
আবুল কাসেম ফজলুল হক বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত গবেষক, ঐতিহাসিক, অনুবাদক, সমাজবিশ্লেষক, সাহিত্য সমালোচক ও চিন্তাবিদ। তিনি তার রাজনৈতিক চিন্তা ও তত্ত্বের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। তিনি দেশের রাজনীতির উন্নতির জন্য চিন্তা ও কাজ করেন, লেখেন এবং মত প্রকাশ করেন। সম্প্রতি ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে’ বিএনপি ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছে। বিষয়টি নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী।
দেশ রূপান্তর : অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের সংবিধানসহ রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার দরকার বলে অনেকেই বলে আসছেন। যারা ঘুরেফিরে ক্ষমতায় আছেন তারাও নানা সময়ে এসব বলে এসেছেন। দেখা গেছে মেনিফেস্টোতে যে কথা থাকে, ক্ষমতায় গিয়ে তারা সেটা ভুলে যান। এরশাদ পতনের আন্দোলনে ‘তিন জোটের রূপরেখা’র কথা সবাই ভুলে গিয়েছে। বিএনপি ‘রূপকল্প ২০৩০’ দিয়েছিল। অন্যদিকে, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’, ‘রূপকল্প ২০২১’ নামে যে নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল তা সময়ের একটি রাজনৈতিক রূপরেখা হয়ে ওঠে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে’ বিএনপির ২৭ দফা রূপরেখাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজন নানাভাবে ব্যক্ত হচ্ছে। যেসব দল ক্ষমতায় ছিল এবং আছে, তাদের থেকেও সংবিধানের সংস্কারের কথা বলা হয়। গত অর্ধশতাব্দীতে সংবিধানের সতেরোটি সংশোধন হয়েছে। রাজনীতির উন্নতি হচ্ছে না। জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ অল্পই করা হয়। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামপন্থি দলগুলো আন্দোলন করেছে নিতান্তই ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে। শেষে অবস্থার চাপে তিন জোটের রূপরেখা প্রণীত হয়। এই রূপরেখা বাস্তবায়নের জন্য কোনো দলেরই কোনো প্রস্তুতি ছিল না। আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যবাহী দল, শক্তিশালী। বিএনপি সে তুলনায় শক্তিশালী নয়। একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে আন্দোলনকারী সব দলই রাজনৈতিক কর্মসূচি ও উদ্দেশ্য ঘোষণা না করে কেবল সরকার উৎখাতের ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। ব্যাপারটিকে বলা হয়েছে বিরাজনীতিকরণ বা নিঃরাজনীতিকরণ। রাজনৈতিক দলগুলোর এই রাজনীতি-শূন্যতার মধ্যে বিএনপি ঘোষিত ২৭ দফা কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। যেভাবে বক্তব্যটি উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। সংশোধন ও পরিমার্জন করে পুস্তিকা আকারে সারা দেশে এটি প্রচার করলে বাংলাদেশের গোটা রাজনীতির গতিপ্রকৃতি পরিবর্তিত হবে। নেতৃত্বের প্রশ্ন আছে। বিএনপিতে ২৭ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্দোলন চালানোর মতো নেতৃত্ব নেই।
দেশ রূপান্তর : এই রূপরেখা তারা ক্ষমতায় এলে বাস্তবায়ন করবে বা করতে পারবে বলে কি মনে করেন? অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের ওপর কি সে আস্থা রাখা যায়?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জনের এবং ২৭ দফা বাস্তবায়নের মতো নেতৃত্ব বিএনপিতে নেই। উত্তরাধিকারভিত্তিক ও পরিবারতান্ত্রিক নেতৃত্ব দিয়ে সুফল হবে না। সুবিধাবাদী ভোগবাদী নেতৃত্ব বাঞ্ছনীয় নয়। জনগণ রাজনীতিবিমুখ, ঘুমন্ত। গণজাগরণ দরকার। গণজাগরণ কী? গণজাগরণের উপায় কী? এসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে হবে। জাতীয় সংসদের আগামী নির্বাচন যত ভালোভাবেই সম্পন্ন হোক, তা দ্বারা রাজনীতির উন্নতিশীলতা সূচিত হবে না। কেবল নির্বাচন নিয়ে এত আশা কেন?
দেশ রূপান্তর : বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান যে ১৯ দফা দিয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে বিএনপি সেখান থেকে সরে এসেছিল। এবারের ২৭ দফা রূপরেখা দেওয়ার মধ্যে কি তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনের বার্তা দেখতে পান।
আবুল কাসেম ফজলুল হক : দেখা যাক, কোন দল কী করে। প্রত্যেক দলেরই রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তিত হয়। উত্থান-পতন আছে। রাজনৈতিক দলগুলো ভালোর দিকে অগ্রসর হোক এটাই কাম্য। শ্রমিক, কৃষক, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ঘুমিয়ে থাকলে সুফল হবে না। ঘুমন্ত জনসাধারণকে জাগাতে হবে।
দেশ রূপান্তর : বিএনপি একদিকে বলছে আওয়ামী লীগ সরকার কর্র্তৃক গৃহীত সব অযৌক্তিক, বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী সংশোধন বা রহিত করবে। অন্যদিকে বলছে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে অন্তর্ভুক্তিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করবে। এর আগে বিএনপি-আওয়ামী লীগ কেউই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, সামনে কী হবে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : হিংসা-প্রতিহিংসা চলছে। খুন-খারাপি চলছে। এ থেকে মুক্তি দরকার। বিবেক ও যুক্তির প্রাধান্য চাই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিবেক ও যুক্তি প্রাধান্য পেলে ক্রমে সব কিছু ভালোর দিকে চলবে। রাজনৈতিক দলকে গুরুত্ব দিতে হবে। দল গঠন নিয়ে চিন্তা ও কাজ করা দরকার। দল উন্নত চরিত্রের না হলে সরকার ভালো হবে কী করে? চিন্তা ও চেষ্টা ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজনীতির চরিত্র উন্নত হবে না।
দেশ রূপান্তর : প্রতি পাঁচ বছর পর পর ‘একটি নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারই কি একমাত্র সমাধান?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ বা রাজনীতি নিরপেক্ষ, বা অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধাযক সরকার দিয়ে সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি, হচ্ছে না, হবে না। দেশের রাজনীতিকে, রাজনৈতিক দলগুলোকে এত নিকৃষ্ট অবস্থায় রেখে, জনমননকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে, জাতীয় রাজনীতির সমস্যার সমাধান হতে পারে না। উন্নত রাজনৈতিক চরিত্র অর্জনে নিরন্তন প্রয়াসপর রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাই, উৎকৃষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি চাই, সর্বোপরি চাই উন্নতিশীল জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের রাজনীতি বিষয়ে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা চাই। এসবের কোনোটাই রাতারাতি অর্জন করা যাবে না। রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার প্রত্যেক জাতি ও জনজীবনের জন্য। রাজনীতিবিদদের ও সাধারণ মানুষের উন্নতির জন্য রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ব্যাপার। ‘আটাশ দফা : আমাদের মুক্তি ও উন্নতির কর্মসূচি’ নামে আমার একটি লেখা আছে। তাতে আমি বাংলাদেশে আমাদের সংকটের স্বরূপ এবং মুক্তি ও উন্নতির উপায় সম্পর্কে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছি।
দেশ রূপান্তর : মোটা দাগে আপনার প্রস্তাব আমাদের সংকট ও রাষ্ট্র নিয়ে কী বলছে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : আমি মনে করি, ওই প্রস্তাবে যে পথ নির্দেশিত হয়েছে, কেবলমাত্র সেই পথে অগ্রসর হয়েই সমস্যার সমাধান হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সর্বজনীন কল্যাণে চিন্তা ও কাজ করতে হবে, দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মেয়াদি সরকার গঠন করে এগোতে হবে, রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পুনর্গঠন লাগবে। গোটা পৃথিবীর সব নেশনের বা জাতির রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পুনর্গঠন দরকার। জাতিসংঘ দিয়ে কাজ অল্পই হচ্ছে। এই জাতিসংঘকে সংস্কার করে বিশ্বব্যবস্থার আমূল পুনর্গঠন করতে হবে। সব রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করে, পুনর্গঠিত নতুন রাষ্ট্রসংঘের পরিচালনায় একটিমাত্র সেনাবাহিনী রাখতে হবে। মানব প্রজাতি চাইলে, চেষ্টা করলে পৃথিবীকে স্বর্গরাজ্যে পরিণত করতে পারবে। মানুষের অন্তরে আশা ও সাহস চাই। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানুষকেই গড়ে তুলতে হবে অভিপ্রেত নেতৃত্ব। মানুষের শক্তি ও সম্ভাবনা বিকাশমান। শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। ঞৎঁঃয ংযধষষ ঢ়ৎবাধরষ. মিথ্যাকে পরাজিত অবস্থায় রাখতে হবে, বিলুপ্ত করা যাবে কীভাবে।
দেশ রূপান্তর : ‘পরপর দুইবারের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না’। বিএনপি কি তাহলে খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়েই চিন্তা করছে? এটা কি রাজনীতিতে একটা পালাবদলের ইঙ্গিত?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : বাংলাদেশে চলছে বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার-ভিত্তিক নেতৃত্ব ও পরিবারতন্ত্র। গণতন্ত্রকে পর্যবসিত করা হয়েছে নির্বাচনতন্ত্রে। বাংলাদেশ নির্বাচনের মাধ্যেমে সরকার গঠনের যোগ্যতাও অর্জন করেনি। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিকে পর্যবসিত করেছে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসমুখী ও ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্ক-অভিমুখী। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ কী করবে, কী করতে পারবে, জনসাধারণের দিক থেকে তার বিচার করে দেখা দরকার। আমার মনে হয় গতানুগতিক ধারার রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্মের দ্বারা সমাধান হবে না, সংকটের সমাধানের জন্য নতুন ধারার চিন্তা ও কাজ লাগবে। আমি আটাশ দফা কর্মসূচিতে যে পথনির্দেশ করেছি একমাত্র সেই প্রশ্ন ধরে চিন্তা ও কাজ করতে হবে। আমার মতে আমাদের রাজনীতির ও সার্বিক উন্নতির পথ সেটাই। বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কী সেটাও বিচার করে দেখা দরকার। যারা আগে ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে আত্মপরিচয় দিতেন, তারা এখন ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ বলে আত্মপরিচয় দেন। কেন এই পরিবর্তন?
