
ব্যবসায়ী, সমাজসেবক ও দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা ‘আর পি সাহা’ নামেও পরিচিত। তিনি ১৮৯৬ সালের ১৬ নভেম্বর ঢাকার অদূরে সাভারের কাছৈড় গ্রামে দরিদ্র একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৪ বছর বয়সে আরপি সাহা কলকাতায় যান এবং বিপ্লবী দলে যোগ দেন। কয়েকবার কারাবরণও করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ-বেঙ্গল সেনা মেডিকেল কোরে যোগ দিয়ে ইরাকে যান; সেনাবাহিনীতে কমিশনও লাভ করেন। এরপর কয়লা সরবরাহের ব্যবসা শুরু করেন। চার বছরেই তিনি কলকাতায় বিশিষ্ট কয়লা ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। ১৯৩৮ সালে নিজ গ্রাম মির্জাপুরে তিনি ২০ শয্যার হাসপাতাল এবং ২০০ ছাত্রীর থাকা ও পড়াশোনার উপযোগী আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি গরিবদের কল্যাণে ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল’ নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করান। মায়ের স্মরণে মির্জাপুরে ‘কুমুদিনী মহিলা কলেজ’ ও বাবার নামে ‘দেবেন্দ্র কলেজ’ স্থাপন করেন। মির্জাপুরে ভারতেশ্বরী হোমস প্রতিষ্ঠা তার অন্যতম কীর্তি। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৭ মে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের হাতে শহীদ হন। ১৯৭৮ সালে সরকার তাকে এবং ১৯৮৪ সালে তার প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টকে সমাজসেবায় অবদানের জন্য স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার দেয়।
প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ইতিহাসেও বিশ্ববিদ্যালয়মাত্রই ছিল আবাসিক। অর্থাৎ সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের আবাসন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য শুধু শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পাঠ দেওয়া নয়; বরং জ্ঞানচর্চা করা, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক নিবিড় আদান-প্রদানের সুবিধার্থে এই আবাসিক ব্যবস্থা। এভাবে শ্রেণিকক্ষ, পাঠাগার, আর গবেষণাগারে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নতুন জ্ঞান বিকাশের পথ তৈরি হয়। কিন্তু সেই বাস্তবতা আজ আর নেই। প্রশাসন শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট দূর করতে সচেষ্ট নয় বলেই বছরের পর বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলে গাদাগাদি করে থাকছে শিক্ষার্থীরা। একই কারণে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেই তৈরি হয়েছে বহুল সমালোচিত ‘গণরুম’
সংস্কৃতি। প্রশ্ন হলো শিক্ষার্থীরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেও বছরের পর বছর যথাযথ আবাসনের সুবিধা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয় তাহলে তারা শিক্ষায় মনোনিবেশ করবে কীভাবে?
দেশ রূপান্তরে মঙ্গলবার ‘এক কক্ষে ২০০ ছাত্রী’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আবাসন সংকট নিয়ে হলেও আদতে দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রায় একই দশা। আবাসিক হলের সাধারণ কক্ষগুলোতে খানিকটা স্বস্তি মিললেও গণরুমের দশা সবসময়ই করুণ। গণরুমেও তিন ফুট প্রস্থের একেকটি বিছানায় থাকতে হচ্ছে দুজনকে। দুজনের জন্য বরাদ্দ মাত্র একটি করে টেবিল-চেয়ার। প্রতিটি বিছানার মাঝে দুই ফুটের ফাঁকা স্থানে রাখা টেবিলে বা নিচে রাখতে হয় দুজনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। ফলে ঘুম, খাওয়া, পড়াশোনা সবই করতে হয় বিছানায়। এভাবে একটি গণরুমে দুই শতাধিক ছাত্রীকে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীহলগুলোর গণরুমে। গণরুমের এসব বাসিন্দাকে ভোগান্তি পোহাতে হয় রান্না করতে গিয়েও। নিত্য বিড়ম্বনা আছে শৌচাগার নিয়েও; গড়ে ৩০ জন ছাত্রীর জন্য আছে মাত্র একটি শৌচাগার। শিক্ষার্থী, প্রশাসন থেকে শুরু করে সবাই বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি ছাত্রীহলের গণরুমের বর্তমান দশা যেকোনো শরণার্থী শিবিরের চেয়েও করুণ। এসব হলের হাজারের বেশি ছাত্রীর দিন কাটছে মানবেতর অবস্থায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, ৯ হাজার ৩৪৬ জন ছাত্রীর বিপরীতে সিট রয়েছে ৪ হাজার ৩৫৪টি; যা মোট আবাসনের মাত্র ৪৬ শতাংশ। পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধা না থাকায় ছাত্রীদের ছয়টি আবাসিক হলেই গণরুম সৃষ্টি হয়েছে। হল প্রাধ্যক্ষরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্রী নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। আর্থিক অসচ্ছলতার কথা উল্লেখ করে তারা গণরুমের সিটের জন্য বিভিন্ন অনুরোধ করেন। অনেকের অভিভাবক এসে মেয়ের নিরাপত্তার কথা বলে গণরুমে সিটের জন্য কাকুতি-মিনতি করেন। তখন বাধ্য হয়ে সিটের তুলনায় অধিক শিক্ষার্থী রাখতে হয়। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমবর্ষ ও দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্রীদের গণরুমে থাকতে দেওয়া হয়। এর মধ্যে মন্নুজান হলের চারটি গণরুমে প্রায় দুই শতাধিক ছাত্রী, তাপসী রাবেয়া হলের দুটি গণরুমে ২৮০ জন, খালেদা জিয়া হলের দুটি গণরুমে প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী থাকেন। এছাড়া বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের একটিমাত্র গণরুমে এ বছর ২১০ জন ছাত্রীকে থাকতে দেওয়া হয়েছে, বেগম রোকেয়া হলে পাঁচটি রুমে প্রায় ২৫০ জন ছাত্রী ও রহমতুন্নেছা হলে কয়েকটি গণরুমে প্রায় ২৫০ ছাত্রী থাকেন। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে তাপসী রাবেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ফেরদৌসী মহলের বক্তব্য বেশ স্পষ্ট। তিনি সরাসরিই বলেছেন, ছাত্রীদের জন্য হলের সংখ্যা না বাড়ালে এসব সংকট কাটবে না। অন্যদিকে, প্রশাসন জানিয়েছে, প্রতি বছর যত সংখ্যক মেয়ে ভর্তি হচ্ছে তাদের সবাইকে জায়গা দেওয়ার মতো সিট ক্যাপাসিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। কারণ আগে ছাত্রীদের সংখ্যা কম থাকলেও এখন ছেলে-মেয়ে প্রায় সমান হারে ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু ছেলেদের জন্য ১১টি হল থাকলেও মেয়েদের জন্য পর্যাপ্ত হল নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সংকটের এমন করুণ পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা ইউজিসি কারুরই অজানা নয়। কিন্তু আবাসন সংকট দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেই। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৯৫৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে আবাসন সুবিধা রয়েছে মাত্র ৯৯ হাজার ৭২৩ জন শিক্ষার্থীর। প্রতিবেদন অনুযায়ী শতকরা ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থীই আবাসন সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। তুলনায় কম হলেও বহু বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকদের আবাসনেরও সংকট রয়েছে। অথচ আবাসন সংকটের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। কারণ শিক্ষা কেবল শ্রেণিকক্ষের বিষয় নয়। শ্রেণিকক্ষের মতোই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্ত পরিসর আর মানসম্মত আবাসনের নিশ্চয়তাও সমান জরুরি। এসব জরুরি বিষয় নিশ্চিত করা না গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক জ্ঞানতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিসরও বিকশিত হবে না। আমরা আশা করব কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সব বিশ্ববিদ্যালয়ই ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসন সংকট দূর করতে সচেষ্ট হবে।
ডিম্বাস্ত্র আবার কী? প্রক্ষিপ্ত মিসাইল। মাথায় পড়লে টের পাবেন। নিক্ষিপ্ত ডিমের কথা শুনলে বেশি বিচলিত হয়ে থাকেন রাজনীতিবিদরা। বহু বছর আগে পচা ডিমের ব্যবহার নামে একটি প্রতিবেদন পড়েছিলাম। প্রশ্ন ছিল এত পচা ডিম যায় কোথায়? প্রায় সব বিক্রেতাই ‘কমন ক্রেতা’র কথা বলেছেনবেকারি মালিক। কেক তৈরি করতে পাইকারি দরে কিনে নেন। একজন বিক্রেতা তার দৃঢ় বিশ্বাস থেকে এমনও বলেছেন যে পচা ডিম না হলে কেক সুস্বাদু হয় না। রাজনীতিবিদদের ওপর নিক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে কয়েকজন বিক্রেতার কাছ থেকে সতর্ক কিছু ক্রেতা ডিম কিনে থাকেন।
ডিন মার্টিনের গানটা এমনকি রাজনীতিবিদরাও ভালোবাসেন। গানের সারমর্ম অনেকটা এ রকম : তুমি যদি কারও ভালোবাসা না পাও, তুমি মানুষই না; ছুড়ে দেওয়া ডিম যদি তোমার মাথায় না ভাঙে তুমি রাজনীতিবিদই না।
বিশেষ করে ছুড়ে দেওয়া পচা ডিম যতক্ষণ না রাজনীতিবিদকে আঘাত করছে রাজনীতিবিদ হিসেবে তার নাবালকত্ব কাটছে না। এই সাবালকত্বের সঙ্গে চুল-দাড়ি-গোঁফ গজানোর সম্পর্ক অতি সামান্য। চুল-দাড়ি-গোঁফ কেবল গজায়নি, পেকে টাক পড়ার দশা হয়েছে এমন একজন বাহাত্তর-উত্তীর্ণ তিয়াত্তরে রাজা তৃতীয় চার্লস প্রায় মাতৃসম রানী ক্যামিলা পার্কারকে নিয়ে ইয়র্কশায়ার সফরে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য সদ্য প্রয়াত রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের ভাস্কর্য উন্মোচন। এ সময়ই এক তরুণের ছুড়ে দেওয়া ডিম্ব-মিসাইল রাজাকে ও রানীকে আঘাত করতে চেষ্টা করে।
