
কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে অতিথি পাখির ডানায় ভর করে আগমন ঘটে শীতকালের। পরিযায়ী পাখিদের আমরা আদর করে অতিথি পাখি বলে ডাকি। যেসব প্রজাতির পাখি পরিযানে অংশ নেয়, সেগুলোকে পরিযায়ী পাখি বলে। আমাদের দেশে এসব অতিথি পাখির আগমন ঘটে উত্তর মেরু থেকে। সাইবেরিয়া, ফিলিপস, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, অ্যান্টার্কটিকাসহ অনেক অঞ্চলে তাপমাত্রা যখন মাইনাস শূন্য ডিগ্রিতে নেমে আসে, তখন সেখানে দেখা দেয় প্রচণ্ড খাদ্যাভাব। তীব্র শীতে পাখির দেহ থেকে পালক খসে পড়ে। ফলে প্রাণ বাঁচাতে শীতপ্রধান অঞ্চলের পাখিগুলো হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আসে আমাদের মতো নাতিশীতোষ্ণ এলাকায়। কিন্তু প্রকৃতি তাদের অনুকূলে হলেও একশ্রেণির দুর্বৃত্ত ব্যস্ত হয়ে ওঠে এসব অতিথি পাখি নিধনে।
মঙ্গলবার দেশ রূপান্তরে ‘বাঁচতে এসে হারাচ্ছে জীবন’ শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতি বছরের মতো এবারও শীতের শুরুতেই হাকালুকি হাওরে আশ্রয় নিতে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, মৌসুমের শুরুতেই ফাঁদ পেতে ও বিষটোপ দিয়ে হাওরে পাখি নিধন চলছে।
প্রকৃতিপ্রেমীদের আক্ষেপ, বাঁচতে আসা প্রাণীগুলোকে এভাবে হত্যা করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঠিকঠাক নজরদারি করতে পারছে না। অবশ্য বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকায় পাখি শিকারিদের সঙ্গে পেরে উঠছে না তারা। হাওরপাড়ের বাসিন্দারা জানান, শুষ্ক মৌসুমে হাওর শুকিয়ে যায়। এ সময় শীতপ্রধান বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে আসা ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এ হাওরে আশ্রয় নেয়। পাখিরা দিনে দল বেঁধে হাওরের বিভিন্ন বিলে খাবার খুঁজে বেড়ায়। এ সুযোগে দুর্বৃত্তরা জাল দিয়ে ফাঁদ পেতে পাখি নিধন করে। জালের ফাঁদ পেতে অতিথি পাখি নিধনের খবর পড়লেই কবি জয় গোস্বামীর ‘দিকে দিকে পাখি পাতা, জাল নয়’ লাইনটির কথা মনে পড়ে। এ ছাড়া সেদ্ধ করা ধানের সঙ্গে একধরনের বিষ মিশিয়ে ‘বিষটোপ’ তৈরি করে শিকারিরা বিভিন্ন বিলের পাড়ে ছিটিয়ে দেয়। পাখিরা খাবার ভেবে এসব টোপ খেয়ে মারা যায়। শিকার করা এসব পাখি লুকিয়ে আশপাশের বিভিন্ন হাটবাজার ও বাড়ি বাড়ি ফেরি করে চড়া দামে বিক্রি করা হয়।
বাংলাদেশে ১৯৯৪ সালে অতিথি পাখি এসেছিল ৮ লাখের বেশি। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা নেমে এসেছে দুই লাখের নিচে। অর্থাৎ গত ২০ বছরে প্রায় ছয় লাখ পাখি আসা কমে গেছে। তবে এখন এ সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের মতো হতে পারে বলছেন গবেষকরা। অতিথি পাখি যেন নিরাপদে বাংলাদেশে অবস্থান করতে পারে সেজন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে কিছু অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে। এসব পাখি শিকার বা হত্যাকে দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষণা করে আইনও করা হয়েছে। কিন্তু থেমে নেই অতিথি পাখি নিধনের ঘটনা। বরং পাখি শিকারিরা নিত্যনতুন কৌশলে চালিয়ে যাচ্ছে নিধনযজ্ঞ। ‘বাঁশির নকল সুর’ বাজিয়ে পাখিকে ধরার এক নিদারুণ কায়দাও এখানে আছে। এমনকি, পাখির ডাক মোবাইলে বাজিয়েও পাখি ধরার কথা খবরে আসছে। অতিথি পাখিকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাস্তায় হাঁক দেওয়া সেসব পাখি বিক্রেতাকে ইদানীং কম দেখা গেলেও বিভিন্ন এলাকার খাবার দোকান ও হোটেলে নিয়মিতই মেলে রান্না করা পাখির মাংস।
দেশের বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চল দেশি, পরিযায়ীসহ নানা পাখির বিচরণস্থল। দুনিয়ায় বিরল এমন অনেক পাখি কেবল এখানেই দেখা যায়। দেশের এই অঞ্চল দিনে দিনে পাখিদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। পরিবেশকর্মী খোরশেদ আলম বলেন, অবাধে পাখি শিকারের কারণে হাওরে পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আওতায় আনা জরুরি। বিচারহীন পাখি হত্যা জনমনস্তত্ত্বে এখন ‘সহ্য করার মতো স্বাভাবিক’ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন। পাখি হত্যা রোধে প্রশাসনের সত্যিকার অর্থে সক্রিয় ও সজাগ হওয়া জরুরি। পাখি শিকার বন্ধে বন বিভাগের লোকবল সংকট রয়েছে। অবিলম্বে বন বিভাগের লোকবল সংকট নিরসন করে শিকার রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চলে পাখি সুরক্ষায় দৃঢ় নীতি ও সক্রিয় পদক্ষেপ না নিলে এই অঞ্চল অচিরেই হয়তো নিদারুণভাবে পাখিশূন্য হবে। পাখি নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং উপকূলীয় অঞ্চলে জনতৎপরতা বাড়াতে পরিবেশ ও প্রাণী অধিকার কর্মী ও সচেতন নাগরিকদের আরও সোচ্চার হতে হবে। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে পাখিরক্ষা কমিটি গঠন করে জনগণকে সচেতন করার পদক্ষেপ নিতে হবে। আদরের অতিথি পাখি উড়ে এসে বসার ও বিচরণের নিরাপত্তা পাক আর বেলা শেষে ডানা মেলে ফিরে যাক।
বিশ্বমানচিত্রে উদ্বাস্তু যাত্রা শুরু সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে। পশুদের যাত্রা শুরু হতো পানীয় জল আর খাদ্যের অভাবে। মানুষের শুরু শিকারভূমি আর কৃষিভূমির সন্ধানে। রক্তাক্ত লড়াইটা হতো গোত্রে গোত্রে। বাইবেলে প্রাচীন ইহুদিদের মিসর থেকে বিতাড়নের কাহিনী আছে। আছে দলনেতা নবী মুসার কথা এবং মহান ঈশ্বরের দ্রাক্ষা ক্ষেত্র আর যব শস্যভূমি কিংবা বনমধুর প্রাচুর্য দানের প্রতিজ্ঞার আখ্যান। আর এই আধুনিক যুগে উদ্বাস্তুযাত্রা শুরু ধর্মের নামে, রাজনৈতিক মতবাদের নামে নরহত্যা, নারী ধর্ষণের পথ ধরে। এই আধুনিকে আবার মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় প্রাচীন আর মধ্যযুগ। রামায়ণ আর মহাভারতের মহাকাব্যিক যুদ্ধ এবং নরহত্যা যে ধর্মপ্রতিষ্ঠার নামে, ন্যায় স্থাপনের অসিলায়, তার সাথে আজকের অনেক মিল আছে। যুদ্ধ, হামলা, হত্যা, ধর্ষণ আর হিংস্রতার ফলে যে পলাতকদের উদ্বাস্তুযাত্রা শুরু হয় এই আধুনিক যুগে, তা পুরাতন যুগের দুর্ভিক্ষ আর জাতিদাঙ্গার পরিণামের চেয়েও ভয়াবহ।
অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ এশিয়া এবং আফ্রিকায় দীর্ঘস্থায়ী জাতিগত, ধর্মগত, বর্ণগত এবং মতাদর্শগত সংঘাত লাগিয়ে রেখেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে যা ঘটেছে এবং ঘটছে তার পেছনে রয়েছে দেশীয় এবং আন্তঃদেশীয় ষড়যন্ত্র। এই চক্রান্তের শেকড় অতি গভীর রাজনৈতিক মৃত্তিকাগর্ভে প্রোথিত। জনগণের গণতন্ত্রের দাবি, ক্ষুধামুক্তির দাবি, অন্ন-বস্ত্র-গৃহ-স্বাস্থ্য ইত্যাদির দাবির ভেতর দিয়ে বিক্ষোভ, ধূমায়িত হলেই কবির ভাষায় ‘সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা।’ জনগণের প্রতিবাদী দৃষ্টির ভেতর অ্যাসিড ছিটিয়ে অন্ধ বানানোর প্রশাসনিক প্রচেষ্টা চলে। আক্ষেপ এটাই, যে জাতি একাত্তরের অবিনাশী-অবিনশ্বর গৌরবের ইতিহাস স্রষ্টার ভূমিকায় নেমে বিশ্বকে চমকে দেয়, সে জাতিই ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িকতায় প্রেতনৃত্যে মেতে ওঠে। বাংলাদেশে এই কুৎসিত-কদর্য অপরাজনীতির শুরু স্বাধীনতা লাভের পরপরই।
একটি নির্মম প্রশ্ন আজ বেআব্রু হয়ে পড়ে। পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক গৌরবের ইতিহাস কি কেবল স্বাধীনতা যুদ্ধ আর ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? অন্য ইতিহাস নেই? এদেশে কি তেভাগা আন্দোলন হয়নি? হাজী দানেশের ইতিহাস কি মাটিচাপা পড়েছে? কমরেড সিরাজ সিকদারের জনযুদ্ধ কি হাওয়ায় উড়ে গেল? মণি সিংহের হাজং বিদ্রোহ কি শিশুতোষ গল্প? সিলেটে নানকার বিদ্রোহটা কী? পাকিস্তান যুগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে প্রগতিশীল নাগরিকদের সাহসী ভূমিকা কি তুচ্ছ বিষয়? ১৯৬৪ সালে দাঙ্গার সময় যুব ও ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনোরা যে দাঙ্গা প্রতিরোধে নেমে নিজেরা রক্তাক্ত হলেন তা তো অলীক গপ্পো!
