
যে কোনো সমাজে বসবাস করাই একটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। নিজ, পরিবার ও সমাজকে নিয়ে ভাবাই রাজনীতি। সার্বিকভাবে কোনো সমাজে মানুষের সার্বিক অগ্রগতির প্রচেষ্টাই হচ্ছে সেই সমাজের রাজনীতির মোদ্দা কথা। তবে উন্নতি ও অগ্রগতি সবসময়ই আপেক্ষিক। এসব স্থান, কাল ও পাত্রের আলোকে বিবেচিত হয়। এর যেমন বস্তুগত দিক রয়েছে একই সঙ্গে রয়েছে নৈতিক প্রেক্ষাপট যেটা আচার-আচরণের সঙ্গে যুক্ত। অনেক সময় কোনো সমাজের বেশিরভাগ মানুষের আচার-ব্যবহার সেই সমাজের মধ্যকার বৈষম্য সৃষ্টির জন্য দায়ী। সমাজের কেউ কেউ মনে করেন সামাজিক ব্যবহারবিধির ভিত্তি হওয়া উচিত ইতিমধ্যে স্বীকৃত কোনো মোরাল কোড এবং অবশ্যই এর ভিন্ন কিছু নয়। যদিও বস্তুগত সংস্কৃতি ও ব্যবহারবিধি দুটিই পরিবর্তনশীল এবং একে অপরের সঙ্গে যুক্ত ও একে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত। অন্যদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাইরের প্রভাবে বিশেষ করে প্রযুক্তির ব্যবহার ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্বারা ব্যবহারবিধি পরিবর্তিত হয়ে থাকে। তবে নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই হচ্ছে মূল চালিকাশক্তি। কারণ এই সমাজে কোনো একটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ছাড়া টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। যদিও হয় তা অনুগ্রহ নির্ভর এবং তাতে সামাজিক ক্ষমতা কাঠামোতে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। যেমন আমাদের সমাজের বেশিরভাগ নারী সারা দিন গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এর কোনো অর্থনৈতিক মূল্যায়ন না থাকার কারণে তাদের অবস্থান ক্ষমতা কাঠামোর নিম্ন স্তরে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এটাও কি রাজনীতির অংশ? কেন না? অর্থনৈতিক কাঠামো যদি রাজনীতির অংশ হয় তাহলে এর সম্পর্ক নির্ভর ক্ষমতাকাঠামোর সবকিছু রাজনীতিরই অংশ।
রাজনীতিকে আমরা যেভাবেই দেখি না কেন, এতে একটি বৃহত্তর ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষমতা সম্পর্কযুক্ত থাকে আর এর সহজাত জটিলতার কারণেই সহজে একে ব্যাখ্যা করা কঠিন। রাজনীতির মাধ্যমে সামাজিক অগ্রগতির একটি সহজ ব্যাখ্যা হতে পারে এই ক্ষমতা সম্পর্কগুলোর মধ্যে ভারসাম্যমূলক পরিবর্তন এবং সব ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার অন্তর্ভুক্তিমূলক বিকল্প সমাধান। রক্ষণশীল রাজনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে বর্তমান বা সাবেকি ধারণার চাষবাস এবং সেটাকে ক্রমাগত শুদ্ধতার মাপকাঠিতে দেখা, আপাতদৃষ্টিতে যার কোনো চূড়ান্ত পরিসীমা নেই। বিপরীতে, প্রগতিশীল রাজনীতির মূল বিষয় হচ্ছে নতুন চর্চা ও ব্যবস্থাকে আহ্বান করা, যার সবকিছু নিজস্ব হওয়ার ব্যবস্থা নেই, তবে নিজস্ব ভাবধারার আলোকে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুযোগ আছে।
আজকের দিনে আমরা অনেকেই সাধারণ জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিস্পৃহতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকি। প্রচলিত অভিযোগ যে, এখন আমরা অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক এবং এখানে সমাজ নিয়ে ভাববার অবকাশ নেই। তাই সামাজিক সমস্যা সমাধানে সামষ্টিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আজকের দুনিয়ার সামাজিক সমস্যা সমাধান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেন্দ্রিক এবং অনেকটাই প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল। বেশিরভাগ মানুষই যেহেতু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত তাই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইতিমধ্যে তাদের অংশগ্রহণ যে আছে তা বলাই বাহুল্য; তা হোক প্রান্তে বা কেন্দ্রে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ক্ষমতার প্রান্তে যারা আছে তাদের আমরা সত্যিকার অর্থে কেন্দ্রে আনতে চাই কি না?
আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাজনীতি প্রথাগত কেতাবি রাজনীতি থেকে যে ভিন্ন তা সহজেই অনুমেয়। এখানে রাজনীতির একটি বড় ইস্যু হচ্ছে প্রচলিত ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা ও পাশাপাশি ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখানো। তবে এই সময়ের রাজনীতির বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে প্রচলিত ক্ষমতা সম্পর্কে পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হওয়া। অন্যকথায় সমান্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, ক্ষমতার চর্চা ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ বা সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি নিশ্চিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। আর এই ধরনের সামন্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মাঝে মাঝে বা একটি নির্দিষ্ট বিরতিতে পাত্র-পাত্রীর পরিবর্তন হলেও ব্যবস্থাপনাগত পরিবর্তন হয় না, সেখানে কাঠামোগত অগ্রগতির লক্ষ্য অর্জন একটি দুরূহ বিষয়।
আর রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের বিষয়টি এখানেই যেন থমকে গেছে। সাধারণ মানুষ এখান থেকে নতুন কিছু পাচ্ছে না, যেমন পাচ্ছে না বিকল্প উন্নয়ন মডেলের প্রস্তাবনা যা নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে সক্ষম। অন্যথায় সাধারণ জনগণ কেন ব্যবস্থা ঠিক রেখে শুধু পাত্র-পাত্রী পরিবর্তনের হাতিয়ার হবে যদি না এতে তাদের ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া জোরদার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এক্ষেত্রে রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনে প্রতিশ্রুতির কোনো বিকল্প নেই এবং এ সংশ্লিষ্ট প্রতিটি উদ্যোগই প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারে। বিশ্বাসযোগ্য ও আস্থার পরিবেশ তৈরি ও চর্চা ছাড়া শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ কামনা নিছক আবদারের পর্যায়ে পড়ে। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রচলিত আচরণবিধি ও প্রথাগত নৈতিকতার দোহাই দিয়ে জনগণকে সংগঠিত করার চেষ্টা থাকছে সেক্ষেত্রে মানুষকে সাময়িক উদ্বুদ্ধ করতে পারলেও সংকীর্ণ গোষ্ঠীগত স্বার্থের বাস্তবতায় দীর্ঘমেয়াদে সাধারণ জনগণ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতে পারে না। প্রচলিত রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্টই তাদের এই প্রক্রিয়া থেকে বের করে দেয়।
এই অবস্থায় সাধারণ জনগণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে এবং তাদের মাধ্যমে ক্ষমতাকেন্দ্রিক চর্চার পরিবর্তন করতে চাইলে তাদের বঞ্চনাগুলোকে রাজনীতির সামনে নিয়ে আসতে হবে এবং পাশাপাশি রাজনীতিকে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে উদ্ধার করাটাও আবশ্যক। বর্তমান এই রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় এবং জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে কি এরকম কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে যেখানে জনগণ কাঠামোগত পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতে পারে? সত্যিকার অর্থে তারা কি এমন কোনো কর্মসূচি জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছে যে কর্মসূচি ক্ষমতাবান ও সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যকার ব্যবধান বা পার্থক্য কমিয়ে আনতে চায়, ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো বিকেন্দ্রীকরণ করতে চায়? বা প্রকৃতপক্ষেই সমস্যার সমাধান করতে চায়? তারা কি জাতিকে এমন একটি সমাজ কাঠামোর স্বপ্ন দেখাচ্ছে যা বিভেদ ও বিদ্বেষকে দূরে ঠেলে দিয়ে সমতা ও সাম্যের বার্তা সামনে নিয়ে আসছে?
প্রথাগত রাজনীতিতে শুধু পক্ষ বা বিপক্ষ সমর্থন করা আমাদের দেশের রাজনীতির একটি বড় সীমাবদ্ধতা। কারণ শুধু এই পক্ষ-বিপক্ষ চর্চার মাধ্যমে নতুন পথের সন্ধান তো পাওয়া যায়ই না, বরঞ্চ সজ্ঞানে একই ভুল বারবার করা। ভুল জেনেও পুরনো পথকে সমর্থন করতে বাধ্য হওয়া। এ যেন একই চক্রে বারবার ঘুরপাক খাওয়া, যে চক্রের প্রান্তে সাধারণ জনগণ আর কেন্দ্রে ঘুরেফিরে প্রায় সেই তথাকথিত একই শক্তি। তাই সাধারণভাবে রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণের নিস্পৃহতার দায় সাধারণের নয়, বরঞ্চ এখানো যারা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন তাদেরই। জনগণকে তারা কতটুকু আস্থায় নিয়ে আসতে পারছেন সেটাই মুখ্য। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না প্রগতিশীলতা ও পরিবর্তনকামিতা ছাড়া যে রাজনীতি সেটা সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। এই পরিবর্তন শুধু পাত্র-পাত্রীর পরিবর্তন না এই পরিবর্তন হচ্ছে ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোর পরিবর্তন যা সবসময় গণমানুষের পক্ষে ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
