
ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক মীর মশাররফ হোসেনের জন্ম কুষ্টিয়া জেলার লাহিনীপাড়ায় ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর। বাবা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন জমিদার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় কুষ্টিয়া স্কুলে। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করে কলকাতার কালীঘাট স্কুলে ভর্তি হন; কিন্তু লেখাপড়া আর বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। কর্মজীবনের শুরুতে প্রথমে তিনি বাবার জমিদারি দেখাশোনা করেন। পরে ফরিদপুর নবাব এস্টেটে চাকরি নেন এবং ১৮৮৫ সালে দেলদুয়ার এস্টেটের ম্যানেজার হন। একসময় চাকরি ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় চলে যান। ছাত্রাবস্থায় তিনি সংবাদ প্রভাকর ও কুমারখালীর গ্রামবার্তা প্রকাশিকার মফস্বল সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করেন। এখানেই তার সাহিত্যজীবনের শুরু। গ্রামবার্তার সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ ছিলেন তার সাহিত্যগুরু। তিনি ১৮৭৪ সালে আজিজননেহার ও ১৮৯০ সালে হিতকরী নামে দুটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। তিনি ছিলেন উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি বিষয়ে তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। কারবালার বিষাদময় কাহিনী অবলম্বনে ‘বিষাদসিন্ধু’ উপন্যাস লিখে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন। গতিশীল গদ্য রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। নাটক ও আত্মজৈবনিক উপন্যাসগুলোতে তিনি সমকালীন সমাজের অসংগতি ও সমস্যার ওপর তীক্ষè কটাক্ষপাত করেন। ১৯১২ সালে তিনি মারা যান।
ড. জাহিদ হোসেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি দীর্ঘদিন সাউথ এশিয়া ফাইনান্স অ্যান্ড পোভার্টি গ্রুপের মুখ্য অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেন। তিনি প্রায় ১৪ বছর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি ও অর্থনীতির চাপ সামলাতে আইএমএফ থেকে বাংলাদেশের ঋণ নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন এই অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশকে শর্তসাপেক্ষে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দেবে। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
ড. জাহিদ হোসেন : বর্তমানে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি একটা চাপের মধ্যে আছে। চাপটা দুটো জায়গায় বেশি। একটা হলো বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, মানে ডলারের অভাব। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে, চলতি খাতের অ্যাকাউন্ট ব্যাল্যান্স অব পেমেন্ট ডেফিসিট বেড়ে গিয়েছে। আরেকটা হলো মূল্যস্ফীতি, যদিও গত দু’মাসে সামান্য কমেছে, তারপরেও এটা অনেক বেশি। এই ধরনের চাপের মধ্যে আইএমএফের দ্বারস্থ হওয়া। আমরা যে শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থায় পড়েছি, তা না। আমরা খাদে পড়ার আগে, শ্রীলঙ্কা তো খাদের ভেতর থেকে গেছে। তো খাদে পড়ার আগে সংস্কার কর্মসূচির ভিত্তিতে যারা ম্যাক্রো ব্যবস্থাপনায় আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে, সেটা আইএমএফ। কাজেই তাদের সঙ্গে ৪২ মাস মেয়াদি একটা কর্মসূচির দিকে যাওয়া, এটা ম্যাক্রো ম্যানেজমেন্টের জন্য সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। আগামী ২০২৩ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে; প্রতি বছরে যদি অন্তত দুটো কিস্তি পাওয়া যায়, তাহলে প্রতি বছর ১০০ কোটি ডলারের মতো একটা অর্থের জোগানের জায়গা এখান থেকে তৈরি হচ্ছে। যদিও আমাদের সার্বিক ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি অনেক বেশি, সে তুলনায় এটা মোটা কোনো অঙ্ক না। তবে শূন্যের চেয়ে তো ভালো। সেদিক থেকে একটা স্বস্তির জায়গা তৈরি হচ্ছে।
দেশ রূপান্তর : শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে দেখলাম যে বিভিন্ন ঋণদাতার কিস্তির অর্থ পাওয়া নিয়ে শর্তপূরণ হাওয়া-না হওয়ার কারণে একটা টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছিল। যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। সেখানে আমরাও আইএমএফের কিস্তির টাকা পেতে একই সমস্যায় পড়তে পারি কিনা?
ড. জাহিদ হোসেন : শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে চায়না, জাপান থেকে ঋণ পাওয়া নিয়ে এ সমস্যা হয়েছিল। বন্ডেজ ঋণের ক্ষেত্রে হয়েছিল। তো আমাদের ক্ষেত্রে আইএমফের শর্তটা হলো সংস্কারের। এক্ষেত্রে আপনার সমস্যার গোড়ার কারণটা অ্যাড্রেস করতে হবে। আপনি আইএমএফ থেকে যে অর্থটা পাবেন সেটা সাময়িক ক্রাইসিস মোকাবিলা করার জন্য। এটা অনেকটা সময় কেনার মতো। মানে ওই সময়ের মধ্যে আমি গোড়ার সমস্যাগুলোর সমাধান করব, সংস্কারের মাধ্যমে। আমি ধরে নিচ্ছি তর্কের খাতিরে আইএমএফের শর্তগুলো গোড়ার সমস্যাগুলোর সমাধানযোগ্য শর্ত। এটাকেই সংস্কার বলা হচ্ছে। তো এটা যদি আপনি না করেন, তাহলে তো আপনি আসল সমস্যাকে অ্যাড্রেস করলেন না। মানে যে ওষুধটা আপনার খাওয়া দরকার সেটা যদি আপনি না খেয়ে কেবল প্যারাসিটামল খান তাহলে জ¦র কমলেও অসুখ তো সারবে না।
দেশ রূপান্তর : সংস্থাটি জানিয়েছে, কর্মসূচির উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার এবং দেশের সংহতি, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে সহায়তা করা। এ জন্য কাঠামোগত পরিবর্তনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্যে কী কী পড়ছে?
ড. জাহিদ হোসেন : এইখানেই হলো তথ্যের ঘাটতি। কারণ, আমরা জানি না আসলে আইএমএফের এই কর্মসূচিতে কী ধরনের সুনির্দিষ্ট সংস্কারকাজ করতে হবে। এখানে কিছু এরিয়া তারা চিহ্নিত করেছে। প্রেস রিলিজে যেমন বলেছে, রাজস্ব আদায়ে উন্নতি করতে হবে, সরকারি ব্যয় যৌক্তিকরণ করতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, মুদ্রানীতি আধুনিকায়ন করতে হবে। অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতি কমাতে আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ যাতে আসতে পারে সেজন্য পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তারপর জলবায়ু সহিষ্ণুতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। এখন এগুলো সবই তো আকাক্সক্ষা।
দেশ রূপান্তর : এগুলো তো অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা আগে থেকেই বলছেন। বাস্তবায়ন তো দেখা যায়নি।
ড. জাহিদ হোসেন : আইএমএফের কর্মসূচিতে আসলে কী আছে, সেটা পরিষ্কার না। আইএমএফ এসে এনবিআরের সঙ্গে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিটিং করেছে। তাদের সঙ্গে সমস্যাগুলো নিয়ে আলাপই হয়েছে, সেখানে তারা পরামর্শও দিয়ে গেছে। কিন্তু পরামর্শগুলোর মধ্যে কী এবং কোনগুলো তাদের তিন বছরের কর্মসূচিতে বাস্তবায়িত হবে, সেটা তো আমরা জানি না। আমরা কেবল জেনারেল কিছু আকাক্সক্ষার কথা জানি। সংবাদ সম্মেলনে যেটা বলেছে, গত চার বছরে বাজেটে অর্থমন্ত্রী যেসব সংস্কারের কথা বলেছেন ওইখান থেকে একটা মানদ- তৈরি করে আইএমএফের কর্মসূচির জন্য আমরা একটা রিফর্ম প্যাকেজ তৈরি করব। আইএমএফের প্রেস রিলিজে যেসব আকাক্সক্ষার কথা বলা হয়েছে তার সবই প্রতি বছরের বাজেট বক্তৃতায় পাবেন। ওখানেও তো সুর্নিদিষ্ট করে কিছু বলা নেই। প্রতিটি বাজেট বক্তৃতায় সুশাসন এবং সংস্কার বলে একটা চ্যাপ্টার থাকে। ব্যাংকিং সেক্টরে, এনার্জি খাতে, এনবিআরের জন্য, জলবায়ুর জন্য এই এই করব। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভর্তুকি, সামাজিক সুরক্ষা... মানে অনেক কিছু বলা থাকে; এখানে এটা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা কী? একটা উদাহরণ দিই, আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করার কথা বলছে। তার মানে কী? মন্দ ঋণের স্বীকৃতির জন্য এখন ১৮০ দিন অপেক্ষা করে। আগে তো এটা ৯০ দিন ছিল, আন্তর্জাতিক মানদ-ও ৯০ দিনের। একটা সুপারিশ ছিল যে এটাকে ১৮০ দিনের পরিবর্তে ৯০ দিনে নিয়ে আসা হোক। এটা তো একটা সুর্নিদিষ্ট পদক্ষেপ। তো এটা কি আইএমএফের সংস্কার কর্মসূচিতে আছে? সেটা তো জানি না। এরকম সুর্নিদিষ্ট কথা না জানলে আপনি, আমি কীভাবে বলব কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ বা কোনটা সম্ভব হবে, কোনটা অসম্ভব।
দেশ রূপান্তর : রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য আইএমএফ পরামর্শ দিয়েছে। সাধারণ ভোক্তাদের ওপর চাপ না দিয়ে রাজস্ব বাড়াতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
