
নিয়মটা তো এই রকমেরই ধেয, একপক্ষ জয়ী হলে অন্যপক্ষ পরাজিত হবে এবং এ নিয়মেও মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত যে, জয়ীর সংখ্যা হবে অল্প, পরাজিতদের সংখ্যা অধিক। তা বাংলাদেশে জয়ী হয়েছে কারা, কারা ওই অল্পসংখ্যক লোক যারা পরাজিত করেছে বিপুলসংখ্যক দেশবাসীকে?
এ প্রশ্নের মীমাংসা মোটেই জটিল নয়, বরং খুবই সহজ। যেদিকে তাকাই দেখতে পাব জয়ীদের এবং সঙ্গে সঙ্গে দূরে নয়, কাছেই, বলা যাবে পাশেই চোখ পড়বে পরাজিতদের। এই শহরে তিন কোটি টাকা দামের গাড়িও চলে। দাম জানি না, নিরূপণের সুযোগ নেই, যারা জানেন তারা বলেন। এরাই তো জয়ী, এই বিত্তবানরা। আর পাশেই, ওই গাড়ি যখন যানজটের জন্য থেমে যায় তখনই চোখে পড়বে জীর্ণশীর্ণ কিশোরীকে, যে ফুল বিক্রি করে, তিনশ নয়, তিরিশও নয়, তিন টাকা পেলেই বর্তে যায়। এই যে তিন কোটি টাকা ও তিন টাকা এ কোনো স্থির ছবি নয়, সহ-অবস্থানের চমৎকার দৃশ্য বলা যাবে না একে, এ হচ্ছে তিন কোটিওয়ালার নিপীড়ন ও অপমান, তিন টাকাওয়ালাকে। তিন কোটির মালিক অল্প কয়েকজন, তিন টাকার কাঙাল অসংখ্য, লাখ লাখ।
এই জয়, এই পরাজয়, এ কোনো নতুন ব্যাপার নয়। কিন্তু জয়ী এবং পরাজিতের মধ্যে ফারাকটা বাড়ছে, দিনে দিনে, বছরে বছরে। গ্রামে কাজ নেই, আশ্রয়ও নেই, নিরুপায় মানুষ উপায়ের খোঁজে শহরে আসে, এসে বস্তিতে ওঠে তারপর বস্তিতে এক দিন আগুন লাগে, সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়, নিঃস্ব হয়ে পড়ে। বস্তিবাসী গ্রামে পরাজিত হয়ে যে শহরে এসেছিল; শহরে হেরে গিয়ে সে কোথায় চলে যায়, কে জানে। যেখানে বস্তি ছিল সেখানে বিজয় উঠতে বিলম্ব ঘটে না, দর্পিত অ্যাপার্টমেন্ট কিংবা আত্মসন্তুষ্ট বিপণি বিতান দাঁড়িয়ে যায়, জয়ীদের জয়ের তালিকা যেমন, তেমনি পরাজিতদের পরাজয়ের তালিকাও প্রসারিত হতে থাকে, পরস্পর বিরুদ্ধ ফলাফল তৈরি করে দিয়ে। ছোট ব্যবসায়ীদের বাজারটা পুড়ে যায়, যাতে বড় ব্যবসায়ীরা সেখানে আরও বড় বাজার খুলতে পারে।
এসব তো বাইরের দৃশ্য। জয়ী মানুষদের ঘরের ভেতরের ছবি দেখলে সন্দেহ থাকবে না যে, আরব্য রজনীর সেই দৈত্য তাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে, হুকুম করার অপেক্ষামাত্র, অমনি যা চাইবে এনে দেবে। এরা ঈদে যায় কলকাতায়, অসুখ হলে ব্যাংককে, ছেলেমেয়েদের রাখে আমেরিকায়। নিজেরা কখনো দেশে থাকে, কখনো বিদেশে। দেশি জিনিস পারতপক্ষে ব্যবহার করে না, দেশি ভাষায় নিজেরা ক্ষমাঘেন্না করে কথা বললেও সন্তানদের কারবার সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এসব যখন চলে তখন মঙ্গা ঘটে রংপুরে। দেশের অর্থমন্ত্রী বলেন, মঙ্গা কী তিনি জানেন না। আগের অর্থমন্ত্রী যেমন বলেছিলেন, শেয়ার মার্কেট কী বস্তু তিনি বোঝেন না, যদিও তার চোখের সামনেই ফটকাবাজারে জুয়া খেলতে গিয়ে শত শত মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার নিজেদের সর্বস্ব খুইয়েছে এবং দেশি-বিদেশি ভুয়া কোম্পানি শেয়ারের মূল্যহীন কাগজ তাদের হাতে গছিয়ে দিয়ে নগদ টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছে। মঙ্গা কী, তা মন্ত্রী না বুঝলেও ভুক্তভোগী মাত্রই বোঝে। হাড়ে হাড়ে। কয়েকজন তরুণ গিয়েছিল মঙ্গাপীড়িত এলাকায়। তাদের একটি অভিজ্ঞতাই বলে দেবে মানুষ সেখানে কীভাবে টিকে আছে। অতিশয় বৃদ্ধ একজন এসেছিলেন সাহায্য নিতে। তার পরনের লুঙ্গিটি ছেঁড়া, কিন্তু তিনি চাইলেন একটি শাড়ি। কারণ কী জানতে চাইলে বললেন, তিনি তো তবু ফাটা লুঙ্গি পরে বাইরে আসতে পেরেছেন, তার স্ত্রীর পক্ষে ঘরের বাইরে আসার উপায় নেই। ওই সময়টা ছিল রোজার, ত্রাণকর্মীরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন সাহরিতে তিনি কী খেয়েছেন, জবাব পেয়েছেন যে, পান্তাভাত ও কাঁচা মরিচ জুটেছিল, ইফতারির সময় পানি ছাড়া অন্যকিছু পাবেন বলে ভরসা করেন না। তরুণ ত্রাণকর্মীদের কৌতূহল রয়েছে ঈদের দিন তিনি কোন ধরনের খাবার খাবেন বলে আশা করেন, ভদ্রলোক জানিয়েছেন ভাতের সঙ্গে ডিম ভাজা পেলে খুবই খুশি হবেন। গরিবের ঈদ নিয়ে কবিতা আমরা অনেক পড়েছি। কিন্তু সেই ঈদ যে এমন সাদামাটা এবং এই ঈদ যে একজনের নয়, বহুজনেরতার বিপরীতে তিন কোটিওয়ালাদের ঈদ যে কতটা দাপটের হতে পারে তার হদিস কবির পক্ষেও পাওয়া সহজ হবে না।
কে জয়ী আর কে-ইবা পরাজিত তা নিয়ে কি সন্দেহের কোনো অবকাশ আছে? জয়ীর সংখ্যা শতকরা পাঁচজনের বেশি হবে না, বাদবাকি সবাই বিভিন্ন মাত্রায় পরাভূত। জয়ীরা কারা? তাদের পরিচয় কী? পরিচয় একটাই, তারা ধনী। হ্যাঁ, পেশাগত পার্থক্য আছে, আদর্শগত দূরত্বও থাকতে পারে, কিন্তু তাদের জয় সেসব বিভিন্নতাকে অবলুপ্ত করে দিয়েছে। এরাই এ দেশের ব্যবসায়ী, আমলা, রাজনীতিক এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে পেশাজীবী। এদের মধ্যে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি সবাই রয়েছে। যেন একই পরিবারের সদস্য, কলহ যা তা পারিবারিক বটে; ভাগাভাগি নিয়ে কাড়াকাড়ি মাত্র, নইলে তারা সমান সুবিধাতেই রয়েছে। সরকারি জোটের সদস্য জামায়াতের আমির নিঃসংকোচে বলে যাচ্ছেন যে, সূর্যসেন ছিলেন এ দেশের প্রথম সন্ত্রাসী, জামায়াত একাত্তরে মানুষ খুন করেছে, এখনো যে করছে না তা নয়, কিন্তু তা নিয়ে ক্ষমা চাওয়া দূরের কথা, দুঃখ প্রকাশও করতে হয়নি। জয়ীদের কাতারে তারা অত্যন্ত আরামে বসে আছে।
নব্বইয়ে একটি গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল, পতন ঘটেছিল এক স্বৈরশাসকের। পতনের রাতে তিনি দেশ ছেড়ে পালাতে চেষ্টা করছেন বলে খবর রটেছিল, হাজার মানুষ ছুটেছিল বিমানবন্দরের দিকে, তাকে আটকাতে। তিনি আটকও হয়েছিলেন, কিন্তু পরে শুধু ছাড়াই পাননি, ওই যে যারা জয়ী তাদের মধ্যে একজন প্রধান পুরুষ হিসেবে বিরাজ করছেন। তিনি বিবাহ এবং বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, সম্প্রতি মেয়ের বয়সী ও আগে-বিবাহিত এক পাত্রীকে স্ত্রীর আসনে বসিয়েছেন, সে খবর নয় কেবল, তার নতুন স্ত্রীর রাজনৈতিক বক্তব্যও আমাদের শুনতে হয়েছে। তার প্রথম স্ত্রী নির্বাচিত এমপি, দ্বিতীয় স্ত্রীও শোনা যাচ্ছিল মহিলা কোটায় এমপি হবেন বলে কথা ছিল। পরে আরও তেলেসমাতি কা-। দ্বিতীয় স্ত্রীকে তিনি ত্যাগ করেছেন এবং জেল খাটিয়েছেন। দ্বিতীয় স্ত্রীও বসে নেই, অতবড় মানুষের স্ত্রী, তাই সাবেক হলেও রাজনীতিতে হট্টগোল করছেন। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন ড. মিলন, কাগজে খবর বের হয়েছে যে, যারা সেদিন মিলনকে গুলি করেছিল তাদের নিজ হাতে গোলাবারুদ সরবরাহ করেছিলেন স্বয়ং এরশাদের প্রথম স্ত্রী। কদিন আগে মিলনের মা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে মিলন হত্যার বিচার দাবি করেছেন, প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই তাকে আশ্বাস দিয়েছেন, বিচার হবে বলে। এর কদিন পর রওশন এরশাদ তার দলের এমপিদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন বলে যে খবর বের হয়েছিল সে ঘটনার পরিণতি যদি এমন হতো যে, রওশন এরশাদ একজন মন্ত্রী হয়েছেন, তাহলেও বিস্মিত হওয়ার কারণ থাকত না। কিছুই অসম্ভব নয়।
রূপকথায় কল্পজগতের কাহিনী থাকে, সেখানে নিয়মকানুন-কায়দাকানুন সবকিছুই অন্যরকমের, আমাদের দেশে ধনীরাও ওই জগতেরই বাসিন্দা, তাদের কাজ একেবারেই ভিন্ন ধরনের। বিদেশিরা আমাদের গ্যাস-তেল নিতে চায়। সরকার রাজি, বিরোধী দলও যে গররাজি তা নয়। টাটা কোম্পানি আসবে, তাদের গ্যাস দেওয়া হবে; সরকার উৎসাহী, বিরোধী দল যে অনাগ্রহী তাও মনে হয় না। বিদেশিরা বন্দর নিয়ে নেবে এমন আশঙ্কা, সে ব্যাপারে সরকারি এবং বিরোধী দল কারও মনোভাবেই প্রকৃত দেশপ্রেমিকের নয়। এ দেশে যারা ক্ষমতায় যাতায়াত করে তারা সবাই একই শ্রেণির মানুষ। সেটি হলো শাসকশ্রেণি, সেই শ্রেণিতে দেশপ্রেমের বড়ই অভাব; ছড়াছড়ি আত্মপ্রেমের। একাত্তরে কি তাহলে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি? সেই যুদ্ধে কি জয় হয়নি জনগণের? শতকরা পঁচানব্বইজনই তো ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, পাঁচজন হয়তো বিপক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় কি তবে চলে গেল দেশের ধনিক শ্রেণির হাতে?