লেখক : উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। শিক্ষাবিদ, লেখক ও বুদ্ধিজীবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন চার দশকের বেশি সময়। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে (ইউল্যাব) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বিষয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : বায়ান্নতে পা দিল বাংলাদেশদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : গত ৫১ বছরে আমাদের অর্থনীতিতে দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ির অবস্থান থেকে আমরা এখন দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় শক্তিশালী অর্থনীতি। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কভিড সংকটের সময়েও ৭ শতাংশের ধারেকাছে ছিল। গত দেড় দশক এই উন্নতি দ্রুত হয়েছে, তবে কভিড সংকট এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী যে বিশাল সংকট সৃষ্টি করেছে তার অভিঘাতে আমরা এখন বিপদে আছি।
উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু পাশাপাশি বৈষম্য বেড়েছে। এই বৈষম্য প্রকট করেছে দুর্নীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা, বিত্তবানদের লোভ এবং বিদেশে টাকা পাচারের চর্চা। কিছু মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ, অথচ তৃণমূল পর্যায়ে কৃষক-শ্রমিক-খেটে খাওয়া মানুষের এখন তিন বেলা আহার জোটানো কঠিন। এ অবস্থার জন্য দায়ী নীতি ও কৌশলের দুর্বলতা, মন্ত্রণালয়গুলোর এবং বিভিন্ন প্রকল্পের কর্মকান্ডে অস্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির অভাব। ব্যাংকের তহবিল লুটে নেওয়ার খবর আমরা শুনি, কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি পেতে দেখি না। এসব ক্ষেত্রে সরকার যদি কঠোর হয়, আইন-আদালত কঠোর অবস্থানে যায়, তাহলে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটবে। এটি না হলে সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্য মøান হয়ে যাবে।
সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে, প্রধানত শিক্ষার বিস্তারের ফলে, কর্মক্ষেত্রে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এবং মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকার কারণে। বড় কিছু এনজিও সামাজিক উন্নয়নে প্রভাব রেখেছে। তাদের কাজে দারিদ্র্য কমেছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নতি ঘটেছে। সরকারের অনেক নীতি ও কর্মসূচি বিশেষ করে স্কুল-কলেজের মেয়েদের বৃত্তি দেওয়া, বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ ইত্যাদি সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। উল্টোপিঠে, সমাজে সাম্প্রদায়িকতা, হানাহানি এবং সংঘাত বেড়েছে। উগ্রবাদের প্রসার ঘটেছে। সংস্কৃতিচর্চা ক্রমশ অদৃশ্য হচ্ছে। এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো চলতে থাকলে সমস্যা আরও বাড়বে।
রাজনীতিতে সংঘাত এবং রক্তক্ষয় চিরস্থায়ী হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে নিয়ে যে রাজনীতিচর্চা হচ্ছে তাতে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। বড় দুই দল পরস্পরের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস পোষণ করে, এটি রাজনীতিতে সুস্থতা আনতে পারে না। ১৯৭১ সালকে অস্বীকার করার, এর প্রধান নায়কদের সম্পূর্ণভাবে আড়ালে ঠেলে ১৯৪৮ সাল থেকে চলা পাকিস্তানের নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে চব্বিশ বছরের আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে একটি পক্ষ। এই মানসিকতার অবসান না হলে রাজনীতি কখনো সংঘাতমুক্ত হবে না, একাত্তরে যারা স্বজাতি হত্যা করেছিল, তাদের শক্তিশালী করা হবে। দুঃখজনক সত্যটি হলো, ১৯৭১ নিয়ে ছড়ানো নানা বিভ্রান্তিও দেশের রাজনীতিকে দুর্বল করে রেখেছে।
দেশ রূপান্তর : আপনাদের বেড়ে ওঠার সময় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ধরন কেমন ছিল? এখন কেমন দেখছেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমি ১৯৬৮ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন বুদ্ধিজীবী শব্দটি সমীহ জাগাত। কারণ বুদ্ধিজীবী তাদেরই বলা হতো যারা তাদের চিন্তাভাবনা এবং বুদ্ধির চর্চা দিয়ে কিছু বিষয়কে সামনে নিয়ে আসতেন, যেগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য তারা নিরন্তর চেষ্টা করে যেতেন, অনেকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামেও নেমেছেন যেমন সাম্য, মানবাধিকার, দেশের সম্পদে গরিবের ন্যায্য অধিকার, শোষণ-বঞ্চনার অবসান। তাদের প্রায় সবাই পেশাজীবী ছিলেন, কিন্তু নিজস্ব পেশার বাইরে গিয়ে দেশের কল্যাণে তারা নিবেদিত থাকতেন। এরা অবধারিতভাবে ছিলেন এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধী অনেকে কারাভোগও করতেন।
