
বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ খান সারওয়ার মুরশিদ ভাষা আন্দোলনসহ বাংলাদেশের সব গণ-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের নেপথ্য রূপকারদের একজন। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য প্রতিভা। ১৯৪৭ সালের পর কিছুদিন ইংরেজি ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘নিউ ভ্যালুজ’ প্রকাশ করে তিনি বিদ্যোৎসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং রাষ্ট্রদূত ছিলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও পরে টিআইবির চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ১৯২৪ সালের ১ জুলাই কুমিল্লা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আলী আহমদ খান অবিভক্ত বাংলা এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জর্জ হাই স্কুল থেকে ১৯৩৯ সালে প্রবেশিকা পাস করেন। এরপর ফেনী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে ১৯৪৮ সালে এমএ ডিগ্রি নেন। খান সারওয়ার মুরশিদ ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিছুদিন পর ব্রিটেনের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যান। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘ইয়েটস, হাক্সলে এবং এলিয়টের ওপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব’। ১৯৫১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সংস্কৃতি সংসদ’ নামে একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ এই দুই বছর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত গণ-আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত গণতদন্ত কমিশনের সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া তিনি মানবাধিকারভিত্তিক সংস্থা ‘নাগরিক উদ্যোগ’-এর চেয়ারম্যান ছিলেন। তার একমাত্র গ্রন্থ ‘কালের কথা’ ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়। ২০১০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। ২০১২ সালের ৮ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
জার্সির কথা বাদই থাক। চলুন লুঙ্গির কথা বলি। ৩৭০ টাকাফিক্সড প্রাইজ ব্রাজিল লুঙ্গি কিংবা আর্জেন্টিনা লুঙ্গি। ফিক্সড প্রাইজ লেখা থাকলেও দর-কষাকষিতে সমস্যা নেই। একই মানের লুঙ্গির (ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা বর্জিত) দাম আড়াইশ টাকা। শুধু ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা নয়, বড় মাপের অন্য ফুটবলার দেশের জার্সি ঢাকার বাজারে আসে, হয়তো লুঙ্গিও এসে যাবে।
বহু বছর আগেই বিশ্ববাজারে ব্রাজিল বক্ষবন্ধনী এবং আর্জেন্টিনা বক্ষবন্ধনী এসেছে। ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, পর্তুগাল ও উরুগুয়ে বক্ষবন্ধনীও ফুটবলের আনুষঙ্গিক ক্রয় তালিকায় ঢুকেছে। আরও কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার প্রশ্নে যারা নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে চান সে ধরনের ফুটবলপ্রিয় নারীর জন্য মিশ্র ডিজাইন বাজারে এসেছেএকটি কাপ ব্রাজিল জার্সির, একটি কাপ আর্জেন্টাইন জার্সির।
বাংলাদেশের মুদি দোকানে চিপস এবং ক্রিসপস-এর প্যাকেটের নতুনত্ব এসেছে, এবারই প্রথম চোখে পড়ল দশ টাকা দামের ব্রাজিল প্যাকেট, দশ টাকা দামের আর্জেন্টিনা প্যাকেট।
ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা যত প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হোক বিশ্বকাপ শুরুর ৯২ বছরে ফাইনালে কখনো ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয়নি। মাত্র চারবার পরস্পরকে বিশ্বকাপে মোকাবিলা করেছে; ১৯৭৪-এ দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিল ২-১ গোলে আর্জেন্টিনাকে হারায়, ১৯৭৮-এ দ্বিতীয় রাউন্ডে ০-০ ড্র হয়, ১৯৮২-তে ৩-১ গোলে ব্রাজিল জিতে, ১৯৯০ সালে শেষ ষোলোর রাউন্ডে আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে ব্রাজিলকে হারায়।
বাংলাদেশের জন্য বিশ্বকাপের একটি বড় সূচক টেলিভিশন বিক্রয় বৃদ্ধি। শুধু ফুটবলের জন্য আর্থিক অসচ্ছলতার মধ্য থেকেও ধার করে বাংলাদেশের গ্রামেও অনেক বাড়িতে টেলিভিশন কেনা হয়েছে। টেলিভিশন শিল্পের বিকাশে ফুটবল শুধু বাংলাদেশে নয় উন্নয়নশীল সব দেশেই বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
ফুটবল সরঞ্জাম
অবশ্যই ফুটবল। ভালোমানের ফুটবলের দাম ১০০ ডলারও হতে পারে। আর কি লাগে, মাঠ গোলপোস্ট তো লাগবেই, বাকি তালিকাটি করে ফেলি : গোলপোস্ট নেট, কর্নার ফ্ল্যাগ, ফুটবল ব্যাগ, ক্যাপ্টেন’স আর্মব্যান্ড, পানির বোতল, গোলকিপার্স গ্লাভস, গোলকিপার্স জার্সি, প্লেয়ার্স জার্সি, প্লেয়ার্স শর্টস, মোজা, অ্যাথলেটি টেপ, মাউথ গার্ড, পিন গার্ড, শিন প্যাড, রেফারির ইউনিফর্ম, রেফারির ফ্ল্যাগ, স্টপওয়াচ, পেনাল্টি কার্ডহলুদ ও লাল, হুইসেল, ট্রেনিং বল, ওয়ার্মআপ ক্লথস, সকার ক্লিটস, ইনডোর শু, টার্ফ শু, বুট, গিয়ার ব্যাগ, জকস্ট্র্যাপএমন অনেক আইটেম যা অ্যাডিডাস, নাইকির মতো প্রতিষ্ঠান বিশ্ববাজারে সরবরাহ করে থাকে। ফুটবল সরঞ্জাম ফিফা বা অ্যাডিডাসের মতো প্রতিষ্ঠান নিজেরা তৈরি করে না, বাণিজ্যিক সুনাম রয়েছে এমন দেশ ও প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে তৈরি করায়। কাতার বিশ^কাপের ফুটবল আল রিহলা তৈরি হয়েছে পাকিস্তানে, ইন্দোনেশিয়ায়; কাতারের স্টেডিয়ামগুলোতে ফুটবল জার্সি গায়ে যেসব উদ্যমী সমর্থকদের দেখা যাচ্ছে তাদের অনেকের জার্সিই বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানায় তৈরি হয়েছে। কেবলমাত্র বিশ^ ফুটবলের বাজার ২০০০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। পাকিস্তানের শিয়ালকোট এবং আশপাশে ফুটবল তৈরির ১০০০ কারখানা রয়েছে।