এই ডিম্ব-মিসাইলে একদা সূর্য না ডোবা সাম্রাজ্যের বৃদ্ধ রাজাকে সাবালক বানানোর উদ্যোগ নিয়ে এক তরুণ গ্রেপ্তার হন এবং তার এই টার্গেট শুটিংয়ের জন্য মোটেও অনুতপ্ত নন বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন। দেরিতে সাবালকত্বের দিকে ধাবিত তৃতীয় চার্লস নাবালকসুলভ আচরণ করে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেননি, কোনো রাজনৈতিক দলের অপকীর্তি বলে পাড়া মাত করেননি, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও মনে করেননি, নিজেও ডিমকামানের গোলন্দাজের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেননি, এমনকি টাকা খরচ করে প্ল্যাকার্ড, পোস্টার, ফেস্টুন ইত্যাদি বানিয়ে রসিক তরুণটির ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই ধ্বনি দেওয়ার জন্য ছাত্র ও যুব ফ্রন্টকে রাস্তায় নামিয়ে দেননি। এটাই হচ্ছে ডিম্বাঘাতী সাবালকত্ব। ডিমের আঘাতে গত আড়াই হাজার বছরে কোনো রাজনীতিবিদ মৃত্যুবরণ করেননি। তবুও দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে হলে নিক্ষেপকারী তাৎক্ষণিক মৃত্যু ভাগ্যক্রমে এড়াতে পারলেও হত্যাপ্রচেষ্টা মামলার আসামি হতোই। সাবালকত্ব পরিমাপে ডিম্বসূচকটি সমাদৃত।
‘গড সেইভ দ্য কিং’জাতীয় সংগীত হলেও ইয়র্কের তরুণরা চেঁচিয়েছে ‘তোমাকে রাজা মানি না’, নুয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ বছর বয়সী ডিম নিক্ষেপকারী চেঁচিয়ে বলেছেও ‘ক্রীতদাসের রক্তের ওপর এই দেশ দাঁড়িয়েছে’।
নিক্ষিপ্ত ডিম একটি নয় একাধিক। ৯ সেপ্টেম্বরের অনুষ্ঠানের সংবাদ কাভার করতে আসা গার্ডিয়ান প্রতিনিধি দেখেছেন তিনটি নিক্ষিপ্ত ডিম-মিসাইল আর বিবিসির প্রতিনিধি দেখেছেন পাঁচটি। তিন বা পাঁচ বিতর্কের চেয়ে হতাশাব্যঞ্জক বিষয়টি হচ্ছে উভয় মাধ্যমই দাবি করেছে ডিম রাজাকে আঘাত করতে পারেনি। রাজা ডিমকে ডজ দিয়েছেন। এই সংবাদে আবার দুটি আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে; প্রয়াত রাজার সাবালকসুলভ আচরণ তাহলে সাময়িক। দ্বিতীয়ত. একালের তরুণরা টার্গেট শুটিংয়ে ব্যর্থ। দুটোই চিন্তার কারণ।
পাঁচটি হোক কী তিনটি হোক একাধিক ডিম রাজার দিকে ধেয়ে এসেও তাকে ছুঁতে পারেনি টার্গেট শুটিংয়ে ব্যর্থতার কারণে তার সাজা হোক এতে কেউ আপত্তি করবে না। কিন্তু এটাকে যেন হত্যাপ্রচেষ্টা বলে প্রচার না করা হয়। এমনকি নিক্ষেপকারীর ইচ্ছে ছিল রাজাকে ব্যথা দেওয়াএ কথাও যেন বলা না হয়। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে ডিম নিক্ষেপ করা হয়েছেসরকারের পক্ষে এ কথা ছড়ানো হলেও ধৃত আসামির পক্ষে বলা হয় ব্যথা দেওয়ার ইচ্ছে থাকলে তো সেদ্ধ ডিম ছোড়া হতোডিমটা কাঁচা ছিল। সেদ্ধ বেশি হলে শক্তও বেশি, আঘাতে ব্যথা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
টার্গেট মিস করা নিয়ে আফসোস করে গেছেন সর্দার উধম সিং। লন্ডনের ক্যাক্সটন হলে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের সময়কার পাঞ্জাবের গভর্নর মাইকেল ও ডায়ার এবং তখনকার সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া লর্ড জেটল্যান্ডকে (১৯১৭ থেকে ১৯২২ বাংলা গভর্নর) হত্যার উদ্দেশ্যেই গুলি করেন। মাইকেল ও ডায়ার সেখানেই লুটিয়ে পড়েন কিন্তু টার্গেট হয়তো মিস করেছেন এমনই আশঙ্কা করেছিলেন তরুণ উধম সিং। পুলিশবেষ্টিত অবস্থায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘জেটল্যান্ড কি মরেছেন? তারও মরা উচিত। আমি তার ডানদিকে দুটো গুলি করেছিলাম।’
সর্দার উধম সিংয়ের সংশয় সঠিক। জেটল্যান্ড কেবল আহত হয়েছেন। তার গুলি টার্গেট ছুঁয়ে গেলে যথাস্থানে আঘাত করেনি। তিনি আফসোস করে বললেন, মাত্র একজন মরেছেন। আমি তো ভেবেছি আরও বেশি মারতে পারব। আমি নিশ্চয়ই খুব ধীরে ধীরে কাজটা করেছি। অনেক মহিলা ছিলেন তো তাই।
(মার্ডার অ্যাট ক্যাক্সটন হল ও অন্যান্য ইতিহাস : প্রকাশক এপিপিএল)
ডিমের দাম এতটাই বেড়েছে, কোথাও কোথাও সম্ভবত গুলির দামকেও ছাড়িয়ে গেছে। তার পরও যারা গাঁটের পয়সা খরচ করে ডিম কিনে কাঁচা অবস্থায় অথবা সেদ্ধ করে ছুড়ে মারেন তাদের উদ্দেশ্য যে উধম সিংয়ের মতো হত্যা করা নয় তা যে স্পষ্ট, আর যাই হোক ডিম নিক্ষেপকারীকে রাষ্ট্রদ্রোহীর মর্যাদা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার কোনো মানে নেই। বরং টার্গেট মিস করার জন্য তাকে অদক্ষ বলে গালাগাল দিয়ে পিজিয়ন টার্গেট শুটিংয়ে হাত পাকানের সুযোগ করে দেওয়া উচিত বলেও পশ্চিমের ‘এগ প্রোজেক্টাইল অ্যানালিস্টরা’ মনে করেন।
মুনতাজার আল জাইদি নামের জুতো-ছোড়া সাংবাদিকের কথা মনে করুন। ১৪ ডিসেম্বর ২০০৮ প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইরাকি প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকিকে নিয়ে বাগদাদে বহুসংখ্যক টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে যখন লাইভ সংবাদ সম্মেলন করছিলেন মুনতাজার নিজের পায়ের জুতো খুলে প্রেসিডেন্টের মাথা বরাবর ছুড়লেন, দক্ষ আক্রোব্যাটের মতো প্রেসিডেন্ট জুতোকে ডজ দিলেন। এক জুতোতে আর কাজ কীভেবে মুনতাজার দ্বিতীয়টিও ছুড়লেন। এবার প্রেসিডেন্ট মাথা সরালেন আর ইরাকি প্রধানমন্ত্রী নিক্ষিপ্ত দ্রব্যটি ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। অনস্বীকার্য, সেদিন থেকে মুনতাজার আল জাইদি সেলিব্রিটি হিসেবে যাই নাম কামিয়ে থাকুন না কেন টার্গেট শুটিংয়ে তিনি যে অদক্ষ এটা কাঁচা শুটাররাও বলতে ছাড়েননি। তার কারাবাসকে তারা অদক্ষতার শাস্তি হিসেবে মেনে নিয়েছেন। মুনতাজার দুটো বাক্যমিসাইলও নিক্ষেপ করেছিলেন। প্রথম নিক্ষেপের সময় বলেছিলেন, ‘তোর মতো কুত্তার জন্য ইরাকি জনগণের শেষ চুম্বন।’ দ্বিতীয় নিক্ষেপের সময় বলেছেন, ‘এই জুতোটি ইরাকের বিধবা, এতিম ও নিহতদের পক্ষ থেকে।’
