
পণ্ডিত রবি শঙ্করের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের বারানসিতে ৭ এপ্রিল ১৯২০ সালে। সংগীতজ্ঞ হিসেবে সেতারবাদনে কিংবদন্তিতুল্য শ্রেষ্ঠত্বের জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। আদি পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের নড়াইল জেলায়। বাবার নাম শ্যাম শঙ্কর চৌধুরী এবং মা হেমাঙ্গিনী। ১৯৩০ সালে তিনি প্যারিসে বড় ভাই উদয় শঙ্করের কাছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য যান এবং ১২ বছর বয়স থেকেই তিনি ভাইয়ের নাচের দলের নৃত্যশিল্পী ও সেতারবাদক হয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে বেড়িয়েছেন ভারত ও ইউরোপের নানা শহরে। ১৯৩৮ সালে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সেতারের দীক্ষা নিতে শুরু করেন। ১৯৩৯ সালে ভারতের আহমেদাবাদ শহরে রবি শঙ্করের প্রথম সাধারণের জন্য উন্মুক্ত একক সেতার পরিবেশন অনুষ্ঠান হয়। তিনি কবি ইকবালের সারে জাঁহাসে আচ্ছা কবিতাকে সুর দিয়ে ভারতীয় জাতীয় সংগীতের পর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া রেডিওর সংগীত পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। এ সময়ে তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি পথের পাঁচালী, অপরাজিত ও অপুর সংসার চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা। ১৯৬২ সালে তিনি কিন্নর স্কুল অব মিউজিক, বোম্বে এবং ১৯৬৭ সালে কিন্নর স্কুল অব মিউজিক, লস অ্যাঞ্জেলেস স্থাপন করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় ও তহবিল সংগ্রহের জন্য পাশ্চাত্যের জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী জর্জ হ্যারিসনসহ অন্যদের নিয়ে নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চ্যারিটি কনসার্ট ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর অন্যতম সংগঠক রবি শঙ্কর। ভারত সরকারের পদ্মবিভূষণসহ নানা পুরস্কার ও সম্মানে তিনি ভূষিত হয়েছেন। ১২ ডিসেম্বর ২০১২ সালে রবি শঙ্কর মৃত্যুবরণ করেন।
১১ ডিসেম্বর ১৯২২ তখনকার ব্রিটিশ ভারতের, এখনকার পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পেশোয়ার শহরের কিসসাখানি বাজারের একটি ফল ব্যবসায়ী পরিবারে মোহাম্মদ ইউসুফ খান জন্মগ্রহণ করেন। বাবা লালা গুলাম সারওয়ার খান এবং মা আয়েশা বেগম। এক দিন বাবার চোখে পড়ল রাস্তার দেয়ালে সিনেমার পোস্টার। তাতে সিনেমার নায়কের যে ছবি তা ইউসুফ খানের বলেই তিনি মনে করলেন, কিন্তু নাম ভিন্ন, দিলীপ কুমার। তিনি নিশ্চিত হতে চান। বাড়ি ফিরে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন।
পোস্টারে লেখা আছে দিলীপ কুমার অভিনীত জোয়ার ভাটা। সেদিন তার বাবার সঙ্গে ছিলেন দেওয়ান বাশেশ^রনাথ কাপুর (ইউসুফের বন্ধু, একই এলাকার রাজ কাপুরের দাদা), তিনিও সন্দেহ করলেন এই ছেলে ইউসুফ না হয়ে যায় না। দুজন একসঙ্গে টোঙ্গাতে ফিরছিলেন। সন্দেহ কাপুরেরও।
লালা গুলাম সারওয়ার খান বললেন, ‘সিনেমার পোস্টারে দিলীপ কুমার নামের একটি ছেলেকে দেখলাম। কসম খোদার সে দেখতে তোর মতো। পোস্টারের ছেলেটি কি তুই?’
ছেলে নিশ্চুপ, ক্ষুব্ধ লালাজি বললেন, ‘জবাব দে, পোস্টারের ছেলেটি তুই, না অন্য কেউ?’
কোমল ও আতঙ্কিত কণ্ঠের জবাব, ‘হ্যাঁ আমি’।
তারপর প্রবল একটা চড় পড়ল তার গালে, মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। মেঝেতে পড়ে রইলেন, পাঁচ আঙুল বসে গেছে।
পরের আদেশ, ‘এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা।’
এ বছরই প্রকাশিত ফয়সাল ফারুকীর ‘দিলীপ কুমার : ইন দ্য শ্যাডো অব অ্যা লেজেন্ড’ গ্রন্থে দিলীপ কুমারের বলা এ কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে।
যদি মা আয়েশা খাতুন ও বড় বোন সকিনা না থাকতেন তাকে বাড়িছাড়া হতে হতো।
‘আমি সিনেমায় থাকার কথা কখনো ভাবিনি, আমার প্রিয় কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীও ছিলেন না। আমি দেখেছি আমাদের খাবার জোগাড় করতে আমার আব্বা-আম্মা উদয়াস্ত পরিশ্রম করতেন। কিছু কামাই করে তাদের ভার কিছুটা লাঘব করার চেষ্টাই আমার ছিল।
দিলীপ কুমার কাহিনীর বাকি অংশ তার আত্মজীবনী ‘দ্য সাবস্ট্যান্স অ্যান্ড দ্য স্যাডো : অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’র ‘দ্য টার্নিং পয়েন্ট’ অধ্যায় থেকে কিছুটা সংক্ষেপে উপস্থাপন করছি :
আমি এক দিন সকালে চার্চগেইট স্টেশনে অপেক্ষা করছি, সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে সেন্ট্রাল বোম্বের দাদর যাব। সেখানে একজনের সঙ্গে দেখা করব, তিনি একটা ব্যবসা দিতে পারেন। ব্যাপারটা ক্যান্টনমেন্টে সেনাবাহিনীর জন্য কাঠের খাট সরবরাহ-সংক্রান্ত। সেখানে ডক্টর মাসানিকে দেখতে পেলাম। তিনি একজন মনোবিজ্ঞানী, একবার উইলসন কলেজে এসেছিলেন তখন আমি সেখানকার ছাত্র। উইডলসনে আমি এক বছর পড়াশোনা করেছি। চার্চগেইট স্টেশনে আমি এগিয়ে তার কাছে যাই এবং নিজের পরিচয় দিই। যেহেতু তিনি আমার আব্বার পরিচিত আমাকে চিনবেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইউসুফ এখানে কী করছো?’