ড. জাহিদ হোসেন : এখানে তো অনেক লম্বা এজেন্ডা। পলিসির ব্যাপার আছে, অ্যাডমিনিস্ট্রিশনের ব্যাপার আছে। তারপরে সুশাসনের বিষয় আছে। পলিসির ক্ষেত্রে আইএমএফ ৬ মাস আগে নিয়মিত ভিজিটে দুই পৃষ্ঠার একটা নোট দিয়ে গিয়েছিল। সেখানে করের ক্ষেত্রে তারা ভ্যাট রেইটের কথা বলেছিল। বর্তমানে ভ্যাটের চারটা রেইট আছে। তারা বলেছিল এটাকে সরলীকরণ করে একটা রেইটের দিকে যেতে। এখনই যে করতে হবে তা না, কিন্তু সেদিকে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে বলেছে। কাস্টমসে, ইনকাম ট্যাক্সে, করপোরেট ট্যাক্সে সব ক্ষেত্রেই তো পলিসি রিফর্মেও প্রয়োজন আছে। আইএমএফের কর্মসূচিতে ট্যাক্স কালেকশন বাড়াতে কোন পলিসি তারা নিচ্ছে, যেটা আগামী ৩ বছরের মধ্যে করা সম্ভব, এটা হয়তো আমরা ফেব্রুয়ারিতে জানতে পারব।
দেশ রূপান্তর : রিজার্ভের কথা সরকার যেটা বলত, জানা গেল আইএমএফের হিসাবে সেটা অনেক কম। এতে একটা আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
ড. জাহিদ হোসেন : এখানে প্রথম কথা হলো সাদাকে সাদা বলা, কালোকে কালো। ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ কত আছে, হিসাবটা তো আপনাকে ঠিক মতো করতে হবে। এটা তো কারোর ব্যক্তিগত সম্পদ না। এটার প্রকাশটাও স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে হবে। আমরা যদি বলি আমার ৩৪ বিলিয়ন ডলার আছে, কিন্তু আসলে তো সেটা নেই। আইএমএফ বলার পর জানা গেল ২৬ বিলিয়ন। সঠিক হিসাব জানা সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতি নির্ধারকদেরও দরকার। খাদ্যমন্ত্রী যদি ভাবেন যে আমার তো ৩৬ বিলিয়ন রিজার্ভ আছে, কাজেই খাদ্য আমদানিতে সমস্যা হবে না। কিন্তু রিজার্ভ তো আছে ২৬ বিলিয়ন। যে টাকা আপনার ক্যাশ ফর্মে নেই, সেটা আপনি কেন বলবেন যে আছে। আপনার এক লাখ টাকা আছে, আমাকে ১০ হাজার দিলেন ধার। এখন যদি জানতে চাই আপনার হাতে কত টাকা আছে, আপনি কি বলবেন যে আপনার কাছে এক লাখ আছে, আপনার কাছে তো আছে ৯০ হাজার। শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলার ধার দিয়ে সেটাও হিসাবে দেখাচ্ছে যে তার আছে, এটা বলতে পারেন, কিন্তু সেটা তো সঠিক না।
দেশ রূপান্তর : অনেকে বলছেন ব্যাংকে টাকা রাখলে তা ফেরত পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ রয়েছে। পরিস্থিতি কি এতটাই খারাপ? ‘ব্যাংক রান’-এর সম্ভাবনা দেখছেন কি?
ড. জাহিদ হোসেন : বাংলাদেশের অবস্থা ওই পর্যায়ে গেছে বা যেতে পারে বলে আমার মনে হয় না। তার মানে এই না যে আপনার সমস্যা নেই। আসলে ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটের দুর্বলতার মাত্রা কতটুকু সেটা জানার জন্য আপনার দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের হিসাবটা ঠিক মতো করতে হবে। ছয় মাস আগের আইএমএফের যে ভিজিটের কথা বললাম, তখন তারা এটাও বলেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক ফাইনান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটির যে রিপোর্ট করে সেটাতে আগে দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের একটা সংখ্যা দিত। ২০১৮ সালের পর থেকে এটা আর দেওয়া হয় না। তাদের পরামর্শ ছিল, এই সংখ্যাটা সঠিকভাবে ক্যালকুলেট করা হোক এবং রিপোর্টে সেটা উল্লেখ করা হোক। তাহলেই তো আপনি যে প্রশ্নটা করেছেন, যে কোন ব্যাংকে টাকা রাখলে সেটা পেতে সমস্যা হবে জানা যেত। সব ব্যাংক তো খারাপ না। তথ্যের অস্বচ্ছতা থাকলে, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য থাকলে গুজবের জায়গা তৈরি হবে। স্বচ্ছ হিসাব প্রকাশ করা হলে গুজবের সুযোগ থাকবে না।
দেশ রূপান্তর : দেশের ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাবে বিশেষ সুবিধায় অনেকেই ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। পর্ষদ সদস্যরা প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন সময় ঋণ অনুমোদন করাচ্ছেন। সমঝোতার ভিত্তিতে এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে আইএমএফ। আপনার অভিমত কী?
ড. জাহিদ হোসেন : ব্যাংকের বোর্ডে যে পরিচালক নিয়োগ করা হয় সেখানে আমাদের ব্যাংকিং কোম্পানি আইনেই একটা প্রপার ক্রাইটেরিয়া বলে দেওয়া আছে। কোন ধরনের লোক, কোন ধরনের অভিজ্ঞতা, অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড, তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক বিবেচনায় এনেই তো আপনাকে নিয়োগ দিতে হবে। যাতে স্বার্থের সংঘাত তৈরি না হয়। অযোগ্য লোক যেন ওখানে না বসে। এটা রাষ্ট্রায়ত্ত এবং প্রাইভেট সব ব্যাংকের জন্য একটা কনসার্ন। এখানে আইএমএফ সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা মনে করি এই পরামর্শ বা প্রস্তাব আমাদের আর্থিক খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এটা কর্মসূচিতে আছে কি না সেটা দেখতে হবে। আপনি একজন ঋণদাতা, এখন আপনি আমাকে বললেন আপনার পর্ষদটা ঠিক করেন, কিন্তু আপনাকে আমি ঋণ যে কোনো অবস্থাতেই দেব, পর্ষদ ঠিক করেন বা না করেন। আমি কী করব? আপনি ঋণটা নিলেন কিন্তু পর্ষদ ঠিক করলেন না, তাহলে কী হবে? এখানে আইএমএফের সিরিয়াসনেসটা আরও বিশ^াসযোগ্য হবে যদি পরামর্শ ও প্রস্তাবগুলো কর্মসূচির ভেতরে থাকে।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর ইরানসহ সারা পৃথিবীতে ‘নৈতিক পুলিশি’ তথা শাসক গোষ্ঠীর এহেন আচরণের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বরাবরের মতো এবারও ইরানের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী বিক্ষোভকারীদের ওপর ব্যাপক মাত্রায় দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী এবারের বিক্ষোভে এই নভেম্বর পর্যন্ত তিনশ’র বেশি মানুষ মারা গেছে যার মধ্যে শিশুরাও আছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম অনুযায়ী এই বিক্ষোভে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করছে আর তাদের দমনের জন্য ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী মাত্রাতিরিক্ত শক্তির ব্যবহার করছে।
মাহসা আমিনি তেহরান ভ্রমণ করেছিলেন এবং ঠিকভাবে হিজাব পরিধান না করার কারণে ইরানের নৈতিক পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। অভিযোগ আছে নৈতিক পুলিশের নির্যাতনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বাইশ বছরের এই তরুণী। কর্র্তৃপক্ষ বলছে তার মৃত্যু হয় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম জানায়, গ্রেপ্তারের পর পুলিশের গাড়িতে তাকে নির্যাতন করা হয়। মাহসা আমিনি একজন কুর্দি তরুণী। ইরানের মতো সামাজিক বাস্তবতায় তার প্রান্তিকতা ন্যূনতম দ্বিমাত্রিক। এই শিয়া রক্ষণশীল শাসকগোষ্ঠীর কাছে তিনি একজন নারী, দ্বিতীয়ত, তিনি একজন কুর্দি নারী। কুর্দি জাতীগোষ্ঠীর ওপর বর্তমান ইরানের শাসক শ্রেণির ক্ষোভ ঐতিহাসিক। আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে সোচ্চার জাতিগত কুর্দি জনগোষ্ঠী ইরানের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১০ শতাংশ, যাদের একটি বড় অংশ সুন্নি মুসলিম। ইরানের শাসক গোষ্ঠী এখন চূড়ান্ত পর্যায়ের রক্ষণশীল। এই রক্ষণশীলতা যেন ইরান নামক রাষ্ট্র পরিচালনার তাদের বৈধতা তৈরি করে। আর এর সাফাই গাওয়ার জন্য শাসক গোষ্ঠী বলে থাকে তারা শুধু দেশের মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে লালন করছে। যেন দেশের মানুষই রক্ষণশীল সংস্কৃতি ধারণ করছে! জনগণকে বলির পাঠা বানাতে কী ভয়ংকর কথা।
মাহসা আমিনি এখন সারা পৃথিবীতে প্রতিবাদের প্রতীক। পৃথিবীর দেশে দেশে যখন তার এই অকাল মৃত্যু নিয়ে প্রতিবাদ হচ্ছে তখন স্বাভাবিকভাবেই ইরান একে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের চক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছে। ইরান মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শিল্প ও তেলসমৃদ্ধ দেশ। পশ্চিমাদের একের পর এক নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করে গত চার দশক বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের সফলতাও বেশ বিস্ময়ের উদ্রেক করে। পশ্চিমারা যখন ইরানের ওপর একের পর নিষেধাজ্ঞা দেয় তখন তারা রাশিয়ায় যুদ্ধ ড্রোন পাঠায় ইউক্রেনে হামলায় সহযোগিতা করার জন্য। তবে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা যে রাজনৈতিক তা নানা ধরনের ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত। একই সঙ্গে এই নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য যে ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যে সুন্নি অধ্যুষিত ক্ষমতা বলয়ের বিপরীতে ইরানকে কোণঠাসা করার চেষ্টা সেটাও প্রমাণিত। মাহসা আমিনির হত্যার প্রতিবাদ আন্দোলন শুধু নারীদের চলাফেরার স্বাধীনতা সম্পর্কিত আন্দোলনের সঙ্গে আর যুক্ত নেই; এটা ইরানের বর্তমান রেজিম-এর রক্ষণশীলতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ইরানের কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে আন্দোলনের তীব্রতা বেশি। বলা হচ্ছে এবারের বিক্ষোভের গভীরতা গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এতে নারীরা শুধু বিক্ষোভই করছে না, প্রতিবাদে জনসম্মুখে হিজাব খুলে ফেলছে, চুল কেটে ফেলছে।
