
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়কে চলাচল দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ছে, অনেকে বেঁচে থাকলেও পঙ্গু হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। শুধু সাধারণ মানুষ নয় জরিপে দেখা যাচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনার শিকার অধিকাংশই শিশু। গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ শিশু হেঁটে স্কুলে যায়। গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সড়ক নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে। নিয়ম না জানার কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীদের মৃত্যু উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, নিরাপদে বিদ্যালয়ে যাতায়াত ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সড়ক নিরাপত্তা সচেতনতা বাড়াতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কর্র্তৃক বাস্তবায়িত ‘সেকেন্ড রুরাল ট্রান্সপোর্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট-২ (আরটিআইপি-২) প্রকল্পভুক্ত ১৫টি জেলার ১৫টি উপজেলায় সড়ক নিরাপত্তা প্রচারাভিযান পরিচালনা করছে। এ কাজে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে ব্র্যাকের কমিউনিটি রোড সেফটি প্রোগ্রাম।
এই প্রচারাভিযানে ৩৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় নব্বই হাজার শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়কের তালিকা থেকে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হয়। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, শেরপুর, টাঙ্গাইল, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনার ২৫০ কিলোমিটার সড়কসংলগ্ন বিদ্যালয়সমূহে এ প্রচারাভিযান পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এ প্রচারাভিযানটি পরিচালিত হয়।
প্রচারাভিযানের আগে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুশীলন মূল্যায়নের জন্য নরসিংদী ও মেলান্দহ উপজেলার শিক্ষার্থীদের ওপর ভিত্তি জরিপ পরিচালনা করা হয়। ভিত্তি জরিপের ওপর পাওয়া ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে শিখন উপকরণগুলো তৈরি করা হয়; যার মধ্যে ছিলফ্লিপ চার্ট, কুইজ বুক।
ভিত্তি জরিপ থেকে জানা যায়, নরসিংদী সদরে শতকরা ৮৭ ভাগ শিক্ষার্থী হেঁটে স্কুলে যায়। মেলান্দহ উপজেলার শতকরা ৭২ ভাগ শিক্ষার্থী হেঁটে স্কুলে যায়। শতকরা ৪০ ভাগ শিক্ষার্থী একা স্কুলে হেঁটে যায় এবং শতকরা ৫৮ ভাগ শিক্ষার্থী তাদের বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে স্কুলে যায়। ভিত্তি জরিপে আরও জানা যায়, ছোট রাস্তার আশপাশে দুর্ঘটনা ঘটেছে প্রায় শতকরা ২৯ ভাগ (মেলান্দহে শতকরা ৩৪ ভাগ এবং নরসিংদী সদরে শতকরা ২৫ ভাগ) এবং প্রধান সড়কে শতকরা ২৫ ভাগ (মেলান্দহে শতকরা ২৬ ভাগ এবং নরসিংদী সদরে শতকরা ২৫ ভাগ)। গত ১২ মাসে প্রায় শতকরা ২১ ভাগ শিক্ষার্থীর সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
প্রচারাভিযান শেষে অনুবর্তী (ফলোআপ) স্টাডিতে, নরসিংদী সদরে প্রায় শতকরা ৬৮ ভাগ শিক্ষার্থী রাস্তার ডান দিক হাঁটা নিরাপদ মনে করেছে, যা বেজলাইন সার্ভেতে ছিল শতকরা ৩৭ ভাগ। রাতে রাস্তা চলাচল প্রসঙ্গে নরসিংদী ও মেলান্দহে প্রায় শতকরা ৩৪ ভাগ শিক্ষার্থী জানত না যে এ সময় রঙিন জামা পরা ভালো, যা এখন শতকরা ৬০ ভাগ শিক্ষার্থী জানে। ‘আগে আমি রাস্তার বাম পাশ দিয়ে হাঁটতাম। এখন আমি রাস্তার সঠিক দিক দিয়ে হাঁটা শিখেছি, আমি জেনেছি রাস্তার ডান দিকে হাঁটা নিরাপদ। আমি নিজে সচেতন হয়ে, আমার পরিবারের সবাইকে রাস্তায় নিরাপদে হাঁটা ও হাঁটার সময় সড়কের নিয়ম মেনে চলার পরামর্শ দিই।’ এভাবেই সড়ক সচেতনতার কথা বলছিলেন নরসিংদী সদর উপজেলার ভাটপাড়া নগেশ চন্দ্র গুপ্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারজানা হামিদ ফিজা।
অধিকাংশ শিক্ষার্থী রাস্তায় হাঁটা বা পারাপারের সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়। শিক্ষার্থীদের সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতার অভাবে এমন দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। সড়ক নিরাপত্তা প্রচারাভিযানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সড়কে নিরাপদে চলাচলের নিয়ম শেখানো হয়। শিক্ষার্থীদের সড়ক নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন করতে ৩৬০ জন প্রধান শিক্ষক ও ৭২০ জন সহকারী শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা বিদ্যালয়গুলোতে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সেশন পরিচালনা করেন। এ প্রচারাভিযানে অংশ নেওয়া একজন ছাত্র বলে, ‘আমরা আগে জানতাম না কীভাবে রাস্তা পার হতে হয়। আমরা ছুটে যেতাম। আমাদের শিক্ষক আমাদের ডানে-বামে দেখে দ্রুত রাস্তা পার হতে শিখিয়েছেন। এবং আমরা জেনেছি রাতে রাস্তায় চলাচলের জন্য আমাদের লাইট বা হারিকেন ব্যবহার করতে হবে।’
এই প্রচারাভিযানটি এলজিইডি আওতাভুক্ত ১৫টি জেলার ১৫টি উপজেলার ‘উপজেলা সড়ক নিরাপত্তা কমিটি’র কার্যক্রম গতিশীল করতে স্থানীয় সদস্যদের নিয়ে একটি বড় পরিসরের কমিটি গঠন করা হয়েছে। যেখানে ৬৭৫ জন সদস্য নিয়ে ৭৫টি ‘কমিউনিটি রোড সেফটি গ্রুপ’ গঠন করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সড়ক নিরাপত্তা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পেতে সক্ষম হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দেওয়া ফ্লিপ চার্টের মাধ্যমে তারা ছবি দেখে খুব সহজেই সড়ক নিরাপত্তা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছে। এই প্রকল্পের আগে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী জানত না কোন পাশ দিয়ে হাঁটতে হবে কিন্তু এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পর তারা জানে কোন পাশ দিয়ে রাস্তায় হাঁটা নিরাপদ। রাস্তায় নারী যাত্রী ও পথচারীদের নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতার বিষয়ে তারা জানতে পেরেছে। টাঙ্গাইলের ছনখোলা শেখ ফজিলাতুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র মো. আবু বকর বলে, ‘আমরা সঠিকভাবে রাস্তা পার হতে শিখেছি। প্রথমে বাম-ডানে দেখতে হবে কোনো যানবাহন আসছে কি না। তারপর ডানে, বামে, ডানে তাকাতে হবে, যদি কোনো যানবাহন না থাকে তাহলে দ্রুত রাস্তা পার হতে হবে।’
শিক্ষার্থীদের মধ্যে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে দিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে কুইজ বই দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা কুইজ বইয়ের মাধ্যমে তাদের অর্জিত জ্ঞান পুনরায় ঝালাই করতে পারবে। এ ছাড়া তারা তাদের পরিবারকেও সচেতন করতে পারছে। এই সড়ক নিরাপত্তা অভিযানের ফল মূল্যায়নের জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। আমরা আশাবাদী সড়ক নিরাপত্তায় এ প্রচারাভিযান শিক্ষার্থীদের নিরাপদে পথ চলতে সহায়তা করবে, যা তাদের দুর্ঘটনার হাত থেকে নিশ্চিত সুরক্ষা দেবে।
