
কাতার বিশ্বকাপ ২০২২ এর ফাইনালে মুখোমুখি ইউরোপের ফ্রান্স ও লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনা। রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ, ক্ষণে ক্ষণে বিজয়ের কাঁটা ঘুরে এদিক ওদিক। শেষ পর্যন্ত জয় উঠেছে আর্জেন্টিনার ঘরে। ম্যাচের পেনাল্টি, অফসাইড হওয়া না হওয়া নিয়ে নানা বিতর্ক হলেও শেষ পর্যন্ত ট্রফি চলে গেছে লাতিনে।
ফ্রান্স একটি ইউরোপের দেশ। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা লাতিন আমেরিকার। সাধারণ চিন্তায় লাতিনে মিশ্র বর্ণের ও ইউরোপে শে^তাঙ্গ মানুষের বসবাস বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু বিশ্বকাপ ফাইনালে দেখা গেল উল্টো চিত্র। ফ্রান্স টিমে খেলেছে কৃষ্ণ ও মিশ্র বর্ণের খেলোয়াড় অন্যদিকে আর্জেন্টিনা টিমে খেলেছে শে্বতাঙ্গ খেলোয়াড়রা। বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরে প্রতিটি টিম তাদের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে। দুই দলের টিম নিয়ে পূর্ব ধারণা নেই এমন কেউ আর্জেন্টিনার টিমকে ইউরোপীয় টিম ও ফ্রান্সের টিমকে আফ্রিকার টিম ভেবে ভুল করতে পারে। আলোচনাটা খেলোয়াডের গায়ের রং নিয়ে হলেও এটা মোটেও বর্ণবাদী আলোচনা নয়। বরং এখানে যে উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের আসল চিত্র লুকিয়ে আছে সেটাই দেখার চেষ্টা।
বিশ্বজুড়ে যখন দাস ব্যবসার রমরমা চলছিল তখন লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনাতেও পৌঁওছছিল দাস বণিকদের জাহাজ। Africana, the Encyclopaedia of the African and African American Experience-এ জয় এলিহান্দ্রো লিখেছেন, ১৭০০ সালের দিকে আর্জেন্টিনার জনসংখ্যার অর্ধেক এবং রাজধানীর ৪০-৪২ ভাগই ছিল কৃষ্ণাঙ্গ অথবা মিশ্র বর্ণের। তারা নানারকম বৈষম্যের মধ্যে বসবাস করত। ১৮১২ সালে আর্জেন্টিনার বিখ্যাত রাজনীতিবিদ বেরনার্ডুকে দেশের এক্সিকিউটিভ বডি থেকে বাদ দেওয়া হয় কারণ তার মা ছিল আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। আর্জেন্টিনায় যেখানে শে^তাঙ্গ বাচ্চারা ৪ বছরের মাধ্যমিক শিক্ষা পেত কৃষ্ণাঙ্গরা পেত ২ বছর। ১৮৫৩ সালের আগে কোনো কৃষ্ণাঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অনুমতি ছিল না।
আজ লাতিন আমেরিকাতে কৃষ্ণাঙ্গ ও মিশ্র বর্ণের আধিপত্য থাকলেও আর্জেন্টিনায় সাদারাই একচ্ছত্র! আর্জেন্টিনায় কৃষ্ণাঙ্গদের নিধন করা হয় মূলত ১৮৬৫-১৮৭০ সালের প্যারাগুয়ে যুদ্ধে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে মিত্র শক্তি প্যারাগুয়ের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে আর্জেন্টিনার কৃষ্ণাঙ্গদের পরিকল্পিতভাবে যোদ্ধা ও মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। আর্জেন্টিনার সরকার যুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ ও মিশ্র বর্ণের লোকদের বাছাই করে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করেছিল। এই পরিকল্পনার মূলহোতা ছিলেন দেশটির সপ্তম রাষ্ট্রপতি ডমিঙ্গো ফিস্তনো সারমিয়েন্তো। ১৮৬৫ এর দিকেই আর্জেন্টিনায় দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হয়। ফলে একদিকে আর্জেন্টনায় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের আসা বন্ধ হয় অন্যদিকে যুদ্ধে তারা হাজারে হাজারে মারা পড়ে। দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হওয়া ও পাঁচ বছরের যুদ্ধে অগণিত কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির মৃত্যুর পরও কিছু কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি বেঁচে ছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষে আর্জেন্টিনা ‘বিশুদ্ধ শে^তাঙ্গ জাতি’ তৈরির অভিযানে নামে। হিটলার যেভাবে ইহুদিমুক্ত জার্মানি গড়তে চেয়েছিলেন, রাখাইনরা যেভাবে রোহিঙ্গামুক্ত আরাকান চায় ঠিক তেমনি কৃষ্ণাঙ্গমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে দেশটিতে কৃষ্ণাঙ্গদের জঙ্গলে বসতি গড়তে বাধ্য করা হয়। পরে এসব বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে কলেরা ও পীত রোগে অসংখ্য কৃষ্ণাঙ্গ মৃত্যুবরণ করে। বর্তমানে বিরল হলেও কিছু মিশ্রবর্ণের আফ্রো-আর্জেন্টাইন সেখানে বাস করে। তারা মূলত যুদ্ধে পুরুষদের মৃত্যুর পর জীবিত থাকা কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের গর্ভে জন্ম নেওয়া শে্বতাঙ্গ ঔরসজাত প্রজন্ম। ফলে লাতিন আমেরিকার অন্যান্য টিমে কৃষ্ণাঙ্গ বা মিশ্রবর্ণের খেলোয়াড় দেখা গেলেও আর্জেন্টিনার দলটি একেবারেই ‘ইউরোপীয় ধবধবে শ্বেতবর্ণের টিম’। অবশ্য বোঝাই যাচ্ছে যে- আজ থেকে দেড়শ বছর আগেই বিশ্বে একটি বিশুদ্ধ শ্বেতাঙ্গ জাতি হিসেবে পরিচিতি পেতে চেয়েছিল আর্জেন্টিনা।
২০১৮ এর বিশ্বকাপ ফাইনালের আরেক রোমাঞ্চকর ম্যাচে ক্রোয়েশিয়াকে ৪-২ গোলে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল ফ্রান্স। সে ম্যাচে দুর্দান্ত একটি গোল করে ফ্রান্সের জয় নিশ্চিত করেছেন কিলিয়ন এমবাপ্পে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে খেলতে এসে সে বিশ্বকাপে চারটি গোল করে বিশ্বের নজর কেড়েছিলেন এমবাপ্পে। ২০২২ এর বিশ্বকাপে ফ্রান্সের জয়ের জন্য কান্ডারি হিসেবে শেষ পর্যন্ত লড়েছিলেন এই তরুণ। এবার বিশ্বকাপ শিরোপা জিততে না পারলেও হাতে উঠেছে মর্যাদাপূর্ণ গোল্ডেন বুট। কিন্তু এমবাপ্পে মেজরিটি ফ্রেঞ্চদের মতো শ্বেতবর্ণের নন। মিশ্রবর্ণের এই তরুণের বাবা উইলফ্রিদ একজন খ্রিস্টান ও এসেছিলেন ক্যামেরুন থেকে। আর মা হলেন আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত ফেজা লামারি, ধর্মে মুসলিম ও পেশায় একজন হ্যান্ডবল খেলোয়াড়। ফ্রান্সের আরেকজন তারকা খেলোয়াড় পল লাবিল পগবাও একজন মুসলিম কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড। পল পগবার জন্ম ফ্রান্সে হলেও তার শেকড় গিনিতে। গিনির মুসলিম দম্পতির সন্তান পল পগবা। এমনকি তার অপর দুই যমজ ভাই ম্যাথিয়াস পগবা ও ফ্লোরেনটিন পগবা গিনি জাতীয় দলের হয়ে খেলেন।
কিন্তু কীভাবে আফ্রিকান এসব রতœ হয়ে গেলেন ফ্রেঞ্চ জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধি! এটাই উপনিবেশবাদের চক্র। টেক দ্য বেস্ট অ্যান্ড লিভ দ্য রেস্ট। দুর্দান্ত খেলে বলে এমবাপ্পে ও পল পগবা ফ্রেঞ্চ। কিন্তু একই ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম এসব পূর্বপরিচয় নিয়ে ফ্রেঞ্চ হওয়া অন্যান্য তরুণের জীবন কি ফ্রান্সে একই! ফ্রান্স কি অন্যদের নিয়ে যেভাবে গর্ব করে সেভাবেই কি এমবাপ্পে ও পল পগবাকে নিয়ে করে? উত্তর হলো, না।