১৭৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার এক মাসের মধ্যে আয়াতুল্লাহ খোমিনি ইরানের নারীদের জনসম্মুখে হিজাব পরা বাধ্য করে একিটি ডিক্রি জারি করেন। তখন থেকেই ইরানের নারীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে এবং একইভাবে অব্যাহত আছে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে শাসক গোষ্ঠীর চরম রক্ষণশীল আচরণ। মাহসা আমিনির ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যারা নিহত, আহত ও গ্রেপ্তার হয়েছেন তারাই এসব নৃশংসতার প্রমাণ। আর এই পরিপ্রেক্ষিতেই বলা যায়, মাহসা আমিনির হত্যার প্রতিবাদ পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক না কেন, এর পেছনে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই থাকুক না কেন, এর সবগুলোই সমর্থনযোগ্য। এখনকার পৃথিবীতে শাসক গোষ্ঠীর এমন আচরণ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য না এবং এটা প্রতিবাদের বাইরে থাকতে পারে না। যতদিন ইরানে এই ধরনের আচরণ অব্যাহত থাকবে তার বিরুদ্ধে সচেতন ও বিবেকবান মানুষের প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে হবে পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক না কেন। পৃথিবীতে এখনো যারা সব মানুষের অধিকারের প্রতি যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করতে পারে না তাদের অন্য যেকোনো রাজনীতির দোহাই দিয়ে নিজেদের অনৈতিক কাজের বৈধতা অর্জন করার কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকতে পারে না।
ইরানি বিপ্লবের একটি মজার দিক হলো, খোমেনি যখন বিদেশে বসে তার মতবাদ প্রচার করছিলেন সেই সময় তিনি অনেক ধর্মনিরপেক্ষ, বামপন্থি ও জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন পেয়েছিলেন। এর আগে পশ্চিমাদের সমর্থনপুষ্ট ইরানের শাহ আর্থ-সামাজিক কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন এবং তার কিছু সফলতাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সবার সমর্থন নিয়ে আয়াতুল্লাহ খোমেনি যখন ক্ষমতায় এলেন তখন ধীরে ধীরে সব সহযোগীকে ত্যাগ করলেন, বিপ্লব প্রথমে ছিল অসাম্য, বৈষম্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে; বিপ্লব পরবর্তীকালে হয়ে গেছে ইসলামি বিপ্লব। এ বছর ইরানি বিপ্লবের ৪৩ বছর পূর্ণ হলো। প্রায় অর্ধশতাব্দী পূর্ণ হলেও এটাই আবার প্রমাণ হলো সব বিপ্লব সব মানুষের জন্য কল্যাণকর না। প্রমাণ হলো বিপ্লবের কাঠামো ও কেন্দ্র যদি প্রগতিশীল না হয়, গণমানুষের পক্ষে না হয়, তার সুফল সাধারণ মানুষের পক্ষে যায় না। অনেক ক্ষেত্রে তারা শুধু গণমানুষের ভাবাবেগকে কাজে লাগায় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কিন্তু মানুষকে ক্ষমতার অংশীদার করে না। উপরন্তু এর হাত ধরে ভিন্ন পরিচয় এবং ভেদাভেদের সূত্র ধরে নতুন করে প্রান্তিকতা তৈরি হয়। ইরানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে যেখানে শিয়া ধর্মীয় অভিজাতরা আগের থেকে নিশ্চয়ই ভালো আছে কিন্তু সংকটটা অন্যদের।
বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে ইরানের প্রতি পশ্চিমাদের রুষ্ট হওয়ার কারণ আছে। শাহের আমলে তারা ছিল ইরানের তেল সম্পদের সুফলভোগী। শাহের পতনের পর ইরান ও ইরানের জনগণকে বিপদে ফেলার জন্য যারপরনাই এমন উদ্যোগ নিতে বাকি রাখেনি পশ্চিমারা। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে চলমান আন্দোলনের প্রতি প্রশ্চিমাদের সমর্থন আসলে কতটা ইরানের জনগণের পক্ষে? ইরানের জনগণের শক্তি ও সামর্থ্য আছে নিজেদের রাজনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তন নিয়ে আসার সেটা এখন বা আর কিছুদিন পরে এবং সেই শক্তির ওপর বিশ্বাস করেই বর্তমান আন্দোলনকে সমর্থন দিতে হবে। অন্যদিকে, ইরানের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী যদি তাদের এই গোঁড়ামি অব্যাহত রাখে তাহলে যে পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে শাহের বিরুদ্ধে জনগণ ফুঁসে উঠেছিল ঠিক তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। তখন আর পশ্চিমাদের দোষারোপ করে লাভ হবে না। ইরানের ক্ষমতাসীনদের বর্তমান আচরণ শুধু দেশের অভ্যন্তরে তাদের অবস্থানকে দুর্বল করবে না, পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরায়েলের আগ্রসনের পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের প্রতি যারা সহানুভূতিশীল ছিলেন তারাও ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নেবেন আর সেটাই হবে সময়ের বিচার। সময়ের এই বিচারে এখন ইরান ও পশ্চিমের দ্বৈরথে নতুন পরীক্ষা মাহসা আমিনি।
লেখক : উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
করোনার মতো ডেঙ্গুও ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে প্রায় দুইশ’র কাছাকাছি পৌঁছেছে। এটি দেশের ইতিহাসে এক বছরে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা। গত প্রায় এক মাস ধরে প্রতিদিন গড়ে চার থেকে পাঁচশ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। চলতি নভেম্বরের প্রথম ৯ দিনে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৭ হাজার জন এবং এই সময়ে মারা গেছেন ৪৬ জন। গত অক্টোবর মাসে দেশে ২১ হাজার ৯৩২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। মারা যান ৮৬ জন। রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি হলেও তা শুধু এখানেই থেমে নেই। এ বছর ৫০টি জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ ডেঙ্গু রোগীর যে হিসাব দিচ্ছে, বাস্তবে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সারা দেশে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে ডেঙ্গু বাংলাদেশে বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে আছে। ২০০০ সালের পর থেকে প্রতি বছর বহু মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে, মানুষ মারাও যাচ্ছে। করোনা মহামারী শুরুর বছর ২০২০ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কম ছিল। কিন্তু গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৮ হাজার ৪২৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। এর মধ্যে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। কিন্তু ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী কার্যকর কোনো উদ্যোগ স্বাস্থ্য বিভাগের বা অন্য কোনো বিভাগের নেই। তারা রুটিন মাফিক কাজ করছেন, মর্জিমাফিক কথা বলছেন। মানুষের জীবনের মূল্য না থাকলে যা হয় আর কি! দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, বর্ষার মৌসুম শেষ হলেও কমছে না ডেঙ্গুর প্রকোপ। গত বছর এ সময়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এলেও এ বছর আসেনি; বরং মৃত্যু আতঙ্ক ছড়িয়েই যাচ্ছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তারা সক্ষম হয়নি। তবে সিটি করপোরেশন বলছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তারা সফল এবং যেসব রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই করপোরেশন এলাকার বাইরে থেকে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসছেন। দেশে ডেঙ্গুর এই প্রাদুর্ভাব নতুন নয়। প্রতি বছর এই সময় সে রাজধানীসহ বিভিন্ন শহর দাপিয়ে বেড়ায়, প্রাণ কাড়ে প্রতি বছর ডেঙ্গুর খবর সংবাদপত্র জুড়ে থাকে। এবং প্রতি বছরই নিয়ম করে একই কথা ফিরে বলতে হয় : ডেঙ্গুর মোকাবিলায় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও স্বাস্থ্য দপ্তর কী কী করছে, কতটা করছে, ঠিকমতো ও ঠিক সময়ে করছে কি না। বর্ষার মৌসুম শুরুর আগে থেকে প্রস্তুত হয়ে থাকা জলাশয় ও যে-যে জায়গায় জল জমতে পারে, পূর্বানুমানে সেগুলো পরিষ্কার করার বন্দোবস্ত করা, জনবসতি জঞ্জালমুক্ত রাখা ও সর্বোপরি ডেঙ্গু, তার উপসর্গ ও চিকিৎসা নিয়ে তৃণমূল স্তরে গিয়ে প্রচার অভিযানÑ এগুলো উপেক্ষিতই থাকছে। প্রতি বছর একই অভিযোগ, একই অবহেলা, এ-ই কি তবে ভবিতব্য?