লেখক : প্রকল্প পরিচালক আরটিআইপি-টু (গ্রামীণ পরিবহন উন্নয়ন প্রকল্প)
মহানগর ও রাজধানী ঢাকার আজ এক নবযাত্রা শুরু হলো। নাম ঢাকা’র মতোই নগর ঢাকার ঢাকা পড়া ইতিহাসের অনেক পাতা হারিয়ে গেলেও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং ইতিহাসবিদদের রচনায় এটা স্পষ্ট যে, ঢাকা কেবল বাংলাদেশই নয় বরং বঙ্গীয় ভূগোলের অন্যতম প্রাচীন নগরী যা এখনো জীবন্ত ও ক্রমবর্ধমান। পূর্ববাংলার বাণিজ্য ও অর্থনীতির প্রধান কেন্দ্র ঢাকা একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেন্দ্র হওয়ায় ঢাকার ওপর বহু দুর্যোগ নেমে এসেছিল। এসব কারণে ঢাকার ধারাবাহিক ক্রমোন্নতি পাওয়া যায় না। তবে এটাও ঠিক যে, ১৮৬৪ সালে যে ঢাকায় প্রথম পৌরসভা চালু হয়েছি আর ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে ১৯১৭ সালে যে ঢাকা মহানগরের জন্য প্রথম নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেই তুলনায় আধুনিক মহানগর হিসেবে ঢাকা এখনো অনেক পিছিয়ে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ঢাকা বারবারই ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং পুরো দেশ ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সামনে এগিয়ে গেছে। তা যেমন রাজনীতিতে ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে, তেমনি অর্থনীতিতেও। আশার কথা হলো, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ঢাকা মহানগর ঘিরে যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে এবং যেসব পরিকল্পনা এখন বাস্তবায়নাধীন তাতে আগামীতে ঢাকা মহানগর সত্যিকার অর্থেই একটা আধুনিক মেট্রোপলিটন সিটি হিসেবে গড়ে ওঠার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ রাজধানী ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল চালু মেট্রোপলিটন ঢাকার অগ্রযাত্রায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের চলমান টানা তৃতীয় দফার প্রথম দফায় ২০১২ সালে এই মেট্রোরেল প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। মূল কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল লাইনের দৈর্ঘ্য ২১ কিলোমিটারের কিছু বেশি। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে আজ চালু হচ্ছে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ। মতিঝিল পর্যন্ত ২০২৩ সালে এবং কমলাপুর পর্যন্ত ২০২৫ সালে চালু হওয়ার কথা। এই মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। ক্রমেই দৃশ্যমান হতে থাকা ঢাকা মেট্রোতে কেবল এই উত্তরা-কমলাপুর রুটই নয়, আওয়ামী লীগ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় মোট ছয়টি মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সব মেট্রোরেল মিলে মোট দৈর্ঘ্য হবে ১২৮ কিলোমিটার। এসব মেট্রো রুটের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে পূর্বাচল সিটি, গাজীপুর, সাভারের আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জের দ্রুততম সময়ে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হবে। মেগাসিটি ঢাকার আগামীর চাহিদা পূরণ এবং যানজট নিরসনে সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প এসব। আশা করা যায়, ইতিমধ্যেই চালু হওয়া পদ্মা সেতু যেমন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভাবনীয় অগ্রগতির দুয়ার খুলে দিয়েছে; তেমনি ভবিষ্যৎমুখী গণপরিবহন ব্যবস্থার শুভসূচনা হিসেবে মেট্রোরেল ঢাকা মহানগরের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে।
ঢাকার মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) জানিয়েছে মেট্রোরেলের চলাচল, স্টেশনে থামা, কোথায় কত গতিতে চলবে সেসবের পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করা হবে কেন্দ্রীয়ভাবে, সফটওয়্যারের মাধ্যমে। এই ব্যবস্থা উত্তরার দিয়াবাড়ির ডিপোতে থাকা অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টারে (ওসিসি) থাকবে। আজ থেকে আগামী কিছুদিন মেট্রোরেল চলবে দিনে মাত্র চার ঘণ্টা করে। যদিও অন্তত মেট্রোরেলের বহরে ১২টি ট্রেন চলাচলের জন্য প্রস্তুত আছে, যা দিয়ে প্রতি তিন থেকে পাঁচ মিনিট অন্তর ট্রেন ছাড়া সম্ভব। এ ছাড়া মেট্রোরেলের মাত্রাতিরিক্ত নির্মাণ ব্যয় এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি নিয়েও সমালোচনা রয়েছে। আলোচনা-সমালোচনা চলছে মেট্রোরেলের নির্ধারিত ভাড়া সবার জন্য উপযোগী কি না তা নিয়েও। এটা মনে রাখতে হবে যে, ঢাকার ৬০-৭০ শতাংশ মানুষই গণপরিবহন ব্যবহার করেন। কিন্তু একটা সেকেলে ও অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ গণপরিবহন ব্যবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে মানুষকে দ্রুতগতির গণপরিবহনে নিয়ে আসার এই ক্রান্তিকালে সবদিক থেকেই মেট্রোরেলকে যাত্রীবান্ধব করে তুলতে হবে।
ঢাকা মহানগরের যানজট কমাতে ও মেট্রোরেলের পূর্ণাঙ্গ সুফল পেতে মেট্রোর পাশাপাশি এক ছাতার নিচে সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থায় আধুনিক বাস সার্ভিস চালু করা এবং মেট্রো স্টেশনগুলোর সঙ্গে তা যুক্ত করা খুবই জরুরি। এ ছাড়া মেট্রো স্টেশনের কাছে পর্যাপ্ত গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা এবং স্টেশনের আশপাশে পথচারীদের প্রাধান্য দিয়ে স্বচ্ছন্দে হাঁটাচলার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। তবে মেট্রোরেলের কাক্সিক্ষত সুফল পেতে হলে ঢাকার চারপাশ ঘিরে যে সার্কুলার রুট ও বাইপাসের পরিকল্পনা রয়েছে সেটা বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে এবং এসব সার্কুলার রুটের সঙ্গে মেট্রোরেল রুটগুলোকে যুক্ত করতে হবে। এভাবে ঢাকা মেট্রোকে ঘিরে থাকা গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের মতো শহরগুলো সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থায় যুক্ত হয়ে গেলে ঢাকা সত্যিকার অর্থেই যুগোপযোগী ঢাকা মেট্রোতে পরিণত হতে পারবে।
মেট্রো হচ্ছে আধুনিক নগরীর বাহন। এটার প্রভাব পড়ে অনেক জায়গায়। শহরের ভূমি ব্যবহার কেমন হবে, তা মেট্রোই নির্দিষ্ট করে দেয়। বিশেষ করে মেট্রো স্টেশনের আশপাশে। সেখানে ভূমির ঘনত্ব বেড়ে যায়। মেট্রো হলো একধরনের ‘ফ্যাটাল অ্যাট্রাকশন’। মানুষজনের মধ্যে মেট্রোকেন্দ্রিক আগ্রহটা মারাত্মক রকমের বেশি। এখন যেমন অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের স্কুলের আশপাশে বাসা নেওয়া বা থাকাটা প্রাধান্য দেন; তেমনি গ্লোবাল অভিজ্ঞতায় বলে যে, মেট্রো হওয়ার পর মানুষ যখন এর নির্ভরযোগ্যতা, দ্রুতগামিতা এবং আরামদায়কতা দেখে, তখন সে মেট্রোর আশপাশে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করে। এর ফলে মেট্রোর পাশের যে ভূমি মালিকের দোতলা বাড়ি ছিল, তিনি তা ২০ তলা বানিয়ে ফেলেন। ভাড়ার চাহিদা এত বেড়ে যায় যে, এরপরও তার নিজেকে বোকা মনে হতে পারে।
