
আমরা অনেক সময় কাজ করতে করতে বিশ্রামের কথা ভুলে যাই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থের লোভ বিশ্রাম নেওয়ার কথা ভুলিয়ে দেয়। আপনি হয়তো কাজ করেই যাচ্ছেন, করেই যাচ্ছেন। চিন্তা করছেন, এইটুকু কাজ করলেই এত টাকা পাচ্ছি, আরও করি আরও পাব। এই একটু কাজ করলে তো আর মারা যাব না! কিন্তু বুঝতেই পারছেন না, কাজের চাপ এক সময় আপনাকে এতটাই দুর্বল করে দেবে, এক সময় কিছুই করতে পারবেন না। তাই মাঝে মাঝে বিশ্রাম নেওয়া অতি জরুরি। অন্ন-বস্ত্রের মতো বাসস্থানও মানুষের একটি মৌলিক প্রয়োজন। এর আসল উদ্দেশ্য হলো বিশ্রাম, শান্তি ও বসবাস।
মানুষকে সুস্থ থাকার জন্য যেমন রাতের বেলা ঘুমাতে হয়, তেমনি দিনের বেলায়ও সামান্য সময় ঘুমানো সুন্নত। দিনের এই ঘুমকে আমাদের দেশে বলা হয় ভাত-ঘুম, আরবিতে একে বলা হয় ‘কাইলুলা’। দুপুর বেলায় সামান্য ঘুমানোর রীতি আরবেও আছে, নবী কারিম (সা.)-এর যুগেও এই ঘুমের প্রচলন ছিল। সাহাবি হজরত সাহাল ইবনে সাদ (রা.) বলেন, ‘আমরা জুমার নামাজের পর দুপুরের বিশ্রাম গ্রহণ ও খাবার খেতাম।’ -সুনানে আবু দাউদ : ১০৮৬
এমনকি নবী কারিম (সা.) নিজেও দুপুর বেলা কাইলুলা করতেন বলে হাদিসের বর্ণনায় রয়েছে। দুপুর বেলায় সুন্নতের নিয়তে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে একদিকে যেমন নবীজির সুন্নত পালনের সওয়াব পাওয়া যাবে, তেমনি শারীরিক ও মানসিক প্রফুল্লতা অর্জন হবে। এতো গেল শারীরিক বিশ্রামের কথা। এ ছাড়া জীবনে আরও নানা ধরনের বিশ্রামের প্রাসঙ্গিকতা বিদ্যমান।
আমরা জানি, শরিয়তের দু’টি প্রধান ও প্রতিষ্ঠিত বৈশিষ্ট্য হলো শিথিলতা ও সরলতা। এ দুটি গুণ মুসলমানকে তার ইবাদত-বন্দেগি, কাজ-কর্ম ও আচার-আচরণে সাহায্য করে। এ কারণে আমরা দেখতে পাই, আল্লাহর রাসুল (সা.) হাসি ও কৌতুক উভয়টিই করতেন। কিন্তু সত্য ছাড়া অন্য কিছু (মিথ্যা) বলতেন না। সমাজে এমন অনেক লোক রয়েছে, যারা ভালো নিয়তে অধিক পরিমাণে নফল নামাজ পড়েছে এবং ধর্ম-কর্ম পালনে চরম বাড়াবাড়ি করেছে। কিন্তু এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারে না। এক সময় দেখা যায়, তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা আগে যেমন ছিল তার চেয়ে কমে গেছে; এমনটি কাম্য নয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘(হে মুহাম্মদ!) তোমার ওপর আমি কোরআন এ জন্য নাজিল করিনি যাতে তুমি কষ্ট পাও।’ -সুরা ত্বহা: ২
যারা নিজেদের ওপর সাধ্যাতীত বোঝা চাপায়, আল্লাহতায়ালা তাদের তিরস্কার করেন। কোরআন মাজিদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘আর সন্ন্যাসবাদ, তারা একে আবিষ্কার করেছিল, আমি তাদের ওপর এ বিধান দিইনি। তবে তারা নিজেরাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য এটা পালন করত। কিন্তু এটাকেও তারা যথাযথভাবে পালন করেনি।’ -সুরা আল হাদিদ: ২৭
ইসলাম দেহ-মনের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখার কারণে, ইহ-পরকালের পাথেয় জোগান এবং সবার কাছে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিশ্বাস অন্তর্ভুক্তের কারণে অন্য ধর্ম থেকে ব্যতিক্রমধর্মী। ইসলামে অহির মাধ্যমে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, মানুষের সঙ্গে মিলে থাকতে, জ্ঞানী লোকদের অনুসরণ করতে এবং ধর্মীয় ব্যাপারে সমাজের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে। যে ব্যক্তি নিজের ধর্ম এবং সম্পদ রক্ষায় নিজেই যথেষ্ট, তার জন্য একাকিত্ব উত্তম। তবে প্রয়োজনের সময় ও ভালোকাজে অন্যদের সঙ্গে মেশা দরকার। তা সত্ত্বেও তাকে জরুরি কাজগুলো অবশ্যই সম্পাদন করতে হবে; যেমন জামাতে নামাজ আদায়, সালামের উত্তর দেওয়া, রোগী দেখতে যাওয়া, জানাজায় হাজির হওয়া ইত্যাদি। যা দরকার তা হলো অতিমাত্রায় সামাজিক হতে গিয়ে বিভিন্ন ফেতনায় না জড়ানো, ইবাদত-বন্দেগি ভুলে যাওয়া। অতিমাত্রায় সামাজিক হওয়ার ফলে সময় নষ্ট হবে এবং অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অবহেলা করা হবে। দেহের জন্য পানাহারের প্রয়োজন যেমন, সমাজের অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করা তেমন। উভয় ক্ষেত্রেই যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু গ্রহণ করা উচিত।
ইমাম কোশাইরি (রহ.) একাকিত্ব বিষয়ে বলেছেন, যে নিঃসঙ্গতা অন্বেষণ করে তার মনে রাখা উচিত, সে এ কাজ করছে তার ক্ষতি থেকে জনগণকে বাঁচানোর জন্য এবং এর বিপরীতটা নয় (জনগণের ক্ষতি থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য নয়)। এর কারণ, প্রথমজন নিজের সম্বন্ধে বিনয়ী মনোভাব পোষণ করে (মানুষকে নিজের চেয়ে ভালো মনে করা)- যা ধর্ম চায়। দ্বিতীয়জন অন্যদের ওপর নিজের বড়ত্ব আরোপ করেছে (মানুষকে নিজের চেয়ে খারাপ মনে করা)- যা মুমিনের চরিত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।
