
এটা সবাই বলতে চাইবে যে, একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদাররা হেরে গিয়েছিল ঠিকই; কিন্তু তারপর থেকে আমরা কেবলি নিজেরা নিজেদের কাছেই হারছি। চতুর্দিকে পরাজয়ের চিহ্ন। হতাশা, অরাজকতা, মীমাংসিত প্রশ্নের অমীমাংসিত হয়ে যাওয়া কোনটা বাদ দিয়ে কোনটার কথা বলি। পরাজয়টা তাই ভেতর থেকে। বড় দুঃখে। কিন্তু কার কাছে হারলাম? কেই-বা হারাল? কখন? পরাজয়ের সূত্রপাত বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু পাকিস্তানিদের কাছে নয়; ওই গৌরব তাদের একেবারেই প্রাপ্য নয়। হার হয়েছে সেই প্রায়-অদৃশ্য কিন্তু অত্যন্ত পরাক্রমশালী শক্তির কাছে যার অধীনে পাকিস্তানিরা তখনো ছিল, এখনো আছে। এই প্রভুটির নাম পুঁজিবাদ। পরাজয় হয়েছে তার কাছেই।
আশা ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওই প্রভুরও পতন ঘটবে। ঘোড়া পড়ে গেলে ঘোড়সওয়ারও পড়ে যাবে। কিন্তু তা কি হয়? এই সওয়ারটি অনেক বেশি শক্তি রাখে। তার ক্ষমতা বিশ্বব্যাপী ন্যস্ত; সে কেন পড়ে যাবে খামোখা? একটা ঘোড়া গেছে অন্য ঘোড়া সহজেই পেয়ে যাবে। বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রটি এই পুঁজিবাদের নতুন ঘোড়া বটে। সওয়ারটি দাবড়ে বেড়াচ্ছে। আর ওই যে আমাদের আশা তার ভিত্তিটাই বা কী ছিল?
ভিত্তি ছিল জনগণের আত্মত্যাগ। তারা এমনভাবে লড়েছে, এত অধিক মূল্য দিয়েছে এবং এতটা ঐক্যবদ্ধ ছিল যে, ভরসা ছিল যে পুঁজিবাদের পতন ঘটবে এবং বাংলাদেশের মানুষ কেবল স্বাধীন নয়, প্রকৃত প্রস্তাবেই মুক্ত হবে; কিন্তু কেবল আত্মত্যাগে তো ওই রকমের পরাক্রমশীল শক্তি, নাম যার পুঁজিবাদ, তার পতন ঘটে না। সাময়িকভাবে পিছু হটলে অনতিবিলম্বে সে ফিরে আসে। আমরা তো বুঝতেই পারছি যে আমাদের ক্ষেত্রেও ডাশ তাই-ই ঘটেছে। পুঁজিবাদ ফিরে এসেছে। কেবল ফেরত আসেনি, আগের চেয়ে বেশি নৃশংস হয়ে এসেছে, যেন তাকে বিরক্ত করার দরুন ক্ষিপ্ত সে, শাস্তি দেবে।
বাংলাদেশ একটি নতুন রাষ্ট্র বটে। কিন্তু কতটা নতুন? নামে নতুন, ভূখ-ে নতুন; কিন্তু স্বভাব-চরিত্রে? না, স্বভাব-চরিত্রে সে এতটুকু বদলায়নি। পুরাতন রাষ্ট্রের মতোই রয়ে গেছে আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী। হ্যাঁ, শাসক বদলেছে। পুরাতন শাসকদের জায়গায় নতুন শাসক এসেছে; কিন্তু তারা রাষ্ট্রকে বদলাবে, এই রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করবে, ভেঙে দেবে এর আমলাতান্ত্রিক কাঠামো, ঘটাবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, প্রতিষ্ঠা করবে মানুষে মানুষে অধিকার ও সুযোগের সাম্য এসব কেন আশা করব আমরা? আশা অবশ্য করেছিলাম ওই আত্মত্যাগের কারণেই। কিন্তু জনগণের আত্মত্যাগের কী মূল্য আছে এই নিপীড়নকারী শাসকশ্রেণি এবং তাদের স্বার্থ-সংরক্ষণকারী আমাদের এই নতুন রাষ্ট্রের কাছে?
কে হারল এই প্রশ্নের জবাবও এই বাস্তবতার ভেতরেই পাওয়া যাবে। হেরে গেছে জনগণ। হেরেছে এই জন্য যে, তাদের রাজনৈতিক সংগঠন নেই, নেতৃত্বের রয়েছে অভাব, অভাব ঘটেছে রাজনৈতিক শক্তির। একাত্তরের পর থেকে যে নেতৃত্বকে আমরা পেয়েছি তারা হারেনি, তারা আত্মসমর্পণ করেছে। হারতে হলে লড়তে হয়। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারা তো পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি। প্রশ্নই ওঠে না লড়াইয়ের। তারা উদগ্রীব ছিল আত্মসমর্পণে। সেটাই তারা করেছে। আত্মসমর্পণের পর এখন চলছে তোয়াজ করার পালা। এখানে তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। জনতার জয় পদপিষ্ট হচ্ছে বিজয়-উদ্ধত পুঁজিবাদ ও পুঁজিবাদীদের দাপটের নিচে। এই বিজয়টা যেমন স্থানীয় তেমনি আন্তর্জাতিক; পুঁজিবাদ একটি বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থা বটে। একাত্তরে এদেশের মানুষের জীবনে যে দুর্ভোগ নেমে এসেছিল সেটা ছিল অপরিমেয়; কিন্তু যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যে গৌরব তারা অর্জন করেছিল তাও ছিল অতুলনীয়। ষোলই ডিসেম্বর বাঙালি জাতির ইতিহাসে গৌরবের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুহূর্ত। কিন্তু তারপরে?