দেশ রূপান্তর : ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে’ বিএনপি ২৭ দফা রূপরেখা নিয়ে আপনার অন্য পর্যবেক্ষণগুলো কী?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : দেশে যে রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে তাতে বিএনপি যদি তার ২৭ দফা কর্মসূচির কিছুটা পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে পুস্তিকা আকারে দেশব্যাপী প্রচার করে, তাহলে তার ফল বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এবং জনগণের জন্য কল্যাণকর হবে। সব দলের নেতাকর্মীদের এবং বুদ্ধিজীবীদের থেকেই উন্নতিশীল রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্ম আশা করি। জনচরিত্রকেও উন্নত করতে হবে। জনসাধারণকে বিচারকের ভূমিকায় রাখতে হবে। চিন্তা ও কর্মের নবউত্থান চাই।
দেশ রূপান্তর : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আবুল কাসেম ফজলুল হক : আপনাকে ও দেশ রূপান্তরকেও অনেক ধন্যবাদ।
নির্বাচনের ঢেউ আপাতত শেষ। কাজেই আমরা এখন হয়তো ‘পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীর দখল করে নিতে ভারত প্রস্তুত’এ ধরনের বাগাড়ম্বর কম শুনব। তবে পরবর্তী দফা ভোটের জন্য অপেক্ষা করুন। সেই বুলি আবারও ফিরে এলো বলে! এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, নয়াদিল্লি গোটা জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অংশ করবে বলে সংকল্প নিয়েছে। তা সে পাক-অধিকৃত কাশ্মীর বা চীন নিয়ন্ত্রিত আকসাই চীন যেটাই হোক। তবে পাক-অধিকৃত কাশ্মীর দখলের চেষ্টার কী পরিণতি হতে পারে তা বোঝার জন্য আরও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের প্রয়োজন।
ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষে গৃহীত ১৯৯৪ সালের একটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সমগ্র জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভারতের সরকারি মানচিত্রেও দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে পুরো কাশ্মীর অঞ্চলকে দেখানো হয়। তবে কাগজে যাই হোক, বাস্তবে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। ভূখণ্ডগুলো চীন এবং পাকিস্তানের দখলে রয়েছে। তাই অতি উত্তেজনা বাদ দিয়ে নাগরিকদের প্রকৃত পরিস্থিতি জানানোর এটাই সময়। সোজাসাপ্টা ভাষায় বলতে গেলে, ভারত এইরকম পরিস্থিতিতে চীন এবং পাকিস্তানের একজোট হওয়ার হুমকির মুখে পড়বে। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতের পদক্ষেপ চীনের হস্তক্ষেপ ডেকে আনতে পারে। সেখানে চীনের ব্যাপক অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ অঞ্চলটির কিছু অংশকে প্রায় চীনা উপনিবেশে পরিণত করেছে। ‘এটা যুদ্ধের যুগ নয়’ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি আরও তাৎপর্যপূর্ণ। পাকিস্তান ১৯৬৩ সালে ভারতের দখলে নেওয়া শাক্সগাম উপত্যকা (সিয়াচেন হিমবাহের উত্তরে অবস্থিত) ছেড়ে দেয়। এটি পাকিস্তান ও চীনের কারাকোরাম হাইওয়ের পথ প্রশস্ত করে। সিয়াচেন হিমবাহের পশ্চিমে অবস্থিত গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চল বা পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণাধীন উত্তরাঞ্চল। আর ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের পশ্চিমে অবস্থান পাকিস্তানের ‘আজাদ কাশ্মীর’-এর।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখানে চীনের অনেক স্বার্থ জড়িয়ে। কারণ দেশটি চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরকে (সিপিইসি) সম্প্রসারিত করতে চায় যা অধিকৃত কাশ্মীরের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে যাবে। ‘সিপিইসি’ হচ্ছে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক প্রকল্প। এর মধ্যে আছে তিন হাজার কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত অঞ্চলে সড়ক, রেলপথ এবং পাইপলাইনের এক বিশাল নেটওয়ার্ক। এটি চীন ও পাকিস্তানসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের মধ্যে বাণিজ্যকে সহজতর করবে।
‘সিপিইসি’ প্রকল্পের লক্ষ্য পাকিস্তানের অবকাঠামো উন্নত করা এবং চীনের শিনজিয়াং প্রদেশকে পাকিস্তানের গোয়াদার ও করাচির মতো বন্দরের সঙ্গে যুক্ত করা, যা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যকে এগিয়ে নেবে। ‘সিপিইসি’ প্রকল্পকে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয় যে, এর কাজে পাহারা দেওয়ায় নিয়োজিত রয়েছে অনেক চীনা সেনা। বিভিন্ন সময় এরকম ছবি উঠে এসেছে প্রচার মাধ্যমে।
চীনের শিনজিয়াংয়ের সঙ্গে ভারতের লাদাখের সীমানা রয়েছে। অন্যদিকে চীন-পাকিস্তান অর্থনেতিক করিডর অগ্রসর হয়েছে পাকিস্তান অভিমুখী কৌশলগত কারাকোরাম পর্বতমালার মধ্য দিয়ে। ১৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ কারাকোরাম মহাসড়ক কারাকোরাম পর্বতের ভেতর দিয়ে চীন এবং পাকিস্তানকে সংযুক্ত করেছে। এটি গোটা বিশ্বের মধ্যেই ভূপৃষ্ঠের সর্বোচ্চ স্থানে নির্মিত আন্তর্জাতিক পাকা সড়ক। কারাকোরাম পাসের অবস্থান লাদাখের উত্তরে। গিরিপথটি ভারত ও চীন উভয়ের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এটি ভারতের লাদাখ অঞ্চল এবং চীনের শিনজিয়াং অঞ্চলের সীমানার মধ্যে পড়ে। ভারতীয় নিয়ন্ত্রণাধীন গুরুত্বপূর্ণ সিয়াচেন হিমবাহ পড়েছে কারাকোরাম পর্বতমালার পূর্বাঞ্চলে। চীনের শিনজিয়াং সীমান্তবর্তী অন্য দেশগুলো হচ্ছে আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান, রাশিয়া এবং মঙ্গোলিয়া। চীন-পাকিস্তান অর্থনেতিক করিডরের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল আজ থেকে সাত বছরের মতো আগে। ২০১৫ সালের ২০ এপ্রিল পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং সেদিন এ সংক্রান্ত ৫১টি চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছিলেন। এগুলোর আর্থিক মূল্য ছিল ৪ হাজার ৬শ কোটি ডলার। চীন তখন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্প সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছিল। ‘বিআরআই’ চীন-পাকিস্তান অর্থনেতিক করিডরের প্রধান প্রকল্প। আগের ‘ওবিওআর’ (ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড) এর নতুন নাম ‘বিআরআই’। এ সংক্রান্ত ‘করিডর’গুলোর আওতায় ৬৫টির বেশি দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ চলছে। অর্থনৈতিক করিডর কর্র্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট অনুসারে, এসব অঞ্চলে বসবাস বিশ্বের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের। আর এ অঞ্চল থেকে আসে বৈশ্বিক জিডিপির ৪০ শতাংশ।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার এবং তালেবানের আবার ক্ষমতা দখল চীনকে কাবুল পর্যন্ত ‘সিপিইসি’ সম্প্রসারিত করার দীর্ঘলালিত স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্মরণ করা যায়, ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান আরকেএস ভাদাউরিয়া ২০২০ সালে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় বলেছিলেন, পাকিস্তান চীনা নীতিতে একটি দাবার ঘুঁটি হয়ে উঠছে। মার্কিন বাহিনীর তড়িঘড়ি প্রস্থানের পরে চীনারা আফগানিস্তানে প্রবেশের জন্য পাকিস্তানকে ব্যবহার করতে পারে।
আরকেএস ভাদাউরিয়া বলেন, ‘আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান চীনের জন্য এই অঞ্চলে নানা ধরনের ভূমিকা রাখার পথ করে দিয়েছে। সরাসরি এবং পাকিস্তানের মাধ্যমে উভয় পথেই। এটি চীনকে মধ্য এশিয়া অঞ্চলে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। দীর্ঘকাল ধরেই অঞ্চলটি নজরে রয়েছে তাদের।’ আফগানিস্তানের ঘটনাপ্রবাহের বিষয়ে চীনের প্রতিক্রিয়া ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ভারত। বিভিন্ন সূত্র বলছে, বেইজিং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে তার প্রভাব বাড়ানোর জন্য পাকিস্তানকে কাজে লাগানোর সুযোগ খুঁজছে। আর ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পর্যালোচনা অনুসারে, আফগানিস্তান পর্যন্ত চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের সম্প্রসারণ হিসেবে পেইচিং আবারও পেশোয়ার-কাবুল মহাসড়ক নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে।
পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে চীনের এ ধরনের শক্তপোক্ত উপস্থিতি থাকলে তারা যে এই অঞ্চলে ভারতের কোনো সামরিক অভিযান হাত গুটিয়ে বসে বসে দেখবে না তা চোখ বুজেই বলে দেওয়া যায়। পূর্ব লাদাখে চীনা আগ্রাসন অন্যকিছুর পাশাপাশি ভারতকে কারাকোরাম মহাসড়কে প্রভাব বিস্তারের কোনো সুযোগ না দেওয়ার পরিকল্পনারই অংশ। ২০২০ সালের মে মাস থেকে পূর্ব লাদাখের ঘটনাপ্রবাহ চীনা অভিপ্রায়ের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত। আর এটি নিশ্চয়ই আকসাই চীনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
লেখক : ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপের প্রকাশনা
‘মেইল টুডে’-এর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। ইন্ডিয়া টুডে অনলাইন থেকে ভাষান্তর: আবু ইউসুফ
ক্ষমতার বাইরে থাকলে বিদেশিদের কাছে নালিশ করা, ক্ষমতাসীনদের নানা অপকর্মের বয়ান তুলে ধরা, মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়া ইত্যাদি আমাদের রাজনীতির সাধারণ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা আমাদের দেশের বিরোধী দলের কাছে বিশেষ মর্যাদা পান। বিরোধী দল তাদের ত্রাতা মনে করে। বিরোধী দলের এই মনোভাবের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিবিদদের অকাতরে নাক গলাতে দেখা যায়। বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিবিদরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে চলেছেন অনেক দিন ধরে। ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনের সময় কূটনীতিকদের প্রকাশ্যে ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। পরে নির্বাচনকেন্দ্রিক সমঝোতার নামে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা বিভিন্ন সময়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে। কখনো কখনো তারা আমাদের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের মাধ্যম হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন।
কূটনীতিকদের অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ শিষ্টাচারবহির্ভূত একটি কাজ। তবে শিষ্টাচারবহির্ভূত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কূটনীতিকরা যেমন একদিকে দায়ী, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহাবস্থান না থাকাও সমানভাবে দায়ী। সরকারের বাইরে থাকা দলগুলোর জনসমর্থনে ঘাটতি থাকে বিধায় নির্বাচন এলেই তারা মনে করে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে পারবে না। ফলে বিদেশি বিভিন্ন শক্তির ওপর নির্ভরতা তাদের বেড়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের কাছে সাহায্য প্রত্যাশা করে নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার জন্য।
গত ১৩ বছর আওয়ামী লীগ সরকারে থাকার ফলে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিরোধী দলগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, লম্বা সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপি নেতাকর্মী-সমর্থকদের মধ্যে দলের প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় দলের নেতাদের মধ্যেও এক ধরনের বিভক্তি দেখা দিয়েছে। এছাড়া দলে রয়েছে নেতৃত্বের সংকট। দলে একটি গোষ্ঠী রয়েছে যারা বিএনপি চেয়ারপারসনের অনুরক্ত। অন্যদিকে দলের মধ্যে একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী রয়েছে যারা বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে পরিচালিত হয়। এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এক ধরনের নেতৃত্বের সংকট রয়েছে। যেহেতু ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, অতএব এই নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছে।
কূটনীতিকদের প্রতি আমাদের দেশের রাজনীতির মানুষগুলোর রয়েছে এক আশ্চর্য নতজানু মানসিকতা। বিদেশি কূটনীতিকদের দেখলে তাদের উচ্ছ্বাস-আগ্রহ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কোনো কিছু হলেই এইসব বিদেশিদের ডেকে নালিশ করা হয়। নালিশ যাদের কাছে করার কথা, জনগণের কাছে, দেশের ভোটারের কাছে, সেটা তারা বড় বেশি করেন না। তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে অভিযোগ জানাতে। যা কোনোভাবেই উচিত নয়। এ ব্যাপারে আমাদের সাংবাদিকদের দায়ও কম নয়। বিদেশি কূটনীতিকদের দেখলেই সাংবাদিকরাও কেমন বিগলিত হয়ে ওঠেন। তাদের মুখ থেকে কিছু একটা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। ‘বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন কেমন হবে বলে আপনি মনে করেন?’ ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ কি আছে?’ ‘বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যে মামলা ধরপাকড়ের পরও কি আপনি মনে করেন যে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ আছে?’ ‘আপনি কি মনে করেন সরকার ঠিক কাজ করছে?’ ‘আপনি কি মনে করেন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে ঢোকানো ঠিক হয়েছে?’ ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী?’
