
ভাষাসংগ্রামী, আইনজীবী ও রাজনীতিক আতাউর রহমান খান ঢাকার ধামরাইয়ের বালিয়া গ্রামে ১৯০৭ সালের ১ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। প্রজা সমিতিতে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক জীবনের সূচনা। ১৯৪৪ সালে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত দলটির সহসভাপতি ছিলেন। তিনি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সদস্য হিসেবে ভাষা আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। যুক্তফ্রন্টের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন (১৯৫৩-৫৫) এবং যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হন এবং ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারির পূর্ব পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন। ১৯৬২ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে জাতীয় লীগ নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন এবং পাঁচ মাস কারাভোগের পর মুক্তি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে তিনি বাকশালে যোগ দেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৭৯ সালে তিনি আবার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বে জাতীয় লীগ সাতদলীয় জোটের শরিক দল হিসেবে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নেয়। অবশ্য পরে তিনি জেনারেল এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন এবং ১৯৮৪ সালের মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৯১ সালের ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে অতিথি পাখির ডানায় ভর করে আগমন ঘটে শীতকালের। পরিযায়ী পাখিদের আমরা আদর করে অতিথি পাখি বলে ডাকি। যেসব প্রজাতির পাখি পরিযানে অংশ নেয়, সেগুলোকে পরিযায়ী পাখি বলে। আমাদের দেশে এসব অতিথি পাখির আগমন ঘটে উত্তর মেরু থেকে। সাইবেরিয়া, ফিলিপস, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, অ্যান্টার্কটিকাসহ অনেক অঞ্চলে তাপমাত্রা যখন মাইনাস শূন্য ডিগ্রিতে নেমে আসে, তখন সেখানে দেখা দেয় প্রচণ্ড খাদ্যাভাব। তীব্র শীতে পাখির দেহ থেকে পালক খসে পড়ে। ফলে প্রাণ বাঁচাতে শীতপ্রধান অঞ্চলের পাখিগুলো হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে আসে আমাদের মতো নাতিশীতোষ্ণ এলাকায়। কিন্তু প্রকৃতি তাদের অনুকূলে হলেও একশ্রেণির দুর্বৃত্ত ব্যস্ত হয়ে ওঠে এসব অতিথি পাখি নিধনে।
মঙ্গলবার দেশ রূপান্তরে ‘বাঁচতে এসে হারাচ্ছে জীবন’ শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতি বছরের মতো এবারও শীতের শুরুতেই হাকালুকি হাওরে আশ্রয় নিতে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, মৌসুমের শুরুতেই ফাঁদ পেতে ও বিষটোপ দিয়ে হাওরে পাখি নিধন চলছে।
প্রকৃতিপ্রেমীদের আক্ষেপ, বাঁচতে আসা প্রাণীগুলোকে এভাবে হত্যা করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঠিকঠাক নজরদারি করতে পারছে না। অবশ্য বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকায় পাখি শিকারিদের সঙ্গে পেরে উঠছে না তারা। হাওরপাড়ের বাসিন্দারা জানান, শুষ্ক মৌসুমে হাওর শুকিয়ে যায়। এ সময় শীতপ্রধান বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে আসা ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এ হাওরে আশ্রয় নেয়। পাখিরা দিনে দল বেঁধে হাওরের বিভিন্ন বিলে খাবার খুঁজে বেড়ায়। এ সুযোগে দুর্বৃত্তরা জাল দিয়ে ফাঁদ পেতে পাখি নিধন করে। জালের ফাঁদ পেতে অতিথি পাখি নিধনের খবর পড়লেই কবি জয় গোস্বামীর ‘দিকে দিকে পাখি পাতা, জাল নয়’ লাইনটির কথা মনে পড়ে। এ ছাড়া সেদ্ধ করা ধানের সঙ্গে একধরনের বিষ মিশিয়ে ‘বিষটোপ’ তৈরি করে শিকারিরা বিভিন্ন বিলের পাড়ে ছিটিয়ে দেয়। পাখিরা খাবার ভেবে এসব টোপ খেয়ে মারা যায়। শিকার করা এসব পাখি লুকিয়ে আশপাশের বিভিন্ন হাটবাজার ও বাড়ি বাড়ি ফেরি করে চড়া দামে বিক্রি করা হয়।
বাংলাদেশে ১৯৯৪ সালে অতিথি পাখি এসেছিল ৮ লাখের বেশি। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা নেমে এসেছে দুই লাখের নিচে। অর্থাৎ গত ২০ বছরে প্রায় ছয় লাখ পাখি আসা কমে গেছে। তবে এখন এ সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের মতো হতে পারে বলছেন গবেষকরা। অতিথি পাখি যেন নিরাপদে বাংলাদেশে অবস্থান করতে পারে সেজন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে কিছু অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে। এসব পাখি শিকার বা হত্যাকে দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষণা করে আইনও করা হয়েছে। কিন্তু থেমে নেই অতিথি পাখি নিধনের ঘটনা। বরং পাখি শিকারিরা নিত্যনতুন কৌশলে চালিয়ে যাচ্ছে নিধনযজ্ঞ। ‘বাঁশির নকল সুর’ বাজিয়ে পাখিকে ধরার এক নিদারুণ কায়দাও এখানে আছে। এমনকি, পাখির ডাক মোবাইলে বাজিয়েও পাখি ধরার কথা খবরে আসছে। অতিথি পাখিকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাস্তায় হাঁক দেওয়া সেসব পাখি বিক্রেতাকে ইদানীং কম দেখা গেলেও বিভিন্ন এলাকার খাবার দোকান ও হোটেলে নিয়মিতই মেলে রান্না করা পাখির মাংস।