আমাদের দেশে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বাস্তবায়ন করা হয় না। এমনকি রুটিন কাজটাও ঠিকঠাক মতো করা হয় না। নগরীতে কিছু কিছু এলাকায় মাঝে মাঝে মশক নিধন ওষুধ ছিটানো হয়, মেয়র সাহেবরা হঠাৎ হঠাৎ দুচার জায়গা পরিভ্রমণ করে এক-দুজনকে জরিমানা করেন, হম্বিতম্বি করেন। এর বাইরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ কখনো দেখা যায় না। তবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবই সিটি করপোরেশন ও সরকারেরই দায়, এই মনোভাবও ক্ষতিকর। সচেতন হতে হবে নাগরিককেও। জ্বর মানেই তা ভাইরাল, এই মৌসুমে একটু-আধটু হয় বলে অবহেলাও নাগরিক অসচেতনতা, বাড়ির পাশে খোলা জায়গা নর্দমা বা বাগানে নিজেরাই জঞ্জাল ফেলা, ফুলের টব বা ডাবের খোলায় জল জমতে দেওয়াও নাগরিক কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় নয়। সরকারের ব্যবস্থাপনায় গলদ আছে ঠিক কথা, কিন্তু নাগরিক জীবনযাত্রায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনেক কিছুই কর্র্তৃপক্ষের সার্বিক নজরদারি এড়িয়ে যেতে পারে। যে কোনো মৃত্যুই বড় বেদনার, বিশেষ করে ডেঙ্গুতে শিশু, তরুণদের মৃত্যু। অথচ, আমরা যেন ধরেই নিয়েছি যে, প্রতি বছর বর্ষাকালে ও বর্ষার আগে-পরে কিছু প্রাণ অকালে ঝরে যাবে। তাই শহরের অজস্র জায়গাকে আমরা মশক বাহিনীর জন্য ‘অভয়ারণ্য’ হিসেবে গড়ে তুলেছি। রাজপথে খানাখন্দ, যত্রতত্র না-বোজানো গর্ত, তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। রাস্তার গর্তে বৃষ্টির জল জমে, জমা জলে দ্রুতলয়ে ডিম পাড়ে মশক বাহিনী। মশার ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে ভোর আর সন্ধ্যায় পায়ে হুল ফুটিয়ে যায়। একজন থেকে দশ জনের শরীরে ভাইরাস ছড়ালে রোগ ছড়ানোর দায়টা কার পথের, মশার, সিটি করপোরশেন, নাগরিকদের, না সরকারের?
আমরা সরকার আর সিটি করপোরেশনের ওপর আমাদের রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করি। পারলে লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। হ্যাঁ, তাদের ওপর হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়াই উচিত। কিন্তু নিজেদের দায়িত্বটাও কি আমরা কখনো ঠিকঠাক মতো পালন করি? নিয়ম করে সাফ করি নিজের বাড়ির ছাদের বা বারান্দার টবে, বালতিতে জমা জল? আমরা বাড়ির ময়লা ফেলি যেখানে সেখানে, ফুলদানির জল একভাবে পড়ে থাকে দিনের পর দিন। মাত্র আধ ইঞ্চি জমা জলেও ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়ার মশা ডিম পাড়ে, বছরভর এ নিয়ে কমবেশি প্রচার চালায় পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ। বর্ষা এলেই ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু নিয়ে নানা জায়গায় চোখে পড়ে বড় বড় হোর্ডিং, দেখেও কি দেখি আমরা? জ্বর হলেই, ‘ও কিছু না, ভাইরাল ফিভার’ ধরে নিই। হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা করাতে গড়িমসি করেন বহু মানুষ। সেটা তার নিজের জন্য, সেই সঙ্গে সবার জন্য বিপদ ডেকে আনে।
কভিডের একের পর এক ভয়ংকর ঢেউ, এতগুলো মর্মান্তিক মৃত্যু চোখের সামনে দেখেও আমরা বুঝলাম না যে, রোগপ্রতিরোধের উপায় আমাদের হাতেই আছে, তা প্রয়োগের ইচ্ছা আর উদ্যম থাকা দরকার। এবং সেই উদ্যম বজায় রাখতে হবে সারা বছর, সব কাজে। বড় বড় নির্মাণ করতে গিয়ে একটা এলাকার জলনিষ্কাশন ব্যবস্থা রুদ্ধ হয়ে যায়। যেসব চক্র বৈধ বা অবৈধ নির্মাণ করতে গিয়ে গোটা এলাকার মানুষকে এভাবে বিপদে ফেলে, সে সব ঘুঘুর বাসা ভাঙতে মাঝেমাঝে হুঙ্কার দিলে কাজ হয় না। বেআইনি নির্মাণের সঙ্গে শহরের জলনিষ্কাশন ব্যবস্থার শুধু নয়, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও নির্দিষ্ট নানা রোগব্যাধি প্রতিরোধের সম্পর্ক গভীর। বেআইনি নির্মাণকে ‘জনস্বাস্থ্য সমস্যা’ বলে দেখা দরকার।
রোগপ্রতিরোধে ব্যর্থতার ঝুলি নিয়েই দেশ এগোচ্ছে অনির্দিষ্ট গন্তব্যে। রাজনৈতিক সংঘাত বাড়ছে। শাসক দল শক্তি প্রয়োগের নীতি নিয়ে টিকে থাকতে চাইছে। কিন্তু মানুষের প্রাণরক্ষায় চোখে পড়ার মতো কোনো কর্মসূচি নেই। ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু প্রাণের সুরক্ষা আরও বড়। ডেঙ্গুর চিকিৎসায় রক্তের অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেট প্রায়শই অপরিহার্য। রোগী বাড়ছে, প্লাটিলেটের অভাবও দেখা দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দরকার পাড়া-মহল্লায় রক্তদান শিবির। ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল আপাতত ব্যস্ত বড় বড় জমায়েত করে নিজেদের জনপ্রিয়তার প্রমাণ দিতে। এতে কার কী লাভ? যে রোগীটা রক্তের অভাবে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, তার জন্য রক্তের ব্যবস্থা করা কি রাজনৈতিক দলগুলোর কর্তব্য নয়? কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে জনসমাবেশ করার চেয়ে যদি প্রতিটি হাসপাতালে কিংবা পাড়ায় পাড়ায় রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা যেত, তাহলে সত্যিকার অর্থে অনেক মানুষের উপকার হতো, অনেকের প্রাণ বাঁচত। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের বাঁচাতে রক্তের জন্য হাহাকার চলছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। লেখক: লেখক ও কলামিস্ট
দেশের মোট জনসংখ্যার ১৬ দশমিক ৮ শতাংশই কোনো না কোনো পর্যায়ের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। এই তথ্য সর্বশেষ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপের (২০১৮-১৯)। ওই জরিপ অনুসারে দেশের দুই কোটির বেশি মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত। কিন্তু এই বিশাল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সক্ষমতা দেশের মানসিক হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের নেই। পাবনা মানসিক হাসপাতাল দীর্ঘদিন ধরে দেশের একমাত্র বিশেষায়িত মানসিক হাসপাতাল হিসেবে সেবা দিয়ে আসছিল। দেশের সবচেয়ে পুরনো এই সরকারি মানসিক হাসপাতালটি অব্যবস্থাপনা-অনিয়মে বেহাল। পাবনার এই হাসপাতালের ওপর চাপ কমানো আর চিকিৎসা ও নীতি গবেষণার জন্য ১৯৮১ সালে রাজধানী ঢাকায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইএমএইচ) প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের কিছু সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা চালু আছে। সামরিক হাসপাতাল ও সশস্ত্র বাহিনীর মেডিকেল কলেজেও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা আছে। এসব হাসপাতালের সম্মিলিত সক্ষমতাও প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। তাই প্রশ্ন উঠছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কেন মনোরোগ চিকিৎসার বিষয়ে এতটা উদাসীন?
মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার বিষয়ে সরকারের উদাসীনতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তার সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত পাবনা মানসিক হাসপাতালের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় দেখা যাচ্ছে। শনিবার দেশ রূপান্তরে ‘৪ মাস ধরে ধারদেনায় খাবার সরবরাহ’ শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চার মাসেরও বেশি সময় ধরে ধারদেনা করে খাওয়ানো হচ্ছে পাবনা মানসিক হাসপাতালের আবাসিক রোগীদের। অন্যদিকে, পাওনাদারের কাছে হাসপাতালের বকেয়া প্রায় ৭০ লাখ টাকা। জানা গেছে, আবাসিক রোগীদের খাবার ও ওষুধ সরবরাহের দরপত্রে ‘উপকরণের নাম উল্লেখ নেই’ অজুহাতে মামলা করে রোজ এন্টারপ্রাইজ নামে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। মামলায় টেন্ডার প্রক্রিয়ায় নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত। কিন্তু মামলা খারিজের দুই মাস পেরুলেও নতুন করে টেন্ডার না হওয়ায় খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ঠিকাদার। হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ গত জুলাই থেকে বিশেষ কমিটি গঠন করে রোগীদের জন্য বাকিতে খাবার কিনছে। এই অবস্থায় হাসপাতালে সপ্তাহে মাত্র দুদিন রোগী ভর্তির সিদ্ধান্ত দিয়ে আদেশ জারি করেছে কর্র্তৃপক্ষ। অন্যদিকে, বিনামূল্যে চিকিৎসা ও খাবার পাওয়া রোগীদের ‘বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার’ও ব্যবস্থা করেছে। এসব খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো তৎপরতা দেখা না যাওয়া অগ্রহণযোগ্য।
১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশেষায়িত হাসপাতালটির অবস্থা আরও করুণ। শুরুতে হাসপাতালে মাত্র ৬০টি শয্যা ছিল। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে দুই দফায় শয্যাসংখ্যা বাড়িয়ে ১৫০ ও পরে ২০০ করা হয়। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে হাসপাতালটি ৫০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। বর্তমানে হাসপাতালে পাঁচটি নারী ওয়ার্ডসহ মোট ১৯টি ওয়ার্ড রয়েছে। মোট শয্যার ৩৫০টি বিনামূল্যের এবং বাকি ১৫০টিতে রোগীদের নিজ খরচে থাকতে হয়। নিজ খরচে থাকা রোগীদের দুই মাসের ওষুধ ও শয্যাভাড়া বাবদ ৮ হাজার ৫২৫ টাকা করে ১৭ হাজার ৫০ টাকা অগ্রিম পরিশোধ করতে হয়। বলাবাহুল্য, বিনামূল্যের রোগীদের খরচ সরকার বহন করে। যাদের সবাই দরিদ্র্য ও নিম্নবিত্ত ঘরের মানুষ। পাবনার মানসিক হাসপাতালে সারা দেশ থেকে রোগী আসে। প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ নতুন/পুরনো রোগী বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসেন। বহির্বিভাগে রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসার পাশাপাশি দুই মাস বা ষাট দিনের প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হয়। কিন্তু আর্থিক সংকটে পড়ে সবার আগে বহির্বিভাগে রোগী দেখা ও বিনামূল্যের রোগী ভর্তি কমিয়ে দিয়েছে পাবনা মানসিক হাসপাতাল। মানসিক রোগের সরকারি চিকিৎসাসেবার এই করুণ দশার সুযোগ নিয়ে রাজধানীসহ জেলা পর্যায়ে গজিয়ে উঠেছে বিপুলসংখ্যক সাইনবোর্ডসর্বস্ব মনোরোগ চিকিৎসাকেন্দ্র/মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ইত্যাদি। কিন্তু এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি নেই। লাইসেন্সের শর্তানুযায়ী ১০ শয্যার বেসরকারি মানসিক হাসপাতাল চালাতে সার্বক্ষণিক তিনজন চিকিৎসক, ছয়জন নার্স ও তিনজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাখা বাধ্যতামূলক। শয্যা যত বেশি হবে, আনুপাতিক হারে এই সংখ্যা বাড়বে। বলাবাহুল্য বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালেই তা মানা হয় না। খেয়াল করা দরকার, আমাদের সমাজে মানসিক ভারসাম্যহীনদের ‘পাগল’ তকমা দিয়ে খুব সহজে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায়। তাই অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরাই যথাযথ চিকিৎসা চায় না। তার ওপর অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো রোগীদের সঙ্গে বেপরোয়া আচরণ করে। অনেক ক্ষেত্রে সুস্থ মানুষকে মানসিক রোগী আখ্যা দিয়ে ভুল চিকিৎসায় অসুস্থ করে তোলারও অভিযোগ আছে এমন বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। এই বাস্তবতা আমলে নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মানসিক চিকিৎসার বিষয়ে নজর দিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জবাবদিহি এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এমন কিছু চরিত্র আছে, যারা সব সময়ই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, ক্ষেত্র বিশেষে এরা নীতিনির্ধারকও হয়ে ওঠে। ক্ষমতার মধু আহরণে এরা সামনের কাতারে থাকলেও, পালাবদলের আগেই ওরা রূপ পাল্টাতে শুরু করে! ওদের কাছে কি কোনো বার্তা আছে বদলে যাওয়া বা বদলে ফেলার বার্তা?