মেট্রো হওয়ার কিছুদিন পরেই দেখা যায়, স্টেশনের পাশে ভূমির ব্যবহারের ঘনত্বটা বাড়তে বাড়তে ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের দিকে চলে যায়। তবে ঢাকার মতো আনপ্ল্যানড সিটিগুলোর ক্ষেত্রে এটা সমান্তরালভাবে পেরিফেরিতে আনুভূমিক ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ে। এটা এত বড় হয়ে যায় যে, সেটায় আর নিয়ন্ত্রণ থাকে না যেটা আসলে ম্যানেজেবল না। কিন্তু স্মার্ট সিটির ডেফিনেশনই হলো সংক্ষিপ্ত জায়গার। সিঙ্গাপুর, হংকংয়ের মতো ছোট জায়গায় ছোট শহরে যেমনটা হয়েছে ইকোনমিক, ভাইব্রেন্ট অ্যাক্টিভিটি। মেট্রো স্টেশনের পাশে যতই ঊর্ধ্বমুখী যাওয়া যাক না কেন কোনো যানজট হয় না। মানুষ স্টেশনের পাশে থেকে হাঁটার দূরত্বে মেট্রো ধরবে। ভূমি ব্যবহারটা এমন হতে হয় যে, মেট্রো স্টেশনের সামনে থাকে অফিসপাড়া, বাণিজ্যিক এলাকা; এর পেছনে থাকে সার্ভিস; তার পেছেনে থাকে আবাসিক এলাকা। এরকম তিন-চারটা রিং করে কেবলাটা দেওয়া হয় মেট্রো স্টেশনমুখী। সবকিছু আধা কিলোমিটারের দূরত্বে হবে, সবাই সমান দূরত্বে। এই মেট্রো কেবলাকে বলে সাবজেন। মানুষ তখন এই মেট্রোসংশ্লিষ্ট চিন্তাভাবনা করে দিনযাপন করে। মানে, এই অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে কখন বের হবে, আধাঘণ্টা আগে না এক ঘণ্টা পরে রওনা করবে বা সপ্তাহের কোন বার, ভিড় হবে কিনা এসব হিসাবনিকাশ করতে হবে না। সে কেবল মেট্রো আসার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে স্টেশনে পৌঁছাবে। এই যে সে হেঁটে স্টেশনে চলে গেল, তার গাড়ি লাগল না, বাসে উঠতে হলো না, বাস-গাড়ি লাগছে না, সরকারকেও রাস্তা বানাতে হচ্ছে না। অন্যদিকে জ¦ালানি তেলও বেঁচে গেল। মেট্রোর ফলে এভাবে একটা নগরী স্মার্ট হয়ে ওঠে। মেট্রোর উদ্দেশ্যও এটাই।
মেট্রোর ক্ষেত্রে আমরা যে গণপরিবহনের কথা বলছি, সেটা আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধি দিয়ে বলছি। মেট্রোর ব্যাপকতাটা এরকম যে, শহরকে যদি আমরা স্মার্ট করতে চাই; তাহলে মেট্রোকে মেরুদ- করে শহরটাকে মেট্রো স্টেশনকেন্দ্রিক করতে হবে। এটা করা গেলে ব্যক্তিগত গাড়ি, গণপরিবহনের সংখ্যা কমে যাবে, দূষণ কমে যাবে, যানজট কমে যাবে। অন্যদিকে, এখন যাতায়াতের ক্ষেত্রে মানুষের কর্মঘণ্টার যে ১২ বিলিয়ন ডলারের মতো প্রতিবছর লস হচ্ছে, সেটা লস না হয়ে জিডিপিতে যোগ হবে। এ ছাড়া, এখন যে ভাঙাচোরা গণপরিবহনে বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিসে যায় মানুষ, এতে তো সে যাত্রাপথেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তার শক্তি তো অফিসে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই শেষ, কাজের শক্তি সে পাবে কোথায়! যাত্রাপথের এই ভোগান্তিতে তার প্রোডাক্টিভিটি কমে যায়। তো মেট্রোতে যারা চলবেন তারা এসব ঝঞ্ঝাট এড়িয়ে পুরো শক্তি নিয়ে সজীবতা নিয়ে অফিসের কাজে নিজের সবটুকু দিতে পারবেন। এমনকি কাজ শেষে বাসায় ফেরার পরও সজীবতা নিয়ে ফিরবেন, পরিবারকে কোয়ালিটি টাইম দিতে পারবেন। এজন্যই কিন্তু মেট্রো এত ক্যাপিটাল ইনটেন্সিভ বা ব্যয়বহুল হওয়ার পরও পৃথিবীতে এটাকেই ভিত্তি করে নতুন নতুন শহরগুলো হচ্ছে।
এসব বিবেচনায় মেট্রোকে যদি আমরা একটু সার্বিক বিবেচনায় বানাতে পারতাম, তাহলে এতক্ষণ যে কথাগুলো বললাম, সেগুলো আমাদের অর্জন হতো। কিন্তু আমরা ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে এর সমন্বয়ই করিনি। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এখানে অনুপস্থিত। রাজউক যে একটা স্পেশাল ড্যাপ দেবে, সেটা কীভাবে? এখন যে শেওড়াপাড়া, সেনপাড়া, মিরপুরে ৬ তলার বেশি আবাসিক ভবন করতে দেওয়া হয় না, মেট্রোর পর তা কি বদলাবে? অন্যান্য দেশে এই মেট্রোর আশপাশে এবং মেট্রো যেই করিডরে থাকে সেখানে পথচারীদের চলাচলের জন্য ফুটপাথগুলো চওড়া থাকে। যাতে লোকজন হাঁটাচলা করতে পারে, স্টেশনে আসতে পারে, যাত্রীরা একসঙ্গে ওঠানামা করতে পারে। স্টেশনের আশপাশে ছোট ছোট গাড়িতে, যেমন রাইড শেয়ার, রিকশা, মাইক্রো, সিএনজি ইত্যাদি যাত্রী নামাতে আসবে; এগুলো যেন মূল সড়কে না দাঁড়ায়, ট্রান্সফার ফ্যাসিলিটিজ দিয়ে মূল রাস্তার থেকে ভেতরের দিকে লোক নামায় সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। অন্যান্য দেশের সরকার অধিগ্রহণের দিকে যায় না। এটা সেকেলে হয়ে গিয়েছে। মনে রাখতে হবে মেট্রো হওয়ার পর আশপাশের ভূমির ভ্যালু কিন্তু অনেক বেড়ে যায়। তো এখন যেটা করে সরকার ল্যান্ড ভ্যালুকে ক্যাপচার করে উইন উইন সিচুয়েশন তৈরি করে ভূমির মালিককে গিয়ে বলে ‘তুমি আছ প্লটে, চলো আমরা ব্লকে চলে যাই। তুমি জায়গাটা দাও, তোমার আড়াই কাঠার সাথে আমি আরও সাড়ে তিন কাঠা জোড়া লাগিয়ে ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করে আমরা পার্টনার হয়ে যাই।’ আমিও ইনকাম করব, তুমিও করবে এবং জনগণের জন্য হাঁটার চাহিদা, ট্রান্সফারের চাহিদা মিটিয়ে, কমার্শিয়াল অ্যাক্টিভিটি করে ইনকাম করব। কেবল মেট্রোর ভাড়া থেকে খরচটা তুলব না। স্টেশনের আশপাশের বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনা করে নন-অপারেশনাল কিছু করে কিছু রেভিনিউ কালেকশন করব। আর মেট্রো ভাড়াকে পানির মতো সস্তা করে দেব। দেখলে মনে হবে যে ফ্রি দেওয়া হচ্ছে। দেউলিয়া হচ্ছি। কিন্তু আসলে তা না। আমি ইনকামের জন্য শুধু যাত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকিনি। অভিজ্ঞতা বলছে বাণিজ্যবিতান, বাজার থেকে শুরু করে অফিস, ব্যবস্থাপনা মেট্রো স্টেশনমুখী করলে, সেখান থেকে টাকা ইনকাম সম্ভব। আর সেই টাকা হিসাবে ধরে মেট্রো ভাড়া কমিয়ে মানুষের ওপর চাপ কমানো যায়। আর ভাড়া একদম কমিয়ে রাখলে মানুষও ব্যক্তিগত গাড়ি, অন্যান্য গণপরিবহনের চেয়ে মেট্রোতে চড়তে বেশি আগ্রহী হবে। তখন দেখা যাবে যে নিচের রাস্তা ফাঁকা পড়ে আছে। এজন্য মেট্রোতে চড়ার ভাড়া কমিয়ে সাধারণ মানুষের নাগালে আনার জন্য ভূমির সমন্বিত ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনায় সমন্বয় ঘটাতে হবে। কিন্তু আমরা এটি করিনি। তাই ব্রেকইভেনে আসতে প্রথমেই যাত্রীর থেকে আশপাশের দেশগুলোর চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করার কথা ভাবছি।
