
রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও সমাজকর্মী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রামরাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯০৪ সালে নবীনগর হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা, ১৯০৮ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯১০ সালে একই কলেজ থেকে বিএল পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯১১ সালে তিনি কুমিল্লা জেলা বারে যোগ দেন। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ অনুসরণে তিনি ‘মুক্তি সংঘ’ নামে একটি সমাজকল্যাণমূলক সংস্থা গঠন করেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে ত্রাণসহায়তা কর্মকাণ্ডে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন এবং অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন এবং বঙ্গীয় কৃষিঋণ গ্রহীতা ও বঙ্গীয় মহাজনি আইন পাসের বিষয়ে ভূমিকা রাখেন। ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণে তিনি কয়েক দফায় গ্রেপ্তার হন। পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য ওই বছর ডিসেম্বরে পূর্ববঙ্গ থেকে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৮ সালের ২৫ আগস্ট তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনের সব কার্যবিবরণীতে বাংলা অন্তর্ভুক্ত রাখার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ-বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৬০ সালে পাকিস্তানিদের রোষানলে পড়েন এবং ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাকে গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে ছেলে দিলীপকুমার দত্তসহ গ্রেপ্তার হওয়ার পর ময়নামতী সেনানিবাসে হানাদারদের হাতে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত শহীদ হন।
দাবি আদায়ে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে মানুষের সংগঠিত হওয়া, প্রতিবাদ জানানো কিংবা ধর্মঘট অন্যতম গণতান্ত্রিক অধিকার। বাংলাদেশের বাস্তবতায় যেখানে শোষণ-বঞ্চনা ও শ্রেণি বৈষম্য প্রকট, সেখানে এই অধিকারকে সংকুচিত করার সুযোগ নেই। এসবে জনভোগান্তি তৈরি হলেও অধিকার প্রতিষ্ঠা, ন্যায্য দাবি আদায় ও অন্যায়ের প্রতিবাদে কর্মবিরতি, হরতাল, ধর্মঘটের মতো চূড়ান্ত কর্মসূচিতে যাওয়া ছাড়া উপায়ও থাকে না। তবে অনেক সময় এসব কর্মসূচি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে ভিন্ন কোনো মহলের স্বার্থকে হাসিল করতে দেওয়া হয় কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মঙ্গলবার দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত ‘খর্ব হচ্ছে ১৯ সেক্টরে ধর্মঘটের অধিকার’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এসব সেক্টরে ধর্মঘট, লে-অফ, লকআউটের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে যাচ্ছে সরকার। এ জন্য ‘অত্যাবশ্যক পরিষেবা আইন, ২০২২’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। ফলে জনজীবন ব্যাহত হয়এমন কোনো ক্ষেত্রে ইচ্ছা করলেই আর ধর্মঘট বা হরতাল ডাকা যাবে না। নতুন আইনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি সরকারের কাছে আবেদন করে নিজেদের অত্যাবশ্যকীয় সেবায় যুক্ত করতে চায়, তাহলে তারা সেই সুযোগ পাবে। অর্থাৎ বেসরকারি যেসব বন্দর আছে বা তৈরি পোশাক খাতও নিজেদের অত্যাবশ্যকীয় সেবা ঘোষণা করে এর আওতায় আসতে পারবে।
কর্মসংস্কৃতি বলতে একটি বিষয় আছে। গুরুত্ব বিবেচনায় অনেক পেশার সঙ্গেই থাকে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের শর্ত, অনেক ক্ষেত্রে বাঁচা-মরার প্রশ্নও জড়িয়ে থাকে। ফলে সব পেশায় চাইলেই সেবাদান বন্ধ করা যায় না। অন্যদিকে ন্যায্য দাবি আদায়, অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানোর অধিকার সব শ্রেণির সব পেশার মানুষেরই রয়েছে। তবে বিভিন্ন দেশে জরুরি সেবা খাতে এ ধরনের কর্মসূচি কালেভাদ্রে দেওয়া হয় বলেই দেখা যায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশে ‘জরুরি সেবা’ সংশ্লিষ্ট খাতে হরহামেশা ডেকে বসা কর্মবিরতি, ধর্মঘট ও এর ফলে সৃষ্ট জনদুর্ভোগ এখন নিত্যনৈমিত্তিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে, এসব কর্মসূচিতে সংশ্লিষ্টদের দাবিদাওয়ার চাইতে জনভোগান্তির চিত্রই বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। এতে একদিকে মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের অধিকার অন্যদিকে জনগণের জরুরি সেবা পাওয়ার অধিকার উভয়কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে মূলত কায়েমি কোনো স্বার্থ হাসিল করা হয় বলে প্রতীয়মান।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) অনেকবার বলেছে বাংলাদেশের শ্রম আইন দুর্বল। বিভিন্ন খাতের শ্রমিক শোষণ ও তাদের বঞ্চনার কথা আমাদের সবারই জানা। বিভিন্ন সময় যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্যই তাদের পথে নামতে হয়। অত্যাবশ্যক পরিষেবা আইন পাস হলে শ্রম আইন আরও দুর্বল হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরোধী দলের কর্মসূচিকে সামনে রেখে দেওয়া পরিবহন ধর্মঘটে সৃষ্ট দুর্ভোগকে ‘রাজনৈতিক জনভোগান্তি’ বলে মনে করারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। একপক্ষ বলছে, বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে নয়, নিজেদের নিরাপত্তা ও দাবিদাওয়া আদায়ে বাস ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। অপরপক্ষ বলছে, মালিক ও শ্রমিকের নাম দিয়ে ধর্মঘটের কথা বলা হলেও এর সঙ্গে সরকারই সম্পৃক্ত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব ধর্মঘটে বিআরটিসি বাসও বন্ধ ছিল। রাজনীতি বিশ্লেষক ও যাত্রী কল্যাণে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, বিএনপির আমলেও এ ধরনের কর্মসূচি দেখা গেছে। কিন্তু এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবেএ কথা সবাই বলেন, কিন্তু রাজনৈতিক সমাবেশ এবং পরিবহন ধর্মঘটের ঘটনা যে ঘটেই চলেছে তা দেশের মানুষকে কী বার্তা দেবে? ক্ষমতা দেখানোর এই সংস্কৃতির অবসান হবে? অন্যদিকে, স্বজনের মৃত্যুতে চিকিৎসক ও হাসপাতালের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনা এবং এর প্রতিবাদে চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে যাওয়াসহ অ্যাম্বুলেন্স চালক ও নার্সদের ধর্মঘটের খবরও গণমাধ্যমে এসেছে। এ ক্ষেত্রে রোগীর স্বজনদের ক্ষমতা প্রদর্শনের সংস্কৃতি যেমন দায়ী, তেমনি জরুরি ও বিশেষ মুহূর্তে অসহায় মানুষের অভিযোগ জানানোর সুযোগের অভাবও দায়ী। সমস্যাগুলো বহুমাত্রিক। একদিকে প্রকট শ্রেণি বৈষম্য, শ্রমিক শোষণ, অন্যায্য মজুরি; অন্যদিকে মালিক-কর্তৃপক্ষের স্বার্থপরতা, পেশাজীবীদের যূথবদ্ধ স্বার্থ ও সর্বোপরি অপরাজনীতি। ফলে অত্যাবশ্যক পরিষেবার নামে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার ও ধর্মঘট করার গণতান্ত্রিক অধিকার সংকোচন করা হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কেবল আইন করে হবে না, সবার আগে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। বিভিন্ন সেবা খাতের পেশাজীবী, মালিক-শ্রমিক এবং সেবা গ্রহীতা জনগণের মধ্যে সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অর্জনেও সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর চর্চিত সংস্কৃতি বড় প্রভাব রাখে।
কার্ল মার্কসের পাথরমূর্তি আজও বহাল তবিয়তেই রয়েছে। অবশ্য মাঝেমধ্যে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী ফ্যাসিস্ট বদমাশদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। বিলেতে মার্কসের পাথরমূর্তি আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টির মূর্তির চেয়েও মহিমান্বিত। অন্যদিকে রুশ বিপ্লবের জনক তথা বিশ্বের মেহনতি জনতার মুক্তিদাতা ভøাদিমির ইলিচ লেনিন রয়েছেন মমি হয়ে, মস্কোয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ধ্বংসকারী গর্বাচেভ আর ইয়েলেতসিন সে মমিকে স্পর্শ করার সাহস পায়নি। সোভিয়েতের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির প্রাক্তন প্রধান বর্তমান রুশ রাষ্ট্রনায়ক ভøাদিমির পুতিনও লেনিনের মমিকে জাদুঘর থেকে অপসারিত করে কবরগুহায় স্থানান্তর করেননি। লেনিনের সে সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ আর নেই, মহাশক্তিধর হিসেবে এক দিন সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে ছিল দণ্ডায়মান, তা অতীত। কিন্তু মমিতে পরিণত হয়েও লেনিন আছেন, মানবসভ্যতার অবশ্যম্ভাবী আগামী মহাবিপ্লবের ঘুমন্ত ভলকানো হয়ে। এটাই পুঁজিবাদের চিরস্থায়ী আতঙ্ক। দুঃস্বপ্ন। তবে লেনিন যে একেবারে ভাগ্যশূন্য এমন দাবি করা যাবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলোপ হলে আমেরিকার ইন্ধনে এবং গোপন অর্থে সারা দেশে বুলডোজার দিয়ে লেনিনের মূর্তি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে রাজনৈতিক বিবর্তন ঘটলেও একই কাণ্ড ঘটানো হয়। বাংলাদেশের একেবারে কানঘেঁষা ক্ষুদ্র ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরায়ও উগ্র হিন্দু মৌলবাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি ক্ষমতায় আসামাত্র লেনিনের মূর্তিকে দুরমুশ করা হয়েছে।
মূর্তি ভাঙার ঐতিহ্য মানবসমাজের নতুন কোনো দর্শন নয়। এর শুরু সভ্যতার একেবারে গোড়ায়। এর পেছনে রয়েছে আধিপত্যবাদী বাসনা। রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম-বিশ্বাসের ইন্ধন শক্তি। মানবসভ্যতার প্রাচীন এবং মধ্যযুগ তো হচ্ছে মূর্তি ভাঙার যুগ। আধুনিক যুগ তার উত্তরসূরি। আমরা স্মরণ করতে পারি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। বিদ্যাসাগর হচ্ছেন বাঙালির মাতৃভাষা চর্চার আদি গুরু। সত্তর দশকে কলকাতায় বিদ্যাসাগরের মূর্তির মুন্ডু ছেদন করে মাওবাদী নকশাল কমিউনিস্টরা। পরে তারা ভুল স্বীকার করলেও ইতিহাস ভোলা যায় না। তখন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মূর্তিও পুলিশ পাহারায় ছিল কিছুদিন। কী অপরাধ রবীন্দ্রনাথের? না তিনি ‘বুর্জোয়া কবি’। একেবারে হালে বিদ্যাসাগরের নিজের কলেজের ভেতরই তার ক্ষুদ্র মূর্তিটি ভেঙে দেয় আরএসএস, বিজেপির উগ্রহিন্দু মৌলবাদী মিছিলকারী যুবকরা। কেন এই আদিম অভ্যাস ভাঙাভাঙির? ভয়! আতঙ্ক! মূর্তিকে আবার ভয় কী? সে তো জড়পদার্থ। শক্তিহীন। প্রতিরোধ-শূন্য। ভয় অবশ্যই আছে, মূর্তির ভয় নয়, ভয় আদর্শের, মূর্তি-হয়ে-যাওয়া একদা জীবন্ত মানুষটির অগ্নিময় মতাদর্শের। এই মতাদর্শের তো মৃত্যু নেই। সে অমর। রবীন্দ্রনাথ তার ‘ছবি’ কবিতায় মৃত স্ত্রীর ছবির দিকে তাকিয়ে আত্মপ্রশ্ন জাগিয়েছিলেন, ‘হায় ছবি, তুমি কি কেবল ছবি শুধু পটে লিখা?’ কবি শামসুর রাহমানের একটি অসাধারণ কবিতা আছে অকাল-মৃত পুত্রের ছবির দিকে তাকিয়ে। কবির শ্যামলীর বাসায় এ বিষয়ে তাকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম। কবি ছিলেন নীরব। ঠোঁট কাঁপছিল। চোখ সজল। তাতেই আমি উত্তরটাও পেয়ে যাই। অনেকক্ষণ পর কবি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘হরিপদ, আপনি কি সাঁতার জানেন?’ কেননা এ প্রশ্নের পেছনে ছিল কবিপুত্রের পানিতে ডুবে অকালমৃত্যু।
অন্যদিকে মূর্তির অমরত্বের পেছনে যে শুধু শুভশক্তিই রয়েছে তা কিন্তু নয়। অশুভ শক্তিও আছে। ধরা যেতে পারে মহাসমুদ্র অভিযাত্রী কলম্বাসের কথা। সাম্রাজ্যবাদ আর উপনিবেশবাদ সমর্থক ইতিহাসবিদরা কলম্বাসের গুণকীর্তনে মুখর। শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের উপনিবেশ স্থাপনে যেসব সমুদ্র-অভিযাত্রী নতুন দেশ-ভূমি আবিষ্কার করে সহায়তা করে দিয়েছেন, কলম্বাস তাদের অন্যতম। আমেরিকার ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে কলম্বাসের একটি মূর্তি ছিল। তা ভেঙে দেয় আমেরিকার আদিবাসী ভূমিপুত্রদের একদল রাগী যুবক। এতে হয়তো তাদের শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় দখলদারদের প্রতি ঘৃণাই প্রকাশ পেল। কিন্তু উপনিবেশবাদের ইতিহাস, বর্ণবিদ্বেষের ইতিহাস বদলানো কি গেল? নিশ্চয়ই নয়। ইতিহাসের কবর খুঁড়লে তো স্তূপের পর স্তূপ শোষণ-নির্যাতনের কঙ্কাল বেরিয়ে আসবে। অন্যদিকে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ভেতর আজও সগৌরবে বিরাজ করছে একটি মূর্তি। পলাশী যুদ্ধের খলনায়ক, ভারতবর্ষে ইংরেজ উপনিবেশ স্থাপনের স্থপতি রবার্ট ক্লাইভের। ইংরেজের তৈরি মূর্তি। অতীতে ছিল, বর্তমানেও আছে। কই, এত বছর পরও কোনো বাঙালি তো সেই মূর্তি ভাঙতে গেল না? ভাঙল বিদ্যাসাগরের মূর্তি! এ কী রহস্যময় বাঙালি চরিত্র?
কলকাতার নগরের রাজপথে স্থাপিত মার্কস অথবা লেনিনের মূর্তি ভেঙে ফেলা মোটেই কঠিন কাজ নয়। স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতা পকেটে গোটা কতক নোট আর পেটে এক পেগ ঢুকিয়ে হাতে একটা কুড়াল তুলে দিলেই কেল্লা ফতে! অথচ আজ এই করোনা মহামারী আর অর্থনৈতিক, মানবিক মহাবিপর্যয়ের দিনে বারবার মনে পড়ে মার্কস-লেনিনকে। কেন মনে পড়ে মার্কসকে? মনে পড়ে, কেননা মহা-ভয়ংকর অজ্ঞাত-অচিন্ত্যনীয় ব্যাধি সর্বগ্রাসী মৃত্যুক্ষুধা নিয়ে মানবসভ্যতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পুঁজিবাদী বিশ্ব ভয়ে থরহরিকম্প। পুঁজিবাদী অর্থনীতি, পুঁজিবাদী সমাজরাষ্ট্র, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিক্ষা, যোগাযোগ, বাণিজ্য, শিল্প-কারখানাসব লুটিয়ে পড়েছে। ক্যাপিটালিজমের সব অর্জন মিথ্যে হয়ে গেছে। আমরা ভুলিনি, সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের সময় লুটেরা পুঁজিবাদের তল্পিবাহকরা বগল বাজিয়ে নেচে-কুঁদে ঘোষণা করেছিল মার্কসবাদ মৃত, সমাজতন্ত্র মৃত, বাতিল ওসব ডগমা। তখন বিলেতে পাথরমূর্তির ভেতর মৃত কার্ল মার্কস হাসছিলেন। মস্কোয় কাচঘেরা ঘরে মমি হয়ে ঘুমিয়ে-পড়া লেনিন মুচকি হাসিতে কাচের দেয়ালে শীতল ভেপার তৈরি করেছিলেন।
পৃথিবীর দেশে দেশে কোটি কোটি কৃষক, যাদের পূর্বপুরুষরা চাষাবাদ করে জীবন কাটাত গ্রামের মাঠে-খামারে, শ্রমিক হয়ে আজ তারা শহরে চলে গেছে। চাষাবাদ তাদের খাদ্য জোগাতে পারে না। চাষিপুত্র আজ চাষি হতে চায় না। বাধ্য হয় দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে মজুর হতে। মহাব্যাধি আর মৃত্যু তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে বন্ধ হয়ে যাওয়া নির্মাণকাজ আর কারখানা থেকে। দেশের ঠিকানায় ছুটতে ছুটতে বিশ্বায়নের মানুষ, মুক্তবাজার অর্থনীতির মানুষ শুনছে রাষ্ট্রসংঘের ঘোষণাআসছে মহামন্বন্তর! প্রশ্ন হলো, কোথায় গেল পুঁজিবাদী দেশের বা মাতৃভূমির পবিত্র সংবিধানে বর্ণিত নাগরিকের অধিকার? কোথায় হারাল বাঁচার অধিকার, চিকিৎসার অধিকার? রাজনীতি কি শুধু ভোটের উৎসব? বাংলাদেশের মানুষের কি মনে পড়ে না একাত্তরের অঙ্গীকার? একাত্তরে তাদের মুক্তিযোদ্ধা পূর্বসূরিরা রাজনীতি বলতে কী বুঝত? তাদের কাছে রাজনীতিটা কি ছিল না শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন? এসবই তো ছিল মার্কসের কথা। কার্ল মার্কস তো এটা বলেননি যে টাকাপয়সার শক্তি বিদ্যা আর জ্ঞানচর্চার চেয়ে অধিক।
আমরা যে শ্রেণিতে অবস্থান করছি তাকে পেছনে ঠেলে শুধু ওপরে উঠতে চাইছি। যত অর্থ-মুদ্রা আছে তারও ওপরে উঠতে উন্মাদ আমরা। অথচ মার্কস তার বিরুদ্ধে। একসঙ্গে চলতে বলেছেন তিনি। বলেছেন শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। বারবার বলেছেন ক্ষুধাহীন সমাজ আর রোগ-শোক-ব্যাধি-শূন্য আনন্দময় এক সমাজের কথা। ডাস ক্যাপিটাল লিখে দুনিয়ার অর্থনীতির সংজ্ঞা বদলে দিয়েছেন। শুধু ইংল্যান্ডে নয়; জার্মানি-সমেত ইউরোপের দেশে দেশে তিনি প্লেগের দাপট দেখেছেন। বুঝেছেন পুঁজিবাদী সমাজ সফলভাবে এই রোগের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ। কেননা পুঁজিবাদে মানবতা নেই। স্বার্থপরতা আছে। চিকিৎসার বদলে চলে চিকিৎসা-বাণিজ্য। কেন থাকবে শুধু একচেটিয়া ধনীদেরই চিকিৎসা-অধিকার? কার্ল মার্কস পাথরের বা ধাতব কোনো মূর্তির ভেতর নেই, তিনি আছেন আদর্শে, দর্শনে। আজ মানুষ মার্কসের চোখ দিয়েই দেখছে এইডসের মতো ঘাতক রোগ কেন সমাজতান্ত্রিক সমাজে নেই। এটাও দেখছে পুঁজিবাদ অতি-মুনাফার লোভে কী করে ধ্বংস করছে বিশ্ব পরিবেশ এবং জন্ম দিচ্ছে নতুন নতুন ব্যাধির। মার্কস আছেন অন্নহীন, গৃহহীন, ব্যাধিতে-আক্রান্ত মানুষের মুক্তির স্বপ্নে। মার্কসই জানিয়েছেন মানুষের রোগমুক্তির অধিকার, আনন্দময় জীবনের অধিকার হচ্ছে তার মৌলিক অধিকার। পুঁজিবাদ তা গ্রাস করতে পারে না।
মানবসভ্যতায় মার্কসের তত্ত্বের সফল প্রয়োগ প্রথম যিনি করেন তার নাম লেনিন। তিনিই প্রথম বিশ্বের মধ্যে বৈজ্ঞানিকভাবে জনস্বাস্থ্য পরিষেবার উদ্ভাবক। বিপ্লবের পর ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নানা দেশের স্প্যানিশ ফ্লু-আক্রান্ত সৈন্যরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষেও এই ঘাতক ব্যাধি চলে আসে। বাংলাসহ এই ভারতবর্ষেই দুই লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। রাশিয়া আরও সংকটে পড়ে ফ্লু-এর সঙ্গে কলেরা-মহামারী শুরু হলে। এদিকে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় সাম্রাজ্যবাদীরা। বাইরে থেকে ওষুধ আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। লেনিন দৃঢ় হাতে মহামারী দমনে নেমে পড়েন। তিনি গড়ে তোলেন জনস্বাস্থ্য কমিসারিয়েট। এর কার্যভার তুলে দেওয়া হয় শ্রমিক কাউন্সিলগুলোর ওপর। লেনিন ঘোষণা করেন, ‘হয় ব্যাধির জীবাণু ধ্বংস করবে সমাজতন্ত্রকে, নয়তো সমাজতন্ত্রই পরাভূত করবে মহামারীকে’। তাই তিনিই বিশ্বে প্রথম শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য পরিষেবা তুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবাকে জাতীয়করণ করেন। বিনা মূল্যে নাগরিকরা স্বাস্থ্য পরিষেবা লাভ করেন। লেনিনই প্রথম বিশ্বনেতা যিনি সদ্য (১৯১৭) বিপ্লব-করা দেশে দুবছর পর ১৯১৯ সালে বিপ্লব রক্ষার্থে রাজধানী মস্কোর রেলস্টেশনগুলোকে জীবাণুমুক্তকরণে স্যানিটাইজার পদ্ধতি গ্রহণ করেন। বিপ্লবী স্বাস্থ্যকর্মীর (বিপ্লবে অংশগ্রহণ-করা জনফৌজ) অসংখ্য গ্রুপ তৈরি করে রেলযাত্রীদের চিকিৎসা পরিষেবার ব্যবস্থা করেন। সারা বিশ্ব (পুঁজিবাদী) অবাক হয়ে দেখে বিস্ময়কর সেই কর্ম-প্রচেষ্টা।
আজকে করোনা আক্রান্ত দেশে দেশে রোগীদের যে লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, নিভৃতবাসে পাঠিয়ে চিকিৎসা দান করা হয়, তার উদ্ভাবক হচ্ছেন ইলিচ লেনিন। তিনি জানতেন বিপ্লব রক্ষা করতে গেলে মহামারীকে পরাজিত করতেই হবে। আমাদের আক্ষেপ-কষ্ট এই, আমরা স্মৃতির দংশনে ক্ষত-বিক্ষত হই, যখন মনে পড়ে সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে সংক্রামক ব্যাধি এবং মহাদুর্ভিক্ষের কথা। সেদিন আমরা ব্যাধি, ক্ষুধা আর যুদ্ধপীড়িত সদ্য-স্বাধীন জনগণকে সেবা দিতে পারিনি। যে রাশিয়া আমাদের যুদ্ধবিজয়ে বিরাট ভূমিকা নিয়েছিল তার অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করিনি। শিক্ষা নিইনি। আজকে যে বিশ্ববাসী করোনাকে পরাভূত করার ওষুধ আবিষ্কারের জন্য হাতড়ে মরছে, ১৯১৮ থেকে ১৯২২ সাল অবধি রাশিয়ার অবস্থা ছিল তাই। শতভাগ নিরাময় হতে পারে, কলেরার জন্য এমন ওষুধ তখনো আবিষ্কার হয়নি। কলেরায় রাশিয়ায় মৃত্যু ঘটেছিল ২০ লাখ মানুষের। রুশ বিপ্লবের বিপ্লবী বাহিনীর সদস্য তো বটেই, মৃত্যু ঘটেছিল রেড আর্মির অন্যতম নেতা, লেনিনের সহযোদ্ধা লিও ট্রটস্কির পিতার। সেদিন লেনিন স্বাস্থ্যকর্মীদের ইউনিয়নের সম্মেলনে ঘোষণা করেন, ‘বিপ্লবী যুদ্ধে আমরা রক্তপাতের পথে সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত ধ্বংস করতে পেরেছি। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে রক্তপাতহীন যুদ্ধে ব্যাধি মহামারীকে পরাভূত করা’।
(আগামীকাল দ্বিতীয় কিস্তিতে সমাপ্য)
লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক
সম্বোধন আমাদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্বোধন শুনে বোঝা যায় মানুষে মানুষে সম্পর্ক, সামাজিক অবস্থান ও শ্রেণিবৈষম্য। বাংলা ভাষায় তিনটি সম্বোধন পদ আছে : তুই, তুমি ও আপনি। তুচ্ছার্থে বা নিচু শ্রেণি বোঝাতে যেমন ‘তুই’ বলা হয় তেমনি অতি প্রিয়জনকে ভালোবেসে বা আদর করে ‘তুই’ সম্বোধন করা হয়। এটা আমাদের ভাষার মাধুর্য, রেওয়াজ বা প্রচলিত রীতি। আমরা ছোটদের ‘তুই’ বা ‘তুমি’ আর বড়দের ‘আপনি’ বলি। এই আমরাই আবার শ্রেণি বিবেচনায় বাবা-মা-দাদা-নানার বয়সী মানুষকেও তুই-তোকারি করি দম্ভ ভরে। যুগ যুগ ধরে সামাজিক অবস্থান বা পোশাক দেখে খুব সহজেই তুই-তোকারির প্রথা রয়েছে। বাসাবাড়িতে কাজের বুয়াকে ৫-৬ বছরের শিশুও ‘তুই’-‘তুমি’ বলে ডাকে। আর বয়স্ক বুয়ারা ‘ভাইয়া’, ‘আপামণি’ বলে ডাকে। রিকশাওয়ালা ফেরিওয়ালা বা নিম্নবিত্তের মানুষদের অবলীলায় ‘তুই-তোকারি’ করাটাই এখানকার নিয়ম। এই ঘটনাগুলো আমাদের কাছে অতি পরিচিত।
এ ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা নিরাপদ। সেখানে সবাই ‘ইউ’ অর্থাৎ তুমি। ‘আপনি’ বা ‘তুই’ এর বালাই নেই। আমাদের পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ‘তুই’ সম্বোধনটাই বেশি চলে। তারা ছোটদের ‘তুই’ বলে ডাকে। এক টিভি সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মোহাম্মদ বলেন, ‘বিশ্বভারতীতে (শান্তিনিকেতন) পড়াশোনা করতে গিয়ে প্রথমে আমার খুব সমস্যা হয়েছিল। সেখানে সব শিক্ষকরা তুই বলে ডাকেন। আমি সেটা মেনে নিতে পারতাম না। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়েছি। আসলে তুই বলে ডাকাটাই সেখানকার চল’। চলচ্চিত্রনির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘এবং ঋতুপর্ণ’ নামে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ছোট-বড় প্রায় সবাইকে তুই সম্বোধন করতেন। একবার ঋতুপর্ণ ঘোষকে কোনো এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল সবাইকে তুই বলার কারণ। তিনি বলেছিলেন, ‘তুই বললে একে অন্যকে কাছের আর বেশি আপন মনে হয়। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অন্তরঙ্গ হওয়া সহজ হয়।’ ৭০-৮০’র দশকে বন্ধু-বান্ধবীরা তুই বলেই সম্বোধন করত বেশি। ’৯০ দশক থেকে বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে তুমি বলার চল বেড়েছে। বন্ধু-বান্ধবীদের মধ্যে বিয়ে হলে তুই থেকে তারা তুমি বা আপনি সম্বোধনে চলে যেতেন। কারণ বিয়ের পর তুই-তোকারি চলে না। সহপাঠীরা একে অপরকে তুই বলে ডাকলেও উভয়ের মধ্যে পরিণয় ঘটলে তখন এক অজানা নির্দেশে ‘তুই’ শব্দটি তুমিতে উন্নীত হয়। বিয়ের পর তুই সম্বোধন তাদের কাছে যেন বেমানান লাগে। দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্পর্কে সম্বোধনটি তুমি হলেই যেন ভালো। এক সময় আমাদের দেশে স্বামীরা স্ত্রীদের সম্মান করে আপনি বলে ডাকতেন। আবার তুই বলে ডাকার চলও আছে। স্ত্রীকে আপনি বলবেন এটা অনেক পুরুষ যেন ভাবতেই পারেন না। তবে, ইদানীং অনেকেই স্ত্রীকে তুমির পরিবর্তে তুই বা আপনি বলে ডাকছেন ভালোবেসে।
তুই সম্বোধন করে অনেক গানও হচ্ছে আজকাল। গানগুলো জনপ্রিয়ও হচ্ছে। তবে এই গানগুলো একতরফা ছেলেরাই মেয়েদের নিয়ে গাচ্ছে। তপুর গানের শিরোনাম ‘তুই’। আসিফ আকবরের গান-‘খোদার কসম-আজ থেকে ভুলে যাব তোর নাম’। এমনি আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। তুই সম্বোধনটাকে আবার অনেকে মেনে নিতে পারছেন না আমাদের সমাজে। তারা মনে করছেন এতে নারীদের অসম্মান করা হচ্ছে। গানের লিরিকে কেন তুই-তোকারি থাকবে? আমাদের চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় গান আছে তুমি বলে ডাকলে কত মধুর লাগে/আজ থেকে আর আপনি বলে ডেকো না আমাকে। প্রখ্যাত গীতিকার রফিকুজ্জামান গানে তুই-তোকারিকে পছন্দ করেননি। একটি জনপ্রিয় অনলাইন পোর্টালে তার কলামে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল কবিদের লেখায় তুই-তোকারি’র অনেক উদাহরণ আছে। কিন্তু সেসব নিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ কখনো কোনো প্রশ্ন তোলেনি। ‘‘আপাতভাবে নিরীহ মনে হলেও ‘তুই’, ‘তুমি’ ও ‘আপনি’ শব্দ তিনটি আমাকে খুব ভাবায়। অনেক দেখার পর আমার মধ্যে এই বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে যে এই তিনটি শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে আমরা ব্যাপক অবিচার করে থাকি। আমরা গরিবকে অবমূল্যায়ন করি; পরিশ্রমীকে অপমান করি; অযোগ্যকে সম্মান করি, নিরীহকে ভয় দেখাই, সাধারণ লোকের আত্মসম্মানে আঘাত করি; সর্বোপরি সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করি। চোখ কান একটু খোলা রাখলেই আপনি উপলদ্ধি করতে পারবেন।’’ (আমার ভাবনা/মনিরুজ্জামান সোহেল, ভোকাব গ্রামার-১,পৃ ৫৮৭)।
তুই-তোকারির কারণে শুধু যে মানুষ অপমানিত হয়, বিব্রতবোধ করে আর শ্রেণিবৈষম্য চোখে পড়ে তাই না। জীবননাশের ঘটনাও ঘটছে। তুচ্ছ কারণেই জীবন চলে যাচ্ছে। মেয়েদের মধ্যে তুই তুমি নিয়ে তেমন সমস্যা না থাকলেও তরুণদের মধ্যে রয়েছে। বয়সে ছোট কেউ তুই তুমি বললে যুবকরা একদম সহ্য করতে পারে না। তাদের ইগোতে লাগে। এ নিয়ে আমাদের দেশে অনেক ফ্যাসাদ হয়। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে, শুধু ‘তুই’ করে বলাতেই ২০১৭ থেকে ২০১৯ এই তিন বছরে রাজধানীতে খুন হয়েছে চারজন। তুই-তোকারি করতে গিয়ে আমরা অনেকেই মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ঝগড়া বিবাদে আপনি বা তুমি থেকে তুইতে নামতে বেশি সময় লাগে না। আমাদের জীবনে সম্বোধনের ভূমিকা রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই পরিবারের মধ্যে এ ধরনের চর্চা ও শিক্ষা দেওয়া উচিত। মানুষকে ‘তুই’ এর পরিবর্তে তুমি বা আপনি বললে ক্ষতি কী? এতে যদি একটি মানুষ নিজেকে সম্মানিত মনে করে।
সম্বোধনের এই জটিল সমীকরণ থেকে মুক্ত হতে তুই তুমি ও আপনি থেকে যে কোনো একটা বেছে নিতে পারি। এ ক্ষেত্রে হয়তো অধিকাংশই তুমি বলাকেই পছন্দ করবেন। আবার অনেকে এটাও মনে করেন বৈচিত্র্য হিসেবে তিনটি সম্বোধন থাকলে দোষ কী? সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে সম্বোধনের ধরন। সম্পর্কই বলে দেবে কাকে আপনি কাকে তুমি আর কাকে তুই বলতে হবে। তবে, অপরিচিতজনকে তুই কিংবা তুমি না বলে আপনি বলাই বুদ্ধিমানের কাজ। তা না হলে কখনো বিব্রত হতে পারেন। কোনো মানুষকে তুই তুমি বলার আগে আরেকটিবার ভাবুন, ভাবুন এবং ভাবুন। কাউকে তুমি বলার আগে একবার ভাবুন আর তুই বলার আগে দুইবার ভাবুন। সৌজন্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। প্রথম পরিচয়ে কোনো অবস্থাতেই সম্বোধনে যেন ত্রুটি না থাকে সেদিকে সতর্ক হোন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ফুল কুঁড়িতেই ঝরে গেল। ফুলের নাম লিজ ট্রাসম্যারি এলিজাবেথ ট্রাস; রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের এজাজত নিয়ে উজিরে আজমের (সরি, বলা উচিত উজিরানী আজম) গদিতে বসেছিলেন। কিন্তু ঠিকমতো গোদ পেতে বসতে পারলেন না। তার আগেই পশ্চাতোত্থিত করতে হলো। লিজকে নিয়ে কত যে কথা হলো! তাতে রীতিমতো একটি উপাখ্যান হয়ে যাবেউপাখ্যানের নাম হতে পারে মাদার অব লিলিপুট অব ‘পলিপুট’। অর্থাৎ পলিটিকস পুরাণের লিলিপুট। প্রধানমন্ত্রিত্বের আয়ুষ্কাল বিবেচনায় তিনি লিলিপুটই বটে। অথবা তাকে বলা যেতে পারে, ‘হবিট অব দ্য হেবিটেবল শায়ার’। ইংল্যান্ড তো শায়ারেরই দেশ।
জে আর আর টলকিয়েনের লর্ড অব দ্য রিংসের প্রিকুয়েল ‘হবিট’-এ উল্লিখিত এবং বিখ্যাত হবিট-কুলের রানী ‘ট্রাস দ্য হবিট’। অবশ্য আরব্য রজনীর ‘এক দিনের বাদশাহ’কে পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন ট্রাস; একচুয়ালি দেয়ার ওয়াজ নো ট্রাস্ট ইন হার ‘আনএক্সপেক্টেড জার্নি অব দ্য হবিট’। হোয়াট আ মেস অব বিলবো ব্যাগিনস! আহারে, এলভস অব দ্য মিডল আর্থ আর গন টু রাশিয়া উইথ দ্য ডর্ভস। বিদায়ের পর তার জন্য ‘সিংহাসন’ সাজিয়ে দিচ্ছে ‘আজগ’ দ্য মেরিকান। নাউ হার রয়্যাল সোলজার্স আর দি ওর্কস। লিজ ট্রাস আসলেই কামেলিয়তির এক উপাখ্যান রচনা করে গেছেন। তিনি দ্য ক্রনিকলস অব নার্নিয়ার সিংহবাহিনী সেই ছোট্ট মেয়েটিই রয়ে গেলেন! বড় হওয়ার সময় আর পেলেন না। তার উপাখ্যানের কথাবলি নিয়ে একটা নতুন মহাভারত হতে পারে। লিজ ট্রাসকে নিয়ে কিছু সংবাদ-শিরোনামের কথা বলা যেতে পারেযেমন ‘নো ট্রাস্ট ইন ট্রাস’, ‘উইল শি বি মোর ডিউরেবল দ্যান লেটুস!’, ‘হোয়েন ট্রাস উইল লিভ টেন ডাউনিং স্ট্রিট’, ‘আওয়ারস নট ডেইজ’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ ট্রল করে বলেছেন, ‘নোবেল (প্রাইজ) শুড বি গিভেন টু হার ফর কুইক ডেস্ট্রাকশন অব ইউকে ফাইন্যান্স সিস্টেম’। যে যেভাবে পারে তাকে নিয়ে মজা করেছে।
ব্রিটিশ পত্রপত্রিকা তো বটেই, আন্তর্জাতিক সব মিডিয়াতেই লিজ মশকারার পাত্রী ছিলেন। ব্রিটিশদের ভাষায় আনকালচারড, আনসিভিলাইজড রুশ জাতির সাবেক প্রেসিডেন্টও তাকে নিয়ে মশকরা করতে ছাড়েননি। তিনি নাকি আজগের পিঠে (ইউক্রেনি ট্যাংক) সওয়ার হয়ে দনবাসবাসীকে ভয় দেখাতে গিয়েছিলেন। ইতিহাস-চেতনার নিরিখে দারুণ এক অপগণ্ডের নাম এলিজাবেথ ট্রাস। তার বিদায়ে সম্ভবত রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কবরের পাশ ফিরে শুয়েছেন। আর বলছেন, ওম শান্তি! শান্তি শান্তি। এ কথা বলা যেতেই পারে, কেন না লিজের বিদায়ের পর রবিবারই ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেছেন, ‘ইউকে রেডি টু অ্যাসিস্ট ইন রিজলভিং ইউক্রেইন কনফ্লিক্টকিয়েভ নর দ্য ওয়েস্ট ইজ সিকিং অ্যান এস্কেলেশন অব দ্য অনগোয়িং কনফ্লিক্ট’। বাস্তবে ওয়ালেস কী করতে পেরেছেন সে কথা না হয় মাচাঙের ওপর তোলা থাক। একটা ফ্যান্টাসি শেষ হতে না হতেই আরেকটা ফ্যান্টাসির শুরু। লিজ ট্রাসের অতি স্বল্পস্থায়ী ‘রুলিং অব দ্য রিয়েলম’ শেষ হতে পারেনি, মঞ্চে আবির্ভূত হলেন নতুন কুশীলবঋষি সুনাক। গেম অব থ্রোনসের আবহে সুনাকেরও আবির্ভাব; ‘ল্যানিস্টার’ বংশীয় ব্রিটিশদের দাপটে তার অবস্থা ‘নেড স্টার্ক’-এর মতো হবে না তো! সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে যুদ্ধজাহাজে করে (ভিক্টারিয়ন গ্রেজয়) লর্ড কমান্ডার অব দি আয়রন ফ্লিট (মানে আমেরিকান ফ্লিট) যুক্তরাজ্যকে গ্রাস করবে না তো! (ভিক্টারিয়ন গ্রেজয় আবার ল্যানিস্টার বংশীয়া সার্সি ল্যানিস্টারের পাণিপ্রার্থী) সেই রকমটা হলে সুনাকের পক্ষে সাফল্যের মুখ দেখা কঠিন হবে। যুক্তরাজ্য তথা ইউনাইটেড কিংডম (ইউকে) ফ্যান্টাসির ধূসর অথচ বর্ণাঢ্য জগতে আটকা পড়েছেইন গেম অব থ্রোনস, হবিট এবং দ্য ক্রনিকলস অব নার্নিয়া। এই খেলার নাটাই আটলান্টিক সাগরের ওপারে থ্যালাসোক্রেটিক রিয়ালম যুক্তরাষ্ট্রের হাতে।
কিন্তু ঋষি সুনাককে নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে অন্য জাতের এক উন্মাদনা দেখা দিয়েছে। কারণ তার জন্মের সুতায় ভারতীয় কাদা লেগে আছে। সেই সুতা যত দূরবর্তীই হোক না কেন। সুনাক ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ। তার দাদা-দাদি একসময় ভারতভূমিতে ছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যুগে। ব্রিটিশের নাগরিক হিসেবেই একসময় তারা আফ্রিকায় গিয়েছিল। যেমন মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিলেন। ব্রিটিশের নাগরিক হিসেবেই তারা গ্রেট ব্রিটেনে পাড়ি জমিয়েছিল। সেভাবেই সুনাক একজন ব্রিটিশ নাগরিকভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক মুঘলদের চেয়েও কম এবং পাতলা। তবে তার আরেকটা খুঁটির জোর আছে, সেই খুঁটি হলো তার স্ত্রী অক্ষতাঅক্ষতা মূর্তি। এক ভারতীয় ধনকুবেরের মেয়ে। সেই সূত্রে সুনাক ভারতের জামাতাও বটেন। সুনাকের যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ায় এক ধরনের উন্মাদনা দেখা গেছে। যুক্তরাজ্য ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারলেও ভারতবাসীর এই জিনিসটা হতে এখনো অনেক বাকি। শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশ, পাকিস্তানেরও ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া এখনো ঢের বাকি। তাই সুনাকের ‘হিন্দু’ পরিচয়টা ভারতীয় ডিসকোর্সে বেশি জায়গা পাচ্ছে। হয়তোবা বিজেপি নামের একটা ‘অষ্টরম্ভা সত্তা’ ক্ষমতায় আছে বলে। সুনাককে বেশি বেশি করে ‘হিন্দু’ হিসেবে পরিচয় করানো হয়েছে। সুনাক ভারতের নয়, ‘হিন্দু’ ভারতের অতিদূরবর্তী এক সুতা। তাকে দিয়ে ভারতবাসীর অর্জন ঠিক ততটুকুই হবে যতটুকু অর্জন আফ্রিকাবাসীর হয়েছে বারাক ওবামাকে দিয়ে। কে কোন দেশি বা কোন দেশের বংশোদ্ভূত সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী যারা হন তারা যে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন সে দেশের এস্টাবলিশমেন্টের অংশ হয়েই কাজ করেন। আর রাষ্ট্রপ্রেম বা দেশপ্রেম বজায় রাখতে হলে একজন ব্যক্তিকে তার রাষ্ট্রের, দেশের কথাই ভাবতে হবে। সুনাক তার ব্যতিক্রম হতে পারেন না। অতএব ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলে এত চেঁচানোর কোনো মানে হয় না। তাকে তার কাজ করতে দেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ‘আমপাবলিকের’ তালে তাল দেওয়া আকলমন্দ কাজ হবে না। লন্ডনের মেয়র সাদিক খানও যদি কোনো দিন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হন, তাকে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বলে বা মুসলমান বলে আত্মতৃপ্তি বোধ করার কিছু থাকবে না। এসব আসলে এক ধরনের ‘আওয়াম বা আম উন্মাদনা’। বারাক ওবামা এই ক্ষেত্রে দারুণ এক উদাহরণ। কমলা হ্যারিসও একজাম্পল হতে পারেন। সুনাককে বর্তমান বিশ^-বাস্তবতা এবং ব্রিটেনের ‘অবশিষ্ট সাম্রাজ্যের মানসিকতা’র নিরিখেই বিচার করতে হবে। যাই হোক, ভারতীয়রা উচ্ছ্বসিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। ভারতীয়রা ব্যাপারটিকে দেখছে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে। তবে ধর্মের প্রসঙ্গটাই প্রাধান্য পেয়েছে। যদিও ব্রিটিশ রাজনীতিতে ধর্ম ‘আপাত গৌণ’ বিষয়। হিন্দু, মুসলিম, পারসিক, শিখসব ধর্মাবলম্বীই ব্রিটিশ ক্যাবিনেটে থাকে এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন তারা। ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে এবং নিজের যোগ্যতাবলে। সুনাক প্রতিভাবান এবং সফল একজন ব্যক্তি; বিলিওনেয়ার। দুনিয়ার সবচেয়ে সফল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসে কাজ করেছেন তিনি। নিজের ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি চালিয়েছেন। অল্প বয়সে এমপি হয়েছেন। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে। কভিড মহামারীর সময়ে ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রীর (চ্যান্সেলর অব দ্য এক্সচেকার) দায়িত্ব পালন করেছেন।
ব্রিটিশদের মধ্যে জাত্যাভিমান যে একেবারেই কাজ করেনি তা বলা যায় না। ঋষি সুনাক কিন্তু প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। বর্ণবাদ তথা জাত্যাভিমান ভেতরে ভেতরে ক্রিয়াশীল ছিল। প্রধানমন্ত্রীর পদ যাতে সুনাক পেতে না পারেন অনেকেই সে চেষ্টা করেছিলেন, বিশেষ করে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন (অর্থাৎ বো-জো) তাকে ভোট না দিয়ে লিজ ট্রাসের মতো অকেজো-অসার প্রার্থীকে ভোট দিতে তার প্রভাব খাটিয়েছিলেন। মনে তার বাসনা ছিল যে, লিজ ট্রাস টেঁসে গেলে আবার তিনি (একজন খাস ব্রিটিশ হিসেবে) প্রধানমন্ত্রী হবেন। যদিও তিনি তা পারলেন না। লিজ ট্রাস যে অসার মাল তা তো বোঝাই যাচ্ছিল, বেশ আগে থেকেই; ইউক্রেন ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছকেই পা ফেলেছেন তিনি। অবশ্য দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর যুক্তরাজ্যের কূটনীতি তথা পররাষ্ট্রনীতি স্বাধীন কোনো বিষয় নয়, এ কথা সবাই জানে। ধারণা করি, কল্পরাজ্যের হবিটরাও এ কথা জানে। ঋষি সুনাক ব্রিটিশদের চেয়েও বড় ব্রিটিশ, তা প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন তিনি। কারণ সবার নজর থাকবে তার ওপর। কীভাবে দেশ চালান তিনি সবাই খেয়ালে রাখার চেষ্টা করবে যেহেতু তিনি নেটিভ ব্রিটিশ নন। যুক্তরাষ্ট্রের কারণেও তিনি ব্রিটিশ হতে চাইবেন। একদা গোল্ডম্যান স্যাকসের কর্মচারী ছিলেনএ বিষয়টাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। জিতে গিয়ে তিনি একবার বলেছিলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপথ পাল্টানোর চেষ্টা করবেন তিনি। পেছনে ‘গোল্ডম্যান স্যাকস’ সুতো টেনে ধরেছিল কি না তা আমাদের জানা নেই। ওই কথা বেশি দূর এগোতে দেননি তিনি। বরং বলেছেন, ইউক্রেনে তিনি যুক্তরাজ্যের চলমান ভূমিকাই অব্যাহত রাখবেন। ইউক্রেন থেকে যুক্তরাষ্ট্র যেমন সম্মান বাঁচিয়ে বের হয়ে আসতে পারবে না, ঋষি সুনাকের যুক্তরাজ্যও বের হতে পারবে নাএমনটাই মনে হচ্ছে। শত হলেও নর্ড স্ট্রিম টু-এর বিস্ফোরণে যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা মহলের (রয়্যাল নেভির) একটা ভূমিকা আছে বলে রাশিয়া অভিযোগ করেছে। সুনাকের পক্ষে তার বিপরীতে যাওয়া কি সম্ভব!
ইউরোপের সমাজ ব্যবস্থা এমন যে, বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, ধর্ম বিষয়ে তারা খুব অসচেতন। কিন্তু ধর্ম ব্রিটিশদের মনে খুব ভালোভাবেই প্রোথিত। বর্ণবিষয়ক অনুভূতিও একই রকম। শামীমা বেগম নামে নাবালিকা ধরনের মেয়ের আইএসের জঙ্গিকে বিয়ে করতে সিরিয়ায় ছুটে যাওয়ার পেছনে ব্রিটিশ গোয়েন্দা মহলের ইন্ধন রয়েছে বলে জোরালো প্রচার আছে এবং এসব কথা একেবারে অমূলক নয়। একাত্তরের রাজাকারদের ঠাঁইও কিন্তু ব্রিটেনেই হয়েছে। কাজেই অন্তত রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের ব্যবহার যুক্তরাজ্যে নেই তা বলা যায় না। ঋষি সুনাক ধর্ম এবং বর্ণের বাধা ডিঙিয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন তার একটি কারণএই আপৎকালীন সময়ে রক্ষণশীল তথা টোরি পার্টিতে বলি হওয়ার জন্য কেউ নিজ থেকে গলা বাড়িয়ে দিতে এত আগ্রহ দেখায়নি, যেমন দেখিয়েছেন সুনাক। আর ঋষি সুনাক অর্থনীতি ভালোই বোঝেন, এর নমুনা তিনি করোনাকালীন দুর্যোগে দেখাতে পেরেছেন। তার মঙ্গল হোক। এই অবকাশে ভারতীয়রা সাবেক প্রভুরাজ্য জয়ের ‘পিতলা সুখ’ পাক বা পেতে থাকুক। আমরা না হয় তার রাজনীতির পরবর্তী এপিসোডের জন্য অপেক্ষা করব।
লেখক: সাংবাদিক
ঢাকাকে বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে এখন পর্যন্ত যেসব পরিকল্পনা বা মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু জনঘনত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এক-তৃতীয়াংশ নগর সুবিধায় ঢাকায় চার গুণের বেশি মানুষের বসবাস। অবকাঠামো বিবেচনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ বহন করছে দেশের রাজধানী শহর।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ ভাগ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। ৪০০ বছরের পুরনো শহর ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ ভাগ। আর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ৭৬ ভাগ জায়গায়। একটি পরিকল্পিত শহরে প্রতি একরে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ জন বসবাস করে। ঢাকায় বর্তমানে একর প্রতি বসবাস করছে ৪০০-৫০০ জন।
দুই সিটিতে বিভক্ত ঢাকা মহানগরের আয়তন ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী শহরে জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮২। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হয়।
রাজউকের ড্যাপের তথ্যমতে, ঢাকায় সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ ভাগ, জলাশয় রয়েছে ১৩ দশমিক ৯২ ভাগ এবং উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ ভাগ। জনঘনত্ব হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাসকৃত এলাকার জনঘনত্ব ৫০০ জন।
ড্যাপে আরও বলা হয়েছে, ঢাকার লালবাগ এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৫১ জন মানুষ বসবাস করে। জনঘনত্বের দিক থেকে যা বিশে^র সর্বোচ্চ। চকবাজারে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৩০ হাজার ১২২ জন মানুষ বসবাস করে। যা বিশে^ তৃতীয়। কোতোয়ালিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৩ জন বসবাস করে। যা জনঘনত্বের দিক থেকে বিশে^ দশম।
রাজউকের নগরপরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে হলে মূল ঢাকার ওপর চাপ কমাতে হবে। এ জন্য ঢাকার আশপাশে পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সেখান থেকে ঢাকার সঙ্গে দ্রুততম সময়ে যোগাযোগের জন্য অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে মূল ঢাকার জনঘনত্ব কমবে। আর জনঘনত্ব কমলে মূল ঢাকা অনেকাংশ বসবাস উপযোগী হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ঢাকায় জলাভূমি ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমেছে ১৩৪ বর্গকিলোমিটার। আর এ সময়ে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কংক্রিট। ইতিমধ্যে ঢাকার দুই সিটি এলাকার প্রায় ৮২ ভাগ কংক্রিট আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে।
পরিকল্পনাবিদদের এ সংগঠটি বলছে, পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলতে সড়ক থাকা দরকার ২৫ শতাংশ, জলাশয় ১৫ শতাংশ, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থান থাকা দরকার ২০ শতাংশ। অর্থাৎ নাগরিক সুবিধার জন্য ৬০ ভাগ জায়গা খালি থাকা দরকার। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মার্কেট গড়ে উঠবে। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, জনঘনত্ব এবং অন্যান্য বিবেচনায় সড়ক, জলাশয়, সবুজ ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। তবে কোনো শহরের ৪০ ভাগের বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করলে তার বাসযোগ্য পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
নিরাপত্তার বিবেচনায়ও ঢাকা যে নাজুক অবস্থায় রয়েছে, সেটা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৩৮ শতাংশ ভবন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৫ শতাংশ। আর গত বছর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গ্লোবাল লাইভবিলিটি ইনডেক্স অনুসারে ঢাকা বিশে^র সপ্তম কম বসবাসযোগ্য শহর।
চলতি মাসে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার সাড়ে আট ভাগ সবুজ রয়েছে। ঢাকার উন্মুক্ত স্থান ও জলাশয়কেন্দ্রিক সুবজ এলাকা ধরে এ গবেষণা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকার বর্তমান সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ। আর জনসংখ্যা রয়েছে চার গুণ অর্থাৎ, ঢাকা অবকাঠামোর তুলনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ নিয়ে চলেছে। ভালো হতো ১২ ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা থাকলে।
তিনি বলেন, ঢাকার বাস্তবতা বিবেচনায় চাইলেই আদর্শ জায়গায় যাওয়া সম্ভব হবে না। ইচ্ছা করলেই এখন সড়কের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়। তবে এখনো কিছু উন্নয়ন করার সুযোগ রয়েছে। সেটা হলো, বিদ্যমান সড়কগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে।
ড. আদিল বলেন, ‘ঢাকার উন্মুক্ত জায়গা বাড়ানো তো দূরের কথা, যেগুলো আছে সেগুলোও টিকিয়ে রাখতে পারছে না সরকার। এ জন্য পলিসি পর্যায়ে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। এখনো ঢাকায় ওয়ার্ড পর্যায়ে ছোট ছোট উন্মুক্ত জায়গা সৃষ্টি করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রাজউকের ড্যাপের কিছু প্রস্তাবনা রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করে ঢাকার জনঘনত্ব কমানো এবং গণপরিসর বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি ঢাকার জনঘনত্ব কমাতে ঢাকায় নতুন কোনো কর্মস্থান সৃষ্টি করা যাবে না। যেমন শিল্প, কলকারখানা এবং অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তাহলে জনসংখ্যার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে।’