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসের মাটিতে কেমন যেন একটা তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হতাশা, অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, এরাও যেন দৃশ্যপটে আসতে শুরু করেছে। রূপ পাল্টে যারা আওয়ামী সেজে এতদিন চারদিক দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন, খোলস পাল্টাতে এদের কেউ কেউ প্রস্তুতি শুরু করেছেন, প্রবাসের মাটিতে এরা রূপ পাল্টিয়ে ইতিমধ্যে নতুন রূপ ধারণ করতে শুরু করেছেন। এরা কি তাহলে নতুন কোনো আগমনী বার্তায় উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন? কী সেই বার্তা? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তনের বার্তা দেওয়ার মালিক জনগণ, আর তার একমাত্র উপায় গণভোট। এখনো সেই গণভোটের বাকি এক বছর, তাহলে বসন্তের কোকিলদের মাঝে এত দৌড়ঝাঁপ কেন?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দাতা নামের লগ্নিকারকদের দারুণ প্রভাব। সরকার ও রাজনীতিতে আড়ালে-আবডালে এরা নানাভাবে কলকাঠি নাড়ে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, উন্নয়ন অংশীদার বা দাতা পরিচয়ে এরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির নানারকম কর্মকা- চালায়। সোজাসাপ্টা ভাষায়, আমরা যাদের ডিপ্লোমেট বা কূটনীতিক নামে চিনি, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী এদের কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকা- নিয়ে সরব হওয়ার সুযোগ নেই। তবুও দরিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়েও এরা তৎপর হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে মানবাধিকারের নামে চাপাচাপির বার্তা চালায়।
প্রকৃত অর্থে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, নিষেধাজ্ঞার খড়্গ আসতেই পারে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো, তাদের মানবাধিকার তখন জাগ্রত হলো না!
একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আইভী রহমানসহ যারা নিহত হলেন, তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হলো, পার্লামেন্টারিয়ান আহসান উল্লাহ মাস্টার, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া নিহত হলেন, তখনো এদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না! সাঈদীকে চাঁদ দেখার গুজব রটিয়ে শত শত মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে অঙ্গার হয়ে অসার দেহ পড়ে থাকল, তখনো তাদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না!
একুশ বছরে বিকৃত ইতিহাস জেনে গড়ে উঠে একটি প্রজন্ম। এই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস-ই সত্যরূপে আবির্ভূত হয়। গত এক যুগে একাত্তরের পরাজিত আদর্শের অনুসারী একদল সুবিধাবাদী রঙ পাল্টিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এই ধারাটি শুধু দেশে নয়, প্রবাসের মাটিতেও সক্রিয় ছিল। কূটনীতিকদের লম্ফঝম্ফ দেখে এরা আবারও রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে। এতদিন ‘জয়বাংলা’ বলে যারা হুঙ্কার ছেড়েছিল, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে তাদের আপত্তি!
অগ্নিঝরা মার্চ আর বিজয়ের ডিসেম্বর! এ মাস দুটি বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জনের মাস। তবুও এ মাসগুলোতেই যেন কিছু মানুষের হৃদয়ের দহন বেড়ে যায়! যন্ত্রণায় এদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। অন্তরাত্মাকে শীতল করতে এরা প্রচন্ড প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। এর অন্তরালে কাজ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার এক সুদূরপ্রসারী হীন প্রচেষ্টা। এই ঘৃণ্য অপশক্তির প্রথম টার্গেট ছিল ১৫ আগস্ট।
একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল দিন। পনেরো আগস্ট, ৩ নভেম্বর বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কময় দিবস। প্রবাসে থাকলেও এসব দিবসে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারি না। ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ থেকেই নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করি। ২০২২-এর বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আয়োজকদের মতে, প্রবাসের নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকশিত করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। উপস্থিত বারোজন সংবর্ধিত মুক্তিযোদ্ধার একজন বাদে কেউই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলেননি! এ মহান নেতার নামটিও উচ্চারণ করেননি। সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুকে এড়িয়ে চলার এমন হীন চেষ্টা দেখে বিস্মিত হয়েছি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছেন, বিশ্বব্যাংককে অবজ্ঞা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, ফ্লাইওভারের মতো বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে রাত-দিন কাজ করছেন, তবুও চারদিকে এত ষড়যন্ত্র কেন?
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির নায়ক শাসক দলের ব্যাপক ক্ষমতাবান নেতাদের মুহূর্তে কপর্দকহীন করে শেখ হাসিনা তাদের আইনের মুখোমুখি করেছেন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজ চক্র, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে রেল আর সড়ক যোগাযোগে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট, পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত অবধি বিস্তৃত হচ্ছে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, গড়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে স্টেশনসহ বড় বড় মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। এতসবের পরও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। আবারও বঙ্গবন্ধুর নামকে মুছে দিতে দেশি-বিদেশি লম্ফঝম্ফ দৃশ্যমান হচ্ছে! স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধারণ করেই এই ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। যারা বঙ্গবন্ধুকে বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, এরা দেশপ্রেমের ছদ্মাবরণে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সোল এজেন্ট, এদের রুখতেই হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়ন গবেষক
ক্যালগেরি, কানাডা
ভারতীয় পারিবারিক হিন্দি চলচ্চিত্র ‘অভিমান’। ১৯৭৩ সালের সাড়া জাগানো এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন প্রখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন ও জয়া ভাদুড়ি। অর্ধশত বছর পার করলেও অভিমানের আবেদন এখনো অটুট। লিখেছেন নাসরিন শওকত
অমিতাভ-জয়া জুটি
১৯৬৯ সালে ‘সাত হিন্দুস্থানি’ চলচ্চিত্র দিয়ে বলিউডে অভিষেক হয় অমিতাভ বচ্চনের। তখন একের পর এক চলচ্চিত্র মুখ থুবড়ে পড়ায় বলিউডে অস্তিত্ব¡ সংকটের মুখে পড়েন অভিনেতা। ঠিক তখনই মুক্তি পায় ‘দিওয়ার’। অমিতাভের সেই ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ ইমেজে মজেন ভারতীয়রা। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বলিউডের আজকের ‘শাহেনশাহ’ এবং মেগাসুপারস্টার বিগ বি’কে। অন্যদিকে নায়িকা হিসেবে জয়ার ক্যারিয়ার শুরু হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘গুড্ডি’ (১৯৭১ সালে) চলচ্চিত্র দিয়ে। অমিতাভের সঙ্গে একাধিক ছবিতে কাজ করেছেন তিনি, যার মধ্যে অন্যতম ‘জাঞ্জির’, ‘চুপকে চুপকে’, ‘অভিমান’, ‘মিলি’, ‘শোলে’, ‘সিলসিলা’।
একসময় বলিউডের চলচ্চিত্রশিল্পে অমিতাভ-জয়ার প্রেম ছিল চর্চিত বিষয়। অমিতাভ বচ্চন যখন ক্যারিয়ার শুরু করেন, ততদিনে জয়া ভাদুড়ি প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী। ১৯৭১ সালে যখন ‘গুড্ডি’ মুক্তি পায়, তখন থেকেই অমিতাভের সঙ্গে জয়ার প্রেমের সূত্রপাত। শোনা যায়, ওই চলচ্চিত্রের সেট থেকেই জয়ার প্রতি অনুরাগের শুরু তার। এরপর ‘এক নজর’ চলচ্চিত্রে কাজ করতে গিয়ে জয়াতে নিজেকে হারান অমিতাভ। পরে ‘জঞ্জির’ বক্স অফিসে সাফল্য পেলে লন্ডন বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন এই জুটি। পরিকল্পনা অনুযায়ী লন্ডনের টিকিট কেটে ফেলেন অমিতাভ ও জয়া। কিন্তু তাদের লন্ডন ভ্রমণে বাধা হয়ে দাঁড়ান স্বয়ং অমিতাভের বাবা হরিবংশ রাই বচ্চন। ছেলেকে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, বিয়ে না করে একসঙ্গে বিদেশে বেড়াতে যাওয়া যাবে না কোনোভাবেই।
