
আবুল হাসনাত আমাদের সময়ের একজন অনন্য সাহিত্য-সম্পাদকই কেবল ছিলেন না কিংবা কবি-প্রাবন্ধিক, শিশু-সাহিত্যিকই শুধু নন; মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন বেশ খানিকটা অন্যরকম মানুষ। যাকে কিনা শঙ্খ ঘোষের ভাষায় বলতে পারি, ‘এই একজন মানুষের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল গোটা-মানুষের খানিকটা আদল।’ সেই ‘আদলে’র মধ্যে দেখা গিয়েছে বিষাদের পাশাপাশি একটি সংবেদনশীল মনের উজ্জ্বলতা, যা মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে অনেকখানি ‘স্রোতময় করে তোলে’। অথচ তিনি যদি এর বিপরীত কিছু হয়ে উঠতেন, তাতেও আশ্চর্যের কিছুই ছিল না। কারণ, তিনি নিজেই আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘আমার জন্ম হয়েছে ১৯৪৩ সালে, মহাদুর্ভিক্ষের সময়ে।’ শুধু জন্মকালই নয়, বলা যায় যে, জীবন-সংগ্রামের এই কালো ছায়ায় তাকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বসবাস করতে হয়েছে। আবুল হাসনাতের নিজের বয়ানে পাচ্ছি, ‘জীবন সংগ্রামে বিপর্যস্ত হওয়ায় আমি...‘সংবাদ’-এ চাকরি নিয়েছিলাম। দিনের বেলায় [ঢাকা] বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যয়ন করছি আর রাতে চাকরি করি বার্তা বিভাগে। যদিও অধ্যয়ন বা নিয়মিত ক্লাস করা সবসময় হয়ে উঠত না।’ সেইসঙ্গে আমরা এ-ও জানতে পারছি যে তিনি ভর্তি পরীক্ষায় খুব ভালো ফলাফল করা সত্ত্বেও রাজনীতি ও চাকরি সামলিয়ে পড়াশোনাটা শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারেননি। এতে করে তার তেমন-একটা ক্ষতি অবশ্য হয়নি।
২. কেন বলছি যে, তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি? বলছি, তার কারণ হচ্ছে উচ্চশিক্ষার কাগুজে সার্টিফিকেট জোটাতে না-পারলেও, আমাদের অনেকেরই জানা আছে, আবুল হাসনাত আমৃত্যু ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের গভীর আর মনোযোগী একজন পাঠক। তার সাহিত্যবোধ ও সাহিত্যচিন্তার ধরনটা ছিল অনবদ্য, যা তাকে একজন অতুলনীয় সম্পাদক হিসেবে স্থান করে দিয়েছিল। শুধুই সাহিত্যবোধ নয়, সেইসঙ্গে তার শৈল্পিক বিবেচনাবোধ ও মাত্রাজ্ঞান ছিল যে-কোনো মানদ-ের বিচারে তুলনাহীন। নিজের কর্মক্ষেত্রে, বিশেষ করে দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি অনন্য ছিলেন ঠিকই, কিন্তু পূর্বসূরিদের কৃতিত্বের কথা সবসময়ই অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেন। দৈনিক ‘সংবাদে’ নিজের কাজের পরিধি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বারংবার স্মরণ করেছেন অগ্রজ কবি ও সম্পাদক আহসান হাবীবের কথা। আবুল হাসনাত বলেছেন, ‘দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক হিসেবে কবি আহসান হাবীবের সুনাম ও প্রতিষ্ঠা তখন তুঙ্গে...ষাটের দশক, মৃত্যুকাল অবধি এক বৈরী ও প্রতিকূল আবহে তিনি তার সম্পাদিত ‘দৈনিক বাংলা’ সাহিত্য বিভাগটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন।’ আর এরই সূত্রে নিজের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমি তার [আহসান হাবীব] প্রবর্তিত কিছু বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে আরও প্রসারিত চেতনায় [সংবাদের] সাময়িকী বিভাগটিকে বিন্যস্ত করেছিলামএ কথা মনে পড়ে।’
৩. তার মানে আবার এটাও নয় যে, দৈনিকের সাহিত্যের পাতা সম্পাদনা করতে গিয়ে তিনি শুধুই আহসান হাবীবকে অনুসরণ করেছিলেন, তার নিজস্বতা বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ব্যাপারটি সেরকম তো নয়ই, বরং এই আয়োজনে তার নিজস্বতা নানাভাবেই চোখে পড়ার মতো ছিল। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যেমন বলেছিলেন, আবুল হাসনাত “দীর্ঘদিন ‘সংবাদ’-এর সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করে...সাময়িকীকে একটি বিশেষ উচ্চতায় দাঁড় করিয়েছেন।’ আবুল হাসনাতের স্বকীয়তার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও জানিয়েছিলেন, ‘সম্পাদনার ক্ষেত্রে যে গুণটা সবচেয়ে বেশি থাকা দরকার সেটা হলো লেখা চেনার ক্ষমতা এবং লেখাটিকে সঠিকভাবে তুলে ধরা। আবুল হাসনাত ভালো লেখা সহজে চিনতে পারতেন। তার সম্পাদনার মুনশিয়ানার কারণে ভালো লেখা পেতে সমস্যা হতো না।’ আর সেইসঙ্গে তিনি আবুল হাসনাতের যে-অসাধারণ গুণটির কথা উল্লেখ করতে ভোলেননি, সেটি হচ্ছে সম্পাদনার ক্ষেত্রে তার নৈর্ব্যক্তিকতা। এই গুণটি আজকের দিনে, বলা যায়, প্রায়ই-বিলুপ্তির পথে!
৪. শুধু সম্পাদনার মধ্যেই নয়, আবুল হাসনাত তার কাজের পরিধিকে ব্যাপ্ত করেছিলেন সক্রিয় রাজনীতির মধ্যেও। অবশ্য তার জীবনের এই অভিজ্ঞতাটি সবসময় সুখকর কিছু হয়নি। কিন্তু তাই বলে এটা বলা যাবে না যে, তিনি একেবারে ব্যর্থ হয়েছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি, আমাদের দেশে যে-দলটিকে বলা হতো মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি, সেটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা দেখতে পাই যে, এই দলটির বুর্জোয়া লেজুড়বৃত্তি আর আপসকামিতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই, ছিল না। পার্টির এই সুবিধাবাদী পথ আবুল হাসনাতকে নানাভাবে আহত করেছে। তিনি বাধ্য হয়েছিলেন পার্টি ছেড়ে দিতে, কিন্তু দৃঢ়ভাবেই বলেছিলেন, ‘একদিনের জন্য কমিউনিস্ট আদর্শকে শত টালমাটালের মধ্যেও ত্যাগ করিনি কিংবা [অন্য] কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিইনি।’
৫. সিপিবির নেতাদের সুবিধাবাদিতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বেশ কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন এ-প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘জিয়াউর রহমানের শাসনামলে হ্যাঁ-না ভোটের সময় মোহাম্মদ ফরহাদ পার্টি নেতা হিসেবে প্রায় এককভাবে জিয়াউর রহমানকে হ্যাঁ ভোট দেওয়ার যে অনমনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তা অনেকের সঙ্গে আমার রুচিকে দারুণভাবে আহত করেছিল।’ আবার পার্টির আরেক নেতা সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিকের প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ‘যখন বলা হলো, সোভিয়েত পার্টি ভেঙে যাওয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির আর কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই, তখন খুবই ব্যথিত ও দুঃখিত হয়েছিলাম।’ আরও খানিকটা অগ্রসর হয়ে তিনি বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘ক্ষমার অযোগ্য এক পাপ করেছিল...দীর্ঘদিনের একটি আদর্শবাদী দলের বৃহৎ অংশ ব্যারিস্টার কামাল হোসেনের অব্যাহত অনুরোধে গণফোরামে যোগ দিল।’ এই ব্যাপারটিকে আবুল হাসনাতের মনে হয়েছিল, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে...এক কলঙ্কজনক ঘটনা।’
৬. এসবের পাশাপাশি আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে পেয়েছি, তার স্মৃতিকথায় আবুল হাসনাত পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাদী বিপ্লবী কমিউনিস্টদের প্রতি তার আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। নকশাল আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি খানিকটা অনুতাপের সঙ্গেই জানিয়েছিলেন, ‘আমরা তখন আশ্রিত ও মুক্তিযুদ্ধের নানা কাজে ব্যস্ত’, আর সেই কারণেই ‘এই আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গের যুব ও ছাত্রসমাজের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষাকে, আত্মোৎসর্গকে কোনোদিক থেকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করিনি। কারণ ইন্দিরা গান্ধী ও কংগ্রেস ছিল বাংলাদেশের বাঙালির ত্রাণকর্তা।’ পরবর্তী সময়ে তিনি তার সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। নকশাল বিপ্লবীদের সম্পর্কে তিনি মনে করতেন, ‘তাদের প্রত্যয় ও দেশচেতনা আমার কাছে ভিন্ন মর্যাদা দাবি করে।’ কারণ, আবুল হাসনাতের ভাষায়, ‘নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা স্বপ্ন দেখেছিলেন শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের পথ’। আর সেইসঙ্গে নকশাল বিপ্লবীদের ‘চেতনা ও মর্মবাণীতে সমাজ বদলের আকাক্সক্ষা কত তীব্র ছিল তা পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল তাদের জীবন উৎসর্গে।’ নকশাল বিপ্লবীদের নিয়ে এমন আন্তরিক মূল্যায়ন বাংলাদেশের আর কোনো মস্কোপন্থির লেখায় কখনো পড়েছি বলে ঠিক মনে করতে পারি না।
