
গত শতকের ষাট সত্তর দশকে, পৃথিবীর ছবিটা ছিল অন্যরকম। তখন দুনিয়াজুড়ে বামপন্থি রাজনীতির বিপুল দাপট। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার সর্বত্রই বাতাসে বারুদের গন্ধ। আমার দেশও পিছিয়ে নেই। আমরা বড় হচ্ছি, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও, কমরেড মাও-এর চিন্তাধারা শুনতে শুনতে। দেয়ালে দেয়ালে মাও-এর মুখ। জ্বলজ্বলে পোস্টারে জানান দেওয়া হচ্ছে, চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান...।
আবেগের আতিশয্যে কোনো কোনো বিপ্লবী রেড বুক সাক্ষী রেখে বিয়ে অবধি সেরে ফেলতেন। গায়ক অজিত পান্ডে একই ভাবে লাল কেতাব হাতে নিয়ে, প্রেসিডেন্সি কলেজের পোর্টিকোতে বিয়ে করে অনেকের চোখে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন। আজকের পৃথিবী বদলে গেছে। দক্ষিণপন্থি রাজনীতির রমরমা একটা দুটো দেশ বাদ দিয়ে সব জায়গায়। খোদ চীনেও বাজার অর্থনীতির দাপটে সমাজতন্ত্র আদৌ টিকে আছে কি-না তা নিয়েই যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। মাও সেতুং নিয়ে কোনো চর্চাও নিজের দেশেই যেখানে নেই, সেখানে তার তিন দুনিয়ার তত্ত্ব বা গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাওয়ের রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা কতটা তা নিয়ে প-িতেরা আলোচনা করুন। আমরা বরং এদেশে মাওবাদী রাজনীতি নিয়ে যে বিরাট জল্পনা তা নিয়ে একটু-আধটু কথা বলি।
এ লেখা একাধারে ডায়েরি, রিপোর্টাজ, এলোমেলো চলতে চলতে দেখা থেকে। আসলে ডকুমেন্টারি ফিল্ম মেকার হিসেবে ভারতের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়কে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। এদেশে যারা মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি করেন বা দাবি করেন যে তারাই আসল মাও রাজনীতির ধারক, তারা রাষ্ট্রের কাছে অত্যন্ত বিপজ্জনক শক্তি। এখন তো আর্বান নকশাল শব্দটি রাজনৈতিক ডিসকোর্সে ঢুকে পড়েছে। স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, তাদের নিয়ে লেখালেখি করাও দেশের পক্ষে গর্হিত কাজ। আমি যে সময়ের কথা বলব তখন অবশ্য মাও শব্দটি এমন নিষিদ্ধ ছিল না। কিন্তু তখনো বস্তার, দ-কারণ্য এলাকায় উপদ্রুত ঘোষণা হয়ে গেছে। তল্লাটজুড়ে আধা সামরিক বাহিনীর বিপুল জমায়েত। তার মধ্যেই গড়ে উঠেছে মাওবাদী সংগঠনের গোপন গেরিলা ঘাঁটি।
খানিকটা ঝোঁকের মাথায় ঠিক করে ফেলেছিলাম যে নিষিদ্ধ এই বামদের নিয়ে একটা ছবি করব। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছিল যে এদেশের সবকটি বাম দলের কর্মসূচি, দলিল, চিন্তাভাবনা নিয়েই একধরনের ভিজ্যুয়াল প্রবন্ধ লিখব যা ভবিষ্যতে গবেষণার কাজে লাগবে। অন্য দলগুলো নিয়ে কাজ করা অনেক সহজ বলে প্রথমেই ঠিক করে নিলাম, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার পক্ষে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক মাওবাদী গেরিলাদের নিয়েই শুরু করব। ভাবা সহজ। কাজটা কঠিন। কুড়ি একুশ বছর আগেও গোপন ঘাঁটিতে গিয়ে শ্যুটিং করা ছিল অকল্পনীয়। একে তো মাওবাদীদের দিক থেকে ছাড়পত্র নাও মিলতে পারে। তারপর যদি তারা অনুমতি দিল, কিন্তু সরকার তো ছাড়বে না। এ একেবারে মারীচের মতো অবস্থা। হয় রামে না হয় রাবণে মারবে।
যাই হোক, অনেক কষ্টে, কাঠখড় পুড়িয়ে প্রায় এক বছর ধরে চেষ্টার পর বস্তার দ-কারণ্যের গভীর জঙ্গলে মাওবাদী ডেরায় গিয়ে শ্যুটিংয়ের অনুমতি পেলাম। একমাস ছিলাম গোপন ঘাঁটিতে। কীভাবে যে এখনো বেঁচে আছি, মাঝেমধ্যে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করি। এক এক সময় এখন ভাবি, জীবন বাজি রেখে ডকুমেন্টারি করতে যাওয়ার পেছনে বোধহয় ছিল শৈশব কৈশোরে অবচেতনে মাও-এর প্রভাব। আগেই বলেছি যে, তখন তো এক অন্য সময়। বিশ্বে এনেছে নতুন দিন, মাও সে তুং আর হো চি মিন।
তখন অবশ্য মাওবাদ ছিল না। বলা হতো মাও চিন্তাধারা। সারা বিশ্বে দিচ্ছে নাড়া কমরেড মাও-এর চিন্তাধারা। এদেশে নকশালপন্থিদের দুটো গোষ্ঠী এমসিসি বা মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র ও সিপিআই-এমএল জনযুদ্ধ এই টার্মটা সামনে আনে মাওবাদ। পরে দুই গোষ্ঠী এক হয়ে নতুন পার্টির নাম রাখে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)।
বাদ না চিন্তা তা বিতর্ক রয়েছে। নকশালপন্থিদের বড় অংশ মাওবাদ বলে কিছু হতে পারে বলে বিশ্বাস করে না। প্রথম কথা দ্বান্দ্বিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে মার্কসবাদী তাত্ত্বিকতায় বৈপ্লবিক চিন্তা, শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের যে নীতি ও কৌশল তার থেকে মাও রাজনীতির নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ফারাক যথেষ্ট। মাও তৃতীয় বিশ্বে কৃষকদের অগ্রণী ভূমিকা যে বিপ্লবের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে তা চোখে আঙুল দিয়ে যান্ত্রিক মার্কসবাদীদের সফল চীন বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে মার্কসবাদী তত্ত্বে মাও-এর নিজস্ব কিছু অবদান আছে তা অনস্বীকার্য।