বিশ্বকাপে ব্যবহৃত ফুটবল
১৯৩০ সালের প্রথম বিশ্বকাপে টিয়েন্টো ও টি-মডেল ফুটবল বেছে নেওয়া হয়েছে। ফাইনালের দিন প্রথমার্ধের বল সরবরাহ করেছে আর্জেন্টিনা। বলটি টিয়েন্টো। দ্বিতীয়ার্ধের বল টি-মডেল জোগান দিয়েছে অপর ফাইনালিস্ট উরুগুয়ে। ৪-২ গোলে উরুগুয়েই বিশ্বকাপ জিতে নেয়। রোম বিশ্বকাপে (১৯৩৪) ফেডারেল টি এবং প্যারিস বিশ্বকাপে (১৯৩৮) এলেন ফুটবল মাঠে নামানো হয়। ব্রাজিল বিশ্বকাপে (১৯৫০) সুপারবল কোম্পানি ডুপ্লো টি এবং সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপে (১৯৫৪) সুইস ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন ব্র্যান্ডের ফুটবল ব্যবহার করা হয়। ১৯৫৮-তে স্টকহোম বিশ^কাপে মাঠে নামে টপ স্টার ফুটবল। ১৯৬২-এর চিলির বিশ^কাপে ক্র্যাক ছিল দাপ্তরিক ফুটবল। কিন্তু রেফারি অ্যাস্টন বলটি গ্রহণে রাজি না হওয়ায় ইউরোপিয়ান বল সরবরাহ করা হয়। ইউরোপিয়ান টিমগুলো চিলিতে প্রস্তুত বলে খেলতে রাজি হয়নি। ১৯৬৬-তে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে স্ল্যাজেঞ্জার কোম্পানির চ্যালেঞ্জ-৪ স্টার ফুটবল ব্যবহার করা হয়। ১৯৭০ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে অ্যাডিডাস প্রথমবারের মতো টেলস্টার ফুটবল সরবরাহ করে। সেই থেকে ২০২২ পর্যন্ত অন্য কোনো কোম্পানি অ্যাডিডাসকে অপসারণ করে জায়গা নিতে পারেনি। এ বছর ৫২ পূর্তি হচ্ছে, সম্ভবত আগামীতে অ্যাডিডাসের রাজত্ব বহাল থাকবে। ১৯৭৪-এ সরবরাহ করে টেলস্টার ভুরলাস্ট বলের ওপর পলিথিন আস্তরণ, ফলে ওয়াটার প্রুফ, সুতা বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও দূর হয়। অ্যাডিডাস ১৯৭৮-এ আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে সরবরাহ করে ট্যাঙ্গো। একই বল ইউরোপিয়ান লিগ এবং অলিম্পিকও গ্রহণ করে। ১৯৮২-এর স্পেন বিশ্বকাপে আসে ট্যাঙ্গো এস্পানা, ১৯৮৬-তে মেক্সিকো বিশ্বকাপে মাঠে নামে সম্পূর্ণ সিনথেটিক অ্যাজটেকা বল। ১৯৯০ সালে রোম বিশ্বকাপে ইলেস্কো ইউনিকো, ১৯৯৪-তে যুক্তরাষ্ট্রে কোয়েস্ত্রা, ১৯৯৮-তে ফ্রান্সে আসে ট্রিকালার, সেবারই বহু রঙের ফুটবল মাঠে ছোটাছুটি করে। ২০০২-এ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ বিশ্বকাপে ফেভারনোভা, ২০০৬ সালে জার্মানিতে টিমগিস্ট বার্লিন ফুটবল প্রতিটি ম্যাচের তারিখ, স্টেডিয়ামের নাম এবং দলের নাম ফুটবলে মুদ্রণ করা হয়।
২০১০-এ দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপে জাবুলানি নামের ৮ প্যানেলের ফুটবল ব্যবহার করা হয়, তবে এই বলের অ্যারোডিনামিক্স নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। ২০১৪ সালের বল ব্রাজুকা এবং শেষ দিনের জন্য ব্রাজুকা ফাইনাল রিও। এই বিশ্বকাপটি ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৮-এর রাশিয়ার বিশ্বকাপে টেলস্টার এইটিন এবং টেলস্টার মেখতা ব্যবহার করা হয়। ২০২২-এ কাতার বিশ্বকাপে ব্যবহৃত আল রিহলা ধারণ করছে ভিডিও অ্যাসিস্টেড রেফারিং-এর জন্য কার্যকর চিপযুক্ত ফুটবল। ফুটবল খেলোয়াড়কে বিশ্বখ্যাতি এনে দেয়, দারিদ্র্য ঘোচায় এমনকি মহাবিত্তবানও করে তোলে। ফুটবল ক্লাব একসময় কেবল সুস্বাস্থ্য রক্ষা এবং বিনোদনের ক্লাবও ছিল। এখন সবকিছু ছাপিয়ে ফুটবল ক্লাব বৃহৎ বাণিজ্যের ক্লাব। ফুটবল ক্লাবের কাজ বাণিজ্য সফল দল তৈরি করা, তার মানে যেভাবেই হোক উইনিং দল গঠন করা হচ্ছে ক্লাবের সাফল্য। তার পরও ইউরোপের বড় দলগুলোর দিকে তাকালে আতঙ্কিত হতে হয়, বেশ কটার ঋণের অঙ্ক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
ইউরোপা লিগসহ শ্রেষ্ঠ কটি লিগে মূলত বাণিজ্যই মুখ্য হয়ে উঠেছে। এই লিগগুলো হচ্ছে : স্প্যানিশ লা লিগা, প্রিমিয়ার লিগ, বুন্দেসলিগা ইতালিয়ান সেরি এ, পর্তুগিজ লিগা, ফ্রেঞ্চ লিগ ওয়ান, ডাচ এরডিভাইস, আর্জেন্টাইন লিগ, ব্রাজিলিয়ান সেরি এ। আর ধনী দলগুলোর মধ্যে রয়েছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, বায়ার্ন মিউনিখ, ম্যানচেস্টার সিটি, আর্সেনাল, প্যারিস-সেইন্ট-জার্মান, চেলসি, লিভারপুল, জুভেন্টাস, টটেনহাম হটস্পার, বরুসিয়া ডর্টমুন্ড, অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ, লিস্টার সিটি ও ইন্টারন্যাশিওনাল। ফুটবল খেলোয়াড়, কোচ থেকে শুরু ম্যানেজার পর্যন্ত সবই নিলামে উঠে চড়া দামে বেচাকেনা চলে। প্রতিটি ক্লাবকেন্দ্রিক হরেক রকম ব্যবসা, চকলেট থেকে শুরু করে পানীয় সবই বিক্রি হয়। যদি বিশ্বকাপের হিসাব ধরা হয়১৯৯০ সালে ইতালি ব্যয় করেছে ৪ বিলিয়ন ডলার, ৩২ বছর পর কাতার ২২০ বিলিয়ন ডলার, সবই বাণিজ্যিক পণ্য ও স্থাপনার পেছনে ব্যয় হচ্ছে। শুধু রেফারির হুইসেলের কথা ভাবি। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ব্যবহৃত কয়েকটি হুইসেল ব্র্যান্ড : হিপাত হুইসেল (২৩ ডলার) একমি টোরনাডো হুইসেল (৬ ডলার), ফক্সফর্টি রেফারি হুইসেল (৯ ডলার), ফক্স ফর্টি ক্ল্যাসিক হুইসেল (৭ ডলার), গিলবার্ট হুইসেল (১০ ডলার), স্কুইজ হুইসেল (১০ ডলার), নিউপ্যাল কোচ হুইসেল (১৩ ডলার), একমি থান্ডার ৫৮ (১৫.১০ ডলার)। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশ এই হুইসেলও টার্গেট করতে পারেনি।