৭. অন্যদিকে আবার, আবুল হাসনাত ছিলেন একজন প্রকৃত কবি। তার কবিতার সংখ্যা হয়তো খুব বেশি নয়, কিন্তু আমৃত্যু তিনি কবিতাচর্চায় নিমগ্ন থেকেছিলেন। আমাদের অনেকেরই সম্ভবত জানা নেই যে, তিনি কবিতা লিখতেন ‘মাহমুদ আল জামান’ নামে। তার ‘নির্বাচিত কবিতা’র (২০১৭) ‘আত্মকথনে’ আবুল হাসনাত বলেছিলেন, ‘কবিতা লিখছি ষাটের দশক থেকে। কেন লিখি এ-কখনো ভেবে দেখিনি। হৃদয়, মন, মস্তিষ্ক কখনো-সখনো দিনযাপনের দুঃখ, বেদনা, কষ্ট, গ্লানি, আনন্দ কবিতা লিখতে প্রেরণা দেয়। কখনো অঙ্গীকারের তাগিদে, কখনো ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে।’ তার কবিতায় জীবনের এইসব উপাদানই বিচিত্রভাবে শৈল্পিক মর্যাদায় অভিব্যক্ত হয়েছে। যেমন ‘ছায়াময় ভুবনডাঙায়’ শীর্ষক কবিতায় তিনি বলেছেন : ‘আমি কখনো জীর্ণ, কখনো শীর্ণ;/কল্পলতায়/শুয়ে আছে মরদেহের প্রগাঢ় ঘুম!/কে তুমি মধ্যরাতে ফের কড়া নাড়ো?/কী খেলা যে খেলছো তুমি কে জানে।/বিষাদ প্রতিমা বুকে নিয়ে/আমি তো পড়ে থাকি এই ঘুমে।’ খুব সংগত কারণেই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার একটি স্মৃতিমেদুর প্রবন্ধে লিখেছিলেন, আবুল হাসনাতের কবিতায় ‘তাঁর ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, আবেগ, মান-অভিমান জায়গা করে নিত।’ সেইসঙ্গে তিনি এই মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেননি যে, হাসনাতকে ‘আরও ব্যাপকভাবে খুঁজে পাওয়া যেত কবিতায়।’ আমরাও সেটি মনে করি।
৮. কবিতার প্রতি নানাভাবে সমর্পিত হয়েও, আবুল হাসনাত,
কথাসাহিত্য নিয়ে তার অনুরাগের কথা নানা জায়গায় ব্যক্ত করেছিলেন। উপন্যাস, বিশেষ করে মানিক-সতীনাথকে নিয়ে তার একটি আলাদা ধরনের আগ্রহ ছিল। তার লেখালেখিতেও এর নমুনা ছড়িয়ে আছে। ‘রবিশঙ্কর মানিক সতীনাথ ও অন্যান্য’ (অয়ন প্রকাশন : একুশে বইমেলা, ২০১৬) গ্রন্থটি প্রধানত আমাদের কথাসাহিত্যসহ নানা বিষয়ে আবুল হাসনাতের নিজস্ব ভাবনা নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধের সংকলন। এই গ্রন্থের ‘ভূমিকার বদলে’ তিনি বলেছিলেন, ‘এই প্রবন্ধগুলো নিয়ে বই বেরোবে তা কোনোদিন ভাবিনি এবং বইয়ের প্রস্তুতি নিয়ে এসব লেখা হয়নি।’ এইসব প্রবন্ধ রচনার নেপথ্যের কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘কারুর ব্যক্তিস্বরূপ আমার কাছে হয়ে উঠেছিল আকর্ষণীয়, কারুর সঙ্গ পেয়ে সাহিত্য ও শিল্পের অর্কেস্ট্রার ধ্বনি বেজে উঠেছে আমার হৃদয়ে। এতে সাহিত্যের রুচি, ধারণা ও রূপকল্পের এক প্রতিমা গড়ে উঠেছে।’ কথাগুলো তিনি এতটুকুও বাড়িয়ে বলেননি।
৯. আমরা আগেও বলেছি, আবুল হাসনাত ছিলেন দৈনিক পত্রিকার জগতের মানুষ। তিনি ছিলেন সম্পাদনার জগতের মানুষ। কিন্তু তারপরও তিনি মনে করতেন যে, ‘সাহিত্য ছাড়া আমার কোনো দ্বিতীয় প্রেম নেই।’ আর এই প্রেমের নিরবচ্ছিন্ন প্রকাশ তার রাজনীতি-সম্পাদনা-কবিতা-প্রবন্ধের মধ্যে বিচিত্রভঙ্গিতে নানান স্তরে ছড়িয়ে রয়েছে। হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে তিনি লিখেছিলেন : ‘আমার রোদ্দুর ঢেকে যাচ্ছে কালো মেঘে/হায় ছায়াবৃতা দাও, আমাকে দাও সজীব/সহজ উজ্জ্বলতা।’ নিজের বিশ্বাসের ওপর ভরসা রাখতেন বলেই এমনভাবে তিনি সজীব উজ্জ্বলতাকে যাচ্ঞা করতে পেরেছিলেন। জীবনের ঔৎসুক্য, জীবনের নানাবিধ কৌতূহলের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল বলেই মৃত্যুকে খুব সহজভাবে মেনে নিতে তার খুব কষ্ট হয়নি।
১০. আবুল হাসনাত ছিলেন সেই ব্যক্তি, যার মধ্যে আমরা পেয়েছিলাম সত্যের প্রতি নিমগ্নতা, পেয়েছিলাম নৈর্ব্যক্তিক ধরন, পেয়েছিলাম সৌজন্য। জীবনের তাৎপর্যকে এমন আন্তরিকভাবে গ্রহণ করবার মতো মানুষ আজকের দুনিয়ায় খুব বেশি নেই। আজ তার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তার স্মৃতির প্রতি জানাই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা!
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
করোনা মহামারীর সময় থেকেই দেশের মানুষের সঞ্চয় কমে গেছে। এ অবস্থা শুধু ব্যক্তিপর্যায়ের নয়, জাতীয়ভাবেও একই সমস্যা। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২ অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় দেশজ সঞ্চয় কমে আসছে। অর্থাৎ জিডিপি যে হারে বাড়ছে, সঞ্চয় সেভাবে বাড়ছে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশজ সঞ্চয় ছিল ২৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এই পরিস্থিতির মধ্যেই গত বছরের সেপ্টেম্বরে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমিয়েছে সরকার। সঞ্চয়পত্রে যত বেশি বিনিয়োগ, মুনাফার হার তত কম হবে। অবশ্য ১৫ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মুনাফা একই আছে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়। নতুন নিয়মে যাদের এই সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলে মুনাফার হার হবে সাড়ে ৯ শতাংশ। এতদিন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকে সবচেয়ে নিরাপদ মনে করা হলেও চলমান অর্থনৈতিক সংকট, রেকর্ড পরিমাণ মূল্যস্ফীতি এবং সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নানা শর্তারোপের কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি এখন তলানিতে ঠেকেছে।
সোমবার দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরে সরকারি সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৩০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯৬ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ছিল ৮ হাজার ৫৫৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এই খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চ মুনাফার সঞ্চয়পত্রে প্রকৃত সুবিধাভোগী বিনিয়োগ নিশ্চিতের পাশাপাশি সুদ ব্যয় কমাতে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে সরকার। সব শেষ ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে আয়কর রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে সুদহার কমানো হয়। আবার ঘোষণার বাইরে সঞ্চয়পত্র থাকলে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এসব কারণে অনেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছেন। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সঞ্চয়পত্রের মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধের পর চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাসে এ খাতে সরকারকে কোষাগার থেকে উল্টো ৭০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা দিতে হয়েছে; অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ঋণ নেওয়ার চেয়ে পরিশোধ করেছে বেশি। প্রতি মাসে বিক্রি হওয়া সঞ্চয় স্কিমগুলো থেকে প্রাপ্ত বিনিয়োগের হিসাব থেকে আগে বিক্রি হওয়া স্কিমগুলোর মূল ও মুনাফা বাদ দিয়ে নিট ঋণ হিসাব করা হয়। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেটে নির্ধারিত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়; অর্থাৎ গত সেপ্টেম্বরে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ না নিয়ে উল্টো পরিশোধ করেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে বলে ঠিক করেছে সরকার।
অন্যদিকে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যাংক খাতে আমানতও সেভাবে বাড়ছে না। কারণ, ব্যাংকে আমানত রেখে যে সুদ মিলছে, তা দিয়ে মূল্যস্ফীতির ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না। ব্যাংকগুলোকে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে মেয়াদি আমানতের সুদহার নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে মূল্যস্ফীতি বাড়ায় ব্যাংকগুলো আর আমানতের সুদহার বাড়াতে পারছে না। কারণ, ঋণের সুদহারের সীমা সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রশ্ন হলো, ঋণের সুদহারের সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে আমানতের সুদহার বাড়ানোর নির্দেশনা কার্যকর হবে কীভাবে? বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের সব মানুষের সঞ্চয়ের টাকা ব্যাংকে নেওয়ার উদ্দেশে বেশি সুদের স্কিমগুলোর মুনাফার হার কমানো হচ্ছে। এতে মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা কমে গিয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতেও। কারণ সঞ্চয় কমলে বিনিয়োগ সংকট আরও বাড়বে। এমনিতেই দেশে সঞ্চয়ের অর্থ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিনিয়োগের সুযোগ খুবই কম। সঞ্চয়পত্র, ডাকঘর সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক, শেয়ারবাজারের বাইরে বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে বিনিয়োগ করে সঞ্চয়কারীরা বিভিন্ন সময় প্রতারিত হয়েছেন। ফলে একই সঙ্গে ব্যাংক ও ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে আমানতের সুদহার কমে যাওয়ায় বিনিয়োগের দুটি ক্ষেত্র বাকি থাকছে। একটি সঞ্চয়পত্র, অন্যটি শেয়ারবাজার। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করায় সে ক্ষেত্রটি সংকুচিত হয়েছে। অন্যদিকে, শেয়ারবাজারও স্থিতিশীল নয়, সেখানে বিনিয়োগ করে বারবার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সহায়-সম্বল হারাতে হয়েছে। তাহলে সাধারণ মানুষ সঞ্চয় করবে কীভাবে আর বিনিয়োগ করবে কোথায়?
