
কবি, প্রাবন্ধিক, ছন্দবিশারদ ও সম্পাদক আবদুল কাদিরের জন্ম কুমিল্লার আড়াইসিধা গ্রামে ১৯০৬ সালের ১ জুন। তার বাবার নাম হাজি আফসারউদ্দীন। ১৯২৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা মডেল হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯২৫ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে তিনি আইএসসি পাস করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন। ১৯২৯ সালে কলকাতার মাসিক সওগাত পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে যোগ দেন। ১৯২৬ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের মাধ্যমে ঢাকায় যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন সংঘটিত হয়, তিনি ছিলেন তার অন্যতম উদ্যোক্তা। সংগঠনের মুখপত্র বার্ষিক ‘শিখা’ পত্রিকার তিনি প্রকাশক ও লেখক ছিলেন। তিনি কিছুকাল কলকাতা করপোরেশনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি তিনি মাসিক জয়তী পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ (১৯৩০-১৯৩৩) করেন এবং সাপ্তাহিক নবশক্তি, যুগান্তর, দৈনিক নবযুগ, সাপ্তাহিক মোহাম্মদী ও সাপ্তাহিক পয়গম পত্রিকায়ও বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন। ১৯৫২ সালে ঢাকায় এসে মাসিক মাহে নও পত্রিকা সম্পাদনা করেন (১৯৫২-১৯৬৪)। তিনি কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রকাশনা কর্মকর্তা (১৯৬৪-১৯৭০) পদে দায়িত্ব পালন করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ দিলরুবা, উত্তর বসন্ত, ছন্দসমীক্ষণ, বাংলা ছন্দের ইতিবৃত্ত, যুগকবি নজরুল ইত্যাদি। তিনি বাংলা ছন্দ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও বিশ্লেষণ করেছেন। এ ছাড়া কাব্যমালঞ্চ, এয়াকুব আলী চৌধুরী রচনাবলি, নজরুল রচনাবলি, শিরাজী রচনাবলি, কাজী ইমদাদুল হক রচনাবলি, রোকেয়া রচনাবলিসহ নানা গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তিনি ১৯৮৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। শিক্ষাবিদ, লেখক ও বুদ্ধিজীবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন চার দশকের বেশি সময়। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে (ইউল্যাব) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বিষয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : বায়ান্নতে পা দিল বাংলাদেশদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : গত ৫১ বছরে আমাদের অর্থনীতিতে দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ির অবস্থান থেকে আমরা এখন দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় শক্তিশালী অর্থনীতি। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কভিড সংকটের সময়েও ৭ শতাংশের ধারেকাছে ছিল। গত দেড় দশক এই উন্নতি দ্রুত হয়েছে, তবে কভিড সংকট এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী যে বিশাল সংকট সৃষ্টি করেছে তার অভিঘাতে আমরা এখন বিপদে আছি।
উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু পাশাপাশি বৈষম্য বেড়েছে। এই বৈষম্য প্রকট করেছে দুর্নীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা, বিত্তবানদের লোভ এবং বিদেশে টাকা পাচারের চর্চা। কিছু মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ, অথচ তৃণমূল পর্যায়ে কৃষক-শ্রমিক-খেটে খাওয়া মানুষের এখন তিন বেলা আহার জোটানো কঠিন। এ অবস্থার জন্য দায়ী নীতি ও কৌশলের দুর্বলতা, মন্ত্রণালয়গুলোর এবং বিভিন্ন প্রকল্পের কর্মকান্ডে অস্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির অভাব। ব্যাংকের তহবিল লুটে নেওয়ার খবর আমরা শুনি, কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি পেতে দেখি না। এসব ক্ষেত্রে সরকার যদি কঠোর হয়, আইন-আদালত কঠোর অবস্থানে যায়, তাহলে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটবে। এটি না হলে সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্য মøান হয়ে যাবে।
সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে, প্রধানত শিক্ষার বিস্তারের ফলে, কর্মক্ষেত্রে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এবং মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকার কারণে। বড় কিছু এনজিও সামাজিক উন্নয়নে প্রভাব রেখেছে। তাদের কাজে দারিদ্র্য কমেছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নতি ঘটেছে। সরকারের অনেক নীতি ও কর্মসূচি বিশেষ করে স্কুল-কলেজের মেয়েদের বৃত্তি দেওয়া, বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ ইত্যাদি সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। উল্টোপিঠে, সমাজে সাম্প্রদায়িকতা, হানাহানি এবং সংঘাত বেড়েছে। উগ্রবাদের প্রসার ঘটেছে। সংস্কৃতিচর্চা ক্রমশ অদৃশ্য হচ্ছে। এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো চলতে থাকলে সমস্যা আরও বাড়বে।
রাজনীতিতে সংঘাত এবং রক্তক্ষয় চিরস্থায়ী হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে নিয়ে যে রাজনীতিচর্চা হচ্ছে তাতে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। বড় দুই দল পরস্পরের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস পোষণ করে, এটি রাজনীতিতে সুস্থতা আনতে পারে না। ১৯৭১ সালকে অস্বীকার করার, এর প্রধান নায়কদের সম্পূর্ণভাবে আড়ালে ঠেলে ১৯৪৮ সাল থেকে চলা পাকিস্তানের নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে চব্বিশ বছরের আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে একটি পক্ষ। এই মানসিকতার অবসান না হলে রাজনীতি কখনো সংঘাতমুক্ত হবে না, একাত্তরে যারা স্বজাতি হত্যা করেছিল, তাদের শক্তিশালী করা হবে। দুঃখজনক সত্যটি হলো, ১৯৭১ নিয়ে ছড়ানো নানা বিভ্রান্তিও দেশের রাজনীতিকে দুর্বল করে রেখেছে।
দেশ রূপান্তর : আপনাদের বেড়ে ওঠার সময় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ধরন কেমন ছিল? এখন কেমন দেখছেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমি ১৯৬৮ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন বুদ্ধিজীবী শব্দটি সমীহ জাগাত। কারণ বুদ্ধিজীবী তাদেরই বলা হতো যারা তাদের চিন্তাভাবনা এবং বুদ্ধির চর্চা দিয়ে কিছু বিষয়কে সামনে নিয়ে আসতেন, যেগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য তারা নিরন্তর চেষ্টা করে যেতেন, অনেকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামেও নেমেছেন যেমন সাম্য, মানবাধিকার, দেশের সম্পদে গরিবের ন্যায্য অধিকার, শোষণ-বঞ্চনার অবসান। তাদের প্রায় সবাই পেশাজীবী ছিলেন, কিন্তু নিজস্ব পেশার বাইরে গিয়ে দেশের কল্যাণে তারা নিবেদিত থাকতেন। এরা অবধারিতভাবে ছিলেন এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধী অনেকে কারাভোগও করতেন।
আমাদের এই সময়ে বুদ্ধিজীবী যারা আছেন, তারা প্রধানত নিজেদের পেশাতেই নিয়োজিত থাকেন, এবং পেশাজীবী হিসেবে হয়তো সুনামও কুড়িয়েছেন। কিন্তু পেশার বাইরে গিয়ে খেটে খাওয়া মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, তরুণ এবং পরিবর্তনকামী মানুষের পক্ষে তারা কোনো সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করেন না। মাত্র কয়েকজনই আছেন, যারা পুরনো ধারার বুদ্ধিজীবী, যারা ক্ষমতাকে ভয় না পেয়ে সত্য কথাটা বলে যান।
দেশ রূপান্তর : ৭০-এর দশকে প্রফেসর রাজ্জাক বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক প্রভাব রাখতেন, পরবর্তী সময়ে তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি। সবশেষ, তরুণদের ভেতর আহমদ ছফার জনপ্রিয়তা দেখা গেছে। তাদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? নতুন কেউ আসছেন না কেন, নাকি আমরা দেখতে পারছি না নতুনদের?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এদের দুজনই এস্টাব্লিশমেন্ট যেদিকে চলত, তার বিপরীতে ছিলেন। প্রফেসর রাজ্জাক মানুষের নিজস্বতাকে মূল্য দিতেন, কোনো আদেশ-নির্দেশকে পরোয়া করতেন না, প্রকৃত জ্ঞানকে আত্মস্থ করতে সবাইকে উৎসাহ দিতেন। ফলে প্রতিবাদী এবং পরিবর্তনকামী তরুণদের কাছে তিনি প্রিয় ছিলেন। আহমদ ছফা শুধু তার চিন্তাচেতনা নয়, জীবনযাপনেও এক প্রচলবিরোধী মানুষ হিসেবে নন্দিত হয়েছিলেন। তিনিও চিন্তার স্বাধীনতা এবং সক্রিয়তাকে, পুরনোকে প্রশ্ন করতে এবং হায়ারার্কি অথবা সমাজের মোড়লদের দ্বিমুখী চরিত্র এসবের বিরুদ্ধে সংগ্রামমুখর হতে তরুণদের বলতেন। নতুনরা যে আসছেন না, তা নয়, কিন্তু এখন সমাজটাই তো বদলে গেছে। এখন আহমদ ছফার মতো মানুষ যদি দলনির্বিশেষে রাজনীতিকে তার অন্তঃসারশূন্যতার জন্য প্রশ্ন করতে থাকেন, তাকে অনেক তরুণের বাধার সামনে পড়তে হবে।
এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শাসিত গুজব আর মেকি খবর এবং দৃশ্য মাধ্যমের তারল্যের যুগে এবং মুখস্থবিদ্যাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার সময়ে প্রফেসর রাজ্জাক এবং আহমদ ছফার মতো মানুষকে সহজে গ্রহণ করার মতো তরুণদের সংখ্যাই তো কম।
দেশ রূপান্তর : বলা হয়ে থাকে গত ৫০ বছরে দেশের সাংস্কৃতিক অবনমন ঘটেছে, এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের দায় কতটুকু বা আদৌ তাদের কোনো দায় আছে কি না?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : গত পঞ্চাশ বছরে সংস্কৃতিবিরোধী শক্তি সংগঠিত হয়েছে, দীর্ঘদিন তারা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা এবং উগ্রবাদ বেড়েছে, সংস্কৃতিকে একেবারে প্রান্তিক অবস্থানে নিতে এরা তৎপর। এখন রাষ্ট্র সত্যিকার বুদ্ধিজীবীদের বিপদ ভাবে। এসব কারণে মুক্তচিন্তার মানুষেরা একদিকে এই সংস্কৃতিবিরোধী শক্তির আঘাত, অন্যদিকে সরকারের সমর্থনের অভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। ফলে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরাও যেমন সংখ্যায় নিতান্ত কম, সমাজও তাদের আর খোলা মন নিয়ে গ্রহণ করতে রাজি নয়। সংস্কৃতির অবনমনের কারণ যদি হয় সমাজের অবস্থান পরিবর্তন (উদারনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক থেকে চূড়ান্ত রক্ষণশীল, এবং অনেক সময় সংস্কৃতিবিরোধী), দায়টা তো সবার।
দেশ রূপান্তর : একসময় বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীদের আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার যে চর্চা তার একটা প্রভাব ছিল। এখন সেটা তেমন দেখা যাচ্ছে না। আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার প্রয়োজন কি শেষ?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার প্রয়োজন কখনো শেষ হয় না। কিন্তু সমাজের অসহিষ্ণু, সাম্প্রদায়িক চিন্তায় আচ্ছন্ন, জাগতিক লোভের কাছে আত্মসমর্পিত অংশটির যেরকম শক্তি বাড়ছে, তাতে আদর্শের কথাটা এখন অচল হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে আছে। বুদ্ধিজীবীরা তখনই তাদের কাজের প্রভাব দেখেন যখন মানুষ নিজেদের অধিকারের (যার মধ্যে সাংস্কৃতিক অধিকার অন্যতম, যেমন ছিল ৫০-৬০ এর দশকে) জন্য সংগ্রামে নামে। সেই পরিবেশ এখন নেই। সেজন্য আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামটাই প্রথমে করতে হবে, কিন্তু যেখান থেকে এই সংগ্রাম শুরু হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পরিবারসেখানেই তো দুর্বলতা প্রকট।
দেশ রূপান্তর : ইন্টারনেটের প্রসারে অনলাইনে একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দাবি করা হয়। এ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : পশ্চিমা বিশ্বে, এশিয়ার অনেক দেশে, এমনকি ভারতেও ইন্টারনেটে জ্ঞানচর্চার একটা শক্তিশালী ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে। কভিডের দুই-আড়াই বছরে আমি পশ্চিমের দু’তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জুম-আলোচনায় অংশ নিয়েছি, ইউটিউবে অসংখ্য ভিডিও দেখেছি, যেখানে জ্ঞানের নানা অঞ্চলে আলো ফেলে কেউ লেকচার দিয়েছেন, বক্তব্য দিয়েছেন অথবা প্রশ্নোত্তরে তাদের কথাগুলো বলেছেন। ইউটিউবে আমাদের দেশের সেরকম ভিডিও আমি খুব কমই পেয়েছি। ইউটিউবে (এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে) একবার ঘুরে এলে দেখবেন কীরকম হিংসা, বিদ্বেষ, অসূয়া, নারীকে নিয়ে কটূক্তি, মানুষকে অপমান করার নিরন্তর চর্চা সেখানে হয়। ইন্টারনেটে বুদ্ধিবৃত্তির যে সত্যিকার চর্চা এখানে হয়, তা এতই সীমিত যে আঠারো কোটি মানুষের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তা সত্যিই দুঃখজনক।
ইউটিউবে ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর যদি কোনো বক্তৃতা পান, দেখবেন, সেই বক্তৃতা শুনেছে খুব বেশি হলে ৫ হাজার মানুষ। অথচ গালিগালাজ করা, বিদ্বেষ আর উগ্রতা ছড়ানো হয় যেসব ভিডিওতে, সেগুলো শোনে লাখ লাখ মানুষ।
ইন্টারনেটকে আমরা হয়তো একদিন জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের একটা মাধ্যম হিসেবে পাব, কিন্তু সেজন্য অনেক সময় লাগবে। ততদিনে হয়তো ইন্টারনেটই প্রাচীন হয়ে যাবে। নতুন কোনো প্রযুক্তি আসবে।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আপনাকেও ধন্যবাদ।
যে কোনো সমাজে বসবাস করাই একটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। নিজ, পরিবার ও সমাজকে নিয়ে ভাবাই রাজনীতি। সার্বিকভাবে কোনো সমাজে মানুষের সার্বিক অগ্রগতির প্রচেষ্টাই হচ্ছে সেই সমাজের রাজনীতির মোদ্দা কথা। তবে উন্নতি ও অগ্রগতি সবসময়ই আপেক্ষিক। এসব স্থান, কাল ও পাত্রের আলোকে বিবেচিত হয়। এর যেমন বস্তুগত দিক রয়েছে একই সঙ্গে রয়েছে নৈতিক প্রেক্ষাপট যেটা আচার-আচরণের সঙ্গে যুক্ত। অনেক সময় কোনো সমাজের বেশিরভাগ মানুষের আচার-ব্যবহার সেই সমাজের মধ্যকার বৈষম্য সৃষ্টির জন্য দায়ী। সমাজের কেউ কেউ মনে করেন সামাজিক ব্যবহারবিধির ভিত্তি হওয়া উচিত ইতিমধ্যে স্বীকৃত কোনো মোরাল কোড এবং অবশ্যই এর ভিন্ন কিছু নয়। যদিও বস্তুগত সংস্কৃতি ও ব্যবহারবিধি দুটিই পরিবর্তনশীল এবং একে অপরের সঙ্গে যুক্ত ও একে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত। অন্যদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাইরের প্রভাবে বিশেষ করে প্রযুক্তির ব্যবহার ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্বারা ব্যবহারবিধি পরিবর্তিত হয়ে থাকে। তবে নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই হচ্ছে মূল চালিকাশক্তি। কারণ এই সমাজে কোনো একটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ছাড়া টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। যদিও হয় তা অনুগ্রহ নির্ভর এবং তাতে সামাজিক ক্ষমতা কাঠামোতে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। যেমন আমাদের সমাজের বেশিরভাগ নারী সারা দিন গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এর কোনো অর্থনৈতিক মূল্যায়ন না থাকার কারণে তাদের অবস্থান ক্ষমতা কাঠামোর নিম্ন স্তরে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এটাও কি রাজনীতির অংশ? কেন না? অর্থনৈতিক কাঠামো যদি রাজনীতির অংশ হয় তাহলে এর সম্পর্ক নির্ভর ক্ষমতাকাঠামোর সবকিছু রাজনীতিরই অংশ।
রাজনীতিকে আমরা যেভাবেই দেখি না কেন, এতে একটি বৃহত্তর ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষমতা সম্পর্কযুক্ত থাকে আর এর সহজাত জটিলতার কারণেই সহজে একে ব্যাখ্যা করা কঠিন। রাজনীতির মাধ্যমে সামাজিক অগ্রগতির একটি সহজ ব্যাখ্যা হতে পারে এই ক্ষমতা সম্পর্কগুলোর মধ্যে ভারসাম্যমূলক পরিবর্তন এবং সব ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার অন্তর্ভুক্তিমূলক বিকল্প সমাধান। রক্ষণশীল রাজনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে বর্তমান বা সাবেকি ধারণার চাষবাস এবং সেটাকে ক্রমাগত শুদ্ধতার মাপকাঠিতে দেখা, আপাতদৃষ্টিতে যার কোনো চূড়ান্ত পরিসীমা নেই। বিপরীতে, প্রগতিশীল রাজনীতির মূল বিষয় হচ্ছে নতুন চর্চা ও ব্যবস্থাকে আহ্বান করা, যার সবকিছু নিজস্ব হওয়ার ব্যবস্থা নেই, তবে নিজস্ব ভাবধারার আলোকে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুযোগ আছে।
আজকের দিনে আমরা অনেকেই সাধারণ জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিস্পৃহতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকি। প্রচলিত অভিযোগ যে, এখন আমরা অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক এবং এখানে সমাজ নিয়ে ভাববার অবকাশ নেই। তাই সামাজিক সমস্যা সমাধানে সামষ্টিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আজকের দুনিয়ার সামাজিক সমস্যা সমাধান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেন্দ্রিক এবং অনেকটাই প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল। বেশিরভাগ মানুষই যেহেতু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত তাই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইতিমধ্যে তাদের অংশগ্রহণ যে আছে তা বলাই বাহুল্য; তা হোক প্রান্তে বা কেন্দ্রে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ক্ষমতার প্রান্তে যারা আছে তাদের আমরা সত্যিকার অর্থে কেন্দ্রে আনতে চাই কি না?
আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাজনীতি প্রথাগত কেতাবি রাজনীতি থেকে যে ভিন্ন তা সহজেই অনুমেয়। এখানে রাজনীতির একটি বড় ইস্যু হচ্ছে প্রচলিত ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা ও পাশাপাশি ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখানো। তবে এই সময়ের রাজনীতির বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে প্রচলিত ক্ষমতা সম্পর্কে পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হওয়া। অন্যকথায় সমান্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, ক্ষমতার চর্চা ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ বা সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি নিশ্চিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। আর এই ধরনের সামন্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মাঝে মাঝে বা একটি নির্দিষ্ট বিরতিতে পাত্র-পাত্রীর পরিবর্তন হলেও ব্যবস্থাপনাগত পরিবর্তন হয় না, সেখানে কাঠামোগত অগ্রগতির লক্ষ্য অর্জন একটি দুরূহ বিষয়।
আর রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের বিষয়টি এখানেই যেন থমকে গেছে। সাধারণ মানুষ এখান থেকে নতুন কিছু পাচ্ছে না, যেমন পাচ্ছে না বিকল্প উন্নয়ন মডেলের প্রস্তাবনা যা নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে সক্ষম। অন্যথায় সাধারণ জনগণ কেন ব্যবস্থা ঠিক রেখে শুধু পাত্র-পাত্রী পরিবর্তনের হাতিয়ার হবে যদি না এতে তাদের ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া জোরদার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এক্ষেত্রে রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনে প্রতিশ্রুতির কোনো বিকল্প নেই এবং এ সংশ্লিষ্ট প্রতিটি উদ্যোগই প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারে। বিশ্বাসযোগ্য ও আস্থার পরিবেশ তৈরি ও চর্চা ছাড়া শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ কামনা নিছক আবদারের পর্যায়ে পড়ে। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রচলিত আচরণবিধি ও প্রথাগত নৈতিকতার দোহাই দিয়ে জনগণকে সংগঠিত করার চেষ্টা থাকছে সেক্ষেত্রে মানুষকে সাময়িক উদ্বুদ্ধ করতে পারলেও সংকীর্ণ গোষ্ঠীগত স্বার্থের বাস্তবতায় দীর্ঘমেয়াদে সাধারণ জনগণ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতে পারে না। প্রচলিত রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্টই তাদের এই প্রক্রিয়া থেকে বের করে দেয়।
এই অবস্থায় সাধারণ জনগণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে এবং তাদের মাধ্যমে ক্ষমতাকেন্দ্রিক চর্চার পরিবর্তন করতে চাইলে তাদের বঞ্চনাগুলোকে রাজনীতির সামনে নিয়ে আসতে হবে এবং পাশাপাশি রাজনীতিকে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে উদ্ধার করাটাও আবশ্যক। বর্তমান এই রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় এবং জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে কি এরকম কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে যেখানে জনগণ কাঠামোগত পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতে পারে? সত্যিকার অর্থে তারা কি এমন কোনো কর্মসূচি জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছে যে কর্মসূচি ক্ষমতাবান ও সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যকার ব্যবধান বা পার্থক্য কমিয়ে আনতে চায়, ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো বিকেন্দ্রীকরণ করতে চায়? বা প্রকৃতপক্ষেই সমস্যার সমাধান করতে চায়? তারা কি জাতিকে এমন একটি সমাজ কাঠামোর স্বপ্ন দেখাচ্ছে যা বিভেদ ও বিদ্বেষকে দূরে ঠেলে দিয়ে সমতা ও সাম্যের বার্তা সামনে নিয়ে আসছে?
প্রথাগত রাজনীতিতে শুধু পক্ষ বা বিপক্ষ সমর্থন করা আমাদের দেশের রাজনীতির একটি বড় সীমাবদ্ধতা। কারণ শুধু এই পক্ষ-বিপক্ষ চর্চার মাধ্যমে নতুন পথের সন্ধান তো পাওয়া যায়ই না, বরঞ্চ সজ্ঞানে একই ভুল বারবার করা। ভুল জেনেও পুরনো পথকে সমর্থন করতে বাধ্য হওয়া। এ যেন একই চক্রে বারবার ঘুরপাক খাওয়া, যে চক্রের প্রান্তে সাধারণ জনগণ আর কেন্দ্রে ঘুরেফিরে প্রায় সেই তথাকথিত একই শক্তি। তাই সাধারণভাবে রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণের নিস্পৃহতার দায় সাধারণের নয়, বরঞ্চ এখানো যারা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন তাদেরই। জনগণকে তারা কতটুকু আস্থায় নিয়ে আসতে পারছেন সেটাই মুখ্য। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না প্রগতিশীলতা ও পরিবর্তনকামিতা ছাড়া যে রাজনীতি সেটা সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। এই পরিবর্তন শুধু পাত্র-পাত্রীর পরিবর্তন না এই পরিবর্তন হচ্ছে ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোর পরিবর্তন যা সবসময় গণমানুষের পক্ষে ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
লেখক : উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
রবীন্দ্রনাথ তার ‘কালান্তর’ গ্রন্থের একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘ধর্ম যদি অন্তরের জিনিস না হইয়া শাস্ত্রমত ও বাহ্য আচারকেই মুখ্য করিয়া তোলে, তবে সেই ধর্ম যত বড়ো অশান্তির কারণ হয়, এমন আর-কিছুই না।’ কথাটির নিহিত তাৎপর্য আজ আমরা দুনিয়াজুড়ে উপলব্ধি করতে পারছি। রবীন্দ্রনাথের মতো অতটা হয়তো তীব্রভাবে নয়, কিন্তু তার পরও বলি, সেদিনে পিছিয়ে-পড়া মুসলিম সমাজের পক্ষ থেকে একজনকে অন্তত পাই, যার লেখালেখির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ-কথিত কঠিন সত্যিটাই আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সেই লেখক মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী। আজ যাকে আমরা বলতে গেলে ভুলেই গিয়েছি। কেন ভুলে গিয়েছি সেইটা বুঝতে পারা কঠিন হবে না, যদি আমরা তার চিন্তার চৌহদ্দিটা খানিকটা হলেও পরিমাপ করতে পারি।
২. মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরীর প্রথম গ্রন্থ ‘ধর্মের কাহিনী’ প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালে। সেই গ্রন্থের ‘পূর্বাভাস’-এ তিনি বলেছিলেন, ‘মনে হইয়াছে সৎ হওয়াই বুঝি মানব-জীবনের প্রধান কাজ। বাল্যকালের সেই অস্পষ্ট ধারণা বয়সের সহিত ক্রমে স্পষ্ট হইয়াছে।’ ধর্মের সঙ্গে সততার ধারণাকে যুক্ত করে এক দিন তার মনে হয়েছিল, ‘ধর্মই বুঝি মানুষের সবেধন এক নীলমণিসাত রাজার ধন এক মানিক।’ শুধুই এইটুকুই নয়, তার এ-ও মনে হতো, ‘ধর্মই বুঝি মানুষের জীবনের সাধ, সাধের সুখ, সুখের স্বপ্ন। সকলেই বুঝি কেবল ধর্ম পথেরই পথিক।’ কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গে বাস্তব জগতের দিকে তাকিয়ে তিনি ঠিক এর বিপরীত চিত্রটাই দেখতে পেয়েছেন। আর স্বপ্নভঙ্গের সেই বেদনা নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আজ ভীত স্তম্ভিত হইয়া দেখিতেছি, ধর্ম কোথায়ও নাই। বৈশাখ মাসের বাতাসে শুষ্ক পাতা যেমন করিয়া উড়িয়া যায়, আজ জনসমাজ হইতে ধর্মও তেমনিভাবে উড়িয়া গিয়াছে।’ শুধু এইটুকু যোগ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি; ক্ষুব্ধতায় নিজের বেদনাবোধকে এসবের সঙ্গে যুক্ত করে বলেছেন, ‘সত্য, সাধুতা, ন্যায়, দয়া ও পরোপকার আজ স্বপ্নের কাহিনী।’
এই অংশটুকু পাঠ করতে গিয়ে আমাদের কারও-কারও মনে পড়বে কবি জীবনানন্দ দাশের কথা। এয়াকুব আলীর এই প্রবন্ধটি প্রকাশের অনেকগুলো বছর পরে আমাদের সাহিত্যের ‘নির্জনতম’ কবি বলবেন তার চৈতন্য আর অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা এসব নিষ্ঠুর অথচ বাস্তব একপর্যায়ের কথা, যা আমাদের সমাজ জীবনের সঙ্গে তো বটেই, ব্যক্তিগত জীবনেও মিলেমিশে একাকার হয়ে আমাদের প্রতিদিনকার জীবনকে জখম করে রাখে প্রতিনিয়ত। কী বলেছিলেন জীবনানন্দ? তিনি লিখেছিলেন‘চারিদিকে বিকলাঙ্গ অন্ধ ভিড়অলীক প্রয়াণ।/ মন্বন্তর শেষ হলে নতুন যুদ্ধের নান্দীরোল;/ মানুষের লালসার শেষ নেই/ উত্তেজনা ছাড়া কোনো দিন ঋতু ক্ষণ/ অবৈধ সংগম ছাড়া সুখ/ অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ/ নেই।’
৩. দয়া-দান-অতিথি-সেবা নিত্যদিনের কর্মযজ্ঞ এবং সেই সঙ্গে মানুষের আচার-ব্যবহারের কথা বলতে গিয়ে এয়াকুব আলী চৌধুরী নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝি-বা লিখেছিলেন, ‘দেখিয়াছি মফঃস্বলের কোন লোক কলিকাতায় গিয়া জুয়াচোরের হাতে পড়িয়া সর্বস্ব খোয়াইলে তাহার মরণ নিশ্চিত।’ কেন এই কথা? প্রাবন্ধিক জানিয়েছেন, ‘তিন দিন ধরিয়া কলিকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইলেও কেহ তাহাকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করে না।’ শুধু তা-ই নয়; এয়াকুব আলী আরও লিখেছেন, ‘বড় বড় ধপ্ধপে দালানে উঁকি দেওয়ারও তাহার কোন অধিকার নাই।’ অবশেষে তিনি বলেছিলেন, ‘ধর্মের এক অতি প্রিয় অনুষ্ঠান (“অতিথি-সেবা”) এইরূপে আমাদের ধর্মের সংসারে শুকাইয়া মরিতেছেভ্রুক্ষেপ করিবার কেহ নাই।’
বিচিত্রভাবে চারপাশের বিভিন্ন দিকের প্রতি দৃষ্টিপাত করে গ্রন্থের উপসংহারে এসে লেখক বলেছেন, ‘এইরূপে মানবসমাজের যেদিকে ও যে স্তরেই দৃষ্টিপাত করি, সেইদিকে কেবল অধর্মেরই পূর্ণ প্রসার দেখিতে পাই’ আর তারই পরিণামে লেখকের ভাষায়, ‘ধর্মকে কোথায়ও খুঁজিয়া পাই না।’ ধর্মকে খুঁজে পাননি তিনি, শুধু তা-ই নয়, প্রতিদিনকার জীবনযাপনের যে-আনুষঙ্গিক আচরণবিধি, যার মধ্যে একটি সুসংগত জীবনবোধের পরিচয় পাই আমরা, সেই পরার্থপরতা, পরোপকার, জীবসেবা, একটু দয়া, মমত্ববোধ, প্রাণের সহানুভূতি পর্যন্ত লেখক কোথায়ও খুঁজে পাননি। তার পরিবর্তে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, ‘ধর্মবোধ এমনিভাবে লুপ্ত হইয়াছে যে, যে-লোক একটুকু সরল ব্যবহার ও সরল বিশ্বাসী হয়, পাঁচ পয়সা দিব বলিয়া দুই পয়সা দিতে না জানে, বিবিধ কলাকৌশলে...পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গিয়া’ খাইতে না জানে, সেই লোক এই সমাজে ‘নিতান্ত অকর্মণ্য, বোকাচন্ডী বলিয়া স্থির হয়।’
৪. এয়াকুব আলী চৌধুরী প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মেও বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু মনুষ্যধর্মকে তার থেকে বিযুক্ত করতে চাননি কখনো। এটি চাননি বলেই মানুষ সম্পর্কে তিনি বিশ্বাস করতেন, সে শুধুই জড়পদার্থ নয়, সে চৈতন্যস্বরূপ। আর ‘চৈতন্য মানেই যে আধ্যাত্মিকতা’ইসলাম ধর্মের অনুসারী হয়েও, ভারতীয় দর্শনের এই তত্ত্বটিকে তিনি একেবারেই অস্বীকার করেননি। মানুষকে উদ্দেশ করে সে-কারণেই তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি গরু নও, বানর নও, ব্যাঘ্র নওতুমি মানুষ। এই জড়দেহ তাহার ক্ষুদ্র সীমার পরপারে, হে পুণ্য ও চৈতন্যস্বরূপ! তোমার তরে স্বর্গের ও বিভু মিলনের অপার শান্তি, তৃপ্তি ও আনন্দ সঞ্চিত রহিয়াছে। কেন ভুলিবে, কেন ডুবিবে, কেন মরিবে?’ প্রতিটি মানুষকে এয়াকুব আলী একটা মর্যাদাবান সত্তা হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সময়ের বিচারে তিনি যে একজন অগ্রসর মানুষ ছিলেন, সেটি প্রমাণিত হয় তার চিন্তার অভিব্যক্তিতে, যা কি না এইসব বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। অথচ অবাক হতে হয় এ কারণেই যে মানুষটি জন্মেছিলেন ফরিদপুরের পাংশা থানার মাগুরাডাঙ্গা গ্রামে, ১৮৮৮ সালে (১৮ই কার্তিক, ১২৯৫ বঙ্গাব্দ)। চোখের অসুখে ভুগতেন বলে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের পড়াশোনাটাও শেষ করতে পারেননি।
৫. এয়াকুব আলী চৌধুরীর জীবন সম্পর্কে জানাতে গিয়ে প্রাবন্ধিক-গবেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম লিখেছেন, মাত্র ‘৪৭-৪৮ বৎসর বয়সে তিনি ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হন। জীবনের শেষ কয়েকটি বৎসর তাকে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় গ্রামের বাড়িতে দিন কাটাতে হয়।’ তিনি নিজে একজন আত্মসচেতন ও প্রতিভাধর মানুষ ছিলেন বলেই, সমাজের ইসলাম ধর্মানুসারী মানুষকে এইভাবে বলতে পেরেছিলেন, ‘প্রতিভা তোমার মনুষ্যত্বের স্পর্ধা, জ্ঞান ও চৈতন্য তোমার মানবতার গরিমা! কেন ভুলিবে, কেন ছোট হইবে, কেন পাপ করিবে?’ আমরা বুঝতে পারি নিজের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে তিনি কতিপয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি, দেখতেও চাননি। সেটিকে গোটা মানবসমাজের স্পর্ধা ও গরিমার সঙ্গে সে-কারণেই যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এয়াকুব আলী চৌধুরী প্রচলিত অর্থে ধার্মিক ছিলেন ঠিকই, আর তার ধর্মচর্চার মধ্যে আমরা সক্রিয়তার মনোভাব নানাভাবে দেখতে পাই। যে-সক্রিয়তা সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যেও বলিষ্ঠভাবে ছিল বলে মনে করি। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘সম্প্রতি সুশিক্ষিত বাঙ্গালিদিগের মধ্যে হিন্দুধর্মের আলোচনা দেখা যাইতেছে। অনেকেই মনে করেন যে, আমরা হিন্দুধর্মের প্রতি ভক্তিমান হইতেছি। যদি এ কথা সত্য হয় তবে আহ্লাদের বিষয় বটে।’ কেন আহ্লাদের বিষয়, সেটি খোলাসা করতে গিয়ে ভাববাদী বঙ্কিম তার দৃঢ় বিশ্বাসের কথা এইভাবে আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘জাতীয় ধর্মে পুনর্জীবন ব্যতীত ভারতবর্ষের মঙ্গল নাই।’ কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি এটিও বলতে দ্বিধা করেননি, ‘হিন্দু হাঁচি পড়িলে পা বাড়ায় না, টিকটিক ডাকিলে “সত্য সত্য” বলে, হাই উঠিলে তুড়ি দেয়।’ এগুলোকে তিনি ধর্ম বা ধর্মীয় আচার হিসেবে মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তার মতে, ‘এ সকল হিন্দুধর্ম নহে। মূর্খের আচার মাত্র। যদি ইহা হিন্দুধর্ম হয়, তবে আমরা মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি যে, আমরা হিন্দুধর্মের পুনর্জ্জীবন চাহি না।’ অন্যদিকে তার রচিত ‘ধর্মের কাহিনী’ গ্রন্থটি সম্পর্কে মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বলেছিলেন, ‘এই পুস্তক সংসারে সর্বজনীন পাপ-স্রোতের বিরুদ্ধে ধর্মের এক স্বাভাবিক আর্তনাদ।’ তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘মানুষকে সংসারে ধর্মের নামে ধর্মকে ফাঁকি দিয়া নিত্যনিয়ত অধর্ম করিতে দেখিয়া অন্তরে যে দারুণ বেদনা অনুভব করিয়াছি, এই ক্ষুদ্র পুস্তক তাহারই প্রকাশ মাত্র।’ এয়াকুব আলীর এই কথাগুলি পাঠ করতে গিয়ে ধর্ম প্রসঙ্গে কার্ল মার্কসের কয়েকটি কথা মনে না-পড়ে পারে না। এটিও তার চিন্তার অগ্রসরতারতাই আরেকটি নমুনা।
৬. অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম তার প্রবন্ধে এয়াকুব আলীর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে আমাদের আরও কিছু তথ্য জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ ছিল তার জীবন। পক্ষান্তরে তার জীবনও অনেক দুঃখ-কষ্টে পরিকীর্ণ। সাংবাদিক হিসেবেও তার খ্যাতি ছিল এবং এ-সময়ই তিনি বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও সাহিত্য-সমিতির সঙ্গে যুক্ত থাকেন।’ এই তথ্য জেনে আমরা বিমর্ষ বোধ করি যে, ‘দুঃখ-কষ্ট ও দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে হয় বলে তার গ্রন্থ-সংখ্যা খুব বেশি নয়।’ শ্রদ্ধেয় আবদুল কাইয়ুম ঠিকই বলেছেন। এয়াকুব আলীর প্রকাশিত গ্রন্থ-সংখ্যা মাত্র চারটি। ব্যঞ্জনাময় গদ্যে রচিত ‘ধর্মের কাহিনী’ নিয়ে আমরা সামান্য আলোচনা করেছি। এ ছাড়া রয়েছে‘নূরনবী’ (১৯১৮), ‘শান্তিধারা’ (১৯১৯) ও ‘মানব-মুকুট’ (১৯২২)। তার অপ্রকাশিত রচনার একটি সংকলন ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
৭. রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে, ব্যক্তি মানুষের ‘সর্বজনীন মনকে উত্তরোত্তর বিশুদ্ধ করে উপলব্ধি করাতেই মানুষের অভিব্যক্তির উৎকর্ষ।’ অভিব্যক্তির সেই উৎকর্ষের অনেকখানি আমরা মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরীর রচনায়, চিন্তায়, তার অটল সাধনার মধ্যে দেখতে পাই। লেখাই বাহুল্য যে, সেই সাধনারই প্রকাশিত মর্ম-মাধুরী হচ্ছে তার রচনাকর্ম। ১৯৪০ সালের ১৫ ডিসেম্বর এই সাধক-লেখক প্রয়াত হন। আমরা তার স্মৃতির গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রেললাইনে একের পর এক লাশ পাওয়া যাচ্ছে। এই লাশ কেবল দেশব্যাপী রেলপথে দুর্ঘটনায় কাটা পড়া লাশই নয় রেললাইন আর লাইনের পাশের জমিতে পড়ে থাকছে লাশ। অনেক ক্ষেত্রেই এসব মৃত্যু নিয়ে রহস্যের জট খুলছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব লাশের মধ্যে যেমন অসতর্কতার কারণে ট্রেনে কাটা পড়া কিংবা আত্মহত্যায় মৃত্যুর লাশ রয়েছে, তেমনি রয়েছে ডাকাতির সময় ট্রেন থেকে ফেলে হত্যা করা ব্যক্তির লাশও। আবার অন্য কোথাও কাউকে হত্যা করে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু বলে চালানোর জন্য লাশ ফেলে রাখা হয় রেললাইনে। বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন চিত্র দেখা গেলেও বিশেষ উদ্বেগ দেখা দিয়েছে রাজধানী ঢাকার লাগোয়া গাজীপুরের কিছু নির্দিষ্ট রেলপথ নিয়ে। দেশ রূপান্তরে রবিবার ‘গাজীপুরে এক বছরে রেললাইনে ৬০ লাশ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন উদ্বেগের কথা। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, চলতি ২০২২ সালে এখন পর্যন্ত গাজীপুর জেলার ধীরাশ্রম থেকে শ্রীপুরের কাওরাইদ এবং টাঙ্গাইলের মির্জাপুর আউটার সিগন্যাল পর্যন্ত রেললাইন ও এর আশপাশ থেকে ৪৫ জনের লাশ উদ্ধার করেছে রেলওয়ে পুলিশ। এছাড়া ধীরাশ্রম থেকে টঙ্গী পর্যন্ত এবং টঙ্গী থেকে কালীগঞ্জের আড়িখোলা পর্যন্ত রেলপথ থেকে আরও অন্তত ১৫টি লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট এলাকার রেলওয়ে থানা পুলিশ জানিয়েছে। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠছে গাজীপুরে রেলপথের এমন নির্দিষ্ট এলাকাতেই কেন বারবার লাশ পাওয়া যাচ্ছে?
খেয়াল করা দরকার, রেলপথে মৃত্যুর মিছিল এমনিতেই বেশ দীর্ঘ। কেবল ২০২১ সালেই রেলপথে ২৭০টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৫৪ জন, আহত হয়েছেন ৪২ জন। এর ওপর কেবল এক জেলাতেই এক বছরে রেলপথে ৬০টি লাশ পাওয়ার কারণ অনুসন্ধান জরুরি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসতর্কতার কারণে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর অন্যতম কারণ রেললাইনের ওপর অবৈধ রেলক্রসিং এবং রেললাইন ঘেঁষে অবৈধ বাজার ও অস্থায়ী দোকান বসানো। টঙ্গীর বনমালা ও আরিচপুরে রেললাইনের ওপর মানুষের ভিড় থাকে প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে বিকেল থেকে রাত। আরিচপুরে রেললাইনের ওপর অবৈধ বাজার থাকায় সেখানে টঙ্গী ও উত্তরার মানুষ বাজার করতে আসেন। কিন্তু হুটহাট ট্রেন চলে এলে লাইন থেকে সরে দাঁড়ানোর তেমন জায়গা না থাকায় ঘটে প্রাণহানির ঘটনা। এছাড়া স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কিছু কিছু এলাকায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রেললাইনের ওপর ভিড় জমায় তরুণ-তরুণীরা। অনেক সময় লাইনের ওপর হাঁটাহাঁটি ও টিকটক ভিডিও বানানোর সময় ঘটে দুর্ঘটনা। এই এলাকায় প্রায়ই রেলে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দেওয়া জরুরি অরক্ষিত রেললাইনের সুরক্ষা নিয়ে। রেললাইনের ওপর কিংবা রেললাইন ও স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় অবৈধভাবে বাজার বসানো এবং দোকানপাট সারা দেশের সাধারণ বাস্তবতা হলেও এমন কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না কেন? রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যথাযথ উদ্যোগের পাশাপাশি এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের সক্রিয়া হওয়া জরুরি।
রেলপথে এমন লাশ পড়ে থাকা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, নদীতে লাশ ভেসে থাকার কথা। মাত্র কিছুদিন আগেই দেশ রূপান্তরে ‘২২ মাসে ৭১৫ লাশ নদীতে’ শিরোনামের প্রতিবেদনে নদীতে লাশ পাওয়ার এক নির্মম বাস্তবতা সামনে উঠে এসেছিল। প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল হত্যাকারীরা লাশ নিশ্চিহ্নের উদ্দেশ্যে হত্যার পর নদীতে লাশ ভাসিয়ে দিচ্ছে। ওই ৭১৫ লাশের মধ্যে ২১৬টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনও করা হয়েছে। সারা দেশেই এমন ঘটনা ঘটলেও শুধু রাজধানী ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদী থেকেই গত ১০ মাসে উদ্ধার করা হয়েছিল ৯০টি লাশ। তদন্তকারী সংস্থাগুলো বলছে, নদীতে উদ্ধার হওয়া লাশগুলোর বেশিরভাগই হত্যাকাণ্ডের শিকার বলে আশঙ্কা তাদের। আর সেসব হত্যাকান্ডের বেশিরভাগই ডাঙায় ঘটলেও লাশ ফেলা হচ্ছে নদীতে। ফলে তদন্তে বেগ পেতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর বেশকিছু নির্জন স্থানকে অপরাধীরা লাশ ফেলার নিরাপদ এলাকা হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছিল, রাজধানী ঘিরে থাকা বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীকে লাশের ডাম্পিং জোন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না। একই কারণে এই সন্দেহ করার অবকাশ আছে যে, গাজীপুর জেলার ওই নির্দিষ্ট এলাকাগুলোর রেললাইনকেও অপরাধীরা লাশের ডাম্পিং জোন হিসেবে ব্যবহার করছে কি না। এমন এক সময়ে দেশের রেলপথ আর নদী থেকে একের পর এক লাশ উদ্ধারের ঘটনা দেখছি যখন গুম-খুন-নিখোঁজের রহস্য উন্মোচন ক্রমশই দুরূহ হয়ে উঠছে। অন্যদিকে রেলপথে পড়ে থাকা আর নদীতে ভাসা লাশের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এই বাস্তবতাকে বিশেষভাবে আমলে নিয়ে রেলপথে লাশ উদ্ধারের বিষয়ে বিশদ তদন্ত জরুরি।
রাজধানীর মিরপুরের একটি মাধ্যমিক-সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সিফাত। একই এলাকায় বসবাসকারী তার বন্ধু সিয়াম পড়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে। সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার থেকে রোজার ছুটি। আর সরকারি প্রাথমিকে ছুটি ১৫ রোজা অর্থাৎ ৭ এপ্রিল থেকে।
এক দেশে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন নিয়মে ছুটি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে লেখাপড়ায় কেউ এগিয়ে যাবে, আবার কেউ পিছিয়ে পড়বে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার বা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে ভেবেচিন্তেই নেয়। তবে সব ধরনের স্কুলে একটা কো-অর্ডিনেশন থাকলে ভালো হয়। আমরা ছুটির ব্যাপারে আরও আলাপ-আলোচনা করব।’
জানা গেছে, চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে আগামী শুক্রবার শুরু হতে পারে রমজান মাস। বছরের শুরুতেই স্কুলগুলোর ছুটির তালিকা অনুমোদন করা হয়। সে অনুযায়ী পবিত্র রমজান, স্বাধীনতা দিবস, ইস্টার সানডে, বৈসাবি, নববর্ষ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা ও টিটি (টিচার্স ট্রেনিং) কলেজেও একই সময়ে ছুটির ঘোষণা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছুটির তালিকা ভিন্ন। তারা পবিত্র রমজান, ইস্টার সানডে, চৈত্র-সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আগামী ৭ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ প্রায় ১৫ রমজান পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা থাকবে।
রাজধানীসহ বড় বড় শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকের মতোই তাদের ছুটি থাকবে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রোজার ছুটিও একই। তবে মাদ্রাসায় রোজার ছুটি শুরু এক দিন আগেই অর্থাৎ আজ বুধবার, ২২ মার্চ।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। তাই বুধবার ক্লাস করে বৃহস্পতিবার রোজার ছুটি শুরু হবে। তবে সব স্কুলে একই ধরনের ছুটি থাকা জরুরি। এতে একই সময়ে সিলেবাস শেষ করা যাবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সন্তুষ্ট থাকবে।’
রমজানে মাধ্যমিকে স্কুল বন্ধ আর প্রাথমিকে খোলা রাখায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষকের মধ্যে। তারা বলছেন, যেসব অভিভাবকের সন্তান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্কুলেই পড়ে তাদের সমস্যা হবে। রমজান মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও রোজা রাখেন। তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিল রেখে প্রাথমিকের ছুটি নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগাঠনিক সম্পাদক জুলফিকার আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকারি ছুটি ৭৬ দিন, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৫৪ দিন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিন্ন ছুটি নির্ধারণের যুক্তি তুলে ধরে আমরা ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছি। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো সাড়া পাইনি।’
‘বস্তি এলাকার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। পানি সরবরাহ ও নর্দমা লাইন প্রায়ই এক হয়ে যাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে দূষিত ও নোংরা পানি পান করছেন তারা।’ এভাবে বলছিলেন ঢাকার বস্তির জীবন মান নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকের উন্নয়ন কর্মী বাছেরা আক্তার।
শুধু বস্তি এলাকা নয়, দেশের সব এলাকার সুপেয় পানি সরবরাহের চিত্র এমনই। রাজধানী ঢাকায় সরবরাহ করা পানিই না ফুটিয়ে পান করা যায় না। চট্টগ্রাম শহরের পানি লবণাক্ত। রাজশাহীর পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ। খুলনায় সরবরাহ করা পানিও না ফুটিয়ে পান করা যায় না। রয়েছে লবণাক্ততাও। গভীর নলকূপের পানিও নিরাপদ নয়, আর্সেনিক ও লবণাক্ততার কারণে ব্যবহার করাও দুষ্কর। পাহাড়ে সুপেয় পানির উৎস সীমিত। পাহাড়ি ছড়া শুকিয়ে যাচ্ছে। উজানে বাঁধ দেওয়ার কারণে নদন্ডনদীর পানিও কমছে। সুপেয় পানি ও সেচের জন্য অত্যধিক মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে দিন দিন।
এ পরিস্থিতিতে আজ ২২ মার্চ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য : ‘আসুন নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধানে পরিবর্তন ত্বরান্বিত করি।’
সরকারের পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় মিষ্টি পানিসমৃদ্ধ বাংলাদেশেও সুপেয় পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকার মানুষ সুপেয় পানির বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও নিরাপদ পানি মিলছে না। এ ব্যর্থতা ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনও হুমকিতে পড়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. তানভীর আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানিকে সুপেয় পানি বলা যায়। তবে সেখানে কোনো ময়লা ঢুকে পড়লে সেই পানিকে আর সুপেয় থাকে না। সুপেয় পানি না ফুটিয়েই পান করা যাবে।’
পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ওয়াসার পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে অনেক সময় বাইরে ময়লা ঢুকে পড়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এমন ঘটনা ঘটলে সেই পানিকে নিরাপদ বলা যাবে না। শুধু ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের পানির মান ভালো হলে চলবে না, বাসা পর্যন্ত ভালো পানি পৌঁছে দিতে হবে। কেননা সরবরাহ লাইনের পানি নিরাপদ রাখাও সংস্থার দায়িত্ব।’
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন এবং ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে। এ জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা পিছিয়ে রয়েছি। আশা করি সবাই মিলে কাজ করে পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দূর করে আমরা নির্ধারণ সময়ে লক্ষ্যপূরণ করতে পারব।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার। এর মধ্যে ৫৯ ভাগ অর্থাৎ ৯ কোটি ৭৪ লাখ ৪৩ হাজার ২২০ জন মানুষ সুপেয় পানি সুবিধার আওতায় এসেছে। আর সুপেয় পানি সুবিধার বাইরে রয়েছে ৪১ ভাগ অর্থাৎ ৬ কোটি ৭৭ লাখ ১৪ হাজার ৭৮০ জন মানুষ। এখনো দেশের ১০ ভাগ মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে।
বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-তে বলা হয়েছে, দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সুপেয় পানি প্রাপ্যতার বিবেচনায় ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে চর এলাকা, বন্যাপ্রবণ এলাকা, উপকূলীয় এলাকা, হাওর এলাকা, বরেন্দ্র অঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকা। দেশের এই ছয় শ্রেণির এলাকা বিস্তৃত রয়েছে ১০০টি উপজেলায়। দেশের ১৫৯ সিটি ও পৌরসভায় সরবরাহ করা পানির মানও একই। ওইসব এলাকায় ১৬৮টি পানি শোধনাগার, ১ হাজার ৫০০টি গভীর নলকূপে ১৫ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সরকার চালু রেখেছে। গ্রাম পর্যায়ের ২০ লাখ টিউবওয়েলের পানি নিরাপদ হওয়ার কথা ছিল। তবে আর্সেনিক ও মাত্রাতিরিক্ত আয়রন সে পানিও জনজীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।
২০১৬ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বিশে^র সবচেয়ে বড় ‘গণবিষ’-এর উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের আর্সেনিক পরিস্থিতিকে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বছরে আর্সেনিকে ৪৩ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার তথ্য প্রকাশ করা হয়। আর ২০০৩ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, দেশের ২৯ শতাংশ নলকূপে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আর্সেনিক পাওয়া যায়। আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী শনাক্তে ২০১২ সালে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। তখন ৬৫ হাজার ৯১০ জন রোগী শনাক্ত করা হয়। ২০১৭ সালে ৪২টি জেলার হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ তথ্য সংগ্রহ করে। ওই হিসাব অনুযায়ী, ওই বছর এসব হাসপাতালে ১৮ হাজার ৬৬২ আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী সেবা গ্রহণ করে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের সরকারিভাবে স্থাপিত গভীর ও অগভীর নলকূপ রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। সেই হিসাবে জনসংখ্যার বিবেচনায় সরকার ৮৩ জনে একটি পানির উৎস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। সমগ্র জনসংখ্যার বিবেচনায় বর্তমান পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে ১১ ভাগ। আর শহর এলাকার জনসংখ্যা বিবেচনায় ৩৮ ভাগ।
এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারকে সুপেয় পানি সরবরাহে শতভাগ সাফল্য অর্জন করতে হবে। সেটা করতে হলে প্রতি বছর ছয় ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। বর্তমান অগ্রগতি প্রায় এক ভাগ। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণে সামনের দিনগুলোতে পানি সরবরাহ খাতের অর্জন আরও কম হতে পারে। এ জন্য লক্ষ্য পূরণে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে চারগুণ তৎপরতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা যায়, দেশে বেসরকারি টিউবওয়েল রয়েছে প্রায় দেড় কোটি। আর সরকারি টিউবওয়েল রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। এ দুটো ধরে হিসাব করতে দাঁড়ায় প্রতি ১০ জনে একটি পানির উৎস রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ, কয়রা, বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এলাকায় পানযোগ্য পানি খুবই দুষ্পাপ্য। এসব এলাকার বেশিরভাগ উপজেলায় গভীর নলকূপ কার্যকর নয়। সরকার পানি সরবরাহ সেবার আওতায় আনতে পেরেছে ৯৮ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষকে। এখনো ১ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষ পানি সুবিধার আওতার বাইরে রয়েছে।
নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর : ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ায় স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। যে হারে পানির স্তর নামছে, সে হারে পানির স্তর পূরণ হচ্ছে না। স্বাভাবিক অবস্থা ৬ থেকে ৭ ফুট নিচেই ভূগর্ভস্থ উৎসে পানি পাওয়ার কথা। কিন্তু সে অবস্থা এখন আর নেই। ঢাকায় পানি পেতে ২৫৫ থেকে ২৬০ মিটার নিচে নামতে হচ্ছে। খুলনায় ভূগর্ভস্থ পানি নেমে গেছে ২৫-৩০ ফুট। রাজশাহী ও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর ১২০ থেকে ১৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে। খরার মৌসুমে এ অবস্থা থাকে। বর্ষার মৌসুমে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়।
অন্যদিকে দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২-৩ মিটার নেমে যায়। আর ২৫ ভাগ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৫-১০ মিটার নেমে যায়। বর্ষার মৌসুমে এসব এলাকার বেশিরভাগ অংশে পানির ভূগর্ভস্থ স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে। তবে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল ও দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে না। দেশের গৃহস্থালি ও খাবার পানির ৯৪ শতাংশ চাহিদা পূরণ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। গ্রাম এলাকায় এ উৎস থেকে ৯৯ শতাংশ ও শহর এলাকায় ৮০ শতাংশ পানি সরবরাহ করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ১৮ শতাংশ নলকূপের পানি উত্তোলনে সমস্যা হয়। এ ছাড়া ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা, মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ, গড়াই নদীর পানি কমে যাওয়ায় এসব এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পুনঃভরণ হয় না।
ভূ-উপরিস্থ সুপেয় পানির উৎসের অভাবে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর অঞ্চলে সারা বছর সুপেয় পানির সংকট থাকে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যরকম সংকট। খরার মৌসুমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনার নলকূপগুলোতে পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। বর্ষার মৌসুমে দেশের অন্যান্য এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির শূন্য স্তরের ২৫ শতাংশ পূরণ হয়ে যায়। তবে বরেন্দ্র অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয়। ওইসব এলাকায় ১৬০ ফুটের আগে পানির দেখা মিলছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূগর্ভস্থ পানি বিভাগের পরিচালক এবং পানি বিশেষজ্ঞ ড. আনোয়ার জাহিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারকে বর্ষায় কৃত্রিমভাবে মাটির নিচে পানি প্রবেশ করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমন উদ্যোগ নেওয়া না হলে ভবিষ্যতে দেশ বড় ধরনের পানি সংকটের মুখোমুখি হতে পারে।
উপকূলে লবণাক্ততা সমস্যা : ভূতত্ত্ববিদদের মতে, উপকূলীয় এলাকার পানিতে একবার লবণাক্ত পানি প্রবেশ করলে ওখানকার ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নদীতে পানি না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই অববাহিকা অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নেমে যাবে। একই সঙ্গে সাগরের দিক থেকে লবণ পানি প্রবেশের হার বাড়বে।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরের উপকূলীয় এলকাগুলোতে আমরা গভীর নলকূপ বসাতে পারি না। এই এলাকায় নলকূপে লবণাক্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে।’
উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা কমাতে উজান থেকে পানির প্রবাহ বাড়ানোর কথা বলছে ভূতত্ত্ববিদরা। কিন্তু ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ৫৬টি যৌথ নদী থেকে ইতিমধ্যে পানি প্রত্যাহার শুরু হয়েছে। এর প্রভাবে দেশের নদীগুলোতে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে এবং শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়েও যাচ্ছে। নদীগুলোর গভীরতা কমে গিয়ে পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সারা নওরিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের উত্তরাঞ্চলে স্বাভাবিকভাবেই পানির স্তর নিচে। এখন এই হার আরও বেড়েছে।’
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
২০১০ সালে ভোলার চর কুকরিমুকরি বনের ১৫ হাজার গাছের প্রাণভিক্ষা চেয়ে লিখেছিলাম। ‘১৫ হাজার গাছের প্রাণভিক্ষা চাই’ শিরোনামে দৈনিকে প্রকাশিত লেখাটি নিয়ে আলাপ ওঠেছিল তখন। চর কুকরিমুকরি বনের উত্তরাংশ বাবুগঞ্জ থেকে পাতিলার বুড়াগৌরাঙ্গ নদ পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২০ ফুট প্রশস্ত পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য কুকরিমুকরি ইউনিয়ন পরিষদ বন বিভাগে আবেদন করে। ১৬ মে ২০১০ তারিখে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ন্যূনতম গাছ কাটার শর্তে সড়ক নির্মাণের অনুমতি দেয়। সড়কপথে দ্বীপচরে যাতায়াতের জন্য মাত্র ১৫ মিনিট সময় বাঁচাতে প্রাণদন্ড দেয়া হয়েছিল ১৫ হাজার গাছের। কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, পশুরের মতো অবিস্মরণীয় সব ম্যানগ্রোভ বৃক্ষপ্রজাতি।
চর কুকরিমুকরির পর এবার ভোলার ঢালচরের উপকূল বন বিপদে পড়েছে। উপকূল বন নিশ্চিহ্ন করে ঘরবাড়ি, বাণিজ্যিক মাছের ঘের, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এ ছাড়া বনের গাছ কেটে ইটভাটায় বিক্রি হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ, ঢালচরের প্রায় একশ একর বনভূমি উজাড় হয়েছে এভাবেই। মূলত বসতি স্থাপন, বেদখল, মাছের ঘের ও মাছ-ঘাট, এবং ইটভাটার কারণে। ঢালচর ইউনিয়নের চর সত্যেন মৌজার মাঝের চরে প্রায় ৭১ একর অরণ্যভূমি উজাড় করা হয়েছে। পুরো অঞ্চলে নিথর হয়ে পড়ে আছে বহু নিহত গাছের গুঁড়ি। চারধারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই রক্তাক্ত লাশ খ-গুলোই জানান দিচ্ছে কী নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক উপকূল বন। গণমাধ্যম জানায়, দ্রুত গাছ কাটার জন্য এখানে ভেকু মেশিন (যন্ত্রচালিত এক্সকাভেটর) ব্যবহার করা হয়। বন নিধনে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ জড়িত থাকলেও গণমাধ্যমের কাছে এ অভিযোগ অস্বীকার করে।
বন কেটে দখল নিয়ে যারা বসত গড়েছেন তাদের সবার ভাষ্য হলো, নদীভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে এই বিরান হওয়া বনভূমিতে তারা আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রাকৃতিকভাবে তো এই বন বিরান হয়নি, নিষ্ঠুরভাবে একে বিরান করা হয়েছে। ঢালচরসহ ভোলা ও উপকূল অঞ্চলে মূলত প্রাকৃতিকভাবেই বিশেষ ম্যানগ্রোভ বন গড়ে ওঠে। ঢালচর সংরক্ষিত বনের আওতায় প্রায় ১০ হাজার হেক্টর এলাকা আছে। স্থানীয় বন বিভাগের ভাষ্য, ১৯৭৬ সালে ঢালচরের মাঝেরচরে বৃক্ষরোপণ করা হয় এবং নদীভাঙনকবলিত মানুষের আশ্রয়ের নামে ইতিমধ্যে ৭৬ একর বন উজাড় হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে বন উজাড়ের ঘটনায় বন বিভাগ ৩৫টি মামলা করেও বন বিনাশ রোধ করতে পারেনি। জোয়ার-ভাটা ও ভূমি ভাঙা-গড়ার ভেতর দিয়ে চরফ্যাশনের বাস্তুতন্ত্র প্রতিনিয়ত বিকশিত হচ্ছে।
ঢালচর, পূর্বেরচর, ভাসানচর, বয়ারচর, চর আলিম, আন্ডারচর, কলাগাছিয়াচর ও শিবচরের মতো ভূখ-গুলো প্রায় ৮ হাজার একর ভূমি নিয়ে নতুনভাবে জেগেছে। এসব ভূমিতেও জোয়ার-ভাটায় ভেসে আসা বীজ দিনে দিনে নতুন বন-প্রতিবেশ গড়ে তুলবে। ঢালচরসহ পুরো উপকূল অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগ-প্রহরী এই উপকূল বনগুলো। নিয়ত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, তীব্র তাপপ্রবাহ সব আপদ নিজের জীবন দিয়ে সামলিয়ে উপকূলকে নিরাপদ রাখে বনের বৃক্ষকুল। আর উপকূল-প্রহরী এই গাছগুলোকে খুন করে আমরা উপকূলকে বারবার বিপদের দিকে ঠেলছি। বৃক্ষপ্রাচীর ও বন ছাড়া আপদন্ডবিপদ সামাল দেয়া সম্ভব নয়।
সত্তরের ঘূর্ণিঝড়, বিধ্বস্ত মনপুরা কিংবা সিডরের অভিজ্ঞতা কী বলে? সুন্দরবনসহ উপকূল বনভূমি ও বৃক্ষকুল প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি ও মাত্রা নিজের জীবন দিয়ে দুর্বল করেছে। উপকূলে বন না থাকলে সব আপদন্ডবিপদে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি অসহনীয় হয়ে উঠত। কিন্তু আমরা আমাদের উপকূলের বৃক্ষকুল ও বনের কাছে একবিন্দু কৃতজ্ঞতাও জারি রাখিনি। বরং প্রতিদিন উপকূল বনকে ল-ভ- রক্তাক্ত করছি। ঢালচরের উপকূল বন সামগ্রিকভাবে সুরক্ষা করতে হবে। বৃক্ষ ও বন নিধনের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইন ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। ঢালচরসহ উপকূল বনের সামগ্রিক পরিস্থিতি এবং করণীয় বিষয়ে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার ও তৎপরতা স্পষ্ট করতে হবে।
আয়তনে ছোট্ট হলেও প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে বাংলাদেশ অনন্য। সমতল, অববাহিকা, বরেন্দ্র, গড়, টিলা, পাহাড়, চর এলাকার পাশাপাশি দেশের নোয়াখালী, ভোলা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সুন্দরবন অঞ্চলের উপকূল-চর ও দ্বীপগুলো দেশকে দিয়েছে বিশেষ আমেজ ও গতিময়তা। নোয়াখালীর নিঝুপ দ্বীপ, সুখচর, হাতিয়া, তমরুদ্দিন, নলচিরা, চান্দনন্দি, হারনি, চর কিং, বয়রারচর, চরপিয়া; ভোলার মনপুরা, চর মনিকা, চর সাকুচিয়া, চরনিজাম, ঢালচর, চর কুকরিমুকরি, গাজীপুর, ভেদরিয়া, সোনাচর, হাজিরহাট, চর নিউটন, চর পাতিলা, চর লক্ষ্মী, চর আইচা, নীলকমল, মদনপুর, মেদুয়া; চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ; কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিন বা নারিকেল জিঞ্জিরা, সোনাদিয়া, শাহপরীর দ্বীপ এবং সুন্দরবন অঞ্চলের আন্ডারচর, ডিমেরচর, দিয়ারচর, কালীরচর বা দুবলারচর দেশের গুরুত্বপূর্ণ উপকূল চর ও দ্বীপাঞ্চল। নদীপ্রবাহের বিস্তীর্ণ পলিমাটিতে গড়ে ওঠা এসব চর-দ্বীপ। মহেশখালী শৈল দ্বীপ আর সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপ। প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক নানা বিন্যাস গড়ে উঠেছে এসব অঞ্চলে। এসব দ্বীপে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে নয়া ম্যানগ্রোভ বাস্তুসংস্থান। মাছ, পাখি, সরীসৃপ, কাছিমসহ জলজ ও স্থলজ প্রাণবৈচিত্র্যের এক অবিস্মরণীয় আখ্যান তৈরি হয়েছে দেশের দ্বীপগুলোতে।
জলোচ্ছ্বাস ও ঝড় থেকে দেশের ভূগোল বুক আগলে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে এসব দ্বীপাঞ্চল। শত-সহস্র মাছের জোগান দিয়ে তরতাজা রাখছে রাষ্ট্রের অর্থনীতি। কিন্তু নিদারুণভাবে বাংলাদেশের উপকূল-চর ও দ্বীপগুলো এক ‘অচ্ছুত’ এবং বঞ্চিত ভূগোল। এখানকার প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ নিরাপত্তা কোনো বিবেচনায় রাখা হয় না। এসব উপকূল চর ও দ্বীপগুলোর পরিবেশবিনাশ কিংবা সামাজিক সংঘাতের খবর খুব একটা প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েও আসে না। দেখা গেছে, একেবারেই স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্য ও বিনাশ করে। এমনকি বৃহৎ অবকাঠামো, খনন, বাণিজ্যিক পর্যটন, করপোরেট মনস্তত্ত্বও উপকূল বনের প্রাকৃতিক বিকাশের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশেষ করে উপকূল চরের বন বাস্তুতন্ত্র এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত। বসতি স্থাপন কিংবা বাসস্থান সম্প্রসারণের নামে সবচেয়ে প্রথম কোপ পড়ে উপকূল বনে। এভাবেই আমরা হারিয়েছি চর কুকরিমুকরি কিংবা ঢালচরের বিশাল অংশ।
ঢেউয়ে ভেসে আসা কেউরগুলা, ছুনে গুলা, শিউলি গুলা, গাকগুলা, কেয়াড়াগুলা, সুগুলা, উন্দুরাগুলা, চরিকগুলা, গুরুপ ফলগুলো মাছের জালে উঠে বা হাতেও ধরা যায়। নানান জাতের ইলিশ, পাতা মাছ, ব্যাঙ মাছ, আটগোড়া মাছ উপকূল চর-দ্বীপের অনন্য প্রাণসত্তা। উপকূলীয় অনেক চর-দ্বীপে বিকশিত হওয়া ম্যানগ্রোভ বাস্তুসংস্থানে শেয়াল, কাঠবিড়ালি, গুইসাপের পাশাপাশি হরিণেরও বংশবিস্তার ঘটছে। বিশ্বব্যাপী ঝুঁকিতে থাকা চামচঠুঁটো বাটান পাখির বিচরণস্থল ঢালচরসহ আশপাশের উপকূল চরভূমি। যদি ঢালচরের বন সুরক্ষিত না থাকে তবে বহু বন্যপ্রাণ অচিরেই তাদের বিচরণ অঞ্চল ও খাদ্য উৎস হারাবে। ধীরে ধীরে প্রকৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন হতে বাধ্য হবে।
সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ নিরাপত্তা বিধান করবে। সংবিধানের অঙ্গীকার অনুযায়ী ঢালচরের বনভূমি ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। নদীভাঙা মানুষের আশ্রয়স্থল নিশ্চিত করা জরুরি, কিন্তু সেটি প্রাকৃতিক বন উজাড় করে নয়। ঢালচরের বন বিষয়ে রাষ্ট্রকে অঙ্গীকার করতে হবে। বন বিভাগ, স্থানীয় সরকার এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ঢালচরের বন সুরক্ষায় তৎপর হতে হবে। স্থানীয় মানুষদের ঢালচরের বন ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক কাজে যুক্ত করা যেতে পারে। কারণ এই বন সব আপদন্ডবিপদ থেকে চরবাসীকে সুরক্ষিত রাখছে। নির্দয়ভাবে বনের বিনাশ বন্ধ করে বনের প্রতি ঢালচরের প্রতিজন নাগরিককে সামাজিক ঢাল হিসেবে দাঁড়াতে হবে। ঢালচরের প্রাকৃতিক ঢাল উপকূল-বন আর বনের ঢাল ঢালচরের জনগণ। প্রাকৃতিক ও সামাজিক ঢালের এই সংহতি সক্রিয় হলেই বিকশিত হবে ঢালচরের বন বাস্তুতন্ত্র।
লেখক: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।