হ্যাঁ, সেটাই ঘটেছে বটে। ক্ষমতা চলে গেছে ধনীদের হাতে। একাত্তরে কে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল, কে ছিল বিপক্ষে সেটা আজ আর কোনো বিবেচনার বিষয় নয়, বিবেচ্য হলো কার হাতে টাকা আছে, কার হাতে নেই। যার টাকা আছে গেন ক্ষমতাবান, টাকা কোন পথে এসেছে তা কেউ জানতে চায় না। কেননা জানাই আছে যে, সব টাকাই অর্জিত হয়েছে অন্যায় পথে। কিন্তু ব্যাপারটাকে ছিনতাই বলা বোধকরি অন্যায় হবে। ঘটনাটা খুবই স্বাভাবিকভাবে ঘটেছে। সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। ঘরের মেয়েরা নানাভাবে লাঞ্ছনা সহ্য করেছে। যুদ্ধ শেষে তারা চলে গেছে নিজ নিজ পুরাতন অবস্থানে, যে অবস্থান এরই মধ্যে আগের তুলনায় ভালো হবে কী আরও খারাপ হয়েছে। তারা কাজ পায়নি। অনেকে দুর্ভিক্ষে পড়েছে। আগে ছিল রাজাকারের আতঙ্ক, পরে দেখা দিয়েছে রক্ষীবাহিনীর ভয়। আর যারা বিত্তবান তাদের সুবিধা হয়েছে, তারা একবার ধন বৃদ্ধির সুবিধা পেয়েছিল পাকিস্তান আসায়, আরেকবার পেল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়। বিত্তবানদের যে অংশ যুক্ত ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে তারা তো উৎফুল্ল হলোই, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল তাদেরও কোনো অসুবিধা হলো না। রাজাকারদের ভেতর চিকন আলীরাই শুধু ধরা পড়েছে, স্ফীতোদররা সহজেই পুনর্বাসিত হয়ে গেছে। বলাবাহুল্য, আদর্শের জোরে নয়, টাকার জোরে। যুদ্ধে জনগণের জয় হয়েছে. এটা একাত্তরের শেষে এবং বাহাত্তরের শুরুতে সত্য ছিল। মনে হয়েছিল বিপ্লব ঘটে গেছে। আমরা নতুন রাষ্ট্র তো বটেই, নতুন এক সমাজও পাব। জনগণ বলতে সেই মুহূর্তে ধনী-দরিদ্র সবাইকে বোঝাত। কেননা সবাই একসঙ্গে লড়ছিল একটি চিহ্নিত শত্রুর বিরুদ্ধে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের ঐক্য তো টেকেনি।
ধনীরা চলে গেছে ধনীদের জায়গায়, বাদবাকিরা পরাজিত মানুষের মতো ফিরে গেছে আগে, যেখানে ছিল তার চেয়েও খারাপ জায়গায়। গত ৩৪ বছরের ইতিহাস এ দেশে ধনীদের আরও ধনী হওয়ার ইতিহাস বটে। ধনী হয়েছে উৎপাদন করে নয়, মূলত লুণ্ঠন করে; কাজটি হানাদাররা শুরু করেছিল, স্থানীয়রা তাকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। একাত্তরে জাতি বিভক্ত হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারে, তারপর বিভক্ত হয়েছে ধনী ও দরিদ্রে। ধনীরা জয়ী হয়েছে, গরিবদের হারিয়ে দিয়ে। যেন ধনীকে আরও ধনী করার জন্যই সবকিছু ঘটেছে।
এমন তো কথা ছিল না। লড়াইটা তো শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার ছিল না, ছিল সার্বিক মুক্তির, যে মুক্তির মূল ভিত্তিটাই হওয়ার কথা ছিল অর্থনৈতিকশুধু উন্নয়নের নয়, বৈষম্যহীনতারও। জনগণের আশা কেন তাহলে ভেঙে গেল খান খান হয়ে। গেল এজন্য যে, সমাজ মোটেই বদলাল না। রয়ে গেল আগের মতোই। রাষ্ট্র বদলাল বটে, কিন্তু সে শুধু বহিরঙ্গ, ভেতরে সে রয়ে গেল আগের মতোই। সেই একই আমলাতন্ত্র, আইনকানুন, অফিস-আদালত শিক্ষাব্যবস্থা, প্রচারমাধ্যম, ধমক-ধামক, ঠাটবাট। শাসক বদলাল কিন্তু শাসন বদলাল না।
সাতচল্লিশে ব্রিটিশ শাসকরা চলে গিয়েছিল পাকিস্তানিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে, একাত্তরের পাকিস্তানি শাসকরাও সেই একই কাজ করতে বাধ্য হলো, ক্ষমতা দিয়ে গেল বাঙালি শাসকদের হাতে। রাষ্ট্র হুবহু এক রইল না, কিন্তু একই ধরনের রয়ে গেল। দুবারই যারা রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়েছে তাদের প্রধান যোগ্যতা ছিল তাদের বিত্ত। বিত্তবানরাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষমতায় ছিল, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায়ও তারাই রয়েছে। জয় তাদেরই। আর তারা যদি জয়ী হয় তবে সাধারণ মানুষ তো পরাজিত হবেই। তারা ঠিকই পরাজিত হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্য দিয়ে; বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা সশস্ত্র যুদ্ধের সাহায্যে। এই ব্যবধানটা সামান্য নয়। স্বায়ত্তশাসন নয়, স্বাধীনতাও নয় শুধু; চাই মুক্তি। খুব বড় একটা আশা তৈরি মুক্তির কল্পনাকে ঘিরে হয়েছিল। সফল হলো না বিত্তবানদের কারণে। তারা রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে সেই কাজই করতে থাকলপাকিস্তানি শাসকরা যা করছে, নিজেরা আরও ধনী হতে থাকলে জনগণকে বঞ্চিত করে। এদের চরিত্র দেশপ্রেমিকের নয়, লুণ্ঠনকারীর বটে।
লেখকঃ ইমেরিটাস অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সরকারি হিসাবে বর্তমানে বিশ্বের ১৬৮টি দেশে কাজ করছে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৩২ লাখ কর্মী (প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি)। জিডিপিতে প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। দিন দিন প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই কাজ করছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। শ্রমবাজারে ভাষাজ্ঞান একটি শক্তি। যে কোনো শ্রমবাজারে অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয় ভাষাজ্ঞান। শুধুমাত্র ইংরেজি ভালো জানার জন্য আমাদের দেশের কর্মীদের তুলনায় ফিলিপাইন, ভারত ও শ্রীলঙ্কার কর্মীদের বেতন দ্বিগুণ বা তারচেয়েও বেশি বৈদেশিক শ্রমবাজারে।
বাংলাদেশের প্রায় সমপরিমাণ কর্মী ফিলিপাইনের প্রবাসে কাজ করে। তাদের প্রবাসী আয় বাংলাদেশের চেয়ে দ্বিগুণ ইংরেজির কারণে। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এডুকেশন ফার্স্ট (ইএফ)। সংস্থাটির সমীক্ষায় ফিলিপাইন ইংরেজি দক্ষতায় উচ্চ অবস্থানে (২০) রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সৈয়দ মনজুর এলাহী এক সভায় বলেছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিপাইনের লোকেরা বাংলাদেশিদের চেয়ে চারগুণ বেশি বেতন পান। কারণ তারা সাবলীল ইংরেজি বলতে পারেন। যে জন্য তারা মধ্যম সারির কাজ পান’। ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ফিদেন রামোস বিবিসি টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বিদেশে আমাদের দেশের কর্মীরা ইংরেজিতে সাবলীলভাবে কথা বলতে পারেন। ছোটবেলা থেকে তারা ইংরেজিতে অভ্যস্ত। তাই বিদেশে তাদের চাহিদা বেশি।’
শুধুমাত্র ইংরেজি ভালো না জানার কারণে আমরা প্রবাসে প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়ছি মেধা থাকা সত্ত্বেও। ক্যারিয়ার গঠনে ইংরেজি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে তা ভুক্তভোগী প্রবাসীরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘ইংরেজি দক্ষতার অভাবে আমরা আন্তর্জাতিক দেন-দরবারেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’ এত প্রতিকূলতার পরও ইংরেজি ভাষাকে আমরা এখনো ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবেই শিখছি। ‘সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ’ ঘোষণা করতে পারলাম না আজও। ইংরেজি দক্ষতায় বাংলাদেশের অবস্থা খুবই নিম্নস্তরে এমন তথ্য উঠে এসেছে এক আন্তর্জাতিক সমীক্ষায়। অর্থনীতি ফোরামের হিসাবে ‘পৃথিবীতে ইংরেজি ভাষায় কথা বলেন ১৫০ কোটি মানুষ। কিন্তু এদের মধ্যে ৪০ কোটিরও কম মানুষের মাতৃভাষা এটি (বিবিসি বাংলা)’। সারা পৃথিবীতে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি যতটা ব্যবহার হয় অন্য কোনো ভাষা এতটা ব্যবহার হয় না। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে ইংরেজি সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা। ২০৫০ সালেও ইংরেজি সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষাই থাকবে (বিবিসি বাংলা ২৬ আগস্ট ২০২০)’। সাহিত্য সংস্কৃতি, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় ইংরেজি এখনো শীর্ষস্থানেই আছে।
