
আধুনিক ধারণায় কারাগারকে শুধু শাস্তির জায়গা হিসেবে না রেখে বন্দিদের ‘সংশোধনাগার’ হিসেবে দেখা হয়। শাস্তি ভোগ করে বেরিয়ে বন্দিরা যাতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে, সে জন্য আছে নানা ব্যবস্থা। এরপরও সেখানে ঢোকার পর যদি কেউ জঙ্গিবাদে আরও বেশি জড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায় সেটা উদ্বেগের। অন্যদিকে, অভিযোগ রয়েছে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ থাকার পরও দীর্ঘদিন ধরেই দেশের বিভিন্ন কারাগারে মোবাইল ব্যবহার করছে হাজতিরা। এমনকি সেলের ভেতরেই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা কথা বলছে বাইরে থাকা অন্য সহযোগীদের সঙ্গে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, সর্বশেষ ঢাকার আদালত থেকে ছিনতাই ঘটনার আগের দিনও কারাগারে ছিনতাই হওয়া জঙ্গিদের সঙ্গে কথোপকথন হয়েছে। কখন তাদের আদালতে নেওয়া হবে সেই সময়ও জেনে যায় সহযোগীরা। পাশাপাশি জামিনপ্রাপ্ত জঙ্গিদের অনেকেই আবার উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে বা কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে যাচ্ছে বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে রবিবার দেশ রূপান্তরে ‘কারাগারের জঙ্গিদের মামাবাড়ির আবদার’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি জঙ্গিরা বিক্ষোভ করেছেন। বন্দি জঙ্গিরা নিজেদের চাহিদামতো কম্বল সরবরাহ, স্বজনদের সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে এক দিন সাক্ষাৎ ও ফোনে কথা বলার দাবি জানায়। পাশাপাশি তারা সাধারণ বন্দিদের মতো ঘোরাফেরা করার দাবি করে। প্রশ্ন হলো, যেখানে কারাগারে এ ধরনের বন্দিদের আলাদা রাখার কথা; সেখানে তারা সংগঠিত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনের সুযোগ পেল কীভাবে! অভিযোগ রয়েছে, কারাগারে জঙ্গিদের ওপর সেভাবে নজরদারি নেই। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কারাগারকে ‘প্রশিক্ষণ সেন্টারে’ পরিণত করেছে জঙ্গিরা। সংবাদপত্রেও এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জঙ্গি বন্দিরা সাধারণ কয়েদিদের মধ্যে ঘোরাফেরা তো দূরের কথা নিজেদের মধ্যেও যেন সলাপরামর্শ করতে না পারে সেদিকে সতর্ক হওয়া উচিত। আমরা চাই না সাধারণ কয়েদি হিসেবে কারাগারে ঢুকে কেউ জঙ্গি হয়ে বেরিয়ে আসুক।
অন্যদিকে, নিষিদ্ধ থাকার পরও দেশের সবক’টি কারাগারেই দেদার মোবাইল ফোনে কথা বলছে বন্দিরা। অপরাধী ও জঙ্গিরা কারাগারের ভেতর থেকেই তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশিরভাগ কারাগারেই জ্যামার থেকেও না থাকার মতো অবস্থা। অভিযোগ উঠেছে, টাকার বিনিময়ে জ্যামারগুলো বিকল করে রেখেছে অসাধু কারারক্ষীরা। ওই সব জ্যামার দ্রুত সচল করা ও নতুন জ্যামার বসানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অভিযোগের পর কিছুদিন ঠিকমতো সবকিছু চললেও ধীরে ধীরে তা ফিরে যায় আগের অবস্থায়। কিন্তু ঢাকা কেন্দ্রীয় ও কাশিমপুরের চার কারাগারে কীভাবে বন্দিরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর সঙ্গে জড়িত কারারক্ষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, কারাগারের অধিকাংশ দুর্ঘটনার সঙ্গে একশ্রেণির অসাধু কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী, কর্তব্যরত পুলিশের কিছু সদস্য জড়িত থাকে। বন্দি আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু পুলিশ সদস্য ওই সময় বন্দিদের মাদক, মোবাইল ফোন ও বিভিন্ন অবৈধ দ্রব্য দিয়ে থাকে বলে তারা তথ্য পেয়েছেন। কারাগারে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে অপরাধীরা তাদের সহযোগীদের আগাম তথ্য পাচার করে দিয়ে থাকে, এমন তথ্য পাওয়া গেছে। কারা কর্তৃপক্ষের এই অনিয়ম, অসততার সুযোগ নিচ্ছে কারাবন্দি জঙ্গিরা। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে জঙ্গির সংখ্যা প্রায় সাত হাজারের বেশি। জামিনপ্রাপ্ত জঙ্গিদের অনেকেই আবার উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। আবার কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে যাচ্ছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যোগাযোগের জন্য জেলখানাকেই আপাতত নিরাপদ জায়গা মনে করছে জঙ্গিরা। জামিনে বের হয়ে আসা জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে করা প্রতিবেদনেও এর সত্যতা পাওয়া গিয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ‘বাইরে জঙ্গিরা দুর্বল হয়ে পড়লেও কারাবন্দি জঙ্গিরা বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। কারাগারে জঙ্গিদের জন্য আলাদা সেল না থাকায় এ সমস্যা তৈরি হচ্ছে। জঙ্গিরা একত্রিত হয়ে নতুন নতুন পরিকল্পনার সুযোগ পাচ্ছে।’ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি প্রচারণা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাফল্যের দাবির কথা আমরা শুনে আসছি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সরকার জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে পেরেছে। বিভিন্ন ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠী নাম পরিবর্তন করে, কৌশল পরিবর্তন করে তৎপরতা চালিয়ে আসছে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কিশোর-তরুণদের জঙ্গি দলে নাম লিখিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়া, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সন্ধান ও গ্রেপ্তারের খবর নিয়মিতই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে আসছে। ফলে সতর্কতা ও পদক্ষেপ জরুরি।
এটা সবাই বলতে চাইবে যে, একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদাররা হেরে গিয়েছিল ঠিকই; কিন্তু তারপর থেকে আমরা কেবলি নিজেরা নিজেদের কাছেই হারছি। চতুর্দিকে পরাজয়ের চিহ্ন। হতাশা, অরাজকতা, মীমাংসিত প্রশ্নের অমীমাংসিত হয়ে যাওয়া কোনটা বাদ দিয়ে কোনটার কথা বলি। পরাজয়টা তাই ভেতর থেকে। বড় দুঃখে। কিন্তু কার কাছে হারলাম? কেই-বা হারাল? কখন? পরাজয়ের সূত্রপাত বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু পাকিস্তানিদের কাছে নয়; ওই গৌরব তাদের একেবারেই প্রাপ্য নয়। হার হয়েছে সেই প্রায়-অদৃশ্য কিন্তু অত্যন্ত পরাক্রমশালী শক্তির কাছে যার অধীনে পাকিস্তানিরা তখনো ছিল, এখনো আছে। এই প্রভুটির নাম পুঁজিবাদ। পরাজয় হয়েছে তার কাছেই।
আশা ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওই প্রভুরও পতন ঘটবে। ঘোড়া পড়ে গেলে ঘোড়সওয়ারও পড়ে যাবে। কিন্তু তা কি হয়? এই সওয়ারটি অনেক বেশি শক্তি রাখে। তার ক্ষমতা বিশ্বব্যাপী ন্যস্ত; সে কেন পড়ে যাবে খামোখা? একটা ঘোড়া গেছে অন্য ঘোড়া সহজেই পেয়ে যাবে। বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রটি এই পুঁজিবাদের নতুন ঘোড়া বটে। সওয়ারটি দাবড়ে বেড়াচ্ছে। আর ওই যে আমাদের আশা তার ভিত্তিটাই বা কী ছিল?
ভিত্তি ছিল জনগণের আত্মত্যাগ। তারা এমনভাবে লড়েছে, এত অধিক মূল্য দিয়েছে এবং এতটা ঐক্যবদ্ধ ছিল যে, ভরসা ছিল যে পুঁজিবাদের পতন ঘটবে এবং বাংলাদেশের মানুষ কেবল স্বাধীন নয়, প্রকৃত প্রস্তাবেই মুক্ত হবে; কিন্তু কেবল আত্মত্যাগে তো ওই রকমের পরাক্রমশীল শক্তি, নাম যার পুঁজিবাদ, তার পতন ঘটে না। সাময়িকভাবে পিছু হটলে অনতিবিলম্বে সে ফিরে আসে। আমরা তো বুঝতেই পারছি যে আমাদের ক্ষেত্রেও ডাশ তাই-ই ঘটেছে। পুঁজিবাদ ফিরে এসেছে। কেবল ফেরত আসেনি, আগের চেয়ে বেশি নৃশংস হয়ে এসেছে, যেন তাকে বিরক্ত করার দরুন ক্ষিপ্ত সে, শাস্তি দেবে।
বাংলাদেশ একটি নতুন রাষ্ট্র বটে। কিন্তু কতটা নতুন? নামে নতুন, ভূখ-ে নতুন; কিন্তু স্বভাব-চরিত্রে? না, স্বভাব-চরিত্রে সে এতটুকু বদলায়নি। পুরাতন রাষ্ট্রের মতোই রয়ে গেছে আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী। হ্যাঁ, শাসক বদলেছে। পুরাতন শাসকদের জায়গায় নতুন শাসক এসেছে; কিন্তু তারা রাষ্ট্রকে বদলাবে, এই রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করবে, ভেঙে দেবে এর আমলাতান্ত্রিক কাঠামো, ঘটাবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, প্রতিষ্ঠা করবে মানুষে মানুষে অধিকার ও সুযোগের সাম্য এসব কেন আশা করব আমরা? আশা অবশ্য করেছিলাম ওই আত্মত্যাগের কারণেই। কিন্তু জনগণের আত্মত্যাগের কী মূল্য আছে এই নিপীড়নকারী শাসকশ্রেণি এবং তাদের স্বার্থ-সংরক্ষণকারী আমাদের এই নতুন রাষ্ট্রের কাছে?
কে হারল এই প্রশ্নের জবাবও এই বাস্তবতার ভেতরেই পাওয়া যাবে। হেরে গেছে জনগণ। হেরেছে এই জন্য যে, তাদের রাজনৈতিক সংগঠন নেই, নেতৃত্বের রয়েছে অভাব, অভাব ঘটেছে রাজনৈতিক শক্তির। একাত্তরের পর থেকে যে নেতৃত্বকে আমরা পেয়েছি তারা হারেনি, তারা আত্মসমর্পণ করেছে। হারতে হলে লড়তে হয়। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারা তো পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি। প্রশ্নই ওঠে না লড়াইয়ের। তারা উদগ্রীব ছিল আত্মসমর্পণে। সেটাই তারা করেছে। আত্মসমর্পণের পর এখন চলছে তোয়াজ করার পালা। এখানে তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। জনতার জয় পদপিষ্ট হচ্ছে বিজয়-উদ্ধত পুঁজিবাদ ও পুঁজিবাদীদের দাপটের নিচে। এই বিজয়টা যেমন স্থানীয় তেমনি আন্তর্জাতিক; পুঁজিবাদ একটি বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থা বটে। একাত্তরে এদেশের মানুষের জীবনে যে দুর্ভোগ নেমে এসেছিল সেটা ছিল অপরিমেয়; কিন্তু যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যে গৌরব তারা অর্জন করেছিল তাও ছিল অতুলনীয়। ষোলই ডিসেম্বর বাঙালি জাতির ইতিহাসে গৌরবের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুহূর্ত। কিন্তু তারপরে?
তারপরের ইতিহাস উত্থানের থাকেনি, পরিণত হয়েছে পতনের। আমরা নামছি। কেবলই নামছি। এই নিম্নধাবমানতা নানাক্ষেত্রে ঘটেছে। সবচেয়ে ক্ষতিকরভাবে ঘটেছে মূল্যবোধের ক্ষেত্রে। খুব জরুরি যে মূল্যবোধ সেটি হচ্ছে দেশপ্রেম। এই দেশপ্রেমেরই চূড়ান্ত প্রকাশ আমরা দেখেছি একাত্তরে; আজ তার অভাব দেখছি পদে পদে। দেশপ্রেমের একটা বড় প্রকাশ ঘটেছিল আজ থেকে একশ বছর আগে, ১৯০৫ সালে, বঙ্গভঙ্গ রদ করবার সংগ্রামে। কিন্তু সেটা ঘটেছিল সীমিত আকারে; সীমাবদ্ধ ছিল মধ্যবিত্তের মধ্যে, যে মধ্যবিত্ত সেদিন ছিল মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্বারা গঠিত। বঙ্গভঙ্গকে প্রতিরোধ করবার আন্দোলনে প্রবল দেশপ্রেমের জোয়ার এসেছিল। প্লাবন দেখা দিয়েছিল জাতীয়তাবাদের। মানুষ কারাভোগ করেছে, প্রাণও দিয়েছে। কিন্তু নেতৃত্বের মারাত্মক রকমের ভ্রান্ত পদক্ষেপের দরুন ওই জাতীয়তাবাদ চলে গেল ধর্মীয় পুনর্জাগরণের অন্ধ পথে।
হিসাব করলে সেদিন দেখা যেত বাঙালিদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা মোটেই অল্প ছিল না। আসলে তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। হিন্দু জাতীয়তাবাদের জোয়ার মুসলমানদের সঙ্গে নিতে পারল না। বরং দেখা দিল সাম্প্রদায়িক বিভাজন। পরিণতিতে দাঙ্গা বাধল এবং সাতচল্লিশে দেশ গেল ভাগ হয়ে। সবটাই ঘটল নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে, একাত্তরে দাঙ্গা হয়নি, যুদ্ধ হয়েছে। বাঙালি বিভক্ত হয়নি, ঐক্যবদ্ধ ছিল। এ যেন সাতচল্লিশের সেই ভুলের সংশোধন। এবারে দেশভাগের প্রশ্ন নেই, এবারের প্রশ্নটা রাষ্ট্রকে ভাঙার। রাষ্ট্র ভাঙল। এলো স্বাধীনতা। কিন্তু তারপরে? তারপরে দেশপ্রেমের পতন ঘটেছে। কিন্তু কেন? এবারও দায়িত্ব নেতৃত্বেরই। না, যত দোষ নন্দ ঘোষের নয়, পতনের জন্য নেতারাই দায়ী। দোষ তাদেরই। তারা লড়াইতে যেতে চায়নি। যুদ্ধ নয়, তারা চেয়েছিল স্বায়ত্তশাসন, যার অর্থ তাদের জন্য অবাধ স্বাধীনতা; অন্যকিছুর নয়, লুণ্ঠনের। তাদের আন্তরিক দীক্ষা ছিল পুঁজিবাদে। সেই দীক্ষাটাকে যুদ্ধের সময়ে প্রকাশ না-করলেও বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচিত করেছে। উন্মোচনেরও দরকার হয়নি, আপনা আপনি বের হয়ে পড়েছে। দেশপ্রেম ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে পুঁজিবাদের দাপটে। যুদ্ধপরবর্তী পুঁজিবাদীরা লড়াই করেছে নিজেদের মধ্যে, ক্ষমতার (অর্থাৎ লুণ্ঠনের অধিকারের) ভাগাভাগি নিয়ে পাকিস্তানিদের সঙ্গেও তাদের লড়াইটা ছিল ওই ভাগাভাগি নিয়েই। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই সাঙ্গ করা যাবে বলে ভরসা করেছিল।
জনগণের লক্ষ্যটা ছিল ভিন্ন। তারা ক্ষমতার ভাগ পাবে এটা আশা করেনি; ওই লোভে যে উত্তেজিত হয়েছে তাও নয়। তাদের আশাটা ছিল মুক্তির। স্বায়ত্তশাসনের নয়, ক্ষমতার হস্তান্তরেও নয়, তাদের জন্য স্বপ্নটা ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির। তারা আশা করেছে এমন একটি সমাজ ও রাষ্ট্র পাবে যেখানে মানুষে মানুষে সম্পদ, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ইত্যাদি নিয়ে বৈষম্য থাকবে না; কেউ কারও শত্রু হবে না, সবাই হবে সবার মিত্র। বলাবাহুল্য জনগণ এই মুক্তি পায়নি।
পুঁজিপন্থিরা কিন্তু স্বাধীনতা পেয়ে গেল। তারা আরও ধনী হলো। তাদের ধনসম্পদ বৃদ্ধি পেল অবিশ্বাস্য গতিতে। তাদের সংখ্যাও যে খুব সীমিত রইল তা নয়, বেশ বেড়ে গেল। কিন্তু জনগণের সংখ্যার তুলনায় তারা অবশ্যই অল্প। তবে তাদের দাপট অসম্ভব প্রবল। বাংলাদেশ এখন সেই দাপটে থর থর করে কাঁপে।
জনগণ দেখল নতুন রাষ্ট্রের চেহারাটা আগের রাষ্ট্রের চেয়ে ভয়ংকর। এ রাষ্ট্র শাসকশ্রেণির অধীনস্ত তো বটেই; কিন্তু রীতিমতো সন্ত্রাসীও বৈকি। সাতচল্লিশের পরে বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিল, এবারও হলো; নিজের দেশের মধ্যেই তারা গৃহহীন, আশ্রয়হীন। তাদের দেশ নেই, দেশ চলে গেছে অন্যদের হাতে, যাদের হৃদয় ও মস্তিষ্কে দেশের জন্য কোনো স্থান অবশিষ্ট নেই। বাংলাদেশে এখন দেশপ্রেমিক বলতে শ্রমজীবী মানুষকেই বোঝায়। এই মানুষেরাই উৎপাদন করে। দেশকে এরাই টিকিয়ে রেখেছে এবং দেশের বাইরে এদের জন্য কোথাও কোনো স্থান নেই। যতই গৃহহারা হোক এই মানুষেরাই গৃহী এবং দেশপ্রেমিক। আর উদ্বাস্তু হচ্ছে তারা যাদের ধন-সম্পত্তি অনেক। বস্তুত যার বিত্তবেসাত যত অধিক সেই তত বড় উদ্বাস্তু, আমাদের এই বাংলাদেশে। এদের আদর্শ এদেশ নয়, আদর্শ হচ্ছে পুঁজিবাদী বিশ্ব। মানুষের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান বিনিয়োগ হচ্ছে সন্তানসন্ততি; সেই বিনিয়োগ এরা দেশে করে না, করে বিদেশে। সন্তানেরা বিদেশে যায় পড়ালেখার অজুহাতে, গিয়ে আর আসে না, এলেও আগমনটা বিদেশিদের মতোই, অবস্থানও সেই প্রকারেরই। ধনীদের জন্য বাংলাদেশ এখন এক প্রকারের জমিদারি। জমিদারদের তবু সরকারি তহবিলে খাজনা দিতে হতো, এরা সেটাও দেয় না।
পুঁজিবাদের দাসানুদাস এই শাসকশ্রেণিই দেশপ্রেমের অবনতির জন্য দায়ী। তারাই হচ্ছে দৃষ্টান্ত। তারা তাদের আদর্শকে জনগণের ভেতর ছড়িয়ে দিয়েছে। মানুষকে যতভাবে পারা যায় উদ্বুদ্ধ করছে আত্মস্বার্থসর্বস্ব ও ভোগবাদী হতে; উসকানি দিচ্ছে সব কিছু ভুলে কেবল নিজের কথা ভাবতে। মানুষকে নিয়ে এসেছে বাজারে। সর্বোপরি সর্বক্ষণ ব্যস্ত রাখছে জীবিকার সন্ধানে। যাতে অন্যকিছু ভাববার সময় না হয়, বিশেষ করে শাসকশ্রেণির অত্যাচার যেন চোখের বাইরে থাকে।
বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি দুটি কাজ খুব দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে, একটি বেকার সৃষ্টি, অপরটি মাদ্রাসা শিক্ষার বিস্তার। দুটোই দেশপ্রেমের বিকাশের পথে মস্ত বড় অন্তরায়। এদেশের ধনীরাই হচ্ছে শাসক এবং তারা বিনিয়োগ করে না, লুণ্ঠন করে। তাদের লুণ্ঠন তৎপরতায় বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়। জনগণের আয় এরা ব্যাংকের মাধ্যমে কিছুটা, কিছুটা নানাবিধ প্রতারণার ভেতর দিয়ে আত্মসাৎ করে ফেলে। ফলে কর্মসংস্থান বাড়ে না। লোক বাড়ছে, কাজ বাড়ছে না; অথচ করবার মতো কাজের তো কমতি থাকবার কথা নয় আমাদের মতো অনগ্রসর দেশের। সরকার আসে যায়, কিন্তু কোনো সরকারকেই দেখা যায় না কাজ সৃষ্টির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হতে। পুঁজিবাদ এমনিতেই শ্রমিকবিরোধী, শ্রমঘন উৎপাদনকে যে ঘৃণা করে, তার পক্ষপাত প্রযুক্তিঘন উৎপাদনের প্রতি। বাংলাদেশি পুঁজিবাদ উৎপাদনে বিশ্বাসই করে না, তার নির্ভরতা লুণ্ঠন ও ব্যবসাতে; বলাবাহুল্য ব্যবসা জিনিসটাও লুণ্ঠন ভিন্ন অন্য কিছু নয়।
যে মানুষটি বেকার তার তো কোনো দেশপ্রেম থাকবার কথা নয়। দেশ তো তাকে কিছুই দিচ্ছে না, বিড়ম্বনা ভিন্ন। তার সার্বক্ষণিক চিন্তা নিজেকে নিয়েই। আর মানুষের মতো আত্মপ্রেমিক সংসারে সত্যি বিরল। বেকারে যখন দেশ ছেয়ে যাচ্ছে, দেশে তখন দেশপ্রেমের বন্যা বইবে এমনটা আশা করা মোটেই যুক্তিসংগত নয়।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সক্কাল সক্কাল ঢাকার এক বন্ধুকে ফোন করতেই ঈষৎ বিরক্ত গলায় সে জানিয়ে দিল, খুব ঠান্ডা, পরে কথা হবে। আমার চট্টগ্রামবাসী এক স্নেহের বোন মোবাইলে নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কথোপকথন পোস্ট করেছে। করো কি খুব ঠান্ডা, তুমি- ভীষণ ঠান্ডা, কম্বল জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকো, হ্যাঁ বেশ ঠান্ডা, দেখা হবে কবে! খুব ঠান্ডা... ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আর কী বলি! এ লেখা লিখছিও তো লেপের মধ্যে পা ঢুকিয়ে। আমাদের ব্রিটিশ মালিকদের দস্তুর নাকি শীতকালে দেখা হলেই আগে গুড মর্নিং না বলে ঠান্ডার হাল-হকিকত নিয়ে খোঁজখবর নেওয়া।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট র্যাডক্লিফ সাহেব অনেক কিছু পারলেও, দেশকে টুকরো করে ভাগ করলেও দুপাড়ের শীতকে নিয়ন্ত্রণ করতে যে ব্যর্থ তা দুই বঙ্গের বাসিন্দারাই মানবেন। যার সঙ্গেই দেখা হোক, কাঁপতে কাঁপতে বলছে, ঠান্ডা কিন্তু জবর পড়েছে। এও এক সমস্যা। শীত পড়লেও দোষ, না পড়লেও কবিতায় লেখা হবে, ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা!’
পশ্চিমবঙ্গের সামনের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রিগিং হবে কি হবে না সেসব আলোচনা ছেড়ে সবাই শুধু তার জেলায় কত ঠান্ডা পড়েছে তা নিয়ে মশগুল। এরমধ্যে কোথাও যেন একটু-আধটু আকছাআকছিও পরস্পরের মধ্যে আছে তাও একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায়। বর্ধমান ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, শ্রীনিকেতন ৮.৪, আসানসোল ৯, কৃষ্ণনগর ৭, পুরুলিয়া ৬। সবমিলিয়ে ঠান্ডা লড়াইয়ে দক্ষিণবঙ্গ উত্তরবঙ্গকে হারিয়ে দিতে পেরেছে, লেপের তলায় বসে এটুকু খবরেই দক্ষিণ গর্বিত।
শীতকাল নিয়ে যতই লিখি না কেন, মনে হয় কিছুই বলা গেল না। পর্বের পর পর্ব লিখে ফেলা যায় এই রুক্ষ, ধূসর, কুয়াশাঢাকা দিনগুলো নিয়ে। শীতকাল নিয়ে লিখতে বসলেই নিমেষে কেমন ছেলেবেলা ফিরে আসে। পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট, সন্ধ্যেবেলায় ব্যাটমিন্টন এখনো বড় মিস করি। শীত পড়তে না পড়তেই বাড়ির লেপকম্বল রোদ্দুরে দেওয়া, পুরনো হয়ে গেলে ধুনুরি ডেকে মেরামত করা বা নতুন বানানো, এ ছিল শুধু আমাদের নয়, মধ্যবিত্ত পরিবারের দস্তুর। পাড়ায় ধুনুরিওয়ালার হাতের অদ্ভুত যন্ত্রের টুংটাং শব্দ আর লেপ-তোশক বানাবেন বলে হাঁক দেওয়া চোখ বুজলে এখনো শুনতে পাই। আর শুনতে পাই ‘পাটালি গুড় লাগবে ও জয়নগরের মোয়া লেবেন’ ডাক দিতে দিতে ফেরিওয়ালার পাড়া মাত করা মধুর আওয়াজ।
ইদানীং পশ্চিমবঙ্গের সিরিয়ালে সিঁদুরের রমরমা বাড়ছে। হঠাৎ হাত লেগে কোনো মহিলার কপালে সিঁদুর পড়ে গেলেও তাকে বিয়ে না করার মতো ‘অপরাধ’ আর নেই। আবার রোজ লাথিঝাঁটা খাওয়া স্ত্রীর একচিলতে সিঁদুরের সৌজন্যে গভীর কোমায় চলে যাওয়া আর দুশ্চরিত্র স্বামীও দিব্যি বেডে উঠে নিজের ভুল স্বীকার করে স্ত্রীকে প্রেম নিবেদন করেন। এমন সিঁদুরের রমরমার কালেও সেই চীনা সিঁদুর নেবেন গো ডাক শুনতে পাই না। হতে পারে চীন-ভারতের সম্পর্কের জটিলতা একটা কারণ।
শীতকালে কমলালেবু না খাওয়া বাঙালি পাওয়া কঠিন। আমাদের শহরে ভালো, মিষ্টি কমলালেবু মানেই দার্জিলিং। নাগপুরের কমলালেবু সস্তা, বিক্রি হয় বেশি। কিন্তু স্বাদ হয় না। টক। নিন্দুকেরা কেউ কেউ বলেন, নাগপুরে আরএসএসের সদর দপ্তর। সেখানকার কোনো জিনিস মিষ্টি হবে না তাই তো স্বাভাবিক। বেচারা লেবুও খারাপের সঙ্গে কেমন টকে গেল, ভাবতে কষ্ট হয়।
ছোটবেলায় শীতকালে চিড়িয়াখানা যাওয়া ছিল কম্পালসারি। বাঘ, সিংহ, হাতি, জিরাফ দেখার পাশাপাশি যাব যাব বলে সকাল থেকে তোড়জোড় করারও আলাদা আনন্দ ছিল। শীতের রোদে হাঁটাহাঁটি করে ক্লান্ত আমরা চাদর বিছিয়ে খেতে বসতাম লুচি, আলুর দম, নলেনগুড়ের সন্দেশ, আহা স্বাদ যেন আজও মুখে লেগে আছে। মা, বাবা কবেই চলে গেছেন। আমিই দুনিয়া ছেড়ে যাব যাব করছি। অথচ শীতকাল এলেই কেমন যেন মায়ের ওমের স্পর্শ আর বাবার হাঁকডাক টের পাই।
সেদিন এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম শীতে কী ভালো লাগে! বলল, মিঠে রোদে বসে বই পড়া, লেপের তলায় অনেকক্ষণ ল্যাদ খাওয়া, হাফ বয়েল ডিম সেদ্ধ ইত্যাদি বলে আমার কাছে জানতে চাইল, তোমার! আমি বললাম, যা আগেও বলেছি, কাছেপিঠে গেলে খেজুরের রস, রোদে বসে পাটালি খাওয়া, কড়াইশুঁটির কচুড়ি, ফুলকপির শিঙ্গাড়া, নলেনগুড়ের সন্দেশ ইত্যাদি। পিঠে পায়েস দুজনেই ভালোবাসি। এই প্রসঙ্গে অন্য একটি গল্প না বলে পারছি না। এ ঘটনা শুনেছিলাম, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অমিতাভ চন্দ্রের কাছে। অমিতাভ নাকি কোনো এক সরকারি অফিসে গিয়ে দেখে কেউ কোনো কাজ করছে না। শীতে জবুথবু হয়ে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে সবাই। বিষয় সেই শীতকাল। পরস্পর পরস্পরের কাছে জানতে চাইছে, এই সময় কার কী ভালো লাগে! এক একজন এক একরকম উত্তর দিচ্ছেন। কারও পছন্দ ঝোলাগুড়, রুটি, কারও আবার পেঁয়াজি, আলুর চপ, কেউ আবার রাত হলে দু-এক পাত্তর হলে বেশ হয় বলে আসর জমাচ্ছেন। একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক শুধু একমনে কাজ করে যাচ্ছেন। অন্য সবার তা সহ্য হলো না। একসঙ্গে সবাই চেঁচিয়ে উঠে বলতে লাগল, ও দাদা, ও ভট্টাচার্য দা আপনি কিছু বলুন। তিনি নিরুত্তর। অনেক চেঁচামেচি করার পরে কম্পিউটার থেকে সামান্য মুখ তুলে নির্বিকার গলায় তিনি জানিয়ে দিলেন মুড়ি দিয়া নারীকোল। অমিতাভ অকালে চলে গেছে। এখনো গল্পটা মনে আছে।
শীতকাল এলেই সার্কাস দেখা রেওয়াজ ছিল। কত রকমের সার্কাস, অলিম্পিক, পানামা, ভারত, গ্রেট ইস্টার্ন আরও কত। গ্যালারির টিকিট ছিল সস্তা। সামনের চেয়ারের দাম বেশি। আমরা গ্যালারিতে বসেই আনন্দ পেতাম। কত রকমের খেলা। তখন তো আর পশুক্লেষ নিবারণী সমিতি ছিল না। ফলে বাঘ, সিংহ, হাতির খেলা নিয়ে কোথাও কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। বাঘের হুঙ্কার শুনে ভয় লাগলেও মজাও পেতাম। হাতি ছোট্ট একটা টুলে বসে ট্রেনারের কথায় উঠত-বসত বাধ্য ছেলের মতো। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম, ট্র্যাপিজের খেলা। সুন্দরী মেয়েরা ঝলমলে ড্রেস পরে দারুণ দারুণ অ্যাডভেঞ্চার করত। তবে সব থেকে মজা পেতাম জোকারদের কান্ড দেখে। বড় হয়ে জেনেছি, ওরাই ছিল সার্কাসের সম্পদ। ওদের দেওয়া ট্রেনিংয়ে এই ট্র্যাপিজ সুন্দরীরা অমন কসরত শিখতে পারত। একটু বড় হয়ে এও জেনেছিলাম, জোকাররা লোক হাসায়, কিন্তু তাদের জীবনের অনেক অন্ধকার ওই হাসিঠাট্টায় চেপে রাখে। রাজ কাপুরের ‘মেরা নাম জোকার’ সিনেমাতে এই বাইরে হাসি ভেতরে কান্না ব্যাপারটা সুন্দরভাবে ধরা আছে। জোকারদের মনে হতো পৃথিবীর সেরা বিদূষক।
এখন এই পরিণত বয়সে পৌঁছে বুঝি, আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মতো বড় বিদূষক হয় না। জোকারেরা পেটের দায়ে নানা রকমের কসরত করে উল্টোপাল্টা বকে লোক হাসান। আর আমাদের দেশনেতারা জোকার সাজেন নিজেদের স্বার্থে। তাদের দেখে, কথা শুনেও জনতা মজা করেন, আড়ালে হাসেন। আত্মগর্বী রাজনীতির কারবারিরা ক্ষমতার দম্ভে তা টের পান না।
লেখক : ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক [email protected]
ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়কের ফুটপাত ও সড়ক দ্বীপে ভাসমান মানুষের বসবাস ও ভিড় যেন বেড়েই চলেছে। তাদের অনেকেরই জীবনযাপনের ধরন দেখে মনে হয় তারা কেউ কেউ পরিবার নিয়ে বসবাস করছে। তাদের কেউ হয়তো মুটে-মজুর, কেউ রিকশাচালক, কেউ-বা ফুটপাতের দোকানদার যাদের কোনো রকমে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। রাস্তা ও ফুটপাত এমন জনগোষ্ঠীর শুধুমাত্র রাতযাপনের জায়গা না, সেটাই যেন তার ঘরবাড়ি, আবাস। যদিও এই আবাস যে এতটুকুও নিরাপদ নয় তা সহজেই অনুমেয় এবং একান্ত নিরুপায় হয়েই বসবাস। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ইত্যাদির প্রকোপ যেন তার গা-সওয়া অধিকন্তু ঢাকা শহরের বিখ্যাত মশার উৎপাত সহ্য করা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার হুমকি এবং চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যে তারা যে কতটুকু অসহায় তা সহজেই অনুমেয়। কে নেই ফুটপাতে বৃদ্ধ-যুবক, নারী-পুরুষ, আরও আছে বেশ কিছু ভবিষ্যৎ না জানা কিশোর-কিশোরীরা। ফুটপাতে থাকা এই কিশোরদের প্রায়ই ছোট ছোট দলে অবস্থান ও ঘুরতে ফিরতে দেখা যায়। এই শিশু-কিশোররা যেমন পারিবারিক আবহ থেকে দূরে এবং একই সঙ্গে বঞ্চিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকে। অন্যদিকে সড়ক দ্বীপে মাদক গ্রহণরত অবস্থায় যুবক তো বটেই, কিশোর বয়সী মাদকাসক্তদের উপস্থিতিও বিচ্ছিন্ন ঘটনা না বরং স্থান-কাল-জায়গা বিশেষে যেন গা-সওয়া।
ঢাকা শহরের এই চিত্র অনেককেই আতঙ্কিত করবে সেটাই স্বাভাবিক। জনশুমারি ২০২২ অনুযায়ী ঢাকা শহরে বস্তিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ এবং ভাসমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। সরকারের বাজেট ডকুমেন্ট বলছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু। যদিও বাংলাদেশে পথশিশু নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, এই সংখ্যাটা কমবেশি এক মিলিয়ন এবং এর ৭৫ শতাংশই ঢাকায় বসবাস করে। কোনো কোনো সংগঠনের তথ্য মতে, ঢাকা শহরের পথশিশুদের প্রায় ৮৫ শতাংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাদকাসক্ত। এর মধ্য দিয়েই বোঝা যায় পরিস্থিতি কতটুকু আশঙ্কার!
আমরা এখন উন্নয়নের মহাসড়কে, নিঃসন্দেহে সময়ের হাত ধরে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থায় পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ওপরের চিত্র এটাই প্রমাণ করে উন্নয়নকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য এখনো অনেক কিছু বাকি আছে। এখনো উন্নয়নের প্রচেষ্টায় সমাজের একটা বড় অংশ প্রবেশ করতে পারছে না বা বর্তমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো তাদের যুক্ত করতে পারছে না। মানুষ ইচ্ছা করে ফুটপাতে থাকে না যতক্ষণ না পর্যন্ত সে বাধ্য হয়। আবার রাস্তায় মূল্যবান কৈশোরের অপচয় এবং তা মানবসম্পদ তৈরিতে বিনিয়োগ করতে না পারার পেছনে কারণসমূহ কী? কেনই-বা আমরা তাদের জন্য শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করতে পারছি না? কেনই-বা একজন কিশোর ধীরে ধীরে মাদকে আসক্ত হয়ে উঠছে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে ও নিজের সম্ভাবনাগুলো বিসর্জন দিচ্ছে। এখন এই প্রশ্নগুলো করার সময় এসেছে কারণ অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ নির্মাণ করা না গেলে সেই সমাজে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা কোনোটাই থাকার সম্ভাবনা নেই এবং সেটাই কোনো একটা জাতিকে অগ্রগতির রাস্তা থেকে টেনে ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট।
আমরা জানি, যে কোনো জনগোষ্ঠীর একটি নির্দিষ্ট অংশকে সহযোগিতা করতে হয়। সেই হারটা হতে পারে দশ শতাংশ বা তার আশপাশে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য, তবে হারটা অনুমেয়ভাবে বেশি। বিবিএস-এর তথ্য মতে, ২০১৮-১৯ সালে বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ছিল ২০.৫ শতাংশ এবং অতিদরিদ্রের হার ১০.৫ শতাংশ। সে হিসাবে নতুন জনশুমারির চূড়ান্ত ফলাফল অনুযায়ী দেশের প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষ অতিদরিদ্র। সংখ্যার হিসাবে অনেক বড়। তথাপি মাঝের কারোনার দুই বছরে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ভিত্তি ক্ষয়িষ্ণু করেছে, অনেক মানুষ তথাতথিত দারিদ্র্যসীমার নিচে নামতে বাধ্য হয়েছে, আবার করোনা-পরবর্তী সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধজনিত উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির হার বেশ কিছু মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিচ্ছে। ভাসমান মানুষের এই উপস্থিতি কি সেটারই ইঙ্গিত দিচ্ছে? সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদদের এ নিয়ে গবেষণা করার প্রয়োজন আছে। সরকারি তথ্য মতে সারা দেশে ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবার রয়েছে। অনুমেয় এই গৃহহীন পরিবারগুলোই শহরের ভাসমান জনগোষ্ঠীর প্রধানতম অংশ; পাশাপাশি নদীভাঙন, গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানের অভাব ও নানা ধরনের অনিশ্চয়তা তাদের এই অবস্থায় ঠেলে দিচ্ছে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এই অনিশ্চয়তাসমূহ দূর করা দরকার। মেগা প্রকল্পসমূহ বাদ দিলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে প্রশংসনীয় উদ্যোগ হচ্ছে ভূমিহীনদের জন্য গৃহনির্মাণ প্রকল্প। তথ্য মতে মুজিববর্ষ উপলক্ষে সরকার ইতিমধ্যে প্রায় ১ লাখ ৮৫ হাজার গৃহহীন পরিবারকে ঘর বিতরণ করেছে। এই ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং সাধারণ জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি করেছে। তবে ঘর বিতরণই হয়তো সবক্ষেত্রে সবধরনের প্রান্তিকতাকে দূর করতে পারছে না। তাই এই ধরনের উদ্যোগ যেমন আরও গ্রহণ করা দরকার এবং একইসঙ্গে আরও কী কী উপায়ে এই প্রান্তিকতাকে ধারাবাহিকভাবে দূর করা যায় তা বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সক্ষমতাই হচ্ছে অর্থনীতির প্রকৃত শক্তি, এই অংশকে যত বেশি কর্মক্ষম করা যায়, দক্ষ করা যায় ততই পরিবর্তনের ভিত মজবুত করা সম্ভব। চুইয়ে পরা অর্থনীতির আকার বেশি হলেও তা উন্নয়নের বুদবুদ তৈরি করতে পারে কিন্তু বিবেচনায় রাখতে হবে, বুদবুদ ক্ষণস্থায়ী এবং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হয় না। আমাদের দেশে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতা ও জীবনমান উন্নয়নে ২০২২-২৩ বাজেটে ১১৫টি কর্মসূচিকে সামাজিক সুরক্ষামূলক কার্যক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনেক সময় এই প্রকল্পগুলো গৎবাঁধা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে শুধুমাত্র সাহায্য গ্রহণকারী হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি কতটুকু ভাসমান হতে বাধ্য হওয়া জনগোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে পরিকল্পনা করা হয়েছে সেটাও একটা প্রশ্নের বিষয়। সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে শুধু সাহায্য গ্রহণকারী হিসেবে দেখলেই চলবে না, এর জন্য ঐ জনগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট পরিস্থিতি ও চাহিদা অনুধাবন করে তাদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। আর কর্মসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রে জীবন ধারণকে নিছক সাহায্য করা থেকে বেরিয়ে এসে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে অবদান রাখার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। আর এই বিষয়গুলোই রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে খতিয়ে দেখা দরকার। কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার যে মূলনীতি তা আমাদের দেশে শুধুমাত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্যই দরকার না, বরঞ্চ আরও বেশি দরকার সামাজিক স্থিতিশীলতা বাজায় রাখার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ টেকসই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
সাহিত্যিক ও প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ১৮৪২ সালের ১ জুন। তিনি ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র এবং রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ। ১৮৬২ সালে তিনি সস্ত্রীক লন্ডন যান এবং ১৮৬৪ সালে আইসিএস হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৮৬৫ সালে আহমেদাবাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। চাকরি থেকে অবসরগ্রহণের পর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৮৬৭ সালের ১২ এপ্রিল চৈত্রসংক্রান্তির দিন তিনি কলকাতার বেলগাছিয়ায় হিন্দু মেলার প্রবর্তন করেন। ১৯০০ ও ১৯০১ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯০৬ সালে আদি ব্রাহ্মসমাজের আচার্য ও পরে সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ৯টি বাংলা ও তিনটি ইংরেজি গ্রন্থ রচনা করেন। এ ছাড়া তার করা তিলকের ‘ভগবদ্গীতাভাষ্য’, ‘কালিদাসের মেঘদূত’ এবং তুকারামের ‘অভঙ্গে’র অনুবাদ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি কিছুকাল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ১৯২৩ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি মারা যান।
মসজিদ ও মাদ্রাসায় ইমামদের সচেতনতা বার্তা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
রাজধানীর মিরপুরে পিএসসি (পুলিশ স্টাফ কলেজ) কনভেনশন হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকার মসজিদের ইমামদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
মতবিনিময় সভায় ডিএনসিসি এলাকার এক হাজার ইমাম ও খতিব অংশগ্রহণ করেন।
উপস্থিত ইমামদের উদ্দেশে ডিএনসিসি মেয়র বলেন, ‘আমরা মসজিদে গিয়ে ওয়াক্ত নামাজের সময়, জুমার নামাজের সময় মনোযোগ দিয়ে আপনাদের বয়ান শুনি। আপনারাই পারেন মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে। আপনারাই পারেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। আপনারা মানুষকে জানাবেন বর্ষাকালে এডিস মশার প্রকোপ বেড়ে যায়। এডিস মশার কামড়ে জ্বর হয়, মৃত্যু হয়। জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশার লার্ভা জন্মায়। অতএব কোনোভাবে যেন পানি জমে না থাকে’।
মেয়র আরো বলেন, ‘এডিস মশা যখম কামড় দেবে, মশা কিন্তু চিনবে না কে মেয়র, কে কাউন্সিলর, কে ইমাম আর কে খতিব। এডিস মশা সবার জন্যই হুমকি। অতএব এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। একমাত্র সচেতনতা পারে ডেঙ্গু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখতে। যদিও সিটি করপোরেশন থেকে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি। কার্যকরী লার্ভিসাইডিং করছি, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছি। কিন্তু সবার সচেতনতা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়’।
এ সময় ডিএনসিসি মেয়র গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসা, মাটির পাত্র, খাবারের প্যাকেট, অব্যবহৃত কমোড এগুলো দেখিয়ে উপস্থিত ইমামদের সচেতন করেন।
মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান। প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে লাখো লাখো মসজিদের ইমাম ও মাদ্রাসার খতিব রয়েছেন। ইমাম ও খতিবরা মসজিদে মুসুল্লিদের ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে সচেতন করলে এই ভয়াবহ মশাবাহিত রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যেকোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির ও অন্যান্য সাধারণ মানুষের বক্তৃতা থেকে ইমামদের বক্তৃতা বেশি কার্যকর হবে। মসজিদে বিশেষ করে জুমার নামাজের সময় বয়ানে, খুতবায় মুসুল্লিরা ইমামগণের কথা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনেন। আপনাদের বার্তা মানুষের মনে গেথে থাকে।
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমানের সঞ্চালনায় ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, ডিএনসিসির প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহ. আমিরুল ইসলাম, প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর এস এম শরিফ-উল ইসলাম, কাউন্সিলর, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও ডিএনসিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
পিছিয়ে পড়া রিয়াল মাদ্রিদকে বহুবার ম্যাচে ফিরিয়ে এনেছেন করিম বেনজেমা। ক্লাবের হয়ে শেষ ম্যাচেও তাই করলেন। তার গোলে ড্র করে মৌসুম শেষ করেছে রিয়াল।
ঘরের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে রিয়াল নিজেদের শেষ ম্যাচ খেলতে নামে অ্যাথলেটিক ক্লাবের সঙ্গে। ম্যাচের প্রথমার্ধটা গোল শূন্য থেকে যায়। এই সমতা নিয়ে বিরতিতে যায় দুই দল।
তবে বিরতি থেকে ফিরে চার মিনিটের মাথায় গোল পেয়ে যায় অ্যাথলেটিক। ৪৯ মিনিটে একক প্রচেষ্টায় একাধিক খেলোয়াড়কে কাটিয়ে লক্ষ্য বরাবর শট নেন ওয়েন সানচেত। তবে তিবু কুর্তোয়া দারুণভাবে সেটা প্রতিহত করেন। কিন্তু তিনি উল্লাসটা খুব দ্রুত করে ফেলেন, বলের দিকে তার নজর ছিল না। আর সেই সুযোগটা নেন সানচেত। আদায় করে নেন গোল।
সেই গোল হজম করে হার দিয়ে মৌসুম শেষের শঙ্কায় পড়েছিল রিয়াল। তবে প্রতিবার যেমন শেষবেলায় ত্রাতা হতেন বেনজেমা, এবারও তাই হলেন। গোল শোধ করতে মরিয়া মাদ্রিদিয়ানরা সেটা আদায় করে ৭২ মিনিটে। তবে সেটা নিজেদের পায়ের জাদুর নৈপুণ্যে নয়। ডি বক্সের ভেতরে মিলিতাওকে ফাউল করেন জুরি বারচিকে। হলুদ কার্ডের সঙ্গে জরিমানা হিসেবে গুনেন পেনালটি। সেখান থেকে গোল আদায় করে নেন বেনজেমা।
গোলের পরে তাকে নিয়ে সতীর্থরা মেতে উঠেন উল্লাসে। কারণ এটাই যে ছিল তার শেষ ম্যাচ। বিদায়ী ম্যাচটা গোল করে রাঙালেন বেনজেমা।
রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে ১৪ বছরের সম্পর্কের ইতি টানছেন ২০২২'র ব্যালন ডি'অর জয়ী করিম বেনজেমা। ক্লাবের তরফ থেকে আজ এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, 'রিয়াল মাদ্রিদ এবং আমাদের অধিনায়ক করিম বেনজেমা এই ক্লাবের হয়ে তার অসাধারণ ও অবিস্মরণীয় ক্যারিয়ারের ইতি টানার জন্য রাজি হয়েছে।'
মেসি, সুয়ারেজ ও নেইমার একসঙ্গে তিন মৌসুম খেলেছেন বার্সেলোনায়। ২০১৪ সালে লিভারপুল থেকে সুয়ারেজ বার্সায় আসার পর এবং ২০১৭-তে নেইমার পিএসজিতে পাড়ি জমানো পর্যন্ত ‘এমএসএন’ এর রাজত্ব ছিল বার্সেলোনায়। সে সময়ে এই তিনজন মিলে ৩৬৪ গোল করার পাশাপাশি অ্যাসিস্ট করেছেন ১৭৩টি। এই ত্রয়ী বার্সাকে দুটি লা লিগা খেতাব, তিনটি কোপা দেল রে এবং একটি করে সুপারকোপা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, উয়েফা সুপার কাপ ও ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন।
সুয়ারেজ-নেইমার বার্সা ছেড়ে চলে গেলে মাঠের জুটি ভাঙলেও বন্ধুত্ব অটুট এমএসএনের। সেদিন মেসিকে মাঠে দর্শকরা দুয়ো ধনি দলে তার প্রতিবাদ করেছেন সুয়ারেজ নেইমার। মেসির পিএসজি ছাড়ার পর নেইমার বন্ধুর প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছেন, সুয়ারেজও জানিয়েছেন সাধুবাদ।
নেইমার ইনস্টাগ্রামে একটি বিদায় নোট পোস্ট করেছেন মেসিকে উদ্দেশ্য করে, 'ভাই.. আমরা যেমন ভেবেছিলাম তেমনটা হয়নি কিন্তু আমরা আমাদের সেরাটা দিয়েছিলাম। তোমার সাথে আরও ২ বছর ভাগ করে নিতে পারাটা আনন্দের ছিল। তোমার পরবর্তী। তোমার নতুন অধ্যায়ের জন্য শুভকামনা এবং সুখী হও। তোমাকে ভালোবাসি।'
উত্তরে মেসি বলেছেন, 'ধন্যবাদ নে! সব কিছুর পরও আমরা একসাথে খেলা উপভোগ করেছি এবং প্রতিদিন ভাগ করে নিয়েছি। তোমার জন্য শুভ কামনা। তুমি কিছু পাগলাটে, কিন্তু মানুষ তুমি দারুন।আর এটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি নেইমার।'
আর এই বার্তা পড়ে সুয়ারেজ লিখেছেন,' কি সুন্দর বার্তা মেসি। নেইমারের সাথে আপনাকে আবার একসাথে দেখে খুব ভালো লাগলো। একে অপরের প্রতি এই ভালবাসা, সর্বদা সবকিছুতে একে অপরকে সমর্থন করা আরও সুন্দর! আমি তোমাদের ভালোবাসি বন্ধুরা।'
তিনজনের এই বার্তা পড়ে একটা কথাই বলতে হয়, বন্ধুত্বের জয় হোক।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতিতে জোর করে হারানো হয়েছে।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভিন্ন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের যেকোনো আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটির ভোটে যে সংসদ সদস্য দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার তথ্য মিলবে তাকেই বাদ দেওয়া হবে। এ সিটি ভোটে হারের কারণ জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব একটি সংস্থাকে নির্ভুল তথ্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্বও পেতে পারেন আজমত, ওই সূত্র দাবি করে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
নানা অব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তির আওতায় এসেছে অনেক আগে। এরপর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজ অনেকটাই আটকে আছে। খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে চরম দুরবস্থার কথা। গবেষয়ণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু কাজ করার চেষ্টা করলেও কথায় কথায় তাদের ওপর নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। মানের উন্নয়ন না হলেও ঠিকই অধিদপ্তরে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সম্প্রতি এই গবেষণা করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেখানে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। করোনাকালে বন্ধের প্রভাবে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের গড় হার ৫১ শতাংশের বেশি, যা আগে ছিল ৬৮ শতাংশের মতো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও ক্ষতি বেড়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এ ধরনের গবেষণার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখেই তা করা হয়েছে। আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদন দু-এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা অন্তত এক বছরের জন্য রেমিডিয়াল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা দিন দিন পিছিয়ে পড়লেও সেদিকে তেমন একটা নজর নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। তারা ব্যস্ত আছে লাখ লাখ শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন নিয়ে। কেউ কথা বললেই তার ওপর নেমে আসছে শাস্তি। ফলে শিক্ষকরাও দিন দিন তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন; কোনো রকমে দিন পার করছেন।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্ভাবনী ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন রাজবাড়ী জেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিক নির্বাচিত হন। সাধারণত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থীদের পদক দেওয়া হয় একই অনুষ্ঠানে। কিন্তু করোনাকালে তাদের হাতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষক পদক তুলে দেওয়া যায়নি। গত ১২ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তাই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে স্বাভাবিকভাবে তারা দাবি তুলেছিলেন, দেরি হলেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তারা পদক নেবেন; যা তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে ঠিকই পদক নেন। তবে এর ৬৮ দিনের মাথায় এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবি তোলায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ঘটনায় জয়পুরহাটের হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ পদক নিতে ১১ মার্চ ঢাকা এসেছিল। ওই শিক্ষকও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের কাউকে শোকজ করা হয়নি; যা বিধিবহির্ভূত বলছেন শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেদিকেই আমরা যাব।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক নেওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে সেরা প্রাপ্তি। এ জন্য শিক্ষকদের দাবি থাকতেই পারে, প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। শিক্ষকদের যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। এর প্রভাব অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বন্ধ থাকা প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখতে কিছু শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন; যাতে অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনাসহ নানা কাজ করা হয়। এতে প্রতিটি ফেসবুক গ্রুপে লাখ থেকে হাজারো শিক্ষক যুক্ত হয়েছেন। এখনো সেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সেই গ্রুপগুলোকেই এখন শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে যুক্ত থাকা অনেক শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাকেই দেওয়া হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ)। সরকার যেখানে শিক্ষকদের ডিজিটালি আপডেট হওয়ার কথা বলছে, সেখানে প্রায় অনেকটাই উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে আসন গেড়ে বসেছেন কিছু কর্মকর্তা। অনেকেই ৬ থেকে ১২ বছর ধরে একই দপ্তরে চাকরি করছেন। তাদের যে দায়িত্বই থাক না কেন যত লাভজনক কাজ আছে, সেগুলোতেই তারা হাত দিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে আনলে তাদের সরে যেতে হবে, এ জন্য তারা নানাভাবে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিয়ে মাঠপর্যায়ে শাস্তি দিয়ে সবাইকে ভীত করে তুলছেন। এতে পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত মার্চ-এপ্রিলে অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। যদিও নিয়ম ছিল, অনলাইনে নির্দিষ্ট মানদন্ড পূরণ ছাড়া কেউ বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু তা মানেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিয়ম ভেঙে কয়েক শো শিক্ষকের বদলির আদেশ জারি করা হয়। আর এই বদলি-পদায়নে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের; যা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আবার অনেক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলিতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। কাউকে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও অনেক দূরে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন।
জানা যায়, চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। আর আগামী বছর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সাল থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। কিন্তু তা পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই অধিদপ্তরের। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আসলে এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছে বা এ জন্য আর কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তেমন নজর নেই।
এ ছাড়া এখনো প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেডে। দুই ধরনের প্রায় চার লাখ শিক্ষকই ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারাও দীর্ঘদিন ধরে নবম গ্রেডের দাবি করছেন। আর মাঠে কাজ করা এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদোন্নতিও নেই বললেই চলে। কিন্তু এগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের; যা প্রাথমিকের মান উন্নীতের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনো মফস্বলে বা দুর্গম অঞ্চলের অনেক স্কুলেই এক-দুজন শিক্ষক। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ তিন-চার বছর ধরে শূন্য। শিক্ষক না থাকলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের একটু আলাদা যতœ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলোও হচ্ছে না। শিক্ষকরাও তাদের বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। সব মিলিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছি না।’
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।