিশন এমনকি খবরের কাগজগুলোতে যেচে এসে বলে যাচ্ছেন বিমান অনেক বেশি ভাড়া নিচ্ছে।
কীভাবে বিমান ভাড়া বাড়ায় জানতে চাইলে একজন জনশক্তি রপ্তানিকারক জানান, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখে তা নতুন করে বলার দরকার নেই। তাদের কর্মস্থলে পাঠাতে বা ফিরিয়ে আনতে বিমানের বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। বিমান কোনো দিন কোনো ঘোষণায় বলেনি ‘এ উদ্যোগটি শুধু রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য’। এই শ্রমজীবীদের জন্য বিমানের কোনো ছাড় নেই। বরং যখন যে ‘আদম বাজার’ চাঙ্গা হয় তখন সেখানে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় বিমান। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রচুর শ্রমিক যাচ্ছে। সেখানে ভাড়া বাড়িয়েছে সংস্থাটি। শ্রমিক এবং ওমরাহর কারণে জেদ্দার টিকিটই পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তা অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
এ অবস্থা থেকে বিমান কীভাবে বের হয়ে আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমান নানা পলিসি নিতে পারে। বিকল্প রুট চালু করতে পারে। ট্রানজিট দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে নিতে পারে। এতে যাত্রীরা কম দামে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ যাত্রী যেহেতু শ্রমজীবী তাই তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। কত সময় ট্রানজিট নিয়ে গেল তা মুখ্য নয়। ঠিক এ জায়গাটিতেই এগিয়ে আছে আমাদের নিকটবর্তী শহর কলকাতা। ঢাকার তুলনায় অনেক কম দামে কলকাতার যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। সেখান থেকে পরিচালিত এয়ারলাইনসগুলো সরাসরি বা এক-দুটি ট্রানজিট দিয়ে অনেক কমে যাত্রী বহন করে। বিমান কেন পারে না সেই প্রশ্নটি কেউ তুলছে না।
এক সপ্তাহ পর আগামী ৪ এপ্রিল ফ্লাই (যাত্রা) করার জন্য গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা কুয়ালালামপুর রুটের বিমান টিকিটের দাম ছিল ৫৩ হাজার ২৭ টাকা। থাই এয়ারওয়েজ ৪১ হাজার ৭৬ টাকায়, ইন্ডিগো এয়ার ৪৩ হাজার ৬৪৪, ইউএস-বাংলা ৪৭ হাজার ১৯, এয়ার এশিয়া ৪৯ হাজার ৪৪৫, মালিন্দো এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৯০ এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ভাড়া ছিল ৬১ হাজার ৪৭২ টাকা।
অথচ কলকাতা থেকে এয়ার এশিয়া একই দিনে একই গন্তব্যে নন-স্টপ ফ্লাইটে মাত্র ১৭ হাজার ৩৭৯ টাকায় পৌঁছে দেওয়ার অফার ছিল অনলাইনে। এয়ারক্রাফটের মানভেদে একই দিনে বিভিন্ন সময়ে টিকিটটির দাম ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ছিল। ইন্ডিগো এয়ার চেন্নাইয়ে একটি স্টপেজ দিয়ে ২০ হাজার ৩৩৭ টাকায় অফার দেয়। কলকাতা থেকে কুয়ালালামপুরে যাওয়ার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিটের দাম ছিল ২৯ হাজার ৬৩৯ টাকা। মুম্বাই এবং সিঙ্গাপুরে দুই স্টপেজ দিয়ে এয়ারলাইনসটি এ ভাড়া নির্ধারণ করে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস মুম্বাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে কলকাতা থেকে ৫৪ হাজার ৩২৬ টাকায় যাত্রীদের নিয়ে যায় কুয়ালালামপুর।
ঢাকা রিয়াদ রুটে আগামী ৩ এপ্রিলের এয়ার অ্যারাবিয়ার ভাড়া ৫৪ হাজার ৯৫১ টাকা। শারজায় একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কলম্বোতে একটি স্টপেজ দিয়ে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস রিয়াদ নিয়ে যাবে ৫৬ হাজার ৫৪৫ টাকায়। জাজিরা কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৫ হাজার টাকায়, গালফ এয়ার বাহরাইনে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৭ হাজার ৬৭৭ টাকায়, সৌদিয়া এয়ারলাইনস ৭১ হাজার ৭১১ টাকায় সরাসরি, কুয়েত এয়ারওয়েজ কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৩ হাজার ২৪৭ টাকায়, ওমান এয়ার মাস্কটে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৩২ টাকায়, ফ্লাই দুবাই দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৬৩ টাকায়, কাতার এয়ারওয়েজ দোহায় এক স্টপেজ দিয়ে ৮২ হাজার ৫৫৭ টাকায়, এমিরেটস দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৮৪ হাজার ২৩১ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে। আর ঢাকা-রিয়াদ রুটে বিমানের ভাড়া ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৭ টাকা। ৩ এপ্রিল কলকাতা থেকে রিয়াদ যাওয়ার ভাড়াও ঢাকা রিয়াদের তুলনায় অনেক কম।