কৃষিপ্রধান ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে তাই মাও সেতুং-এর প্রভাব অন্যান্য অনেক রথীমহারথীদের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি এটা ঠিক। প্রভাব না বলে আপনি জনপ্রিয়তাও বলতে পারেন। সেক্ষেত্রে কার্ল মার্কস বা লেনিন সাহেবকেও পেছনে ফেলবেন মাও। কিন্তু তা হলেও মাওবাদ কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকবেই। বস্তুত ইদানীং কখনো কখনো খুব মনে হয় যে ১৯৪৯-এ চীন বিপ্লবের সময় সেদেশের পরিস্থিতি মেনে একুশ শতকের ভারতে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখাটা বোধহয় একটু বেশিমাত্রায় রোমান্টিক। অ্যাডভেঞ্চারিজম তো বটেই। আজকের দিনে ঘাঁটি এলাকা, লাল ফৌজ, গেরিলা যুদ্ধ, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও বাস্তবে কতটা কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।
বস্তারে মাও রাজনীতির সবচেয়ে বড় পরীক্ষাগারে গিয়ে আমার মনে হয়েছে আবেগ, পরিশ্রম, দুর্জয় সাহস এসব বাদ দিলে কোথাও যেন পুরনো দিনের মাও পথকে অন্ধ অনুসরণ করার ঝোঁক খুবই চোখে লাগে। ওড়িশা, বিহার, অন্ধ্র, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় রাজ্যের যে সব এলাকায় মাওবাদী রাজনীতির প্রভাব রয়েছে সব জায়গাতেই জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আদিবাসী। উন্নয়নের তথাকথিত ঝলমলে ভারতে এই দলিত, আদিবাসীরাই সব থেকে বঞ্চিত। জল, জঙ্গল, জমি থেকে হাজারে হাজারে তারা নগরায়ণের নামে স্বাধীনতার পর থেকেই পিছু হটছেন। ফলে মাওবাদী রাজনীতির মূল সাফল্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে বড়মাপের গণআন্দোলন গড়ে তোলা। এ এক আদিবাসী বিদ্রোহ। তেলেঙ্গানার কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে বস্তারের জনযুদ্ধের মিল আছে। বস্তারের জঙ্গল বড় গভীর। ভালুক, চিতা, হায়েনার উৎপাত খুব। মাইলের পর মাইল হাঁটছি। দিন রাতে কম করে দশমাইল হাঁটা বাধ্যতামূলক। জল ফুটিয়ে খেতে হতো। খাওয়া বলতে দিনে ভাত তরকারি, রাতে রুটি সবজি। দশদিন বাদে একদিন ডিম পেয়ে খুব আনন্দ হয়েছিল। নদী, পাহাড় পার হচ্ছি গেরিলাদের সঙ্গে। ছোট ছোট স্কোয়াড। পিঠে রুকস্যাক, তারমধ্যে বাড়তি জামাকাপড় আর বই। পড়া কম্পালসারি। রাতে খোলা আকাশের নিচে ঘুম। ভুল বললাম, গাছের তলায় একটা নীল পলিথিন পেতে ঘুমিয়ে পড়া। থাকতে থাকতে শিখে গেছিলাম কেন বাঁশঝাড়ের নিচে শুতে নেই, কেন বট, অশ^ত্থ শোয়ার পক্ষে ভালো, দূর থেকে প্রাণীর ডাক শুনে বোঝা বিপদ আসছে কিনা আরও কত কিছুই যে শিখেছি, জীবনে ভুলব না। তাইতো কখনো কখনো ফিল্মের ক্লাসে ছাত্রদের বলি সব কথা তোমরা বইয়ে পাবে না। কীভাবে কঠিন পরিস্থিতিতে ডকুমেন্টারি বানাতে হয় তা বাস্তবে ক্যামেরা কাঁধে নিয়েই তোমাকে শিখতে হবে।
হাঁটছি আর গ্রাম দেখছি। শতাব্দী প্রাচীন এক একটা গ্রাম। মূলত গোন্দ জনজাতির বাস। গোন্দ ভারতের প্রাচীনতম বাসিন্দা। আদিতে এই জায়গা ছিল গন্দোয়ানা ল্যান্ড। তখন হিমালয় পর্বতমালার জন্ম হয়নি। অস্ট্রেলিয়া ছিল গন্দোয়ানা ভূখ-ের অংশ। ভূমিকম্পের ফলে অস্ট্রেলিয়া আলাদা হয়ে গেল। আজ মাও সেতুং-এর জন্মদিন। ফলে এলোমেলো অনেক কথা মনে পড়ছে।
লেখকঃ ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক
নিয়মটা তো এই রকমেরই ধেয, একপক্ষ জয়ী হলে অন্যপক্ষ পরাজিত হবে এবং এ নিয়মেও মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত যে, জয়ীর সংখ্যা হবে অল্প, পরাজিতদের সংখ্যা অধিক। তা বাংলাদেশে জয়ী হয়েছে কারা, কারা ওই অল্পসংখ্যক লোক যারা পরাজিত করেছে বিপুলসংখ্যক দেশবাসীকে?
এ প্রশ্নের মীমাংসা মোটেই জটিল নয়, বরং খুবই সহজ। যেদিকে তাকাই দেখতে পাব জয়ীদের এবং সঙ্গে সঙ্গে দূরে নয়, কাছেই, বলা যাবে পাশেই চোখ পড়বে পরাজিতদের। এই শহরে তিন কোটি টাকা দামের গাড়িও চলে। দাম জানি না, নিরূপণের সুযোগ নেই, যারা জানেন তারা বলেন। এরাই তো জয়ী, এই বিত্তবানরা। আর পাশেই, ওই গাড়ি যখন যানজটের জন্য থেমে যায় তখনই চোখে পড়বে জীর্ণশীর্ণ কিশোরীকে, যে ফুল বিক্রি করে, তিনশ নয়, তিরিশও নয়, তিন টাকা পেলেই বর্তে যায়। এই যে তিন কোটি টাকা ও তিন টাকা এ কোনো স্থির ছবি নয়, সহ-অবস্থানের চমৎকার দৃশ্য বলা যাবে না একে, এ হচ্ছে তিন কোটিওয়ালার নিপীড়ন ও অপমান, তিন টাকাওয়ালাকে। তিন কোটির মালিক অল্প কয়েকজন, তিন টাকার কাঙাল অসংখ্য, লাখ লাখ।
এই জয়, এই পরাজয়, এ কোনো নতুন ব্যাপার নয়। কিন্তু জয়ী এবং পরাজিতের মধ্যে ফারাকটা বাড়ছে, দিনে দিনে, বছরে বছরে। গ্রামে কাজ নেই, আশ্রয়ও নেই, নিরুপায় মানুষ উপায়ের খোঁজে শহরে আসে, এসে বস্তিতে ওঠে তারপর বস্তিতে এক দিন আগুন লাগে, সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়, নিঃস্ব হয়ে পড়ে। বস্তিবাসী গ্রামে পরাজিত হয়ে যে শহরে এসেছিল; শহরে হেরে গিয়ে সে কোথায় চলে যায়, কে জানে। যেখানে বস্তি ছিল সেখানে বিজয় উঠতে বিলম্ব ঘটে না, দর্পিত অ্যাপার্টমেন্ট কিংবা আত্মসন্তুষ্ট বিপণি বিতান দাঁড়িয়ে যায়, জয়ীদের জয়ের তালিকা যেমন, তেমনি পরাজিতদের পরাজয়ের তালিকাও প্রসারিত হতে থাকে, পরস্পর বিরুদ্ধ ফলাফল তৈরি করে দিয়ে। ছোট ব্যবসায়ীদের বাজারটা পুড়ে যায়, যাতে বড় ব্যবসায়ীরা সেখানে আরও বড় বাজার খুলতে পারে।