পরিকল্পনা হয় বাস্তবায়ন হয় না : ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ১৯১৭ সালে নগরপরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিসকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করে ব্রিটিশরা। এটাকে মাস্টারপ্ল্যানের ধারণাপত্র বলা হয়। এর নাম ছিল ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। এ দুটো বাস্তবতা ধরে বিশদ পরিকল্পনার সুপারিশ করেন ওই নগরপরিকল্পনাবিদ। কিন্তু ওই সুপারিশের আর বাস্তব রূপ পায়নি। সে সময় ঢাকার চারদিকে চারটি নদীর পাশাপাশি শহরে অনেক খালও ছিল। একসময় শহরে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫০টি প্রাকৃতিক খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ত। ফলে জলাবদ্ধতা হতো না। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৮-১০ লাখ।
এরপর পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। এ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বেশ কিছু অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়। তবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৫৯ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ।
বাংলাদেশে পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে ঢাকার জন্য প্রথম মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয় ২০১০ সালে। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি ধরা হতো। রাজউকের নেতৃত্বে প্রণয়ন করা এ মাস্টারপ্ল্যানের নাম ড্যাপ। মাস্টারপ্ল্যানটি পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগর গঠনের সূচকের বিবেচনায় ৭০ ভাগ সঠিক ছিল। তবে ৩০ ভাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। ২০১৫ সালে ড্যাপের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সালের জন্য ড্যাপ সংশোধন করা হয়। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সংশোধিত ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এবারের ড্যাপে ঢাকার জনঘনত্ব কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এমন কিছু চরিত্র আছে, যারা সব সময়ই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, ক্ষেত্র বিশেষে এরা নীতিনির্ধারকও হয়ে ওঠে। ক্ষমতার মধু আহরণে এরা সামনের কাতারে থাকলেও, পালাবদলের আগেই ওরা রূপ পাল্টাতে শুরু করে! ওদের কাছে কি কোনো বার্তা আছে বদলে যাওয়া বা বদলে ফেলার বার্তা?
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসের মাটিতে কেমন যেন একটা তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হতাশা, অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, এরাও যেন দৃশ্যপটে আসতে শুরু করেছে। রূপ পাল্টে যারা আওয়ামী সেজে এতদিন চারদিক দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন, খোলস পাল্টাতে এদের কেউ কেউ প্রস্তুতি শুরু করেছেন, প্রবাসের মাটিতে এরা রূপ পাল্টিয়ে ইতিমধ্যে নতুন রূপ ধারণ করতে শুরু করেছেন। এরা কি তাহলে নতুন কোনো আগমনী বার্তায় উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন? কী সেই বার্তা? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তনের বার্তা দেওয়ার মালিক জনগণ, আর তার একমাত্র উপায় গণভোট। এখনো সেই গণভোটের বাকি এক বছর, তাহলে বসন্তের কোকিলদের মাঝে এত দৌড়ঝাঁপ কেন?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দাতা নামের লগ্নিকারকদের দারুণ প্রভাব। সরকার ও রাজনীতিতে আড়ালে-আবডালে এরা নানাভাবে কলকাঠি নাড়ে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, উন্নয়ন অংশীদার বা দাতা পরিচয়ে এরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির নানারকম কর্মকা- চালায়। সোজাসাপ্টা ভাষায়, আমরা যাদের ডিপ্লোমেট বা কূটনীতিক নামে চিনি, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী এদের কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকা- নিয়ে সরব হওয়ার সুযোগ নেই। তবুও দরিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়েও এরা তৎপর হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে মানবাধিকারের নামে চাপাচাপির বার্তা চালায়।
প্রকৃত অর্থে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, নিষেধাজ্ঞার খড়্গ আসতেই পারে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো, তাদের মানবাধিকার তখন জাগ্রত হলো না!
একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আইভী রহমানসহ যারা নিহত হলেন, তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হলো, পার্লামেন্টারিয়ান আহসান উল্লাহ মাস্টার, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া নিহত হলেন, তখনো এদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না! সাঈদীকে চাঁদ দেখার গুজব রটিয়ে শত শত মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে অঙ্গার হয়ে অসার দেহ পড়ে থাকল, তখনো তাদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না!
একুশ বছরে বিকৃত ইতিহাস জেনে গড়ে উঠে একটি প্রজন্ম। এই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস-ই সত্যরূপে আবির্ভূত হয়। গত এক যুগে একাত্তরের পরাজিত আদর্শের অনুসারী একদল সুবিধাবাদী রঙ পাল্টিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এই ধারাটি শুধু দেশে নয়, প্রবাসের মাটিতেও সক্রিয় ছিল। কূটনীতিকদের লম্ফঝম্ফ দেখে এরা আবারও রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে। এতদিন ‘জয়বাংলা’ বলে যারা হুঙ্কার ছেড়েছিল, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে তাদের আপত্তি!
অগ্নিঝরা মার্চ আর বিজয়ের ডিসেম্বর! এ মাস দুটি বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জনের মাস। তবুও এ মাসগুলোতেই যেন কিছু মানুষের হৃদয়ের দহন বেড়ে যায়! যন্ত্রণায় এদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। অন্তরাত্মাকে শীতল করতে এরা প্রচন্ড প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। এর অন্তরালে কাজ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার এক সুদূরপ্রসারী হীন প্রচেষ্টা। এই ঘৃণ্য অপশক্তির প্রথম টার্গেট ছিল ১৫ আগস্ট।
একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল দিন। পনেরো আগস্ট, ৩ নভেম্বর বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কময় দিবস। প্রবাসে থাকলেও এসব দিবসে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারি না। ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ থেকেই নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করি। ২০২২-এর বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আয়োজকদের মতে, প্রবাসের নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকশিত করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। উপস্থিত বারোজন সংবর্ধিত মুক্তিযোদ্ধার একজন বাদে কেউই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলেননি! এ মহান নেতার নামটিও উচ্চারণ করেননি। সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুকে এড়িয়ে চলার এমন হীন চেষ্টা দেখে বিস্মিত হয়েছি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছেন, বিশ্বব্যাংককে অবজ্ঞা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, ফ্লাইওভারের মতো বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে রাত-দিন কাজ করছেন, তবুও চারদিকে এত ষড়যন্ত্র কেন?
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির নায়ক শাসক দলের ব্যাপক ক্ষমতাবান নেতাদের মুহূর্তে কপর্দকহীন করে শেখ হাসিনা তাদের আইনের মুখোমুখি করেছেন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজ চক্র, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে রেল আর সড়ক যোগাযোগে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট, পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত অবধি বিস্তৃত হচ্ছে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, গড়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে স্টেশনসহ বড় বড় মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। এতসবের পরও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। আবারও বঙ্গবন্ধুর নামকে মুছে দিতে দেশি-বিদেশি লম্ফঝম্ফ দৃশ্যমান হচ্ছে! স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধারণ করেই এই ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। যারা বঙ্গবন্ধুকে বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, এরা দেশপ্রেমের ছদ্মাবরণে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সোল এজেন্ট, এদের রুখতেই হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়ন গবেষক
ক্যালগেরি, কানাডা
আজ বুধবার (২৯ মার্চ) ভোর ৫টায় দৈনিক প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমবাগান এলাকার নিজ বাসা থেকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)-এর একটি দল।
স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলো পত্রিকার আলোচিত রিপোর্টটির কারণে তাকে আটক করা হয়েছে বলে সিআইডির দলটি উপস্থিত ব্যক্তিদের জানিয়েছেন।
এভাবে গভীর রাতে তল্লাশি চালিয়ে একজন সংবাদকর্মীকে আটক বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর চরম আঘাত বলে মনে করে গণতন্ত্র মঞ্চ। এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন গণতন্ত্র মঞ্চের নেতৃবৃন্দ।
কুখ্যাত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বানানোর পর থেকেই বিরোধী মতের রাজনৈতিক কর্মীরা যেমন মতপ্রকাশ করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তেমনি গণমাধ্যম কর্মীরাও নির্যাতিত হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলামসহ সারাদেশে বহু গণমাধ্যমকর্মীদের ওপরই সরকারি সংস্থা কিংবা দলের লোকের নির্যাতনের খবর এসেছে। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে শামসুজ্জামান শামসকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানাচ্ছে। সেই সাথে গণমাধ্যম কর্মীসহ মত প্রকাশের অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে তাদের মামলা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবী জানান নেতৃবৃন্দ।
চারদিকে পাহাড় ও সবুজের অরণ্য। এই সবুজ বিনাশ করে সড়ক নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। পাহাড়ি এলাকায় সড়ক নির্মাণের প্রকৌশলগত জ্ঞানের অভাব কিংবা অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা, রাস্তার প্রায় এক কিলোমিটার অংশ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের আওতায় চলে যাওয়া বা রেল লাইনের ওপর ব্রিজ নির্মাণসহ নানা জটিলতায় একের পর এক আটকে যাওয়া প্রকল্পটি ইতিমধ্যে ২৭ বছর পার করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ও পরিমার্জনে শুরুর ৪০ কোটি টাকার প্রকল্প এখন ৩৫৩ কোটিতে পৌঁছেছে। তারপরও শেষের দেখা নেই ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ ডিটি-বায়েজীদ (বায়েজীদ লিংক রোড) সংযোগ সড়কের।
দীর্ঘদিন ধরে রেললাইনের ওপরে নির্মিত ব্রিজের কাজ প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেওয়ার পর এখন চলছে। গত সপ্তাহে দেখা যায়, রেললাইনের ওপরের অংশে গার্ডার বসানোর কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন। এতদিন রেললাইনের উভয় প্রান্তে গার্ডার বসলেও রেললাইনের ওপরের অংশে খালি রাখা হয়েছিল। রেললাইন বিড়ম্বনার পাশাপাশি রোডের গা ঘেঁষে রয়েছে সুউচ্চ পাহাড়। টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ধসে রাস্তার ওপর পড়তে পারে এবং এতে যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা হতে পারে। অর্ধকাটা এসব পাহাড় নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও রোড নির্মাণ বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মধ্যে বিরোধ চলছে। পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণের কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ১০ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। অর্ধকাটা এসব পাহাড় কেটে ঝুঁকিমুক্ত করার বিষয়ে শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায়ও আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু এখনো এর সুরাহা নেই। যথারীতি আরেকটি বর্ষা আসছে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে খাড়া পাহাড়। বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে জানমালের ক্ষতি হতে পারে সেই শঙ্কায় গত বছর বর্ষায় এই রোডে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে। এবারও কি একই পথে হাঁটতে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় রোড বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের সঙ্গে। তিনি বলেন, পাহাড়ের বিষয়টি নিয়ে এই সপ্তাহে পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে আমাদের মিটিং রয়েছে। আশা করছি বিষয়টি সুরাহা হবে।’
এদিকে পাহাড় নিয়ে সুরাহার পথ সুগম হলেও জনগণের যাতায়াতের ওপর টোল বসাচ্ছে সিডিএ। চট্টগ্রাম মহানগরীতে নগরবাসীর চলাচলের কোনো পথে টোল নেই (কর্ণফুলী সেতু ও টোল রোড ছাড়া)। এরমধ্যে টোল রোডটি শুধুমাত্র পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলের জন্য নির্মিত। কিন্তু ডিটি-বায়েজীদ সংযোগ সড়কে টোল যুক্ত হতে যাচ্ছে। ৩২০ কোটি টাকার প্রকল্প সরকার ৩৫৩ কোটি টাকায় বর্ধিতকরণের অনুমোদনের সময় অতিরিক্ত ৩৩ কোটি টাকা টোল আদায়ের মাধ্যমে পরিশোধের কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘রোড মেইনটেনেন্স আমরা করব। একইসঙ্গে সড়কবাতি স্থাপন, রেললাইনের ওপরে ব্রিজ নির্মাণ, নালা সংস্কার কাজগুলো নতুন করে করা হবে।’ টোল প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘টোল প্লাজা বসবে ফৌজদারহাট অংশে। শহর প্রান্ত দিয়ে এসে টোল প্লাজা ক্রস করলেই শুধুমাত্র টোল দিতে হবে। রোডের সৌন্দর্য উপভোগ করে ফিরে গেলে টোল দিতে হবে না।’
কবে নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ হতে পারে জানতে চাইলে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, চলতি বছরের মধ্যে আমরা কাজ শেষ করে দ্বিতীয় ব্রিজটি চালু করে আনুষ্ঠানিকভাবে তা ওপেন করে দিতে চাই। যদিও ইতিমধ্যে এই রোড দিয়ে অনেক যান চলাচল করছে। কিন্তু ওভারব্রিজটি চালু না করায় তা পূর্ণতা পায়নি।
টোল কবে থেকে যুক্ত হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘আগামী বছর থেকে টোল যুক্ত হতে পারে।’
সড়কের ইতিবৃত্ত বায়েজীদ বোস্তামী রোডের সঙ্গে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডকে (ডিটি রোড) যুক্ত করার উদ্দেশ্যে প্রায় ছয় কিলোমিটার পাহাড়ি এলাকার ওপর দিয়ে এই রোড নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ৪০ কোটি টাকার সেই প্রকল্পের অধীনে ব্যাপক হারে পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণ করলেও বর্ষা এলেই পুরো রাস্তাসহ পাহাড়ি ঢলে চলে যেত। ফলে প্রকল্পটি বারবার হোঁচট খায়। এই প্রকল্পের মাঝখানের এক কিলোমিটার অংশ আবার এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন করার সময় তাদের ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে যায়। ফলে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের বাইরে দিয়ে নতুন করে বাঁক নিয়ে সড়কের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। দুই লেনের সেই প্রকল্প প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৭২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে এসে আবারও নকশায় পরিবর্তন। এবার দুই লেনের পরিবর্তে চার লেনে উন্নীত করা হয়। যথারীতি বাজেট ৩২০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০২১ সালে এসে তা ৩৫৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
প্রথমবারের মত মা হলেন চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি।
মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) রাত ১১টা ২০ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে পুত্র সন্তানের জন্ম দেন তিনি। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মাহির স্বামী রাকিব সরকার।
তিনি জানান, মা ও ছেলে দুজনেই সুস্থ আছেন। পুত্রের নাম এখনও ঠিক করা হয়নি বলে জানান তিনি।
২০১২ সালে ‘ভালোবাসার রঙ’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বড়পর্দায় অভিষেক ঘটে রাজশাহীর মেয়ে মাহির। পরবর্তীতে ‘অগ্নি’ ‘কী দারুণ দেখতে, ‘দবির সাহেবের সংসার’, ‘অনেক সাধের ময়না’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’সহ বেশ কয়েকটি আলোচিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
দুই বছর আগে গাজীপুরের ব্যবসায়ী রকিবকে বিয়ে করেন মাহি। তার কয়েক মাস আগে পারভেজ মাহমুদ অপুর সঙ্গে তার দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মা হচ্ছেন বলে খবর দিয়েছিলেন এই চিত্রনায়িকা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’