মুনতাজার মাত্র ৯ মাস জেল খেটে বেরিয়ে এসে প্যারিসে গিয়ে তারই এক স্বদেশির জুতো হামলার শিকার হয়েছেন। টার্গেট শুটাররা মনে করেন টার্গেট মিস করার শাস্তি এত কম হলে শুটিংয়ের সিরিয়াসনেস কমে যাবে।
* * *
খ্রিস্টজন্মের ৬৩ বছর পর রোমান গভর্নর ভেসপাসিয়ানকে যে প্রজা টার্গেট করেছিলেন তিনি লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি। সেকালে ডিম কিংবা জুতো (কজনই বা জুতো পরতেন!) জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি, ছোড়া হতো আহার্য ও ফলমূল। ভেসপাসিয়ানের গায়ে লেগেছিল শালগম।
অপরাধী ও রাজনীতিবিদদের ডিম পাওয়ার ব্যাপারটি বেশ পুরনো। প্রথম এলিজাবেথের যুগে থিয়েটার দর্শকদের কেউ কেউ পকেটে পুরে দু-একটি ডিম নিয়ে যেতেন। কারও অভিনয় বিরক্তিকর হলে তার ওপর ডিম এসে পড়ত। শত শত দর্শকের মধ্যে কাজটা কোন অসন্তুষ্ট দর্শকেরকখনো কখনো তা শনাক্ত করা গেলেও তারা মামলা-মোকদ্দমা বা হেনস্তার শিকার হননি। বরং নাট্যপরিচালক অভিনেতাকে বদলে দিয়েছেন কিংবা তার চরিত্রে গতি সংযোজন করেছেন।
রাজনীতিবিদ নিজ দলের হলেও বক্তৃতার সময় যদি অসমীচীন কথা বলেন তাতে দলের ভাবমূর্তিও ক্ষুণœ হয়। সমর্থকদের বরাবরই প্রত্যাশা নেতার কথা জাদুতে তাদের মুগ্ধ করবেন, বিরক্তির উদ্রেক করবেন না। ইংরেজরা তাদের রাজনৈতিক সভাগুলোতেও ওভারকোটের ভেতর ডিম নিয়ে অংশগ্রহণ করতে শুরু করলেন। ১৮৭১ সালে প্রকাশিত জর্জ এলিয়টের বিখ্যাত উপন্যাস ‘মিডল মার্চ’-এ রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী চরিত্র মিস্টার ব্রুক নির্বাচন প্রচারণায় যে ভাষণ দিলেন তা ছিল অগোছালো এবং দুর্বল। সুতরাং ভাষণের একপর্যায়ে তার ওপর ডিম বর্ষিত হতে শুরু করলরীতিমতো শিলাবৃষ্টির মতো।
ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে এগ ক্রিয়াপদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে চলেছেপ্রাইম মিনিস্টার এগড্ মানে প্রধানমন্ত্রী ডিম্বাক্রান্ত হয়েছেন। সদ্য ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ঢোকা ঋষি সুনাক এখনো এগড্ হননি, তার মানে সাবালকত্বপ্রাপ্তি ঘটেনি। লিজ ট্রাসকে নাবালিকা অবস্থাতেই বিদায় নিতে হয়েছেমাত্র ৪৫ দিনের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, তিনি কোনো ডিম্বাস্ত্র আকর্ষণ করতে পারেননি। অথচ তাদের পূর্বসূরিদের সাফল্যের ইতিহাসে ডিম্বাস্ত্রের ভূমিকা খাটো করে দেখার উপায় নেই। বিংশ শতকের সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রীদের একজন (কেবল ব্রিটেনে নয় সমগ্র বিশে^ সাফল্যের নিরিখে) মার্গারেট থেচার ডিম খেয়েছেন। বাংলা অভিধান ডিম্বাক্রান্ত হওয়া শব্দটি গ্রহণ করেনি। ডিম খাওয়া দ্ব্যর্থবোধক শব্দযুগল হিসেবে গৃহীত হতে পারেনাশতায় ডিম খাওয়া কিংবা জনসভায় ডিম খাওয়া। থেচারের আগে ডিম খেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন। পরে ডিম খেয়েছেন জন মেজর, টনি ব্লেয়ার, ডেভিড ক্যামেরন। ডিমভাগ্যই তাদের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে বহাল রেখেছে। তাদের সাবালকত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে।
বিংশ শতকের সবচেয়ে সফলদের একজন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর এপিসোডটি তুলে না ধরলেই নয়। ১৯৬৭-এর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন প্রচারণায় ভুবনেশ্বর এসেছেন ইন্দিরা গান্ধী। ডিম্বাকৃতির একটি প্রক্ষিপ্ত মিসাইল (ব্রিটিশরা বলে থাকে ডেয়ারি মিসাইল) বক্তৃতারত ইন্দিরা গান্ধীর নাকে আঘাত করল। গুরুতর আঘাত নাকের হাড় ভেঙে দিল, রক্তপাত শুরু হলো, তিনি নাকমুখ চেপে ধরলেন। এ অবস্থাতেই তিনি বললেন, এটা গণতন্ত্রের জন্য অশুভ সংকেত। কাকে ভোট দেবেন? নিক্ষেপকারীকে? বেশি রক্তপাত হতে থাকায় তাকে দ্রুত ডায়াস থেকে নামিয়ে দিল্লিতে হাসপাতালে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, ডাক্তারের নির্দেশ উপেক্ষা করে ব্যান্ডেজ বাঁধা নাক নিয়ে আবার জনসমক্ষে আসেন এবং বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে পাকাপাকি প্রধানমন্ত্রী হন।
জেরেমি ওয়েবস্টার জীবদ্দশায় মার্গারেট থেচারকে হাতের কাছে পাননি বলে তখন ডিম খাওয়াতে পারেননি। ২৬ মে ২০২২ লিঙ্কনশায়ারে মার্গারেট থেচারের ১০ ফুট উঁচু ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য স্থাপিত হওয়ার আগে থেকেই লিস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা বিভাগের প্রধান ৫৯ বছর বয়সী জেরেমি ওয়েবস্টারের হাত পকেটের ভেতর নিশপিশ করছিল। ভাস্কর্যটি স্থাপিত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি পকেট নয়, ডিমের বাক্স থেকেই ডিম বের করে ‘ম্যাগি’র ওপর ছুড়ে মারলেন। ব্যাপারটা লোকচক্ষুর অন্তরালে ঘটেনি। তার ডিম প্রক্ষেপণের চিত্রধারণের সুযোগও নিয়েছেন রসিক ফটোগ্রাফার। পুলিশ তাকে ছাড়েনি। মার্গারেট থেচারের পক্ষে তার কোনো স্বজন কিংবা তার রক্ষণশীল দল তার ফাঁসি দাবি না করলেও সংক্ষিপ্ত বিচারের বিলেতি পুলিশ আইনের ৫ ধারায় তার ৯০ পাউন্ড জরিমানা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা মোটেও থেচারবিরোধী নন এবং তার ভাস্কর্য স্থাপনে তাদের কোনো অসন্তোষও নেই, ব্যাপারটা জেরেমির নিজস্ব চিন্তাপ্রসূত।