আশপাশের দেশগুলোর মধ্যে যারা ২০১৯/২০/২১ সালে মেট্রো উদ্বোধন করেছে আমরা তাদের থেকে প্রায় দুই-তিনগুণ বেশি ভাড়া ধার্য করলাম। যারা এই ভাড়া ঠিক করেছেন তারা যদি একটু আশপাশের দেশগুলোর দিকে তাকাতেন, তাহলে ভালো করতেন। কিন্তু তারা তো সেটা করবেন না। কারণ অন্যদের দিকে তাকালেই দেখতে পারবেন যে, তাদের অদক্ষতার জন্য নির্মাণের সময় এবং খরচ দুটোই বেড়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে, অদক্ষতার জন্য বাড়তি খরচ করলাম, মানুষকে ‘উন্নয়ন যন্ত্রণা’ দিলাম, আবার যে বাড়তি খরচ হলো, সেটাও জনগণের ওপর চাপিয়ে দিলাম। ওনারা মাঝে মাঝে সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া বা কম্ফোর্টের কথা বলেন। কিন্তু তারা একবারও ভাবেন না যে, মেট্রো মানুষকে ডোর টু ডোর ফ্যাসিলিটি দেবে না। তাহলে বাসা থেকে ফিডার হিসেবে বাহন খরচ ব্যয় করে সে মেট্রো স্টেশনে আসবে। মেট্রো থেকে নামার পরও তার গন্তব্যে যেতে আবার অন্য বাহন নিতে হতে পারে। এখানে একটা ট্রিপের মধ্যে সময় এবং তিনটা ভাড়া খরচের হিসাব প্রতিদিনের জন্য ধরতে হবে। এখন স্বল্প বা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ তাদের কাছে তো দ্রুতগতি ও কম্ফোর্টের চেয়ে প্রতিদিনের খরচের হিসাবটা তো অত্যন্ত জরুরি। এজন্য মেট্রোর ভাড়াটা কৌশলগতভাবে অনেক কমিয়ে রাখা হয়। এজন্য সাবসিডি বা ভর্ভুকি লাগে না।
পাশাপাশি নির্মাণ খরচটাও আমরা অনেক বেশি করে ফেলেছি। জাইকার লোনে পাশের দেশের কলকাতার ইস্ট-ওয়েস্টে যে মেট্রো হলো, সেটাতে ৫৭ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে পার কিলোমিটার করতে। আর আমরা প্রতি কিলোমিটারে খরচ করেছি ১৫৪ মিলিয়ন ডলার। পাকিস্তান আমাদের পরে কাজ শুরু করে প্রায় পৌনে এক বছর আগে তারা মেট্রোর উদ্বোধন করেছে। তাদের প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছে ৬৭ মিলিয়ন ডলার। এসব তথ্য এটাই বলে যে, আমরা বেহিসাবিভাবে উন্নয়ন করেছি। এর দায় তো ভাড়া বাড়িয়ে মানুষের ওপর চাপানো ঠিক নয়।
এর ফলে মেট্রোর যে মূলমন্ত্র আমজনতাকে মেট্রোতে তুলে নিচের রাস্তা ফাঁকা করে আমি যানজট কমাব, সেটাই তো হবে না মনে হয়। এটা ঠিক যে, মেট্রো দিয়ে সবার ট্রিপ হবে না, যাত্রাপথ মিলবে না। কিন্তু নিচে যারা থাকবেন তারাও কিন্তু মেট্রো দ্বারা উপকৃত হবেন বলে আশা করা হয়। এখন যেহেতু স্টেশন সমন্বিত হয়নি, রাইড শেয়ারের জন্য আলাদা জায়গা নেই, ফলে বর্তমানে রাজধানীর সড়কগুলোতে বাসগুলো যেমন জটলা পাকিয়ে একটা বটলনেক তৈরি করে, তেমনি প্রতিটি মেট্রো স্টেশনে একটা করে বটলনেক তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে যা ভোগান্তি বাড়াবে। আমি একজনকে কম্ফোর্ট দিতে গিয়ে আরেকজনকে ক্ষতিগ্রস্ত করব, মেট্রোর উদ্দেশ্য তো তা নয়। আমি বলব এখানে অনেক কিছু আশপাশের দেশগুলো থেকে শিখতে হবে। পাকিস্তানের মেট্রো ড্রাইভারলেস। ওদের চেয়ে বেশি খরচে, বেশি সময়ে আমরা যে মেট্রো করলাম সেখানে ড্রাইভার তৈরি, নিয়োগ, প্রশিক্ষণের আরেক বোঝা মাথায় নিলাম।
আসলে এখানে সরকার ও কর্তৃপক্ষের ভাবনাচিন্তার ব্যাপার আছে। আগামীতে আমরা আরও ৫টি মেট্রো করব। এখানে করাটা বড় না, কত টাকায় করলাম; যেহেতু ফেয়ার বা ভাড়ার সঙ্গে রিলেটেড, এটা তো ফ্লাইওভার না যে করে হাত গুটিয়ে নেব তা সম্ভব নয়। যা করলাম তার মাশুল যদি যাত্রীদের ওপর গিয়ে পড়ে, সেটা কাম্য নয়। স্মার্টলি করতে পারলে, কম খরচে, কম সময়ে করতে পারলে তখনই আমজনতা এর সুফল পাবে। সেই জায়গায় এই মেট্রো-৬ একটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে। সেটা হচ্ছে যারা এটি বানালেন তারা যেন এটার মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করে পরের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক
আজ উদ্বোধন হচ্ছে দেশের প্রথম মেট্রোরেল। আমাদের আর্থিক সক্ষমতা, পরিবেশবান্ধব পরিবহনব্যবস্থা ও টেকসই উন্নয়নের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে যাচ্ছে আধুনিক এ যোগাযোগ অবকাঠামো। ঢাকা শহরের প্রধান সমস্যা যানজট কমিয়ে নাগরিক জীবনকে গতিশীল করাই যার প্রধান উদ্দেশ্য। ২৫ জুন ২০২২ তারিখে বাংলাদেশের দক্ষিণের দুয়ার উন্মুক্ত করা পদ্মা সেতু যেমন ২১ জেলার সঙ্গে অবিশ্বাস্যভাবে যোগাযোগব্যবস্থাকে পাল্টে দিয়েছে, জীবনে এনেছে গতি, তেমনি আশা করা যাচ্ছে পদ্মা সেতুর মতোই ঢাকাকে নতুন এক অভিজ্ঞতার সুন্দর সকাল উপহার দেবে মেট্রোরেল।
মেট্রোরেল সার্ভিস বর্তমান সময়ে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে চলাচলের প্রধান বাহন হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। ১৮৬৩ সালে লন্ডনে প্রথম চালু হয় ভূগর্ভস্থ মেট্রোরেল। পৃথিবীর ইতিহাসে বিস্ময় জাগানিয়া বিখ্যাত সেই মেট্রোরেল আজও নিরবচ্ছিন্নভাবে লন্ডনবাসীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। চালু হওয়ার প্রথম দিনেই লন্ডনে ৩০ হাজার যাত্রী পরিবহন করে নাটকীয়ভাবে লন্ডনের মানুষের জীবনকে পাল্টে দিয়েছিল মেট্রোরেল। গত ২০১৯ সালে লন্ডনে মেট্রোরেল ব্যবহার করেছেন ১.১৭ বিলিয়ন যাত্রী। ১১০ বছর আগের নিউ ইয়র্ক মেট্রো ২০২০ সালে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টায় ব্যবহার করেছে ১.৭১ বিলিয়ন যাত্রী। শুধু ইউরোপ আমেরিকায় নয় এশিয়ার জাপানে ১৯২৭ সালে চালু হওয়া মেট্রোরেল এখন সেখানকার প্রধান বাহন। মেগাসিটি টোকিওতে প্রতিদিন ৮.৭ মিলিয়ন লোক মেট্রোরেল ব্যবহার করে। বর্তমান বিশে^র বড় শহরগুলোর মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে মেট্রোরেল।
রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল মেগাসিটি। ঘনবসতির দিক থেকে ২০২২ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৯,৩৫৩ জন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩০,৩৫৩ জন লোক বসবাস করে। জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক দিয়ে ঢাকা পৃথিবীর জনবহুলতম শহর। যেখানে জীবনমান উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় অসহনীয় যানজট। আশা করা যায় এ যানজটের অভিশাপ থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিতে পারবে কাক্সিক্ষত মেট্রোরেল।
২০৩০ সালের মধ্যে ছয়টি মেট্রোরেল প্রজেক্ট চালু করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। ১২৮.৭ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল এবং পাতাল মেট্রোরেল নির্মাণ করে ঢাকাকে যানজটমুক্ত করতে চায় সরকার। সব কটি লাইনের কাজ (সমীক্ষাসহ) চলমান থাকলেও বেশি অগ্রগতি হয়েছে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন লাভ করা ২০.১ কিলোমিটার দীর্ঘ উত্তরা থেকে মতিঝিল-কমলাপুর মেট্রোরেল প্রকল্প। এই মেগা প্রকল্পটি জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ প্রচেষ্টায় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হলে উভয় দিকে থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। ১৬টি স্টেশনে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য ১৩.৪৭ মেগাওয়াট নেওয়া হবে জাতীয় গ্রিড থেকে, যার জন্য স্থাপন করা হয়েছে ডেডিকেটেড বিদ্যুৎকেন্দ্র।
