
করোনার মতো ডেঙ্গুও ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে প্রায় দুইশ’র কাছাকাছি পৌঁছেছে। এটি দেশের ইতিহাসে এক বছরে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা। গত প্রায় এক মাস ধরে প্রতিদিন গড়ে চার থেকে পাঁচশ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। চলতি নভেম্বরের প্রথম ৯ দিনে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৭ হাজার জন এবং এই সময়ে মারা গেছেন ৪৬ জন। গত অক্টোবর মাসে দেশে ২১ হাজার ৯৩২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। মারা যান ৮৬ জন। রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি হলেও তা শুধু এখানেই থেমে নেই। এ বছর ৫০টি জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ ডেঙ্গু রোগীর যে হিসাব দিচ্ছে, বাস্তবে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সারা দেশে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে ডেঙ্গু বাংলাদেশে বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে আছে। ২০০০ সালের পর থেকে প্রতি বছর বহু মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে, মানুষ মারাও যাচ্ছে। করোনা মহামারী শুরুর বছর ২০২০ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কম ছিল। কিন্তু গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৮ হাজার ৪২৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। এর মধ্যে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। কিন্তু ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী কার্যকর কোনো উদ্যোগ স্বাস্থ্য বিভাগের বা অন্য কোনো বিভাগের নেই। তারা রুটিন মাফিক কাজ করছেন, মর্জিমাফিক কথা বলছেন। মানুষের জীবনের মূল্য না থাকলে যা হয় আর কি! দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, বর্ষার মৌসুম শেষ হলেও কমছে না ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত বছর এ সময়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এলেও এ বছর আসেনি; বরং মৃত্যু আতঙ্ক ছড়িয়েই যাচ্ছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তারা সক্ষম হয়নি। তবে সিটি করপোরেশন বলছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তারা সফল এবং যেসব রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই করপোরেশন এলাকার বাইরে থেকে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসছেন। দেশে ডেঙ্গুর এই প্রাদুর্ভাব নতুন নয়। প্রতি বছর এই সময় সে রাজধানীসহ বিভিন্ন শহর দাপিয়ে বেড়ায়, প্রাণ কাড়ে প্রতি বছর ডেঙ্গুর খবর সংবাদপত্র জুড়ে থাকে। এবং প্রতি বছরই নিয়ম করে একই কথা ফিরে বলতে হয় : ডেঙ্গুর মোকাবিলায় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও স্বাস্থ্য দপ্তর কী কী করছে, কতটা করছে, ঠিকমতো ও ঠিক সময়ে করছে কি না। বর্ষার মৌসুম শুরুর আগে থেকে প্রস্তুত হয়ে থাকা জলাশয় ও যে-যে জায়গায় জল জমতে পারে, পূর্বানুমানে সেগুলো পরিষ্কার করার বন্দোবস্ত করা, জনবসতি জঞ্জালমুক্ত রাখা ও সর্বোপরি ডেঙ্গু, তার উপসর্গ ও চিকিৎসা নিয়ে তৃণমূল স্তরে গিয়ে প্রচার অভিযানÑ এগুলো উপেক্ষিতই থাকছে। প্রতি বছর একই অভিযোগ, একই অবহেলা, এ-ই কি তবে ভবিতব্য?
আমাদের দেশে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বাস্তবায়ন করা হয় না। এমনকি রুটিন কাজটাও ঠিকঠাক মতো করা হয় না। নগরীতে কিছু কিছু এলাকায় মাঝে মাঝে মশক নিধন ওষুধ ছিটানো হয়, মেয়র সাহেবরা হঠাৎ হঠাৎ দুচার জায়গা পরিভ্রমণ করে এক-দুজনকে জরিমানা করেন, হম্বিতম্বি করেন। এর বাইরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ কখনো দেখা যায় না। তবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবই সিটি করপোরেশন ও সরকারেরই দায়, এই মনোভাবও ক্ষতিকর। সচেতন হতে হবে নাগরিককেও। জ্বর মানেই তা ভাইরাল, এই মৌসুমে একটু-আধটু হয় বলে অবহেলাও নাগরিক অসচেতনতা, বাড়ির পাশে খোলা জায়গা নর্দমা বা বাগানে নিজেরাই জঞ্জাল ফেলা, ফুলের টব বা ডাবের খোলায় জল জমতে দেওয়াও নাগরিক কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় নয়। সরকারের ব্যবস্থাপনায় গলদ আছে ঠিক কথা, কিন্তু নাগরিক জীবনযাত্রায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনেক কিছুই কর্র্তৃপক্ষের সার্বিক নজরদারি এড়িয়ে যেতে পারে। যে কোনো মৃত্যুই বড় বেদনার, বিশেষ করে ডেঙ্গুতে শিশু, তরুণদের মৃত্যু। অথচ, আমরা যেন ধরেই নিয়েছি যে, প্রতি বছর বর্ষাকালে ও বর্ষার আগে-পরে কিছু প্রাণ অকালে ঝরে যাবে। তাই শহরের অজস্র জায়গাকে আমরা মশক বাহিনীর জন্য ‘অভয়ারণ্য’ হিসেবে গড়ে তুলেছি। রাজপথে খানাখন্দ, যত্রতত্র না-বোজানো গর্ত, তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। রাস্তার গর্তে বৃষ্টির জল জমে, জমা জলে দ্রুতলয়ে ডিম পাড়ে মশক বাহিনী। মশার ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে ভোর আর সন্ধ্যায় পায়ে হুল ফুটিয়ে যায়। একজন থেকে দশ জনের শরীরে ভাইরাস ছড়ালে রোগ ছড়ানোর দায়টা কার পথের, মশার, সিটি করপোরশেন, নাগরিকদের, না সরকারের?