দেশের বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চল দেশি, পরিযায়ীসহ নানা পাখির বিচরণস্থল। দুনিয়ায় বিরল এমন অনেক পাখি কেবল এখানেই দেখা যায়। দেশের এই অঞ্চল দিনে দিনে পাখিদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। পরিবেশকর্মী খোরশেদ আলম বলেন, অবাধে পাখি শিকারের কারণে হাওরে পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আওতায় আনা জরুরি। বিচারহীন পাখি হত্যা জনমনস্তত্ত্বে এখন ‘সহ্য করার মতো স্বাভাবিক’ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন। পাখি হত্যা রোধে প্রশাসনের সত্যিকার অর্থে সক্রিয় ও সজাগ হওয়া জরুরি। পাখি শিকার বন্ধে বন বিভাগের লোকবল সংকট রয়েছে। অবিলম্বে বন বিভাগের লোকবল সংকট নিরসন করে শিকার রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চলে পাখি সুরক্ষায় দৃঢ় নীতি ও সক্রিয় পদক্ষেপ না নিলে এই অঞ্চল অচিরেই হয়তো নিদারুণভাবে পাখিশূন্য হবে। পাখি নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং উপকূলীয় অঞ্চলে জনতৎপরতা বাড়াতে পরিবেশ ও প্রাণী অধিকার কর্মী ও সচেতন নাগরিকদের আরও সোচ্চার হতে হবে। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে পাখিরক্ষা কমিটি গঠন করে জনগণকে সচেতন করার পদক্ষেপ নিতে হবে। আদরের অতিথি পাখি উড়ে এসে বসার ও বিচরণের নিরাপত্তা পাক আর বেলা শেষে ডানা মেলে ফিরে যাক।
বিশ্বমানচিত্রে উদ্বাস্তু যাত্রা শুরু সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে। পশুদের যাত্রা শুরু হতো পানীয় জল আর খাদ্যের অভাবে। মানুষের শুরু শিকারভূমি আর কৃষিভূমির সন্ধানে। রক্তাক্ত লড়াইটা হতো গোত্রে গোত্রে। বাইবেলে প্রাচীন ইহুদিদের মিসর থেকে বিতাড়নের কাহিনী আছে। আছে দলনেতা নবী মুসার কথা এবং মহান ঈশ্বরের দ্রাক্ষা ক্ষেত্র আর যব শস্যভূমি কিংবা বনমধুর প্রাচুর্য দানের প্রতিজ্ঞার আখ্যান। আর এই আধুনিক যুগে উদ্বাস্তুযাত্রা শুরু ধর্মের নামে, রাজনৈতিক মতবাদের নামে নরহত্যা, নারী ধর্ষণের পথ ধরে। এই আধুনিকে আবার মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় প্রাচীন আর মধ্যযুগ। রামায়ণ আর মহাভারতের মহাকাব্যিক যুদ্ধ এবং নরহত্যা যে ধর্মপ্রতিষ্ঠার নামে, ন্যায় স্থাপনের অসিলায়, তার সাথে আজকের অনেক মিল আছে। যুদ্ধ, হামলা, হত্যা, ধর্ষণ আর হিংস্রতার ফলে যে পলাতকদের উদ্বাস্তুযাত্রা শুরু হয় এই আধুনিক যুগে, তা পুরাতন যুগের দুর্ভিক্ষ আর জাতিদাঙ্গার পরিণামের চেয়েও ভয়াবহ।
অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ এশিয়া এবং আফ্রিকায় দীর্ঘস্থায়ী জাতিগত, ধর্মগত, বর্ণগত এবং মতাদর্শগত সংঘাত লাগিয়ে রেখেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে যা ঘটেছে এবং ঘটছে তার পেছনে রয়েছে দেশীয় এবং আন্তঃদেশীয় ষড়যন্ত্র। এই চক্রান্তের শেকড় অতি গভীর রাজনৈতিক মৃত্তিকাগর্ভে প্রোথিত। জনগণের গণতন্ত্রের দাবি, ক্ষুধামুক্তির দাবি, অন্ন-বস্ত্র-গৃহ-স্বাস্থ্য ইত্যাদির দাবির ভেতর দিয়ে বিক্ষোভ, ধূমায়িত হলেই কবির ভাষায় ‘সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা।’ জনগণের প্রতিবাদী দৃষ্টির ভেতর অ্যাসিড ছিটিয়ে অন্ধ বানানোর প্রশাসনিক প্রচেষ্টা চলে। আক্ষেপ এটাই, যে জাতি একাত্তরের অবিনাশী-অবিনশ্বর গৌরবের ইতিহাস স্রষ্টার ভূমিকায় নেমে বিশ্বকে চমকে দেয়, সে জাতিই ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িকতায় প্রেতনৃত্যে মেতে ওঠে। বাংলাদেশে এই কুৎসিত-কদর্য অপরাজনীতির শুরু স্বাধীনতা লাভের পরপরই।
একটি নির্মম প্রশ্ন আজ বেআব্রু হয়ে পড়ে। পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক গৌরবের ইতিহাস কি কেবল স্বাধীনতা যুদ্ধ আর ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? অন্য ইতিহাস নেই? এদেশে কি তেভাগা আন্দোলন হয়নি? হাজী দানেশের ইতিহাস কি মাটিচাপা পড়েছে? কমরেড সিরাজ সিকদারের জনযুদ্ধ কি হাওয়ায় উড়ে গেল? মণি সিংহের হাজং বিদ্রোহ কি শিশুতোষ গল্প? সিলেটে নানকার বিদ্রোহটা কী? পাকিস্তান যুগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে প্রগতিশীল নাগরিকদের সাহসী ভূমিকা কি তুচ্ছ বিষয়? ১৯৬৪ সালে দাঙ্গার সময় যুব ও ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনোরা যে দাঙ্গা প্রতিরোধে নেমে নিজেরা রক্তাক্ত হলেন তা তো অলীক গপ্পো!