বাবার নির্দেশ অনুয়ায়ী, পরদিন সকালে পরিবার ও বন্ধুদের খবর দেওয়া হয়। ডেকে আনা হয় পুরোহিতকে। রাতে লন্ডনের বিমানে ওঠার কথা ছিল দুজনের। তাই ওই দিন সকালে একেবারে সাদাসিদেভাবে অমিতাভ-জয়ার বিয়ের আসর বসে। বরের পোশাক পরেই অমিতাভ গাড়ি চালিয়ে গিয়ে মালাবার হিলস থেকে তুলে আনেন জয়াকে। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই (১৯৭৩ সালের ৩ জুন ) বিয়ে হয়ে যায় তাদের। বিয়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নবদম্পতি রাতে লন্ডনের বিমানে ওঠেন। বিয়ের ১ বছর পর (১৯৭৪ সালে) প্রথম সন্তানের মা হন জয়া বচ্চন। মেয়ের নাম রাখেন শে^তা। এর দুবছর পর জন্ম হয় ছেলে অভিষেকের। বিয়ের পর একেবারে সংসারী হয়ে ওঠেন জয়া। অভিনয় জীবন থেকে লম্বা বিরতি নেন। মন দেন দুই সন্তান শ্বেতা ও অভিষেককে বড় করার দিকে।
অমিতাভ-জয়াকে বলিউডের অন্যতম আদর্শ দম্পতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেখতে দেখতে দাম্পত্যেরও অর্ধশত বছর পার করেছেন তারা। বর্তমানে ৩ নাতি-নাতনি নিয়ে সুখের সংসার তাদের। অভিষেক-ঐশ্বর্যের মেয়ে আরাধ্য। অন্যদিকে শে^তা বচ্চন নন্দার দুই ছেলেমেয়ে অগাস্ত্য ও নভ্যা নভেলি নন্দা। দীর্ঘ এই দাম্পত্য জীবনে বহু চড়াই-উতরাইয়ের সাক্ষী থেকেছেন অমিতাভ-জয়া। তারপরও শক্ত করে ধরে রেখেছেন একে অপরের হাত ।
সুপারহিট ‘অভিমান’
বাঙালি পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘অভিমান’ নির্মিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। যেখানে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন অমিতাভ বচ্চন ও জয়া ভাদুড়ি। পরিচালক হৃষিকেশ অমিতাভকে তার স্ত্রী জয়ার সঙ্গে জুটি বাঁধিয়েছিলেন, যে জুটি চুটিয়ে প্রেম করছেন তখন । অভিমান মুক্তির এক মাস আগেই বিয়ে করেন তারা। কিন্তু এরই মধ্যে রুপালি পর্দার নবদম্পতির ব্যক্তিত্বের সংঘাত বাস্তব জীবনে সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তবে জয়া উমা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জেতেন।
‘অভিমান’-এর বাণিজ্যিক সাফল্যের কথা হয়তো পরিচালক হৃষিকেশের মাথায় আগে থেকেই ছিল (বাস্তবের অভিমান সব শ্রেণির দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়)। কিন্তু চলচ্চিত্রটিতে ঠুনকো অহংকার ও ভঙ্গুর মানসিকতার কারণে সৃষ্টি হয় দাম্পত্য কলহ, যার সহজাত কিন্তু গভীর উপলব্ধির পুঙ্খানুপঙ্খ চিত্রায়নের মধ্যেই মূলত লুকিয়ে ছিল এর স্থায়ী আবেদন ।
অভিমানে অমিতাভ ‘সুবির’ নামের এক গায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন, যিনি পপগানের জন্য সবার কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। স্টেজে তাকে বিখ্যাত গায়ক কিশোর কুমার ও মোহাম্মদ রফির কণ্ঠে গাওয়া নানা সুপারহিট গান গাইতে দেখা যায়। মাঝরাতে উন্মত্ত নারী অনুরাগীদের টেলিফোন কলের জ¦ালাতন এবং চিত্রার মতো ধনী ও অভিজাত বান্ধবীর তার প্রতি গভীর অনুরাগ থাকা সত্ত্বেও ওই গানের নিঃসঙ্গতার মতোই সুবীর নিজেকে বড্ড একা অনুভব করে। এমন একসময়েই সুবীর তার প্রিয় মাসি দুর্গা মৌসির (দুর্গা খোটে) দূরের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যায়। যেখানে ঘটনাচক্রে এক শাস্ত্রীয় সংগীতকারের মেয়ে উমার (জয়া ভাদুরী) সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সুবীর প্রথমে উমার শিববন্দনার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং একসময় সে উমার প্রতিও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।
মজার বিয়ষ হলো, এই দম্পতি যে তখন বাস্তব জীবনেও একে অপরের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, পরিচালক হৃষিকেশ সূক্ষ্মভাবে অভিমানের মধ্য দিয়েই ভিন্ন আঙ্গিকে তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সুবীরের পরামর্শে উমা মঞ্চে তার সঙ্গে একটি দ্বৈত গান গাইতে রাজি হয়। পরে সে একক গানের প্রস্তাব পেয়ে আপ্লুত হয়ে পড়ে। কিন্তু ঘটনাচক্রে উমা যখন জনপ্রিয়তায় তাকে ছাড়িয়ে যায়, তখন সুবীর মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে ও স্ত্রীর প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে ওঠে। এই কয়েক দৃশ্যে পরিচালক হৃষিকেশ এই দম্পতির মধ্যকার বৈপরীত্যকে গভীর মমতায় সেলুলয়েডে তুলে আনেন।
চলচ্চিত্রটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি দৃশ্যে অন্তজর্¦ালায় জ¦লতে থাকা সুবীরকে (যে কিনা এরই মধ্যে চিত্রার বাড়িতে সময় কাটানো শুরু করেছে) বলতে শোনা যায়, ‘প্রথমেও একাই ছিলাম, আজও একাই আছি।’ তখন চিত্রা উপলব্ধি করে, একাকিত্ব হলো নিজের সৃষ্ট এক ব্যথা, যার জন্ম ছোট ছোট অভিমান আর অহংকার থেকে।
এ সময় উমা স্বেচ্ছায় গান গাওয়া বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এরই মধ্যে সুবীরের ক্ষতবিক্ষত মন আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এমনই এক চরম মুহূর্তে উমাকে সে বলে বসে, তাকে আর তার প্রয়োজন নেই। সুবীরের সন্তানকে গর্ভে নিয়ে উমা তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসে। চরম এক বিপর্যয়ের মুহূর্তে উমা তার সন্তানকে হারায়। একপর্যায়ে অনুতপ্ত হয়ে উমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনে সুবীর। কিন্তু শোকে কাতর উমা একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়। তখন উমার নীরবতা ভাঙার জন্য দিশেহারা হয়ে পড়ে সুবীর। শেষ পর্যন্ত স্টেজ শো করে তাদের দুজনের প্রিয় গান গায় (তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে র্যায়না), যা উমাকে স্বামীর ভালোবাসায় ফিরিয়ে আনে আবার। সুবীর উমাকে আবার গান গাইতে অনুরোধ করে।
অমিতাভ-জয়ার দুর্দান্ত অভিনয়ই অভিমানের প্রাণশক্তি। প্রাথমিক অবস্থায় চলচ্চিত্রটির নাম রাখা হয় ‘রাগ রাগিনী’। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরিচালক হৃষিকেশ এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘অভিমান’। চলচ্চিত্রটি মুক্তির মাত্র এক মাস আগে অমিতাভ বচ্চন ও জয়া ভাদুড়ি বিয়ে করেন। তাই এর প্রথম দিকের দৃশ্যগুলোতে এই দম্পতিকে বিয়ের প্রাথমিক ঘনিষ্ঠতা উপভোগ করতে দেখা যায়, যা ছিল জীবনঘনিষ্ঠ। এর সংগীত পরিচালক ছিলেন এস ডি বর্মণ।
অভিমান-এর পোস্টমর্টেম
১৯৮০-র দশকের শুরুর দিককার কথা। তখন বলিউডে বারবার অ্যাকশন হিরোর চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক সফলতা পাওয়ায় ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ ইমেজ গড়ে ওঠে অমিতাভের। তখন ‘দিওয়ার’, ‘শোলে’ ও ‘জাঞ্জির’-এর মতো ব্যবসাসফল অ্যাকশন চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, সে সময়ের সংগীতের নাটকীয়তাকে ঘিরে এক নবদম্পতির ঈর্ষাপরায়ণতা, ভালোবাসা ও মান-অভিমানের কাহিনি নিয়ে নির্মিত ‘অভিমান’ ছিল অমিতাভ অভিনীত সবচেয়ে ভালো চরিত্রগুলোর মধ্যে একটি।
‘অভিমান’ এবছর অর্ধশত বছর পূর্ণ করেছে। ১৯৭৩ সালে অমিতাভের কমপক্ষে অর্ধ ডজন চলচ্চিত্র মুক্তি পায়, যার মধ্যে ‘অভিমান’ একটি। এই তালিকায় রয়েছে ‘সওদাগর’, যেটি আনুষ্ঠানিকভাবে সে বছর ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে অস্কারে যায় এবং আরেকটি ছিল ‘জাঞ্জির’, ব্লকবাস্টার এই চলচ্চিত্রটি অমিতাভকে ভারতের শীর্ষ ‘অ্যাকশন হিরো’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। কিন্তু চলচ্চিত্র সমালোচক ও লেখক শৈবাল চট্টোপাধ্যায় সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেছেন, ‘‘অভিমান’ ছিল ওই বছরের সবচেয়ে আলোচিত চলচ্চিত্র এবং সে বছরে তার (অমিতাভ) সবচেয়ে বড় হিট চলচ্চিত্রও’’। ‘অভিমান’ দেখতে ভক্তরা দলে দলে ছুটে যান সিনেমা হলগুলোতে। বাবা-মা এবং ছোট বাচ্চাসহ পুরো পরিবারে ভরে যায় থিয়েটারগুলো। সমান তালে ভিড় থাকে ম্যাটিনি ও সান্ধ্য শোতে।
বছরের পর বছর ধরে চলচ্চিত্র শিল্পের ভক্ত, সমালোচক এবং বচ্চন দম্পতির সহকর্মীদের কাছ থেকে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে ‘অভিমান’। অমিতাভ বচ্চন নিজেও সুযোগ পেলেই ‘অভিমান’-এর প্রতি তার ভালোবাসার কথা উল্লেখ করেন। একবার তিনি বলেছিলেন, ‘এটি সেই চলচ্চিত্র, যা আমাদের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় সৃজনশীল কাজ করাতে জয়া ও আমাকে একত্রিত করেছে এবং এর গানগুলো কোনোভাবেই ভোলার নয়। অনেকের কাছেই এখনো তা স্বপ্নের মতোই।’