আমরা সরকার আর সিটি করপোরেশনের ওপর আমাদের রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করি। পারলে লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। হ্যাঁ, তাদের ওপর হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়াই উচিত। কিন্তু নিজেদের দায়িত্বটাও কি আমরা কখনো ঠিকঠাক মতো পালন করি? নিয়ম করে সাফ করি নিজের বাড়ির ছাদের বা বারান্দার টবে, বালতিতে জমা জল? আমরা বাড়ির ময়লা ফেলি যেখানে সেখানে, ফুলদানির জল একভাবে পড়ে থাকে দিনের পর দিন। মাত্র আধ ইঞ্চি জমা জলেও ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার মশা ডিম পাড়ে, বছরভর এ নিয়ে কমবেশি প্রচার চালায় পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ। বর্ষা এলেই ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু নিয়ে নানা জায়গায় চোখে পড়ে বড় বড় হোর্ডিং, দেখেও কি দেখি আমরা? জ্বর হলেই, ‘ও কিছু না, ভাইরাল ফিভার’ ধরে নিই। হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা করাতে গড়িমসি করেন বহু মানুষ। সেটা তার নিজের জন্য, সেই সঙ্গে সবার জন্য বিপদ ডেকে আনে।
কভিডের একের পর এক ভয়ংকর ঢেউ, এতগুলো মর্মান্তিক মৃত্যু চোখের সামনে দেখেও আমরা বুঝলাম না যে, রোগপ্রতিরোধের উপায় আমাদের হাতেই আছে, তা প্রয়োগের ইচ্ছা আর উদ্যম থাকা দরকার। এবং সেই উদ্যম বজায় রাখতে হবে সারা বছর, সব কাজে। বড় বড় নির্মাণ করতে গিয়ে একটা এলাকার জলনিষ্কাশন ব্যবস্থা রুদ্ধ হয়ে যায়। যেসব চক্র বৈধ বা অবৈধ নির্মাণ করতে গিয়ে গোটা এলাকার মানুষকে এভাবে বিপদে ফেলে, সে সব ঘুঘুর বাসা ভাঙতে মাঝেমাঝে হুঙ্কার দিলে কাজ হয় না। বেআইনি নির্মাণের সঙ্গে শহরের জলনিষ্কাশন ব্যবস্থার শুধু নয়, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও নির্দিষ্ট নানা রোগব্যাধি প্রতিরোধের সম্পর্ক গভীর। বেআইনি নির্মাণকে ‘জনস্বাস্থ্য সমস্যা’ বলে দেখা দরকার।
রোগপ্রতিরোধে ব্যর্থতার ঝুলি নিয়েই দেশ এগোচ্ছে অনির্দিষ্ট গন্তব্যে। রাজনৈতিক সংঘাত বাড়ছে। শাসক দল শক্তি প্রয়োগের নীতি নিয়ে টিকে থাকতে চাইছে। কিন্তু মানুষের প্রাণরক্ষায় চোখে পড়ার মতো কোনো কর্মসূচি নেই। ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু প্রাণের সুরক্ষা আরও বড়। ডেঙ্গুর চিকিৎসায় রক্তের অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেট প্রায়শই অপরিহার্য। রোগী বাড়ছে, প্লাটিলেটের অভাবও দেখা দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দরকার পাড়া-মহল্লায় রক্তদান শিবির। ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল আপাতত ব্যস্ত বড় বড় জমায়েত করে নিজেদের জনপ্রিয়তার প্রমাণ দিতে। এতে কার কী লাভ? যে রোগীটা রক্তের অভাবে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, তার জন্য রক্তের ব্যবস্থা করা কি রাজনৈতিক দলগুলোর কর্তব্য নয়? কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে জনসমাবেশ করার চেয়ে যদি প্রতিটি হাসপাতালে কিংবা পাড়ায় পাড়ায় রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা যেত, তাহলে সত্যিকার অর্থে অনেক মানুষের উপকার হতো, অনেকের প্রাণ বাঁচত। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের বাঁচাতে রক্তের জন্য হাহাকার চলছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে।
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট
ড. জাহিদ হোসেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি দীর্ঘদিন সাউথ এশিয়া ফাইনান্স অ্যান্ড পোভার্টি গ্রুপের মুখ্য অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেন। তিনি প্রায় ১৪ বছর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি ও অর্থনীতির চাপ সামলাতে আইএমএফ থেকে বাংলাদেশের ঋণ নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন এই অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশকে শর্তসাপেক্ষে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দেবে। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
ড. জাহিদ হোসেন : বর্তমানে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি একটা চাপের মধ্যে আছে। চাপটা দুটো জায়গায় বেশি। একটা হলো বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, মানে ডলারের অভাব। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে, চলতি খাতের অ্যাকাউন্ট ব্যাল্যান্স অব পেমেন্ট ডেফিসিট বেড়ে গিয়েছে। আরেকটা হলো মূল্যস্ফীতি, যদিও গত দু’মাসে সামান্য কমেছে, তারপরেও এটা অনেক বেশি। এই ধরনের চাপের মধ্যে আইএমএফের দ্বারস্থ হওয়া। আমরা যে শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থায় পড়েছি, তা না। আমরা খাদে পড়ার আগে, শ্রীলঙ্কা তো খাদের ভেতর থেকে গেছে। তো খাদে পড়ার আগে সংস্কার কর্মসূচির ভিত্তিতে যারা ম্যাক্রো ব্যবস্থাপনায় আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে, সেটা আইএমএফ। কাজেই তাদের সঙ্গে ৪২ মাস মেয়াদি একটা কর্মসূচির দিকে যাওয়া, এটা ম্যাক্রো ম্যানেজমেন্টের জন্য সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। আগামী ২০২৩ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে; প্রতি বছরে যদি অন্তত দুটো কিস্তি পাওয়া যায়, তাহলে প্রতি বছর ১০০ কোটি ডলারের মতো একটা অর্থের জোগানের জায়গা এখান থেকে তৈরি হচ্ছে। যদিও আমাদের সার্বিক ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি অনেক বেশি, সে তুলনায় এটা মোটা কোনো অঙ্ক না। তবে শূন্যের চেয়ে তো ভালো। সেদিক থেকে একটা স্বস্তির জায়গা তৈরি হচ্ছে।
দেশ রূপান্তর : শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে দেখলাম যে বিভিন্ন ঋণদাতার কিস্তির অর্থ পাওয়া নিয়ে শর্তপূরণ হাওয়া-না হওয়ার কারণে একটা টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছিল। যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। সেখানে আমরাও আইএমএফের কিস্তির টাকা পেতে একই সমস্যায় পড়তে পারি কিনা?
ড. জাহিদ হোসেন : শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে চায়না, জাপান থেকে ঋণ পাওয়া নিয়ে এ সমস্যা হয়েছিল। বন্ডেজ ঋণের ক্ষেত্রে হয়েছিল। তো আমাদের ক্ষেত্রে আইএমফের শর্তটা হলো সংস্কারের। এক্ষেত্রে আপনার সমস্যার গোড়ার কারণটা অ্যাড্রেস করতে হবে। আপনি আইএমএফ থেকে যে অর্থটা পাবেন সেটা সাময়িক ক্রাইসিস মোকাবিলা করার জন্য। এটা অনেকটা সময় কেনার মতো। মানে ওই সময়ের মধ্যে আমি গোড়ার সমস্যাগুলোর সমাধান করব, সংস্কারের মাধ্যমে। আমি ধরে নিচ্ছি তর্কের খাতিরে আইএমএফের শর্তগুলো গোড়ার সমস্যাগুলোর সমাধানযোগ্য শর্ত। এটাকেই সংস্কার বলা হচ্ছে। তো এটা যদি আপনি না করেন, তাহলে তো আপনি আসল সমস্যাকে অ্যাড্রেস করলেন না। মানে যে ওষুধটা আপনার খাওয়া দরকার সেটা যদি আপনি না খেয়ে কেবল প্যারাসিটামল খান তাহলে জ¦র কমলেও অসুখ তো সারবে না।
দেশ রূপান্তর : সংস্থাটি জানিয়েছে, কর্মসূচির উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার এবং দেশের সংহতি, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে সহায়তা করা। এ জন্য কাঠামোগত পরিবর্তনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্যে কী কী পড়ছে?