আমি বললাম চাকরির খোঁজ করছি কিন্তু তেমন কিছু চোখে পড়ছে না। তাই ব্যবসায়ের চেষ্টা করছিলাম। তিনি বললেন, তিনি বোম্বের পশ্চিম উপশহরের দিকে মালাদ-এ যাচ্ছেন সেখানে সিনেমা স্টুডিও বোম্বে টকিজ-এর মালিকের সঙ্গে দেখা করবেন। তিনি বললেন, তুমি যদি আমার সঙ্গে যেতে চাও চলো, তাদের সঙ্গে দেখা হবে। তোমার জন্য তাদের কাছেও কোনো চাকরি থাকতে পারে। খুব সাদামাটাভাবে তিনি কথাগুলো বললেন। আমি এক মুহূর্তের জন্য ভেবে দাদর যাওয়ার ব্যাপারটা বাদ দিলাম এবং তার সঙ্গে যোগ দিলাম। রেলওয়েতে আমার একটা ফার্স্ট ক্লাস সিজন টিকিট ছিল, কিন্তু সেটা বান্দ্রা পর্যন্ত, মালাদ বান্দ্রা পেরিয়ে আরও ১৮ মাইল দূরে। ডক্টর মাসানি টিকিট চেকারকে চিনতেন। সুতরাং বর্ধিত অংশের একটা টিকিট পেয়ে গেলাম। যদিও স্টেশন থেকে বোম্বে টকিজ খুব কাছে তবুও তিনি ট্যাক্সি নিলেন, কারণ লাঞ্চটাইম প্রায় হয়ে গেছে, তিনি চিন্তিত বোম্বে টকিজ-এর বস মিসেস দেবিকা রানী দুপুরের খাবার খেতে আবার না বাসায় চলে যান।
***
এর আগে আমি জীবনেও কখনো সিনেমার স্টুডিও দেখিনি, এমনকি স্টুডিওর ছবিও না। আমি রাজ কাপুরের কাছে বোম্বে টকিজের কথা শুনেছি। তার পিতা পৃথ্বীরাজ কাপুর অভিনীত সিনেমার শ্যুটিং হতো এখানে। বহু একর জমিনের ওপর ছড়িয়ে আছে বোম্বে টকিজ স্টুডিও, একটা বাগান, বাগানে একটা ঝরনা। এর অফিস ভবন দেখতে সনাতন অফিসের মতো নয়, বাংলোর মতন।
ডক্টর মাসানি যখন প্রবেশ করলেন দেবিকা রানী তাকে উষ্ণ সম্ভাষণ জানালেন এবং তাকে বসতে বললেন। পরিচিত হওয়ার জন্য আমি যখন দাঁড়িয়ে আছি তিনি বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকালেন। তিনি রুচিশীলতার প্রতিমূর্তি, ডক্টর মাসানি যখন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন নমস্তে বলে আমাকে স্বাগত জানিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসতে বললেন। কিন্তু তার দৃষ্টি আমার ওপর নিবদ্ধ যেন আমাকে নিয়ে তিনি কিছু একটা ভাবছেন। তিনি আমাদের অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, পরে জেনেছি তিনি বিখ্যাত পরিচালক; তিনি সোফায় বসেছিলেন। দেবিকা রানী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি উর্দুতে ভালো কি না। আমি ‘হ্যাঁ’ বললাম। ডক্টর মাসানি আমার পেছনের ইতিহাস ব্যাখ্যা করলেন; বললেন আমরা পেশোয়ার থেকেই উঠে এসেছি। আমার বাবার কথা, তার ব্যবসায়ের কথা বললেন। তিনি আগ্রহ নিয়ে শুনলেন, আমি তার মুখের দিকে তাকাই, স্বাভাবিক দ্যুতিময়তা ও সুস্বাস্থ্যের প্রমাণ তাতে। তিনি কেবল আমার উর্দু জ্ঞানের কথা শুনলেনএতে কোন ধরনের চাকরি তিনি আমাকে দিতে পারেন আমি তাই ভাবছিলাম।
তিনি আমার দিকে ফিরে মিষ্টি হেসে আমাকে যে প্রশ্নটা করলেন তা আমার জীবনের ধারা সম্পূর্ণভাবে এবং অপ্রত্যাশিতভাবে বদলে দিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমি অভিনয় করতে চাই কি না? মাসে সাড়ে বারোশো টাকা বেতনে তা করতে রাজি কি না? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। ডক্টর মাসানির দিকে যখন তাকালাম তাকেও বিস্মিত মনে হলো। তিনি কাঁধ নাড়লেন, আমি বুঝতে পারলাম আমাকে হ্যাঁ বলানোর এটা একটা সংকেত। আমি বেহুদা চিন্তা করে সময় নষ্ট করার মানুষ নই। সুতরাং আমি হাসিমুখে তার হাসির জবাব দিতে গিয়ে বললাম, এটা তার বিশেষ দয়া যে অভিনয় করার একটা চাকরি তিনি আমাকে দিচ্ছেন। কিন্তু আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই, ফিল্ম সম্পর্কে ধারণাও নেই। তা ছাড়া আমি জীবনে একটি মাত্র সিনেমা দেখেছি, সেটাও একটা যুদ্ধের ডকুমেন্টারি। দেওলালির সৈনিকদের জন্য ছবিটি নির্মিত।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের পারিবারিক ফল ব্যবসায়ী তুমি কতটা অভিজ্ঞ? আমি বললাম, আমি শিখছি, বেশি অভিজ্ঞতার দাবি করতে পারব না।
তিনি বললেন, এই তো ফলের ব্যবসায় এসে তুমি ফল, ফলচাষএসব সম্পর্কে যেমন শিখছো সিনেমা তৈরির শৈলী, অভিনয় এসব একইভাবে শিখে নিতে পারবে। আমার একজন তরুণ, সুদর্শন এবং শিক্ষিত অভিনেতা দরকার। আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার মধ্যে ভালো অভিনেতা হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে।
লাঞ্চের সময় এসে গেল, আমরা তার সঙ্গে লাঞ্চে যোগ দেব কি না আন্তরিকভাবেই জিজ্ঞেস করলেন। ডক্টর মাসানি বিনীতভাবে জানালেন লাঞ্চ করবেন না, বিদায় দিয়ে চলে এলেন, আমি তাকে অনুসরণ করলাম। ফেরার পথে ডক্টর মাসানি তেমন কথা বললেন না। দ্রুতগতিতে ছোটা রেলের শব্দ এবং চাকরির অফারের বিস্ময় আমাদের দুজনকে নির্বাক করে দিয়েছে। আমি যে সিনেমা ও অভিনয় নিয়ে কিছুই জানি না এটা আমাকে আর বিচলিত করেনি। ট্রেনের দুলুনিতে আমার মধ্যে যখন আয়েশি ভাব এসে গেল আমি ভালো বোধ করলাম এবং এত বেতনের জন্য কৃতজ্ঞ বোধ করতে থাকলাম। এখন আমার লিখিত সম্পত্তির অপেক্ষা।
* * *
বাড়ি ফিরে ভাইদের মধ্যে তার বড় জন আইয়ুব সাহাবকে তার চাকরির সাড়ে বারোশো টাকা বেতনের অফারটার কথা বললেন (পারিবারিক সংস্কৃতিতে বড় ভাইকে শুধু নাম ধরে ডাকা যাবে না, নামের সঙ্গে সাহাব যোগ করতে হবে, কিন্তু ইউসুফ আইয়ুবকে নাম ধরে ডেকে বকা ও মারও খেয়েছেন।) আইয়ুব বললেন, চাকরি ঠিকই আছে তবে বেতন বছরে সাড়ে বারোশো টাকা। তিনি আরও বললেন, রাজ কাপুর বোম্বে টকিজ থেকে মাসে ১৭০ টাকা পান, এটা তার জানা আছে। আমার মনে হলো আইয়ুব ঠিকই বলেছেন। আমাকে প্রতি মাসে এত টাকা তিনি কেমন করে দেবেন? আমি বুঝলাম আসলেই বছরে সাড়ে বারোশো। আমি ভাবলাম এ চাকরি গ্রহণ করার মানে নেই, তাতে আমার আব্বার ভার তেমন কমবে না।
আইয়ুব ছাড়া বাড়ির কেউ আর আমার এই চাকরি পাওয়ার কথা জানেন না। আমার সবচেয়ে বড় ভাই নূর সাহাব এসব নিয়ে কখনো ভাবেন না, তিনি তার নিজস্ব ভুবনে বাস করেন। তাকে কেবল খাবার সময় বাড়িতে দেখা যায়। আমি ভাবলাম আমার সিদ্ধান্তটি আগে ডক্টর মাসানিকে জানানো সমীচীন হবে। আমি চার্চগেইটে তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম, বললাম, ইলেকট্রিক ট্রেনে প্রতিদিন মালাদ আসা-যাওয়া করে যে খরচ হবে তাতে বছরে সাড়ে বারোশো টাকায় আসলে পোষাবে না।
কিন্তু তিনি নিশ্চিত বছরে নয় মাসে ১২৫০ টাকা। তিনি আমার সামনে নিজে থেকেই দেবিকা রানীকে ফোন করে বেতনটা নিশ্চিত হলেন, তিনি যেভাবে ফোন ধরে থাকলেন তাতে আমার মনে হলো তিনি অপর প্রান্ত থেকে সুখকর কিছু শুনছেন। রিসিভার রেখে তিনি বললেন, বার্ষিক নয় মাসিক ১২৫০; দেবিকা মনে করেন আমি প্রতিশ্রুতিশীল, কাজেই আমি সানন্দে গ্রহণ করতে পারি এমন অফারই তিনি দিয়েছেন। পরদিন দুপুরের খাবারের পর চার্চগেইট স্টেশনে ডক্টর মাসানির সঙ্গে দেখা করি। বছরটা ১৯৪২, দিনটা শুক্রবার, তারিখটা মনে নেই। নামাজের পর, ভালো ভোজনের পর আমি নীরবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। কেউ জানে না আমি কোথায় যাচ্ছি।
ইউসুফ খান এসে হাজির হলেন বোম্বে টকিজ-এ; দেবিকা রানী বুঝতে পারলেন ইউসুফ চাকরির অফারটা যে গ্রহণ করেছেন তা নিশ্চিত করতে এসেছেন। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে আয়েশা বেগমকে বললেন, ‘আম্মা আমি মাসে ১২৫০ টাকা বেতনের একটা চাকরি পেয়েছি, তাতে আপনার রান্নাঘরের খুচরো খরচ, আর আমার ভাই-বোনদের পড়াশোনার খরচটা মেটানো যাবে।’
কিন্তু এত টাকার চাকরি, কাজটা কী? সন্দিগ্ধ আয়েশা খাতুন জিজ্ঞেস করলেন।
তিনি বললেন, সম্মানজনক কাজ, উর্দুতে ভালো বলেই কাজটা পেয়েছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এই উন্মাতাল সময়ে উর্দুর ভালো জ্ঞান হয়তো গুরুত্বপূর্ণইমা তাই ভাবলেন। মা বোঝেননি এটা ইউসুফ খানের দিলীপ কুমার হওয়ার চাকরি।
লেখকঃ কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
আমাদের সমবয়সী বা কাছাকাছি বয়সের অনেকের সঙ্গে কথা বললে মনে হয়, আগে সব ঠিক ছিল। এখন কোথাও কিছু আলো নেই। সব অন্ধকার। অনেক সময় ঠাট্টা করে আমরা বলি, সবকিছু ‘ব্যাদে’ অর্থাৎ ‘বেদ’-এ আছে। এই ঠাট্টার লক্ষ্য মনুবাদী, মৌলবাদী ধ্যান-ধারণা। যুক্তিতর্কের বাইরে নিছক আবেগ দিয়ে সব বিশ্লেষণ করা। ইদানীং এই প্রবণতা বাড়ছে। এ একধরনের গোঁড়ামি। কিন্তু এই একই মৌলবাদ তথাকথিত প্রগতিশীল বন্ধুদের মধ্যেও দেখলে বেশ অবাক লাগে। বিশেষ করে এ ধরনের চিন্তাভাবনা বেশি দেখা যায় ষাট-সত্তর দশকের প্রজন্মের মধ্যে। এটা ঠিক, সে সময় সারা দুনিয়ায় বাম মতাদর্শ অনেক সক্রিয় ছিল। পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-সাহিত্যে শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃপ্তি মিত্র, কেয়া চক্রবর্তী, বাদল সরকার নাটকে; উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষরা চলচ্চিত্রে রাজত্ব করছেন। পরিচালনায় সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক; গানে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, কিশোর কুমার আরও অনেকে স্বমহিমায় রাজত্ব করছেন। বামপন্থি রাজনীতি আদর্শের পথে এগিয়ে চলেছে। এক এক সময় তো মনে হচ্ছে, বিপ্লব দরজায় কড়া নাড়ছে। দরজা খুলে দিলেই বিপ্লব হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়বে।
বাস্তবে তা ঘটল না। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার পতন ঘটার পর থেকেই গেল গেল রব উঠল বিভিন্ন দেশের বামপন্থিদের একাংশের মধ্যে। তারও পরে গোলকায়নের ধাক্কায় অনেকেই হিমশিম খেয়ে, সহজ রাস্তা, মনের সুখে পুরনো স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরলেন। ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...’। আমি এই অতীত বিলাসীদের থেকে হাজার হাত দূরে।
আদরের ছোট পুত্র শমীর মৃত্যুর খবর যখন এলো রবীন্দ্রনাথ তখন ট্রেনে কলকাতা ফিরছেন। নীরব কবি বিষাদ বুকে নিয়ে চরাচরের দিকে তাকালেন। বাইরের পৃথিবী বড় চমৎকার। ছোট ছোট নদীর জলে মায়াবী চাঁদের আলো বড় সুন্দর। অজানা কোনো পাখি একমনে ডেকে চলেছে। কবি বুঝলেন, পৃথিবীতে ব্যক্তিশোক যতই যন্ত্রণার হোক, বিপুলা পৃথিবী তার মতো করে এগিয়ে চলে। থামার কোনো লক্ষণ নেই। রবিঠাকুর লিখলেন, ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে...’।
মাও সেতুং বলতেন, ‘যা কিছু পুরনো তাই ঐতিহ্য নয়।’ সত্যিই কি আগে সব ভালো ছিল! কালোবাজারি ছিল না, দুর্নীতি! কিংবা অসততা! এসব কি ছিল না? এক-আধজন নিশ্চয়ই বাঘা যতীন, ক্ষুদিরাম বা প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত বা পরের যুগে মৃত্যু-তুচ্ছ-জ্ঞান করা স্বাধীনতা যোদ্ধা থাকলেও ব্রিটিশদের পা ধরে রায়বাহাদুর, খানবাহাদুররা তো সংখ্যায় কম ছিলেন না। কলকাতা শহরের যত ঐতিহাসিক স্থাপত্য, বসত, ঠাকুর দালান অধিকাংশই গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশদের মুৎসুদ্দি পুঁজির দৌলতে। বামপন্থি রাজনীতিতে আদর্শবাদ একসময় নিশ্চিত আজকের চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু তখনো সবাই লেনিন ছিলেন এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই। অনেক আগুনখেকো বিপ্লবীর আসল চেহারা শুনলে চমকে যেতে হবে। আমার বাবা বলতেন, জেলে গেলে বোঝা যায় কমরেডদের আসল চেহারা। সামান্য মাছের টুকরো নিয়ে যেভাবে কেউ কেউ কামড়া-কামড়ি করেন, দেখে কে বলবে এরাই সাম্যবাদী সমাজের রূপকার!
জীবন আসলে নদীর মতো। কখনো একদিক শুকিয়ে যায়। চড়া পড়ে। ভাঙনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। কিন্তু অন্য দিকে স্রোতে ভেসে যায়। চড়াতে নতুন বসতির পত্তন হয়। গড়ে ওঠে নতুন স্বপ্ন। এভাবেই সভ্যতা বয়ে চলে নিরন্তর। শতাব্দীর পর শতাব্দী। হাজার বছর ধরে চেষ্টা করতে করতে মানুষ একদিন পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালাতে শিখেছিল। আজ সে প্রযুক্তি ব্যবহার করে চাঁদে অবধি পৌঁছে গেছে।
কয়েক দশক আগেও হিন্দু ঘরে বাবাকে সন্তান আপনি সম্বোধন করত। আজ অনেক সংসারেই বাবা-মা দুজনেই সন্তানের বন্ধু হয়ে গেছেন। একদা যে দূরত্ব ছিল তা আজ আর নেই। স্নেহ তখনো ছিল। এখনো আছে। তার প্রকাশভঙ্গি পাল্টে গেছে। একটা সময় ছিল যখন কুন্দনলাল সায়গল, কানন দেবী বা কৃষ্ণ চন্দ্র দের গান লোকের মুখে মুখে ফিরত। এখন তারা নতুন প্রজন্মের কাছে বাতিল হয়ে গেছেন। নতুন কত শিল্পী উঠে আসছেন রোজ। আমরা খোঁজও রাখি না। কোক স্টুডিওতে ভালোমন্দ কত গান শুনি। অনেকেই তরুণ। অনেকের নামও আগে শুনিনি। কিন্তু রাতে একা শুনলে বেশ লাগে।
নিজেও মাঝেমধ্যে বলি বটে, লেখা আর আগের মতো নেই। সত্যি কি তাই! এই পশ্চিমবঙ্গেই মুখে মুখে দশজনের নাম বলে দিতে পারি যারা তথাকথিত অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। করপোরেট পুঁজি আগ্রাসী চেহারা নিয়ে সমাজের মূল্যবোধ বদলে দিচ্ছে। তার ভেতরেও কত মানুষ কত কত কাজ করে চলেছেন তা আমরা দেখেও দেখি না। যে গায়ক আদ্যোপান্ত সুবিধাবাদী, সেও মঞ্চে দাঁড়িয়ে ডাক্তারদের পেশা নিয়ে প্রশ্ন তুলে হাততালি কুড়োচ্ছেন। কভিডকালে কত ডাক্তার জীবন তুচ্ছ করে রোগী দেখতে দেখতে মারা গেছেন এটাও সত্যি। আগে মাস্টারমশাইরা কত ভালো ছিলেন। এখন সবাই খারাপ? নিশ্চয়ই অনেক ফাঁকিবাজ, অসৎ লোক শিক্ষা জগতে আছেন। পাশাপাশি কোনো দিন টিউশনি না করে অবসর সময়ে বিনা পয়সায় ছেলেমেয়েদের পড়া দেখিয়ে দিচ্ছেন এ-রকম উদাহরণও কম নেই। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কত নতুন নতুন পেশায় প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, যা আগে আমরা কখনো ভাবিনি। বিজ্ঞাপন, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, ফ্যাশন ডিজাইনার, আইটি, ব্যবস্থা আরও কত। সবাইকে স্রেফ ভোগবাদী, স্বার্থপর বলতে আমি অন্তত রাজি না। করোনা সংকটের মধ্যে রেড ভলেন্টিয়ার্সের ভূমিকা ইতিহাস মনে রাখবে। এই নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাই আজও গণআন্দোলনের সামনে থাকে। সারা দেশে। এন.আর.সি’র সময় শাহীনবাগের লড়াই ভোলার নয়। এখনো উমর খালিদের মতো ছেলে জেলে থাকে, আমরা যারা ‘ধুর কোথাও কিছু নেই’ বলে হতাশা জনমনে চারিয়ে দিতে সক্রিয়, তারা শুধুই সমালোচনা করি।
গ্রামের পর গ্রামে ঘুরি। স্কুলে যাই। কলেজেও। অনেক খারাপ অভিজ্ঞতা হয়। পাশাপাশি কত ঝকঝকে মুখ দেখি। সোজা হয়ে হাঁটছে। মাটির সঙ্গে যোগ না থাকলে ওই গেল গেল করা ছাড়া রাস্তা নেই। নিন্দুকেরা শুধুই অন্ধকার দেখেন। আমি আলোর খোঁজ করি। প্রাণ বিপন্ন করে মানুষের পাশে থাকা তরুণের মুখের দিকে আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। গজদন্ত মিনারে বসে ঠিক সুরে রবীন্দ্র সংগীত শুনে তারিফ নিশ্চয়ই করব। কিন্তু গিটার হাতে নিয়ে ঈষৎ বেসুরে যে মেয়েটি জীবনের গান গাইছে, আমি আস্তে করে তার পিঠে হাত রাখব। জীবন কখনো থেমে থাকে না। তাকে হারিয়ে দেওয়া কঠিন, বড্ড কঠিন।
লেখক : ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক
কাবাডি বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হলেও ফুটবল বাঙালির রক্তে মিশে আছে। আবাহনী, মোহামেডান, শেখ জামাল ধানম-ি ক্লাব, ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব, রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস ক্লাবসহ দেশের নানা প্রান্তে অসংখ্য ফুটবল ক্লাব বেশ উজ্জ্বল সময় পার করেছে। নদীবিধৌত বাংলাদেশের নদীর চর আর গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠে কিশোর থেকে যুবক সবাই ফুটবল খেলে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন। শহর থেকে গ্রাম যেখানেই ফুটবলের আয়োজন সেখানে কিশোর থেকে বৃদ্ধ খেলা দেখতে ভিড় করেন। ফুটবলের এই এক অদ্ভুত শক্তি সব বয়সীদের আকর্ষণ করতে পারে। বাংলাদেশে ফুটবল একটা জনপ্রিয় খেলা হলেও দেশের জাতীয় ফুটবল দলের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্য নেই বললেই চলে। অব্যবস্থাপনায় জেলা পর্যায়ের ক্লাবগুলোতে কালভদ্রেও প্র্যাকটিস হয় না। যদিও আমাদের অনূর্ধ্ব ১৭ নারী ফুটবল দল সম্প্রতি সাফ শিরোপা জিতে এসেছে। তাদের এই শিরোপা জয় সারা বাংলাদেশের মানুষ উদযাপন করেছে। এয়ারপোর্টে জয়ী দলকে দেওয়া হয় অভূতপূর্ব সংবর্ধনা। ফলে সহজেই অনুমেয় বাংলাদেশের মানুষ ফুটবল নিয়ে কতটা আগ্রহান্বিত।
ইদানীং কালের ফুটবল আলোচনা ও আগ্রহ ইউরোপীয় কিছু ক্লাব ও লাতিন আমেরিকার দুই দল আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের ফুটবল ম্যাচেই সীমাবদ্ধ থাকছে। বিশ্বকাপ এলে দেশের গ্রাম থেকে শহর সবখানে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকায় ছেয়ে যায়। এটা নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনাও এসেছে। সংসদে একবার বিদেশি পতাকা ওড়ানোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও উঠেছিল। বরাবরের মতোই এবারের বিশ্বকাপ উপলক্ষেও আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীরা ব্রাজিল আর্জেন্টিনার জার্সি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিদেশি ক্লাব ও ভিনদেশের ফুটবলের প্রতি তরুণ প্রজন্মের বিশেষ আগ্রহের কারণ দেশের মাঠে আর ফুটবল নেই। এখন ফুটবলের আনন্দ খুঁজতে দর্শককে নির্ভর করতে হয় টিভি স্ক্রিনে।
ক্রিকেটে বাংলাদেশের মানুষকে বিদেশি দল সমর্থন করে তাদের জার্সি গায়ে দিয়ে ঘুরতে দেখা যায় না। কিন্তু ফুটবলে দেখা যায়। কারণ আমাদের দেশে ফুটবলের আমেজ আছে কিন্তু ফুটবল নেই। ২০১০-২০১২ সালের দিকে একটা বিজ্ঞাপন দেখা যেত ‘২০২২ বিশ্বকাপ আমাদেরও স্বপ্ন’। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) থেকে এই ধরনের একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। এমনকি সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, ‘বিশ্বকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ নেই এটা কষ্ট দেয়’। কিন্তু বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ফুটবলে থাকতে পারা খুব একটা অসম্ভব না। বাংলাদেশে একটা ক্রেজি ফুটবল ফ্যান আছে, এটাই যথেষ্ট বিশ্বকাপ ফুটবলে জায়গা করে নিতে। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার এমন সব দেশ বিশ্বকাপ ফুটবলে দাপট দেখাচ্ছে যেখানে মানুষ দু’বেলা খাবার পায় না। দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে দেশের অর্ধেক মানুষ। বুট কেনার টাকা হয় না ফুটবলারদের। সেখানে শুধুমাত্র ফুটবলপাগল জনগণের সমর্থনে পায়ের জোর খুঁজে পায় ফুটবলাররা। দুঃখের বিষয় ফুটবলপাগল একটি বড় দর্শক থাকার পরও যথাযথ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে আমাদের দেশের ফুটবলকে আমরা মাঠে নিয়ে আসতে পারছি না। ২০০৬ সালে ফরাসি ফুটবলার জিনেদিন জিদান একবার ঢাকা সফর করেন। সে সময় দেশের মানুষ নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা ও হরতাল অবরোধে ত্যক্ত-বিরক্ত। জিদান তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে রাষ্ট্রপ্রধান তাকে নির্বাচনের পর্যবেক্ষক হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সফরের প্রথম দিন গ্রামীণ ব্যাংক ভিজিট করে দ্বিতীয় দিন আবাহনী ও মোহামেডানের অনূর্ধ্ব ১৬ দলের প্রীতি ম্যাচে অংশ নিয়েছিলেন জিদান। দিনটি ছিল ৭ নভেম্বর। সেদিন ঢাকা শহরের মানুষ রাজনৈতিক অস্থিরতার বিরক্তিকে পাশ কাটিয়ে ‘জিদান উৎসবে’ মেতেছিল। আর ঢাকার বাইরে টিভির সামনে ছিল মানুষের উপচেপড়া ভিড়। নিজ দেশে প্রিয় ফুটবলারের পায়ের জাদু দেখার সাক্ষী হয়েছিল হাজার হাজার মানুষ। তারা সমস্ত নিরাশা হতাশা ভুলে সেদিন ফুটবল উদযাপনে নিজেদের আনন্দ খুঁজে নিয়েছিল। সেদিনটিই সাক্ষী বাংলাদেশের মানুষ কতটা ফুটবলপাগল।
খেলায় রাজনীতি : অনেক দেশের মধ্যে যুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছে খেলার মধ্য দিয়ে আবার মাঠেই হয়েছে অনেক যুদ্ধের সূচনা। যতই বলি খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশাবেন না কিন্তু খেলায়ও রাজনীতি আছে। আধুনিক যে জাতীয়তাবাদের ধারণা সেখানে একটি জনপ্রিয় কনসেপ্ট হলো দেশপ্রেম। যেখানে রাষ্ট্রকে মহান করে তোলা ও রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আবেগ আনুগত্যকে বিশেষ মানদ- ধরা হয়। ভাষা, সংস্কৃতি, জাতীয় পতাকার পাশাপাশি জাতীয় ক্রীড়া দলও সে জাতীয়তাবাদের ধারক হয়ে উঠেছে। ফলে জাতীয় ক্রীড়া দলের অর্জনকে জাতির অর্জন ও গৌরবের বিষয় হিসেবে দেখা হয়।
যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙে তখন ছোট ছোট দেশগুলো জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার আগে ফিফার সদস্য হওয়ার চেষ্টা করেছিল। কলকাতার ইস্ট বেঙ্গল, মোহনবাগান ক্লাব দুটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও উপমহাদেশের ধর্মীয় রাজনীতির ইতিহাস। যুক্তরাজ্যের স্বাধীনতাকামী অঞ্চল ওয়েলস ফুটবল দল ও স্কটল্যান্ড ক্রিকেট টিমের মাধ্যমে তাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার প্রকাশ করছে। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতে ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিম’ অসংখ্য প্রীতি ম্যাচ খেলেছে। কাতারের ওপর সৌদির অবরোধ তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় সৌদি-কাতার প্রীতি ফুটবল ম্যাচ দিয়ে।
১৯৬৮ সালের অলিম্পিকে ‘দি ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট’ এর ঘটনা ঘটে, যা ছিল আমেরিকার কালো মানুষের অধিকারের পক্ষে যুগান্তরকারী এক প্রতিবাদ। দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা নিরসন করে ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ককে পুনঃস্থাপন করা হয় একটি টেবিল টেনিস টুর্নামেন্টের মাধ্যমে, ইতিহাসে যা পিং পং কূটনীতি নামে পরিচিত। এই বিশ্বকাপে ইসরায়েল ও আর্জেন্টিনার মধ্যে জেরুজালেমে একটি প্রীতি ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল। এই টুর্নামেন্টের মাধ্যমে মূলত ইসরায়েল জেরুজালেম শহরকে নিজেদের বলে বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করতে চেয়েছিল। এই রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরে ইসরায়েলের পরিকল্পনায় লাল কার্ড দেখানো হয়েছে। বর্তমানে কাতার বিশ্বকাপে ফিলিস্তিন দল না খেললেও স্টেডিয়ামে স্টেডিয়ামে উড়ছে ফিলিস্তিনের পতাকা। মূলত কাতারে বসবাসরত ও বিভিন্ন দেশ থেকে কাতার ভ্রমণ করা ফিলিস্তিনি নাগরিকরা পতাকা তুলে ধরে নিজেদের দেশের ব্রান্ডিং করছে। সেই সঙ্গে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ইরানের অনেক সমর্থক তাদের দেশে হিজাব না পরায় পুলিশি গুলিতে নিহত মাশা আমিনির ছবি দেখিয়ে তার মৃত্যুর প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এমনকি ইরানের ফুটবল দল ম্যাচ শুরুর আগে জাতীয় সংগীত না গেয়ে সে দেশে চলমান আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছে। বিশ্বরাজনীতিতে বর্তমানে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র ঘোরতর শত্রু। দুই শত্রু যখন বিশ্বকাপে কাতারে মুখোমুখি তখন এমন একটি উত্তেজনা ও আতঙ্ক তৈরি হয় যেন খেলা নয় যুদ্ধ হবে। যতই খেলাকে আলাদা করার কথা বলা হোক। খেলা রাজনীতির এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠেছে।
জঙ্গি হামলার পর নিরাপত্তার অজুহাতে পাকিস্তানে কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট ও সামিট হচ্ছিল না তখন নিজ দেশের ব্রান্ডিংয়ের জন্য বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়া টিমকে বিশেষ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে পাকিস্তানে টুর্নামেন্ট খেলার আমন্ত্রণ জানায়। কাতার বিশ্বকাপের মাধ্যমে বিশ্বের ৮০০ কোটি মানুষের মধ্যে ৫০০ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে কাতারের নাম। ফলে ক্রীড়া, ক্রীড়া আসর এসব কিছু রাজনীতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতির অংশ চাইলেই এসবকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই।
আমাদের উৎসবের সীমা : হাজার হাজার মাইল দূরে ফুটবল ম্যাচ নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের উৎসব ও উৎসব প্রস্তুতির শেষ নেই। দর্শক প্রিয় দলের জার্সি কিনছে, পতাকা কিনছে। বিজয় র্যালি করছে, তর্ক করছে, বিতর্ক করছে। ফেইসবুকে খুনসুটি করছে। সবই উদযাপনের অংশ। তবে সে উদযাপন প্রায়শই সীমা অতিক্রম করছে। ফেইসবুকের খুনসুটি মাঝে মাঝে ঘৃৃণাসূচক আচরণে রূপ লাভ করছে। অনেক সময় আলোচনা থেকে মারামারি হাতাহাতির ঘটনাও ঘটছে। আমরা ভিন্ন একটি টাইম জোনে হওয়ায় বেশিরভাগ খেলা হচ্ছে রাতের বেলা। রাতের বেলা বড় স্ক্রিনে বাড়ির বাইরে খেলা দেখতে ও উৎসব করতে গিয়ে অনেকে সাধারণ মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। রাত ২/৩টা বাজে মোটরসাইকেলের হর্ন বাজিয়ে, র্যালি করে মাঝরাতে বাচ্চা ও বৃদ্ধদের ঘুম নষ্ট অগ্রহণযোগ্য আচরণ। কারণ এতে ভোরের শিফটে স্কুলগামী বাচ্চাদের সকালের স্কুল মিস হচ্ছে, বাড়ির বৃদ্ধ ও অসুস্থ রোগীরা ঘুমজনিত সমস্যায় ভুগছেন। মাঝরাতে যখন সবদিক নিস্তব্ধ তখন এসব শব্দদূষণ ব্যাপকভাবে আঘাত করার সুযোগ পায়। ফলে আমাদের খেয়াল রাখা উচিত কোনো উৎসব আনন্দ যেন কোনোভাবে অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়। লেখকঃ কলামিস্ট
কয়েক বন্ধু মিলে পরিকল্পনা করছিল সমুদ্রে ঘুরতে যাওয়ার। এজন্য তারা আলাপ-আলোচনা করতে মেসেঞ্জারে ‘সাম্পান’ নামে একটি ক্লোজ গ্রুপ খোলেন। তাদের সেই গ্রুপে সাগরে নামার জন্য সাম্পান ভাড়া, নাবিক সংগ্রহ, নিরাপত্তা সরঞ্জাম, টর্চলাইট, রান্না ও নিরাপত্তার জন্য ছুরি, তাঁবু ইত্যাদির তথ্য আদান-প্রদান করছিল। নানান বিষয়ের মধ্যে সেখানে বেকারত্বে থাকা এক বন্ধু সাগর পথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া চলে যেতে চেয়েও মজা করে এবং অন্যরা তাতে সায় দেয়, হাসে। দিন, তারিখ ঠিক হওয়ার পর, বন্ধুরা সাগর ভ্রমণ করতে কক্সবাজারের উদ্দেশে বাসে করে যাত্রাও করল। বিপত্তিটা শুরু হয় তৃতীয় পক্ষের অচেনা এক লোক ওই বন্ধুদের কারও মোবাইল পেয়ে ‘সাম্পান’ গ্রুপের মেসেজ দেখে এবং তাদের ‘মানব পাচারকারী’ সন্দেহ করে বসে। ওই তৃতীয় পক্ষের লোকটি পুলিশকে ‘সাগরপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া’ গমন ঠেকাতে এগিয়ে আসতে বলে। ভ্রমণপিপাসু বন্ধুদের কাল্পনিক এই ঘটনার মতো আমরা কি মোবাইলের মেসেজের ওপর নির্ভর করে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারি? মোবাইল ফোনে আমরা খুবই ব্যক্তিগত পরিসরে, আন্তরিক শব্দ ও হাস্যরসে এমন অনেক কথাই বলি, শেয়ার করি যা আমরা পাবলিক করতে চাই না। কথা হচ্ছে মানুষ তাদের ব্যক্তিগত পরিসরে কথা বলতে নানা ধরনের পরিভাষা, ইঙ্গিত ব্যবহার করে, যা অন্যদের কাছে একই সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক, এমনকি যথেষ্ট শোভন নাও মনে হতে পারে; কিন্তু তা তো অপরাধ নয়।
রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বিশেষ করে সরকারবিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি করা; গ্রেপ্তার করা; সন্দেহভাজন কাউকে ৫৪ ধারায় আটক করা এমনকি বিরোধী মতের লোকজনের ওপর লাঠিপেটা করাও পুলিশের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। আবার পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়ে মাদক মামলার আসামি করার অভিযোগও আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার চেক করার মতো ঘটনার খবরও আমাদের পড়তে হলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস ১০ ডিসেম্বরের দুই দিন বাকি থাকতে, ঢাকায় বিএনপির বিভাগীয় মহাবেশকে কেন্দ্র করে ‘নিরাপত্তার’ প্রশ্নে! এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে না।
১৯৪৮ সালে ঘোষিত জাতিসংঘ মানবাধিকার ঘোষণার ১২ নম্বর আর্টিকেলে বলা হয়েছে, ‘কারও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কিংবা তার গৃহ, পরিবার ও চিঠিপত্রের ব্যাপারে খেয়ালখুশিমতো হস্তক্ষেপ কিংবা তার সুনাম ও সম্মানের ওপর আঘাত করা চলবে না। এ ধরনের হস্তক্ষেপ বা আঘাতের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।’ বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনতা রক্ষার অধিকার থাকিবে।’ এখানে যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের মধ্যে টেলিফোন, মোবাইল ফোন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। তার মানে কারও মোবাইল ফোনের গোপনীয়তার সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে বলা হতে পারে যে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার স্বার্থে ফোনের মেসেজ চেক করা হচ্ছে। কিন্তু তাতেই কি এটা বৈধ হয়ে যায়? সভ্য কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রে কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য একজন নাগরিকের মোবাইল ফোন চেক করতে পারে, যতক্ষণ না তার বিরুদ্ধে বড় কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় কিংবা তাকে বড় কোনো অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্দেহ করে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হয়?
গত বছর ফোনালাপ ফাঁস নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছিল। ফোনে আড়িপাতা এবং ফোনালাপ প্রকাশ (ফাঁস) নিয়ে দেশের কোনো আইনে সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই। টেলিযোগাযোগ আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে, নিরাপত্তা সংস্থা তদন্তের ও মামলার স্বার্থে কারও ফোনালাপ চাইলে টেলিফোন সেবাদাতা সংস্থা তাদের সব রকমের তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে; কিন্তু তারা কারও ফোনে আড়িপাততে পারবেসে বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। প্রশ্ন উঠেছিল, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রসঙ্গ ছাড়া কারও ফোনকল রেকর্ড করা এবং সেই ফোনকল ফাঁস করে দেওয়া ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন কি না? রাস্তায় দাঁড় করিয়ে পুলিশ যদি নাগরিকদের হাত থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ বা অন্য কোনো টেক্সট, ছবি বা ভিডিও চেক করে যেখানে একজন নাগরিকের খুব ব্যক্তিগত কোনো জিনিসও থাকতে পারে রাষ্ট্রের সংবিধান, আইন বা নীতি কি সেটাকে সমর্থন করবে?
বাংলাদেশ নারী জাতীয় ফুটবল দলের রক্ষণভাগের অন্যতম সেরা আঁখি খাতুন। সেই ছোট থেকেই গড়ন, উচ্চতা ও লড়াকু ফুটবল দিয়ে আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন। মেয়েদের ফুটবলে বাংলাদেশের প্রায় সব সাফল্যেই ছিলেন অগ্রনায়ক হয়ে। সম্প্রতি তিনিও জাতীয় দলের ক্যাম্প ছেড়েছেন। তবে সতীর্থ সিরাত জাহান স্বপ্নার মতো অবসরের সিদ্ধান্ত নেননি। বরং নিজেকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাফুফের বন্দী জীবনকে বিদায় জানিয়েছেন।
সম্প্রতি চীনের বন্দরনগরী হাইকোউ শহরের একটি ফুটবল অ্যাকাডেমিতে খেলার পাশাপাশি পড়ালেখার প্রস্তাব পেয়েছেন আঁখি। এখন চলছে চীনের ভিসা নেওয়ার প্রক্রিয়া। সবকিছু ঠিক থাকলে আসছে ঈদের পর দেশ ছাড়বেন তিনি। বিষয়টি দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেছেন আঁখি।
তিনি যে আর দশজন ফুটবলারের মতো নন, তা আগেই বুঝিয়েছেন আঁখি। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়ের পর বিশ্ব ফুটবলের নজর কাড়েন দীর্ঘদেহী এই ডিফেন্ডার। তার নির্ভীক ফুটবল বড্ড মনে ধরে সুইডেনের শীর্ষ লিগের একটি ক্লাবের। সাফে বাংলাদেশ মাত্র একটি গোল হজম করেছিল।
এই কৃতিত্বের বড় দাবীদার সেন্টারব্যাক আঁখি। তাই সুইডিশ ক্লাবটি তাকে দলে নেওয়ার প্রস্তাবও দেয়। প্রথম নারী ফুটবলার হিসেবে ইউরোপের কোন দেশের শীর্ষ লিগে খেলার প্রস্তাবে আঁখি দেখতে শুরু করেছিলেন বড় মঞ্চে নিজেকে প্রমাণের স্বপ্ন। তবে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের হঠকারি সিদ্ধান্তে সুইডেনে খেলতে যাওয়া হয়নি। জাতীয় দলের খেলা থাকবে বলে সুইডেনের দরজা বন্ধ করে দেয় বাফুফে। পরে অবশ্য অর্থ সঙ্কটসহ নানা অযুহাতে জাতীয় দলকে সিঙ্গাপুরে ফিফা ফ্রেন্ডলি ও মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাইপর্ব খেলতে পাঠানো হয়নি।
বিষয়টা ভীষণ কষ্ট দিয়েছিল সদ্য এইচএসসি পাস করা আঁখিকে। অভিমানে কিছুদিন ক্যাম্প ছেড়েও চলে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য ক্যাম্পে যোগ দেন। তবে হতাশা একটুও কমেনি। দিনের পর দিন লক্ষ্যহীণ পথ চলতে কারই বা ভালো লাগে? দেশের ফুটবলের যে ভবিষ্যত নেই ঢের বুঝতে পেরেছিলেন। তাই চীনের প্রস্তাবটাকে লুফে নেন আঁখি।
দেশ রূপান্তরের কাছে ক্যাম্প ছাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, 'আমি ওখান থেকে চলে এসেছি ঠিক, তবে ফুটবলেই থাকবো। চীনে ভাল অ্যাকাডেমিতে অনুশীলন ও লিগ খেলার সুযোগ পাচ্ছি। তাই ওইখানে যাবো। এখন ভিসা নিয়ে কাজ করছি। আমার জন্য দোয়া করবেন।'
গত ফেব্রুয়ারিতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৪.৫০ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন সিরাজগঞ্জের গর্ব আঁখি। দেশে সুযোগ ছিল বেসরকারী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। তবে তিনি যে স্বপ্ন বুনেছেন চীনে লেখাপড়া করার, ‘মূলত আমি ওখানে পড়াশোনা ও খেলা এক সঙ্গে করবো। এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। তবে ভর্তি হইনি।’
তার এই সিদ্ধান্ত বাফুফেকে জানিয়েই নেওয়া। তবে জাতীয় দলের প্রয়োজনে যেখানেই থাকেন না কেন, চলে আসবেন, 'আমি পল স্যারকে (বাফুফের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলি) জানিয়েই ক্যাম্প ছেড়েছি। তাকে এটাও বলেছি আমি যেখানেই থাকি, জাতীয় দলের প্রয়োজন হলে চলে আসবো।'
সম্প্রতি মেয়েদের ক্যাম্পে লেগেছে দ্রোহের আগুন। তিনদিন আগে অভিমানে অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের অন্যতম স্ট্রাইকার স্বপ্না। একই দিনে মেয়েদের ফুটবলের সকল সাফল্যের রূপকার অভিজ্ঞ কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। মূলত বাফুফের গঞ্জনার শিকার হয়েই ছোটনের এই সিদ্ধান্ত। তাতেই হুলস্থুল লেগে গেছে ফুটবল অঙ্গনে। সালাউদ্দিন-কিরণের হাতে বন্দী নারী ফুটবল নিয়ে উঠেছে সমালোচনার ঝড়। প্রিয় কোচ ছোটনের জন্য ভীষণ মন খারাপ আঁখির, 'সত্যি খুব খারাপ লাগছে স্যারের সরে যাওয়ার কথা শুনে।'
তাকে সুইডেনে খেলতে যেতে দেওয়া হয়নি। স্বপ্নাকেও ভারতের লোভনীয় প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। আঁখি অবশ্য এই অপ্রিয় বিষয়গুলো এড়িয়েই যেতে চাইলেন। শুধু বলেছেন, 'স্বপ্না আপুর ভারতে খেলার সুযোগ ছিল। তার সঙ্গে কী হয়েছে, সেটা সবার জানা। আমার সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটেছে।'
শেষটায় আঁখি যা বলেছেন, তা দিয়েই নারী ফুটবলের ভেতরের চিত্রটা ফুটে উঠেছে। তারা দেশকে অসংখ্য সাফল্য এনে দিয়েছেন। গোটা দেশের কাছে তারা একেকজন খেলার মাঠের বীর সেনানী। তবে তাতে তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। বাফুফের চতুর্থ তলায় গাদাগাদি করে থাকতে হয়। মাস শেষে জুটে নামকোয়াস্তে পারিশ্রমিক। সেটা বাড়ানোর দাবী করলেই নাম কাটা যায় গুডবুক থেকে। আঁখির কথায়, 'ভাইয়া, আমরা তো মেয়ে। আর কত কষ্ট করবো যদি ঠিকভাবে পারিশ্রমিকই না পাই?'
দক্ষিণ এশিয়ার সেরা দল হওয়ার পরও আঁখিদের আকাশ ঢেকে আছে নিকশ কালো অন্ধকারে। এর দায় কী এড়াতে পারবেন, বছরের পর বছর মসনদ আঁকড়ে রাখা ফুটবল কর্তারা?
হার দিয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শেষ করলো চ্যাম্পিয়ন ম্যানচেস্টার সিটি। অন্যদিকে ৫-০ গোলের দাপুটে জয়ে শেষ করেছে দ্বিতীয় স্থানের আর্সেনাল। জিতেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। আর ৪-৪ গোলে ড্র করেছে লিভারপুল। সাউদাম্পটনের অবনমন আগেই নিশ্চিত হয়েছিল। রবিবার তাদের সঙ্গে নেমে গেছে লিস্টার ও লিডস। লিডস ১-৪ গোলে হেরে গেছে টটেনহ্যাম হটস্পারের কাছে। আর ২-১ গোলে ওয়েস্টহ্যামকে হারিয়েও লাভ হয়নি লিস্টারের। বেন্টফোর্ডের মাঠে হালান্ড-গুনদোয়ানসহ প্রথমসারির কয়েকজনকে খেলানইনি পেপ গার্দিওলা। সামনে ছিলেন আলভারেজ, মাহরেজ, তাদের পেছেন ফোডেন। ৮৫ মিনিট পর্যন্ত অরক্ষিত রেখেছিল সিটি তাদের গোল। ঠিক ওই সময়ে ব্রেন্টফোর্ডের ইথান পিনোক। পঞ্চম হার দিয়ে লিগ শেষ করে সিটি।
নগর প্রতিদ্বন্দ্বি ম্যানইউ ঘরের মাঠে জেডন সানচো ও ব্রুনো ফার্নান্দেজের দ্বিতীয়ার্ধের দুগোলে ফুলহ্যামকে হারিয়ে তৃতীয় হয়েছে। চেলসির সঙ্গে নিউক্যাসলে ১-১ গোলে ড্র করায় চতুর্থ স্থান নিয়ে শেষ করলো সৌদি যুবরাজের মালিকানধীন নিউক্যাসল। সাউদাম্পটনের সঙ্গে ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েও একপর্যায়ে ৪-২ গোলে পিছিয়ে পড়ে হারের শঙ্কায় পড়েছিল লিভারপুল। ৭২ ও ৭৩ মিনিটে কোডি গাকপো ও ডিয়েগো জোতার গোল ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়ে ইয়ুর্গেন ক্লপের শিষ্যরা। ৬৭ পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চম হয়েছে লিভারপুল। ব্রাইটন হয়েছে ষষ্ঠ। ঘরে মাঠে জাকার দুই ও সাকার এক গোলে উলভসের বিপক্ষে প্রথমার্ধেই ৩-০তে এগিয়ে যায় গানার্সরা। দ্বিতীয়ার্ধে জেসুস ও কিইয়োর আরো দুই গোল করলে বড় জয়ের স্বস্তিতে মৌসুম শেষ করে একসময় শিরোপা লড়াইয়ে থাকা আর্সেনাল।
নতুন পে-স্কেল কিংবা মহার্ঘ ভাতা নয়, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়বে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট অনুযায়ী। তাদের বেতন প্রতি বছর যতটা বাড়ার কথা এবার তার চেয়ে বেশি বাড়বে। আর তা চলতি বছরের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়ানো হবে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট ৫ শতাংশের বাইরে বাড়ানো হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত প্রায় এক বছর ধরে দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের বেশিরভাগের একমাত্র আয় বেতন-ভাতা। বৈশি^ক মন্দার কারণে সরকারও খানিকটা সংকটে আছে। এ পরিস্থিতিতে পে-স্কেল দেওয়ার মতো বড় ধরনের ব্যয় বাড়ানো সরকারের পক্ষে কঠিন হবে। ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হলে সরকারের ওপর চাপ বেশি হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সরকারি কর্মরতদের খানিকটা স্বস্তি দিতে কোন খাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় এমন প্রস্তাব চাওয়া হয়। একই সঙ্গে বাজেটবিষয়ক বিভিন্ন বৈঠকে সরকারি নীতিনির্ধারকরাও এ বিষয়ে আলোচনা করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই-বাছাই করে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করে। চলতি মাসে গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী এ বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী ওই বৈঠকে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে কত বাড়তি ব্যয় হবে তা হিসাব করে পরের বৈঠকে উপস্থাপন করতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বড় ধরনের ব্যয় না বাড়িয়ে একটা উপায় বের করতেও বলেন। শেষ পর্যন্ত ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যা চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে নিজেই জানিয়েছেন।
বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা ২০১৫ সালের বেতন কমিশন অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এ বেতন কমিশন প্রণীত হয়েছিল। এ কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, আর নতুন বেতন কমিশন গঠন করা হবে না। প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট বা বেতন বাড়ানো হবে। এ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তা হয়ে আসছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি হিসাব অনুযায়ী, দেশে সরকারি কর্মচারী ১৪ লাখ। বিভিন্ন করপোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিয়ে হিসাব করলে প্রায় ২২ লাখ।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে নিয়মিত ইনক্রিমেন্টের বাইরে আরও কতটা বাড়ানো যায় তা হিসাব করে নির্ধারণ করা হবে। এ কাজ করতে বাজেট প্রস্তাব পেশ করার পর আলাদা কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে যাচাই-বাছাই শেষে ইনক্রিমেন্টের হার সুপারিশ করবে। এ ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে বিদ্যমান ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে প্রতি মাসে বেতন বাড়ানো হবে, নাকি গড় মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে ইনক্রিমেন্টের হার বাড়ানো হবে, তা খতিয়ে দেখা হবে। ২০তম গ্রেড থেকে প্রথম গ্রেড পর্যন্ত সবার জন্য একই হারে বেতন বাড়নো হবে কি না, তা আরও খতিয়ে দেখা হবে। চূড়ান্ত হিসাব অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে প্রকাশ করা হবে। যে তারিখেই প্রকাশ করা হোক না কেন, আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকরী ধরা হবে।
এখানে মহার্ঘ ভাতা ১০ শতাংশ দেওয়া হলে এ হিসাবে ৪ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। ১৫ শতাংশ দেওয়া হলে ৬ হাজার কোটি এবং ২০ শতাংশ দেওয়া হলে ৮ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। অর্থাৎ মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে আগামী অর্থবছরে সরকারের ব্যয় বাড়বে। আর এতে সরকার ব্যয় কমিয়েও সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তুষ্টিতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো পথে হেঁটেছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতা বাবদ রাখা হয়েছে ছিল ৭৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। খরচ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ১ হাজার ৯৩ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা বাজেট হওয়ার কথা আছে। এ বাজেট সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতার জন্য বরাদ্দ ৭৭ হাজার কোটি টাকা রাখা হতে পারে। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেক পদ এখনো খালি আছে। এতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো হলেও সরকারের ব্যয়ে বড় ধরনের চাপ বাড়বে না।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন জায়েদা খাতুন।
তিনি ঘড়ি প্রতীকে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাতে রির্টানিং কর্মকর্তা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
নির্বাচনের অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ ৭ হাজার ২০৬ ভোট, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন-অর-রশীদ ২ হাজার ৪২৬ ভোট এবং হাতি প্রতীকের সরকার শাহনূর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) নির্মিত হয়েছে বিশেষ কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘ও ভোরের পাখি’। ঈমাম হোসাইনের প্রযোজনায় এটি উপস্থাপনা করেছেন তামান্ন তিথি। অনুষ্ঠানটিতে আবৃত্তি করেছেন আশরাফুল আলম, মীর বরকত, রফিকুল ইসলাম, পলি পারভিন, শাকিলা মতিন মৃদুলা, মাসকুর-এ সাত্তার কল্লোল, আসলাম শিশির, সংগীতা চৌধুরী, আহসান উল্লাহ তমাল। প্রচারিত হয় ২৫ মে সকাল সাড়ে ৯টায়।
এছাড়াও নির্মিত হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘আমারে দেবো না ভুলিতে’। অনুষ্ঠানটিতে গান, কবিতা ও আলোচনার সমন্বয়ে কবিকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও বাচিকশিল্পীদের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। ইয়াসমিন মুসতারী, সালাউদ্দিন আহমেদ, শেলু বড়ুয়া, ছন্দা চক্রবর্ত্তী ও ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছেন প্রফেসর মুন্সী আবু সাইফ। মনিরুল হাসানের প্রযোজনায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছে ২৫ মে দুপুর ১ টা ০৫ মিনিটে। আরও প্রচারিত হবে সংগীতানুষ্ঠান ‘দোলনচাঁপা’ ও ‘সন্ধ্যামালতী’। রাত ৯টায় প্রচারিত হবে নাটক ‘বনের পাপিয়া’ (পুনপ্রচার)।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোট শেষ হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এখন পর্যন্ত ৪৫০টি কেন্দ্রের প্রাথমিক ফল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নৌকা প্রতীকে আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩৭৯ ভোট এবং টেবিলঘড়ি প্রতীকে জায়েদা খাতুন পেয়েছেন ২ লাখ ৫ হাজার ৪১৩ ভোট।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
গাজীপুর সিটিতে মেয়র পদে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা খান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের মধ্যে। দুজনই জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। অপরদিকে ভোটের পরিবেশ ভালো বলে জানান আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহনূর ইসলাম রনি।
কোটা পদ্ধতি তুলে দেওয়ার পরও বিসিএস পরীক্ষায় নারীদের চাকরি পাওয়ার হার প্রায় একই রয়েছে। ১০ শতাংশ কোটা থাকা অবস্থায় তারা যে পরিমাণ চাকরি পাচ্ছিলেন, কোটা তুলে দেওয়ার পরও প্রায় একই হারে চাকরি পাচ্ছেন। সাধারণ ক্যাডার বা কারিগরি ক্যাডারে পিছিয়ে পড়লেও শিক্ষার মতো পেশাগত ক্যাডারগুলোতে এগিয়ে গিয়ে বিসিএসে মোট চাকরি পাওয়ার হারে প্রায় একই অবস্থান ধরে রেখেছেন নারীরা।
অথচ কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় বলা হয়েছিল, কোটা তুলে দিলে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। প্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণের গ্রাফ নিম্নমুখী হবে। আসলে তা হয়নি। কোটা তুলে দেওয়ার পরও তারা প্রায় সমানতালে এগিয়ে চলছেন।
৪০তম বিসিএস দিয়ে চাকরিতে ঢুকে বর্তমানে ঢাকা বিভাগে কর্মরত একজন নারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে বয়সে ছেলেরা চাকরির জন্য প্রতিযোগিতা করে সেই বয়সে অধিকাংশ নারীকেই বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করতে হয়। সংসার করে, সন্তান লালনপালন করে নারীরা ভালো প্রস্তুতি নিতে পারে না। ফলে অনেক মেধাবী নারী প্রতিযোগিতায় উতরে যেতে পারেন না। অনেক নারী পারিবারিক কারণে বিয়ের পর চাকরির আবেদনই করেন না। বিয়ের পর পরীক্ষায় অংশ নিতে বাধা আসে। এসব কাটিয়ে উঠে চাকরিতে প্রবেশ করা কঠিন। আর বিসিএসের চাকরি মানেই বদলিযোগ্য। সংসার-সন্তান রেখে বদলিকৃত পদে যোগ দেওয়া কঠিন বিষয়। সবকিছু মিলিয়ে নারীদের জন্য এ চাকরি সহজ নয়। একজন পুরুষ বেকার নারী বিয়ে করে, কিন্তু একজন নারী বেকার পুরুষ বিয়ে করে না। এ বিষয়টাও ছেলেদের প্রস্তুত হতে সাহায্য করে। এ বাস্তবতা থেকেও পুরুষ প্রতিযোগী বেশি হয়। অন্যদিকে যোগ্য হলেও অনেক নারী প্রতিযোগিতাই করে না।
একজন নারী ইউএনও বলেন, পরীক্ষার হলে বা মৌখিক পরীক্ষার সময় অনেক নারীকে দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে সঙ্গে আনতে হয়। এগুলোও অনেক সময় নারীকে চাকরির ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে। ঘরে ঘরে বাধা পায় নারীর অগ্রযাত্রার নানা চেষ্টা। নগর-জীবনে নারীর অস্তিত্ব অনেকটা স্বচ্ছন্দের। কিন্তু নগরসভ্যতার বাইরে বিশাল বিস্তৃত গ্রামীণ জনজীবনে পুরুষতন্ত্রের নানা ধরনের অনাকাক্সিক্ষত বেষ্টনী এখনো নারীকে ধরাশায়ী করে রাখে। হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথ হাঁটছে নারী-পুরুষ। তবু তাদের মধ্যে ভারসাম্য নেই।
কোটা না থাকার পরও নারীরা তাদের অবস্থান কীভাবে ধরে রাখলেন জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নারী শিক্ষায় বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। প্রাথমিকের পর মাধ্যমিকেও মেয়েরা অনেক এগিয়েছে। উচ্চশিক্ষায়ও মেয়েদের অংশগ্রহণের হার বেড়েছে। সবকিছু মিলে বিসিএসে এর প্রতিফল ঘটেছে। যে পরিমাণ মেয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে, সেই তুলনায় চাকরিতে প্রবেশের হার বেশি। উচ্চশিক্ষায় যায় হয়তো ৮০ ভাগ ছেলে। আর মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার হার ৩০ বা ৩৫ শতাংশ। তাদের মধ্যে ২৬ বা ২৭ শতাংশ মেয়ে বিসিএস দিয়ে চাকরি পাচ্ছে। এদিক দিয়ে চিন্তা করলে মেয়েরা অনেক ভালো করছে।’
এক প্রশ্নের জবাব ড. ইমতিয়াজ বলেন, ‘মেয়েদের কাছে শিক্ষা এখনো অপরচুনিটি (সুযোগ) আর ছেলেদের কাছে অধিকার। মেয়েরা যখন এ সুযোগটা পায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা কাজে লাগাতে চায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরিবারের ছেলেসন্তানের জন্য যে বিনিয়োগ, মেয়েসন্তানের জন্য এখনো তার চেয়ে অনেক কম। এখনো মনে করা হয় মেয়ে তো অন্যের ঘরে চলে যাবে। অথচ মজার বিষয় হচ্ছে, পরিবারের দায়িত্ব উচ্চশিক্ষিত ছেলের তুলনায় উচ্চশিক্ষিত মেয়ে অনেক বেশি বহন করে। এসব প্রতিবন্ধকতা হাজার বছরে তৈরি হয়েছে। এগুলো দূর হতে আরও সময় লাগবে।’
অন্যান্য কোটার মতো প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা ছিল। নারীরা যোগ্যতা অনুযায়ী মেধা কোটায়ও নিয়োগ পেতেন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে মেধাভিত্তিক জেলা কোটার পাশাপাশি ১৫ শতাংশ নারী কোটা রয়েছে এখনো। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক জেলা কোটার পাশাপাশি ৬০ শতাংশ নারী কোটা সংরক্ষিত রেখে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে নারীরা সরকারি চাকরিতে পুরুষ প্রার্থীর সঙ্গে মেধা কোটায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিয়োগ লাভের পাশাপাশি সংরক্ষিত কোটায়ও নিয়োগ লাভের সুবিধা পেয়ে থাকেন।
শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে ছাত্রীর হার বাড়ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এক দশকের বেশি সময় ধরে ছাত্রের চেয়ে ছাত্রীর হার বেশি। কলেজ পর্যায়ে ছাত্র ও ছাত্রীর হার প্রায় সমান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর হার ৩৬ শতাংশের বেশি।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে সরকার। ৪০তম সাধারণ বিসিএস হচ্ছে কোটামুক্ত প্রথম বিসিএস। ধাপে ধাপে বাছাই করে গত বছর ৩০ মার্চ এই বিসিএসের চূড়ান্ত সুপারিশ করে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। প্রায় ১৩ মাস পর গত মাসে সেই সুপারিশের বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে পিএসসি। সেখানে বলা হয়েছে, ৪০তম বিসিএসে মোট ২৬ দশমিক ০৩ শতাংশ নারী চূড়ান্তভাবে সুপারিশ পেয়েছেন। যা কোটাযুক্ত ৩৮তম বিসিএসে ২৬ দশমিক ৯১ ও ৩৭তমে ২৪ দশমিক ৬০ শতাংশ ছিল। গত ১ নভেম্বর এ বিসিএসের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দিয়েছেন।
পিএসসির একজন সাবেক চেয়ারম্যান বলেছেন, কোটামুক্ত একটি সাধারণ বিসিএসে ২৬ দশমিক ০৩ শতাংশ নারী চূড়ান্তভাবে সুপারিশ পেয়েছেন এটা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নারীদের শক্ত সক্ষমতা প্রকাশ করে। কারণ এর আগে কোটাযুক্ত ৩৮তম বিসিএসের তুলনায় মাত্র দশমিক ৮৮ শতাংশ কম। অর্থাৎ কোটা তুলে দেওয়ার পরও নারীরা ১ শতাংশও পিছিয়ে পড়েননি। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, প্রত্যেক বিসিএসে নারীদের আবেদনের হার অর্থাৎ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের হার পুরুষের তুলনায় কম অর্থাৎ গড় হার কম। পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতেও নারী প্রার্থীদের পুরুষের তুলনায় অনেক কম চোখে পড়ে। এমনকি কোনো কোনো কক্ষে নারী প্রার্থী থাকেই না। একই সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ধাপগুলো অতিক্রম করার ক্ষেত্রে নারীদের অনুত্তীর্ণ হওয়ার পরিমাণ বেশি থাকে। ৪০তম বিসিএসে যোগ্য আবেদনকারী নারী ছিলেন ৩৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তাদের মধ্যে ১৯ দশমিক ১৯ শতাংশ নারী প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হন। অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র। যোগ্য আবেদনকারী পুরুষ ছিলেন ৬১ দশমিক ৬২ শতাংশ। প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ পুরুষের হার ৮০ দশমিক ৮১ শতাংশ।
৪০তম বিসিএসের সাধারণ ক্যাডারে ২১ দশমিক ০৮ শতাংশ নারী সুপারিশ পেয়েছেন। এই হার ৩৮ ও ৩৭তম বিসিএসে ছিল যথাক্রমে ২৪ দশমিক ১৪ ও ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
৪০তম বিসিএসের কারিগরি ক্যাডারে ২৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ নারী সুপারিশ পেয়েছেন। এই হার ৩৮ ও ৩৭তম বিসিএসে ছিল যথাক্রমে ২৯ দশমিক ৫৩ ও ২৫ দশমিক ২ শতাংশ।
সাধারণ এবং কারিগরি ক্যাডারে নারীরা পিছিয়ে পড়লেও শিক্ষার মতো পেশাগত ক্যাডারে এগিয়েছেন। ৪০তম বিসিএসে ২৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ নারী সুপারিশ পেয়েছেন। যা ৩৮তমে ২৬ দশমিক ৩০ এবং ৩৭তমে ২৫ দশমিক ২ শতাংশ ছিল।
পুরোপুরি মেধার ভিত্তিতে নেওয়া ৪০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারেও নারীরা পিছিয়েছেন। জেলা কোটাও না থাকায় নাটোর, ভোলা, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি থেকে প্রশাসন ক্যাডারে কেউ সুপারিশ পাননি।
গত বছর প্রকাশিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি চাকরিজীবীদের তথ্যসংক্রান্ত ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস’ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সিভিল প্রশাসনের ১৪ লাখ সরকারি কর্মচারীর মধ্যে ২৬ শতাংশ নারী। সরকারি দপ্তরের মধ্যে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করেন সবচেয়ে কমসংখ্যক নারী। মন্ত্রণালয়ের মোট জনবলের ১৯, অধিদপ্তরের ৩১, বিভাগীয় কমিশনার ও ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয়ের ১২ এবং আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ১২ শতাংশ কর্মী নারী।