কোনো বিদেশি কূটনীতিককে দেখলেই আমাদের দেশের সাংবাদিকরা এ ধরনের প্রশ্ন নিয়ে হামলে পড়েন। যেন ওই বিদেশি ভদ্রলোক বললেই সেটা খাঁটি হয়ে যাবে, তা না হলে ওটা মিথ্যে! আমাদের দেশের সাংবাদিকতা পেশার এটা একটা বড় দুর্বলতা। কাকে সম্মান দিতে হবে, কাকে, কী জিজ্ঞেস করতে হবে, কীভাবে মোক্ষম প্রশ্নটা করে উত্তর বের করে আনতে হবে সেটা অনেকেই জানেন না। তাদের সে বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণও নেই। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো বিকারও নেই। পৃথিবীর আর কোনো দেশে বিদেশি কূটনীতিকরা সাংবাদিকদের কাছে এত পাত্তা পান না। নিজেদের দেশের রাজনীতি নিয়ে তাদের মতামত কেউ কখনো জানতে চেয়েছেন বলে শুনিনি। আমাদের রাজনীতিবিদরাই এজন্য প্রধানত দায়ী। তারাই বিদেশি কূটনীতিকদের রাজনীতি নিয়ে, অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে নাক গলানোর সুযোগ করে দিয়েছেন। কিছুদিন পরপরই তাদের ডেকে এনে ব্রিফিং দেন। প্রতিপক্ষ সম্পর্কে নালিশ করেন। প্রতিকার চান। এমনকি হস্তক্ষেপেরও অনুরোধ জানান।
আমাদের দেশে নির্বাচন এলে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা নিজেরা যেমন তৎপর হয়ে ওঠেন, তেমনি আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের সক্রিয় করে তোলে। আসলে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগেই কূটনীতিকরা তাদের তৎপরতা বৃদ্ধির সুযোগ পাচ্ছেন। বিদেশি কূটনীতিকরা যখন হাই-প্রোফাইল পলিটিশিয়ানদের সঙ্গে দেখা করেন তখন তারা কী কথা বলেন তা বিস্তারিত জানা যায় না। যে দুই পক্ষ দেখা করেন এবং কথা বলেন তারাও সেই বৈঠকের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেন না। এসব সাক্ষাৎকারের যে তথ্য বিবরণী প্রকাশ করা হয় সেটি গৎবাঁধা। বলা হয় যে, তারা পরস্পরের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে তাদের মতামত প্রদানের কোনো অধিকার নেই।
কিন্তু গত শতকের নব্বই দশক থেকে দেখা যাচ্ছে যে, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন বিদেশি কূটনীতিকরা, বিশেষ করে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা, আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলিয়েই চলেছেন। এ ব্যাপারে বড় দুই দলের ভূমিকা বেশ চমকপ্রদ। বিদেশি কূটনীতিকদের দৌড়াদৌড়ি ছুটাছুটি যখন তাদের পক্ষে যায় তখন তারা চুপ করে থাকেন, অথবা তাদের সেই তৎপরতাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন জানান। কিন্তু যখনই বিদেশিদের তৎপরতা তাদের অবস্থানের বিপক্ষে যায় তখনই তারা ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ’ বলে চিৎকার শুরু করে দেন। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাজনীতিতেও নানা ধরনের সংকট আছে। নানা ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। তবে দেশের প্রশ্নে সেই দেশের রাজনীতিবিদরা কিন্তু এক। দেশের ব্যাপারে তারা বাইরের কাউকে নাক গলাতে দেয় না। এই শিক্ষাটা আমাদের নেওয়া উচিত। বাংলাদেশে কীভাবে নির্বাচন হবে, কে কীভাবে তা পর্যবেক্ষণ করবে, সেটা ঠিক করব আমরা। দেশের নীতিনির্ধারণ ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া যায় না। এটা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য শুভ নয়। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমন নজির নেই। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে বিদেশিদের আশীর্বাদ নিতে চায় বলেই হয়তো এমন পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রদূতদের বৈঠক করাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে মত-মন্তব্য করা তার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না।
গণতন্ত্রকে যদি প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তবে আমাদের দেশ আমাদের মতো করেই পরিচালনা করতে হবে। বাইরের কাউকে ডেকে এনে নাক গলানোর সুযোগ দেওয়া যাবে না। কোনো মর্যাদাশীল দেশ এটা করে না। কোনো মর্যাদাশীল দেশের রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিও এটা করে না। আমাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের এই বোধোদয়টা কবে হবে? কবে তারা আমাদের সমস্যাগুলোকে আমাদের মতো করে সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেবে? যারা বাইরের মানুষের কাছে অভিযোগ করে তারাই যে ছোট হয় এটা তারা কবে বুঝবে? একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ একটি দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর বড় আঘাত। সব রাজনৈতিক দলকে বিষয়টি মাথায় রেখেই রাজনীতি করা দরকার। বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনে চাকরিরত কূটনীতিকদের একটি বিষয় মাথায় রাখা উচিত যে তাদের দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নাক গলানো তাদের কাজের আওতার বাইরে। তবে এটা ঠিক, একটি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে সরকারি ও বিরোধী দল উভয়েই যোগাযোগ রাখবে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য। কিন্তু সেই সম্পর্ক উন্নয়নের নির্দিষ্ট একটি মাত্রা থাকতে হবে।
বিদেশি কূটনীতিকদের যদি আমরা মাথায় চড়িয়ে রাখি তবে তারা সেখান থেকে নামবেন না। এটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশেও শক্তিশালী দেশগুলো ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। মনে রাখতে হবে বিদেশিদের মদদ দিয়ে শক্তিশালী দেশগুলোকে ক্ষমতার এমন অপব্যবহারের পথ প্রশস্ত করছেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাই।
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট
‘সুগন্ধা ট্র্যাজেডি’র এক বছর পূর্ণ হলো গতকাল শনিবার। গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর ভোর রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকা-ের ঘটনায় ৪৮ জন নিহত হয়। দগ্ধ হন আরও শতাধিক যাত্রী। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও পুড়ে মারা যাওয়া ১৯ জনের লাশ এখনো শনাক্ত হয়নি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, ১৯ লাশ পুড়ে এতটাই অঙ্গার যে লাশগুলোর হাড় ও ক্যালসিয়াম পর্যন্ত ছিল না। ফলে স্বজনদের কাছ থেকে নেওয়া স্যাম্পলের সঙ্গে ডিএনএ ম্যাচিং করা যায়নি। খেয়াল করা দরকার আগুনে পুড়ে যাওয়া লঞ্চটিতে কতজন যাত্রী ছিল তার সঠিক তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। দুর্ঘটনার পরপরই বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছিল, লঞ্চটিতে প্রায় ৪০০ যাত্রী ছিল। কিন্তু লঞ্চ থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের ভাষ্যমতে অভিযান-১০ লঞ্চটিতে যাত্রী ছিল ৮০০ থেকে ১ হাজার। অর্থাৎ, কেবল ১৯টি পোড়া লাশের পরিচয়ই নয়, যাত্রী বা নিখোঁজের পূর্ণাঙ্গ তালিকাও পাওয়া গেল না। আমাদের নৌপথে এমন দুর্ঘটনা যেমন নতুন নয় তেমনি দুর্ঘটনায় নিহত বা নিখোঁজদের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ার ঘটনাও নতুন নয়। একইভাবে প্রতিটি বড় বড় নৌদুর্ঘটনার পর একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ এবং দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার কাজটিও সবসময় হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে অবহেলিত বিষয় দুর্ঘটনারোধের সুপারিশ বাস্তবায়ন। ফলে বারবার একই পৌনঃপুনিক চক্রে চলতে থাকে নৌপথের দুর্ঘটনা। এই বাস্তবতাই বলে দেয় মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর এবং নৌযান মালিকরা দুর্ঘটনা রোধে আন্তরিক নয়।
সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১৭ সাল থেকে পূর্ববর্তী ৫০ বছরে দেশে নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে অন্ততপক্ষে ২০ হাজার ৫০৮ জন। ওই ৫০ বছরে দেশে অন্তত ২ হাজার ৫৭২টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় সম্পদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৪১৭ কোটি ২০ লাখ টাকার। দীর্ঘ এ সময়ে দুর্ঘটনাকবলিত নৌযানের সংখ্যা ২ হাজার ৬৭২। এর মধ্যে ৯০১টি নৌযান কোনোদিনই উদ্ধার সম্ভব হয়নি। নৌপথে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে উপযুক্ত নৌযান, দক্ষ চালক এবং অনুকূল আবহাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যাত্রীবাহী অথবা মালবাহী প্রতিটি নৌযানের ডিজাইন, ধারণ ক্ষমতা, কারিগরি দিক, রুট ইত্যাদি বিবেচনা করে বিআইডব্লিউটিএ’র অনুমতিপত্র বা ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার বিধান পুরোপুরি কার্যকর হতে দেখা যায়নি। আর যাত্রীবাহী লঞ্চ-স্টিমারে কয়েকটি বয়া আর কিছু লাইফ জ্যাকেট শোপিসের মতো সাজিয়ে রাখতে দেখা গেলেও কয়েকশ যাত্রী বহনকারী ওই সব নৌযান দুর্ঘটনায় কবলিত হলে এগুলো কীভাবে কাজে লাগবে তা নিয়ে কর্তৃপক্ষ কিংবা নৌযান মালিকের কোনো মাথাব্যথা নেই। লঞ্চডুবি ঘটলে যাত্রীদের বড় অংশই যে লঞ্চ থেকে বের হওয়ারই সুযোগ পান না তার কারণ মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক বহির্গমন পথ না থাকা। কিন্তু নৌযানের ডিজাইন ও ফিটনেসসহ এসব প্রাথমিক বিষয়ই যেখানে মানা হয় না সেখানে দুর্ঘটনা রোধ করা কীভাবে সম্ভব।
আমাদের নদীপথ এতটাই বিস্তৃত যে, দেশের চার ভাগের তিনভাগ বাণিজ্যকেন্দ্র বা কেন্দ্রের কাছাকাছি নৌযান নিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় সহজেই। নৌপথ পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হলেও নৌপথ এখনো অনিরাপদ ও অরক্ষিত। নদীমাতৃক এই দেশে নদী আর নৌপথের ভাগ্য একই পাঁকে বাঁধা। চোখের সামনে যেভাবে নদী মরছে সেভাবেই গুরুত্ব হারিয়েছে নৌপথ। জ্বালানি সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব এবং তুলনামূলক নিরাপদ হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের অভাবে সরকারের কর্মকৌশলে নৌপরিবহন দীর্ঘদিন ধরেই অবহেলিত। দেশের নদ-নদীর নাব্য সংকট আর নৌপথের ক্রমহ্রাসমান দৈর্ঘ্য এই সুদীর্ঘ অবহেলা-অনাচারেরই প্রতিচ্ছবি। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৩৩ সালে নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল ১৪ হাজার ৩৮ কিলোমিটার। পাকিস্তান আমলে ১৯৬৭ সালে পানির মৌসুমে ১২ হাজার কিলোমিটার, আর শুষ্ক মৌসুমে ৮ হাজার কিলোমিটার। বাংলাদেশ আমলে ১৯৮৯ সালে পানির মৌসুমে নৌপথ ছিল ৫ হাজার ৯৬৮ কিলোমিটার, আর শুষ্ক মৌসুমে ৩ হাজার ৬০০ কিলোমিটার। বিআইডব্লিউটিএ বলছে, বিগত কয়েক বছরে ব্যাপক খননকাজের ফলে শুষ্ক মৌসুমেই নৌপথের দৈর্ঘ্য বেড়ে প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটারে উঠেছে। অন্যদিকে, ১৯৭৫ সালে মোট জাতীয় পরিবহনের ৩৭ শতাংশ হতো নদীপথে। তখন ১৬ শতাংশ যাত্রী নৌপথে যাতায়াত করত। এখন এ হিস্যা কমে যথাক্রমে ১৬ শতাংশ এবং ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলে জানা গেছে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে। সরকার যদি অগ্রাধিকার না দেয় তাহলে এই নদীর দেশে নৌপথ কীভাবে আর কবে নিরাপদ হবে? নৌপথে নজর ফিরবে কবে?