ড. জাহিদ হোসেন : এইখানেই হলো তথ্যের ঘাটতি। কারণ, আমরা জানি না আসলে আইএমএফের এই কর্মসূচিতে কী ধরনের সুনির্দিষ্ট সংস্কারকাজ করতে হবে। এখানে কিছু এরিয়া তারা চিহ্নিত করেছে। প্রেস রিলিজে যেমন বলেছে, রাজস্ব আদায়ে উন্নতি করতে হবে, সরকারি ব্যয় যৌক্তিকরণ করতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, মুদ্রানীতি আধুনিকায়ন করতে হবে। অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতি কমাতে আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ যাতে আসতে পারে সেজন্য পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তারপর জলবায়ু সহিষ্ণুতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। এখন এগুলো সবই তো আকাক্সক্ষা।
দেশ রূপান্তর : এগুলো তো অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা আগে থেকেই বলছেন। বাস্তবায়ন তো দেখা যায়নি।
ড. জাহিদ হোসেন : আইএমএফের কর্মসূচিতে আসলে কী আছে, সেটা পরিষ্কার না। আইএমএফ এসে এনবিআরের সঙ্গে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিটিং করেছে। তাদের সঙ্গে সমস্যাগুলো নিয়ে আলাপই হয়েছে, সেখানে তারা পরামর্শও দিয়ে গেছে। কিন্তু পরামর্শগুলোর মধ্যে কী এবং কোনগুলো তাদের তিন বছরের কর্মসূচিতে বাস্তবায়িত হবে, সেটা তো আমরা জানি না। আমরা কেবল জেনারেল কিছু আকাক্সক্ষার কথা জানি। সংবাদ সম্মেলনে যেটা বলেছে, গত চার বছরে বাজেটে অর্থমন্ত্রী যেসব সংস্কারের কথা বলেছেন ওইখান থেকে একটা মানদ- তৈরি করে আইএমএফের কর্মসূচির জন্য আমরা একটা রিফর্ম প্যাকেজ তৈরি করব। আইএমএফের প্রেস রিলিজে যেসব আকাক্সক্ষার কথা বলা হয়েছে তার সবই প্রতি বছরের বাজেট বক্তৃতায় পাবেন। ওখানেও তো সুর্নিদিষ্ট করে কিছু বলা নেই। প্রতিটি বাজেট বক্তৃতায় সুশাসন এবং সংস্কার বলে একটা চ্যাপ্টার থাকে। ব্যাংকিং সেক্টরে, এনার্জি খাতে, এনবিআরের জন্য, জলবায়ুর জন্য এই এই করব। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভর্তুকি, সামাজিক সুরক্ষা... মানে অনেক কিছু বলা থাকে; এখানে এটা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা কী? একটা উদাহরণ দিই, আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করার কথা বলছে। তার মানে কী? মন্দ ঋণের স্বীকৃতির জন্য এখন ১৮০ দিন অপেক্ষা করে। আগে তো এটা ৯০ দিন ছিল, আন্তর্জাতিক মানদ-ও ৯০ দিনের। একটা সুপারিশ ছিল যে এটাকে ১৮০ দিনের পরিবর্তে ৯০ দিনে নিয়ে আসা হোক। এটা তো একটা সুর্নিদিষ্ট পদক্ষেপ। তো এটা কি আইএমএফের সংস্কার কর্মসূচিতে আছে? সেটা তো জানি না। এরকম সুর্নিদিষ্ট কথা না জানলে আপনি, আমি কীভাবে বলব কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ বা কোনটা সম্ভব হবে, কোনটা অসম্ভব।
দেশ রূপান্তর : রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য আইএমএফ পরামর্শ দিয়েছে। সাধারণ ভোক্তাদের ওপর চাপ না দিয়ে রাজস্ব বাড়াতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
ড. জাহিদ হোসেন : এখানে তো অনেক লম্বা এজেন্ডা। পলিসির ব্যাপার আছে, অ্যাডমিনিস্ট্রিশনের ব্যাপার আছে। তারপরে সুশাসনের বিষয় আছে। পলিসির ক্ষেত্রে আইএমএফ ৬ মাস আগে নিয়মিত ভিজিটে দুই পৃষ্ঠার একটা নোট দিয়ে গিয়েছিল। সেখানে করের ক্ষেত্রে তারা ভ্যাট রেইটের কথা বলেছিল। বর্তমানে ভ্যাটের চারটা রেইট আছে। তারা বলেছিল এটাকে সরলীকরণ করে একটা রেইটের দিকে যেতে। এখনই যে করতে হবে তা না, কিন্তু সেদিকে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে বলেছে। কাস্টমসে, ইনকাম ট্যাক্সে, করপোরেট ট্যাক্সে সব ক্ষেত্রেই তো পলিসি রিফর্মেও প্রয়োজন আছে। আইএমএফের কর্মসূচিতে ট্যাক্স কালেকশন বাড়াতে কোন পলিসি তারা নিচ্ছে, যেটা আগামী ৩ বছরের মধ্যে করা সম্ভব, এটা হয়তো আমরা ফেব্রুয়ারিতে জানতে পারব।
দেশ রূপান্তর : রিজার্ভের কথা সরকার যেটা বলত, জানা গেল আইএমএফের হিসাবে সেটা অনেক কম। এতে একটা আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
ড. জাহিদ হোসেন : এখানে প্রথম কথা হলো সাদাকে সাদা বলা, কালোকে কালো। ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ কত আছে, হিসাবটা তো আপনাকে ঠিক মতো করতে হবে। এটা তো কারোর ব্যক্তিগত সম্পদ না। এটার প্রকাশটাও স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে হবে। আমরা যদি বলি আমার ৩৪ বিলিয়ন ডলার আছে, কিন্তু আসলে তো সেটা নেই। আইএমএফ বলার পর জানা গেল ২৬ বিলিয়ন। সঠিক হিসাব জানা সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতি নির্ধারকদেরও দরকার। খাদ্যমন্ত্রী যদি ভাবেন যে আমার তো ৩৬ বিলিয়ন রিজার্ভ আছে, কাজেই খাদ্য আমদানিতে সমস্যা হবে না। কিন্তু রিজার্ভ তো আছে ২৬ বিলিয়ন। যে টাকা আপনার ক্যাশ ফর্মে নেই, সেটা আপনি কেন বলবেন যে আছে। আপনার এক লাখ টাকা আছে, আমাকে ১০ হাজার দিলেন ধার। এখন যদি জানতে চাই আপনার হাতে কত টাকা আছে, আপনি কি বলবেন যে আপনার কাছে এক লাখ আছে, আপনার কাছে তো আছে ৯০ হাজার। শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলার ধার দিয়ে সেটাও হিসাবে দেখাচ্ছে যে তার আছে, এটা বলতে পারেন, কিন্তু সেটা তো সঠিক না।
দেশ রূপান্তর : অনেকে বলছেন ব্যাংকে টাকা রাখলে তা ফেরত পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ রয়েছে। পরিস্থিতি কি এতটাই খারাপ? ‘ব্যাংক রান’-এর সম্ভাবনা দেখছেন কি?
ড. জাহিদ হোসেন : বাংলাদেশের অবস্থা ওই পর্যায়ে গেছে বা যেতে পারে বলে আমার মনে হয় না। তার মানে এই না যে আপনার সমস্যা নেই। আসলে ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটের দুর্বলতার মাত্রা কতটুকু সেটা জানার জন্য আপনার দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের হিসাবটা ঠিক মতো করতে হবে। ছয় মাস আগের আইএমএফের যে ভিজিটের কথা বললাম, তখন তারা এটাও বলেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক ফাইনান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটির যে রিপোর্ট করে সেটাতে আগে দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের একটা সংখ্যা দিত। ২০১৮ সালের পর থেকে এটা আর দেওয়া হয় না। তাদের পরামর্শ ছিল, এই সংখ্যাটা সঠিকভাবে ক্যালকুলেট করা হোক এবং রিপোর্টে সেটা উল্লেখ করা হোক। তাহলেই তো আপনি যে প্রশ্নটা করেছেন, যে কোন ব্যাংকে টাকা রাখলে সেটা পেতে সমস্যা হবে জানা যেত। সব ব্যাংক তো খারাপ না। তথ্যের অস্বচ্ছতা থাকলে, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য থাকলে গুজবের জায়গা তৈরি হবে। স্বচ্ছ হিসাব প্রকাশ করা হলে গুজবের সুযোগ থাকবে না।
দেশ রূপান্তর : দেশের ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাবে বিশেষ সুবিধায় অনেকেই ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। পর্ষদ সদস্যরা প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন সময় ঋণ অনুমোদন করাচ্ছেন। সমঝোতার ভিত্তিতে এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে আইএমএফ। আপনার অভিমত কী?