ফ্রান্সে জন্ম নেওয়া আফ্রিকানদের নানা ধরনের বৈষম্যের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং তাদের ফ্রেঞ্চ হিসেবে গণ্য করা হয় না। ফ্রান্সে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ মুসলিম হলেও জেলখানাতে ৫০ শতাংশের অধিক কয়েদি আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মুসলিম, যারা এমবাপ্পে ও পল পগবার জাতভাই। ফলে ফ্রেঞ্চ একজন সাধারণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গের জীবন মোটেও ফ্রেঞ্চ জাতীয়তাবাদের গর্ব এমবাপ্পে ও পল পগবার মতো না। তাদের জীবন ওই জেলখানায় বন্দি ৫০ শতাংশ কয়েদির মতো।
প্রতি বছর ফ্রান্স আফ্রিকা থেকে আসা অন্তত ১০ হাজার আশ্রয়প্রার্থীকে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু এমবাপ্পে ও পল পগবার মতো রতœরা হয়ে ওঠেন ফ্রেঞ্চ জাতীয়তাবাদের পরিচায়ক। এভাবে বছরের পর বছর ধরে আফ্রিকার রতœ দখল করে আজকের ফ্রান্সের নির্মাণ। ঘোষণা দিয়ে আফ্রিকানদের ‘সভ্য’ করে তোলার প্রত্যয়ে আফ্রিকার ২৪টা দেশে ফ্রান্সের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ফ্রান্সের দখল করা ২৪ দেশের মধ্যে ১৪ দেশে এখনো চলছে ফ্রান্সের শোষণ। টোগো, বেনিন, বুরকিনা ফাসো, গিনি বিসাউ, সেনেগাল, আইভরিকোস্ট, মালি, নাইজার, চাদ, ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো (ব্রাজাভিলা), নিরক্ষীয় গিনি ও গ্যাবনসহ ১৪ দেশকে বলা হয়ে থাকে ফ্রান্সফ্রিকা বা ফ্রাংক জোন। কারণ এই ১৪টি দেশকে ব্যবহার করতে হয় ফ্রান্স নিয়ন্ত্রিত মুদ্রা ফ্রাংক।
এসব দেশের জাতীয় আয়ের ৬৫ শতাংশই এখনো জমা রাখতে হয় ফ্রান্সে। আর তাদের আয়ের প্রায় ২০ শতাংশই ব্যয় করতে হয় ফ্রান্সের নানা দেনা মেটাতে। দেশ চালাতে অর্থের প্রয়োজন হলে তাদের অর্থই ফ্রান্সের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। এই চক্র থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আফ্রিকায় ফ্রান্সফ্রিকা নামে একটি নেটওয়ার্ক আছে। এই নেটওয়ার্কের কাজ হচ্ছে ফ্রান্সের চক্র থেকে বের হতে চাওয়া রাজনীতিবিদদের ক্যু, রাজনৈতিক হত্যাকা- ও কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে দমিয়ে রাখা। সিলভানাস অলিম্পিতে ১৯৬৩ সালে টোগোতে নিজস্ব মুদ্রা চালুর লক্ষ্যে জাতীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু তার পরের দিন ফ্রান্সের প্রশিক্ষিত স্বদেশিরা তাকে হত্যা করে। ১৯৬৩ সালের পর থেকে এই পর্যন্ত ফ্রান্সফ্রিকার ১৪ দেশের ২২ জন সরকারপ্রধান হত্যার শিকার হন। যারা প্রত্যেকে নিজেদের জাতীয়তাবাদ নিয়ে সচেতন হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন।
এসব দেশে অন্য দেশের বিনিয়োগের সুযোগও নেই। চীন-ঘেঁষা আইভরি কোস্টের প্রেসিডেন্ট লঁরা বেগবো একটি সেতু গড়তে চেয়েছিলেন। এই সেতু নির্মাণে ফরাসি একটি সংস্থা মার্কিন ডলারে একটি দাম হাঁকে। কিন্তু তার অর্ধেক দাম হাঁকে চীনা প্রতিষ্ঠান। তারা অর্থ পরিশোধের সুযোগ দিয়েছিল আইভরি কোস্টের প্রাকৃতিক সম্পদ কোকো বিন দিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লঁরা বেগবোকেই ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়।
গৃহযুদ্ধ চলছিল মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে। ফ্রান্সের অনুগত বনাম বিরোধী দলের মধ্যে। রাজধানী বাঙগুই বিমানবন্দরে মাত্র ৩০০ সৈন্য পাঠিয়ে অনুগতদের ক্ষমতা দখল করে দেয় ফ্রান্স। অন্যতম সম্পদশালী দেশ মালি। মালির ইউরেনিয়ামের পুরোটাই যায় ফ্রান্সে। চলতি দশকের শুরুতে শ’তিনেক মাফিয়া ও বিদ্রোহীদের হাত থেকে সোনার খনি রক্ষার কথা বলে ৪ হাজার ফরাসি সৈন্য ঘাঁটি গেড়ে বসেছে মালিতে। এছাড়া জিবুতি, গ্যাবন, সেনেগালেও সামরিক ঘাঁটি রয়েছে ফ্রান্সের। ২০১১ সালের কথিত আরব বসন্তের প্রাক্কালে লিবিয়ার গাদ্দাফির বিরোধীদের প্রথম সমর্থন দেয় ফ্রান্স। তার অন্যতম কারণ গাদ্দাফির আপসহীন মানসিকতা ও আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের নেতৃত্ব দেওয়া যা ফ্রান্সের উপনিবেশের ভিত কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।
ফ্রান্সের প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের জোগান দেওয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারভাগের তিনভাগই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এসব কেন্দ্রের কাঁচামাল ইউরেনিয়ামের বড় জোগানদাতা গ্যাবন, মালিসহ আফ্রিকার দেশগুলো। তাই গ্যাবনে দশকের পর দশক ধরে ফ্রান্স বসিয়ে রেখেছে তার পুতুল সরকার। আফ্রিকার ইউরেনিয়াম দিয়ে যেভাবে প্যারিস ঝলমল করছে তেমনি আফ্রিকান বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়দের পায়ের জাদুতে ট্রফি যায় ফ্রান্সের ঘরে। ঔপনিবেশিকতার শেষ হলো আর কোথায়!
লেখক: কলামিস্ট
ঔপনিবেশিক যুগ শুরুর বহু আগে থেকেই ভারতবর্ষ সম্পর্কে ইউরোপের কৌতূহল আর প্রধান বিস্ময় ছিল তার জাদু-মন্ত্র আর সাধু-সন্ন্যাসীর বিষয়ে। ইংরজি সাহিত্যে এ বিষয়ে নানা আখ্যান গড়ে উঠেছে। ভাগ্য, তন্দ্র, টোটকা, বশীকরণ, জাদুটোনা, ব্ল্যাক ম্যাজিক বা কালাজাদু নিয়ে তারা গবেষণাও করেছে। ফকির, দরবেশ, সাধু-সন্ন্যাসীদের মনও বুঝতে চেয়েছে। বঙ্গ-ভারতীয়দের মানস গঠন সম্পর্কে চেনাশোনা, জানা-বোঝাটা দরকার ছিল শাসন-শোষণের জন্য। ‘মাঙ্কিজ প’ বা ‘বানের থাবা’ নামের ইংরেজি গল্পে গা ছমছম করা চিত্তশিহরণ জাগানো আখ্যান পাওয়া যায়। ভারতবর্ষীয়দের জাদু-মন্ত্র বিশ্বাসের এ এক অপূর্ব গল্প। জনৈক ভারতীয় জাদুকরের কাছ থেকে পাওয়া মন্ত্রপূত বানরের থাবার শক্তিতে দুর্ঘটনায় নিহত পুত্রহারা এক ইংরেজ মহিলার মৃতসন্তানের পুনর্জীবন লাভ করে ফেরার লোমহর্ষক ঘটনা রয়েছে এই গল্পে।
এই বশীকরণ আর কালাজাদুই যে উপনিবেশ শাসনের আসল শক্তি, ইংরেজরা তা বুঝেছিল। যখন বুঝতে পারে আর শাসন করা যাবে না তখনই ধর্ম, ঈশ্বর, দেবদেবীর সহায়তায় দেশ ভেঙে যায়। হিন্দু-মুসলমান লাখো-কোটি মানুষ হারায় তাদের জন্মভূমি। হারায় আইডেনটিটি। উদ্বাস্তু হয়। আজ ৭০ বছর পর আবার তারা সেই ব্ল্যাক ম্যাজিকে পতিত। বশীকরণ বা কালাজাদু রাজনীতিতে কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা ইংরেজরা শিখিয়ে দিয়ে যায় শাসিত ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-ইয়াঙ্গুন আর শ্রীলঙ্কাকে। বার্মা বা ইয়াঙ্গুনের রোহিঙ্গা, শ্রীলঙ্কার তামিল, ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের জাতিগত আর ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা টের পাচ্ছে কালাজাদু কী। কেবল তারাই নয়, ওইসব দেশের জনগণও আজ আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় মহাবশীকরণের শিকার। এতো গেল রাজনীতির কথা, সমাজের ভেতরটা কেমন?