তারপরও প্রশ্ন আসে, অনেক কিছুই হয়েছে পূর্ববঙ্গ বা উপমহাদেশে, কিন্তু হয়েছে কি সামাজিক আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন? আসল কাজগুলোই পাশে পড়ে রইল। পাশ কেটে এগিয়ে গেল ক্ষমতা দখলের রাজনীতি। আচমকা মৃত্যুর বিভীষিকা নিয়ে সারা বিশ্বে ঝাঁপিয়ে পড়ল কভিড বা করোনা। শাপেবর হলো স্বৈরাচারী শাসকদের। মিডিয়া বা প্রচার যন্ত্রগুলো জনগণের মনে এমন আতঙ্ক সৃষ্টি করল যে, মানুষ ভুলে গেল গণতন্ত্র কী, স্বৈরাচার কী, দুর্নীতি কী, ন্যায়ের শাসন কী। জনকণ্ঠ রোধের অসংখ্য আইন হলো। যন্ত্রণায় মানুষ কঁকিয়ে উঠলেও তর্জন গর্জন এলো, ‘অ্যাই চুপ, করোনা আসছে।’ শাসকরা চায় মানুষ মরার মতো পড়ে থাকুক। ষোল আনাই সফল হয়েছে শাসক-শ্রেণি জনগণকে প্যারালাইসড করে নিরাপদে শাসন চালিয়ে যেতে।
ধর্মবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ আজকের সময়ে বিশ্বরাজনীতির অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সংখ্যালঘুর প্রশ্নই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মৌলিক উপাদানের আসন গ্রহণ করেছে। ক্ষমতায় যাওয়া-আসা চলে এই একটি মাত্র পথে। পশ্চিমা-ধর্মী রাষ্ট্রগুলো দরিদ্র, আধা দরিদ্র দেশের জনগণকে এমনি তুকতাক কালা জাদু করেছে যে তারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে ছুটছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, মেলবোর্ন। বাংলাদেশের একজন অভিবাসী কেবল ধর্মেই নয়, বর্ণে, ভাষায়, সংস্কৃতিতেও ওদেশে সংখ্যালঘু। সাদা বর্ণ আমেরিকানরা কী ধরনের আচরণ করে ওরা তা বুঝতেও চায় না। স্বেচ্ছা-অভিবাসী এই ক্রীতদাসদের প্রকৃত অর্থে ঘাড়ের ওপর মস্তক বলে অংশটি নেই। এমন দাসত্ব, এমন আনুগত্য প্রদর্শন মনুষ্যত্বেরই অসম্মান।
জটিল প্রশ্নটি হচ্ছে দাঙ্গা, ধর্ষণ, নরহত্যা এবং যুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে যারা ইউরোপ, আমেরিকায় পালায় বা পালাতে চায়, তাদের সম্পর্কে কোন বিবেচনাটা আসে? প্রাণরক্ষা কি মানুষের আদিম প্রবৃত্তি? অবশ্যই। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয় খোঁজাও অন্যতম প্রবণতা। আক্ষেপ এটাই যে, যে ইউরোপ-আমেরিকা এশিয়া-আফ্রিকাকে উপনিবেশের চারণভূমি হিসেবে পরিণত করে তাদের কাছেই জীবন ভিক্ষা? এ যেন এক উন্মাদ কাণ্ডজ্ঞানহারা মানুষের অন্ধ ছুটে চলা। নৌকা করে গভীর অতলান্তিক মহাসমুদ্র অতিক্রম করে অচেনা আশ্রয়ভূমির সন্ধানে নামা। গভীর সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া কিংবা ডুবে মরাই হয় নিয়তি। জনসংখ্যা ভারে আনত ক্ষুদ্র ভূখণ্ড বাংলাদেশে কেন পাহাড়-সমুদ্র অতিক্রম করে ইয়াঙ্গুনের রোহিঙ্গারা লাখো লাখো সংখ্যায় আশ্রয় নিল? কক্সবাজার উপকূলে পলাতকরা নৌ-ডুবিতে মরল কেন? কেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা ভারতের দিল্লি আর জম্মুতে আশ্রয় শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে? রাষ্ট্রহীন, নাগরিকত্বহীন মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ কী? আমেরিকা তার সৎভাই তালেবানদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে কেটে পড়লে কী হাল হলো আফগানিস্তানের? আফগানরা সীমান্ত অতিক্রম করেছে উজবেকিস্তান আর তাজিকিস্তানে। এমনিতে পাকিস্তান সীমান্তে আশ্রয় শিবিরে দশ লাখের অধিক আফগান শরণার্থী পড়ে আছে এক যুগ ধরে। জন্ম আর মৃত্যুর অট্টহাসি শোনা যায় দুর্গম পাথুরে পাহাড়-পর্বতের গোলক ধাঁধায়। আমরা কি ভুলতে পারি সমাজতন্ত্রের পতনের পর যুগোশ্লাভিয়ার খণ্ডিত অংশ সার্বিয়া-বসনিয়া-হারজেগোভিনায় মুসলিম সংখ্যালঘুর ইতিহাস? সার্বিয়ানরা হাজার হাজার সংখ্যালঘু মুসলমানকে হত্যা করেছে, গর্ভবতী করেছে নারীকে। বিশ্বমানব কি ভুলতে পারে সার্বীয় কিশোরী-গর্ভবতীর পলায়নের দৃশ্যের ছবি?
ইসলাম এবং খিলাফতের স্মৃতিবিজড়িত সিরিয়ার পবিত্র নগরী দামেস্ককে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে মার্কিনি মদদপুষ্ট আইএস বা ইসলামিক স্টেটস জঙ্গি বাহিনী। বন্দি করে অদৃশ্য করে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য নারীকে। দেশ ছেড়ে পালিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। ইরাকের ভাগ্যেও তা-ই ঘটেছে। ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তানে খ্রিস্টান, ইহুদি তো বটেই, শিয়া, ইয়াজেদি হত্যা, নির্যাতন এবং বিতাড়নের শিকার হয়। প্রাণরক্ষার জন্য এসব মানুষ ছুটছে অজানার সন্ধানে। ইউরোপে আশ্রয় নিতে গিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশের অপরাধে বন্দি হয়ে জেলে ঢুকছে কিংবা জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ফেলে যাওয়া দেশে। পুনরায় পড়ছে হিংস্র বিতাড়ক বাহিনীর হাতে। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর সংখ্যালঘু মুসলমানদের তো বিদ্রোহের অপরাধে চীনা রেড আর্মিরা অর্ধেককে মেরেই ফেলেছে। জোর করে তুলে নিয়ে হাজার মাইল দূরের দুর্গম প্রদেশে অভিবাসিত করছে। ভারত কাশ্মীরের জনগণকে তো বলতে গেলে জেলখানার কয়েদি বানিয়ে দিয়েছে। সমস্ত মানবিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয়েছে।
ধর্মীয়, জাতিগত, বর্ণগত হিংসা, বিশ্বমানবের এই হচ্ছে বাস্তব সত্য। কেননা এই বিশ্বমানব সংখ্যালঘু। পূর্ববঙ্গে দেশভাগের সময় সংখ্যালঘুরা ছিল ৪০ শতাংশে, বর্তমান দুই হাজার একুশ সালে প্রজাতি বিলুপ্তির সূত্র ধরে দাঁড়িয়েছে মাত্র আট শতাংশে। মধ্যের সংখ্যাটা অভিবাসী হয়েছে ভারত এবং ইউরোপ-আমেরিকায়। কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়ায়। প্রাচীন এবং মধ্যযুগের বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষের মাটি থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সম্রাট হর্ষবর্ধনের হাতে কত সংখ্যক বৌদ্ধ নিহত হয়েছে এবং বৌদ্ধ ধর্ম মন্দির ধ্বংস হয়েছে তার হিসাব প্রায় অসম্ভব। নগর সভ্যতা থেকে প্রান্তবাসী বলে দলিত অর্থাৎ নিম্নবর্গ হিন্দুরা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাত থেকে রক্ষা পেলেও বর্তমান সময়ে তারা অশেষ নির্যাতনের শিকার। প্রতিদিন দলিত নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে, খুন হচ্ছে। প্রশাসন অন্ধ। বুঝা যায় ধর্মগত সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণগত সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে নিষ্ঠুর কম নয়। দলিত হিন্দুদের পালাবার স্থান নেই। ধর্মান্তরিত হলেও। বাবা সাহেব ভীমরাও আম্বেদকর অর্থাৎ ভি.আর. আম্বেদকরের মতো মানুষও বর্ণবাদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। অথচ আজীবন তাকে নিচুজাতের তকমা নিয়ে পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়। কেন এমনটা হলো? কেননা ভারতে ধর্মবাদ আর বর্ণবাদ সমার্থক।
ভারতবর্ষের ইতিহাসের পাতা অসংখ্য আন্দোলনে আকীর্ণ, কিন্তু বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের প্রমাণ মেলে না। এমনকি আধুনিক যুগে মহাত্মা গান্ধীও তা করেননি। আক্ষেপ এই, বাম-কমিউনিস্ট আর গণতন্ত্রীরাও তা পাশ কাটিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। প্রগতির পক্ষে, সমাজতন্ত্রের পক্ষে, জাতীয়তাবাদের পক্ষে অসংখ্য আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনকে। শিক্ষিত সমাজ তথা বুদ্ধিজীবী মহলেও এর গুরুত্ব অনুধাবন করা হয়নি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে, সভা-সমাবেশ হয়েছে, এটা সত্য। স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছে, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু করেনি সামাজিক আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন। হয়নি মননশীল আর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভারে চাপা পড়ে রইল সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন। তাই স্বাধীনতার পরপরই মাটির তলায় ঘাপটি মেরে থাকা সাম্প্রদায়িকতা কন্দমূলের মতো নতুন অঙ্কুর মাথা তুলে জেগে উঠল। অথচ রাষ্ট্রবিজ্ঞান আমাদের জানায় ভোটের রাজনীতিটা হচ্ছে গণতন্ত্রের বাইরের খোলস, ঠিক পেঁয়াজের মতো, ভেতরের শাঁসটা হচ্ছে সামাজিক সাম্য।