উত্তর ও দক্ষিণ দুই সিটি করপোরেশন মিলে ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৮ হাজার ৮৮২ জন। এ জনসংখ্যার বিপরীতে প্রয়োজনীয় রাস্তাঘাট বা যানবাহন খুবই অপ্রতুল। ২০১৭ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখানো হয় যানজটের কারণে ঢাকা নগরীতে প্রতিদিন গড়ে ৩.২ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, অর্থমূল্যে যার পরিমাণ প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০০৭ সালে ঢাকা শহরে গাড়ির গড় গতি যেখানে ছিল ২১ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা, সেখানে ২০১৭ সালে সে গতি কমে দাঁড়িয়েছে ৬ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। বিশ্বব্যাংক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, ২০৩৫ সালে ঢাকার গাড়ির গড় গতি ৪ কিলোমিটার ঘণ্টায় নামতে পারে, যা হেঁটে চলা মানুষের গতির থেকেও কম। ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় গণপরিবহনের জন্য রাস্তা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তথ্য মতে, ব্যক্তিগত গাড়ির দখলে ঢাকার সড়কের ৭৬.৩৫ শতাংশ আর ঢাকায় সড়ক আছে ভূমির ৭-৮ শতাংশ। রাজধানী ঢাকা আমাদের জিডিপির প্রায় ৪০ শতাংশ জোগান দেয়, কেননা ঢাকাতেই সব বড় শিল্প-কারখানা ও অফিস। যানজট না থাকলে এ অবদান আরও অনেক বেশি হতে পারত। উত্তরা থেকে মতিঝিল যাতায়াত করতে যেখানে বর্তমানে সময় লাগে ২-৩ ঘণ্টা, সেখানে মেট্রোরেল চালু হলে উত্তরা থেকে কমলাপুর যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩৮ মিনিট। যানজটে শুধু আর্থিক ক্ষতিই হচ্ছে না, মানসিক বিভিন্ন অবসাদের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। পাশাপাশি ঢাকাবাসী ভুগছে উচ্চ রক্তচাপ, বক্ষব্যাধিসহ আরও নানান স্বাস্থ্য সমস্যায়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলে ২০৩০ সালে মেট্রোরেলের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ মানুষকে পরিবহনসেবা দেওয়া যাবে, যা ঢাকার যানজট এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অসামান্য অবদান রাখবে। সরকারের নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকায় মেট্রোরেলের সবগুলো রুট বাস্তবায়িত হলে তীব্র যানজটের শহর ঢাকা হয়ে উঠবে গতিশীল এক চঞ্চল নগরী। আমাদের গণপরিবহনে গর্ভবতী মহিলা, বয়স্ক মানুষ, নারী ও প্রতিবন্ধীরা অপর্যাপ্ত ব্যবস্থার জন্য প্রধানত সমস্যায় পড়ে। মেট্রোরেলে এ বিশেষ মানুষগুলোর জন্য থাকছে বিশেষ সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা। সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতি নিয়ে মেট্রোরেল মাত্র ৩৮ মিনিটে যাত্রীদের পৌঁছে দেবে ঢাকার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। মেট্রোরেলের উন্নতসেবার ফলে মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে অনুৎসাহিত হবে, মেট্রোরেল হয়ে উঠবে প্রধান গণপরিবহন।
বর্তমানে বিশ্বের ৫৬টি দেশের ১৭৮টি শহরে ১৮০টি পাতালরেল ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ঢাকায় চালু হলে তা হবে ৫৭তম দেশ। কিন্তু অচিরেই ব্যবহারকরীর সংখ্যার দিক থেকে ঢাকা উঠে আসবে প্রথম সারিতে। এখন যানজটের প্রতি মিনিটেই কোটি কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগ তুলনামূলক কম আকৃষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ অসহনীয় যানজট। রিসার্চ গেটের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে ঢাকায় যানজটের কারণে ৬.৫ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে এবং ২০১৮ সালে এ ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৫ বিলিয়ন ডলার, যা জাতীয় অর্থনীতিতে নিম্নমুখী প্রভাব ফেলছে।
মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অপারেটিং রুম, টিকিট কাউন্টার, ক্যাফেটেরিয়া, পরিচ্ছন্নতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনাসহ পুরো সিস্টেম পরিচালনা করতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দক্ষতাসম্পন্ন লোকবল বৃদ্ধি পাবে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ মেট্রোরেল প্রকল্পে প্রায় ১২,০০০ জন প্রকৌশলীর কর্মসংস্থান হবে। আমাদের জনশক্তি নতুন এক প্রযুক্তি সম্পর্কে অবগত হবে। এতে আমাদের ভবিষ্যতে এ ধরনের আরও নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ সাশ্রয় করবে। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের মতে, মেট্রোরেল আমাদের প্রতি বছর ৩৫০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করবে। এ ধরনের বড় প্রজেক্ট চালানোর জন্য চাই দক্ষ কর্মিবাহিনী। তাই আমাদের দেশের লোককে কারিগরি বিষয়গুলোতে দক্ষ করে তুলতে হবে। আশার কথা হচ্ছে, মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রথম দিকে ৭৫ শতাংশ বিদেশি লোক কাজ করলেও বর্তমানে ৮০ শতাংশই বাংলাদেশি কাজ করছে।
মেট্রোরেল রাজধানীর পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালু। শুধু বায়ুদূষণজনিত কারণে প্রতি বছর দেশে কয়েক হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। এ প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎচালিত মেট্রোরেল আমাদের পরিবেশকে খুব কম দূষিত করবে। রাজধানী ঢাকাকে সবার জন্য বসবাসের উপযোগী করতে যথাযথ, সুদূরপ্রসারী ও সমন্বিত মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের অন্যতম পদক্ষেপ মেট্রোরেল ব্যবস্থা। বিপুলসংখ্যক যাত্রী পরিবহনে সক্ষমতার জন্য মেট্রো হয়ে উঠবে ঢাকার প্রধান বাহন। ফলে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা হ্রাস পাবে, যা পরিবেশের জন্য উপকার হবে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় ধারাবাহিকভাবে ছয়টি রুটে ১২৮.৭ কিলোমিটারে (৬১ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ডসহ) ১০৪টি স্টেশন নির্মাণের যে বৃহৎ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার তাতে ঢাকা অনেকটাই যানজটমুক্ত হবে। মেট্রোরেল প্রাথমিকভাবে সর্বোচ্চ ৬০,০০০ যাত্রী পরিবহন করতে সক্ষম হলেও ঢাকায় স্কুল, কলেজ ও অফিস চলাকালীন যাত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি থাকবে। মেট্রোরেলের যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে তা দিয়ে বৃহৎ এ প্রকল্পে লাভ করার চিন্তা সরকারের আপাতত নেই। তার পরও নির্ধারিত ভাড়া শ্রমজীবী মানুষ, সাধারণ ও ভাসমান শ্রমিক, নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হচ্ছে কি না তা বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে। দীর্ঘদিনের অপরিকল্পিত ঢাকায় মেট্রো নির্মাণের পরও ফল পাওয়া চ্যালেঞ্জিং। যাত্রীদের মেট্রোরেল থেকে নেমে নিকটবর্তী বা দূরবর্তী স্থানে যেতে সাপোর্টিভ পরিবহনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে হবে। তা ছাড়া সংযোগ রাস্তাগুলোকে যথাসম্ভব চলাচল উপযোগী এবং হকারমুক্ত রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে।