কী জানি জেরেমি হয়তো ভেবেছেন মার্গারেট থেচার (১৯২৫-২০১৩) জীবদ্দশায় পর্যাপ্ত ডিম খাননি, তার ভাস্কর্যকেও কিছু খাওয়ানো দরকার।
শ্রমিকদলীয় প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন ১৯৭০ সালে হ্যারোতে ডিম খেলেন। নিক্ষিপ্ত একাধিক ডিমের একটি তার গায়ে লেগে ভেঙেও গেল। হ্যারল্ড উইলসন হেসে উঠলেন এবং মাইক্রোফোনে জনতার উদ্দেশে বললেন, হ্যারোতে দ্রব্যমূল্যের কথা যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে স্বীকার করতেই হবে শ্রমিক দলের শাসনকালে ডিম এত সস্তা হয়েছে যে তা নিক্ষেপও করা যায়। যদি রক্ষণশীল দল ক্ষমতায় আসে তাহলে নিশ্চিত থাকতে পারেন আগামী ৫ বছর ব্রিটেনের জনগণ ডিম কিনে নিক্ষেপ করার সক্ষমতা অর্জন করবে না।
হ্যারল্ড উইলসন ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ এবং ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
ডিম খাওয়ার পর টনি ব্লেয়ার বলেছিলেন, শুধু ডিম কেন, মাখনও নিক্ষেপ করুক, তাহলে কেক বানিয়ে খাওয়া যেত। এর নামই রাজনৈতিক সাবালকত্ব।
বিবেচনা করুন ‘ডিমপরিপক্বতা’ হ্যারল্ড উইলসনকে কত সম্মানিত করেছে আর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রক্ষিপ্ত ডিমকে হয়তো বলা হবে আণবিক বোমাহিরোশিমা ও নাগাসাকির বোমার চেয়ে হাজার গুণ শক্তিশালী। এর নাম রাজনৈতিক নাবালকত্ব।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
বাংলাদেশে টিকে থাকতে হলে একটু ‘কায়দা করে’ চলতে হয়। সোজা পথে না চলে কিছুটা বাঁকা রাস্তায় যাওয়াই যেন এখানকার রীতি। এখানে নৈতিকভাবে ভালো লোকদের বলা হয় ‘সহজ-সরল’। এই বলার মধ্যে আবার একটুখানি প্রচ্ছন্ন দরদ থাকে। সৎ লোকদের প্রতি দরদ না দেখিয়েও উপায় নেই, কেননা এরা পদে পদে বিপদে পড়েন। বেশিরভাগ সরকারি অফিসে বৈধ এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কোনো কাজ করাতে চাইলে যে কাজটার জন্য যে সময় লাগে সেই একই কাজে যখন অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়, তার অর্ধেক সময় লাগে। অনিয়ম যখন সমস্ত ব্যবস্থাকে গ্রাস করে তখন শিক্ষাব্যবস্থাও এর বাইরে যেতে পারে না। কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে এর শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করলেই চলে। বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি উচ্চমাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্টধারী শিক্ষার্থীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় টিকছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি দূরে থাক, এসব শিক্ষার্থী পাস নম্বরও পাচ্ছে না। অর্থাৎ, ধরে নিতে হবে গলদটা গোড়ায়। প্রায় শতভাগ পাস আসলে কতটা সংখ্যাগত আর কতটুকু গুণগত সেটা এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে। সময় এসেছে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকেই প্রশ্ন করার। নানা সময়ে সংবাদ মাধ্যমে এসেছে পরীক্ষার খাতা যারা দেখেন তাদের প্রতি এক ধরনের মৌখিক নির্দেশনা আছে শিক্ষার্থীদের যেন ফেল করানো না হয়। নির্দেশনা যেহেতু মৌখিক, তাই এ অভিযোগ প্রমাণ করা শক্ত। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই যে ‘পাস করা’ শিক্ষার্থীদের ঘটে তেমন বিদ্যাবুদ্ধি নেই তার প্রমাণও তো নেহাত কম নয়।
অনেকদিন ধরে ‘সৃজনশীল’ নামক এক ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি বাংলাদেশে চলমান। নামে সৃজনশীল হলেও এটা আসলে প্রকৃত অর্থে সৃজনশীল নয়। প্রশ্নপত্রে আসা ‘উদ্দীপক’ নামক কয়েক লাইনের রচনার সঙ্গে পাঠ্যবইয়ে থাকা কোনো একটি গদ্যের তুলনামূলক বিচার ছাড়া ‘সৃজনশীল’ শিক্ষাপদ্ধতিতে নতুন কিছু আমাদের চোখে পড়েনি। তা ছাড়া সৃজনশীল প্রশ্ন শিক্ষকরা কতটুকু বোঝেন তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ফলে পাঠদানে রয়ে যাচ্ছে প্রচুর খামতি। সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা আবার মুখস্ত করছে ‘সহায়ক’ বই। গাইড বই বন্ধ হয়েছে বেশ আগে। কিন্তু ঠিকই ‘কায়দা করে’ চলছে এসব ‘সহায়ক বই’। শুধু নামেই আলাদা।