পূর্ববঙ্গের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের অত্যন্ত উজ্জ্বল প্রতিনিধি হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। রাজনৈতিক জীবনে তিনি অব্যাহত আন্দোলন করেছেন, বহু রকমের দুর্ভোগ ও নির্যাতন সহ্য করেছেন এবং বাঙালির জাতীয়তাবাদের পক্ষে ছিলেন অনমনীয়। বাঙালি বলতে কেবল সুবিধাভোগীদের বুঝতেন না, সকল শ্রেণির বাঙালিকেই বুঝতেন। কারাবন্দি অবস্থায় লেখা তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা বইয়ের পাতায় পাতায় এর পরিচয় পাওয়া যাবে। ১৯৬৬-তে যখন তাকে বন্দি করা হয় তখন তার বিরুদ্ধে মামলা ছিল ১১টা, তাকে রাখা হয়েছিল অন্যসব কয়েদি ও বন্দির কাছ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে। সন্ধ্যা হলেই সেলের দরজা তালাবন্ধ হতো। সময় কাটানো অত্যন্ত কঠিন। কষ্ট হয়েছে, কিন্তু হতাশ হননি। কারাজীবনটা দাঁড়িয়েছিল নির্জন দ্বীপে রবিনসন ক্রুশোর দিনযাপনের মতো। এর মধ্যেও অক্ষুণœ রয়েছে তার সংবেদনশীলতা। বাইরের মানুষের কথা তো ভাবছেনই, ভেতরে যারা আছে, কয়েদি ও সিপাহি-জমাদার, যারা তার আশপাশে থাকে তাদের সঙ্গে নিজের খাবার ভাগ করে খান; রোজনামচায় লেখেন, ‘আমি না খেয়ে থাকতে রাজি, কিন্তু ওদের না দিয়ে খেতে পারব না।’ জেলখানায় কয়েদি ও সিপাহিদের কাছে মুড়ি দুর্লভ সামগ্রী। তিনি মুড়ি আনিয়ে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ মাখিয়ে নিজে খান এবং আশপাশের সবাইকে খাওয়ান। পাকের ঘরে মোরগ-মুরগি থাকে তিনটি। একটির অসুখ হলে কাতর হয়ে পড়েন। কবুতর ও তাদের বাচ্চাদের দেখেন, দেখেন কাকদের জীবনযাত্রা। সেলের সামনের ফুলগাছগুলোর যতœ নেন, আগাছা পরিষ্কার করেন। পেটি বুর্জোয়া শ্রেণি থেকেই এসেছেন, কিন্তু সেই শ্রেণির সংকীর্ণতা ও অসংবেদনশীলতাকে সঙ্গে রাখেননি, সরিয়ে ফেলতে পেরেছেন, এবং সেজন্যই অত বড় হয়েছেন। কিন্তু অন্য অনেকেই তা পারেন না, পারেননি।
১৯৬২ সালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে আটক ছিলেন ডা. এম এ করিম। তিনি বাম ঘরানার লোক; কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গেই তার খুবই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। কারাগারে তখন আওয়ামী লীগের বড় এক নেতা ছিলেন, একসময় যিনি মন্ত্রীও ছিলেন, প্রথমে প্রদেশের পরে কেন্দ্রের। তার সম্পর্কে করিম সাহেব লিখেছেন যে, ‘ভদ্রলোক চুলে সরষের তেল মাখতেন। জেলখানা থেকে বরাদ্দ করা ছিল। আর এই বরাদ্দ থেকে সরষের তেল বাঁচিয়ে প্রায় এক টিন জমিয়ে ফেললেন। এমনিভাবে নিজের বরাদ্দ মাখন থেকে বাঁচিয়ে জ্বালিয়ে ঘি তৈরি করেছেন। জেল থেকে বেরুবার সময়ে সাথে করে নিয়ে গেছেন একটিন সরষের তেল ও এক সের ঘি।...বিশ্বাস করতেও কষ্ট হবার কথা। আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না।’ এ ধরনের জাতীয়তাবাদীদের কাছে সবকিছুই ছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তি, এমনকি জেলখানার সামান্য সুযোগ-সুবিধাগুলোও। ওদিকে কারাযন্ত্রণায় কাতর অবস্থায় কেউ কেউ হার মানতেন। কেউ-বা বন্ড দিয়ে বের হয়েছেন এবং রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনীতে আছে শামসুল হক রাতভর জিকির করতেন। তাতে অন্যদের যে অসুবিধা হয় সেদিকে তাকাতেন না, বলতেন এ তার আধ্যাত্মিক সাধনা। জেল থেকে যখন বের হলেন তখন দেখা গেল মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। অত্যন্ত মহৎ একটি সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেল।
জাতীয়তাবাদী ধারার প্রগতিশীল অংশের ভেতর এই উপলব্ধিটা তৈরি হচ্ছিল যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুক্তি নেই, সমাজতন্ত্রেই যেতে হবে। শেখ সাহেবের বই দুটিতে এমন চিন্তার আভাস পাওয়া যায়। ১৯৬৬-তে জেলে এসে তিনি দেখেন জেলের ভেতরেই পুঁজিবাদ কায়েম হয়ে গেছে। শিক্ষার কোনো দাম নেই, দাম টাকার, টাকা দিয়ে অনেক রকমের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। আগে যখন এসেছেন দেখেছেন কিছুটা চক্ষুলজ্জা ছিল, এখন তাও নেই। আত্মজীবনীতে তিনি লিখছেন ১৯৫৩ সালে তিনি চীনে গিয়েছিলেন, বিশ্ব শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে। চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯-এ, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ১৯৪৭-এ, অথচ ওই কবছরেই চীনের যে উন্নতি ও পরিবর্তন হয়েছে দেখে এবং কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের অনুভূতি হয়েছিল এই রকমের : ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যত দিন দুনিয়ায় থাকবে তত দিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না।’ ১৯৬৬-এর কারাগারের রোজনামচায় তিনি লিখেছেন, আইয়ুব খানের শাসনে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ভিক্ষুক হয়ে গেছে। আমেরিকার কাছে ভিক্ষা চাইছে। মন্তব্য করেছেন, ‘ভিক্ষুকের কোনো সম্মান নাই। তবে শোয়েব সাহেব (অর্থমন্ত্রী) যে অর্থনীতি এখানে চালাইতেছেন তাতে ইহা ছাড়া আইয়ুব সাহেবের উপায়ই বা কী ছিল? একমাত্র সমাজতন্ত্র কায়েম করলে কারও কাছে হেয় হয়ে সাহায্য নিতে হতো না।’
জেলখানায় কমিউনিস্ট রাজবন্দিরা থাকেন। তাদের আলাদা করে রাখা হয়, পাছে তাদের প্রভাবে পড়ে অন্যরা কমিউনিস্ট হয়ে যায়। শেখ মুজিবকে তারা তাদের বাগান থেকে কুমড়ার ডগা, ঝিঙে, কাঁকরোল এসব পাঠান। তিনি অভিভূত হন। তার প্রতিক্রিয়া, ‘এরা ত্যাগী রাজবন্দি। দেশের জন্য বহু কিছু ত্যাগ করেছেন। জীবনের সবকিছু দিয়ে গেলেন এই নিষ্ঠুর কারাগারে। আমি তাদের সালাম পাঠালাম।’ জন্মদিনে এরা তাকে পাঠিয়েছেন একগুচ্ছ রজনীগন্ধা। মুজিব লিখছেন, ‘তাদের এই উপহার আমার কাছে অনেক মূল্যবান। শুধু মনে মনে বললাম, তোমাদের মতো ত্যাগ যেন আমি করতে পারি। তোমরা যে নীতিই মানো না কেন, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। তোমরা দেশের মঙ্গল চাও, তাতে আমার সন্দেহ নাই।... তোমাদের আমি শ্রদ্ধা করি।’
কোনো দক্ষিণপন্থি জাতীয়তাবাদীর পক্ষে এমনটা ভাবা সম্ভব নয়। তা ছাড়া দক্ষিণপন্থিরা কমিউনিস্টদের কাছ থেকে এমন শুভেচ্ছাও আশা করতে পারতেন না। শেখ মুজিবেরই তো সমসাময়িক রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। জাতীয়তাবাদীও। তবে পুরোপুরি দক্ষিণপন্থি এবং পরিপূর্ণরূপে সুবিধাবাদী, নিজেকে তিনি নন-কমিউনিস্ট বলতেন না, বলতেন অ্যান্টি-কমিউনিস্ট। মোহাম্মদ তোয়াহা স্মরণ করেছেন যে ১৯৪৪-এ মুসলিম লীগ কর্মীরা যখন একত্রে কাজ করছেন তখনই দেখা গেছে দলের ভেতর ‘কমিউনিস্ট খেদাও’ তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে, এবং ঢাকায় সে-তৎপরতার নেতৃত্ব দিচ্ছেন খন্দকার মোশতাক। শেষ পর্যন্ত তিনি কোন পরিণতিতে গিয়ে পৌঁছাবেন তার পূর্বাভাস সূত্রপাতেই দেখা দিয়েছিল। তা খন্দকার মোশতাকরা তো শুরু থেকেই দক্ষিণপন্থি ছিলেন, কিন্তু অলি আহাদ তো তা ছিলেন না; অন্য অনেকের তুলনাতেই তিনি ছিলেন অনেক অগ্রসর। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ যখন গঠিত হয় তখন তাতে তিনি যোগ দিতে চাননি, সংগঠনটি অসাম্প্রদায়িক নয় বলে; একই কারণে আওয়ামী মুসলিম লীগও তাকে আকর্ষণ করেনি। তিনি ছিলেন যুবলীগে, যেখানে আত্মপ্রকাশে-অসমর্থ কমিউনিস্টরা গোপনে কাজ করছিলেন। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সোভিয়েত ইউনিয়ন-প্রভাবিত পূর্ব-এশীয় যুব সম্মেলনেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন।
১৯৫০-এ নাচোলে কৃষকবিদ্রোহ হয়। নেতৃত্বে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। পার্টির স্থানীয় নেত্রী ইলা মিত্রকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং যেভাবে নির্যাতন করে তাতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের নৃশংস চরিত্রের প্রথম উন্মোচন ঘটে। রাজশাহী কোর্টে ইলা মিত্র একটি জবানবন্দি দেন। অলি আহাদ স্মরণ করেছেন যে ‘স্পর্শকাতর ও ক্ষুব্ধ মনের তাড়নায়’ তিনি ‘সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে’ অতিগোপনে বহু কষ্টে ঢাকার একটি ছাপাখানা থেকে ইশতেহারের আকারে জবানবন্দিটি ছাপিয়ে সন্তর্পণে সর্বত্র বিলি করার ব্যবস্থা করেন। জবানবন্দিটি ছিল ইংরেজিতে, ইশতেহারে ইংরেজির সঙ্গে বাংলায় অনুবাদও ছিল, এবং অনুবাদ তিনি নিজেই করেছিলেন। কাজটি সামান্য ছিল না। যেমন দুঃসাহসিক, তেমনি দুঃসাধ্য, এবং ঐতিহাসিক। একসময়ে আওয়ামী লীগের তিনি সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন, কিন্তু মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যখন ন্যাপ গঠিত হলো তখন আওয়ামী লীগ ছেড়ে ন্যাপেই যোগ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের ভেতর কমিউনিস্ট ঘরানার যারা ছিলেন সবাই ন্যাপে চলে গিয়েছিলেন।