আমাদের এই সময়ে বুদ্ধিজীবী যারা আছেন, তারা প্রধানত নিজেদের পেশাতেই নিয়োজিত থাকেন, এবং পেশাজীবী হিসেবে হয়তো সুনামও কুড়িয়েছেন। কিন্তু পেশার বাইরে গিয়ে খেটে খাওয়া মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, তরুণ এবং পরিবর্তনকামী মানুষের পক্ষে তারা কোনো সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করেন না। মাত্র কয়েকজনই আছেন, যারা পুরনো ধারার বুদ্ধিজীবী, যারা ক্ষমতাকে ভয় না পেয়ে সত্য কথাটা বলে যান।
দেশ রূপান্তর : ৭০-এর দশকে প্রফেসর রাজ্জাক বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক প্রভাব রাখতেন, পরবর্তী সময়ে তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি। সবশেষ, তরুণদের ভেতর আহমদ ছফার জনপ্রিয়তা দেখা গেছে। তাদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? নতুন কেউ আসছেন না কেন, নাকি আমরা দেখতে পারছি না নতুনদের?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এদের দুজনই এস্টাব্লিশমেন্ট যেদিকে চলত, তার বিপরীতে ছিলেন। প্রফেসর রাজ্জাক মানুষের নিজস্বতাকে মূল্য দিতেন, কোনো আদেশ-নির্দেশকে পরোয়া করতেন না, প্রকৃত জ্ঞানকে আত্মস্থ করতে সবাইকে উৎসাহ দিতেন। ফলে প্রতিবাদী এবং পরিবর্তনকামী তরুণদের কাছে তিনি প্রিয় ছিলেন। আহমদ ছফা শুধু তার চিন্তাচেতনা নয়, জীবনযাপনেও এক প্রচলবিরোধী মানুষ হিসেবে নন্দিত হয়েছিলেন। তিনিও চিন্তার স্বাধীনতা এবং সক্রিয়তাকে, পুরনোকে প্রশ্ন করতে এবং হায়ারার্কি অথবা সমাজের মোড়লদের দ্বিমুখী চরিত্র এসবের বিরুদ্ধে সংগ্রামমুখর হতে তরুণদের বলতেন। নতুনরা যে আসছেন না, তা নয়, কিন্তু এখন সমাজটাই তো বদলে গেছে। এখন আহমদ ছফার মতো মানুষ যদি দলনির্বিশেষে রাজনীতিকে তার অন্তঃসারশূন্যতার জন্য প্রশ্ন করতে থাকেন, তাকে অনেক তরুণের বাধার সামনে পড়তে হবে।
এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শাসিত গুজব আর মেকি খবর এবং দৃশ্য মাধ্যমের তারল্যের যুগে এবং মুখস্থবিদ্যাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার সময়ে প্রফেসর রাজ্জাক এবং আহমদ ছফার মতো মানুষকে সহজে গ্রহণ করার মতো তরুণদের সংখ্যাই তো কম।
দেশ রূপান্তর : বলা হয়ে থাকে গত ৫০ বছরে দেশের সাংস্কৃতিক অবনমন ঘটেছে, এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের দায় কতটুকু বা আদৌ তাদের কোনো দায় আছে কি না?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : গত পঞ্চাশ বছরে সংস্কৃতিবিরোধী শক্তি সংগঠিত হয়েছে, দীর্ঘদিন তারা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা এবং উগ্রবাদ বেড়েছে, সংস্কৃতিকে একেবারে প্রান্তিক অবস্থানে নিতে এরা তৎপর। এখন রাষ্ট্র সত্যিকার বুদ্ধিজীবীদের বিপদ ভাবে। এসব কারণে মুক্তচিন্তার মানুষেরা একদিকে এই সংস্কৃতিবিরোধী শক্তির আঘাত, অন্যদিকে সরকারের সমর্থনের অভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। ফলে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরাও যেমন সংখ্যায় নিতান্ত কম, সমাজও তাদের আর খোলা মন নিয়ে গ্রহণ করতে রাজি নয়। সংস্কৃতির অবনমনের কারণ যদি হয় সমাজের অবস্থান পরিবর্তন (উদারনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক থেকে চূড়ান্ত রক্ষণশীল, এবং অনেক সময় সংস্কৃতিবিরোধী), দায়টা তো সবার।
দেশ রূপান্তর : একসময় বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীদের আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার যে চর্চা তার একটা প্রভাব ছিল। এখন সেটা তেমন দেখা যাচ্ছে না। আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার প্রয়োজন কি শেষ?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার প্রয়োজন কখনো শেষ হয় না। কিন্তু সমাজের অসহিষ্ণু, সাম্প্রদায়িক চিন্তায় আচ্ছন্ন, জাগতিক লোভের কাছে আত্মসমর্পিত অংশটির যেরকম শক্তি বাড়ছে, তাতে আদর্শের কথাটা এখন অচল হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে আছে। বুদ্ধিজীবীরা তখনই তাদের কাজের প্রভাব দেখেন যখন মানুষ নিজেদের অধিকারের (যার মধ্যে সাংস্কৃতিক অধিকার অন্যতম, যেমন ছিল ৫০-৬০ এর দশকে) জন্য সংগ্রামে নামে। সেই পরিবেশ এখন নেই। সেজন্য আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামটাই প্রথমে করতে হবে, কিন্তু যেখান থেকে এই সংগ্রাম শুরু হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পরিবারসেখানেই তো দুর্বলতা প্রকট।