এ বিষয়ে মানুষকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। দু’টি বিপরীতধর্মী, তৃতীয়টি মাঝামাঝি। প্রথম শ্রেণির মানুষ নিজেদের সাধারণ মানুষ থেকে এতটাই আলাদা করে রাখে যে, তারা জুমার নামাজে হাজির হয় না। জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করে না এবং সামাজিক কল্যাণকর কোনো কাজেই যোগ দেয় না। তারা স্পষ্টভাবে ভ্রান্ত। দ্বিতীয় শ্রেণির লোকজন এতটাই সামাজিক যে, তারা মন্দ সমাবেশে অংশগ্রহণ করে- যেখানে মিথ্যা গুজব ও সময়ের অপচয় হয়। তারাও ভুলের মধ্যে রয়েছে। মধ্যপন্থি (তৃতীয় শ্রেণি) লোকেরা যেসব ইবাদত অবশ্যই জামাতে আদায় করতে হয়, সেসবে অন্যদের সঙ্গে একত্রিত হয়। ধর্ম প্রচার এবং আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে তারা অন্যদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে। যেসব সমাবেশে শয়তানি, মিথ্যা ও অপচয় হয় তারা সেগুলো এড়িয়ে চলে। ইরশাদ হয়েছে, ‘এরূপে আমি তোমাদের এক মধ্যপন্থি জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি।’ -সুরা বাকারা: ১৪৩
এমন মধ্যমপন্থাই ইসলামের শিক্ষা। যে শিক্ষার সঙ্গে মানবজীবনে বিশ্রামের প্রয়োজনীয়তা যেমন মিশে আছে, তেমনি রয়েছে অতি বাড়াবাড়ি, ছাড়াছাড়ি ও অলসতা ত্যাগের শিক্ষাও।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিচার বা দণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না। সংবিধানে এমন বিস্তৃত অধিকার থাকা সত্ত্বেও দেখা যায় আইন ও বিধির কথা বলে প্রায়শই নাগরিকের অধিকার ভঙ্গের পাশাপাশি হয়রানি ও অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে। নিকট অতীতে পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও উদাসীনতায় জঙ্গি ও দাগি আসামিদের হেফাজত থেকে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে। আবার সাধারণ কোনো আসামির বিষয়ে কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত সতর্কতা দেখাতে গিয়ে মানবাধিকার ও সংবিধান পরিপন্থী কাজ করছে। দেখা যাচ্ছে কিছু ক্ষেত্রে তারা উদাসীনতা দেখান। আবার কিছু ক্ষেত্রে তারা সতর্কতা, কারাবিধির নামে বাড়তি উৎসাহ দেখান। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে কর্তৃপক্ষই কারও জন্য পলায়নের পথ তৈরি করছে আর কারও জন্য ডান্ডাবেড়ি-হাতকড়ার আয়োজন করছে। এতে পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষই বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার গাজীপুরের কালিয়াকৈরের পাবরিয়াচালায় মায়ের জানাজায় ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় অংশ নেন স্থানীয় বিএনপি নেতা আলী আজম। ঘটনাটি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশের পর দেশজুড়ে সমালোচনা শুরু হয়। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও কারা কর্র্তৃপক্ষ বলছে, কারাবিধি অনুযায়ীই তাকে ডান্ডাবেড়ি ও হাতকড়া পরানো হয়েছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, বিচারের আগেই ডান্ডাবেড়ি পরানো কোনো সভ্য দেশের রীতি হতে পারে না। তবে, অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন মনে করেন, কিছু ভুল হয়ে থাকলেও সতর্কতার জন্যই ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, জানাজার আগে ডান্ডাবেড়ি ও হাতকড়া খুলে দিতে স্থানীয় লোকজন অনুরোধ করলেও তাতে কান দেয়নি পুলিশ। গাজীপুরের পুলিশ সুপার কাজী শফিকুল আলম বলেন, ‘ডান্ডাবেড়ি বা হাতকড়া লাগানো, না লাগানো জেল কর্র্তৃপক্ষের ব্যাপার। এতে পুলিশের কোনো দায় নেই।’ যদিও এ ঘটনায় তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ডান্ডাবেড়ি খুলে দিলে ভালো হতো।
আইনজীবী জেড আই খান পান্না দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিচারের আগেই তাকে কেন ডান্ডাবেড়ি পরানো হবে? বাংলাদেশের সংবিধান, ফৌজদারি কার্যবিধি, দ-বিধি কোথাও ডান্ডাবেড়ির বিষয়টির উল্লেখ নেই। সংবিধান ও আইন অনুযায়ী ন্যায়বিচারের স্বার্থে একজন আসামির দিকেও নজর রাখতে হয়।’ ডান্ডাবেড়ির বিষয়ে উচ্চ আদালতের অন্তত দুটি রায় রয়েছে, যেখানে আদালত আপত্তি তুলে নির্দেশনা দিয়েছে। কারা কর্র্তৃপক্ষ দাবি করে, আসামি যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য কারাবিধি অনুযায়ী ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, কারাবিধি কি সংবিধান, হাইকোর্ট, ফৌজদারি আইনের চেয়ে বড়?
গত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন থানায় নাশকতা, ভাঙচুরসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এসব মামলার অজ্ঞাত আসামিদের গ্রেপ্তার ও হয়রানির মাধ্যমে পুলিশ অর্থ আদায় করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে, পুলিশ সদর দপ্তরের দাবি, বিজয় দিবস, বড়দিন, খ্রিস্টীয় বর্ষবরণ উদ্যাপন নিরাপদ ও নির্বিঘœ করতে এবং ২০ নভেম্বর ঢাকায় আদালত ফটক থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ অভিযান চালায় পুলিশ। কিন্তু ছিনতাই হওয়া দুই জঙ্গি কিংবা যেসব জঙ্গি তাদের ছিনতাই করে নিয়ে গেছে, কারও হদিস করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ১ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা পুলিশের দুই সপ্তাহব্যাপী এ অভিযানে ২৩ হাজার ৯৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে তালিকাভুক্ত জঙ্গি ও সন্ত্রাসী ৭২ জন। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠবে, এর বাইরে কারা গ্রেপ্তার হয়েছে? প্রশ্ন উঠছে জঙ্গি দমনের চেয়ে কর্তৃপক্ষের বিরোধীদের দমন ও ভয়ভীতি প্রদর্শনেই উৎসাহ বেশি কিনা, তা নিয়ে।
গাজীপুরে যে ঘটনাটি ঘটেছে তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। সংবিধান, প্রচলিত আইন সবকিছুর ব্যত্যয় ঘটেছে এ ক্ষেত্রে। ওই ব্যক্তি তো সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি নন। একজন শোকাগ্রস্ত মানুষকে ডান্ডাবেড়ি পরানোর ঘটনায় যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। দুর্ধর্ষ জঙ্গিকে আদালতে নেওয়ার সময় নিরাপত্তা নিয়ে একেবারে ছেলেখেলা করা হলো। আর এ ক্ষেত্রে একজন রাজনৈতিক সংগঠককে একটি মামলায় এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হলো। সমাজে ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে এরকম করা হলো কি না, সেটি যেমন দেখা উচিত তেমনি কোনো একটি গোষ্ঠীকে খুশি করতে এটা করা হলো কি না, তারও পর্যালোচনা হওয়া উচিত।
একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সুসমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। যেমন অপরিহার্য একটি সার্থক সংগীত নির্মাণে গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী ও বাদক যন্ত্রীদের সমন্বিত ও আন্তরিক প্রয়াস। অর্থ বিভাগ জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করে ঠিকই কিন্তু সেই বাজেটের আয়-ব্যয়ের চাহিদা প্রাক্কলন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকেই আসে এবং বাজেট বরাদ্দের পর তা ব্যয়ন, বাস্তবায়ন সব মন্ত্রণালয়গুলোই করে থাকে। সুতরাং বাজেট ব্যবস্থাপনায় অর্থ বিভাগের দায়িত্ব একক নয় এবং এর সাফল্য ব্যর্থতার দায়ভার অবশ্যই সবার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেশের আমদানি-রপ্তানির নীতিনির্ধারণ করে মাত্র। কিন্তু আমদানি-রপ্তানির সার্বিক পারঙ্গমতা বেসরকারি খাতের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল। কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষি খাতের উপায় উপকরণ থেকে শুরু করে চাষাবাদসহ যাবতীয় বিষয়-আশয়ের নীতি নিয়মকানুন ভালোমন্দ তদারকি করে থাকলেও কৃষি কাজে নিয়োজিত দেশের শতকরা ৭০ ভাগ জনগোষ্ঠীই কৃষি উৎপাদন বিপণনের সফলতা-ব্যর্থতার ভাগীদার। একই অবস্থা সব খাত ও ক্ষেত্রে। আমাদের জাতীয় বাজেটের সর্বমোট ব্যয়ের গড়ে ৭০ ভাগ অর্থায়ন হয় অভ্যন্তরীণ সম্পদ দ্বারা যার আহরণের প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের। কিন্তু রাজস্ব বোর্ড নিজে ব্যবসা বাণিজ্য, বিনিয়োগ করে না, সম্পদ সৃষ্টিতে কোনো ভূমিকা রাখে না। যারা আয় করেন, যাদের ওপর আয়কর আরোপিত হওয়ার বিষয়, যারা ভোগ করেন, যাদের ওপর ভ্যাট প্রযোজ্য এবং যারা আমদানি করেন, যাদের ওপর আমদানি শুল্ক প্রযোজ্য তাদের কৃতকর্মের ওপর কর আহরণের গতিপ্রকৃতি নির্ভরশীল। আবার ব্যক্তি বা কোম্পানির আয় শুধু ব্যক্তি বা কোম্পানির দক্ষতা-অদক্ষতার ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল নয়। যে পরিবেশে বা যে ব্যবসায় বা যে কর্মকাণ্ডের মধ্য থেকে ব্যক্তি বা কোম্পানি আয় উপার্জন করে সে পরিবেশ, সে লোকবল, সে ব্যবসা বা সে কর্মকাণ্ড নিরাপদ সঞ্চালনের ওপর নির্ভরশীল। একই অবস্থা ভোক্তা ও আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের বেলায়ও প্রযোজ্য। সুতরাং সামষ্টিক অর্থনীতির সামষ্টিকতা সর্বত্র পরিব্যাপ্ত।
দেখা যাচ্ছে কার্যকারণের সঙ্গে ফলাফলের আন্তঃযোগাযোগ বা আন্তঃসম্পর্ক পরস্পর প্রযুক্ত ও নিবিড়ভাবে নির্ভরশীল। যে কোনো পর্যায়কে তাই বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই, দীর্ঘমেয়াদে অর্জিত সাফল্যকে একটি সীমাবদ্ধ সময়ের অবয়বে শুধু নিজেদের সাফল্য হিসেবে দেখার, প্রচারের ও প্রগলভতা প্রকাশের সুযোগ নেই। সামষ্টিকতার সামষ্টিকতাই থাকে না যদি কজ আর ইফেক্টের মধ্যকার পরস্পর প্রযুক্ততার বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণে যাওয়া না হয়। অর্থনীতির ক্ষতিকর যে কোনো অপপ্রয়াসের সামনের ও নেপথ্যের উভয় কারণের প্রতি দৃষ্টিদান সমাধান প্রত্যাশা ও প্রয়াসকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে পারে। কার্যকারণ ছাড়া কোনো কিছু উদ্ভব হয় না। শুধমাত্র উদ্ভূত পরিস্থিতি কিংবা উপস্থাপিত ফলাফলকে সমালোচনার কাঠগড়ায় না এনে একই সঙ্গে কী কারণে এই পরিস্থিতির উদ্ভব কিংবা এই ফলাফলের উপলক্ষকেও বিচার বিশ্লেষণের আর্জিতে আনার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। দৃষ্টিভঙ্গি সীমাবদ্ধ হলেই যে কোনো ফলাফলকে নানান অবয়বে উপস্থাপন ও সমালোচনা চলে। তার দাবি, প্রয়োজন ও চাহিদামতো পুষ্টিকর খাবার না পেলে কোনো শিশু ক্ষুধায় কাঁদলে, হাত-পা ছুড়ে একাকার করতে থাকলে তাকে ‘কাঁদুনে শিশু’ বলে অপবাদ দেওয়ার অপপ্রয়াস নিশ্চয়ই সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত।
দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এককভাবে কোনো মন্ত্রণালয় বা কর্তৃপক্ষের বা কর্তৃত্বের হতে পারে না। এর সঙ্গে সবার সংঘবদ্ধ অথচ স্ব স্ব দায়িত্ব কর্তব্য পালনের ওপর নির্ভরশীলতাকে মানতেই হবে সুতরাং সামগ্রিক অবয়বে দেখেই বিচার করতে হবে সব ফলাফলকে। সামষ্টিক অর্থনীতির সামষ্টিকতায় প্রধান সীমাবদ্ধতা এখানে যে প্রত্যেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে অবস্থান করেই দ্বীপপুঞ্জের সাফল্য ও কল্যাণ কামনা করা হয়। সবার সাফল্য শুধু নিজের বলে জাহির আবার নিজের ব্যর্থতাকে অন্যের ওপর চাপানোর মানসিকতা সব সমন্বয় ও সাযুজ্যকরণকে বাধাগ্রস্ত করে। পরস্পরের দোষারোপের দ্বারা ঐক্যবদ্ধ চেতনা বিকাশ লাভ করে না, সবার প্রয়াস এক সুরে বাঁধা যায় না, হয় না। উন্নয়নের তানপুরায় বারবার ধূলি জমে আর সেখানে ঐকমত্যের সুর সাধা বেসুরো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
একান্ন বছর বয়সী বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকসমূহের প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে সময়ের অবসরে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। পরস্পর প্রযুক্ত সাহায্য-সহযোগিতা যেমন একে বলবান করেছে, আবার আত্মঘাতী পদক্ষেপের দ্বারা অগ্রযাত্রাকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এ সাফল্য ও ব্যর্থতায়, আনন্দ ও সর্বনাশে দেশের শিল্পনীতি, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ পরিবেশ এবং পুঁজিবাজারের পথপরিক্রমার সামষ্টিক দৃষ্টিভঙ্গির স্বরূপ সন্ধানে আমরা লক্ষ করি এক বিচিত্র গতিপ্রকৃতি।
কোন পদক্ষেপ অর্থনীতির জন্য সুদূরপ্রসারী সুফল বয়ে আনতে পারে তা চটজলদি বলা মুস্কিল, তবে যে কোনো পদ্ধতির ভালোমন্দ উভয় দিক যেহেতু আছে ভালো দিকটা যাতে প্রতিভাত হয় সে জন্য সময় ও মেধা প্রয়োগ সমীচীন। বিগত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অভিযাত্রায় টেকসই উন্নয়ন প্রয়াস প্রচেষ্টা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অত্যন্ত সাময়িক, সীমিত ও খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গির অবয়বে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়েই রয়ে গেছে। শিল্পনীতিসমূহে ঘোষিত নীতিমালায় দ্রুত শিল্পায়নের উচ্চভিলাষী ও পরিকল্পিত প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটলেও তার সফল বাস্তবায়ন, নিদেনপক্ষে ফলাফল যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-পর্যালোচনার অবকাশ মেলেনি। ১৯৮২ সালের শিল্পনীতিতে উচ্চারিত বক্তব্য ১৯৮৬, ১৯৯২, ১৯৯৬, ১৯৯৯ এবং ২০১০ এর শিল্পনীতিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই বলয়ে রয়ে গেলেও দেশের শিল্পায়ন পদ্ধতি প্রক্রিয়ায় এ তিনটি দশকে বেসরকারি খাতের কিছুটা বিকাশ প্রত্যক্ষ করা গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত নিজস্ব উদ্যোগে উদ্ভূত সমস্যাবলি নিজেরা মোকাবিলা করে নিজেদের মতো করে ওপরে উঠছে। পাবলিক সেক্টর এ সময় আরও লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বিপুল বিদেশি অর্থের বিনিয়োগ ঘটিয়েও শিল্প সহায়ক সংস্থা (টেলিফোন, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, বন্দর) অবকাঠামোগত সহায়তার পূর্ণাঙ্গ সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজির অবাধ প্রবেশে নিজেদের ব্যবস্থাদি আরও দুর্বল হয়েছে। সবল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে করতে নিজস্ব সক্ষম শক্তিগুলো বয়োবৃদ্ধির ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির পরিসংখ্যান বাস্তবের কাছাকাছি পৌঁছাতে গিয়ে পরিবর্তিত হয়েছে বারবার আর উক্ত খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ পরিসংখ্যানের আলোকে প্রণীত শুল্ক, কর আরোপ ও অন্য ব্যবস্থাদি বাস্তব ক্ষেত্রে কখনো বা অপ্রতুল, ক্ষেত্রবিশেষ অপ্রাসঙ্গিক এবং কোথাও কোথাও নিরুৎসাহমূলক প্রতীয়মান হয়েছে। ব্যবসায়ী সংগঠন সমিতি থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে শুল্ক করাদির ক্ষেত্রে নিষ্কৃতি কিংবা হ্রাসকরণের দাবি পেশ কালে দাবির সমর্থনে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক বিশ্লেষণাত্মক যুক্তি যথাযথভাবে উপস্থাপনে প্রায়শ অপারগ থেকেছেন।
সঞ্চয় বিনিয়োগের প্রধানতম পূর্বশর্ত। জনগণের মাথাপিছু আয়ের মৌল স্তর বৃদ্ধি ছাড়া কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৃদ্ধির চিন্তাচেতনা বাস্তবসম্মত নয়। সামাজিক কল্যাণ খাতে উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটিয়ে সঞ্চয় বাড়ানোর পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। ক্যালরি ইনটেক বাড়িয়ে, বিশুদ্ধ পানি ও মৌল স্বাস্থ্যসেবার আওতায় (জনস্বাস্থ্য) সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে মৃত্যুর হার কমিয়ে জন্মহারকে সুষম নিয়ন্ত্রণ, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান সংক্রান্ত মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং কাজ সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের মৌলিক আয়ের স্তর বাড়ানো সম্ভব হতে পারে। শিক্ষা, চিকিৎসা খাতে ব্যক্তিগত ব্যয়ের মাত্রা কমিয়েও সঞ্চয়ের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। সঞ্চয়কে উৎসাহিত করতে ব্যাংকিং সৃবিধা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। বিদেশি সাহায্য ও ঋণনির্ভর অর্থনীতিতে সঞ্চয় প্রত্যাশা করা বাতুলতা মাত্র বিধায় জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় দেশজ সম্পদ উন্নয়নে গৃহীত পরিকল্পনা নিজস্ব উপায়ে বাস্তবায়ন সক্ষমতার সমাহার আবশ্যক। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হার এখনো নিম্নে। বিনিয়োগ হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যকর ও সহনশীল পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক। দেখা গেছে বেসরকারি খাতের উন্নয়নে ১৯৭৩ সালে শিল্পনীতিতে ঘোষিত সংরক্ষণবাদী বিধানাবলি ১৯৮২ সালে অপসারিত হলেও ১৯৯১ এর আগে বেসরকারি খাতে প্রকৃত বিনিয়োগ হয়নি। আবার, ১৯৭৬, ১৯৮২, ১৯৮৬’র শিল্পনীততে গার্মেন্টস শিল্প খাতে উন্নয়ন বিষয়ক কোনো পরিকল্পনার আভাস-ইঙ্গিত ততটা না থাকলেও এ-খাতে বিনিয়োগ হয়েছে অভাবিতপূর্ব। শিল্পনীতিতে আবকাঠামো, খাদ্য, কৃষি ও ক্ষুদ্রশিল্প খাতের উন্নয়নে যথাযথ সহায়তা ও প্রযত্ন প্রদানের পর্যাপ্ত ক্ষমতা রাখা হয়নি পোষক প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে। সীমিত ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্যোগও লক্ষণীয় হয়ে ওঠেনি। সমন্বয়হীনতা এক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায় হয়ে রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের অভ্যুদয় পুঁজিবাদের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত হওয়ায় নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির প্রভাববলয়ে চলে যায় নতুন অর্থনীতির চালিকাশক্তি। সাবেক পাকিস্তান আমলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির রেখে যাওয়া শিল্প-কারখানা বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর রাষ্ট্রীয় মালিকানায় এনে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে তাদের নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় বেসরকারি খাত তখন এমন স্বয়ম্ভর ও সক্ষম ছিল না যে পরিত্যক্ত শিল্প অবকাঠামো দেখাশুনার ভার নিতে পারে। তখন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ছাড়া গত্যন্তরও ছিল না।
যে উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়কে সামনে রেখে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে জাতীয়করণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয় তা পূরণ ও বাস্তবায়নে পাবলিক সেক্টরেও দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব যে প্রকট তা যথাসময়ে উপলব্ধি করা যায়নি। ফলে লাভজনক শিল্প-কারখানাগুলো অধিক লোকসান এবং এমনকি যন্ত্রপাতি যন্ত্রাংশ পাচার হওয়ার মতো দুঃখজনক পরিস্থিতির শিকার হয়। পরবর্তী সময়ে এগুলো বিএমআরই কিংবা বেসরকারি খাতে বিক্রি করাতেও বিপত্তি দেখা দিয়েছে। ফলে এগুলো জাতীয় অর্থনীতিতে জগদ্দল পাথরে পরিণত হয়েছে। পাবলিক সেক্টর দিয়ে জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়ন সম্ভব না হলেও পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরে উন্নয়নের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণে বিলম্ব ও উদ্যোগের অভাব আগের মতোই থাকে। সত্তরের দশকের শেষ এবং আশির দশকের শুরুতে নতুন শিল্পনীতিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতের কার্যকর অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে নীতিমালা ও কৌশল ঘোষিত হয়। ১৯৮২ সালের শিল্পনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগ ও স্থানীয় পুঁজির বিকাশকে প্রত্যাশা করে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে শিথিল ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির আগ্রহ প্রকাশ পায়। জাতীয়করণ উদ্দেশ্য অভিপ্রায় বাস্তবায়নের মতো ১৯৮২’র শিল্পনীতি বাস্তবায়নেও বশংবদ অনীহা অদক্ষতা দেশের শিল্প বিকাশের খাত ও ক্ষেত্রকে মাঝেমধ্যে যাত্রাপথে থামিয়ে দেয়। স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের কর্মসূচিতে অমনোযোগিতার অবসরে কার্যকর বিনিয়োগ প্রবাহের পরিবর্তে পুঁজিবাদী বিশ্বের স্বার্থ ও সমর্থনে কম ভ্যালু এডিশন সম্পন্ন শিল্প এদেশের বাজার দখলের পাঁয়তারায় প্রবেশ করে। দেশের বেসরকারি খাতের স্বয়ম্ভর হওয়ার সুযোগ সেখানে সংকুচিত হয়ে দাঁড়ায় এবং অর্থনীতির পরনির্ভরশীলতা থেকেই যায়। উন্নত বিশ্বের পরিত্যক্ত প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি ও পরিবেশ দূষণকারী শিল্প অবকাঠামো বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পুঁজিবাজারে প্রবেশ করে।
লেখক: সরকারের সাবেক সচিব এনবিআর-এর সাবেক চেয়ারম্যান
আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ের সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানেই পুরোপুরিভাবে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নেই। তবে, গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় যেমন গণিত, ইংরেজি ও বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক অর্থাৎ যে সব শিক্ষক এ বিষয়গুলোতে অনার্স কিংবা মাস্টার্স করেছেন কিংবা স্নাতক পাস করলেও স্নাতক শ্রেণিতে তাদের ঐ বিষয়গুলো ছিল তাদেরই পড়ানোর কথা। মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশই তাদের বিদ্যালয় জীবন শেষ করছে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে দুর্বলতা নিয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে বর্তমান বাস্তবতায় মাধ্যমিক পর্যায়ে আমরা কি বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক পাওয়ার অবস্থায় আছি?
ব্যানবেইস দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতি বছরই ‘বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০২১ সালের তথ্য বলছে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের ৮০ শতাংশেরই নেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। বছরটিতে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন ৯৬ হাজার ৫৮ জন। তাদের মধ্যে কেবল ৬ হাজার ২৪১ জন শিক্ষক ইংরেজিতে স্নাতক ডিগ্রিধারী আর এ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ছিলেন ৯ হাজার ৪১ জন শিক্ষক। সে হিসেবে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকদের ৮৪ শতাংশেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ডিগ্রি নেই। অভিন্ন চিত্র দেখা যায় গণিতের ক্ষেত্রেও। ব্যানবেইসের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছর দেশের সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় গণিতের শিক্ষক ছিলেন সর্বমোট ৬৭ হাজার ৯৫৫ জন। এর মধ্যে মাত্র ৫ হাজার ৮৪৩ জন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক ও ৭ হাজার ২৮৫ জন শিক্ষক গণিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। সে হিসাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়টিতে ডিগ্রি রয়েছে কেবল ১৯ শতাংশ শিক্ষকের। বাকি ৮১ শতাংশই অন্য বিষয়ে ডিগ্রিধারী।
বিষয়ভিত্তিক ডিগ্রিধারী শিক্ষকের দিক থেকে বেসরকারির তুলনায় অবশ্য সরকারি বিদ্যালয়গুলোর চিত্র ভালো। সরকারি বিদ্যালয়ে ৪ হাজার ৫০৬ জন ইংরেজি শিক্ষকের মধ্যে ১ হাজার ৪৬৩ জনেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ন্যূনতম স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে যা শতকরা ৩০.৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বিদ্যালয়ে ৯১ হাজার ৫৫২ ইংরেজি শিক্ষকের মধ্যে বিষয়ভিত্তিক ডিগ্রি রয়েছে ১৩ হাজার ৮১৯ জনের বা ১৫.০৯ শতাংশ। আর গণিত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে সরকারি বিদ্যালয়ে ৩ হাজার ৬০২ শিক্ষকের মধ্যে এক হাজার ২৫৪ জন বা ৩৪.৮১ ভাগের বিষয়ভিত্তিক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। বেসরকারির ক্ষেত্রে সেই হার ১৮.৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৬৪ হাজার ৩৫৩ শিক্ষকের মধ্যে গণিতের ডিগ্রি রয়েছে কেবল ১১ হাজার ৮৭৪ জনের। সরকারি স্কুলের ৪ হাজার ৫০৬ জন ইংরেজি শিক্ষকের মধ্যে ৬৯০ জনের স্নাতকে ইংরেজি ছিল আর ১৪৬ জন এইচএসসি পাস। আর বেসরকারি স্কুলের ৯১ হাজার ৫৫২ জন ইংরেজি শিক্ষকের মধ্যে ২০ হাজার ৬৫০ জনের স্নাতকে ইংরেজি ছিল না আর ৩ হাজার ৭১১ জন এইচএসসি পাস। ৬৭ হাজার ৯৫৫ জন গণিত শিক্ষকের মধ্যে ১৬ হাজার ২৫৬ জন বা ২৩.৯৩ শতাংশের স্নাতকে গণিত ছিল না। আর ১২.১৫ শতাংশ বা ৮ হাজার ২৫৮ জন এইচএসসিতে গণিত পড়েননি, কিন্তু গণিতে শিক্ষকতা করছেন। এদের মধ্যে ৩ হাজার ৬০২ জন গণিত শিক্ষকের মধ্যে ৭৪৫ জনের স্নাতক পর্যায়ে গণিত ছিল না, আর এইচএসসিতে গণিত ছিল না ২০২ জনের। বেসরকারি স্কুলের ৬৪ হাজার ৩৫৩ জন গণিত শিক্ষকের মধ্যে ১৫ হাজার ৫১১ জনের স্নাতক পর্যায়ে গণিত ছিল না, আর এইচএসসিতে গণিত ছিল না ৮ হাজার ৫৬ জনের।
শিক্ষকদের যোগ্যতাগত ঘাটতির প্রভাব স্বভাবতই শিক্ষার্থীদের শিখনফলে পড়ার কথা এবং পড়ছেও। সরকারের বিভিন্ন গবেষণায়ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে দক্ষতাগত দুর্বলতার চিত্র উঠে এসেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের তদারক ও মূল্যায়ন বিভাগ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের দক্ষতাবিষয়ক একটি গবেষণা পরিচালনা করে। ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অব সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস-২০১৯ শীর্ষক প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি মাউশি। তবে ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাধ্যমিকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এখনো ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে। এর মধ্যে ইংরেজিতে বেশি খারাপ। ষষ্ঠ শ্রেণির প্রায় ২৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর ইংরেজি অবস্থা খুবই খারাপ, ৩২ শতাংশ খারাপ বা গড়পড়তা স্তরে আছে। এ দুই স্তর মেলালে ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থীর অবস্থাই খারাপ বলা যায়। মোটামুটি ভালো স্তরে আছে ১৮ শতাংশের মতো। বাকি শিক্ষার্থীরা ভালো ও খুবই ভালো স্তরে আছে। অষ্টম শ্রেণিতে ইংরেজিতে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ব্যান্ড ২ ও ৩ স্তরে আছে। ২৮ শতাংশ মোটামুটি ভালো। এ শ্রেণিতে চার ভাগের প্রায় এক ভাগ খুবই ভালো করেছে। এ বিষয়ে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক ভালো। সাড়ে ১২ শতাংশ খারাপ স্তরে। বাকিরা মোটামুটি ভালো, ভালো ও খুবই ভালো।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, যেসব শিক্ষকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি নেই, তাদের দিয়ে পাঠদান করিয়ে কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত শিখনফল অর্জন সম্ভব নয়। তাদের মতে, শুধু গণিত কিংবা ইংরেজি নয়, বিজ্ঞানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ডিগ্রিধারীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া জরুরি। একটি গবেষণায় উঠে এসেছে যে, গণিতের গ্র্যাজুয়েট যারা তাদের শিক্ষার্থীরা গণিতে ভালো করেছে, যারা বিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট তাদের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানে ভালো করেছে। আর ম্যানেজমেন্ট পড়ে যারা গণিতে পড়াচ্ছেন তাদের শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জনের হার কম। প্রশিক্ষণের দিক দিয়েও বেশ পিছিয়ে রয়েছেন গণিত ও ইংরেজি শিক্ষকরা। ২০১৯ সালে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার নানাদিক নিয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযান। এর ফলাফলের ভিত্তিতে ‘সেকেন্ডারি স্কুল টিচারস ইন বাংলাদেশ : ইন দ্য লাইট অব এসডিজি ফোর’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। তাতে উঠে আসে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে নিয়োজিত ৫৫ শতাংশ শিক্ষকেরই বিষয়ভিত্তিক কোনো প্রশিক্ষণ নেই। শিক্ষকের মানের কথা বলতে গেলে সবার আগে যে বিষয়টি আসে সেটি হলো শিক্ষকের যোগ্যতা। কারণ দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক ছাড়া মানসম্মত শিক্ষা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনার বিষয়টি বেশ অবহেলিত। আর যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক না পাওয়ার অন্যতম কারণ আমরা এ পেশায় তাদের আকৃষ্ট করতে পারছি না। বিভিন্ন খাতে যত বড় উন্নয়নই হোক না কেন, শিক্ষাকে অবহেলায় রেখে তা কখনই টেকসই হবে না। তাই আমাদের শিক্ষায় বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে হলেও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় প্রয়োজন বলে কোনো কোনো শিক্ষাবিদ মন্তব্য করেছেন।