এসব তো বাইরের দৃশ্য। জয়ী মানুষদের ঘরের ভেতরের ছবি দেখলে সন্দেহ থাকবে না যে, আরব্য রজনীর সেই দৈত্য তাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে, হুকুম করার অপেক্ষামাত্র, অমনি যা চাইবে এনে দেবে। এরা ঈদে যায় কলকাতায়, অসুখ হলে ব্যাংককে, ছেলেমেয়েদের রাখে আমেরিকায়। নিজেরা কখনো দেশে থাকে, কখনো বিদেশে। দেশি জিনিস পারতপক্ষে ব্যবহার করে না, দেশি ভাষায় নিজেরা ক্ষমাঘেন্না করে কথা বললেও সন্তানদের কারবার সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এসব যখন চলে তখন মঙ্গা ঘটে রংপুরে। দেশের অর্থমন্ত্রী বলেন, মঙ্গা কী তিনি জানেন না। আগের অর্থমন্ত্রী যেমন বলেছিলেন, শেয়ার মার্কেট কী বস্তু তিনি বোঝেন না, যদিও তার চোখের সামনেই ফটকাবাজারে জুয়া খেলতে গিয়ে শত শত মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার নিজেদের সর্বস্ব খুইয়েছে এবং দেশি-বিদেশি ভুয়া কোম্পানি শেয়ারের মূল্যহীন কাগজ তাদের হাতে গছিয়ে দিয়ে নগদ টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছে। মঙ্গা কী, তা মন্ত্রী না বুঝলেও ভুক্তভোগী মাত্রই বোঝে। হাড়ে হাড়ে। কয়েকজন তরুণ গিয়েছিল মঙ্গাপীড়িত এলাকায়। তাদের একটি অভিজ্ঞতাই বলে দেবে মানুষ সেখানে কীভাবে টিকে আছে। অতিশয় বৃদ্ধ একজন এসেছিলেন সাহায্য নিতে। তার পরনের লুঙ্গিটি ছেঁড়া, কিন্তু তিনি চাইলেন একটি শাড়ি। কারণ কী জানতে চাইলে বললেন, তিনি তো তবু ফাটা লুঙ্গি পরে বাইরে আসতে পেরেছেন, তার স্ত্রীর পক্ষে ঘরের বাইরে আসার উপায় নেই। ওই সময়টা ছিল রোজার, ত্রাণকর্মীরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন সাহরিতে তিনি কী খেয়েছেন, জবাব পেয়েছেন যে, পান্তাভাত ও কাঁচা মরিচ জুটেছিল, ইফতারির সময় পানি ছাড়া অন্যকিছু পাবেন বলে ভরসা করেন না। তরুণ ত্রাণকর্মীদের কৌতূহল রয়েছে ঈদের দিন তিনি কোন ধরনের খাবার খাবেন বলে আশা করেন, ভদ্রলোক জানিয়েছেন ভাতের সঙ্গে ডিম ভাজা পেলে খুবই খুশি হবেন। গরিবের ঈদ নিয়ে কবিতা আমরা অনেক পড়েছি। কিন্তু সেই ঈদ যে এমন সাদামাটা এবং এই ঈদ যে একজনের নয়, বহুজনেরতার বিপরীতে তিন কোটিওয়ালাদের ঈদ যে কতটা দাপটের হতে পারে তার হদিস কবির পক্ষেও পাওয়া সহজ হবে না।
কে জয়ী আর কে-ইবা পরাজিত তা নিয়ে কি সন্দেহের কোনো অবকাশ আছে? জয়ীর সংখ্যা শতকরা পাঁচজনের বেশি হবে না, বাদবাকি সবাই বিভিন্ন মাত্রায় পরাভূত। জয়ীরা কারা? তাদের পরিচয় কী? পরিচয় একটাই, তারা ধনী। হ্যাঁ, পেশাগত পার্থক্য আছে, আদর্শগত দূরত্বও থাকতে পারে, কিন্তু তাদের জয় সেসব বিভিন্নতাকে অবলুপ্ত করে দিয়েছে। এরাই এ দেশের ব্যবসায়ী, আমলা, রাজনীতিক এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে পেশাজীবী। এদের মধ্যে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি সবাই রয়েছে। যেন একই পরিবারের সদস্য, কলহ যা তা পারিবারিক বটে; ভাগাভাগি নিয়ে কাড়াকাড়ি মাত্র, নইলে তারা সমান সুবিধাতেই রয়েছে। সরকারি জোটের সদস্য জামায়াতের আমির নিঃসংকোচে বলে যাচ্ছেন যে, সূর্যসেন ছিলেন এ দেশের প্রথম সন্ত্রাসী, জামায়াত একাত্তরে মানুষ খুন করেছে, এখনো যে করছে না তা নয়, কিন্তু তা নিয়ে ক্ষমা চাওয়া দূরের কথা, দুঃখ প্রকাশও করতে হয়নি। জয়ীদের কাতারে তারা অত্যন্ত আরামে বসে আছে।
নব্বইয়ে একটি গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল, পতন ঘটেছিল এক স্বৈরশাসকের। পতনের রাতে তিনি দেশ ছেড়ে পালাতে চেষ্টা করছেন বলে খবর রটেছিল, হাজার মানুষ ছুটেছিল বিমানবন্দরের দিকে, তাকে আটকাতে। তিনি আটকও হয়েছিলেন, কিন্তু পরে শুধু ছাড়াই পাননি, ওই যে যারা জয়ী তাদের মধ্যে একজন প্রধান পুরুষ হিসেবে বিরাজ করছেন। তিনি বিবাহ এবং বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, সম্প্রতি মেয়ের বয়সী ও আগে-বিবাহিত এক পাত্রীকে স্ত্রীর আসনে বসিয়েছেন, সে খবর নয় কেবল, তার নতুন স্ত্রীর রাজনৈতিক বক্তব্যও আমাদের শুনতে হয়েছে। তার প্রথম স্ত্রী নির্বাচিত এমপি, দ্বিতীয় স্ত্রীও শোনা যাচ্ছিল মহিলা কোটায় এমপি হবেন বলে কথা ছিল। পরে আরও তেলেসমাতি কা-। দ্বিতীয় স্ত্রীকে তিনি ত্যাগ করেছেন এবং জেল খাটিয়েছেন। দ্বিতীয় স্ত্রীও বসে নেই, অতবড় মানুষের স্ত্রী, তাই সাবেক হলেও রাজনীতিতে হট্টগোল করছেন। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন ড. মিলন, কাগজে খবর বের হয়েছে যে, যারা সেদিন মিলনকে গুলি করেছিল তাদের নিজ হাতে গোলাবারুদ সরবরাহ করেছিলেন স্বয়ং এরশাদের প্রথম স্ত্রী। কদিন আগে মিলনের মা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে মিলন হত্যার বিচার দাবি করেছেন, প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই তাকে আশ্বাস দিয়েছেন, বিচার হবে বলে। এর কদিন পর রওশন এরশাদ তার দলের এমপিদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন বলে যে খবর বের হয়েছিল সে ঘটনার পরিণতি যদি এমন হতো যে, রওশন এরশাদ একজন মন্ত্রী হয়েছেন, তাহলেও বিস্মিত হওয়ার কারণ থাকত না। কিছুই অসম্ভব নয়।
রূপকথায় কল্পজগতের কাহিনী থাকে, সেখানে নিয়মকানুন-কায়দাকানুন সবকিছুই অন্যরকমের, আমাদের দেশে ধনীরাও ওই জগতেরই বাসিন্দা, তাদের কাজ একেবারেই ভিন্ন ধরনের। বিদেশিরা আমাদের গ্যাস-তেল নিতে চায়। সরকার রাজি, বিরোধী দলও যে গররাজি তা নয়। টাটা কোম্পানি আসবে, তাদের গ্যাস দেওয়া হবে; সরকার উৎসাহী, বিরোধী দল যে অনাগ্রহী তাও মনে হয় না। বিদেশিরা বন্দর নিয়ে নেবে এমন আশঙ্কা, সে ব্যাপারে সরকারি এবং বিরোধী দল কারও মনোভাবেই প্রকৃত দেশপ্রেমিকের নয়। এ দেশে যারা ক্ষমতায় যাতায়াত করে তারা সবাই একই শ্রেণির মানুষ। সেটি হলো শাসকশ্রেণি, সেই শ্রেণিতে দেশপ্রেমের বড়ই অভাব; ছড়াছড়ি আত্মপ্রেমের। একাত্তরে কি তাহলে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি? সেই যুদ্ধে কি জয় হয়নি জনগণের? শতকরা পঁচানব্বইজনই তো ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, পাঁচজন হয়তো বিপক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় কি তবে চলে গেল দেশের ধনিক শ্রেণির হাতে?