দেশ রূপান্তর : ইন্টারনেটের প্রসারে অনলাইনে একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দাবি করা হয়। এ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : পশ্চিমা বিশ্বে, এশিয়ার অনেক দেশে, এমনকি ভারতেও ইন্টারনেটে জ্ঞানচর্চার একটা শক্তিশালী ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে। কভিডের দুই-আড়াই বছরে আমি পশ্চিমের দু’তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জুম-আলোচনায় অংশ নিয়েছি, ইউটিউবে অসংখ্য ভিডিও দেখেছি, যেখানে জ্ঞানের নানা অঞ্চলে আলো ফেলে কেউ লেকচার দিয়েছেন, বক্তব্য দিয়েছেন অথবা প্রশ্নোত্তরে তাদের কথাগুলো বলেছেন। ইউটিউবে আমাদের দেশের সেরকম ভিডিও আমি খুব কমই পেয়েছি। ইউটিউবে (এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে) একবার ঘুরে এলে দেখবেন কীরকম হিংসা, বিদ্বেষ, অসূয়া, নারীকে নিয়ে কটূক্তি, মানুষকে অপমান করার নিরন্তর চর্চা সেখানে হয়। ইন্টারনেটে বুদ্ধিবৃত্তির যে সত্যিকার চর্চা এখানে হয়, তা এতই সীমিত যে আঠারো কোটি মানুষের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তা সত্যিই দুঃখজনক।
ইউটিউবে ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর যদি কোনো বক্তৃতা পান, দেখবেন, সেই বক্তৃতা শুনেছে খুব বেশি হলে ৫ হাজার মানুষ। অথচ গালিগালাজ করা, বিদ্বেষ আর উগ্রতা ছড়ানো হয় যেসব ভিডিওতে, সেগুলো শোনে লাখ লাখ মানুষ।
ইন্টারনেটকে আমরা হয়তো একদিন জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের একটা মাধ্যম হিসেবে পাব, কিন্তু সেজন্য অনেক সময় লাগবে। ততদিনে হয়তো ইন্টারনেটই প্রাচীন হয়ে যাবে। নতুন কোনো প্রযুক্তি আসবে।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আপনাকেও ধন্যবাদ।
রবীন্দ্রনাথ তার ‘কালান্তর’ গ্রন্থের একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘ধর্ম যদি অন্তরের জিনিস না হইয়া শাস্ত্রমত ও বাহ্য আচারকেই মুখ্য করিয়া তোলে, তবে সেই ধর্ম যত বড়ো অশান্তির কারণ হয়, এমন আর-কিছুই না।’ কথাটির নিহিত তাৎপর্য আজ আমরা দুনিয়াজুড়ে উপলব্ধি করতে পারছি। রবীন্দ্রনাথের মতো অতটা হয়তো তীব্রভাবে নয়, কিন্তু তার পরও বলি, সেদিনে পিছিয়ে-পড়া মুসলিম সমাজের পক্ষ থেকে একজনকে অন্তত পাই, যার লেখালেখির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ-কথিত কঠিন সত্যিটাই আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সেই লেখক মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী। আজ যাকে আমরা বলতে গেলে ভুলেই গিয়েছি। কেন ভুলে গিয়েছি সেইটা বুঝতে পারা কঠিন হবে না, যদি আমরা তার চিন্তার চৌহদ্দিটা খানিকটা হলেও পরিমাপ করতে পারি।
২. মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরীর প্রথম গ্রন্থ ‘ধর্মের কাহিনী’ প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালে। সেই গ্রন্থের ‘পূর্বাভাস’-এ তিনি বলেছিলেন, ‘মনে হইয়াছে সৎ হওয়াই বুঝি মানব-জীবনের প্রধান কাজ। বাল্যকালের সেই অস্পষ্ট ধারণা বয়সের সহিত ক্রমে স্পষ্ট হইয়াছে।’ ধর্মের সঙ্গে সততার ধারণাকে যুক্ত করে এক দিন তার মনে হয়েছিল, ‘ধর্মই বুঝি মানুষের সবেধন এক নীলমণিসাত রাজার ধন এক মানিক।’ শুধুই এইটুকুই নয়, তার এ-ও মনে হতো, ‘ধর্মই বুঝি মানুষের জীবনের সাধ, সাধের সুখ, সুখের স্বপ্ন। সকলেই বুঝি কেবল ধর্ম পথেরই পথিক।’ কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গে বাস্তব জগতের দিকে তাকিয়ে তিনি ঠিক এর বিপরীত চিত্রটাই দেখতে পেয়েছেন। আর স্বপ্নভঙ্গের সেই বেদনা নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আজ ভীত স্তম্ভিত হইয়া দেখিতেছি, ধর্ম কোথায়ও নাই। বৈশাখ মাসের বাতাসে শুষ্ক পাতা যেমন করিয়া উড়িয়া যায়, আজ জনসমাজ হইতে ধর্মও তেমনিভাবে উড়িয়া গিয়াছে।’ শুধু এইটুকু যোগ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি; ক্ষুব্ধতায় নিজের বেদনাবোধকে এসবের সঙ্গে যুক্ত করে বলেছেন, ‘সত্য, সাধুতা, ন্যায়, দয়া ও পরোপকার আজ স্বপ্নের কাহিনী।’
এই অংশটুকু পাঠ করতে গিয়ে আমাদের কারও-কারও মনে পড়বে কবি জীবনানন্দ দাশের কথা। এয়াকুব আলীর এই প্রবন্ধটি প্রকাশের অনেকগুলো বছর পরে আমাদের সাহিত্যের ‘নির্জনতম’ কবি বলবেন তার চৈতন্য আর অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা এসব নিষ্ঠুর অথচ বাস্তব একপর্যায়ের কথা, যা আমাদের সমাজ জীবনের সঙ্গে তো বটেই, ব্যক্তিগত জীবনেও মিলেমিশে একাকার হয়ে আমাদের প্রতিদিনকার জীবনকে জখম করে রাখে প্রতিনিয়ত। কী বলেছিলেন জীবনানন্দ? তিনি লিখেছিলেন‘চারিদিকে বিকলাঙ্গ অন্ধ ভিড়অলীক প্রয়াণ।/ মন্বন্তর শেষ হলে নতুন যুদ্ধের নান্দীরোল;/ মানুষের লালসার শেষ নেই/ উত্তেজনা ছাড়া কোনো দিন ঋতু ক্ষণ/ অবৈধ সংগম ছাড়া সুখ/ অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ/ নেই।’