২০৪১ সাল নাগাদ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে যোগাযোগব্যবস্থার আধুনিকায়ন ছাড়া সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। গত দেড় দশকে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। কৃষি, শিল্প, সেবা খাতে বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বাংলাদেশ। আর এসবের কেন্দ্রবিন্দু তিলোত্তমা মহানগরী ঢাকা, যার জন্য টেকসই, পরিবেশ ও যাত্রীবান্ধব এবং সময় সাশ্রয়ী গণপরিবহনব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: সামরিক বাহিনীতে কর্মরত
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা এবং নাট্যকার আবদুল জব্বার খান বাংলা ১৩২২ সালের ৭ বৈশাখ (১৯১৬ ইং) মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে উত্তর মসদগাঁওয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম হাজি মোহাম্মদ জমশের খান। আসামের ধুবড়ী এলাকায় তার শৈশবে ও স্কুলজীবন কাটে। স্কুলে থাকতেই তিনি অভিনয় করেন ‘বেহুলা’ ও ‘সোহরাব রোস্তম’ নাটকে। ১৯৪১ সালে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল থেকে ডিপ্লোমা পাস করে চাকরিতে যোগ দেন। দেশভাগের পর ১৯৪৯ সালে স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে সংগঠিত করেন ‘কমলাপুর ড্রামাটিক অ্যাসোসিয়েশন’। ১৯৫৬ সালে তার রচিত নাটক ‘ডাকাত’ অবলম্বনে তৈরি করেন ‘মুখ ও মুখোশ’ নামক চলচ্চিত্র। এটাই ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল জব্বার খান মুজিবনগর সরকারের চলচ্চিত্র প্রদর্শন ও পরিবেশনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জুরি বোর্ড, অনুদান কমিটি, সেন্সর বোর্ড, ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও আর্কাইভে সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। আবদুল জব্বার খান ১৯৯৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
বর্তমান সময়ে একটি খবর অনেক শেয়ার হতে দেখেছি ফেসবুকে। সেট হলো বিয়ে বিচ্ছেদের খবর। আধুনিক তরুণ-তরুণীরা একসঙ্গে বেশি দিন থাকতে চান না। এ মানসিকতা কেন গড়ে উঠল? এমনকি প্রেমের বিয়েও টিকছে না। এই জটিল পরিস্থিতি নিয়ে কিছু কথা মনে পড়ল। যেমন-
‘আমাদের সোসাইটির সমস্যাটাই এখানে। আমরা সব সময় সম্পর্কের পরিণতি নিয়ে চিন্তা করি। আরে বাবা প্রেমটা তো প্রেমই। প্রেমের আবার পরিণতি থাকতে হবে কেন? সম্পর্কের আগে অবশ্যই মানুষ চিন্তা ভাবনা করে সম্পর্কে জড়াবে না। কারণ এটা মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে হয়ে যায়। কারো সাথে জোর করে তো সম্পর্ক হয় না।’
কথাগুলো বলেছে কুঞ্জ। সুশ্রী, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার কুঞ্জ অবশ্য বাস্তব কোনো চরিত্র নয়। একটি উপন্যাসের চরিত্র। উপন্যাসটির নাম ‘প্রেম যমুনার মাতাল হাওয়া’। এর লেখক মাহবুব নাহিদ।
কুঞ্জ বাস্তবে বিচরণ না করলেও আধুনিক সময়ের নাগরিকদের মনের এক জটিল জিজ্ঞাসাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এই যে ‘প্রেমের আবার পরিণতি থাকতে হবে কেন?’ কিংবা বিয়ের পরও প্রেম থাকে কি না-এ সংকট অনেকের বেঁচে থাকাকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।
উপন্যাসেও কুঞ্জকে আমরা পাই বিপন্ন অবস্থায়। সৌহার্দ্যের সঙ্গে তার প্রেমের পর বিয়ে হলেও ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
আমাদের সমাজে বিয়ের পর সেপারেশনে থাকা একজন নারীকে কী যন্ত্রণা পোহাতে হয় তার উদাহরণ এই কুঞ্জ। ঘরের মা থেকে শুরু করে সমাজের নানা অংশের মানুষ তাদের জীবন বিষিয়ে তোলে।
‘বিষ’ দিয়ে শুরু হয় মাহবুব নাহিদের উপন্যাস ‘প্রেম যমুনার মাতাল হাওয়া’। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের হাসি, কষ্ট, রাগ, অভিমান নিয়ে শুরু হওয়া উপন্যাসটি এগিয়ে যেতে থাকে কুঞ্জকে কেন্দ্র করে। ইন্টেরিয়র ডিজাইনার কুঞ্জ সৌহার্দ্যের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর এক বান্ধবীর বাবার রিসোর্টে কাজের অফার পায়। তবে পরিবারের নির্দেশে একা শ্রীমঙ্গলে যাওয়া হয় না তার। বোন বৃন্তকে সঙ্গে নিতে হয়। এই বৃন্ত খুব মজার এক চরিত্র উপন্যাসে। নিজের দুষ্টু বুদ্ধি দিয়ে পরিবারের সব মুশকিল আসান করে সে।
শ্রীমঙ্গলে কুঞ্জর সঙ্গে দেখা হয় দিহানের। দিহানও মজার একটি চরিত্র। ক্ষণে ক্ষণে পাঠককে হাসাতে পারার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার। দিহানের আচরণে কুঞ্জ মাঝে মাঝে রেগে যায় আবার হেসেও দেয়।
তাদের দুজনের সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হওয়ার সময়ে রিসোর্টে এসে হাজির সৌহার্দ্য। উপন্যাসের শুরু থেকে যে কষ্ট কুঞ্জর মনকে আবদ্ধ করে রাখছিল, পাঠকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় এখানে এসে।
এরপর এক বৃষ্টির দিনে কুঞ্জ আর সৌহার্দ্য দেখা থেকে শুরু করে প্রেমের ঘটনা জানা যায়। আধুনিক মনস্ক দুটি ব্যক্তি কত যে টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে যায়! তারপর তাদের যখন সংসার হয়, যতই প্রেম থাকুক, দুজন মানুষ যখন সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকতে শুরু করে-তখন তাদের একে অপরের অন্য রূপ দেখতে পায়। যেমন সৌহার্দ্য বলে, ‘আমরা পুরুষ মানুষ ভারী অদ্ভুত এ বুঝলে। তুমি হয়তো জান না। প্রায় প্রত্যেক পুরুষের মাঝেই এক ধরনের অচেনা সত্তা বাস করে। ভয়ংকর সত্তা। অবচেতন মনে এরা ভয়ংকর কল্পনায় মেতে ওঠে। অথচ নিজেও সেটা কোনো দিন টের পায় না। তুমি সেই রূপ দেখেছ তাই তোমার কাছে আমার অপ্রকাশ্য আর কিছুই নেই। তুমি যদি শাস্তিস্বরূপ আমাকে আজীবন দূরে সরিয়ে রাখতে চাও, রাখতে পারো। কিন্তু বিশ্বাস করো কুঞ্জ, আমরা দুজন দুজনকে অসম্ভব ভালোবাসি। আমরা একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারব না। অযথা এই শাস্তি নিজেকে দিও না।’
কুঞ্জও যেমন ভাবে, ‘প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে গেলো কুঞ্জ। পুরুষ মানুষ এমনও হয়! এ আবেগের নাম কি দেবে সে? তার নিজের একজন ইস্পাতের মতো কঠিন পুরুষ মানুষ আছে। সেই মানুষের সম্পূর্ণ বিপরীত এই পুরুষ মানুষটি। তার মানুষটা উদাসীন, প্রিয়তমা ও সংসারের বাইরে ভিন্ন একজন মানুষ। আর দিহান, প্রচণ্ড সংসারীমনা, প্রিয়তমাকে ভালোবেসে সর্বক্ষণ নিজের উজাড় করে দিতে প্রস্তুত ধরনের একজন। জগতে কত অদ্ভুত প্রজাতির মানুষ বাস করে তা বোঝা মুশকিল।’
শেষ পর্যন্ত কুঞ্জ ভাবে, ‘ভালোবাসা এমন একটা অসহ্য বিষয়, না একেবারে ছেড়ে থাকা যায়, না পুরোপুরি নিয়ে থাকা যায়!’
