
বাংলাদেশ নামক এই ভূখন্ডের মানুষ নিজস্ব রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করার সুযোগ পেয়েছে ১৯৭১ সালের দেশের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে। আমরা সবাই জানি আমাদের এই স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাধ্যমে। বাংলাদেশ নামক দেশটি যখন তৈরি হয় তখন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নানান সমস্যায় দেশের মানুষ ছিল জর্জরিত। ভঙ্গুর অবকাঠামো, অতি দারিদ্র্যের হার, পুষ্টিহীনতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক চাহিদা ও অধিকারের অপ্রাপ্তি ছিল প্রায় সর্বব্যাপী। উল্লেখ্য, এর পেছনে রয়েছে ঔপনিবেশিক যুগ থেকে শুরু করে ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনা ও পরাধীনতা। আর এ কাজে তারা ব্যবহার করেছে তাদের প্রশাসন ও সামরিক তন্ত্রকে। গত পঞ্চাশ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বিভিন্ন আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে এ দেশের অগ্রগতি অনেকের জন্য বিস্ময়কর। অনেকে একে ‘প্যারাডক্স’ বা স্ববিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্যারাডক্স এই অর্থে যে শাসনব্যবস্থায় ধারাবাহিক চ্যুতি থাকা সত্ত্বেও কীভাবে ধারাবাহিক উন্নয়ন করা সম্ভব? এতসব পরিবর্তন সত্ত্বেও এ দেশে ধীরে ধীরে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার প্রকট ঘাটতি, ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা, গোষ্ঠীগত স্বার্থের প্রাধান্য এবং জনগণের একটা বড় অংশের প্রান্তিকতা এখনো একটি বড় উন্নয়ন ইস্যু। অনেকে এটাকেই ‘প্যারাডক্স’-এর ফলাফল হিসেবে দেখে থাকেন আর এটিই আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়ন পরিস্থিতি পরবর্তী ধাপে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।
১৯৭১ সালে স্বাধীন হলেও, স্বাধীন দেশেও রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামো ছিল সেই ঔপনিবেশিক আমলের পুরনো ব্যবস্থাপনায়। বিজ্ঞজনরা বলেন, এখনো আমরা পাকিস্তান আমল তো বটেই অনেক ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাঠামো অনুসরণ করে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনা করছি।
অনেক সময় ঔপনিবেশিকতার দর্শন শুধু রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, আমরা জনগণও এর দ্বারা প্রভাবিত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতিকে যতটা অন্তরে ধারণ করেছিলেন, ততটাই বুঝেছিলেন এ দেশের মানুষকে। তিনি তো আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি’। কবিগুরু বাঙালি ও মানুষ হওয়ার মধ্যে কী পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন তা এত সহজ করে বলা সহজ হয়। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে রেসকোর্স ময়দানের এক সমাবেশে তিনি কবিগুরুকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘সাত কোটি বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ স্বাধীনতার সমসাময়িককালে বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও সংস্কৃতির মধ্যে সমতা ও সাম্য বোধের যে উন্মেষ ঘটেছিল তা ক্ষমতার মোহের আবহে খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। যেমন পারেনি সমাজ কাঠামোকে দুর্নীতির গ্রাস থেকে মুক্ত করতে। স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু এই সংকট বুঝতে পেরে রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার কাছে যে বিকল্প ছিল তা থেকে তিনি একটি বেছে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, অবশ্য, এই কাঠামো কতটুকু ভালো, কতটুকু মন্দ, কতটুকু গণতান্ত্রিক বা উদার তা নিয়ে প্রশ্ন করার যথেষ্ট সুযোগ আছে এবং থাকবেও।
বঙ্গবন্ধুর সেই প্রচেষ্টা যেমন সফল হয়নি, তাই শাসনব্যবস্থা নিয়ে আমাদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পরও আমরা বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। অনেকেই বলে থাকেন, স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতার কেন্দ্র পরিবর্তন হলেও ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো ও তথাকথিত ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হতে পারেনি। এখনো কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার দাপট ও পদে পদে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব চোখে পড়ার মতো। এর প্রধানতম কারণ মনে হয় দেশ স্বাধীন হলেও আমরা শাসনব্যবস্থার কাঠামো যেমন স্বাধীন করতে পারিনি, তেমনি পারিনি আমাদের পুরাতন চিন্তাভাবনা বদলাতে। অন্যদিকে এই দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় কয়েক গুণ। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায়নি, গড়ে তোলা যায়নি অত্যাবশ্যকীয় অবকাঠামো। জনসংখ্যার একটা অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচ থেকে বের হয়েছে সত্য কিন্তু একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য এবং ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীনদের মধ্যে পার্থক্য। দেশকে আমরা যতই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বলি না কেন বর্তমান ব্যবস্থাপনায় সেবা প্রদানকে কোনোভাবেই নাগরিকের অধিকার হিসেবে দেখা হয় না। বরং সেবা গ্রহণের প্রক্রিয়া অনেকে বেশি ভারসাম্যহীন ক্ষমতা সম্পর্ক দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক দলের নেতারাসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে শাসন কাঠামোর পুনর্গঠনের বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। অনেকেই শাসনব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি বেশ জোরেশোরে নিয়ে আসছেন। আসলে আমাদের শাসন কাঠামোতে বিভিন্ন গোষ্ঠী ক্ষমতা আহরণ করেছে কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য শাসনব্যবস্থার সংকট সব সময়ই ছিল। অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির প্রশ্ন প্রায় সব সময় উত্থাপিত হয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সরকারি সেবা পেতে প্রায় সব সময়ই কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। আর এখানেই মূল সংকটটি দৃশ্যমান। আর এই সংকট দূর করাই নতুন শাসনব্যবস্থার লক্ষ্য হওয়া উচিত, যেখানে সমতা ও সাম্য এবং ক্ষমতাহীনদের মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি সরকারি সেবা প্রদানের জন্য জনগণের কাছে স্বচ্ছতার পাশাপাশি জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে বর্তমান দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের বড়ই প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমান ব্যবস্থাপনায় একদিকে যেমন নীতিগত ও কাঠামোগত সংকট রয়েছে এবং একই সঙ্গে এই বিশেষজ্ঞ জ্ঞানেরও ঘাটতি। প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির ধারণ করা বা প্রথাগত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বর্তমান প্রতিযোগিতায় তাল মেলানো সম্ভব হবে না।
নতুন যুগে নতুন ব্যবস্থাপনা ও নতুন কাঠামোর প্রশাসন হবেÑসেটাই প্রত্যাশিত। কাঠামো ঠিক রেখে শুধু পাত্র-পাত্রী পরিবর্তন করে প্রত্যাশিত পরিবর্তন আশা করা উচিত হবে না। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে আজকে আমাদের বড় অর্জন বাংলাদেশ এখন দরিদ্র দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল বিশ্বে পদার্পণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো। এই উন্নয়নশীল বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশাও অনেক বেশি। পুরনো কাঠামো কিন্তু উন্নয়নশীল বাংলাদেশ বড় বেশি বেমানান। নিঃসন্দেহে এই উত্তরণ দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে নতুন চাহিদা তৈরি করবে এবং এই চাহিদা পূরণ করাই একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে তৈরি হতে পারে। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে উত্তরণের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার এখনই সময় এবং যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন প্রচলিত চিন্তাভাবনা থেকে মুক্তি ও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং এর মধ্য দিয়ে নতুন ব্যবস্থার গ্রহণ।
লেখক : উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
কেবল আমরা সাধারণ মানুষরা নই, বড় বড় মানুষও ভুল করেন। কেউ কেউ বলেন, বড় বড় মানুষ যে ভুল করেন সেটা ভালোই করেন, তাদের দেখে আমরা সান্ত¡না পাই এই ভেবে যে, তারাই যদি ভ্রান্ত হন তবে আমরা কোন ছার! তা ব্যক্তিগত ব্যাপারে ভুল করুন ঠিকই আছে, বিপদ হয় রাজনৈতিক ব্যাপারে ভুল করলে। আমরা জড়িয়ে পড়ি। প্রহৃত, বিপদগ্রস্ত, বিপর্যস্ত হই। মারা পড়ি। মওলানা আজাদ বলেছেন, তিনি ভুল করেছিলেন। মস্ত বড় ভুল। ঠিক একই কথা বলেছিলেন জিন্নাহও। বলেছেন, মস্ত বড় ভুল করেছিলেন। এবং কী আশ্চর্য, পরিহাস কত বড়, একই বিষয়ে ভ্রান্তি তাদের পাকিস্তান বিষয়ে। দুজনে দুই শিবিরের মানুষ ছিলেন তারা। পাকিস্তান প্রশ্নে ঠিক আকাশপাতালের ব্যবধান তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে, কিন্তু ঠিক ওই ব্যাপারেই মস্ত বড় ভুল করলেন তারা উভয়েই। পরিহাস তো বটেই। ইতিহাসের? নাকি মানুষের?