পৃথিবীতে ফুটবলপ্রেমিকের সংখ্যা ৪ বিলিয়ন। এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কোনো না কোনো দলের কোনো না কোনো খেলোয়াড়ের ফ্যান। প্রশ্ন হচ্ছেএই ফ্যানরা কি সমর্থক, না ভোক্তা? বাণিজ্যের সাফল্যনির্ভর করে ভোক্তার সাড়ার ওপর। ফ্যান যদি একটি দলের সাপোর্টার হয়ে থাকেন তার পছন্দ ভীষণ সীমিত। সমর্থন করা দলের জন্য সমর্থনকারী ভালোবাসার শেকলে বাঁধা এখান থেকে বেরিয়ে আসা তার জন্য কঠিন এবং যন্ত্রণারও। কিন্তু কনজিউমার বা ভোক্তার পছন্দ অবারিত। তিনি দর-কষাকষি করতে পারেন, পছন্দ না হলে এক বিক্রেতার কাছ থেকে অন্য বিক্রেতার কাছে যেতে পারেন। কিন্তু সমর্থক হয়ে গেলে ফুটবল ও ক্লাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পণ্য ক্রয়ে ঠকতেই হয় বেশি। ব্যবসায়ী সে ক্ষেত্রে সমর্থকের আবেগকে এক্সপ্লয়েট করার সুযোগ নেন। সাধারণ ব্যবসায় ভোক্তাকে নির্ধারিত মানের সন্তুষ্টি প্রদান করতে না পারলে বিক্রেতার বাজারে টিকে থাকা কঠিন, কিন্তু সমর্থক হলে তিনি আর বিক্রেতার অস্তিত্বের জন্য হুমকি নন, বরং শোষিত হওয়ার জন্য অবচেতনে প্রস্তুত।
ফুটবলার কি ব্যবসায়ী হতে পারেন; উত্তর না এবং হ্যাঁ, উভয়ই। ‘না’-এর ভাগই বেশি। পেলে লিখেছেন আমি ভালো ব্যবসায়ী নই, আমি হৃদয়ের কথা শুনি। জর্জ ব্রেস্ট টাকার সবচেয়ে দুর্বল ব্যবস্থাপকদের একজন। তিনি বলেছেন, আমার টাকার ৯০ ভাগ নারী, গাড়ি ও অ্যালকোহলের জন্য ব্যয় করেছি, ১০ ভাগ মাত্র অপচয়। আবার ব্যবসাসফল ফুটবলারদের মধ্যে রয়েছেন : জেরার্ড পিকে, ডেভিড বেকহাম, ম্যাথু ফ্ল্যামিনি, অলিভার কান প্রমুখ। ফরাসি ফুটবলার ও ফুটবল ব্যবস্থাপক মিশেল প্ল্যাতিনির কথা স্মরণ করতে হয় :
It’s a game before a product
a sport before a market
a show before a business
ফুটবল পণ্যের আগে একটি খেলা, বাজারের আগে একটি ক্রীড়া, ব্যবসায়ের আগে একটি প্রদর্শনী।
ব্যবসায়ের নব্য ব্র্যান্ড
ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরেও মেসি-শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে। নিজের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত চার কিলোমিটার দীর্ঘ একটি দক্ষিণ কোরীয় পতাকা বানিয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ায় অনেক বছরের কর্মজীবন কাটিয়ে দেশে ফেরা এক যুবক। তিনি মনেপ্রাণে কামনা করেন যে দেশ তার অন্নের সংস্থান করে একটি বিয়ে করার সামর্থ্য সৃষ্টি করেছে, সেই দক্ষিণ কোরিয়া জিতুক। পতাকার ব্যবসাটি রমরমা। এর মধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে ক্রিকেটে বাংলাদেশ জিতলেও যে উচ্চস্বর আনন্দ ধনী ওঠার কথা তা হয়নিউল্লেখযোগ্য একটি অংশের নজর কেবল ফুটবলেরই ওপর। বাংলাদেশের পতাকা বিক্রি বাড়তে পারত, আশানুরূপ বাড়েনি। ফিফা ব্যাজ লাগানো কয়েক লাখ জ্যাকেট সরবরাহ করেছে বাংলাদেশের একটি পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান। পণ্য বিক্রি বাড়াতে এ সময় জিলেট রেজর নিয়ে ক্যামেরায় দাঁড়িয়েছেন ফুটবলার মেসি।
পতাকা আর জার্সি বিক্রিতে এগিয়ে কোন দেশ? ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা? টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ভারতে আগ্রহের শীর্ষে আছে আর্জেন্টিনা, তারপরই ব্রাজিল। বিভিন্ন দেশের প্রতীক ও রংশোভিত আন্ডারওয়্যারও বিক্রি হচ্ছে। পণ্য বিপণনে বিজ্ঞাপনের ভূমিকা অসীম। বিশ্বকাপ পণ্য হিসেবে বিগত কয়েক দশকে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে সেরা কটির মধ্যে রয়েছে : ম্যাকডোনাল্ডসের খাবার, ইংল্যান্ডের মার্স চকলেট, পেপসি কার্লসবার্গ বিয়ার, নাইকো জুতো, অ্যাডিডাস জুতো ও ফুটবল।
লেখক: সরকারের সাবেক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট
এক। সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশ ‘সামষ্টিক সহিংসতা’ নামক যে ভয়াবহ ব্যাধিতে আক্রান্ত, তার শিকার শিশুরা। ছেয়ে যাচ্ছে সব আজ শিশুহত্যার রোমহর্ষক খবরে। মানুষের বিবেককে কাঁপিয়ে দেওয়া একেকটি হত্যাকাণ্ডের পর মানুষ সজাগ হয়ে উঠলেও ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশে শিশুহত্যার চালচিত্র ভীষণ আতঙ্কজনক। অবৈধ সম্পর্ক দেখে ফেলায় মায়ের হাতে শিশু খুন, সম্পত্তির বিরোধে শত্রুকে ফাঁসাতে নিজের সন্তান হত্যা, সাবেক স্ত্রী বা স্বামীর সঙ্গে বিরোধের জেরে সন্তান হত্যা ইত্যাকার নানা রকম অস্বাভাবিক শিশুহত্যার খবরও আমাদের পাঠ করতে হয়েছে। অন্যান্য অসংখ্য কারণে হত্যা তো আছেই।
দুই। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৪৩৯টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১০৪ জনের বয়স ৬ বছরের নিচে, ৭৯ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। ৯৭৫ জন শিশুর ওপর নানা ধরনের সহিংসতা হয়েছে। এগুলো শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের হিসাব। বাস্তবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। শিশু অধিকার সনদে সই করার পর কেটে গেছে ৩৩ বছর। আমরা যখন ঝলমলে আয়োজনে শিশু অধিকার সপ্তাহ বা নারীর প্রতি সহিংতা প্রতিরোধ পক্ষ বা অন্য কোনো দিবস পালন করছি, তখনই হয়তো কোনো শিশুকে কেটে টুকরো করা হচ্ছে বা কোনো ছোট্ট শিশুকে ধর্ষণ করা হচ্ছে এই দেশে।
তিন। এক মাস আগে চট্টগ্রাম শহরের জামালখান এলাকার একটি ঘটনা ছিল মুষড়ে পড়ার মতো। তখন ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে বইছিল দমকা হাওয়া। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে মাইকিং করতে নেমেছিলেন এক তরুণী সালেহা আক্তার রুবি। কাতর কণ্ঠে তার আর্তি ভেসে আসছিল মাইক দিয়ে ‘আমার বোন মারজানা হক বর্ষা হারিয়ে গেছে। কেউ তার খোঁজ পেলে আমাদের একটু দয়া করে জানান।’ এক বিকেলে বর্ষা মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছিল দোকানে যাওয়ার জন্য। পরে বাসায় না আসায় খোঁজ নিয়ে জানা যায় দোকানে যায়নি সে। সব জায়গায় খুঁজেও পাওয়া যায়নি বর্ষাকে। কয়েক দিনেও বর্ষাকে খুঁজে না পেয়ে পুলিশের অসহযোগিতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। চিৎকার করে বলতে থাকেন : চারদিকে এতগুলো সিসিটিভি বসিয়ে কী লাভ? অবশেষে কয়েক দিন পর নালায় বস্তাবন্দি অবস্থায় পাওয়া গেল বর্ষার লাশ। বস্তায় টিসিবির সিল দেখে আশপাশের বিভিন্ন দোকান ও হোটেল-রেস্টুরেন্টের গোডাউন অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে আসল ঘটনা। ঘাতক এক দোকান কর্মচারী লক্ষ্মণ দাশ, বর্ষাদের প্রতিবেশী। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া রুবির বক্তব্য ছিল এমন ‘আমার বোন নিখোঁজের পর যদি পুলিশ তৎপর হতো, তাকে হত্যা করা যেত না। তাকে বাঁচানো যেত।’