একটি সরল উপন্যাসে জীবনের জটিল দিকটি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন মাহবুব নাহিদ। তার উপন্যাসে এমন একটি মেসেজ আছে যা বিয়ে বিচ্ছেদ, সম্পর্কের টানাপোড়েনের জটিলতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। কী সেই মেসেজ তা অবশ্য পাঠককে পড়েই জানতে হবে।
বইটি প্রকাশ করেছে দাঁড়িকমা, প্রচ্ছদ করেছেন সাদিতউজ্জামান। ৮০ পৃষ্ঠার বইটির দাম ২৫০ টাকা।
রাজধানীর বনানীর একটি ক্লাবে গোপন বৈঠক চলাকাল বিএনপির ৫৪ নেতাকর্মীকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
রোববার (১৯ মার্চ) রাতে তাদের আটক করা হয়। সোমবার (২০ মার্চ) সকালে এই তথ্য জানিয়েছেন বনানী থানার ডিউটি অফিসার এসআই সিদ্দিক।
তিনি জানান, রোববার রাতে বনানী ক্লাবে গোপন বৈঠকে রাষ্ট্রবিরোধী পরিকল্পনা করছিলেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। খবর পেয়ে রাত একটার দিকে সেখানে অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। পরে ৫৪ জনকে আটক করা হয়।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, রাষ্ট্রবিরোধী পরিকল্পনার জন্য দেশের বিভিন্ন জেলার বিএনপির নেতৃবৃন্দ বনানী ক্লাবে গোপন বৈঠক করছে বলে খবর আসে পুলিশের কাছে। পরে ক্লাবটিতে অভিযান চালানো হয়।
আটকদের বিরুদ্ধে বনানী থানায় রাষ্ট্রবিরোধী পরিকল্পনার মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকার বেসরকারি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে উল্লেখ্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাই প্রতিটি সেক্টরকে উদ্যোক্তাদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। কারণ সরকারের একার পক্ষে দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।
সোমবার (২০ মার্চ) সরকারি বাসভবন গণভবনে রপ্তানি সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির ১১তম সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
২০২৬ সালের পর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার কথা বিবেচনা করে নতুন দীর্ঘমেয়াদি রপ্তানি নীতি প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ২০২৬ সালের পর যখন আমরা এলডিসি থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হব, আমরা কিছু সুযোগ পাব... আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে এবং দেশের আরও উন্নয়ন করতে আমাদের সেই সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।
তিনি উল্লেখ করেন যে একটি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর লক্ষ্য হবে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগাতেও সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে থাকায় বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে।তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে অনেক দেশ বাংলাদেশ থেকে খাদ্য সামগ্রী আমদানিতে আগ্রহ দেখিয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে আমরা খাদ্য সামগ্রী রপ্তানি করতে পারতাম। আমরা এর জন্য উদ্যোগ নিতে পারি।তিনি বলেন, দেশে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপন এবং সেসব পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার রপ্তানি খাতকে গুরুত্ব দিয়েছে। তিনি বলেন, ভারত গ্রহণের পর, আমরা এক বছরের ভিত্তিতে নীতির পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি রপ্তানি নীতি প্রণয়নের পদক্ষেপ নিয়েছি। অর্জনগুলো ধরে রাখতে হলে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, সরকার ২০২৪ (২০২১-২০০৪) পর্যন্ত রপ্তানি নীতি প্রণয়ন করেছে।...কিন্তু এর পর আমরা কী করব? এরই মধ্যে, আমরা একটি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হচ্ছি। আমি মনে করি আগামী দিনে আমরা কী করব বা আমরা কীভাবে এগিয়ে যাব তা বিবেচনা করার এটাই সঠিক সময়।
তিনি বিশ্বব্যাপী বর্তমান অর্থনৈতিক অস্থিরতার কথা মাথায় রেখে অর্থনীতির জন্য পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নির্ধারণের ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, আমাদের সারা বিশ্বে নতুন বাজার খুঁজতে হবে। আমাদের পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে, আমাদের রপ্তানি ঝুড়িতে নতুন আইটেম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, রপ্তানি খাতের উন্নয়নের জন্য একটি কৌশল গ্রহণ করতে হবে এবং পণ্য চিহ্নিত করতে হবে। এজন্য আমরা একটি সম্ভাব্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি-২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করতে।
প্রধানমন্ত্রী আইসিটি এবং ডিজিটাল ডিভাইস, আরএমজি, ফার্মাসিউটিক্যালস, হালকা ও মাঝারি ওজনের শিল্প, মোটরযান এবং ইলেকট্রনিক মোটর গাড়ির কথা উল্লেখ করে পণ্য বৈচিত্র্যের কথা বলেন।
তিনি বলেন, সরকার দেশ-বিদেশের বিনিয়োগ নিয়ে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করছে। বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে বলেও জানান তিনি।
দেবর-ভাবির দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টির (জাপা) ভেতর বিভক্তি আবারও প্রকট হয়ে উঠছে। আজ সোমবার পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জন্মদিন পালনের মধ্য দিয়ে সেই বিভাজন ও দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এরশাদের স্ত্রী, পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এবং এরশাদের ভাই ও পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের আলাদা কর্মসূচি নিয়েছেন। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে জন্মদিন পালন করছেন দুপক্ষের নেতাকর্মীরা। কেউ কাউকে আমন্ত্রণ জানাননি। এমনকি যৌথভাবে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের জন্মদিন পালনে কোনো উদ্যোগও নেয়নি কোনোপক্ষ।
জাপায় অভ্যন্তরীণ বিভাজন এতটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, দুপক্ষের শীর্ষনেতারা পরস্পরকে দলের ‘কেউ না’ বলেও মন্তব্য করেছেন। জিএম কাদেরপন্থিরা বলছেন, তাদের অংশই পার্টির মূল। রওশন এরশাদের সঙ্গে যারা আছেন, তারা পার্টির কেউ না। আবার রওশনপন্থিদের অভিমত, পার্টির মূলধারার নেতাকর্মীরা তাদের সঙ্গে আছেন। সুতরাং তারাই জাপার মূল অংশ। এই পক্ষ জিএম কাদেরপন্থিদের ‘প্রতারক’ বলেও মন্তব্য করেছেন ও কাদেরপন্থিরা তাদের ‘কেউ না’ বলে জানিয়েছেন।
৯৪তম জন্মদিন আজ : আজ পালিত হচ্ছে এরশাদের ৯৪তম জন্মদিন। ১৯৩০ সালের ২০ মার্চ কুড়িগ্রাম শহরের ‘লাল দালান’ বাড়িখ্যাত নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সাবেক এ রাষ্ট্রপতি ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পান ১৯৫২ সালে। ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণ করেন এরশাদ। ১৯৮৬ সালে তার প্রতিষ্ঠিত দল জাপার প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি দেশে উপজেলা পদ্ধতি চালু করেন। বিরোধী দলের লাগাতার আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন। এরপর গ্রেপ্তার হয়ে ছয় বছর কারারুদ্ধ ছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক কীর্তি গড়েছেন এরশাদ। ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান। কারাগারে থাকাকালীন ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের নির্বাচনে পাঁচটি করে আসনে জয়ী হন। এরশাদের হাতে গড়া জাপা এখন সংসদে প্রধান বিরোধী দল। দশম জাতীয় সংসদেও প্রধান বিরোধী দল ছিল জাপা। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এরশাদ।
পরস্পরকে অস্বীকার দুপক্ষের : পৃথকভাবে জন্মদিন পালনের ব্যাপারে জিএম কাদেরপন্থি জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গতকাল রবিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পার্টির পক্ষ থেকে আমরা জন্মদিন পালন করছি। এর অংশ হিসেবে আগামীকাল (আজ সোমবার) জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে স্যারের (এরশাদ) প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ও বিকেল ৩টায় বনানী কার্যালয়ে কেক কাটব। আর স্যারের জন্মদিন উপলক্ষে ২২ মার্চ আলোচনা সভা হবে। সেখানে কাদের সিদ্দিকীসহ আরও কয়েকজন অতিথি অংশ নেবেন।’