কিন্তু পরে দেখা যাচ্ছে অলি আহাদ শুধু অ-কমিউনিস্ট নন, খন্দকার মোশতাকের মতোই অঙ্গীকারবদ্ধ কমিউনিস্ট-বিদ্বেষীতে পরিণত হয়েছেন। প্রমাণ আছে তার লেখা ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫’ বইতে। বইটি তিনি বাকশাল গঠনের পরে জেলখানায় থাকা অবস্থাতে লিখতে শুরু করেন। এই বইতে কমিউনিস্ট-বিদ্বেষ জ্বল জ্বল করছে। ধরা যাক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনাকালের বিবরণ। তিনি এমন একটি তথ্য দিচ্ছেন, যা অন্য কেউ দেননি। সেটা হলো আন্দোলনে কমিউনিস্ট-বিরোধিতা। সরকারের পক্ষ থেকে বরং উল্টোটা প্রচার করা হয়েছিল, বলা হয়েছিল যে এ আন্দোলন কমিউনিস্ট ও হিন্দুদের কাজ। হিন্দুদের ব্যাপারটা সর্বৈব মিথ্যা : কিন্তু কমিউনিস্টরা যে ছিল সেটা মোটেই মিথ্যা নয়। অলি আহাদ জানাচ্ছেন যে ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় যে সাধারণ ছাত্রসভা হয় সেটাকে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের কর্মীরা বানচাল করার চেষ্টা করেছিল, আর তাদের সঙ্গে ছিলেন পার্টির নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম। ‘কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের সচেতন সংগ্রামী চেতনা উপরোক্ত প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করিয়া দেয়।’ সরদার ফজলুল করিম নাকি সেখানেই নিবৃত্ত হননি, পরের সভায়ও (১৭ মার্চ) তিনি ‘কতিপয় সমর্থকের সহায়তায় গোলযোগ সৃষ্টির প্রাণপণ চেষ্টা করেন। ইহা নাকি তাহাদের বিপ্লবের স্বার্থে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কর্মসূচিভুক্ত।’ অলি আহাদ আরও জানাচ্ছেন, ‘১৯৪৮ সালের ৩০ জুন কমিউনিস্ট পার্টি সদরঘাটের করনেশন পার্কে একটি জনসভা করার চেষ্টা করে, কিন্তু জনতার আক্রমণে ভীত-সন্ত্রস্ত কমিউনিস্ট কর্মীরা স্ব-স্ব প্রাণ বাঁচাইবার প্রয়াসে সভাস্থল হইতে ঊর্ধ্বশ্বাসে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেন। সরকার সমর্থক মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমান বীরদর্পে বক্তৃতা মঞ্চে আরোহণ করিয়া জনতার উদ্দেশে নাতিদীর্ঘ ভাষণ দান করেন। এভাবেই রাষ্ট্রদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী ও নাস্তিক বলিয়া অভিযুক্ত কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীবৃন্দ ধীরে ধীরে প্রকাশ্য কর্মসূচি বর্জন করিয়া গোপন সংগঠনের দিকে মনোনিবেশ করে। অলি আহাদের ভাবটা এই রকমের যে ভালোই হয়েছে, বেশ হয়েছে, যেমন কর্ম তেমন ফল।’
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মহামারী, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ সভ্যতার ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ঘটেছে। আবারও আমরা এই চক্রের বৃত্ত পূরণের ধারায় আছি। মহামারী যেতে না যেতেই শুরু যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষের অশনি সংকেত বেজে চলছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার পটভূমি নিয়ে ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাস লিখেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে প্রখ্যাত চলচিত্রকার সত্যজিৎ রায় একে সেলুলয়েডের পর্দায় তুলে এনেছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে সারা পৃথিবীতে খাদ্যসংকট নিয়ে বিস্তার আলোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বিশ্বে ভয়াবহ রকমের খাদ্য সংকট ধেয়ে আসছে আর এর বড় ভুক্তভোগী হবে পৃথিবীর খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ।
খাদ্য সংকটের একটি বড় কারণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। তবে দুর্ভিক্ষের বড় কারণ রাজনৈতিক ও ব্যবস্থাপনা সংকট। দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, দুর্ভিক্ষ যতটা না খাদ্যদ্রব্যের সংকটের কারণে তার থেকে অনেক বেশি দায়ী মানুষের অধিকারের স্বীকৃতি না থাকা এবং খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনায় ত্রুটি। অন্যদিকে বিশ্বে এরকম দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি যেখানে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে খাদ্য সরবরাহ করা হয়নি বা সরবরাহ মাঝপথে আটকে দিয়ে একটি দেশকে এবং তার জনগণকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তবে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশের বড় নিয়ামক হচ্ছে এই সব প্রতিকূলতা অতিক্রমের সক্ষমতা।
যুদ্ধে খাদ্যসংকটের কারণ বহুবিদ, একটি হচ্ছে উৎপাদন করতে না পারা, মজুদ ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া। এর সঙ্গে যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয় তাহলে পরিস্থিতি চূড়ান্ত বিপর্যয়ের দিকে যায়। ইউক্রেন-রাশিয়া বিশ্বের খাদ্যভা-ার। এই অঞ্চলের খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া মানে হচ্ছে সারা বিশ্বের ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়া। এই দুটি দেশ মিলে পৃথিবীর ২৮ শতাংশ গম উৎপাদন করে এবং এর মধ্যে ১৫ শতাংশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। তবে শুধুমাত্র উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধানই যথেষ্ট নয়। জনগণের বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতা থাকাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এবারের যুদ্ধের মূল সংকট হচ্ছে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া ও মুদ্রাস্ফীতির কারণে দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পাওয়া। বলা হয় বর্তমান পৃথিবীতে যত খাদ্য উৎপাদন করা হয় তা দিয়ে প্রায় দশ বিলিয়ন জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটানো সম্ভব, যা মোট বর্তমান জনগোষ্ঠীর প্রায় দেড়গুণ। বলা বাহুল্য উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যের প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ নষ্ট হয়। মূলত যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদনের পরও খাদ্য সংকটের জন্য দায়ী মুনাফাভিত্তিক বণ্টনব্যবস্থা, কিছু মানুষের অতিরিক্ত ভোগ, পাশাপাশি বিপুল খাদ্যদ্রব্যের অপচয়। আর এ কারণেই সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ অভুক্ত থাকে, পুষ্ঠিহীনতায় ভোগে। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি অক্টোবর ২০২২ থেকে জানুয়ারি ২০২৩ এই সময়কালে বিশ্বের ১৯টি দেশকে হাঙ্গার হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৫৩টি দেশ বা অঞ্চলে প্রায় ১৯৩ মিলিয়ন মানুষ মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং ২০২৩ সালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সংকট বহুমুখী। আমাদের দেশের জনসংখ্যা বেশি, এখানে রয়েছে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী, প্রয়োজনের তুলনায় কৃষিজমি অল্প এবং রয়েছে কিছু অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্যের জন্য বিশ্ববাজারের ওপর নির্ভরশীলতা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সরবরাহ সংকট ও খাদ্য অধিকারকে ন্যায্যতার দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখা। এক শ্রেণির মানুষের অতিরিক্ত লোভ ও ভোগের কারণে বণ্টনে ন্যায্যতার অভাবে বিশে^ লাখ লাখ মানুষ অনাহারে থাকে। খাদ্যদ্রব্য ক্রয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর চাপ কমানোটাও খাদ্য ন্যায্যতার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বিশ্বে খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক ও জাতীয় উদ্যোগ আছে। কোনো অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ বা মারাত্মক খাদ্য সংকট তৈরি হলে সেসব ক্ষেত্রে জরুরি খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ লক্ষ করা যায় কিন্তু বিশ্বব্যাপী খাদ্যবণ্টন প্রক্রিয়ায় ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেই। আর এর মূল কারণ খাদ্য সম্পর্কিত ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখা এবং ক্ষেত্রবিশেষে খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা।
মূলত শাসক শ্রেণির অবহেলা, অবজ্ঞা ও লুটপাটই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী। যেমনটা হয়েছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (বাংলা ১১৭৬ সালে), এটি বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নামে পরিচিতি। এই দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় তিনভাগের একভাগ মানুষ মারা যায়। এর পেছনে দায়ী ছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং একই সঙ্গে কোম্পানির দুঃশাসন। স্বাধীন নবাবদের পতনের পর, বাংলায় তখন দ্বৈত শাসন। নবাবের ওপর শাসনভার কিন্তু রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব ব্রিটিশদের হাতে। আর এই দুই পেরেশানির মধ্যে জনগণ চিড়েচ্যাপ্টা। অন্যদিকে পঞ্চাশের মন্বন্তরে (১৯৪৩-৪৪) বাংলায় আবার ২০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। একদিকে জাপান অধিকৃত মিয়ানমার থেকে চাল আমদানি বন্ধ, অন্যদিকে ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুদকরণ বাজারের খাদ্যশস্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি ব্রিটিশ রাজের ভুল নীতির কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। অনেকে এই দুর্ভিক্ষের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের ভুল নীতিকে দায়ী করে থাকেন। অন্যদিকে চার্চিল উল্টো ‘নেটিভদের’ ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেছিলেন। তবে, এই দুর্ভিক্ষ কোনো প্রাকৃতিক কারণে ছিল না, মানুষের জীবনকে নিয়ে অবহেলা ও অমানবিক আচরণই ছিল এর কারণ।