চার। সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সবার মনোযোগ এখন ফুটবলকে ঘিরে। সেখানে কত তর্ক-বিতর্ক, কত আবেগের বহিঃপ্রকাশ। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহ ধরে একটি ছবি বারবার হাজির হচ্ছিল। একটি নিখোঁজ সংবাদের পোস্টার। অনেকে ফেইসবুকে শেয়ার দিয়েছেন। বাবা-পরিবার হন্য হয়ে খুঁজছে পাঁচ বছর বয়সী শিশু আয়াতকে। চট্টগ্রাম শহরের ইপিজেড থানার বন্দরটিলা এলাকার ঘটনা এটি। দশদিন পর পাওয়া গেল আয়াতের খোঁজ। তার লাশ কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে ঘাতক। আবির আলী নামে সেই ঘাতককে গ্রেপ্তারও করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপরই বেরিয়ে আসে নিখোঁজ আয়াতের এ করুণ পরিণতি।
পাঁচ। আজ হয়তো বিশ্বকাপ ফুটবল, কাল অন্য কিছু নিয়ে মেতে থাকি আমরা। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যস্ত রাখা হয় বিরোধী দল ঠেকাতে। ফলে যা ঘটার সেটিই ঘটে যায়, যা হওয়ার সেটিই হয়ে যায়! আমাদের শিশুদের জন্য একটি সাজানো বাগানের আকাক্সক্ষা থেকে যায় স্বপ্নে, বাস্তবে তা রূপ পায় না। বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে তোলা তো দূরের কথা, পৃথিবীতে এসেই আমাদের শিশুরা খুন হচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। গণমাধ্যমে নিষ্ঠুরতা দেখতে দেখতে তাতে অভ্যস্ত হয়ে যাই আমাদের মনে কোনো রেখাপাত করে না। সামাজিক মান-মর্যাদার ভেদাভেদের মতো কোনো কোনো ঘটনার দিকে আমরা ফিরেও তাকাই না, আবার কোনো ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশে দেরি করি না। রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির নানা ধূম্রজালে পথ হারাতে হারাতে আমরা এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছি যে, আমাদের শিশুদের এমন পরিণতিই মেনে নিচ্ছি। এমনকি শিশুরা নিখোঁজের পর তাদের লাশ পেয়ে আমাদের ‘সন্তুষ্ট’ থাকতে হচ্ছে।
ছয়। কেউ কেউ ঘটনাগুলোতে ‘বাজার অর্থনীতি’ দর্শনকে দায়ী করে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি ‘সামাজিক অবক্ষয়’ হিসেবেই দেখা উচিত। গত সেপ্টেম্বর মাসে ‘ক্রাইম পেট্রোল’ দেখে নোয়াখালীর স্কুলছাত্রী তাসনিয়া হোসেন অদিতাকে হত্যার পরিকল্পনা ও হত্যা করা হয়। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে এসব কথা জানিয়েছেন সাবেক কোচিং শিক্ষক আবদুর রহিম রনি। (সূত্র : ঢাকা মেইল) ভারতীয় টিভি সিরিজ ‘ক্রাইম পেট্রোল’ দেখে দেশে গত দুই বছরে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রামে ১৯ বছর বয়সী তরুণ আবির আলী ‘ক্রাইম পেট্রোল’ আর ‘সিআইডি’ দেখে যে লোমহর্ষক অপরাধের কৌশল শিখেছে, সেটারই প্রয়োগ করেছে ওই ছোট্ট শিশু আয়াতের ওপর। এসব টিভি সিরিয়ালের মূলে রয়েছে বাজার অর্থনীতি। একই সঙ্গে সমাজের বৈষম্য-সহিষ্ণুতা প্রায় সর্বত্র উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। আমাদের আকাক্সক্ষাগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে। ‘রুলিং অর্থনৈতিক মডেল’ এ ধরনের প্রবণতাকে ভর করে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে। সমাজের মধ্যে প্রচলিত উদাহরণগুলো ভেঙে পড়েছে। নিয়ম ভেঙে, নিয়মকে পাশ কাটিয়ে ও তোয়াক্কা না করে সমৃদ্ধি অর্জনের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। প্রকৃত ও পারিবারিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব হারিয়েছে। বিপরীতে চলছে সনদধারী শিক্ষাব্যবস্থা। যোগ হয়েছে ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের সমাজের মূল্যবোধগুলো ক্ষয়িষ্ণু হয়ে গেছে। আমরা ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’র কথা বলে থাকি কিন্তু বিচারিক আদালতে দ্রুত বিচারে রাকিব, রাজন হত্যার রায় হওয়ার পর একই এলাকায় আমরা শিশুহত্যা হতেও দেখেছি। অনেকেরই ধারণা, এ ধরনের অপরাধে কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। আসলে সামাজিক দিকগুলোয় নজর দেওয়ার সময় পার হয়ে গেছে কি না, তাও ভেবে দেখা দরকার।
সাত। দেশ যতই আধুনিক হোক বা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করুক বা উন্নত বিশ্বের কাতারে নাম লেখানোর স্বপ্ন দেখুক, তাতে ভুক্তভোগী শিশুদের বাবা-মা ও পরিবার এবং এমন আরও অসংখ্য পরিবারের কিছুই আসবে-যাবে না। সভ্যতার কাছে এর থেকে বড় লজ্জা আর কী হতে পারে যেকোনো মূল্যে শিশুদের নির্যাতন ও হত্যা রুখতে হবে। এ ধরনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখানোর পাশাপাশি আরও কঠোর হতে হবে। আমরা শিশু নির্যাতন, খুন, নারী ধর্ষণের আর একটি ঘটনাও দেখতে চাই না। অপরাধীদের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ এগিয়ে আসুক; পাড়া-মহল্লা, গ্রাম-গঞ্জে শিশু ও নারীদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন রোধে তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলুক এটাই প্রত্যাশা। প্রতিটি ঘটনার দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। অন্যথায় নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ঢাকা মহানগর
“বইটা কি তর নিজের? নিজের হইলে বাবা দাগা!”