এরশাদের জন্মদিন উপলক্ষে রওশনপন্থিদের কর্মসূচির ব্যাপারে জাপা মহাসচিব বলেন, ‘ম্যাডামের পক্ষ থেকে তার বাসভবনে পারিবারিকভাবে মিলাদের আয়োজন করেছে। তারা একসঙ্গে জন্মদিন পালনের কোনো আলাপ-আলোচনা জাপার কারও সঙ্গে, বিশেষ করে আমার সঙ্গে করেনি।’
পৃথক এ জন্মদিন পালনের মধ্য দিয়ে দলের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ব্যাপারে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘পার্টির বাইরে কেউ কিছু বললে আমাদের বলার কিছু নেই। তারা পার্টির কেউ কিছু না।’
কিন্তু রওশনপন্থি জাপার নেতা ও এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশীদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যেহেতু স্যার জীবিত নেই, ম্যাডাম জীবিত আছেন, তাই তার বাসায় একটা কোরআন তেলাওয়াত দোয়ার আয়োজন করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আছি। জিএম কাদের আমাদের কোনোদিন ডাকেন না। সুতরাং আমরা তো স্বাভাবিকভাবে আমাদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের জন্মদিন পালন করব।’
কাদেরপন্থি জাপার ব্যাপারে এ নেতা বলেন, ‘পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান হয়েছিল জানুয়ারিতে। ওই অনুষ্ঠানটা একসঙ্গে করার কথা ছিল। এর জন্য একটা যৌথ বিবৃতিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অনুষ্ঠানে দেখা গেল, একটা প্রতারণা করে জিএম কাদেররা শুধু ম্যাডামকে নিয়ে গেছেন। আমাদের মঞ্চে আনুপাতিক হারে আসন দেবে বা কোথায় বসবে, সেটা আয়োজন করার কথা ছিল। কিন্তু সেগুলোর কিছুই করা হয়নি। তাদের এখন আমরা প্রতারক হিসেবে জানি। ভবিষ্যতে তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য হবে কি না, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।’
দুপক্ষের পৃথক কর্মসূচি : জন্মদিন উপলক্ষে জিএম কাদেরপন্থি জাপা সকাল ১০টায় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় কাকরাইল চত্বরে এরশাদের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে। এ ছাড়া আগামীকাল বুধবার বিকেল ৩টায় কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের মাল্টিপারপাস হলে আলোচনা সভা রয়েছে। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন জিএম কাদের। জাপা চেয়ারম্যানের প্রেস সেক্রেটারি-০২ খন্দকার দেলোয়ার জালালী এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কর্মসূচির তথ্য জানান।
অন্যদিকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ্ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, আজ বেলা ১১টায় গুলশানের ৬৭ নম্বর সড়কের ৪/১-এ বিরোধীদলীয় নেতার বাসভবনে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বিশেষ দোয়া ও কেক কাটার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে রওশন এরশাদ প্রধান অতিথি হিসেবে এবং এরশাদপুত্র রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদ এমপিসহ পার্টির শীর্ষ নেতারা উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়া স্বাধানীতা দিবস উপলক্ষে ২৭ মার্চ আলোচনা সভা, দোয়া ও ইফতার আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়েছে : গত বছর নভেম্বরে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী, দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ দলের ভেতর ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। সে ডাকে সাড়া দিয়ে বেশ কিছু উদ্যোগও নিতে দেখা গেছে এরশাদের ছোটভাই ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে। এরই অংশ হিসেবে জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাপার নেতারা রওশন এরশাদের সঙ্গে কয়েক দফা দেখা করেন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে দল পরিচালনায় বেশ কিছু অঙ্গীকারও করেন।
ঐক্যের অংশ হিসেবে ঐক্যবদ্ধভাবে ১ জানুয়ারি জাপার ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন করা হয়। প্রায় চার বছর পর ওই অনুষ্ঠানে একমঞ্চে পাশাপাশি বসেন দেবর-ভাবি কাদের-রওশন। এমনকি টানা ১১ মাস পর সেদিন পার্টির কোনো অনুষ্ঠানে সশরীরেও যোগ দেন রওশন এরশাদ। সর্বশেষ ২০১৮ সালে দলের এক অনুষ্ঠানে একসঙ্গে মঞ্চে ছিলেন এ দুই নেতা।
জাপা নেতরা জানান, জানুয়ারির পর দুপক্ষের মধ্যে আর কোনো ধরনের সমঝোতা বা ঐক্যের আভাস পাওয়া যায়নি। বরং জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে রওশনপন্থি দুই নেতার মামলার কারণে দেবর-ভাবির সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে। সেই অবনতির সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে দেখা দেয় এরশাদের জন্মদিন।
এ ব্যাপারে রওশনপন্থি নেতারা দেশ রূপান্তরকে জানান, জিএম কাদের গত ৬ মার্চ এরশাদের জন্মদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। সেই কর্মসূচির ব্যাপারে রওশন এরশাদকে কিছুই বলেননি। জিএম কাদের ঐক্যবদ্ধভাবে পালন করতে রাজি না। উনি বিভাজন রেখেই যাচ্ছেন।
দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হচ্ছে জানিয়ে রওশনপন্থি শীর্ষ নেতারা জানান, রওশনপন্থি জাপা ইতিমধ্যেই দেশের ৫২ জেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছে। এসব জেলায় যারা পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন ও এরশাদের সময় থেকে পার্টির সঙ্গে আছেন, জিএম কাদের তাদের বাদ দিয়ে নিজের লোকজনদের নিয়ে কমিটি করেছেন। মূলধারার লোকজনদের বাদ দিয়ে রাজনীতি করছেন। এরই অংশ হিসেবে সর্বশেষ ১৫ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আহ্বায়ক কমিটির তথ্য জানানো হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রওশনপন্থি এক নেতা বলেন, রওশন এরশাদ আবারও জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রোজার পর থেকে সম্মেলনের কাজ পুরোদমে শুরু হবে। ২৭ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি সম্মেলন স্থগিত প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে পারেন। সম্মেলন হবে।
জিএম কাদেরের মামলার ব্যাপারে রওশনপন্থি নেতারা বলেন, আমরাও চাই মামলা থেকে জিএম কাদের অব্যাহতি পাক। সে জন্য আমরা নতুন করে আপিল করিনি। আপিল করেও ঝুলিয়ে রেখেছি। উনি যদি সোজা পথে আসেন তাহলে মামলাটা শেষ করব। কিন্তু উনি সেটা চাইছেন না বলে আমরাও সময়ক্ষেপণ করছি। আমরা ওনাকে সুযোগ দিচ্ছি।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ব্যালট ছিনতাই, ভাঙচুর, পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে করা পৃথক তিন মামলায় বিএনপি-সমর্থিত প্যানেলের সভাপতি প্রার্থী এ এম মাহবুব উদ্দিন, সম্পাদক প্রার্থী মো. রুহুল কুদ্দুসসহ ১৩ আইনজীবী আগাম জামিন পেয়েছেন।
সোমবার হাইকোর্টের বিচারপতি মো. সেলিম ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের বেঞ্চ বিএনপির ১৩ আইনজীবীর আগাম জামিন চেয়ে করা পৃথক তিনটি আবেদনের শুনানি শেষে আট সপ্তাহের আগাম জামিন দেন।
এর আগে গত ১৫ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ‘ব্যালট ছিনতাই ও হট্টগোলের’ অভিযোগ এনে বিএনপির শতাধিক আইনজীবীদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেন আওয়ামী লীগের মনোনীত নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান অ্যাডভোকেট মো. মনিরুজ্জামান।
একই অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম মিল্টন আরেকটি মামলা করেনে। পরে কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে শাহবাগ থানায় মামলা করে পুলিশ।
এর আগে গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দুই দিনই বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের মধ্যে পাল্টা-পাল্টি মিছিল ও হট্টগোলের ঘটনা ঘটে। ব্যালট কারচুপির অভিযোগ এনে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা প্রথম দিনেই ভোট বর্জন করেন
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।