আমাদের জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা মূলত উৎপাদন, আমদানি, সরবরাহ, ব্যবস্থাপনা ও নজরদারির ওপর নির্ভর করে। বর্তমান সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার। পাশাপাশি শক্ত নজরদারি যাতে কোনোভাবেই খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত না হয়। কিন্তু এখানেই শেষ না, সরবরাহ প্রক্রিয়ায় মজুদদারির যেন কোনো সুযোগ না থাকে এবং যে যে খাদ্যপণ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল সেসব ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত আমদানির উদ্যোগ আগেভাগেই গ্রহণ করতে হবে।
বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে খাদ্য অধিকার আইন প্রণয়নের দাবি উঠলেও এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। খাদ্য সংকটে ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর ওপর যেমন একই প্রভাব ফেলে না, তেমনি এর প্রভাবও দরিদ্র দেশগুলোর ধনী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে একরকম নয়। ধনী দেশগুলো তার নাগরিকদের নানা ধরনের প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে এই সমস্যা উত্তরণের চেষ্টা করে, তাদের সেই সক্ষমতা আছে। পাশাপাশি প্রভাব খাটিয়ে তারা সরবরাহ সংক্রান্ত সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে পারে। কিন্তু দরিদ্র দেশগুলোকে অনেক সময়ে অন্যের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা কৌশলগত স্বার্থের কাছে বন্দি থাকতে হয় যেমনটা থাকতে হয় এর প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে।
লেখক : উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রর জন্ম ১৮৩০ সালে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার চৌবেড়িয়ায়। তার পিতৃদত্ত নাম গন্ধর্বনারায়ণ। গ্রাম্য পাঠশালায় অধ্যয়ন শেষে বাবার প্রচেষ্টায় স্থানীয় জমিদারের সেরেস্তায় ১৮৪০ সালে মাসিক আট টাকা বেতনে তিনি চাকরি শুরু করেন। কিন্তু তার মধ্যে ছিল উচ্চশিক্ষা লাভের তীব্র বাসনা। তাই পাঁচ বছর চাকরি করার পর বাবার অমতেই গোপনে তিনি চলে যান কলকাতায়। শুরু হয় তার উচ্চশিক্ষা লাভের প্রাণান্ত সংগ্রাম। কলকাতায় পড়াশোনার খরচ জোগাতে তাকে গৃহভৃত্যের কাজ করতে হয়েছে। প্রথমে তিনি রেভারেন্ড জেমস লংয়ের অবৈতনিক স্কুলে ভর্তি হন এবং এ সময়ই তিনি দীনবন্ধু নাম গ্রহণ করেন। পরে তিনি ভর্তি হন হেয়ার স্কুলে। সেখান থেকে ১৮৫০ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় পাস করে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। কলেজের সব পরীক্ষায় তিনি বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৫৫ সালে তিনি পাটনায় পোস্টমাস্টার পদে যোগ দেন। এ বিভাগে বিভিন্ন স্থানে কাজের পর তিনি সহকারী পোস্টমাস্টার জেনারেল হন। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত সরকার তাকে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৮৭২ সালে তিনি ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ইন্সপেক্টর পদ লাভ করেন। কলেজে পড়ার সময়ই ঈশ্বরগুপ্তের সংস্পর্শে গিয়ে সংবাদ প্রভাকর, সাধুরঞ্জন প্রভৃতি পত্রিকায় কবিতা লিখতে শুরু করেন। তবে নাটক ও প্রহসন লিখেই তিনি সর্বাধিক খ্যাতি অর্জন করেন। নীলদর্পণ তার শ্রেষ্ঠ নাটক। তাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার মনে করা হয়। তিনি ছিলেন সমাজকল্যাণনিষ্ঠ শিল্পী এবং কৃত্রিমতার বিরোধী, সত্যের অনুসারী। ১৮৭৩ সালের ১ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
রোজার মাসে খাবারের জন্য শরীফুল আলমের বাজেট ১২ হাজার টাকা। পাঁচ দিনের বাজার করতে গিয়ে তিনি দেখেন, মাছ কিনলে মুরগি কেনা যায় না, মুরগি কিনলে মাছ বাদ দিতে হয়। গরুর মাংস তো বিলাসী খাবার, তাই সে দোকানে নজরই দেননি তিনি। পাঁচ দিনের মধ্যে তিন দিনই তার পরিবারকে মাছ-মাংসের মতো প্রোটিন খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। আর ইফতারিতে উচ্চ মূল্যের বিদেশি ফল বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত তিনি আগেই নিয়েছেন। শুধু শরিফুলই নন, বাজার করতে আসা নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন আয়ের সব ভোক্তারই একই গল্প। তারা বলছেন, এবারের রমজানে কম খেয়েই রোজা রাখতে হবে।
গত এক বছরে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। প্রায় একই হারে বেড়েছে পাকিস্তানি ককসহ অন্যান্য মুরগির দাম। সব ধরনের মাছের দাম গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
একটু সাধারণ হিসাব করা যাক। চারজনের একটি পরিবার যদি মাছ, মাংস বাদ দিয়ে সাহরিতে গড়ে ২০০ টাকা, সন্ধ্যা রাতের খাবারে যদি গড়ে ১৫০ টাকা আর ইফতারিতে ফল যোগ না করে গড়ে যদি ১০০ টাকা খরচ করেন তবে মাসে ব্যয় হবে প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। আর যদি মাছ-মাংস যোগ হয় তাহলে সাহরিতে ন্যূনতম ৩০০, রাতের খাবারে ৩০০ ও ইফতারিতে ফল যোগ করলে গড়ে ২০০ টাকা খরচ করলে মাসে খরচ হবে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। এ হিসাব চারজনের একটি পরিবারের সর্বনিম্ন হিসাব। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গত অক্টোবরের হিসাবে বলা হয়েছে, চারজনের একটি পরিবারে খাবার তালিকায় মাছ-মাংস যোগ করলে মাসে খরচ হবে ২২ হাজার ৪২১ টাকা। এটি শুধু খাবারের খরচ। যদি কোনো পরিবার মাছ-মাংস যোগ না করেন তাতে মাসিক খরচ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৯ টাকা।
সিপিডির গবেষণা সেলের কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, চলতি মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। পরিবারপ্রতি এ মাসে খরচ আরও বেড়ে গেছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক কমানোর পরামর্শ দিচ্ছি আমরা। কিছু ক্ষেত্রে ট্যাক্স ভ্যাট পুরোপুরি উঠিয়ে দিলে সেখানে সবাই উপকৃত হবে।
সিপিডির অক্টোবরের হিসাবই যদি ধরা হয়, তাহলে এবারের রোজায় খাবারের তালিকা ছোট করা ছাড়া উপায় নেই ভোক্তাদের। ২২ হাজার টাকার সঙ্গে যদি বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ভাড়াসহ গড়ে ১৫ হাজার টাকা ধরলে চারজনের একটি পরিবারের খরচ দাঁড়ায় ৩৭ হাজার টাকা।
অবশ্য সিপিডির এ তথ্য যখন প্রকাশ করা হয়, তখন মুরগির মাংসের কেজি ছিল ১৫০ টাকা, এখন তা ২৬০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে। গরুর মাংসের দাম ছিল ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকায়, এখন তা ৭৫০ টাকায়। চিনির দাম ছিল ৯৮ টাকায় এখন তা ১২২ টাকায়। অর্থাৎ সব পণ্যেরই দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা হয় কয়েকজন ভোক্তার। বেসরকারি স্কুল শিক্ষক শিহাবউদ্দিন থাকেন রাজধানীর বাড্ডায়। থাকেন ৩ কামরা একটি ফ্ল্যাটে। তার মাসিক খরচ ৩১-৩২ হাজার টাকা। এর মধ্যে শুধু মাত্র বাসা ভাড়ায় খরচ হয় ১৬ হাজার টাকা। একমাত্র সন্তানের পড়া ও পরিবারের ভরণ-পোষণে খরচ হয় আরও ১৩-১৫ হাজার টাকা। বাদ বাকি খরচ আরও ২ হাজার। তবে এই শিক্ষক মাসে আয় করেন ২৮-৩০ হাজার টাকা। মাসিক আয় হিসেবে তার অতিরিক্ত খরচ হয় ২-৩ হাজার টাকা।
এ শিক্ষক খরচের সমন্বয় করতে সঞ্চয়ও ভেঙেছেন ইতিমধ্যে। তাতেও তার বাড়তি খরচের টাকা প্রতি মাসে ঋণের খাতায় যোগ হয়। উপায়ান্তর না দেখে পরিচয় গোপন করে মাঝেমধ্যে রাইড শেয়ার দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত কাজে এসেছিলাম মহাখালীতে। ভাবলাম একই সঙ্গে রোজার বাজার করে বাসাই ফিরি। তবে বাজারে প্রবেশ করে চিন্তায় পড়ে গেলাম। ব্যাগ দেখিয়ে বলেন, ১ কেজি করে মুরগি, মাছ ও ছোলাসহ আরও দুএকটি পণ্য কিনতেই ১ হাজার টাকা শেষ। দামের অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছে চাহিদা মতো বাকি সদাইগুলো বাসায় নিয়ে যেতে পারব না। আর নয়তো অর্ধেকের ওপর ভরসা রাখতে হবে।
শুধু স্কুল শিক্ষক শিহাবউদ্দিনই নন, গেল কয়েক মাসে দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহ অবস্থার কারণে মধ্য ও নিম্নমধ্য আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে নিত্যপণ্যের বাজার। মাছ-মাংস থেকে শুরু করে সব ধরনের সবজির দামও মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। গরিবের মাছ বলে খ্যাত পাঙ্গাস, তেলাপিয়াও এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকায়। গত ৩-৪ মাস আগেও পাঙ্গাস ১৪০-১৪৫ টাকা ও তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হয়েছিল ১৩৫-৪০ টাকা করে। এছাড়া অন্যান্য মাছের মধ্যে মান ভেদে রুই মাছ ২৯০-৩৮০ টাকা, সরপুঁটি ২০০-৪০০ টাকা, চাষের মাগুর ৬০০ টাকা, শোল মাছ ৮০০ টাকা, গলদা চিংড়ি ১ হাজার টাকা করে বিক্রি করছেন মাছ ব্যবসায়ীরা।