হ্যাঁ, সেটাই ঘটেছে বটে। ক্ষমতা চলে গেছে ধনীদের হাতে। একাত্তরে কে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল, কে ছিল বিপক্ষে সেটা আজ আর কোনো বিবেচনার বিষয় নয়, বিবেচ্য হলো কার হাতে টাকা আছে, কার হাতে নেই। যার টাকা আছে গেন ক্ষমতাবান, টাকা কোন পথে এসেছে তা কেউ জানতে চায় না। কেননা জানাই আছে যে, সব টাকাই অর্জিত হয়েছে অন্যায় পথে। কিন্তু ব্যাপারটাকে ছিনতাই বলা বোধকরি অন্যায় হবে। ঘটনাটা খুবই স্বাভাবিকভাবে ঘটেছে। সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। ঘরের মেয়েরা নানাভাবে লাঞ্ছনা সহ্য করেছে। যুদ্ধ শেষে তারা চলে গেছে নিজ নিজ পুরাতন অবস্থানে, যে অবস্থান এরই মধ্যে আগের তুলনায় ভালো হবে কী আরও খারাপ হয়েছে। তারা কাজ পায়নি। অনেকে দুর্ভিক্ষে পড়েছে। আগে ছিল রাজাকারের আতঙ্ক, পরে দেখা দিয়েছে রক্ষীবাহিনীর ভয়। আর যারা বিত্তবান তাদের সুবিধা হয়েছে, তারা একবার ধন বৃদ্ধির সুবিধা পেয়েছিল পাকিস্তান আসায়, আরেকবার পেল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়। বিত্তবানদের যে অংশ যুক্ত ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে তারা তো উৎফুল্ল হলোই, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল তাদেরও কোনো অসুবিধা হলো না। রাজাকারদের ভেতর চিকন আলীরাই শুধু ধরা পড়েছে, স্ফীতোদররা সহজেই পুনর্বাসিত হয়ে গেছে। বলাবাহুল্য, আদর্শের জোরে নয়, টাকার জোরে। যুদ্ধে জনগণের জয় হয়েছে. এটা একাত্তরের শেষে এবং বাহাত্তরের শুরুতে সত্য ছিল। মনে হয়েছিল বিপ্লব ঘটে গেছে। আমরা নতুন রাষ্ট্র তো বটেই, নতুন এক সমাজও পাব। জনগণ বলতে সেই মুহূর্তে ধনী-দরিদ্র সবাইকে বোঝাত। কেননা সবাই একসঙ্গে লড়ছিল একটি চিহ্নিত শত্রুর বিরুদ্ধে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের ঐক্য তো টেকেনি।
ধনীরা চলে গেছে ধনীদের জায়গায়, বাদবাকিরা পরাজিত মানুষের মতো ফিরে গেছে আগে, যেখানে ছিল তার চেয়েও খারাপ জায়গায়। গত ৩৪ বছরের ইতিহাস এ দেশে ধনীদের আরও ধনী হওয়ার ইতিহাস বটে। ধনী হয়েছে উৎপাদন করে নয়, মূলত লুণ্ঠন করে; কাজটি হানাদাররা শুরু করেছিল, স্থানীয়রা তাকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। একাত্তরে জাতি বিভক্ত হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারে, তারপর বিভক্ত হয়েছে ধনী ও দরিদ্রে। ধনীরা জয়ী হয়েছে, গরিবদের হারিয়ে দিয়ে। যেন ধনীকে আরও ধনী করার জন্যই সবকিছু ঘটেছে।
এমন তো কথা ছিল না। লড়াইটা তো শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার ছিল না, ছিল সার্বিক মুক্তির, যে মুক্তির মূল ভিত্তিটাই হওয়ার কথা ছিল অর্থনৈতিকশুধু উন্নয়নের নয়, বৈষম্যহীনতারও। জনগণের আশা কেন তাহলে ভেঙে গেল খান খান হয়ে। গেল এজন্য যে, সমাজ মোটেই বদলাল না। রয়ে গেল আগের মতোই। রাষ্ট্র বদলাল বটে, কিন্তু সে শুধু বহিরঙ্গ, ভেতরে সে রয়ে গেল আগের মতোই। সেই একই আমলাতন্ত্র, আইনকানুন, অফিস-আদালত শিক্ষাব্যবস্থা, প্রচারমাধ্যম, ধমক-ধামক, ঠাটবাট। শাসক বদলাল কিন্তু শাসন বদলাল না।
সাতচল্লিশে ব্রিটিশ শাসকরা চলে গিয়েছিল পাকিস্তানিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে, একাত্তরের পাকিস্তানি শাসকরাও সেই একই কাজ করতে বাধ্য হলো, ক্ষমতা দিয়ে গেল বাঙালি শাসকদের হাতে। রাষ্ট্র হুবহু এক রইল না, কিন্তু একই ধরনের রয়ে গেল। দুবারই যারা রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়েছে তাদের প্রধান যোগ্যতা ছিল তাদের বিত্ত। বিত্তবানরাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষমতায় ছিল, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায়ও তারাই রয়েছে। জয় তাদেরই। আর তারা যদি জয়ী হয় তবে সাধারণ মানুষ তো পরাজিত হবেই। তারা ঠিকই পরাজিত হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্য দিয়ে; বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা সশস্ত্র যুদ্ধের সাহায্যে। এই ব্যবধানটা সামান্য নয়। স্বায়ত্তশাসন নয়, স্বাধীনতাও নয় শুধু; চাই মুক্তি। খুব বড় একটা আশা তৈরি মুক্তির কল্পনাকে ঘিরে হয়েছিল। সফল হলো না বিত্তবানদের কারণে। তারা রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে সেই কাজই করতে থাকলপাকিস্তানি শাসকরা যা করছে, নিজেরা আরও ধনী হতে থাকলে জনগণকে বঞ্চিত করে। এদের চরিত্র দেশপ্রেমিকের নয়, লুণ্ঠনকারীর বটে।
লেখকঃ ইমেরিটাস অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সরকারি হিসাবে বর্তমানে বিশ্বের ১৬৮টি দেশে কাজ করছে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৩২ লাখ কর্মী (প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি)। জিডিপিতে প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। দিন দিন প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই কাজ করছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। শ্রমবাজারে ভাষাজ্ঞান একটি শক্তি। যে কোনো শ্রমবাজারে অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয় ভাষাজ্ঞান। শুধুমাত্র ইংরেজি ভালো জানার জন্য আমাদের দেশের কর্মীদের তুলনায় ফিলিপাইন, ভারত ও শ্রীলঙ্কার কর্মীদের বেতন দ্বিগুণ বা তারচেয়েও বেশি বৈদেশিক শ্রমবাজারে।
বাংলাদেশের প্রায় সমপরিমাণ কর্মী ফিলিপাইনের প্রবাসে কাজ করে। তাদের প্রবাসী আয় বাংলাদেশের চেয়ে দ্বিগুণ ইংরেজির কারণে। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এডুকেশন ফার্স্ট (ইএফ)। সংস্থাটির সমীক্ষায় ফিলিপাইন ইংরেজি দক্ষতায় উচ্চ অবস্থানে (২০) রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সৈয়দ মনজুর এলাহী এক সভায় বলেছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিপাইনের লোকেরা বাংলাদেশিদের চেয়ে চারগুণ বেশি বেতন পান। কারণ তারা সাবলীল ইংরেজি বলতে পারেন। যে জন্য তারা মধ্যম সারির কাজ পান’। ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ফিদেন রামোস বিবিসি টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বিদেশে আমাদের দেশের কর্মীরা ইংরেজিতে সাবলীলভাবে কথা বলতে পারেন। ছোটবেলা থেকে তারা ইংরেজিতে অভ্যস্ত। তাই বিদেশে তাদের চাহিদা বেশি।’
শুধুমাত্র ইংরেজি ভালো না জানার কারণে আমরা প্রবাসে প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়ছি মেধা থাকা সত্ত্বেও। ক্যারিয়ার গঠনে ইংরেজি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে তা ভুক্তভোগী প্রবাসীরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘ইংরেজি দক্ষতার অভাবে আমরা আন্তর্জাতিক দেন-দরবারেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’ এত প্রতিকূলতার পরও ইংরেজি ভাষাকে আমরা এখনো ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবেই শিখছি। ‘সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ’ ঘোষণা করতে পারলাম না আজও। ইংরেজি দক্ষতায় বাংলাদেশের অবস্থা খুবই নিম্নস্তরে এমন তথ্য উঠে এসেছে এক আন্তর্জাতিক সমীক্ষায়। অর্থনীতি ফোরামের হিসাবে ‘পৃথিবীতে ইংরেজি ভাষায় কথা বলেন ১৫০ কোটি মানুষ। কিন্তু এদের মধ্যে ৪০ কোটিরও কম মানুষের মাতৃভাষা এটি (বিবিসি বাংলা)’। সারা পৃথিবীতে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি যতটা ব্যবহার হয় অন্য কোনো ভাষা এতটা ব্যবহার হয় না। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে ইংরেজি সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা। ২০৫০ সালেও ইংরেজি সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষাই থাকবে (বিবিসি বাংলা ২৬ আগস্ট ২০২০)’। সাহিত্য সংস্কৃতি, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় ইংরেজি এখনো শীর্ষস্থানেই আছে।
আমেরিকার নাগরিকরা অনলাইনে চাইনিজদের ইংরেজি ভাষা শিখিয়ে লাখ লাখ ডলার উপার্জন করছে। ইউরোপের দক্ষ কর্মীর পাশাপাশি অদক্ষ কর্মীরা ইংরেজি ভাষার সুবিধা পেয়ে থাকে শ্রমবাজারে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড এই ৫টি দেশ ইংরেজি ভাষার সুবিধা নিয়ে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করে রয়েছে। বাংলাদেশের শ্রমবাজারেও ভারত ও শ্রীলঙ্কার ইংরেজিতে দক্ষ কর্মীরা অতিরিক্ত বেতনভাতা পাচ্ছে। আমাদের শ্রমবাজারের ঘাটতি পোষাতে ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকে ইংরেজিতে দক্ষ কর্মী আনতে হয়। পেশাগত প্রয়োজনে ইংরেজি শেখার বিকল্প নেই। যদিও দুঃখজনক হলেও সত্য যে কোনো কর্মকর্তা পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে ইংরেজিতে প্রত্যাশিত দক্ষ জনবল পাওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত ৩ খাতের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। কৃষি, গার্মেন্টস ও প্রবাসী আয়। যত সহজে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি করে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করা যাবে; তত সহজে অন্য দুটি খাতে আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব না। তাই অর্থনীতির গতি ত্বরান্বিত করতে এই মুহূর্তে প্রবাসী আয়কে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ইংরেজিতে কথা বলা ও শুনে বোঝা খুব কঠিন কাজ নয়। প্রয়োজন দেশব্যাপী একটি সমন্বিত পরিকল্পনা। দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে যত অর্থ, সময় ও শ্রম ব্যয় হবে তার চেয়ে অনেক কম শ্রমে ও অর্থে ইংরেজির মাধ্যমে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব। সরকারি খরচে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাগ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি বাড়াতে হলে প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই ভাষার ওপর জোর দিতে হবে। ভাষাচর্চার ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকা দরকার।