আমেরিকার নাগরিকরা অনলাইনে চাইনিজদের ইংরেজি ভাষা শিখিয়ে লাখ লাখ ডলার উপার্জন করছে। ইউরোপের দক্ষ কর্মীর পাশাপাশি অদক্ষ কর্মীরা ইংরেজি ভাষার সুবিধা পেয়ে থাকে শ্রমবাজারে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড এই ৫টি দেশ ইংরেজি ভাষার সুবিধা নিয়ে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করে রয়েছে। বাংলাদেশের শ্রমবাজারেও ভারত ও শ্রীলঙ্কার ইংরেজিতে দক্ষ কর্মীরা অতিরিক্ত বেতনভাতা পাচ্ছে। আমাদের শ্রমবাজারের ঘাটতি পোষাতে ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকে ইংরেজিতে দক্ষ কর্মী আনতে হয়। পেশাগত প্রয়োজনে ইংরেজি শেখার বিকল্প নেই। যদিও দুঃখজনক হলেও সত্য যে কোনো কর্মকর্তা পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে ইংরেজিতে প্রত্যাশিত দক্ষ জনবল পাওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত ৩ খাতের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। কৃষি, গার্মেন্টস ও প্রবাসী আয়। যত সহজে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি করে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করা যাবে; তত সহজে অন্য দুটি খাতে আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব না। তাই অর্থনীতির গতি ত্বরান্বিত করতে এই মুহূর্তে প্রবাসী আয়কে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ইংরেজিতে কথা বলা ও শুনে বোঝা খুব কঠিন কাজ নয়। প্রয়োজন দেশব্যাপী একটি সমন্বিত পরিকল্পনা। দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে যত অর্থ, সময় ও শ্রম ব্যয় হবে তার চেয়ে অনেক কম শ্রমে ও অর্থে ইংরেজির মাধ্যমে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব। সরকারি খরচে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাগ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি বাড়াতে হলে প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই ভাষার ওপর জোর দিতে হবে। ভাষাচর্চার ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকা দরকার।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে লাখ লাখ কর্মীকে ইংরেজি শেখানো সম্ভব। আমাদের দেশে এখন ইংরেজি শেখানোর মতো দক্ষ জনবল রয়েছে। মাত্র কয়েকশ কোটি টাকা খরচ করে কয়েক লাখ নাগরিককে কমিউনিকেটিভ বা বিজনেস ইংলিশ শেখনো যাবে না কেন? আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে ভাষা এক বিরাট শক্তি। আর এ শক্তি অর্জন করতে হলে ইংরেজির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে ও ২০৩০ সালের মধ্যে সাসটেইনেইবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) অর্জনে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার বাড়াতে হবে কর্মক্ষেত্রে। জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে দেশে ইংরেজি ভাষা চর্চার ব্যবস্থা করে এ ভাষায় দক্ষ জনশক্তি বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। ভাষাই বয়ে আনতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনা।
লেখক : সাংবাদিক
গত শতকের ষাট সত্তর দশকে, পৃথিবীর ছবিটা ছিল অন্যরকম। তখন দুনিয়াজুড়ে বামপন্থি রাজনীতির বিপুল দাপট। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার সর্বত্রই বাতাসে বারুদের গন্ধ। আমার দেশও পিছিয়ে নেই। আমরা বড় হচ্ছি, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও, কমরেড মাও-এর চিন্তাধারা শুনতে শুনতে। দেয়ালে দেয়ালে মাও-এর মুখ। জ্বলজ্বলে পোস্টারে জানান দেওয়া হচ্ছে, চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান...।
আবেগের আতিশয্যে কোনো কোনো বিপ্লবী রেড বুক সাক্ষী রেখে বিয়ে অবধি সেরে ফেলতেন। গায়ক অজিত পান্ডে একই ভাবে লাল কেতাব হাতে নিয়ে, প্রেসিডেন্সি কলেজের পোর্টিকোতে বিয়ে করে অনেকের চোখে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন। আজকের পৃথিবী বদলে গেছে। দক্ষিণপন্থি রাজনীতির রমরমা একটা দুটো দেশ বাদ দিয়ে সব জায়গায়। খোদ চীনেও বাজার অর্থনীতির দাপটে সমাজতন্ত্র আদৌ টিকে আছে কি-না তা নিয়েই যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। মাও সেতুং নিয়ে কোনো চর্চাও নিজের দেশেই যেখানে নেই, সেখানে তার তিন দুনিয়ার তত্ত্ব বা গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাওয়ের রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা কতটা তা নিয়ে প-িতেরা আলোচনা করুন। আমরা বরং এদেশে মাওবাদী রাজনীতি নিয়ে যে বিরাট জল্পনা তা নিয়ে একটু-আধটু কথা বলি।
এ লেখা একাধারে ডায়েরি, রিপোর্টাজ, এলোমেলো চলতে চলতে দেখা থেকে। আসলে ডকুমেন্টারি ফিল্ম মেকার হিসেবে ভারতের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়কে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। এদেশে যারা মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি করেন বা দাবি করেন যে তারাই আসল মাও রাজনীতির ধারক, তারা রাষ্ট্রের কাছে অত্যন্ত বিপজ্জনক শক্তি। এখন তো আর্বান নকশাল শব্দটি রাজনৈতিক ডিসকোর্সে ঢুকে পড়েছে। স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, তাদের নিয়ে লেখালেখি করাও দেশের পক্ষে গর্হিত কাজ। আমি যে সময়ের কথা বলব তখন অবশ্য মাও শব্দটি এমন নিষিদ্ধ ছিল না। কিন্তু তখনো বস্তার, দ-কারণ্য এলাকায় উপদ্রুত ঘোষণা হয়ে গেছে। তল্লাটজুড়ে আধা সামরিক বাহিনীর বিপুল জমায়েত। তার মধ্যেই গড়ে উঠেছে মাওবাদী সংগঠনের গোপন গেরিলা ঘাঁটি।
খানিকটা ঝোঁকের মাথায় ঠিক করে ফেলেছিলাম যে নিষিদ্ধ এই বামদের নিয়ে একটা ছবি করব। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছিল যে এদেশের সবকটি বাম দলের কর্মসূচি, দলিল, চিন্তাভাবনা নিয়েই একধরনের ভিজ্যুয়াল প্রবন্ধ লিখব যা ভবিষ্যতে গবেষণার কাজে লাগবে। অন্য দলগুলো নিয়ে কাজ করা অনেক সহজ বলে প্রথমেই ঠিক করে নিলাম, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার পক্ষে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক মাওবাদী গেরিলাদের নিয়েই শুরু করব। ভাবা সহজ। কাজটা কঠিন। কুড়ি একুশ বছর আগেও গোপন ঘাঁটিতে গিয়ে শ্যুটিং করা ছিল অকল্পনীয়। একে তো মাওবাদীদের দিক থেকে ছাড়পত্র নাও মিলতে পারে। তারপর যদি তারা অনুমতি দিল, কিন্তু সরকার তো ছাড়বে না। এ একেবারে মারীচের মতো অবস্থা। হয় রামে না হয় রাবণে মারবে।
যাই হোক, অনেক কষ্টে, কাঠখড় পুড়িয়ে প্রায় এক বছর ধরে চেষ্টার পর বস্তার দ-কারণ্যের গভীর জঙ্গলে মাওবাদী ডেরায় গিয়ে শ্যুটিংয়ের অনুমতি পেলাম। একমাস ছিলাম গোপন ঘাঁটিতে। কীভাবে যে এখনো বেঁচে আছি, মাঝেমধ্যে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করি। এক এক সময় এখন ভাবি, জীবন বাজি রেখে ডকুমেন্টারি করতে যাওয়ার পেছনে বোধহয় ছিল শৈশব কৈশোরে অবচেতনে মাও-এর প্রভাব। আগেই বলেছি যে, তখন তো এক অন্য সময়। বিশ্বে এনেছে নতুন দিন, মাও সে তুং আর হো চি মিন।
তখন অবশ্য মাওবাদ ছিল না। বলা হতো মাও চিন্তাধারা। সারা বিশ্বে দিচ্ছে নাড়া কমরেড মাও-এর চিন্তাধারা। এদেশে নকশালপন্থিদের দুটো গোষ্ঠী এমসিসি বা মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র ও সিপিআই-এমএল জনযুদ্ধ এই টার্মটা সামনে আনে মাওবাদ। পরে দুই গোষ্ঠী এক হয়ে নতুন পার্টির নাম রাখে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)।
বাদ না চিন্তা তা বিতর্ক রয়েছে। নকশালপন্থিদের বড় অংশ মাওবাদ বলে কিছু হতে পারে বলে বিশ্বাস করে না। প্রথম কথা দ্বান্দ্বিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে মার্কসবাদী তাত্ত্বিকতায় বৈপ্লবিক চিন্তা, শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের যে নীতি ও কৌশল তার থেকে মাও রাজনীতির নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ফারাক যথেষ্ট। মাও তৃতীয় বিশ্বে কৃষকদের অগ্রণী ভূমিকা যে বিপ্লবের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে তা চোখে আঙুল দিয়ে যান্ত্রিক মার্কসবাদীদের সফল চীন বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে মার্কসবাদী তত্ত্বে মাও-এর নিজস্ব কিছু অবদান আছে তা অনস্বীকার্য।