আমাদের এক সহপ্রশিক্ষণার্থীর দিকে চোখ পড়তেই লেকচার থামিয়ে বলে উঠলেন ডক্টর রহমান। সে ১৯৯৮ সালের অক্টোবরের শেষ দিকের কথা। আমি তখন সিনিয়র সহকারী জজ। সাবজজ হওয়ার কথা (কথাটা এ অধমের নয়, আইনের) জজিয়তির সাত বছর পূর্ণ হলে। সাড়ে দশ পেরিয়ে তখন আমাদের পৌনে এগারো বছর কেটে যায়, সাবজজে পদোন্নতির খবরই নেই! সাবজজ পদ খালি হওয়ার প্রার্থনা করে চলেছি! (পদ খালি না হলে, একটা-দুটো নয়, গুচ্ছের পদ খালি না হলে পদোন্নতির প্যানেল ধরার স্বভাবই নেই আইন মন্ত্রণালয়ের! প্যানেল ধরেছিল আরও বছর দুয়েক পরে!) এমন সময় ডাক এলো প্রশিক্ষণে।
‘বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাত্র আগের বছর ১৯৯৭-তে, যদিও তার আইনটা হয়েছে আরও বছর দুই আগে ১৯৯৫-তে। (বিলম্ব পিছু ছাড়ে না বিচারের কোনো কিছুতে!) প্রতিষ্ঠার বছর খানেক পর এই ১৯৯৮-তেই প্রথম শুরু বিচারকদের প্রশিক্ষণ। ২১ দিনের একেকটা কোর্স। সিনিয়র সহকারী জজ আমাদেরটা ছিল নবম কোর্স। ডাক পেয়ে সাতক্ষীরা থেকে (আমার পোস্টিং তখন সেখানে) ছুটে আসি ঢাকায়। দুদিনের মাইগ্রেন ব্যথা মাথায় নিয়েও যেমন সৌজন্যের উত্তরে দাঁত চেপে বলি ‘ভালো আছি’, এই ‘ছুটে আসি’ হলো তেমনি সকালের বাস ধরে ধুলো-গরমে কুঁথে কুঁথে (সে-লাইনে তখনো এসি বাস চালু হয়নি, হলেও লাভ হতো না স্বল্প-বেতনভোগী এ বিচারীর) সারা দিন জার্নির বিস্তর প্যাচাল চেপে!
ইনস্টিটিউটের ডরমিটরিটা তখন ছিল কাদাপ্যাঁক ওঠা, রিকশার জ্যামে ঠাসা শাজাহানপুর আমতলা মসজিদ গলির পুরাতন এক তিনতলা বাড়িতে। (আহা! কত কষ্টই না করতে হয়েছে কর্র্তৃপক্ষের, এমন একটা গলির ভেতর জুতসই এ বাড়িখানা খুঁজে পেতে! প্রথম দিন সন্ধ্যায় ধুলো-ঘামে মাখা শরীর নিয়ে পৌঁছেই দেখি পানি নেই বাথরুমে!) প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আমাদের একটু কষ্ট করে হেঁটে যেতে-আসতে হতো শুধু হরতালের দিনগুলোতে! জি, হ্যাঁ! ১৯৯৬-তে দু-দুবার (১৫ ফেব্রুয়ারি হরতালের দিনে আর ১২ জুনে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে) দু-দুটো (ষষ্ঠ ও সপ্তম) সংসদ নির্বাচনের (দুটোই হয়েছিল কিন্তু রাতের আঁধার কেটে গেলে দিনের ফকফকা আলোতে) বছর না ঘুরতেই ঘুরে আসে হরতাল! সরকার হটাতে! একদা (১৯১৯ সালে) পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ খেদাতে মহাত্মা গান্ধী (মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী) অহিংস আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি বলে চালু করেন যে হরতাল (তার গুজরাটি ভাষায় যা ছিল হাড়তাল, ক্রমেই তা সহিংস ও অশান্তিপূর্ণ হয়ে উঠে চরম অশান্তিতে ভোগায় স্বয়ং মহাত্মাকেই!) সেই হয়েছে আমাদের স্বাধীন দেশের রাজনীতির চিরকেলে তাল! (শাসন ক্ষমতা পেলেই ঘাড়ে চাপে ব্রিটিশ-ভূত, ক্ষমতা হারালেই ধরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনী-ভূতে! আছি যেন ব্রিটিশেরই কালে! হাড়ে বাতাস লাগাবে কি আর পাবলিকে, পাবলিকেরই হাড় দিয়ে ডুগডুগি বাজায় পাবলিকেরই চামে! ‘জয় বাপুজি তুমহারা হাড়তাল!’) হরতালবিহীন দিনগুলোতে অবশ্য প্রশিক্ষণার্থীদের আনা নেওয়ার ‘ঠাসা ব্যবস্থা’ ছিল ইনস্টিটিউটের ভাড়ায় বাঁধা মাইক্রেবাসে।
প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ইনস্টিটিউট অফিস ছিল পুরাতন (পুরাতনই কপাল বিচারের!) হাইকোর্ট ভবনে (এখন যেটা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) আইন কমিশনের সঙ্গে এজমালিতে। (আরেক শরিকান জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের জন্ম হয়নি তখনো, হয়েছে ২০০৭ সালে।) আমাদের প্রশিক্ষণ-ক্লাস হতো দোতলায়। প্রশিক্ষণ দিতে ‘রিসোর্স পার্সনস’ আসতেন বিচারপতিরাই বেশিরভাগ, কর্মরত ও কর্মকাল সমাপ্ত (অবসরপ্রাপ্ত বা সাবেক যেহেতু বলতে নেই তাঁহাদের!) মিলিয়ে। আর আসতেন সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি রেজিস্ট্রার থেকে রেজিস্ট্রার পর্যন্ত মহোদয়রা, (রেজিস্ট্রার জেনারেল পদটা হয়নি তখনো, হয়েছে ১৫ জুন ২০১৫ থেকে) আইন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত মহোদয়রা (সিনিয়র সচিব পদটা হয়েছে ২০১২-তে, তবে বিচার বিভাগে আসেনি এখনো, সিনিয়র সহকারী সচিব আছেন যথেষ্ট!) এবং সবার ওপরে খোদ মন্ত্রী মহোদয় নিজে। ঘরের লোকের বাইরে আসতেন দু-একজন এক্সপার্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-একজন আইন-শিক্ষক, সুপ্রিম কোর্টের নামকরা দু-একজন অ্যাডভোকেটও। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট, ডক্টর রহমান ছিলেন তাদেরই একজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে পার্টটাইম শিক্ষকতাও করেছেন একসময়ে। (করতেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ই বাইরে থেকে এরকম প্র্যাকটিশনারদের ধরে এনে করাত। সে-চল নাকি প্রায় উঠে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আপন যোগীদের ভিড়ে!) পড়াতেন এভিডেন্স অ্যাক্ট (সাক্ষ্য আইন)। এভিডেন্স অ্যাক্টের গুরুদের গুরু বলে খ্যাত তিনি ঢাকার আইন জগতে। সেই এখতিয়ারে তিনি নির্বিচারে ‘তুই’ সম্বোধন করেন তার চেয়ে কম বয়সী সবাইকে।
চিনতাম না তাকে, (ঢাকার মানুষ নই, পড়াশোনা চাকরি কোনোটাই করিনি ঢাকাতে।) জেনেছি সব ওই সেদিনের পরে। আমাদের প্রশিক্ষণেও ডক্টর রহমানের বিষয় ছিল যথারীতি এভিডেন্স অ্যাক্ট। বসেও নয় দাঁড়িয়েও নয়, ক্লাস নিচ্ছিলেন তিনি আমাদের বেঞ্চিগুলোর সামনে দিয়ে হালকা দুটো-একটা থাবড়া মেরে মেরে (কারও গায়ে নয়, বেঞ্চিগুলোর তক্তাতে) হেঁটে হেঁটে। তার এই হাঁটাহাঁটির সুবিধে করতেই বোধ হয় বেঞ্চিগুলো সাজানো হয়েছিল অর্ধবৃত্তাকারে! ঠাণ্ডা-শীতল কণ্ঠে নিরাসক্ত স্বরে ইংরেজি ধারাগুলো মুখস্থ আওড়াতে আওড়াতে নিজ এলাকার আঞ্চলিক টানের বাংলা চালিয়ে তিনি ঢুকে চলেছেন এভিডেন্স অ্যাক্টের গভীর প্যাঁচে! হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পৌঁছেছেন অর্ধবৃত্তের এক পাশের শেষ প্রান্তে। লেকচার মুখে ফিরতি হাঁটা ধরতে পেছন ঘুরেই চোখ পড়ল তার অর্ধবৃত্তের অপর পাশের এক বেঞ্চিতে। এক প্রশিক্ষণার্থী বুঁদ হয়ে বইয়ের পাতা খুলে ধারার তলে তলে সমানে দাগ টেনে চলেছেন লেকচারের তালে তালে! নিজের বই নিয়ে কেউ আসে না প্রশিক্ষণে, দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় জানা আছে তার ভালো করে। নির্ঘাত তুলেছে ব্যাটা ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরি থেকে! না হলে কি আর মায়া-দয়া ভুলে মনের সুখে এমন করে দাগাতে পারে! থাকতে পারলেন না আর তাই দেখে। লেকচারের সঙ্গেই মিকচার করে সেই ঠাণ্ডা-শীতল কণ্ঠে নিরাসক্ত স্বরে আঞ্চলিক টানে বলে উঠলেন : ‘বইটা কি তর নিজের? নিজের হইলে বাবা দাগা!’ সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ দাগ টানা। মিলে গেল ‘কংক্লুসিভ প্রুফ’ (চূড়ান্ত প্রমাণ), বইটা কার! প্রমাণের আর দরকার নেই, ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরি থেকেই তোলা।