এখন প্রশ্ন হলো সাম্প্রদায়িকতার শিকার জন্মভূমি বিচ্ছিন্ন মানুষ যাবে কোথায়? কোথায়ই বা যায়? এই সাম্প্রদায়িকতা, এই উদ্বাস্তুকরণ, উদ্বাস্তুযাত্রা আর তার পরিণাম নিয়ে ইতিহাস আজও নিশ্চুপ। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সত্যকে চাপা দেওয়া হয়েছে। সেই দেশভাগ। লাখো-কোটি পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুকে নেহরু সরকার মানবিকভাবে দেখেনি। তারা তথাকথিত আর্যরক্তবাহী পশ্চিমবঙ্গে স্থান দিতে চায়নি অনার্যরক্তবাহী পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের। তাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের দায় নেয়নি পশ্চিমবঙ্গ। একদিকে উদ্বাস্তুদের বেশির ভাগই ছিল নিম্নবর্ণ হিন্দু এবং বাঙালি সতো বটেই। বাঙালি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ভাষাগত ক্ষমতার রাজনীতিটা উল্টে যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গে, তাই তাদের ঠেলে দেওয়া হয় আন্দামানে এবং দণ্ডকারণ্যে। টাটা শিল্পগোষ্ঠী বিহারের জামশেদপুর এবং বর্ধমানের আসানশোল শিল্প তালুক গড়ে সস্তা শ্রমের জন্য উদ্বাস্তুদের একটি অংশের জন্য শ্রমিক বস্তি গড়ে (উপনিবেশ) দেয়। পাঞ্জাবের শিখরা জামাই আদর পায়, বাঙালিরা পড়ে মরে রেল স্টেশনে। নেহরু থেকে ইন্দিরা গান্ধী এবং বর্তমান সরকার এমন সব আইন করে যার ফলে পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশের উদ্বাস্তুরা রাষ্ট্রহীন হয়ে যায়। এমন জটিল আইনকে ডিঙিয়ে আজকের উদ্বাস্তুরা কিছুতেই ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবে না। আজকের বিজেপি সরকারের যে জটিল নাগরিক আইন তার জন্মদাতা গান্ধী-নেহরুর কংগ্রেস। বাঙালি প্রতিরোধের বেলায় হিন্দি বলয়ের ‘যাহা বিজেপি তাহা কংগ্রেস’। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে যা-ই ঘটুক বাংলাদেশের সংখ্যালঘুকে তার জন্মমাটি আঁকড়ে থাকতে হবে। বাম রাজনীতির সঙ্গে তাদের যুক্ত হতে হবে। বামপন্থিরাই প্রকৃতপক্ষে তাদের সহমর্মী এবং মিত্র। তারাই দিতে পারে তাদের নিরাপত্তা। অন্ধ-রাজভক্তিতে মিলবে শূন্য। শাসক দলের আনুগত্য মনুষ্যত্বের অসম্মান মাত্র।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সাক্ষাৎ ঘটা কভিডকে ১৯৬৪ সালে প্রথম শনাক্ত করেন ভাইরোলজিস্ট ড. আলমিডা। গণচীনের কিছু স্থানে টানা লকডাউন চলতে থাকা এবং গত ২৪ নভেম্বর তারিখে উরুমচি শহরের একটি বহুতল ভবনে অগ্নিকা-ের ঘটনায় দশজন নিহত হওয়ার পর বিদ্রোহ আকারে এ অগ্নিকা- চীনের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। টানা লকডাউন বিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে জিরো কভিড নীতির স্থাপক সরকারের প্রতি মানুষের অসন্তোষ প্রকাশের একটা অপূর্ব সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আন্দোলনকারীদের দাবি, লকডাউনের কারণে তালাবদ্ধ বিল্ডিং থেকে না বেরুতে পেরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন নিহতরা।
আমরা করোনার প্রায়-সমার্থক হিসেবে যে চিত্রকল্প তৈরি করি, সে চিত্রকল্প লকডাউন, আইসোলেশন, নিরাপদ দূরত্ব ইত্যাদির প্রায়োগিক চর্চায় আমাদের বাধ্য করে। এসবের পেছনে রয়েছে দৈহিক দূরত্বের প্রপঞ্চ। আমাদের মানসিক দূরত্ব প্রকট। এমনকি পিতা-পুত্রের প্রজন্মগত দূরত্বও চোখে পড়ার মতো। আত্মিক দূরত্ব অকাট্য নিয়তির মতো। প্রতিষ্ঠান থেকে বাজার, সর্বত্র দৈহিক নৈকট্যের যা ছিল আমাদের মধ্যে, তাও কভিডের পর নড়বড়ে হয়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়াও কভিডের মতো একটা অব্যক্ত ভাইরাসের মরুভূমিতে আমাদের একাকী করে তোলে। ভাইরাল হওয়া তথ্যের একটা বিশাল অংশই এখানে মিথ্যার সংমিশ্রণে ভাইরাস হয়ে ওঠে। মানুষের প্রকৃতি বড়ই অদ্ভুত। পৃথিবীর পুরো বয়সকে এক বছর ধরা হলে এর শেষ ২৪ মিনিটে মানুষের আবির্ভাব পৃথিবীতে। এরই মধ্যে এ পৃথিবী হয়ে উঠেছে সুখ-দুঃখের ধারাবাহিক প্রকাশিকা।
প্রতিটি দুর্যোগ ও মহামারী সঙ্গে নিয়ে আসে বাটারফ্লাই ইফেক্ট। অর্থাৎ প্রজাপতি ওড়ার সময় একই সঙ্গে দুই ডানা ওপরে বা নিচে নেয় না। একটা ওপরে নিলে অপরটা নিচে থাকে। নদীর ভাঙাগড়ার মতো। ফলে দুর্যোগ ও মহামারীতে প্রজাপতির ওপরের দিকের ডানায় বসে কিছু অসাধু মানুষ, প্রতিষ্ঠান এমনকি রাষ্ট্রও ফুলেফেঁপে ওঠে। এবং তাদের ফেঁপে ওঠার মনস্তত্ত্বই মূলত জন্ম দেয় এমন মহামারীর, যা সন্তানকে বাধ্য করে মায়ের মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। অথচ অনুমতি দেয় না মাকে শেষবার ছুঁয়ে দেখার।
বাইবেলের এক্সোডাস, নেহেমিয়া, করিন্থিয় ইত্যাদি বইয়ে নবি মুসার সময়কার একটা গল্প প্রচলিত আছে। গল্পটা এমন, মুসা দশ অহি গ্রহণের জন্য চল্লিশ রাত ও দিন সিনাই উপত্যকায় অবস্থান করেন। এদিকে তার এক অবাধ্য অনুসারী সামেরি বনি ইসরাইলের সমস্ত স্বর্ণ একত্র করে তা দিয়ে একটি গোবৎস তৈরি করে। এবং স্বর্ণনির্মিত এ গোবৎসের পূজা করার জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে। বনি ইসরাইলের একটা অংশ গোবৎসের পূজায় লিপ্ত হলে মুসা সিনাই থেকে ফিরে এসে ক্রোধান্বিত হন। গোবৎস তৈরির মাধ্যমে তার অনুসারী দলকে বিভ্রান্ত করার কারণে মুসা সামেরিকে অভিসম্পাত করেন। এ অভিসম্পাতে সামেরির এক বিশেষ জ্বর হয়। এ জ্বরের বৈশিষ্ট্য এমন যে, ইতিপূর্বে এর নমুনা কোথাও ছিল না। সামেরিকে ছোঁয়া মাত্রই এ জ্বর অন্যের শরীরে স্থানান্তরিত হতো এবং আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যেত। ফলে সামেরি সারা দিন-রাত মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলত এবং মানুষ দেখলেই চেঁচিয়ে বলত আমাকে স্পর্শ কোরো না। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখো। কুরআন সামেরির এ বাচনভঙ্গি উদ্ধৃত করেছে ‘লা মিসাস’ তথা স্পর্শ কোরো না শব্দে। সুরা ত্বাহা : আয়াত ৯৭ দ্রষ্টব্য।
কভিডও জ্বর এবং স্পর্শ না করা তথা নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার মানসিক শাস্তি আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে। শরীরের ওপর শাস্তি কায়েম করলে শরীর যেমন অসুস্থ হয়, আমাদের মনও এ শাস্তির ফলে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে।
ব্যক্তি সামেরির গোবৎস তৈরির প্রেক্ষাপটে ‘লা মিসাস’-এর আপদের সঙ্গে মিল রেখে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রসমূহ এমন কিছু কী করেছে, যার ফলস্বরূপ আমরাও জ্বর ও নিরাপদ দূরত্বের মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছিলাম এবং এখনো আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে মুক্ত নই?
সামেরির স্বর্ণনির্মিত গোবৎস ও এর সামনে মাথা নত করে জীবনের কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য বিবেচনা করে পূজা করার মধ্যে আমরা এক ভয়ংকর পুঁজিবাদী মানসিকতার খোঁজ পাই। স্বর্ণের মূল্যবাহক মুদ্রার মনস্তত্ত্বের সঙ্গে সামেরির গোবৎসের প্রাসঙ্গিকতা দেখে আঁতকে উঠি। প্রচলিত প্রতিষ্ঠিত ও আন্দোলনরত মতবাদসমূহে পৃথিবীর সমস্ত অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত করার মানসিক অসুস্থতা আমাদের অন্যের অধিকার নিয়ে ভাবতে দেয় না। দায়িত্বের সর্বজনীন দৃষ্টি, মহানুভবতার হৃৎপি-ের ধুকপুকানি, মানসিক স্থিরতা, প্রণয়ের গভীরতা ও অমরত্ব ইত্যাদি সবকিছু আর আমাদের মধ্যে দেয়াল হয়ে ওঠে সামেরির বাছুর। এ এক অস্ফুট যাতনা।
সামেরির বাছুর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নবী মুসা মূলত বনি ইসরাইল জাতির তাবৎ স্বর্ণ অধিগ্রহণকারী ধর্মব্যবসায়ী সামেরির এমন এক মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা ভেঙেছিলেন, যা ধর্মের চোখে শেরেক ও রাষ্ট্রের চোখে কোষাগার লুট। আমাদের মধ্যেও একাই সব কুক্ষিগত করার যে বাসনা, তা প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট করে। এবং কেউ এটা অস্বীকার করে না যে, এ পৃথিবীর যত দুর্যোগ ও মহামারী আসে, তা প্রত্যক্ষভাবে মানুষের কর্ম অথবা পরোক্ষভাবে মানুষের মনস্তত্ত্ব থেকে সৃষ্ট। হোক সেটা ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়া কিংবা এককালীন প্রভাব।
ব্যক্তিস্বাধীনতার এ সেøাগানমুখর যুগে আমরা প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গী/সঙ্গিনীর সঙ্গে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করছি। সবচেয়ে কাছের মানুষকে ঠকাচ্ছি। আত্মকেন্দ্রিকতার নাম করে দেহকেন্দ্রিক হয়ে উঠছি। কারণ, আত্মকেন্দ্রিক মানুষ আত্মপরিচয় লাভ করবেন এটা স্বাভাবিক। এবং আত্মপরিচয় লাভ করার পর মানুষ অন্যকেও নিজের অনুরূপ বিবেচনা করতে শিখে গিয়ে সত্যিকারার্থে মানবিক হয়ে উঠবেন এটা আরও স্বাভাবিক।
মানুষ জাতির মন যদি বস্তুগত রূপ ধরে পৃথিবীতে বেরিয়ে পড়ত, তাহলে যা ঘটতে পারত, তার তুলনায় করোনা কি আমাদের করুণা ছাড়া আর কিছু করেছে?
লেখক : শিক্ষার্থী
রাজনীতিকে খেলার আইটেম করে অর্থনীতিও এখন জগৎ শেঠদের কব্জামুখী। অথচ কিছুদিন আগেও রাজনীতিতে অনুপ্রবেশের দোষারোপ ছোড়া হতো ব্যবসায়ীদের দিকে। রাজনীতিকরা এখন অর্থনীতিকও। অর্থনীতির সংজ্ঞা-ধারণা-ব্যাখ্যা তারাই দেন। এ দুর্গতিতে অর্থনীতিকরা চলে গেছেন সাইড লাইনে। না পারতে মুখ খোলেন না। চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও তাদের নীরবতা খেয়াল করার মতো। অর্থনৈতিক যত কথা রাজনীতিকরাই বলছেন। দেশের বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা কথা বললে অন্তত জনগণের কিছুটা হলেও অর্থনীতির প্রকৃত তথ্য জানার সুযোগ হতো।
রাজনীতিকরা অর্থনৈতিক বিষয়ে কথা বলতে পারবেন না বা এ বিষয়ক জ্ঞান তাদের নেই; বিষয়টা এমন নয়। কিন্তু, অর্থনৈতিক বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকা রাজনীতিকরাও ডলার, রিজার্ভ, জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্স নিয়ে এমন সব কথা ছেড়ে দিচ্ছেন, যা কেবল মানুষকে বিভ্রান্তই করছে না, গুজবের ডালপালা ছড়ানোর ব্যবস্থাও করে দিচ্ছে। একেক সময় একেকটা বলে তারা চলে যাচ্ছেন আরেক কথায়। আগের কথার মধ্যে থাকছেন না। রাজনীতিকদের কোনো কথা বলে দায় নিতে হয় না। কেউ তাদের কাছে জবাবও চায় না। কোনো কারণে জবাবদিহি অনিবার্য হয়ে গেলে বলে দেন, এভাবে কথাটা বলেননি। অথবা কম বোঝা সাংবাদিকরা গণ্ডগোল পাকিয়েছে, ঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেননি তার কথাটা। এতেও না কুলালে কথা আরেকটা তৈরি থাকে, ‘সিøপ অব টাং হয়ে গেছে’। এগুলো রাজনীতিতে খাটে, তাই বলে অর্থনীতিতেও?