সম্প্রতি এইচএসসির প্রশ্নপত্রের কয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে কথা উঠেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তুমুল সমালোচনা। প্রশ্নপত্রে কমপক্ষে তিনটি সমালোচনাযোগ্য উপাদান ছিল। ৬ নভেম্বর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বাংলা-২য় প্রশ্নপত্রের একটি প্রশ্ন ছিল এমন ‘প্রখ্যাত সাহিত্যিক আনিসুল হক লেখালিখি করে সুনাম অর্জন করতে চান। ২১শে বইমেলায় তাড়াহুড়ো করে আনিসুল হক বই প্রকাশ করেন। পাঠকদের কাছে তার লেখা খাপছাড়া মনে হয়। ফলে পাঠকদের কাছে তিনি সমাদৃত হন না।’ এরপর প্রশ্ন করা হয়েছে, (ক) ‘যশ’ শব্দের অর্থ কী? (খ) ‘লেখা ভালো হইলে সুনাম আপনি আসিবে।’ উক্তিটি ব্যাখ্যা করো। (গ) আনিসুল হক কোন কারণে ব্যর্থ, তা ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ রচনার আলোকে ব্যাখ্যা করো। (ঘ) সাহিত্যের উন্নতিকল্পে ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ রচনায় লেখকের পরামর্শ বিশ্লেষণ করো। এই প্রশ্নে প্রথম মূল সমস্যা হলো ব্যক্তি আক্রমণ এবং বিদ্বেষ ছড়ানো। আনিসুল হক লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ফলে প্রশ্নকর্তা না জেনেই আনিসুল হকের নাম নিয়েছেন সেটা ভাবার অবকাশ নেই। এ রকম একটা পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে তাকে হেয় করা অত্যন্ত নিম্নরুচির কাজ। তাছাড়া উদ্দীপকের প্রথম বাক্যটিও ভুল। যিনি ‘প্রখ্যাত’ সাহিত্যিক তিনি কেন ‘সুনাম’ অর্জন করতে চাইবেন! প্রখ্যাত মানেই তো যিনি ইতিমধ্যে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করার মতো দায়িত্বশীল লোকজন ভুল বাক্য লিখবেন এটাও মেনে নেওয়া মুশকিল। আরেকটি প্রশ্নে ছড়ানো হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা। সেখানকার উদ্দীপকে বলা হয়েছে ‘নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ-বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ- বণ্টন মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আব্দুল নামের এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমি এক অংশ বিক্রি করে। আব্দুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙে যায়। কিছুদিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।’
সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা ও সংকট নিয়ে যখন বাংলাদেশে বহুল আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তখন এমন প্রশ্ন এইচএসসির শিক্ষার্থীদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে সেটা বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। উল্টোদিকে দেশে অনেক ইতিবাচক দৃষ্টান্ত আছে অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার। হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় গিয়ে দেখেছি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সম্মান রেখে সেখানকার বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হয় না। অথচ প্রশ্নের উদ্দীপকটিতে ঘৃণা ও বিদ্বেষের বাড়াবাড়ি রয়েছে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের জন্যই উদ্দীপকটি অস্বস্তিকর। দায়িত্ববোধ ও কাণ্ডজ্ঞানের অভাব থাকলেই কেবল এমন প্রশ্ন করা সম্ভব। আরেকটি উদ্দীপকে বলা হয়‘ফারজানা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত একজন কলেজ শিক্ষিকা। অনেক আগেই বিয়ের বয়স পেরিয়েছেনতাই তিনি বিয়ে করেননি। ছাত্রজীবনে তিনি ভালোবেসেছিলেন ব্যক্তিত্বহীন একজনকে। কারণ বাবা-মার যৌতুকের চাপের মুখে সে ফারজানাকে বিয়ের কথা অস্বীকৃতি জানায়। এরপর থেকে ফারজানা তার কলেজ আর একাকিত্ব জীবন কাটায়।’ উদ্দীপকটিতে সংবেদনশীলতার লেশমাত্র নেই। নারীশিক্ষার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও এখানে স্পষ্ট। আলোচ্য তিনটি উদ্দীপকই রচনা হিসেবে খুব নিম্নমানের তো বটেই, এসবের অভিঘাত সম্পর্কেও প্রশ্ন প্রণয়নকারীরা সচেতন নন।
সৃজনশীল প্রশ্ন নামে বাংলাদেশে যা চালু আছে তাতে কোনো প্রকার সৃজনশীলতা শেখানো সম্ভব না। সত্যিকার অর্থে যদি সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হয় তাহলে যেসব দেশে সৃজনশীল শিক্ষা চালু আছে সেখান থেকে পদ্ধতি দেখে-শুনে-বুঝে প্রথমে আমাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। প্রকৃত বিদ্বান মানুষদের যুক্ত করতে হবে এসব কাজের সঙ্গে। তারপর ভাবতে হবে এটি চালু করার কথা। গোঁজামিল দেওয়া নামসর্বস্ব শিক্ষাপদ্ধতিকে সৃজনশীল নামে চালিয়ে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়।
বাংলাদেশে যেহেতু ‘কায়দা করে’ অনেক কিছু হওয়া সম্ভব, শিক্ষকতার চাকরিও এর ব্যতিক্রম নয়। সবাই জানে সরকারি চাকরি পেতে বড় অঙ্কের টাকা দিতে হয়। মেধাহীন মানুষদের শিক্ষকতার মতো গুরুত্বপূর্ণ পেশায় বসালে তার খেসারত পুরো জাতিকেই দিতে হবে। আমরা, আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকেরা অন্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করি, কিন্তু তাতে প্রলয় বন্ধ হয় না।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