মওলানা আজাদের সেই ত্রিশ পৃষ্ঠার রহস্য আজ বিশ বছরের প্রতীক্ষা ও নানা মামলা-মোকদ্দমার বাধা পার হয়ে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। তিনি লিখে গেছেন, তার মৃত্যুর পূর্বে, যে ১৯৪৬ সালে জওয়াহেরলাল নেহরুকে কংগ্রেসের সভাপতি করার প্রস্তাব দিয়ে তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে মারাত্মক ভুলটি করেছেন। কেননা সভাপতি হয়েই নেহরু একটা কা- করলেন। বলে বসলেন যে, ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান গ্রহণের দ্বারা কংগ্রেসের হাত-পা বাঁধা পড়ে যায়নি, কংগ্রেস ইচ্ছা করলেই ওই প্ল্যান যেমন ইচ্ছা বদলে নিতে পারবে। জিন্নাহ যেন এই বক্তব্যের অপেক্ষাতেই ছিলেন। ভারতীয় ইউনিয়নের মধ্যে থাকার ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান জিন্নাহ না পারতে মেনে নিয়েছিলেন, এখন কংগ্রেস তা মেনে নেয়নি বলার সুযোগ পেয়ে তিনিও বলে বসলেন, তাহলে আমরাও মানি না। উল্টো তিনি প্রত্যক্ষ কর্মপন্থা দিবস ঘোষণা করলেন। দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেধে গেল। অনিবার্য হয়ে পড়ল পাকিস্তান সৃষ্টি। এভাবে নেহরু যে পাকিস্তানকে ঠেকাবেন বলে ভেবেছিলেন, চেয়েছিলেন, সেই পাকিস্তানকেই প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে দিলেন। মওলানার দুঃখ নেহরুর নাম তিনিই প্রস্তাব করেছিলেন, না-করলে নেহরু সভাপতি হতেন না, এবং ওই কথা বলার সুযোগও পেতেন না।
দুঃখ জিন্নাহরও। মৃত্যুর পূর্বে তিনিও বলে গেছেন পাকিস্তান সৃষ্টি ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। কাকে বলেছেন? খোদ ‘কায়েদে মিল্লাত’ ‘উজিরে আজম’ লিয়াকত আলী খান সাহেবকে। কথাগুলো মারাত্মক ‘নিজেকে তুমি এখন মস্ত মানুষ মনে করছো তাই না? তুমি কে? কিচ্ছু না। আমিই তোমাকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছি। তুমি ভাবছো তুমিই পাকিস্তান বানিয়েছো। তুমি না। বানিয়েছি আমি। কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি যে, আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি করে ফেলেছি। এখন যদি সুযোগ পাই আমি দিল্লি যাব, জওয়াহেরলালকে বলব অতীতের ভুল-ভ্রান্তি ভুলে গিয়ে আবার বন্ধু হতে।’ মৃত্যুপথযাত্রী জিন্নাহ বলেছেন এ কথা, লিয়াকত আলী খানকে। বলে হাত তুলে ভঙ্গি করেছেন হাত মেলানোর। নেহরুর সঙ্গে।
সাক্ষী তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক লে. ক. ইলাহী বক্স। পরে, লিয়াকত আলী খান সেই তাদের পরস্পরের শেষ সাক্ষাৎ সেরে চলে গেলে, ফাতেমা জিন্নাহ বলেছেন ইলাহী বক্সকে, ‘লিয়াকত আলী খান এসেছিলেন নিজের চক্ষে দেখে যেতে ভাই আর কতক্ষণ বাঁচবেন।’ ভ্রাতার রোগশয্যার পাশে দাঁড়িয়ে বলেছেন তিনি ওকথা। ফাতেমা জিন্নাহর উক্তিটি এর আগেই প্রকাশ পেয়েছে, এবং তার ভিন্ন রকম অর্থ এত দিন করা হচ্ছিল, কিন্তু জিন্নাহর নিজের উক্তির আলোকে ফাতেমা জিন্নাহর উক্তির অর্থ এখন একটাই দাঁড়ায়, অন্য কোনোটা নয়।
জিন্নাহ লিখে যাননি এসব কথা। সময় ছিল না। লিখলেও প্রকাশ পেত না। পাকিস্তানে তখন অন্য রকম অবস্থা। এমনকি ওই যে চিকিৎসক তিনিও এসব কথা লেখেননি নিজে, যদিও জিন্নাহর শেষ দিনগুলোর ওপর একটি বই লিখেছেন তিনি। তবে এক বন্ধুকে বলেছেন সব কথা। সেই বন্ধুও ফেলনা কেউ নন, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন এক সময়ে। এই দ্বিতীয় ভদ্রলোক পেশোয়ারের এক দৈনিকে একটি প্রবন্ধে ফাঁস করে দিয়েছেন এসব কথা। তিনি বলেছেন, ১৯৫২ সালে লে. ক. ইলাহী বক্স তাকে বিবরণ দিয়েছিলেন সমগ্র ঘটনার। ‘আল্লাহ আমাকে শাস্তি দেবেন, যদি ইলাহী বক্সের কথা এক বর্ণও বাড়িয়ে বলে থাকি আমি।’ ইনি কসম খেয়ে বলেছেন। ইলাহী বক্স নিজে একটা বই লিখলেন, কিন্তু তাতে এসব তথ্য কিছুই দিলেন না। কেন? এ প্রশ্নের জবাবে ইলাহী বক্স বলেছেন, জবাব সোজা। ভয়। ‘ভয় ছিল সত্য কথা বললে লোকে আমাকে ফেড়ে ফেলবে।’ কে অস্বীকার করবে এর যথার্থতা?
পাকিস্তান যে একটা ভুল এত কংগ্রেস বলবে, জিন্নাহ কেন বললেন? সে-প্রশ্ন খুবই জরুরি, বিশেষ করে আমাদের জন্য, আমরা যারা জড়িত এবং ভুক্তভোগী। কিন্তু তারও আগে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা দরকার : ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা কী? পাহাড় বেয়ে গাড়িটা নামছিল তখন ঘোড়া গাড়িকে টানছিল, নাকি গাড়ি ঘোড়াকে ঠেলছিল পেছন থেকে? এ জিজ্ঞাসা টলস্টয়ের ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ উপন্যাসে। আরও একটি উপমা দিয়েছেন তিনি, আপেলটি যে পড়ে গেল তার কারণ কী? বোঁটাটি শুকিয়ে গিয়েছিল? জোরে বাতাস বইছিল? পাখিতে ঠুকরে দিয়েছিল? নাকি নিচে দাঁড়ানো বালকটি ইচ্ছা করেছিল বলেই টুপ করে পড়ে গেল ফলটি। বালক তাই মনে করে। আমরাও তাই মনে করি। ইতিহাসের গাছের নিচে অপেক্ষমাণ বালক হয়ে যাই আমরা থেকে থেকে ভাবি যা কিছু ঘটছে সব আমাদের মঙ্গলের জন্যই। না-ভাবলেও ভাবানো হয়। এ ক্ষেত্রেও হয়েছে। প্রচার করা হয়েছে পাকিস্তান আমাদের মঙ্গলের জন্যই, যদিও মঙ্গল হয়েছে অল্পকজনেরই। ধনীদের। বিশেষভাবে পাঞ্জাবি ধনীদের। ওদিকে মওলানা আজাদ মনে করেছেন, পাকিস্তান তিনিই সৃষ্টি করলেন, পরোক্ষে। মাউন্টব্যাটেন অবশ্যই মনে করতে পারেন যে, তিনিই তো দিলেন পাকিস্তান-হিন্দুস্তান। এটলি বলতে পারেন তিনিই দায়ী। আর জিন্নাহ তো বলবেনই, বলেছেনই।
কিন্তু ইতিহাস কি অত সরল, অমন একরৈখিক? না, তা নয়। ইতিহাস বড় জটিল।
এবং ইতিহাস বড়ই পরিহাসপ্রিয়, নইলে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ঘোরবিরোধী নেহরু ও আজাদকে দিয়ে দ্বি-জাতিতত্ত্বের সেবা করিয়ে নেবে কেন সে, অমনভাবে? জিন্নাহর ক্ষেত্রেও ওই পরিহাস একবার নয়, বারবার দেখা গেছে। এককালে তিনি ছিলেন ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অগ্রদূত,’ কালে তিনিই হলেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রধান প্রবক্তা। ইংরেজি ছাড়া যিনি কথা বলতেন না, সাহেবি পোশাক ছাড়তেন না, খাদ্য-অখাদ্যের ব্যাপারে যার কোনো বাছ-বিচার ছিল না। কোন মাসে রোজা তার খবর রাখতেন না, নিজে বিয়ে করেছিলেন পার্সি মহিলাকে, কন্যা পার্সি যুবককে, তিনিই হলেন ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যখন ভারতবর্ষকে দ্বিখ-িত করতে বদ্ধপরিকর সেই সময়েই তিনি মাউন্টব্যাটেনকে বলেছিলেন, ‘পাঞ্জাব ও বাংলার হিন্দুস্তান-পাকিস্তান বিভাজন তিনি কিছুতেই মেনে নেবেন না।’ যুক্তি কী? যুক্তি খুব স্পষ্ট। ‘আপনি বুঝতে পারছেন না কেন,’ মাউন্টব্যাটেনকে তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন ‘পাঞ্জাব হচ্ছে একটি জাতি। হিন্দু বা মুসলমান তো পরে, আগে আমরা পাঞ্জাবি কিংবা বাঙালি।’ তাহলে দ্বি-জাতিতত্ত্বের বাকি থাকে কি? বাকি তিনি কিছু রাখতে চাননি, যেজন্য পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে, পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, পাকিস্তানে কেউ আর আলাদা করে হিন্দু থাকবে না, মুসলমানও থাকবে না, সবাই মিলে হবে এক জাতি। যে মুসলমানরা ভারতে পড়ে রইল তারা কোন জাতি সে প্রশ্নেরও জবাব দেননি। ওদিকে আবার পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালি যখন চঞ্চল হয়েছে, পাঠান অস্থির, বেলুচ উদ্বিগ্ন তখন তিনি তাদের ধমকে দিয়েছেন, বলেছেন, ‘তোমরা কেউ বাঙালি নও, পাঠান নও, বেলুচ নও, সবাই পাকিস্তানি।’ পরিহাসের কী কোনো অবধি আছে?