লেখক শৈবাল চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘ ‘অভিমান’কে সব সময় বচ্চনের ক্যারিয়ারের ‘একটি শীর্ষ সময়’ হিসেবে আলোচনা করতে হবে। কারণ এটি ছিল এমন একটি চলচ্চিত্র, যেখানে তাকে গতানুগতিক পৌরুষদীপ্ত, তেজী বা রাগী যুবক হিসেবে তুলে ধরা হয়নি। এটি এমন একটি চরিত্র ছিল, যেখানে তার ভিন্ন এক রূপ দেখানো হয়েছে। সেখানে তিনি একজন সত্যিকারের নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, একজন সত্যিকারের মানুষ যিনি নিরাপত্তাহীনতায় ঈর্ষাকাতর হয়ে ওঠেন এবং এখানেই তিনি একজন বহুমুখী অভিনেতার পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম হন। প্রমাণ করেন যে, পরিচালক তার জন্য যে চরিত্রই লেখেন না কেন, তিনি তাতে পারদর্শী।’ ”
সময় যত গড়িয়েছে, ‘অভিমান’-এর কাহিনিকে ঘিরে অনুমানের চর্চাও তত বেড়েছে। তখন ধারণা করা হতো যে, চলচ্চিত্রটি তার দুই প্রধান তারকার সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই নির্মাণ করা হয়েছিল। কেননা অমিতাভ তখন বলিউডে একজন নবাগত হলেও জয়া এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত একজন অভিনেত্রী ছিলেন। আবার কখনো সেতারবাদক রবিশঙ্কর ও তার প্রথম স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবীর জীবনের সঙ্গেও এর তুলনা করা হয়েছে, যিনি নিজেও একজন প্রতিভাবান সেতারবাদক ছিলেন। কিন্তু পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় এসব তুলনা প্রত্যাখ্যান করেন।
এ ছাড়াও ‘অভিমান’কে হলিউডের চলচ্চিত্র ‘এ স্টার ইজ বর্ন’-এর সঙ্গেও তুলনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই একই কাহিনি নিয়ে হলিউডে মোট চারটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। প্রথমটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে এবং এর সবশেষ সংস্করণটি ২০১৮ সালে নির্মাণ হয়। যেখানে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন বিশ্ববিখ্যাত গায়িকা লেডি গাগা ও অভিনেতা ব্রাডলি কুপার। যদিও এই তুলনাকে কখনোই স্বীকার করেননি ‘অভিমান’-র পরিচালক হৃষিকেশ। এর পরিবর্তে তিনি বলেছিলেন, তার চলচ্চিত্রটি বলিউডের কিংবদন্তি গায়ক কিশোর কুমার ও তার প্রথম স্ত্রী রুমা দেবীর জীবনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল, যিনি বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের একজন সফল অভিনেত্রী ও গায়িকা। এক সাক্ষাৎকারে পরিচালক হৃষিকেশ বলেন, ‘অভিনেত্রী রুমা কম প্রতিভাবান ছিলেন না। যেহেতু কিশোর তার ক্যারিয়ারের শুরুতে কিছুটা সংগ্রাম করছিলেন, তাই অভিনয়শিল্পী হিসেবে রুমার প্রতিভার বিষয়ে সব সময় সতর্ক থাকতেন তিনি।’
তবে আজকাল কিছু নারীবাদী ‘অভিমান’-এ জয়াকে নম্র ও পতিব্রতা স্ত্রী হিসেবে চিত্রিত করার জন্য চলচ্চিত্রটির সমালোচনা করেন। যিনি কখনোই নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করেননি, যার কাছে তার স্বামীই মুখ্য।
রমজানের পঞ্চম দিনেও রাজধানী ছিল তীব্র যানজটের কবলে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে ইফতারের আগ পর্যন্ত নগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে। এবার রোজার শুরুতে সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে স্বাধীনতা দিবসের ছুটি মিলিয়ে তিন দিন বন্ধ থাকায় রোজার চতুর্থ দিন সোমবার তীব্র যানজটের কবলে পড়েছিল ঢাকা। গতকাল মঙ্গলবার সে তীব্রতা আরও বেড়ে যায়। যাত্রী, পরিবহন শ্রমিক থেকে শুরু করে সবরাই অভিযোগ, সেবা সংস্থাগুলো তাদের কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গার রাস্তা কাটায় যান চলাচাল ব্যাহত হচ্ছে, ভোগান্তি বেড়েছে পথাচারীদের।
গতকাল রাজধানীর সদরঘাট, গুলিস্তান, পল্টন, শাহবাগ, ফার্মগেট, রামপুরা ও মিরপুরসহ বেশ কটি এলাকা ঘুরে সকাল থেকে তীব্র যানজট দেখা যায়। যানজটে আটকা পড়ে অনেককে হাঁসফাঁস করতে দেখা যায়। কাউকে কাউকে আবার বাসে দীর্ঘ সময় বসে থেকে পরে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য হেঁটেই রওনা দিতে দেখা যায়। অনেক জায়গায় শুধু সড়ক নয়, ফ্লাইওভারে দেখা দেয় তীব্র যানজট।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীর অনেক জায়গায় রাস্তাঘাটের সংস্কারকাজ চলায় বিকল্প পথ ব্যবহারের কারণে যানজটের শিকার বেশি হতে হচ্ছে ওইসব এলাকার যাত্রীদের। বিশেষ করে অফিসের শুরু ও শেষের দিকে যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা যায়।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী মো. জয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, রাস্তাঘাটের যানজট এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো জায়গায় ঠিকমতো যাওয়া যায় না। তাছাড়া কোনো কিছুরই সঠিক পরিকল্পনা নেই। এক রাস্তা কয়েকবার কাটতে দেখা যায়। আর এজন্যই মূলত এত যানজট।’
যানজটের কারণে যাত্রীদের পাশাপাশি ক্ষুব্ধ গণপরিবহনের চালক ও কর্মীরাও। দিশারী পরিবহনের চালক মো. সানোয়ার বলেন, ‘সকাল থেকেই রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট ছিল। সোমবারের থেকে আজ (গতকাল) আরও যানজট বেড়েছে। কোনোভাবেই গাড়ি সামনে যাচ্ছে না।’
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি শহরের জন্য যতটুকু পরিমাণ রাস্তাঘাট দরকার তার কোনো কিছুই মানা হচ্ছে না এই নগরীতে। আর প্রতিদিন কী পরিমাণ যানবাহন সড়কে চলছে তার সঠিক সংখ্যাও জানা নেই বিআরটিএর। আর গণপরিবহন ব্যবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় বিকল্প ব্যবস্থায় মানুষের যাতায়াত বাড়ছে। সে জন্য ছোট গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। যার জন্য সড়কে যানজট বাড়ছে।
বিদেশিদের সম্পত্তি কেনার অনুমতি দিয়ে নতুন একটি আইনের পরিকল্পনা করছে সৌদি আরব সরকার। নতুন এই আইন পাস হলে বিদেশিরা দেশটিতে যেকোনো এলাকায় সম্পত্তি কিনতে পারবেন। অন্যান্য দেশের নাগরিকদেরমতো বাংলাদেশিরাও এই সুযোগ পাবেন। অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার কৌশলের অংশ হিসেবে আবাসন খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতেই এমন পরিকল্পনা বলে জানিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলো।
সৌদি আরবের রিয়েল এস্টেট জেনারেল অথরিটির (আরইজিএ) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আব্দুল্লাহ আলহাম্মাদদের বরাতে সৌদি গেজেটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশিদের সম্পত্তি কেনা সম্পর্কিত নতুন একটি আইন পর্যালোচনাধীন রয়েছে। এই আইনের আওতায় সৌদি নাগরিক নন, এমন বিদেশিরা মক্কা, মদিনাসহ সৌদি আরবের যেকোনো এলাকায় সম্পত্তি কিনতে পারবেন।
আবদুল্লাহ আলহাম্মাদ বলেন, আইনটি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে আইনটির বিষয়ে সবাইকে জানানো হবে।
বিদেশিদের সম্পত্তি কেনার বিষয়ে ২০২১ সালে একটি নির্দেশনা জারি করেছিল সৌদি আরব। এই নির্দেশনায় সৌদির নাগরিক নন, এমন ব্যক্তিসহ দেশটিতে থাকা বৈধ বাসিন্দাদের শর্ত সাপেক্ষে একক সম্পত্তি কেনার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
আবদুল্লাহ আলহাম্মাদ বলেন, সৌদিতে রিয়েল এস্টেটের মালিকানার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের চেয়ে নতুন আইনটি আরও বিস্তৃত ও ব্যাপক হবে। নতুন আইনের অধীন বিদেশিরা সৌদিতে বাণিজ্যিক, আবাসিক, কৃষিসহ যেকোনো ধরনের সম্পত্তি কিনতে পারবেন।
আগের আইনে সৌদির পবিত্র শহরগুলোতে বিদেশিদের সম্পত্তি কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে নতুন আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, পবিত্র মক্কা-মদিনাসহ সৌদি আরবের সব জায়গায় বিদেশিরা সম্পত্তির মালিক হতে পারবেন।
নতুন আইনের মাধ্যমে সৌদি আরব তার আবাসন খাতে একটা রূপান্তর আনতে চাইছে। তারা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে এ খাতকে আকর্ষণীয় করে তুলতে চায়। সৌদি কর্র্তৃপক্ষ মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এ খাতের অবদান আরও বাড়াতে আগ্রহী।
সৌদির রিয়েল এস্টেট জেনারেল অথরিটি নতুন যে আইনটির কথা বলছে, তা কার্যকর হলে দেশটি প্রবাসী ও বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন বিনিয়োগের একটি গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে।
সংলাপে নয়, আলোচনার জন্য বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেছেন, ‘মূল জিনিসটা হলো, আমরা কিন্তু সংলাপে আহ্বান করিনি। সংলাপ বিষয়টি আনুষ্ঠানিক। আমরা কোনোভাবেই উনাদের (বিএনপি) সংলাপে ডাকিনি। আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি আনুষ্ঠানিক না হলেও (আনুষ্ঠানিক মানে সংলাপ) অন্তত অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আপনারা আসতে পারেন। অত্যন্ত বিনীতভাবে এ আহ্বানটা করেছি।’