রাজধানী ঢাকায় ছোট্ট একটি কম্পোজ ও ফটোকপির দোকান চালান জালাল। মাসে যা আয় করেন তা দিয়েই চলে তার চার সদস্যের পরিবার। দোকানে শিক্ষার্থীদের খাতা-কলম আর কাগজও বিক্রি করেন তিনি। কিন্তু মাস দু-এক ধরে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই তার জন্য কষ্টকর হয়ে পড়েছে। হঠাৎ করে কাগজের বাজারে অস্থিরতাই এর প্রধান কারণ। কয়েক গুণ বেশি টাকা দিয়েও নিয়মিত মিলছে না প্রিন্ট ও ফটোকপির কাগজ। বেশি টাকায় কাগজ মিললেও কাস্টমার বাড়তি টাকায় প্রিন্ট ও ফটোকপি করতে নারাজ। এ নিয়ে নিয়মিত চলছে বচসা। তার ভাষায়, ‘কাস্টমার সাফ বলে দেয়আপনারা তো ডাকাত। সরকার তো কাগজের দাম বাড়ায়নি। আপনি কেন বেশি নেবেন? আমরা কীভাবে বোঝাব যে সরকার তো কাগজের বাজারটা নিয়ন্ত্রণও করছে না।’
জালাল বলছিলেন, ‘কাগজের দাম বাড়ার কারণে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের খাতার বিক্রিও কমেছে কয়েক গুণ। কাগজের প্যাকেট, কার্টুনসহ কাগজসংশ্লিষ্ট পণ্যের দামও অনেক। এভাবে কাগজের দাম বাড়লে আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের পথে বসতে হবে। শিক্ষার্থী আছে এমন পরিবারগুলোকেও গুনতে হবে খরচের বাড়তি টাকা। এর প্রভাব পড়বে সরকারের ওপরও। তাই কাগজের দামের লাগাম টানতে সরকারকেই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।’
কাগজের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের ওপরও যে এর প্রভাব পড়ছে তা উঠে আসে ঢাকার কাফরুল এলাকার এ ব্যবসায়ীর ভাষ্যে। কয়েক মাস পরেই বইমেলা আর জানুয়ারি মাসে নতুন বই লাগে স্কুল-কলেজে। ঠিক তখনই কাগজের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বাজারে সরবরাহেও টান পড়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানান সংশ্লিষ্টরা। এ সুযোগে হু-হু করে বাড়ছে কাগজের দাম। পাইকারিতে কাগজের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা পণ্যের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত এক সপ্তাহে পাইকারি বাজারে কাগজের দাম প্রতিদিনই বেড়েছে।
হোয়াইট প্রিন্ট কাগজের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে টনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা বেড়ে দাম দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায়। প্রতি টন হোয়াইট নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম বেড়েছে ১৫ হাজার টাকা। এ কাগজের দাম ২০ হাজার থেকে বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে লেজার কাগজের দাম। প্রতি টনের দাম ৩০ হাজার টাকা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। প্রতি টন নিউজপ্রিন্ট কাগজের দাম ৬৪ হাজার থেকে বেড়ে ৮৫ হাজার টাকা হয়েছে। এ কাগজের দাম গত দুই সপ্তাহে বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। শুধু যে কাগজের দাম বেড়েছে তা নয়। বেড়েছে মলাটের কাগজ, আর্ট কার্ড ও রঙিন কাগজের দামও। কিন্তু কাগজের এ দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের তদারকি, কোনো উদ্যোগ কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির বক্তব্যও আমরা পাইনি।
বর্তমান সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে বই তুলে দেওয়া। কাগজের বাজারে অস্থিরতার কারণে সেটিও অনেকটা শঙ্কার মুখে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে দেরিতে কাজ পাওয়া, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়া, বিদ্যুৎ-বিভ্রাটসহ নানা চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা।
তবে বই পাওয়া বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জোর আশ্বাস দিলেও বই ছাপার কাজ যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে নতুন বছরের প্রথম দিন প্রাথমিকের সব পাঠ্যবই পাওয়ার সুযোগ কম বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। কাগজের মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি শিক্ষা ও শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট কাজকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। প্রতিটি পরিবারের শিক্ষার খরচও তখন বেড়ে যায়, যা চলছে বর্তমানে।
কিন্তু কেন কাগজের এই লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি? গণমাধ্যমের সংবাদ বলছে, কাগজের কাঁচামালের সংকট রয়েছে। বিদ্যুতের সংকটের কথাও তুলে ধরছেন ব্যবসায়ীরা। ব্রাইটনেস কাগজের জন্য লাগে ভার্জিন পাল্প। চাহিদা থাকলেও যেটা পর্যাপ্ত পরিমাণ আমদানি হয়নি। ডলার সংকটের কারণে এখন আমদানিও করা যাচ্ছে না। পাল্পের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় কাগজকল মালিকরা তা আমদানিও করছেন না। ফলে কাগজের চাহিদার এই সময়ে সংকট তৈরি হচ্ছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে কাগজের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হবে প্রকাশনা শিল্প। এমনটাই মনে করছেন প্রকাশকরা। করোনা পরিস্থিতির পর সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালেই স্বাভাবিক সময়ে বইমেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। মেলা উপলক্ষে দেশীয় প্রকাশনীগুলোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে এখন থেকেই। কিন্তু কাগজের দামসহ সব খরচ বেড়ে যাওয়ায় বইয়ের দামও অনেকটাই বাড়বে। এতে পাঠকরা বই কিনতে এসে বড় একটা ধাক্কা খাবেন এবং বই বিক্রি স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। ফলে দেশে বই বিক্রির সবচেয়ে বড় মৌসুমে বাড়তি দামে বইয়ের বেচাকেনা নিয়ে এখনই চিন্তার ভাঁজ অনেকের কপালেই।