আশ্চর্যের বিষয় এই, আধুনিক বিজ্ঞান আর যুক্তিবাদ-বুদ্ধিবাদের উৎকর্ষের এই যুগে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস আর জাদুটোনার প্রভাব। পত্রপত্রিকা আর বিভিন্ন চ্যানেলে বিজ্ঞানের নামে এদের উপদ্রব এতই বেড়ে গেছে যে, মনে হবে অপশক্তির ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে মানুষের সমাজে। মানুষ সভ্যতার আলো থেকে দ্রুত অন্ধকারে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে। কেন এমন হলো? মানুষের এমন পশ্চাৎপদতার রহস্য কী? আসলে আধুনিক মানুষ, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের ভরসা ছিল সমাজ বদল বা সমাজতন্ত্র। সারা বিশে^ সমাজতন্ত্রের পতন আর অবক্ষয়ের পর সভ্যতার আর এগোবার সুযোগ হলো না। চরম হতাশায় ডুবে যাচ্ছে মানুষ। ব্যক্তিমানুষের জাগতিক দুঃখ, কষ্ট আর দুর্ভোগ এতই অপ্রতিরোধ্য যে, ব্যর্থ মানুষ হতাশার অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। চরম হতাশায় পতিত মানুষ বাধ্য হচ্ছে অন্ধবিশ্বাসে ডুবে যেতে। ঘরে-বাইরে কোথাও শান্তি নেই মানুষের। কোথাও তার ইচ্ছা পূরণ হচ্ছে না। তাই ঈশ্বর, ধর্ম, তন্ত্র-মন্ত্র জাদুটোনা বশীকরণে বিশ্বাসী হয়ে উঠছে। মানুষের এই দুর্বলতার খবরটা জানে প্রতারকরা। অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত মানুষ হতাশ হয়ে তাদের শিকারে পরিণত হচ্ছে। ওরা আসছে ছদ্মবেশে। পীরবাবা, সাধুবাবা, মহাতান্ত্রিক, কামাক্ষ্যা সিদ্ধ, তান্ত্রিক মহারাজ, দৈবশক্তির সাধক ইত্যাদি পদবি ধারণ করে তারা। আশ্চর্য এই, অসংখ্য বেকার তরুণী বা অর্থলোভী নারী পর্যন্ত এই কালাজাদু পেশায় নেমে পড়েছে। এদের পদবি মহাসাধিকা, মাতা কামাক্ষ্যানী, মা-খনা, জ্যোতিষী, তন্দ্রসাধিকা, প্রেতাত্মা বশীকরণ সিদ্ধা ইত্যাদি। সুন্দরী, যুবতী হলে তো কথাই নেই। সমস্যা সামধানের জন্য ছুটে যাচ্ছে মানুষ। অভিজ্ঞরা বলছে ওরা নাকি সাক্ষাৎ স্বর্গের দেবি।
কোন কোন সমস্যার সমাধান দেন এসব তান্ত্রিকরা? ব্যবসায় সাফল্য, চাকরি, বিদেশ ভ্রমণ, প্রেমে সফফতা, মামলায় জেতা, সন্তানের শিক্ষায় অমনোযোগিতা, স্ত্রী বা স্বামীকে আজ্ঞাবাহ বানানো ইত্যাদি। এ ধরনের তান্ত্রিক বা বশীকরণ বিদ্যার ট্রেনিং সেন্টারও আছে। কীভাবে মানুষকে হিপ্টোনাইজ করতে হয়, কীভাবে কোন পোশাকে শ্রেণি হিসেবে মানুষকে বশে আনতে হয় সেসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যেমন ভূতে বা জিনে পাওয়া নারীদের বেলায় প্রথমে তন্ত্র-মন্ত্রী ঝাড়ফুঁক। তাতে কাজ না হলে ঝাঁটা দিয়ে পেটানো। এর ফলে ভূত পালায় ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে নেয় রোগীর প্রাণ।
এই যে তন্ত্র-মন্ত্র-বশীকরণ রহস্য তার অন্ধকারেই লুকিয়ে রয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতির শেকড়-বাকড়। তুকতাক, বশীকরণে জনগণকে নির্জীব করে রাখো, কাজ না হলে বাহুবল প্রদর্শন করো, হামলা-মামলায় ফেলে দাও। তাতেই মানুষের মাথা থেকে গণতন্ত্র, সাম্য, নাগরিক অধিকার, ন্যায়বিচার আর আইনের শাসনের দাবি-দাওয়ার ভূত পালিয়ে যাবে। শাসকশ্রেণি চিরকালই চায় আনুগত্য। বশ মানা। বাঘের বাচ্চাকে খাঁচায় পুষে মাংসের বদলে ঘাস খাওয়া শিক্ষা দিলে সে ভুলে যায় পশু শিকার, খাদ্যপ্রণালীও ভুলে যায়। বাঘশিশু বড় হয়ে ভীতু ছাগল হয়ে যায়। শাসকরা তাই চায়। কালাজাদু দিয়ে মানুষকে বশে রাখে তারা, ভোট আদায় করে। রাজা-রানীর নামে জয়ধ্বনি দেয়।
মনোবিজ্ঞানীরা দেখেছেন মানুষের মধ্যে দ্বৈতসত্তা বিরাজ করে। একটি তান্ত্রিক সত্তা, অন্যটি বিজ্ঞান সত্তা। অব্যাহত বিজ্ঞান বা সঠিক জিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে বিকশিত হলে মানুষ সংস্কারমুক্ত হতে পারে। হতে পারে যুক্তিবাদী। এর ফলে তার বিপরীত সত্তা, ওই যে তান্ত্রিক সত্তার মৃত্যু ঘটে। সে হয়ে ওঠে প্রকৃত মানুষ। শাসকের প্রতি অন্ধ আনুগত্য, অপরাজনীতির প্রতি বিশ্বাস, ভয়-ভীতিকে জয় করে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তন্ত্র-মন্ত্রের জগৎ এমন প্রতিবাদী মানুষ চায় না। এমন মানুষ তার প্রতিপক্ষ।
বিভিন্ন কারণে শরীর দুর্বল বা প্রতিরোধক্ষমতা কমে গেলে নানারকম রোগ শরীরে প্রবেশ করে। হতাশাও এমনি একটি মনোরোগ। যারা হতাশায় আক্রান্ত হয় তারা বিজ্ঞানমনস্কতা বা যুক্তিবাদ হারায়। হয়ে ওঠে ভাগ্য বিশ্বাসী। তাদের মন আচ্ছন্ন করে ফেলে অন্ধ বিশ্বাস আর জাদুটোনার রহস্যময় দুনিয়া। আজও আমি ভুলিনি সেই দৃশ্য। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে আমি ঢাকার জগন্নাথ কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ছিলাম। হঠাৎ একদিন দেখতে পাই আমাদের ইংরেজির একজন প্রিয় শিক্ষক ভিক্টোরিয়া পার্কের পশ্চিম পাশে রাস্তার ওপর হাত পেতে বসে আছেন। সামনে বসে টিয়ে পাখিওয়ালা ভাগ্যগণক। বিস্মিত এবং কৌতূহলী হয়েছিলাম। আধুনিক ইংরেজি ভাষার অধ্যাপকের এই দশা! সহপাঠী বন্ধু বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের একজন খ্যাতিমান লেখক বুলবুল চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করায় বুলবুল কারণটা ব্যাখ্যা করেছিল। বড় কষ্ট পেয়েছিলাম মনে। সেই আমাদের শিক্ষক পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক হয়েছিলেন। দীর্ঘ ৪০/৪৫ বছর পর প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ ঘটে তার বাড়ির লনে। শায়িত ছিলেন তিনি। খানিক বাদে জানাজা হবে। চোখে আমার জল নামে। পুরাতন স্মৃতি বুকের ভেতর আগুন হয়ে জ¦লে। সেদিন আমার সেই অন্তিম দর্শনের সঙ্গী ছিলেন অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তাই বলি হতাশা আর আত্মদ্বন্দ্ব একজন আধুনিক মানুষকেও পেছনে ঠেলে দিতে পারে। বিজ্ঞানবাদীকেও অতি প্রাকৃতবাদী করে তুলতে পারে।
এই জাদুমন্ত্র কিংবা বশীকরণ তন্ত্র আসলে ছদ্মবেশী আধিপত্যবাদ। ব্যক্তির ওপর ব্যক্তির আধিপত্য, রাষ্ট্রের ওপর রাষ্ট্রের আধিপত্য। অসহায় আদিম সমাজ জটিল জীবনের ভেতর দুঃখ, কষ্ট, ক্ষুধা ইত্যাদি, ব্যাধি আর খেয়ালি প্রকৃতির হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্যই এই রহস্যময় এক তান্ত্রিক জগতের কল্পনা করেছিল। বৌদ্ধতান্ত্রিক সমাজ আর হিন্দুতান্ত্রিক সমাজ পরবর্তী সময়ে এর সাক্ষ্য বহন করে। কেবল প্রাচীন ভারতবর্ষই নয়, প্রচলিত ধর্মগুলোর উদ্ভবের আগে সারা বিশে^র মানব সমাজটাই ছিল বশীকরণ তন্ত্রের দাস। ওই যে ভূকম্পন আর প্রবল ঝড়ের ধ্বংসলীলা থেকে প্রাণ রক্ষার জন্য আদিম সমাজের পশুবলি বা নরবলি দেওয়ার হিংস্র বাসনা, তার পেছনে রয়েছে তন্ত্রশক্তির মিথ্যে সাধনা।
সারা বিশে্ব সমাজতন্ত্র পতনের পর বিশে^র দেশে দেশে কবর থেকে প্রাচীন মৃত জাদুবিদ্যা, তন্ত্র, বশীকরণ, জাদুটোনার পুনরুত্থান ঘটেছে। বিজ্ঞান যত এগোচ্ছে, পাশাপাশি অধিজ্ঞান বা অতিপ্রাকৃতবাদও ছুটে চলেছে। অতি আধুনিক এই সমাজে আজকের মানুষ অতীতের তুলনায় বহুগুণ অধিক অসুখী এবং হতাশায় আক্রান্ত। এত নিঃসঙ্গ আগে কখনো ছিল না মানুষ। জনসংখ্যা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষও মানুষ থেকে ততই নিঃসঙ্গ হচ্ছে। একাকিত্বের এ যেন মহামারী। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে সর্বগ্রাসী ধনতন্ত্র। প্রতিটি মানুষকে জটিল যন্ত্রে পরিণত করছে। মানুষের মনের ভেতর যে মহাদ্বন্দ্ব আর মহাসংকট চলছে তা আজকের মনোবিজ্ঞানীদেরও বিস্মিত করছে। মনোবিজ্ঞানের প্রাচীন সূত্রগুলো আধুনিক মানুষের মনের এই সংকটের ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ। নিত্যনতুন অনুষঙ্গ তৈরি হচ্ছে আধুনিক মানুষের মনের ভেতর। বিস্ময়কর, অকল্পনীয় শিহরণ জাগানো আচরণ করছে আধুনিক মানুষ। অপরাধ বিজ্ঞানও তাজ্জব! এই যে জটিল মানুষ, তাকে সহজেই তান্ত্রিক বশীকরণের জগতে ঠেলে ফেলে দেওয়া যায়। উদ্ধারের সহজ পথ মেলে না।
ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা আজকের এই জটিল মানব সমাজকে মুক্তি বা শান্তি এতে দিতে পারবে না। অসুস্থ এই সমাজকে ভেঙে দিতে হবে। আজকের সমাজে এই যে তুকতাক বশীকরণ দ্রুত বিস্তার লাভ করছে তার পেছনের ইন্ধনদাতা এই ধনতন্ত্র। ধনতন্ত্র সংকটে পতিত বলেই জনগণের মনকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে ঈশ্বরের পাশাপাশি শয়তানকেও ব্যবহার করছে। বাস্তব জগৎ ভুলিয়ে দাও মানুষকে, ডুবিয়ে দাও অতিপ্রাকৃত জগতে, এই হচ্ছে ধূর্ত ধনতন্ত্র।