ড. জাহিদ হোসেন : ব্যাংকের বোর্ডে যে পরিচালক নিয়োগ করা হয় সেখানে আমাদের ব্যাংকিং কোম্পানি আইনেই একটা প্রপার ক্রাইটেরিয়া বলে দেওয়া আছে। কোন ধরনের লোক, কোন ধরনের অভিজ্ঞতা, অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড, তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক বিবেচনায় এনেই তো আপনাকে নিয়োগ দিতে হবে। যাতে স্বার্থের সংঘাত তৈরি না হয়। অযোগ্য লোক যেন ওখানে না বসে। এটা রাষ্ট্রায়ত্ত এবং প্রাইভেট সব ব্যাংকের জন্য একটা কনসার্ন। এখানে আইএমএফ সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা মনে করি এই পরামর্শ বা প্রস্তাব আমাদের আর্থিক খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এটা কর্মসূচিতে আছে কি না সেটা দেখতে হবে। আপনি একজন ঋণদাতা, এখন আপনি আমাকে বললেন আপনার পর্ষদটা ঠিক করেন, কিন্তু আপনাকে আমি ঋণ যে কোনো অবস্থাতেই দেব, পর্ষদ ঠিক করেন বা না করেন। আমি কী করব? আপনি ঋণটা নিলেন কিন্তু পর্ষদ ঠিক করলেন না, তাহলে কী হবে? এখানে আইএমএফের সিরিয়াসনেসটা আরও বিশ^াসযোগ্য হবে যদি পরামর্শ ও প্রস্তাবগুলো কর্মসূচির ভেতরে থাকে।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর ইরানসহ সারা পৃথিবীতে ‘নৈতিক পুলিশি’ তথা শাসক গোষ্ঠীর এহেন আচরণের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বরাবরের মতো এবারও ইরানের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী বিক্ষোভকারীদের ওপর ব্যাপক মাত্রায় দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী এবারের বিক্ষোভে এই নভেম্বর পর্যন্ত তিনশ’র বেশি মানুষ মারা গেছে যার মধ্যে শিশুরাও আছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম অনুযায়ী এই বিক্ষোভে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করছে আর তাদের দমনের জন্য ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী মাত্রাতিরিক্ত শক্তির ব্যবহার করছে।
মাহসা আমিনি তেহরান ভ্রমণ করেছিলেন এবং ঠিকভাবে হিজাব পরিধান না করার কারণে ইরানের নৈতিক পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। অভিযোগ আছে নৈতিক পুলিশের নির্যাতনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বাইশ বছরের এই তরুণী। কর্র্তৃপক্ষ বলছে তার মৃত্যু হয় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম জানায়, গ্রেপ্তারের পর পুলিশের গাড়িতে তাকে নির্যাতন করা হয়। মাহসা আমিনি একজন কুর্দি তরুণী। ইরানের মতো সামাজিক বাস্তবতায় তার প্রান্তিকতা ন্যূনতম দ্বিমাত্রিক। এই শিয়া রক্ষণশীল শাসকগোষ্ঠীর কাছে তিনি একজন নারী, দ্বিতীয়ত, তিনি একজন কুর্দি নারী। কুর্দি জাতীগোষ্ঠীর ওপর বর্তমান ইরানের শাসক শ্রেণির ক্ষোভ ঐতিহাসিক। আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে সোচ্চার জাতিগত কুর্দি জনগোষ্ঠী ইরানের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১০ শতাংশ, যাদের একটি বড় অংশ সুন্নি মুসলিম। ইরানের শাসক গোষ্ঠী এখন চূড়ান্ত পর্যায়ের রক্ষণশীল। এই রক্ষণশীলতা যেন ইরান নামক রাষ্ট্র পরিচালনার তাদের বৈধতা তৈরি করে। আর এর সাফাই গাওয়ার জন্য শাসক গোষ্ঠী বলে থাকে তারা শুধু দেশের মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে লালন করছে। যেন দেশের মানুষই রক্ষণশীল সংস্কৃতি ধারণ করছে! জনগণকে বলির পাঠা বানাতে কী ভয়ংকর কথা।
মাহসা আমিনি এখন সারা পৃথিবীতে প্রতিবাদের প্রতীক। পৃথিবীর দেশে দেশে যখন তার এই অকাল মৃত্যু নিয়ে প্রতিবাদ হচ্ছে তখন স্বাভাবিকভাবেই ইরান একে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের চক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছে। ইরান মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শিল্প ও তেলসমৃদ্ধ দেশ। পশ্চিমাদের একের পর এক নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করে গত চার দশক বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের সফলতাও বেশ বিস্ময়ের উদ্রেক করে। পশ্চিমারা যখন ইরানের ওপর একের পর নিষেধাজ্ঞা দেয় তখন তারা রাশিয়ায় যুদ্ধ ড্রোন পাঠায় ইউক্রেনে হামলায় সহযোগিতা করার জন্য। তবে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা যে রাজনৈতিক তা নানা ধরনের ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত। একই সঙ্গে এই নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য যে ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যে সুন্নি অধ্যুষিত ক্ষমতা বলয়ের বিপরীতে ইরানকে কোণঠাসা করার চেষ্টা সেটাও প্রমাণিত। মাহসা আমিনির হত্যার প্রতিবাদ আন্দোলন শুধু নারীদের চলাফেরার স্বাধীনতা সম্পর্কিত আন্দোলনের সঙ্গে আর যুক্ত নেই; এটা ইরানের বর্তমান রেজিম-এর রক্ষণশীলতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ইরানের কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে আন্দোলনের তীব্রতা বেশি। বলা হচ্ছে এবারের বিক্ষোভের গভীরতা গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এতে নারীরা শুধু বিক্ষোভই করছে না, প্রতিবাদে জনসম্মুখে হিজাব খুলে ফেলছে, চুল কেটে ফেলছে।
১৭৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার এক মাসের মধ্যে আয়াতুল্লাহ খোমিনি ইরানের নারীদের জনসম্মুখে হিজাব পরা বাধ্য করে একিটি ডিক্রি জারি করেন। তখন থেকেই ইরানের নারীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে এবং একইভাবে অব্যাহত আছে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে শাসক গোষ্ঠীর চরম রক্ষণশীল আচরণ। মাহসা আমিনির ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যারা নিহত, আহত ও গ্রেপ্তার হয়েছেন তারাই এসব নৃশংসতার প্রমাণ। আর এই পরিপ্রেক্ষিতেই বলা যায়, মাহসা আমিনির হত্যার প্রতিবাদ পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক না কেন, এর পেছনে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই থাকুক না কেন, এর সবগুলোই সমর্থনযোগ্য। এখনকার পৃথিবীতে শাসক গোষ্ঠীর এমন আচরণ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য না এবং এটা প্রতিবাদের বাইরে থাকতে পারে না। যতদিন ইরানে এই ধরনের আচরণ অব্যাহত থাকবে তার বিরুদ্ধে সচেতন ও বিবেকবান মানুষের প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে হবে পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক না কেন। পৃথিবীতে এখনো যারা সব মানুষের অধিকারের প্রতি যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করতে পারে না তাদের অন্য যেকোনো রাজনীতির দোহাই দিয়ে নিজেদের অনৈতিক কাজের বৈধতা অর্জন করার কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকতে পারে না।
ইরানি বিপ্লবের একটি মজার দিক হলো, খোমেনি যখন বিদেশে বসে তার মতবাদ প্রচার করছিলেন সেই সময় তিনি অনেক ধর্মনিরপেক্ষ, বামপন্থি ও জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন পেয়েছিলেন। এর আগে পশ্চিমাদের সমর্থনপুষ্ট ইরানের শাহ আর্থ-সামাজিক কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন এবং তার কিছু সফলতাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সবার সমর্থন নিয়ে আয়াতুল্লাহ খোমেনি যখন ক্ষমতায় এলেন তখন ধীরে ধীরে সব সহযোগীকে ত্যাগ করলেন, বিপ্লব প্রথমে ছিল অসাম্য, বৈষম্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে; বিপ্লব পরবর্তীকালে হয়ে গেছে ইসলামি বিপ্লব। এ বছর ইরানি বিপ্লবের ৪৩ বছর পূর্ণ হলো। প্রায় অর্ধশতাব্দী পূর্ণ হলেও এটাই আবার প্রমাণ হলো সব বিপ্লব সব মানুষের জন্য কল্যাণকর না। প্রমাণ হলো বিপ্লবের কাঠামো ও কেন্দ্র যদি প্রগতিশীল না হয়, গণমানুষের পক্ষে না হয়, তার সুফল সাধারণ মানুষের পক্ষে যায় না। অনেক ক্ষেত্রে তারা শুধু গণমানুষের ভাবাবেগকে কাজে লাগায় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কিন্তু মানুষকে ক্ষমতার অংশীদার করে না। উপরন্তু এর হাত ধরে ভিন্ন পরিচয় এবং ভেদাভেদের সূত্র ধরে নতুন করে প্রান্তিকতা তৈরি হয়। ইরানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে যেখানে শিয়া ধর্মীয় অভিজাতরা আগের থেকে নিশ্চয়ই ভালো আছে কিন্তু সংকটটা অন্যদের।
বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে ইরানের প্রতি পশ্চিমাদের রুষ্ট হওয়ার কারণ আছে। শাহের আমলে তারা ছিল ইরানের তেল সম্পদের সুফলভোগী। শাহের পতনের পর ইরান ও ইরানের জনগণকে বিপদে ফেলার জন্য যারপরনাই এমন উদ্যোগ নিতে বাকি রাখেনি পশ্চিমারা। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে চলমান আন্দোলনের প্রতি প্রশ্চিমাদের সমর্থন আসলে কতটা ইরানের জনগণের পক্ষে? ইরানের জনগণের শক্তি ও সামর্থ্য আছে নিজেদের রাজনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তন নিয়ে আসার সেটা এখন বা আর কিছুদিন পরে এবং সেই শক্তির ওপর বিশ্বাস করেই বর্তমান আন্দোলনকে সমর্থন দিতে হবে। অন্যদিকে, ইরানের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী যদি তাদের এই গোঁড়ামি অব্যাহত রাখে তাহলে যে পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে শাহের বিরুদ্ধে জনগণ ফুঁসে উঠেছিল ঠিক তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। তখন আর পশ্চিমাদের দোষারোপ করে লাভ হবে না। ইরানের ক্ষমতাসীনদের বর্তমান আচরণ শুধু দেশের অভ্যন্তরে তাদের অবস্থানকে দুর্বল করবে না, পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরায়েলের আগ্রসনের পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের প্রতি যারা সহানুভূতিশীল ছিলেন তারাও ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নেবেন আর সেটাই হবে সময়ের বিচার। সময়ের এই বিচারে এখন ইরান ও পশ্চিমের দ্বৈরথে নতুন পরীক্ষা মাহসা আমিনি।
লেখক : উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
দেশের মোট জনসংখ্যার ১৬ দশমিক ৮ শতাংশই কোনো না কোনো পর্যায়ের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। এই তথ্য সর্বশেষ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপের (২০১৮-১৯)। ওই জরিপ অনুসারে দেশের দুই কোটির বেশি মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। কিন্তু এই বিশাল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সক্ষমতা দেশের মানসিক হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের নেই। পাবনা মানসিক হাসপাতাল দীর্ঘদিন ধরে দেশের একমাত্র বিশেষায়িত মানসিক হাসপাতাল হিসেবে সেবা দিয়ে আসছিল। দেশের সবচেয়ে পুরনো এই সরকারি মানসিক হাসপাতালটি অব্যবস্থাপনা-অনিয়মে বেহাল। পাবনার এই হাসপাতালের ওপর চাপ কমানো আর চিকিৎসা ও নীতি গবেষণার জন্য ১৯৮১ সালে রাজধানী ঢাকায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইএমএইচ) প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের কিছু সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা চালু আছে। সামরিক হাসপাতাল ও সশস্ত্র বাহিনীর মেডিকেল কলেজেও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা আছে। এসব হাসপাতালের সম্মিলিত সক্ষমতাও প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। তাই প্রশ্ন উঠছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেন মনোরোগ চিকিৎসার বিষয়ে এতটা উদাসীন?
মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার বিষয়ে সরকারের উদাসীনতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তার সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত পাবনা মানসিক হাসপাতালের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় দেখা যাচ্ছে। শনিবার দেশ রূপান্তরে ‘৪ মাস ধরে ধারদেনায় খাবার সরবরাহ’ শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চার মাসেরও বেশি সময় ধরে ধারদেনা করে খাওয়ানো হচ্ছে পাবনা মানসিক হাসপাতালের আবাসিক রোগীদের। অন্যদিকে, পাওনাদারের কাছে হাসপাতালের বকেয়া প্রায় ৭০ লাখ টাকা। জানা গেছে, আবাসিক রোগীদের খাবার ও ওষুধ সরবরাহের দরপত্রে ‘উপকরণের নাম উল্লেখ নেই’ অজুহাতে মামলা করে রোজ এন্টারপ্রাইজ নামে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। মামলায় টেন্ডার প্রক্রিয়ায় নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত। কিন্তু মামলা খারিজের দুই মাস পেরুলেও নতুন করে টেন্ডার না হওয়ায় খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ঠিকাদার। হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ গত জুলাই থেকে বিশেষ কমিটি গঠন করে রোগীদের জন্য বাকিতে খাবার কিনছে। এই অবস্থায় হাসপাতালে সপ্তাহে মাত্র দুদিন রোগী ভর্তির সিদ্ধান্ত দিয়ে আদেশ জারি করেছে কর্র্তৃপক্ষ। অন্যদিকে, বিনামূল্যে চিকিৎসা ও খাবার পাওয়া রোগীদের ‘বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার’ও ব্যবস্থা করেছে। এসব খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো তৎপরতা দেখা না যাওয়া অগ্রহণযোগ্য।
১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশেষায়িত হাসপাতালটির অবস্থা আরও করুণ। শুরুতে হাসপাতালে মাত্র ৬০টি শয্যা ছিল। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে দুই দফায় শয্যাসংখ্যা বাড়িয়ে ১৫০ ও পরে ২০০ করা হয়। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে হাসপাতালটি ৫০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। বর্তমানে হাসপাতালে পাঁচটি নারী ওয়ার্ডসহ মোট ১৯টি ওয়ার্ড রয়েছে। মোট শয্যার ৩৫০টি বিনামূল্যের এবং বাকি ১৫০টিতে রোগীদের নিজ খরচে থাকতে হয়। নিজ খরচে থাকা রোগীদের দুই মাসের ওষুধ ও শয্যাভাড়া বাবদ ৮ হাজার ৫২৫ টাকা করে ১৭ হাজার ৫০ টাকা অগ্রিম পরিশোধ করতে হয়। বলাবাহুল্য, বিনামূল্যের রোগীদের খরচ সরকার বহন করে। যাদের সবাই দরিদ্র্য ও নিম্নবিত্ত ঘরের মানুষ। পাবনার মানসিক হাসপাতালে সারা দেশ থেকে রোগী আসে। প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ নতুন/পুরনো রোগী বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসেন। বহির্বিভাগে রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসার পাশাপাশি দুই মাস বা ষাট দিনের প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু আর্থিক সংকটে পড়ে সবার আগে বহির্বিভাগে রোগী দেখা ও বিনামূল্যের রোগী ভর্তি কমিয়ে দিয়েছে পাবনা মানসিক হাসপাতাল। মানসিক রোগের সরকারি চিকিৎসাসেবার এই করুণ দশার সুযোগ নিয়ে রাজধানীসহ জেলা পর্যায়ে গজিয়ে উঠেছে বিপুলসংখ্যক সাইনবোর্ডসর্বস্ব মনোরোগ চিকিৎসাকেন্দ্র/মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ইত্যাদি। কিন্তু এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি নেই। লাইসেন্সের শর্তানুযায়ী ১০ শয্যার বেসরকারি মানসিক হাসপাতাল চালাতে সার্বক্ষণিক তিনজন চিকিৎসক, ছয়জন নার্স ও তিনজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাখা বাধ্যতামূলক। শয্যা যত বেশি হবে, আনুপাতিক হারে এই সংখ্যা বাড়বে। বলাবাহুল্য বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালেই তা মানা হয় না। খেয়াল করা দরকার, আমাদের সমাজে মানসিক ভারসাম্যহীনদের ‘পাগল’ তকমা দিয়ে খুব সহজে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায়। তাই অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরাই যথাযথ চিকিৎসা চায় না। তার ওপর অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো রোগীদের সঙ্গে বেপরোয়া আচরণ করে। অনেক ক্ষেত্রে সুস্থ মানুষকে মানসিক রোগী আখ্যা দিয়ে ভুল চিকিৎসায় অসুস্থ করে তোলারও অভিযোগ আছে এমন বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। এই বাস্তবতা আমলে নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মানসিক চিকিৎসার বিষয়ে নজর দিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জবাবদিহি এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক মীর মশাররফ হোসেনের জন্ম কুষ্টিয়া জেলার লাহিনীপাড়ায় ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর। বাবা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন জমিদার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় কুষ্টিয়া স্কুলে। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করে কলকাতার কালীঘাট স্কুলে ভর্তি হন; কিন্তু লেখাপড়া আর বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। কর্মজীবনের শুরুতে প্রথমে তিনি বাবার জমিদারি দেখাশোনা করেন। পরে ফরিদপুর নবাব এস্টেটে চাকরি নেন এবং ১৮৮৫ সালে দেলদুয়ার এস্টেটের ম্যানেজার হন। একসময় চাকরি ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় চলে যান। ছাত্রাবস্থায় তিনি সংবাদ প্রভাকর ও কুমারখালীর গ্রামবার্তা প্রকাশিকার মফস্বল সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করেন। এখানেই তার সাহিত্যজীবনের শুরু। গ্রামবার্তার সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ ছিলেন তার সাহিত্যগুরু। তিনি ১৮৭৪ সালে আজিজননেহার ও ১৮৯০ সালে হিতকরী নামে দুটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। তিনি ছিলেন উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি বিষয়ে তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। কারবালার বিষাদময় কাহিনী অবলম্বনে ‘বিষাদসিন্ধু’ উপন্যাস লিখে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন। গতিশীল গদ্য রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। নাটক ও আত্মজৈবনিক উপন্যাসগুলোতে তিনি সমকালীন সমাজের অসংগতি ও সমস্যার ওপর তীক্ষè কটাক্ষপাত করেন। ১৯১২ সালে তিনি মারা যান।
ঢাকাসহ সারা দেশে তীব্র দাবদাহ চলছে। দফায় দফায় বিদ্যুৎ থাকছে না বাসা-বাড়ি, অফিস আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র। এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে।
বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে একটি মহল পরিস্থিতি ঘোলা করার চেষ্টায় আছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য এসেছে। আর ওই তথ্য পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তর নড়েচড়ে বসেছে। পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ শীর্ষ কর্তারা বৈঠক করেছেন। যেকোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সোমবার পুলিশের সব রেঞ্জ অফিস ও ইউনিট প্রধানদের কাছে বিশেষ নির্দেশনা পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
বিশেষ বার্তা পেয়ে ইউনিট প্রধান, রেঞ্জ ডিআইজি ও ৬৪ জেলার পুলিশ সুপাররা আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কঠোর নিরাপত্তা দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে কাজও শুরু করে দিয়েছে পুলিশ।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুতের সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি। এরই মধ্যে যেকোনো পরিস্থিতি এড়াতে আমরা সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ স্টেশনগুলো নিরাপত্তার আওতায় আনা হচ্ছে। এই জন্য আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সোমবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পুলিশের সব ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপারদের কাছে বিদ্যুৎ স্টেশনে নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি নজরদারি বাড়াতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। একটি মহল লোডশেডিংয়ের অজুহাতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে চাচ্ছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। যেসব এলাকায় বেশি বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে তারও একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
কয়েকটি জেলার পুলিশ সুপার দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, পুলিশ সদর দপ্তরের চিঠি পাওয়ার পর আমরা বিশেষ বৈঠক করছি। এলাকায় বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে তা সত্য। এ জন্য আমরা বেশ সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ অফিস ও স্টেশনগুলোর বিষয়ে থানার ওসিদের দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, লোডশেডিংয়ের অজুহাত তুলে বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে একটি বিশেষ মহল। প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাড়তি পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে থানার ওসিদের নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন জেলার পুলিশ সুপাররা। এমনকি বাড়তি ফোর্সও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
তা ছাড়া রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
বিদ্যুৎ অফিসের পাশাপাশি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তার বলয় গড়ে তুলতে ৫০ থানার ওসিদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
খন্দকার গোলাম ফারুক দেশ রূপান্তরকে জানান, বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে যাতে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সে জন্য আমরা সতর্ক আছি। বিদ্যুৎ স্টেশনগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো বাড়তি নিরাপত্তার আওতায় আনা হয়েছে। ইতিমধ্যে সবাইকে সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎসহ যেকোনো সমস্যা নিয়ে কোন মহল যাতে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য বিশেষ নজরদারি করা হচ্ছে। আশা করি বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটবে না। তারপরও পুলিশ সতর্ক আছে।
সূত্র জানায়, লোডশেডিংকে পুঁজি করে কেউ যাতে অপ্রীতিকর কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ নিতে না পারে, সে বিষয়ে নজর রাখতে বলা হয়েছে। নির্দেশনার পর সারা দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, বিদ্যুৎ অফিস, সাবস্টেশনসহ কেপিআই স্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের চেয়ে বৃদ্ধি করা হয়েছে। গোয়েন্দা কার্যক্রম ও পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা সমিতি বা কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকেও পুলিশকে চিঠি দিয়ে বাড়তি নিরাপত্তাও চাওয়া হয়েছে।
সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে প্রেম এরপর বিয়ে। দেড় বছরের দাম্পত্য জীবনে আট মাস ধরে চিত্রনায়িকা পরীমণি ও শরিফুল রাজের বনিবনা হচ্ছে না বলেই শোনা যাচ্ছে। চলছে টানাপোড়েন এবং সেই সংসার এখন ভাঙনের পথে। রাজের ফেসবুক থেকে অভিনেত্রী তানজিন তিশা, নাজিফা তুষি ও সুনেরাহ বিনতে কামালের কিছু ছবি ও ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর রাজের সঙ্গে পরীমণির মতপার্থক্য প্রকাশ্যে আসে। সব ছাপিয়ে যা এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
রবিবার একটি গণমাধ্যমের ‘লাইভ’ অনুষ্ঠানে এসে শরিফুল রাজ জানান, আপাতত তারা সেপারেশনে আছেন এবং তাদের আর একসাথে হওয়ার কোন সুযোগ নেই। পরীকে তিনি শ্রদ্ধা করেন জানিয়ে সবশেষে পরীমণির উদ্দেশ্যে রাজ বলেন, ‘বেবি, আই লাভ ইউ। যা-ই হোক না কেন, আনন্দে থেকো। আমরা আমাদের সন্তানকে ভালো রাখব।’
রাজের এমন মন্তব্যের উত্তর দিতে সোমবার রাতে গণমাধ্যমটির লাইভে এসে রাজের উদ্দেশ্যে পরীমণি বলেন, ‘গরু মেরে জুতা দান করার কোনো দরকার নেই। কেউ রেসপেক্ট করলে সেটা তার কার্যকলাপ দেখেই বোঝা যায়, মুখ ফুটে বলতে হয় না। আমাকে পাবলিকলি অপমান করে এরপর রেসপেক্ট দেখানোর কোনো দরকার নেই। আর আমার বাচ্চাকে নিয়ে এসব ইমোশনালি কোনো কথা শুনতে চাই না। এসব ইমোশনালি কথা মানুষকে গিলিয়ে লাভ নেই। মানুষ বুঝে।’
ফাঁস হওয়া ভিডিওগুলো পরী বলেন, ‘এত বছর ধরে তারা বন্ধু অথচ আমি জানতাম না। এসব সামনে আসার পর জানতে পারলাম। আর রাজ যতটা তার বন্ধুদের ইমেজ নিয়ে কনসার্ন তার পরিবার নিয়ে এতটাও কনসার্ন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি এমনিতে অনেক শান্তশিষ্ট। অনেকটা সাপের মতো, লেজে পাড়া না দিলে চুপচাপ থাকি কিন্তু আমার লেজে পাড়া দিলেই আমি ফুঁস করে উঠি আর তখন কামড় দিবই।’
সবশেষে পরী বলেন, ‘আমি চাই এসবের শেষ হোক। আমি আজকে এখানে এসে এসব বলতাম না। তুমিই (রাজ) আমাকে বাধ্য করেছ। এরকম অসুস্থ মানুষের সঙ্গে আমি আর থাকতে চাই না। আমি চাই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাজ আমাকে ডিভোর্স দিক।’
বছরে ৪০ কোটি ডলার পারিশ্রমিকের প্রস্তাব নিয়ে লিওনেল মেসির সংগে যোগাযোগ করছে আলো হিলাল। তারা মংগলবার চুক্তির ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে বলে জানিয়ে রেখেছে। কিন্তু মেসি তাদেরকে ২০২৪ পর্যন্ত প্রস্তাবটা পিছিয়ে দিতে বলেছেন বলে খবর দিয়েছে ফুটবল বিষয়ক ওয়েব পোর্টাল গোল ডটকম।
তবে সৌদি ক্লাব এ-ই প্রস্তাব এখনই গ্রহন না করলে আগামী বছর তা একই রকম থাকবে না বলে জানিয়েছে।
মেসি আসলে তার শৈশবের ক্লাবে আরো অন্তত এক বছর খেলতে চান। তাতে তার পারিশ্রমিক সৌদি ক্লাবের প্রস্তাবের ধারে কাছে না হলেও ক্ষতি নেই। জানা গেছে, বার্সা তাকে এক বছরে ১৩ মিলিয়েন ডলার পারিশ্রমিক প্রস্তাব করতে যাচ্ছে।
লা লিগা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পাওয়ায় মেসিকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেবে বার্সা। ধারনা করা হচ্ছে বুধ-বৃহস্পতিবারের মধ্যে এ ব্যাপারে একটা স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল বিশ্বের প্রায় সব দেশই। অধিকাংশ দেশই তাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। প্রতিবেশী ভারত ও শ্রীলঙ্কার নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির কথা প্রায় সবারই জানা, তারাও ইতিমধ্যে তাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে এসেছে। তবে ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। কোনোভাবেই নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সরকার। ফলাফল ভোক্তা মূল্যসূচকে (সিপিআই) বা মূল্যস্ফীতিতে ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড। মে মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সিপিআই ইনডেক্সে এ হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে।
গত ১ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করে সরকার। এ বাজেটের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আগামী অর্থবছরে সরকার কীভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য বাজেট প্রস্তাবে কোনো পদক্ষেপ না থাকলেও লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি পরাবাস্তব বাজেট। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা আসলে সম্ভব নয়। গত ১১ মাসে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মে মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। সে হিসাবে মূল্যস্ফীতি ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো, আগের বছরের মে মাসে যে পণ্য গড়ে ১০০ টাকা কিনতে হয়েছে, এ বছরের মে মাসে তা কিনতে হচ্ছে গড়ে ১০৯ টাকা ৯৪ পয়সায়। আরও পরিষ্কারভাবে বললে, ধরুন আগের বছরের একই সময়ে ৫০০ টাকার একটি নোটে কোনো ব্যক্তি পাঁচটি পণ্য কিনতে পেরেছিলেন। এ বছরের একই সময়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় এখন একই টাকায় তিনটি পণ্য কিনতে পারছেন। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়।
খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১ বছরে বেড়েছে ১১.৩২ শতাংশ : ২০২২ সালের মে মাসে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ, অথচ এ বছরের মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। এ বছরের এপ্রিল মাসেও খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ০৪ শতাংশ।
খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে এক বছরে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৬৪ শতাংশ : বিবিএসের তথ্য বলছে, সদ্য শেষ হওয়া মে মাসে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ হয়েছে। ২০২২ সালের মে মাসে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৬৩ দশমিক ৮২ শতাংশ বা ৬৪ শতাংশ।
গ্রামের চেয়ে শহরের মূল্যস্ফীতি বেশি : এক বছর আগেও শহরের মূল্যস্ফীতি গ্রামের চেয়ে কম ছিল। কারণ গ্রামের চেয়ে শহরে পণ্য মজুদের আধুনিক ব্যবস্থা আছে। তবে সরকারি উদ্যোগে শহরের মতো গ্রামেও কিছু স্থানে খাদ্যগুদামের ব্যবস্থা তৈরি হওয়ায় এখন শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতি কমেছে। মে মাসে শহর এলাকায় গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ, একই সময়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
বিশ্বে কমেছে মূল্যস্ফীতি, বাংলাদেশে বাড়ছে : গত শনিবার মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের (এমসিসিআই) বাজেট-পরবর্তী আলোচনায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ মূল্যস্ফীতি ইস্যুতে বলেন, বিশ্বের প্রায় সব দেশ সফলভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। শুধু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, থাইল্যান্ডে ২০২২ সালের জুনে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, গত এপ্রিলে তা নেমে এসেছে ২ দশমিক ৭ শতাংশে। অর্থাৎ আগের তুলনায় দেশটিতে মূল্যস্ফীতি কমেছে ৬৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে ২০২২ সালের জুনে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। সেখান থেকে ৪৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে আনতে সক্ষম হয়েছে তারা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের গত অক্টোবর মাসের মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, সেখান থেকে ৩৪ শতাংশ কমিয়ে ৭ শতাংশে আনতে সক্ষম হয়েছে ইইউ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি সুদহার বাড়িয়ে দেয়। তবে বাংলাদেশ এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় শুরুর দিকে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো গত বছর আগস্টে এক ঘোষণাতেই জ্বালানি তেলের দাম ৫১ শতাংশ বাড়ানো হয়। ওই মাসেই মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশ দেরিতে হলেও নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। বর্তমানে এ সুদহার ৬ দশমিক ২ শতাংশ। তবে নীতি সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে আভাস দিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল দাবি করেছে, বিশে^র দেশে দেশে মূল্যস্ফীতির যে হার, তা সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য হুমকি। মূল্যস্ফীতির এই হার ১২ বছর বা এক যুগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭-০৮ সালে বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
২০০৯ সালের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখনো মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপর ছিল। পরে অবশ্য তা কমতে কমতে সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে। দীর্ঘদিন ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে।
৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ঠিক এরকম এক সময়ে গত বছর ৫ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায়। এর পরপরই বাড়ানো হয় সব ধরনের পরিবহন ভাড়া। এ দুইয়ের প্রভাবে বেড়ে যায় প্রায় সব পণ্যের দাম। ফলে পরের মাস আগস্টে মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে ওঠে।