চলচ্চিত্র অভিনেতা, পরিচালক ও সুরকার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিনের জন্ম ১৮৮৯ সালের ১৬ এপ্রিল। চ্যাপলিন লন্ডনে প্রচণ্ড দারিদ্র্য ও কষ্টের মধ্য দিয়ে শৈশব অতিবাহিত করেন। শিশুশিল্পী হিসেবে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন রঙ্গশালায় সফর করেন এবং পরে একজন মঞ্চাভিনেতা ও কৌতুকাভিনেতা হিসেবে অভিনয় শুরু করেন। তার নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হলো দ্য কিড, পরবর্তী সময়ে তিনি আ ওম্যান অব প্যারিস, দ্য গোল্ড রাশ এবং দ্য সার্কাস চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন এবং এসব চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ফ্যাসিস্ট অ্যাডলফ হিটলারকে ব্যঙ্গ করে নির্মাণ করেন দ্য গ্রেট ডিক্টেটর। নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের অন্যতম মৌলিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব চ্যাপলিন নিজের ছবিতে নিজেই অভিনয় করতেন, এবং চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা, পরিচালনা, প্রযোজনা এমনকি সংগীত পরিচালনাও করতেন। তাকে ১৯৭২ সালে অ্যাকাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার প্রদান করা হয়। ফ্রান্স সরকার ১৯৭১ সালে লেজিওঁ দনরের কমান্ডার ও রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯৭৫ সালে নাইটহুডে ভূষিত করেন। তিনি ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর ভোরে ঘুমের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তার নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন।
বিশ্বকাপের দল ঘোষণা নিয়ে চলছে নানা নাটকীয়তা। রাতটা পোহালেই বাংলাদেশ দল উড়াল দেবে ভারতের গোয়াহাটিতে। তবে এখনও ঘোষণা করা হয়নি দল। বিসিবি জানিয়েছে, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে চলমান তৃতীয় ওয়ানডের ম্যাচ শেষেই জানানো হবে বিশ্বকাপের দল।
প্রচুর আলোচনা ও জল্পনা–কল্পনার পর আজ বিশ্বকাপে নিজেদের স্কোয়াড ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। বিসিবির ফেসবুক পেজে আজ দুপুর ১টা ২৮ মিনিটে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। সেখানে দেখা যায় বিসিবির লোগোসংবলিত বক্সে করে গুরুত্বপুর্ণ কিছু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভিডিও–র শেষে প্রশ্ন করা হয়েছে, বলুন তো ভেতরে কি?
বিকেল ৫টা ৪৩ মিনিটে আরেকটি পোস্টে জানানো হয় সন্ধ্যা পৌণে ৬টায় ঘোষণা করা হবে দল। কিন্তু ৫টা ৪০ মিনিটে আরেকটি পোস্টে জানানো হয় তৃতীয় ওয়ানডের শেষেই দল ঘোষনা করা হবে।
বাংলাদেশে ফৌজদারি অপরাধে আইনের যে ধারায় শাস্তি দেওয়ার হয়, দণ্ডবিধি বা পেনাল কোড নামে আইনটি ১৬৩ বছরের পুরনো। বিচারের দিক-নির্দেশক হিসেবে ফৌজদারি কার্যবিধি (দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর বা সিআরপিসি) নামে পদ্ধতিগত আইনটিও ১২৫ বছর আগের তৈরি। এ ছাড়া ১৫১ বছরের বেশি পুরনো (১৮৭২ সাল থেকে প্রচলিত) সাক্ষ্য আইন (অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট)। ব্রিটিশ আমলে তখনকার প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতিতে তৈরি এ আইনগুলোর কাঠামো নিয়ে আপত্তি না থাকলেও আইন ও বিচারসংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ মানুষের প্রশ্ন আছে সময়, পরিস্থিতি ও প্রয়োজনে আইনগুলোর সংস্কার এবং যুগোপযোগী না করা নিয়ে। বাংলাদেশসহ এ উপমহাদেশে ৭৬ বছর আগে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে। আইনের সংস্কার নিয়ে বছরের পর বছর দাবি উঠেছে জোরেশোরে। স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসব আইনের আলোকে, অনেক বিশেষ আইন হয়েছে। সেগুলোর অনেক ধারাতেও অসংগতি ও অস্পষ্টতার বিষয়টি নানা সময়ে আলোচনায় এসেছে। কিন্তু সংস্কারের বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত।
১৮৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত দণ্ডবিধিতে ৫১১ ধারার ৪৫৯টি শাস্তিসংক্রান্ত। এর মধ্যে আটটি ধারায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। ১৮৯৮ সালে তৈরি হওয়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬৫ ধারার বেশিরভাগই বিচারের লক্ষ্যে দিকনির্দেশনা সংক্রান্ত। এ ছাড়া ১৫১ বছরের বেশি পুরনো (১৮৭২ সাল থেকে প্রচলিত) ও ১৬৬টি ধারা সংবলিত সাক্ষ্য আইনে (অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট) ধর্ষণের শিকার নারীদের জন্য অবমাননাকর একটি ধারা গত বছর নভেম্বরে বাতিলসহ এ আইনে ডিজিটাল তথ্য-প্রমাণ আমলে নেওয়ার সুযোগ রাখা হয় সংশোধনীতে। আইন কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, সাক্ষ্য আইনটিকে আরও যুগোপযোগী ও সংস্কারের অংশ হিসেবে চলতি বছরেই তারা সুপারিশসংক্রান্ত প্রতিবেদন দেবেন।
আইনের সংস্কার প্রশ্নে পাঁচজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে তাদের মতামত নিয়েছে দেশ রূপান্তর। প্রায় অভিন্ন সুরে তারা বলেন, আইনের প্রতিষ্ঠিত নীতিবাক্য হলো ‘দশজন অপরাধী খালাস পেলেও একজন নিরপরাধ ব্যক্তি যেন সাজা না পান’। ফলে বিচারে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং আইনের ভাষা হতে হয় সহজ ও অযান্ত্রিক। একই সঙ্গে বিচারপ্রত্যাশীর ভোগান্তি লাঘবে দ্রুত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হয়। তাদের মতে, প্রায় ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক সময়ে মানুষকে প্রজা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এর প্রভাব পড়েছে ওই সময়ে তৈরি আইনগুলোতে। যেখানে শুধু শাস্তিকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। অন্যদিকে একশ, দেড়শ বছরে অপরাধের ধরন, ভিন্নতা, অপরাধে প্রযুক্তিগত ব্যবহারসহ বদলেছে অনেক কিছু। বিপরীতে আইনগুলোতে নগণ্য কিছু সংশোধনী ছাড়া সংস্কার হয়নি।
পুরনো আইনের সংস্কার না হওয়াকে মামলাজটের কারণ উল্লেখ করে আইনজীবীরা আরও বলেন, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি, আদালতের সময়সহ বিচারপ্রত্যাশীর অর্থ ও সময় সাশ্রয়, অপরাধীর পুনর্বাসন, সংশোধন ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তেমন কিছুই নেই আইনগুলোতে। অন্যদিকে আইনের অপপ্রয়োগ কিংবা দুর্বলতায় প্রায়ই নির্দোষ ব্যক্তিকে নির্যাতন, জেলে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) ট্রাস্টি অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষের জন্য আইন। কিন্তু ব্রিটিশরা কর্তৃত্ব ও নিপীড়নমূলক অনেক আইন করেছে মানুষকে শোষণ, শাসন ও লুণ্ঠন করতে। তখন তো আর নাগরিক ও মানবাধিকার নিয়ে এত কথা হতো না। তাদের লক্ষ্যই ছিল কথায় কথায় স্বাধীনতাকামীদের বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়া। তিনি বলেন, ‘এখন তো আমরা ব্রিটিশদের উপনিবেশে নেই। কিন্তু ৫৪ (বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার) ১৬৭ ধারার (রিমান্ড) মতো নিপীড়নমূলক আইনগুলোসহ আরও অনেক কিছু রয়ে গেছে। ১৯৭২ সালে মাত্র কয়েক দিনে একটি ভালো সংবিধান হলে এখন মানুষের জন্য যুগোপযোগী আইন কেন হবে না?’
সম্প্রতি ২৪তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নিয়োগ পাওয়ার পরদিন গত ১৩ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি মামলাজটকে তার প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন। এ লক্ষ্যে আইনের সংস্কার বড় বিষয় উল্লেখ করে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘মানুষের দুর্গতি ও কষ্ট লাঘবে সরকার নিশ্চয়ই এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করবে।’ নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা।
আইন সাময়িকী ডিএলআরের সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. খুরশীদ আলম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি যথার্থই বলেছেন। আমরাও আইনের সংস্কার চাই। শুধু ফৌজদারি কিংবা দণ্ডবিধি নয়, এসব আইনের আলোকে আর্থিক অপরাধ, মানি লন্ডারিংসহ এমন কিছু আইন আছে যেগুলোর অনেক কিছুর সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে।’
কিছুদিন আগে ভারত সরকার ব্রিটিশদের তৈরি ফৌজদারি আইন ব্যাপক সংস্কারে উদ্যোগ নিয়েছে।
সংস্কারের রূপরেখা আলোর মুখ দেখেনি : পুরনো ফৌজদারি আইনের সংস্কার নিয়ে ২০১১ সালে একটি রূপরেখা তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে প্রতিবেদন দিয়েছিল আইন কমিশন। এতে আইনের প্রতিষ্ঠিত নীতিবাক্যটিকে একটু ভিন্নভাবে উপস্থান করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘একজন নির্দোষ ব্যক্তি যাতে সাজা না পায় এবং একজন অপরাধীও যাতে খালাস না পায়।’ আইনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে প্রশ্নের অবতারণা করে সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধানে ৩৩টি সুপারিশ করে কমিশন। এর মধ্যে তদন্ত ও বিচারের ত্রুটি কাটাতে ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত করতে স্থায়ী, পেশাদার ও দক্ষ পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য শুধু হাতেকলমে না লিখে টেপ রেকর্ডার, ভিডিওতে রাখা, ১৬৪ ধারায় আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির সঙ্গে সাক্ষীর বক্তব্য রেকর্ড করা, মিথ্যা ও তুচ্ছ অভিযোগকারীকে জরিমানা, ক্ষতিপূরণ বা কারাদণ্ড দিতে ম্যাজিস্ট্রেটের পাশাপাশি দায়রা জজকেও ক্ষমতা দেওয়া, বিচারকাজের দীর্ঘসূত্রতা কমাতে মুলতবির সময় সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া, মামলার কার্যক্রম স্থগিতের সময়সীমা ৩০ দিনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনের তাগিদ দেয় কমিশন। এ ছাড়া কারাগারের চাপ কমানো এবং আসামিকে সংশোধনের লক্ষ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও অভিযোগ গঠনের সময় দোষ স্বীকার করলে সাজা রেয়াত দেওয়া, যুক্তিতর্কের কারণে মামলার কার্যক্রম বিলম্বিত হওয়ায় তা লিখিত আকারে জমা দেওয়া, আদালতের সংখ্যা অনুপাতে আপিল আদালত প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে কমিশন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কমিশনের ওই সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি।
কমিশনের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোর্শেদ ইমতিয়াজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রতিবেদন দেওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে কমিশন অবহিত নয়।
দণ্ডবিধির অনেক ধারার অসংগতি ও অস্পষ্টতা নিয়ে আইন ও বিচার সংশ্লিষ্টরা বলেন, এই আইনে অনেক কিছুই আছে। কিন্তু গণপিটুনিতে মৃত্যু, অর্থনৈতিক অপরাধের মতো আরও কিছু বিষয়ে আইনে কিছু নেই। অন্যদিকে পুরনো এ আইনে এখনো ১০ টাকা, ১০০ টাকা ও ২০০ টাকার মতো অর্থদণ্ডের বিধান রয়ে গেছে। জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার তিনজন (একজন অবসরে) বিচারক এসব আইনে তাদের বিচারিক অভিজ্ঞতার বিষয়টি দেশ রূপান্তরের কাছে তুলে ধরেন। সংগতকারণে তারা তাদের নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানান। একজন বিচারক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আদালত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রসিকিউশনসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সমন্বয়ে একটি ফৌজদারি মামলার বিচার কার্যক্রম হয়। কিন্তু বিচারের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে শুধু বিচার বিভাগকে শুনতে হয়। পুরনো আইনগুলোতে এমন অনেক কিছু আছে, যা একটু আধুনিক হলে বিচারকাজে আরও গতিশীল হবে।’ অন্য একজন বিচারক বলেন, ‘বিচারকাজের সময় টাইম (আদালত ও বিচারপ্রার্থীর সময়), কস্ট (বিচারপ্রার্থীর খরছ) এবং ভিজিট (বিচারপ্রত্যাশীর আদালতে আসা-যাওয়া) এ তিনটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আইনগুলোতে এসব বিষয়ে স্পষ্ট কিছু দিকনির্দেশনা নেই। সংগতকারণে বিচারপ্রার্থীর প্রতি সিমপ্যাথি (সহানুভূতি) ও ইমপ্যাথি (সহানুভূতির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু করা) থাকা সমীচীন।’
আইন সংস্কারের উদ্যোগ থমকে দুই বছর ধরে : ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফৌজদারি আইন সংস্কার ও আইনটি বাংলা ভাষায় প্রণয়ন করতে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হককে নির্দেশ দেন। দুদিন পর ফৌজদারি আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন করে আইনটি যুগোপযোগী, আধুনিক ও বাংলা ভাষায় প্রণয়নের উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এতে চেয়ারপারসন করা হয় মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব মো. মইনুল কবিরকে। কমিটিকে অন্যান্য দেশের আইন বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করে সমস্যা চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তবে মন্ত্রণালয়ের ওয়াকিবহাল একটি সূত্রের তথ্য বলছে, দুই বছর পার হলেও এ বিষয়ে কার্যকর কোনো অগ্রগতি নেই।
এ বিষয়ে জানতে সচিব ময়নুল কবিরের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল ধরেননি। সার্বিক বিষয়ে জানতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলেও তার সাড়া মেলেনি। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এএম আমিন উদ্দিন মনে করেন, পুরনো আইনগুলোর আমূল পরিবর্তন কিংবা পুরো সংস্কার নয়, যতটুকু করলে বিচারপ্রার্থীর দ্রুত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে সেটি হতে পারে। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘আইনগুলোর প্রসিডিউরে (কার্যপ্রণালি) তেমন ভুল নেই। যেসব ক্ষেত্রে অসংগতি বা অস্পষ্টতা আছে শুধু সেগুলোই আলোচনার মাধ্যমে সংশোধন করা উচিত। এ ক্ষেত্রে অংশীজন হিসেবে অন্যদের সঙ্গে অবশ্যই আইনজীবীদের সম্পৃক্ত রাখা উচিত।’
ভারতের ভিসা পাওয়া নিয়ে পাকিস্তান দল যে জটিলতার মধ্যে ছিল সেটার অবসান হয়েছে। অবশেষে ভারতের সরকার পাকিস্তান দলের জন্য ভিসা অনুমোদন করেছে।
সোমবার ক্রিকেট বিষয়ক ভারতীয় ওয়েবসাইট ক্রিকবাজ এই খবর জানিয়েছে। ভিসা অনুমোদনের ফলে বাবর আজমের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান দল এখন বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতে ভ্রমণ করতে পারবে। আগামী ৫ অক্টোবর শুরু হতে যাওয়া ১০ দলের আসরে শেষ দল হিসেবে ভিসা পেয়েছে পাকিস্তান।
ওয়ানডে বিশ্বকাপ অংশ নিতে আগামী বুধবার ভারতের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার কথা রয়েছে পাকিস্তান দলের। তবে যাত্রার ৪৮ ঘণ্টা আগেও ভিসা না পাওয়াকে 'অস্বাভাবিক দেরি' হিসেবে উল্লেখ করে উদ্বেগ জানায় পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)। তারা বিষয়টি নিয়ে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির দ্বারস্থও হয়। এর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এসেছে ভিসা অনুমোদনের খবর।
ক্রিকবাজ জানিয়েছে, আইসিসির একটি সূত্র তাদেরকে পাকিস্তান দলের ভারতের ভিসা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ভিসা পেতে দেরি হওয়াকে স্বাভাবিক প্রশাসনিক প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করেছে ওই সূত্র।
সবশেষ এশিয়া কাপের মূল আয়োজক ছিল পাকিস্তান। তবে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে দেশটিতে যেতে চায়নি ভারত। ওই আসরে ভারতের সবগুলো ম্যাচ হয় শ্রীলঙ্কায়। একটি বাদে সুপার ফোরের বাকি সব ম্যাচ আর ফাইনালও অনুষ্ঠিত হয় দ্বীপ দেশটিতে।
ভারত নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকায় হাইব্রিড মডেলে এশিয়া কাপ আয়োজনের প্রস্তাব আসে পাকিস্তানের কাছ থেকেই। এর আগে ভারত দল পাকিস্তানে না গেলে পাকিস্তানও ভারতে বিশ্বকাপ খেলতে যাবে না বলে হুমকি দিয়েছিল পিসিবি। যদিও নিজেদের সেই সিদ্ধান্ত থেকে পরে সরে আসে তারা।
বিশ্বকাপের আগে আগামী শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অফিসিয়াল প্রস্তুতি ম্যাচে মাঠে নামবে পাকিস্তান। তিনদিন পর তাদের আরেকটি প্রস্তুতি ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপে বাবরদের প্রথম ম্যাচ নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। আগামী ৬ অক্টোবর হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত হবে ম্যাচটি।
খাগড়াছড়ির পানছড়িতে বিজিবির ওপর হামলা চালিয়ে টাকাসহ আসামী ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে ও ৬০০ জনকে অজ্ঞাত আসামী করে মামলা হয়েছে। সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সকালে বিজিবি বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পানছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হারুনুর রশিদ।
সাড়ে ১২ লাখ টাকাসহ দুই হুন্ডি ব্যবসায়ীকে আটকের জেরে রবিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) বিকেলে খাগড়াছড়ির পানছড়িতে বিজিবির উপর হামলা চালিয়ে টাকাসহ দুই হুন্ডি ব্যবসায়ীকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। হামলায় ৯ বিজিবি সদস্য আহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিজিবি ১৩ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। আটক করা হয়েছে এক ব্যক্তিকে।
বিজিবি ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, রবিবার সকাল ১০টার দিকে পানছড়ি ব্যাটালিয়ন (৩ বিজিবি) অধীনস্থ লোগাং বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা একটি বস্তা ও দুই যাত্রীসহ রেজিস্ট্রেশন বিহীন একটি মোটরসাইকেল আটক করে। পরে তল্লাশি করে সাড়ে ১২ লাখ পাওয়া যায়। কিন্তু মোটরসাইকেল আরোহী রিংটু চাকমা ও ধনরঞ্জন চাকমা টাকার উৎস ও মালিকানা সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হলে লোগাং বিজিবি ক্যাম্পের সুবেদার মোফাজ্জল হোসেন স্থানীয় তিন জনপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে টাকাসহ আসামীদের পানছড়ি থানায় সোপর্দ করার জন্য আসার পথে পুজগাং বাজার এলাকায় ৫/৬ শতাধিক গ্রামবাসী লাঠিসোটা নিয়ে বিজিবির দুটি গাড়ীর গতিরোধ করে। এক পর্যায়ে গ্রামবাসীরা হামলায় চালিয়ে টাকা ও আসামীদের ছিনিয়ে নেয়। সেইসঙ্গে বিজিবির গাড়ীতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
পানছড়ি ব্যাটালিয়ন (৩ বিজিবির) অধিনায়ক লে.কর্নেল একে এম আরিফুল ইসলাম জানান, রাষ্ট্রীয় ও জানমাল রক্ষার্থে বিজিবির সদস্যরা অন্তত ১৩ রাউন্ড ফাঁকাগুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং ঘটনাস্থল থেকে সুমন চাকমা নামে এক হামলাকারীকে আটক করে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, রিংটু চাকমা ও ধনরঞ্জন চাকমা পানছড়ি সীমান্ত এলাকায় সংঘবদ্ধ হুন্ডি ব্যবসায়ী চক্রের সদস্য।
ন্যায্য পারিশ্রমিক ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার সীমিত করার দাবি নিয়ে পাঁচ মাস আগে হলিউডে শুরু হওয়া হট্টগোলের অবসান হচ্ছে। আন্দোলনকারী লেখকরা প্রযোজকদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর পর ধর্মঘট তুলে নেওয়ার কথা জানান। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানাচ্ছে, পাঁচ মাস আগে লেখক বা চিত্রনাট্যকারদের আন্দোলনের সঙ্গে যোগ দেন অভিনয়শিল্পীরা। যার কারণে হলিউডে একধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। বন্ধ হয়ে যায় অনেক সিনেমার নির্মাণকাজ। তবে স্থানীয় সময় গত রবিবার হলিউডের লেখক ইউনিয়ন বড় স্টুডিওগুলোর সঙ্গে একটি প্রাথমিক চুক্তিতে পৌঁছেছে।
সিএনএন বলছে, এই চুক্তির ফলে হলিউডের ইতিহাসের বড় দুটি ধর্মঘটের মধ্যে একটি পক্ষ কাজে ফিরতে সম্মত হলো। এই ধর্মঘটের ফলে প্রায় পাঁচ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে বেশিরভাগ ফিল্ম ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানের চিত্রায়ণ। ক্যালিফোর্নিয়ার অর্থনীতিতে এর প্রভাব বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের। তাই এবার আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে লেখক ও অভিনয়শিল্পীদের কাজে ফেরাতে সচেষ্ট হচ্ছে হলিউডের স্টুডিওগুলো।
লেখকদের সঙ্গে নিষ্পত্তি হলেও এখনই হলিউডের স্টুডিওগুলোর আলো জ্বলছে না। অভিনেতাদের সংগঠন এসএজি-এএফটিআরএ এখনো পারিশ্রমিক ও এআই ইস্যুতে ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছে। এসব দাবির পাশাপাশি লেখকদের পারিশ্রমিক ও লভ্যাংশ ইস্যুতে সংহতি প্রকাশ করে ২ মে থেকে কর্মবিরতি পালন করছেন তারা। এসব বিষয়ে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে বার্তা সংস্থার আহ্বানে সাড়া দেয়নি দ্য অ্যালায়েন্স অব মোশন পিকচার অ্যান্ড টেলিভিশন প্রডিউসারস, ওয়াল্ট ডিজনি, নেটফ্লিক্স, ওয়ার্নার ব্রস ডিসকভারিসহ অন্যান্য প্রতিনিধিত্বকারী বাণিজ্যিক গোষ্ঠী।
চলতি বছরের ২ মে থেকে শুরু হওয়া ধর্মঘটে ১১ হাজারেরও ফিল্ম এবং টিভি লেখক অংশগ্রহণ করেন, যারা স্ট্রিমিং যুগে উচ্চ বেতন এবং আরও ভালো কাজের দাবি করছেন। তারা যুক্তি দিয়েছেন যে স্টুডিওগুলো স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরম থেকে যে আয় করেছে, সেই তুলনায় তাদের ক্ষতিপূরণ মিলছে না। লেখকরা নতুন নিয়মও চান, যাতে এসব স্টুডিও টিভি শোগুলোর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক লেখক নিয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে বড় স্টুডিওগুলোর কাছ থেকে বেশি পারিশ্রমিক চেয়ে একটি চুক্তি করতে চেয়েছিল লেখকদের সংগঠন রাইটার্স গিল্ড অব আমেরিকা (ডব্লিউজিএ)। সেই চুক্তির চেষ্টা ব্যর্থ হওয়াতেই মূলত ধর্মঘটের ডাক দেন লেখকেরা। হলিউড আন্দোলনের কারণে অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে টেলিভিশন শো ও হলিউডের নির্মাণাধীন সিনেমাগুলো।
পুলিশের পদোন্নতির তালিকায় থাকা পদ কাটছাঁট করায় অসন্তোষ কমছে না। এ নিয়ে পুলিশ কর্তারা একাধিক বৈঠক করছেন। প্রধানমন্ত্রী দেশে এলে পদোন্নতি নিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। পুলিশের অসন্তোষ ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগও নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে পদোন্নতির পদ আরও বাড়াতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে। চিঠি পেয়ে জনপ্রশাসনও কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, পদোন্নতির সংখ্যাটি প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কাটছাঁট করে পুলিশকে বিব্রত করেছে। অন্য ক্যাডাররা একের পর এক পদোন্নতি পেলেও পুলিশ পিছিয়ে আছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিব আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা হবে।
এদিকে ক্যাডারদের পাশাপাশি নন-ক্যাডারদেরও পদোন্নতির বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। ইতিমধ্যে সাব-ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতির উদ্যোগ নিতে পুলিশ সদর দপ্তর বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। পদোন্নতির তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তিন দিন আগে পদোন্নতি পেতে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। ওই সময় রাজধানীর ৫০ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতির বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের ক্যাডার ও নন-ক্যাডারদের পদোন্নতির বিষয়ে আমরা কাজ করছি। যাদের পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা আছে তারা অবশ্যই পদোন্নতি পাবেন। বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পদ বাড়াতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি শিগগির বিষয়টি সুরাহা হবে। নন-ক্যাডারদের কর্তারাও কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের বিষয়টিও সমাধান হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার পুলিশের জন্য যা করেছে, অতীতের কোনো সরকারই তা করেনি। পুলিশের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পুুলিশের পদোন্নতির তালিকা কাটছাঁটের বিষয়ে গত মঙ্গলবার আইজিপিসহ পুলিশ কর্মকর্তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওইদিন বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পুলিশের পদোন্নতির বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নুর-এ- মাহবুবা জয়া।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ রাষ্ট্রের আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাবাহিনী প্রধানতম বাহিনী, যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, পেশাদায়িত্ব ও শৃঙ্খলা রক্ষায় তদারকি ও ব্যবস্থাপনা এ বাহিনীর নেতৃত্বের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ বাহিনীকে নেতৃত্ব প্রদানে পুলিশ সুপার থেকে তদূর্ধ্ব পদে পর্যাপ্তসংখ্যক পদ এবং দক্ষ জনবল থাকা বাঞ্ছনীয়। পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (গ্রেড-৩) ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (গ্রেড-২) তুলনামূলক কম। বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোর আলোকে (বিদ্যমান পদে অতিরিক্ত) অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক এবং উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক পদোন্নতি দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হবে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদানের জন্য পদ সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিদ্যমান পদের অতিরিক্ত সুপারনিউমারারি পদ রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে সৃজনের প্রস্তাবে পদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) থেকে পুলিশ সুপার (এসপি) পর্যন্ত ৭২০ কর্মকর্তার পদোন্নতি পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। তালিকাটি সংশোধন করতে ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। পরে পুলিশ সদর দপ্তর ৫২৯টি পদ চূড়ান্ত করে আরেকটি তালিকা পাঠায়। সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দিতে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গত ১ আগস্ট এ প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় তালিকা কাটছাঁট করেছে। অতিরিক্ত আইজিপি পদে দুজন, ডিআইজি পদে ৫০ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে ১৪০ ও পুলিশ সুপার পদে ১৫০ জনকে পদোন্নতি দিতে ১৪ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন। পুলিশের তালিকায় ছিল অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-১) ১৫, অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-২) ৩৪, ডিআইজি ১৪০, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৫০ ও এসপি ১৯০ পদে পদোন্নতি দিতে। এ তালিকা কাটছাঁট হওয়ায় পুলিশে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ অসন্তোষ এখনো অব্যাহত আছে। অসন্তোষ ঠেকাতে আবার জনপ্রশাসনকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি দ্রুত সমাধান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পুলিশ সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, পুলিশে সংখ্যাতিরিক্ত (সুপারনিউমারারি) পদোন্নতিতে অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও এসপি পদে পদোন্নতির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৫২৯টি সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করতে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। পদোন্নতির বিষয়ে সিগন্যাল আসার পর ২০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে এ-সংক্রান্ত একটি সভা হয়েছিল। সভায় অতিরিক্ত সচিবসহ (পুলিশ ও এনটিএমসি) পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, পুলিশে বর্তমানে একজন অতিরিক্ত আইজিপির পদ খালি রয়েছে। সুপারনিউমারারি পদে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ১৫ ও ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১৮, ২০, ২১, ২২ ও ২৪তম ব্যাচের প্রায় সবাই ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি ২৭, ২৮ ও ২৯তম ব্যাচের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের এসপি হিসেবে পদোন্নতির বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নন-ক্যাডাররা পদোন্নতি পাবেন। সাব-ইন্সপেক্টর থেকে ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টর থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সুপারনিউমারারি পদে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মতোই নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হবে। ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কারা পাবেন তার তালিকা তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দাবিগুলো ছিল পুলিশ পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) ১০ বছর পূর্তিতে ষষ্ঠ গ্রেড দেওয়া। ১০ বছর পূর্তিতে ব্যাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রেড পরিবর্তন করা। ১০ বছরের মধ্যে পদোন্নতি না হলে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দেওয়া। সাব-ইন্সপেক্টরদের (এসআই) ক্ষেত্রেও একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে এসআই/সার্জেন্ট পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তাদের র্যাংক ব্যাজের নীল বা লাল ফিতা তুলে নেওয়া। কনস্টেবলদের বিভাগীয় পরীক্ষায় একবার পাস করলে সেখান থেকে প্রমোশন লিস্ট করে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে মন্ত্রীর কাছে।’
গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত অভিযোগে দেশের কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টা বক্তব্য দিতেও শুরু করেছে। এতে বিরোধীপক্ষেরই ঝুঁকি দেখছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই সবপক্ষই চাপে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থান নিয়ে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা হলেও মূলত নির্বাচনী রাজনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তন আসবে। একপক্ষ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও সেই পথ থেকে তাদেরও সরতে হবে। আবার সরকারপক্ষ যেনতেন নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসে যাবে সেই সুযোগও থাকছে না। যে যাই বলুক নির্বাচনী রাজনীতিতে সামনের দিনগুলোতে এ পরিবর্তন আসতেই হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবপক্ষের জন্য। তাদের অবস্থানে বিএনপি উৎফুল্ল হয়ে যাবে, আর আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন নয়। বরং এতে এক ধরনের সমাধানের পথ খুলে যেতে পারে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ না দিলেও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে এমন আভাস দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু গত বছর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আসছে। তাদের একাধিক প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করে সরকার ও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে সমর্থনের কথা জানিয়ে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রয়োগের কথা জানানো হলো গত শুক্রবার।
এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা ও র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভিসানীতি প্রয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অনড় অবস্থানের বিষয়টি আবার জানাল। দেশটির এ অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দেখছে দুভাবে। একটি হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। দ্বিতীয়টি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করা বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। এর বাইরে অন্য কোনো বিরূপ প্রভাব দেখছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকার এত দিন যেটা চেয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র সেটাই আশা করছে।
তবে বিএনপি ভিসানীতির জন্য সরকারকে দায়ী করেছে এবং সেটা তাদের নেতাকর্মীদের এক দফা আন্দোলনে আরও উজ্জীবিত করবে, এমন দাবি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কারণে আগামী নির্বাচন যেনতেনভাবে হয়ে যাবে সেটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রস্তুতি সবাইকে নিতে হবে। এর বাইরে কোনো রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তা যেই হোক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করা বা একপেশে করার চিন্তা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে চাইলে, পড়তে হবে ভিসানীতির আওতায়। যুক্তরাষ্ট্রের অনড় অবস্থান এখন পর্যন্ত সেটাই ইঙ্গিত করে।’
সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে এক দফা দিয়ে আন্দোলনে আছে বিএনপি। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য এক দফা ঘোষণা করেছে। তারাও শান্তি-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। সেটা নিশ্চিত করতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ এটাও বলে আসছে, তাদের সরকারের চাওয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া একই।
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দুভাবে দেখলেও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে নানা রকম কানাঘুষা রয়েছে। ভেতরে-ভেতরে ‘ভেঙে পড়লেও’ ওপরে শক্ত মনোভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নতুন কিছু নয়। দুপক্ষের অবস্থান একই বলেও দাবি করেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যে অবস্থান তাতে বিএনপিরই ক্ষতি, কারণ তারা ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন হতে দেবে না।’ তিনি বলেন, সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় সরকার। সেখানে সব দল নির্বাচনে আসুক সেই আহ্বানও জানানো হয়েছে।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত এবং সহযোগিতা করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই ব্যক্তিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা জোরালোভাবে দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র তো বিএনপির দাবি সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান সেখানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে এসব বলা হয়নি। ফলে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করায় আওয়ামী লীগ বা সরকার কেন বেকায়দায় পড়বে? আমরা মনে করি, বিএনপিই তো বেকায়দায় রয়েছে। কারণ, তাদের দাবি অসাংবিধানিক। আর অসাংবিধানিক উপায় অবলম্বন করছে। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের এই অনড় অবস্থান বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের দাবি, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত বিএনপি। তারা তো বিএনপির একটা দাবির কথাও বলে নাই।’ সরকার বা আওয়ামী লীগ ভীত ও শঙ্কিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের উচিত বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানা।’
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেমন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই, আমেরিকারও একই রকম চাওয়া।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র যে এমন কিছু করবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। এটা সিম্পল ব্যাপার আমাদের জন্য।’
ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় বিরোধী দল আছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যে বক্তব্য এসেছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিবৃতিতে কোন বিরোধী দলের কথা বলা হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে আজকে দেশে গণতন্ত্রের যে সংকট তার জন্য সরকার এককভাবে দায়ী। তা ছাড়া এর আগে বাইডেন প্রশাসন তাদের দেশে যে গণতন্ত্রের সম্মেলন করেছে তাতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি।’
ভিসানীতি প্রয়োগের জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আজকে আওয়ামী লীগ বিগত দুটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন করার পর আবারও আগামী নির্বাচন একতরফা করতে যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। এর দায় সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। আজকে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ আগের ঘোষণার ধারাবাহিকতা। প্রথমদিকে নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে, সাধারণ মানুষের ভেতর যে বড় ধাক্কা মনে হয়েছিল, ঘোষণা আসার পর সেটা মনে হয়নি। তবে কোনো একটা সমীকরণ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এর প্রভাব কত দূর যাবে সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনে কী বার্তা যাবে সেটা পরিষ্কার নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা তাদের বৈশি^ক চর্চারই অংশ। মূল কথা হলো, এটা সবার জন্যই চাপ।’
বাংলাদেশের কিছু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র বলে জানিয়েছেন ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর আজ শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী ব্যক্তিদের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করার ঘোষণা পর তিনি এ তথ্য জানান। তবে কতজনের ওপর এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা তিনি জানাননি ।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বলেছেন, ‘আমরা যখন এই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছি, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঘটনাবলির ওপর গভীর দৃষ্টি রাখছে। সতর্কতার সঙ্গে তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনার পর আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছি।’
মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্রকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করবে কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘না, এসব ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম আমরা প্রকাশ করব না।’ কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ভিসা রেকর্ড গোপনীয়।
ব্রায়ান শিলার এই কথা বলার ঘণ্টাখানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আজ (শুক্রবার) স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকা বাংলাদেশি ব্যক্তিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ব্যক্তিদের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী, ক্ষমতাসীন দল এবং রাজনৈতিক বিরোধী দলের সদস্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয় তার সমর্থনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে প্রমাণিত অতিরিক্ত ব্যক্তিরাও ভবিষ্যতে এই নীতির অধীনে মার্কিন ভিসার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। এর মধ্যে বর্তমান এবং প্রাক্তন বাংলাদেশী কর্মকর্তা, বিরোধী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমাদের আজকের পদক্ষেপগুলি শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সমর্থন করার জন্য এবং বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায় তাদের সমর্থন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে।’
মে মাসে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে ভিসানীতির ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্থনি ব্লিংকেন ওই ঘোষণা দেন।
সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগামী নভেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার পর প্রশাসনে রদবদলের সুযোগ নেই সরকারের। তাই এর আগেই নির্বাচনী প্রশাসনে ধাপে ধাপে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। প্রশাসনে চলছে পদোন্নতি ও রদবদল। ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রশাসন সাজাতে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে বদলি-পদায়ন হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে বড় পদোন্নতি হয়েছে। নির্বাচনের আগে অবসরে যাওয়া কয়েকজন সচিবেরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের ২৬ জন, ২৫তম ব্যাচের ২০ জন এবং ২৭তম ব্যাচের ১৮ জন ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিসিএসের ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০০৫ সালে, ২৫তম ব্যাচ ২০০৬ সালে এবং ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০০৮ সালে।
জানা যায়, নির্বাচনের সময় ডিসিরা জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকেন। তাদের যে কোনো কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ থেকে শুরু করে বাতিলের ক্ষমতাও থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও থাকে রিটার্নিং কর্মকর্তা তথা ডিসির অধীনে। নির্বাচনের সময় সমন্বয়কারীর ভূমিকায়ও থাকেন ডিসিরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন তাদের দুটি ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে। আর সে সময় বিসিএস নিয়ে বেশ বিতর্ক ছিল। বিসিএসে ছিল নানা ধরনের তদবির। ২৪ ও ২৫তম ব্যাচ দুটি বিএনপির সময়ে নিয়োগ পেলেও ২৭তম ব্যাচ নিয়োগ পেয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। কারণ বিএনপির শেষ সময়ে ২৭তম ব্যাচের নিয়োগে বড় ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকায় তা বাতিল হয়। পরে ফের পরীক্ষা নিয়ে ২০০৮ সালে এ ব্যাচের নিয়োগ দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল ২৪তম ব্যাচের নিয়োগ নিয়ে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ২৪তম ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ডিসির পদ থেকে তুলে আনা হতে পারে। নির্বাচনের সময় যারা ডিসির দায়িত্বে থাকবেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তাদের সবার ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে পরিবার ও নিকট আত্মীয়স্বজনদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো যাচাই করা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে ছাত্রজীবনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে আর ডিসির পদে রাখা হবে না।
এ ছাড়া নির্বাচনে অন্যতম ভূমিকা পালন করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)। বর্তমানে ৩৩, ৩৪ ও ৩৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা রয়েছেন ইউএনও পদে, যারা আসন্ন নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন। এখন ৩৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ইউএনওর দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে; এ ব্যাচে প্রশাসন ক্যাডারের ২৯১ জন কর্মকর্তা রয়েছেন।
জানতে চাইলে সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ইকরাম আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পিএসসির নিয়োগ পরীক্ষা হয় যোগ্যতা, মেধা ও দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে। সেখানে ছাত্রজীবনে কে কোন পার্টি করেছিলেন, কোন দল ক্ষমতায় আছে তা বিবেচনা করা হয় না। বিসিএস কর্মকর্তাদের যে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং হয়, তাতে তাকে একজন অফিসার হিসেবেই গড়ে তোলা হয়। এরপর এসিআর, সুপিরিয়রের মতামত, সুনাম, দক্ষতা, যোগ্যতার ভিত্তিতেই একজন কর্মকর্তাকে উচ্চতর পদে দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তবে সরকার যে দল পরিচালনা করে তাদের কিছু নীতিমালা ও উদ্দেশ্য থাকে। কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সরকারের নেওয়া বৈধ ও জনকল্যাণে গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা। তিনি প্রলুব্ধ হবেন না, নিরপেক্ষ থেকে তার দায়িত্ব পালন করবেন। যদি কোনো নির্বাচনী দায়িত্বও দেওয়া হয়, সেটাও নিরপেক্ষভাবে তিনি পালন করবেন।’
গত মে মাসে অতিরিক্ত সচিব পদে ১১৪ জনের পদোন্নতি হয়। জুলাই মাসে পাঁচ বিভাগে নতুন বিভাগীয় কমিশনার দেওয়া হয়েছে। গত জুলাই মাসেই বদলি ও নতুন মিলিয়ে ৩০টি জেলায় ডিসি পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। উপসচিব পদমর্যাদার এই ডিসি পদে এবারও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর আটজন পিএসকে পদায়ন দেওয়া হয়েছে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ২২১ কর্মকর্তা। এ পদোন্নতিতে মূল বিবেচনায় এসেছে ২২তম ব্যাচ। বর্তমানে যুগ্ম সচিবের স্থায়ী পদ ৫০২টি। এর বিপরীতে পদোন্নতি পাওয়ার পর যুগ্ম সচিবের সংখ্যা হলো ৯৪৬ জন। এর আগে সর্বশেষ গত বছর ২ নভেম্বর ১৭৫ জন কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। আর গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২৭০ জন সিনিয়র সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।
জানা যায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই অন্তত ১০ জন সচিবের স্বাভাবিক অবসরে যাওয়ার কথা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন আগামী ১৩ অক্টোবর অবসরে যেতে পারেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান ১৪ সেপ্টেম্বর, সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আবদুস সালামের ২৬ সেপ্টেম্বর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। তবে আবদুস সালামের চাকরি এক বছর বাড়ানো হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ৯ অক্টোবর, ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দীক ৩০ অক্টোবর, ইআরডি সচিব শরিফা খান ২৪ নভেম্বর, শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এহসানে এলাহী ২৫ নভেম্বর এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের সিনিয়র সচিব কামাল হোসেন ২৯ নভেম্বর অবসরে যাবেন। ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মোছাম্মৎ নাসিমা বেগম এবং ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মো. ফয়জুল ইসলাম। এ ১০ জনের মধ্যে কয়েকজন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারেন।
গত কয়েক বছরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং মুখ্য সচিব পদে যারা ছিলেন, তাদের অনেকেই স্বাভাবিক অবসরের মেয়াদ শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। সর্বশেষ সাবেক চার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মধ্যে একমাত্র কবির বিন আনোয়ার ছাড়া বাকি তিনজনই স্বাভাবিক মেয়াদ শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। তারা হলেন মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা, মোহাম্মদ শফিউল আলম ও খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তাই স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনেরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