কৃষিপ্রধান ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে তাই মাও সেতুং-এর প্রভাব অন্যান্য অনেক রথীমহারথীদের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি এটা ঠিক। প্রভাব না বলে আপনি জনপ্রিয়তাও বলতে পারেন। সেক্ষেত্রে কার্ল মার্কস বা লেনিন সাহেবকেও পেছনে ফেলবেন মাও। কিন্তু তা হলেও মাওবাদ কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকবেই। বস্তুত ইদানীং কখনো কখনো খুব মনে হয় যে ১৯৪৯-এ চীন বিপ্লবের সময় সেদেশের পরিস্থিতি মেনে একুশ শতকের ভারতে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখাটা বোধহয় একটু বেশিমাত্রায় রোমান্টিক। অ্যাডভেঞ্চারিজম তো বটেই। আজকের দিনে ঘাঁটি এলাকা, লাল ফৌজ, গেরিলা যুদ্ধ, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও বাস্তবে কতটা কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।
বস্তারে মাও রাজনীতির সবচেয়ে বড় পরীক্ষাগারে গিয়ে আমার মনে হয়েছে আবেগ, পরিশ্রম, দুর্জয় সাহস এসব বাদ দিলে কোথাও যেন পুরনো দিনের মাও পথকে অন্ধ অনুসরণ করার ঝোঁক খুবই চোখে লাগে। ওড়িশা, বিহার, অন্ধ্র, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় রাজ্যের যে সব এলাকায় মাওবাদী রাজনীতির প্রভাব রয়েছে সব জায়গাতেই জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আদিবাসী। উন্নয়নের তথাকথিত ঝলমলে ভারতে এই দলিত, আদিবাসীরাই সব থেকে বঞ্চিত। জল, জঙ্গল, জমি থেকে হাজারে হাজারে তারা নগরায়ণের নামে স্বাধীনতার পর থেকেই পিছু হটছেন। ফলে মাওবাদী রাজনীতির মূল সাফল্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে বড়মাপের গণআন্দোলন গড়ে তোলা। এ এক আদিবাসী বিদ্রোহ। তেলেঙ্গানার কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে বস্তারের জনযুদ্ধের মিল আছে। বস্তারের জঙ্গল বড় গভীর। ভালুক, চিতা, হায়েনার উৎপাত খুব। মাইলের পর মাইল হাঁটছি। দিন রাতে কম করে দশমাইল হাঁটা বাধ্যতামূলক। জল ফুটিয়ে খেতে হতো। খাওয়া বলতে দিনে ভাত তরকারি, রাতে রুটি সবজি। দশদিন বাদে একদিন ডিম পেয়ে খুব আনন্দ হয়েছিল। নদী, পাহাড় পার হচ্ছি গেরিলাদের সঙ্গে। ছোট ছোট স্কোয়াড। পিঠে রুকস্যাক, তারমধ্যে বাড়তি জামাকাপড় আর বই। পড়া কম্পালসারি। রাতে খোলা আকাশের নিচে ঘুম। ভুল বললাম, গাছের তলায় একটা নীল পলিথিন পেতে ঘুমিয়ে পড়া। থাকতে থাকতে শিখে গেছিলাম কেন বাঁশঝাড়ের নিচে শুতে নেই, কেন বট, অশ^ত্থ শোয়ার পক্ষে ভালো, দূর থেকে প্রাণীর ডাক শুনে বোঝা বিপদ আসছে কিনা আরও কত কিছুই যে শিখেছি, জীবনে ভুলব না। তাইতো কখনো কখনো ফিল্মের ক্লাসে ছাত্রদের বলি সব কথা তোমরা বইয়ে পাবে না। কীভাবে কঠিন পরিস্থিতিতে ডকুমেন্টারি বানাতে হয় তা বাস্তবে ক্যামেরা কাঁধে নিয়েই তোমাকে শিখতে হবে।
হাঁটছি আর গ্রাম দেখছি। শতাব্দী প্রাচীন এক একটা গ্রাম। মূলত গোন্দ জনজাতির বাস। গোন্দ ভারতের প্রাচীনতম বাসিন্দা। আদিতে এই জায়গা ছিল গন্দোয়ানা ল্যান্ড। তখন হিমালয় পর্বতমালার জন্ম হয়নি। অস্ট্রেলিয়া ছিল গন্দোয়ানা ভূখ-ের অংশ। ভূমিকম্পের ফলে অস্ট্রেলিয়া আলাদা হয়ে গেল। আজ মাও সেতুং-এর জন্মদিন। ফলে এলোমেলো অনেক কথা মনে পড়ছে।
লেখকঃ ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক
দেশে এখন জেলায় জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। এভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ইতিমধ্যেই প্রায় অর্ধশতে পৌঁছে গেছে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি বা বিশেষ অবদানের জন্য নয়, প্রশাসনের দুর্নীতি এবং শিক্ষার মান সংকট নিয়েই বছরজুড়ে এগুলোর কোনো না কোনোটি আলোচনায় থাকছেই। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়ম এর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া আর্থিক দুর্নীতি, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে ঘুষবাণিজ্য ও স্বজনপ্রীতির একের পর এক ঘটনা নিয়মিতই আসছে সংবাদমাধ্যমে। আরও দুঃখজনক বিষয় হলো ইদানীং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, শিক্ষক নিয়োগেই যদি অনিয়ম ও দুর্নীতি হয় তাহলে বিশ^বিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কীভাবে বাস্তবায়িত হবে? অনিয়মের মাধ্যমে আত্মীয় বা নিজ পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়া হলে নিয়োগপ্রাপ্ত ও নিয়োগদাতারা কোন নৈতিকতা নিয়ে শিক্ষকতা করবেন? অনিয়মে শিক্ষক হওয়া ব্যক্তি শিক্ষার্থীদেরই বা কী শেখাবেন?
রবিবার দেশ রূপান্তরে ‘প্রভাষক পদে ফেল করে হতে যাচ্ছেন সহকারী অধ্যাপক!’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (আইসিটি) বিভাগে প্রভাষক পদে একাধিকবার লিখিত পরীক্ষা দিয়ে ফেল করা এক প্রার্থী এবার লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সোমবার ওই বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে দুজনকে নিয়োগের জন্য মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার কথা রয়েছে নিয়োগ বোর্ডের। যাতে প্রভাষক পদের পরীক্ষায় ফেল করা ওই বিভাগেরই প্রভাবশালী এক শিক্ষকের স্ত্রীর নিয়োগ চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন বিভাগটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক। জানা গেছে, শিক্ষক নিয়োগের এ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে বেশ কয়েকজন প্রার্থী আবেদন করলেও বিভাগের প্ল্যানিং কমিটি শুধু চারজন প্রার্থীর জন্য সুপারিশ করে রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি পাঠান। এদের মধ্যে একজন বিভাগের প্রভাবশালী এক শিক্ষকের স্ত্রী। ওই শিক্ষক কুবি উপাচার্যের অতি ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তার স্ত্রী এর আগে একাধিকবার প্রভাষক পদে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে পারেননি। প্রভাবশালী ওই শিক্ষক আবার বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির সদস্য। নিয়ম অনুযায়ী প্রার্থীদের কেউ প্ল্যানিং কমিটির কোনো সদস্যের আত্মীয় হলে ওই প্রার্থীর বিষয়ে আলোচনার সময় ওই সদস্য প্ল্যানিং কমিটির সভায় থাকতে পারবেন না। অভিযোগ রয়েছে, ফেল করা ওই প্রার্থী যে কারও আত্মীয় সে বিষয়ে সভায় কোনো আলোচনাই হয়নি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিভাগীয় প্রধান ও প্ল্যানিং কমিটির সভাপতি ড. মো. সাইফুর রহমান ফোন কল কেটে দেন। কুবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নিয়ম দেখতে হবে। রেজিস্ট্রার ভালো বলতে পারবেন।’ কুবির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মো. আমিরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘এখানে শুধু মৌখিক পরীক্ষা হবে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগের জন্য কখনো লিখিত পরীক্ষা হয়নি। আমি আর কিছু জানি না।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালে শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনার পর সব নতুন নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা নিয়েছে কুবি। শুধু অভ্যন্তরীণ প্রার্থী যারা ইতিমধ্যে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন, তারা দ্বিতীয়বার কোনো পদে আবেদন করলে তাদের ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়েই কয়েকবার ফেল করা প্রার্থী এবার সহকারী অধ্যাপক পদে আবেদন করে শিক্ষক হতে যাচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে কাউকে অনিয়মের মাধ্যমে বিশেষ সুবিধা দিতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ ‘অন্ধ সেজে থাকার অনুরাগে’ নিয়মনীতি দেখতে না পাওয়া অথবা না জানার ভান করে কি পার পেতে পারে?