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে লাখ লাখ কর্মীকে ইংরেজি শেখানো সম্ভব। আমাদের দেশে এখন ইংরেজি শেখানোর মতো দক্ষ জনবল রয়েছে। মাত্র কয়েকশ কোটি টাকা খরচ করে কয়েক লাখ নাগরিককে কমিউনিকেটিভ বা বিজনেস ইংলিশ শেখনো যাবে না কেন? আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে ভাষা এক বিরাট শক্তি। আর এ শক্তি অর্জন করতে হলে ইংরেজির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে ও ২০৩০ সালের মধ্যে সাসটেইনেইবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) অর্জনে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার বাড়াতে হবে কর্মক্ষেত্রে। জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে দেশে ইংরেজি ভাষা চর্চার ব্যবস্থা করে এ ভাষায় দক্ষ জনশক্তি বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। ভাষাই বয়ে আনতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনা।
লেখক : সাংবাদিক
দেশে এখন জেলায় জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। এভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ইতিমধ্যেই প্রায় অর্ধশতে পৌঁছে গেছে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি বা বিশেষ অবদানের জন্য নয়, প্রশাসনের দুর্নীতি এবং শিক্ষার মান সংকট নিয়েই বছরজুড়ে এগুলোর কোনো না কোনোটি আলোচনায় থাকছেই। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়ম এর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া আর্থিক দুর্নীতি, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে ঘুষবাণিজ্য ও স্বজনপ্রীতির একের পর এক ঘটনা নিয়মিতই আসছে সংবাদমাধ্যমে। আরও দুঃখজনক বিষয় হলো ইদানীং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, শিক্ষক নিয়োগেই যদি অনিয়ম ও দুর্নীতি হয় তাহলে বিশ^বিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কীভাবে বাস্তবায়িত হবে? অনিয়মের মাধ্যমে আত্মীয় বা নিজ পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়া হলে নিয়োগপ্রাপ্ত ও নিয়োগদাতারা কোন নৈতিকতা নিয়ে শিক্ষকতা করবেন? অনিয়মে শিক্ষক হওয়া ব্যক্তি শিক্ষার্থীদেরই বা কী শেখাবেন?
রবিবার দেশ রূপান্তরে ‘প্রভাষক পদে ফেল করে হতে যাচ্ছেন সহকারী অধ্যাপক!’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (আইসিটি) বিভাগে প্রভাষক পদে একাধিকবার লিখিত পরীক্ষা দিয়ে ফেল করা এক প্রার্থী এবার লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সোমবার ওই বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে দুজনকে নিয়োগের জন্য মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার কথা রয়েছে নিয়োগ বোর্ডের। যাতে প্রভাষক পদের পরীক্ষায় ফেল করা ওই বিভাগেরই প্রভাবশালী এক শিক্ষকের স্ত্রীর নিয়োগ চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন বিভাগটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক। জানা গেছে, শিক্ষক নিয়োগের এ বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে বেশ কয়েকজন প্রার্থী আবেদন করলেও বিভাগের প্ল্যানিং কমিটি শুধু চারজন প্রার্থীর জন্য সুপারিশ করে রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি পাঠান। এদের মধ্যে একজন বিভাগের প্রভাবশালী এক শিক্ষকের স্ত্রী। ওই শিক্ষক কুবি উপাচার্যের অতি ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তার স্ত্রী এর আগে একাধিকবার প্রভাষক পদে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে পারেননি। প্রভাবশালী ওই শিক্ষক আবার বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির সদস্য। নিয়ম অনুযায়ী প্রার্থীদের কেউ প্ল্যানিং কমিটির কোনো সদস্যের আত্মীয় হলে ওই প্রার্থীর বিষয়ে আলোচনার সময় ওই সদস্য প্ল্যানিং কমিটির সভায় থাকতে পারবেন না। অভিযোগ রয়েছে, ফেল করা ওই প্রার্থী যে কারও আত্মীয় সে বিষয়ে সভায় কোনো আলোচনাই হয়নি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিভাগীয় প্রধান ও প্ল্যানিং কমিটির সভাপতি ড. মো. সাইফুর রহমান ফোন কল কেটে দেন। কুবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নিয়ম দেখতে হবে। রেজিস্ট্রার ভালো বলতে পারবেন।’ কুবির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মো. আমিরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘এখানে শুধু মৌখিক পরীক্ষা হবে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগের জন্য কখনো লিখিত পরীক্ষা হয়নি। আমি আর কিছু জানি না।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালে শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনার পর সব নতুন নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা নিয়েছে কুবি। শুধু অভ্যন্তরীণ প্রার্থী যারা ইতিমধ্যে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন, তারা দ্বিতীয়বার কোনো পদে আবেদন করলে তাদের ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়েই কয়েকবার ফেল করা প্রার্থী এবার সহকারী অধ্যাপক পদে আবেদন করে শিক্ষক হতে যাচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে কাউকে অনিয়মের মাধ্যমে বিশেষ সুবিধা দিতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ ‘অন্ধ সেজে থাকার অনুরাগে’ নিয়মনীতি দেখতে না পাওয়া অথবা না জানার ভান করে কি পার পেতে পারে?
দুঃখজনক হলো, কেবল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ই (কুবি) নয়, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও আজকাল শিক্ষক নিয়োগে নিয়মবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। উপাচার্যের স্বজন বা কাছের লোক, প্রভাবশালীর আত্মীয়, রাজনৈতিক পরিচয়ে যোগ্যতা না থাকার পরও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন অনেকে। শিক্ষক পদের মানমর্যাদা রক্ষা এবং সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমন কর্মকা- এই সত্যই মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, জবাবদিহি না থাকা এবং অনিয়ম, অপরাধের বিচার না হওয়ার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো এমন লাগামহীন হয়ে পড়ছে। উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, জ্ঞানচর্চাকে গৌণ করে ফেলে এসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেন কেবল সার্টিফিকেট বিতরণ আর কর্মসংস্থানের প্রকল্পে পরিণত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি বদলাতে হলে কুবি’র আলোচিত নিয়োগ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন নিয়ে ও শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
প্রকাশক, শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক চিত্তরঞ্জন সাহার জন্ম নোয়াখালীতে ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি। বাবার নাম কৈলাশচন্দ্র সাহা এবং মা তীর্থবাসী সাহা। কাপড় ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান হয়েও ১৯৫১ সালে চৌমুহনীতে তিনি বইয়ের ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি চৌমুহনী থেকে ঢাকায় তার পুস্তক ব্যবসা স্থানান্তর করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি পুঁথিঘর প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী তার পুঁথিঘরের অফিস পুড়িয়ে দেয়। তিনি নিরাপত্তার জন্য কলকাতায় চলে যান। সেখানে তিনি ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ গড়ে তোলেন যা পরবর্তী সময়ে ‘মুক্তধারা’ নাম লাভ করে। তিনি নিজ উদ্যোগে ‘রক্তাক্ত বাংলা’ ও ‘বাংলাদেশ কথা কয়’ নামে দুটি সংকলন প্রকাশ করেন। তার উদ্যোগেই প্রথম বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে বইমেলার সূচনা হয়। পরে বাংলা একাডেমি একুশে বইমেলার প্রবর্তন করে। তিনি ২০০৫ সালে একুশে পদক ও বিদ্যাসাগর পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশের ৫৩তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস রবিবার।
একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত গণহত্যা অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে এবং বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি বেসামরিক লোকের ওপর গণহত্যা শুরু করে।
তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সকল সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। ওই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়।
বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তারের আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পাশাপাশি যে কোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
মুহূর্তের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই সময় বাস্তবতা ও নিরাপত্তা জনিত কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা নথি সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তৎকালীন ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পরে। পরে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধর পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে একটি ভূখণ্ডের, যার নাম বাংলাদেশ।
দেশে ইতিমধ্যে কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভজি ইন্টারনেট সেবা চালু করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক। অন্য অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক একই সেবা চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সব মোবাইল অপারেটরই দেশের বেশিরভাগ স্থানে ফোরজি সেবা চালু করেছে। আর সে হিসেবেই তারা ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু গ্রাহকরা ফোরজি ইন্টারনেট কিনলেও দেশের অনেক এলাকায় টুজি-থ্রিজি’র সেবা পাচ্ছেন। তারা অপারেটর কোম্পানিগুলোকে এ ব্যাপারে বারবার অভিযোগ জানালেও এর সুরাহা হচ্ছে না।
জানা গেছে, রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে মোটামুটিভাবে গ্রাহকরা ফোরজি সেবা পাচ্ছেন। তবে এসব এলাকায়ও অনেক সময় ফোরজি থাকে না, থ্রিজিতে নেমে আসে নেটওয়ার্ক। তবে জেলা পর্যায়ে বেশিরভাগ সময়েই থাকে থ্রিজি। আর মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ সময় সেই থ্রিজিও থাকে না, তখন টুজি নেটওয়ার্কই ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ইন্টারনেট প্যাকেজ যথাযথভাবে থাকার পর তা কাজ করে না, বাফারিং হয়। এতে গ্রাহকরা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো সারা দেশের ব্যবসা একত্রে হিসাব না করে এলাকাভিত্তিক ব্যবসার হিসাব-নিকাশ করার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা দেখেন, কোন এলাকায় তাদের গ্রাহক সংখ্যা কত, সেখানে কত সিমে ইন্টারনেট চালু আছে। যদি দেখা যায়, তাদের হিসাব মতে তা সন্তোষজনক আছে তাহলে সেখানে ফোরজি সেবা চালুর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বহাল রাখে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক টাওয়ার নির্মাণ করে। কিন্তু যদি দেখে সন্তোষজনক গ্রাহক নেই তাহলে সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় না, এতে সেই এলাকায় ফোরজি পাওয়া যায় না। অথচ শহর এলাকাগুলোতে তারা বেশি ব্যবসা করলেও সেটাকে হিসাবে ধরে না। কিন্তু মফস্বল এলাকা থেকে কল বাবদ প্রয়োজনের বেশি ব্যবসা হলেও তা ইন্টারনেটের সঙ্গে সমন্বয় করে না।
মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর ফেসবুক পেইজে প্রতিনিয়ত অসংখ্য অভিযোগ জানান গ্রাহকরা। অভিযোগ অনুযায়ী, অপারেটরদের মধ্যে টেলিটকের নেটওয়ার্কই বেশি দুর্বল। টেলিটকের ফেসবুক পেজের এক পোস্টে মো. ফয়জুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই, নেটওয়ার্ক পাই না সকাল থেকে। মিরপুর-২ নম্বরে বাসা স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে। আর আমার গ্রামের কথা না হয় বাদ দিলাম।’ আরাফাত আলী লেখেন, ‘২জিবি নেট কিনলে দেড় জিবি নষ্ট হয়। মেয়াদ ১৫ দিন তাও ফুরাতে পারি না। তাহলে বুঝেন নেটওয়ার্ক কত ভালো।’ কার্জন চাকমা লেখেন, ‘পাহাড়ি এলাকায় ফোরজি নিশ্চিত করুন। আমাদের পার্বত্য এলাকাগুলোতে টেলিটকের গ্রাহক সবচেয়ে বেশি, কিন্তু শুধু থ্রিজি-টুজিতে সীমাবদ্ধ।’ রাসেল আহমেদ লেখেন, ‘গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাংগা গ্রামে থ্রিজি নেটওয়ার্ক তো নেই-ই। মাঝেমধ্যে টুজি’ও নেই। বুঝুন অবস্থাটা। আমাদের থ্রিজি সেবা দেওয়ার চেষ্টা করুন।’
টেলিটকের মহাব্যবস্থাপক (সিস্টেম অপারেশন) নুরুল মাবুদ চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ফাইভজি রেডিনেস প্রজেক্ট শুরু করেছি। যা শেষ হতে এক বছর বা তার কিছু বেশি সময় লাগতে পারে। এর ফলে আমাদের কাভারেজ এলাকাগুলোতে ফোরজি সেবা নিশ্চিত হবে। এছাড়া আমাদের কাভারেজ বাড়ানোরও বড় পরিকল্পনা রয়েছে।’
বাংলালিংকের পেজের একটি পোস্টে মাহাদী হাসান তালহা লেখেন, ‘আমার এলাকায় আপনাদের সিম ব্যবহার করতে হলে ফোন গাছের ডালে বেঁধে লাউডস্পিকার দিয়ে কথা বলা লাগে। এত্তো ফাস্ট কেন আপনাদের নেটওয়ার্ক।’ আকরাম হোসাইন লেখেন, ‘ভাই আপনাদের সবই ঠিক, তবে নেটওয়ার্ক সেøা।’
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অফিসার তৈমুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফোরজি সেবার জন্য ২৩০০ মেগাহার্জের স্পেকটার্ম প্রয়োজন হয়। কিন্তু টুজিতে তা লাগে মাত্র ৯০০ মেগাহার্জ। আমরা ইতিমধ্যে ৯৫ শতাংশ কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা নিশ্চিত করেছি। তবে আমাদের আরও বেশি সাইট লাগবে। যদি সব অপারেটর মিলে আমরা টাওয়ার শেয়ার করতে পারি, তাহলে সব গ্রাহকের কাছে ভালো সেবা পৌঁছে দেওয়া সহজ হবে।’
রবির পেজে এক পোস্টে তানভীর আহমেদ লেখেন, ‘কলাপাড়া থানা শহরে যদি থ্রিজি নেটওয়ার্ক না পাওয়া যায়, এরচেয়ে দুঃখজনক কিছুই হতে পারে না।’ এইচএমএম ইসমাঈল লেখেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার চম্পকনগর ইউনিয়নে রবি সিমের থ্রিজি নেই। অথচ অনেক বছর আগে রবি টাওয়ার বসানো হয়েছে। আমরা রবি সিম দিয়ে ইন্টারনেট চালাতে অক্ষম।’
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলটরি অফিসার শাহেদ আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা রয়েছে। তবে দেখা যায়, অনেক ফোন ফোরজি সাপোর্ট করে না। আর কাভারেজ এলাকা থেকে যতদূরে যাওয়া যাবে, নেটওয়ার্ক তত কমতে থাকবে। এছাড়া আমাদের কিছু জায়গায় নেটওয়ার্কের কাজ চলছে। পাশাপাশি নতুন কিছু টাওয়ার তৈরির কাজও আমাদের চলছে।’
গ্রামীণের পেইজে একটি পোস্টে রহিদুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই আমি যখন গ্রামে যাই তখন নেটওয়ার্কের ঝামেলা হয়।’ সাইদুর রহমান লেখেন, ‘এমন সার্ভিস হলে চলবে? কলরেট, ইন্টারনেটের দাম তো ঠিকই বেশি আপনাদের, বাকি সব অপারেটরদের থেকে।’
গত বছরের ২৮ এপ্রিল টেলিকম অপারেটররা বহুল প্রতীক্ষিত ‘আনলিমিটেড’ ও ‘মেয়াদবিহীন’ ইন্টারনেট ডাটা প্যাক চালু করেছে। তবে এতে গ্রাহকদের খুব বেশি সুবিধা হচ্ছে না। কারণ এজন্য প্যাকেজের দাম বাড়িয়েছে অপারেটররা। আর মেয়াদহীন ইন্টারনেট পেতে প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একই প্যাকেজ চালু করতে হবে। কিন্তু গ্রাহকের সব সময় একই ধরনের ইন্টারনেট প্যাকেজ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে অব্যবহৃতই থেকে যাচ্ছে গ্রাহকের কেনা ইন্টারনেট। এছাড়া মেয়াদবিহীন হিসেবে মোবাইল অপারেটররা যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে গ্রাহকদের।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে সচল সিমের সংখ্যা ১৮ কোটি ২০ লাখ ৬১ হাজার। এরমধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা ৭ কোটি ৯০ লাখ ৯৫ হাজার, রবির ৫ কোটি ৫০ লাখ ১৪ হাজার, বাংলালিংকের ৪ কোটি ৮৫ হাজার এবং টেলিটকের ৬০ লাখ ৬৭ হাজার। আর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৫০ লাখ। এরমধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ কোটি ৩০ লাখ ১৩ হাজার এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি ও পিএসটিএন)-এর মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ লাখ ৮৭ হাজার গ্রাহক।
রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধির মধ্যেই তৈরি পোশাক খাতের আকাশে দেখা দিয়েছে শঙ্কার মেঘ। কয়েক মাস ধরেই খাতটির উদ্যোক্তারা রপ্তানি আয় কমে যাওয়া নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন। তারা বলছেন, রপ্তানির প্রধান প্রধান অঞ্চলগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকায় আগামীতে ওই সব অঞ্চলে রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে গেছে। তাদের ভাষ্য, ইতিমধ্যে তার প্রভাবও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। অর্ডার কমে যাওয়ায় কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যও বলছে সে কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলার হার নেমেছে প্রায় অর্ধেকে।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তবে এই খাতের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির পুরোটাই আমদানিনির্ভর; যা চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাপক হারে কমে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) টেক্সটাইল ফেব্রিক্স আমদানির এলসি বা ঋণপত্র খোলা কমেছে ২৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ৬২৬ কোটি ডলারের এলসি খোলেন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮৬৫ কোটি ডলার।