তা থাক পরিহাস, কিন্তু জিন্নাহ কেন বললেন যে, তিনি ভুল করেছেন পাকিস্তান সৃষ্টি করে, নেহরুই বা কেন বলতে গেলেন ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান মানি-না-মানি আমার ইচ্ছা? হতে পারে নেহরু ভেবেছিলেন, সভাপতি হিসেবে তিনি কর্তৃত্ব প্রকাশ করবেন। অন্তত তাই মনে হয় মওলানা আজাদের আত্মজীবনী যদি পড়ি। জিন্নাহ? তার ক্ষেত্রেও ওই একই সন্দেহ আমাদের। তিনি দেখছিলেন পাকিস্তানে তার কর্তৃত্ব নেই। তিনি কর্তৃত্ব ভালোবাসতেন, যেজন্য তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী না হয়ে গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন এবং যে, তার পাকিস্তানে গভর্নর জেনারেলই হবেন সর্বেসর্বা, প্রধানমন্ত্রী আজ্ঞাবহ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেখলেন এক পাহাড়ি অঞ্চলে তাকে ফেলে রাখা হয়েছে, কেউ খোঁজ নেয় না, টেলিগ্রাম পাঠালে ওষুধ আসে না। বুঝে ফেললেন পাকিস্তান কী বস্তু। রেগেমেগে তাই ওই কথা বললেন, লিয়াকত আলী খানকে। লিয়াকত আলী কী করলেন? ইলাহী বক্স বলছেন লিয়াকত আলী একটুও বিচলিত হননি। জিন্নাহকে শায়িত রেখে হেঁটে চলে এলেন। পাশের কামরা পার হয়ে বারান্দায় গেলেন। ‘তারপর তিনি খুব জোরে হাসলেন এবং উঁচু গলায় বললেন, বৃদ্ধ এখন বুঝতে পেরেছেন যে, তিনি ভুল করে ফেলেছেন।’ আবার হাসি।
এর কদিন পরেই জিন্নাহর মৃত্যু হয়। লিয়াকত আলী খান নিজেও এরপর বেশি দিন বাঁচেননি। বছর-তিনেক পরে তিনিও মারা গেলেন। জিন্নাহর তবু স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল, লিয়াকত আলী খুন হলেন। মৃত্যুর আগে সেই প্রসিদ্ধ উক্তিটি করে গেলেন, ‘খোদা পাকিস্তান কি হেফাজত করে।’ সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, যারা তাকে হত্যা করেছেন তারাই ওই উক্তি বসিয়ে দিয়েছেন তার মুখে। মারলেনই যখন, তখন অমর করে রাখতে অসুবিধা কী। গরু মেরে জুতা দান। পরিহাস। কিন্তু আরও বড় পরিহাস তো এখানে যে, ওই দোয়ার খুব প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য। কেননা খোদা ছাড়া পাকিস্তানকে বাঁচাতে পারে এমন শক্তি কারও ছিল না। তারা, যারা খুন করেছিলেন লিয়াকত আলীকে, তারা পাকিস্তান চাননি, পাকিস্তানকে রক্ষার ব্যাপারেও তাদের মাথাব্যথা ছিল না, কেবল নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার চেয়েছিলেন। কার স্বার্থ? পুঁজিপতির ও জমিদারের, বিশেষ অর্থে পাঞ্জাবির। জিন্নাহ পাঞ্জাবি ছিলেন না, লিয়াকত আলীও না, পাঞ্জাবিরা পাকিস্তান আনেনি, কিন্তু স্থির হয়ে গিয়েছিল যে তারাই পাকিস্তান শাসন করবে। তাই ঘটল। জিন্নাহ ও লিয়াকতের পরে প্রথম এলেন পাঞ্জাবি আমলারা, পরে সেনাপতিরা।
খ-িত পাকিস্তানে এখনো পাঞ্জাবিরাই প্রধান। বেনজির ভুট্টোর প্রধান অযোগ্যতা ছিল তিনি যে মহিলা তা নয়, অযোগ্যতা তিনি পাঞ্জাবি নন, সিন্ধি। আর ওই যে মোহাজের, ভারত থেকে এসেছে সর্বস্ব খুইয়ে, তারাও এখন বুঝছে পাঞ্জাবি সাথী কী বস্তু। মোহাজের নেতা আলতাফ হোসেন পাঞ্জাবি নেতা নেওয়াজ শরিফকে বলে দিতে কসুর করেননি, ‘আপনারা তো আমাদের ভারতের চর মনে করেন, তাহলে?’ পাঞ্জাবিরা যেহেতু নিজেদের পাঞ্জাবিই বলে পাকিস্তানি না-বলে, মোহাজেররা তাই বলছেন, তাহলে স্বীকার করতে হবে যে, পাকিস্তানে এখন জাতিসত্তা চারটি নয়, পাঁচটি পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পাঠান, বেলুচ ও মোহাজের। তাহলে? পাঁচ জাতির আবির্ভাব। পঞ্চজাতির সম্মেলন। আসল কথা স্বার্থ। জাগতিক স্বার্থই নানা রকম আধ্যাত্মিক ছদ্মবেশ গ্রহণ করে, নানা সময়ে। বেনজির ভুট্টো নিজেকে সিন্ধি বলেননি, বলেছেন পাকিস্তানি। সিন্ধি বললে সুবিধা নেই, অসুবিধা রয়েছে। সমূহ।
বড় মানুষরা বড় বড় ভুল করেন এবং দুঃখ প্রকাশ করে আরও বড় হন। কিন্তু তারা কী করবে যারা : উলুখাগড়া, রাজায় রাজায় যুদ্ধে যাদের প্রাণ যায়? কিংবা যারা গাছের তলের বালক, যেভাবে ফলটা তার জন্যই পড়েছে, কিন্তু তুলতে গেলেই দেখে বিপদ, দারোয়ান আসছে ছুটে। ঘাড় ধরে বলে, তুমি চোর। মূল্য যা দেওয়ার এই সাধারণ মানুষই দেয়। দিয়েছে বৈকি সাতচল্লিশে, একাত্তরে। লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। তাদের জন্য ভুল করার কোনো সুযোগ ছিল না, সুযোগ ছিল কেবল প্রাণ দেওয়ার। অর্থাৎ মৃত্যুবরণ করার। ওদিকে নেপোরা কিন্তু দই মেরেই চলেছে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
টেলিভিশন নাট্যাভিনেতা মীর সাব্বিরের একটি উক্তিতে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেশ সরগরম। লাইভ অনুষ্ঠানে পোশাক নিয়ে মন্তব্য করায় আক্রান্ত বোধ করেছেন এমন অভিযোগ করেছেন অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা ইসরাত পায়েল। এর পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আলোচনা চলছে। অনেকে বলছেন উপস্থাপিকা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেননি কিন্তু পরে এটা নিয়ে কথা বলেছেন কারণ তিনি আলোচনায় থাকতে চান। আবার অনেকের মতে মীর সাব্বিরের এমন রসিকতা করা উচিত হয়নি। এসব ক্ষেত্রে যা হয় মঞ্চে অপ্রীতিকর কোনো কিছু ঘটলেও সেটাকে সামলে নিয়ে অনুষ্ঠান চালিয়ে নিয়ে যেতে হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের। সে কারণেই সঞ্চালনা বা উপস্থাপনার জায়গাগুলোতে উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন, স্মার্ট নারী-পুরুষকে বেছে নেওয়া হয়। সেদিনের ঘটনাতে ইসরাত পায়েলও একই কাজ করেছেন। তিনি আক্রান্ত হয়েছেন এমনটা অন্তত মঞ্চে প্রকাশ করেননি। কেননা তিনি সেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব পালন করছিলেন। অনুষ্ঠানের সুরটি কাটতে না দেওয়াতে তার পেশাদারি মনোভাবই প্রকাশ পেয়েছে।