দ্রব্যমূল্য যে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে, তা শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল মজুমদারও বলছেন। গত বুধবার শিল্প মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারের কোনো মিল নেই। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ব্যবসা করছে। ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবেই দেখা যায়, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ দশমিক ৬১ শতাংশ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। যদিও গত মঙ্গলবার একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, চলতি মার্চে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। চৈত্রের খরা ও রোজায় মানুষের অতিরিক্ত মজুদের কারণে এ মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কার কথা বলেছেন তিনি।
বিবিএসের চিত্রেই আবার ফেরা যাক। গত বছর চিনির কেজি ছিল ৮২ টাকা, সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২২ টাকায়। যদিও বাজারের চিত্র ব্যতিক্রম। গরুর মাংস গত বছরের মার্চে কেজি ছিল ৬১০ টাকা, কিন্তু বছর ঘুরতেই এ পণ্যের দাম এখন ৭৫০ টাকা। মানুষ বেশি দামে গরুর মাংস কিনতে না পেরে কিছুদিন আগেও ভরসা করত ব্রয়লার মুরগির ওপর, যার দাম এখন ২৬০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে।
রমজানের ইফতারিতে বেশি চাহিদা থাকে ফলের ওপর। কিন্তু সেই ফলের দামও লাগামছাড়া। ডলার সংকটের কারণে ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ফলের ওপর শুল্কারোপ বাড়িয়ে দেয় সরকার। ফলে গত কয়েক মাস ধরেই ফলের দাম অনেক বেশি।
সাহরিতে রোজাদারের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর অন্যতম উপাদান দুধ। গত বছরের মার্চে দুধের লিটার কিনতে হয়েছিল ৭০ টাকায়, এ বছর তা ৯০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের একটা প্রভাব রয়েছে। তবে আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছি বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। তিনি বলেন, রমজানের ভোক্তা পর্যায়ে ভোগান্তি কমাতে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছি। মাঠ পর্যায়ে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। যেখানে অনিয়ম পাচ্ছি তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিছুটা দায়ী। কিন্তু পুরোপুরি না। সম্পূর্ণ দায় এ যুদ্ধের ওপর চাপানো ঠিক না। ভোক্তাদের দায় বেড়েছে, তাদের ওপর চাপও বেড়েছে।
সিন্ডিকেশন করে মুরগির বাচ্চা ও ব্রয়লার মুরগির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে মাত্র ৫২ দিনে বড় উৎপাদকদের একটি চক্র ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পোলট্রি খাতের উদ্যোক্তাদের অন্য একটি সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন গতকাল বৃহস্পতিবার এ অভিযোগ করে। এদিকে মুরগির দাম নিয়ে ‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত চার প্রতিষ্ঠানকে গতকাল তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আলোচনার পর ওই চার কোম্পানি ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৪০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। অন্য এক মতবিনিময় সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন, মুরগি ও গরুর মাংসের দাম না কমালে তা তারা বিদেশ থেকে আমদানি করার সুপারিশ করবেন। রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সরকারি তদারকি না থাকায় হরিলুট চলছে পোলট্রি সেক্টরে। প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ৩ হাজার ৫০০ টন। কিন্তু অস্বাভাবিক দাম ও প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে উৎপাদন কমায় এখন দুই থেকে আড়াই হাজার টন সরবরাহ হচ্ছে। প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ আগে কম থাকলেও এখন প্রতি কেজিতে ১৬০-১৬৫ টাকা এবং করপোরেট কোম্পানিদের উৎপাদন খরচ ১৩০-১৪০ টাকা। কিন্তু পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত।
সংগঠনটি জানিয়েছে, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজিতে যদি অতিরিক্ত ৬০ টাকা মুনাফা ধরা হয় তবে প্রতিদিন অন্তত ২ হাজার টনে ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৫২ দিনে শুধু ব্রয়লার মুরগি থেকে ৬২৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ সিন্ডিকেট। এ ছাড়া এক দিনের মুরগির বাচ্চা প্রতিদিন উৎপাদন হয় ২০ লাখ। একটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন খরচ ২৮ থেকে ৩০ টাকা। যা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ১০-১৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সেই বাচ্চা ৬২ থেকে ৬৮ টাকা মেসেজ করলেও প্রকৃতপক্ষে তা বিক্রয় হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। প্রতি বাচ্চায় ৩০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা ধরা হলে আলোচ্য সময়ে মুরগির বাচ্চা বিক্রি থেকে ৩১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ব্রয়লার মুরগি ও বাচ্চা বিক্রি থেকেই ৫২ দিনে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শীর্ষ কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, পোলট্রি ফিড ও মুরগির বাচ্চা শতভাগ উৎপাদন করে করপোরেট গ্রুপ। তারাই আবার আংশিক ডিম ও মুরগি উৎপাদন করে এবং চুক্তিভিক্তিক খামার করেন। এতে বাজার এসব প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে যাচ্ছে।
ব্রয়লার মুরগির দাম কমল ৪০ টাকা : ব্রয়লার মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণে শীর্ষ উৎপাদনকারী ফার্মগুলো নতুন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোজার মাসে ভোক্তা পর্যায়ে অস্বস্তি কমাতে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি খামারি পর্যায়ে ১৯০-১৯৫ টাকা দরে বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় চারটি মুরগি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। যা গেল কয়েক সপ্তাহে ২২০-২৩০ টাকায় বিক্রি হয়ে আসছে। হাতবদল হয়ে এসব মুরগি ভোক্তাপর্যায়ে এসে বিক্রি হচ্ছে ২৭০-২৮০ টাকায়।
‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত এই চার প্রতিষ্ঠানকে গতকাল তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আলোচনার পর ওই চার কোম্পানি ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৪০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত জাতীয় ভোক্তা অধিকারের কনফারেন্স কক্ষে কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, আফতাব বহুমুখী ফার্মস ও সিপি বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠক হয়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, গতকাল আমরা ২৭০-২৮০ টাকায় ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হতে দেখেছি। এ দাম অযৌক্তিক। এটা ২০০ টাকার বেশি হতে পারে না। ফার্ম পর্যায়ে ২২০-২৩০ টাকা দরে ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হচ্ছে। হাতবদল হয়ে ভোক্তাপর্যায়ে এ অবস্থা। ব্রয়লার মুরগি এসএমএসের মাধ্যমে নিলাম হচ্ছে। আমি তাদের আহ্বান করেছি, আপনারা এ রমজান মাসে একটু কম লাভ করেন। তারা একমত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, খামার থেকে আসা ব্রয়লার মুরগি হাতবদলে যেন দাম খুব বেশি না বাড়ে, সে বিষয়ে সংস্থাটি নজর রাখবে। ব্রয়লারের দাম কমাতে প্রয়োজনে বর্ডার উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
এ সময় কাজী ফার্ম কর্তৃপক্ষ জানান, তারা রমজানে ২২০ টাকা থেকে কমিয়ে ব্রয়লার বিক্রি করবেন ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায়। এ বিষয়ে একমত পোষণ করছে আফতাব, প্যারাগন ও সিপি কোম্পানি।
রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে : মুরগি ও গরুর মাংসের দাম বাড়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে আগামী দুই-তিন মাসের জন্য মুরগি ও গরুর মাংস বিদেশ থেকে আমদানি করার সুপারিশ করবে সংগঠনটি। গতকাল এফবিসিসিআই বোর্ডরুমে ‘রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি, মজুদ, সরবরাহ ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায়’ এ কথা জানানো হয়। এ সময় সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানান, রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, দেশীয় উৎপাদক, ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখার জন্য সরকার কিছু পণ্যে বাড়তি শুল্ক আরোপ ও কিছু পণ্য আমদানি বন্ধ রেখেছে। এ সুযোগে বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ালে হবে না। ভোক্তার ওপর এত চাপ দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় বেশি খেজুর আছে। পর্যাপ্ত রয়েছে ছোলা, পামঅয়েল, সয়াবিনসহ অন্যান্য পণ্য। আমরা চাই না ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীদের হেনস্তা করুক। পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ও মজুদ বিষয়ে সরকারের নিয়মনীতি রয়েছে। এসব বিষয়ে সাধারণ ব্যবসায়ীদের সচেতন করতে বাজার কমিটিগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পণ্যের সরবরাহ বিঘ্নিত হলে আমাদের জানান, আমরা সহযোগিতা করব।