তবে প্রস্তুত কাপড়ের চেয়ে বেশি আমদানি কমেছে কাঁচামালের। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে কাঁচা তুলা বা কটন আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এ সময়ে কাঁচা তুলা আমদানিতে ১৫৩ কোটি ডলারের এলসি খোলেন ব্যবসায়ীরা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে তুলা আমদানিতে ২৭২ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। আবার তুলার চেয়ে সুতা আমদানি আরও কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সুতা আমদানিতে এলসি খোলা হয় ১০৭ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৪২ কোটি ডলার। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সুতা আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৫৬ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের আট মাসে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৫৪ দশমিক ১১ শতাংশ। এই সময় টেক্সটাইল যন্ত্রপাতির এলসি খোলা কমেছে ৭০ দশমিক ৪২ শতাংশ। আর গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৬৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা সাধারণত নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন বা কারখানার সম্প্রসারণ করে থাকেন। অর্থাৎ শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে। আর এটি কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা ব্যবসা সম্প্রসারণ কিংবা নতুন কলকারখানা স্থাপন অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। এতে দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদনে ‘ধস’ নামার একটা অশনিসংকেত পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে কাঁচামাল ও জাহাজভাড়া অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার ব্যাপক পতন, বিভিন্ন দেশে মন্দার শঙ্কাসহ নানা কারণে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে উচ্চ আমদানি ব্যয়ের কারণে দেশে ডলার সংকট দেখা দিলে এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করে সরকার। এতে ডলারের ওপর চাপ কিছুটা কমানো গেলেও আমদানি জটিলতায় পড়েছে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য খাত।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানির ক্রয়াদেশ কিছুটা কমেছে। কিন্তু উচ্চমূল্যের পণ্য রপ্তানি বাড়ায় রপ্তানি আয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রভাব পড়েনি। যেহেতু সাধারণ পোশাক রপ্তানি কমেছে সে কারণে কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানিও কমেছে। পাশাপাশি ডলার সংকটও আমদানি কমে যাওয়াতে ভূমিকা রেখেছে। ফারুকের আশঙ্কা, উন্নত দেশগুলোতে ব্যাংকিং খাতে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তার কারণেও রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে এসব বিষয় মোকাবিলায় পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ করার মতো অর্থের সংকট রয়েছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে পারছে না। পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার বড় অবমূল্যায়নের কারণে মালিকরা খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মূলধনি যন্ত্রপাতি আনছেন না। অবশ্য আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম কমায় আমদানির পরিমাণে প্রভাব পড়েছে বলেও মনে করেন ফজলে শামীম এহসান।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দার আশঙ্কায় কেউ নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। তবে কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়াটাকে তারাও আসন্ন সংকট হিসেবে দেখছেন। গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশে ডলারের সংকটের কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল আমদানি করতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এটা খুব ভালো লক্ষণ নয়। তবে তিনি আশাও দেখছেন। তার ভাষ্য, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম কমে যাওয়ায় মূলত আমদানি ব্যয় কম হয়েছে। আমদানির পরিমাণ খুব একটা কমেছে বলে মনে করেন না তিনি।
পুলিশ ভেরিফিকেশন না হওয়ায় চাকরি স্থায়ীকরণ হচ্ছিল না। কিন্তু তার দেরি সয়নি। নিজের তত্ত্বাবধানে থাকা সার্ভিস বইয়ের পাতায় কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে স্থায়ী করে নিলেন নিজের চাকরি। এই ব্যক্তি হলেন ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী মো. মনোয়ার হোছাইন। স্থানীয় সরকার বিভাগ তদন্তের পর থানায় মামলা হয়। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে তার বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগের চারটির প্রমাণ মিলে। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট আইনের দুটি ধারায় তার ১২ বছর সাজা ও অর্থদ- হয়েছে। পুলিশ মনোয়ারকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৪ সালের ১৯ মে ‘ক্রু’ বা মশককর্মী পদে যোগ দেন মনোয়ার হোছাইন। দপ্তরের চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী, এলডিএ কাম টাইপিস্ট হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করে তিনি ওই পদও বাগিয়েছেন। ওই পদ থেকে উচ্চমান সহকারী (হেড ক্লার্ক) পদেও পদোন্নতি নিয়েছেন। এরপর দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে নেন। তথ্য গোপন করে পদোন্নতি নেওয়া এই কর্মকর্তার বাদ ছিল চাকরিতে স্থায়ী হওয়া। প্রথমবার কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে বিধিবহির্ভূত পদোন্নতি নেওয়ার পর তার উচ্চাকাক্সক্ষা বেড়ে যায়। ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল স্বাক্ষর করে চাকরি স্থায়ী করেন। এর আগে দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. রওশন আরা তালুকদারকে চাকরি স্থায়ী করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি।
এ ঘটনার পর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্থানীয় সরকার বিভাগ ও দুদকের তদন্ত কমিটির কাছে লিখিতভাবে তার স্বাক্ষর জাল করার বিষয়ে অভিযোগ করেন। ২০১১ সালে মনোয়ারকে বরখাস্ত করা হয়।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. রওশন আরা তালুকদার তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগের পক্ষে বিভিন্ন প্রমাণও জমা দেন। তিনি লিখিত বক্তব্যে জানান, অভিযুক্ত মনোয়ার হোছাইনের চাকরি স্থায়ীকরণ সংক্রান্ত চাকরি বইয়ের দ্বিতীয় খ-ের নবম পৃষ্ঠায় যে স্বাক্ষর রয়েছে তা তার নয়। ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখের স্বাক্ষরটি মনোয়ারের সৃজনকৃত। চাকরিকালীন তার বিষয়ে কোনো পুলিশ ভেরিফিকেশন করানো হয়নি। এ জন্য তার চাকরিও স্থায়ী করা হয়নি। আর সার্ভিস বইয়ে যে সিল ব্যবহার করা হয়েছে তা তার সময়ে ব্যবহৃত সিল থেকে ভিন্ন। সিলের নিচে যে স্বাক্ষর রয়েছে তিনি বলতে পারবেন সেটা কীভাবে হলো। ইস্যু রেজিস্টার খাতায় ৪৬ নম্বর দিয়ে যে চিঠিটি তৈরি করা হয়েছে তার কোনো কপি কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি। ৪৬ নম্বর ক্রমিকটি ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি লেখা রয়েছে। অন্যান্য কলাম খালি রয়েছে। পরের পাতায় ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি ২৬ নম্বর ক্রমিক দিয়ে একটি বদলির চিঠি ইস্যু করা হয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরও জানান, ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন মনোয়ার হোছাইন। দপ্তরের বিধি-বিধান অনুযায়ী নথি, রেকর্ডপত্র, সার্ভিস বই তার কাছে রক্ষিত ছিল। এ কারণে জাল স্বাক্ষরের দায় তিনি কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। দপ্তরে জমা দেওয়া তার এলএলবি পাসের সনদও সঠিক ছিল না। জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় থেকে তার ওই সনদ সঠিক নয় বলে লিখিতভাবে দপ্তরকে জানানো হয়েছে।
মনোয়ারের বিরুদ্ধে অনিয়মতান্ত্রিক কার্যকলাপ, নিয়োগ বাণিজ্য, স্বাক্ষর জাল, নিজেই নিজের চাকরি স্থায়ীকরণ এবং নথি, রেকর্ডপত্র, সার্ভিস বইয়ে ত্রুটি ঘটানোসহ পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে চারটি অভিযোগের প্রমাণ মেলে।
ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তর সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্দেশে ২০১৩ সালের ১৮ জুন দপ্তরের পক্ষ থেকে চকবাজার থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা (নম্বর-৪) করা হয়। পরে মামলাটি তদন্তের জন্য দুদকে পাঠানো হয়। দুদক তদন্ত করে মনোয়ারের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর তাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট আইনের একটি ধারায় তার পাঁচ বছরের কারাদ- হয়। পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের সশ্রম কারাদ- দেয় আদালত। আরেকটি ধারায় সাত বছরের কারাদন্ড দেওয়ার পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের বরখাস্ত উচ্চমান সহকারী মনোয়ার হোছাইন দেশ রূপান্তরকে বলেন, একটি চক্র তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে চলেছে। তাদের চক্রান্তের শিকার হয়ে তিনি কর্মস্থল থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল এবং আদালতের সাজার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা কত কিছু করছে। কোথায় আবার কী করেছে বুঝতে পারছি না। এ প্রসঙ্গটি বারবার উত্থাপন করলেও তিনি এড়িয়ে যান।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গণহত্যা নিয়ে পাকিস্তান যা বলে, তারাও (বিএনপি) তাই বলে। কারণ তারা পাকিস্তানি ভাবধারায় উজ্জীবিত, তাদের হৃদয়ে পাকিস্তানি চেতনা।