বিজ্ঞানীর দশ আঙুলে দশটি আংটি। গ্রহরতœ বিচার করে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক আঙুলে ধারণ করেন বিচিত্র পাথর বসানো রিং। মানুষ তখনই অবাক হয় যখন দেখে কমিউনিস্ট বিপ্লবে বিশ্বাসী রাজনৈতিক বামকর্মীও রোগ সারানোর জন্য তাবিজ ধারণ করেন। বিশ্বাসটা দ্বান্দ্বিক, যদি লেগে যায়? পুঁজিবাদী সমাজ এভাবেই একজন বাম রাজনৈতিক কর্মীর বিশ্বাসে দ্বন্দ্ব এবং ধন্দ তৈরি করে। এখানেই পুঁজিবাদী দর্শনের শক্তি। সে মানুষকে ভেঙে দেয়, দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি করে তার চিন্তা এবং বিশ্বাসের জগতে।
ব্যক্তিমানুষের কোনো সমস্যাই জাদুটোনা-বশীকরণ তন্ত্র-মন্ত্র মীমাংসা করতে পারে না। পুঁথিগত শিক্ষা বা দেশি-বিদেশি বড় বড় ডিগ্রি মানুষকে তার অন্ধ বিশ্বাস থেকে সরাতে পারে না। যুক্তিবাদ, বুদ্ধিবাদ আর বিজ্ঞানমনস্কতাই মানুষের অন্ধ বিশ্বাস দূর করতে পারে। বিজ্ঞানমনস্ক হতে গেলে বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির কোনো প্রয়োজন নেই। সে সব ডিগ্রি বরং সাধারণ মানুষ থেকে ডিগ্রিধারীকে দূরেই ঠেলে দেয়। অহংবোধ-উন্নাসিকতা তৈরি করে। মানুষকে আত্মস্বাধীন মানুষ হতে হবে। তবেই নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব বশীকরণ মহিমার নামের অন্ধকার জগৎ থেকে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক
প্রযুক্তির ছোঁয়া এখন আর শুধু উন্নত দেশগুলোতে সীমাবদ্ধ নেই। তুলনামূলকভাবে কম উন্নত দেশগুলোতেও উন্নয়নের মাত্রায় যোগ করেছে ভিন্নতা। প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের জীবনকে সহজ করে দেয় ঠিকই, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রযুক্তির ব্যবহারে দিন দিন কমে যাচ্ছে কর্মসংস্থান।
বইয়ের কথাই ধরা যাক। বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল, আছে এবং থাকবে। কিন্তু দিন দিন বই পড়ার জন্য আমাজন কিন্ডল, ট্যাবলেট বা ইলেক্ট্রনিক বুক রিডার চাহিদা বেড়েই চলেছে। গড়ে উঠছে গুগল বুকস-এর মতো অনলাইন লাইব্রেরি। এসব লাইব্রেরিতে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা যে কোনো বই পড়া যায় ইচ্ছামতো। ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ইন্টারনেট-ভিত্তিক লাইব্রেরি গড়ে তোলার কাজ শুরু করে দিয়েছে। বড় বড় প্রকাশনীও তাদের মুদ্রিত বইগুলোকে ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তরের কাজ শুরু করে দিয়েছে। ফলে প্রথাগত প্রকাশনা ও লাইব্রেরিগুলো খুব দ্রুত আবেদন হারাচ্ছে। এটা অনুমেয় যে, লাইব্রেরিয়ানের কাজটি একসময় নিতান্তই বিরল হয়ে যাবে।
যেকোনো খেলা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য দায়িত্বে একজন নিয়োজিত থাকেন। যেমন, ফুটবলে রেফারি আর ক্রিকেটে আম্পায়ার। বর্তমানে ভিডিও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে ফুটবলে ও ক্রিকেটে অনেক সিদ্ধান্তই রিভিউ করা হয় প্রযুক্তির মাধ্যমে। তাই সে সময় আর খুব বেশি দেরি নেই, যখন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক খেলার সব সিদ্ধান্তই প্রযুক্তির সাহায্যে নেওয়া হবে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ফিউচার অব জব সার্ভে ২০২০ অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় সাড়ে আট কোটি চাকরি গায়েব হয়ে যাবে। তবে, নতুনভাবে উদ্ভব হবে আরও সাড়ে নয় কোটি চাকরির। যেসব চাকরির চাহিদা বাড়বে, তার প্রথম দিকে রয়েছে ডেটা বিশ্লেষক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং বিশেষজ্ঞ, বিগ ডেটা বিশেষজ্ঞ, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং কৌশল বিশেষজ্ঞ, প্রসেস অটোমেশন বিশেষজ্ঞ। আর যে চাকরির চাহিদা কমবে, সে তালিকার প্রথম পাঁচটি হলো ডেটা এন্ট্রি ক্লার্ক, প্রশাসনিক ও নির্বাহী সচিব, অ্যাকাউন্টিং, বুককিপিং এবং পে’রোল ক্লার্ক, হিসাবরক্ষক এবং নিরীক্ষক, উৎপাদন কারখানার শ্রমিক।
১৭৬০ সালের দিকে বাষ্পীয় ইঞ্জিনকে কেন্দ্র করে শুরু হয় প্রথম শিল্পবিপ্লব। বস্ত্র, খনিজ, কৃষি বিভিন্ন খাতে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি হয় শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণির। ১৮৭১ সাল থেকে শুরু হয় প্রযুক্তিগত দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব। রেলপথ, টেলিফোন ও বিদ্যুতের আবিষ্কার সে বিপ্লবের সময় কারখানাগুলোকে দেয় নতুন গতি, অর্থনীতিকে দেয় অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি। এরপর বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে শুরু হয় তৃতীয় শিল্পবিপ্লব। ইলেক্ট্রনিকস এবং তথ্যপ্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে ঘটে যাওয়া সেই বিপ্লব ডিজিটাল বিপ্লব নামেও পরিচিত। আসে কম্পিউটার, সুপার কম্পিউটার।
বর্তমানে বুদ্ধিদীপ্ত বিভিন্ন ধরনের সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেমের উদ্ভবের মাধ্যমে আমরা এগিয়ে চলছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ভেতর দিয়ে। এই বিপ্লবের চালিকাশক্তি নানা ধরনের বিকাশমান প্রযুক্তির সংমিশ্রণ। এর মধ্যে যেমন আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিকস, বিগ ডেটা, ক্লাউড কম্পিউটিং; তেমন আবার আছে জিন প্রকৌশল, ন্যানোটেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, থ্রি-ডি প্রিন্টিং, অগমেন্টেড রিয়েলিটি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মতো প্রযুক্তিগুলো।
জ্ঞানভিত্তিক এই বর্তমান বিশ্বে ভিত্তি যদি দুর্বল হয়, বড়জোর আমরা প্রযুক্তির ব্যবহারকারী হতে পারব, প্রযুক্তির উদ্ভাবনকারী হতে পারব না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রকৌশলী আর বিজ্ঞানীরাই শুধু চাকরির বাজার দখল করে রাখবেন, ব্যাপারটা সে রকমও নয়। একটি প্রযুক্তি অবলম্বন করে সৃষ্টি হয় অনেকগুলো কর্মসংস্থানের, যেগুলো ক্ষেত্রবিশেষে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে আয়ত্ত করা সম্ভব। যেমন মোবাইল ঠিক করার জন্য সবাইকে ইলেকট্রিক্যাল বা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হতে হয় না, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ থাকলে পাড়ার মোড়ের দোকানেই ঠিক করে ফেলা সম্ভব। অতএব, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকেন্দ্রিক কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব বরাবরের মতোই থাকছে।
পূর্ববর্তী শিল্পবিপ্লবগুলোর সঙ্গে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অন্যতম পার্থক্য হলো এটি আগের বিপ্লবগুলোর তুলনায় অনেক বেশি দ্রুতগতিতে পরিবর্তনশীল, প্রতিটি দেশের প্রায় প্রতিটি শিল্পকে এটি প্রভাবিত করছে। উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা, পরিষেবা কিংবা পরিচালনা সবকিছুরই রূপান্তরের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন খাতের ওপর এটুআই প্রকল্প দ্বারা পরিচালিত একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ২০৪১ সালের মধ্যে গড়ে এই খাতগুলোতে প্রতি পাঁচজনের দুজন চাকরি হারানোর ঝুঁকির মধ্যে থাকবেন। এর মধ্যে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র এবং ফার্নিচার খাতেই ঝুঁকির মুখে পড়বে ৬০ ভাগ চাকরি। তবে, এই সময়ে ৫৫ লাখ চাকরি হারানোর সম্ভাব্য হুমকির বিপরীত দিক হিসেবে ধারণা করা হয়েছে, ১ কোটি নতুন চাকরির সম্ভাবনাও তৈরি হবে।
একটু ভিন্নভাবে অনেকেই মত দিয়ে থাকেন, বিকাশমান এসব প্রযুক্তি প্রতিস্থাপন নয়, বরং মানুষকে স্মার্ট করবে, দক্ষ করবে। অ্যামাজন তাদের ওয়্যারহাউজে এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখের বেশি রোবট ব্যবহার করেছে। সঙ্গে সঙ্গে নিজ প্রতিষ্ঠানের প্রায় তিন লাখ কর্মীর শিক্ষা এবং দক্ষতা প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বাজেটের ঘোষণা দিয়েছে। সামনের সময়গুলোতে চাহিদা বাড়বে, যেমন চিকিৎসা সহকারী, পরিসংখ্যানবিদ, সফটওয়্যার প্রকৌশলী, নার্সিং এসব বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্ব প্রদান করবে।
অধিকাংশ মানুষই পণ্য কেনার পর যত দ্রুত সম্ভব টাকা পরিশোধ করে চলে যেতে চান। বর্তমানেই স্বয়ংক্রিয় চেকআউট মেশিনগুলো নির্ভুলভাবে এবং অতি দ্রুত টাকা হিসাব করা ও গ্রহণ করার কাজটি সুন্দরভাবে করে যাচ্ছে। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই, নিকটবর্তী ভবিষ্যতে লেনদেনের জন্য একজন ক্যাশিয়ার রাখা ও তার বেতন দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।
খাদ্য আমাদের অন্যতম প্রধান মৌলিক চাহিদা। আর খাদ্য উৎপাদনে কাজটি করে থাকেন একজন কৃষক। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবিকার উৎস কৃষিকাজ। কিন্তু কৃষি প্রকৌশলের উন্নতি ও আধুনিকীকরণের ফলে খুব শিগগিরই কৃষিতে মানুষের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। ড্রোনের সাহায্যে জমির পরিমাণ নির্ণয়, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সাহায্যে বীজ বপন, ফসল কাটা, গাছ থেকে ফসল আলাদা করা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ করা হবে। ফলে, এসব আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে মাত্র একজন কৃষকই বিপুল পরিমাণ জমিতে কৃষিকাজ করতে পারবেন। বর্তমানে, আমাদের দেশেই বীজ বপন, ফসল কাটার যন্ত্রের ব্যবহার অল্পবিস্তর শুরু হয়েছে।
এমতাবস্থায় এই জনশক্তিকে বোঝা না বানিয়ে সম্পদে পরিণত করার সময় এসেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকেন্দ্রিক কৌশল ঘোষণা দিয়েছে। যেখানে ডিজিটাল গভর্ন্যান্স ও সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল অর্থনীতি এবং সমাজের ডিজিটাল রূপান্তরের মতো বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু। প্রায় অর্ধযুগ ধরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে আলোচনা চলছে, আয়োজিত হচ্ছে ওয়ার্কশপ, সেমিনার। কিন্তু সে অনুযায়ী যে পরিকল্পনা, দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদে যে কার্যক্রম হাতে নেওয়ার কথা ছিল, সেটি আশানুরূপভাবে দেখতে পাওয়া যায় না।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, বিচারপতি ও লেখক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ১৯২৮ সালে অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদের দয়ারামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মৌলভি জহিরউদ্দিন বিশ্বাস, মায়ের নাম গুল হাবিবা। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে আইএ পাস করেন। সাতচল্লিশের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৫১ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উরস্টার কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে আধুনিক ইতিহাসে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৬২ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে লিঙ্কনস ইন থেকে বার-এট-ল সম্পন্ন করেন। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে লেকচারার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। শিক্ষকতা ছেড়ে ১৯৬৪ সালে ঢাকা হাইকোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। হাবিবুর রহমান ১৯৭৬ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৯০-৯১ সালে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবং ১৯৯৫ সালে প্রধান বিচারপতি পদে অভিষিক্ত হন। ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। তার গবেষণা ও লেখালেখির ক্ষেত্রে বিস্তৃত ছিল সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির বিচিত্র পরিসরে। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৭ সালে একুশে পদকসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো, বাংলা একাডেমির ফেলো, লিংকন্স ইনের অনারারি বেঞ্চার এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উরস্টার কলেজের অনারারি ফেলো ছিলেন তিনি। তিনি ২০১৪ সালের ১১ জানুয়ারি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
প্রযুক্তির এই উৎকর্ষের যুগে যত লোভনীয় সময় কাটানোর উপাদানই থাকুক না কেন, বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে প্রত্যেক এলাকার জন্যই আমাদের মাঠ নির্দিষ্ট করতে হবে, মাঠের জন্য জায়গা রাখতে হবে। মাঠ কি আছে? মাঠগুলো থাকবে তো? আশঙ্কাটা নিতান্তই অমূলক নয়। দেশজুড়ে বহু মাঠ বেদখল হয়ে গেছে। খেলার মাঠ কেড়ে নিয়ে কেউ স্টেডিয়াম গড়েনি, নির্মিত হয়েছে বহুতল ভবন কিংবা শপিং মল। আকাশ চুরির মতোই চুরি হয় মাঠ-ময়দান। অন্যদিকে, আমাদের দেশে বড় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলাধুলা আয়োজনের অবকাঠামোগত ঘাটতি রয়েছে। ফুটবল, ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার বিপরীতে তার অবকাঠামো বেশ দুর্বল। ঘুরেফিরে বারবার একই ভেন্যুতে হয় আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলো। ঢাকার শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম ও চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম; এই দুটো ভেন্যুতেই আয়োজন করা হয় আন্তর্জাতিক সিরিজগুলো। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে সংস্কারকাজ চলায় বাফুফেকে ফুটবল খেলার আয়োজন করতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সারা দেশের জেলা স্টেডিয়ামগুলোর বেশিরভাগের বেহাল দশা আর ক্রীড়াঙ্গনের স্থবিরতা ক্রীড়াক্ষেত্রের উন্নয়নে অন্যতম বড় দুই বাধার নাম।
মঙ্গলবার দেশ রূপান্তরে ‘গর্বের স্টেডিয়াম এখন ডোবা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২৫ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামটি বছরের পর বছর ধরে পানিতে নিমজ্জিত থাকায় স্টেডিয়ামটির ভেতরে ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। দিনেও মাঠের ভেতর উঁকি দিতে কাউকে দেখা যায় না। আর সন্ধ্যা নামতেই মাঠের পাশ দিয়ে যাতায়াত করতে পথচারীদের গা শিউরে ওঠে। এমন একটি আন্তর্জাতিক ভেন্যু চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, অথচ দেখার যেন কেউ নেই। অচিরেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নজর না দিলে ঐতিহ্যবাহী এই স্টেডিয়াম পড়বে অস্তিত্বসংকটে। পরিত্যক্ত ডোবায় পরিণত হবে একটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামটির বর্তমান অবস্থা দেখে জনমনে প্রশ্ন এই ডোবায় কি এখন মাছ চাষ হবে? হাঁসেরা ঘুরে বেড়াবে? মাছ আর হাঁস মিলে ক্রিকেট খেলবে? জানা গেছে, স্টেডিয়ামটি ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। ২০১১ ক্রিকেট বিশ্বকাপে এই মাঠে ইংল্যান্ড-পাকিস্তানের একটি প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ হয়েছিল। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপের অন্যতম প্রধান ভেন্যু ছিল এই মাঠ। ২০০৬ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের মাধ্যমে শুরু হয় এই স্টেডিয়ামে টেস্ট ম্যাচের ইতিহাস। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ-ভারত টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় এখানে। সর্বশেষ এই মাঠে খেলার কথা ছিল অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের। তবে জলাবদ্ধতার কারণে প- হয়েছিল ম্যাচটি। সেই জলাবদ্ধতা দূর করতে নেওয়া হয়নি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, ক্রিকেট বোর্ড বা জেলা ক্রীড়া সংস্থাসহ কোনো সংস্থার কর্মকর্তারাই এ ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তা এ জেড এম ইসমাঈল বাবুল বলেন, ‘দুর্নীতি আর অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণের কারণেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। সাত বছর ধরে অস্তিত্বসংকটে পড়ে আছে স্টেডিয়ামটি।’ আমরা চাই জলাবদ্ধতা কাটুক, মাছ চাষ নয় খেলা হোক স্টেডিয়ামটিতে।
বাংলাদেশের ১০টি স্টেডিয়াম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজনে সক্ষম হলেও মাত্র দুটি স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হয় ম্যাচগুলো। তবে ওই দুই স্টেডিয়ামে অতিরিক্ত খেলা হওয়ায় ভালো উইকেট তৈরি করতে পারেন না কিউরেটররা। খেলার মান উন্নয়নে স্টেডিয়াম বাড়ানোর বিকল্প নেই। পাশাপাশি বর্তমান মাঠগুলোর উন্নয়নেও অতিসত্বর কাজ শুরু করা উচিত। কারণ ম্যাচের বাইরেও সারা বছর খেলোয়াড়দের প্রস্তুতি ও অনুশীলন করতে হয়। ঢাকার বাইরের বাকি স্টেডিয়ামগুলোতে পর্যাপ্ত অনুশীলনের সরঞ্জাম নেই। ক্রীড়াঙ্গনের প্রাণকেন্দ্র স্টেডিয়ামগুলোর তদারকিতে থাকা ক্রীড়া সংস্থাগুলোর গাফিলতির খবর এখন ওপেন সিক্রেট। স্টেডিয়ামগুলোর এমন ভঙ্গুর দশা যেন দেখার কেউ নেই। উন্নত ক্রীড়া কাঠামো থাকলেও নেই কোনো রক্ষণাবেক্ষণ। বিপুল সরকারি অর্থ খরচ করে তৈরি স্টেডিয়ামগুলো ফেলে রাখায় একদিকে যেমন তা নষ্ট হচ্ছে; অন্যদিকে তা কোনো কাজে তো আসছেই না, বরং অপচয় বাড়ছে। সারা দেশের স্টেডিয়ামগুলো জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অধীনে। আর দেখভালের দায়িত্বে জেলা ক্রীড়া সংস্থা। খেলাধুলার স্থবিরতার অন্যতম কারণ হিসেবে ক্রীড়া সংস্থার উদাসীনতাকে দায়ী করা হয়। তবে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ও দায় এড়াতে পারে না। মন্ত্রণালয়ের কঠোর নজরদারির বিকল্প নেই। সারা দেশের উপজেলা পর্যায়ে স্টেডিয়াম নির্মাণে সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগকেও ভেস্তে দিয়েছে বেশকিছু অসাধু ব্যক্তি। ক্রীড়াঙ্গনের উন্নতিতে সারা দেশের ক্রীড়া কাঠামোগুলোর সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ এখন সময়ের দাবি।
রাজধানীর মিরপুরের একটি মাধ্যমিক-সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সিফাত। একই এলাকায় বসবাসকারী তার বন্ধু সিয়াম পড়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে। সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার থেকে রোজার ছুটি। আর সরকারি প্রাথমিকে ছুটি ১৫ রোজা অর্থাৎ ৭ এপ্রিল থেকে।
এক দেশে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন নিয়মে ছুটি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে লেখাপড়ায় কেউ এগিয়ে যাবে, আবার কেউ পিছিয়ে পড়বে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার বা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে ভেবেচিন্তেই নেয়। তবে সব ধরনের স্কুলে একটা কো-অর্ডিনেশন থাকলে ভালো হয়। আমরা ছুটির ব্যাপারে আরও আলাপ-আলোচনা করব।’
জানা গেছে, চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে আগামী শুক্রবার শুরু হতে পারে রমজান মাস। বছরের শুরুতেই স্কুলগুলোর ছুটির তালিকা অনুমোদন করা হয়। সে অনুযায়ী পবিত্র রমজান, স্বাধীনতা দিবস, ইস্টার সানডে, বৈসাবি, নববর্ষ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা ও টিটি (টিচার্স ট্রেনিং) কলেজেও একই সময়ে ছুটির ঘোষণা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছুটির তালিকা ভিন্ন। তারা পবিত্র রমজান, ইস্টার সানডে, চৈত্র-সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আগামী ৭ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ প্রায় ১৫ রমজান পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা থাকবে।
রাজধানীসহ বড় বড় শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকের মতোই তাদের ছুটি থাকবে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রোজার ছুটিও একই। তবে মাদ্রাসায় রোজার ছুটি শুরু এক দিন আগেই অর্থাৎ আজ বুধবার, ২২ মার্চ।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। তাই বুধবার ক্লাস করে বৃহস্পতিবার রোজার ছুটি শুরু হবে। তবে সব স্কুলে একই ধরনের ছুটি থাকা জরুরি। এতে একই সময়ে সিলেবাস শেষ করা যাবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সন্তুষ্ট থাকবে।’
রমজানে মাধ্যমিকে স্কুল বন্ধ আর প্রাথমিকে খোলা রাখায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষকের মধ্যে। তারা বলছেন, যেসব অভিভাবকের সন্তান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্কুলেই পড়ে তাদের সমস্যা হবে। রমজান মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও রোজা রাখেন। তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিল রেখে প্রাথমিকের ছুটি নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগাঠনিক সম্পাদক জুলফিকার আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকারি ছুটি ৭৬ দিন, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৫৪ দিন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিন্ন ছুটি নির্ধারণের যুক্তি তুলে ধরে আমরা ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছি। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো সাড়া পাইনি।’
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
‘বস্তি এলাকার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। পানি সরবরাহ ও নর্দমা লাইন প্রায়ই এক হয়ে যাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে দূষিত ও নোংরা পানি পান করছেন তারা।’ এভাবে বলছিলেন ঢাকার বস্তির জীবন মান নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকের উন্নয়ন কর্মী বাছেরা আক্তার।
শুধু বস্তি এলাকা নয়, দেশের সব এলাকার সুপেয় পানি সরবরাহের চিত্র এমনই। রাজধানী ঢাকায় সরবরাহ করা পানিই না ফুটিয়ে পান করা যায় না। চট্টগ্রাম শহরের পানি লবণাক্ত। রাজশাহীর পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ। খুলনায় সরবরাহ করা পানিও না ফুটিয়ে পান করা যায় না। রয়েছে লবণাক্ততাও। গভীর নলকূপের পানিও নিরাপদ নয়, আর্সেনিক ও লবণাক্ততার কারণে ব্যবহার করাও দুষ্কর। পাহাড়ে সুপেয় পানির উৎস সীমিত। পাহাড়ি ছড়া শুকিয়ে যাচ্ছে। উজানে বাঁধ দেওয়ার কারণে নদন্ডনদীর পানিও কমছে। সুপেয় পানি ও সেচের জন্য অত্যধিক মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে দিন দিন।
এ পরিস্থিতিতে আজ ২২ মার্চ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য : ‘আসুন নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধানে পরিবর্তন ত্বরান্বিত করি।’
সরকারের পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় মিষ্টি পানিসমৃদ্ধ বাংলাদেশেও সুপেয় পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকার মানুষ সুপেয় পানির বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও নিরাপদ পানি মিলছে না। এ ব্যর্থতা ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনও হুমকিতে পড়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. তানভীর আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানিকে সুপেয় পানি বলা যায়। তবে সেখানে কোনো ময়লা ঢুকে পড়লে সেই পানিকে আর সুপেয় থাকে না। সুপেয় পানি না ফুটিয়েই পান করা যাবে।’
পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ওয়াসার পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে অনেক সময় বাইরে ময়লা ঢুকে পড়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এমন ঘটনা ঘটলে সেই পানিকে নিরাপদ বলা যাবে না। শুধু ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের পানির মান ভালো হলে চলবে না, বাসা পর্যন্ত ভালো পানি পৌঁছে দিতে হবে। কেননা সরবরাহ লাইনের পানি নিরাপদ রাখাও সংস্থার দায়িত্ব।’
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন এবং ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে। এ জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা পিছিয়ে রয়েছি। আশা করি সবাই মিলে কাজ করে পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দূর করে আমরা নির্ধারণ সময়ে লক্ষ্যপূরণ করতে পারব।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার। এর মধ্যে ৫৯ ভাগ অর্থাৎ ৯ কোটি ৭৪ লাখ ৪৩ হাজার ২২০ জন মানুষ সুপেয় পানি সুবিধার আওতায় এসেছে। আর সুপেয় পানি সুবিধার বাইরে রয়েছে ৪১ ভাগ অর্থাৎ ৬ কোটি ৭৭ লাখ ১৪ হাজার ৭৮০ জন মানুষ। এখনো দেশের ১০ ভাগ মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে।
বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-তে বলা হয়েছে, দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সুপেয় পানি প্রাপ্যতার বিবেচনায় ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে চর এলাকা, বন্যাপ্রবণ এলাকা, উপকূলীয় এলাকা, হাওর এলাকা, বরেন্দ্র অঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকা। দেশের এই ছয় শ্রেণির এলাকা বিস্তৃত রয়েছে ১০০টি উপজেলায়। দেশের ১৫৯ সিটি ও পৌরসভায় সরবরাহ করা পানির মানও একই। ওইসব এলাকায় ১৬৮টি পানি শোধনাগার, ১ হাজার ৫০০টি গভীর নলকূপে ১৫ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সরকার চালু রেখেছে। গ্রাম পর্যায়ের ২০ লাখ টিউবওয়েলের পানি নিরাপদ হওয়ার কথা ছিল। তবে আর্সেনিক ও মাত্রাতিরিক্ত আয়রন সে পানিও জনজীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।
২০১৬ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বিশে^র সবচেয়ে বড় ‘গণবিষ’-এর উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের আর্সেনিক পরিস্থিতিকে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বছরে আর্সেনিকে ৪৩ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার তথ্য প্রকাশ করা হয়। আর ২০০৩ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, দেশের ২৯ শতাংশ নলকূপে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আর্সেনিক পাওয়া যায়। আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী শনাক্তে ২০১২ সালে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। তখন ৬৫ হাজার ৯১০ জন রোগী শনাক্ত করা হয়। ২০১৭ সালে ৪২টি জেলার হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ তথ্য সংগ্রহ করে। ওই হিসাব অনুযায়ী, ওই বছর এসব হাসপাতালে ১৮ হাজার ৬৬২ আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী সেবা গ্রহণ করে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের সরকারিভাবে স্থাপিত গভীর ও অগভীর নলকূপ রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। সেই হিসাবে জনসংখ্যার বিবেচনায় সরকার ৮৩ জনে একটি পানির উৎস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। সমগ্র জনসংখ্যার বিবেচনায় বর্তমান পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে ১১ ভাগ। আর শহর এলাকার জনসংখ্যা বিবেচনায় ৩৮ ভাগ।
এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারকে সুপেয় পানি সরবরাহে শতভাগ সাফল্য অর্জন করতে হবে। সেটা করতে হলে প্রতি বছর ছয় ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। বর্তমান অগ্রগতি প্রায় এক ভাগ। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণে সামনের দিনগুলোতে পানি সরবরাহ খাতের অর্জন আরও কম হতে পারে। এ জন্য লক্ষ্য পূরণে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে চারগুণ তৎপরতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা যায়, দেশে বেসরকারি টিউবওয়েল রয়েছে প্রায় দেড় কোটি। আর সরকারি টিউবওয়েল রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। এ দুটো ধরে হিসাব করতে দাঁড়ায় প্রতি ১০ জনে একটি পানির উৎস রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ, কয়রা, বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এলাকায় পানযোগ্য পানি খুবই দুষ্পাপ্য। এসব এলাকার বেশিরভাগ উপজেলায় গভীর নলকূপ কার্যকর নয়। সরকার পানি সরবরাহ সেবার আওতায় আনতে পেরেছে ৯৮ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষকে। এখনো ১ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষ পানি সুবিধার আওতার বাইরে রয়েছে।
নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর : ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ায় স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। যে হারে পানির স্তর নামছে, সে হারে পানির স্তর পূরণ হচ্ছে না। স্বাভাবিক অবস্থা ৬ থেকে ৭ ফুট নিচেই ভূগর্ভস্থ উৎসে পানি পাওয়ার কথা। কিন্তু সে অবস্থা এখন আর নেই। ঢাকায় পানি পেতে ২৫৫ থেকে ২৬০ মিটার নিচে নামতে হচ্ছে। খুলনায় ভূগর্ভস্থ পানি নেমে গেছে ২৫-৩০ ফুট। রাজশাহী ও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর ১২০ থেকে ১৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে। খরার মৌসুমে এ অবস্থা থাকে। বর্ষার মৌসুমে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়।
অন্যদিকে দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২-৩ মিটার নেমে যায়। আর ২৫ ভাগ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৫-১০ মিটার নেমে যায়। বর্ষার মৌসুমে এসব এলাকার বেশিরভাগ অংশে পানির ভূগর্ভস্থ স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে। তবে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল ও দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে না। দেশের গৃহস্থালি ও খাবার পানির ৯৪ শতাংশ চাহিদা পূরণ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। গ্রাম এলাকায় এ উৎস থেকে ৯৯ শতাংশ ও শহর এলাকায় ৮০ শতাংশ পানি সরবরাহ করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ১৮ শতাংশ নলকূপের পানি উত্তোলনে সমস্যা হয়। এ ছাড়া ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা, মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ, গড়াই নদীর পানি কমে যাওয়ায় এসব এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পুনঃভরণ হয় না।
ভূ-উপরিস্থ সুপেয় পানির উৎসের অভাবে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর অঞ্চলে সারা বছর সুপেয় পানির সংকট থাকে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যরকম সংকট। খরার মৌসুমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনার নলকূপগুলোতে পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। বর্ষার মৌসুমে দেশের অন্যান্য এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির শূন্য স্তরের ২৫ শতাংশ পূরণ হয়ে যায়। তবে বরেন্দ্র অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয়। ওইসব এলাকায় ১৬০ ফুটের আগে পানির দেখা মিলছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূগর্ভস্থ পানি বিভাগের পরিচালক এবং পানি বিশেষজ্ঞ ড. আনোয়ার জাহিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারকে বর্ষায় কৃত্রিমভাবে মাটির নিচে পানি প্রবেশ করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমন উদ্যোগ নেওয়া না হলে ভবিষ্যতে দেশ বড় ধরনের পানি সংকটের মুখোমুখি হতে পারে।
উপকূলে লবণাক্ততা সমস্যা : ভূতত্ত্ববিদদের মতে, উপকূলীয় এলাকার পানিতে একবার লবণাক্ত পানি প্রবেশ করলে ওখানকার ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নদীতে পানি না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই অববাহিকা অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নেমে যাবে। একই সঙ্গে সাগরের দিক থেকে লবণ পানি প্রবেশের হার বাড়বে।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরের উপকূলীয় এলকাগুলোতে আমরা গভীর নলকূপ বসাতে পারি না। এই এলাকায় নলকূপে লবণাক্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে।’
উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা কমাতে উজান থেকে পানির প্রবাহ বাড়ানোর কথা বলছে ভূতত্ত্ববিদরা। কিন্তু ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ৫৬টি যৌথ নদী থেকে ইতিমধ্যে পানি প্রত্যাহার শুরু হয়েছে। এর প্রভাবে দেশের নদীগুলোতে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে এবং শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়েও যাচ্ছে। নদীগুলোর গভীরতা কমে গিয়ে পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সারা নওরিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের উত্তরাঞ্চলে স্বাভাবিকভাবেই পানির স্তর নিচে। এখন এই হার আরও বেড়েছে।’
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
আজ ২২ মার্চ (বুধবার)। ভাগ্যরেখা অনুযায়ী আপনার আজকের দিনটি কেমন কাটতে পারে? ব্যক্তি, পারিবারিক ও কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে কী বলছে জ্যোতিষশাস্ত্র? এ বিষয়গুলো সম্পর্কে যারা দিনের শুরুতেই কিছুটা ধারণা নিয়ে রাখতে চান তারা একবার পড়ে নিতে পারেন আজকের রাশিফল।
মেষ : ২১ মার্চ-২০ এপ্রিল
মঙ্গলগ্রহের ফেরে জন্মলগ্নে রবির প্রভাবে জাতক পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য দূরের যাত্রায় যেতে পারেন। যাত্রাপথে দুর্ঘটনার যোগ রয়েছে।
বৃষ : ২১ এপ্রিল-২০ মে
পৃষ্ঠোদয় রাশির কারণে হঠাৎ অর্থপ্রাপ্তির যোগ রয়েছে। প্রতিবেশীর গচ্ছিত অর্থ ব্যবসায় খাটানোর অনুমতি পাবেন। ফলে ব্যবসায় লাভবান হবেন।
মিথুন : ২১ মে-২০ জুন
শীর্ষোদয় রাশির শুষ্ক দশাকালে জাতক-জাতিকার শারীরিক উন্নতির যোগ রয়েছে। পুরনো কোনো রোগবালাই দূর হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
কর্কট : ২১ জুন-২০ জুলাই
জন্মতিথির দ্বিতীয়াতে অবস্থানের ফলে জাতক সামাজিক কাজে সফল হবেন। সরকারি কর্মচারীর সহায়তায় পুরনো বিরোধের অবসান হবে।
সিংহ : ২১ জুলাই-২০ আগস্ট
এ সপ্তাহে কোনো দুর্যোগ জয় করবেন বলে প্রতীয়মান হয়। জাতক পুরনো কোনো অর্থলগ্নির সুফল পাবেন। পারিবারিক কারণে কষ্ট পাবেন।
কন্যা : ২১ আগস্ট-২২ সেপ্টেম্বর
অর্থপ্রাপ্তির যোগ রয়েছে। প্রতিবেশী রমণীর মায়ায় অর্থবিয়োগ হতে পারে। সবল রূপে আবেগ পরিত্যাজ্য।
তুলা : ২৩ সেপ্টেম্বর-২২ অক্টোবর
চিত্রা নক্ষত্রের প্রভাবে আসন্ন সপ্তাহে বিচিত্র কর্মে জড়িয়ে পড়বেন। পথশিশুদের সাহায্যার্থে গৃহীত অর্থ তছরুপের সম্ভাবনা রয়েছে। একটু সাবধান।
বৃশ্চিক : ২৩ অক্টোবর-২০ নভেম্বর
রবির অষ্টবর্গে রেখাপাতের ফলে পরস্ত্রীতে আকৃষ্ট হতে পারেন। প্রতিবেশী রমণী অর্থলাভের জন্য প্রেম নিবেদন করবে। ছলনায় সাড়া দেবেন না।
ধনু : ২১ নভেম্বর-২০ ডিসেম্বর
বিংশোত্তরী মহাদশার ফলে বান্ধবীর সঙ্গে বিবাহপূর্ব শারীরিক মিলনে জড়িয়ে পড়তে পারেন। এ সম্পর্ক সামাজিকরূপে অসম্মান বয়ে আনবে।
মকর : ২১ ডিসেম্বর-১৯ জানুয়ারি
ত্রিকোণে মিত্রক্ষেত্রের অবস্থানের ফলে পুরনো কোনো ভুলের মাশুল দিতে হতে পারে। অতীতের কোনো কর্ম নতুন করে সামনে এসে দাঁড়াবে।
কুম্ভ : ২০ জানুয়ারি-১৮ ফেব্রুয়ারি
জন্মকু-লীতে শনির মহাদশার ফলে পুলিশি হয়রানির সম্ভাবনা রয়েছে। যতই প্রলোভন আসুক কোনো প্রকার রাজনৈতিক কাজে জড়াবেন না।
মীন : ১৯ ফেব্রুয়ারি-২০ মার্চ
অলৌকিক কিছু ঘটতে পারে। হঠাৎ অর্থ বা কোনো অনূঢ়ার কুদৃষ্টিতে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
রাজধানীর একটি নামি স্কুলে আগের বছরগুলোর মতো এবারও শিক্ষার্থীদের বর্ষপঞ্জি দেওয়া হয়। তাতে মার্চের মাঝামাঝি তাদের প্রথম শ্রেণি-অভীক্ষা শুরুর উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের প্রশিক্ষণ পেয়ে শিক্ষকরা জানান, এ বছর শ্রেণি-অভীক্ষা হবে না। ফলে শিথিল অবস্থায় ছিল শিক্ষার্থীরা। প্রথম অভীক্ষার জন্য দেওয়া সিলেবাসও শেষ হয়নি তাদের। এখন হঠাৎ করে প্রচলিত নিয়মে শ্রেণি-অভীক্ষা নেওয়া শুরু করেছে স্কুলটি। দশ বিষয়েরই। এতে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
শুধু রাজধানীর একটি স্কুলই নয়, দেশের বেশির ভাগ স্কুলেই এ বছর একই অবস্থা। নতুন শিক্ষাক্রমের কারণে সবাই তালগোলে পড়ে গেছে। এ বছর প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। আগামী বছর প্রাথমিকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণি এ শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে।
সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে প্রচলিত কোনো পরীক্ষা বা মডেল টেস্ট নেওয়া যাবে না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ম্যানুয়াল অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা গ্রহণ ছাড়াই সারা বছর শিক্ষার্থীদের শিখনকালীন মূল্যায়ন চলবে। বছর শেষে মাত্র একটি পরীক্ষার মাধ্যমে সামষ্টিক মূল্যায়ন করতে হবে। কিন্তু তা না মেনে অনেক স্কুল শ্রেণি-অভীক্ষা বা সিটি পরীক্ষার সূচি প্রকাশ করেছে। কোনো স্কুল পরীক্ষা নিতেও শুরু করেছে।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ১০টি বিষয় রয়েছে। এসবের মধ্যে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ ও সামষ্টিক মূল্যায়ন ৪০ শতাংশ। আর জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি এই পাঁচ বিষয়ে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে যে বিষয়গুলো আনার পরিকল্পনা ছিল তা সঠিকভাবে আনতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু বইপত্র নিয়ে যা হয়েছে, মূল্যায়ন নিয়ে এর চেয়েও বেশি তালগোল অবস্থা তৈরি হবে। যে শিক্ষাক্রম হয়েছে, তা আমাদের শিক্ষকদের সক্ষমতার বাইরে। এই শিক্ষাক্রম অনুসরণ করার মতো শিক্ষক আমাদের নেই। বই যারা লিখেছেন তারাও নিরপেক্ষ থাকেননি।’ আগামী দিনের জন্য পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম আরও সময় নিয়ে ধাপে ধাপে করা উচিত ছিল। আগে যথাযথভাবে বইপত্র তৈরি করতে হবে, শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হবে; তারপর শিক্ষকদের তৈরি করতে হবে। চার-পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণে শিক্ষক তৈরি করা সম্ভব নয়। আগামী বছরের জন্য এখন থেকেই এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।’
জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রম চালু করে স্বস্তিতে নেই শিক্ষা প্রশাসন। গত মাসে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের অনুসন্ধানী পাঠ্যবই দুটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলনী পাঠ ও ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান এই তিনটি বই সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখনো সংশোধনের কাজ শেষ হয়নি। তিন মাস হতে চলছে বই তিনটি ঠিকমতো পড়াতে পারছেন না শিক্ষকরা। নতুন শিক্ষাক্রমের অন্যান্য বইতেও অসংখ্য ভুল আর অসংগতি ধরা পড়ছে। অথচ দুটি বই প্রত্যাহার করেই দায় সেরেছে কর্তৃপক্ষ।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তিনটি বইয়ের সংশোধন বিষয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। কাজ এখনো শেষ হয়নি। আমরা চেষ্টা করছি, যত দ্রুত তা করা যায়। যে দুটি বই প্রত্যাহার করা হয়েছে ওই দুটির আরেকটি করে অংশ রয়েছে, যা পড়লে শিক্ষার্থীরা পুরো পাঠই পাবে। আগামী বছরের বইগুলোর ব্যাপারে আমরা আরও সচেতন থাকব। এ বছরের বইগুলোর যথাযথ পরিমার্জন করা হবে আগামী বছর।’
আগে পাঠ্যবইয়ের কোনো কিছু না বুঝলে সহায়ক বইয়ের সাহায্য নিতেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সহায়ক বই প্রকাশ করেনি। ফলে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। তারা প্রতিদিন লাইব্রেরিতে সহায়ক বইয়ের জন্য ধরনা দিচ্ছেন।
এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ হয় প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষার ফল। দুপুরে ফল প্রকাশ হলেও বিকেলেই তা স্থগিত করা হয়। পরদিন ১ মার্চ রাতে সংশোধিত ফল প্রকাশ করা হয়। দেখা যায়, প্রথমবার প্রকাশিত ফলে যারা বৃত্তি পেয়েছিল, সংশোধিত ফলে তাদের অনেকের নাম নেই। অথচ বৃত্তি পেয়ে আনন্দ-উল্লাস, মিষ্টি বিতরণ করে ফেলেছিল তারা। তাদের আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা জেনে গিয়েছিল বৃত্তি পাওয়ার খবর। কিন্তু সংশোধিত ফলে যখন ওই শিক্ষার্থীর নাম এলো না তখন তাদের মন ভেঙে যায়।
১৪ বছর ধরে চালু থাকা সৃজনশীল পদ্ধতি শুরুতে বুঝতে হিমশিম খেয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এখন আবার নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ায় আবারও হিমশিম খাওয়ার দশায় পড়েছে তারা। অনেকেই তাল মেলাতে পারছে না। পরীক্ষা ও নম্বর বণ্টনের বিষয়টি তারা বুঝে উঠতে পারছে না। পরীক্ষার ওপর চাপ কমানোর ফলে স্কুলেও পড়ালেখার চাপ কমেছে। কোনো রকমে ক্লাস পার করেই দায় সারছেন অনেক শিক্ষক। আর অভিভাবকদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রমবিষয়ক মাত্র পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণে শিক্ষকরা কতটা আত্মস্থ হতে পেরেছেন তা নিয়ে অনেকে সন্দিহান। বাস্তবভিত্তিক ও শিখনকালীন মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত নিয়েও জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বোঝানো একজন শিক্ষকের পক্ষে কষ্টকর। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, বিজ্ঞানাগার ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ নেই বেশির ভাগ স্কুলে। এটা বড় সমস্যা। এই শিক্ষকরাই যেহেতু সরাসরি শিখনকালীন মূল্যায়ন করবেন, তারা কতটুকু নির্মোহভাবে তা করতে পারবেন সে ব্যাপারে অভিভাবকরা সন্দিহান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে ধনী-দরিদ্র, গ্রাম-শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য তৈরি হবে। কারণ ধনী পরিবারের সন্তানরা এরই মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমে প্রশিক্ষণ পাওয়া একাধিক শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়া শুরু করেছেন। এগিয়ে যাচ্ছে তারা। আর প্রাইভেট পড়তে না পেরে পিছিয়ে পড়ছে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা। আবার শহরের স্কুলের চেয়ে গ্রামের স্কুলগুলো আগে থেকেই পিছিয়ে আছে। কারণ শহরের স্কুলগুলোতে বেশি বেতন ও প্রাইভেটে বেশি শিক্ষার্থী পাওয়ায় অপেক্ষাকৃত মেধাবীরা সেখানে শিক্ষকতা করেন। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য আরও বাড়বে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সব শিক্ষক সমান যোগ্যতাসম্পন্ন নন। ফলে তারা এখনো সেভাবে নতুন শিক্ষাক্রমে অভ্যস্ত হতে পারেননি। একদল শিক্ষার্থী মনে করছে, তাদের পরীক্ষা নেই। তারা রিলাক্স মুডে রয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা-সহায়ক সামগ্রী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই। নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর এখনো প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের কোনো প্রশিক্ষণ হয়নি। তারা কীভাবে বিষয়টির তদারকি করবেন, সেটা বড় সমস্যা।’