জসিম উদ্দিন বলেন, এখন গরু ও পোলট্রির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। দেশীয় এ খাত বাঁচাতে এতদিন মাংস আমদানি বন্ধ ছিল। এখন তারা যদি সঠিক মূল্যে গরুর মাংস ও ব্রয়লার মুরগি দিতে না পারে তাহলে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলব, বাজার ঠিক রাখতে আমদানির অনুমতি দেওয়ার জন্য। আমদানি করলে যদি বাজারে দাম কমে যায়, তাহলে আমদানি করতে হবে। মানুষ যদি ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে না পারে, তাহলে ইন্ডাস্ট্রির কথা চিন্তা করে লাভ নেই।
এফবিসিসিআই সভাপতি ব্যবসায়ীদের বলেন, এবার সরকার বাজার মনিটরিংয়ে থাকবে কঠোরভাবে। কোনো বাজারে বেশি মূল্য রাখা হলেই সেই বাজার কমিটি বাতিল করবে সরকার। একই সঙ্গে দাম বেশি নেওয়া প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সও বাতিল করা হবে। আমরা চাই না, রোজায় কোনো ব্যবসায়ীর লাইসেন্স বাতিল হোক, কাউকে আটক করা হোক।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের সমস্যা থাকতে পারে। সমস্যাটি আমাদের জানাবেন। আমরা কথা বলব। আমাদের টিমও বাজার মনিটরিংয়ে থাকবে। আশা করব আপনারা কেউ বেশি মুনাফা করবেন না।
জনগণের জানার অধিকার রয়েছে কাকে কোনো প্রকল্পের কাজ দেওয়া হচ্ছে, কার সঙ্গে কী চুক্তি হচ্ছে এবং তা কীভাবে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতির কোনো কিছুই প্রকাশ করা হচ্ছে না। অদক্ষভাবে বিদ্যুৎ চুক্তির কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়ে থাকতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি)।
গতকাল বৃহস্পতিবার ধানমন্ডিতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে আয়োজিত ‘নতুন নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২২ (খসড়া) : এটি কি পরিচ্ছন্ন জ্বালানির লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হবে?’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কোনো একটি পক্ষকে সুবিধা দিয়ে কাজ দেওয়ায় দুর্নীতির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
বিদ্যুতের বড় ঘাটতি মেটাতে ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের প্রয়োজন ছিল। তবে বর্তমানে আইনটি অদক্ষতার জায়গা তৈরি করছে বলে মনে করে সিপিডি। সংস্থাটির মতে, জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের ফলে সরকারকে বিপুল পরিমাণ বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। কোনো কোনো পক্ষ পাচ্ছে বাড়তি সুবিধাও। অবিলম্বে আইনটি বাতিল করার দাবি জানিয়ে সিপিডি বলছে, নো ইলেকট্রিসিটি, নো পে- এমন চুক্তিতে গেলে বাড়তি ভর্তুকির চাপ থেকে সরকার সরে আসতে পারবে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০০৯ সালে জরুরি বিদ্যুৎ আইনের প্রয়োজন ছিল। ওই সময় বড় রকমের বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল, সেটা মেটানোর জন্য চুক্তির দরকার ছিল। এরপর চারবার নবায়ন হয়েছে ওই আইন। আমরা মনে করি, এখন যে জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, এরকম চুক্তির আর প্রয়োজন নেই।
দ্রুত জ্বালানি সরবরাহ আইন ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই আইন থেকে সরকারের সরে আসা দরকার। এই আইন বিভিন্নভাবে সমস্যা করছে। সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি নিয়ে যেসব চুক্তি হয়েছে, এর আগেও যেগুলো হয়েছে- সেগুলো এখন সরকারের জন্য বড় রকমের মাথাব্যথার কারণ। এর মূল কারণ এই দ্রুত জ্বালানি সরবরাহ আইন।
সিপিডির এ গবেষণা পরিচালক বলেন, বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি সমন্বয় নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কাজ করছে সরকার। বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির সমন্বয় করা হচ্ছে ভোক্তার ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে। ভুল পলিসির কারণে এমনটি হচ্ছে। এর ফলে বিপুল পরিমাণে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে, ভর্তুকিও দিতে হচ্ছে ব্যাপক হারে। সেটির দায় ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দিয়ে ভর্তুকি সমন্বয় করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আইনটি যদি অবলোপন করে নো ইলেকট্রিসিটি, নো পে- চুক্তির দিকে যদি যাওয়া যায়, তাহলে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বাড়তি ভর্তুকির চাপ থেকে সরে আসার সুযোগ রয়েছে। ফসিল ফুয়েল থেকে সরে এসে ধীরে ধীরে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে গেলে বড় রকমের ভর্তুকির চাপ থেকে সরে আসার সুযোগ রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমরা শুনে এসেছি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের মূল্য সবচেয়ে কম। অথচ নতুন চুক্তির অধীনে আমরা যে ভারত থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ আনা শুরু করলাম, সেটার মূল্য তো ১৫ টাকা। এটা তো বোধগম্য না কী করে এরকম মূল্য, এরকম জায়গায় আমরা চুক্তি করতে পারি।
জ্বালানি চুক্তি খোলামেলা হওয়া উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো চুক্তির ডকুমেন্টস আমরা পাই না। কী রেটে চুক্তিগুলো করা হচ্ছে- জনগণের সেটা জানার অধিকার রয়েছে।
নতুন নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২২ এর খুঁটিনাটি তুলে ধরে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এতে জ্বালানি নিরাপত্তার পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যেসব চুক্তি হচ্ছে, সেগুলো কতটা স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সঙ্গে করা হচ্ছে, তা আলোচনা হয়েছে। সরকারের রাজনৈতিক লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি আহরণ, তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। ২০০৮ সালে গৃহীত পলিসির আওতায় সামগ্রিক উৎপাদনের ৮ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এটা পলিসির ব্যর্থতা।
তিনি আরও বলেন, নতুন নীতিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎসের কথা বলা হয়েছে। শুধু সোলার বলেই ছেড়ে দেওয়া হয়নি। রুফটফ সোলার, নেট মিটারিং, মিনি গ্রিড, ন্যানো গ্রিড, সোলার ইরিগেশন, চার্জিং স্টেশন, স্ট্রিট লাইটে রিনিউয়েবল এনার্জি, ফ্লোটিং সোলার সিস্টেম- এরকমভাবে ডিটেইল বলা আছে। একইভাবে উইন্ড এনার্জি, বায়োমাস এনার্জি, বায়ো ফুয়েলের কথা বলা হয়েছে। রিনিউয়েবল এনার্জির কিছু নতুন উৎসের কথাও এখানে বলা হয়েছে। এর ভিত্তিতে আগামীতে মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কথা বলা হয়েছে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। এতে কিছু টার্গেটের কথা বলা হয়েছে। রিনিউয়েবল এনার্জির ক্ষেত্রে কিছু টার্গেট দেওয়া হয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কথা এতে উল্লেখ রয়েছে জানিয়ে এই গবেষণা পরিচালক বলেন, স্রেডাকে এখানে নোডাল এজেন্সি বলা হয়েছে। আমরাও তাই মনে করি। কিন্তু স্রেডাকে সব ধরনের ক্যাপাসিটি দিতে হবে। বড় পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রস্তাবনা দেখভাল করার ও অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা স্রেডাকে দেওয়া উচিত। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কার দরকার আছে। তবে এই সংস্কার আবার খসড়া প্রস্তাবে অনুপস্থিত।
তিনি বলেন, নুতন নীতিতে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারের আবার নীতি সংস্কার হয়েছে। মন্ত্রণালয় তার হাতে কর্তৃত্ব নিয়ে ফেলছে। এর ফলে রেগুলেটরি কমিশনের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে জ্বালানি নীতিতে যে গাইডলাইন দেওয়া আছে, আর সরকার এখন যেভাবে দাম নির্ধারণ করেছে, তাতে এটা এখন উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করছে।
তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি পলিসি-২০২২ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বর্তমান বিদ্যুৎ খাতে যে সংকট রয়েছে তা অনেকটাই কমে যাবে।
সকাল
‘বড় ভাই, গাবতলী কোন দিকে?’ কিছুটা দৌড়ে এসে জানতে চায় এক ছেলে। হাতের ইশারায় বাম দিকের রাস্তা দেখিয়ে বলি, ‘এখান থেকেই বাসে উঠতে হবে।’ ছেলেটি ফের জানতে চায়, ‘আমার কাছে টাকা নাই। গাবতলীতে হাঁইটা যাইতে কতক্ষণ লাগবে?’ বলি, ‘সে তো অনেক টাইম লাগবে। ঘণ্টাখানেক তো লাগবেই।’
ছেলেটি সূর্যের দিকে একবার তাকিয়ে নেয়। তারপর দেখানো রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। তার পায়ের দিকে আমার চোখ যায়। দুটি পা-ই খালি। ডান পায়ের তালু আবার গামছার কিছু অংশ দিয়ে বাঁধা। মনে হচ্ছে সেখানে কোনো ঘা রয়েছে বা কেটে গেছে। পরনে পুরনো একটা জিন্সের প্যান্ট; নিচের দিকটা ছেঁড়া ও কাদামাখা। গায়ে চেক ফুলশার্ট। মুখভরা ব্রণ। গোঁফ গজাচ্ছে। হাতে একটি লুঙ্গি!