এরশাদ সরকার জনপ্রিয়তার জন্য ইংরেজি ছাড়া বিএ ও গণিত ছাড়া বিএসসি পড়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। তখন পাস করা শিক্ষার্থীদের একটা অংশ শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়ে গণিত ও ইংরেজি বিষয় পড়াচ্ছেন। আমাদের দেশের তখনকার শিক্ষাবিদরা কি বিষয়টিতে খুব একটা বাধা প্রদান করেছিলেন? করেননি। এরশাদ আর্মির লোক। আর্মিতে তো ইংরেজির গুরুত্ব থাকে সবক্ষেত্রেই, কিন্তু এখানে কী ঘটেছিল? তবে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এ সংকট কেটে যাবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ কারণ এসব শিক্ষক অবসরে চলে গেলে ও নতুন যোগ্যতা অনুসারে শিক্ষক নিয়োগ হলে এমনটি আর থাকবে না। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে উচ্চশিক্ষা সবক্ষেত্রেই ইংরেজিতে দক্ষতা জরুরি। আর বিশে^র সব শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয় গণিত শিক্ষাকে। আর এ দুটোতেই আমাদের শিক্ষার্থীরা দুর্বলতা নিতে ওপরের শ্রেণিতে উঠতে থাকে।
মাধ্যমিক পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকা একটি বাস্তবতা। একে স্বীকার করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। যারা গণিত, ইংরেজি কিংবা বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স কিংবা মাস্টার্স নিয়ে পড়াশুনা করেন তাদের মধ্যে বড় একটি অংশ শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কোনো পেশায় চলে যান বা যেতে চান, এটা স্বাভাবিক। শিক্ষকতা অর্থনৈতিকভাবে সব জায়গায় বা সবক্ষেত্রে আকর্ষণীয় নয়। তা ছাড়া এ পেশা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এবং বর্তমান যুগে খুব চাপেরও। প্রতিষ্ঠান যদি একটু নাম করা হয় তাহলে শিক্ষকদের খাটুনির অন্ত থাকে না। তাই, অনেক মেধাবী এ পেশায় আসতে চান না।
মাধ্যমিকে ভালোভাবে পড়ানোর জন্য শিক্ষকদের আলাদা প্রস্তুতি নিতে হয়। গণিতে তারা যেসব বিষয় গ্র্যাজুয়েশন লেভেলে পড়ে আসেন সেগুলো কিন্তু মাধ্যমিকে নেই। অন্য বিষয়ের শিক্ষক যদি ডেডিকেটেড হন তাহলে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে কিন্তু শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাদান আনন্দময় করতে পারেন। গণিতে অনার্স পড়–য়ারাই যে গণিত করাতে পারবেন তা নয়। যারা অর্থনীতি কিংবা অ্যাকাউন্টিং কিংবা ম্যানেজমেন্ট পড়ে আসেন তারাও কিন্তু পারবেন। একইভাবে, ইতিহাস, অর্থনীতিসহ অন্যান্য বিষয়ে যারা অনার্স পড়েন তারা যদি চর্চা করেন, প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তাহলে ইংরেজি পড়াতে পারেন। আমাদের বাস্তবতায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করার বিকল্প নেই।
লেখক: প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)
কবি, ভাষাসংগ্রামী ও ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতার রচয়িতা মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জন্ম চট্টগ্রামের রাউজানে ৭ নভেম্বর ১৯২৭ সালে। তার বাবার নাম আহমাদুর রহমান চৌধুরী এবং মা রওশন আরা চৌধুরী। ১৯৪৭ সালে গহিরা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি ডিসটিংশনসহ এন্ট্রান্স পাস করেন। চট্টগ্রাম কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালে রাজনৈতিক কারণে তিনি কলেজ ত্যাগ করেন। ১৯৪৫ সালে বিভাগ-পূর্ব ভারতে ‘ছাত্র ফেডারেশন’ নামে ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যোগ দেন এবং এ বছরই ‘দ্য বেঙ্গল রিজিওনাল স্টুডেন্ট কনফারেন্স’ অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতার প্রতিনিধি হিসেবে এ অনুষ্ঠানে যোগ দেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, ভবানী সেন ও সুকান্ত ভট্টাচার্য। এতে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আন্দোলনকারী ভাষাসংগ্রামীদের ওপর পুলিশের গুলি এবং ছাত্র নিহত হওয়ার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদস্বরূপ তিনি ‘একুশে’ শিরোনামে রচনা করেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’, যা ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতা হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৫০ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পাকিস্তানের সংবিধানভুক্ত না করার প্রতিবাদে তিনি পাকিস্তান সরকারের রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদসভার আয়োজন করেন। চট্টগ্রামে পূর্ব পাকিস্তানের বিশ্বশান্তি পরিষদের কমিটি গঠন করা হলে তিনি এ পরিষদের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত যুক্তফ্রন্টের চট্টগ্রাম শাখা কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে কাজ করেছেন। একুশে পদকসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন এই ভাষাসংগ্রামী।
বেলজিয়ামের নতুন অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে সম্মানতি বোধ করছেন ম্যানচেস্টার সিটি তারকা কেভিন ডি ব্রুইনা।
গত বছর বিশ্বকাপের পর রিয়াল মাদ্রিদ তারকা এডেন হ্যাজার্ড জাতীয় দলকে বিদায় জানান। বেলজিয়াম কোচ ডোমেনিকো টেডেসকো প্লেমেকার ডি ব্রুইনাকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন। বিশ্বকাপের পর বেলজিয়ামের কোচের পদে রবার্তো মার্টিনেজের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন টেডেসকো।
গত জানুয়ারিতে ৩২ বছরে পা রেখেছেন ব্রুইনা। আরটিএল-টিভিআই টেলিভিশনে বেলজিয়ামের নেতৃত্ব পাওয়া নিয়ে ডি ব্রুইনা বলেছেন, ‘এভাবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারা সত্যিই সম্মানের। আমার বয়স প্রায় ৩২ হয়ে গেছে। আমি কখনই আন্তর্জাতিক অবসরের চিন্তা করিনি। আমি বিশ্বাস করি এখনো দলকে কিছু দেবার সক্ষমতা আমার আছে। এই সুযোগে তরুণদেরও সহযোগিতা করতে চাই।’
সুইডেনের বিরুদ্ধে শুক্রবার ইউরো বাছাইপর্বে অধিনায়ক হিসেবে ডি ব্রুইনার অভিষেক হতে যাচ্ছে। মাদ্রিদ গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া ও চেলসি রোমেলু লুকাকু ডি ব্রুইনার সহ-অধিনায়ক হিসেবে কাজ করবেন।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
কোনো জেলায় কেউ গৃহহীন ও ভূমিহীন রয়েছে কি না তা জানতে তালিকা তৈরি করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রত্যেক ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা আমার সরকারের লক্ষ্য হওয়ায় আমি প্রত্যেককে বাড়ি দেব। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা চাই প্রতিটি মানুষ বাড়ি, আশ্রয় এবং জীবিকার সুযোগ পাবে। তারা আর সমাজের বোঝা হয়ে থাকবে না। আমরা চাই প্রত্যেকে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এবং যথাযথ সম্মানের সঙ্গে বসবাস করবে।’
গতকাল প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের চতুর্থ ধাপে বাড়ি হস্তান্তরের সময় এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি সাতটি জেলা ও ১৫৯টি উপজেলাকে গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। জেলাগুলো হলো মাদারীপুর, গাজীপুর, নরসিংদী, জয়পুরহাট, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গা।
এর আগে তিনি পঞ্চগড় ও মাগুরার সব উপজেলাসহ ৫২টি উপজেলাকে গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। তিনি গতকাল ৯টি জেলা এবং ২১১টি উপজেলা গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। খবর বাসসের।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভূমিহীনদের ঘর দেওয়ার সবচেয়ে বড় অর্জন হলো দুস্থ মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। জাতির পিতা দেশকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত করে বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে একটি উন্নত ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন দিতে চেয়েছিলেন। যার জন্য তার সরকার অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশে কেউ গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না বলে তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে গৃহহীনদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করেন। বঙ্গবন্ধুর পদচিহ্ন অনুসরণ করে তিনি বলেন, তার সরকার ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের বাড়িঘর ও জমির মালিকানা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোহাম্মদ তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া। অনুষ্ঠানে বাড়িপ্রাপ্তদের পরিবর্তিত জীবনযাত্রার ওপর একটি ভিডিও-প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
সরকার প্রধান বলেন, ‘কেউ ঠিকানা ছাড়া থাকবে না। আমরা তাদের শুধু ঘরই দিইনি, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থাও করে দিয়েছি। তাদের জীবিকার জন্য ঋণও দিয়েছি। তারা এখন দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।’ তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা ঘোষণা করেছিলেন, একজন ব্যক্তি ১০০ বিঘা জমির অধিকারী হতে পারবে এবং এর অতিরিক্ত পরিমাণ জমি কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র গড়তে রোডম্যাপ জরুরি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভৌগোলিক-কৌশলগত সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। গতকাল ঢাকায় প্রথম অ্যাভিয়েশন সামিটের উদ্বোধন অধিবেশনে দেওয়া এক ভিডিও ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সহযোগিতায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশ অ্যাভিয়েশন সামিট-২০২৩’-এর আয়োজন করে।
প্রধানমন্ত্রী এই শীর্ষ সম্মেলনকে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। কারণ, দেশটির এই অঞ্চলে একটি বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হওয়ার আকাক্সক্ষা রয়েছে।
বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে শেখ হাসিনা যাত্রী ও মালামাল উভয়ের জন্যই একটি উন্নত ও টেকসই বাজার সৃষ্টির পাশাপাশি সহায়ক পরিবেশ তৈরির জন্য সরকারি সংস্থা, এয়ারলাইনস ও সংশ্লিষ্ট অন্য সব পক্ষকে যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘সরকার ই-ভিসা সিস্টেম চালু করতে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশে ব্যবসা করতে ও পর্যটনে আসা যাত্রীদের সুবিধা দেবে ও ভিসা প্রক্রিয়া দ্রুত হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের যুবকদের অবশ্যই পাইলট, বিমান প্রকৌশলী, মেকানিক, ক্রু ও আরও অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ থাকতে হবে।’ তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, তার সরকারের প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি দেশের বিমানশিল্পে লোকবলের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, এই বিমানশিল্প এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে নেতৃত্ব দিতে হবে।
সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এম মাহবুব আলী ও ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী বক্তব্য দেন।
রাজধানীর মালিবাগ রেলগেটে ট্রেনের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষের ঘটনায় ২ ঘণ্টা পর চালু হয়েছে রেল যোগাযোগ।
ইঞ্জিন পরীক্ষার পর পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি রাত ১১টার দিকে ছেড়ে যায়। এতে সড়কের ২ পাশের যান চলাচলও স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে।
বুধবার রাত ৯টার পর মালিবাগ লেভেল ক্রসিংয়ে পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি সোহাগ পরিবহনের একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসে ধাক্কা দেয়। এতে বাসের সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এ ঘটনায় তিন জন আহত হন। দুর্ঘটনার সময় বাসটিতে কোনো যাত্রী ছিল না। ট্রেনের গতিও কম ছিল।
মাদারীপুরের শিবচরে সড়ক দুর্ঘটনার কামরুজ্জামান ফকির (৩৫) নামে এক পল্লি চিকিৎসক নিহত হয়েছেন। এ সময় জাহিদ (২৮) নামে আরেকজন আহত হন। আজ বৃহস্পতিবার ভোর ৬টার দিকে উপজেলার শেখপুর বাজারসংলগ্ন মির্জারচর এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত কামরুজ্জামান মাদারীপুর সদর উপজেলার আদিত্যপুর গ্রামের আবদুর রব ফকিরের ছেলে।
হাসপাতালে, ফায়ার সার্ভিস ও নিহতের আত্মীয় সূত্রে জানা যায়, ভোরে কামরুজ্জামান তার আপন ভায়রা জাহিদকে নিয়ে তাবলিগ জামাতে অংশ নিতে গাজীপুরের টঙ্গী যাওয়ার উদ্দেশে শিবচরের পাঁচ্চর বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা হন। পাঁচ্চর থেকে বাসযোগে টঙ্গী যাওয়ার কথা ছিল তার। এ সময় তার মোটরসাইকেলটি শিবচর-মাদারীপুর আঞ্চলিক সড়কে শিবচরের শেখপুর মির্জারচর নামক স্থানে আসলে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মোটরসাইকেল থাকা দুজন গুরুতর আহত হন। পরে স্থানীয়রা কামরুজ্জামানকে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। আহত জাহিদকে উদ্ধার করে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়।
শিবচর ফায়ার সার্ভিসের লিডার তরুনুর রশিদ খান বলেন, ভোরে আমরা খবর পেয় ঘটনাস্থলে যাই। সেখান থেকে আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসি। পরে ডাক্তার তাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন।
শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, সকালে রোগীকে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন উদ্ধার করে এখানে নিয়ে আসে। পরে আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পাই হাসপাতালে আসার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।