দুঃখজনক হলো, কেবল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ই (কুবি) নয়, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও আজকাল শিক্ষক নিয়োগে নিয়মবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। উপাচার্যের স্বজন বা কাছের লোক, প্রভাবশালীর আত্মীয়, রাজনৈতিক পরিচয়ে যোগ্যতা না থাকার পরও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন অনেকে। শিক্ষক পদের মানমর্যাদা রক্ষা এবং সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমন কর্মকা- এই সত্যই মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, জবাবদিহি না থাকা এবং অনিয়ম, অপরাধের বিচার না হওয়ার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো এমন লাগামহীন হয়ে পড়ছে। উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, জ্ঞানচর্চাকে গৌণ করে ফেলে এসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেন কেবল সার্টিফিকেট বিতরণ আর কর্মসংস্থানের প্রকল্পে পরিণত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি বদলাতে হলে কুবি’র আলোচিত নিয়োগ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন নিয়ে ও শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
প্রকাশক, শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক চিত্তরঞ্জন সাহার জন্ম নোয়াখালীতে ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি। বাবার নাম কৈলাশচন্দ্র সাহা এবং মা তীর্থবাসী সাহা। কাপড় ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান হয়েও ১৯৫১ সালে চৌমুহনীতে তিনি বইয়ের ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি চৌমুহনী থেকে ঢাকায় তার পুস্তক ব্যবসা স্থানান্তর করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি পুঁথিঘর প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী তার পুঁথিঘরের অফিস পুড়িয়ে দেয়। তিনি নিরাপত্তার জন্য কলকাতায় চলে যান। সেখানে তিনি ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ গড়ে তোলেন যা পরবর্তী সময়ে ‘মুক্তধারা’ নাম লাভ করে। তিনি নিজ উদ্যোগে ‘রক্তাক্ত বাংলা’ ও ‘বাংলাদেশ কথা কয়’ নামে দুটি সংকলন প্রকাশ করেন। তার উদ্যোগেই প্রথম বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে বইমেলার সূচনা হয়। পরে বাংলা একাডেমি একুশে বইমেলার প্রবর্তন করে। তিনি ২০০৫ সালে একুশে পদক ও বিদ্যাসাগর পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন সুলতান মাহমুদ। ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে ধানমন্ডি এলাকায় ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন এ শিক্ষক। এখনো সেই ফ্ল্যাটের ঋণ পুরোপুরি পরিশোধ হয়নি। সুলতানের ব্যবহৃত ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা দুটি। একটি বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংক আর অন্যটি প্রাইম ব্যাংকের।
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধা জানতে চাইলেন তিনি জানান, ফ্ল্যাটের কিস্তি পরিশোধ, সন্তানদের বেতন আর ফ্যামিলি খরচ পরিশোধ সব মিলিয়ে প্রায় প্রতি মাসের শেষেই আর্থিক সংকট তৈরি হয়। এ সংকট থেকে বাঁচতেই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন। তবে মাসের শুরুতে বেতন পেয়েই পরিশোধ করে দিচ্ছেন ক্রেডিট কার্ডের বিল। এতে অতিরিক্ত সুদও গুনতে হচ্ছে না তাকে।
সুলতান মাহমুদ বলেন, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার না করলে হয়তো প্রতি মাসেই আমার বিভিন্নজনের কাছ থেকে ধার করে চলতে হতো। এতে সম্মানহানিরও ঝুঁকি থাকে। কিন্তু এখন ব্যাংক থেকে স্বল্প সময়ের জন্য ধার নিয়ে তা আবার ফেরত দিচ্ছি। এতে কারও কাছে হাত পাততে হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, একসময় মানুষ ক্রেডিট কার্ডের প্রতি কম আগ্রহী হলেও বর্তমানে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে দেশের ৩৯টি ব্যাংক কার্ড সেবা দিচ্ছে। গত মার্চ শেষে এসব ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ লাখ ৭৮ হাজারটি। ঠিক চার বছর আগে ২০১৯ সালে মার্চ শেষে এ কার্ডের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৪৯ হাজারটি। অর্থাৎ মাত্র চার বছরের ক্রেডিট কার্ড বেড়েছে ৮ লাখ ২৮ হাজার বা ৬১ দশমিক ৪২ শতাংশ। এই একই সময়ে লেনদেনের পরিমাণও বেড়েছে। গত মার্চে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের মার্চে এ লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ চার বছরের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে ১৪৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
শুধু সুলতানই নন, ব্যবসায়ী আমিরুল, সাংবাদিক আক্তার আর চাকরিজীবী তারিকুলও একই কারণে ব্যবহার করছেন দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ক্রেডিট কার্ড। তাদের মতে, ক্রেডিট কার্ডের কারণে সহজ হয়েছে তাদের জীবনযাত্রা। তবে উল্টো চিত্রও আছে। করোনা মহামারীর সময় চাকরি হারানো আজাদুল ইসলাম ক্রেডিট কার্ডে ধার নিয়ে এখন বিপাকে রয়েছেন। তিনি বলেন, করোনার সময় প্রথম দিকে আমাদের বেতন কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়। সে সময় সংসারের খরচ বহন করতে ক্রেডিট কার্ডের সহায়তা নিয়েছেন। যে ঋণ এখন পর্যন্ত টানতে হচ্ছে তাকে। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ হবে বলে আশাবাদী এ গ্রাহক।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ক্রেডিট কার্ড জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে এর ‘ধার’ নেওয়ার পদ্ধতির জন্য। পাশাপাশি পণ্যের দামে ডিসকাউন্টের পাশাপাশি কিস্তিতে পরিশোধের পদ্ধতিও এ ব্যাপ্তি বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। যেটি গ্রাহককে এককালীন বেশি দামের পণ্য কিনতে সহায়তা করে। এবার জেনে নেওয়া যাক ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা-অসুবিধাগুলো।
পণ্য কিনতে কিস্তি সুবিধা : ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কিস্তিতে পণ্য কিনতে একসঙ্গে সব টাকা পরিশোধ করতে হবে না। বিনা সুদে বা নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদে গ্রাহক কয়েক মাসের সমান কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করতে পারবেন। যদিও গ্রাহক তার ক্রেডিট লিমিটের চেয়ে বেশি দামি পণ্য কিনতে পারবেন না। আর কিস্তির টাকাও পরিশোধ করতে হবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। এতে কারও কাছে টাকা ধার করার ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তবে পরিশোধের ক্ষেত্রে সময়সীমা পার হয়ে গেলে জরিমানা গুনতে হতে পারে।
ঋণের সুবিধা : কিছু ক্রেডিট কার্ড, বিশেষ করে বিদেশে শূন্য শতাংশ সুদে ঋণ দেয়। এসব ক্ষেত্রে মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য পরিশোধ করতে হয়, যা বেশ সুবিধাজনক। আবার কোনো কোনো কার্ডে ঋণে সুদের হার অনেক থাকে। এ ক্ষেত্রেও একটা সুবিধা আছে। বোঝা এড়াতে দ্রুত ঋণ পরিশোধ করা হয়। নিজস্ব ঋণ থাকে না।
পরিবর্তনযোগ্য : এসব ক্ষেত্রে সঠিক কার্ডটি বেছে নিতে পারা জরুরি। একটি ভুল কার্ড দিনের পর দিন ব্যবহার করলে ঋণের বোঝা শুধু বাড়তেই থাকবে। তবে এটা বুঝতে ব্যাংকের পুরো শর্তাবলি মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। যদিও কার্ডের ধরন পরিবর্তন করা যায় খুব সহজে। কারণ প্রতিটি ব্যাংকে বিভিন্ন প্রকারের ক্রেডিট থাকে। আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী কার্ড যেমন নিতে পারবেন তেমনি পরবর্তী সময়ে সেটির ধরন পরিবর্তনও করতে পারবেন। আবার নির্দিষ্ট পরিমাণ লেনদেন করলে বাৎসরিক ফি এড়ানো যায়। যেমন অনেক ব্যাংকের কার্ডে অন্তত ১৮ বার কেনাকাটা করলে বাৎসরিক ফি দিতে হয় না। ব্যাংকভেদে এ নিয়মের ভিন্নতা রয়েছে। দেশের বাইরেও ব্যবহার করা যায় : ক্রেডিট কার্ড ইন্টারন্যাশনাল হলে সেটি ব্যবহার করা যাবে বিশ্বের অনেক দেশেই। টাকার পাশাপাশি ডলারও ধার করে ব্যবহার করা যায়। হোটেল বুকিং, বিমানভাড়া, রেস্টুরেন্ট ও কেনাকাটায় মেলে নানা ছাড় ও পয়েন্ট জেতার সুযোগ। বিদেশে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে যা খরচ করবেন, মাস শেষে আপনার সেই পরিমাণ বিল হিসেবে ইস্যু করবে ব্যাংক। তারপর সুদ বা জরিমানা এড়াতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই বিল পরিশোধ করতে হবে।
অফারের ছড়াছড়ি
বিভিন্ন সময়ে ক্রেডিট কার্ডে বিভিন্ন অফার দেওয়া হয়। যেমন ‘ক্যাশ ব্যাক অফার’, ‘স্পেশাল ডিসকাউন্ট’। দেশের বাইরে বেড়াতে গেলে, হোটেলে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারে অনেক সময়ই মূল্যছাড় দেওয়া হয়। প্লেনের টিকিট কাটতেও অনেক সময় পাওয়া যায় বিশেষ মূল্যছাড়। আর অনলাইন কেনাকাটার জন্যও এখন ক্রেডিট কার্ড বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, নামিদামি হোটেল ও রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়ায় ছাড় এবং অফার দিয়ে থাকে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আবাসিক হোটেলগুলোও ক্রেডিট কার্ডে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকে। একটি কিনলে একটি ফ্রি (বাই ওয়ান গেট ওয়ান) অফারও দেওয়া হয়। এ ছাড়া রয়েছে মূল্যছাড়সহ নানা অফার। অনেকেই পরিবার নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে ঘুরতে যান। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও হোটেলের নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে হোটেল বুক করা যায়। এ ক্ষেত্রেও আপনি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারেন। তবে বিদেশে হোটেল বুকিংয়ের টাকা পরিশোধের ক্ষেত্রে ডুয়েল কারেন্সি ক্রেডিট কার্ড প্রয়োজন হবে।
অসুবিধা
ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনি অসুবিধাও কম নয়। এজন্য বেশ সতর্ক হতে হবে গ্রাহককে। একটু বেখেয়ালি হলেই পড়তে পারেন ঋণের ফাঁদে।
ঋণের ফাঁদ
ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার সবসময়ই একটি ঋণ নেওয়ার মাধ্যম। মনে রাখতে হবে অর্থ খরচের ৪৫ দিনের মধ্যে সেটি পরিশোধ করতেই হবে। অন্যথায় ঋণের ওপর সুদ শুরু হবে। যা ঋণের পরিমাণ প্রতিদিন বাড়িয়ে দেবে। তাই কিছুটা ঝুঁকি থেকেই যায়।
লুক্কায়িত ব্যয়
সুদের হার পরিশোধই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের একমাত্র ব্যয় নয়। সময়মতো মাসিক বিল পরিশোধ না করলে গ্রাহককে জরিমানা গুনতে হতে পারে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে নগদ অর্থ তুলতে এর জন্য নির্দিষ্ট হারে ফি দিতে হতে পারে। সরাসরি বুথ থেকে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে নগদ অর্থ উত্তোলন করতে গেলে বাড়তি ফি এবং ওইদিন থেকেই (এ ক্ষেত্রে ৪৫ দিন সময় দেওয়া হয় না) সুদ গণনা শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে চেক দিয়ে টাকা সঞ্চয় হিসেবে স্থানান্তর করে তারপর সেটি নগদায়ন করলে ৪৫ দিন সময় পাওয়া যাবে।