তারপরের ইতিহাস উত্থানের থাকেনি, পরিণত হয়েছে পতনের। আমরা নামছি। কেবলই নামছি। এই নিম্নধাবমানতা নানাক্ষেত্রে ঘটেছে। সবচেয়ে ক্ষতিকরভাবে ঘটেছে মূল্যবোধের ক্ষেত্রে। খুব জরুরি যে মূল্যবোধ সেটি হচ্ছে দেশপ্রেম। এই দেশপ্রেমেরই চূড়ান্ত প্রকাশ আমরা দেখেছি একাত্তরে; আজ তার অভাব দেখছি পদে পদে। দেশপ্রেমের একটা বড় প্রকাশ ঘটেছিল আজ থেকে একশ বছর আগে, ১৯০৫ সালে, বঙ্গভঙ্গ রদ করবার সংগ্রামে। কিন্তু সেটা ঘটেছিল সীমিত আকারে; সীমাবদ্ধ ছিল মধ্যবিত্তের মধ্যে, যে মধ্যবিত্ত সেদিন ছিল মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্বারা গঠিত। বঙ্গভঙ্গকে প্রতিরোধ করবার আন্দোলনে প্রবল দেশপ্রেমের জোয়ার এসেছিল। প্লাবন দেখা দিয়েছিল জাতীয়তাবাদের। মানুষ কারাভোগ করেছে, প্রাণও দিয়েছে। কিন্তু নেতৃত্বের মারাত্মক রকমের ভ্রান্ত পদক্ষেপের দরুন ওই জাতীয়তাবাদ চলে গেল ধর্মীয় পুনর্জাগরণের অন্ধ পথে।
হিসাব করলে সেদিন দেখা যেত বাঙালিদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা মোটেই অল্প ছিল না। আসলে তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। হিন্দু জাতীয়তাবাদের জোয়ার মুসলমানদের সঙ্গে নিতে পারল না। বরং দেখা দিল সাম্প্রদায়িক বিভাজন। পরিণতিতে দাঙ্গা বাধল এবং সাতচল্লিশে দেশ গেল ভাগ হয়ে। সবটাই ঘটল নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে, একাত্তরে দাঙ্গা হয়নি, যুদ্ধ হয়েছে। বাঙালি বিভক্ত হয়নি, ঐক্যবদ্ধ ছিল। এ যেন সাতচল্লিশের সেই ভুলের সংশোধন। এবারে দেশভাগের প্রশ্ন নেই, এবারের প্রশ্নটা রাষ্ট্রকে ভাঙার। রাষ্ট্র ভাঙল। এলো স্বাধীনতা। কিন্তু তারপরে? তারপরে দেশপ্রেমের পতন ঘটেছে। কিন্তু কেন? এবারও দায়িত্ব নেতৃত্বেরই। না, যত দোষ নন্দ ঘোষের নয়, পতনের জন্য নেতারাই দায়ী। দোষ তাদেরই। তারা লড়াইতে যেতে চায়নি। যুদ্ধ নয়, তারা চেয়েছিল স্বায়ত্তশাসন, যার অর্থ তাদের জন্য অবাধ স্বাধীনতা; অন্যকিছুর নয়, লুণ্ঠনের। তাদের আন্তরিক দীক্ষা ছিল পুঁজিবাদে। সেই দীক্ষাটাকে যুদ্ধের সময়ে প্রকাশ না-করলেও বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচিত করেছে। উন্মোচনেরও দরকার হয়নি, আপনা আপনি বের হয়ে পড়েছে। দেশপ্রেম ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে পুঁজিবাদের দাপটে। যুদ্ধপরবর্তী পুঁজিবাদীরা লড়াই করেছে নিজেদের মধ্যে, ক্ষমতার (অর্থাৎ লুণ্ঠনের অধিকারের) ভাগাভাগি নিয়ে পাকিস্তানিদের সঙ্গেও তাদের লড়াইটা ছিল ওই ভাগাভাগি নিয়েই। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই সাঙ্গ করা যাবে বলে ভরসা করেছিল।
জনগণের লক্ষ্যটা ছিল ভিন্ন। তারা ক্ষমতার ভাগ পাবে এটা আশা করেনি; ওই লোভে যে উত্তেজিত হয়েছে তাও নয়। তাদের আশাটা ছিল মুক্তির। স্বায়ত্তশাসনের নয়, ক্ষমতার হস্তান্তরেও নয়, তাদের জন্য স্বপ্নটা ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির। তারা আশা করেছে এমন একটি সমাজ ও রাষ্ট্র পাবে যেখানে মানুষে মানুষে সম্পদ, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ইত্যাদি নিয়ে বৈষম্য থাকবে না; কেউ কারও শত্রু হবে না, সবাই হবে সবার মিত্র। বলাবাহুল্য জনগণ এই মুক্তি পায়নি।
পুঁজিপন্থিরা কিন্তু স্বাধীনতা পেয়ে গেল। তারা আরও ধনী হলো। তাদের ধনসম্পদ বৃদ্ধি পেল অবিশ্বাস্য গতিতে। তাদের সংখ্যাও যে খুব সীমিত রইল তা নয়, বেশ বেড়ে গেল। কিন্তু জনগণের সংখ্যার তুলনায় তারা অবশ্যই অল্প। তবে তাদের দাপট অসম্ভব প্রবল। বাংলাদেশ এখন সেই দাপটে থর থর করে কাঁপে।
জনগণ দেখল নতুন রাষ্ট্রের চেহারাটা আগের রাষ্ট্রের চেয়ে ভয়ংকর। এ রাষ্ট্র শাসকশ্রেণির অধীনস্ত তো বটেই; কিন্তু রীতিমতো সন্ত্রাসীও বৈকি। সাতচল্লিশের পরে বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিল, এবারও হলো; নিজের দেশের মধ্যেই তারা গৃহহীন, আশ্রয়হীন। তাদের দেশ নেই, দেশ চলে গেছে অন্যদের হাতে, যাদের হৃদয় ও মস্তিষ্কে দেশের জন্য কোনো স্থান অবশিষ্ট নেই। বাংলাদেশে এখন দেশপ্রেমিক বলতে শ্রমজীবী মানুষকেই বোঝায়। এই মানুষেরাই উৎপাদন করে। দেশকে এরাই টিকিয়ে রেখেছে এবং দেশের বাইরে এদের জন্য কোথাও কোনো স্থান নেই। যতই গৃহহারা হোক এই মানুষেরাই গৃহী এবং দেশপ্রেমিক। আর উদ্বাস্তু হচ্ছে তারা যাদের ধন-সম্পত্তি অনেক। বস্তুত যার বিত্তবেসাত যত অধিক সেই তত বড় উদ্বাস্তু, আমাদের এই বাংলাদেশে। এদের আদর্শ এদেশ নয়, আদর্শ হচ্ছে পুঁজিবাদী বিশ্ব। মানুষের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান বিনিয়োগ হচ্ছে সন্তানসন্ততি; সেই বিনিয়োগ এরা দেশে করে না, করে বিদেশে। সন্তানেরা বিদেশে যায় পড়ালেখার অজুহাতে, গিয়ে আর আসে না, এলেও আগমনটা বিদেশিদের মতোই, অবস্থানও সেই প্রকারেরই। ধনীদের জন্য বাংলাদেশ এখন এক প্রকারের জমিদারি। জমিদারদের তবু সরকারি তহবিলে খাজনা দিতে হতো, এরা সেটাও দেয় না।
পুঁজিবাদের দাসানুদাস এই শাসকশ্রেণিই দেশপ্রেমের অবনতির জন্য দায়ী। তারাই হচ্ছে দৃষ্টান্ত। তারা তাদের আদর্শকে জনগণের ভেতর ছড়িয়ে দিয়েছে। মানুষকে যতভাবে পারা যায় উদ্বুদ্ধ করছে আত্মস্বার্থসর্বস্ব ও ভোগবাদী হতে; উসকানি দিচ্ছে সব কিছু ভুলে কেবল নিজের কথা ভাবতে। মানুষকে নিয়ে এসেছে বাজারে। সর্বোপরি সর্বক্ষণ ব্যস্ত রাখছে জীবিকার সন্ধানে। যাতে অন্যকিছু ভাববার সময় না হয়, বিশেষ করে শাসকশ্রেণির অত্যাচার যেন চোখের বাইরে থাকে।
বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি দুটি কাজ খুব দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে, একটি বেকার সৃষ্টি, অপরটি মাদ্রাসা শিক্ষার বিস্তার। দুটোই দেশপ্রেমের বিকাশের পথে মস্ত বড় অন্তরায়। এদেশের ধনীরাই হচ্ছে শাসক এবং তারা বিনিয়োগ করে না, লুণ্ঠন করে। তাদের লুণ্ঠন তৎপরতায় বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়। জনগণের আয় এরা ব্যাংকের মাধ্যমে কিছুটা, কিছুটা নানাবিধ প্রতারণার ভেতর দিয়ে আত্মসাৎ করে ফেলে। ফলে কর্মসংস্থান বাড়ে না। লোক বাড়ছে, কাজ বাড়ছে না; অথচ করবার মতো কাজের তো কমতি থাকবার কথা নয় আমাদের মতো অনগ্রসর দেশের। সরকার আসে যায়, কিন্তু কোনো সরকারকেই দেখা যায় না কাজ সৃষ্টির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হতে। পুঁজিবাদ এমনিতেই শ্রমিকবিরোধী, শ্রমঘন উৎপাদনকে যে ঘৃণা করে, তার পক্ষপাত প্রযুক্তিঘন উৎপাদনের প্রতি। বাংলাদেশি পুঁজিবাদ উৎপাদনে বিশ্বাসই করে না, তার নির্ভরতা লুণ্ঠন ও ব্যবসাতে; বলাবাহুল্য ব্যবসা জিনিসটাও লুণ্ঠন ভিন্ন অন্য কিছু নয়।
যে মানুষটি বেকার তার তো কোনো দেশপ্রেম থাকবার কথা নয়। দেশ তো তাকে কিছুই দিচ্ছে না, বিড়ম্বনা ভিন্ন। তার সার্বক্ষণিক চিন্তা নিজেকে নিয়েই। আর মানুষের মতো আত্মপ্রেমিক সংসারে সত্যি বিরল। বেকারে যখন দেশ ছেয়ে যাচ্ছে, দেশে তখন দেশপ্রেমের বন্যা বইবে এমনটা আশা করা মোটেই যুক্তিসংগত নয়।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সক্কাল সক্কাল ঢাকার এক বন্ধুকে ফোন করতেই ঈষৎ বিরক্ত গলায় সে জানিয়ে দিল, খুব ঠান্ডা, পরে কথা হবে। আমার চট্টগ্রামবাসী এক স্নেহের বোন মোবাইলে নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কথোপকথন পোস্ট করেছে। করো কি খুব ঠান্ডা, তুমি- ভীষণ ঠান্ডা, কম্বল জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকো, হ্যাঁ বেশ ঠান্ডা, দেখা হবে কবে! খুব ঠান্ডা... ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আর কী বলি! এ লেখা লিখছিও তো লেপের মধ্যে পা ঢুকিয়ে। আমাদের ব্রিটিশ মালিকদের দস্তুর নাকি শীতকালে দেখা হলেই আগে গুড মর্নিং না বলে ঠান্ডার হাল-হকিকত নিয়ে খোঁজখবর নেওয়া।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট র্যাডক্লিফ সাহেব অনেক কিছু পারলেও, দেশকে টুকরো করে ভাগ করলেও দুপাড়ের শীতকে নিয়ন্ত্রণ করতে যে ব্যর্থ তা দুই বঙ্গের বাসিন্দারাই মানবেন। যার সঙ্গেই দেখা হোক, কাঁপতে কাঁপতে বলছে, ঠান্ডা কিন্তু জবর পড়েছে। এও এক সমস্যা। শীত পড়লেও দোষ, না পড়লেও কবিতায় লেখা হবে, ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা!’
পশ্চিমবঙ্গের সামনের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রিগিং হবে কি হবে না সেসব আলোচনা ছেড়ে সবাই শুধু তার জেলায় কত ঠান্ডা পড়েছে তা নিয়ে মশগুল। এরমধ্যে কোথাও যেন একটু-আধটু আকছাআকছিও পরস্পরের মধ্যে আছে তাও একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায়। বর্ধমান ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, শ্রীনিকেতন ৮.৪, আসানসোল ৯, কৃষ্ণনগর ৭, পুরুলিয়া ৬। সবমিলিয়ে ঠান্ডা লড়াইয়ে দক্ষিণবঙ্গ উত্তরবঙ্গকে হারিয়ে দিতে পেরেছে, লেপের তলায় বসে এটুকু খবরেই দক্ষিণ গর্বিত।
শীতকাল নিয়ে যতই লিখি না কেন, মনে হয় কিছুই বলা গেল না। পর্বের পর পর্ব লিখে ফেলা যায় এই রুক্ষ, ধূসর, কুয়াশাঢাকা দিনগুলো নিয়ে। শীতকাল নিয়ে লিখতে বসলেই নিমেষে কেমন ছেলেবেলা ফিরে আসে। পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট, সন্ধ্যেবেলায় ব্যাটমিন্টন এখনো বড় মিস করি। শীত পড়তে না পড়তেই বাড়ির লেপকম্বল রোদ্দুরে দেওয়া, পুরনো হয়ে গেলে ধুনুরি ডেকে মেরামত করা বা নতুন বানানো, এ ছিল শুধু আমাদের নয়, মধ্যবিত্ত পরিবারের দস্তুর। পাড়ায় ধুনুরিওয়ালার হাতের অদ্ভুত যন্ত্রের টুংটাং শব্দ আর লেপ-তোশক বানাবেন বলে হাঁক দেওয়া চোখ বুজলে এখনো শুনতে পাই। আর শুনতে পাই ‘পাটালি গুড় লাগবে ও জয়নগরের মোয়া লেবেন’ ডাক দিতে দিতে ফেরিওয়ালার পাড়া মাত করা মধুর আওয়াজ।
ইদানীং পশ্চিমবঙ্গের সিরিয়ালে সিঁদুরের রমরমা বাড়ছে। হঠাৎ হাত লেগে কোনো মহিলার কপালে সিঁদুর পড়ে গেলেও তাকে বিয়ে না করার মতো ‘অপরাধ’ আর নেই। আবার রোজ লাথিঝাঁটা খাওয়া স্ত্রীর একচিলতে সিঁদুরের সৌজন্যে গভীর কোমায় চলে যাওয়া আর দুশ্চরিত্র স্বামীও দিব্যি বেডে উঠে নিজের ভুল স্বীকার করে স্ত্রীকে প্রেম নিবেদন করেন। এমন সিঁদুরের রমরমার কালেও সেই চীনা সিঁদুর নেবেন গো ডাক শুনতে পাই না। হতে পারে চীন-ভারতের সম্পর্কের জটিলতা একটা কারণ।
শীতকালে কমলালেবু না খাওয়া বাঙালি পাওয়া কঠিন। আমাদের শহরে ভালো, মিষ্টি কমলালেবু মানেই দার্জিলিং। নাগপুরের কমলালেবু সস্তা, বিক্রি হয় বেশি। কিন্তু স্বাদ হয় না। টক। নিন্দুকেরা কেউ কেউ বলেন, নাগপুরে আরএসএসের সদর দপ্তর। সেখানকার কোনো জিনিস মিষ্টি হবে না তাই তো স্বাভাবিক। বেচারা লেবুও খারাপের সঙ্গে কেমন টকে গেল, ভাবতে কষ্ট হয়।
ছোটবেলায় শীতকালে চিড়িয়াখানা যাওয়া ছিল কম্পালসারি। বাঘ, সিংহ, হাতি, জিরাফ দেখার পাশাপাশি যাব যাব বলে সকাল থেকে তোড়জোড় করারও আলাদা আনন্দ ছিল। শীতের রোদে হাঁটাহাঁটি করে ক্লান্ত আমরা চাদর বিছিয়ে খেতে বসতাম লুচি, আলুর দম, নলেনগুড়ের সন্দেশ, আহা স্বাদ যেন আজও মুখে লেগে আছে। মা, বাবা কবেই চলে গেছেন। আমিই দুনিয়া ছেড়ে যাব যাব করছি। অথচ শীতকাল এলেই কেমন যেন মায়ের ওমের স্পর্শ আর বাবার হাঁকডাক টের পাই।