তার নাম শেখ মোহাম্মদ আসলাম। একসময় সুইডেন ছিলেন বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন স্ইুডেন আসলাম নামে। তেজগাঁও এলাকার এই শীর্ষ সন্ত্রাসী একসময় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড বা অপরাধ জগৎ কাঁপাতেন। ২৭ বছর ধরে আছেন কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে। হত্যাসহ ১৭ মামলার একটি ছাড়া বাকিগুলোতে জামিন পেয়েছেন তিনি। কিন্তু বহু দিনের পুরনো প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারানোর শঙ্কায় জামিনের জন্য আবেদন করছেন না তিনি।
মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালও জামিনের আবেদন করছেন না। প্রায় ২০ বছর ধরে কারাগারে থাকা হেলালের বিরুদ্ধে আছে অন্তত এক ডজন মামলা। বেশিরভাগ মামলায় জামিন হয়ে গেছে। এই দুজনের মতোই কারা হাজতে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছেন না। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষ্যও দিতে আসেন না আদালতে। তারা বছরের পর বছর ধরে কারাগারে থাকলেও সমস্যা হচ্ছে না। অনেকেই অসুস্থ না হয়েও বছরের পর বছর হাসপাতালে আরামে
থাকছেন। বাইরে থাকা তাদের সহযোগীদের সঙ্গেও যোগাযোগ থাকছে। এই সহযোগীরাই তাদের হয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করছেন।
পুলিশের তালিকায় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম আছে যাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। অবশ্য এই তালিকায় সুইডেন আসলাম নেই। তালিকা করা হয় ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। এদের মধ্যে ১৩ জন বিদেশে আত্মগোপন করে আছেন। কারাগারে আছেন ৬ জন, মারা গেছেন ৩ জন। একজনের কোনো হদিস নেই।
এই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আটজনকে ১ লাখ টাকা এবং ১৫ জনকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে পিচ্চি হান্নান র্যাবের ক্রসফায়ার, গণপিটুনিতে আলাউদ্দিন ও কামাল পাশা ওরফে পাশা কারাগারে মারা গেছেন। কালা জাহাঙ্গীর বেঁচে আছেন নাকি আত্মগোপনে, কেউ বলতে পারছেন না। পিচ্চি হেলাল, টিটন, ফ্রিডম সোহেল ও কিলার আব্বাস কারাগারে আছেন। খোরশেদ আলম ওরফে রাশু কিছুদিন আগে ছাড়া পেলেও কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আবার আটক করেছে। মশিউর রহমান কচি, সুব্রত বাইন, আমিন রসুল সাগর. ইমাম হোসেন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, মোল্লা মাসুদ, শামীম আহমেদ, হারিস আহমেদ, তানভিরুল ইসলাম জয়, জাব্বার মুন্না, জাফর আহমেদ, কামরুল হাসান হান্নান ওরফে ছোট হান্নান দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তাদের ধরতে ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করা আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ডে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে গাড়ি থামিয়ে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও গুলিবিদ্ধ এক পথচারী সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। এ ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন জড়িত বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও। দেশের বাইরে থাকা সন্ত্রাসীরা নিজেদের সহযোগীদের মাধ্যমে নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীরাও সহযোগীদের নানা বিষয়ে বার্তা দিচ্ছে। এর মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হতে চাইছে। যে কারণে সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে পুলিশ সদর দপ্তর সব কটি ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার এসপিদের বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীদের বিষয়ে নতুন করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কারাগার কর্তৃপক্ষকেও হাজতি ও বন্দি সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, যেসব সন্ত্রাসী দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক আছে, তাদের একটি তালিকা করেছে একটি সংস্থা। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও তারা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছে না। তারা কারাগারকেই নিরাপদ মনে করছে।
কারা সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম একটি মামলায় জামিন না নেওয়ায় কারাগারে আছেন। বাকি সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। ২৭ বছরের কারাজীবনে তার দুইবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। বেশিরভাগ সময় কেটে যাচ্ছে হাসপাতালে থেকেই। হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করেন সব সময়। মোবাইল ফোনে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ করেন সহযোগীদের সঙ্গে। তার স্ত্রী আয়েশা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
সুইডেন আসলামের বিষয়ে তার এক আত্মীয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, এলাকায় তার যখন একক আধিপত্য ছিল, তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। তারাই এখন তার বিরুদ্ধে। সুইডেন আসলাম বের হয়ে এলে প্রতিপক্ষরাই তাকে মেরে ফেলবে, এমন শঙ্কা আছে। এসব দিক বিবেচনা করেই তিনি বের হতে চাইছেন না। কারাগারেই তিনি ভালো আছেন।
জানা গেছে, সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে মামলাগুলোতে কোনো সাক্ষীও পাওয়া যায় না। ১৯৮৬ সালে তিনি অপরাধ জগতে যুক্ত হন। ওই বছর পূর্ব রাজাবাজারে স্কুলের সামনে কিশোর শাকিলকে গুলি করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তারপর থেকে তার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যাকা-সহ নানা অপরাধের তথ্য বের হয়ে আসে। এরই মধ্যে নিজেকে রক্ষা করতে সুইডেন চলে যান। বছর পাঁচেক ওই দেশে থেকে আবার ফিরে আসেন দেশে। তারপর সুইডেন শব্দটি নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালের ২৩ মার্চ গালিব খুন হন। এ ঘটনায় আসলামসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২৪ সাক্ষীর মধ্যে পুলিশ চারজনকে আদালতে হাজির করতে পেরেছে। বাকিরা আর আসেননি এবং এই মামলায় তিনি জামিনও নেননি।
দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলেও আসলাম মোবাইল ফোনে সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। স্ত্রী আয়েশা আকতার নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। বলা চলে রাজার হালেই আছেন তিনি।
মিরপুর ও কাফরুল এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস ২২ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। তার বিরুদ্ধে থাকা ১১টি মামলার জামিন হয়েছে। একটি মামলার জামিন হতে বাকি আছে। তা ছাড়া কমিশনার নিউটন হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হলেও উচ্চ আদালতে খালাস পেয়েছেন তিনি। আরেকটি মামলার শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিলার আব্বাসের এক সহযোগী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে দেখা করে আসি। দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি কারাগার থেকে বের হতে চাচ্ছেন না। জামিন চাইলে তিনি জামিন পেয়ে যাবেন। কিন্তু ভাই তা করবেন না। কারণ প্রতিপক্ষ সক্রিয় আছে। তার প্রাণ শঙ্কা আছে। আমরা ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় জামিন নিয়ে ভাইকে বের করে আনতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আরেক সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালেরও প্রায় সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। শুধু একটা মামলার জামিন বাকি আছে। তিনি যখন কারাগারে, তখন বিএনপি তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছিল। অথচ হেলাল বিএনপির রাজনীতি করেন। জেলে বসেই মোহাম্মদপুর, আদাবর ও ধানম-ি, মিরপুর এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড দখল ও চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। তার সঙ্গে মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের ভালো যোগাযোগ। মোবাইল ফোনে নিয়মিত কথা বলেন তারা। তার আরেক সহযোগী হাবিবুর রহমান তাজ ১৩ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। মামলার সাক্ষীদের হাজির করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। ইচ্ছে করে জামিনও নিচ্ছেন না তাজ। গ্রেপ্তারের আগে দীর্ঘদিন ভারত পালিয়ে ছিলেন। ২০০৮ সালে ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক মাস পর তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজধানীর কাফরুলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ইসমাইল হোসেনকে হত্যা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তা ছাড়া কলেজছাত্র কামরুল ইসলাম ওরফে মোমিন হত্যার সঙ্গেও জড়িত তাজ। মতিঝিল থানার সাবেক ওসি এ কে এম রফিকুল ইসলামের আশ্রয়-প্রশয়ে থাকতেন তিনি। কয়েক বছর আগে ওসি রফিক মারা যান।’
মতিঝিলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুই কর্মকর্তাকে হত্যা করে আলোচনায় আসে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ঈদুল। প্রায় ১৫ বছর ধরে কাশিমপুর কারাগারে আটক আছেন তিনি। একবার পঙ্গু হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে আটক করে ফেলে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা থাকলেও দুটি মামলা বাদে সব কটিতে জামিন পেয়েছেন। বাকি মামলাগুলোতে ইচ্ছা করে জামিন নিচ্ছেন না বলে তার এক স্বজন জানিয়েছেন।
সেভেন স্টার গ্রুপের একসময়ের সদস্য ফ্রিডম সোহেল ধানম-ি ৩২ নম্বরে গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজার আসামি। সাজা কমিয়ে কারাগারেই থাকার চেষ্টা করছেন সোহেল। তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা আছে। ৯টি মামলায় জামিন পেয়েছেন। একটি মামলায় সাজা হয়েছে। আরেকটি মামলায় জামিন নিচ্ছেন না।
তার সহযোগী পুরস্কারঘোষিত সন্ত্রাসী রাশু কিছুদিন আগে কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আটক করে। তার এক স্বজন দেশ রূপান্তরকে জানান, মাস দুয়েক আগে সর্বশেষ মামলায় জামিন হয় রাশুর। তার কোনো ইচ্ছা ছিল না কারাগার থেকে বের হওয়ার। আর এ কারণে ইচ্ছা করেই একটি সংস্থাকে কারাগার থেকে বের হওয়ার তথ্য দিয়ে আবার গ্রেপ্তার হন। কারণ তিনি বের হলে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে মেরে ফেলবে এমন আশঙ্কা ছিল। আরেক সন্ত্রাসী লম্বু সেলিম একটি মামলা বাদে সব মামলায় জামিনে আছেন। ভারতের কলকাতা থেকে তাকে পুশব্যাক করা হয়েছিল। প্রায় আট বছর ধরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। বেশিরভাগ সময় হাসপাতালে থাকেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে জেল থেকে বের হচ্ছেন না তিনি।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, সন্ত্রাসীদের কর্মকা- রোধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নানা কৌশলে কাজ করছে। তারা সরগরম হলেও কাজ হবে না। যারা দেশের বাইরে আছে, তাদের চিহ্নিত করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ধরার চেষ্টা চলছে। যারা দেশে আছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে পুলিশ-র্যাব কাজ করছে। তবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কেউ বিশ্ঙ্খৃলা তৈরি করতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘কোনো সন্ত্রাসী জামিন না নিলে এটা আমাদের করার কিছু নেই। তবে তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সেদিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।’
পুলিশ সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, চোরাকারবারিসহ ভিন্ন ধরনের অপরাধীরা দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করে আছেন। তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকা- চালিয়ে আসছেন। তাদের নির্দেশে হত্যাকান্ডের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছেন তারা। মতিঝিলে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকান্ডের পেছনে বিদেশ কানেকশন।
২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাইয়ে আত্মগোপন করে আছেন। টিপু হত্যাকান্ডের পর তিনি আলোচনায় এসেছিলেন। দুবাইয়ে থাকলেও ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে সবচেয়ে বেশি প্রভাব তার। জিসানের সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক ভারতে পালিয়ে আছেন। কিন্তু দেশে তার দখলবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য ও চাঁদাবাজিতে নিয়ন্ত্রণ এখনো আছে। মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইন ভারতে থেকে সক্রিয় আছেন। তানভীর ইসলাম জয়ও সক্রিয় আছেন। কলকাতা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ঘুরে তার অবস্থান এখন থাইল্যান্ডে। সেখানে বসেই তিনি কলকাঠি নাড়ছেন।