মহামারী করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বের প্রায় সব দেশই অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে জনসাধারণকে কিছুটা স্বস্তি দিতে ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়াসহ নীতিনির্ধারণী নানা ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে। বাংলাদেশও এমন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। বিদেশি মুদ্রার সংকটসহ মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে শর্তসাপেক্ষে ধার নেওয়া ছাড়াও আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এখনো এর সুফল মেলেনি। এমন সংকটের মধ্যেই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ বাজেট উপস্থাপন হতে যাচ্ছে।
এবারের বাজেট সব দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে সামনে নির্বাচন, অন্যদিকে বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক চাপে চিড়েচেপ্টা দেশের অর্থনীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম, আইএমএফের শর্তের জাল নানান বাস্তবতার মধ্যে আগামীকাল বৃহস্পতিবার ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বিশাল বাজেট প্রস্তাব পেশ করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) জন্য বরাদ্দ করা অর্থ পুরোপুরি খরচ করতে না পারার শঙ্কার মধ্যেই আরও বড় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বেশি। যদিও অর্থনীতিবিদরা এ বাজেটকে বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে মনে করছেন।
এবারের বাজেটের স্লোগান ‘উন্নয়নের দীর্ঘ অগ্রযাত্রা পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’। এটি মুস্তফা কামালের দায়িত্বকালে পঞ্চম, আওয়ামী লীগ সরকারের ২৩তম ও বাংলাদেশের ৫২তম বাজেট। ১ জুন সংসদে বাজেট প্রস্তাব পেশ করার কথা রয়েছে অর্থমন্ত্রীর। আজ বুধবার থেকে বাজেট অধিবেশন শুরু হতে যাচ্ছে।
দেশের অর্থনীতি যখন চাপের মুখে, তখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে ঋণ চেয়েছিল বাংলাদেশ। নানান চড়াই-উতরাই শেষে গত ৩০ জানুয়ারি ৪৭ কোটি ডলার ছাড়ও করে ঋণদাতা সংস্থাটি। কিন্তু ঋণ দেওয়ার আগে নানান শর্ত জুড়ে দেয় তারা। এর মধ্যে ‘দুর্বল’ এনবিআরকে সবল করার বিশেষ শর্ত ছিল। জিডিপির তুলনায় বাংলাদেশের কর আদায়ের হার ৯ শতাংশের মধ্যে। ৩৮টি শর্তের মধ্যে কর আদায় বাড়ানোর অন্যতম শর্ত ছিল তাদের। এবারের বাজেটেও কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই কর আদায়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আদতে কতটুকু বাস্তবসম্মত তা নিয়েও সন্দিহান তারা।
বাজেটের আয়ের খাত বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাজস্ব থেকে আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। বৈদেশিক অনুদানসহ এর আকার দাঁড়াবে ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। রাজস্ব বোর্ডের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রতি বছরের মতো এবারও বাড়ছে। এবারের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
এনবিআরবহির্র্ভূত কর ২০ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কর ব্যতীত অন্য আয় হবে ৫০ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক অনুদানের লক্ষ্যমাত্রা ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাজেটের যে লক্ষ্যমাত্রার হিসাব ধারা হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। গত বছরের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল সেটি থেকে বাড়িয়ে তারা বাজেট ধরছে। তবে আমি মনে করি, বাজেটে পাস হওয়ার পর তা কতটুকু কার্যকর হয়েছে সেই হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা হওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রার কতটা আদায় হয়েছে তা বিবেচনা করে নতুন করে বেশি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা বাস্তবসম্মত নয়। সম্পদ আছে মনে করে যদি ব্যয় কাঠামো তৈরি করা হয়, তাহলে যে অর্থ নেই তাকে ব্যয় মনে করে দেখানো হবে। তার মানে হলো, সম্পদ না থাকলে ব্যয়ও হবে না।’
ড. দেবপ্রিয় বলেন, ‘এই মুহূর্তে লোক দেখানোর মতো একটা হিসাব দেখা যায়। আয়ও হবে না, ব্যয়ও হবে না। আমার ভাষায় এটি পরাবাস্তব বাজেট।’
ব্যয়ের খাত : অন্যান্য বারের মতো এবারও আয়ের তুলনায় ব্যয়ের খাত বেশি হচ্ছে। এবারের ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। বাজেটে পরিচালন ব্যয় অর্থাৎ আবর্তক ব্যয়, মূলধন ব্যয়, অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ও বৈদেশিক ঋণের সুদসহ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। তাছাড়া এবারের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের (এডিপি) ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। এডিপিবহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পগুলোর ব্যয় ৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়ায় অনুদানসহ ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা।
ঘাটতি মেটানো হবে যেভাবে : বাজেটের ঘাটতি মেটানো হবে মূলত অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে। এবারের বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা প্রথমবারের মতো ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিদেশিক ঋণদাতাদের কাছ থেকে ঋণ আনার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।
অভ্যন্তরীণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের ভরসা এবারও ব্যাংক খাত। বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকেই নেওয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ঋণ। ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেবে ৮৬ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেবে ৪৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা।
তাছাড়া ব্যাংক থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হলেও এবারের বাজেটে ব্যাংকবহির্ভূত ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে। এবারের ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে সরকার ঋণ নেবে ২৩ হাজার কোটি টাকা। গত বছরও এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৫ হাজার কোটি টাকা। এবারের সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ঋণ নেবে ১৮ হাজার কোটি টাকা, আগের অর্থবছরে যা ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা।
জিডিপি : আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের বাজেটে সংশোধিত জিডিপির চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির আকার ৪৪ লাখ ৩৯ কোটি ২৭৩ কোটি টাকা। এবারের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ আর ভোক্তা মূল্যসূচক বা মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমান পরিস্থিতিতে জিডিপি ও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
আগামী অর্থবছরের বাজেট সরকারের জন্য সব দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফের যে ৩৮টি শর্ত রয়েছে, অর্ধেকের বেশিই বাস্তবায়ন করতে হবে এ অর্থবছরে। সরকারকে বেঁধে দেওয়া শর্তগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রিজার্ভের যথাযথ গণনা পদ্ধতি প্রণয়ন, প্রতি তিন মাস অন্তর জিডিপির হার নির্ধারণ, সুদের হারে করিডোর পদ্ধতি তৈরি, মুদ্রা বিনিময় হারের একটি দর রাখাসহ কয়েকটি শর্ত পূরণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলোর কিছু বাস্তবায়নের ঘোষণা আসবে আগামী জুন মাসে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময়, কিছু আসবে জুলাইয়ে। আইএমএফের চাওয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ।
ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়েই চলছে ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান। নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়েছে, তারপরও যেন ভাগ্যটা ফেরানো যাচ্ছিল না। পরাশক্তির তকমাটা খসে যায় গেল এক যুগে। লিগ শিরোপা তাদের কাছে শুধুই মরীচিকা। সাদা-কালোদের কাছে টুর্নামেন্টের শিরোপাও দূর আকাশের তারায় রূপ নিয়েছিল। সেখান থেকে মোহামেডানকে বলতে গেলে একাই শিরোপার স্বাদ দিয়েছেন ‘ঘরের ছেলে’ সুলেমান দিয়াবাতে। মালির এই স্ট্রাইকার টানা পাঁচ মৌসুম ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন মাঝারি মানের মোহামেডানকে। তার জাদুতে গতকাল ফেডারেশন কাপের মহা-ফাইনালে আবাহনীকে হারিয়েছে সাদা-কালোরা। এই অর্জন এসেছে অনেক অপেক্ষার পর। তাই তো এই শিরোপাকে মোহামেডানের ঘুরে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখছেন দিয়াবাতেও। বিশ্বাস করেন, এই শিরোপা বদলে দেবে মোহামেডানের চিন্তাধারাকে।
টাইব্রেকারে শিরোপা জয়ের পর ড্রেসিং রুমে সতীর্থদের হুল্লোড়ের মধ্যে ম্যাচসেরা, টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার নিয়ে এক কোনায় বসে দেশে পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন দিয়াবাতে। সেই ফাঁকেই সাংবাদিকদের কাছে জানালেন প্রতিক্রিয়া, ‘পেনাল্টি শুটআউটের আগ পর্যন্ত ম্যাচটা ভীষণ কঠিন ছিল আমাদের জন্য। আল্লাহ আমাদের সহায়তা করেছেন এই ট্রফিটি জিততে। তাই আমি অনেক খুশি। আমার ক্যারিয়ারে কোনো ফাইনালে প্রথমবারের মতো চার গোল করলাম। তাই সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।’ দিয়াবাতে বলেন, ‘৯ বছর পর আমি একা নই, সব খেলোয়াড় মিলে মোহামেডানকে একটা শিরোপা এনে দিয়েছি। বিশ্বাস ছিল ম্যাচে ফিরতে পারলে আমরাই শিরোপা জিতব, সেটাই হয়েছে। আমি এই অর্জন মালিতে থাকা আমার পরিবার, বিশেষ করে আমার মাকে উৎসর্গ করছি।’ শিরোপাটা মোহামেডানের অন্তর্বর্তীকালীন কোচ আলফাজ আহমেদের জন্যও বিশেষ অর্জন। ফুটবল ক্যারিয়ারে অসংখ্য আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ খেলেছেন এবং জিতেছেন। তবে এই জয়টাকে আলাদা করে রাখছেন তিনি, ‘আজকের খেলাটা অনেক বড় অর্জন। ব্যাকফুটে থেকে ফিরে আসা, ম্যাচ দেখে বোঝা যাচ্ছিল না কে জিতবে। দিয়াবাতে আসাধারণ ফুটবল খেলেছে। মুজাফ্ফারভের হাত ভেঙে দিয়েছিল, ওই অবস্থায়ও সে খেলা চালিয়ে গেছে। খেলোয়াড়দের কমিটম্যান্ট ছিল অসাধারণ। খেলোয়াড় হিসেবে আমি শিরোপা জিতেছি, এবার কোচ হিসেবে শীর্ষ পর্যায়ে প্রথম শিরোপা জিতলাম। তাই শিরোপাটাকেই আমি এগিয়ে রাখব।’ প্রথমার্ধে ২ গোলে পিছিয়ে পড়ার পরও হাল ছাড়েননি আলফাজ। শিষ্যদের শিখিয়েছেন মাথা ঠান্ডা রেখে পাল্টা জবাব দেওয়ার মন্ত্র, ‘প্রথমার্ধের খেলা শেষে শিষ্যদের বলেছি, তোমরা মাথা ঠা-া রেখে খেলো। তারা সেটাই করেছে।’
চোটে পড়ে মাঠ ছাড়া গোলকিপার সুজন সতীর্থ বিপুকে টাইব্রেকারে দারুণ পারফরম্যান্সের জন্য প্রশংসায় ভাসিয়েছেন, ‘মাঠ ছাড়ার এক মিনিটের মধ্যে আবাহনী যখন গোল পরিশোধ করল, তখন ভীষণ খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমরা আর পারব না। তবে আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে বিপু। আমি তাই অনেক বেশি খুশি।’
বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশের প্রয়োজনীয়তার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুসলিম উম্মাহকে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে তাদের সন্তানদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার ক্ষেত্রে আরও বেশি বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) ক্যাম্পাসে ৩৫তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমাদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য আরও বেশি পরিমাণে বিনিয়োগ করতে হবে।’
মুসলমানদের যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ রয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির উন্নয়নে যথাযথভাবে এই সম্পদ ব্যবহার করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, আমরা এটা করতে পারব।’ তিনি আরও বলেন, ‘যখনই আমি ওআইসি সদস্য দেশে যাই, তাদের আমি এই অনুরোধই করি।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘ইসলামের স্বর্ণযুগে বিশ^সভ্যতা, বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন, রসায়ন, গণিত, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোলসহ জ্ঞানের আরও অনেক শাখায় মুসলিম স্কলারদের ব্যাপক অবদান রয়েছে, যা আমাদের মুসলিমদের ঐতিহ্যের গৌরবময় ইতিহাস গড়েছে। সেই যুগের মুসলিম স্কলাররা সংস্কৃতি, জ্ঞান অর্জন, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং সমসাময়িক সাহিত্যে বিশে^ আধিপত্য বিস্তার করেছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেই অবস্থান থেকে বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর এই পিছিয়ে থাকার কারণগুলো আমাদের বিশ্লেষণ করা দরকার।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতির অভাব, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভাব এবং অন্য অনেক বিষয় মুসলিম উম্মাহর পতনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি এই হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য আমাদের মুসলিম উম্মাহকে মতভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি মুসলিম দেশগুলোকে, বিশেষ করে তাদের নিজস্ব শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও বিজ্ঞান এবং আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, আধুনিক যুগে মুসলিমরা মাত্র তিনটি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এটাই এই আধুনিক যুগে গবেষণা, প্রযুক্তি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর অবদানের প্রকৃত উদাহরণ। তিনি অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, ‘মুসলিম জাতির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে জোরালো প্রচেষ্টা প্রয়োজন, যাতে করে তারা এ ক্ষেত্রে আরও অবদান রাখতে পারেন।’
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব দ্বারা উপস্থাপিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মুসলিম সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়া উচিত নয়; বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, ইন্টারনেট অব থিংস, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও অন্যান্য খাতে।
ওআইসির মহাসচিব ও ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) চ্যান্সেলর হিসেন ব্রাহিম তাহার সভাপতিত্বে এতে স্বাগত বক্তব্য দেন আইইউটির ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। এ ছাড়া এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ও শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনিও বক্তব্য দেন।
সমাবর্তনে ২০২১ এবং ২০২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের স্নাতক, মাস্টার্স, পিএইচডি এবং ডিপ্লোমা ডিগ্রি দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের অসামান্য ফলাফলের জন্য দুই ধরনের স্বর্ণপদক আইইউটি স্বর্ণপদক এবং ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়েছে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে আইইউটির ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তার অর্থায়নে আইইউটির নবনির্মিত মহিলা হলেরও উদ্বোধন করেন।।
ক্রেডিট কার্ড একটি লাইফস্টাইল পণ্য। বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যাংক এখন ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করছে। বাংলাদেশে ইস্যুকৃত মোট ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা ২২ লাখ কিন্তু একক (ইউনিক) গ্রাহক সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। ক্রেডিট কার্ড পুরোপুরি জামানতবিহীন পার্সোনাল ঋণ হলেও ঋণ পরিশোধের হার খুব সন্তোষজনক। গ্রাহক পর্যায়ে একটি ক্রেডিট কার্ড দিতে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী বেশ কিছু অত্যাবশ্যক কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়। এটিকে ঋণ হিসেবে না দেখে লাইফস্টাইল পণ্য হিসেবে দেখে এর আবশ্যকীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা কিছুটা শিথিল করা হলে ক্রেডিট কার্ড ব্যাপ্তি অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। তখন নিম্ন আয়ের মানুষরাও ক্রেডিট কার্ড নিতে পারবেন, যা ক্যাশলেস সোসাইটি গঠনের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করবে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা দ্রুতগতিতে ডিজিটাল আর্থিক লেনদেনে রূপান্তরিত হচ্ছে। ক্যাশলেস বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ডিজিটাল লেনদেনে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে যেমন পিওএস, এটিএম, সিআরএম, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, কিউআর কোড ইত্যাদি। বিগত বছরগুলোতে ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২১ সালের মার্চ মাসে ইন্টারনেট ব্যাংকিং এবং ই-কমার্সের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার কোটি টাকা, ২০২২ সালে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালের মার্চ মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। তাই বলা যায়, প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুতগতিতে অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে প্রথাগত আর্থিক লেনদেনের পাশাপাশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা।
তুলনামূলক কম ব্যবহারকারী
আমাদের দেশে তুলনামূলকভাবে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক কম। দেশে ইস্যুকৃত ডেবিট কার্ডের সংখ্যা ৩ কোটি ১০ লাখ যেখানে ইস্যুকৃত ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যার মধ্যে যে বড় ব্যবধান, এর প্রধান এবং অন্যতম কারণ হলো ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে কাগজপত্র জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা। এছাড়া রয়েছে ক্রেডিট কার্ড সম্পর্কে গ্রাহকদের প্রচলিত বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা।
ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়াতে হলে আগে কার্ড ব্যবহারের ইকোসিস্টেম প্রসারিত করতে হবে। কিউ-আরকোড এবং অ্যাপসভিত্তিক লেনদেন বৃদ্ধি পেলে পুরো দেশে ক্রেডিট কার্ড তথা সামগ্রিকভাবে কার্ডের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়বে।
ব্যবহারকারী কারা
ব্যাংকগুলো চাকরিজীবী এবং ব্যবসায়ী উভয় শ্রেণির গ্রাহকদের ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করছে, তবে এক্ষেত্রে চাকরিজীবীদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ক্রেডিট কার্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ঋণের সহজলভ্যতা এবং সুবিধাজনক পরিশোধ ব্যবস্থা। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রমোশনাল অফার যেমন ইএমআই, ক্যাশব্যাক ডিসকাউন্টসহ বাই ওয়ান গেট ওয়ান, ইন্স্যুরেন্স, রিওয়ার্ড পয়েন্ট, মিট অ্যান্ড গ্রিট, লাউঞ্জ সুবিধা ইত্যাদি।
ঋণ শোধের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়
ক্রেডিট কার্ড আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য পণ্য হয়ে উঠেছে। এটি নিতে হলে ঋণ পরিশোধের যোগ্যতার প্রমাণের সঙ্গে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রমাণও দাখিল করতে হয়। দেশে এখন রিটার্ন জমা দেওয়ার হার বেড়েছে। সবাই প্রতি বছর তার আয়কর রিটার্ন জমা দেয়। কিন্তু অনেকে অসাবধানতাবশত আয়কর রিটার্ন জমা দেয় না। তাছাড়া অনেকের করযোগ্য আয় না থাকায় তারাও রিটার্ন জমা দেয় না। যা ক্রেডিট ইস্যু করার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও প্রভাব বিস্তার করছে বলে মনে করি।
জীবন সহজ করছে ক্রেডিট কার্ড
ক্রেডিট কার্ড আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। এটির ব্যবহারও অত্যন্ত সহজ। ক্রেডিট কার্ড বিলম্বিত বিল পরিশোধের ভিত্তিতে কাজ করে, যার অর্থ আপনি এখন আপনার প্রয়োজনে কার্ড ব্যবহার করে অর্থ ব্যয় করতে পারেন এবং পরে তা সুবিধামতো সময়ে পরিশোধ করতে পারেন। ব্যবহৃত অর্থ গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে ডেবিট হয় না। এভাবে গ্রাহক প্রতিবার তার প্রয়োজনে কার্ড ব্যবহার করতে পারেন, যা আমাদের জীবনযাত্রাকে অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল করে তুলেছে। একজন গ্রাহক যদি নিয়মিত সঠিক সময়ে তার ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ করেন তাহলে কখনোই সেই গ্রাহক ঋণগ্রস্ত হবেন না। ব্যাংকগুলোর শক্তিশালী মনিটরিং ও রিকভারি ব্যবস্থা থাকার কারণে এই সেক্টরের খেলাপি ঋণের হার তুলনামূলক অনেক কম।
নিরাপত্তায় প্রয়োজন সচেতনতা
ডিজিটাল পেমেন্টগুলো সাধারণত বিভিন্ন ব্যবহারিক কারণে অফলাইন পেমেন্টের চেয়ে বেশি নিরাপদ। যেমন নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি না থাকা, চুরি, জালিয়াতির আশঙ্কা কম থাকা। ডিজিটাল লেনদেনে গ্রাহকের যে ধরনের সচেতনতা প্রয়োজন
কার্ড নম্বর, কার্ডের পেছনের ৩ সংখ্যার কার্ড ভেরিফিকেশন ভ্যালু (CVV2), ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (OTP), মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এবং নিরাপত্তা পিন কারও সঙ্গে বিনিময় না করা।
সন্দেহজনক কোনো ওয়েবসাইটে ই-কমার্স লেনদেন থেকে বিরত থাকা ও কার্ডের তথ্য সংরক্ষণ থেকে বিরত থাকা।
সন্দেহজনক কোনো ই-মেইল অথবা এসএমএসে থাকা লিঙ্কে প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকা।
সাইবার সংক্রান্ত ঝুঁকি বিবেচনায় ডিজিটাল ডিভাইসের সব সফটওয়্যার হালনাগাদ রাখা এবং নিরাপত্তা সফটওয়্যার ব্যবহার করা।
যেকোনো সন্দেহজনক লেনদেন অতিসত্বর ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ব্রাঞ্চ অথবা ব্যাংকের কল সেন্টারে অবহিত করা।