কিন্তু অনুষ্ঠানের পরে তিনি অভিযোগ করেছেন যে তিনি এতে আক্রান্ত বোধ করেছেন। মঞ্চে এ ধরনের জোকস নতুন কিছু নয়, নারীরা খুব কম ক্ষেত্রে এসবের প্রতিবাদ করেন, অধিকাংশ সময়েই এড়িয়ে যান, যেমন রাস্তাঘাটের উটকো লোকের ছোটখাটো টিপ্পনী তারা প্রতিনিয়ত এড়িয়ে যান। ইসরাত পায়েল প্রতিবাদ করেছেন সেজন্য তাকে সাধুবাদ জানানো উচিত। কারণ এই চুপ করে থাকার চর্চা বন্ধ হওয়া দরকার।
প্রাপ্তবয়স্কদের যেসব জোকস চালু আছে সারা দুনিয়ায়, তার বেশিরভাগই নারীদের হেয় করে বানানো। কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে কথা হচ্ছিল সেই মঞ্চে, তিনি তার কবিতায় বলেছেন ‘অপরের মুখ মলিন করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ নেই।’ বেশিরভাগ জোকসই কারও না কারও মুখ মলিন করে দেয়। তাহলে কি আমরা জোকস বলা বন্ধ করে দেব? তার দরকার নেই, কিন্তু মনে রাখতে হবে স্থান-কাল-পাত্রভেদে অনেক কিছুর অর্থই বদলে যায়। বন্ধুচক্রে বা ঘরোয়া আড্ডায় আমরা যেসব জোকস বলি বড় পরিসরের একটা লাইভ অনুষ্ঠানে সেগুলো না বলাই হলো কাণ্ডজ্ঞান।
আমরা এখন এমন এক দুনিয়ায় বাস করি যেখানে মামুলি ছাই থেকে শুরু করে সোনার প্রলেপ দেওয়া লাখ টাকার আইসক্রিম সবকিছুরই ক্রেতা আছে। আমাদের অনেক প্রয়োজন এখন কৃত্রিম এবং আদতে তাকে প্রয়োজনও বলা যায় না, কিন্তু তার জন্য লাখ টাকা, কোটি টাকা খরচ করি আমরা। আইফোনের জন্য লোকে কিডনি পর্যন্ত বিক্রি করে দিচ্ছে। বাজারব্যবস্থায় আমাদের সামনে এমন সব রঙিন স্বপ্ন তুলে ধরা হয় যার কারণে বিলাসিতাকে আমরা প্রয়োজন ভাবি এবং তার জন্য নিজের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিক্রি করে দিতেও ভাবি না। বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড আপনাকে বলে দিচ্ছে কোন জিনিসটা আপনার ‘দরকার’, কোনটা এখন ‘ফ্যাশন’, কোনটা ‘ট্রেন্ডি’। এ-সবই ব্যবসার কৌশল। এমনকি বিজ্ঞাপনের খরচ কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্রব্যের তৈরি-খরচের চেয়ে বেশি। সমাজ যেমন নারীকে আটকে রাখতে চায়, পুঁজিবাদী দুনিয়া চায় নারীর পণ্যায়ন।
এই যে পণ্যায়নের দুনিয়া, তার অন্যতম অভিশাপ হলো, ধনী-গরিবে বৈষম্য এখন আকাশচুম্বী। কারও বাসায় এত কাপড় যে রাখার জায়গা নেই আবার কেউ শতচ্ছিন্ন কাপড় গায়ে খোলা আকাশের নিচে জীবনপাত করছে। সবকিছুরই পণ্যায়ন হয়েছে এখন। যিনি ভাবছেন, আমি তো সারা দিন বিজ্ঞাপন দেখি কিন্তু কিছু কিনি না, তিনিও আসলে বাজারচক্রের বাইরে নন। কেননা বিজ্ঞাপন তাকে আটকে রাখছে ফোন অথবা টেলিভিশনের স্ক্রিনে। আটকে রাখছে তার সময়, উৎপাদনশীলতা, সৃজনশীলতা। আপনি কতক্ষণ কোন বিজ্ঞাপন দেখবেন সেটাও ঠিক করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নামক অত্যাধুনিক নতুন প্রযুক্তি। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীর যৌনতা বিক্রির ইতিহাস অনেক পুরনো। এখন পুরুষের যৌনতাও বিকোচ্ছে বাজারে। তবে, কে কী বিক্রি করবে সেটাও তার স্বাধীনতা। তা নিয়ে কটূক্তি শোভন নয়।
আপনাদের হয়তো মনে আছে এ বছরের শুরুর দিকে অস্কারের মঞ্চেও এমন একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। অস্কারজয়ী বিখ্যাত অভিনেতা উইল স্মিথ তার স্ত্রী জেডা পিঙ্কেটের রোগ নিয়ে রসিকতা করায় ক্ষেপে গিয়ে চড় মেরেছিলেন উপস্থাপক ক্রিস রককে। এই চড় মারার ঘটনা নিয়েও সারা দুনিয়া সেদিন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। একদল বলেছিল উইল স্মিথ ঠিক কাজটি করেছে, অন্যদলের অভিমত ছিল প্রকাশ্যে এমন কাণ্ড করা উচিত হয়নি স্মিথের। তবে, লক্ষণীয় হলো, জেডা কিন্তু নিজের অপমানে নিজে কোনো ভূমিকা পালন করেননি, করছিলেন উইল স্মিথ। চড় মারার আগে তিনি স্ত্রীর অনুমতি বা পরামর্শ নেননি, এটিকে ‘স্বামী-সুলভ’ দায়িত্ব মনে করেছেন।
পোশাকের জন্য আমাদের দেশের নারীদের প্রতিনিয়ত কটূক্তির শিকার হতে হয়। আমাদের সমাজ এখনো নারীর স্বাধীনতা, তার স্বাধীন মতামত বা ইচ্ছেমতো পোশাক নির্বাচনের অধিকার মেনে নেওয়ার মতো অবস্থায় আসেনি। সম্প্রতি রাস্তাঘাটে অচেনা মানুষদের কাছেও পোশাকের জন্য হয়রানির শিকার হতে হয়েছে বেশ কয়েকজন নারীকে। সেই দিক থেকে চিন্তা করলে মীর সাব্বিরের অন্তত পোশাক নিয়ে প্রকাশ্যে এমন রসিকতা করা উচিত হয়নি, সেটা তিনি যত নির্দোষ মনেই করেন না কেন। তিনি নিজে অবশ্য ভুল স্বীকার করে বলেছেন তিনি কিছু ভেবে কথাটি বলেননি, তাৎক্ষণিকভাবে বলে ফেলেছেন। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব এমনই যা আচমকা আমাদের আচরণে প্রকাশ পেয়ে যায়। মীর সাব্বিরের মতো বরিশালের স্থানীয় অনেকেই হয়তো এটিকে নির্দোষ রসিকতা ভাবতে পারেন, কিন্তু অনুষ্ঠানটি আঞ্চলিক ছিল না। তা ছাড়া আপাত নির্দোষ রসিকতাতেই নারীকে হেয় করার প্রচুর উপাদান থাকে। মানুষ এসব রসিকতাতে অভ্যস্ত থাকে বলে এগুলো বিশ্লেষণযোগ্য বা ভিন্নভাবে ভেবে দেখার মতো বলে মনে করে না।
অভিযোগ করার পর থেকে ইসরাত পায়েল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচুর কটূক্তির শিকার হচ্ছেন এবং এর সিংহভাগ তার পোশাক নিয়ে। আমাদের সমাজের পুরুষতান্ত্রিক এবং কর্র্তৃত্ববাদী আচরণ এসব কটূক্তি ও গালাগালের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। মেয়েদের যে ‘বড় গলায়’ কথা বলতে নেই সেটা আমাদের মেয়েশিশুরা ছোটবেলা থেকেই শুনে বড় হয়। আমরা সবসময় মেয়েদের দমিয়ে রাখতে পছন্দ করি। নারী কোনো অভিযোগ করলে আমরা বলি ‘মানিয়ে চলতে’। যেন মানিয়ে চলা শুধু নারীদের দায়িত্ব। নারীদের অভিভাবকের কোনো অভাব নেই এই সমাজে। পাশের বাসার আন্টি থেকে শুরু করে পথচলতি অচেনা লোক, সবাই নারীর মুরব্বি। নারী কেমন করে হাঁটবে, কথা বলবে, কোথায় যাবে, কী খাবে, কী পরবে সবটাই ঠিক করে দিতে চান এই অভিভাবকরা। মীর সাব্বিরের কথাতেও অভিভাবকত্বের প্রকাশ রয়েছে। উপস্থাপক পুরুষ হলে এই রসিকতা তার মাথায় আসত কি?
কিছু পেশা আছে যাদের কাজের ধরন এমন যে তারা না চাইলেও মানুষের প্রতি তাদের কিছু দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। অভিনয় এমনই এক পেশা। সমাজের একটা বড় অংশের মানুষ অভিনয়শিল্পীদের অনুসরণ করেন, তাদের কাজকর্মে প্রভাবিত হন, তাদের মতো হতে চেষ্টা করেন। সে কারণে আমাদের মতো নারীবিদ্বেষী ও পশ্চাৎপদ সমাজে অভিনয়শিল্পীদের দায়িত্বও অনেক বেশি। ফলে মীর সাব্বিরের মতো মানুষদের আপাত নির্দোষ কিন্তু সামান্য রকমের ত্রুটিবিচ্যুতিও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। লেখক: কবি ও সাংবাদিক
জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি প্রচারণা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাফল্যের দাবির কথা আমরা শুনে আসছি। তার অর্থ এই নয় যে, সরকার জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে পেরেছে। এই প্রেক্ষাপটে ঢাকার আদালতপাড়া থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের দুই সদস্য তাদের সহযোগীদের সহায়তায় পুলিশের চেখে স্প্রে ছিটিয়ে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ, আদালতপাড়া থেকে ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গি জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। পলাতক দুই জঙ্গির নাম মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব। উল্লেখ্য, আদালতে চার জঙ্গির হাজিরা শেষে তাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন একজন পুলিশ ও একজন আনসার সদস্য। গেটের সামনে আসার পরপরই জঙ্গিরা পুলিশ ও আনসার সদস্যকে কিল-ঘুসি মারতে শুরু করে। বাইরে আরও চার জঙ্গি বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ঘুসি দেওয়ায় পুলিশ সদস্য আহত হন। ফলে তার হাতে থাকা দুই আসামি ছেড়ে দেন তিনি। আনসার সদস্যকেও অনেক মারধর করা হয়েছে, স্প্রে মেরেছে প্রচুর। কিন্তু আনসার সদস্য দুই জঙ্গিকে ছাড়েননি। পুলিশ সদস্য যে দুই আসামিকে ছেড়ে দিয়েছেন তারা বাইরে রাখা মোটরসাইকেলে উঠে চলে যায়। এখানে আনসার সদস্যের কর্তব্যপরায়ণতা এবং পুলিশ সদস্যের পরাভূত হওয়া দুই রকম পেশাদারত্ব দেখতে পাই আমরা। পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের ধরতে সারা দেশে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর জনপ্রতি ১০ লাখ টাকা করে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। পাঁচ সদস্যর তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন ডিএমপি কমিশনার। কারোর দায়িত্ব পালনে অবহেলা থাকলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
দেশ রূপান্তরের আরেক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে পুলিশের প্রিজন ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেওয়া তিন জঙ্গির মধ্যে একজনের সন্ধান আজো মেলেনি। অপর দুজনের একজন বন্দুকযুদ্ধে নিহত, আরেক জন ভারতে গ্রেপ্তার রয়েছে। ওই ঘটনার তদন্তে গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাটি ছিল সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত। পুরো ঘটনায় পুলিশ ও কারাগারের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে। গত রবিবার ফের আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দুই জঙ্গিকে ফিল্মি স্টাইলে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাটিও যে পরিকল্পিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ৪ জঙ্গি আসামিকে হাজিরা শেষে নিতান্ত সাধারণ কয়েদির মতো প্রিজন ভ্যানে নিয়ে যাচ্ছিলেন মাত্র একজন পুলিশ ও একজন আনসার সদস্য! এমন দুটি স্পর্শকাতর হত্যামামলার আসামিকে এমন নিরাপত্তাহীনভাবে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে নেওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এ দায় কারা কর্তৃপক্ষ এবং আদালতের নিরাপত্তায় নিয়োজিতরা এড়াতে পারেন না। এবার তো জঙ্গিরা আগ্নেয়াস্ত্রের পরিবর্তে স্প্রে ছিটিয়েই কার্যসিদ্ধি করেছে। অন্যদিকে স্মরণযোগ্য যে, হলি আর্টিজান হামলার বিচারকালে আদালত প্রাঙ্গণে আসামিদের আইএসের টুপি পরিধানের ঘটনা ওই মামলার সাত আসামির মৃত্যুদ-াদেশের রায়কে কিছুটা মøান করে দিয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছিল, কী করে আসামিদের কাছে আইএসের প্রতীক সংবলিত টুপি এলো? আমাদের কথা হচ্ছে পরিকল্পিত হোক অথবা হঠাৎ উদ্ভূত পরিস্থিতিই হোক, কোনো অবস্থাতেই ঘটনাগুলো মোকাবিলা করতে না পারার দায় সরকার এড়াতে পারে না।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে নাম পরিবর্তন করে, কৌশল পরিবর্তন করে তৎপরতা চালিয়ে আসছে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কিশোর-তরুণদের জঙ্গি দলে নাম লিখিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়া, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সন্ধান ও গ্রেপ্তারের খবর নিয়মিতই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে আসছে। সর্বশেষ ঘটনায় সহযোগীদের ছিনিয়ে নিতে যে অভিনব অস্ত্রের ব্যবহার করেছে, তাতে মোটেও চিন্তামুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে জঙ্গিবাদে যারা জড়াচ্ছেন তাদের ৬১ ভাগের বেশি তরুণ। তাদের মধ্যে ৭৩ ভাগের বেশি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। সচ্ছল পরিবারের এসব তরুণ পারিবারিক, রাজনৈতিক, ভাবাদর্শগতসহ আটটি কারণে ছয়টি ধাপে জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছেন। যাদের অধিকাংশেরই অভিভাবকরা শুরুতে বিষয়টি বুঝে উঠতেও পারছেন না। গবেষণায় জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে করণীয় বিষয়েও বিস্তর নির্দেশনা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাঙালি সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ লালন, মননশীল চর্চা কিংবা খেলাধুলায় উৎসাহিত করা। অন্যদিকে, বাকস্বাধীনতা, ভিন্নমত, মুক্তবুদ্ধি ও বিজ্ঞানমনস্কতাই জঙ্গিবাদের টার্গেট হয়ে আসছে। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় পুলিশ ও গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করার পাশাপাশি, দেশে সামাজিক ন্যায়বিচার, বৈষম্যহীন ও ধর্মীয় বিদ্বেষমুক্ত সমাজ গঠনের মতো মৌলিক বিষয়গুলোতে জোর দেওয়া জরুরি।
প্রখ্যাত বাঙালি সংগীতশিল্পী, কবি, লেখক এবং সুরকার হেমাঙ্গ বিশ্বাস ১৯১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৩১৯ বঙ্গাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান তৎকালীন শ্রীহট্ট বা সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার চুনারুঘাট উপজেলার মিরাসি গ্রামে। বাবা হরকুমার বিশ্বাস ও মা সরোজিনী দেবী। কলেজে থাকতেই স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে ১৯৩৫ সালে প্রথমবার কারাবন্দি হওয়ার পর তিনি যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন। ১৯৪৮ সালে তেলেঙ্গানা আন্দোলনের সময় তিনি আবারও গ্রেপ্তার হন এবং তিন বছর কারাবন্দি থাকেন। ১৯৩৮-৩৯ সালে বিনয় রায়, নিরঞ্জন সেন, দেবব্রত বিশ্বাস প্রমুখের সঙ্গে মিলে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা ‘আইপিটিএ’ গঠন করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বাংলার প্রগতিশীল লেখক শিল্পীদের আমন্ত্রণে তিনি প্রথম কলকাতায় আসেন সংগীত পরিবেশন করতে। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তার উদ্যোগে এবং জ্যোতিপ্রকাশ আগরওয়ালের সহযোগিতায় ‘সিলেট গণনাট্য সংঘ’ তৈরি হয়। স্বাধীনতার আগে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের গানের সুরকারদের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রধান। চীন-ভারত মৈত্রীর ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল। ‘মাস সিঙ্গার্স’ নামে নিজের দল গঠন করে তিনি গ্রাম-গ্রামান্তর ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে বেড়িয়েছেন। তিনি ‘কল্লোল’, ‘তীর’, ‘লাললণ্ঠন’ প্রভৃতি নাটকের সংগীত পরিচালক ছিলেন। রাঢ় বঙ্গের ঝুমুর, বরেন্দ্রীর ভাওয়াইয়া, চটকা, জারি-সারি, মুর্শিদি, বঙ্গের ভাটিয়ালি, বীরভূমের বাউল, নদীয়ার ফকির বাউল হয়ে হাছন রাজায় মিলেছে তার গানের পথচলা। তিনি গাজীর গান, ধামাইল গান, বাইদ্যার গান, কবি গান, হোরি গানসহ নানা রাগের সুরকে আত্মস্থ করে গেয়েছেন অনেক গান। ১৯৮৭ সালের ২২ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
টেস্ট ক্রিকেটে সিলেটের পথচলা শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। অভিজাত সংস্করণে যা ছিল দেশের অষ্টম ভেন্যু। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ম্যাচ দিয়ে সাদা পোশাকের ক্রিকেটে পা রাখে দেশের সবচেয়ে সুন্দর এই স্টেডিয়ামটি। তবে মাঠের অভিষেক ম্যাচেই হেরে যায় বাংলাদেশ। তারপর আর কোনো পাঁচ দিনের খেলা গড়ায়নি এই মাঠে। এ নিয়ে স্থানীয়দের আক্ষেপের শেষ নেই।
অবশেষে অপেক্ষার প্রহর ফুরাচ্ছে। পাঁচ বছর পর আবারও টেস্ট ক্রিকেট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক ও সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল।
ক্রিকবাজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছেন, ‘আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরে আমরা নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ম্যাচের সিরিজের প্রথম টেস্ট আয়োজন করতে পারব বলে আশা করছি। এটি আমাদের জন্য খুব একটি উপলক্ষ হবে। কারণ পাঁচ বছর পর সিলেটের মাঠে টেস্ট ক্রিকেট ফিরবে।’
সম্প্রতি নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের প্রতিনিধি দল সিলেট সফর করেছে। তারা সেখানকার মাঠসহ সব সুযোগ সুবিধা পরিদর্শন করেছেন। পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষয়ে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। সবকিছু দেখে তারা এখানে আরও বেশি ম্যাচ আয়োজনের জন্য উন্মুখ বলে জানিয়েছেন বিসিবির নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান নাদেল।
তিনি যোগ করেছেন, ‘নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের প্রতিনিধি দল আমাদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বেশ মুগ্ধ। তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে আমরা তাদের সব প্রত্যাশা ও প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারব।’
এফটিপি সূচি অনুযায়ী চলতি বছর বাংলাদেশের বিপক্ষে তিন ওয়ানডে ও দুই টেস্ট ম্যাচের সিরিজে খেলার কথা নিউজিল্যান্ডের। তবে সিরিজটি হবে দুই ভাগে। প্রথম ভাগে সেপ্টেম্বরের শেষভাগে বাংলাদেশের সঙ্গে ওয়ানডে খেলবে কিউইরা। এই সিরিজ খেলেই বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে যাবে দুই দল।
বিশ্বকাপের পর হবে দুই দলের টেস্ট সিরিজ। নভেম্বরের শেষ দিকে আবারও বাংলাদেশে আসবে কিউইরা। বিসিবি প্রস্তাবিত সূচি অনুযায়ী ২১ নভেম্বর ঢাকায় পা রাখার কথা সফরকারীদের। এরপর একটি প্রস্তুতি ম্যাচও খেলবে দলটি। ২৮ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর হবে বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার সিরিজের প্রথম টেস্ট।
রাজধানীর সরকারি কবি নজরুল সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি এম ওয়াসিম রানার (৩০) লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে জানিয়েছেন তার বন্ধুরা। শুক্রবার (০২ জুন) রাত সাড়ে ১২টার দিকে চানখারপুলের একটি বাসায় তার বন্ধুরা তাকে দরজা ভেঙে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করে।
অচেতন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ফাড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
রানার বন্ধু ইমরান হোসেন বাবু জানান, 'রানা কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলায়। কয়েক দিন যাবৎ রানার খু্ব মন খারাপ ছিল। একাকী থাকতে চাইত। চুপচাপ থাকত। তবে কী চিন্তা করত সে ব্যাপারে কিছু বলত না। তাই আমি তাকে বলেছিলাম- বন্ধু, তুমি কিছুদিনের জন্য কক্সবাজার ঘুরে আস।'
ঘটনার পরপরই রানার স্ত্রী পরিচয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে রাত দেড়টার সময় সানজিদা নামে এক মেয়েকে আহাজারি করতে দেখা যায়। সানজিদা আক্তার (জান্নাতি) কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক কমিটির ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।
সানজিদা আক্তারের প্রতিবেশী মাইদুল ইসলাম জানান, 'সানজিদা আপুকে আমরা জান্নাতি আপু বলে ডাকি। রানা ভাইয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে অনেকদিন আগে। রাজনৈতিক কারণে বিষয়টি জানাজানি হয়নি। জান্নাতি আপু ডেমরা রূপগঞ্জের তারাবো এলাকায় একটি বাসায় থাকতেন।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক এক সহসভাপতি বলেন, 'আমরা জানতাম, সানজিদার সঙ্গে প্রেম ছিল। বিয়ে হয়েছিল কি-না তা সঠিক জানি না।' মৃত্যুর কারণ যা-ই হোক, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আসল রহস্য উন্মোচন করে বিচারের দাবি জানান তিনি।
রানার মৃত্যুর খবরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে আসেন এবং তারা শোক জানান। আজ (০৩ জুন) শনিবার সকাল সাড়ে ৮টায় কবি নজরুল সরকারি কলেজ মাঠে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
প্রথম দুই সেটই গড়িয়েছে টাইব্রেকারে। প্রথমটি নিষ্পত্তি হয়েছে ৮৫ মিনিটে। দ্বিতীয়টিও টাইব্রেকারে। সেটির নিষ্পত্তি ঘণ্টার ওপরে। দুটোতেই জয় নোভাক জকোভিচের। তারপরেরটিও জিতে যান এই সার্বিয়ান। ১৪তম ফ্রেঞ্চ ওপেনের খেলায় স্পেনের আলেজান্দ্রো ফোকিনার সঙ্গে ৩-০ সেটে জয়লাভ করেন তিনি। যে জয়ে মধুর প্রতিশোধ নিয়ে শেষ ষোলো নিশ্চিত করেছেন তিনি।
৩৬ বছর বয়সী এই নাম্বার ওয়ান টেনিস তারকা প্রথম সেটে কিছুটা ছন্দহীন ছিলেন। তবে চ্যাম্পিয়নদের ঘুরে দাঁড়াতে তো সময় বেশি লাগে না। জকোভিচও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তারপর ফোকিনাকে কোনো সেট জিততে না দিয়েই ম্যাচ শেষ করেন তিনি।
প্রায় ৪ ঘণ্টাব্যাপী চলা এই ম্যাচটিতে এক পেশে জয় হলেও প্রতিটি সেটেই উত্তেজনার পারদ ছড়িয়েছেন দুজন। সমর্থকেরাও বারবার হয়েছেন রোমাঞ্চিত। তবে শেষ পর্যন্ত নোভাক জকোভিচের সমর্থকেরাই হাসি নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। আগামী সোমবার জকোভিচ শেষ ষোলোর ম্যাচ খেলতে নামবেন। সেখানে প্রতিপক্ষ হিসেবে কার্লোস আলকারাজকে পেতে পারেন তিনি।
স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট কো-স্পোর্টস যতটা না তাদের কর্মগুণে সমাদৃত, তার চেয়ে বেশি আলোচিত নানা নেতিবাচক কারণে। একটা সময় কে-স্পোর্টস ও এর প্রধান নির্বাহী ফাহাদ করিমে আস্থা রেখেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। বড় বড় সব চুক্তিও সে সময় হয়েছিল দুই পক্ষের। তবে চুক্তির নানা শর্ত ভঙ্গ করে বিসিবির গুড বুক থেকে কাটা গেছে তাদের নাম।
বিসিবিতে সুবিধা করে উঠতে না পেরে গেল কয়েক বছর ফাহাদ করিম সওয়ার হয়েছেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনে। বাফুফের এই আলোচিত সভাপতি একটা সময় বড় গলায় ভারতীয় ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ, বিসিবির বিপিএলের কঠোর সমালোচনা করে বলেছিলেন, ফুটবলকে জনপ্রিয় করতে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের মতো সস্তা আয়োজনের প্রয়োজন নেই।
অথচ ফাহাদের পাল্লায় পড়ে সেই সালাউদ্দিনই নিজের বলা কথা ভুলে গেছেন। তৎপর হয়েছেন নারী ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আয়োজনে। যদিও এমন আয়োজনের জন্য কোনো রকম পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না কে-স্পোর্টসের। যার জ্বলন্ত উদাহরণ ফ্র্যাঞ্চাইজি চূড়ান্ত না করেই আসর মাঠে গড়ানোর তারিখ ঘোষণা করা এবং অনুমিতভাবেই ঘোষিত তারিখে খেলা শুরু করতে না পারা।
কে-স্পোর্টসের সিইও ফাহাদ করিমের সঙ্গে সালাউদ্দিনের দহরম মহরম বেশ কয়েক বছর আগে থেকে। সেটা কখনো কখনো ফুটবলের স্বার্থ ছাড়িয়ে চলে যায় ব্যক্তিস্বার্থে। সাফল্যপ্রসবা নারী ফুটবলে বেশি আগ্রহ সালাউদ্দিনের। ক্রীড়া-বেনিয়া ফাহাদও সালাউদ্দিনের নারী ফুটবলের প্রতি বাড়তি অনুরাগটা ধরে ফেলে ২০১৯ সালে বাফুফেতে প্রবেশ করেন ঢাকায় অনূর্ধ্ব-১৯ আন্তর্জাতিক নারী টুর্নামেন্ট আয়োজনের মধ্য দিয়ে।
এর পরের বছর টিভি সম্প্রচারস্বত্ব পাইয়ে দিতে বাফুফের সঙ্গে তিন বছরের বড় অঙ্কের চুক্তি করে কে-স্পোর্টস। চুক্তি অনুযায়ী বাফুফেকে ফি-বছর আড়াই কোটি টাকা করে দেওয়ার কথা কে-স্পোর্টসের। সেই অর্থ বুঝে না পেয়ে সম্প্রতি ফাহাদ করিমকে চিঠি দেয় বাফুফে।
বিষয়টি সমাধান না হলে নারী ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ নিয়ে চুক্তি না করার ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছিল চিঠিতে। তবে এই চিঠি দেওয়া যে শুধুই আনুষ্ঠানিকতার, তা সালাউদ্দিন-ফাহাদ করিমের হাবভাবেই বোঝা যায়। চুক্তির বিষয়টাকে এক পাশে রেখে আসলে তাদের বড় দুর্ভাবনা নারী ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ।
পাঁচ তারকা হোটেলে সাবিনা খাতুন, কৃষ্ণা রানীদের নিয়ে দেশ-বিদেশ থেকে নামীদামি নায়ক-নায়িকা-মডেল ভাড়া করে এনে ফাহাদ করিম এর মধ্যেই আসরের লোগো, ট্রফি ও বল উন্মোচন করেছেন একাধিক অনুষ্ঠানে। ১ মে হওয়ার কথা ছিল আসরের প্লেয়ার্স ড্রাফটস। সেদিন ড্রাফটসের জায়গায় হয়েছে ট্রফি ও বল উন্মোচন অনুষ্ঠান। কে-স্পোর্টস যে ফ্র্যাঞ্চাইজিও চূড়ান্ত করতে পারেনি, প্লেয়ার ড্রাফটসটা হবেই বা কাদের নিয়ে?
এই অবস্থা এখনো চলমান। ১৫ মে শুরু হওয়ার কথা ছিল খেলা। সেই তারিখও ভেস্তে গেছে। আসলে অনিয়ম-জালিয়াতির আখড়ায় রূপ নেওয়া বাফুফের প্রতি আস্থা হারিয়েছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। যেচে কেউই চায় না ফাহাদ-সালাউদ্দিনের দেওয়া টোপ গিলতে। এমনকি ফুটবলের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক আছে এমন কোম্পানিগুলোও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
শুরুতে এ আসরটি ছয় দল নিয়ে আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছিল কে-স্পোর্টস। পরে ফ্র্যাঞ্চাইজিদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাড়া না পেয়ে দলসংখ্যা নামিয়ে আনা হয় চারে। জানা গেছে, বাফুফেকে পৃষ্ঠপোষকতা করা বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে বারবার গিয়েও খেলতে রাজি করাতে পারেননি ফাহাদ। অথচ তারপরও এই ফাহাদে সালাউদ্দিনের আস্থা টলেনি।
সম্প্রতি সালাউদ্দিন, বাফুফের সিনিয়র সহসভাপতি সালাম মুর্শেদী ও বাফুফের নারী কমিটির প্রধান মাহফুজা আক্তারের সঙ্গে দীর্ঘ সভা করেন। বৈঠক শেষে বাফুফে ভবন ছাড়ার সময় ফাহাদ করিম যা বলেছিলেন, তাতে পরিষ্কার নারী ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের কোনো অগ্রগতিই হয়নি।
দেশ রূপান্তরকে ফাহাদ বলেছেন, ‘দুটি ফ্র্যাঞ্চাইজি চূড়ান্ত হয়েছে। বাকিগুলো শিগগিরই হয়ে যাবে। বড় কোনো অগ্রগতি হলে আমি সবাইকে ডেকে জানাব।’
গত সোমবার বাফুফের জরুরি সভা শেষে কাজী সালাউদ্দিন নতুন করে লিগ শুরুর তারিখ ঘোষণা করেন। পরে গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘ওমেন্স ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ ১০ জুন থেকে শুরু হবে। ১২ দিনে হবে ১৩ টি ম্যাচ। এটা এখন বলা দরকার যে, ফিফা উইন্ডোতে লিগ করছি। যেন বিদেশি খেলোয়াড় আসতে পারে। না হলে আসতে পারবে না।’
নতুন তারিখ ঘোষণা করেছেন ঠিকই। তবে আদৌ নির্ধারিত তারিখে খেলা হবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট শঙ্কা।
গত বছর নেপালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকেই মাঠে ফেরার দিন গুনছেন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়রা। সাফ জয়ের পর সালাউদ্দিন শুনিয়েছিলেন গালভরা বুলি। সাবিনাদের নিয়মিত খেলার ব্যবস্থা করবেন। অথচ লিগের কিছু ম্যাচ ছাড়া আর খেলারই সুযোগ আসেনি। অথচ অর্থ সংকটের খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে বাফুফে মেয়েদের মিয়ানমারে পাঠায়নি অলিম্পিক বাছাই খেলতে।
ফিফা উইন্ডোতেও বাফুফে পারেনি দলের জন্য প্রতিপক্ষ জোগাতে। পাঁচ তারকা হোটেলের চোখ ঝলসানো মায়াবী আলো আর সুরের মূর্ছনায় ফাহাদ করিম আয়োজন করেছিলেন লোগো, ট্রফি উন্মোচন অনুষ্ঠান। সেখানে গিয়ে সাবিনারাও দেখেছিলেন বাড়তি কিছু উপার্জনের রঙিন স্বপ্ন। তবে বাফুফের অদূরদর্শী সভাপতি অপ্রস্তুত এক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আয়োজনের দায়িত্ব তুলে দিয়ে যেন সাবিনাদের স্বপ্নটাকেই আরেকবার গলাটিপে ধরতে চাইছেন।
এক লোক হজরত সুফিয়ান সাওরি (রহ.) কে প্রশ্ন করল, নামাজের সময় কাতারের কোন পাশে দাঁড়ানো উত্তম? প্রথম কাতারের ডান পাশে না কি বাম পাশে? তখন সুফিয়ান সাওরি (রহ.) বলেন, প্রথমে দেখো খাবারের জন্য রুটির যে টুকরোটা নিয়েছে তা হালাল না কি হারাম? তুমি কাতারের যেখানেই নামাজ আদায় করো তা তোমার কোনো ক্ষতি করবে না। তুমি নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে খুব ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করো, তুমি নামাজ কোথায় আদায় করবে? অথচ তুমি এমন একটি কাজে লিপ্ত যা তোমাকে নামাজ কবুল হওয়া থেকে বিরত রাখে!
একবার হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে উদ্দেশ করে বলেন, তোমরা কি জানো প্রকৃত দরিদ্র কে? তারা বললেন, দরিদ্র তো সে যার কোনো দিনার-দেরহাম নেই (অর্থকড়ি নেই)। তখন তিনি বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে দরিদ্র সে, কিয়ামতের দিন নামাজ, রোজা ও জাকাতের সওয়াব নিয়ে আসবে; কিন্তু সে একে গালি দিয়েছে, ওকে প্রহার করেছে, অন্যায়ভাবে অন্যের মাল ভক্ষণ করেছে, তখন এই লোক তার সওয়াব থেকে নেবে, ওই লোক তার সওয়াব থেকে নেবে, অতঃপর যখন তার সওয়াব শেষ হয়ে যাবে তখন অন্য পাওনাদাররা তাদের অপরাধগুলো এই লোককে দিয়ে দেবে, এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
এরপর সুফিয়ান সাওরি (রহ.) লোকটিকে বলেন, তুমি প্রথম কাতারে নামাজ আদায় করলে তাতে কী লাভ; যদি তুমি মানুষের হক নষ্ট করো, অন্যের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো? সুতরাং তুমি হালাল ও পবিত্র খাবার গ্রহণ করো।
নবী কারিম (সা.) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র এবং তিনি পবিত্র জিনিস ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করেন না এবং তিনি মুমিন বান্দাদের তাই আদেশ করেছেন যা তিনি নবী-রাসুলদের আদেশ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে রাসুলরা, পবিত্র বস্তু আহার করুন এবং সৎ কাজ করুন। আপনারা যা করেন সে বিষয়ে আমি পরিজ্ঞাত।’ সুরা মুমিনুন : ৫১
এই আয়াতে আল্লাহতায়ালা পবিত্র খাবারকে নেক আমলের পূর্বে এনেছেন। অর্থাৎ নামাজ আদায়, দিনের বেলা রোজাপালন, রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি ও কোরআন তেলাওয়াতের পূর্বে হালাল খাবারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা এখানে রাসুলদের উদ্দেশ করে বলেছেন, হে রাসুলরা! তোমরা হালাল খাবার গ্রহণ করো। এরপর তিনি বলেছেন এবং সৎ আমল করো। অর্থাৎ নেক আমলের পূর্বে হালাল ও পবিত্র খাবার গ্রহণ করো, যাতে হারাম খাবার গ্রহণের কারণে নেক আমলগুলো নষ্ট না হয়ে যায়। এ কারণেই আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমরা পবিত্র বস্তু গ্রহণ করো এবং সৎ আমল করো।
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) দীর্ঘ সফরে ক্লান্ত ধূলোমলিন চুল ও চেহারাওয়ালা এক লোকের উপমা দিয়ে বলেছেন, সে আসমানের দিকে হাত তুলে বলে, হে আমার রব! হে আমার রব! তিনি বলেন, অথচ তার খানাপিনা হারাম, তার পোশাক-পরিচ্ছেদ হারাম, সে যা ভক্ষণ করে তা হারাম, তাহলে তার দোয়া কবুল হবে কীভাবে?
ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, হালাল খাবার মানুষের মেধা, ইলম ও আমলের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। সুতরাং এ প্রশ্ন করা অবান্তর, আমাদের দোয়া কবুল করা হয় না। দোয়া কবুল না হওয়ার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো হালাল ও পবিত্র খাবার গ্রহণ না করা। বস্তুত সমস্যা দোয়ার মধ্যে নয়, সমস্যা আমার-আপনার মধ্যে। আপনি খাবারকে পবিত্র রাখুন, দেখবেন আপনার দোয়াগুলো কবুল হচ্ছে।
একজন হারাম কজে লিপ্ত, অন্যায়ভাবে মানুষের হক ভক্ষণকারী, শ্রমিকের পারিশ্রমিক পরিশোধ করেন না, বাড়ির অসহায় কাজের মেয়েটির প্রাপ্য ভাতা প্রদান করেন না, অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন না আর সেই আপনিই আবার অভিযোগ করেন আমার দোয়া কবুল হয় না?
একটু ভাবুন, চিন্তা করুন। সর্বদা পবিত্র খাবার খাওয়ার, পবিত্র পোশাক পরিধানের চেষ্টা করুন। দয়াময় আল্লাহ আপনাকে বঞ্চিত করবেন না।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতিতে জোর করে হারানো হয়েছে।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভিন্ন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের যেকোনো আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটির ভোটে যে সংসদ সদস্য দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার তথ্য মিলবে তাকেই বাদ দেওয়া হবে। এ সিটি ভোটে হারের কারণ জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব একটি সংস্থাকে নির্ভুল তথ্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্বও পেতে পারেন আজমত, ওই সূত্র দাবি করে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
নানা অব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তির আওতায় এসেছে অনেক আগে। এরপর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজ অনেকটাই আটকে আছে। খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে চরম দুরবস্থার কথা। গবেষয়ণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু কাজ করার চেষ্টা করলেও কথায় কথায় তাদের ওপর নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। মানের উন্নয়ন না হলেও ঠিকই অধিদপ্তরে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সম্প্রতি এই গবেষণা করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেখানে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। করোনাকালে বন্ধের প্রভাবে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের গড় হার ৫১ শতাংশের বেশি, যা আগে ছিল ৬৮ শতাংশের মতো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও ক্ষতি বেড়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এ ধরনের গবেষণার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখেই তা করা হয়েছে। আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদন দু-এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা অন্তত এক বছরের জন্য রেমিডিয়াল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা দিন দিন পিছিয়ে পড়লেও সেদিকে তেমন একটা নজর নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। তারা ব্যস্ত আছে লাখ লাখ শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন নিয়ে। কেউ কথা বললেই তার ওপর নেমে আসছে শাস্তি। ফলে শিক্ষকরাও দিন দিন তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন; কোনো রকমে দিন পার করছেন।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্ভাবনী ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন রাজবাড়ী জেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিক নির্বাচিত হন। সাধারণত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থীদের পদক দেওয়া হয় একই অনুষ্ঠানে। কিন্তু করোনাকালে তাদের হাতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষক পদক তুলে দেওয়া যায়নি। গত ১২ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তাই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে স্বাভাবিকভাবে তারা দাবি তুলেছিলেন, দেরি হলেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তারা পদক নেবেন; যা তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে ঠিকই পদক নেন। তবে এর ৬৮ দিনের মাথায় এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবি তোলায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ঘটনায় জয়পুরহাটের হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ পদক নিতে ১১ মার্চ ঢাকা এসেছিল। ওই শিক্ষকও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের কাউকে শোকজ করা হয়নি; যা বিধিবহির্ভূত বলছেন শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেদিকেই আমরা যাব।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক নেওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে সেরা প্রাপ্তি। এ জন্য শিক্ষকদের দাবি থাকতেই পারে, প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। শিক্ষকদের যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। এর প্রভাব অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বন্ধ থাকা প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখতে কিছু শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন; যাতে অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনাসহ নানা কাজ করা হয়। এতে প্রতিটি ফেসবুক গ্রুপে লাখ থেকে হাজারো শিক্ষক যুক্ত হয়েছেন। এখনো সেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সেই গ্রুপগুলোকেই এখন শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে যুক্ত থাকা অনেক শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাকেই দেওয়া হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ)। সরকার যেখানে শিক্ষকদের ডিজিটালি আপডেট হওয়ার কথা বলছে, সেখানে প্রায় অনেকটাই উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে আসন গেড়ে বসেছেন কিছু কর্মকর্তা। অনেকেই ৬ থেকে ১২ বছর ধরে একই দপ্তরে চাকরি করছেন। তাদের যে দায়িত্বই থাক না কেন যত লাভজনক কাজ আছে, সেগুলোতেই তারা হাত দিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে আনলে তাদের সরে যেতে হবে, এ জন্য তারা নানাভাবে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিয়ে মাঠপর্যায়ে শাস্তি দিয়ে সবাইকে ভীত করে তুলছেন। এতে পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত মার্চ-এপ্রিলে অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। যদিও নিয়ম ছিল, অনলাইনে নির্দিষ্ট মানদন্ড পূরণ ছাড়া কেউ বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু তা মানেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিয়ম ভেঙে কয়েক শো শিক্ষকের বদলির আদেশ জারি করা হয়। আর এই বদলি-পদায়নে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের; যা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আবার অনেক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলিতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। কাউকে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও অনেক দূরে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন।
জানা যায়, চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। আর আগামী বছর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সাল থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। কিন্তু তা পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই অধিদপ্তরের। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আসলে এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছে বা এ জন্য আর কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তেমন নজর নেই।
এ ছাড়া এখনো প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেডে। দুই ধরনের প্রায় চার লাখ শিক্ষকই ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারাও দীর্ঘদিন ধরে নবম গ্রেডের দাবি করছেন। আর মাঠে কাজ করা এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদোন্নতিও নেই বললেই চলে। কিন্তু এগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের; যা প্রাথমিকের মান উন্নীতের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনো মফস্বলে বা দুর্গম অঞ্চলের অনেক স্কুলেই এক-দুজন শিক্ষক। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ তিন-চার বছর ধরে শূন্য। শিক্ষক না থাকলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের একটু আলাদা যতœ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলোও হচ্ছে না। শিক্ষকরাও তাদের বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। সব মিলিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছি না।’
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতি জোর করে হারানো হয়েছে।
গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন তেমনি যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী লিমিটেড ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের মধ্যকার ফেডারেশন কাপ ফুটবলের ফাইনাল দেখতে কুমিল্লায় উড়ে গেছেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন।
কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে আজ বেলা ৩টা ১৫ মিনিটে শুরু হয়েছে ম্যাচটি। সালাউদ্দিন ম্যাচ শুরুর ঘণ্টা খানেক আগে কুমিল্লায় পৌঁছান।
ঢাকা থেকে সড়ক পথে কুমিল্লায় পাড়ি দিতে মাত্র দুই ঘণ্টা সময় লাগে। তবে সালাউদ্দিন দূরত্বটা পাড়ি দিয়েছেন হেলিকপ্টারে করে। যা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
টাকার অভাবে কদিন আগে নারী ফুটবলারদের অলিম্পিক বাছাইয়ে পাঠায়নি বাফুফে। অথচ ঢাকা থেকে কুমিল্লায় যেতে বাফুফে সভাপতি বেছে নিলেন হেলিকপ্টার।
হেলিকপ্টারে ঢাকা থেকে কুমিল্লার এই যাত্রায় বাফুফে সভাপতির সঙ্গী হয়েছেন সংস্থার নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ।