
ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম বিপ্লবী নায়ক হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন সূর্য সেন। তিনি বিপ্লবী দল ‘যুগান্তর’-এর চট্টগ্রাম শাখার প্রধান এবং ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের প্রধান সংগঠক। জন্ম ১৮৯৪ সালে চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামে। পুরো নাম সূর্যকুমার সেন। বাবা রাজমনি সেন এবং মা শশীবালা দেবী। বিএ পড়ার সময় শিক্ষক অধ্যাপক শতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে বৈপ্লবিক আদর্শে দীক্ষিত হন। ‘ন্যাশনাল স্কুল’-এ শিক্ষকতা করার কারণে তিনি ‘মাস্টারদা’ আখ্যা পান। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর আত্মগোপনে থেকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তার নির্দেশেই বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে সফল আক্রমণ চালান, তবে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন প্রীতিলতা। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কয়েকজন বিপ্লবীসহ ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়েন সূর্য সেন। বিচারে সূর্য সেন ও তার বিপ্লবী সঙ্গী তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির রায় হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কারাগারে উভয়ের ফাঁসি কার্যকর হয়।
দীর্ঘ মহামারীর পর ভেবেছিলাম এক মুক্তির সুবর্ণরেখা ছুঁতে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু খ্রিস্টীয় পঞ্জিকার নতুন বছরটাই শুরু হলো দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার দিয়ে। ক্ষমতার দাপট দিয়ে। জিইয়ে থাকা কাঠামোগত বৈষম্য উসকে দিয়ে। বান্দরবানের লামার সরই পাহাড়ে এক রাবার কোম্পানি চুরমার করে দিয়েছে রেংয়েনপাড়া। ঠিক নতুন বছরের সূচনারাতে পুড়ে অঙ্গার হয়েছে এক প্রাচীন ম্রো গ্রাম। আমরা ভেবেছিলাম রাষ্ট্র রেংয়েনপাড়ার ম্রো-সহ দেশের সব আদিবাসী নাগরিকের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করবে। কিন্তু আবারও হামলা হয়েছে বগুড়ায়। রেংয়েনপাড়া থেকে আম্বইল গ্রাম। বান্দরবান থেকে বগুড়া। ম্রো পাড়া থেকে তুরী সিংদের গ্রাম। ২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি বগুড়ার শেরপুরে ভবানীপুর ইউনিয়নের আম্বইল গ্রামে তুরী সিংদের ওপর হামলা হয়েছে। হয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। আদিবাসী ও বাঙালিদের বহুজন ঘটনায় আহত হন।
কেন বান্দরবানের সরই পাহাড় কিংবা বগুড়ার আম্বইল গ্রামে এমন হামলা ঘটছে? এর কারণ খুবই সরল এক গণিত। আদিবাসী ভূমি জবরদখল। উল্লিখিত দুই জনপদে ম্রো ও তুরী সিংদের প্রাচীন বসতি। এই ম্রো ও তুরী সিং কারা? ২০১০ সালে বাংলাদেশ ‘‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন অনুমোদন করে। উক্ত আইন অনুযায়ী ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলতে উক্ত আইনের তফসিলে উল্লিখিত বিভিন্ন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও শ্রেণির জনগণকে বোঝানো হয়েছে। উল্লিখিত আইনের ২ (১) এবং ধারা ১৯-এ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গা, বম, পাংখোয়া, চাক, খিয়াং, খুমি, লুসাই, কোচ, সাঁওতাল, ডালু, উসাই (উসুই), রাখাইন, মণিপুরী, গারো, হাজং, খাসিয়া, মং, ওরাও, বর্মণ, পাহাড়ি, মালপাহাড়ি, কোল এবং বর্মণ নামে মোট ২৭ জনগোষ্ঠীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই ২৭ জাতির পাশাপাশি পরে কুর্মি মাহাতো, কন্দ, গঞ্জু, গড়াইত, মালো, তুরি, তেলী, পাত্র, বানাই, বাগদী, বেদিয়া, বড়াইক, ভূমিজ, মুসহর, মাহালী, রাজোয়ার, লোহার, শবর, হদি, হো এবং কড়া মিলিয়ে ২১ জাতির নামও আইনের তফসিলভুক্ত হয়। তার মানে আক্রান্ত রেংয়েনপাড়ার ম্রো এবং আম্বইল গ্রামের তুরী সিং জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের উল্লিখিত আইনের তফসিলভুক্ত ‘বিভিন্ন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও শ্রেণির জনগণ’। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে উল্লেখ করা হয়েছে, ... রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। সংবিধানে ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টি নেই। এমনকি সংবিধানে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ প্রত্যয়টিও নেই। সংবিধানে আছে ‘নৃগোষ্ঠী’, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ নয়।
সভ্যতার বিকাশ কী মুক্তিসংগ্রাম সবকিছুতেই ঐতিহাসিক অবদান থাকলেও রেংয়েনপাড়া ও আম্বইল গ্রামের ম্রো কিংবা তুরী সিংরা আজ নয়াউদারবাদী করপোরেট ব্যবস্থা ও চলমান অধিপতি রাষ্ট্রের দুর্বলতম নাগরিক। নিদারুণভাবে রাষ্ট্রের দুর্বলতম এই নাগরিকরা অবিরাম দেশের প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষা ও সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখলেও আজ তারা কার্যত ভূমিহীন। ১৯৮৪ সালের শুমারিতে দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা ছিল ৮,৯৭,৮২৮ জন এবং তখন মাত্র ২৮ জাতিগোষ্ঠীর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ১৯৯১ সালের শুমারিতে আদিবাসী জনসংখ্যা দেখানো হয় ১২,০৫,৯৭৮ জন এবং জাতিসত্তা দেখানো হয় ২৯টি। ২০০১ সালের শুমারিতে আদিবাসী জনসংখ্যা উধাও ছিল। সর্বশেষ ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ অনুযায়ী দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৬,৫০,১৫৯ জন এবং জাতিসত্তা ৫০টি এবং মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.২ ভাগ। দুর্বল কি সবল, ক্ষুদ্র কি বৃহৎ, বোঁচা নাক কি উঁচু নাক রাষ্ট্র সংবিধানে সব নাগরিকের নিরাপত্তা সুরক্ষার অঙ্গীকার করেছে। ম্রো, তুরী সিং কি বাঙালি সবার জন্যই রাষ্ট্রের অধিকার সমান। তাহলে কেন বান্দরবান কি বগুড়ায় ম্রো কিংবা তুরী সিংদের ওপর বাঙালিরা আক্রমণ ও হামলা করে? এর অন্যতম কারণ আদিবাসীদের ভূমি জোর করে দখল করা। কারণ আদিবাসী ভূমি দখলের বিরুদ্ধে কোনো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি আজও। আমরা আশা করব বান্দরবানের সরই পাহাড় কি বগুড়ার আম্বইল গ্রামে আদিবাসীদের ওপর হামলা ও অন্যায়ের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র। ক্ষতিগ্রস্ত সবার পাশে দাঁড়াবে দেশ।
কী ঘটেছে বগুড়ার শেরপুরে?
বগুড়ার শেরপুরের ভবানীপুর ইউনিয়নের আম্বইল মৌজার শতবিঘা জমির মালিকানা নিয়ে স্থানীয় তুরী সিং আদিবাসী ও আশপাশের চার গ্রামের বাঙালিদের ভেতর বিরোধ চলছে। এসব জমিকে কেন্দ্র করে আদালতে মামলাও চলছে। এর ভেতর বিবদমান চার বিঘা জমি সোলায়মান আলী মাস্টার নিজের দাবি করে সেই জমিতে জোর করে বাঙালিদের দিয়ে চলতি বোরো মৌসুমে ধান চারা রোপণ করা শুরু করেন। অন্যদিকে আদিবাসীরা এই জমি নিজেদের বলে দাবি করেন। দখলদাররা তখন আদিবাসীদের ওপর হামলা করে এবং দফায় দফায় সংঘর্ষ তৈরি হয়। যদিও দখলদাররা গণমাধ্যমে বলেছেন, এগুলো তাদের ক্রয়কৃত জমি এবং আদিবাসীরা এসব জমিকে খাসজমি দেখিয়ে ভোগদখল করতে চায়। বেশ কিছুদিন ধরেই সোলায়মান আলী মাস্টার, হাফিজুর রহমান ও স্বপন মিয়াসহ শতাধিক বাঙালি স্থানীয় তুরী সিংদের ভোগদখলীয় জমি এভাবেই নানাভাবে জবরদখল নিচ্ছে। সাম্প্রতিক হামলা পুলিশের উপস্থিতিতে শেষ হয় এবং সংঘর্ষে গুরুতর আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। আদিবাসীদের ভূমি দখল নিয়ে বগুড়ার এই সাম্প্রতিক সংঘর্ষে আহত হয়েছেন বহু মানুষ। আহতদের ভেতর গণমাধ্যম নূরুন্নবী সরকার, আবু সাঈদ, ফজলুল হক, জুয়েল সরকার, নূর হোসেন, আব্দুল বারিক, জসিম উদ্দিন সরকার, হায়দার আলী, মিলন সরকার, ফারুক হোসেন, আসফদৌল্লা খান, টুটুল মিয়া, নাদু সিং, প্রদীপ সিং, জাম্পু মেম্বার, জিরেন সিং, শান্ত সিং, রফিক মেম্বার, সন্তোষ সিং, গজেন সিং, নয়ন সিং, অর্জন সিং, কৃষ্ণা সিং, পরী সিং, সুকুমার সিং, সোহানা সিং ও দিলীপ সিংয়ের নাম ছেপেছে (সূত্র: দেশ রূপান্তর, ৯/১/২৩)।
জমির জন্য জখম চলছেই
বগুড়ার আদিবাসীদের প্রায়ই জমির জন্য জখম হতে হচ্ছে। গ্রাম কি নগরে, সর্বত্র। উত্তরাধিকার, ভোগদখলীয়, খাসজমি আদিবাসীরা নিজ অধিকারে রাখতে পারছেন না। যে কোনো একটা ছুতা তৈরি করেই আদিবাসীদের ওপর হামলা হচ্ছে এবং এই অবিরত নিপীড়ন এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যখন আদিবাসীদের নিজ বসত ছেড়ে নিরুদ্দেশ হতে হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বগুড়ার শেরপুরের মির্জাপুর পুরাতন হাটখোলায় আদিবাসীদের ওপর এক নৃশংস হামলা হয়। হামলায় ফুলচান, রবিন চন্দ্র, রেহানা রানী ও সুমন চন্দ্র গুরুতর আহত হয়ে হাসপতালে ভর্তি হন। আদিবাসী ভ্যানচালক ফুলচানের বাড়ির সামনে এলাকার মনির ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন। তাকে উদ্ধারে যান ফুলচান। ছিনতাইকারী শাহীন ও শাহাদাত পরেরদিন ফুলচানের ওপর দেশীয় অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা করেন। এ সময় আদিবাসী পাড়ায় হামলা করে বহু বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় থানায় আদিবাসী ও হামলাকারী বাঙালি উভয়েই পৃথকভাবে অভিযোগ করেন। কিন্তু জানা যায়, এমনসব হামলার অন্যতম কারণ আদিবাসীদের জমি জবরদখল করা। কারণ আদিবাসীরা সরকারি খাসজমিতে বসবাস করে আসছেন এবং সেই জমি থেকে তাদের উচ্ছেদ করে জমি জবরদখলের জন্য এমন নানা হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে (সূত্র : আজকের পত্রিকা, ১৬/১২/২১)।
কার্বন কপি বাতিল হোক
আদিবাসী ভূমি দখল এক প্রশ্নহীন কার্বন কপি বাহাদুরি। রায় ও অন্যরা (২০০৭) বাংলাদেশের সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের ওপর পরিচালিত শিক্ষা ও ভূমি বিষয়ক বেশ কিছু প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন, সমতল এলাকার আদিবাসীরা বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে সমতল এলাকার বিভিন্ন জেলায় বসবাস, সংখ্যালঘিষ্ঠতা এবং নানা শোষণ ও নির্যাতনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে এখনো প্রান্তিক পর্যায়ে রয়েছেন। নিজের জমির রেকর্ড রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রভাবশালীদের নজরে পড়ে উক্ত জমি জবরদস্তি দখল হচ্ছে এবং অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে জালিয়াতি করে অনেকে তাদের জমি দখল করেছে। আর এভাবে জমির মালিকানা থেকে দিন দিন আদিবাসীদের নাম মুছে যাচ্ছে। উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের ওপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় আখতার (২০০৪) জানিয়েছেন, বৃহত্তর উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহালী, পাহান, রবিদাস, পাহাড়ি, সিং, রাজোয়ার আদিবাসীরা ক্রমান্বয়ে ভূমিহীন হয়ে পড়ছে। কেবল সমতল বা পাহাড় নয় দেশের সর্বত্র আদিবাসী ভূমি জবরদখল হচ্ছে এবং ভূমি জবরদখলের ঘটনায় আদিবাসীদের ওপর হামলা ও জখম হচ্ছে। আর এটিই এক কার্বনকপি প্রশ্নহীনতা।
২০২২ সালের ১৯ আগস্ট সকাল সাতটার দিকে দা, শাবল, লোহার রড, লাঠি, কাঁচি সমেত প্রায় ২০০-২৫০ বাঙালি পুরুষের একটি দল নিয়ে রাশিদুল ও এবাদুল সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ধূমঘাট অন্তাখালী মুন্ডাপাড়া অবরুদ্ধ করে। কুপিয়ে হত্যা করে কৃষক নরেন্দ্র মুন্ডাকে। রাজশাহীর তানোরের পাঁচন্দর ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে ২০২২ সালের ১৮ মে বুলডোজার দিয়ে মো. দেলোয়ার হোসেন একটি কর্মকার আদিবাসী পাড়া নির্মমভাবে ভেঙেচুরে তাদের উচ্ছেদ করেন। ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট হাতেম আলী ও সীতেশ ভট্টাচার্যদের ভাড়াটে দল সাঁওতাল আদিবাসীদের ভূমি জবরদখলের জন্য সশস্ত্র আক্রমণ করে নওগাঁর মহাদেবপুরের ভীমপুর গ্রামে। বাঙালিদের উচ্ছেদ আক্রমণ ঠেকাতে আলফ্রেডের নেতৃত্বে জ্যোৎস্না সরেন, রেবেকা সরেন, বিশ্বনাথ বেসরা, সুবল বেসরা, কমল সরেন, দেবেন সরেন, অনিল সরেন ও শ্রীমন্ত হেমব্রমরা গ্রামবাসীদের নিয়ে রুখে দাঁড়ান। আক্রমণকারীদের আঘাতে ৩২ বছর বয়সে নিহত হন আলফ্রেড সরেন। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মে নিজভূমির উত্তরাধিকার আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন মঙ্গল মার্ডী, শ্যামল হেমব্রম ও রমেশ টুডু। আদিবাসী ভূমি জবরদখলের এ কার্বনকপি বদলাতে হবে। তা না হলে কার্বনকপির এ দীর্ঘ যন্ত্রণা ও অন্যায়ের স্তূপ একদিন রাষ্ট্রকে ভঙ্গুর করে দেবে।
ভুলে যাওয়া যাবে না জমিজমার প্রতিবেশীয় নিরাপত্তা ও সামাজিক অধিকার চাইতে গিয়ে তেভাগা আন্দোলনে শহীদ হন শিবরাম মাঝি ও কম্পরাম সিং। টংক আন্দোলনে রাশিমনি হাজং, সুসং দুর্গাপুরে সত্যবান হাজং, জুড়িতে অবিনাশ মুড়া, নওগাঁয় আলফ্রেড সরেন, সুন্দরবনে নরেন্দ্র মুন্ডা, মধুপুরে গীদিতা রেমা বা পীরেন স্নাল।
বান্দরবানের সরই পাহাড়ে হামলার চারদিন পর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পরিদর্শনে গিয়েছিল। আশা করি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বগুড়ার আম্বইল গ্রামেও আসবে। ক্ষতিগ্রস্ত ম্রোদের মতো ক্ষতিগ্রস্ত তুরী সিংদের পাশেও দাঁড়াবে। বগুড়ার আম্বইল গ্রামের আদিবাসীদের ওপর হামলা ও নিপীড়নের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সক্রিয় হবে তারা।
লেখক: গবেষক ও লেখক
আধুনিক বিশ্ব ক্রমেই প্রযুক্তিনির্ভর, পরিবেশবান্ধব এবং স্মার্ট হতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ নামক একটি রূপকল্প প্রণয়ন করেছে। ইন্টারনেটের এই যুগে মানুষের জীবনযাপন হয়েছে অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। তারই ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে বাংলাদেশ ২০০৯ সালে ‘রূপকল্প ২০২১’ গ্রহণ করে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল তার কেতাবি নাম ছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। মানবসম্পদ উন্নয়ন, ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া, ই-প্রশাসন ও তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প খাত গড়ে তোলাকে স্তম্ভ ধরে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। সে প্রকল্পকে মোটামুটি সফল বলা যায়।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়। বিশ্বব্যাংকের অভীক্ষা বলছে, ২০২৪ সাল নাগাদ আমরা উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারব। মানবসম্পদ উন্নয়ন, ইন্টারনেট প্রযুক্তির বিকাশ ও ইন্টারনেটনির্ভর জনপ্রশাসন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতাদুটিই থাকলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসাযোগ্য। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রকল্পের ব্যর্থতা মূলত বোধগম্যতায়। সম্পূর্ণ প্রকল্পটিকে এতটা জটিল করে উপস্থাপন করা হয়েছে যে তা সাধারণ জনগণের পক্ষে উপলব্ধি করা কঠিন। ফলে সেবাদাতা ও সেবা গ্রহীতা উভয়েই অজ্ঞতার কারণে ডিজিটাল বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ সুফল লাভ করতে সক্ষম হচ্ছে না।
সরকার ঘোষিত রূপকল্প ২০৪১ মূলত ডিজিটাল বাংলাদেশের পরবর্তী গন্তব্য। স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি স্তম্ভস্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট ইকোনমি। এই চারটি স্তম্ভের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে প্রায় ৪০টি মেগা প্রকল্প। যদিও মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের খরচ ও তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে কিন্তু এই উচ্চাভিলাষী স্মার্ট বাংলাদেশ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য একটু সাহসী হওয়ার বিকল্প নেই। স্মার্ট বাংলাদেশ মহাপরিকল্পনায় ২০২৫, ২০৩১ এবং ২০৪১ এই তিনটি সময়রেখায় প্রকল্প বাস্তবায়নের গতিপথ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই মহাপরিকল্পনাগুলোতে চারটি স্তর পার করতে হবে : চালু, স্থায়ীকরণ, মানদণ্ড প্রস্তুতকরণ এবং উত্তরণ। এই প্রকল্পের শুরুতে অর্থাৎ ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলা ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি, আইসিটি নীতিমালা (তথ্য গোপনীয়তা ও সাইবার নিরাপত্তা, বাণিজ্য সহজীকরণ), জাতীয় প্রকিউরমেন্ট ই-বাজার, ডিজিটাল চাকরির প্ল্যাটফর্ম, স্মার্ট পাবলিক সার্ভিস (জনপরিষেবা) ও পেপারলেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (কাগজবিহীন প্রশাসন), ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্সিয়াল (অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক সংস্থান), গভর্নমেন্ট ক্লাউড অ্যান্ড ডেটা সেন্টার ইত্যাদি কার্যক্রম শুরুর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পরে ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ইউনিভার্সাল ডিজিটাল আইডি, ডিজিটাল কারিকুলাম, স্মার্ট ডিভাইস অ্যাকসেস, ডিজিটাল কলাবুরেশন প্ল্যাটফর্ম, স্মার্ট বাংলা ক্যাম্পেইন, স্মার্ট হেলথ কেয়ার, স্মার্ট ট্যাক্স, ব্লেন্ডেড লার্নিং, ডিজিটাল লিডারশিপ অ্যাকাডেমি ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে স্মার্ট ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, স্মার্ট পোস্টাল সার্ভিস, স্মার্ট জুডিশিয়ারি, স্মার্ট বর্ডারস, স্মার্ট সোশ্যাল সেফটি নেট, পুলিশ মডার্নাইজেশন, ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্সিয়াল ইকোসিস্টেম, ফিনটেক অ্যাকসেলারেটর, উদীয়মান প্রযুক্তিবিষয়ক সেন্টার অব এক্সিলেন্স (সিওই) বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ প্রকল্প একটি মহাপরিকল্পনা, যার সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করছে একটি নির্ভুল ডেটা বেইজ তৈরি করার সক্ষমতার ওপর। বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যার সঠিক, নির্ভরযোগ্য ও নির্ভুল ডেটা বেইজ তৈরি করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। বিশেষত দেশে যেখানে দুর্নীতি, অসততা, অপশিক্ষার শেকড় অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত। ডিজিটাল বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এগুলো সাফল্যের গতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ ধারণায় নাগরিক সেবার সঙ্গে শুধু প্রযুক্তির সংশ্লেষ ঘটানো হলে সেটি অর্থবোধক হবে না। বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাক-স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ইউনেসকোর দিকনির্দেশনা অনুসরণ না করে শিক্ষা খাতে ৬ শতাংশের বদলে বছরের পর বছর জিডিপির ২ শতাংশ ব্যয় করে চলেছে। শিক্ষার এই স্বল্পব্যয়ের মধ্যেও নানা রকম বৈষম্যমূলক আচরণ রয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের ব্যয় জিডিপির ১ শতাংশের কাছে। উন্নত দেশগুলোতে যেটি ৬-৭ শতাংশ। একটি স্বাস্থ্যবান জাতি গঠন ছাড়া কোনোভাবেই দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বাক-স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত ছাড়া কোনো রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। এটা সর্বজনবিদিত যে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির পথে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকা জরুরি। অন্যদিকে, সংবাদপত্র সরকারি-বেসরকারি-ব্যক্তিপর্যায়ে সংঘটিত নানা অসংগতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করবে সেটিই স্বাভাবিক। সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাংলাদেশে যেখানে জনগণ নিজ মত, দর্শন ও পছন্দ অনুযায়ী নেতা নির্বাচন করবে, সরকার নির্ধারণ করবে। বাংলাদেশে এ বিষয়গুলো বর্তমানে তীব্রভাবে অনুপস্থিত। গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের অভাব কীভাবে একটি দেশকে বিপর্যস্ত করতে পারে তার উদাহরণ অমর্ত্য সেন তার ‘দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ’ গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন এবং সেখানে তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে উৎপাদন-স্বল্পতা নয় বরং বণ্টনব্যবস্থার দুর্বলতাকে চিহ্নিত করেছেন। এই বণ্টন সমস্যার মূলে ছিল আইনের শাসনের অভাব এবং ছদ্মগণতন্ত্র।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। দেশের বিচারব্যবস্থা কাগজে-কলমে স্বাধীন হলেও নানা সময়ে এর ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব বিস্তার ঘটানোর সম্যক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশে ই-আদালত বিনির্মাণের সঙ্গে যেন নাগরিক সুষ্ঠু ও ন্যায়সংগত বিচার লাভের অধিকার পান তা নিশ্চিত করা হয়।
স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের যে স্বপ্ন সরকার দেখতে শুরু করেছে তা দল-মত নির্বিশেষ সবার জন্য বাস্তবায়ন করতে পারাটা বড় একটি চ্যালেঞ্জ। যে দেশের শাসনব্যবস্থায় ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পদ্ধতি বর্তমান রয়েছে সে দেশে আধুনিক, সময়োপযোগী একটি ইউনিভার্সাল নাগরিক সুবিধা প্রকল্প বাস্তবায়ন ভীষণ কঠিন। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে কীভাবে সরকার সবার জন্য স্মার্ট একটি রাষ্ট্র উপহার দিতে পারে তা চাক্ষুষ করতে আমরা সবাই গভীর দৃষ্টি রাখছি। উন্নয়নশীল দেশ হতে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রকল্পের অংশীদারত্ব সরকার ও জনগণ সবার।
লেখক : গবেষক, নোভা ইনফরমেশন
ম্যানেজমেন্ট স্কুল, লিসবন, পর্তুগাল
বাংলাদেশে বড় কৃষকের সংখ্যা মোট কৃষকের শতকরা ২ ভাগ, মাঝারি ১৮ ভাগ এবং ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের সংখ্যা শতকরা ৮০ ভাগ। এই ৮০ ভাগ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকই কৃষির মূল চালিকাশক্তি। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) বলছে এনজিও, আত্মীয়স্বজন, বেসরকারি ব্যাংক ও দাদন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন বেসরকারি উৎস থেকে কৃষকরা ৮১ শতাংশের বেশি ঋণগ্রহণ করেন। এই সব ঋণের সুদ ১৯ থেকে ৬৩ শতাংশ। আর সরকারের কৃষি ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদে যে কৃষিঋণ দেয়, তার পরিমাণ মাত্র ৬ শতাংশ। এ থেকেই বোঝা যায় সিংহভাগ কৃষক সরকারি বিশেষায়িত ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ফসল চাষের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিঋণ পান না।
এসব কারণে ব্যাংকের শাখাগুলোতে চালু করতে হবে কৃষিঋণ বুথ। এনজিওর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ কমাতে হবে। চলমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। এমন কর্মসূচির সাফল্যের উদাহরণ রয়েছে চিনিকলে। সেখানে কৃষকদের মধ্যে উপকরণ ও নগদ টাকা হিসেবে যে ঋণ বিতরণ করা হয়, তা আখ উন্নয়ন কর্মীরা (সিডিএ) কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দেন। সিডিএরা শুধু ঋণই দেন না। কৃষককে আখ চাষের আধুনিক প্রযুক্তি হাতেকলমে শিখিয়ে দেন। আখ বিক্রির জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র (পুর্জি) প্রদানের ক্ষেত্রেও মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ফলে প্রতিটি চিনিকলেই এখন শতভাগ কৃষিঋণ আদায় হয়।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ বেসরকারি ব্যাংক সরাসরি কৃষিঋণ বিতরণ করে না বরং বিতরণের জন্য বেসরকারি সংস্থাকে নিয়োগ করে। এনজিওর মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের সুদ ২৪ শতাংশ পর্যন্ত। আর ব্যাংকগুলো বিতরণ করছে ৮ শতাংশ সুদে। বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের কৃষিঋণের ৭০ শতাংশ বিতরণ করে এনজিওর মাধ্যমে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক এক বৈঠকে বলা হয়, যত দ্রত সম্ভব এনজিওগুলোর ঋণ বিতরণের হার ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। কারণ, যখনই এনজিওগুলো ঋণ বিতরণ করে, তখই সুদের হার বেড়ে যায়। এনজিওগুলোর সুদের হার কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবস্থা নিতেও বলা হয় বৈঠকে। দেশের সব ব্যাংক শাখায় একটি কৃষিঋণ বুথ খুলতে বলা হয়; যাতে কৃষক বুঝতে পারেন কোথায় যেতে হবে ঋণের জন্য। সভায় অংশ নেওয়া ব্যাংকগুলোকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কৃষিঋণ মেলার আয়োজন করতে বলা হয়েছে, যেখানে ব্যাংকার ও কৃষকরা অংশ নেবেন। কারণ, কৃষকরা মাঠে ব্যস্ত থাকেন এবং ব্যাংকে যাওয়ার জন্য তাদের সময় কম। মেলায় অংশ নেওয়া ব্যাংকগুলো কৃষকদের মধ্যে তাৎক্ষণিক আবেদনপত্র বিতরণ ও গ্রহণ এবং ঋণ অনুমোদন করবে। এছাড়াও ওই সভায় কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগকে প্রতিটি উপজেলার কৃষকদের তালিকা তৈরি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। যাদের ঋণ প্রয়োজন, উপজেলা খামার-ঋণ কমিটি তাদের তালিকা তৈরি করে ব্যাংকগুলোকে দেবে। এরপর ব্যাংক কর্মকর্তারা কৃষকের বাড়ি গিয়ে ঋণ বিতরণ করবেন। কৃষিঋণ ব্যবস্থার পরিবর্তন আনার জন্য কৃষি বিভাগ কৃষকদের জন্য যেসব প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করে সেখানে ব্যাংকারদের আমন্ত্রণ জানাতেও বলা হয়। যাতে ব্যাংকাররা সেখানে বসে ঋণের আবেদনপত্র বিতরণ এবং ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন।
কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে মোট ঋণের ২.১০ শতাংশ কৃষি খাতে বিতরণ করতে হবে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ ফসল, ১০ শতাংশ মাছ চাষ, ১০ শতাংশ পশুসম্পদ এবং ২০ শতাংশ অন্যান্য কৃষি উপ-খাতে বিতরণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরে ৩০ হাজার ৯১১ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যা গত অর্থবছরে ছিল ২৮ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছিল ২৮ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা।
‘পদকজয়ী সেই কৃষকরা এখন নিঃস্ব’ (প্রথম আলো, ১১ নভেম্বর-২০২২) শিরোনামে সম্প্রতি প্রকাশিত খবরে কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্টদের মনে কৃষিঋণ নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন জেগেছে যে কৃষক করোনার ভয়াবহ সময়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ফসল ফলিয়ে আমাদের জীবন বাঁচিয়েছেন, তারা সামান্য ঋণের দায়ে জেলে যাবেন কেন? কেন তাদের কোমরে রশি পরানো হবে? আর যারা তথাকথিত ব্যবসার নামে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে খেলাপি হয়ে বুক ফুলিয়ে বাংলার সবুজ প্রান্তরে ঘুরে বেড়ান, তাদের নামে কেন মামলা হবে না বিষয়টি মোটেও বোধগম্য নয়।
দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায়। ছিদ্দিকুর রহমান ওরফে ‘কুল ময়েজ’ নামে পরিচিতি স্বশিক্ষিত এই কৃষক বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করে কুলের পরাগায়ন বাড়িয়ে ফলন বাড়াতে সক্ষম হন। তার উদ্ভাবিত প্রযুক্তিটি সারা দেশে কুলচাষিদের মধ্যে প্রভূত সাড়া ফেলে। এজন্য তিনি ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পান। সেই ময়েজ উদ্দিন এখন ঋণের দায়ে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। নিজের কেনা জমি ও ঘরবাড়ি ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ। ঋণখেলাপির মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। জাতীয় পদক পাওয়া নিঃস্ব হওয়া কৃষকদের মধ্যে আরও আছেন আব্দুল জলিল ওরফে কিতার ম-ল। যিনি ‘লিচু কিতাব’ নামেই বেশি পরিচিত। জাহিদুল ইসলাম ওরফে ‘গাজর জাহিদ’ এবং হাবিবুর রহমানের নামটিও ‘মাছ হাবিব’ নামে পরিচিত। এসব কৃষক নিজেদের চেষ্টা, মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। অতিঅল্প সময়ে ধনী হওয়ার নেশায় তারা ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ গ্রহণ করেন। কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ ছাড়াই ঋণের টাকায় গো-খামার করেন কেউ কেউ। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক থেকে ২ থেকে ৫ কোটি টাকা ঋণ প্রদানকালে এইসব কৃষকের খামার ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা ও কোনো প্রশিক্ষণ ছিল কি না তা বিবেচনা করা হয়নি। ঝুঁকি নিরসনের ব্যবস্থাস্বরূপ কৃষি বীমাও ছিল না এসব কৃষকের।
ঈশ্বরদীতে কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক আছেন ১৫ জন। বিপাকে পড়া চারজন কৃষকের একজন ‘ঋণখেণাপি কৃষক’ কিতাব আলী ম-ল সফল লিচু চাষি ছিলেন। ব্যাংক থেকে গরুর খামার করার জন্য ঋণ দিয়ে তাকে বিপদে ফেলা হয়েছে। সফল লিচুচাষি হিসেবে জাতীয় কৃষি পদক পান আব্দুল জলিল ওরফে কিতাব ম-ল। এখন তার লিচুবাগান নিলামে উঠেছে। তিনি ২০১০ সালে ২০০ গরুর খামারের জন্য অগ্রণী ব্যাংক থেকে ৭৫ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করে সময়মতো পরিশোধ না করে মহাবিপদে পড়েছেন। ভারইমারী গ্রামের জাহিদুল ইসলাম ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পান। গাজর চাষের মুনাফা থেকে তিনি ৩০ বিঘা জমি কেনেন। সেই জমিতে গরুর খামার করেন। খামারে ১৭৫টি গরু ছিল। খামারের জন্য ২০১২ সালে তিনি ৫ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ নেন। জাহিদুল দুধের ভালো দাম না পাওয়ায় খামারের আয় দিয়ে ঋণ শোধ করতে পারেননি। খেলাপি হওয়া ও চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় ব্যাংক মোট আটটি মামলা করে। এখন ঢাকায় মামলার হাজিরা দিতেই তার অধিকাংশ সময় কাটে।
মুলাডুলির হাবিবুর রহমানের বাড়িঘর, খামার সবই নিলামে উঠেছে। ১১টি মামলা তার নামে চলমান। তিনি ২০১০ সালে জাতীয় মৎস্য পুরস্কার ও ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার অর্জন করেন। খামারে ২০০ গরু ছিল, ৫০ বিঘা আয়তনের পুকুরে মাছ ও পাঁচ হাজার মুরগি ছিল। ২৯১২ সালে তিনি ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েন। ঋণখেলাপি হিসেবে ২০২১ সালে ব্যাংক তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। তার সম্পদও এখন নিলামে উঠেছে। অগ্রণী ব্যাংকের ঢাকা প্রিন্সিপাল অফিস থেকে ময়েজ উদ্দিন ও কিতাব ম-ল ঋণ গ্রহণ করেছিলেন। আর হাবিবুর রহমান ও জাহিদুল ইসলাম মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ঈশ্বরদী শাখা থেকে ঋণ গ্রহণ করেছিলেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, তারা ঋণ নিয়ে যথাযথ ব্যবহার করেননি।
আমাদের কথা হলো, গতানুগতিক কৃষিঋণ ব্যবস্থার মাধ্যমে আর যাই হোক টেকসই কৃষি উন্নয়ন সম্ভব নয়এর আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। কৃষি মৎস্য ও পশুপালন খাতে ঋণের সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের দিতে হবে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীর থাকতে হবে পূর্ব অভিজ্ঞতা। এছাড়া উৎপাদিত পণ্যের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে কৃষককে বাঁচানোর জন্য থাকতে হবে কৃষি বীমার ব্যস্থা। এসব ছাড়া কৃষি ঋণ বিতরণ একবারেই অর্থহীন।
লেখক: সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন
‘যত গর্জে তত বর্ষে না’ প্রবাদটি বাঙালির অনেক দিনের জানা। কিন্তু নিয়তিই এমন যে এমন জানা কথাই বারবার ফিরে ফিরে আসে নানা দৃষ্টান্তে। ধরা যাক সম্প্রতি আলোচনায় আসা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনের কথাই। ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন মো. জাকির হোসেন। দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই তিনি আকস্মিকভাবে রাজধানীর মিরপুরের বেশ কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখতে গিয়েছিলেন। কাউকে আগেভাগে না জানিয়ে তার যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল সরকার নির্ধারিত সময়সীমা অনুযায়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে কি না, নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম, শিক্ষকদের উপস্থিতি, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মান, স্কুলের পরিবেশসহ সব কিছু ঠিকঠাক আছে কি না তা জানা। আমরা ভেবেছিলাম এতদিনে তাহলে দেশে এমন একজন কর্তব্যনিষ্ঠ প্রতিমন্ত্রী পাওয়া গেল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যিনি হয়তো কাজের কাজী হবেন। কিন্তু তেমন দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল না। বরং এরপর আমরা প্রতিমন্ত্রীকে আলোচনায় আসতে দেখলাম স্কুল শিক্ষার্থীদের ‘মিড ডে মিল’ ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা নিতে কয়েকশ কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণ সংক্রান্ত প্রস্তাবিত এক প্রকল্পের জন্য। ওই রকম একটি প্রকল্প প্রস্তাবে ব্যক্তি হিসেবে মো. জাকির হোসেনের দায় যতটুকুই হোক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তার নাম আসবেই। তবে, এবার আর তাকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ থাকছে না। ছেলের বউভাত ঘিরে যে কা- তিনি করেছেন তাতে কা-জ্ঞানসম্পন্ন মানুষদের গলা দিয়ে আর ভাত নামার কথা না।
দেশ রূপান্তরে বুধবার ‘গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীকে জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি’ শিরোনামের প্রতিবেদনে উঠে আসে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন ছেলের বউভাতে কুড়িগ্রামের তিন উপজেলার ২৬৫ বিদ্যালয় ছুটি দিয়ে শিক্ষকদের যোগদান বাধ্যতামূলক করেছেন। এতেই তিনি খান্ত হননি, তাদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে উপহার নিশ্চিত করে সেসব গ্রহণ করেছেন। গত রবিবার কুড়িগ্রামের চিলমারী, রৌমারী ও চর রাজিবপুর উপজেলার ২৬৫ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছুটি দিয়ে উপহারসহ শিক্ষকরা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ছেলের বউভাতে অংশ নেন। এই ঘটনাকে ন্যক্কারজনক আখ্যা দিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনসহ জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে টিআইবি। বিবৃতিতে টিআইবি আরও বলেছে, এ ঘটনা দেশের শিক্ষা খাতকে দলীয়করণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ধ্বংস করার শামিল। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘এতগুলো বিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়ে কারও ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও বাধ্যতামূলক জনপ্রতি ৫০০ টাকা চাঁদা সংগ্রহ করে উপহার দেওয়ার ঘটনা জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের সক্রিয় যোগসাজশ না থাকলে কোনো অবস্থাতেই ঘটতে পারত না। প্রতিমন্ত্রী ও তার পরিবার এই উপহার গ্রহণ করে যে ন্যক্কারজনক মানসিকতার পরিচয় দিলেন, তার ব্যাখ্যা কী? আর এই পুরো ঘটনার জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করা না হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎই বা কী! সরকারের উচিত জনগণের, বিশেষ করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জ্ঞাতার্থে তা ব্যাখ্যাসহ প্রকাশ করা।
কুড়িগ্রামে ছেলের বউভাতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন যে কা- ঘটালেন তাতে দায়িত্ব গ্রহণের পরপর তিনি কর্তব্য পালনে আন্তরিকতার যে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলেন তা মেকি বলেই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আসলেই এদেশে ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’। উদ্বেগের বিষয় হলো, এমন একজন প্রতিমন্ত্রীর মুখেই আমাদের শুনতে হচ্ছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর কথা। গত ১ জানুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত বই বিতরণ উৎসব ২০২৩-এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ স্মার্ট বাংলাদেশের কারিগর হবে আজকের শিশুরা। তাই আসুন আমরা আমাদের শিশুদের স্মার্ট বাংলাদেশের কারিগর হিসেবে গড়ে তুলি। প্রশ্ন হলো, যে আনস্মার্ট প্রতিমন্ত্রী নিজের ছেলের বউভাতের দাওয়াতে আসার জন্য ২৬৫ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছুটির ঘটনা মেনে নেন এবং চাঁদা তুলে দেওয়া বাধ্যতামূলক উপহার গ্রহণ করেন তার হাতে আমাদের শিশুরা কেমন স্মার্টনেস শিখবে? দুঃখজনক বিষয় হলো, যে অনুষ্ঠানে তিনি এই কথা বললেন সেদিনও প্রত্যাশ্য অনুসারে সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বিতরণের বই দেওয়া যায়নি। প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, কাগজের অভাবে প্রেস থেকে সব বই আসেনি। এক মাসের মধ্যে সব বই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করতে পারব। আমরা আশা করব দ্রুতই সব শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেওয়ার কাজটি প্রতিমন্ত্রী করতে পারবেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাবে যে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রতিমন্ত্রীকে স্মার্টনেসের শিক্ষা কে দেবেন?
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি এক বছরেরও কম। সবকিছু ঠিক থাকলে এ বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে অথবা আগামী বছরের জানুয়ারিতে নির্বাচন হবে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে সংসদ থেকে পদত্যাগ করা দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো আন্দোলন করছে।
এ ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপ রয়েছে বিদেশিদের। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে এই চাপ ক্রমশ বাড়ছে। বিদেশিদের মধ্যে এবার যুক্তরাষ্ট্রের চাপ অনেক বেশি। এর আলামত দেখা যাচ্ছে কয়েক মাস ধরে। নির্বাচন ছাড়াও দেশটি মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীন প্রশ্নে অনেক সোচ্চার। ২০২১ সালের ডিসেম্বর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটি।
সরকারের তরফ থেকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য তারা বিদেশিদের উদ্যোগ নিতে বলছে। একই সঙ্গে সরকার যেকোনো চাপে নতি স্বীকার করবে না, সেটাও বলেছে।
কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৯০ সালে দেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি আসার পর থেকেই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক আগ্রহ বাড়ছে। নির্বাচনের এক বছর আগে থেকেই প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নানা সবক দিতে থাকে। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
তাদের মতে, বরং নির্বাচন ঘিরে পরাশক্তিগুলোর প্রভাব লক্ষণীয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই প্রতিবেশী দেশ এবং বড় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সরকার নিয়ে সবচেয়ে বেশি আধিপত্য দেখিয়ে আসছিল ভারত। ১৯৯০ সাল থেকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমাদের প্রভাব। আর তিন দশক ধরে বিভিন্ন কূটনৈতিক জোট, আঞ্চলিক জোট এবং সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আগ্রহ বেড়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রভাবশালী দেশগুলোর নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ যতই থাক না কেন, এর মূল কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা। তারা মনে করছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সমাধান যদি নিজেরা না করতে পারি, তাহলে বাইরের প্রভাব বাড়তে থাকবে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালী উর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন ভূ-রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশকে তাদের প্রভাব বলয়ে রাখতে চায়। তাদের নিজেদের দেশেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। বর্তমান সরকারও অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কাজ করছে। তাদের এই চাপ কাজে দেবে না।’ আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন মহলের অভিমত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, ইন্দো প্যাসিফিক কৌশল এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে এবং আঞ্চলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কারণও তাই। কূটনীতিকরা বলছেন, ভারত, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ থাকলেও এক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক তৎপরতা লক্ষণীয়। এ ক্ষেত্রে সরকারবিরোধী বিএনপির পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বারবার নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি কিছুটা হলেও গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি নির্বাচন পদ্ধতি এবং নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র অনেক বেশি সোচ্চার হলেও তাদের কূটনীতি সরকারবিরোধী দলগুলোর পক্ষে যাবে এমন ধারণা করার কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। এটা যেমন সত্য, তেমনি ইন্দো প্যাসিফিক এবং এ অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের বোঝাপড়াটা বেশি জরুরি। আর সে কারণেই বিএনপি যতই তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলুক যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি নিয়ে কথা বলছে না। তাদের বক্তব্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং নির্বাচনে বিরোধীপক্ষের জন্য সুষ্ঠু ও অবাধ পরিবেশ তৈরি করা।
কূটনীতিক সূত্রগুলো বলছে, আগের কয়েক দফা যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী থাকলেও ভারতের সঙ্গে একধরনের সমঝোতা করে বা আলোচনা করে তাদের মতামত দিয়েছে। কিন্তু ইন্দো প্যাসিফিক কৌশল এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে। এবার যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি নির্বাচন নিয়ে পরামর্শ এবং তাদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়ে বেশি সোচ্চার।
বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক চর্চার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগের বিষয়টি প্রথম প্রকাশ পায় ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে। এরপর থেকেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা চলছে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সংলাপও হয়েছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল এবং প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফর করেছেন। তাদের সফরে আগামী নির্বাচন, বিরোধীপক্ষের প্রতি সরকারের আচরণ, মানবাধিকার ও সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে সরকার, আওয়ামী লীগ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
গত ২১ মার্চ নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের উদ্ধৃত করে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে, নির্বাচনে জাল ভোট দেওয়া হয়েছে এবং বিরোধীদলীয় পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয় দেখানোসহ গুরুতর অনিয়ম রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিত সম্মান ও অংশীদারিত্বের মনোভাব নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে মানবাধিকারের বিষয়গুলো উত্থাপন করে। এটা তারা চালিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এমন আগ্রহের কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বলয় বাড়াতে চায় দেশটি। এরই মধ্যে দেশটি এশিয়ায় তাদের বন্ধু দেশগুলোকে নিয়ে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ (আইপিএস) পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। এর আওতায় ইন্দো-প্যাসিফিক ফোরাম গঠন করা হয়েছে। একই কৌশলের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভারত সামরিক সহযোগিতা বাড়াতে কোয়াড গঠন করেছে। এগুলোর লক্ষ্য হলো চীনের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলে একটি শক্তিশালী বলয় গঠন করা। ভারতের পাশাপাশি এ বলয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকেও চায়। বাংলাদেশ যেন কোনোভাবেই চীনের বলয়ে না যেতে পারে, সেই কৌশলের অংশ হিসেবেও আগামী নির্বাচন ঘিরে চাপ তৈরির কৌশল নিয়েছে দেশটি। যদিও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনো জোটেই যায়নি। আবার ‘বার্মা অ্যাক্ট’ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রস্তাবে তারা বাংলাদেশকে পাশে চায়। এসব কারণে বাংলাদেশকে চাপে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ নানা ইস্যুতে সোচ্চার হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুসহ ঢাকায় সফররত দেশটির কর্মকর্তারা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের পাশাপাশি দুই দেশের সম্পর্ক নিয়েও ইতিবাচক কথা বলেন। এ ছাড়া ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের বিভিন্ন বক্তব্যেও নির্বাচনের পরিবেশ ও স্বচ্ছতা নিয়ে আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে ঢাকা সফরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তারও বলেছিলেন, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে তারা সরকারকে এবং এই দেশকে সহযোগিতা করেব। তিনি সেই সময় দেশটির যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকা দূতাবাস ও ইউএসএইডের বাংলাদেশ কার্যালয়ে আয়োজিত এক আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব তুলে ধরেন।
গত বছরের অক্টোবরে ঢাকায় এসেই এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সাংবাদিকদের বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন দেখতে চায়। এরপর থেকে তিনি নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায় অভিন্ন বক্তব্য দিয়ে আসছেন। পাশাপাশি তিনি এ-ও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কোনো একটি দলকে সমর্থন করে না। তারা চান জনগণ তাদের পছন্দের সরকার নির্বাচন করবে।
এর আগে গত বছরের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসহ ১৪টি দেশের কূটনীতিকরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচন নিয়ে তাদের মনোভাব তুলে ধরেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের অভিনন্দন বার্তায়ও বাংলাদেশে সবার জন্য উন্মুক্ত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। দিবসটি উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শুভেচ্ছা বার্তায় অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। শেখ হাসিনাকে লেখা বাইডেনের এ বার্তায় বর্তমান সরকার ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসাও করা হয়েছে।
এর আগে ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সিলর ডেরেক এইচ শোলে তার ঢাকা সফরে বলেছিলেন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, অর্থাৎ যারা পরাজিত হবেন, তারাও যেন মনে করেন নির্বাচনটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ হয়েছে এমনটাই তারা চান। তিনি বলেছিলেন, শক্তিশালী সুশীল সমাজ, মুক্ত গণমাধ্যম এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক পরিবেশ চায় যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে নেতিবাচক প্রশ্ন উঠবে না। এই পরিবেশ তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলেও শোলে জানান।
ডেরেক শোলে চলে যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, সরকারপক্ষ থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিকে বলা হয়েছে তারা অবাধ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। তারা সরকারের প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত। তবে মানবাধিকার পরিস্থিতি ও পূর্ববর্তী নির্বাচন নিয়ে তারা তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। যখনই প্রয়োজন হবে, তারা সেটা জানাবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশিদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগ নেই। এই সুযোগটা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোই করে দিয়ে আসছে। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র একটি শক্তিশালী অবস্থান চায়। এ জন্যই তারা কথা বলছে।’
রমজানের সম্মান ও পবিত্রতা রক্ষায় সবার দায়িত্ব রয়েছে। কারও কোনো অবহেলা কিংবা গর্হিত কাজে রোজাদারের রোজা পালনে অসুবিধা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা। রমজানের পবিত্রতা রক্ষার পাশাপাশি মুসলমানরা যেন নির্বিঘেœ ইবাদত-বন্দেগি করতে পারে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করা। মাহে রমজান ও রোজাদারের প্রতি সম্মান বজায় রাখা। সকল প্রকার গোনাহ পাপাচার এবং অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকা।
রোজাদারদের কষ্ট লাঘবে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করা। তারা যেন সুন্দরভাবে মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারে, সে জন্য মসজিদের আশপাশের রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করা। ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং সাহরি ও ইফতারে পচা-বাসি খাবার বিক্রি না করার বিষয়ে নজরদারি করা। মশার কামড় রোধে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া।
নানা কারণে অনেকে রোজা রাখতে পারেন না। এ কারণে ব্যক্তিভেদে মাসয়ালা প্রয়োগ হবে। কিন্তু রমজানের পবিত্রতা নষ্ট করা, রোজা ও রোজাদারের প্রতি সম্মান না দেখানো অনেক বড় ধৃষ্টতা। এগুলো থেকে বিরত থাকা চাই। প্রকাশ্যে ইসলামের কোনো বিধানের অমর্যাদা, রোজার মূল চেতনা ক্ষুণœ হয় এমন বিষয়ে লিপ্ত থাকা নাফরমানির অন্তর্ভুক্ত। জেনেবুঝে সংঘবদ্ধভাবে এমন নাফরমানি আল্লাহর ক্রোধ বাড়িয়ে দেয় এবং অনেক বড় দুর্গতি ডেকে আনে। আল্লাহর ওয়াস্তে রমজানের সম্মান ও পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে এসব গর্হিত আচরণ থেকে নিবৃত্ত থাকা চাই।
মনে রাখতে হবে, রমজান তাকওয়া (আল্লাহভীতি) অর্জনের মাস। এ মাসে করণীয় হলো তাকওয়া অর্জনে এগিয়ে আসা। কিয়ামুল লাইলের (তারাবি ও তাহাজ্জুদের নামাজ) প্রতি যতœবান হওয়া। কোরআন নাজিলের মাস হিসেবে তেলাওয়াতে কোরআন, তাদাব্বুরে কোরআন (কোরআনের আয়াত ও হেদায়েত নিয়ে চিন্তাভাবনা) এবং আমল বিল কোরআনের (কোরআনের আমল) প্রতি মনোযোগী হওয়া। যাদের কোরআন তেলাওয়াত সহিহ নেই তেলাওয়াত সহিহ করা। বেশি বেশি নফল ইবাদত, দোয়া-দরুদ, তওবা-ইস্তিগফার, জিকির-আজকার ইত্যাদিতে সময় ব্যয় করা। সর্বাবস্থায় সহনশীলতা ও ভ্রাতৃত্ব চর্চায় মনোযোগী হওয়া। অধিক পরিমাণে দান-সদকা করা এবং সব ধরনের কল্যাণকর কাজে এগিয়ে আসা। সংযম বজায় রাখা। প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করা। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের আত্মিক উৎকর্ষের প্রতি মনোনিবেশ করা।
রমজানের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তগুলোর ব্যাপারে যতœবান হওয়া। যেমন সাহরি, ইফতার, তারাবি, তাহাজ্জুদ, শবেকদর ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোর ব্যাপারে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা। এ মুহূর্তগুলোর যে বিশেষ আমল রয়েছে তাতে আত্মনিয়োগ করা। বাসাবাড়ি, অফিস-আদালতে ইবাদতের পরিবেশ গড়ে তোলা। মসজিদগুলো ইবাদতের মাধ্যমে আবাদ রাখা। মোদ্দা কথা, এই এক মাসে তাকওয়ার মেহনতের মাধ্যমে গোটা বছরের ইমানি, আমলি এবং রুহানি জিন্দেগির পাথেয় সংগ্রহ করা।
আলেমরা বলে থাকেন, রোজা রেখে ক্লান্ত হয়ে গেলে প্রয়োজনে বিশ্রাম করুন। কিন্তু অনর্থক গল্পে লিপ্ত হবেন না। কারণ কথায় কথা টানতে থাকে এবং আল্লাহ না করুন, বেশি কথা বললে তা ধীরে ধীরে মিথ্যা, গীবত-শেকায়েত ইত্যাদি বিভিন্ন দিকে ছুটতে থাকে।
রমজানে গোনাহের ধারা অব্যাহত রাখা খুবই খারাপ কথা। যেখানে ঘোষণা হতে থাকে নেকির কাজে অগ্রসর হতে, অনিষ্ট থেকে নিবৃত্ত হতে, সেখানে গোনাহের ধারা অব্যাহত রাখা অনেক বড় বঞ্চনার কারণ। বিশেষ করে অনাচার-পাপাচার ও অশ্লীলতা এবং এমন গোনাহ, যা আল্লাহর ক্রোধকে বাড়িয়ে দেয়, এমনসব বিষয় পুরোপুরি বর্জন করা। কারণ ফিরে আসার এটাই মোক্ষম সময়। কিন্তু ফিরে না এসে এর অনুভূতিও জাগ্রত না হওয়া বহুত বড় ক্ষতির বিষয়।
আজ রমজানের ৯ তারিখ। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যাচ্ছে রমজান মাস। এভাবে মানুষের জীবনও একদিন শেষ হয়ে যাবে। বুদ্ধিমান তো সে, যে আগ থেকেই প্রস্তুতি নিতে থাকে। কাজে লাগায় রমজানের বরকতময় প্রতিটি মুহূর্ত। সে অগ্রগামী হয় নেকি ও কল্যাণের পথে, তাকওয়া হাসিলের পথে এবং ব্রত হয় গোনাহ থেকে পাক-পবিত্র হয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার মেহনতে।
লেখক : খতিব, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ
রাজধানীর পল্লবীতে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি আয়োজিত ইফতার মাহফিলে সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীরা স্থানীয় যুবদলের নেতা। শুক্রবার ইফতারের আগে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য চলাকালে যুবদলের নেতাকর্মীরা সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেন।
হামলায় বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভির বিশেষ প্রতিনিধি ইমরুল আহসান জনি, চ্যানেল আইয়ের প্রতিবেদক আখতার হাবিবসহ বেশ কয়েকটি চ্যানেলের ক্যামেরাপারসন আহত হন। দুটি ক্যামেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জানা গেছে, ইফতার অনুষ্ঠানে নেতাকর্মীদের বিপুল উপস্থিতিতে গণমাধ্যমকর্মীদের দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না। এ নিয়ে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে দলের কিছু কর্মী কয়েকজন সাংবাদিকের ওপর চড়াও হন।
উপস্থিত নেতাকর্মীরা জানান, যুবদল নেতাদের হামলা থামাতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঞ্চ থেকে নেমে এলেও তাদের নিবৃত্ত করতে পারছিলেন না। পরে তিনি নেতাকর্মীদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ভিডিওতে দেখা যায় হামলায় অংশ নেন পল্লবী থানার ৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক ইসমাইল হোসেন, পল্লবী থানা যুবদলের পিয়াস, পল্লবী থানা যুবদলের সাবেক সভাপতি রাজিব হোসেন পিন্টু, রূপনগর থানা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক মো. আসিফ, পল্লবী থানা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক মো. মাসুদ এবং পল্লবী থানা ২ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের মো. মনির।
নেতাকর্মীরা জানান, এসব নেতা যুবদল কেন্দ্রীয় সংসদের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টনের অনুসারী। তবে এ বিষয়ে জানতে মিল্টনের মোবাইলে ফোন করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হকের মোবাইলে একাধিকবার কল করলেও সাড়া দেননি তিনি।
তবে ঘটনার পর সংবাদকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনার পর আমিনুল হক দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ক্ষমা চান। মিল্টন ও আমিনুল উভয়ই ঢাকা-১৬ আসনের বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য প্রার্থী।
এ ঘটনায় সংবাদকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিএনপির প্রায় অনুষ্ঠানে সংবাদকর্মীদের হেনস্তা হতে হয়। ক্ষমতায় না আসতেই সাংবাদিকদের এ অবস্থা। ক্ষমতায় আসলে তো আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি নির্যাতন করবে। এমন কোনো প্রোগ্রাম নেই যে সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়নি।
তারা আরো বলেন, ‘এর আগে বিএনপির কর্মীরা মাই টিভির সাংবাদিক ইউসুফের ওপর হামলা করেছে। আজকের (শুক্রবার) ঘটনা যে ঘটিয়ে থাকুক, এর দায় উত্তরের শীর্ষ দুই নেতার। আপনারা নিজেরা নিজেরা মারামারি করেন, কিন্তু সাংবাদিকদের ওপর হাত তোলা বরদাশত করা যায় না। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিন, ব্যাখ্যা দিন, ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেন। একই সঙ্গে আর এমন হবে না, সেটি প্রকাশ্যে বলুন। মনে রাখবেন, এই সাংবাদিকরাই আপনাদের বছরের পর বছর সার্ভ করছে। তারা এভাবে মার খেলে আখেরে আপনারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সব হারাবেন’।
এ বিষয়ে বিএনপির মিডিয়া উইং সদস্য শায়রুল কবির ভাই সাংবাদিকদের বলেন, ‘জনি ভাইসহ আহত সাংবাদিকদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি বিএনপির মহাসচিব মহোদয়ের প্রতি তিনি নিজে গিয়ে জনি ভাইকে উদ্ধার করেছেন। তবে ফুটেজে দেখলাম হামলাকারীদের ছবি আছে। তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। দলের না হলেও চিহ্নিত করে পরিষ্কার করা উচিত তারা কারা’।
জানা গেছে, শুক্রবার রাতে হামলায় আহত সাংবাদিকদের বাসায় গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান ও সদস্য সচিব আমিনুল হক।
এ ঘটনায় মির্জা ফখরুল এক বিবৃতিতে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘মনে হয় না তারা (নেতাকর্মীরা) দলকে ভালোবাসে। তারা অতিথিদের সম্মান রক্ষা করতে জানে না।’
এ সময় নেতাকর্মীদের শৃঙ্খলার মধ্যে আসার আহ্বান জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সরকারের দালালেরা অনুষ্ঠানে ঢুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। তারা গণমাধ্যমের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে।’
আয়োজকদের পক্ষ থেকে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে এর সমাধান করা হয়েছে। সাংবাদিকদের কাছে ক্ষমাও চাওয়া হয়েছে।’