কলকাতা থেকে মাত্র ৩৫ হাজার ৩২৪ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া। মুম্বাইতে মাত্র একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীদের সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। ওইদিন সময়ভেদে তাদের ভাড়া ৪১ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এক স্টপেজ দিয়ে ফ্লাই দুবাই নিয়ে যাচ্ছে ৪১ হাজার ৫৬০ টাকায়। ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ভাড়া ৪১ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকা। এয়ার ইন্ডিয়া দিল্লিতে একটি স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪১ হাজার ৪১৯ টাকা। গালফ এয়ার মুম্বাই এবং বাহরাইনে দুই দফা স্টপেজ দিয়ে নিচ্ছে ৪৫ হাজার ৫৮৭ টাকা। ইন্ডিগো এয়ার দিল্লিতে এক স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪৮ হাজার ১৮৭ টাকা। দুবাইতে এক দফা বিরতি দিয়ে এমিরেটস কলকাতা থেকে রিয়াদের ভাড়া নিচ্ছে ৫৪ হাজার ৬৪৬ টাকা। কাতার এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৩৮ টাকায় এবং এমিরেটস ৬০ হাজার ১০৮ টাকায় একটি বিরতি দিয়ে কলকাতা থেকে রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে।
এসব রুটে বিমানের উচ্চমূল্য নির্ধারণই ভাড়া বৃদ্ধির মূল কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এর সঙ্গে আছে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট কমানো এবং উচ্চ দামের সুযোগ নিতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং ২০২৩ সালে ডলারের বর্ধিত বিনিময় দর। জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধিও টিকিটের দাম বৃদ্ধির কারণ।
বিমানের এমডি শফিউল আজিম বিমান ভাড়া বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি না মানলেও রিক্রুটিং এজেন্ট, ট্রাভেল এজেন্ট বা হজ এজেন্সির তরফ থেকে বরাবরই এ অভিযোগ করা হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, যখন বিমান ভাড়া বাড়ায় তখন অন্য এয়ারলাইনসগুলোও ভাড়া বাড়ায়। বিমান যখন বাড়ায় তখন কোনো সীমা মানে না। তারা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ায়।
৩৫ বছরের পেশাজীবনের কথা উল্লেখ করে মাজহারুল ইসলাম বলেন, বিমানের ভাড়ার সঙ্গে কুলাতে পারছি না। একজনকে বাইরে পাঠানোর সব খরচ অনুমান করা যায়, বিমান ভাড়া ছাড়া। কারণ ৫ ডলারের ভিত্তিভাড়া তারা ৩০ ডলার থেকে শুরু করে। বিমান ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু জ্বালানি খরচ কমছে। যখন কমে তখন বিমান ভাড়া কমায় না। বিমান যেভাবে ভাড়া বাড়ায় তাতে ব্যবহারকারীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বিমানের ভাড়া প্রায় মহামারীর সময়ের মতো অবস্থায় চলে গেছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টরা । বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে শ্রম আমদানিকারক দেশের গন্তব্যগুলোতে ভাড়া বেড়েছে। ঢাকা-জেদ্দা রুটে টিকিট পাওয়াই সৌভাগ্য। এ মাসের শুরুতে যে ভাড়া ছিল ৫০ হাজার তা এখন ৮০ হাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিমান ভাড়া বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি খেসারত দিচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)-ওয়েবসাইট তথ্য দিচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২ লাখ ১৩ হাজার শ্রমিক বিদেশে গেছে। যাদের বেশিরভাগই গেছেন মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
গত বছরের শেষদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা হয়। বাজার নতুন করে শুরু হওয়ার পর ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে টিকিটের দাম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। ব্যাংকক, কলম্বো বা অন্যান্য শহরে ট্রানজিট ফ্লাইট দিয়েও অনেক এয়ারলাইন কুয়ালালামপুরে যাত্রী বহন করছে। এতে টিকিটের দাম কমেছে ৩০-৪০ হাজার টাকা।
এবার হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এ টাকা বাড়িয়ে হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হজযাত্রী এবং হাবের ধারাবাহিক বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিমান ভাড়া বাড়িয়ে যচ্ছে। এবারও বাড়িয়েছে। গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হজবিষয়ক এক সভায় হাবের সিনিয়র সহসভাপতি ইয়াকুব শরাফতি হজে বিমান ভাড়া কমানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত বিমানের এমডি ভাড়া কমানোর সুযোগ নেই বলে জানান। বৈঠকে হজে কেন বিমান ভাড়া বাড়নো হলো তার যৌক্তিকতা জনসমক্ষে তুলে ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয় এমডিকে।
ইয়াকুব শরাফতি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি হজের বিমান ভাড়া কমানোর জন্য। বিমান কোনোভাবেই কমাতে রাজি হয়নি।’
বিমানের বর্ধিত ভাড়ার সুযোগে সৌদিয়া দেশ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কারণ বিমান যে ভাড়া নির্ধারণ করে সৌদিয়াও একই ভাড়ায় হজযাত্রী বহন করে। হজের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশি হজযাত্রীদের অর্ধেক বহন করবে সৌদি আরবের এয়ারলাইনস।
আটাবের সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া জানান, প্রধান এয়ারলাইনসগুলোর পাশাপাশি এয়ার অ্যারাবিয়ান, ফ্লাই দুবাই, সালাম এয়ারের মতো বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলো তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের তুলনায় কম ভাড়া নেওয়ার কথা। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে বেশি নিচ্ছে। বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলোও তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে মাত্র ৫০০ বা ১০০০ টাকা কম নিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। অথচ সরকারের কাছে তাদের প্রজেকশন ছিল তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে অর্ধেক মূল্যে যাত্রী নেবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং কম থাকায় তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
সাতক্ষীরার পৌরসভার ব্যাংক লেনদেন সচল রাখার দাবিতে ময়লার গাড়ি রেখে ব্যাংকের প্রবেশ পথ আড়াই ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন বেতন না পাওয়া পৌর কর্মচারীরা।
সোমবার (২৭ মার্চ) সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সাতক্ষীরার সুলতানপুর বড় বাজার সড়কস্থ সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের সামনে এ অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন তারা।
এ সময় ব্যাংকের সাধারণ গ্রাহকরা লেনদেন করতে না পেরে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে পুলিশের উপস্থিতিতে ব্যাংক ম্যানেজার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে বিষয়টি নিষ্পত্তির আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
তবে, সমস্যা সুরাহা করতে ১২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছেন পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক আন্দোলনকারী জানিয়েছেন, সাতক্ষীরা পৌরসভার কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী ২/৩ মাস যাবত বেতন তুলতে পারছেন না। বেতনের টাকা উত্তোলনকে কেন্দ্র করে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক কর্মকর্তা ও পৌর কর্মচারীদের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। সে কারণে ব্যাংকের সামনে পৌরসভার ময়লার গাড়ি রেখে অবরোধ করা হয়।
পরে, পুলিশের উপস্থিতিতে ব্যাংক ম্যানেজারের আশ্বাসে আন্দোলন আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। ১২ ঘণ্টার মধ্যে সুরাহা না হলে ফের আন্দোলনে নামতে বাধ্য হব, যোগ করেন ওই আন্দোলনকারী।
জানা যায়, সাতক্ষীরার পৌর মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতীর বিরুদ্ধে নাশকতার মামলায় হওয়ায় ৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে বরখাস্ত হন। এ সময় ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন কাজী ফিরোজ হাসান।
এরপর ১৪ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি কে এম কামরু কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর সমন্বিত হাইকোর্ট ডিভিশনের দ্বৈত বেঞ্চ এক আদেশে চিশতীর বরখাস্তের ওই আদেশ স্থগিত করেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে মেয়র পদে বসতে দেয়নি পৌর কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, চিশতীর পক্ষে দেওয়া উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কপি সোনালী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, সাউথবাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে জমা দিলে পৌরসভার ব্যাংক লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। যে কারণে ২/৩ মাস পৌর কর্মচারীরা বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
এক পর্যায়ে তারা সোমবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত পৌরসভার ময়লার গাড়ি নিয়ে পূবালী ব্যাংক, সাউথবাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রবেশ পথ বন্ধ করে অবরোধ কর্মসূচি পালন করে।
এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত পৌর মেয়র কাজী ফিরোজ হাসান বলেন, পৌর কর্মচারীদের মাসিক বেতন দিতে তার এবং পৌরসভার সিইওয়ের যৌথ স্বাক্ষরে একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয় সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকে। কিন্তু হাইকোর্টের চিঠি আছে টাকা তোলা যাবে না বলে বিভিন্ন তালবাহানা করছে তারা।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলেছি আমি আর আমার পৌর কর্মচারীরা বেতন পাবে না। তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। টাকার জন্য পৌরসভার অন্যান্য কার্যক্রম ব্যাহত হবে, তাও কাম্য নয়। পৌরসভার ২ লাখ বাসিন্দা টাকার অভাবে নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে, এ হতে পারে না। ব্যাংক ম্যানেজার কেন একক সিদ্ধান্তে এ রকম তালবাহানা করল তা জানা নেই। মঙ্গলবারের (২৮ মার্চ) মধ্যে ব্যাংকে জমা রাখা সমুদয় টাকা দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
অন্যদিকে, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ অফিসার সরফরাজ নেওয়াজ বলেন, পৌর কর্মচারীদের বেতন দিয়ে দিতে বাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা হয়েছে। ২/১ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
প্রসঙ্গত, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে মামলা হওয়া কথা উল্লেখ করে ৬ ফেব্রুয়ারি পৌর মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতীকে বরখাস্ত করে। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি নাশকতার মামলায় তিনি কারাগারে যান এবং ৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে জামিনে মুক্ত হন।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’
পাবনার বেড়া উপজেলায় অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন প্রকল্প ‘বীর নিবাস’-এ বাড়ি বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজ পরিবারের নামে সেখানে বাড়ি নিয়েছেন বরাদ্দ কমিটির সদস্য সচিব বেড়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। তাকে এ কাজে সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মুজিববর্ষে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ‘বীর নিবাস’ নামে সারা দেশে ৩০ হাজার একতলা পাকা বাড়ি নির্মাণ করছে সরকার। নীতিমালা অনুসারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সভাপতি ও সমাজসেবা কর্মকর্তা সদস্য সচিব হিসেবে বরাদ্দ কমিটি গঠন করে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বাছাইয়ের কাজ করবেন।
বাস্তবে দেখা গেল, রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ছোট ভাই শফিউদ্দিন ফকিরের জন্য বীর নিবাসের বাড়ি বরাদ্দ নিয়েছেন বেড়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। বাড়ির নির্মাণকাজ শেষ, এখন তা হস্তান্তরের পালা।
‘বীর নিবাস’-এ বরাদ্দ নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারি আবাসন কিংবা ভূমি সুবিধা পাননি এমন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বা তার পরিবার সেখানে বরাদ্দ পাবেন। যুদ্ধাহতরা অগ্রাধিকার পাবেন। আবেদনকারী আর্থিকভাবে অসচ্ছল হলেই শুধু বিবেচনাধীন হবেন।
কিন্তু বেড়া উপজেলার কাজীরহাটে বাড়ি বরাদ্দ পাওয়া সমাজসেবা কর্মকর্তার ভাই শফিউদ্দিন ফকির অসচ্ছল ব্যক্তি নন। তিনি সরকারি চাকরিজীবী, কাজীরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। রফিকুলের আরেক ছোট ভাই শওকত আলী ফকির পাবনার সুজানগর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা। রফিকুল ইসলামরা তিন ভাই রফিকুল, শফিউদ্দিন ও শওকত।
অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ পরিবারের সদস্যকে বীর নিবাসে বরাদ্দ দিয়েছেন রফিকুল ইসলাম।
সরেজমিনে কাজীরহাটে গিয়ে দেখা গেছে, শফিউদ্দিন ফকিরের জন্য বীর নিবাসের বাড়ি নির্মাণ শেষ হয়েছে। ওই বাড়ির পাশেই তিনতলা বাড়িতে থাকেন তার বড় ভাই বেড়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম।
শফিউদ্দিন জানান, তাদের বাবা মৃত মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন ফকিরের নামে পরিবারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ কমিটির কাছে বীর নিবাসে বাড়ি বরাদ্দ চান তারা। পৈতৃক জমিতে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় তারা মাসুমদিয়া ইউনিয়নে জায়গা কেনেন। সেখানেই বীর নিবাসের বাড়ি বরাদ্দ করেছে বরাদ্দ কমিটি। ভালো বেতনে সরকারি চাকরি করেও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার ঘর কীভাবে বরাদ্দ পেলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে ইউএনও সাহেব বলতে পারবেন।’
বরাদ্দপ্রাপ্তির পর বাড়ির ভোগদখলের জন্য শফিউদ্দিনকে ক্ষমতা দিয়ে হলফনামা করেন পরিবারের অন্য সদস্যরা। সে সময় আবুল হোসেনের দ্বিতীয় স্ত্রী হালিমা খাতুন বরাদ্দ দাবি করলে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও ও ইউপি চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে প্রভাব খাটিয়ে বীর নিবাসের স্বত্ব ছাড়তে লিখিত দলিল করিয়ে নেন প্রথম পক্ষের সন্তানরা। এ অভিযোগ করেছেন দ্বিতীয় স্ত্রী হালিমা খাতুন।
হালিমা খাতুন বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রী হিসেবে বাড়িপ্রাপ্তিতে আমার অগ্রাধিকার আছে। আমার একটি নাবালিকা মেয়েও আছে। প্রথম পক্ষের ছেলেরা সরকারি চাকরি করে। তাদের অবস্থা ভালো।’
তিনি বলেন, ‘বাড়ি বরাদ্দের কথা শুনে আমি ইউএনও অফিসে যোগাযোগ করি। কিন্তু তারা আমাকে বরাদ্দ দেয়নি। শফির নামে বাড়ি বরাদ্দ হবে বলে জানায়। পরে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, রূপপুর ইউপি চেয়ারম্যান রূপপুর ইউনিয়ন পরিষদে বৈঠক করে আমার মেয়ের নামে এক লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলে দলিলে সই করিয়ে নেয়। বাধ্য হয়েই তাদের সিদ্ধান্ত আমাকে মেনে নিতে হয়েছে।’
রূপপুর ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মাজহারুল ইসলাম মোহন বলেন, ‘উপজেলা কমিটির কাছ থেকে বীর নিবাসে বরাদ্দ নেওয়ার পর মৃত আবুল হোসেন ফকিরের প্রথম পক্ষের ছেলেদের সঙ্গে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর বিরোধ বাধে। পরে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ইউএনও আমার পরিষদে উভয় পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসেন। সেখানে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর নাবালিকা মেয়ের জন্য এক লাখ টাকা ব্যাংকে স্থায়ী আমানত ও বিয়ের সময় সহযোগিতার শর্তে বীর নিবাসের বাড়ির মালিকানা প্রথম পক্ষের মেজো ছেলে শফিউদ্দিনকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।’
শফিউদ্দিন বীর নিবাসের বাড়ির বরাদ্দ নেওয়ায় অনিয়ম হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুরো প্রক্রিয়াই অনিয়মের মধ্য দিয়ে গেছে। কারণ আবুল হোসেন ফকির মুক্তিযোদ্ধাই নন। তিনি ভারতেও প্রশিক্ষণে জাননি, কোনো দিন মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বলেও শুনিনি। অথচ এসব পরিবারের লোকজন মুক্তিযোদ্ধার সুবিধা ভোগ করছেন। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বঞ্চিত হচ্ছেন। আমি এর বিপক্ষে।’
‘বীর নিবাস’ নিয়ে সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুলের পারিবারিক সালিশ শেষে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর কাছ থেকে বীর নিবাসের দাবি না করার অঙ্গীকারনামা-দলিল করে নেওয়া হয়। সেই দলিলে সাক্ষী হিসেবে সই করেছেন বেড়া উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল হক বাবু।
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আবুল হোসেন ফকিরের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম পক্ষের সন্তানদের বীর নিবাস নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়। পরে উভয় পক্ষ বসে সমঝোতা করে নিয়েছে। বৈঠকে আমি অসচ্ছল বিধবা স্ত্রীর অগ্রাধিকারের কথা বলেছিলাম। কিন্তু উভয় পক্ষ সমঝোতা করে স্ট্যাম্প করে। সবার অনুরোধে আমি সাক্ষী হিসেবে স্ট্যাম্পে সই করেছি। উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে আমার স্বাক্ষর দেওয়া ঠিক হয়নি। আমি তখন বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করিনি; সরল মনে স্বাক্ষর করেছি। সমাজসেবা কর্মকর্তার ক্ষমতা ব্যবহার করে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি কেন নিতে হবে, আমার বোধগম্য হয় না। এটি লজ্জারও বিষয়।’
এ বিষয়ে বেড়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বীর নিবাসে বাড়ির জন্য আবেদন আবেদন কম ছিল। আবার যারা আবেদন করেছিল তাদের অনেকেরই প্রয়োজনীয় জমি নেই। আমার পরিবারের সদস্যকে বীর নিবাসে বাড়ি বরাদ্দ আমি একা দিইনি। কমিটি যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
বাড়ি বরাদ্দে অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেছেন বরাদ্দ কমিটির সভাপতি ও বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সবুর আলী। তিনি বলেন, কমিটির সবার মতামতের ভিত্তিতেই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শফিউদ্দিনের নিজের বাড়ি নেই। অসচ্ছল হিসেবেই তাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে পাবনা জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন বলেন, ‘সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বা তার পরিবারের কোনো সদস্যের বীর নিবাসে বরাদ্দপ্রাপ্তির সুযোগ নেই। খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যের ন্যাশভিলের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বন্দুকধারীর হামলায় ৩ শিশুসহ ছয়জন নিহত হয়েছেন। আজ মঙ্গলবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের স্কুলটিতে বন্দুক হামলা চালানো হয়। গুলিবিদ্ধ ৩ শিশুকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। এই ঘটনায় মোট ছয়জন নিহত হন। বেশ কয়েকজন আহতও হন। তবে কতজন আহত হয়েছেন, তা এখনো জানানো হয়নি।
স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, বন্দুক হামলাকারী ছিলেন ২৮ বছর বয়সী নারী। পুলিশের গুলিতে তিনিও প্রাণ হারান।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার (এফবিআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যতগুলো বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে, এর ৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রেই হামলাকারী পুরুষ ছিলেন। ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২৫০টি বন্দুক হামলার ঘটনার ৯টিতে হামলাকারী নারী ছিলেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
রাজধানীর মিরপুরের একটি মাধ্যমিক-সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সিফাত। একই এলাকায় বসবাসকারী তার বন্ধু সিয়াম পড়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে। সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার থেকে রোজার ছুটি। আর সরকারি প্রাথমিকে ছুটি ১৫ রোজা অর্থাৎ ৭ এপ্রিল থেকে।