সেদিন এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম শীতে কী ভালো লাগে! বলল, মিঠে রোদে বসে বই পড়া, লেপের তলায় অনেকক্ষণ ল্যাদ খাওয়া, হাফ বয়েল ডিম সেদ্ধ ইত্যাদি বলে আমার কাছে জানতে চাইল, তোমার! আমি বললাম, যা আগেও বলেছি, কাছেপিঠে গেলে খেজুরের রস, রোদে বসে পাটালি খাওয়া, কড়াইশুঁটির কচুড়ি, ফুলকপির শিঙ্গাড়া, নলেনগুড়ের সন্দেশ ইত্যাদি। পিঠে পায়েস দুজনেই ভালোবাসি। এই প্রসঙ্গে অন্য একটি গল্প না বলে পারছি না। এ ঘটনা শুনেছিলাম, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অমিতাভ চন্দ্রের কাছে। অমিতাভ নাকি কোনো এক সরকারি অফিসে গিয়ে দেখে কেউ কোনো কাজ করছে না। শীতে জবুথবু হয়ে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে সবাই। বিষয় সেই শীতকাল। পরস্পর পরস্পরের কাছে জানতে চাইছে, এই সময় কার কী ভালো লাগে! এক একজন এক একরকম উত্তর দিচ্ছেন। কারও পছন্দ ঝোলাগুড়, রুটি, কারও আবার পেঁয়াজি, আলুর চপ, কেউ আবার রাত হলে দু-এক পাত্তর হলে বেশ হয় বলে আসর জমাচ্ছেন। একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক শুধু একমনে কাজ করে যাচ্ছেন। অন্য সবার তা সহ্য হলো না। একসঙ্গে সবাই চেঁচিয়ে উঠে বলতে লাগল, ও দাদা, ও ভট্টাচার্য দা আপনি কিছু বলুন। তিনি নিরুত্তর। অনেক চেঁচামেচি করার পরে কম্পিউটার থেকে সামান্য মুখ তুলে নির্বিকার গলায় তিনি জানিয়ে দিলেন মুড়ি দিয়া নারীকোল। অমিতাভ অকালে চলে গেছে। এখনো গল্পটা মনে আছে।
শীতকাল এলেই সার্কাস দেখা রেওয়াজ ছিল। কত রকমের সার্কাস, অলিম্পিক, পানামা, ভারত, গ্রেট ইস্টার্ন আরও কত। গ্যালারির টিকিট ছিল সস্তা। সামনের চেয়ারের দাম বেশি। আমরা গ্যালারিতে বসেই আনন্দ পেতাম। কত রকমের খেলা। তখন তো আর পশুক্লেষ নিবারণী সমিতি ছিল না। ফলে বাঘ, সিংহ, হাতির খেলা নিয়ে কোথাও কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। বাঘের হুঙ্কার শুনে ভয় লাগলেও মজাও পেতাম। হাতি ছোট্ট একটা টুলে বসে ট্রেনারের কথায় উঠত-বসত বাধ্য ছেলের মতো। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম, ট্র্যাপিজের খেলা। সুন্দরী মেয়েরা ঝলমলে ড্রেস পরে দারুণ দারুণ অ্যাডভেঞ্চার করত। তবে সব থেকে মজা পেতাম জোকারদের কান্ড দেখে। বড় হয়ে জেনেছি, ওরাই ছিল সার্কাসের সম্পদ। ওদের দেওয়া ট্রেনিংয়ে এই ট্র্যাপিজ সুন্দরীরা অমন কসরত শিখতে পারত। একটু বড় হয়ে এও জেনেছিলাম, জোকাররা লোক হাসায়, কিন্তু তাদের জীবনের অনেক অন্ধকার ওই হাসিঠাট্টায় চেপে রাখে। রাজ কাপুরের ‘মেরা নাম জোকার’ সিনেমাতে এই বাইরে হাসি ভেতরে কান্না ব্যাপারটা সুন্দরভাবে ধরা আছে। জোকারদের মনে হতো পৃথিবীর সেরা বিদূষক।
এখন এই পরিণত বয়সে পৌঁছে বুঝি, আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মতো বড় বিদূষক হয় না। জোকারেরা পেটের দায়ে নানা রকমের কসরত করে উল্টোপাল্টা বকে লোক হাসান। আর আমাদের দেশনেতারা জোকার সাজেন নিজেদের স্বার্থে। তাদের দেখে, কথা শুনেও জনতা মজা করেন, আড়ালে হাসেন। আত্মগর্বী রাজনীতির কারবারিরা ক্ষমতার দম্ভে তা টের পান না।
লেখক : ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক [email protected]
ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়কের ফুটপাত ও সড়ক দ্বীপে ভাসমান মানুষের বসবাস ও ভিড় যেন বেড়েই চলেছে। তাদের অনেকেরই জীবনযাপনের ধরন দেখে মনে হয় তারা কেউ কেউ পরিবার নিয়ে বসবাস করছে। তাদের কেউ হয়তো মুটে-মজুর, কেউ রিকশাচালক, কেউ-বা ফুটপাতের দোকানদার যাদের কোনো রকমে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। রাস্তা ও ফুটপাত এমন জনগোষ্ঠীর শুধুমাত্র রাতযাপনের জায়গা না, সেটাই যেন তার ঘরবাড়ি, আবাস। যদিও এই আবাস যে এতটুকুও নিরাপদ নয় তা সহজেই অনুমেয় এবং একান্ত নিরুপায় হয়েই বসবাস। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ইত্যাদির প্রকোপ যেন তার গা-সওয়া অধিকন্তু ঢাকা শহরের বিখ্যাত মশার উৎপাত সহ্য করা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার হুমকি এবং চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যে তারা যে কতটুকু অসহায় তা সহজেই অনুমেয়। কে নেই ফুটপাতে বৃদ্ধ-যুবক, নারী-পুরুষ, আরও আছে বেশ কিছু ভবিষ্যৎ না জানা কিশোর-কিশোরীরা। ফুটপাতে থাকা এই কিশোরদের প্রায়ই ছোট ছোট দলে অবস্থান ও ঘুরতে ফিরতে দেখা যায়। এই শিশু-কিশোররা যেমন পারিবারিক আবহ থেকে দূরে এবং একই সঙ্গে বঞ্চিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকে। অন্যদিকে সড়ক দ্বীপে মাদক গ্রহণরত অবস্থায় যুবক তো বটেই, কিশোর বয়সী মাদকাসক্তদের উপস্থিতিও বিচ্ছিন্ন ঘটনা না বরং স্থান-কাল-জায়গা বিশেষে যেন গা-সওয়া।
ঢাকা শহরের এই চিত্র অনেককেই আতঙ্কিত করবে সেটাই স্বাভাবিক। জনশুমারি ২০২২ অনুযায়ী ঢাকা শহরে বস্তিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ এবং ভাসমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। সরকারের বাজেট ডকুমেন্ট বলছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু। যদিও বাংলাদেশে পথশিশু নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, এই সংখ্যাটা কমবেশি এক মিলিয়ন এবং এর ৭৫ শতাংশই ঢাকায় বসবাস করে। কোনো কোনো সংগঠনের তথ্য মতে, ঢাকা শহরের পথশিশুদের প্রায় ৮৫ শতাংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাদকাসক্ত। এর মধ্য দিয়েই বোঝা যায় পরিস্থিতি কতটুকু আশঙ্কার!