রুতুরাজ গয়কোয়াডের দাপুটে ব্যাটিংয়ে চ্যালেঞ্জিং পুঁজি গড়ল চেন্নাই সুপার কিংস। যা তাড়া করতে নেমে শুভমন গিলের পর রাহুল তেওয়াতিয়া ও রশিদ খানের নৈপুণ্যে জয় তুলে নিল গুজরাট টাইটান্স।
আহমেদাবাদে শুক্রবার আইপিএলের উদ্বোধনী ম্যাচে ৫ উইকেটের জয় তুলে নেয় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন গুজরাট। ১৭৯ রানের লক্ষ্য তারা ৪ বল হাতে রেখে ছুঁয়েছে।
গিল সর্বোচ্চ ৩৬ বলে ৬৩ রান করেছেন ৬ চার ও ৩ ছক্কায়। শেষ দিকে তেওয়াতিয়ার ১৪ বলে অপরাজিত ১৫ ও রশিদ খানের ৩ বলে অপরাজিত ১০ রান দলকে জয় এনে দেয়।
চেন্নাইয়ের পক্ষে রাজবর্ধন হাঙ্গার্গেকর ৩৬ রান খরচায় ৩ উইকেট নেন।
এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নামা চেন্নাই নির্ধারিত ২০ ওভারে ৭ উইকেটে ১৭৮ রান সংগ্রহ করে। রুতুরাজ সর্বোচ্চ ৯২ রান করেন। তার ৫০ বলের ইনিংসে ছিল ৪ চার ও ৯ ছক্কা।
রনজিদা বেগম (৬০) থাকেন পুরান ঢাকার লালবাগে। রোজা রেখে বাসাবাড়ির কাজ শেষে প্রতিদিন সন্ধ্যায় হাজির হন লালবাগের হরনাথ ঘোষ সড়কে। এখানে ‘নবীনের মেহমান খানায়’ প্রতিদিন তার মতো হাজার মানুষের জন্য বিনামূল্যের ইফতারি দেয় নবীন বাংলাদেশ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
রনজিদা বেগম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি এত কষ্ট করে মানুষের বাসায় কাজ করে খাই। ছেলে খোঁজ লয় না, তাই লাইনে দাঁড়াইছি। রোজা রেখে কেউ কি ছেলের নামে মিথ্যা কথে বলে? আর রমজানে এখানে প্রতিদিন পোলাও, মাংস, মাছ, রুটি ও ফলসহ বিভিন্ন খাবার দেওয়া হয়। সাহরির জন্য দুধও দেওয়া হয়। তাই খরচ বাঁচাতে এখানে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নেই।’
আয়োজকেরা জানান, পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী এনামুল হাসান নবীনের উদ্যোগে চার বছর ধরে লালবাগ, চকবাজার ও কামরাঙ্গীরচরসহ আশপাশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে ইফতারি দেওয়া হচ্ছে। রোজা শুরুর আগেই নবীন বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবীরা বিভিন্ন জায়গা ঘুরে হাজার সুবিধাবঞ্চিতকে কার্ড দেন। পরে কার্ড নিয়ে এলে তাকে খাবার দেওয়া হয়।
মেহমানখানার খাবারে বৈচিত্র্য আনার জন্য একেক দিন একেক রকম আয়োজন থাকে। পোলাও, মুরগি, গরুর মাংস, রুই মাছ, দুধ, খেজুর, তরমুজ ও রুটিসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার দেওয়া হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, ইফতারের এক ঘণ্টা আগেই সড়কের দুই দিকে দীর্ঘ লাইন। সবাই অপেক্ষা করছেন। ইফতারের সময় একজন করে এসে সুশৃঙ্খলভাবে কার্ড দেখিয়ে নির্দিষ্ট খাতায় স্বাক্ষর দিয়ে খাবার নিয়ে যাচ্ছেন। হরনাথ ঘোষ এলাকার বাসিন্দারা জানান, নবীনের মতো ব্যবসায়ীরা সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে দাঁড়ালে সমাজের চিত্র বদলে যেত। গত রমজানেও মেহমানখানা থেকে ইফতারি দেওয়া হয়। এবারও ঠিকঠাকভাবেই সবকিছু চলছে।
ইফতারি নিতে আসা সানজিদা বেগম বলেন, ‘বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম। রমজানে মাংস দিয়ে খেতে হলে অনেকগুলো টাকা চলে যাবে। এখানে মুরগি, গরু, মাছ সব ধরনের খাবার দেয় পুরো রমজানে। এই খাবার দিয়ে পরিবার নিয়ে প্রতিদিন খাওয়া হয়। ফলে সংসারে খাবারের খরচ কিছুটা সাশ্রয় হয়।’
পুরান ঢাকায় আরও অনেক ধনী আছে, কিন্তু আমরা সেভাবে কারও কাছ থেকে ইফতার পাই না জানিয়ে মো. রাকিব নামের এক বাসিন্দা জানান, ‘অনেক ধনী আছে পুরান ঢাকায়। কিন্তু কারও থেকে সেভাবে কোনো সহায়তা পাই না। গরিব মানুষ তাই এইখানে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নেই। শুধু রমজানে নয়, এলাকার গরিব-দুঃখী বিপদে পড়লে এখানে আসলে উপকার পাওয়া যায়। আর রমজান শেষে ঈদের দিনও বাজার দেওয়া হয়।’
নবীন বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাফেজ এনামুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ব্যবসার লাভের অংশ দিয়ে প্রতি রমজানে ইফতারের আয়োজন করি। আমার মেহমানদের আগেই কার্ড দেই, তারা কার্ড দেখিয়ে খাবার নেন। ইফতারে তাদের জন্য যে খাবার দেওয়া হয়, তা আমি নিজেও খাই। ভালো বাবুর্চি দিয়ে মেহমানদের খাবার রান্না করা হয়। একজনকে যে পরিমাণ খাবার দেওয়া হয়, তাতে চারজন খেতে পারেন। তবে গতবারের চেয়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়তি। তাতে মেহমানখানা চালাতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। বিবেকের তাড়না থেকেই রমজানে সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াই। আমার মতো সব ব্যবসায়ী তাদের পাশে দাঁড়ালে কিছুটা হলেও এসব সুবিধাবঞ্চিত মানুষ স্বস্তি পেতেন।’
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভাড়া ৫৩ হাজার টাকা। এ রুটের অন্যসব এয়ারলাইনস আরও কম দামে যাত্রী বহন করলেও বিমান করে না। খালি যাবে, তাও কম ভাড়ায় যাত্রী নেয় না বিমান।
ঢাকা থেকে বিমান কত বেশি ভাড়া নেয় তা স্পষ্ট বোঝা যায় নিকটতম প্রতিবেশী শহর কলকাতার দিকে চোখ বোলালে। কলকাতার নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানের তিন ভাগের এক ভাগ ভাড়া দিয়ে কুয়ালালামপুর যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে উড়ে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে বিমানের ভাড়া বেশি। বিমানের ভাড়া শুধু বেশিই নয়, এই এয়ারলাইনস ভাড়া বাড়ানোর নেতৃত্ব দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রথমে বিমান ভাড়া বাড়ায় পরে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এয়ারলাইনসগুলো সেই সুযোগ নেয়।
অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় বিমানের ভাড়া বেশি এ অভিযোগ ছিল মূলত জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ট্রাভেল এজেন্টদের। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছেন সাধারণ যাত্রীরাও। কুয়ালালামপুর, রিয়াদ বা জেদ্দার মতো বাংলাদেশি শ্রমিকপ্রবণ শহরগুলোতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, দেশের বেসরকারি টেলিভিশন এমনকি খবরের কাগজগুলোতে যেচে এসে বলে যাচ্ছেন বিমান অনেক বেশি ভাড়া নিচ্ছে।
কীভাবে বিমান ভাড়া বাড়ায় জানতে চাইলে একজন জনশক্তি রপ্তানিকারক জানান, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখে তা নতুন করে বলার দরকার নেই। তাদের কর্মস্থলে পাঠাতে বা ফিরিয়ে আনতে বিমানের বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। বিমান কোনো দিন কোনো ঘোষণায় বলেনি ‘এ উদ্যোগটি শুধু রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য’। এই শ্রমজীবীদের জন্য বিমানের কোনো ছাড় নেই। বরং যখন যে ‘আদম বাজার’ চাঙ্গা হয় তখন সেখানে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় বিমান। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রচুর শ্রমিক যাচ্ছে। সেখানে ভাড়া বাড়িয়েছে সংস্থাটি। শ্রমিক এবং ওমরাহর কারণে জেদ্দার টিকিটই পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তা অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
এ অবস্থা থেকে বিমান কীভাবে বের হয়ে আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমান নানা পলিসি নিতে পারে। বিকল্প রুট চালু করতে পারে। ট্রানজিট দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে নিতে পারে। এতে যাত্রীরা কম দামে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ যাত্রী যেহেতু শ্রমজীবী তাই তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। কত সময় ট্রানজিট নিয়ে গেল তা মুখ্য নয়। ঠিক এ জায়গাটিতেই এগিয়ে আছে আমাদের নিকটবর্তী শহর কলকাতা। ঢাকার তুলনায় অনেক কম দামে কলকাতার যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। সেখান থেকে পরিচালিত এয়ারলাইনসগুলো সরাসরি বা এক-দুটি ট্রানজিট দিয়ে অনেক কমে যাত্রী বহন করে। বিমান কেন পারে না সেই প্রশ্নটি কেউ তুলছে না।
এক সপ্তাহ পর আগামী ৪ এপ্রিল ফ্লাই (যাত্রা) করার জন্য গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা কুয়ালালামপুর রুটের বিমান টিকিটের দাম ছিল ৫৩ হাজার ২৭ টাকা। থাই এয়ারওয়েজ ৪১ হাজার ৭৬ টাকায়, ইন্ডিগো এয়ার ৪৩ হাজার ৬৪৪, ইউএস-বাংলা ৪৭ হাজার ১৯, এয়ার এশিয়া ৪৯ হাজার ৪৪৫, মালিন্দো এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৯০ এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ভাড়া ছিল ৬১ হাজার ৪৭২ টাকা।
অথচ কলকাতা থেকে এয়ার এশিয়া একই দিনে একই গন্তব্যে নন-স্টপ ফ্লাইটে মাত্র ১৭ হাজার ৩৭৯ টাকায় পৌঁছে দেওয়ার অফার ছিল অনলাইনে। এয়ারক্রাফটের মানভেদে একই দিনে বিভিন্ন সময়ে টিকিটটির দাম ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ছিল। ইন্ডিগো এয়ার চেন্নাইয়ে একটি স্টপেজ দিয়ে ২০ হাজার ৩৩৭ টাকায় অফার দেয়। কলকাতা থেকে কুয়ালালামপুরে যাওয়ার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিটের দাম ছিল ২৯ হাজার ৬৩৯ টাকা। মুম্বাই এবং সিঙ্গাপুরে দুই স্টপেজ দিয়ে এয়ারলাইনসটি এ ভাড়া নির্ধারণ করে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস মুম্বাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে কলকাতা থেকে ৫৪ হাজার ৩২৬ টাকায় যাত্রীদের নিয়ে যায় কুয়ালালামপুর।
ঢাকা রিয়াদ রুটে আগামী ৩ এপ্রিলের এয়ার অ্যারাবিয়ার ভাড়া ৫৪ হাজার ৯৫১ টাকা। শারজায় একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কলম্বোতে একটি স্টপেজ দিয়ে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস রিয়াদ নিয়ে যাবে ৫৬ হাজার ৫৪৫ টাকায়। জাজিরা কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৫ হাজার টাকায়, গালফ এয়ার বাহরাইনে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৭ হাজার ৬৭৭ টাকায়, সৌদিয়া এয়ারলাইনস ৭১ হাজার ৭১১ টাকায় সরাসরি, কুয়েত এয়ারওয়েজ কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৩ হাজার ২৪৭ টাকায়, ওমান এয়ার মাস্কটে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৩২ টাকায়, ফ্লাই দুবাই দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৬৩ টাকায়, কাতার এয়ারওয়েজ দোহায় এক স্টপেজ দিয়ে ৮২ হাজার ৫৫৭ টাকায়, এমিরেটস দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৮৪ হাজার ২৩১ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে। আর ঢাকা-রিয়াদ রুটে বিমানের ভাড়া ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৭ টাকা। ৩ এপ্রিল কলকাতা থেকে রিয়াদ যাওয়ার ভাড়াও ঢাকা রিয়াদের তুলনায় অনেক কম।
কলকাতা থেকে মাত্র ৩৫ হাজার ৩২৪ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া। মুম্বাইতে মাত্র একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীদের সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। ওইদিন সময়ভেদে তাদের ভাড়া ৪১ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এক স্টপেজ দিয়ে ফ্লাই দুবাই নিয়ে যাচ্ছে ৪১ হাজার ৫৬০ টাকায়। ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ভাড়া ৪১ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকা। এয়ার ইন্ডিয়া দিল্লিতে একটি স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪১ হাজার ৪১৯ টাকা। গালফ এয়ার মুম্বাই এবং বাহরাইনে দুই দফা স্টপেজ দিয়ে নিচ্ছে ৪৫ হাজার ৫৮৭ টাকা। ইন্ডিগো এয়ার দিল্লিতে এক স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪৮ হাজার ১৮৭ টাকা। দুবাইতে এক দফা বিরতি দিয়ে এমিরেটস কলকাতা থেকে রিয়াদের ভাড়া নিচ্ছে ৫৪ হাজার ৬৪৬ টাকা। কাতার এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৩৮ টাকায় এবং এমিরেটস ৬০ হাজার ১০৮ টাকায় একটি বিরতি দিয়ে কলকাতা থেকে রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে।
এসব রুটে বিমানের উচ্চমূল্য নির্ধারণই ভাড়া বৃদ্ধির মূল কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এর সঙ্গে আছে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট কমানো এবং উচ্চ দামের সুযোগ নিতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং ২০২৩ সালে ডলারের বর্ধিত বিনিময় দর। জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধিও টিকিটের দাম বৃদ্ধির কারণ।
বিমানের এমডি শফিউল আজিম বিমান ভাড়া বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি না মানলেও রিক্রুটিং এজেন্ট, ট্রাভেল এজেন্ট বা হজ এজেন্সির তরফ থেকে বরাবরই এ অভিযোগ করা হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, যখন বিমান ভাড়া বাড়ায় তখন অন্য এয়ারলাইনসগুলোও ভাড়া বাড়ায়। বিমান যখন বাড়ায় তখন কোনো সীমা মানে না। তারা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ায়।
৩৫ বছরের পেশাজীবনের কথা উল্লেখ করে মাজহারুল ইসলাম বলেন, বিমানের ভাড়ার সঙ্গে কুলাতে পারছি না। একজনকে বাইরে পাঠানোর সব খরচ অনুমান করা যায়, বিমান ভাড়া ছাড়া। কারণ ৫ ডলারের ভিত্তিভাড়া তারা ৩০ ডলার থেকে শুরু করে। বিমান ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু জ্বালানি খরচ কমছে। যখন কমে তখন বিমান ভাড়া কমায় না। বিমান যেভাবে ভাড়া বাড়ায় তাতে ব্যবহারকারীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বিমানের ভাড়া প্রায় মহামারীর সময়ের মতো অবস্থায় চলে গেছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টরা । বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে শ্রম আমদানিকারক দেশের গন্তব্যগুলোতে ভাড়া বেড়েছে। ঢাকা-জেদ্দা রুটে টিকিট পাওয়াই সৌভাগ্য। এ মাসের শুরুতে যে ভাড়া ছিল ৫০ হাজার তা এখন ৮০ হাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিমান ভাড়া বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি খেসারত দিচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)-ওয়েবসাইট তথ্য দিচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২ লাখ ১৩ হাজার শ্রমিক বিদেশে গেছে। যাদের বেশিরভাগই গেছেন মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
গত বছরের শেষদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা হয়। বাজার নতুন করে শুরু হওয়ার পর ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে টিকিটের দাম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। ব্যাংকক, কলম্বো বা অন্যান্য শহরে ট্রানজিট ফ্লাইট দিয়েও অনেক এয়ারলাইন কুয়ালালামপুরে যাত্রী বহন করছে। এতে টিকিটের দাম কমেছে ৩০-৪০ হাজার টাকা।
এবার হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এ টাকা বাড়িয়ে হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হজযাত্রী এবং হাবের ধারাবাহিক বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিমান ভাড়া বাড়িয়ে যচ্ছে। এবারও বাড়িয়েছে। গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হজবিষয়ক এক সভায় হাবের সিনিয়র সহসভাপতি ইয়াকুব শরাফতি হজে বিমান ভাড়া কমানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত বিমানের এমডি ভাড়া কমানোর সুযোগ নেই বলে জানান। বৈঠকে হজে কেন বিমান ভাড়া বাড়নো হলো তার যৌক্তিকতা জনসমক্ষে তুলে ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয় এমডিকে।
ইয়াকুব শরাফতি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি হজের বিমান ভাড়া কমানোর জন্য। বিমান কোনোভাবেই কমাতে রাজি হয়নি।’
বিমানের বর্ধিত ভাড়ার সুযোগে সৌদিয়া দেশ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কারণ বিমান যে ভাড়া নির্ধারণ করে সৌদিয়াও একই ভাড়ায় হজযাত্রী বহন করে। হজের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশি হজযাত্রীদের অর্ধেক বহন করবে সৌদি আরবের এয়ারলাইনস।
আটাবের সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া জানান, প্রধান এয়ারলাইনসগুলোর পাশাপাশি এয়ার অ্যারাবিয়ান, ফ্লাই দুবাই, সালাম এয়ারের মতো বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলো তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের তুলনায় কম ভাড়া নেওয়ার কথা। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে বেশি নিচ্ছে। বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলোও তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে মাত্র ৫০০ বা ১০০০ টাকা কম নিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। অথচ সরকারের কাছে তাদের প্রজেকশন ছিল তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে অর্ধেক মূল্যে যাত্রী নেবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং কম থাকায় তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
সন্ধ্যার আকাশে রহস্যময় চাঁদ দেখে আটকে যায় চোখ। চাঁদের নিচে আলোকরেখার মতো ছোট এক বিন্দু। এ নিয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) সন্ধ্যা থেকেই সোশালে মাতামাতি। এ সংক্রান্ত ছবি সমানে শেয়ার করে চলেছে নেটিজেনরা। সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন নানা রকম মন্তব্য।
কেউ কেউ বলছেন, এটি দেখতে ঠিক আরবি হরফ ‘বা’-এর মতো। আবার কেউ কেউ বলছেন, দৃশ্যটির সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে কাজী নজরুল ইসলামের একটি গান মোর ‘প্রিয়া হবে এসো রানী’র। গানে প্রিয়তমার খোঁপায় ‘তারার ফুল’ দেওয়ার কথা বলেছিলেন বিদ্রোহী কবি।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিকসের বরাত দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছে, বসন্তের আকাশে ধরা পড়া রহস্যময় এই আলোকরেখা আসলে শুক্র গ্রহ। অবশ্য এই মহাজাগতিক দৃশ্য বিরল। সৌরমণ্ডলের উজ্জ্বলতম গ্রহটি শুক্রবার চলে আসে পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের কাছাকাছি। নতুন অবস্থানের কারণেই মানুষের কাছে ভিন্নভাবে ধরা দেয় গ্রহটি। তবে সেটি আবার কয়েক মিনিটের মধ্যেই হারিয়ে যায়।
এদিন সন্ধ্যার পর বাংলাদেশ-ভারতসহ কয়েকটি দেশে আকাশে চাঁদের নিচে আলোকবিন্দুটি দেখা যায়। এ সময় অনেকেই চাঁদ দেখতে ঘর থেকে বের হয়ে যান। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এই বিরল মহাজাগতিক মিলন দেখার উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিকস টেলিস্কোপ ও ক্যামেরা ব্যবহার করে এই মহাজাগতিক ঘটনা সরাসরি সম্প্রচার করে।
সোশালে সাইফুদ্দিন আহমেদ নামে একজন কলেজ শিক্ষক মন্তব্য করেন, ‘এটিই নজরুলের ‘তৃতীয়া তিথির চৈতি চাঁদের দুল...। কবি তার একটি গানে লিখেছিলেন, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী, দেব খোঁপায় তারার ফুল / কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতি চাঁদের দুল ...।’ গতকাল ছিল চৈত্র মাস, চাঁদ আর শুক্রের সম্মিলিত এই মোহনীয় রূপও ছিল ঠিক তৃতীয়া তিথিতে।
তবে শুধু এই কলেজ শিক্ষকই নন, আরও অনেকে চাঁদ ও শুক্র গ্রহের বিরল এবং যৌথ রূপকে কানের দুলের মতো দেখতে বলে মন্তব্য করেছেন।
এর আগে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে চাঁদের সঙ্গে এক সারিতে দেখা গিয়েছিল শুক্র ও সৌরমণ্ডলের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতিকে। এবার চাঁদের নিচে দেখা মিলল শুক্র গ্রহের। চাঁদের নিচে অবস্থানের পাশাপাশি কিছুক্ষণের জন্য চাঁদের আড়ালেও চলে গিয়েছিল গ্রহটি।
মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা বলছে, গত ১ মার্চ থেকেই খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে বৃহস্পতি ও শুক্র গ্রহ। বিভিন্ন দেশে রাতের আকাশেই দেখা মিলছে এ বিরল দৃশ্যের। সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশের দিকে তাকালেই দেখা যাচ্ছে বৃহস্পতি ও শুক্র। আকাশে মেঘ না থাকলে কাছাকাছি আসার দৃশ্য খালি চোখেই দেখতে পারছেন যে কেউ।
বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট অ্যাকিউ ওয়েদার বলছে, পৃথিবীর দুই প্রতিবেশী গ্রহ শুক্র ও মঙ্গল একে অপরের সবচেয়ে নিকটে আসতে চলেছে। একই সঙ্গে এক সারিতে দেখা যাবে শুক্র-মঙ্গল ও চাঁদকে। এমন ঘটনাকে ‘প্ল্যানেটরি কনজাংশন’ বলে আখ্যা করেছেন বিজ্ঞানীরা।
আগামী ২৬ মার্চ, মঙ্গল ও শুক্র গ্রহ নিজেদের কক্ষপথ থেকে সবচেয়ে কম দূরত্বে ও একই সারিতে অবস্থান করবে। ওই দিন সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশে দুটি গ্রহ দৃশ্যমান হবে। এর আগে, ২৫ মার্চ রাতে চাঁদের কাছাকাছি আসবে এই দুই প্রতিবেশী গ্রহ, যা মহাকাশ বিজ্ঞানে বেশ বিরল ঘটনা।