তারপরও প্রশ্ন আসে, অনেক কিছুই হয়েছে পূর্ববঙ্গ বা উপমহাদেশে, কিন্তু হয়েছে কি সামাজিক আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন? আসল কাজগুলোই পাশে পড়ে রইল। পাশ কেটে এগিয়ে গেল ক্ষমতা দখলের রাজনীতি। আচমকা মৃত্যুর বিভীষিকা নিয়ে সারা বিশ্বে ঝাঁপিয়ে পড়ল কভিড বা করোনা। শাপেবর হলো স্বৈরাচারী শাসকদের। মিডিয়া বা প্রচার যন্ত্রগুলো জনগণের মনে এমন আতঙ্ক সৃষ্টি করল যে, মানুষ ভুলে গেল গণতন্ত্র কী, স্বৈরাচার কী, দুর্নীতি কী, ন্যায়ের শাসন কী। জনকণ্ঠ রোধের অসংখ্য আইন হলো। যন্ত্রণায় মানুষ কঁকিয়ে উঠলেও তর্জন গর্জন এলো, ‘অ্যাই চুপ, করোনা আসছে।’ শাসকরা চায় মানুষ মরার মতো পড়ে থাকুক। ষোল আনাই সফল হয়েছে শাসক-শ্রেণি জনগণকে প্যারালাইসড করে নিরাপদে শাসন চালিয়ে যেতে।
ধর্মবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ আজকের সময়ে বিশ্বরাজনীতির অঙ্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সংখ্যালঘুর প্রশ্নই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মৌলিক উপাদানের আসন গ্রহণ করেছে। ক্ষমতায় যাওয়া-আসা চলে এই একটি মাত্র পথে। পশ্চিমা-ধর্মী রাষ্ট্রগুলো দরিদ্র, আধা দরিদ্র দেশের জনগণকে এমনি তুকতাক কালা জাদু করেছে যে তারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে ছুটছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, মেলবোর্ন। বাংলাদেশের একজন অভিবাসী কেবল ধর্মেই নয়, বর্ণে, ভাষায়, সংস্কৃতিতেও ওদেশে সংখ্যালঘু। সাদা বর্ণ আমেরিকানরা কী ধরনের আচরণ করে ওরা তা বুঝতেও চায় না। স্বেচ্ছা-অভিবাসী এই ক্রীতদাসদের প্রকৃত অর্থে ঘাড়ের ওপর মস্তক বলে অংশটি নেই। এমন দাসত্ব, এমন আনুগত্য প্রদর্শন মনুষ্যত্বেরই অসম্মান।
জটিল প্রশ্নটি হচ্ছে দাঙ্গা, ধর্ষণ, নরহত্যা এবং যুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে যারা ইউরোপ, আমেরিকায় পালায় বা পালাতে চায়, তাদের সম্পর্কে কোন বিবেচনাটা আসে? প্রাণরক্ষা কি মানুষের আদিম প্রবৃত্তি? অবশ্যই। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয় খোঁজাও অন্যতম প্রবণতা। আক্ষেপ এটাই যে, যে ইউরোপ-আমেরিকা এশিয়া-আফ্রিকাকে উপনিবেশের চারণভূমি হিসেবে পরিণত করে তাদের কাছেই জীবন ভিক্ষা? এ যেন এক উন্মাদ কাণ্ডজ্ঞানহারা মানুষের অন্ধ ছুটে চলা। নৌকা করে গভীর অতলান্তিক মহাসমুদ্র অতিক্রম করে অচেনা আশ্রয়ভূমির সন্ধানে নামা। গভীর সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া কিংবা ডুবে মরাই হয় নিয়তি। জনসংখ্যা ভারে আনত ক্ষুদ্র ভূখণ্ড বাংলাদেশে কেন পাহাড়-সমুদ্র অতিক্রম করে ইয়াঙ্গুনের রোহিঙ্গারা লাখো লাখো সংখ্যায় আশ্রয় নিল? কক্সবাজার উপকূলে পলাতকরা নৌ-ডুবিতে মরল কেন? কেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা ভারতের দিল্লি আর জম্মুতে আশ্রয় শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে? রাষ্ট্রহীন, নাগরিকত্বহীন মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ কী? আমেরিকা তার সৎভাই তালেবানদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে কেটে পড়লে কী হাল হলো আফগানিস্তানের? আফগানরা সীমান্ত অতিক্রম করেছে উজবেকিস্তান আর তাজিকিস্তানে। এমনিতে পাকিস্তান সীমান্তে আশ্রয় শিবিরে দশ লাখের অধিক আফগান শরণার্থী পড়ে আছে এক যুগ ধরে। জন্ম আর মৃত্যুর অট্টহাসি শোনা যায় দুর্গম পাথুরে পাহাড়-পর্বতের গোলক ধাঁধায়। আমরা কি ভুলতে পারি সমাজতন্ত্রের পতনের পর যুগোশ্লাভিয়ার খণ্ডিত অংশ সার্বিয়া-বসনিয়া-হারজেগোভিনায় মুসলিম সংখ্যালঘুর ইতিহাস? সার্বিয়ানরা হাজার হাজার সংখ্যালঘু মুসলমানকে হত্যা করেছে, গর্ভবতী করেছে নারীকে। বিশ্বমানব কি ভুলতে পারে সার্বীয় কিশোরী-গর্ভবতীর পলায়নের দৃশ্যের ছবি?
ইসলাম এবং খিলাফতের স্মৃতিবিজড়িত সিরিয়ার পবিত্র নগরী দামেস্ককে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে মার্কিনি মদদপুষ্ট আইএস বা ইসলামিক স্টেটস জঙ্গি বাহিনী। বন্দি করে অদৃশ্য করে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য নারীকে। দেশ ছেড়ে পালিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। ইরাকের ভাগ্যেও তা-ই ঘটেছে। ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তানে খ্রিস্টান, ইহুদি তো বটেই, শিয়া, ইয়াজেদি হত্যা, নির্যাতন এবং বিতাড়নের শিকার হয়। প্রাণরক্ষার জন্য এসব মানুষ ছুটছে অজানার সন্ধানে। ইউরোপে আশ্রয় নিতে গিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশের অপরাধে বন্দি হয়ে জেলে ঢুকছে কিংবা জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ফেলে যাওয়া দেশে। পুনরায় পড়ছে হিংস্র বিতাড়ক বাহিনীর হাতে। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর সংখ্যালঘু মুসলমানদের তো বিদ্রোহের অপরাধে চীনা রেড আর্মিরা অর্ধেককে মেরেই ফেলেছে। জোর করে তুলে নিয়ে হাজার মাইল দূরের দুর্গম প্রদেশে অভিবাসিত করছে। ভারত কাশ্মীরের জনগণকে তো বলতে গেলে জেলখানার কয়েদি বানিয়ে দিয়েছে। সমস্ত মানবিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয়েছে।
ধর্মীয়, জাতিগত, বর্ণগত হিংসা, বিশ্বমানবের এই হচ্ছে বাস্তব সত্য। কেননা এই বিশ্বমানব সংখ্যালঘু। পূর্ববঙ্গে দেশভাগের সময় সংখ্যালঘুরা ছিল ৪০ শতাংশে, বর্তমান দুই হাজার একুশ সালে প্রজাতি বিলুপ্তির সূত্র ধরে দাঁড়িয়েছে মাত্র আট শতাংশে। মধ্যের সংখ্যাটা অভিবাসী হয়েছে ভারত এবং ইউরোপ-আমেরিকায়। কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়ায়। প্রাচীন এবং মধ্যযুগের বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষের মাটি থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সম্রাট হর্ষবর্ধনের হাতে কত সংখ্যক বৌদ্ধ নিহত হয়েছে এবং বৌদ্ধ ধর্ম মন্দির ধ্বংস হয়েছে তার হিসাব প্রায় অসম্ভব। নগর সভ্যতা থেকে প্রান্তবাসী বলে দলিত অর্থাৎ নিম্নবর্গ হিন্দুরা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাত থেকে রক্ষা পেলেও বর্তমান সময়ে তারা অশেষ নির্যাতনের শিকার। প্রতিদিন দলিত নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে, খুন হচ্ছে। প্রশাসন অন্ধ। বুঝা যায় ধর্মগত সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণগত সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে নিষ্ঠুর কম নয়। দলিত হিন্দুদের পালাবার স্থান নেই। ধর্মান্তরিত হলেও। বাবা সাহেব ভীমরাও আম্বেদকর অর্থাৎ ভি.আর. আম্বেদকরের মতো মানুষও বর্ণবাদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। অথচ আজীবন তাকে নিচুজাতের তকমা নিয়ে পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়। কেন এমনটা হলো? কেননা ভারতে ধর্মবাদ আর বর্ণবাদ সমার্থক।
ভারতবর্ষের ইতিহাসের পাতা অসংখ্য আন্দোলনে আকীর্ণ, কিন্তু বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের প্রমাণ মেলে না। এমনকি আধুনিক যুগে মহাত্মা গান্ধীও তা করেননি। আক্ষেপ এই, বাম-কমিউনিস্ট আর গণতন্ত্রীরাও তা পাশ কাটিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। প্রগতির পক্ষে, সমাজতন্ত্রের পক্ষে, জাতীয়তাবাদের পক্ষে অসংখ্য আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনকে। শিক্ষিত সমাজ তথা বুদ্ধিজীবী মহলেও এর গুরুত্ব অনুধাবন করা হয়নি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে, সভা-সমাবেশ হয়েছে, এটা সত্য। স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছে, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু করেনি সামাজিক আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন। হয়নি মননশীল আর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভারে চাপা পড়ে রইল সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন। তাই স্বাধীনতার পরপরই মাটির তলায় ঘাপটি মেরে থাকা সাম্প্রদায়িকতা কন্দমূলের মতো নতুন অঙ্কুর মাথা তুলে জেগে উঠল। অথচ রাষ্ট্রবিজ্ঞান আমাদের জানায় ভোটের রাজনীতিটা হচ্ছে গণতন্ত্রের বাইরের খোলস, ঠিক পেঁয়াজের মতো, ভেতরের শাঁসটা হচ্ছে সামাজিক সাম্য।
এখন প্রশ্ন হলো সাম্প্রদায়িকতার শিকার জন্মভূমি বিচ্ছিন্ন মানুষ যাবে কোথায়? কোথায়ই বা যায়? এই সাম্প্রদায়িকতা, এই উদ্বাস্তুকরণ, উদ্বাস্তুযাত্রা আর তার পরিণাম নিয়ে ইতিহাস আজও নিশ্চুপ। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সত্যকে চাপা দেওয়া হয়েছে। সেই দেশভাগ। লাখো-কোটি পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুকে নেহরু সরকার মানবিকভাবে দেখেনি। তারা তথাকথিত আর্যরক্তবাহী পশ্চিমবঙ্গে স্থান দিতে চায়নি অনার্যরক্তবাহী পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের। তাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের দায় নেয়নি পশ্চিমবঙ্গ। একদিকে উদ্বাস্তুদের বেশির ভাগই ছিল নিম্নবর্ণ হিন্দু এবং বাঙালি সতো বটেই। বাঙালি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ভাষাগত ক্ষমতার রাজনীতিটা উল্টে যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গে, তাই তাদের ঠেলে দেওয়া হয় আন্দামানে এবং দণ্ডকারণ্যে। টাটা শিল্পগোষ্ঠী বিহারের জামশেদপুর এবং বর্ধমানের আসানশোল শিল্প তালুক গড়ে সস্তা শ্রমের জন্য উদ্বাস্তুদের একটি অংশের জন্য শ্রমিক বস্তি গড়ে (উপনিবেশ) দেয়। পাঞ্জাবের শিখরা জামাই আদর পায়, বাঙালিরা পড়ে মরে রেল স্টেশনে। নেহরু থেকে ইন্দিরা গান্ধী এবং বর্তমান সরকার এমন সব আইন করে যার ফলে পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশের উদ্বাস্তুরা রাষ্ট্রহীন হয়ে যায়। এমন জটিল আইনকে ডিঙিয়ে আজকের উদ্বাস্তুরা কিছুতেই ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবে না। আজকের বিজেপি সরকারের যে জটিল নাগরিক আইন তার জন্মদাতা গান্ধী-নেহরুর কংগ্রেস। বাঙালি প্রতিরোধের বেলায় হিন্দি বলয়ের ‘যাহা বিজেপি তাহা কংগ্রেস’। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে যা-ই ঘটুক বাংলাদেশের সংখ্যালঘুকে তার জন্মমাটি আঁকড়ে থাকতে হবে। বাম রাজনীতির সঙ্গে তাদের যুক্ত হতে হবে। বামপন্থিরাই প্রকৃতপক্ষে তাদের সহমর্মী এবং মিত্র। তারাই দিতে পারে তাদের নিরাপত্তা। অন্ধ-রাজভক্তিতে মিলবে শূন্য। শাসক দলের আনুগত্য মনুষ্যত্বের অসম্মান মাত্র।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সাক্ষাৎ ঘটা কভিডকে ১৯৬৪ সালে প্রথম শনাক্ত করেন ভাইরোলজিস্ট ড. আলমিডা। গণচীনের কিছু স্থানে টানা লকডাউন চলতে থাকা এবং গত ২৪ নভেম্বর তারিখে উরুমচি শহরের একটি বহুতল ভবনে অগ্নিকা-ের ঘটনায় দশজন নিহত হওয়ার পর বিদ্রোহ আকারে এ অগ্নিকা- চীনের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। টানা লকডাউন বিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে জিরো কভিড নীতির স্থাপক সরকারের প্রতি মানুষের অসন্তোষ প্রকাশের একটা অপূর্ব সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আন্দোলনকারীদের দাবি, লকডাউনের কারণে তালাবদ্ধ বিল্ডিং থেকে না বেরুতে পেরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন নিহতরা।
আমরা করোনার প্রায়-সমার্থক হিসেবে যে চিত্রকল্প তৈরি করি, সে চিত্রকল্প লকডাউন, আইসোলেশন, নিরাপদ দূরত্ব ইত্যাদির প্রায়োগিক চর্চায় আমাদের বাধ্য করে। এসবের পেছনে রয়েছে দৈহিক দূরত্বের প্রপঞ্চ। আমাদের মানসিক দূরত্ব প্রকট। এমনকি পিতা-পুত্রের প্রজন্মগত দূরত্বও চোখে পড়ার মতো। আত্মিক দূরত্ব অকাট্য নিয়তির মতো। প্রতিষ্ঠান থেকে বাজার, সর্বত্র দৈহিক নৈকট্যের যা ছিল আমাদের মধ্যে, তাও কভিডের পর নড়বড়ে হয়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়াও কভিডের মতো একটা অব্যক্ত ভাইরাসের মরুভূমিতে আমাদের একাকী করে তোলে। ভাইরাল হওয়া তথ্যের একটা বিশাল অংশই এখানে মিথ্যার সংমিশ্রণে ভাইরাস হয়ে ওঠে। মানুষের প্রকৃতি বড়ই অদ্ভুত। পৃথিবীর পুরো বয়সকে এক বছর ধরা হলে এর শেষ ২৪ মিনিটে মানুষের আবির্ভাব পৃথিবীতে। এরই মধ্যে এ পৃথিবী হয়ে উঠেছে সুখ-দুঃখের ধারাবাহিক প্রকাশিকা।
প্রতিটি দুর্যোগ ও মহামারী সঙ্গে নিয়ে আসে বাটারফ্লাই ইফেক্ট। অর্থাৎ প্রজাপতি ওড়ার সময় একই সঙ্গে দুই ডানা ওপরে বা নিচে নেয় না। একটা ওপরে নিলে অপরটা নিচে থাকে। নদীর ভাঙাগড়ার মতো। ফলে দুর্যোগ ও মহামারীতে প্রজাপতির ওপরের দিকের ডানায় বসে কিছু অসাধু মানুষ, প্রতিষ্ঠান এমনকি রাষ্ট্রও ফুলেফেঁপে ওঠে। এবং তাদের ফেঁপে ওঠার মনস্তত্ত্বই মূলত জন্ম দেয় এমন মহামারীর, যা সন্তানকে বাধ্য করে মায়ের মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে। অথচ অনুমতি দেয় না মাকে শেষবার ছুঁয়ে দেখার।
বাইবেলের এক্সোডাস, নেহেমিয়া, করিন্থিয় ইত্যাদি বইয়ে নবি মুসার সময়কার একটা গল্প প্রচলিত আছে। গল্পটা এমন, মুসা দশ অহি গ্রহণের জন্য চল্লিশ রাত ও দিন সিনাই উপত্যকায় অবস্থান করেন। এদিকে তার এক অবাধ্য অনুসারী সামেরি বনি ইসরাইলের সমস্ত স্বর্ণ একত্র করে তা দিয়ে একটি গোবৎস তৈরি করে। এবং স্বর্ণনির্মিত এ গোবৎসের পূজা করার জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে। বনি ইসরাইলের একটা অংশ গোবৎসের পূজায় লিপ্ত হলে মুসা সিনাই থেকে ফিরে এসে ক্রোধান্বিত হন। গোবৎস তৈরির মাধ্যমে তার অনুসারী দলকে বিভ্রান্ত করার কারণে মুসা সামেরিকে অভিসম্পাত করেন। এ অভিসম্পাতে সামেরির এক বিশেষ জ্বর হয়। এ জ্বরের বৈশিষ্ট্য এমন যে, ইতিপূর্বে এর নমুনা কোথাও ছিল না। সামেরিকে ছোঁয়া মাত্রই এ জ্বর অন্যের শরীরে স্থানান্তরিত হতো এবং আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যেত। ফলে সামেরি সারা দিন-রাত মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলত এবং মানুষ দেখলেই চেঁচিয়ে বলত আমাকে স্পর্শ কোরো না। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখো। কুরআন সামেরির এ বাচনভঙ্গি উদ্ধৃত করেছে ‘লা মিসাস’ তথা স্পর্শ কোরো না শব্দে। সুরা ত্বাহা : আয়াত ৯৭ দ্রষ্টব্য।
কভিডও জ্বর এবং স্পর্শ না করা তথা নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার মানসিক শাস্তি আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে। শরীরের ওপর শাস্তি কায়েম করলে শরীর যেমন অসুস্থ হয়, আমাদের মনও এ শাস্তির ফলে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে।
ব্যক্তি সামেরির গোবৎস তৈরির প্রেক্ষাপটে ‘লা মিসাস’-এর আপদের সঙ্গে মিল রেখে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রসমূহ এমন কিছু কী করেছে, যার ফলস্বরূপ আমরাও জ্বর ও নিরাপদ দূরত্বের মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছিলাম এবং এখনো আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে মুক্ত নই?
সামেরির স্বর্ণনির্মিত গোবৎস ও এর সামনে মাথা নত করে জীবনের কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য বিবেচনা করে পূজা করার মধ্যে আমরা এক ভয়ংকর পুঁজিবাদী মানসিকতার খোঁজ পাই। স্বর্ণের মূল্যবাহক মুদ্রার মনস্তত্ত্বের সঙ্গে সামেরির গোবৎসের প্রাসঙ্গিকতা দেখে আঁতকে উঠি। প্রচলিত প্রতিষ্ঠিত ও আন্দোলনরত মতবাদসমূহে পৃথিবীর সমস্ত অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত করার মানসিক অসুস্থতা আমাদের অন্যের অধিকার নিয়ে ভাবতে দেয় না। দায়িত্বের সর্বজনীন দৃষ্টি, মহানুভবতার হৃৎপি-ের ধুকপুকানি, মানসিক স্থিরতা, প্রণয়ের গভীরতা ও অমরত্ব ইত্যাদি সবকিছু আর আমাদের মধ্যে দেয়াল হয়ে ওঠে সামেরির বাছুর। এ এক অস্ফুট যাতনা।
সামেরির বাছুর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নবী মুসা মূলত বনি ইসরাইল জাতির তাবৎ স্বর্ণ অধিগ্রহণকারী ধর্মব্যবসায়ী সামেরির এমন এক মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা ভেঙেছিলেন, যা ধর্মের চোখে শেরেক ও রাষ্ট্রের চোখে কোষাগার লুট। আমাদের মধ্যেও একাই সব কুক্ষিগত করার যে বাসনা, তা প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট করে। এবং কেউ এটা অস্বীকার করে না যে, এ পৃথিবীর যত দুর্যোগ ও মহামারী আসে, তা প্রত্যক্ষভাবে মানুষের কর্ম অথবা পরোক্ষভাবে মানুষের মনস্তত্ত্ব থেকে সৃষ্ট। হোক সেটা ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়া কিংবা এককালীন প্রভাব।
ব্যক্তিস্বাধীনতার এ সেøাগানমুখর যুগে আমরা প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গী/সঙ্গিনীর সঙ্গে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করছি। সবচেয়ে কাছের মানুষকে ঠকাচ্ছি। আত্মকেন্দ্রিকতার নাম করে দেহকেন্দ্রিক হয়ে উঠছি। কারণ, আত্মকেন্দ্রিক মানুষ আত্মপরিচয় লাভ করবেন এটা স্বাভাবিক। এবং আত্মপরিচয় লাভ করার পর মানুষ অন্যকেও নিজের অনুরূপ বিবেচনা করতে শিখে গিয়ে সত্যিকারার্থে মানবিক হয়ে উঠবেন এটা আরও স্বাভাবিক।
মানুষ জাতির মন যদি বস্তুগত রূপ ধরে পৃথিবীতে বেরিয়ে পড়ত, তাহলে যা ঘটতে পারত, তার তুলনায় করোনা কি আমাদের করুণা ছাড়া আর কিছু করেছে?
লেখক : শিক্ষার্থী
রাজনীতিকে খেলার আইটেম করে অর্থনীতিও এখন জগৎ শেঠদের কব্জামুখী। অথচ কিছুদিন আগেও রাজনীতিতে অনুপ্রবেশের দোষারোপ ছোড়া হতো ব্যবসায়ীদের দিকে। রাজনীতিকরা এখন অর্থনীতিকও। অর্থনীতির সংজ্ঞা-ধারণা-ব্যাখ্যা তারাই দেন। এ দুর্গতিতে অর্থনীতিকরা চলে গেছেন সাইড লাইনে। না পারতে মুখ খোলেন না। চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও তাদের নীরবতা খেয়াল করার মতো। অর্থনৈতিক যত কথা রাজনীতিকরাই বলছেন। দেশের বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা কথা বললে অন্তত জনগণের কিছুটা হলেও অর্থনীতির প্রকৃত তথ্য জানার সুযোগ হতো।
রাজনীতিকরা অর্থনৈতিক বিষয়ে কথা বলতে পারবেন না বা এ বিষয়ক জ্ঞান তাদের নেই; বিষয়টা এমন নয়। কিন্তু, অর্থনৈতিক বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকা রাজনীতিকরাও ডলার, রিজার্ভ, জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্স নিয়ে এমন সব কথা ছেড়ে দিচ্ছেন, যা কেবল মানুষকে বিভ্রান্তই করছে না, গুজবের ডালপালা ছড়ানোর ব্যবস্থাও করে দিচ্ছে। একেক সময় একেকটা বলে তারা চলে যাচ্ছেন আরেক কথায়। আগের কথার মধ্যে থাকছেন না। রাজনীতিকদের কোনো কথা বলে দায় নিতে হয় না। কেউ তাদের কাছে জবাবও চায় না। কোনো কারণে জবাবদিহি অনিবার্য হয়ে গেলে বলে দেন, এভাবে কথাটা বলেননি। অথবা কম বোঝা সাংবাদিকরা গণ্ডগোল পাকিয়েছে, ঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেননি তার কথাটা। এতেও না কুলালে কথা আরেকটা তৈরি থাকে, ‘সিøপ অব টাং হয়ে গেছে’। এগুলো রাজনীতিতে খাটে, তাই বলে অর্থনীতিতেও?
এর অনিবার্য জের কোথায় গিয়ে ঠেকছে? অর্থনীতি-রাজনীতি মাড়িয়ে অর্থনৈতিক বিষয়-আশয় সোজা চলে যাচ্ছে আদালতে। ইসলামী ব্যাংক থেকে এস. আলম গ্রুপসহ চারটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৪ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার ঘটনায় অর্থপাচার হয়েছে কি-না, সে বিষয়ে দুদক, সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউ সংশ্লিষ্টদের অনুসন্ধানের নির্দেশ জারি হয়েছে হাইকোর্ট থেকে। ৪ মাসের মধ্যে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। এছাড়া, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ লোপাটের ঘটনায় কর্র্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে কেন যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতেও রুল জারি হয়েছে। আগামী ৫ এপ্রিলের মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককেও ব্যাখ্যা দিতে বলেছে আদালত। এর আগে, হাইকোর্টকে রায় দিতে হয়েছে চেক ডিজঅনার বিষয়েও।
অর্থ সেক্টর বা এ বিষয়ে বোঝাশোনা রাজনীতিকরা কর্মতৎপর থাকলে বিষয়টি কি আদালতে গড়াত? ব্যাংক-খেকোদের নিয়ে সরকার বা বাইরের রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব কী তা জানাই হলো না সাধারণ মানুষের। রাজনীতির মাঠে ‘খেলা হবে, খেলা হবে’র মতো অরুচিকর সেøাগান চললেও অর্থ লোপাট নিয়ে কোনো দলের প্রতিক্রিয়ার স্পষ্ট প্রকাশ ঘটেনি। বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণের নামে অর্থ-লোপাটের খবরকে সরকার কতটা অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করছে, জানার বাইরেই থেকে গেল মানুষের।
হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের খবরে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষের কাছ থেকে যে ধরনের উদ্বেগ বা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তার ছিটেফোঁটাও নেই। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে বরং অর্থ লোপাট অস্বীকারের চেষ্টা লক্ষণীয়। ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকের ঋণে অনিয়ম নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, ‘ব্যাংকের অবস্থা কোথায় খারাপ লিখিত দিয়ে যান, খতিয়ে দেখা হবে।’
কোথায় গেছে অবস্থাটা? পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট হওয়ার পর সাংবাদিকদের ব্যক্তিগতভাবে লিখিত দেওয়ার কিছু থাকে? মন্ত্রী তথা রাজনীতিকদের অনেকেই এ কাজটি করেন সাধারণ মানুষ বা তার নির্বাচনী এলাকার অভিযোগ নিয়ে যাওয়া মানুষের সঙ্গে। তাদের বলেন, অভিযোগ লিখে যেতে। অথবা তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে বলেন, অভিযোগটি টুকে রাখতে। রাজনীতির এ টোকাটুকি এখন অর্থনীতিতেও সংক্রমিত। এমন টানাটানি অর্থনীতিকে কতটা বিষাক্ত করে তুলছে তা বুঝতে এ বিষয়ক বিশারদ হওয়া দরকার হয় না। কয়েকটি ব্যাংক থেকে টাকা লোপাটের তথ্য দেশের মূলধারার গণমাধ্যমে ফলাও হলেও সরকার তা গায়ে মাখছে না। বিষয়টি আদালতে চলে যাওয়ায় যেন ‘টুকে রাখা’র কাজটা হয়ে গেছে।
পাচার, লোপাটের খবরগুলো ‘দেশের বাইর থেকে ইউটিউবারের প্রপাগান্ডা’ বা ‘সোশ্যাল মিডিয়ার গালগল্প’ নয়। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই মূলধারার পত্রিকা এইসব খবর প্রকাশ করেছে। ফলে এগুলোকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। দেশের অর্থনীতি যখন প্রবল চাপে, প্রধানমন্ত্রী যখন ব্যয় সংকোচনের কথা বলছেন তখন এই ধরনের লুটপাটের খবর মানুষকে ব্যথা দেওয়া ছাড়া আর কিছু দিতে পারে না। সাদা চোখেই লক্ষণীয় ব্যাংক-খেকোদের নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ব্যাপারে সরকারি মহলে প্রতিক্রিয়ায় ভীষণ অনীহা। সরকার বা কোনো মন্ত্রী বিরক্ত হয়েছেন এমন কোনো খবরও নেই। বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা এ ইস্যুতে কোনো কর্মসূচি দিয়েছেন এমন কোনো খবর কি হয়েছে কোথাও? তার মানে রাজনীতিকদের কাছে এটি কোনো ঘটনা নয়? এসবের বিরুদ্ধে তাদের কোনো ‘খেলা’ থাকতে নেই? নয়াপল্টন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে কর্মসূচিও নয়।
বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর স্বীকার করেছেন। কিন্তু কারা ‘বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার করেছেন’ তাদের সম্পর্কে প্রকাশ্যে তিনি কিছু বলেননি। গত জুলাইতে এই ধরনের প্রায় ১০০টি এলসি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানালেও এই এলসিগুলো কারা খুলতে চেয়েছিলেন, তারা কোন রাজনৈতিক দল-সংশ্লিষ্ট এ প্রশ্ন তাদের কেউ করেনওনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বিরুপাক্ষ পাল রাজনৈতিক হুঁশিয়ারির মতো বলেছেন, ব্যাংকগুলোয় সংঘটিত অনিয়ম আর জালিয়াতির পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা আর মন্ত্রণালয়ের পলিসি মেকারদের ভ্রান্তনীতি রয়েছে। যা তিনি আঙুল গুনে একটা একটা করে দেখিয়ে দিতে পারবেন। আসলে পারবেন বা করবেন কাজটি? আছে তার সেই হিম্মত?
অর্থনীতির এ দুরবস্থা নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম মুস্তফা কামাল অনেকটা ‘ডুব’ দিয়ে থাকার পজিশন নিয়েছেন। কোনো কথাই বলছেন না তিনি। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান অর্থনীতি নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন কুস্তি খেলা উদ্বোধন বা পূজাপার্বণের অনুষ্ঠানেও। গত ৩ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জে কুস্তি প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ অর্থনৈতিক সংকট একদম কেটে যাবে। এর আগে, ১৯ আগস্ট সেখানেই আরেক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এটিই (আগস্ট) দুর্দশার শেষ মাস, আগামী মাসে পূর্ণ মাত্রায় উন্নয়ন শুরু হবে।
মন্ত্রী বা রাজনীতিকদের রয়েছে অর্থনীতিসহ যে কোনো বিষয়ে এ ধরনের যা ইচ্ছে কথামালার এন্তার সুযোগ, বলে দিলেই হয়, গণমাধ্যমে গুরুত্বও পায়। অর্থনীতিবিদরা সাইড লাইনে না থেকে কথা বললে অর্থনীতি বিশেষ করে রিজার্ভ, ডলার এমনকি ব্যাংক নিয়ে এত উড়োকথা রটত না। এর আগে, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার দশায় চলে গেছে বলে ধুয়া চলেছে। রিজার্ভ শেষ, বাংলাদেশ দেউলিয়ার পথে, ব্যাংকে টাকা নেই, গ্রাহকরা জমাকৃত টাকা ফেরত পাচ্ছেন না, কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গুঞ্জনে মানুষকে আতঙ্কে ফেলার জবাব দিতে হয়নি কাউকে।
ব্যাংক বা অর্থনীতি নিয়ে মনগড়া কথা বা তথ্য রটানো যেনতেন অপরাধ নয়। বৈশ্বিক মহামারী করোনার ধকল, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বময় স্নায়ুযুদ্ধসহ স্থানিক নানা কারণে সব দেশই কম-বেশি ভারাক্রান্ত। বাংলাদেশের অর্থনীতিও প্রবল চাপে। সেই তাপে উত্তপ্ত ব্যাংক খাতও। তাই বলে দেউলিয়া হয়ে যাবে? মুখের কথার জোরে আগুয়ান রাজনীতিকরা কেউ বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা বানিয়ে ছাড়েন, কেউ সিঙ্গাপুর বানিয়ে ফেলেন। ইচ্ছেমতো অর্থনীতির পোস্টমর্টেম করেন তারা। কারও ময়নাতদন্ত রিপোর্টে অর্থনীতি খুব টনটনে-টসটসে। কারও কাছে অর্থনীতি মরণ দশায়।
বুঝদার অর্থনীতিক বা অর্থনীতি বিষয়ক ব্যক্তিরা নিশ্চয়ই এ ধাঁচের মূল্যায়ন করবেন না। তাদের নীরবতা অনেক ক্ষতি করে দিচ্ছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখা যাবে বাংলাদেশ নেই, ব্যাংক গায়েব হয়ে গেছে ধরনের শিশুতোষ কথা ছড়ানো ব্যক্তিদের ক’জন অর্থনীতিক বা অর্থ খাত সম্পৃক্ত? মূল্যস্ফীতি, বাজারে নিত্যপণ্যের চড়া দাম, ব্যাংকে খরার টান, বা ডলার ঘাটতি অবশ্যই সত্য। কিন্তু, তা কোন পর্যায়ে? এসব তথ্য জানার অধিকার থেকেও বঞ্চিত সাধারণ মানুষ।
লেখক: কলামিস্ট ও বাংলাভিশনের বার্তা সম্পাদক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
রাজধানীর মিরপুরের একটি মাধ্যমিক-সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সিফাত। একই এলাকায় বসবাসকারী তার বন্ধু সিয়াম পড়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে। সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার থেকে রোজার ছুটি। আর সরকারি প্রাথমিকে ছুটি ১৫ রোজা অর্থাৎ ৭ এপ্রিল থেকে।
এক দেশে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন নিয়মে ছুটি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে লেখাপড়ায় কেউ এগিয়ে যাবে, আবার কেউ পিছিয়ে পড়বে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার বা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে ভেবেচিন্তেই নেয়। তবে সব ধরনের স্কুলে একটা কো-অর্ডিনেশন থাকলে ভালো হয়। আমরা ছুটির ব্যাপারে আরও আলাপ-আলোচনা করব।’
জানা গেছে, চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে আগামী শুক্রবার শুরু হতে পারে রমজান মাস। বছরের শুরুতেই স্কুলগুলোর ছুটির তালিকা অনুমোদন করা হয়। সে অনুযায়ী পবিত্র রমজান, স্বাধীনতা দিবস, ইস্টার সানডে, বৈসাবি, নববর্ষ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা ও টিটি (টিচার্স ট্রেনিং) কলেজেও একই সময়ে ছুটির ঘোষণা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছুটির তালিকা ভিন্ন। তারা পবিত্র রমজান, ইস্টার সানডে, চৈত্র-সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আগামী ৭ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ প্রায় ১৫ রমজান পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা থাকবে।
রাজধানীসহ বড় বড় শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকের মতোই তাদের ছুটি থাকবে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রোজার ছুটিও একই। তবে মাদ্রাসায় রোজার ছুটি শুরু এক দিন আগেই অর্থাৎ আজ বুধবার, ২২ মার্চ।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। তাই বুধবার ক্লাস করে বৃহস্পতিবার রোজার ছুটি শুরু হবে। তবে সব স্কুলে একই ধরনের ছুটি থাকা জরুরি। এতে একই সময়ে সিলেবাস শেষ করা যাবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সন্তুষ্ট থাকবে।’
রমজানে মাধ্যমিকে স্কুল বন্ধ আর প্রাথমিকে খোলা রাখায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষকের মধ্যে। তারা বলছেন, যেসব অভিভাবকের সন্তান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্কুলেই পড়ে তাদের সমস্যা হবে। রমজান মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও রোজা রাখেন। তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিল রেখে প্রাথমিকের ছুটি নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগাঠনিক সম্পাদক জুলফিকার আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকারি ছুটি ৭৬ দিন, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৫৪ দিন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিন্ন ছুটি নির্ধারণের যুক্তি তুলে ধরে আমরা ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছি। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো সাড়া পাইনি।’
'স্যার নয় আপা ডাকলেই চলবে' রংপুরের জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীনের এমন বক্তব্যের পর রাত ৯ টার দিকে আন্দোলন সমাপ্ত করে ক্যাম্পাসে ফিরে গেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এর আগে চিত্রলেখা নাজনীনের বিরুদ্ধে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে বুধবার (২২ মার্চ) বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে একাই অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন উমর ফারুক। এর পর তার সাথে একাত্মতা জানিয়ে আন্দোলনে যুক্ত হন বেরোবির বাংলা বিভাগের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা।
তুহিন ওয়াদুদ তার ফেসবুক পোস্টে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান।
জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, বেরোবির একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে উমর ফারুক আমার কাছে এসেছিলেন। এ সময় আমি বাইরে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম। তখন ওই শিক্ষক আমাকে দেখে আপা বলে ডাক দেন। আমি তাকে স্যার না বলে আপা কেন ডাকছেন জানতে চাই। আমার জায়গায় একজন পুরুষ দায়িত্বে থাকলেও কি তিনি স্যার না বলে ভাই ডাকতেন?
জেলা প্রশাসক জানান, রাতে তিনি ওই শিক্ষক ও আন্দোলনকারীদের স্যার ডাকতে হবে না, আপা ডাকলেই চলবে বলে জানান। এরপর তারা আন্দোলন বন্ধ করে দেন এবং ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে চলে যান।