আমরা এখন উন্নয়নের মহাসড়কে, নিঃসন্দেহে সময়ের হাত ধরে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থায় পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ওপরের চিত্র এটাই প্রমাণ করে উন্নয়নকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য এখনো অনেক কিছু বাকি আছে। এখনো উন্নয়নের প্রচেষ্টায় সমাজের একটা বড় অংশ প্রবেশ করতে পারছে না বা বর্তমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো তাদের যুক্ত করতে পারছে না। মানুষ ইচ্ছা করে ফুটপাতে থাকে না যতক্ষণ না পর্যন্ত সে বাধ্য হয়। আবার রাস্তায় মূল্যবান কৈশোরের অপচয় এবং তা মানবসম্পদ তৈরিতে বিনিয়োগ করতে না পারার পেছনে কারণসমূহ কী? কেনই-বা আমরা তাদের জন্য শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করতে পারছি না? কেনই-বা একজন কিশোর ধীরে ধীরে মাদকে আসক্ত হয়ে উঠছে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে ও নিজের সম্ভাবনাগুলো বিসর্জন দিচ্ছে। এখন এই প্রশ্নগুলো করার সময় এসেছে কারণ অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ নির্মাণ করা না গেলে সেই সমাজে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা কোনোটাই থাকার সম্ভাবনা নেই এবং সেটাই কোনো একটা জাতিকে অগ্রগতির রাস্তা থেকে টেনে ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট।
আমরা জানি, যে কোনো জনগোষ্ঠীর একটি নির্দিষ্ট অংশকে সহযোগিতা করতে হয়। সেই হারটা হতে পারে দশ শতাংশ বা তার আশপাশে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য, তবে হারটা অনুমেয়ভাবে বেশি। বিবিএস-এর তথ্য মতে, ২০১৮-১৯ সালে বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ছিল ২০.৫ শতাংশ এবং অতিদরিদ্রের হার ১০.৫ শতাংশ। সে হিসাবে নতুন জনশুমারির চূড়ান্ত ফলাফল অনুযায়ী দেশের প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষ অতিদরিদ্র। সংখ্যার হিসাবে অনেক বড়। তথাপি মাঝের কারোনার দুই বছরে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ভিত্তি ক্ষয়িষ্ণু করেছে, অনেক মানুষ তথাতথিত দারিদ্র্যসীমার নিচে নামতে বাধ্য হয়েছে, আবার করোনা-পরবর্তী সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধজনিত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির হার বেশ কিছু মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিচ্ছে। ভাসমান মানুষের এই উপস্থিতি কি সেটারই ইঙ্গিত দিচ্ছে? সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদদের এ নিয়ে গবেষণা করার প্রয়োজন আছে। সরকারি তথ্য মতে সারা দেশে ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবার রয়েছে। অনুমেয় এই গৃহহীন পরিবারগুলোই শহরের ভাসমান জনগোষ্ঠীর প্রধানতম অংশ; পাশাপাশি নদীভাঙন, গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানের অভাব ও নানা ধরনের অনিশ্চয়তা তাদের এই অবস্থায় ঠেলে দিচ্ছে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এই অনিশ্চয়তাসমূহ দূর করা দরকার। মেগা প্রকল্পসমূহ বাদ দিলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে প্রশংসনীয় উদ্যোগ হচ্ছে ভূমিহীনদের জন্য গৃহনির্মাণ প্রকল্প। তথ্য মতে মুজিববর্ষ উপলক্ষে সরকার ইতিমধ্যে প্রায় ১ লাখ ৮৫ হাজার গৃহহীন পরিবারকে ঘর বিতরণ করেছে। এই ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং সাধারণ জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি করেছে। তবে ঘর বিতরণই হয়তো সবক্ষেত্রে সবধরনের প্রান্তিকতাকে দূর করতে পারছে না। তাই এই ধরনের উদ্যোগ যেমন আরও গ্রহণ করা দরকার এবং একইসঙ্গে আরও কী কী উপায়ে এই প্রান্তিকতাকে ধারাবাহিকভাবে দূর করা যায় তা বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সক্ষমতাই হচ্ছে অর্থনীতির প্রকৃত শক্তি, এই অংশকে যত বেশি কর্মক্ষম করা যায়, দক্ষ করা যায় ততই পরিবর্তনের ভিত মজবুত করা সম্ভব। চুইয়ে পরা অর্থনীতির আকার বেশি হলেও তা উন্নয়নের বুদবুদ তৈরি করতে পারে কিন্তু বিবেচনায় রাখতে হবে, বুদবুদ ক্ষণস্থায়ী এবং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হয় না। আমাদের দেশে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতা ও জীবনমান উন্নয়নে ২০২২-২৩ বাজেটে ১১৫টি কর্মসূচিকে সামাজিক সুরক্ষামূলক কার্যক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনেক সময় এই প্রকল্পগুলো গৎবাঁধা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে শুধুমাত্র সাহায্য গ্রহণকারী হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি কতটুকু ভাসমান হতে বাধ্য হওয়া জনগোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে পরিকল্পনা করা হয়েছে সেটাও একটা প্রশ্নের বিষয়। সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে শুধু সাহায্য গ্রহণকারী হিসেবে দেখলেই চলবে না, এর জন্য ঐ জনগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট পরিস্থিতি ও চাহিদা অনুধাবন করে তাদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। আর কর্মসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রে জীবন ধারণকে নিছক সাহায্য করা থেকে বেরিয়ে এসে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে অবদান রাখার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। আর এই বিষয়গুলোই রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে খতিয়ে দেখা দরকার। কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার যে মূলনীতি তা আমাদের দেশে শুধুমাত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্যই দরকার না, বরঞ্চ আরও বেশি দরকার সামাজিক স্থিতিশীলতা বাজায় রাখার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ টেকসই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
আধুনিক ধারণায় কারাগারকে শুধু শাস্তির জায়গা হিসেবে না রেখে বন্দিদের ‘সংশোধনাগার’ হিসেবে দেখা হয়। শাস্তি ভোগ করে বেরিয়ে বন্দিরা যাতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে, সে জন্য আছে নানা ব্যবস্থা। এরপরও সেখানে ঢোকার পর যদি কেউ জঙ্গিবাদে আরও বেশি জড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায় সেটা উদ্বেগের। অন্যদিকে, অভিযোগ রয়েছে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ থাকার পরও দীর্ঘদিন ধরেই দেশের বিভিন্ন কারাগারে মোবাইল ব্যবহার করছে হাজতিরা। এমনকি সেলের ভেতরেই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা কথা বলছে বাইরে থাকা অন্য সহযোগীদের সঙ্গে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, সর্বশেষ ঢাকার আদালত থেকে ছিনতাই ঘটনার আগের দিনও কারাগারে ছিনতাই হওয়া জঙ্গিদের সঙ্গে কথোপকথন হয়েছে। কখন তাদের আদালতে নেওয়া হবে সেই সময়ও জেনে যায় সহযোগীরা। পাশাপাশি জামিনপ্রাপ্ত জঙ্গিদের অনেকেই আবার উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে বা কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে যাচ্ছে বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে রবিবার দেশ রূপান্তরে ‘কারাগারের জঙ্গিদের মামাবাড়ির আবদার’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি জঙ্গিরা বিক্ষোভ করেছেন। বন্দি জঙ্গিরা নিজেদের চাহিদামতো কম্বল সরবরাহ, স্বজনদের সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে এক দিন সাক্ষাৎ ও ফোনে কথা বলার দাবি জানায়। পাশাপাশি তারা সাধারণ বন্দিদের মতো ঘোরাফেরা করার দাবি করে। প্রশ্ন হলো, যেখানে কারাগারে এ ধরনের বন্দিদের আলাদা রাখার কথা; সেখানে তারা সংগঠিত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনের সুযোগ পেল কীভাবে! অভিযোগ রয়েছে, কারাগারে জঙ্গিদের ওপর সেভাবে নজরদারি নেই। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কারাগারকে ‘প্রশিক্ষণ সেন্টারে’ পরিণত করেছে জঙ্গিরা। সংবাদপত্রেও এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জঙ্গি বন্দিরা সাধারণ কয়েদিদের মধ্যে ঘোরাফেরা তো দূরের কথা নিজেদের মধ্যেও যেন সলাপরামর্শ করতে না পারে সেদিকে সতর্ক হওয়া উচিত। আমরা চাই না সাধারণ কয়েদি হিসেবে কারাগারে ঢুকে কেউ জঙ্গি হয়ে বেরিয়ে আসুক।
অন্যদিকে, নিষিদ্ধ থাকার পরও দেশের সবক’টি কারাগারেই দেদার মোবাইল ফোনে কথা বলছে বন্দিরা। অপরাধী ও জঙ্গিরা কারাগারের ভেতর থেকেই তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশিরভাগ কারাগারেই জ্যামার থেকেও না থাকার মতো অবস্থা। অভিযোগ উঠেছে, টাকার বিনিময়ে জ্যামারগুলো বিকল করে রেখেছে অসাধু কারারক্ষীরা। ওই সব জ্যামার দ্রুত সচল করা ও নতুন জ্যামার বসানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অভিযোগের পর কিছুদিন ঠিকমতো সবকিছু চললেও ধীরে ধীরে তা ফিরে যায় আগের অবস্থায়। কিন্তু ঢাকা কেন্দ্রীয় ও কাশিমপুরের চার কারাগারে কীভাবে বন্দিরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর সঙ্গে জড়িত কারারক্ষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, কারাগারের অধিকাংশ দুর্ঘটনার সঙ্গে একশ্রেণির অসাধু কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী, কর্তব্যরত পুলিশের কিছু সদস্য জড়িত থাকে। বন্দি আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু পুলিশ সদস্য ওই সময় বন্দিদের মাদক, মোবাইল ফোন ও বিভিন্ন অবৈধ দ্রব্য দিয়ে থাকে বলে তারা তথ্য পেয়েছেন। কারাগারে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে অপরাধীরা তাদের সহযোগীদের আগাম তথ্য পাচার করে দিয়ে থাকে, এমন তথ্য পাওয়া গেছে। কারা কর্তৃপক্ষের এই অনিয়ম, অসততার সুযোগ নিচ্ছে কারাবন্দি জঙ্গিরা। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে জঙ্গির সংখ্যা প্রায় সাত হাজারের বেশি। জামিনপ্রাপ্ত জঙ্গিদের অনেকেই আবার উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। আবার কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে যাচ্ছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যোগাযোগের জন্য জেলখানাকেই আপাতত নিরাপদ জায়গা মনে করছে জঙ্গিরা। জামিনে বের হয়ে আসা জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে করা প্রতিবেদনেও এর সত্যতা পাওয়া গিয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ‘বাইরে জঙ্গিরা দুর্বল হয়ে পড়লেও কারাবন্দি জঙ্গিরা বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। কারাগারে জঙ্গিদের জন্য আলাদা সেল না থাকায় এ সমস্যা তৈরি হচ্ছে। জঙ্গিরা একত্রিত হয়ে নতুন নতুন পরিকল্পনার সুযোগ পাচ্ছে।’ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি প্রচারণা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাফল্যের দাবির কথা আমরা শুনে আসছি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সরকার জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে পেরেছে। বিভিন্ন ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠী নাম পরিবর্তন করে, কৌশল পরিবর্তন করে তৎপরতা চালিয়ে আসছে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কিশোর-তরুণদের জঙ্গি দলে নাম লিখিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়া, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সন্ধান ও গ্রেপ্তারের খবর নিয়মিতই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে আসছে। ফলে সতর্কতা ও পদক্ষেপ জরুরি।
সাহিত্যিক ও প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ১৮৪২ সালের ১ জুন। তিনি ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র এবং রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ। ১৮৬২ সালে তিনি সস্ত্রীক লন্ডন যান এবং ১৮৬৪ সালে আইসিএস হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৮৬৫ সালে আহমেদাবাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। চাকরি থেকে অবসরগ্রহণের পর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৮৬৭ সালের ১২ এপ্রিল চৈত্রসংক্রান্তির দিন তিনি কলকাতার বেলগাছিয়ায় হিন্দু মেলার প্রবর্তন করেন। ১৯০০ ও ১৯০১ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯০৬ সালে আদি ব্রাহ্মসমাজের আচার্য ও পরে সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ৯টি বাংলা ও তিনটি ইংরেজি গ্রন্থ রচনা করেন। এ ছাড়া তার করা তিলকের ‘ভগবদ্গীতাভাষ্য’, ‘কালিদাসের মেঘদূত’ এবং তুকারামের ‘অভঙ্গে’র অনুবাদ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি কিছুকাল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ১৯২৩ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি মারা যান।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) হলের আসন দখল করে রাখার বিরুদ্ধে অনশনরত ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী সামিউল ইসলাম প্রত্যয়সহ তাকে সমর্থন দেওয়া কয়েকজনের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।
মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে এ ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।তারা বলেন, ওই স্থানে গত বুধবার রাত থেকে অনশনে ছিলেন প্রত্যয়। তাকে মারধরের পর অ্যাম্বুলেন্সে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যায় হামলায় জড়িতরা। এ সময় প্রত্যয়ের দাবির সঙ্গে সংহতি জানানো প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের ওপরও হামলা হয়।
জানা গেছে, তিন দাবিতে গত বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনের খেলার মাঠে অনশনে বসেন প্রত্যয়। তিনি ওই হলের আবাসিক ছাত্র। তার অন্য দুটি দাবি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে অছাত্রদের বের করা ও হলের গণরুমে অবস্থান করা বৈধ ছাত্রদের আসন নিশ্চিত করা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং নবীন শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছিলেন। ওই সময় ক্যাম্পাসে লোডশেডিং চলছিল। হঠাৎ করেই প্রত্যয়সহ তার সঙ্গে থাকা অন্যদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
হামলায় জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সৌমিক বাগচী, মার্কেটিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের সৃষ্টি, চারুকলা বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের মনিকা, বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের ৪৮তম ব্যাচের সুরসহ আরও কয়েকজন আহত হন বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, হামলায় ৩০ থেকে ৪০ জন অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। অভিযুক্তদের কয়েকজন হলেন ছাত্রলীগ নেতা ও রসায়ন বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী গৌতম কুমার দাস, তুষার, ফেরদৌস, নোবেল, গোলাম রাব্বি, মুরসালিন, মুরাদ, সোহেল, তানভীর, রায়হান, রাহাত, সৌমিক, তারেক মীর, সজীব ও নাফিস।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী জানান, আমরা যারা প্রত্যয়ের সঙ্গে ছিলাম তাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর প্রত্যয়কে দেখতে চিকিৎসক এসেছিলেন। তখন তারা অ্যাম্বুলেন্সের ওপর হামলা করে সেটি ফিরিয়ে দেয়। প্রক্টরকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি আসেননি। একাধিক ছাত্রীর দিকেও চড়াও হয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মীর মশাররফ হোসেন হলের এক শিক্ষার্থী অসুস্থ এমন একটি ফোনকল পেয়ে তারা অ্যাম্বুলেন্স পাঠায়। তবে কে কল দিয়েছিল সে সম্পর্কে চিকিৎসা কেন্দ্রের কেউ বলতে পারেননি।
তবে যে ফোন নাম্বার থেকে কল দেওয়া হয়েছিল সেটিতে যোগাযোগ করে দেখা যায় নাম্বারটি শাখা ছাত্রলীগের নেতা গৌতম কুমার দাসের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ১৫ হাজার শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। দরকার হলে আমি পদত্যাগ করব।
এদিকে হামলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে রাতেই বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। মিছিল নিয়ে তারা এ রাত পৌনে ১টায় প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান করছেন।
তবে অনশনরত শিক্ষার্থী সামিউলের ওপর হামলারে পেছনে ছাত্রলীগের কোনো হাত নেই বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, মীর মশাররফ হোসেন হলের অনশনরত ওই শিক্ষার্থীর ওপর হামলা হয়েছে। তবে সেটা সাধারণ শিক্ষার্থীরা করেছে। সেখানে ছাত্রলীগের একজনও জড়িত নয়।’
অসুস্হ সাবেক ফুটলার মোহাম্মদ মহসীনের পাশে দাড়িয়েছেন তার সাবেক সতীর্থরা। মোহামেডান ক্লাবের সাবেক ফুটবলার ও সোনালী অতীত ক্লাবের সদস্যরা বিকেলে বসে এই সিদ্ধান্ত নেন। পরে মহসীনের বাসায় যান তার সংগে দেখা করতে।সাবেক ফুটবলারদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল গাফফার, জোসী, বাবলু, জনি, সাব্বির, রিয়াজ।
এসময় গাফফার জানান, মহসীনের চিকিৎসার জন্য বিসিবি সভাপতির উদ্যোগে বুধবার সকালে অসুস্হ ফুটবলারকে হাসপাতালে ভর্তি করবে।
হাসপাতাল থেকে সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে ফেরার পর মহসীন কানাডায় ফিরে যেতে চাইলে সাবেক ফুটবলাররা সহায়তা করবে। মহসীন কানাডা থেকে দেশে ফিরেছেন মায়ের পাশে থাকতে। প্রায় নব্বই ছুই ছুই মহসিনের মায়ের পায়ে ব্যথা। মহসীনের পাশাপাশি তার মায়ের চিকিৎসার ব্যাপারেও সাবেক ফুটবলাররা পাশে থাকবেন বলে জানান আবদুল গাফফার।
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
প্রথম সেটে হেরে পিছিয়ে পড়েছিলেন। তবে পরের সেটেই ঘুরে দাঁড়ান। ৩ ঘণ্টা ৩৮ মিনিটের লড়াইয়ের পর কোয়ার্টার ফাইনালটা জিতে নিলেন নোভাক জকোভিচ। কারেন খাচানভকে ৪-৬, ৭-৬, ৬-২, ৬-৪ ব্যবধানে পরাজিত করে ফ্রেঞ্চ ওপেনের সেমিফাইনালে উঠলেন এই সার্বিয়ান।
কোয়ার্টার ফাইনালের শুরুটা দেখে মনে হচ্ছিল, দিনটা বোধহয় জকোভিচের নয়। তবে মাথা ঠান্ডা রেখেছিলেন তিনি। খাচানভ প্রথম সেট জিতে নেওয়ার পর দ্বিতীয় সেটেও সমানে সমানে লড়াই করেন। যদিও টাইব্রেকারে জোকোর সামনে দাঁড়াতে পারেননি তিনি।
ম্যাচে সমতা ফেরানোর পর এক বার লকার রুমে ফিরে যান জোকোভিচ। তার পর শুধু কোর্টেই ফিরলেন না। নিজের চেনা ছন্দেও ফিরলেন। তৃতীয় এবং চতুর্থ সেটে আর শুরুর মতো লড়াই করতে পারলেন না প্রতিযোগিতার ১১ নম্বর বাছাই।
ফ্রেঞ্চ ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনালে মঙ্গলবার প্রতিযোগিতার প্রথম সেট হারলেন জোকোভিচ। হেরে যেতে পারেন এমন মনে না হলেও এ দিন ছন্দ পেতে কিছু সময় লেগেছে তার। ৩৬ বছরের জোকোভিচ কি সর্বোচ্চ পর্যায়ের টেনিসের ধকল আগের মতো সামলাতে পারছেন না আর?
এমন প্রশ্ন যখন উঁকি দিতে শুরু করছে, তখনই নিজের চেনা ছন্দে দেখা দিয়েছেন। কোয়ার্টার ফাইনালে খাচানভের বিরুদ্ধে সময় পেয়েছেন। সুযোগ পেয়েছেন। সেমিফাইনাল বা ফাইনালের প্রতিপক্ষরা কি ছন্দে ফেরার সময় বা সুযোগ দেবেন তাঁকে?
টেনিসপ্রেমীদের মনে এই প্রশ্ন রেখেই ফ্রেঞ্চ ওপেনের শেষ চারে পৌঁছে গেলেন দু’বারের চ্যাম্পিয়ন। পাশাপাশি কিছুটা হয়তো উদ্বেগেও রাখলেন। সেমিফাইনালে জায়গা নিশ্চিত করার পর জোকার স্বীকারও করে নিয়েছেন, কোয়ার্টার ফাইনালে প্রথম দু’টি সেট তার থেকে ভাল খেলেছেন রুশ প্রতিপক্ষ।
এদিকে ওপর কোয়ার্টার ফাইনালে জয় পেয়েছেন কার্লোস আলকারাজ। সিৎসিপাসের বিপক্ষে তিনি ৩-০ (৬-২, ৬-১, ৭-৬) সেটে জিতে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছেন এই স্পেনিশ টেনিস তারকা।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
দুই দশকেরও বেশি ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটক-টেলিছবি নির্মাণ করেছেন শিহাব শাহীন, উপহার দিয়েছেন হিট প্রোডাকশন। নিজেকে শুধু রোমান্টিক জনরায় আটকে না রেখে কাজ করেছেন বহুমাত্রিক ঘরানায়। নিজেকে প্রমাণ করেছেন সব্যসাচী নির্মাতা হিসেবে। নিজেকে শুধু টেলিভিশনেই আটকে রাখেননি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাল্টেছেন প্লাটফর্ম এবং সেখানেও দেখিয়েছেন নিজের মুন্সিয়ানা।
সর্বশেষ গেল ঈদে তুমুল সাড়া ফেলেছে তার নির্মিত স্পিন অফ সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’। সাফল্যের পর কিছুদিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এর সাকসেস পার্টি যেখানে উপস্থিত ছিলেন টিমের কলাকুশলী থেকে শুরু করে অন্যান্য নির্মাতা ও শিল্পীরা। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি নিয়ে আসছেন সিরিজটির সিক্যুয়াল। শুধু তাই নয়, একসঙ্গে একাধিক সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে আসছেন জনপ্রিয় নির্মাতা।
শিহাব শাহীন বলেন, ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ নিয়ে এতটা প্রত্যাশা ছিল না কিন্তু সে সাড়া পেয়েছি তা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। দর্শকরাই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন আর তাই এখন এর সিক্যুয়াল নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। স্পিন অফে দেখিয়েছি অ্যালেন স্বপনের পেছনের গল্প। সিন্ডিকেটে তাকে আমরা দেখিয়েছিলাম ২০২২ সালে, সে ঢাকায় আসার পর এর মাঝের সময়টার গল্পই থাকবে সিক্যুয়ালে। যেটার সংযোগ থাকতে পারে ‘সিন্ডিকেট ২’-তে। ঈদের পরপর এটার শুট করার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সিক্যুয়াল ছাড়াও আরও বেশ কিছু সিরিজ ও ফিল্ম নিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান এ নির্মাতা। তিনি বলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকির তত্ত্বাবধানে ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির ‘মিনিস্ট্রি অফ লাভ’ সিরিজের একটা কনটেন্ট করবো। এখনও কাস্টিং চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া হইচইয়ের একটি সিরিজ ও বিঞ্জের একটি ফিল্ম করা হবে। নাম চূড়ান্ত হয়নি। তবে দুটোতেই জিয়াউল ফারুক অপূর্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঝে শোনা গিয়েছিল, আফরান নিশোকে নিয়ে ‘সিন্ডিকেট ২’ নাকি হবে না, এটা কতটুকু সত্য? এমন প্রশ্নে শিহাব শাহীন বলেন, এটা ভূয়া তথ্য। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ‘সিন্ডিকেট ২’ করবো তার আগে সেপ্টেম্বরে শুরু করবো ‘রসু খাঁ’।
জানা গেছে, আগামী সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমাচ্ছেন শিহাব শাহীন। দেশে ফিরবেন মাসের শেষ নাগাদ এরপর কাজে নামবেন।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।