যদিও সেপ্টেম্বর থেকে তা কমতে থাকে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশে আসে। জানুয়ারিতে তা আরও কমে ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশে নেমে আসে। তবে রোজাকে সামনে রেখে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি। ফেব্রুয়ারি মাসে তা বেড়ে হয় ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মার্চ মাসে হয় ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এপ্রিলে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছিল।
মজুরি সূচক বেড়েছে : বিবিএসের তথ্য বলছে, গত কয়েক মাস ধরেই মজুরি সূচক অল্প অল্প করে বাড়ছে। অক্টোবরে এ হার ছিল ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। যা মে মাসে এসে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৩২ শতাংশে।
অবশেষে বন্ধ হয়ে গেল দেশের সর্ববৃহৎ পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন। গতকাল সোমবার দুপুরে কেন্দ্রটির দ্বিতীয় ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। কয়লা সংকটে গত ২৫ মে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট বন্ধ হয়। ২০২০ সালে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার পর এবারই প্রথম কয়লা সংকটে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন বন্ধ হলো।
চীন ও বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগের এই বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানটিকে কয়লা ক্রয়ে ঋণ দিয়ে আসছে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কোম্পানি (সিএমসি)। এপ্রিল পর্যন্ত কয়লার ৩৯০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দেয় সিএমসি। পরে ১০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হলে কয়লা আমদানির এলসি খোলার শর্ত দেয় চীনা প্রতিষ্ঠান। গতকাল পর্যন্ত ৯৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এ মাসের শেষদিকে কয়লা দেশে আসার কথা রয়েছে।
কয়লার অভাবে দেশের সবচেয়ে বড় এবং নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি এক মাসে লোকসান হবে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা। আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের কারণে জনদুর্ভোগ ও কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে পুরো ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি।
এদিকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দামের বাইরে শুধু কয়লাবাবদ পিডিবির কাছে কেন্দ্রটির বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে থাকা এ বকেয়ার টাকা পরিশোধের জন্য দফায় দফায় চিঠি দিয়েও তা পরিশোধ করা হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অবহেলার কারণেই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো নিজেদের দায় অস্বীকার করে বলছে, বৈশি^ক মন্দার পরিস্থিতিতে ডলার সংকটের কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, উৎপাদিত বিদ্যুতের দামের পাশাপাশি কেন্দ্রভাড়া বাবদ প্রতি মাসে পিডিবিকে ২৪৭ কোটি টাকা দিতে হবে। এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও নির্ধারিত কেন্দ্রভাড়া পরিশোধ করতে হবে পিডিবিকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, পিডিবির চাহিদা অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্নভাবে গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট করে প্রায় তিন কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছিল কেন্দ্রটি। প্রতি মাসে এর পরিমাণ ছিল ৯০ কোটি ইউনিট। গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বিক্রয়মূল্য ছিল ৫ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ৬ টাকার মতো।
প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফার প্রকৃত জানা না গেলেও নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানান, সব ধরনের ব্যয় বাদ দিয়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে তাদের নিট মুনাফা হতো ৫ থেকে ৬ শতাংশ। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড়মূল্য সাড়ে ৫ টাকা এবং মুনাফা সাড়ে ৫ শতাংশ বিবেচনায় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির এক মাসে মুনাফার পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা। কেন্দ্রটি বন্ধ থাকায় এ মুনাফা থেকে বঞ্চিত হবে বিসিপিসিএল। এদিকে কয়লা কেনার জন্য সাড়ে ৬ শতাংশ সুদে ঋণ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। গত ছয় মাসের বেশি সময় কয়লার বিল বকেয়া থাকায় সুদের পরিমাণও বেড়ে যাবে। বাড়তি এ সুদের অর্থ বিসিপিসিএলকেই পরিশোধ করতে হবে।
বর্তমানে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে পিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয়ের প্রতি ইউনিটের গড়মূল্য প্রায় ১১ টাকা ৫০ পয়সা। যদিও পিডিবি এ বিদ্যুৎ লোকসান দিয়ে বিতরণ কোম্পানির কাছে বিক্রি করছে ৮ টাকা ১০ পয়সায়। পায়রা থেকে এক মাস বিদ্যুৎ কিনতে না পারলে পিডিবির লোকসান আরও বাড়বে।
সূত্রমতে, কয়লা দেশে পৌঁছানো এবং কেন্দ্র চালু করতে সব মিলে অন্তত এক মাসের মতো সময় লাগবে। কোনো কারণে যদি কয়লা আসতে আরও দেরি হয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এএম খোরশেদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বিশে^র সেরা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। এক সুইচে চালু করার পর নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলেও বৈশি^ক কারণে ডলার সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে। এটা আমাদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক। তবে এ সময়ে আমরা বসে না থেকে কেন্দ্রের মেইনটেনেন্সের কাজটি করে ফেলব, যাতে দীর্ঘদিন আর মেইনটেনেন্স করা না লাগে।’
কেন্দ্রটি বন্ধের ফলে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হবে তা জানতে চাইলে প্ল্যান্ট ম্যানেজার শাহ আবদুল মওলা দেশ রূপান্তরকে বলেন ‘আমরা এমনিতেই বকেয়া বিল পাচ্ছি না। এটাই বড় ক্ষতি। অন্যান্য ক্ষতির পাশাপাশি কেন্দ্রটি বন্ধের কারণে সাশ্রয়ী দামে দেশের মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এ কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ সাড়ে ৫ থেকে ৬ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ দিতে না পেরে কমফোর্ড ফিল করছি না।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কেন্দ্র ভাড়ার পাশাপাশি লোডশেডিংয়ে মানুষের ভোগান্তি এবং কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিলেও এ ক্ষতির পরিমাণ অপূরণীয়। আর লোডশেডিং না দিয়ে সরকার যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়, তাহলে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো ছাড়া কোনো উপায় নেই এই মুহূর্তে। সে ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটে ৪ টাকার ওপর লোকসান হবে।’ তিনি বলেন, ‘ডলার ছাড় ঠিকই হচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রটি বন্ধ হওয়ার আগেই ডলার ছাড় করা উচিত ছিল। এতে বিরাট ক্ষতি হলো। এ ক্ষেত্রে দুটো বিষয় হতে পারে। একটি হলো যারা ডলার ছাড় করছেন তারা বিদ্যুৎ খাতের গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না অথবা দেশের পরিস্থিতি আসলেই ভয়াবহ। তবে দেশের উন্নয়নে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতকে অবশ্যই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জাকির হোসেন চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ডলার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের। আর বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে ডলার দেওয়া হয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে। এ ক্ষেত্রে খাতের গুরুত্ব বুঝে ডলার ছাড় করা হয়। তবে দেশের প্রয়োজনে ডলার ছাড় করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ধরনের গাফিলতি নেই।’
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।