ফ্যাক্ট (ঘটনা), রেলিভ্যান্ট ফ্যাক্ট (প্রাসঙ্গিক ঘটনা), ফ্যাক্ট ইন ইস্যু (বিবেচ্য ঘটনা)! ওরে বাবা! এক ফ্যাক্টের কত ফেরকা! ‘মে প্রিজ্যুম’ (অনুমান করতে পারেন), ‘শ্যাল প্রিজ্যুম (অনুমান করতেই হবে)! এক প্রিজ্যুমের এত কিসিম! ‘প্রুভড’ (প্রমাণিত), ‘ডিসপ্রুভড’ (মিথ্যা প্রমাণিত), ‘নট প্রুভড’ (অপ্রমাণিত)! এক প্রুভের কত রূপ! কী দিয়ে যে কী প্রমাণ হয় আর প্রমাণের দায় কার ঘাড়ে যে কখন বর্তায় বোঝা দেখি মুশকিল! সাক্ষ্য আইন বড়ই জটিল! মাথায় ঢোকেনি কিচ্ছু। ঢুকে আছে শুধু ওই দৃশ্য : ইনস্টিটিউটের বইয়ের পাতায় মনের সুখে দাগ টানা, আর ঠাণ্ডা-শীতল কণ্ঠের নিরাসক্ত স্বরে আঞ্চলিক টানের সেই আওয়াজ : ‘বইটা কি তর নিজের? নিজের হইলে বাবা দাগা!’
ভেসে ওঠে এখনো তা রিমেক ভার্সনে মাঝে মাঝে। সরকারি ‘আহা আহা’ সব প্রকল্প-কেনাকাটার বহর-বাহার দেখলে মনে ভাসে যেন, সরকারি টাকার বস্তা খুলে আহা কী আনন্দে ঢেলে চলেছে দরিয়ায়! (চড়া কাটতে আর বন্যার ভাঙন ঠেকাতে বস্তা বস্তা বালি তোলা-ফেলার নৌ-পরিবহন আর পানি উন্নয়ন কর্মটা তো দেখতেই তাই! টাকা ছাড়া বস্তা কি মাগনাই! সেখান থেকেই ‘কোম্পানি কা মাল দরিয়া মে ডাল’ কথাটা উঠেছিল কিনা কাজ নেই আর খোঁচাখুঁচি করে, ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলই উঠে গেছে সেই ১৮৫৮ সালে। কথাটাই আমলের!) আর, কানে বাজে যেন সেই ঠাণ্ডা-শীতল কণ্ঠে নিরাসক্ত স্বরের আঞ্চলিক টানে, ‘টাকাগুলান কি তর নিজের! নিজের হইলে বাবা চালা!’ কিন্তু, বন্ধ হয় না ঢালা। আসলে তো বলেই না কেউ সেভাবে। তবে, বলতেন নাকি দুদকের এক সাবেক চেয়ারম্যান তার নিজস্ব স্টাইলে। তার নিজের মুখ থেকেই শোনা। (পরবর্তী কিস্তিতে সমাপ্য)
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক
বিপুল গতিতে দেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে পড়ার দাবি করা হয়, ঠিক তখনই এসব উন্নয়ন পরিকল্পনা, প্রকল্প এবং এসবের জন্য ব্যয় করা অর্থের নিদারুণ অপচয়ের খবরও সামনে আসে। হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে সামান্য একটি সংযোগ সড়ক বা ছোট কোনো নদী-নালা-খালের ওপর সেতুর অভাবে একটি জনপদ বিচ্ছিন্ন থেকে যাচ্ছে। ফলে উন্নয়নের সুফলবঞ্চিত জনপদের মানুষ দিনের পর দিন ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। অবকাঠামোগত এই সংকটে কেবল যোগাযোগই নয় তারা অর্থনৈতিকভাবেও পিছিয়ে পড়ছেন। চিকিৎসা ও শিক্ষার মতো অধিকার থেকেও বঞ্চিত থাকছেন। আবার দেখা গেছে কয়েকশ কোটি টাকার প্রকল্প শেষ হলেও অবকাঠামোটি আসবাবপত্রসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না, ফলে তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু কাদের উদাসীনতা ও গাফিলতিতে জনগণের ভোগান্তি ও অর্থের এমন অপচয় ঘটে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা জানা যায় না। এক যাত্রায় দুই ফলের মতো একদিকে অবকাঠামোর অভাবে বিচ্ছিন্ন ও উন্নয়ন সুবিধাবঞ্চিত হয়ে পড়া, অন্যদিকে উন্নয়নের নামে বিপুল ব্যয়ে নির্মিত অবকাঠামোর অব্যবহৃত থাকা।
বুধবার দেশ রূপান্তরে ‘ভেসে ভেসে স্কুলযাত্রা’ ও ‘অকাজের ২৫০ কোটির ভবন’ শীর্ষক প্রতিবেদন দুটির কথাই ধরা যাক। প্রথম ঘটনাটি পটুয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের দিয়ারচর ও উত্তর চরমোন্তাজ গ্রামের। দুই গ্রামের মধ্যে প্রায় আড়াইশ ফুট প্রশস্ত এক খাল। দিয়ারচরের শিক্ষার্থীদের ওই খাল পার হয়েই প্রতিদিন যেতে হয় উত্তর চরমোন্তাজের মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। খাল পার হওয়ার জন্য কোনো সেতু নেই। নেই খেয়া পারাপারের ব্যবস্থাও। অগত্যা শীত বা বর্ষায় বইখাতার সঙ্গে রান্নার হাঁড়ির মধ্যে বইপুস্তক আর স্কুলের পোশাক নিয়ে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যায়। ভেজা জামাকাপড় রোদে শুকাতে দিয়ে স্কুল পোশাক পরে ছোটে ক্লাসে। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, স্থানীয়দের উদ্যোগে কয়েকবার বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করা হলেও নোনা জলে সেটি বেশিদিন টেকেনি। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলে সাঁকো থাকাকালে ৩০০-৪০০ শিক্ষার্থী ছিল। এরমধ্যে প্রায় দুইশ শিক্ষার্থী ছিল ওই দুই চরের। সাঁকো না থাকায় এখন দুই চর থেকে ৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী আসে। গ্রামীণ জনপদের জনগুরুত্বের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে হাটবাজার, সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানসহ স্কুল, কলেজ ও হাসপাতালে যাওয়ার রাস্তায় সেতু নির্মাণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তার কোনো প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি না। এক্ষেত্রে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কেউই দায় এড়াতে পারেন না। আমার আশা করি দ্রুত দুই গ্রামের মধ্যে সেতুর ব্যবস্থা হবে, শিক্ষার্থীরা ভেসে নয়, হেঁটে স্কুলে যাবে।
অন্যদিকে দ্বিতীয় প্রতিবেদনটিতে দেখা যাচ্ছে সরকারি অর্থের বিপুল অপচয়। জানা যায়, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৭১টি নতুন ভবনের জন্য প্রায় ২৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেঞ্চ-টেবিলসহ প্রয়োজনীয় ফার্নিচার দেওয়ার কথা। এরপর ভবনের ব্যবহার শুরু হবে। কিন্তু ভবন নির্মাণ ছয় মাস আগে শেষ হলেও আসবাবপত্র সরবরাহ করা হয়নি। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ৭১টি ভবনে সর্বোচ্চ ২৫ কোটি টাকার আসবাবপত্রের প্রয়োজন হতে পারে। দেখা যাচ্ছে, স্কুলভবন তৈরি হয়ে গেলেও বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিলের অভাবে শিক্ষার্থীরা সেখানে ক্লাস করতে পারছে না। ‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো উন্নয়ন প্রকল্প’-এর পরিচালক অধ্যাপক মো. নাসির উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রকল্পটি অর্থ মন্ত্রণালয় কর্র্তৃক ‘বি’ ক্যাটাগরির ঘোষিত হওয়ায় খাতওয়ারি অর্থছাড় স্থগিত আছে। চলতি অর্থবছরেও এসব ভবনের আসবাবের জন্য বরাদ্দ নেই। ফলে এসব ভবন রক্ষণাবেক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।’ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক মন্দার জন্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর শ্রেণিভাগ করার বিষয়টি বাদ দেওয়া না গেলেও, মূল প্রকল্প ‘এ’ ক্যাটাগরির হলে সেগুলোর আসবাবপত্রসহ অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জাকে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে রাখলে সেই উন্নয়ন তো কোনো কাজে আসবে না। বরং এ ধরনের পরিকল্পনা ঘাটতি সরকারি টাকার অপচয়ের কারণ হবে জনগণ কোনো সুফল পাবে না। কাদের পরিকল্পনা ঘাটতি, উদাসীনতা ও গাফিলতির কারণে সরকারের অর্থের এই অপচয় হচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করা দরকার। এ ধরনের কাজ আগামীতে যাতে না হয়, সে বিষয়ে সবাইকে সাবধান হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আশা করব সরকার এসব বিষয়ে দ্রুত নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এবং শিক্ষার্থীরা সেতু পার হয়ে স্কুলে গিয়ে নতুন ভবনে বসে ক্লাস করবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভাড়া ৫৩ হাজার টাকা। এ রুটের অন্যসব এয়ারলাইনস আরও কম দামে যাত্রী বহন করলেও বিমান করে না। খালি যাবে, তাও কম ভাড়ায় যাত্রী নেয় না বিমান।
ঢাকা থেকে বিমান কত বেশি ভাড়া নেয় তা স্পষ্ট বোঝা যায় নিকটতম প্রতিবেশী শহর কলকাতার দিকে চোখ বোলালে। কলকাতার নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানের তিন ভাগের এক ভাগ ভাড়া দিয়ে কুয়ালালামপুর যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে উড়ে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে বিমানের ভাড়া বেশি। বিমানের ভাড়া শুধু বেশিই নয়, এই এয়ারলাইনস ভাড়া বাড়ানোর নেতৃত্ব দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রথমে বিমান ভাড়া বাড়ায় পরে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এয়ারলাইনসগুলো সেই সুযোগ নেয়।
অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় বিমানের ভাড়া বেশি এ অভিযোগ ছিল মূলত জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ট্রাভেল এজেন্টদের। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছেন সাধারণ যাত্রীরাও। কুয়ালালামপুর, রিয়াদ বা জেদ্দার মতো বাংলাদেশি শ্রমিকপ্রবণ শহরগুলোতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, দেশের বেসরকারি টেলিভিশন এমনকি খবরের কাগজগুলোতে যেচে এসে বলে যাচ্ছেন বিমান অনেক বেশি ভাড়া নিচ্ছে।
কীভাবে বিমান ভাড়া বাড়ায় জানতে চাইলে একজন জনশক্তি রপ্তানিকারক জানান, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখে তা নতুন করে বলার দরকার নেই। তাদের কর্মস্থলে পাঠাতে বা ফিরিয়ে আনতে বিমানের বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। বিমান কোনো দিন কোনো ঘোষণায় বলেনি ‘এ উদ্যোগটি শুধু রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য’। এই শ্রমজীবীদের জন্য বিমানের কোনো ছাড় নেই। বরং যখন যে ‘আদম বাজার’ চাঙ্গা হয় তখন সেখানে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় বিমান। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রচুর শ্রমিক যাচ্ছে। সেখানে ভাড়া বাড়িয়েছে সংস্থাটি। শ্রমিক এবং ওমরাহর কারণে জেদ্দার টিকিটই পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তা অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
এ অবস্থা থেকে বিমান কীভাবে বের হয়ে আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমান নানা পলিসি নিতে পারে। বিকল্প রুট চালু করতে পারে। ট্রানজিট দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে নিতে পারে। এতে যাত্রীরা কম দামে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ যাত্রী যেহেতু শ্রমজীবী তাই তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। কত সময় ট্রানজিট নিয়ে গেল তা মুখ্য নয়। ঠিক এ জায়গাটিতেই এগিয়ে আছে আমাদের নিকটবর্তী শহর কলকাতা। ঢাকার তুলনায় অনেক কম দামে কলকাতার যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। সেখান থেকে পরিচালিত এয়ারলাইনসগুলো সরাসরি বা এক-দুটি ট্রানজিট দিয়ে অনেক কমে যাত্রী বহন করে। বিমান কেন পারে না সেই প্রশ্নটি কেউ তুলছে না।
এক সপ্তাহ পর আগামী ৪ এপ্রিল ফ্লাই (যাত্রা) করার জন্য গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা কুয়ালালামপুর রুটের বিমান টিকিটের দাম ছিল ৫৩ হাজার ২৭ টাকা। থাই এয়ারওয়েজ ৪১ হাজার ৭৬ টাকায়, ইন্ডিগো এয়ার ৪৩ হাজার ৬৪৪, ইউএস-বাংলা ৪৭ হাজার ১৯, এয়ার এশিয়া ৪৯ হাজার ৪৪৫, মালিন্দো এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৯০ এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ভাড়া ছিল ৬১ হাজার ৪৭২ টাকা।
অথচ কলকাতা থেকে এয়ার এশিয়া একই দিনে একই গন্তব্যে নন-স্টপ ফ্লাইটে মাত্র ১৭ হাজার ৩৭৯ টাকায় পৌঁছে দেওয়ার অফার ছিল অনলাইনে। এয়ারক্রাফটের মানভেদে একই দিনে বিভিন্ন সময়ে টিকিটটির দাম ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ছিল। ইন্ডিগো এয়ার চেন্নাইয়ে একটি স্টপেজ দিয়ে ২০ হাজার ৩৩৭ টাকায় অফার দেয়। কলকাতা থেকে কুয়ালালামপুরে যাওয়ার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিটের দাম ছিল ২৯ হাজার ৬৩৯ টাকা। মুম্বাই এবং সিঙ্গাপুরে দুই স্টপেজ দিয়ে এয়ারলাইনসটি এ ভাড়া নির্ধারণ করে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস মুম্বাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে কলকাতা থেকে ৫৪ হাজার ৩২৬ টাকায় যাত্রীদের নিয়ে যায় কুয়ালালামপুর।
ঢাকা রিয়াদ রুটে আগামী ৩ এপ্রিলের এয়ার অ্যারাবিয়ার ভাড়া ৫৪ হাজার ৯৫১ টাকা। শারজায় একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কলম্বোতে একটি স্টপেজ দিয়ে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস রিয়াদ নিয়ে যাবে ৫৬ হাজার ৫৪৫ টাকায়। জাজিরা কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৫ হাজার টাকায়, গালফ এয়ার বাহরাইনে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৭ হাজার ৬৭৭ টাকায়, সৌদিয়া এয়ারলাইনস ৭১ হাজার ৭১১ টাকায় সরাসরি, কুয়েত এয়ারওয়েজ কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৩ হাজার ২৪৭ টাকায়, ওমান এয়ার মাস্কটে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৩২ টাকায়, ফ্লাই দুবাই দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৬৩ টাকায়, কাতার এয়ারওয়েজ দোহায় এক স্টপেজ দিয়ে ৮২ হাজার ৫৫৭ টাকায়, এমিরেটস দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৮৪ হাজার ২৩১ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে। আর ঢাকা-রিয়াদ রুটে বিমানের ভাড়া ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৭ টাকা। ৩ এপ্রিল কলকাতা থেকে রিয়াদ যাওয়ার ভাড়াও ঢাকা রিয়াদের তুলনায় অনেক কম।
কলকাতা থেকে মাত্র ৩৫ হাজার ৩২৪ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া। মুম্বাইতে মাত্র একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীদের সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। ওইদিন সময়ভেদে তাদের ভাড়া ৪১ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এক স্টপেজ দিয়ে ফ্লাই দুবাই নিয়ে যাচ্ছে ৪১ হাজার ৫৬০ টাকায়। ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ভাড়া ৪১ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকা। এয়ার ইন্ডিয়া দিল্লিতে একটি স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪১ হাজার ৪১৯ টাকা। গালফ এয়ার মুম্বাই এবং বাহরাইনে দুই দফা স্টপেজ দিয়ে নিচ্ছে ৪৫ হাজার ৫৮৭ টাকা। ইন্ডিগো এয়ার দিল্লিতে এক স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪৮ হাজার ১৮৭ টাকা। দুবাইতে এক দফা বিরতি দিয়ে এমিরেটস কলকাতা থেকে রিয়াদের ভাড়া নিচ্ছে ৫৪ হাজার ৬৪৬ টাকা। কাতার এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৩৮ টাকায় এবং এমিরেটস ৬০ হাজার ১০৮ টাকায় একটি বিরতি দিয়ে কলকাতা থেকে রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে।
এসব রুটে বিমানের উচ্চমূল্য নির্ধারণই ভাড়া বৃদ্ধির মূল কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এর সঙ্গে আছে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট কমানো এবং উচ্চ দামের সুযোগ নিতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং ২০২৩ সালে ডলারের বর্ধিত বিনিময় দর। জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধিও টিকিটের দাম বৃদ্ধির কারণ।
বিমানের এমডি শফিউল আজিম বিমান ভাড়া বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি না মানলেও রিক্রুটিং এজেন্ট, ট্রাভেল এজেন্ট বা হজ এজেন্সির তরফ থেকে বরাবরই এ অভিযোগ করা হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, যখন বিমান ভাড়া বাড়ায় তখন অন্য এয়ারলাইনসগুলোও ভাড়া বাড়ায়। বিমান যখন বাড়ায় তখন কোনো সীমা মানে না। তারা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ায়।
৩৫ বছরের পেশাজীবনের কথা উল্লেখ করে মাজহারুল ইসলাম বলেন, বিমানের ভাড়ার সঙ্গে কুলাতে পারছি না। একজনকে বাইরে পাঠানোর সব খরচ অনুমান করা যায়, বিমান ভাড়া ছাড়া। কারণ ৫ ডলারের ভিত্তিভাড়া তারা ৩০ ডলার থেকে শুরু করে। বিমান ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু জ্বালানি খরচ কমছে। যখন কমে তখন বিমান ভাড়া কমায় না। বিমান যেভাবে ভাড়া বাড়ায় তাতে ব্যবহারকারীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বিমানের ভাড়া প্রায় মহামারীর সময়ের মতো অবস্থায় চলে গেছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টরা । বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে শ্রম আমদানিকারক দেশের গন্তব্যগুলোতে ভাড়া বেড়েছে। ঢাকা-জেদ্দা রুটে টিকিট পাওয়াই সৌভাগ্য। এ মাসের শুরুতে যে ভাড়া ছিল ৫০ হাজার তা এখন ৮০ হাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিমান ভাড়া বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি খেসারত দিচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)-ওয়েবসাইট তথ্য দিচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২ লাখ ১৩ হাজার শ্রমিক বিদেশে গেছে। যাদের বেশিরভাগই গেছেন মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
গত বছরের শেষদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা হয়। বাজার নতুন করে শুরু হওয়ার পর ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে টিকিটের দাম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। ব্যাংকক, কলম্বো বা অন্যান্য শহরে ট্রানজিট ফ্লাইট দিয়েও অনেক এয়ারলাইন কুয়ালালামপুরে যাত্রী বহন করছে। এতে টিকিটের দাম কমেছে ৩০-৪০ হাজার টাকা।
এবার হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এ টাকা বাড়িয়ে হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হজযাত্রী এবং হাবের ধারাবাহিক বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিমান ভাড়া বাড়িয়ে যচ্ছে। এবারও বাড়িয়েছে। গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হজবিষয়ক এক সভায় হাবের সিনিয়র সহসভাপতি ইয়াকুব শরাফতি হজে বিমান ভাড়া কমানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত বিমানের এমডি ভাড়া কমানোর সুযোগ নেই বলে জানান। বৈঠকে হজে কেন বিমান ভাড়া বাড়নো হলো তার যৌক্তিকতা জনসমক্ষে তুলে ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয় এমডিকে।
ইয়াকুব শরাফতি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি হজের বিমান ভাড়া কমানোর জন্য। বিমান কোনোভাবেই কমাতে রাজি হয়নি।’
বিমানের বর্ধিত ভাড়ার সুযোগে সৌদিয়া দেশ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কারণ বিমান যে ভাড়া নির্ধারণ করে সৌদিয়াও একই ভাড়ায় হজযাত্রী বহন করে। হজের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশি হজযাত্রীদের অর্ধেক বহন করবে সৌদি আরবের এয়ারলাইনস।
আটাবের সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া জানান, প্রধান এয়ারলাইনসগুলোর পাশাপাশি এয়ার অ্যারাবিয়ান, ফ্লাই দুবাই, সালাম এয়ারের মতো বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলো তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের তুলনায় কম ভাড়া নেওয়ার কথা। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে বেশি নিচ্ছে। বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলোও তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে মাত্র ৫০০ বা ১০০০ টাকা কম নিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। অথচ সরকারের কাছে তাদের প্রজেকশন ছিল তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে অর্ধেক মূল্যে যাত্রী নেবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং কম থাকায় তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।