এক দেশে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন নিয়মে ছুটি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে লেখাপড়ায় কেউ এগিয়ে যাবে, আবার কেউ পিছিয়ে পড়বে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার বা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে ভেবেচিন্তেই নেয়। তবে সব ধরনের স্কুলে একটা কো-অর্ডিনেশন থাকলে ভালো হয়। আমরা ছুটির ব্যাপারে আরও আলাপ-আলোচনা করব।’
জানা গেছে, চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে আগামী শুক্রবার শুরু হতে পারে রমজান মাস। বছরের শুরুতেই স্কুলগুলোর ছুটির তালিকা অনুমোদন করা হয়। সে অনুযায়ী পবিত্র রমজান, স্বাধীনতা দিবস, ইস্টার সানডে, বৈসাবি, নববর্ষ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা ও টিটি (টিচার্স ট্রেনিং) কলেজেও একই সময়ে ছুটির ঘোষণা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছুটির তালিকা ভিন্ন। তারা পবিত্র রমজান, ইস্টার সানডে, চৈত্র-সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আগামী ৭ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ প্রায় ১৫ রমজান পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা থাকবে।
রাজধানীসহ বড় বড় শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকের মতোই তাদের ছুটি থাকবে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রোজার ছুটিও একই। তবে মাদ্রাসায় রোজার ছুটি শুরু এক দিন আগেই অর্থাৎ আজ বুধবার, ২২ মার্চ।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। তাই বুধবার ক্লাস করে বৃহস্পতিবার রোজার ছুটি শুরু হবে। তবে সব স্কুলে একই ধরনের ছুটি থাকা জরুরি। এতে একই সময়ে সিলেবাস শেষ করা যাবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সন্তুষ্ট থাকবে।’
রমজানে মাধ্যমিকে স্কুল বন্ধ আর প্রাথমিকে খোলা রাখায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষকের মধ্যে। তারা বলছেন, যেসব অভিভাবকের সন্তান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্কুলেই পড়ে তাদের সমস্যা হবে। রমজান মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও রোজা রাখেন। তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিল রেখে প্রাথমিকের ছুটি নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগাঠনিক সম্পাদক জুলফিকার আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকারি ছুটি ৭৬ দিন, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৫৪ দিন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিন্ন ছুটি নির্ধারণের যুক্তি তুলে ধরে আমরা ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছি। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো সাড়া পাইনি।’
'স্যার নয় আপা ডাকলেই চলবে' রংপুরের জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীনের এমন বক্তব্যের পর রাত ৯ টার দিকে আন্দোলন সমাপ্ত করে ক্যাম্পাসে ফিরে গেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এর আগে চিত্রলেখা নাজনীনের বিরুদ্ধে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে বুধবার (২২ মার্চ) বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে একাই অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন উমর ফারুক। এর পর তার সাথে একাত্মতা জানিয়ে আন্দোলনে যুক্ত হন বেরোবির বাংলা বিভাগের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা।
তুহিন ওয়াদুদ তার ফেসবুক পোস্টে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান।
জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, বেরোবির একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে উমর ফারুক আমার কাছে এসেছিলেন। এ সময় আমি বাইরে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম। তখন ওই শিক্ষক আমাকে দেখে আপা বলে ডাক দেন। আমি তাকে স্যার না বলে আপা কেন ডাকছেন জানতে চাই। আমার জায়গায় একজন পুরুষ দায়িত্বে থাকলেও কি তিনি স্যার না বলে ভাই ডাকতেন?
জেলা প্রশাসক জানান, রাতে তিনি ওই শিক্ষক ও আন্দোলনকারীদের স্যার ডাকতে হবে না, আপা ডাকলেই চলবে বলে জানান। এরপর তারা আন্দোলন বন্ধ করে দেন এবং ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে চলে যান।