৩. দয়া-দান-অতিথি-সেবা নিত্যদিনের কর্মযজ্ঞ এবং সেই সঙ্গে মানুষের আচার-ব্যবহারের কথা বলতে গিয়ে এয়াকুব আলী চৌধুরী নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝি-বা লিখেছিলেন, ‘দেখিয়াছি মফঃস্বলের কোন লোক কলিকাতায় গিয়া জুয়াচোরের হাতে পড়িয়া সর্বস্ব খোয়াইলে তাহার মরণ নিশ্চিত।’ কেন এই কথা? প্রাবন্ধিক জানিয়েছেন, ‘তিন দিন ধরিয়া কলিকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইলেও কেহ তাহাকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করে না।’ শুধু তা-ই নয়; এয়াকুব আলী আরও লিখেছেন, ‘বড় বড় ধপ্ধপে দালানে উঁকি দেওয়ারও তাহার কোন অধিকার নাই।’ অবশেষে তিনি বলেছিলেন, ‘ধর্মের এক অতি প্রিয় অনুষ্ঠান (“অতিথি-সেবা”) এইরূপে আমাদের ধর্মের সংসারে শুকাইয়া মরিতেছেভ্রুক্ষেপ করিবার কেহ নাই।’
বিচিত্রভাবে চারপাশের বিভিন্ন দিকের প্রতি দৃষ্টিপাত করে গ্রন্থের উপসংহারে এসে লেখক বলেছেন, ‘এইরূপে মানবসমাজের যেদিকে ও যে স্তরেই দৃষ্টিপাত করি, সেইদিকে কেবল অধর্মেরই পূর্ণ প্রসার দেখিতে পাই’ আর তারই পরিণামে লেখকের ভাষায়, ‘ধর্মকে কোথায়ও খুঁজিয়া পাই না।’ ধর্মকে খুঁজে পাননি তিনি, শুধু তা-ই নয়, প্রতিদিনকার জীবনযাপনের যে-আনুষঙ্গিক আচরণবিধি, যার মধ্যে একটি সুসংগত জীবনবোধের পরিচয় পাই আমরা, সেই পরার্থপরতা, পরোপকার, জীবসেবা, একটু দয়া, মমত্ববোধ, প্রাণের সহানুভূতি পর্যন্ত লেখক কোথায়ও খুঁজে পাননি। তার পরিবর্তে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, ‘ধর্মবোধ এমনিভাবে লুপ্ত হইয়াছে যে, যে-লোক একটুকু সরল ব্যবহার ও সরল বিশ্বাসী হয়, পাঁচ পয়সা দিব বলিয়া দুই পয়সা দিতে না জানে, বিবিধ কলাকৌশলে...পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গিয়া’ খাইতে না জানে, সেই লোক এই সমাজে ‘নিতান্ত অকর্মণ্য, বোকাচন্ডী বলিয়া স্থির হয়।’
৪. এয়াকুব আলী চৌধুরী প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মেও বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু মনুষ্যধর্মকে তার থেকে বিযুক্ত করতে চাননি কখনো। এটি চাননি বলেই মানুষ সম্পর্কে তিনি বিশ্বাস করতেন, সে শুধুই জড়পদার্থ নয়, সে চৈতন্যস্বরূপ। আর ‘চৈতন্য মানেই যে আধ্যাত্মিকতা’ইসলাম ধর্মের অনুসারী হয়েও, ভারতীয় দর্শনের এই তত্ত্বটিকে তিনি একেবারেই অস্বীকার করেননি। মানুষকে উদ্দেশ করে সে-কারণেই তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি গরু নও, বানর নও, ব্যাঘ্র নওতুমি মানুষ। এই জড়দেহ তাহার ক্ষুদ্র সীমার পরপারে, হে পুণ্য ও চৈতন্যস্বরূপ! তোমার তরে স্বর্গের ও বিভু মিলনের অপার শান্তি, তৃপ্তি ও আনন্দ সঞ্চিত রহিয়াছে। কেন ভুলিবে, কেন ডুবিবে, কেন মরিবে?’ প্রতিটি মানুষকে এয়াকুব আলী একটা মর্যাদাবান সত্তা হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সময়ের বিচারে তিনি যে একজন অগ্রসর মানুষ ছিলেন, সেটি প্রমাণিত হয় তার চিন্তার অভিব্যক্তিতে, যা কি না এইসব বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। অথচ অবাক হতে হয় এ কারণেই যে মানুষটি জন্মেছিলেন ফরিদপুরের পাংশা থানার মাগুরাডাঙ্গা গ্রামে, ১৮৮৮ সালে (১৮ই কার্তিক, ১২৯৫ বঙ্গাব্দ)। চোখের অসুখে ভুগতেন বলে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের পড়াশোনাটাও শেষ করতে পারেননি।
৫. এয়াকুব আলী চৌধুরীর জীবন সম্পর্কে জানাতে গিয়ে প্রাবন্ধিক-গবেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম লিখেছেন, মাত্র ‘৪৭-৪৮ বৎসর বয়সে তিনি ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হন। জীবনের শেষ কয়েকটি বৎসর তাকে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় গ্রামের বাড়িতে দিন কাটাতে হয়।’ তিনি নিজে একজন আত্মসচেতন ও প্রতিভাধর মানুষ ছিলেন বলেই, সমাজের ইসলাম ধর্মানুসারী মানুষকে এইভাবে বলতে পেরেছিলেন, ‘প্রতিভা তোমার মনুষ্যত্বের স্পর্ধা, জ্ঞান ও চৈতন্য তোমার মানবতার গরিমা! কেন ভুলিবে, কেন ছোট হইবে, কেন পাপ করিবে?’ আমরা বুঝতে পারি নিজের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে তিনি কতিপয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি, দেখতেও চাননি। সেটিকে গোটা মানবসমাজের স্পর্ধা ও গরিমার সঙ্গে সে-কারণেই যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এয়াকুব আলী চৌধুরী প্রচলিত অর্থে ধার্মিক ছিলেন ঠিকই, আর তার ধর্মচর্চার মধ্যে আমরা সক্রিয়তার মনোভাব নানাভাবে দেখতে পাই। যে-সক্রিয়তা সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যেও বলিষ্ঠভাবে ছিল বলে মনে করি। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘সম্প্রতি সুশিক্ষিত বাঙ্গালিদিগের মধ্যে হিন্দুধর্মের আলোচনা দেখা যাইতেছে। অনেকেই মনে করেন যে, আমরা হিন্দুধর্মের প্রতি ভক্তিমান হইতেছি। যদি এ কথা সত্য হয় তবে আহ্লাদের বিষয় বটে।’ কেন আহ্লাদের বিষয়, সেটি খোলাসা করতে গিয়ে ভাববাদী বঙ্কিম তার দৃঢ় বিশ্বাসের কথা এইভাবে আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘জাতীয় ধর্মে পুনর্জীবন ব্যতীত ভারতবর্ষের মঙ্গল নাই।’ কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি এটিও বলতে দ্বিধা করেননি, ‘হিন্দু হাঁচি পড়িলে পা বাড়ায় না, টিকটিক ডাকিলে “সত্য সত্য” বলে, হাই উঠিলে তুড়ি দেয়।’ এগুলোকে তিনি ধর্ম বা ধর্মীয় আচার হিসেবে মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তার মতে, ‘এ সকল হিন্দুধর্ম নহে। মূর্খের আচার মাত্র। যদি ইহা হিন্দুধর্ম হয়, তবে আমরা মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি যে, আমরা হিন্দুধর্মের পুনর্জ্জীবন চাহি না।’ অন্যদিকে তার রচিত ‘ধর্মের কাহিনী’ গ্রন্থটি সম্পর্কে মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বলেছিলেন, ‘এই পুস্তক সংসারে সর্বজনীন পাপ-স্রোতের বিরুদ্ধে ধর্মের এক স্বাভাবিক আর্তনাদ।’ তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘মানুষকে সংসারে ধর্মের নামে ধর্মকে ফাঁকি দিয়া নিত্যনিয়ত অধর্ম করিতে দেখিয়া অন্তরে যে দারুণ বেদনা অনুভব করিয়াছি, এই ক্ষুদ্র পুস্তক তাহারই প্রকাশ মাত্র।’ এয়াকুব আলীর এই কথাগুলি পাঠ করতে গিয়ে ধর্ম প্রসঙ্গে কার্ল মার্কসের কয়েকটি কথা মনে না-পড়ে পারে না। এটিও তার চিন্তার অগ্রসরতারতাই আরেকটি নমুনা।
৬. অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম তার প্রবন্ধে এয়াকুব আলীর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে আমাদের আরও কিছু তথ্য জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ ছিল তার জীবন। পক্ষান্তরে তার জীবনও অনেক দুঃখ-কষ্টে পরিকীর্ণ। সাংবাদিক হিসেবেও তার খ্যাতি ছিল এবং এ-সময়ই তিনি বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও সাহিত্য-সমিতির সঙ্গে যুক্ত থাকেন।’ এই তথ্য জেনে আমরা বিমর্ষ বোধ করি যে, ‘দুঃখ-কষ্ট ও দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে হয় বলে তার গ্রন্থ-সংখ্যা খুব বেশি নয়।’ শ্রদ্ধেয় আবদুল কাইয়ুম ঠিকই বলেছেন। এয়াকুব আলীর প্রকাশিত গ্রন্থ-সংখ্যা মাত্র চারটি। ব্যঞ্জনাময় গদ্যে রচিত ‘ধর্মের কাহিনী’ নিয়ে আমরা সামান্য আলোচনা করেছি। এ ছাড়া রয়েছে‘নূরনবী’ (১৯১৮), ‘শান্তিধারা’ (১৯১৯) ও ‘মানব-মুকুট’ (১৯২২)। তার অপ্রকাশিত রচনার একটি সংকলন ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
৭. রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে, ব্যক্তি মানুষের ‘সর্বজনীন মনকে উত্তরোত্তর বিশুদ্ধ করে উপলব্ধি করাতেই মানুষের অভিব্যক্তির উৎকর্ষ।’ অভিব্যক্তির সেই উৎকর্ষের অনেকখানি আমরা মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরীর রচনায়, চিন্তায়, তার অটল সাধনার মধ্যে দেখতে পাই। লেখাই বাহুল্য যে, সেই সাধনারই প্রকাশিত মর্ম-মাধুরী হচ্ছে তার রচনাকর্ম। ১৯৪০ সালের ১৫ ডিসেম্বর এই সাধক-লেখক প্রয়াত হন। আমরা তার স্মৃতির গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রেললাইনে একের পর এক লাশ পাওয়া যাচ্ছে। এই লাশ কেবল দেশব্যাপী রেলপথে দুর্ঘটনায় কাটা পড়া লাশই নয় রেললাইন আর লাইনের পাশের জমিতে পড়ে থাকছে লাশ। অনেক ক্ষেত্রেই এসব মৃত্যু নিয়ে রহস্যের জট খুলছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব লাশের মধ্যে যেমন অসতর্কতার কারণে ট্রেনে কাটা পড়া কিংবা আত্মহত্যায় মৃত্যুর লাশ রয়েছে, তেমনি রয়েছে ডাকাতির সময় ট্রেন থেকে ফেলে হত্যা করা ব্যক্তির লাশও। আবার অন্য কোথাও কাউকে হত্যা করে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু বলে চালানোর জন্য লাশ ফেলে রাখা হয় রেললাইনে। বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন চিত্র দেখা গেলেও বিশেষ উদ্বেগ দেখা দিয়েছে রাজধানী ঢাকার লাগোয়া গাজীপুরের কিছু নির্দিষ্ট রেলপথ নিয়ে। দেশ রূপান্তরে রবিবার ‘গাজীপুরে এক বছরে রেললাইনে ৬০ লাশ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন উদ্বেগের কথা। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, চলতি ২০২২ সালে এখন পর্যন্ত গাজীপুর জেলার ধীরাশ্রম থেকে শ্রীপুরের কাওরাইদ এবং টাঙ্গাইলের মির্জাপুর আউটার সিগন্যাল পর্যন্ত রেললাইন ও এর আশপাশ থেকে ৪৫ জনের লাশ উদ্ধার করেছে রেলওয়ে পুলিশ। এছাড়া ধীরাশ্রম থেকে টঙ্গী পর্যন্ত এবং টঙ্গী থেকে কালীগঞ্জের আড়িখোলা পর্যন্ত রেলপথ থেকে আরও অন্তত ১৫টি লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট এলাকার রেলওয়ে থানা পুলিশ জানিয়েছে। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠছে গাজীপুরে রেলপথের এমন নির্দিষ্ট এলাকাতেই কেন বারবার লাশ পাওয়া যাচ্ছে?