আমি বলি, ‘এখানে ওয়েট করো, বিআরটিসি বাস এলে উঠে পড়বে। বলবে, টাকা নাই!’ ছেলেটি বলে, ‘আরে নাহ। টাকা না থাকলে ম্যালা কথা শুনতে হবে।’ সে গায়ে চাদর জড়ানোর মতো করে লুঙ্গিটি জড়িয়ে হাঁটতে থাকে। আমি তাকিয়ে থাকি তার দিকে। ইসিবি-চত্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে বসুমতী কিংবা রবরব পরিবহনে গাবতলীর ভাড়া ৩০ টাকা। বিআরটিসিতে ১০ টাকাতেই হবে। ছেলেটিকে কি আমি টাকাটা দেব? তাকে কি থামতে বলব? আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। ছেলেটি হেঁটে চলছে তো চলছেই! আমার বাস চলে আসে।
বিকেল
রঙিন কাগজে মোড়ানো প্যাকেট হাতে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা অ্যাপ্রন পরা মেয়েটি এসে তার পাশেই দাঁড়ায়। ইসিবি-চত্বরে পৌঁছামাত্র বৃষ্টি ধরে ফেলে আমাকে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে একটি দোকানের সামনে আশ্রয় নিই। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন।
কিছুক্ষণ পর কানে এলো একটি শব্দ। কীসের শব্দ? গাড়ির হর্ন, রিকশার বেল আর বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে যেটি আমাদের কানে এলোÑ গ্লাস ভাঙার শব্দ। ডান পাশে তাকাতেই দেখি ফুটপাতে একটি অর্ধেক লাল রঙের ভাঙা মগ পড়ে আছে, যেখানটায় সাদা অ্যাপ্রন পরা মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের সবার চোখ সেদিকে চলে যায়। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে মেয়েটির চেহারা দেখা যায় না। ছেলেটির চেহারা দেখা যাচ্ছে।
শুনতে পেলাম মেয়েটি বলছে, ‘আর কক্ষনো গিফট দিবা না। ছেলেটি বৃষ্টিতে ভিজছে; মেয়েটি ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে। ছেলেটি একেবারে চুপ, মুখটা মলিন।
‘বুঝলা?’ এবার মেয়েটির গলা বেশ চড়া; ধমকের সুর। ততক্ষণে ছেলেটি ফুটপাতে বসে পড়েছে। বৃষ্টির পানি আর তার চোখের পানি একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই দেখছি। ছেলেটি আর মেয়েটিও আমাদের দেখছে। কোনো শব্দ নেই। মেয়েটি অকারণে দাঁড়িয়ে আছে, ছেলেটিও অকারণে বসে আছে। এ দৃশ্যের যেন সমাপ্তি নেই!
ছেলেটি মেয়েটিকে পছন্দ করে; মেয়েটি করে না। গিফট ছুড়ে দিয়েই মেয়েটির হাঁটা দেওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। কৌতূহল বাড়ছে আমাদের।
যাব যমুনা ফিউচার পার্কে। বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তা পার হয়ে ইসিবি-চত্বরের ডান পাশে গিয়ে দাঁড়াই। জাবালে নূর কিংবা আকিক পরিবহনের জন্য অপেক্ষা করছি আর ওই মেয়ে আর ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছি। মিনিট দশেক পর দেখি, মেয়েটি চলে যাচ্ছে মাটিকাটা বাজারের দিকে। কিন্তু ছেলেটি সেখানেই বসে আছে।
আমি ছেলেটির কথা ভাবছি। ভাবছি বৃষ্টির কথাও। কী দারুণ কম্বিনেশন! হয়তো কিছুক্ষণ পর ছেলেটি উঠে চলে যাবে।
জাবালে নূর চলে এসেছে। আমি উঠতে যাব, ঠিক তখনই দেখি মেয়েটি ফিরে আসছে ছেলেটির দিকে। বাসে আর ওঠা হয় না আমার। শেষ দৃশ্য দেখার জন্য বৃষ্টির মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকি।
মেয়েটি বেশ দূরে চলে গিয়েছিল; কিন্তু ফিরল কেন? আমার হিসাব মেলে না। মেয়েটি ছেলেটির পায়ের কাছে পড়ে থাকা অর্ধেক ভাঙা মগটি তুলে নিল। ভাবলাম, রাগ কমেছে। ছেলেটির এভাবে বসে থাকা ওর মনে দাগ কেটেছে। কিন্তু নাহ। মেয়েটি অর্ধেক ভাঙা মগটি আবারও ছুড়ে ফেলে দিল ফুটপাতে। এবার মগটি টুকরো টুকরো হয়ে গেল। লাল রঙের মগটির টুকরো অংশগুলো দেখে মনে হলো, ছেলেটির হৃদয়টাও টুকরো হয়ে ফুটপাতে পড়ে গেল। আমি বাসে উঠে পড়ি।
সন্ধ্যা
সন্ধ্যা ৭টা। সাত-আট বছরের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইসিবি-চত্বরের একটি দোকানের সামনে। আমাকে দেখেই কী যেন বলে। আমি বুঝতে পারি না। পরের কথাটা ঠিকই বুঝতে পারি। সে আইসক্রিম খাবে। আমাকে বলে, ‘একটা আইচকিরিম কিনে দিবেন?’
আমি মানিকদি এলাকার দিকে যাব। রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। রিকশা, বাইক, প্রাইভেট কার, বাস, ট্রাক যাচ্ছেই। কোনো বিরাম নেই। মেয়েটিকে বলি, ‘তোদের বাসা কোথায়?’ মেয়েটি উত্তর না দিয়ে কয়েক বিল্ডিং পরের একটি বাসা দেখিয়ে বলে, ‘আমার মায় ওই বাসায় কাজ করে।’
রাস্তাঘাটে প্রায়ই সাত-আট বছরের ছেলেমেয়েদের আবদারের পাল্লায় পড়তে হয়। কখনো প্রশ্রয় দিই, আবার কখনো এড়িয়ে যাই। আজকেও বিষয়টি এড়িয়ে রাস্তা পার হতে যাব এমন সময় অজান্তেই পেছন ফিরে তাকাই। দেখি, মেয়েটিও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করি। পারি না। তবে মনে হলো ওর চোখ কী যেন বলতে চায়। আমার পা থেমে যায়। বলি, ‘একটু দাঁড়া, আইসক্রিম কিনে দিচ্ছি।’
মেয়েটিকে দোকানের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে ঢুকলাম ভেতরে। একটি ইগলু চকবার কিনলাম। দোকানদারের কাছে ভাংতি না থাকায় তিনি দুটি চকলেটও ধরিয়ে দিলেন। আমি মেয়েটির হাতে চকবারটি ধরিয়ে দিই। মেয়েটি আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়েই দৌড়। দুটো চকলেট আর দেওয়া হয় না। মেয়েটি আইসক্রিম হাতে নিয়েই রাস্তা দ্রুত পার হয়ে মানিকদির দিকেই যাচ্ছে। আমিও ওর পেছন পেছন দ্রুত হাঁটছি।
ইসিবি-চত্বর পার হয়ে মেয়েটি মানিকদির দিকে যেতে লাগল। মেয়েটি আইসক্রিম না খেয়ে কোথায় যাচ্ছে! আমার কৌতূহল বাড়ে। ওকে ফলো করতে থাকি। মেয়েটি কিছুদূর গিয়ে থামে। আমিও থামি। কবরস্থানের দেয়ালের পাশের ফুটপাতে এক বৃদ্ধার পাশে গিয়ে বসে পড়ে। আমি একটু দূরে মোবাইলে কথা বলার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। ‘ও দাদি, তোমার লাইগা আইচকিরিম আনছি।’ নিয়নলাইটের আলোয় তার চেহারাটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না। তবে বয়সের ভারে সে যে ন্যুব্জ সেটা বুঝতে পারছিলাম।
রাত
স্রেফ এক সেকেন্ড। হাইড্রোলিক ব্রেক না থাকলে কী যে ঘটত! তাকিয়ে দেখি, আমার বাইকের সামনে এক নারী দাঁড়িয়ে; তার কোলে এক-দেড় বছরের এক বাচ্চা। ফুটপাত থেকে হুট করে নেমে ওই নারী আমার বাইকের সামনে; আমার দিকে হাত বাড়িয়ে আছেন।
রাত ১১টা। অফিস থেকে বাসায় ফিরছি। বাইকের গতি ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার। জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার পার হয়ে শুধুই মাটিকাটা ফুটওভার ব্রিজ পার হয়েছি। ইসিবি-চত্বরে আসামাত্রই ওই নারী সামনে এসে পড়লেন।
বাইক থামিয়ে ধমক দিতে যাব। কিন্তু সড়কবাতির আলোয় চোখ যায় তার কোলে থাকা বাচ্চার দিকে। ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বাইকটার ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যাই। নারী বলেন, ‘মাইয়াডা না খায়া আছে। কিছু টাকা দেবেন?’ আমার বুকটা ধুক করে ওঠে।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক