
কবি, প্রাবন্ধিক, ছন্দবিশারদ ও সম্পাদক আবদুল কাদিরের জন্ম কুমিল্লার আড়াইসিধা গ্রামে ১৯০৬ সালের ১ জুন। তার বাবার নাম হাজি আফসারউদ্দীন। ১৯২৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা মডেল হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯২৫ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে তিনি আইএসসি পাস করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন। ১৯২৯ সালে কলকাতার মাসিক সওগাত পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে যোগ দেন। ১৯২৬ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের মাধ্যমে ঢাকায় যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন সংঘটিত হয়, তিনি ছিলেন তার অন্যতম উদ্যোক্তা। সংগঠনের মুখপত্র বার্ষিক ‘শিখা’ পত্রিকার তিনি প্রকাশক ও লেখক ছিলেন। তিনি কিছুকাল কলকাতা করপোরেশনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি তিনি মাসিক জয়তী পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ (১৯৩০-১৯৩৩) করেন এবং সাপ্তাহিক নবশক্তি, যুগান্তর, দৈনিক নবযুগ, সাপ্তাহিক মোহাম্মদী ও সাপ্তাহিক পয়গম পত্রিকায়ও বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন। ১৯৫২ সালে ঢাকায় এসে মাসিক মাহে নও পত্রিকা সম্পাদনা করেন (১৯৫২-১৯৬৪)। তিনি কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের প্রকাশনা কর্মকর্তা (১৯৬৪-১৯৭০) পদে দায়িত্ব পালন করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ দিলরুবা, উত্তর বসন্ত, ছন্দসমীক্ষণ, বাংলা ছন্দের ইতিবৃত্ত, যুগকবি নজরুল ইত্যাদি। তিনি বাংলা ছন্দ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও বিশ্লেষণ করেছেন। এ ছাড়া কাব্যমালঞ্চ, এয়াকুব আলী চৌধুরী রচনাবলি, নজরুল রচনাবলি, শিরাজী রচনাবলি, কাজী ইমদাদুল হক রচনাবলি, রোকেয়া রচনাবলিসহ নানা গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তিনি ১৯৮৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। শিক্ষাবিদ, লেখক ও বুদ্ধিজীবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন চার দশকের বেশি সময়। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে (ইউল্যাব) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বিষয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : বায়ান্নতে পা দিল বাংলাদেশদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : গত ৫১ বছরে আমাদের অর্থনীতিতে দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ির অবস্থান থেকে আমরা এখন দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় শক্তিশালী অর্থনীতি। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কভিড সংকটের সময়েও ৭ শতাংশের ধারেকাছে ছিল। গত দেড় দশক এই উন্নতি দ্রুত হয়েছে, তবে কভিড সংকট এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী যে বিশাল সংকট সৃষ্টি করেছে তার অভিঘাতে আমরা এখন বিপদে আছি।
উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু পাশাপাশি বৈষম্য বেড়েছে। এই বৈষম্য প্রকট করেছে দুর্নীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা, বিত্তবানদের লোভ এবং বিদেশে টাকা পাচারের চর্চা। কিছু মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ, অথচ তৃণমূল পর্যায়ে কৃষক-শ্রমিক-খেটে খাওয়া মানুষের এখন তিন বেলা আহার জোটানো কঠিন। এ অবস্থার জন্য দায়ী নীতি ও কৌশলের দুর্বলতা, মন্ত্রণালয়গুলোর এবং বিভিন্ন প্রকল্পের কর্মকান্ডে অস্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির অভাব। ব্যাংকের তহবিল লুটে নেওয়ার খবর আমরা শুনি, কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি পেতে দেখি না। এসব ক্ষেত্রে সরকার যদি কঠোর হয়, আইন-আদালত কঠোর অবস্থানে যায়, তাহলে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটবে। এটি না হলে সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্য মøান হয়ে যাবে।
সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে, প্রধানত শিক্ষার বিস্তারের ফলে, কর্মক্ষেত্রে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এবং মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকার কারণে। বড় কিছু এনজিও সামাজিক উন্নয়নে প্রভাব রেখেছে। তাদের কাজে দারিদ্র্য কমেছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নতি ঘটেছে। সরকারের অনেক নীতি ও কর্মসূচি বিশেষ করে স্কুল-কলেজের মেয়েদের বৃত্তি দেওয়া, বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ ইত্যাদি সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। উল্টোপিঠে, সমাজে সাম্প্রদায়িকতা, হানাহানি এবং সংঘাত বেড়েছে। উগ্রবাদের প্রসার ঘটেছে। সংস্কৃতিচর্চা ক্রমশ অদৃশ্য হচ্ছে। এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো চলতে থাকলে সমস্যা আরও বাড়বে।
রাজনীতিতে সংঘাত এবং রক্তক্ষয় চিরস্থায়ী হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে নিয়ে যে রাজনীতিচর্চা হচ্ছে তাতে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। বড় দুই দল পরস্পরের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস পোষণ করে, এটি রাজনীতিতে সুস্থতা আনতে পারে না। ১৯৭১ সালকে অস্বীকার করার, এর প্রধান নায়কদের সম্পূর্ণভাবে আড়ালে ঠেলে ১৯৪৮ সাল থেকে চলা পাকিস্তানের নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে চব্বিশ বছরের আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে একটি পক্ষ। এই মানসিকতার অবসান না হলে রাজনীতি কখনো সংঘাতমুক্ত হবে না, একাত্তরে যারা স্বজাতি হত্যা করেছিল, তাদের শক্তিশালী করা হবে। দুঃখজনক সত্যটি হলো, ১৯৭১ নিয়ে ছড়ানো নানা বিভ্রান্তিও দেশের রাজনীতিকে দুর্বল করে রেখেছে।
দেশ রূপান্তর : আপনাদের বেড়ে ওঠার সময় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ধরন কেমন ছিল? এখন কেমন দেখছেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমি ১৯৬৮ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন বুদ্ধিজীবী শব্দটি সমীহ জাগাত। কারণ বুদ্ধিজীবী তাদেরই বলা হতো যারা তাদের চিন্তাভাবনা এবং বুদ্ধির চর্চা দিয়ে কিছু বিষয়কে সামনে নিয়ে আসতেন, যেগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য তারা নিরন্তর চেষ্টা করে যেতেন, অনেকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামেও নেমেছেন যেমন সাম্য, মানবাধিকার, দেশের সম্পদে গরিবের ন্যায্য অধিকার, শোষণ-বঞ্চনার অবসান। তাদের প্রায় সবাই পেশাজীবী ছিলেন, কিন্তু নিজস্ব পেশার বাইরে গিয়ে দেশের কল্যাণে তারা নিবেদিত থাকতেন। এরা অবধারিতভাবে ছিলেন এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধী অনেকে কারাভোগও করতেন।
আমাদের এই সময়ে বুদ্ধিজীবী যারা আছেন, তারা প্রধানত নিজেদের পেশাতেই নিয়োজিত থাকেন, এবং পেশাজীবী হিসেবে হয়তো সুনামও কুড়িয়েছেন। কিন্তু পেশার বাইরে গিয়ে খেটে খাওয়া মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, তরুণ এবং পরিবর্তনকামী মানুষের পক্ষে তারা কোনো সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করেন না। মাত্র কয়েকজনই আছেন, যারা পুরনো ধারার বুদ্ধিজীবী, যারা ক্ষমতাকে ভয় না পেয়ে সত্য কথাটা বলে যান।
দেশ রূপান্তর : ৭০-এর দশকে প্রফেসর রাজ্জাক বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক প্রভাব রাখতেন, পরবর্তী সময়ে তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি। সবশেষ, তরুণদের ভেতর আহমদ ছফার জনপ্রিয়তা দেখা গেছে। তাদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? নতুন কেউ আসছেন না কেন, নাকি আমরা দেখতে পারছি না নতুনদের?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এদের দুজনই এস্টাব্লিশমেন্ট যেদিকে চলত, তার বিপরীতে ছিলেন। প্রফেসর রাজ্জাক মানুষের নিজস্বতাকে মূল্য দিতেন, কোনো আদেশ-নির্দেশকে পরোয়া করতেন না, প্রকৃত জ্ঞানকে আত্মস্থ করতে সবাইকে উৎসাহ দিতেন। ফলে প্রতিবাদী এবং পরিবর্তনকামী তরুণদের কাছে তিনি প্রিয় ছিলেন। আহমদ ছফা শুধু তার চিন্তাচেতনা নয়, জীবনযাপনেও এক প্রচলবিরোধী মানুষ হিসেবে নন্দিত হয়েছিলেন। তিনিও চিন্তার স্বাধীনতা এবং সক্রিয়তাকে, পুরনোকে প্রশ্ন করতে এবং হায়ারার্কি অথবা সমাজের মোড়লদের দ্বিমুখী চরিত্র এসবের বিরুদ্ধে সংগ্রামমুখর হতে তরুণদের বলতেন। নতুনরা যে আসছেন না, তা নয়, কিন্তু এখন সমাজটাই তো বদলে গেছে। এখন আহমদ ছফার মতো মানুষ যদি দলনির্বিশেষে রাজনীতিকে তার অন্তঃসারশূন্যতার জন্য প্রশ্ন করতে থাকেন, তাকে অনেক তরুণের বাধার সামনে পড়তে হবে।
এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শাসিত গুজব আর মেকি খবর এবং দৃশ্য মাধ্যমের তারল্যের যুগে এবং মুখস্থবিদ্যাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার সময়ে প্রফেসর রাজ্জাক এবং আহমদ ছফার মতো মানুষকে সহজে গ্রহণ করার মতো তরুণদের সংখ্যাই তো কম।
দেশ রূপান্তর : বলা হয়ে থাকে গত ৫০ বছরে দেশের সাংস্কৃতিক অবনমন ঘটেছে, এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের দায় কতটুকু বা আদৌ তাদের কোনো দায় আছে কি না?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : গত পঞ্চাশ বছরে সংস্কৃতিবিরোধী শক্তি সংগঠিত হয়েছে, দীর্ঘদিন তারা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা এবং উগ্রবাদ বেড়েছে, সংস্কৃতিকে একেবারে প্রান্তিক অবস্থানে নিতে এরা তৎপর। এখন রাষ্ট্র সত্যিকার বুদ্ধিজীবীদের বিপদ ভাবে। এসব কারণে মুক্তচিন্তার মানুষেরা একদিকে এই সংস্কৃতিবিরোধী শক্তির আঘাত, অন্যদিকে সরকারের সমর্থনের অভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। ফলে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরাও যেমন সংখ্যায় নিতান্ত কম, সমাজও তাদের আর খোলা মন নিয়ে গ্রহণ করতে রাজি নয়। সংস্কৃতির অবনমনের কারণ যদি হয় সমাজের অবস্থান পরিবর্তন (উদারনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক থেকে চূড়ান্ত রক্ষণশীল, এবং অনেক সময় সংস্কৃতিবিরোধী), দায়টা তো সবার।
দেশ রূপান্তর : একসময় বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীদের আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার যে চর্চা তার একটা প্রভাব ছিল। এখন সেটা তেমন দেখা যাচ্ছে না। আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার প্রয়োজন কি শেষ?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার প্রয়োজন কখনো শেষ হয় না। কিন্তু সমাজের অসহিষ্ণু, সাম্প্রদায়িক চিন্তায় আচ্ছন্ন, জাগতিক লোভের কাছে আত্মসমর্পিত অংশটির যেরকম শক্তি বাড়ছে, তাতে আদর্শের কথাটা এখন অচল হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে আছে। বুদ্ধিজীবীরা তখনই তাদের কাজের প্রভাব দেখেন যখন মানুষ নিজেদের অধিকারের (যার মধ্যে সাংস্কৃতিক অধিকার অন্যতম, যেমন ছিল ৫০-৬০ এর দশকে) জন্য সংগ্রামে নামে। সেই পরিবেশ এখন নেই। সেজন্য আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামটাই প্রথমে করতে হবে, কিন্তু যেখান থেকে এই সংগ্রাম শুরু হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পরিবারসেখানেই তো দুর্বলতা প্রকট।
দেশ রূপান্তর : ইন্টারনেটের প্রসারে অনলাইনে একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দাবি করা হয়। এ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : পশ্চিমা বিশ্বে, এশিয়ার অনেক দেশে, এমনকি ভারতেও ইন্টারনেটে জ্ঞানচর্চার একটা শক্তিশালী ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে। কভিডের দুই-আড়াই বছরে আমি পশ্চিমের দু’তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জুম-আলোচনায় অংশ নিয়েছি, ইউটিউবে অসংখ্য ভিডিও দেখেছি, যেখানে জ্ঞানের নানা অঞ্চলে আলো ফেলে কেউ লেকচার দিয়েছেন, বক্তব্য দিয়েছেন অথবা প্রশ্নোত্তরে তাদের কথাগুলো বলেছেন। ইউটিউবে আমাদের দেশের সেরকম ভিডিও আমি খুব কমই পেয়েছি। ইউটিউবে (এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে) একবার ঘুরে এলে দেখবেন কীরকম হিংসা, বিদ্বেষ, অসূয়া, নারীকে নিয়ে কটূক্তি, মানুষকে অপমান করার নিরন্তর চর্চা সেখানে হয়। ইন্টারনেটে বুদ্ধিবৃত্তির যে সত্যিকার চর্চা এখানে হয়, তা এতই সীমিত যে আঠারো কোটি মানুষের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তা সত্যিই দুঃখজনক।
ইউটিউবে ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর যদি কোনো বক্তৃতা পান, দেখবেন, সেই বক্তৃতা শুনেছে খুব বেশি হলে ৫ হাজার মানুষ। অথচ গালিগালাজ করা, বিদ্বেষ আর উগ্রতা ছড়ানো হয় যেসব ভিডিওতে, সেগুলো শোনে লাখ লাখ মানুষ।
ইন্টারনেটকে আমরা হয়তো একদিন জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের একটা মাধ্যম হিসেবে পাব, কিন্তু সেজন্য অনেক সময় লাগবে। ততদিনে হয়তো ইন্টারনেটই প্রাচীন হয়ে যাবে। নতুন কোনো প্রযুক্তি আসবে।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আপনাকেও ধন্যবাদ।
যে কোনো সমাজে বসবাস করাই একটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। নিজ, পরিবার ও সমাজকে নিয়ে ভাবাই রাজনীতি। সার্বিকভাবে কোনো সমাজে মানুষের সার্বিক অগ্রগতির প্রচেষ্টাই হচ্ছে সেই সমাজের রাজনীতির মোদ্দা কথা। তবে উন্নতি ও অগ্রগতি সবসময়ই আপেক্ষিক। এসব স্থান, কাল ও পাত্রের আলোকে বিবেচিত হয়। এর যেমন বস্তুগত দিক রয়েছে একই সঙ্গে রয়েছে নৈতিক প্রেক্ষাপট যেটা আচার-আচরণের সঙ্গে যুক্ত। অনেক সময় কোনো সমাজের বেশিরভাগ মানুষের আচার-ব্যবহার সেই সমাজের মধ্যকার বৈষম্য সৃষ্টির জন্য দায়ী। সমাজের কেউ কেউ মনে করেন সামাজিক ব্যবহারবিধির ভিত্তি হওয়া উচিত ইতিমধ্যে স্বীকৃত কোনো মোরাল কোড এবং অবশ্যই এর ভিন্ন কিছু নয়। যদিও বস্তুগত সংস্কৃতি ও ব্যবহারবিধি দুটিই পরিবর্তনশীল এবং একে অপরের সঙ্গে যুক্ত ও একে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত। অন্যদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাইরের প্রভাবে বিশেষ করে প্রযুক্তির ব্যবহার ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্বারা ব্যবহারবিধি পরিবর্তিত হয়ে থাকে। তবে নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই হচ্ছে মূল চালিকাশক্তি। কারণ এই সমাজে কোনো একটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ছাড়া টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। যদিও হয় তা অনুগ্রহ নির্ভর এবং তাতে সামাজিক ক্ষমতা কাঠামোতে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। যেমন আমাদের সমাজের বেশিরভাগ নারী সারা দিন গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এর কোনো অর্থনৈতিক মূল্যায়ন না থাকার কারণে তাদের অবস্থান ক্ষমতা কাঠামোর নিম্ন স্তরে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এটাও কি রাজনীতির অংশ? কেন না? অর্থনৈতিক কাঠামো যদি রাজনীতির অংশ হয় তাহলে এর সম্পর্ক নির্ভর ক্ষমতাকাঠামোর সবকিছু রাজনীতিরই অংশ।
রাজনীতিকে আমরা যেভাবেই দেখি না কেন, এতে একটি বৃহত্তর ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষমতা সম্পর্কযুক্ত থাকে আর এর সহজাত জটিলতার কারণেই সহজে একে ব্যাখ্যা করা কঠিন। রাজনীতির মাধ্যমে সামাজিক অগ্রগতির একটি সহজ ব্যাখ্যা হতে পারে এই ক্ষমতা সম্পর্কগুলোর মধ্যে ভারসাম্যমূলক পরিবর্তন এবং সব ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার অন্তর্ভুক্তিমূলক বিকল্প সমাধান। রক্ষণশীল রাজনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে বর্তমান বা সাবেকি ধারণার চাষবাস এবং সেটাকে ক্রমাগত শুদ্ধতার মাপকাঠিতে দেখা, আপাতদৃষ্টিতে যার কোনো চূড়ান্ত পরিসীমা নেই। বিপরীতে, প্রগতিশীল রাজনীতির মূল বিষয় হচ্ছে নতুন চর্চা ও ব্যবস্থাকে আহ্বান করা, যার সবকিছু নিজস্ব হওয়ার ব্যবস্থা নেই, তবে নিজস্ব ভাবধারার আলোকে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সুযোগ আছে।
আজকের দিনে আমরা অনেকেই সাধারণ জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিস্পৃহতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকি। প্রচলিত অভিযোগ যে, এখন আমরা অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক এবং এখানে সমাজ নিয়ে ভাববার অবকাশ নেই। তাই সামাজিক সমস্যা সমাধানে সামষ্টিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আজকের দুনিয়ার সামাজিক সমস্যা সমাধান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেন্দ্রিক এবং অনেকটাই প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল। বেশিরভাগ মানুষই যেহেতু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত তাই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইতিমধ্যে তাদের অংশগ্রহণ যে আছে তা বলাই বাহুল্য; তা হোক প্রান্তে বা কেন্দ্রে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ক্ষমতার প্রান্তে যারা আছে তাদের আমরা সত্যিকার অর্থে কেন্দ্রে আনতে চাই কি না?
আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাজনীতি প্রথাগত কেতাবি রাজনীতি থেকে যে ভিন্ন তা সহজেই অনুমেয়। এখানে রাজনীতির একটি বড় ইস্যু হচ্ছে প্রচলিত ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা ও পাশাপাশি ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখানো। তবে এই সময়ের রাজনীতির বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে প্রচলিত ক্ষমতা সম্পর্কে পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হওয়া। অন্যকথায় সমান্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, ক্ষমতার চর্চা ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ বা সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি নিশ্চিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। আর এই ধরনের সামন্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মাঝে মাঝে বা একটি নির্দিষ্ট বিরতিতে পাত্র-পাত্রীর পরিবর্তন হলেও ব্যবস্থাপনাগত পরিবর্তন হয় না, সেখানে কাঠামোগত অগ্রগতির লক্ষ্য অর্জন একটি দুরূহ বিষয়।
আর রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের বিষয়টি এখানেই যেন থমকে গেছে। সাধারণ মানুষ এখান থেকে নতুন কিছু পাচ্ছে না, যেমন পাচ্ছে না বিকল্প উন্নয়ন মডেলের প্রস্তাবনা যা নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে সক্ষম। অন্যথায় সাধারণ জনগণ কেন ব্যবস্থা ঠিক রেখে শুধু পাত্র-পাত্রী পরিবর্তনের হাতিয়ার হবে যদি না এতে তাদের ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া জোরদার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এক্ষেত্রে রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনে প্রতিশ্রুতির কোনো বিকল্প নেই এবং এ সংশ্লিষ্ট প্রতিটি উদ্যোগই প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারে। বিশ্বাসযোগ্য ও আস্থার পরিবেশ তৈরি ও চর্চা ছাড়া শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ কামনা নিছক আবদারের পর্যায়ে পড়ে। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রচলিত আচরণবিধি ও প্রথাগত নৈতিকতার দোহাই দিয়ে জনগণকে সংগঠিত করার চেষ্টা থাকছে সেক্ষেত্রে মানুষকে সাময়িক উদ্বুদ্ধ করতে পারলেও সংকীর্ণ গোষ্ঠীগত স্বার্থের বাস্তবতায় দীর্ঘমেয়াদে সাধারণ জনগণ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতে পারে না। প্রচলিত রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্টই তাদের এই প্রক্রিয়া থেকে বের করে দেয়।
এই অবস্থায় সাধারণ জনগণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে এবং তাদের মাধ্যমে ক্ষমতাকেন্দ্রিক চর্চার পরিবর্তন করতে চাইলে তাদের বঞ্চনাগুলোকে রাজনীতির সামনে নিয়ে আসতে হবে এবং পাশাপাশি রাজনীতিকে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে উদ্ধার করাটাও আবশ্যক। বর্তমান এই রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় এবং জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে কি এরকম কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে যেখানে জনগণ কাঠামোগত পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতে পারে? সত্যিকার অর্থে তারা কি এমন কোনো কর্মসূচি জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছে যে কর্মসূচি ক্ষমতাবান ও সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যকার ব্যবধান বা পার্থক্য কমিয়ে আনতে চায়, ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো বিকেন্দ্রীকরণ করতে চায়? বা প্রকৃতপক্ষেই সমস্যার সমাধান করতে চায়? তারা কি জাতিকে এমন একটি সমাজ কাঠামোর স্বপ্ন দেখাচ্ছে যা বিভেদ ও বিদ্বেষকে দূরে ঠেলে দিয়ে সমতা ও সাম্যের বার্তা সামনে নিয়ে আসছে?
প্রথাগত রাজনীতিতে শুধু পক্ষ বা বিপক্ষ সমর্থন করা আমাদের দেশের রাজনীতির একটি বড় সীমাবদ্ধতা। কারণ শুধু এই পক্ষ-বিপক্ষ চর্চার মাধ্যমে নতুন পথের সন্ধান তো পাওয়া যায়ই না, বরঞ্চ সজ্ঞানে একই ভুল বারবার করা। ভুল জেনেও পুরনো পথকে সমর্থন করতে বাধ্য হওয়া। এ যেন একই চক্রে বারবার ঘুরপাক খাওয়া, যে চক্রের প্রান্তে সাধারণ জনগণ আর কেন্দ্রে ঘুরেফিরে প্রায় সেই তথাকথিত একই শক্তি। তাই সাধারণভাবে রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণের নিস্পৃহতার দায় সাধারণের নয়, বরঞ্চ এখানো যারা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন তাদেরই। জনগণকে তারা কতটুকু আস্থায় নিয়ে আসতে পারছেন সেটাই মুখ্য। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না প্রগতিশীলতা ও পরিবর্তনকামিতা ছাড়া যে রাজনীতি সেটা সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। এই পরিবর্তন শুধু পাত্র-পাত্রীর পরিবর্তন না এই পরিবর্তন হচ্ছে ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোর পরিবর্তন যা সবসময় গণমানুষের পক্ষে ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
লেখক : উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
রবীন্দ্রনাথ তার ‘কালান্তর’ গ্রন্থের একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘ধর্ম যদি অন্তরের জিনিস না হইয়া শাস্ত্রমত ও বাহ্য আচারকেই মুখ্য করিয়া তোলে, তবে সেই ধর্ম যত বড়ো অশান্তির কারণ হয়, এমন আর-কিছুই না।’ কথাটির নিহিত তাৎপর্য আজ আমরা দুনিয়াজুড়ে উপলব্ধি করতে পারছি। রবীন্দ্রনাথের মতো অতটা হয়তো তীব্রভাবে নয়, কিন্তু তার পরও বলি, সেদিনে পিছিয়ে-পড়া মুসলিম সমাজের পক্ষ থেকে একজনকে অন্তত পাই, যার লেখালেখির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ-কথিত কঠিন সত্যিটাই আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সেই লেখক মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী। আজ যাকে আমরা বলতে গেলে ভুলেই গিয়েছি। কেন ভুলে গিয়েছি সেইটা বুঝতে পারা কঠিন হবে না, যদি আমরা তার চিন্তার চৌহদ্দিটা খানিকটা হলেও পরিমাপ করতে পারি।
২. মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরীর প্রথম গ্রন্থ ‘ধর্মের কাহিনী’ প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালে। সেই গ্রন্থের ‘পূর্বাভাস’-এ তিনি বলেছিলেন, ‘মনে হইয়াছে সৎ হওয়াই বুঝি মানব-জীবনের প্রধান কাজ। বাল্যকালের সেই অস্পষ্ট ধারণা বয়সের সহিত ক্রমে স্পষ্ট হইয়াছে।’ ধর্মের সঙ্গে সততার ধারণাকে যুক্ত করে এক দিন তার মনে হয়েছিল, ‘ধর্মই বুঝি মানুষের সবেধন এক নীলমণিসাত রাজার ধন এক মানিক।’ শুধুই এইটুকুই নয়, তার এ-ও মনে হতো, ‘ধর্মই বুঝি মানুষের জীবনের সাধ, সাধের সুখ, সুখের স্বপ্ন। সকলেই বুঝি কেবল ধর্ম পথেরই পথিক।’ কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গে বাস্তব জগতের দিকে তাকিয়ে তিনি ঠিক এর বিপরীত চিত্রটাই দেখতে পেয়েছেন। আর স্বপ্নভঙ্গের সেই বেদনা নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আজ ভীত স্তম্ভিত হইয়া দেখিতেছি, ধর্ম কোথায়ও নাই। বৈশাখ মাসের বাতাসে শুষ্ক পাতা যেমন করিয়া উড়িয়া যায়, আজ জনসমাজ হইতে ধর্মও তেমনিভাবে উড়িয়া গিয়াছে।’ শুধু এইটুকু যোগ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি; ক্ষুব্ধতায় নিজের বেদনাবোধকে এসবের সঙ্গে যুক্ত করে বলেছেন, ‘সত্য, সাধুতা, ন্যায়, দয়া ও পরোপকার আজ স্বপ্নের কাহিনী।’
এই অংশটুকু পাঠ করতে গিয়ে আমাদের কারও-কারও মনে পড়বে কবি জীবনানন্দ দাশের কথা। এয়াকুব আলীর এই প্রবন্ধটি প্রকাশের অনেকগুলো বছর পরে আমাদের সাহিত্যের ‘নির্জনতম’ কবি বলবেন তার চৈতন্য আর অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা এসব নিষ্ঠুর অথচ বাস্তব একপর্যায়ের কথা, যা আমাদের সমাজ জীবনের সঙ্গে তো বটেই, ব্যক্তিগত জীবনেও মিলেমিশে একাকার হয়ে আমাদের প্রতিদিনকার জীবনকে জখম করে রাখে প্রতিনিয়ত। কী বলেছিলেন জীবনানন্দ? তিনি লিখেছিলেন‘চারিদিকে বিকলাঙ্গ অন্ধ ভিড়অলীক প্রয়াণ।/ মন্বন্তর শেষ হলে নতুন যুদ্ধের নান্দীরোল;/ মানুষের লালসার শেষ নেই/ উত্তেজনা ছাড়া কোনো দিন ঋতু ক্ষণ/ অবৈধ সংগম ছাড়া সুখ/ অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ/ নেই।’
৩. দয়া-দান-অতিথি-সেবা নিত্যদিনের কর্মযজ্ঞ এবং সেই সঙ্গে মানুষের আচার-ব্যবহারের কথা বলতে গিয়ে এয়াকুব আলী চৌধুরী নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝি-বা লিখেছিলেন, ‘দেখিয়াছি মফঃস্বলের কোন লোক কলিকাতায় গিয়া জুয়াচোরের হাতে পড়িয়া সর্বস্ব খোয়াইলে তাহার মরণ নিশ্চিত।’ কেন এই কথা? প্রাবন্ধিক জানিয়েছেন, ‘তিন দিন ধরিয়া কলিকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইলেও কেহ তাহাকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করে না।’ শুধু তা-ই নয়; এয়াকুব আলী আরও লিখেছেন, ‘বড় বড় ধপ্ধপে দালানে উঁকি দেওয়ারও তাহার কোন অধিকার নাই।’ অবশেষে তিনি বলেছিলেন, ‘ধর্মের এক অতি প্রিয় অনুষ্ঠান (“অতিথি-সেবা”) এইরূপে আমাদের ধর্মের সংসারে শুকাইয়া মরিতেছেভ্রুক্ষেপ করিবার কেহ নাই।’
বিচিত্রভাবে চারপাশের বিভিন্ন দিকের প্রতি দৃষ্টিপাত করে গ্রন্থের উপসংহারে এসে লেখক বলেছেন, ‘এইরূপে মানবসমাজের যেদিকে ও যে স্তরেই দৃষ্টিপাত করি, সেইদিকে কেবল অধর্মেরই পূর্ণ প্রসার দেখিতে পাই’ আর তারই পরিণামে লেখকের ভাষায়, ‘ধর্মকে কোথায়ও খুঁজিয়া পাই না।’ ধর্মকে খুঁজে পাননি তিনি, শুধু তা-ই নয়, প্রতিদিনকার জীবনযাপনের যে-আনুষঙ্গিক আচরণবিধি, যার মধ্যে একটি সুসংগত জীবনবোধের পরিচয় পাই আমরা, সেই পরার্থপরতা, পরোপকার, জীবসেবা, একটু দয়া, মমত্ববোধ, প্রাণের সহানুভূতি পর্যন্ত লেখক কোথায়ও খুঁজে পাননি। তার পরিবর্তে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, ‘ধর্মবোধ এমনিভাবে লুপ্ত হইয়াছে যে, যে-লোক একটুকু সরল ব্যবহার ও সরল বিশ্বাসী হয়, পাঁচ পয়সা দিব বলিয়া দুই পয়সা দিতে না জানে, বিবিধ কলাকৌশলে...পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গিয়া’ খাইতে না জানে, সেই লোক এই সমাজে ‘নিতান্ত অকর্মণ্য, বোকাচন্ডী বলিয়া স্থির হয়।’
৪. এয়াকুব আলী চৌধুরী প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মেও বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু মনুষ্যধর্মকে তার থেকে বিযুক্ত করতে চাননি কখনো। এটি চাননি বলেই মানুষ সম্পর্কে তিনি বিশ্বাস করতেন, সে শুধুই জড়পদার্থ নয়, সে চৈতন্যস্বরূপ। আর ‘চৈতন্য মানেই যে আধ্যাত্মিকতা’ইসলাম ধর্মের অনুসারী হয়েও, ভারতীয় দর্শনের এই তত্ত্বটিকে তিনি একেবারেই অস্বীকার করেননি। মানুষকে উদ্দেশ করে সে-কারণেই তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি গরু নও, বানর নও, ব্যাঘ্র নওতুমি মানুষ। এই জড়দেহ তাহার ক্ষুদ্র সীমার পরপারে, হে পুণ্য ও চৈতন্যস্বরূপ! তোমার তরে স্বর্গের ও বিভু মিলনের অপার শান্তি, তৃপ্তি ও আনন্দ সঞ্চিত রহিয়াছে। কেন ভুলিবে, কেন ডুবিবে, কেন মরিবে?’ প্রতিটি মানুষকে এয়াকুব আলী একটা মর্যাদাবান সত্তা হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সময়ের বিচারে তিনি যে একজন অগ্রসর মানুষ ছিলেন, সেটি প্রমাণিত হয় তার চিন্তার অভিব্যক্তিতে, যা কি না এইসব বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। অথচ অবাক হতে হয় এ কারণেই যে মানুষটি জন্মেছিলেন ফরিদপুরের পাংশা থানার মাগুরাডাঙ্গা গ্রামে, ১৮৮৮ সালে (১৮ই কার্তিক, ১২৯৫ বঙ্গাব্দ)। চোখের অসুখে ভুগতেন বলে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের পড়াশোনাটাও শেষ করতে পারেননি।
৫. এয়াকুব আলী চৌধুরীর জীবন সম্পর্কে জানাতে গিয়ে প্রাবন্ধিক-গবেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম লিখেছেন, মাত্র ‘৪৭-৪৮ বৎসর বয়সে তিনি ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হন। জীবনের শেষ কয়েকটি বৎসর তাকে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় গ্রামের বাড়িতে দিন কাটাতে হয়।’ তিনি নিজে একজন আত্মসচেতন ও প্রতিভাধর মানুষ ছিলেন বলেই, সমাজের ইসলাম ধর্মানুসারী মানুষকে এইভাবে বলতে পেরেছিলেন, ‘প্রতিভা তোমার মনুষ্যত্বের স্পর্ধা, জ্ঞান ও চৈতন্য তোমার মানবতার গরিমা! কেন ভুলিবে, কেন ছোট হইবে, কেন পাপ করিবে?’ আমরা বুঝতে পারি নিজের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে তিনি কতিপয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি, দেখতেও চাননি। সেটিকে গোটা মানবসমাজের স্পর্ধা ও গরিমার সঙ্গে সে-কারণেই যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এয়াকুব আলী চৌধুরী প্রচলিত অর্থে ধার্মিক ছিলেন ঠিকই, আর তার ধর্মচর্চার মধ্যে আমরা সক্রিয়তার মনোভাব নানাভাবে দেখতে পাই। যে-সক্রিয়তা সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যেও বলিষ্ঠভাবে ছিল বলে মনে করি। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘সম্প্রতি সুশিক্ষিত বাঙ্গালিদিগের মধ্যে হিন্দুধর্মের আলোচনা দেখা যাইতেছে। অনেকেই মনে করেন যে, আমরা হিন্দুধর্মের প্রতি ভক্তিমান হইতেছি। যদি এ কথা সত্য হয় তবে আহ্লাদের বিষয় বটে।’ কেন আহ্লাদের বিষয়, সেটি খোলাসা করতে গিয়ে ভাববাদী বঙ্কিম তার দৃঢ় বিশ্বাসের কথা এইভাবে আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘জাতীয় ধর্মে পুনর্জীবন ব্যতীত ভারতবর্ষের মঙ্গল নাই।’ কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি এটিও বলতে দ্বিধা করেননি, ‘হিন্দু হাঁচি পড়িলে পা বাড়ায় না, টিকটিক ডাকিলে “সত্য সত্য” বলে, হাই উঠিলে তুড়ি দেয়।’ এগুলোকে তিনি ধর্ম বা ধর্মীয় আচার হিসেবে মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তার মতে, ‘এ সকল হিন্দুধর্ম নহে। মূর্খের আচার মাত্র। যদি ইহা হিন্দুধর্ম হয়, তবে আমরা মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি যে, আমরা হিন্দুধর্মের পুনর্জ্জীবন চাহি না।’ অন্যদিকে তার রচিত ‘ধর্মের কাহিনী’ গ্রন্থটি সম্পর্কে মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বলেছিলেন, ‘এই পুস্তক সংসারে সর্বজনীন পাপ-স্রোতের বিরুদ্ধে ধর্মের এক স্বাভাবিক আর্তনাদ।’ তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘মানুষকে সংসারে ধর্মের নামে ধর্মকে ফাঁকি দিয়া নিত্যনিয়ত অধর্ম করিতে দেখিয়া অন্তরে যে দারুণ বেদনা অনুভব করিয়াছি, এই ক্ষুদ্র পুস্তক তাহারই প্রকাশ মাত্র।’ এয়াকুব আলীর এই কথাগুলি পাঠ করতে গিয়ে ধর্ম প্রসঙ্গে কার্ল মার্কসের কয়েকটি কথা মনে না-পড়ে পারে না। এটিও তার চিন্তার অগ্রসরতারতাই আরেকটি নমুনা।
৬. অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম তার প্রবন্ধে এয়াকুব আলীর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে আমাদের আরও কিছু তথ্য জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ ছিল তার জীবন। পক্ষান্তরে তার জীবনও অনেক দুঃখ-কষ্টে পরিকীর্ণ। সাংবাদিক হিসেবেও তার খ্যাতি ছিল এবং এ-সময়ই তিনি বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও সাহিত্য-সমিতির সঙ্গে যুক্ত থাকেন।’ এই তথ্য জেনে আমরা বিমর্ষ বোধ করি যে, ‘দুঃখ-কষ্ট ও দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে হয় বলে তার গ্রন্থ-সংখ্যা খুব বেশি নয়।’ শ্রদ্ধেয় আবদুল কাইয়ুম ঠিকই বলেছেন। এয়াকুব আলীর প্রকাশিত গ্রন্থ-সংখ্যা মাত্র চারটি। ব্যঞ্জনাময় গদ্যে রচিত ‘ধর্মের কাহিনী’ নিয়ে আমরা সামান্য আলোচনা করেছি। এ ছাড়া রয়েছে‘নূরনবী’ (১৯১৮), ‘শান্তিধারা’ (১৯১৯) ও ‘মানব-মুকুট’ (১৯২২)। তার অপ্রকাশিত রচনার একটি সংকলন ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
৭. রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে, ব্যক্তি মানুষের ‘সর্বজনীন মনকে উত্তরোত্তর বিশুদ্ধ করে উপলব্ধি করাতেই মানুষের অভিব্যক্তির উৎকর্ষ।’ অভিব্যক্তির সেই উৎকর্ষের অনেকখানি আমরা মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরীর রচনায়, চিন্তায়, তার অটল সাধনার মধ্যে দেখতে পাই। লেখাই বাহুল্য যে, সেই সাধনারই প্রকাশিত মর্ম-মাধুরী হচ্ছে তার রচনাকর্ম। ১৯৪০ সালের ১৫ ডিসেম্বর এই সাধক-লেখক প্রয়াত হন। আমরা তার স্মৃতির গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রেললাইনে একের পর এক লাশ পাওয়া যাচ্ছে। এই লাশ কেবল দেশব্যাপী রেলপথে দুর্ঘটনায় কাটা পড়া লাশই নয় রেললাইন আর লাইনের পাশের জমিতে পড়ে থাকছে লাশ। অনেক ক্ষেত্রেই এসব মৃত্যু নিয়ে রহস্যের জট খুলছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব লাশের মধ্যে যেমন অসতর্কতার কারণে ট্রেনে কাটা পড়া কিংবা আত্মহত্যায় মৃত্যুর লাশ রয়েছে, তেমনি রয়েছে ডাকাতির সময় ট্রেন থেকে ফেলে হত্যা করা ব্যক্তির লাশও। আবার অন্য কোথাও কাউকে হত্যা করে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু বলে চালানোর জন্য লাশ ফেলে রাখা হয় রেললাইনে। বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন চিত্র দেখা গেলেও বিশেষ উদ্বেগ দেখা দিয়েছে রাজধানী ঢাকার লাগোয়া গাজীপুরের কিছু নির্দিষ্ট রেলপথ নিয়ে। দেশ রূপান্তরে রবিবার ‘গাজীপুরে এক বছরে রেললাইনে ৬০ লাশ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন উদ্বেগের কথা। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, চলতি ২০২২ সালে এখন পর্যন্ত গাজীপুর জেলার ধীরাশ্রম থেকে শ্রীপুরের কাওরাইদ এবং টাঙ্গাইলের মির্জাপুর আউটার সিগন্যাল পর্যন্ত রেললাইন ও এর আশপাশ থেকে ৪৫ জনের লাশ উদ্ধার করেছে রেলওয়ে পুলিশ। এছাড়া ধীরাশ্রম থেকে টঙ্গী পর্যন্ত এবং টঙ্গী থেকে কালীগঞ্জের আড়িখোলা পর্যন্ত রেলপথ থেকে আরও অন্তত ১৫টি লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট এলাকার রেলওয়ে থানা পুলিশ জানিয়েছে। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠছে গাজীপুরে রেলপথের এমন নির্দিষ্ট এলাকাতেই কেন বারবার লাশ পাওয়া যাচ্ছে?
খেয়াল করা দরকার, রেলপথে মৃত্যুর মিছিল এমনিতেই বেশ দীর্ঘ। কেবল ২০২১ সালেই রেলপথে ২৭০টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৫৪ জন, আহত হয়েছেন ৪২ জন। এর ওপর কেবল এক জেলাতেই এক বছরে রেলপথে ৬০টি লাশ পাওয়ার কারণ অনুসন্ধান জরুরি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসতর্কতার কারণে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর অন্যতম কারণ রেললাইনের ওপর অবৈধ রেলক্রসিং এবং রেললাইন ঘেঁষে অবৈধ বাজার ও অস্থায়ী দোকান বসানো। টঙ্গীর বনমালা ও আরিচপুরে রেললাইনের ওপর মানুষের ভিড় থাকে প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে বিকেল থেকে রাত। আরিচপুরে রেললাইনের ওপর অবৈধ বাজার থাকায় সেখানে টঙ্গী ও উত্তরার মানুষ বাজার করতে আসেন। কিন্তু হুটহাট ট্রেন চলে এলে লাইন থেকে সরে দাঁড়ানোর তেমন জায়গা না থাকায় ঘটে প্রাণহানির ঘটনা। এছাড়া স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কিছু কিছু এলাকায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রেললাইনের ওপর ভিড় জমায় তরুণ-তরুণীরা। অনেক সময় লাইনের ওপর হাঁটাহাঁটি ও টিকটক ভিডিও বানানোর সময় ঘটে দুর্ঘটনা। এই এলাকায় প্রায়ই রেলে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দেওয়া জরুরি অরক্ষিত রেললাইনের সুরক্ষা নিয়ে। রেললাইনের ওপর কিংবা রেললাইন ও স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় অবৈধভাবে বাজার বসানো এবং দোকানপাট সারা দেশের সাধারণ বাস্তবতা হলেও এমন কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না কেন? রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যথাযথ উদ্যোগের পাশাপাশি এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের সক্রিয়া হওয়া জরুরি।
রেলপথে এমন লাশ পড়ে থাকা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, নদীতে লাশ ভেসে থাকার কথা। মাত্র কিছুদিন আগেই দেশ রূপান্তরে ‘২২ মাসে ৭১৫ লাশ নদীতে’ শিরোনামের প্রতিবেদনে নদীতে লাশ পাওয়ার এক নির্মম বাস্তবতা সামনে উঠে এসেছিল। প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল হত্যাকারীরা লাশ নিশ্চিহ্নের উদ্দেশ্যে হত্যার পর নদীতে লাশ ভাসিয়ে দিচ্ছে। ওই ৭১৫ লাশের মধ্যে ২১৬টি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনও করা হয়েছে। সারা দেশেই এমন ঘটনা ঘটলেও শুধু রাজধানী ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদী থেকেই গত ১০ মাসে উদ্ধার করা হয়েছিল ৯০টি লাশ। তদন্তকারী সংস্থাগুলো বলছে, নদীতে উদ্ধার হওয়া লাশগুলোর বেশিরভাগই হত্যাকাণ্ডের শিকার বলে আশঙ্কা তাদের। আর সেসব হত্যাকান্ডের বেশিরভাগই ডাঙায় ঘটলেও লাশ ফেলা হচ্ছে নদীতে। ফলে তদন্তে বেগ পেতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর বেশকিছু নির্জন স্থানকে অপরাধীরা লাশ ফেলার নিরাপদ এলাকা হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছিল, রাজধানী ঘিরে থাকা বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীকে লাশের ডাম্পিং জোন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না। একই কারণে এই সন্দেহ করার অবকাশ আছে যে, গাজীপুর জেলার ওই নির্দিষ্ট এলাকাগুলোর রেললাইনকেও অপরাধীরা লাশের ডাম্পিং জোন হিসেবে ব্যবহার করছে কি না। এমন এক সময়ে দেশের রেলপথ আর নদী থেকে একের পর এক লাশ উদ্ধারের ঘটনা দেখছি যখন গুম-খুন-নিখোঁজের রহস্য উন্মোচন ক্রমশই দুরূহ হয়ে উঠছে। অন্যদিকে রেলপথে পড়ে থাকা আর নদীতে ভাসা লাশের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এই বাস্তবতাকে বিশেষভাবে আমলে নিয়ে রেলপথে লাশ উদ্ধারের বিষয়ে বিশদ তদন্ত জরুরি।
ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলে জেলেখা বেগম নামে এক বৃদ্ধাকে মৃত দেখিয়ে তার বয়স্ক ভাতার কার্ড বাতিল করা হয়েছে। বিগত ৫ মাস যাবৎ তিনি বয়স্ক ভাতা বঞ্চিত রয়েছেন বলে জানা গেছে। অপরদিকে তার নাম পরিবর্তন করে আমিনা নামে অন্যজনকে বয়স্ক ভাতার কার্ড বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় মেম্বার বাদশার বিরুদ্ধে।
রানীশংকৈল উপজেলার নন্দুয়ার ইউনিয়নের সাতঘরিয়া গ্রাম এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জেলেখা বেগম নন্দুয়ার ইউনিয়নের সাতঘরিয়া গ্রামের আ. রহিমের স্ত্রী। পূর্বের চেয়ারম্যান ওই বৃদ্ধার নামে বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দেন।
ভুক্তভোগী বলেন, আমি ভাতার কার্ড পাওয়ার পর থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর ১৫০০ টাকা করে পেয়েছিলাম। কিন্তু গত তারিখে আমার টাকার কোনো মেসেজ না আসায় আমি উপজেলা সমাজসেবা অফিসে গিয়ে জানতে পারি আমাকে মৃত দেখিয়ে আমিনা নামে ভাতার কার্ড করে দিয়েছেন মেম্বার বাদশাহ।
ইউনিয়ন পরিষদে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৃত্যুর নিবন্ধন বইয়ের ২০২১ সালের রেজিস্ট্রারে বৃদ্ধার মৃত্যু নিবন্ধিত নেই। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এমন একটি সনদ দেওয়ায় তার ভাতাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তিনি এ বিষয়ে আরও বলেন, আমি জীবিত থাকার পরও মেম্বার বাদশাহ আমাকে মৃত দেখিয়ে আরেকজনের নামে কিভাবে টাকা খেয়ে ভাতার টাকা পরিবর্তন করে দেয়! আমি জীবিত থাকার পরও মেম্বার আমাকে মৃত দেখাল। আমি গরিব মানুষ। আমার কোনো ছেলেমেয়ে নাই। এই টাকা দিয়ে ওষুধ খেয়ে বেঁচে আছি। আমি এর বিচার চাই।
মেম্বার বাদশাহ বলেন, প্রথমবারের মতো এমন ভুল করেছি। সামনের দিকে সর্তকতার সাথে কাজ করব।
নন্দুয়ার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল বারী বলেন, জীবিত মানুষ মৃত দেখিয়ে ভাতার কার্ড পরিবর্তনের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তবে মেম্বার যদি করে থাকেন তাহলে খুবই খারাপ করেছেন।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুর রহিম বলেন, ইউপি চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরিত একটি প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে জানতে পারি, জেলেখা বেগম ৭ ডিসেম্বর ২০২১ এ মৃত্যু বরণ করেন। তাই ভাতাটি বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ওয়েবসাইটে মৃত্যু সনদ যাচাই ছাড়া সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর কাউকে মৃত দেখাতে পারবে না- সাংবাদিকের এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের এভাবেই হয়। আমরা এভাবেই করে থাকি, প্রত্যায়নপত্র দেখে প্রতিস্থাপন করে থাকি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমাজসেবা অফিসে প্রেরিত প্রত্যায়নটির কোনো তথ্য ইউনিয়ন পরিষদের ফাইলে সংরক্ষণ করা হয়নি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহেল সুলতান জুলকার নাইন কবির বলেন, এটি সংশোধনের কার্যক্রম চলমান। তদন্ত করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান বলেন, এটি একটি গুরুতর অভিযোগ। আমরা তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেব।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত করা, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠাসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে আজ রোববার ঢাকা ছাড়া সব মহানগরে পদযাত্রা কর্মসূচি করবে বিএনপি। আজকের পদযাত্রা কর্মসূচির মাধ্যমে সপ্তাহব্যাপী সরকারবিরোধী কর্মসূচির প্রথম ধাপ শেষ হচ্ছে দলটির।
এর আগে, গত ২৩ মে দেশের ১১টি মহানগরে ‘পদযাত্রা’ করে বিএনপি। ঢাকার বাইরে মহানগরগুলোতে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থাকবেন।
সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের ১০ দফাসহ দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, হয়রানি, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ ও অন্যান্য জনগুরুত্বপূর্ণ দাবিতে এই কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে দলটি।
সরকারের পদত্যাগ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন ও সংবিধান সংস্কারসহ ১৪ দফা দাবিতে আজ রোববার (২৮ মে) পদযাত্রা করবে ৬ দলীয় জোট (দল ও সংগঠন) গণতন্ত্র মঞ্চ। এদিন বেলা ১১টায় রাজধানীর মালিবাগ থেকে এই পদযাত্রা শুরু হবে, যা শেষ হবে বাড্ডায়।
গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রোববার ১১টায় রাজধানীর মালিবাগ রেলগেট থেকে বাড্ডা পর্যন্ত গণতন্ত্র মঞ্চের ঢাকা উত্তরের পদযাত্রা শুরু হবে। অবৈধ সরকারের পদত্যাগ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন ও সংবিধান সংস্কারসহ ১৪ দফা দাবিতে এ পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। মালিবাগ রেলগেটে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পদযাত্রা শেষ হবে।
পদযাত্রায় অংশ নেবেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম, জেএসডির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন পাটোয়ারীসহ গণতন্ত্র মঞ্চের কেন্দ্রীয় নেতারা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব শান্তির পক্ষে সোচ্চার ছিলেন এবং মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।
বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদক প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় তিনি এ কথা বলেন।
ড. মোমেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদক প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তি উৎসব আমাদের বিদেশস্থ সকল মিশনে উদযাপন করছি। জুলিও কুরি পদক ছিল জাতির পিতার কর্মের স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান।
তিনি বলেন, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে কারাবরণ করেন বঙ্গবন্ধু। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন বঙ্গবন্ধু মেনে নিতে পারেননি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলার নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে স্বাধীনতার ডাক দেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলার মানুষ দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর “সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বৈরীতা নয়”- এই বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু তার শান্তির বার্তা নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতিসংঘে এক নম্বর শান্তিরক্ষী দেশের মর্যাদা পেয়েছে। দেশে দেশে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে ‘শান্তির সংস্কৃতি’ চালু করেছে।
‘বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদক প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনে আমাদের অঙ্গীকার হবে বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করে যাওয়া। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অর্জিত হবে’।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে।
অপারেশন ছাড়াই সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলায় আব্দুল মোতালেব হোসেন (৩৫) নামের এক মানসিক রোগীর পেট থেকে ১৫টি কলম বের করেছেন চিকিৎসক।
এ কাজ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সিরাজগঞ্জের শহীদ এম.মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুই চিকিৎসক। তাদের এই সাফল্যে রীতিমত হৈচৈ পড়ে গেছে নেট দুনিয়ায়।
এ বিষয়ে আব্দুল মোতালেবের মা লাইলী খাতুন বলেন, তার ছেলে মোতালেব খুব ভাল ছাত্র ছিল। ২টি লেটার মার্ক নিয়ে এসএসসি পাস করে কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। এরপর খারাপ সঙ্গদোষে সে আস্তে আস্তে মাদকাসক্ত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এরপর থেকে পথে ঘাটে ঘুরে বেড়ানোর সময় কুড়িয়ে পাওয়া কলমগুলি খাদ্য মনে করে খেয়ে ফেলে। বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। গত এক বছর ধরে তার শরীরে জ্বর ও পেটে ব্যথা শুরু হয়। অনেক চিকিৎসার পরও তা ভালো হচ্ছিল না। অবশেষে গত ১৬ মে তাকে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম. মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনে ভর্তি করি। এখানে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তার অসুখের কারণ ধরা পড়ে। পরে চিকিৎসকরা তার পেটের ভিতর থেকে বিনা অপারেশনে কলমগুলো বের করে।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. আমিনুল ইসলাম খান বলেন, মোতালেব হোসেন প্রথমে পেটে ব্যথা নিয়ে মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়। মেডিসিন ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা এক্সরে ও আল্ট্রাসনোগ্রাম করেও পেটে কি সমস্যা সেটা শনাক্ত করতে পারছিলেন না। ফলে রোগীটিকে আমার কাছে রেফার্ড করেন। এন্ডোস্কপির মাধ্যমে পরীক্ষা করে তার পেটের ভেতর ১৫টি কলম দেখে প্রথমে চমকে যাই। এটা কীভাবে সম্ভব। পরে এন্ডোস্কপির মাধ্যমেই অপারেশন ছাড়াই আমরা কলমগুলো বের করার সিদ্ধান্ত নেই। তিনি আরও বলেন, কাজটি আমাদের জন্য দারুণ চ্যালেঞ্জিং ছিল। কলমগুলো একে একে পাকস্থলীতে সেট হয়ে গিয়েছিল। কলমগুলো বের করতে আমাদের প্রথমে মাথায় চিন্তা ছিল যেন, কলমগুলোর কারণে কোনোভাবেই শ্বাসনালিতে গিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ না হয়ে যায়। এছাড়াও রক্তক্ষরণের একটা চিন্তাও মাথায় ছিল। অতঃপর প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আমরা কলমগুলো বের করে নিয়ে আসতে সক্ষম হই।
শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. জাহিদুল ইসলাম বলেন, এন্ডোস্কপি করা ব্যক্তি মানসিক অসুস্থ হওয়ায় তার কলম খাওয়ার অভ্যাস ছিল। এভাবে খেতে খেতে সে অনেক কলম খেয়ে ফেলে। কলমগুলো তার পেটের মধ্যে জমা হয়েছিল। আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে তার পেটের ভিতর ১৫টি কলম থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হই। এবং অপারেশন ছাড়াই এন্ডোস্কপির মাধ্যমে তার পেটের ভেতর থেকে একে একে ১৫টি আস্ত কলম বের করে আনি। বর্তমানে রোগীটি সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকদের অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং সুস্থ আছেন।
তিনি আরও বলেন, এন্ডোস্কপির মাধ্যমে মানুষের পেট থেকে কলম বের করার মতো ঘটনা বাংলাদেশে এটাই প্রথম। তাও আবার একটি-দু‘টি নয় ১৫টি কলম। এর আগে ঢাকা মেডিকেলে এক ব্যক্তির পেট থেকে এন্ডোসকপির মাধ্যমে একটি মোবাইল বের করেছেন চিকিৎসকরা।
এ বিষয়ে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে এমন সাফল্য এটাই প্রথম। আমরা অত্যাধুনিক ভিডিও এন্ডোস্কপি মেশিনের মাধ্যমে এবং আমাদের দক্ষ ডাক্তার দ্বারা অপারেশন ছাড়াই শুধু এন্ডোস্কপির মাধ্যমে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের পেট থেকে ১৫টি কলম বের করে আনতে সক্ষম হয়েছি। শুধু এটাই নয়, আমরা বিনা অপারেশনে পেটের পাথর, কিডনিতে পাথর থেকে শুরু করে অনেক কিছুই অপারেশন ছাড়াই সেগুলো অপসারণের কাজ করে যাচ্ছি।
বিরতি কাটিয়ে আবারও আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফিরছে আর্জেন্টিনা। গত মার্চে ঘরের মাঠে সবশেষ আকাশী-নীলদের দেখা গিয়েছিল তিন মাস পর আগামী জুনে তারা আসছে এশিয়া সফরে। সফরকালে ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচও খেলবেন লিওনেল মেসিরা।
আগামী ১৫ জুন বেইজিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে নামবে আর্জেন্টিনা। চারদিন পর ১৯ জুন জাকার্তায় ইন্দোনেশিয়ার মুখোমুখি হবেন তারা। সেই ম্যাচ দুটিকে সামনে রেখে আজ দল ঘোষণা করেছেন দেশটির কোচ লিওনেল স্কালোনি। লিওনেল মেসিকে অধিনায়ক করে ২৭ সদস্যের দল ঘোষণা করা হয়েছে।
বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু নাম। এই দলে এই দলে চমক হিসেবে রয়েছে আলেজান্দ্রো গার্নাচো। যিনি বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনার প্রথম প্রীতি ম্যাচের দলে ছিলেন। তবে চোটের কারণে অভিষেকের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে আলো ছড়িয়েছেন গার্নাচো। গত বছরের জুলাইয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মূল দলে জায়গা হয় তার। এখন পর্যন্ত ক্লাবটির হয়ে ৩৫ ম্যাচ খেলেছেন এই লেফট উইঙ্গার। এখন পর্যন্ত নিজে করেছেন ছয়টি গোল, করিয়েছেন আরও ছয়টি। এমন পারফরম্যান্স নজর এড়ায়নি স্কালোনির। তাই জাতীয় দলে জায়গা পেতে বেগ পেতে হয়নি।
দলের তৃতীয় গোলকিপার হিসেবে জায়গা পেয়েছেন ওয়াল্টার বেতিনেজ। এছাড়া বেশ কয়েক বছর পর দলে ফিরেছেন লিওনার্দো বলের্দি। ফরাসি ক্লাব মার্সেইয়ের হয়ে চলতি মৌসুমে তিনি দুর্দান্ত খেলছেন। তবে স্কোয়াডের মাঝ মাঠের ফুটবলারদের নিয়ে কোনো চমক নেই।
তবে এই স্কোয়াডে নেই লাউতারো মার্তিনেজের নাম। গোড়ালির চোটের কারণে এই দুই প্রীতি ম্যাচে তাকে পাচ্ছে না আর্জেন্টিনা। তবে তার জায়গায় মাঠ মাতাতে দেখা যাবে জিওভানি সিমিওনেকে।
আর্জেন্টিনার ২৭ সদস্যের দল
গোলরক্ষক:
এমিলিয়ানো মার্টিনেজ (অ্যাস্টন ভিলা), জেরনিমো রুলি (আয়াক্স), ওয়াল্টার বেনিটেজ (পিএসভি)।
ডিফেন্ডার:
নাহুয়েল মোলিনা (অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ), গঞ্জালো মন্তিয়েল (সেভিয়া), জার্মান পেজেল্লা (রিয়েল বেটিস), ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো (টটেনহ্যাম হটস্পার), লিওনার্দো বলের্দি (অলিম্পিক মার্সেই), নিকোলাস ওতামেন্ডি (বেনফিকা), ফ্যাকুন্ডো মদিনা (আরসি লেন্স), নিকোলাস তাগলিয়াফিকো (লিয়ন), মার্কোস অ্যাকুনা (সেভিলা)।
মিডফিল্ডার:
লিয়ান্দ্রো পেরেদেস (জুভেন্তাস), এনজো ফার্নান্দেজ (চেলসি), গুইডো রদ্রিগেজ (রিয়েল বেটিস), রদ্রিগো ডি পল (অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ), এজেকিয়েল পালাসিওস (বেয়ার লেভারকুসেন), অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার (ব্রাইটন), থিয়াগো আলমাদা (আটলান্টা ইউনাইটেড), জিওভানি লো সেলসো (ভিলারিয়াল)।
ফরোয়ার্ড:
লুকাস ওকাম্পোস (সেভিয়া), অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া (জুভেন্তাস), লিওনেল মেসি (পিএসজি), জুলিয়ান আলভারেজ (ম্যানচেস্টার সিটি), জিওভানি সিমিওনে (নাপোলি), আলেজান্দ্রো গার্নাচো (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), নিকোলাস গঞ্জালেজ (ফিওরেন্টিনা)।
নতুন পে-স্কেল কিংবা মহার্ঘ ভাতা নয়, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়বে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট অনুযায়ী। তাদের বেতন প্রতি বছর যতটা বাড়ার কথা এবার তার চেয়ে বেশি বাড়বে। আর তা চলতি বছরের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়ানো হবে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট ৫ শতাংশের বাইরে বাড়ানো হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত প্রায় এক বছর ধরে দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের বেশিরভাগের একমাত্র আয় বেতন-ভাতা। বৈশি^ক মন্দার কারণে সরকারও খানিকটা সংকটে আছে। এ পরিস্থিতিতে পে-স্কেল দেওয়ার মতো বড় ধরনের ব্যয় বাড়ানো সরকারের পক্ষে কঠিন হবে। ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হলে সরকারের ওপর চাপ বেশি হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সরকারি কর্মরতদের খানিকটা স্বস্তি দিতে কোন খাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় এমন প্রস্তাব চাওয়া হয়। একই সঙ্গে বাজেটবিষয়ক বিভিন্ন বৈঠকে সরকারি নীতিনির্ধারকরাও এ বিষয়ে আলোচনা করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই-বাছাই করে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করে। চলতি মাসে গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী এ বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী ওই বৈঠকে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে কত বাড়তি ব্যয় হবে তা হিসাব করে পরের বৈঠকে উপস্থাপন করতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বড় ধরনের ব্যয় না বাড়িয়ে একটা উপায় বের করতেও বলেন। শেষ পর্যন্ত ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যা চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে নিজেই জানিয়েছেন।
বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা ২০১৫ সালের বেতন কমিশন অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এ বেতন কমিশন প্রণীত হয়েছিল। এ কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, আর নতুন বেতন কমিশন গঠন করা হবে না। প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট বা বেতন বাড়ানো হবে। এ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তা হয়ে আসছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি হিসাব অনুযায়ী, দেশে সরকারি কর্মচারী ১৪ লাখ। বিভিন্ন করপোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিয়ে হিসাব করলে প্রায় ২২ লাখ।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে নিয়মিত ইনক্রিমেন্টের বাইরে আরও কতটা বাড়ানো যায় তা হিসাব করে নির্ধারণ করা হবে। এ কাজ করতে বাজেট প্রস্তাব পেশ করার পর আলাদা কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে যাচাই-বাছাই শেষে ইনক্রিমেন্টের হার সুপারিশ করবে। এ ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে বিদ্যমান ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে প্রতি মাসে বেতন বাড়ানো হবে, নাকি গড় মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে ইনক্রিমেন্টের হার বাড়ানো হবে, তা খতিয়ে দেখা হবে। ২০তম গ্রেড থেকে প্রথম গ্রেড পর্যন্ত সবার জন্য একই হারে বেতন বাড়নো হবে কি না, তা আরও খতিয়ে দেখা হবে। চূড়ান্ত হিসাব অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে প্রকাশ করা হবে। যে তারিখেই প্রকাশ করা হোক না কেন, আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকরী ধরা হবে।
এখানে মহার্ঘ ভাতা ১০ শতাংশ দেওয়া হলে এ হিসাবে ৪ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। ১৫ শতাংশ দেওয়া হলে ৬ হাজার কোটি এবং ২০ শতাংশ দেওয়া হলে ৮ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। অর্থাৎ মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে আগামী অর্থবছরে সরকারের ব্যয় বাড়বে। আর এতে সরকার ব্যয় কমিয়েও সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তুষ্টিতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো পথে হেঁটেছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতা বাবদ রাখা হয়েছে ছিল ৭৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। খরচ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ১ হাজার ৯৩ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা বাজেট হওয়ার কথা আছে। এ বাজেট সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতার জন্য বরাদ্দ ৭৭ হাজার কোটি টাকা রাখা হতে পারে। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেক পদ এখনো খালি আছে। এতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো হলেও সরকারের ব্যয়ে বড় ধরনের চাপ বাড়বে না।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন জায়েদা খাতুন।
তিনি ঘড়ি প্রতীকে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাতে রির্টানিং কর্মকর্তা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
নির্বাচনের অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ ৭ হাজার ২০৬ ভোট, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন-অর-রশীদ ২ হাজার ৪২৬ ভোট এবং হাতি প্রতীকের সরকার শাহনূর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) নির্মিত হয়েছে বিশেষ কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘ও ভোরের পাখি’। ঈমাম হোসাইনের প্রযোজনায় এটি উপস্থাপনা করেছেন তামান্ন তিথি। অনুষ্ঠানটিতে আবৃত্তি করেছেন আশরাফুল আলম, মীর বরকত, রফিকুল ইসলাম, পলি পারভিন, শাকিলা মতিন মৃদুলা, মাসকুর-এ সাত্তার কল্লোল, আসলাম শিশির, সংগীতা চৌধুরী, আহসান উল্লাহ তমাল। প্রচারিত হয় ২৫ মে সকাল সাড়ে ৯টায়।
এছাড়াও নির্মিত হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘আমারে দেবো না ভুলিতে’। অনুষ্ঠানটিতে গান, কবিতা ও আলোচনার সমন্বয়ে কবিকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও বাচিকশিল্পীদের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। ইয়াসমিন মুসতারী, সালাউদ্দিন আহমেদ, শেলু বড়ুয়া, ছন্দা চক্রবর্ত্তী ও ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছেন প্রফেসর মুন্সী আবু সাইফ। মনিরুল হাসানের প্রযোজনায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছে ২৫ মে দুপুর ১ টা ০৫ মিনিটে। আরও প্রচারিত হবে সংগীতানুষ্ঠান ‘দোলনচাঁপা’ ও ‘সন্ধ্যামালতী’। রাত ৯টায় প্রচারিত হবে নাটক ‘বনের পাপিয়া’ (পুনপ্রচার)।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোট শেষ হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এখন পর্যন্ত ৪৫০টি কেন্দ্রের প্রাথমিক ফল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নৌকা প্রতীকে আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩৭৯ ভোট এবং টেবিলঘড়ি প্রতীকে জায়েদা খাতুন পেয়েছেন ২ লাখ ৫ হাজার ৪১৩ ভোট।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
গাজীপুর সিটিতে মেয়র পদে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা খান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের মধ্যে। দুজনই জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। অপরদিকে ভোটের পরিবেশ ভালো বলে জানান আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহনূর ইসলাম রনি।
কোটা পদ্ধতি তুলে দেওয়ার পরও বিসিএস পরীক্ষায় নারীদের চাকরি পাওয়ার হার প্রায় একই রয়েছে। ১০ শতাংশ কোটা থাকা অবস্থায় তারা যে পরিমাণ চাকরি পাচ্ছিলেন, কোটা তুলে দেওয়ার পরও প্রায় একই হারে চাকরি পাচ্ছেন। সাধারণ ক্যাডার বা কারিগরি ক্যাডারে পিছিয়ে পড়লেও শিক্ষার মতো পেশাগত ক্যাডারগুলোতে এগিয়ে গিয়ে বিসিএসে মোট চাকরি পাওয়ার হারে প্রায় একই অবস্থান ধরে রেখেছেন নারীরা।
অথচ কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় বলা হয়েছিল, কোটা তুলে দিলে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। প্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণের গ্রাফ নিম্নমুখী হবে। আসলে তা হয়নি। কোটা তুলে দেওয়ার পরও তারা প্রায় সমানতালে এগিয়ে চলছেন।
৪০তম বিসিএস দিয়ে চাকরিতে ঢুকে বর্তমানে ঢাকা বিভাগে কর্মরত একজন নারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে বয়সে ছেলেরা চাকরির জন্য প্রতিযোগিতা করে সেই বয়সে অধিকাংশ নারীকেই বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করতে হয়। সংসার করে, সন্তান লালনপালন করে নারীরা ভালো প্রস্তুতি নিতে পারে না। ফলে অনেক মেধাবী নারী প্রতিযোগিতায় উতরে যেতে পারেন না। অনেক নারী পারিবারিক কারণে বিয়ের পর চাকরির আবেদনই করেন না। বিয়ের পর পরীক্ষায় অংশ নিতে বাধা আসে। এসব কাটিয়ে উঠে চাকরিতে প্রবেশ করা কঠিন। আর বিসিএসের চাকরি মানেই বদলিযোগ্য। সংসার-সন্তান রেখে বদলিকৃত পদে যোগ দেওয়া কঠিন বিষয়। সবকিছু মিলিয়ে নারীদের জন্য এ চাকরি সহজ নয়। একজন পুরুষ বেকার নারী বিয়ে করে, কিন্তু একজন নারী বেকার পুরুষ বিয়ে করে না। এ বিষয়টাও ছেলেদের প্রস্তুত হতে সাহায্য করে। এ বাস্তবতা থেকেও পুরুষ প্রতিযোগী বেশি হয়। অন্যদিকে যোগ্য হলেও অনেক নারী প্রতিযোগিতাই করে না।
একজন নারী ইউএনও বলেন, পরীক্ষার হলে বা মৌখিক পরীক্ষার সময় অনেক নারীকে দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে সঙ্গে আনতে হয়। এগুলোও অনেক সময় নারীকে চাকরির ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে। ঘরে ঘরে বাধা পায় নারীর অগ্রযাত্রার নানা চেষ্টা। নগর-জীবনে নারীর অস্তিত্ব অনেকটা স্বচ্ছন্দের। কিন্তু নগরসভ্যতার বাইরে বিশাল বিস্তৃত গ্রামীণ জনজীবনে পুরুষতন্ত্রের নানা ধরনের অনাকাক্সিক্ষত বেষ্টনী এখনো নারীকে ধরাশায়ী করে রাখে। হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথ হাঁটছে নারী-পুরুষ। তবু তাদের মধ্যে ভারসাম্য নেই।
কোটা না থাকার পরও নারীরা তাদের অবস্থান কীভাবে ধরে রাখলেন জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নারী শিক্ষায় বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। প্রাথমিকের পর মাধ্যমিকেও মেয়েরা অনেক এগিয়েছে। উচ্চশিক্ষায়ও মেয়েদের অংশগ্রহণের হার বেড়েছে। সবকিছু মিলে বিসিএসে এর প্রতিফল ঘটেছে। যে পরিমাণ মেয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে, সেই তুলনায় চাকরিতে প্রবেশের হার বেশি। উচ্চশিক্ষায় যায় হয়তো ৮০ ভাগ ছেলে। আর মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার হার ৩০ বা ৩৫ শতাংশ। তাদের মধ্যে ২৬ বা ২৭ শতাংশ মেয়ে বিসিএস দিয়ে চাকরি পাচ্ছে। এদিক দিয়ে চিন্তা করলে মেয়েরা অনেক ভালো করছে।’
এক প্রশ্নের জবাব ড. ইমতিয়াজ বলেন, ‘মেয়েদের কাছে শিক্ষা এখনো অপরচুনিটি (সুযোগ) আর ছেলেদের কাছে অধিকার। মেয়েরা যখন এ সুযোগটা পায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা কাজে লাগাতে চায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরিবারের ছেলেসন্তানের জন্য যে বিনিয়োগ, মেয়েসন্তানের জন্য এখনো তার চেয়ে অনেক কম। এখনো মনে করা হয় মেয়ে তো অন্যের ঘরে চলে যাবে। অথচ মজার বিষয় হচ্ছে, পরিবারের দায়িত্ব উচ্চশিক্ষিত ছেলের তুলনায় উচ্চশিক্ষিত মেয়ে অনেক বেশি বহন করে। এসব প্রতিবন্ধকতা হাজার বছরে তৈরি হয়েছে। এগুলো দূর হতে আরও সময় লাগবে।’
অন্যান্য কোটার মতো প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা ছিল। নারীরা যোগ্যতা অনুযায়ী মেধা কোটায়ও নিয়োগ পেতেন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে মেধাভিত্তিক জেলা কোটার পাশাপাশি ১৫ শতাংশ নারী কোটা রয়েছে এখনো। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক জেলা কোটার পাশাপাশি ৬০ শতাংশ নারী কোটা সংরক্ষিত রেখে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে নারীরা সরকারি চাকরিতে পুরুষ প্রার্থীর সঙ্গে মেধা কোটায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিয়োগ লাভের পাশাপাশি সংরক্ষিত কোটায়ও নিয়োগ লাভের সুবিধা পেয়ে থাকেন।
শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে ছাত্রীর হার বাড়ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এক দশকের বেশি সময় ধরে ছাত্রের চেয়ে ছাত্রীর হার বেশি। কলেজ পর্যায়ে ছাত্র ও ছাত্রীর হার প্রায় সমান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর হার ৩৬ শতাংশের বেশি।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে সরকার। ৪০তম সাধারণ বিসিএস হচ্ছে কোটামুক্ত প্রথম বিসিএস। ধাপে ধাপে বাছাই করে গত বছর ৩০ মার্চ এই বিসিএসের চূড়ান্ত সুপারিশ করে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। প্রায় ১৩ মাস পর গত মাসে সেই সুপারিশের বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে পিএসসি। সেখানে বলা হয়েছে, ৪০তম বিসিএসে মোট ২৬ দশমিক ০৩ শতাংশ নারী চূড়ান্তভাবে সুপারিশ পেয়েছেন। যা কোটাযুক্ত ৩৮তম বিসিএসে ২৬ দশমিক ৯১ ও ৩৭তমে ২৪ দশমিক ৬০ শতাংশ ছিল। গত ১ নভেম্বর এ বিসিএসের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দিয়েছেন।
পিএসসির একজন সাবেক চেয়ারম্যান বলেছেন, কোটামুক্ত একটি সাধারণ বিসিএসে ২৬ দশমিক ০৩ শতাংশ নারী চূড়ান্তভাবে সুপারিশ পেয়েছেন এটা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নারীদের শক্ত সক্ষমতা প্রকাশ করে। কারণ এর আগে কোটাযুক্ত ৩৮তম বিসিএসের তুলনায় মাত্র দশমিক ৮৮ শতাংশ কম। অর্থাৎ কোটা তুলে দেওয়ার পরও নারীরা ১ শতাংশও পিছিয়ে পড়েননি। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, প্রত্যেক বিসিএসে নারীদের আবেদনের হার অর্থাৎ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের হার পুরুষের তুলনায় কম অর্থাৎ গড় হার কম। পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতেও নারী প্রার্থীদের পুরুষের তুলনায় অনেক কম চোখে পড়ে। এমনকি কোনো কোনো কক্ষে নারী প্রার্থী থাকেই না। একই সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ধাপগুলো অতিক্রম করার ক্ষেত্রে নারীদের অনুত্তীর্ণ হওয়ার পরিমাণ বেশি থাকে। ৪০তম বিসিএসে যোগ্য আবেদনকারী নারী ছিলেন ৩৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তাদের মধ্যে ১৯ দশমিক ১৯ শতাংশ নারী প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হন। অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র। যোগ্য আবেদনকারী পুরুষ ছিলেন ৬১ দশমিক ৬২ শতাংশ। প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ পুরুষের হার ৮০ দশমিক ৮১ শতাংশ।
৪০তম বিসিএসের সাধারণ ক্যাডারে ২১ দশমিক ০৮ শতাংশ নারী সুপারিশ পেয়েছেন। এই হার ৩৮ ও ৩৭তম বিসিএসে ছিল যথাক্রমে ২৪ দশমিক ১৪ ও ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
৪০তম বিসিএসের কারিগরি ক্যাডারে ২৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ নারী সুপারিশ পেয়েছেন। এই হার ৩৮ ও ৩৭তম বিসিএসে ছিল যথাক্রমে ২৯ দশমিক ৫৩ ও ২৫ দশমিক ২ শতাংশ।
সাধারণ এবং কারিগরি ক্যাডারে নারীরা পিছিয়ে পড়লেও শিক্ষার মতো পেশাগত ক্যাডারে এগিয়েছেন। ৪০তম বিসিএসে ২৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ নারী সুপারিশ পেয়েছেন। যা ৩৮তমে ২৬ দশমিক ৩০ এবং ৩৭তমে ২৫ দশমিক ২ শতাংশ ছিল।
পুরোপুরি মেধার ভিত্তিতে নেওয়া ৪০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারেও নারীরা পিছিয়েছেন। জেলা কোটাও না থাকায় নাটোর, ভোলা, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি থেকে প্রশাসন ক্যাডারে কেউ সুপারিশ পাননি।
গত বছর প্রকাশিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি চাকরিজীবীদের তথ্যসংক্রান্ত ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস’ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সিভিল প্রশাসনের ১৪ লাখ সরকারি কর্মচারীর মধ্যে ২৬ শতাংশ নারী। সরকারি দপ্তরের মধ্যে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করেন সবচেয়ে কমসংখ্যক নারী। মন্ত্রণালয়ের মোট জনবলের ১৯, অধিদপ্তরের ৩১, বিভাগীয় কমিশনার ও ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয়ের ১২ এবং আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ১২ শতাংশ কর্মী নারী।