খেয়াল করা দরকার, রেলপথে মৃত্যুর মিছিল এমনিতেই বেশ দীর্ঘ। কেবল ২০২১ সালেই রেলপথে ২৭০টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৫৪ জন, আহত হয়েছেন ৪২ জন। এর ওপর কেবল এক জেলাতেই এক বছরে রেলপথে ৬০টি লাশ পাওয়ার কারণ অনুসন্ধান জরুরি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসতর্কতার কারণে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর অন্যতম কারণ রেললাইনের ওপর অবৈধ রেলক্রসিং এবং রেললাইন ঘেঁষে অবৈধ বাজার ও অস্থায়ী দোকান বসানো। টঙ্গীর বনমালা ও আরিচপুরে রেললাইনের ওপর মানুষের ভিড় থাকে প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে বিকেল থেকে রাত। আরিচপুরে রেললাইনের ওপর অবৈধ বাজার থাকায় সেখানে টঙ্গী ও উত্তরার মানুষ বাজার করতে আসেন। কিন্তু হুটহাট ট্রেন চলে এলে লাইন থেকে সরে দাঁড়ানোর তেমন জায়গা না থাকায় ঘটে প্রাণহানির ঘটনা। এছাড়া স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কিছু কিছু এলাকায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রেললাইনের ওপর ভিড় জমায় তরুণ-তরুণীরা। অনেক সময় লাইনের ওপর হাঁটাহাঁটি ও টিকটক ভিডিও বানানোর সময় ঘটে দুর্ঘটনা। এই এলাকায় প্রায়ই রেলে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দেওয়া জরুরি অরক্ষিত রেললাইনের সুরক্ষা নিয়ে। রেললাইনের ওপর কিংবা রেললাইন ও স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় অবৈধভাবে বাজার বসানো এবং দোকানপাট সারা দেশের সাধারণ বাস্তবতা হলেও এমন কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না কেন? রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যথাযথ উদ্যোগের পাশাপাশি এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের সক্রিয়া হওয়া জরুরি।
রেলপথে এমন লাশ পড়ে থাকা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, নদীতে লাশ ভেসে থাকার কথা। মাত্র কিছুদিন আগেই দেশ রূপান্তরে ‘২২ মাসে ৭১৫ লাশ নদীতে’ শিরোনামের প্রতিবেদনে নদীতে লাশ পাওয়ার এক নির্মম বাস্তবতা সামনে উঠে এসেছিল। প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল হত্যাকারীরা লাশ নিশ্চিহ্নের উদ্দেশ্যে হত্যার পর নদীতে লাশ ভাসিয়ে দিচ্ছে। ওই ৭১৫ লাশের মধ্যে ২১৬টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনও করা হয়েছে। সারা দেশেই এমন ঘটনা ঘটলেও শুধু রাজধানী ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদী থেকেই গত ১০ মাসে উদ্ধার করা হয়েছিল ৯০টি লাশ। তদন্তকারী সংস্থাগুলো বলছে, নদীতে উদ্ধার হওয়া লাশগুলোর বেশিরভাগই হত্যাকাণ্ডের শিকার বলে আশঙ্কা তাদের। আর সেসব হত্যাকান্ডের বেশিরভাগই ডাঙায় ঘটলেও লাশ ফেলা হচ্ছে নদীতে। ফলে তদন্তে বেগ পেতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর বেশকিছু নির্জন স্থানকে অপরাধীরা লাশ ফেলার নিরাপদ এলাকা হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছিল, রাজধানী ঘিরে থাকা বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীকে লাশের ডাম্পিং জোন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না। একই কারণে এই সন্দেহ করার অবকাশ আছে যে, গাজীপুর জেলার ওই নির্দিষ্ট এলাকাগুলোর রেললাইনকেও অপরাধীরা লাশের ডাম্পিং জোন হিসেবে ব্যবহার করছে কি না। এমন এক সময়ে দেশের রেলপথ আর নদী থেকে একের পর এক লাশ উদ্ধারের ঘটনা দেখছি যখন গুম-খুন-নিখোঁজের রহস্য উন্মোচন ক্রমশই দুরূহ হয়ে উঠছে। অন্যদিকে রেলপথে পড়ে থাকা আর নদীতে ভাসা লাশের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এই বাস্তবতাকে বিশেষভাবে আমলে নিয়ে রেলপথে লাশ উদ্ধারের বিষয়ে বিশদ তদন্ত জরুরি।
কবি, প্রাবন্ধিক, ছন্দবিশারদ ও সম্পাদক আবদুল কাদিরের জন্ম কুমিল্লার আড়াইসিধা গ্রামে ১৯০৬ সালের ১ জুন। তার বাবার নাম হাজি আফসারউদ্দীন। ১৯২৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা মডেল হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯২৫ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে তিনি আইএসসি পাস করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন। ১৯২৯ সালে কলকাতার মাসিক সওগাত পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে যোগ দেন। ১৯২৬ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের মাধ্যমে ঢাকায় যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন সংঘটিত হয়, তিনি ছিলেন তার অন্যতম উদ্যোক্তা। সংগঠনের মুখপত্র বার্ষিক ‘শিখা’ পত্রিকার তিনি প্রকাশক ও লেখক ছিলেন। তিনি কিছুকাল কলকাতা করপোরেশনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি তিনি মাসিক জয়তী পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ (১৯৩০-১৯৩৩) করেন এবং সাপ্তাহিক নবশক্তি, যুগান্তর, দৈনিক নবযুগ, সাপ্তাহিক মোহাম্মদী ও সাপ্তাহিক পয়গম পত্রিকায়ও বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন। ১৯৫২ সালে ঢাকায় এসে মাসিক মাহে নও পত্রিকা সম্পাদনা করেন (১৯৫২-১৯৬৪)। তিনি কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রকাশনা কর্মকর্তা (১৯৬৪-১৯৭০) পদে দায়িত্ব পালন করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ দিলরুবা, উত্তর বসন্ত, ছন্দসমীক্ষণ, বাংলা ছন্দের ইতিবৃত্ত, যুগকবি নজরুল ইত্যাদি। তিনি বাংলা ছন্দ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও বিশ্লেষণ করেছেন। এ ছাড়া কাব্যমালঞ্চ, এয়াকুব আলী চৌধুরী রচনাবলি, নজরুল রচনাবলি, শিরাজী রচনাবলি, কাজী ইমদাদুল হক রচনাবলি, রোকেয়া রচনাবলিসহ নানা গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তিনি ১৯৮৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।