কার্ড হারানোর পরপরই ব্যাংকের কল সেন্টারে অবহিত করা।
সাধারণত, অধিকাংশ ব্যাংকই নির্দিষ্ট লেনদেনের পরিমাণের ভিত্তিতে ক্রেডিট কার্ডের বার্ষিক ফি সম্পূর্ণ বা আংশিক মওকুফ করে দিয়ে থাকে, যার ফলে এটি গ্রাহকের ওপর বাড়তি কোনো চাপ সৃষ্টি করে না। ক্রেডিট কার্ড একটি লাইফস্টাইল পণ্য, বিশ্বের অন্যান্য দেশের ক্রেডিট কার্ডের সুদের হারের তুলনায় বাংলাদেশে তা অপেক্ষাকৃত অনেক কম। তবে ব্যাংকগুলো সেটেলমেন্টের দিন থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ দিন পর্যন্ত বিনাসুদে বিল পরিশোধের সুযোগ দিয়ে থাকে। তাই যদি কোনো গ্রাহক বুঝে সচেতনভাবে নিয়মিত বিল পরিশোধ করে তবে এটা কিন্তু গ্রাহকদের জন্য একটি চমৎকার সুযোগ।
গ্রাহকদের বিভিন্ন চাহিদার কথা মাথায় রেখে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন উৎসবে নানা ধরনের অফার দিয়ে থাকে যার ফলে গ্রাহক বেশি বেশি লেনদেন করতে উদ্বুদ্ধ হয় যা ব্যবসায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতিতে জোর করে হারানো হয়েছে।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভিন্ন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের যেকোনো আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটির ভোটে যে সংসদ সদস্য দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার তথ্য মিলবে তাকেই বাদ দেওয়া হবে। এ সিটি ভোটে হারের কারণ জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব একটি সংস্থাকে নির্ভুল তথ্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্বও পেতে পারেন আজমত, ওই সূত্র দাবি করে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
নানা অব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তির আওতায় এসেছে অনেক আগে। এরপর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজ অনেকটাই আটকে আছে। খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে চরম দুরবস্থার কথা। গবেষয়ণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু কাজ করার চেষ্টা করলেও কথায় কথায় তাদের ওপর নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। মানের উন্নয়ন না হলেও ঠিকই অধিদপ্তরে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সম্প্রতি এই গবেষণা করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেখানে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। করোনাকালে বন্ধের প্রভাবে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের গড় হার ৫১ শতাংশের বেশি, যা আগে ছিল ৬৮ শতাংশের মতো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও ক্ষতি বেড়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এ ধরনের গবেষণার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখেই তা করা হয়েছে। আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদন দু-এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা অন্তত এক বছরের জন্য রেমিডিয়াল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা দিন দিন পিছিয়ে পড়লেও সেদিকে তেমন একটা নজর নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। তারা ব্যস্ত আছে লাখ লাখ শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন নিয়ে। কেউ কথা বললেই তার ওপর নেমে আসছে শাস্তি। ফলে শিক্ষকরাও দিন দিন তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন; কোনো রকমে দিন পার করছেন।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্ভাবনী ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন রাজবাড়ী জেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিক নির্বাচিত হন। সাধারণত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থীদের পদক দেওয়া হয় একই অনুষ্ঠানে। কিন্তু করোনাকালে তাদের হাতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষক পদক তুলে দেওয়া যায়নি। গত ১২ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তাই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে স্বাভাবিকভাবে তারা দাবি তুলেছিলেন, দেরি হলেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তারা পদক নেবেন; যা তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে ঠিকই পদক নেন। তবে এর ৬৮ দিনের মাথায় এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবি তোলায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ঘটনায় জয়পুরহাটের হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ পদক নিতে ১১ মার্চ ঢাকা এসেছিল। ওই শিক্ষকও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের কাউকে শোকজ করা হয়নি; যা বিধিবহির্ভূত বলছেন শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেদিকেই আমরা যাব।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক নেওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে সেরা প্রাপ্তি। এ জন্য শিক্ষকদের দাবি থাকতেই পারে, প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। শিক্ষকদের যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। এর প্রভাব অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বন্ধ থাকা প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখতে কিছু শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন; যাতে অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনাসহ নানা কাজ করা হয়। এতে প্রতিটি ফেসবুক গ্রুপে লাখ থেকে হাজারো শিক্ষক যুক্ত হয়েছেন। এখনো সেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সেই গ্রুপগুলোকেই এখন শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে যুক্ত থাকা অনেক শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাকেই দেওয়া হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ)। সরকার যেখানে শিক্ষকদের ডিজিটালি আপডেট হওয়ার কথা বলছে, সেখানে প্রায় অনেকটাই উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে আসন গেড়ে বসেছেন কিছু কর্মকর্তা। অনেকেই ৬ থেকে ১২ বছর ধরে একই দপ্তরে চাকরি করছেন। তাদের যে দায়িত্বই থাক না কেন যত লাভজনক কাজ আছে, সেগুলোতেই তারা হাত দিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে আনলে তাদের সরে যেতে হবে, এ জন্য তারা নানাভাবে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিয়ে মাঠপর্যায়ে শাস্তি দিয়ে সবাইকে ভীত করে তুলছেন। এতে পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত মার্চ-এপ্রিলে অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। যদিও নিয়ম ছিল, অনলাইনে নির্দিষ্ট মানদন্ড পূরণ ছাড়া কেউ বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু তা মানেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিয়ম ভেঙে কয়েক শো শিক্ষকের বদলির আদেশ জারি করা হয়। আর এই বদলি-পদায়নে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের; যা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আবার অনেক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলিতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। কাউকে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও অনেক দূরে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন।
জানা যায়, চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। আর আগামী বছর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সাল থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। কিন্তু তা পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই অধিদপ্তরের। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আসলে এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছে বা এ জন্য আর কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তেমন নজর নেই।
এ ছাড়া এখনো প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেডে। দুই ধরনের প্রায় চার লাখ শিক্ষকই ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারাও দীর্ঘদিন ধরে নবম গ্রেডের দাবি করছেন। আর মাঠে কাজ করা এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদোন্নতিও নেই বললেই চলে। কিন্তু এগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের; যা প্রাথমিকের মান উন্নীতের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনো মফস্বলে বা দুর্গম অঞ্চলের অনেক স্কুলেই এক-দুজন শিক্ষক। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ তিন-চার বছর ধরে শূন্য। শিক্ষক না থাকলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের একটু আলাদা যতœ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলোও হচ্ছে না। শিক্ষকরাও তাদের বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। সব মিলিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছি না।’
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতি জোর করে হারানো হয়েছে।
গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন তেমনি যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন জায়েদা খাতুন।
তিনি ঘড়ি প্রতীকে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাতে রির্টানিং কর্মকর্তা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
নির্বাচনের অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ ৭ হাজার ২০৬ ভোট, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন-অর-রশীদ ২ হাজার ৪২৬ ভোট এবং হাতি প্রতীকের সরকার শাহনূর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) নির্মিত হয়েছে বিশেষ কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘ও ভোরের পাখি’। ঈমাম হোসাইনের প্রযোজনায় এটি উপস্থাপনা করেছেন তামান্ন তিথি। অনুষ্ঠানটিতে আবৃত্তি করেছেন আশরাফুল আলম, মীর বরকত, রফিকুল ইসলাম, পলি পারভিন, শাকিলা মতিন মৃদুলা, মাসকুর-এ সাত্তার কল্লোল, আসলাম শিশির, সংগীতা চৌধুরী, আহসান উল্লাহ তমাল। প্রচারিত হয় ২৫ মে সকাল সাড়ে ৯টায়।
এছাড়াও নির্মিত হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘আমারে দেবো না ভুলিতে’। অনুষ্ঠানটিতে গান, কবিতা ও আলোচনার সমন্বয়ে কবিকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও বাচিকশিল্পীদের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। ইয়াসমিন মুসতারী, সালাউদ্দিন আহমেদ, শেলু বড়ুয়া, ছন্দা চক্রবর্ত্তী ও ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছেন প্রফেসর মুন্সী আবু সাইফ। মনিরুল হাসানের প্রযোজনায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছে ২৫ মে দুপুর ১ টা ০৫ মিনিটে। আরও প্রচারিত হবে সংগীতানুষ্ঠান ‘দোলনচাঁপা’ ও ‘সন্ধ্যামালতী’। রাত ৯টায় প্রচারিত হবে নাটক ‘বনের পাপিয়া’ (পুনপ্রচার)।