বিএনপিকে চিঠি পাঠানোর পাঁচ দিন পর গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের নিজ কক্ষের সামনে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, “বিএনপিকে চিঠি দেওয়ায় ইসির কোনো ‘কূটকৌশল’ ছিল না, কোনো মহলের ‘চাপও নেই’। অনানুষ্ঠানিকপত্র দিয়েছি বিএনপি মহাসচিবকে। চিঠি বৃহস্পতিবার শেষবেলায় দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয় চিঠিটা উনারা পেয়েছেন। আমার কাছে কোনো জবাব আসেনি। ধরে নিচ্ছি উনারা পেয়েছেন। অনেকে বলতে চেয়েছেন এটা সরকারের একটি কূটকৌশল। আমি আপনাদের মাধ্যম পুরো জাতিকে অবহিত করতে চাই, আশ্বস্ত করতে চাই এ পত্রের সঙ্গে সরকারের কোনো সংস্রব নেই, সংশ্লিষ্টতা ছিল না।’
তিনি আরো বলেন, ‘যদি কেউ এটাকে কূটকৌশল হিসেবে মনে করতে চান তাহলে এটা নির্বাচন কমিশনের কূটকৌশল হতে পারে, সরকারের নয়। আর নির্বাচন কমিশন কখনো কূটকৌশল হিসেবে এ কাজটি করেনি।’
সিইসি বলেন, ‘ইসি একেবারে প্রথম থেকেই অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বীমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করে আসছে। আমরা ব্যথিত হই যখন বলা হয় সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করি। আজ্ঞা বহন করিনি। আমরা নির্বাচন নিয়ে আলাপ করি, আমাদের চিন্তার মধ্যে ফুটে উঠেছে বিএনপির মতো দলকে নির্বাচনে আনতে পারলে ভালো হয়।’
বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় এখনো আগ্রহী জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি আপনাদের (বিএনপির) যদি কোনো কৌশল থাকে তার ওপর ইসির কোনো মন্তব্য থাকবে না। তার পরও আমরা আলোচনা করতে চাই আপনাদের সঙ্গে। ফল ইতিবাচক হতেও পারে, নাও হতে পারে। প্রয়াস থাকবে। প্রয়াস গ্রহণ করতে বাধা থাকা উচিত নয়।’
এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘আমরা কোনো চিঠি পাইনি। আমি চিঠি দিয়েছি, যেকোনো রেসপন্স আমাদের চিঠির মাধ্যমে দিতে হবে। আমরা আশা করি, যেহেতু বিএনপি মহাসচিব মহোদয়কে চিঠি দিয়েছি। যেকোনো বক্তব্য আমাদের কাছে পত্রের মাধ্যমে আসে সেটাই কাক্সিক্ষত। এরপর আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নেব। আগাম কোনো মন্তব্য নেই।’
বিএনপি যদি আসে তাদের সঙ্গে কী নিয়ে আলোচনা হবে সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘উনারা কী বলবেন, আমরা কী বলব আগাম কোনো বক্তব্য দিতে পারব না। বিএনপি যদি আলোচনার জন্য এজেন্ডা ঠিক করে দেয়, তার পরও বসা বিষয়ে ইতিবাচক’ বলে জানান সিইসি।
কূটনৈতিক মহলে সংলাপ আয়োজনের আলোচনার মধ্যে এমন চিঠি দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘এ ধরনের বিষয় আমাদের নলেজে নেই। আমাদের চিন্তা থেকে, উদ্ভূত সিদ্ধান্ত থেকে এ চিঠি দেওয়া হয়েছে। চাপের কথা যেটা বলেছেন এটা সম্পূর্ণ অমূলক ধারণা। কোনো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর চাপে বিএনপিকে ডাকা হয়নি।’
বিএনপির জবাব পেতে কত দিন অপেক্ষা করবে কমিশন এমন প্রশ্ন করা হলে এড়িয়ে যান সিইসি।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গাইবান্ধা ভোট বন্ধের ইস্যুতে ১৩৪ জনের মধ্যে ৪০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আবারও পদক্ষেপ নেবে ইসি।
সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে চার নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান, মো. আলমগীর, রাশেদা সুলতানা ও আনিছুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
রাজধানীর মিরপুরের একটি মাধ্যমিক-সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সিফাত। একই এলাকায় বসবাসকারী তার বন্ধু সিয়াম পড়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে। সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার থেকে রোজার ছুটি। আর সরকারি প্রাথমিকে ছুটি ১৫ রোজা অর্থাৎ ৭ এপ্রিল থেকে।
এক দেশে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন নিয়মে ছুটি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে লেখাপড়ায় কেউ এগিয়ে যাবে, আবার কেউ পিছিয়ে পড়বে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার বা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে ভেবেচিন্তেই নেয়। তবে সব ধরনের স্কুলে একটা কো-অর্ডিনেশন থাকলে ভালো হয়। আমরা ছুটির ব্যাপারে আরও আলাপ-আলোচনা করব।’
জানা গেছে, চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে আগামী শুক্রবার শুরু হতে পারে রমজান মাস। বছরের শুরুতেই স্কুলগুলোর ছুটির তালিকা অনুমোদন করা হয়। সে অনুযায়ী পবিত্র রমজান, স্বাধীনতা দিবস, ইস্টার সানডে, বৈসাবি, নববর্ষ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা ও টিটি (টিচার্স ট্রেনিং) কলেজেও একই সময়ে ছুটির ঘোষণা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছুটির তালিকা ভিন্ন। তারা পবিত্র রমজান, ইস্টার সানডে, চৈত্র-সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আগামী ৭ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ প্রায় ১৫ রমজান পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা থাকবে।
রাজধানীসহ বড় বড় শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকের মতোই তাদের ছুটি থাকবে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রোজার ছুটিও একই। তবে মাদ্রাসায় রোজার ছুটি শুরু এক দিন আগেই অর্থাৎ আজ বুধবার, ২২ মার্চ।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। তাই বুধবার ক্লাস করে বৃহস্পতিবার রোজার ছুটি শুরু হবে। তবে সব স্কুলে একই ধরনের ছুটি থাকা জরুরি। এতে একই সময়ে সিলেবাস শেষ করা যাবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সন্তুষ্ট থাকবে।’
রমজানে মাধ্যমিকে স্কুল বন্ধ আর প্রাথমিকে খোলা রাখায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষকের মধ্যে। তারা বলছেন, যেসব অভিভাবকের সন্তান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্কুলেই পড়ে তাদের সমস্যা হবে। রমজান মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও রোজা রাখেন। তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিল রেখে প্রাথমিকের ছুটি নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগাঠনিক সম্পাদক জুলফিকার আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকারি ছুটি ৭৬ দিন, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৫৪ দিন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিন্ন ছুটি নির্ধারণের যুক্তি তুলে ধরে আমরা ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছি। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো সাড়া পাইনি।’
'স্যার নয় আপা ডাকলেই চলবে' রংপুরের জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীনের এমন বক্তব্যের পর রাত ৯ টার দিকে আন্দোলন সমাপ্ত করে ক্যাম্পাসে ফিরে গেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এর আগে চিত্রলেখা নাজনীনের বিরুদ্ধে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে বুধবার (২২ মার্চ) বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে একাই অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন উমর ফারুক। এর পর তার সাথে একাত্মতা জানিয়ে আন্দোলনে যুক্ত হন বেরোবির বাংলা বিভাগের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা।
তুহিন ওয়াদুদ তার ফেসবুক পোস্টে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান।
জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, বেরোবির একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে উমর ফারুক আমার কাছে এসেছিলেন। এ সময় আমি বাইরে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম। তখন ওই শিক্ষক আমাকে দেখে আপা বলে ডাক দেন। আমি তাকে স্যার না বলে আপা কেন ডাকছেন জানতে চাই। আমার জায়গায় একজন পুরুষ দায়িত্বে থাকলেও কি তিনি স্যার না বলে ভাই ডাকতেন?
জেলা প্রশাসক জানান, রাতে তিনি ওই শিক্ষক ও আন্দোলনকারীদের স্যার ডাকতে হবে না, আপা ডাকলেই চলবে বলে জানান। এরপর তারা আন্দোলন বন্ধ করে দেন এবং ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে চলে যান।