অনেক প্রকাশক বাছাই করে নতুন বই বা কেউ কেউ নতুন বই করবেন না বলেও পরিকল্পনা করছেন। এতে প্রকাশনা শিল্প যেমন হুমকির মুখে পড়বে, তেমনি দেশের শিল্প-সাহিত্যের অগ্রগতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা মোটেই কাম্য নয়। তবে বিক্ষিপ্তভাবে প্রকাশকরা গণমাধ্যমের কাছে কাগজের মূল্যবৃদ্ধিতে তাদের ক্ষতির কথা তুলে ধরলেও সম্মিলিতভাবে এখনো সরকারের কাছে তারা এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন এমন কোনো খবর আমরা পাইনি। যেটি হওয়ার উচিত ছিল বলে মনে করেন অনেকেই। এ বিষয়ে প্রকাশকদের ঐক্যবদ্ধতার ঘাটতি রয়েছে এবং সে সুযোগে একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময় কাগজের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন বলে মত দেন কেউ কেউ। প্রকাশনা শিল্পে সৃজনশীল বই প্রকাশের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কাগজের দামসহ বই-সংক্রান্ত সব বিষয়ের প্রতি নজর দিতে সরকারিভাবে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করাও উচিত বলে মনে করেন লেখক ও প্রকাশকরা। এতে শিল্প-সাহিত্যের অগ্রগতিতে বাধাগ্রস্ত হওয়ার সুযোগও কমে আসবে বলে মনে করেন তারা।
একসময় কাগজের মূল্যবৃদ্ধিকে জাতীয় সংকট হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ৮ জানুয়ারি বরিশালে ঘূর্ণিঝড় এলাকা পরিদর্শন করেন তিনি। সেখানে অবস্থানকালে তার সঙ্গে দেখা করতে যান বরিশাল থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকার প্রকাশকরা। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের নিউজপ্রিন্ট কাগজ বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানান। প্রকাশকদের সব কথা শুনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ইহা জাতীয় জীবনের একটি আশু সংকট। দুই বৎসরে দুই ধাপে কাগজের টনপ্রতি মূল্যবৃদ্ধির কারণে এর তীব্র প্রভাব পড়িবে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিতে, যা এই অঞ্চলের মানুষের ওপর নতুন আরেকটি বোঝার শামিল। জাতীয় সংবাদপত্র শিল্প যাহাতে এই সংকট থেকে উত্তরণ পায় তাহার ব্যবস্থা লওয়া হইবে।’
তাই বঙ্গবন্ধুকন্যার আমলে কাগজের সংকট ও লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিকে সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দ্রুত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেএমনটাই আমাদের আশা।
লেখক: লেখক ও গবেষক
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে রেকর্ড গড়ে সেঞ্চুরি করেছেন মুশফিকুর রহিম। যে ইনিংসটি চোখে লেগে আছে ওপেনার লিটন দাসের। মুশফিকের এদিনের মতো ইনিংস বাংলাদেশের আর কোনো ক্রিকেটারে ব্যাটেই দেখেননি বলে মন্তব্যও করেছেন তিনি।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ম্যাচটি বৃষ্টিতে ভেসে যায় বাংলাদেশ ইনিংসের পরই। এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৬ উইকেটে ৩৪৯ রানের পুঁজি গড়ে বাংলাদেশ। যা নিজেদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।
ছয় নম্বরে খেলতে নেমে মুশফিক ৬০ বলে ১০০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন ১৪ চার ও ২ ছক্কায়। ম্যাচ শেষে দলের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন লিটন। এ সময় মুশফিকের ইনিংস নিয়ে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে আমি যতদিন খেলছি, বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ই এভাবে শেষের দিকে গিয়ে ১০০ করেনি।’
মুশফিকে মুদ্ধ লিটন বলে যান, ‘যখন দল থেকে কেউ এরকম একটা সেঞ্চুরি করে, দেখলে অনেক ভালো লাগে। সিনিয়ররা কেউ করলে তো আরও ভালো লাগে। মুশফিক ভাইয়ের শুধু আজকের ইনিংস না, শেষ ম্যাচের ইনিংসটা যদি দেখেন, আমার মনে হয় অসাধারণ ছিল।’
‘যদিও রান বেশি নয়, ৪০ বা এরকম ছিল (২৬ বলে ৪৪)। এটাই কিন্তু বড় ভূমিকা রাখে তিন শর বেশি রান করতে। আজকের ইনিংসটা তো ম্যাচের চিত্র বদলে দিয়েছে।’
সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৮ উইকেটে ৩৩৮ রান করেছিল টাইগাররা। এ ম্যাচের আগ পর্যন্ত সেটাই ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ম্যাচটা বাংলাদেশ জিতেছিল রেকর্ড ১৮৩ রানের ব্যবধানে। রানের হিসেবে যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। সুবাদে ১-০ তে সিরিজে এগিয়ে তামিম ইকবালের দল।
একই ভেন্যুতে আগামী বৃহস্পতিবার সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হবে।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।