এর অনিবার্য জের কোথায় গিয়ে ঠেকছে? অর্থনীতি-রাজনীতি মাড়িয়ে অর্থনৈতিক বিষয়-আশয় সোজা চলে যাচ্ছে আদালতে। ইসলামী ব্যাংক থেকে এস. আলম গ্রুপসহ চারটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৪ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার ঘটনায় অর্থপাচার হয়েছে কি-না, সে বিষয়ে দুদক, সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউ সংশ্লিষ্টদের অনুসন্ধানের নির্দেশ জারি হয়েছে হাইকোর্ট থেকে। ৪ মাসের মধ্যে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। এছাড়া, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ লোপাটের ঘটনায় কর্র্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে কেন যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতেও রুল জারি হয়েছে। আগামী ৫ এপ্রিলের মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককেও ব্যাখ্যা দিতে বলেছে আদালত। এর আগে, হাইকোর্টকে রায় দিতে হয়েছে চেক ডিজঅনার বিষয়েও।
অর্থ সেক্টর বা এ বিষয়ে বোঝাশোনা রাজনীতিকরা কর্মতৎপর থাকলে বিষয়টি কি আদালতে গড়াত? ব্যাংক-খেকোদের নিয়ে সরকার বা বাইরের রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব কী তা জানাই হলো না সাধারণ মানুষের। রাজনীতির মাঠে ‘খেলা হবে, খেলা হবে’র মতো অরুচিকর সেøাগান চললেও অর্থ লোপাট নিয়ে কোনো দলের প্রতিক্রিয়ার স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেনি। বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণের নামে অর্থ-লোপাটের খবরকে সরকার কতটা অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করছে, জানার বাইরেই থেকে গেল মানুষের।
হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের খবরে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষের কাছ থেকে যে ধরনের উদ্বেগ বা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তার ছিটেফোঁটাও নেই। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে বরং অর্থ লোপাট অস্বীকারের চেষ্টা লক্ষণীয়। ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকের ঋণে অনিয়ম নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, ‘ব্যাংকের অবস্থা কোথায় খারাপ লিখিত দিয়ে যান, খতিয়ে দেখা হবে।’
কোথায় গেছে অবস্থাটা? পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট হওয়ার পর সাংবাদিকদের ব্যক্তিগতভাবে লিখিত দেওয়ার কিছু থাকে? মন্ত্রী তথা রাজনীতিকদের অনেকেই এ কাজটি করেন সাধারণ মানুষ বা তার নির্বাচনী এলাকার অভিযোগ নিয়ে যাওয়া মানুষের সঙ্গে। তাদের বলেন, অভিযোগ লিখে যেতে। অথবা তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে বলেন, অভিযোগটি টুকে রাখতে। রাজনীতির এ টোকাটুকি এখন অর্থনীতিতেও সংক্রমিত। এমন টানাটানি অর্থনীতিকে কতটা বিষাক্ত করে তুলছে তা বুঝতে এ বিষয়ক বিশারদ হওয়া দরকার হয় না। কয়েকটি ব্যাংক থেকে টাকা লোপাটের তথ্য দেশের মূলধারার গণমাধ্যমে ফলাও হলেও সরকার তা গায়ে মাখছে না। বিষয়টি আদালতে চলে যাওয়ায় যেন ‘টুকে রাখা’র কাজটা হয়ে গেছে।
পাচার, লোপাটের খবরগুলো ‘দেশের বাইর থেকে ইউটিউবারের প্রপাগান্ডা’ বা ‘সোশ্যাল মিডিয়ার গালগল্প’ নয়। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই মূলধারার পত্রিকা এইসব খবর প্রকাশ করেছে। ফলে এগুলোকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। দেশের অর্থনীতি যখন প্রবল চাপে, প্রধানমন্ত্রী যখন ব্যয় সংকোচনের কথা বলছেন তখন এই ধরনের লুটপাটের খবর মানুষকে ব্যথা দেওয়া ছাড়া আর কিছু দিতে পারে না। সাদা চোখেই লক্ষণীয় ব্যাংক-খেকোদের নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ব্যাপারে সরকারি মহলে প্রতিক্রিয়ায় ভীষণ অনীহা। সরকার বা কোনো মন্ত্রী বিরক্ত হয়েছেন এমন কোনো খবরও নেই। বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা এ ইস্যুতে কোনো কর্মসূচি দিয়েছেন এমন কোনো খবর কি হয়েছে কোথাও? তার মানে রাজনীতিকদের কাছে এটি কোনো ঘটনা নয়? এসবের বিরুদ্ধে তাদের কোনো ‘খেলা’ থাকতে নেই? নয়াপল্টন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে কর্মসূচিও নয়।
বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর স্বীকার করেছেন। কিন্তু কারা ‘বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার করেছেন’ তাদের সম্পর্কে প্রকাশ্যে তিনি কিছু বলেননি। গত জুলাইতে এই ধরনের প্রায় ১০০টি এলসি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানালেও এই এলসিগুলো কারা খুলতে চেয়েছিলেন, তারা কোন রাজনৈতিক দল-সংশ্লিষ্ট এ প্রশ্ন তাদের কেউ করেনওনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বিরুপাক্ষ পাল রাজনৈতিক হুঁশিয়ারির মতো বলেছেন, ব্যাংকগুলোয় সংঘটিত অনিয়ম আর জালিয়াতির পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা আর মন্ত্রণালয়ের পলিসি মেকারদের ভ্রান্তনীতি রয়েছে। যা তিনি আঙুল গুনে একটা একটা করে দেখিয়ে দিতে পারবেন। আসলে পারবেন বা করবেন কাজটি? আছে তার সেই হিম্মত?
অর্থনীতির এ দুরবস্থা নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম মুস্তফা কামাল অনেকটা ‘ডুব’ দিয়ে থাকার পজিশন নিয়েছেন। কোনো কথাই বলছেন না তিনি। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান অর্থনীতি নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন কুস্তি খেলা উদ্বোধন বা পূজাপার্বণের অনুষ্ঠানেও। গত ৩ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জে কুস্তি প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ অর্থনৈতিক সংকট একদম কেটে যাবে। এর আগে, ১৯ আগস্ট সেখানেই আরেক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এটিই (আগস্ট) দুর্দশার শেষ মাস, আগামী মাসে পূর্ণ মাত্রায় উন্নয়ন শুরু হবে।
মন্ত্রী বা রাজনীতিকদের রয়েছে অর্থনীতিসহ যে কোনো বিষয়ে এ ধরনের যা ইচ্ছে কথামালার এন্তার সুযোগ, বলে দিলেই হয়, গণমাধ্যমে গুরুত্বও পায়। অর্থনীতিবিদরা সাইড লাইনে না থেকে কথা বললে অর্থনীতি বিশেষ করে রিজার্ভ, ডলার এমনকি ব্যাংক নিয়ে এত উড়োকথা রটত না। এর আগে, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার দশায় চলে গেছে বলে ধুয়া চলেছে। রিজার্ভ শেষ, বাংলাদেশ দেউলিয়ার পথে, ব্যাংকে টাকা নেই, গ্রাহকরা জমাকৃত টাকা ফেরত পাচ্ছেন না, কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গুঞ্জনে মানুষকে আতঙ্কে ফেলার জবাব দিতে হয়নি কাউকে।
ব্যাংক বা অর্থনীতি নিয়ে মনগড়া কথা বা তথ্য রটানো যেনতেন অপরাধ নয়। বৈশ্বিক মহামারী করোনার ধকল, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বময় স্নায়ুযুদ্ধসহ স্থানিক নানা কারণে সব দেশই কম-বেশি ভারাক্রান্ত। বাংলাদেশের অর্থনীতিও প্রবল চাপে। সেই তাপে উত্তপ্ত ব্যাংক খাতও। তাই বলে দেউলিয়া হয়ে যাবে? মুখের কথার জোরে আগুয়ান রাজনীতিকরা কেউ বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা বানিয়ে ছাড়েন, কেউ সিঙ্গাপুর বানিয়ে ফেলেন। ইচ্ছেমতো অর্থনীতির পোস্টমর্টেম করেন তারা। কারও ময়নাতদন্ত রিপোর্টে অর্থনীতি খুব টনটনে-টসটসে। কারও কাছে অর্থনীতি মরণ দশায়।
বুঝদার অর্থনীতিক বা অর্থনীতি বিষয়ক ব্যক্তিরা নিশ্চয়ই এ ধাঁচের মূল্যায়ন করবেন না। তাদের নীরবতা অনেক ক্ষতি করে দিচ্ছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখা যাবে বাংলাদেশ নেই, ব্যাংক গায়েব হয়ে গেছে ধরনের শিশুতোষ কথা ছড়ানো ব্যক্তিদের ক’জন অর্থনীতিক বা অর্থ খাত সম্পৃক্ত? মূল্যস্ফীতি, বাজারে নিত্যপণ্যের চড়া দাম, ব্যাংকে খরার টান, বা ডলার ঘাটতি অবশ্যই সত্য। কিন্তু, তা কোন পর্যায়ে? এসব তথ্য জানার অধিকার থেকেও বঞ্চিত সাধারণ মানুষ।
লেখক: কলামিস্ট ও বাংলাভিশনের বার্তা সম্পাদক
ভাষাসংগ্রামী, আইনজীবী ও রাজনীতিক আতাউর রহমান খান ঢাকার ধামরাইয়ের বালিয়া গ্রামে ১৯০৭ সালের ১ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। প্রজা সমিতিতে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক জীবনের সূচনা। ১৯৪৪ সালে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত দলটির সহসভাপতি ছিলেন। তিনি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সদস্য হিসেবে ভাষা আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। যুক্তফ্রন্টের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন (১৯৫৩-৫৫) এবং যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হন এবং ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারির পূর্ব পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন। ১৯৬২ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে জাতীয় লীগ নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন এবং পাঁচ মাস কারাভোগের পর মুক্তি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে তিনি বাকশালে যোগ দেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৭৯ সালে তিনি আবার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বে জাতীয় লীগ সাতদলীয় জোটের শরিক দল হিসেবে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নেয়। অবশ্য পরে তিনি জেনারেল এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন এবং ১৯৮৪ সালের মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৯১ সালের ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় চলতি বোরো মৌসুমে সেচে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকার নানারকম প্রস্তুতি নিয়েছে বলে দাবি করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতের যে পরিস্থিতি তাতে গ্রীষ্মে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বেশি দাম দিয়েও কৃষক ঠিকমতো বিদ্যুৎ না পেলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। এতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়তে পারে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, জ্বালানি তেল, সার ও বীজের দাম বেড়েছে। এখন আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। তার মানে চারদিক থেকে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর ফলে কৃষকের ‘সিগনিফিকেন্ট লস’ হবে। এভাবে দাম বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বোরো উপকরণনির্ভর ফসল। কিন্তু উপকরণের দাম এভাবে বাড়তে থাকলে, কৃষক আগ্রহ হারিয়ে ফেললে; সে ঠিকমতো উপকরণ ব্যবহার করতে পারবে না। এতে উৎপাদন ব্যাহত হবে। উৎপাদন খারাপ হলে চালের ঘাটতি হবে। এমনিতেই এখন প্রায় ৭০ লাখ টন গম ও ভুট্টা আমদানি করতে হচ্ছে। এরমধ্যে যদি চাল আমদানি করতে হয়; তাহলে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
ড. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সারাবিশ্ব নানারকম সংকটে ভুগছে। এ অবস্থায় আমাদের অন্তত খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সুযোগ রয়েছে। সেজন্য যে পরিমাণ দাম বেড়েছে সে পরিমাণ নগদ অর্থ সহায়তা দিতে হবে কৃষককে। ২০০৯-১০ সালের দিকে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে এক কোটির বেশি কৃষককে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা সরাসরি নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। এজন্য তারা ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খুলেছিলেন। তাদের সেই অ্যাকাউন্ট এখনো আছে, কিন্তু সহায়তা দেওয়া হয় না। এখন যদি সেই সহায়তা দেওয়া হয় তাহলে কৃষক আবার উৎসাহ পাবে।’
বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, প্রতি বছর সেচ মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি থেকে মে) বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। গত মৌসুমে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। চলতি বছর সম্ভাব্য চাহিদা ধরা হয়েছে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। গত বছরের তুলনায় এ বছর সেচ সংযোগের সংখ্যা ১ হাজার ৯১টি বেড়ে মোট ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৪৫৯টি হয়েছে। এজন্য বিদ্যুৎ লাগবে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট।
সেচ মৌসুমে অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সম্প্রতি তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিদ্যুতের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে উৎপাদনও বাড়ানো হচ্ছে। সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গ্যাস, ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল সরবরাহ বৃদ্ধি করা, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস সরবরাহ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে পরিস্থিতি ভালো হবে।’
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে প্রতিদিন ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস, ৭৭ হাজার ৪০০ টন ফার্নেস অয়েল এবং ৬৬ হাজার ১০০ টন ডিজেলের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। সূত্রমতে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ করা বাস্তবে খুব কঠিন ব্যাপার। গত বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পিডিবির দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট ছিল। বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এ বছর জ¦ালানির ঘাটতি আরও বেশি। তবে সরকার খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি করে ঘাটতি মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু আমদানিকৃত গ্যাস দিয়ে চাহিদা অনুযায়ী কতটা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে তা নিয়ে কর্মকর্তাদের অনেকেই সন্দিহান।
পিডিবির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে ১০ হাজার থেকে ১০ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। গ্যাস ও কয়লা সংকটের কারণে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এ ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের কারণেও কিছু কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে।
দেশে নির্মাণাধীন ও আমদানিকৃত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আগামী মার্চের শেষ দিকে ভারতের আদানি থেকে অতি উচ্চ দামে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ছাড়া মে মাসের দিকে চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে ৬১২ মেগাওয়াট এবং অন্যান্য কিছু ছোট বা মাঝারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৫০ থেকে ২০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হতে পারে। এপ্রিল-মে মাসের দিকে বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি হবে। তখন এসব কেন্দ্র সময়মতো উৎপাদনে এলেও ১৩ হাজার মেগাওয়াটের জোগান দেওয়া সম্ভব হবে। এর বাইরে উচ্চ মূল্যের জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে কিছু কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম মনে করেন, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করার সক্ষমতা সরকারের নেই। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি সরবরাহ করতে সরকারের ডলার খরচের যে সক্ষমতা দরকার তা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘জ্বালানি খাতে সরকারের ভুলনীতি আর অন্যায্য ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয়ের কারণে দাম বেড়েই চলেছে। সেই ব্যয় মেটাতে এখন বিদ্যুৎ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করে ভর্তুকি সমন্বয় করতে চাইছে। এই পরিস্থিতিতে উচ্চ দামে বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা অসম্ভব ব্যাপার।’
এদিকে ডলার সংকট এবং ঋণপত্র (এলসি) খোলার বিলম্বের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। সরকারের কাছে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মোটা অঙ্কের বিল পাওনা থাকলেও তারা ঠিকমতো না পাওয়ার কারণে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করতে পারছেন না। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নির্মাণকাজ এবং জ্বালানি আমদানির যে অগ্রগতি তাতে চাহিদার তুলনায় আগামী গ্রীষ্মে বিদ্যুতের ঘাটতি হবে আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট। তবে সাশ্রয় নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে ১ হাজার মেগাওয়াট এবং উচ্চ মূল্যের জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে আরও ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণ করতে পারে সরকার। এরপরও অন্তত ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থাকবে।
এদিকে দাম সমন্বয়ের নামে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে গণশুনানি ছাড়াই নির্বাহী আদেশে জানুয়ারি মাসে ১৮ দিনে চার দফা গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করেছে সরকার। এর মধ্যে দু’দফায় অন্তত ১০ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর আগে গত বছরের আগস্টে সেচে ব্যবহৃত ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ২৯ টাকা দাম বাড়ানো হয়। বিদ্যুৎ ও জ¦ালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষিতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে।
কুমিল্লার নাঙলকোট উপজেলার বাসন্ডা গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম মজুমদার বলছিলেন, গত বছর এক বিঘা বা ৩৩ শতক জমিতে ধান চাষ করতে সেচের জন্য ২৭৫০ টাকা ব্যয় হয়েছে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চলতি বোরো মৌসুমে এ ব্যয় বেড়ে অন্তত ৪ হাজার টাকা হবে। এর বাইরে অন্যান্য খরচও আনুপাতিক হারে অনেক বেড়েছে। ফলে এখন ধান চাষ করলে প্রতি বিঘা জমিতে অন্তত দেড় থেকে দুই হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে।
ডিজেলচালিত ইঞ্জিনের মাধ্যমে জমিতে সেচ দেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর গ্রামের শিয়ালা গ্রামের কৃষক নাঈম। শনিবার রাতে টেলিফোনে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতিবিঘা জমিতে এ বছর সেচের ব্যয় বেড়েছে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা। সার, বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের দামও বেড়েছে।
এর আগে মূল্যবৃদ্ধির গণশুনানির সময় বিইআরসি কৃষক ও প্রান্তিক মানুষের কথা বিবেচনা করলেও নির্বাহী আদেশের সময় এসব কিছুই বিবেচনা করা হয় না।
অতীতে সামাজিক সুরক্ষার অংশ হিসেবে প্রতিমাসে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীকে লাইফলাইন বা প্রান্তিক ব্যবহারকারী হিসেবে বিবেচনা করে তাদের বিদ্যুতের দাম তুলনামূলক কম বাড়াত কমিশন। দেশে এ ধরনের গ্রাহক রয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ, যাদের অধিকাংশই কৃষক। কিন্তু সর্বশেষ বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আদেশে এ সুবিধা বাতিল করা হয়েছে।
লাইফ লাইন শ্রেণির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বিল ছিল ৩.৭৫ টাকা। গত ডিসেম্বরে তা বাড়িয়ে ৩.৯৪ টাকা করেছিল মন্ত্রণালয়। সেখান থেকে এবার আরেক দফা বাড়িয়ে ৪.১৪ টাকা করা হয়েছে। ফলে গত দুই মাসের ব্যবধানে দরিদ্র মানুষকে এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ৩৯ পয়সা বাড়তি ব্যয় করতে হবে।
কৃষকের কথা বিবেচনা করে আগে সেচে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম সবসময়েই তুলনামূলক সাশ্রয়ী রাখার চেষ্টা করা হতো। কিন্তু এখন কৃষকেরাও রেহাই পাচ্ছে না। গত ১২ ডিসেম্বর কৃষিতে ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ২১ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৩৭ টাকা করা হয়। সেখান থেকে এবার আরও ২২ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৫৯ টাকা করা হয়েছে।
রংপুরের একজন কৃষক আনোয়ার আলী খানিকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দফায় দফায় যেভাবে সবকিছুর দাম বাড়ছে তাতে চাষি তো আর বেশিদিন বাঁচতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘ধান চাষ করে এখন লাভ তো দূরের কথা খরচই ওঠে না। তাই আগের চেয়ে ধান চাষ কমিয়ে দিয়েছি। এখন সারা বছর খাওয়ার জন্য যতটুকু ধান দরকার ততটুকুই চাষ করি। তাতে লোকসান হলেও কী করব? ডাল-ভাত তো খাওয়া লাগবে।’
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খারের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তারা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গতিশীল হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। শ্রীলঙ্কার ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে যোগ দিতে দেশটিতে সফরে আছেন মোমেন ও হিনা। গতকাল শনিবার সেখানে তাদের মধ্যে সাইডলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
রেডিও পাকিস্তান ও নিউজ নেটওয়ার্কের প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার পাকিস্তান-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেন। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে অর্থনীতি ও বাণিজ্যে পারস্পরিক উপকারী দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অর্থনৈতিক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংযোগ জোরদার করার এবং পর্যটন ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহ সংক্রান্ত বিষয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে মতের মিল রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সহযোগিতা জোরদারের আশা : এদিকে গত শুক্রবার বিকেলে দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদুজানা পেরামুনা পার্টির দিনেশ গুনাবর্ধনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। এ সময় তারা দুই দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীর মধ্যে চলমান সেক্টরাল সহযোগিতা আরও বাড়ানোর গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করেন। বিশেষ করে বাণিজ্য সহজীকরণ, ব্যবসা ও বিনিয়োগ, পর্যটন ও সংযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতার ওপর জোর দেন তারা।
গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, এর আগে সেদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী সাবরির দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মর্যাদাপূর্ণ ‘লক্ষ্মণ কাদিরগামার স্মারক বক্তৃতা’ শিরোনামে ‘শেয়ারড প্রসপারটি : এ ভিশন ফর সাউথ এশিয়া’ প্রদান করেন। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়ের সম্মিলিত আকাক্সক্ষা এবং যৌথ সমৃদ্ধির জন্য দক্ষিণ এশিয়া সম্মিলিতভাবে যে লক্ষ্যগুলো অনুসরণ করতে পারে সে সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। শ্রীলঙ্কার ঐতিহ্যবাহী পারফরমিং আর্ট সমন্বিত ঐতিহাসিক ইন্ডিপেন্ডেন্স হলে সাংস্কৃতিক উৎসব ‘লঙ্কারলঙ্কা’তে অংশগ্রহণ করেন।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, শ্রীলঙ্কার ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে অংশগ্রহণের জন্য দেশটিতে সফর করছেন ড. মোমেন। গত ৪ ফেব্রুয়ারি সকালে স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এ সফরে তিনি প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী সাবরি, নেপালের সদ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করা বিমলা রায় পাওডেলের সঙ্গে এবং মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খারের সঙ্গেও বৈঠক করেন। আশা করা হচ্ছে, সফর শেষে আজ ঢাকায় পৌঁছাবেন ড. মোমেন।
'পাঠান' মুক্তির আগে থেকেই অনুরাগীদের সঙ্গে শাহরুখের যোগাযোগের একটাই মাধ্যম, টুইটার। শনিবার ফের টুইটারে 'আস্ক এসআরকে' সেশনে ধরা দিলেন শাহরুখ। হালকা মেজাজে, খোলামেলা আড্ডায় মাতলেন অনুরাগীদের সঙ্গে। অনুরাগীদের প্রশ্ন উত্তর দিলেন। সেখানেই একজন টুইটার ব্যবহারকারীর উপদেশ- বয়স অনুযায়ী চরিত্রে অভিনয়ের করার। পাল্টা জবাব দেন শাহরুখও। বলেন, 'তিনি হিরো ছিলেন, আছেন, থাকবেন'।
অনুরাগীরা যেমন রয়েছেন, তেমনই ট্রোল করার লোকের সংখ্যাও কম নয় শাহরুখের সোশালে। বছর সাতান্নর 'তরুণ' এই অভিনেতাকে একজনের প্রশ্ন, 'আপনি কি এভাবেই হিরোর চরিত্রেই অভিনয় করবেন, নাকি কোনো দিন নায়ক-নায়িকার বাবার চরিত্র করার পরিকল্পনাও রয়েছে?' তাতে শাহরুখ যা জবাব দিয়েছেন, তা রীতিমত ছড়িয়ে পড়েছে সোশালে।
এমনিতেই রসিক মানুষ শাহরুখ। তবে কোন কথায় কাকে কী উত্তর দেবেন, তা ভালোই জানা তার। বাদশাহ লেখেন, 'তুই বাপ হ… আমি হিরোর চরিত্রেই ঠিক আছি।'
শনিবারের 'আস্ক এসআরক'-এ সেশনে, শাহরুখের কাছে জানতে চাওয়া হয় 'পাঠান'-এর মোট আয়ের পরিসংখ্যান। তাকেও ফেরাননি শাহরুখ। উত্তর দিয়ে লেখেন, 'ভালোবাসা ৫ হাজার কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে, ৩ হাজার কোটি প্রশংসা, ৩২৫০ কোটি হাগ, ২০০০ কোটি হাসি এখনও গণণা চলছে। তোমার অ্যাকাউন্ট্যান্ট কী বলছেন?'
'পাঠান' ঘিরে উন্মাদনা নজিরবিহীন। প্রেক্ষাগৃহের বাইরে এই ছবি দেখার ঢল। শাহরুখ অভিনীত ছবিটি লম্বা রেসের ঘোড়া, বলেছেন সিনেমা বিশেষজ্ঞরা। ৪ বছর পর শাহরুখ পর্দায় ফিরেছেন বলেই শুধু নয়, ৭ দিনে বক্স অফিসে ৭০০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে 'পাঠান', যা বলিউডে বছরের সেরা ব্লকবাস্টার হিসাবে গণ্য হতে চলেছে।
বিশ্বে জনপ্রিয় ফলগুলোর মধ্যে পেঁপে একটি। পুষ্টিগুণের জন্যই সবাই এই ফলটি বেশি পছন্দ করেন।
চিকিৎসক থেকে পুষ্টিবিদ— সকলেই এই ফলকে ‘মহৌষধ’ বলে থাকেন। শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে, বয়স্কদের অর্শের সমস্যায় আবার কম বয়সীদের ওজন কমানোর ডায়েটে পাকা পেঁপের স্থান সকলের আগে। বিভিন্ন ভিটামিন এবং খনিজের প্রাকৃতিক উৎস পাকা পেঁপে চোখের জন্যও উপকারী। বিটা ক্যারোটিনে ভরপুর পাকা পেঁপে ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
অ্যান্টি অক্সিডেন্টে ভরপুর
ভিটামিন সি এবং অ্যান্টি অক্সিড্যান্টে ভরপুর পাকা পেঁপে ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যধির প্রতিরোধক। এ ছাড়াও পেঁপেতে ছড়েছে ক্যারোটিনয়েড, ভিটামিন সি এবং ই, যা ত্বকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হজমে সহায়ক
পেঁপে মুখের রুচি ফেরায়। সেই সঙ্গে খিদেও বাড়ায় এবং পেট পরিষ্কার রাখে। পেট পরিষ্কার থাকলে গ্যাস অম্বলের সমস্যাও নিয়ন্ত্রণে থাকে। শুধু তাই নয়, যাদের অর্শের সমস্যা রয়েছে, চিকিৎসকরা তাদের পেঁপে খাওয়ার পরামর্শ দেন।
প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সক্ষম
পেঁপে কিন্তু শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ১০০ শতাংশ ভিটামিন সি পাওয়া যায় এই পাকা পেঁপে থেকেই। শরীরে কোনও সংক্রমণ হলে, তা কমাতে চিকিৎসকরা পাকা পেঁপে খাওয়ার পরামর্শ দেন।
ওজন কমাতে
পাকা পেঁপেতে যথেষ্ট পরিমাণ ফাইবার থাকায় তা অন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। পাশাপাশি বিপাক হারও বাড়িয়ে তোলে। এ ছাড়াও যারা ওজন কমাতে ডায়েট মেনে খাবার খেয়ে থাকেন, তাদের জন্যও ভাল পাকা পেঁপে।
হার্টের স্বাস্থ্যরক্ষা করে
হার্টের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে পটাশিয়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগ সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করে এই যৌগ। প্রাকৃতিকভাবে পটাশিয়ামের উৎস হল পাকা পেঁপে।
সংক্ষিপ্ত সফরে নেপাল হয়ে বিকেলে ঢাকায় এসেছেন মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুসন ইসমাইল। আজ শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান ঢাকায় নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনা মো. হাশিম।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শ্রমবাজারের জটিলতা নিয়ে আলাপ করবেন। কিভাবে দেশটিতে আমরা সহজে কর্মী পাঠাতে পারি; সেগুলো আলোচনায় উঠে আসবে। আমাদেরও কিছু প্রস্তাব রয়েছে। আমাদের কর্মীদের স্বার্থ আগে আমরা চাই, সবার জন্য বাজার খুলে দেওয়া হোক। নিয়োগকর্তার পছন্দমতো রিক্রুটিং এজেন্সি নিয়োগ— এটা আমরা চাই না। অভিবাসন ব্যয়
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার গত কয়েক বছর ধরে অস্থির। দেশটিতে প্রত্যাশিত শ্রমিক পাঠাতে পারছে না বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে শ্রমবাজারটির জটিলতা নিরসনে আলোচনা করতে সংক্ষিপ্ত সফরে নেপাল হয়ে ঢাকায় আসছেন মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুসন ইসমাইল।
তার সফরে শ্রমবাজারটি গতিশীল করতে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) পরিবর্তন, অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় কমানোসহ দেশের সব বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য বাজার উন্মুক্ত করার প্রস্তাব দেবে ঢাকা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ২৪ ঘণ্টার সফরে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক করবেন। পাশাপাশি তিনি সেনাকল্যাণ সংস্থার সঙ্গেও একটি বৈঠক করবেন।
শ্রম পরিদর্শক পদে যোগ দেওয়ার ৩৪ বছর পর পদোন্নতি পেলেন মাহমুদুল হক। স্বপ্ন দেখতেন পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে একসময় প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে যাবেন। সেই স্বপ্ন আট বছরেই লুটিয়ে পড়ল জ্যেষ্ঠতার তালিকায়।
১৯৮৮ সালে যোগ দেওয়ায় ’৯৫ সালেই পদোন্নতি পাওয়ার কথা ছিল মাহমুদুল হকের। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অদূরদর্শিতা সে স্বপ্ন শুরুতেই বাধা পেল। এন্ট্রি পোস্টে যোগ দেওয়ার পর তার মতো অন্য কর্মচারীরা যখন পদোন্নতির স্বপ্নে বিভোর, তখন তাতে গা-ই করলেন না সেই সময়ের প্রতিষ্ঠানপ্রধান।
মাহমুদুল অপেক্ষায় রইলেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য। সেই পরিবর্তন আসতে আসতে চাকরিতে কেটে গেল আঠারো বছর। আঠারোতে মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হয়। তিনিও ভাবলেন আঠারোতে তিনি না হয় ‘জব ম্যাচিউরিটি’তে পৌঁছালেন। চাকরির আঠারো বছরে পদোন্নতি পেলেও মন্দ হয় না।
কিন্তু অবাক ব্যাপার, কর্তৃপক্ষ পদোন্নতি দিল, তবে মাহমুদুলকে ছাড়া। পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনে কোথাও তার নাম নেই। হতাশায় মুষড়ে পড়লেন তিনি। জুনিয়র কর্মকর্তারদের নাম আছে, অথচ তার নাম নেই। প্রতিষ্ঠানের নীতি-নির্ধারকদের দরজায় দরজায় ঘুরলেন ন্যায়বিচারের আশায়। কিন্তু তারা পাত্তাই দিলেন না বিষয়টি।
তারা আমলে না নিলেও মাহমুদুলের স্বপ্ন তো সেখানেই থেমে যাওয়ার নয়। সেই স্বপ্ন পুঁজি করে তিনি গেলেন আদালতে। সেই ভিন্ন জগৎটাও কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তার পক্ষে রায় দিল। মাহমুদুল আনন্দে আত্মহারা হলেন। কিন্তু সেই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। সরকার আপিল করল প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলার ফল উল্টে গেল। হতাশায় ভেঙে না পড়ে তিনি গেলেন উচ্চ আদালতে। আপিল বিভাগে সিভিল আপিল মামলা করলে প্রশাসনিক আপিল আদালতের রায় বাতিল হয়। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল থাকে।
জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করার মতো মাহমুদুল হকও যেন সরকারের সঙ্গে লড়াই করতে নামলেন। আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন করল সরকারপক্ষ। একপর্যায়ে সরকার বুঝতে পারল কোনোভাবেই তারা এ মামলায় জিততে পারবে না। সরকারপক্ষে রিভিউ পিটিশন প্রত্যাহার করা হলো। আদালত সরকারের পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনকে আইনের কর্তৃত্ববহির্ভূত বলে ঘোষণা করল। জুনিয়র কর্মকর্তাকে যেদিন থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে এবং যতবার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, একইভাবে মাহমুদুল হককে পদোন্নতি দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। বকেয়া বেতন-ভাতাসহ সব পাওনা কড়ায়-গ-ায় পরিশোধের নির্দেশনা আসে।
আদালতের এই নির্দেশনা দেওয়া হয় ২০১৮ সালে। এরপর আদেশ বাস্তবায়ন করতে সরকারের লেগে যায় প্রায় চার বছর। ২০২২ সালের ১১ মে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ৩৪ বছর পর পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মাহমুদুল হক। আবারও তাকে ঠকিয়েছে সরকার। জুনিয়র কর্মকর্তা যুগ্ম মহাপরিদর্শক হলেও তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয় তার দুই ধাপ নিচের সহকারী মহাপরিদর্শক পদে। উপমহাপরিদর্শক ও যুগ্ম মহাপরিদর্শক আরও ওপরের পদ। আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
কখনোই প্রজ্ঞাপন মাহমুদুল হকের জন্য ভালো বার্তা বয়ে আনেনি। পুরো চাকরিজীবন আদালতের বারান্দায় ঘুরে তিনি পৌঁছেছেন অবসরের প্রান্তসীমায়। আর তিন মাস পরে তিনি অবসরে যাবেন। যৌবন ও মধ্য বয়সের দিনগুলোতে আদালতে ঘুরে বেড়ানোর শক্তি ও সাহস থাকলেও মাহমুদুল হক এখন সেই সাহস দেখাতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করছেন। পারবেন তো শেষ সময়ে এসে সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে?
মাহমুদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, তিনি আদালতের কাছেই জানতে চাইবেন, আদালতের বিচার না মানার শাস্তি কী।
পুরো ঘটনা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা শুনিয়ে জানতে চাইলেন, কতজনের পক্ষে মাহমুদুল হকের মতো লড়াকু মনোভাব দেখানো সম্ভব?
সীমাহীন আনন্দ নিয়ে মানুষ সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়। এরপরই তার মধ্যে যে স্বপ্নটি দানা বাঁধে তা হচ্ছে পদোন্নতি। কার কীভাবে পদোন্নতি হবে তা আইনকানুন, নিয়ম-নীতি দিয়ে পোক্ত করা। পুরো বিষয়টি কাচের মতো স্বচ্ছ। এরপরও পদোন্নতি হয় না। দিন, মাস, বছর পার হয়ে যায়, কাক্সিক্ষত পদোন্নতির দেখা মেলে না।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ক্যাডারে নিয়মিত পদোন্নতি হয়। বাকি ক্যাডারে হতাশা। তার চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি নন-ক্যাডারে। ক্যাডার কর্মকর্তারা নিজের পদোন্নতির ষোলো আনা বুঝে নিয়ে ঠেকিয়ে দেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি। সংখ্যায় বেশি হওয়ায় নন-ক্যাডাররা একজন আরেকজনকে নানা ইস্যুতে আটকাতে গিয়ে পুরো প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেন। সরকারের মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কর্মচারী। সেই হিসেবে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনবলের পদোন্নতি হয় না। পে-কমিশন হলেই কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য করুণা উথলে ওঠে। এমনকি ব্লকপোস্টে যারা আছেন, তাদের জন্যও পদোন্নতির বিকল্প সুবিধা বাতলে দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কর্মচারীদের পদোন্নতি উপেক্ষিতই থাকে।
যখন সময়মতো পদোন্নতি হয় না, তখন নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে থাকে। এসব সমস্যা সংশ্লিষ্ট দপ্তর-অধিদপ্তরের চৌহদ্দি পেরিয়ে আমজনতাকেও প্রভাবিত করে। নন-ক্যাডার কর্মকর্তা আর সঙ্গে কর্মচারীরা যখন বুঝতে পারেন পদোন্নতির আশা তাদের নেই, তখন তারা দুহাতে টাকা কামানোর ধান্দায় মেতে ওঠেন। এতে করে ঘুষের সংস্কৃতি সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। অকার্যকর পথে হাঁটে রাষ্ট্র। সাধারণ মানুষ টাকা ছাড়া তাদের কাছ থেকে কোনো সেবা পায় না, ব্যবসায়ীরা নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে ব্যবসায় আসেন না, ব্যবসাবান্ধব পরিস্থিতি না থাকায় মুখ ফিরিয়ে নেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। প্রধানমন্ত্রীর বারবার আহ্বানেও বিনিয়োগকারীরা সাড়া দেন না। সাধারণ মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে সেবা দেওয়ার বাণীতেও উদ্বুদ্ধ হন না সংশ্লিষ্টরা।
এই পরিস্থিতিতে অনিয়ম আটকে রাখার সব কৌশলই ব্যর্থ হচ্ছে। যথাযথ তদারকি না থাকায় বিভাগীয় ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে। ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫০টি অডিট আপত্তি ঝুলে থাকায় অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোও আগ্রহ হারিয়ে নিজেরাই জড়িয়ে পড়ছে অনিয়মে। দন্তহীন বাঘে পরিণত হওয়ার তথ্য সাংবাদিকদের জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান নিজেই।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদোন্নতির বড় একটা অংশ আটকে রাখে মন্ত্রণালয়গুলো। এই আটকে রাখার কারণ হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের স্বার্থ। বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তরে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিলে নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতিপ্রাপ্তদের ওপরের পদে বসাতে হবে। এতে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের এককালীন লাভ; অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে একবার পদোন্নতি দেওয়া যাবে। কিন্তু পদোন্নতি না দিয়ে সংশ্লিষ্টদের চলতি দায়িত্ব দিলে বছরজুড়ে টাকা আয় করতে পারেন নীতিনির্ধারকরা। দপ্তর, অধিদপ্তরে বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। চলতি দায়িত্বপ্রাপ্তদের আয় অনুসারে নীতিনির্ধারকদের মাসোহারা দিতে হয়। নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া হলে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের নিয়মিত আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে আইন বা বিধি-বিধানের ফাঁকফোকর গলিয়ে নন-ক্যাডার এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি আটকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়।
সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদের সভাপতি নিজামুল ইসলাম ভূঁইয়া মিলন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সচিবালয় এবং সারা দেশের সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতির মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। নন-ক্যাডারের কিছু বিষয় ছাড়া সচিবালয়ের কর্মচারীরা সময়মতো পদোন্নতি পায়। কিন্তু সচিবালয়ের বাইরে পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। সচিবালয়ে মাত্র ১০ হাজার কর্মচারী আছেন। সচিবালয়ের বাইরে আছেন ১০ লাখের বেশি। এসব কর্মচারীর পদোন্নতি নিয়ে বহু বছর ধরে চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনো ফল পাইনি। সর্বশেষ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সমস্যা নিয়ে কাজ করার জন্য একটি কমিটি করে দিয়েছে। কমিটি কিছু সুপারিশ করেছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। এরপর এর কোনো অগ্রগতি নেই। যেখানে সরকারপ্রধান বলেন, চাকরিজীবনে সবাই যেন কমপক্ষে একটি পদোন্নতি পায়। সেখানে বহু কর্মচারী কোনো পদোন্নতি ছাড়াই অবসরে যাচ্ছেন। সরকারপ্রধানের নির্দেশনা উপেক্ষা করেন আমলারা। তাদের আগ্রহ কেনা-কাটায়, বিদেশ ভ্রমণে, নতুন জনবল নিয়োগে। এসব করলে তাদের লাভ। কর্মচারী পদোন্নতি দিতে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এর নিশ্চয়ই একটা শেষ আছে। বৈষম্যের পরিণতি কী হয়, তা অনেক দাম দিয়ে বিডিআর বিদ্রোহে আমরা দেখেছি।’
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি ঝুলছে বছরের পর বছর। এই অধিদপ্তরের কয়েক শ কর্মকর্তা পাঁচ বছর আগেই পদোন্নতির যোগ্য হয়েছেন। নানা কায়দা-কানুন করে তাদের পদোন্নতি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সংশ্লিষ্টদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করে তাদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া এগিয়ে নিলেও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নতুন করে জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার নামে সময়ক্ষেপণ করছে। জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার পর এখন তাদের পারিবারিক সদস্যদের তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই সংস্থা নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদেরও তথ্য তালাশ করছে। তাদের আত্মীয়দের মধ্যে কে কোন দলের সমর্থক তার তথ্য নিচ্ছেন সংস্থার কর্মকর্তারা।
গত মাসে শেষ হওয়া জেলা প্রশাসক সম্মেলনে দায়িত্ব পালন করছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সুরম্য ভবনে দায়িত্ব পালন করলেও ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তার মনের অবস্থাটা মনোহর ছিল না। কেমন আছেন জানতে চাইলে ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তা বলেন, ‘ভালো নেই। চাকরি করছি, পদোন্নতি নেই। ২০১৫ সালের আগে পদোন্নতি না পেলেও টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড ছিল। তাও তুলে দেওয়া হয়েছে। তুলে দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল সময়মতো পদোন্নতি হবে, ব্লকপোস্টধারীদের দেওয়া হবে বিশেষ আর্থিক সুবিধা। এসবের কোনোটাই হয়নি।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে একটি প্রশাসনিক আদেশ খুবই পরিচিত। সেই প্রশাসনিক আদেশ ১৬/২০১৮ অনুযায়ী ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগ হবে। আর ৩০ ভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগের ফলে বিমানে বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় কর্মকর্তা বেশি। নীতিনির্ধারকদের নতুন জনবল নিয়োগে আগ্রহ বেশি। পুরনোদের পদোন্নতি দিয়ে ওপরের পদ পূরণের চেয়ে তারা নতুন নিয়োগে যান। ফলে কারও চাকরিজীবনে একবারও পদোন্নতি হয় না। নামমাত্র যে পদোন্নতি হয় তা অনিয়মে ভরপুর।
নন-ক্যাডার ছাড়াও ১৩তম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। প্রতিটি দপ্তরে এসব গ্রেডের পদোন্নতি আটকে আছে। অথচ এসব গ্রেডেই বেশি লোক চাকরি করছেন। সরকারের মোট জনবল প্রায় ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ২৩ শতাংশ পদের মধ্যেও নন-ক্যাডার রয়েছেন। এ ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৭৭ শতাংশ পদই ১৩তম থেকে তার পরের গ্রেডের। এতে করে সহজেই বোঝা যায় সরকারের জনবলের বড় অংশই পদোন্নতির চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। সরকারের জনবলের এই বিশাল অংশ যখন পদোন্নতি নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগেন, তখন তারা নানা অনিয়মে ঝুঁকে পড়েন।
বেশির ভাগ দপ্তর, অধিদপ্তর পরিচালনা করেন বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা তাদের প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে ক্যাডার কর্মকর্তাদের দপ্তর, অধিদপ্তরে পাঠান। প্রেষণে গিয়ে অনেক কর্মকর্তা শুধু রুটিন কাজটুকুই করতে চান। শূন্যপদে জনবল নিয়োগ বা পদোন্নতি রুটিন কাজ না হওয়ায় তা উপেক্ষিত থাকে। তা ছাড়া পদোন্নতি দিতে গিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়; বিশেষ করে মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রী বা সচিব তাদের পছন্দের লোককে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য সংস্থার প্রধানকে চাপ দেন। এই চাপ উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ না থাকায় অযোগ্য লোককে পদোন্নতি দিতে হয় সংস্থার প্রধানকে। এই জটিলতা থেকে দূরে থাকার জন্য সংশ্লিষ্টদের পদোন্নতি দেওয়া থেকেও দূরে থাকেন সংস্থার প্রধানরা।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের ১৪ গ্রেডের একজন কর্মচারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাইরের লোকের ইচ্ছাটাই জাগে না আমাদের পদোন্নতি দিতে। আমাদের দপ্তরপ্রধান মহাপরিচালক প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। অতিরিক্ত মহাপরিচালকও অনেক সময় প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রেষণে আসেন। তাদের কেন ইচ্ছা জাগবে আমাদের পদোন্নতি নিয়ে। যদি এসব পদে ফুড ক্যাডারের কর্মকর্তা থাকতেন, তাহলে তারা খাদ্য বিভাগের সমস্যা বুঝতেন। তা ছাড়া নিয়োগ বিধি সংশোধনের নামে আমরা দীর্ঘদিন একই পদে আটকে আছি।’
গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে এক আবেদনে জানান, ‘বর্তমানে সচিবালয়ে প্রায় দুই হাজারের বেশি প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা কর্মরত। এর বিপরীতে ক্যাডারবহির্ভূত সংরক্ষিত পদের সংখ্যা ২৬৭টি, যা খুবই নগণ্য। ফলে একই পদে ২০-২২ বছরের বেশি সময় কর্মরত থাকার পরও অনেকে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। পদোন্নতি না পাওয়ায় সৃষ্ট হতাশার ফলে কর্মস্পৃহা নষ্ট হচ্ছে।’
সরকার এ সমস্যা থেকে কীভাবে বের হতে পারে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এসব সমস্যা সমাধানে সরকার সব সময়ই কাজ করে। কিন্তু এ চেষ্টা জটিলতার তুলনায় কম। এ বিষয়ে আরও এফোর্ট দিতে হবে।
বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের উপনির্বাচনে বেসরকারিভাবে ১১২ কেন্দ্রের ফলাফলে ৯৫১ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন বহুল আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম। একতারা প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ১৯ হাজার ৪৮৬ ভোট। এ আসনে জয় পেয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ (ইনু) সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম তানসেন। মশাল প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ২০ হাজার ৪৩৭ ভোট।
বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে বগুড়ার দুইটিসহ মোট ৬ আসনে উপনির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হয়। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির এমপিরা পদত্যাগের ঘোষণা দিলে এ আসনগুলো শূন্য হয়।
তখন, বগুড়া-৬ (সদর) এবং বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন হিরো আলম। নির্বাচন কমিশন একদফা তার প্রার্থিতা বাতিল করলেও পরে আদালতে গিয়ে প্রার্থিতা ফিরে পান তিনি।
বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) ও বগুড়া-৬ (সদর) আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আশরাফুল হোসেন হিরো আলম বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) দুপুর পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘সদরের কেন্দ্র সব দখল হয়্যা গ্যাছে। ডিসি-এসপিক কয়্যাও কোনো কাম হচ্চে না। সদরের আশা সব শ্যাষ। কাহালু-নন্দীগামের অনেক কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে দেকছি। ভোট খুব সুষ্ঠু হচ্চে। মাঠের অবস্থা ভালো। কাহালু-নন্দীগ্রামে নিশ্চিত এমপি হচ্চি।’
এর আগে, সকালে সদর উপজেলার এরুলিয়া উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে যান তিনি। ভোট দেওয়ার পর হিরো আলম বলেন, ‘বগুড়া-৬ আসনে আগে থেকেই গোলযোগের আশঙ্কা করেছিলাম, সেটাই সত্যি হয়েছে। নির্বাচনি এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তবে বগুড়া-৪ আসনে ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে। এভাবে সুষ্ঠু ভোট হলে এই আসনে আমিই বিজয়ী হবো।’
এদিকে বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে কয়েকটি কেন্দ্রে নৌকা প্রার্থীর এজেন্ট বাদে অন্য এজেন্টদের ভোটকক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আজ সকালে হিরো আলমসহ তিনজন প্রার্থী এ অভিযোগ করেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাদের এজেন্টদের বের করে দিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করা হয়।
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫০ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা খরচের হিসাব ধরে বাজেট প্রস্তাব প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে সরকার। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৭২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা বেশি। অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে খরচের বেশিরভাগ অর্থ জোগাড়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১৯ শতাংশ বাড়ানো হবে। আসছে জুনের প্রথমভাগে জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আগামী বাজেট হবে জাতীয় নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ বাজেট। তাই এখানে নেওয়া কোনো পদক্ষেপে যেন আওয়ামী লীগ সরকার সমালোচনার মুখে না পড়ে এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্টদের থাকছে বিশেষ নজর। এ ছাড়া রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। তাই সংকট ও নির্বাচন দুটোই মাথায় রাখতে হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে মোটাদাগে একটি রূপরেখা পাঠানো হয়েছে। নতুন পরিকল্পনার পাশাপাশি গত তিন মেয়াদে সরকার কী কী উন্নয়ন করেছে আগামী বাজেট প্রস্তাবে তা মনে করিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং উচ্চপর্যায়ের সরকারি নীতিনির্ধারকদের উপস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো আগামী বাজেটের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আর গত সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি পাঠিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণে কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে হিসাব ধরে অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট প্রস্তাব প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে তা কয়েক দফা খতিয়ে দেখা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। তিনি প্রয়োজনীয় সংশোধন, যোগ-বিয়োগ করে আবারও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার আগেও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে থাকে।
ডলার সংকটে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছেন না সাধারণ ব্যবসায়ীরা। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় পণ্যের দাম বাড়ছে। কাঁচামাল সংকটে বিপাকে শিল্প খাত। ব্যাংক খাতে অস্থিরতা। নতুন চাকরির সুসংবাদ নেই বললেই চলে। দফায় দফায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। খুব শিগগিরই এসব সংকট কেটে যাবে বলে মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে ঋণদাতা সংস্থার কঠিন শর্তের বেড়াজালে আছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতেই আগামী অর্থবছরের বাজেট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশি^ক অস্থিরতা মোকাবিলায় সরকার কী কী পদক্ষেপ নেবে তা আগামী বাজেটে স্পষ্ট করা হবে। দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথাও বলা হবে। তবে শত সংকটের মধ্যেও আগামী বাজেটে ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী যতটা সুবিধা দেওয়া সম্ভব তা দিতে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে বাজেট প্রস্তুত কমিটির কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে কাঁচামাল আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দিতে হিসাব কষা হচ্ছে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডলার সংকটে আমদানি রপ্তানি প্রায় বন্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্যে সংকটকাল চলছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটে আমাদের দাবি অনুযায়ী নগদ সহায়তা দিতে হবে। রাজস্ব ছাড় দিতে হবে। কর অবকাশ ও কর অব্যাহতি বাড়াতে দিতে হবে।’
ঋণদাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া সংস্কারের শর্ত মানার অঙ্গীকার করে সরকার ঋণ পেয়েছে। শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে ঋণের যেকোনো কিস্তি আটকে দিতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। পর্যায়ক্রমে প্রতি অর্থবছরের বাজেটে এসব সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়ন করা হবে। আসছে বাজেটে শর্ত মানার চেষ্টা থাকবে। বিশেষভাবে অতীতের মতো ঢালাওভাবে কর অব্যাহতি দেওয়া হবে না। আর্থিক খাতের সংস্কারের কিছু ঘোষণা থাকবে। বিশেষভাবে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দেওয়া হবে। আইএমএফের সুপারিশে এরই মধ্যে ভ্যাট আইন চূড়ান্ত হয়েছে। আয়কর আইন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন হয়েছে। শুল্ক আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ে আছে। এ তিন আইন অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণ করা হবে। আসছে বাজেটে টেকসই অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার কথা বলা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগের কথা শোনানো হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঋণদাতা সংস্থার শর্ত মানার কথা বলা হলেও সব আগামী বাজেটে একবারে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে অর্থনীতির গতি কমে যাবে।’
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এনবিআর-বহির্ভূত খাত এবং এনবিআর খাতের জন্য মোট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৪ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৯ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হতে পারে। এতে লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা হবে। এনবিআর এ লক্ষ্যমাত্রা কমানোর জোরালো আবেদন করেছে। কিন্তু তা আমলে আনেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) হিসেবে, ৩৪ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা আয়কর হিসেবে এবং ৩১ শতাংশ বা বাকি ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা শুল্ক হিসেবে সংগ্রহ করার কথা বলা হতে পারে বলে জানা গেছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রার কথা শুধু বললেই হবে না। কীভাবে অর্জিত হবে, সেটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা না থাকলে প্রতিবারের মতো ঘাটতি থাকবে। রাজস্ব ঘাটতি হলে অর্থনীতিতে আয় ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়। তাই এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত।’
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআর উৎসে করের আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। সম্পদশালীদের ওপর নজর বাড়ানো হবে। শুধু বেশি সম্পদ থাকার কারণে অতিরিক্ত কর গুনতে হবে। সারচার্জ বহাল রাখা হবে। সুপারট্যাক্স গ্রুপকে উচ্চহারে গুনতে হবে কর। আগামী অর্থবছরেও অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা থাকবে। অর্থ পাচারোধে আইনের শাসন কঠোর করা হবে। অর্থ পাচার আটকাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হবে। করপোরেট কর কমানোর দাবি থাকলেও তা মানা হবে না। অন্যদিকে নির্বাচনের আগের বাজেট হওয়ায় করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করতে খোদ অর্থমন্ত্রী বললেও রাজস্ব আদায় কমে যাবে এমন যুক্তি দেখিয়ে এনবিআর রাজি নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে। কমানো হবে শিল্পের অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি শুল্ক। ডলারের ওপর চাপ কমাতে বেশি ব্যবহৃত পণ্য আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দেওয়া হবে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানি কমাতে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হবে। তৈরি পোশাক খাতের সব সুবিধা বহাল রাখা হবে। শিল্পের অন্যান্য খাতেও কতটা সুবিধা বাড়ানো যায় তা নিয়ে এনবিআর হিসাব করছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বাজেট প্রস্তুতিবিষয়ক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্পে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি এবং ঘাটতি ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হতে পারে। আগামী অর্থবছরে জিডিপির ৬ শতাংশ ঘাটতি ধরে ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হতে পারে বলে জানা যায়। ঋণদাতা সংস্থার কাছ থেকে ভর্তুকি কমানোর চাপ থাকলেও আগামীবার এ খাতে বেশি ব্যয় ধরা হতে পারে। এ খাতে ১ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ব্যয় আছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, গত সোমবার রাতে আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ অনুমোদন করে। ঋণদাতা সংস্থাটির কাছ থেকে বাংলাদেশ ছয় কিস্তিতে তিন বছরে ৪৭০ কোটি ডলার পাচ্ছে। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের দিন আইএমএফ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে পূর্বাভাস দেয়। সংস্থাটি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হতে পারে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা হতে পারে ৭ দশমিক ১ শতাংশ।
এতে রিজার্ভ সম্পর্কে বলা হয়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ৩ হাজার কোটি ডলার। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বাড়বে এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।