
কার্ল মার্কসের পাথরমূর্তি আজও বহাল তবিয়তেই রয়েছে। অবশ্য মাঝেমধ্যে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী ফ্যাসিস্ট বদমাশদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। বিলেতে মার্কসের পাথরমূর্তি আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টির মূর্তির চেয়েও মহিমান্বিত। অন্যদিকে রুশ বিপ্লবের জনক তথা বিশ্বের মেহনতি জনতার মুক্তিদাতা ভøাদিমির ইলিচ লেনিন রয়েছেন মমি হয়ে, মস্কোয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ধ্বংসকারী গর্বাচেভ আর ইয়েলেতসিন সে মমিকে স্পর্শ করার সাহস পায়নি। সোভিয়েতের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির প্রাক্তন প্রধান বর্তমান রুশ রাষ্ট্রনায়ক ভøাদিমির পুতিনও লেনিনের মমিকে জাদুঘর থেকে অপসারিত করে কবরগুহায় স্থানান্তর করেননি। লেনিনের সে সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ আর নেই, মহাশক্তিধর হিসেবে এক দিন সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে ছিল দণ্ডায়মান, তা অতীত। কিন্তু মমিতে পরিণত হয়েও লেনিন আছেন, মানবসভ্যতার অবশ্যম্ভাবী আগামী মহাবিপ্লবের ঘুমন্ত ভলকানো হয়ে। এটাই পুঁজিবাদের চিরস্থায়ী আতঙ্ক। দুঃস্বপ্ন। তবে লেনিন যে একেবারে ভাগ্যশূন্য এমন দাবি করা যাবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলোপ হলে আমেরিকার ইন্ধনে এবং গোপন অর্থে সারা দেশে বুলডোজার দিয়ে লেনিনের মূর্তি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে রাজনৈতিক বিবর্তন ঘটলেও একই কাণ্ড ঘটানো হয়। বাংলাদেশের একেবারে কানঘেঁষা ক্ষুদ্র ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরায়ও উগ্র হিন্দু মৌলবাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি ক্ষমতায় আসামাত্র লেনিনের মূর্তিকে দুরমুশ করা হয়েছে।
মূর্তি ভাঙার ঐতিহ্য মানবসমাজের নতুন কোনো দর্শন নয়। এর শুরু সভ্যতার একেবারে গোড়ায়। এর পেছনে রয়েছে আধিপত্যবাদী বাসনা। রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম-বিশ্বাসের ইন্ধন শক্তি। মানবসভ্যতার প্রাচীন এবং মধ্যযুগ তো হচ্ছে মূর্তি ভাঙার যুগ। আধুনিক যুগ তার উত্তরসূরি। আমরা স্মরণ করতে পারি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। বিদ্যাসাগর হচ্ছেন বাঙালির মাতৃভাষা চর্চার আদি গুরু। সত্তর দশকে কলকাতায় বিদ্যাসাগরের মূর্তির মুন্ডু ছেদন করে মাওবাদী নকশাল কমিউনিস্টরা। পরে তারা ভুল স্বীকার করলেও ইতিহাস ভোলা যায় না। তখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মূর্তিও পুলিশ পাহারায় ছিল কিছুদিন। কী অপরাধ রবীন্দ্রনাথের? না তিনি ‘বুর্জোয়া কবি’। একেবারে হালে বিদ্যাসাগরের নিজের কলেজের ভেতরই তার ক্ষুদ্র মূর্তিটি ভেঙে দেয় আরএসএস, বিজেপির উগ্রহিন্দু মৌলবাদী মিছিলকারী যুবকরা। কেন এই আদিম অভ্যাস ভাঙাভাঙির? ভয়! আতঙ্ক! মূর্তিকে আবার ভয় কী? সে তো জড়পদার্থ। শক্তিহীন। প্রতিরোধ-শূন্য। ভয় অবশ্যই আছে, মূর্তির ভয় নয়, ভয় আদর্শের, মূর্তি-হয়ে-যাওয়া একদা জীবন্ত মানুষটির অগ্নিময় মতাদর্শের। এই মতাদর্শের তো মৃত্যু নেই। সে অমর। রবীন্দ্রনাথ তার ‘ছবি’ কবিতায় মৃত স্ত্রীর ছবির দিকে তাকিয়ে আত্মপ্রশ্ন জাগিয়েছিলেন, ‘হায় ছবি, তুমি কি কেবল ছবি শুধু পটে লিখা?’ কবি শামসুর রাহমানের একটি অসাধারণ কবিতা আছে অকাল-মৃত পুত্রের ছবির দিকে তাকিয়ে। কবির শ্যামলীর বাসায় এ বিষয়ে তাকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম। কবি ছিলেন নীরব। ঠোঁট কাঁপছিল। চোখ সজল। তাতেই আমি উত্তরটাও পেয়ে যাই। অনেকক্ষণ পর কবি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘হরিপদ, আপনি কি সাঁতার জানেন?’ কেননা এ প্রশ্নের পেছনে ছিল কবিপুত্রের পানিতে ডুবে অকালমৃত্যু।
অন্যদিকে মূর্তির অমরত্বের পেছনে যে শুধু শুভশক্তিই রয়েছে তা কিন্তু নয়। অশুভ শক্তিও আছে। ধরা যেতে পারে মহাসমুদ্র অভিযাত্রী কলম্বাসের কথা। সাম্রাজ্যবাদ আর উপনিবেশবাদ সমর্থক ইতিহাসবিদরা কলম্বাসের গুণকীর্তনে মুখর। শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের উপনিবেশ স্থাপনে যেসব সমুদ্র-অভিযাত্রী নতুন দেশ-ভূমি আবিষ্কার করে সহায়তা করে দিয়েছেন, কলম্বাস তাদের অন্যতম। আমেরিকার ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে কলম্বাসের একটি মূর্তি ছিল। তা ভেঙে দেয় আমেরিকার আদিবাসী ভূমিপুত্রদের একদল রাগী যুবক। এতে হয়তো তাদের শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় দখলদারদের প্রতি ঘৃণাই প্রকাশ পেল। কিন্তু উপনিবেশবাদের ইতিহাস, বর্ণবিদ্বেষের ইতিহাস বদলানো কি গেল? নিশ্চয়ই নয়। ইতিহাসের কবর খুঁড়লে তো স্তূপের পর স্তূপ শোষণ-নির্যাতনের কঙ্কাল বেরিয়ে আসবে। অন্যদিকে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ভেতর আজও সগৌরবে বিরাজ করছে একটি মূর্তি। পলাশী যুদ্ধের খলনায়ক, ভারতবর্ষে ইংরেজ উপনিবেশ স্থাপনের স্থপতি রবার্ট ক্লাইভের। ইংরেজের তৈরি মূর্তি। অতীতে ছিল, বর্তমানেও আছে। কই, এত বছর পরও কোনো বাঙালি তো সেই মূর্তি ভাঙতে গেল না? ভাঙল বিদ্যাসাগরের মূর্তি! এ কী রহস্যময় বাঙালি চরিত্র?
কলকাতার নগরের রাজপথে স্থাপিত মার্কস অথবা লেনিনের মূর্তি ভেঙে ফেলা মোটেই কঠিন কাজ নয়। স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতা পকেটে গোটা কতক নোট আর পেটে এক পেগ ঢুকিয়ে হাতে একটা কুড়াল তুলে দিলেই কেল্লা ফতে! অথচ আজ এই করোনা মহামারী আর অর্থনৈতিক, মানবিক মহাবিপর্যয়ের দিনে বারবার মনে পড়ে মার্কস-লেনিনকে। কেন মনে পড়ে মার্কসকে? মনে পড়ে, কেননা মহা-ভয়ংকর অজ্ঞাত-অচিন্ত্যনীয় ব্যাধি সর্বগ্রাসী মৃত্যুক্ষুধা নিয়ে মানবসভ্যতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পুঁজিবাদী বিশ্ব ভয়ে থরহরিকম্প। পুঁজিবাদী অর্থনীতি, পুঁজিবাদী সমাজরাষ্ট্র, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিক্ষা, যোগাযোগ, বাণিজ্য, শিল্প-কারখানাসব লুটিয়ে পড়েছে। ক্যাপিটালিজমের সব অর্জন মিথ্যে হয়ে গেছে। আমরা ভুলিনি, সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের সময় লুটেরা পুঁজিবাদের তল্পিবাহকরা বগল বাজিয়ে নেচে-কুঁদে ঘোষণা করেছিল মার্কসবাদ মৃত, সমাজতন্ত্র মৃত, বাতিল ওসব ডগমা। তখন বিলেতে পাথরমূর্তির ভেতর মৃত কার্ল মার্কস হাসছিলেন। মস্কোয় কাচঘেরা ঘরে মমি হয়ে ঘুমিয়ে-পড়া লেনিন মুচকি হাসিতে কাচের দেয়ালে শীতল ভেপার তৈরি করেছিলেন।
পৃথিবীর দেশে দেশে কোটি কোটি কৃষক, যাদের পূর্বপুরুষরা চাষাবাদ করে জীবন কাটাত গ্রামের মাঠে-খামারে, শ্রমিক হয়ে আজ তারা শহরে চলে গেছে। চাষাবাদ তাদের খাদ্য জোগাতে পারে না। চাষিপুত্র আজ চাষি হতে চায় না। বাধ্য হয় দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে মজুর হতে। মহাব্যাধি আর মৃত্যু তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে বন্ধ হয়ে যাওয়া নির্মাণকাজ আর কারখানা থেকে। দেশের ঠিকানায় ছুটতে ছুটতে বিশ্বায়নের মানুষ, মুক্তবাজার অর্থনীতির মানুষ শুনছে রাষ্ট্রসংঘের ঘোষণাআসছে মহামন্বন্তর! প্রশ্ন হলো, কোথায় গেল পুঁজিবাদী দেশের বা মাতৃভূমির পবিত্র সংবিধানে বর্ণিত নাগরিকের অধিকার? কোথায় হারাল বাঁচার অধিকার, চিকিৎসার অধিকার? রাজনীতি কি শুধু ভোটের উৎসব? বাংলাদেশের মানুষের কি মনে পড়ে না একাত্তরের অঙ্গীকার? একাত্তরে তাদের মুক্তিযোদ্ধা পূর্বসূরিরা রাজনীতি বলতে কী বুঝত? তাদের কাছে রাজনীতিটা কি ছিল না শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন? এসবই তো ছিল মার্কসের কথা। কার্ল মার্কস তো এটা বলেননি যে টাকাপয়সার শক্তি বিদ্যা আর জ্ঞানচর্চার চেয়ে অধিক।
আমরা যে শ্রেণিতে অবস্থান করছি তাকে পেছনে ঠেলে শুধু ওপরে উঠতে চাইছি। যত অর্থ-মুদ্রা আছে তারও ওপরে উঠতে উন্মাদ আমরা। অথচ মার্কস তার বিরুদ্ধে। একসঙ্গে চলতে বলেছেন তিনি। বলেছেন শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। বারবার বলেছেন ক্ষুধাহীন সমাজ আর রোগ-শোক-ব্যাধি-শূন্য আনন্দময় এক সমাজের কথা। ডাস ক্যাপিটাল লিখে দুনিয়ার অর্থনীতির সংজ্ঞা বদলে দিয়েছেন। শুধু ইংল্যান্ডে নয়; জার্মানি-সমেত ইউরোপের দেশে দেশে তিনি প্লেগের দাপট দেখেছেন। বুঝেছেন পুঁজিবাদী সমাজ সফলভাবে এই রোগের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ। কেননা পুঁজিবাদে মানবতা নেই। স্বার্থপরতা আছে। চিকিৎসার বদলে চলে চিকিৎসা-বাণিজ্য। কেন থাকবে শুধু একচেটিয়া ধনীদেরই চিকিৎসা-অধিকার? কার্ল মার্কস পাথরের বা ধাতব কোনো মূর্তির ভেতর নেই, তিনি আছেন আদর্শে, দর্শনে। আজ মানুষ মার্কসের চোখ দিয়েই দেখছে এইডসের মতো ঘাতক রোগ কেন সমাজতান্ত্রিক সমাজে নেই। এটাও দেখছে পুঁজিবাদ অতি-মুনাফার লোভে কী করে ধ্বংস করছে বিশ্ব পরিবেশ এবং জন্ম দিচ্ছে নতুন নতুন ব্যাধির। মার্কস আছেন অন্নহীন, গৃহহীন, ব্যাধিতে-আক্রান্ত মানুষের মুক্তির স্বপ্নে। মার্কসই জানিয়েছেন মানুষের রোগমুক্তির অধিকার, আনন্দময় জীবনের অধিকার হচ্ছে তার মৌলিক অধিকার। পুঁজিবাদ তা গ্রাস করতে পারে না।
মানবসভ্যতায় মার্কসের তত্ত্বের সফল প্রয়োগ প্রথম যিনি করেন তার নাম লেনিন। তিনিই প্রথম বিশ্বের মধ্যে বৈজ্ঞানিকভাবে জনস্বাস্থ্য পরিষেবার উদ্ভাবক। বিপ্লবের পর ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নানা দেশের স্প্যানিশ ফ্লু-আক্রান্ত সৈন্যরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষেও এই ঘাতক ব্যাধি চলে আসে। বাংলাসহ এই ভারতবর্ষেই দুই লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। রাশিয়া আরও সংকটে পড়ে ফ্লু-এর সঙ্গে কলেরা-মহামারী শুরু হলে। এদিকে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় সাম্রাজ্যবাদীরা। বাইরে থেকে ওষুধ আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। লেনিন দৃঢ় হাতে মহামারী দমনে নেমে পড়েন। তিনি গড়ে তোলেন জনস্বাস্থ্য কমিসারিয়েট। এর কার্যভার তুলে দেওয়া হয় শ্রমিক কাউন্সিলগুলোর ওপর। লেনিন ঘোষণা করেন, ‘হয় ব্যাধির জীবাণু ধ্বংস করবে সমাজতন্ত্রকে, নয়তো সমাজতন্ত্রই পরাভূত করবে মহামারীকে’। তাই তিনিই বিশ্বে প্রথম শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য পরিষেবা তুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবাকে জাতীয়করণ করেন। বিনা মূল্যে নাগরিকরা স্বাস্থ্য পরিষেবা লাভ করেন। লেনিনই প্রথম বিশ্বনেতা যিনি সদ্য (১৯১৭) বিপ্লব-করা দেশে দুবছর পর ১৯১৯ সালে বিপ্লব রক্ষার্থে রাজধানী মস্কোর রেলস্টেশনগুলোকে জীবাণুমুক্তকরণে স্যানিটাইজার পদ্ধতি গ্রহণ করেন। বিপ্লবী স্বাস্থ্যকর্মীর (বিপ্লবে অংশগ্রহণ-করা জনফৌজ) অসংখ্য গ্রুপ তৈরি করে রেলযাত্রীদের চিকিৎসা পরিষেবার ব্যবস্থা করেন। সারা বিশ্ব (পুঁজিবাদী) অবাক হয়ে দেখে বিস্ময়কর সেই কর্ম-প্রচেষ্টা।
আজকে করোনা আক্রান্ত দেশে দেশে রোগীদের যে লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, নিভৃতবাসে পাঠিয়ে চিকিৎসা দান করা হয়, তার উদ্ভাবক হচ্ছেন ইলিচ লেনিন। তিনি জানতেন বিপ্লব রক্ষা করতে গেলে মহামারীকে পরাজিত করতেই হবে। আমাদের আক্ষেপ-কষ্ট এই, আমরা স্মৃতির দংশনে ক্ষত-বিক্ষত হই, যখন মনে পড়ে সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে সংক্রামক ব্যাধি এবং মহাদুর্ভিক্ষের কথা। সেদিন আমরা ব্যাধি, ক্ষুধা আর যুদ্ধপীড়িত সদ্য-স্বাধীন জনগণকে সেবা দিতে পারিনি। যে রাশিয়া আমাদের যুদ্ধবিজয়ে বিরাট ভূমিকা নিয়েছিল তার অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করিনি। শিক্ষা নিইনি। আজকে যে বিশ্ববাসী করোনাকে পরাভূত করার ওষুধ আবিষ্কারের জন্য হাতড়ে মরছে, ১৯১৮ থেকে ১৯২২ সাল অবধি রাশিয়ার অবস্থা ছিল তাই। শতভাগ নিরাময় হতে পারে, কলেরার জন্য এমন ওষুধ তখনো আবিষ্কার হয়নি। কলেরায় রাশিয়ায় মৃত্যু ঘটেছিল ২০ লাখ মানুষের। রুশ বিপ্লবের বিপ্লবী বাহিনীর সদস্য তো বটেই, মৃত্যু ঘটেছিল রেড আর্মির অন্যতম নেতা, লেনিনের সহযোদ্ধা লিও ট্রটস্কির পিতার। সেদিন লেনিন স্বাস্থ্যকর্মীদের ইউনিয়নের সম্মেলনে ঘোষণা করেন, ‘বিপ্লবী যুদ্ধে আমরা রক্তপাতের পথে সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত ধ্বংস করতে পেরেছি। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে রক্তপাতহীন যুদ্ধে ব্যাধি মহামারীকে পরাভূত করা’।
(আগামীকাল দ্বিতীয় কিস্তিতে সমাপ্য)
লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক
দাবি আদায়ে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে মানুষের সংগঠিত হওয়া, প্রতিবাদ জানানো কিংবা ধর্মঘট অন্যতম গণতান্ত্রিক অধিকার। বাংলাদেশের বাস্তবতায় যেখানে শোষণ-বঞ্চনা ও শ্রেণি বৈষম্য প্রকট, সেখানে এই অধিকারকে সংকুচিত করার সুযোগ নেই। এসবে জনভোগান্তি তৈরি হলেও অধিকার প্রতিষ্ঠা, ন্যায্য দাবি আদায় ও অন্যায়ের প্রতিবাদে কর্মবিরতি, হরতাল, ধর্মঘটের মতো চূড়ান্ত কর্মসূচিতে যাওয়া ছাড়া উপায়ও থাকে না। তবে অনেক সময় এসব কর্মসূচি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে ভিন্ন কোনো মহলের স্বার্থকে হাসিল করতে দেওয়া হয় কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মঙ্গলবার দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত ‘খর্ব হচ্ছে ১৯ সেক্টরে ধর্মঘটের অধিকার’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এসব সেক্টরে ধর্মঘট, লে-অফ, লকআউটের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে যাচ্ছে সরকার। এ জন্য ‘অত্যাবশ্যক পরিষেবা আইন, ২০২২’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। ফলে জনজীবন ব্যাহত হয়এমন কোনো ক্ষেত্রে ইচ্ছা করলেই আর ধর্মঘট বা হরতাল ডাকা যাবে না। নতুন আইনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি সরকারের কাছে আবেদন করে নিজেদের অত্যাবশ্যকীয় সেবায় যুক্ত করতে চায়, তাহলে তারা সেই সুযোগ পাবে। অর্থাৎ বেসরকারি যেসব বন্দর আছে বা তৈরি পোশাক খাতও নিজেদের অত্যাবশ্যকীয় সেবা ঘোষণা করে এর আওতায় আসতে পারবে।
কর্মসংস্কৃতি বলতে একটি বিষয় আছে। গুরুত্ব বিবেচনায় অনেক পেশার সঙ্গেই থাকে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের শর্ত, অনেক ক্ষেত্রে বাঁচা-মরার প্রশ্নও জড়িয়ে থাকে। ফলে সব পেশায় চাইলেই সেবাদান বন্ধ করা যায় না। অন্যদিকে ন্যায্য দাবি আদায়, অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানোর অধিকার সব শ্রেণির সব পেশার মানুষেরই রয়েছে। তবে বিভিন্ন দেশে জরুরি সেবা খাতে এ ধরনের কর্মসূচি কালেভাদ্রে দেওয়া হয় বলেই দেখা যায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশে ‘জরুরি সেবা’ সংশ্লিষ্ট খাতে হরহামেশা ডেকে বসা কর্মবিরতি, ধর্মঘট ও এর ফলে সৃষ্ট জনদুর্ভোগ এখন নিত্যনৈমিত্তিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে, এসব কর্মসূচিতে সংশ্লিষ্টদের দাবিদাওয়ার চাইতে জনভোগান্তির চিত্রই বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। এতে একদিকে মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের অধিকার অন্যদিকে জনগণের জরুরি সেবা পাওয়ার অধিকার উভয়কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে মূলত কায়েমি কোনো স্বার্থ হাসিল করা হয় বলে প্রতীয়মান।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) অনেকবার বলেছে বাংলাদেশের শ্রম আইন দুর্বল। বিভিন্ন খাতের শ্রমিক শোষণ ও তাদের বঞ্চনার কথা আমাদের সবারই জানা। বিভিন্ন সময় যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্যই তাদের পথে নামতে হয়। অত্যাবশ্যক পরিষেবা আইন পাস হলে শ্রম আইন আরও দুর্বল হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরোধী দলের কর্মসূচিকে সামনে রেখে দেওয়া পরিবহন ধর্মঘটে সৃষ্ট দুর্ভোগকে ‘রাজনৈতিক জনভোগান্তি’ বলে মনে করারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। একপক্ষ বলছে, বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে নয়, নিজেদের নিরাপত্তা ও দাবিদাওয়া আদায়ে বাস ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। অপরপক্ষ বলছে, মালিক ও শ্রমিকের নাম দিয়ে ধর্মঘটের কথা বলা হলেও এর সঙ্গে সরকারই সম্পৃক্ত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব ধর্মঘটে বিআরটিসি বাসও বন্ধ ছিল। রাজনীতি বিশ্লেষক ও যাত্রী কল্যাণে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, বিএনপির আমলেও এ ধরনের কর্মসূচি দেখা গেছে। কিন্তু এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবেএ কথা সবাই বলেন, কিন্তু রাজনৈতিক সমাবেশ এবং পরিবহন ধর্মঘটের ঘটনা যে ঘটেই চলেছে তা দেশের মানুষকে কী বার্তা দেবে? ক্ষমতা দেখানোর এই সংস্কৃতির অবসান হবে? অন্যদিকে, স্বজনের মৃত্যুতে চিকিৎসক ও হাসপাতালের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনা এবং এর প্রতিবাদে চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে যাওয়াসহ অ্যাম্বুলেন্স চালক ও নার্সদের ধর্মঘটের খবরও গণমাধ্যমে এসেছে। এ ক্ষেত্রে রোগীর স্বজনদের ক্ষমতা প্রদর্শনের সংস্কৃতি যেমন দায়ী, তেমনি জরুরি ও বিশেষ মুহূর্তে অসহায় মানুষের অভিযোগ জানানোর সুযোগের অভাবও দায়ী। সমস্যাগুলো বহুমাত্রিক। একদিকে প্রকট শ্রেণি বৈষম্য, শ্রমিক শোষণ, অন্যায্য মজুরি; অন্যদিকে মালিক-কর্তৃপক্ষের স্বার্থপরতা, পেশাজীবীদের যূথবদ্ধ স্বার্থ ও সর্বোপরি অপরাজনীতি। ফলে অত্যাবশ্যক পরিষেবার নামে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার ও ধর্মঘট করার গণতান্ত্রিক অধিকার সংকোচন করা হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কেবল আইন করে হবে না, সবার আগে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। বিভিন্ন সেবা খাতের পেশাজীবী, মালিক-শ্রমিক এবং সেবা গ্রহীতা জনগণের মধ্যে সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অর্জনেও সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর চর্চিত সংস্কৃতি বড় প্রভাব রাখে।
সম্বোধন আমাদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্বোধন শুনে বোঝা যায় মানুষে মানুষে সম্পর্ক, সামাজিক অবস্থান ও শ্রেণিবৈষম্য। বাংলা ভাষায় তিনটি সম্বোধন পদ আছে : তুই, তুমি ও আপনি। তুচ্ছার্থে বা নিচু শ্রেণি বোঝাতে যেমন ‘তুই’ বলা হয় তেমনি অতি প্রিয়জনকে ভালোবেসে বা আদর করে ‘তুই’ সম্বোধন করা হয়। এটা আমাদের ভাষার মাধুর্য, রেওয়াজ বা প্রচলিত রীতি। আমরা ছোটদের ‘তুই’ বা ‘তুমি’ আর বড়দের ‘আপনি’ বলি। এই আমরাই আবার শ্রেণি বিবেচনায় বাবা-মা-দাদা-নানার বয়সী মানুষকেও তুই-তোকারি করি দম্ভ ভরে। যুগ যুগ ধরে সামাজিক অবস্থান বা পোশাক দেখে খুব সহজেই তুই-তোকারির প্রথা রয়েছে। বাসাবাড়িতে কাজের বুয়াকে ৫-৬ বছরের শিশুও ‘তুই’-‘তুমি’ বলে ডাকে। আর বয়স্ক বুয়ারা ‘ভাইয়া’, ‘আপামণি’ বলে ডাকে। রিকশাওয়ালা ফেরিওয়ালা বা নিম্নবিত্তের মানুষদের অবলীলায় ‘তুই-তোকারি’ করাটাই এখানকার নিয়ম। এই ঘটনাগুলো আমাদের কাছে অতি পরিচিত।
এ ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা নিরাপদ। সেখানে সবাই ‘ইউ’ অর্থাৎ তুমি। ‘আপনি’ বা ‘তুই’ এর বালাই নেই। আমাদের পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ‘তুই’ সম্বোধনটাই বেশি চলে। তারা ছোটদের ‘তুই’ বলে ডাকে। এক টিভি সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মোহাম্মদ বলেন, ‘বিশ্বভারতীতে (শান্তিনিকেতন) পড়াশোনা করতে গিয়ে প্রথমে আমার খুব সমস্যা হয়েছিল। সেখানে সব শিক্ষকরা তুই বলে ডাকেন। আমি সেটা মেনে নিতে পারতাম না। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়েছি। আসলে তুই বলে ডাকাটাই সেখানকার চল’। চলচ্চিত্রনির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘এবং ঋতুপর্ণ’ নামে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ছোট-বড় প্রায় সবাইকে তুই সম্বোধন করতেন। একবার ঋতুপর্ণ ঘোষকে কোনো এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল সবাইকে তুই বলার কারণ। তিনি বলেছিলেন, ‘তুই বললে একে অন্যকে কাছের আর বেশি আপন মনে হয়। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অন্তরঙ্গ হওয়া সহজ হয়।’ ৭০-৮০’র দশকে বন্ধু-বান্ধবীরা তুই বলেই সম্বোধন করত বেশি। ’৯০ দশক থেকে বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে তুমি বলার চল বেড়েছে। বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে বিয়ে হলে তুই থেকে তারা তুমি বা আপনি সম্বোধনে চলে যেতেন। কারণ বিয়ের পর তুই-তোকারি চলে না। সহপাঠীরা একে অপরকে তুই বলে ডাকলেও উভয়ের মধ্যে পরিণয় ঘটলে তখন এক অজানা নির্দেশে ‘তুই’ শব্দটি তুমিতে উন্নীত হয়। বিয়ের পর তুই সম্বোধন তাদের কাছে যেন বেমানান লাগে। দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্পর্কে সম্বোধনটি তুমি হলেই যেন ভালো। এক সময় আমাদের দেশে স্বামীরা স্ত্রীদের সম্মান করে আপনি বলে ডাকতেন। আবার তুই বলে ডাকার চলও আছে। স্ত্রীকে আপনি বলবেন এটা অনেক পুরুষ যেন ভাবতেই পারেন না। তবে, ইদানীং অনেকেই স্ত্রীকে তুমির পরিবর্তে তুই বা আপনি বলে ডাকছেন ভালোবেসে।
তুই সম্বোধন করে অনেক গানও হচ্ছে আজকাল। গানগুলো জনপ্রিয়ও হচ্ছে। তবে এই গানগুলো একতরফা ছেলেরাই মেয়েদের নিয়ে গাচ্ছে। তপুর গানের শিরোনাম ‘তুই’। আসিফ আকবরের গান-‘খোদার কসম-আজ থেকে ভুলে যাব তোর নাম’। এমনি আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। তুই সম্বোধনটাকে আবার অনেকে মেনে নিতে পারছেন না আমাদের সমাজে। তারা মনে করছেন এতে নারীদের অসম্মান করা হচ্ছে। গানের লিরিকে কেন তুই-তোকারি থাকবে? আমাদের চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় গান আছে তুমি বলে ডাকলে কত মধুর লাগে/আজ থেকে আর আপনি বলে ডেকো না আমাকে। প্রখ্যাত গীতিকার রফিকুজ্জামান গানে তুই-তোকারিকে পছন্দ করেননি। একটি জনপ্রিয় অনলাইন পোর্টালে তার কলামে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল কবিদের লেখায় তুই-তোকারি’র অনেক উদাহরণ আছে। কিন্তু সেসব নিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ কখনো কোনো প্রশ্ন তোলেনি। ‘‘আপাতভাবে নিরীহ মনে হলেও ‘তুই’, ‘তুমি’ ও ‘আপনি’ শব্দ তিনটি আমাকে খুব ভাবায়। অনেক দেখার পর আমার মধ্যে এই বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে যে এই তিনটি শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে আমরা ব্যাপক অবিচার করে থাকি। আমরা গরিবকে অবমূল্যায়ন করি; পরিশ্রমীকে অপমান করি; অযোগ্যকে সম্মান করি, নিরীহকে ভয় দেখাই, সাধারণ লোকের আত্মসম্মানে আঘাত করি; সর্বোপরি সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করি। চোখ কান একটু খোলা রাখলেই আপনি উপলদ্ধি করতে পারবেন।’’ (আমার ভাবনা/মনিরুজ্জামান সোহেল, ভোকাব গ্রামার-১,পৃ ৫৮৭)।
তুই-তোকারির কারণে শুধু যে মানুষ অপমানিত হয়, বিব্রতবোধ করে আর শ্রেণিবৈষম্য চোখে পড়ে তাই না। জীবননাশের ঘটনাও ঘটছে। তুচ্ছ কারণেই জীবন চলে যাচ্ছে। মেয়েদের মধ্যে তুই তুমি নিয়ে তেমন সমস্যা না থাকলেও তরুণদের মধ্যে রয়েছে। বয়সে ছোট কেউ তুই তুমি বললে যুবকরা একদম সহ্য করতে পারে না। তাদের ইগোতে লাগে। এ নিয়ে আমাদের দেশে অনেক ফ্যাসাদ হয়। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে, শুধু ‘তুই’ করে বলাতেই ২০১৭ থেকে ২০১৯ এই তিন বছরে রাজধানীতে খুন হয়েছে চারজন। তুই-তোকারি করতে গিয়ে আমরা অনেকেই মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ঝগড়া বিবাদে আপনি বা তুমি থেকে তুইতে নামতে বেশি সময় লাগে না। আমাদের জীবনে সম্বোধনের ভূমিকা রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই পরিবারের মধ্যে এ ধরনের চর্চা ও শিক্ষা দেওয়া উচিত। মানুষকে ‘তুই’ এর পরিবর্তে তুমি বা আপনি বললে ক্ষতি কী? এতে যদি একটি মানুষ নিজেকে সম্মানিত মনে করে।
সম্বোধনের এই জটিল সমীকরণ থেকে মুক্ত হতে তুই তুমি ও আপনি থেকে যে কোনো একটা বেছে নিতে পারি। এ ক্ষেত্রে হয়তো অধিকাংশই তুমি বলাকেই পছন্দ করবেন। আবার অনেকে এটাও মনে করেন বৈচিত্র্য হিসেবে তিনটি সম্বোধন থাকলে দোষ কী? সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে সম্বোধনের ধরন। সম্পর্কই বলে দেবে কাকে আপনি কাকে তুমি আর কাকে তুই বলতে হবে। তবে, অপরিচিতজনকে তুই কিংবা তুমি না বলে আপনি বলাই বুদ্ধিমানের কাজ। তা না হলে কখনো বিব্রত হতে পারেন। কোনো মানুষকে তুই তুমি বলার আগে আরেকটিবার ভাবুন, ভাবুন এবং ভাবুন। কাউকে তুমি বলার আগে একবার ভাবুন আর তুই বলার আগে দুইবার ভাবুন। সৌজন্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। প্রথম পরিচয়ে কোনো অবস্থাতেই সম্বোধনে যেন ত্রুটি না থাকে সেদিকে সতর্ক হোন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ফুল কুঁড়িতেই ঝরে গেল। ফুলের নাম লিজ ট্রাসম্যারি এলিজাবেথ ট্রাস; রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের এজাজত নিয়ে উজিরে আজমের (সরি, বলা উচিত উজিরানী আজম) গদিতে বসেছিলেন। কিন্তু ঠিকমতো গোদ পেতে বসতে পারলেন না। তার আগেই পশ্চাতোত্থিত করতে হলো। লিজকে নিয়ে কত যে কথা হলো! তাতে রীতিমতো একটি উপাখ্যান হয়ে যাবেউপাখ্যানের নাম হতে পারে মাদার অব লিলিপুট অব ‘পলিপুট’। অর্থাৎ পলিটিকস পুরাণের লিলিপুট। প্রধানমন্ত্রিত্বের আয়ুষ্কাল বিবেচনায় তিনি লিলিপুটই বটে। অথবা তাকে বলা যেতে পারে, ‘হবিট অব দ্য হেবিটেবল শায়ার’। ইংল্যান্ড তো শায়ারেরই দেশ।
জে আর আর টলকিয়েনের লর্ড অব দ্য রিংসের প্রিকুয়েল ‘হবিট’-এ উল্লিখিত এবং বিখ্যাত হবিট-কুলের রানী ‘ট্রাস দ্য হবিট’। অবশ্য আরব্য রজনীর ‘এক দিনের বাদশাহ’কে পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন ট্রাস; একচুয়ালি দেয়ার ওয়াজ নো ট্রাস্ট ইন হার ‘আনএক্সপেক্টেড জার্নি অব দ্য হবিট’। হোয়াট আ মেস অব বিলবো ব্যাগিনস! আহারে, এলভস অব দ্য মিডল আর্থ আর গন টু রাশিয়া উইথ দ্য ডর্ভস। বিদায়ের পর তার জন্য ‘সিংহাসন’ সাজিয়ে দিচ্ছে ‘আজগ’ দ্য মেরিকান। নাউ হার রয়্যাল সোলজার্স আর দি ওর্কস। লিজ ট্রাস আসলেই কামেলিয়তির এক উপাখ্যান রচনা করে গেছেন। তিনি দ্য ক্রনিকলস অব নার্নিয়ার সিংহবাহিনী সেই ছোট্ট মেয়েটিই রয়ে গেলেন! বড় হওয়ার সময় আর পেলেন না। তার উপাখ্যানের কথাবলি নিয়ে একটা নতুন মহাভারত হতে পারে। লিজ ট্রাসকে নিয়ে কিছু সংবাদ-শিরোনামের কথা বলা যেতে পারেযেমন ‘নো ট্রাস্ট ইন ট্রাস’, ‘উইল শি বি মোর ডিউরেবল দ্যান লেটুস!’, ‘হোয়েন ট্রাস উইল লিভ টেন ডাউনিং স্ট্রিট’, ‘আওয়ারস নট ডেইজ’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ ট্রল করে বলেছেন, ‘নোবেল (প্রাইজ) শুড বি গিভেন টু হার ফর কুইক ডেস্ট্রাকশন অব ইউকে ফাইন্যান্স সিস্টেম’। যে যেভাবে পারে তাকে নিয়ে মজা করেছে।
ব্রিটিশ পত্রপত্রিকা তো বটেই, আন্তর্জাতিক সব মিডিয়াতেই লিজ মশকারার পাত্রী ছিলেন। ব্রিটিশদের ভাষায় আনকালচারড, আনসিভিলাইজড রুশ জাতির সাবেক প্রেসিডেন্টও তাকে নিয়ে মশকরা করতে ছাড়েননি। তিনি নাকি আজগের পিঠে (ইউক্রেনি ট্যাংক) সওয়ার হয়ে দনবাসবাসীকে ভয় দেখাতে গিয়েছিলেন। ইতিহাস-চেতনার নিরিখে দারুণ এক অপগণ্ডের নাম এলিজাবেথ ট্রাস। তার বিদায়ে সম্ভবত রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কবরের পাশ ফিরে শুয়েছেন। আর বলছেন, ওম শান্তি! শান্তি শান্তি। এ কথা বলা যেতেই পারে, কেন না লিজের বিদায়ের পর রবিবারই ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেছেন, ‘ইউকে রেডি টু অ্যাসিস্ট ইন রিজলভিং ইউক্রেইন কনফ্লিক্টকিয়েভ নর দ্য ওয়েস্ট ইজ সিকিং অ্যান এস্কেলেশন অব দ্য অনগোয়িং কনফ্লিক্ট’। বাস্তবে ওয়ালেস কী করতে পেরেছেন সে কথা না হয় মাচাঙের ওপর তোলা থাক। একটা ফ্যান্টাসি শেষ হতে না হতেই আরেকটা ফ্যান্টাসির শুরু। লিজ ট্রাসের অতি স্বল্পস্থায়ী ‘রুলিং অব দ্য রিয়েলম’ শেষ হতে পারেনি, মঞ্চে আবির্ভূত হলেন নতুন কুশীলবঋষি সুনাক। গেম অব থ্রোনসের আবহে সুনাকেরও আবির্ভাব; ‘ল্যানিস্টার’ বংশীয় ব্রিটিশদের দাপটে তার অবস্থা ‘নেড স্টার্ক’-এর মতো হবে না তো! সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে যুদ্ধজাহাজে করে (ভিক্টারিয়ন গ্রেজয়) লর্ড কমান্ডার অব দি আয়রন ফ্লিট (মানে আমেরিকান ফ্লিট) যুক্তরাজ্যকে গ্রাস করবে না তো! (ভিক্টারিয়ন গ্রেজয় আবার ল্যানিস্টার বংশীয়া সার্সি ল্যানিস্টারের পাণিপ্রার্থী) সেই রকমটা হলে সুনাকের পক্ষে সাফল্যের মুখ দেখা কঠিন হবে। যুক্তরাজ্য তথা ইউনাইটেড কিংডম (ইউকে) ফ্যান্টাসির ধূসর অথচ বর্ণাঢ্য জগতে আটকা পড়েছেইন গেম অব থ্রোনস, হবিট এবং দ্য ক্রনিকলস অব নার্নিয়া। এই খেলার নাটাই আটলান্টিক সাগরের ওপারে থ্যালাসোক্রেটিক রিয়ালম যুক্তরাষ্ট্রের হাতে।
কিন্তু ঋষি সুনাককে নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে অন্য জাতের এক উন্মাদনা দেখা দিয়েছে। কারণ তার জন্মের সুতায় ভারতীয় কাদা লেগে আছে। সেই সুতা যত দূরবর্তীই হোক না কেন। সুনাক ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ। তার দাদা-দাদি একসময় ভারতভূমিতে ছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যুগে। ব্রিটিশের নাগরিক হিসেবেই একসময় তারা আফ্রিকায় গিয়েছিল। যেমন মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিলেন। ব্রিটিশের নাগরিক হিসেবেই তারা গ্রেট ব্রিটেনে পাড়ি জমিয়েছিল। সেভাবেই সুনাক একজন ব্রিটিশ নাগরিকভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক মুঘলদের চেয়েও কম এবং পাতলা। তবে তার আরেকটা খুঁটির জোর আছে, সেই খুঁটি হলো তার স্ত্রী অক্ষতাঅক্ষতা মূর্তি। এক ভারতীয় ধনকুবেরের মেয়ে। সেই সূত্রে সুনাক ভারতের জামাতাও বটেন। সুনাকের যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ায় এক ধরনের উন্মাদনা দেখা গেছে। যুক্তরাজ্য ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারলেও ভারতবাসীর এই জিনিসটা হতে এখনো অনেক বাকি। শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশ, পাকিস্তানেরও ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া এখনো ঢের বাকি। তাই সুনাকের ‘হিন্দু’ পরিচয়টা ভারতীয় ডিসকোর্সে বেশি জায়গা পাচ্ছে। হয়তোবা বিজেপি নামের একটা ‘অষ্টরম্ভা সত্তা’ ক্ষমতায় আছে বলে। সুনাককে বেশি বেশি করে ‘হিন্দু’ হিসেবে পরিচয় করানো হয়েছে। সুনাক ভারতের নয়, ‘হিন্দু’ ভারতের অতিদূরবর্তী এক সুতা। তাকে দিয়ে ভারতবাসীর অর্জন ঠিক ততটুকুই হবে যতটুকু অর্জন আফ্রিকাবাসীর হয়েছে বারাক ওবামাকে দিয়ে। কে কোন দেশি বা কোন দেশের বংশোদ্ভূত সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী যারা হন তারা যে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন সে দেশের এস্টাবলিশমেন্টের অংশ হয়েই কাজ করেন। আর রাষ্ট্রপ্রেম বা দেশপ্রেম বজায় রাখতে হলে একজন ব্যক্তিকে তার রাষ্ট্রের, দেশের কথাই ভাবতে হবে। সুনাক তার ব্যতিক্রম হতে পারেন না। অতএব ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলে এত চেঁচানোর কোনো মানে হয় না। তাকে তার কাজ করতে দেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ‘আমপাবলিকের’ তালে তাল দেওয়া আকলমন্দ কাজ হবে না। লন্ডনের মেয়র সাদিক খানও যদি কোনো দিন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হন, তাকে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বলে বা মুসলমান বলে আত্মতৃপ্তি বোধ করার কিছু থাকবে না। এসব আসলে এক ধরনের ‘আওয়াম বা আম উন্মাদনা’। বারাক ওবামা এই ক্ষেত্রে দারুণ এক উদাহরণ। কমলা হ্যারিসও একজাম্পল হতে পারেন। সুনাককে বর্তমান বিশ^-বাস্তবতা এবং ব্রিটেনের ‘অবশিষ্ট সাম্রাজ্যের মানসিকতা’র নিরিখেই বিচার করতে হবে। যাই হোক, ভারতীয়রা উচ্ছ্বসিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। ভারতীয়রা ব্যাপারটিকে দেখছে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে। তবে ধর্মের প্রসঙ্গটাই প্রাধান্য পেয়েছে। যদিও ব্রিটিশ রাজনীতিতে ধর্ম ‘আপাত গৌণ’ বিষয়। হিন্দু, মুসলিম, পারসিক, শিখসব ধর্মাবলম্বীই ব্রিটিশ ক্যাবিনেটে থাকে এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন তারা। ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে এবং নিজের যোগ্যতাবলে। সুনাক প্রতিভাবান এবং সফল একজন ব্যক্তি; বিলিওনেয়ার। দুনিয়ার সবচেয়ে সফল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসে কাজ করেছেন তিনি। নিজের ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি চালিয়েছেন। অল্প বয়সে এমপি হয়েছেন। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। কভিড মহামারীর সময়ে ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রীর (চ্যান্সেলর অব দ্য এক্সচেকার) দায়িত্ব পালন করেছেন।
ব্রিটিশদের মধ্যে জাত্যাভিমান যে একেবারেই কাজ করেনি তা বলা যায় না। ঋষি সুনাক কিন্তু প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। বর্ণবাদ তথা জাত্যাভিমান ভেতরে ভেতরে ক্রিয়াশীল ছিল। প্রধানমন্ত্রীর পদ যাতে সুনাক পেতে না পারেন অনেকেই সে চেষ্টা করেছিলেন, বিশেষ করে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন (অর্থাৎ বো-জো) তাকে ভোট না দিয়ে লিজ ট্রাসের মতো অকেজো-অসার প্রার্থীকে ভোট দিতে তার প্রভাব খাটিয়েছিলেন। মনে তার বাসনা ছিল যে, লিজ ট্রাস টেঁসে গেলে আবার তিনি (একজন খাস ব্রিটিশ হিসেবে) প্রধানমন্ত্রী হবেন। যদিও তিনি তা পারলেন না। লিজ ট্রাস যে অসার মাল তা তো বোঝাই যাচ্ছিল, বেশ আগে থেকেই; ইউক্রেন ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছকেই পা ফেলেছেন তিনি। অবশ্য দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর যুক্তরাজ্যের কূটনীতি তথা পররাষ্ট্রনীতি স্বাধীন কোনো বিষয় নয়, এ কথা সবাই জানে। ধারণা করি, কল্পরাজ্যের হবিটরাও এ কথা জানে। ঋষি সুনাক ব্রিটিশদের চেয়েও বড় ব্রিটিশ, তা প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন তিনি। কারণ সবার নজর থাকবে তার ওপর। কীভাবে দেশ চালান তিনি সবাই খেয়ালে রাখার চেষ্টা করবে যেহেতু তিনি নেটিভ ব্রিটিশ নন। যুক্তরাষ্ট্রের কারণেও তিনি ব্রিটিশ হতে চাইবেন। একদা গোল্ডম্যান স্যাকসের কর্মচারী ছিলেনএ বিষয়টাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। জিতে গিয়ে তিনি একবার বলেছিলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপথ পাল্টানোর চেষ্টা করবেন তিনি। পেছনে ‘গোল্ডম্যান স্যাকস’ সুতো টেনে ধরেছিল কি না তা আমাদের জানা নেই। ওই কথা বেশি দূর এগোতে দেননি তিনি। বরং বলেছেন, ইউক্রেনে তিনি যুক্তরাজ্যের চলমান ভূমিকাই অব্যাহত রাখবেন। ইউক্রেন থেকে যুক্তরাষ্ট্র যেমন সম্মান বাঁচিয়ে বের হয়ে আসতে পারবে না, ঋষি সুনাকের যুক্তরাজ্যও বের হতে পারবে নাএমনটাই মনে হচ্ছে। শত হলেও নর্ড স্ট্রিম টু-এর বিস্ফোরণে যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা মহলের (রয়্যাল নেভির) একটা ভূমিকা আছে বলে রাশিয়া অভিযোগ করেছে। সুনাকের পক্ষে তার বিপরীতে যাওয়া কি সম্ভব!
ইউরোপের সমাজ ব্যবস্থা এমন যে, বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, ধর্ম বিষয়ে তারা খুব অসচেতন। কিন্তু ধর্ম ব্রিটিশদের মনে খুব ভালোভাবেই প্রোথিত। বর্ণবিষয়ক অনুভূতিও একই রকম। শামীমা বেগম নামে নাবালিকা ধরনের মেয়ের আইএসের জঙ্গিকে বিয়ে করতে সিরিয়ায় ছুটে যাওয়ার পেছনে ব্রিটিশ গোয়েন্দা মহলের ইন্ধন রয়েছে বলে জোরালো প্রচার আছে এবং এসব কথা একেবারে অমূলক নয়। একাত্তরের রাজাকারদের ঠাঁইও কিন্তু ব্রিটেনেই হয়েছে। কাজেই অন্তত রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের ব্যবহার যুক্তরাজ্যে নেই তা বলা যায় না। ঋষি সুনাক ধর্ম এবং বর্ণের বাধা ডিঙিয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন তার একটি কারণএই আপৎকালীন সময়ে রক্ষণশীল তথা টোরি পার্টিতে বলি হওয়ার জন্য কেউ নিজ থেকে গলা বাড়িয়ে দিতে এত আগ্রহ দেখায়নি, যেমন দেখিয়েছেন সুনাক। আর ঋষি সুনাক অর্থনীতি ভালোই বোঝেন, এর নমুনা তিনি করোনাকালীন দুর্যোগে দেখাতে পেরেছেন। তার মঙ্গল হোক। এই অবকাশে ভারতীয়রা সাবেক প্রভুরাজ্য জয়ের ‘পিতলা সুখ’ পাক বা পেতে থাকুক। আমরা না হয় তার রাজনীতির পরবর্তী এপিসোডের জন্য অপেক্ষা করব।
লেখক: সাংবাদিক
রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও সমাজকর্মী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রামরাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯০৪ সালে নবীনগর হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা, ১৯০৮ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯১০ সালে একই কলেজ থেকে বিএল পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯১১ সালে তিনি কুমিল্লা জেলা বারে যোগ দেন। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ অনুসরণে তিনি ‘মুক্তি সংঘ’ নামে একটি সমাজকল্যাণমূলক সংস্থা গঠন করেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে ত্রাণসহায়তা কর্মকাণ্ডে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন এবং অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন এবং বঙ্গীয় কৃষিঋণ গ্রহীতা ও বঙ্গীয় মহাজনি আইন পাসের বিষয়ে ভূমিকা রাখেন। ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণে তিনি কয়েক দফায় গ্রেপ্তার হন। পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য ওই বছর ডিসেম্বরে পূর্ববঙ্গ থেকে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৮ সালের ২৫ আগস্ট তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনের সব কার্যবিবরণীতে বাংলা অন্তর্ভুক্ত রাখার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ-বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৬০ সালে পাকিস্তানিদের রোষানলে পড়েন এবং ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাকে গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে ছেলে দিলীপকুমার দত্তসহ গ্রেপ্তার হওয়ার পর ময়নামতী সেনানিবাসে হানাদারদের হাতে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত শহীদ হন।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতিতে জোর করে হারানো হয়েছে।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভিন্ন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের যেকোনো আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটির ভোটে যে সংসদ সদস্য দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার তথ্য মিলবে তাকেই বাদ দেওয়া হবে। এ সিটি ভোটে হারের কারণ জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব একটি সংস্থাকে নির্ভুল তথ্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্বও পেতে পারেন আজমত, ওই সূত্র দাবি করে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
নানা অব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তির আওতায় এসেছে অনেক আগে। এরপর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজ অনেকটাই আটকে আছে। খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে চরম দুরবস্থার কথা। গবেষয়ণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু কাজ করার চেষ্টা করলেও কথায় কথায় তাদের ওপর নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। মানের উন্নয়ন না হলেও ঠিকই অধিদপ্তরে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সম্প্রতি এই গবেষণা করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেখানে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। করোনাকালে বন্ধের প্রভাবে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের গড় হার ৫১ শতাংশের বেশি, যা আগে ছিল ৬৮ শতাংশের মতো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও ক্ষতি বেড়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এ ধরনের গবেষণার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখেই তা করা হয়েছে। আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদন দু-এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা অন্তত এক বছরের জন্য রেমিডিয়াল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা দিন দিন পিছিয়ে পড়লেও সেদিকে তেমন একটা নজর নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। তারা ব্যস্ত আছে লাখ লাখ শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন নিয়ে। কেউ কথা বললেই তার ওপর নেমে আসছে শাস্তি। ফলে শিক্ষকরাও দিন দিন তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন; কোনো রকমে দিন পার করছেন।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্ভাবনী ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন রাজবাড়ী জেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিক নির্বাচিত হন। সাধারণত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থীদের পদক দেওয়া হয় একই অনুষ্ঠানে। কিন্তু করোনাকালে তাদের হাতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষক পদক তুলে দেওয়া যায়নি। গত ১২ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তাই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে স্বাভাবিকভাবে তারা দাবি তুলেছিলেন, দেরি হলেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তারা পদক নেবেন; যা তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে ঠিকই পদক নেন। তবে এর ৬৮ দিনের মাথায় এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবি তোলায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ঘটনায় জয়পুরহাটের হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ পদক নিতে ১১ মার্চ ঢাকা এসেছিল। ওই শিক্ষকও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের কাউকে শোকজ করা হয়নি; যা বিধিবহির্ভূত বলছেন শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেদিকেই আমরা যাব।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক নেওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে সেরা প্রাপ্তি। এ জন্য শিক্ষকদের দাবি থাকতেই পারে, প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। শিক্ষকদের যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। এর প্রভাব অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বন্ধ থাকা প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখতে কিছু শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন; যাতে অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনাসহ নানা কাজ করা হয়। এতে প্রতিটি ফেসবুক গ্রুপে লাখ থেকে হাজারো শিক্ষক যুক্ত হয়েছেন। এখনো সেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সেই গ্রুপগুলোকেই এখন শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে যুক্ত থাকা অনেক শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাকেই দেওয়া হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ)। সরকার যেখানে শিক্ষকদের ডিজিটালি আপডেট হওয়ার কথা বলছে, সেখানে প্রায় অনেকটাই উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে আসন গেড়ে বসেছেন কিছু কর্মকর্তা। অনেকেই ৬ থেকে ১২ বছর ধরে একই দপ্তরে চাকরি করছেন। তাদের যে দায়িত্বই থাক না কেন যত লাভজনক কাজ আছে, সেগুলোতেই তারা হাত দিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে আনলে তাদের সরে যেতে হবে, এ জন্য তারা নানাভাবে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিয়ে মাঠপর্যায়ে শাস্তি দিয়ে সবাইকে ভীত করে তুলছেন। এতে পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত মার্চ-এপ্রিলে অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। যদিও নিয়ম ছিল, অনলাইনে নির্দিষ্ট মানদন্ড পূরণ ছাড়া কেউ বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু তা মানেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিয়ম ভেঙে কয়েক শো শিক্ষকের বদলির আদেশ জারি করা হয়। আর এই বদলি-পদায়নে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের; যা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আবার অনেক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলিতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। কাউকে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও অনেক দূরে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন।
জানা যায়, চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। আর আগামী বছর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সাল থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। কিন্তু তা পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই অধিদপ্তরের। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আসলে এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছে বা এ জন্য আর কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তেমন নজর নেই।
এ ছাড়া এখনো প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেডে। দুই ধরনের প্রায় চার লাখ শিক্ষকই ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারাও দীর্ঘদিন ধরে নবম গ্রেডের দাবি করছেন। আর মাঠে কাজ করা এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদোন্নতিও নেই বললেই চলে। কিন্তু এগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের; যা প্রাথমিকের মান উন্নীতের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনো মফস্বলে বা দুর্গম অঞ্চলের অনেক স্কুলেই এক-দুজন শিক্ষক। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ তিন-চার বছর ধরে শূন্য। শিক্ষক না থাকলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের একটু আলাদা যতœ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলোও হচ্ছে না। শিক্ষকরাও তাদের বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। সব মিলিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছি না।’
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতি জোর করে হারানো হয়েছে।
গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন তেমনি যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।