আজ রবিবার (২৬ মার্চ) ভোরে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে বীর শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের দাবি 'আওয়ামী লীগের ভুলের জন্য গণহত্যা হয়েছিল'- এমন প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, তাদের (বিএনপি) হৃদয়ে পাকিস্তানি চেতনা। তারা এমনটা বলবে, এটাই সমীচীন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার শত্রুরা সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ; এমন নানা পোশাকে স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ করে। এই অপশক্তিকে পরাস্ত করতে হবে। কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ সোনার বাংলা গড়ার পথে রয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া এখন অন্যতম অঙ্গীকার।
এর আগে, জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, মাহবুলউল আলম হানিফ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের অপরাধীরা আগে ভারতে গিয়ে আত্মগোপন করত। এরপর জানা গেল, সেখান থেকে দেশে অপরাধ ঘটায় তারা। কারও কারও নেপালে অবস্থানের কথাও জানা যায়। ভারতকে নিরাপদ মনে না করায় আরব আমিরাতের দুবাই বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা। সেখানে তারা আস্তানা গেড়েছে।
পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশের অপরাধজগতের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীরা অপরাধ করেই দুবাই চলে যাচ্ছে। সেখানে বসেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কলকাঠি নাড়ছে। এখন বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরাও দুবাইকে কেন্দ্র করে নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। সেখানে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও আছে। তাদের কেউ কেউ সোনার কারবারও করছেন। ওই দেশে ভারতের দুর্ধর্ষ অপরাধী দাউদ ইব্রাহিমের শিষ্যত্ব নেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ওইসব অপরাধীর তথ্য জানার পরও তাদের ফেরত আনতে পারছেন না। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিসের’ দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে পুলিশকে। তালিকাভুক্ত অপরাধীদের ধরতে রেড নোটিস জারি হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর অনেকে পার পেয়ে গেছে। যদিও মামলাটি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। তবে নতুন করে আলোচিত মামলাটির পুনঃতদন্ত করার কথা ভাবছে পুলিশ। এ নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ রূপান্তরকে জানান, ২০২২ সালের ২৪ মার্চ সড়কে গুলি চালিয়ে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যা করা হয়। গুলিতে নিহত হন এক কলেজছাত্রী। চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের মূল হোতা সুমন শিকদার ওরফে মুসা ঘটনার রাতেই দেশ ছেড়ে চলে যায় দুবাইয়ে। সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও জয়ের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে মুসা চলে যায় ওমানে। জিসান ও জয় এখনো দুবাইতেই বসবাস করছে। যদিও ওমান থেকে মুসাকে ওই বছরের ৯ জুন ইন্টারপোলের মাধ্যমে ঢাকায় ফিরিয়ে আনে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই ফের আলোচনায় আসে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও হিরো আলমের দুবাই সফরকে কেন্দ্র করে। তারা বনানীতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের আসামি আরাভ খান নামধারী রবিউল ইসলামের সোনার দোকান উদ্বোধন করতে সেখানে যান। দুবাই যাওয়ার কারণে সাকিব ও হিরো আলমকে যেকোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হতে পারে। এ ছাড়া ‘প্লেজার ট্যুরের’ জন্য এখন দেশের শিল্পপতিদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে দুবাই। কারণ ঢাকাকে তারা নিরাপদ মনে করছেন না। পাশাপাশি দেশে আটক সোনার চালানের ৮০ শতাংশ জব্দ হচ্ছে দুবাইফেরত বিভিন্ন এয়ারলাইনস থেকে। সব মিলিয়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে দুবাই।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অপরাধীরা যে দেশেই থাকুক না কেন, তাদের চিহ্নিত করে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে আটক করার পর দুবাই থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনতে চেয়েছিল পুলিশ। সম্প্রতি আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আরাভকে দুবাই থেকে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আশা করি অল্প সময়ে সুখবর দেওয়া সম্ভব হবে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে জানান, সম্প্রতি আলোচনায় আসা আরাভ খানকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ভারতের পাসপোর্টধারী। দেশে তার নামে ১২টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ওইসব পরোয়ানার কপি ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে পাঠানোর পর দ্রুতই তাকে ফেরানো সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও এর আগে জিসান ও জয়কে দুবাই থেকে ফেরত আনার উদ্যেগ নিয়েও আনতে পারেনি। টের পেয়ে তারা দুবাই ছেড়ে কানাডায় চলে যায়। তারা আবার দুবাই এসেছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা এই দেশে অপরাধ করে দুবাই গিয়ে আস্তানা গাড়েন। ইতিমধ্যে পুলিশ একটি তালিকা করেছে। ওই তালিকায় গুলশান ও বনানী এলাকার মডেলের সংখ্যা বেশি। বছরখানেক আগে গ্রেপ্তার হওয়া ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকেন। তাদের সঙ্গে অপরাধ জগতের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সখ্য আছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। এমনকি বনানীতে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যাকান্ডে তাদেরও সম্পৃক্ততা ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছিল। ঘটনার পর পিয়াসা, রাজ ও আরাভকে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের এক বড় মাপের নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তার অনুরোধে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব বিষয় নিয়ে পুনরায় তদন্ত করা হতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংগীতশিল্পী, এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী ও কয়েকজন মডেল নিয়মিত দুবাই আসা-যাওয়া করেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০১ সালে তৎকালীন সরকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন ধরা পড়েছে। আবার কেউ ক্রসফায়ারে মারা গেছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তাড়া খেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে আছে কেউ কেউ। আত্মগোপনে থেকেই তারা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই দুবাই রয়েছে।
পুলিশ সূত্র আরও জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এ নিয়ে পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আলাদাভাবে বৈঠক হয়েছে। ওইসব বৈঠকে বলা হয়েছে, ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করার পরও কেন তারা ধরা পড়ছে না তা খতিয়ে দেখতে হবে। ২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাই চলে যায়। সেখান থেকেও ঢাকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। তার সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সোহেল শাহরিয়ার ওরফে শটগান সোহেল, কামরুল হাসান হান্নান, ইব্রাহীম, রবিন ও শাহাদৎ হোসেন বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্দিবিনিময় চুক্তি থাকায় বেশ কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, শাহাদৎ, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার আসামি নুর হোসেনসহ অনেকেই কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। নুর হোসেন ছাড়া অন্য সন্ত্রাসীদের দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। সুব্রত, মোল্লা মাসুদ ও শাহাদৎ ভারতে সুবিধা করতে না পেরে মুম্বাই হয়ে দুবাই চলে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার অপরাধজগতের এক সন্ত্রাসী এ প্রতিবেদককে বলেন, অপরাধীরা এখন আর ভারত যেতে চায় না। কারণ ওই দেশে শান্তিতে থাকা যায় না। ফলে সবাই এখন দুবাইমুখী হচ্ছে। দুবাইয়ে সবাই নিরাপদে থাকতে পারছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)