
আবার বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। ২০২২ সালের জুনে বেড়েছে গ্যাসের দাম, আগস্টে বেড়েছিল জ্বালানি তেলের দাম, ২১ নভেম্বর বেড়েছিল পাইকারি বিদ্যুতের দাম আর ১২ জানুয়ারি ২০২৩ সালে নববর্ষের উপহার হিসেবে বাড়ল খুচরাপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম। এর প্রভাব পড়বে জীবনযাপনের সব ক্ষেত্রে। খরচ বাড়বে উৎপাদনের এবং সাধারণভাবে বাড়বে সব জিনিসের দাম।
বাজারে ডিমের হালি ৫০ পয়সা, চাল ২ টাকা সের, ১টা ইলিশ মাছ ৭/৮ টাকা, গরুর মাংস সের ২০/২৫ টাকা, এ কথা বললে চোখ কপালে উঠবে না কি! অবাক হওয়ার মতো অবিশ্বাস্য দাম! বেশি দিন আগে নয়-ছয় দশক আগে এসব পণ্যের দাম এমনই ছিল, এখন এসব পণ্যের দাম কত? এখন ৪০ টাকায় এক হালি ডিম, ১ কেজি চাল ৫০ থেকে ৯০ টাকা, ১টা ইলিশ (মাঝারি) ১ হাজার টাকা আর ৬০০ টাকা কেজিতে কিনতে হয় গরুর মাংস। কিন্তু যে পরিমাণে পণ্যমূল্য বেড়েছে সে অনুপাতে কি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আয় বেড়েছে?
টাকা ক্রমাগত মূল্যহীন হচ্ছে পণ্যের কাছে। কোথায় গিয়ে ঠেকেছে টাকার মূল্যমান যে ঢাকায় রিকশার সর্বনিম্ন ভাড়াও এখন আর ২০ টাকা নিতে রাজি হয় না রিকশাওয়ালারা। ভিক্ষুককে ১/২ টাকা দেওয়া যায় না। আর অভ্যন্তরীণ মুদ্রাবাজারে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে পয়সা। ক্রমাগত জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে পয়সা হারিয়ে গেছে প্রায় মুদ্রাবাজার থেকে। অথচ স্বাধীনতার পরেও বহুদিন পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, পঁচিশ পয়সা ও পঞ্চাশ পয়সা ইত্যাদি বিভিন্ন মানের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। কিন্তু কালক্রমে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে এগুলোর ব্যবহার ক্রমেই কমতে থাকে। মূলত নব্বই দশকের গোড়া থেকেই পয়সার ব্যবহার কমতে থাকে। আর তার পরিবর্তে এক টাকা সমমানের মুদ্রা বাজারে ছাড়া হয়। বর্তমানে এক টাকা, দুই টাকা ও পাঁচ টাকার সমমানের মুদ্রা বাজারে চালু রয়েছে।
টাকার দাম কমছেই না শুধু এশিয়াতে অনেকের চেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স বাংলাদেশের টাকার। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট ও ক্রেডিট ডেফিসিটের জন্যই টাকার দামের এই রেকর্ড পতন। টাকার মূল্য আসলে কী? একই সাইজের কাগজের টুকরার কোনো মূল্য নেই কিন্তু টাকার আছে। সেক্রেটারি অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যেকোনো মূল্যমানের টাকায় স্বাক্ষর করে সত্যায়িত করলেই টাকার মূল্য হয়ে যায়। ফলে টাকা হলো এক প্রকার অঙ্গীকারনামা। গভর্নর সাহেব টাকার গায়ে যে অঙ্ক লিখে দেবেন এবং বাহককে দেওয়ার অঙ্গীকার করবেন সেটাই টাকার মূল্য হিসেবে বিবেচিত হবে। নইলে এক টুকরা কাগজের আর কিইবা মূল্য। টাকার এ মূল্য যে দিন দিন নিচে নামছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন দেশের মানুষ।
দ্রব্যমূল্য লাগামহীন এবং দুবছর ধরে বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণহীন। অজুহাত হিসেবে কভিড আর রাশিয়ার যুদ্ধের কথা বলা হয়, তবে এর ফলে যতটা বাড়ার কথা তার চেয়ে অনেক বাড়িয়েছে সিন্ডিকেট। মূল্যবৃদ্ধির হার বেড়ে যাওয়ার ফলে মধ্যবিত্তের যেমন নাভিশ্বাস উঠেছে, গরিব মানুষের কষ্ট বেড়েছে তার চেয়েও বেশি। কারণ, শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি গরিব মানুষ বাস করেন আর গরিব মানুষকে খাবারের পেছনে তাদের আয়ের বেশির ভাগই ব্যয় করতে হয়, ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে তাদেরই বেশি ক্ষতি এবং এতে তাদের কষ্ট অনেক বেড়ে যায়। টাকার দাম প্রতি বছরই কমে যাচ্ছে আর বিপরীতে পণ্যের দাম বছর বছর বেড়েই চলেছে। কিছুদিন আগেও একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে বাজারে গেলে যতটা চাল-ডাল-তেল-মসলা, ফলমূল, মাছ-মাংস কেনা যেত, এখন তার থেকে কম পরিমাণে কেনা যাচ্ছে। এক বছরের পণ্যের দামের সঙ্গে পরের বছরের দাম মিলছে না। বাড়ছে সীমাহীন গতিতে।
টাকার দাম পড়ে যাওয়ার আর একটা মানে হলো, টাকার তুলনায় আমেরিকান ডলারের দাম বাড়ছে। অর্থাৎ, প্রতিটি ডলার কিনতে বছর ঘুরলেই বেশি টাকা লাগছে। তাই আমদানিপণ্যের মূল্য বাড়ছে। এক বছরের চিত্রটা দেখলেই বোঝা যাবে বছর বছর কীভাবে দাম বাড়ছে। এপ্রিল মাসে দেশে খুচরো পণ্যের বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৭৯ শতাংশ। তার মানে, ২০২১ সালের এপ্রিলে খুচরো বাজারে জিনিসপত্রের দাম যা ছিল, তার তুলনায় ২০২২-এর এপ্রিলে জিনিসপত্রের দাম ৭.৭৯ শতাংশ বেড়েছে। তুলনার জন্য উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০২২-এর মার্চ মাসে মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৯৫ শতাংশ, আর ২০২১-এর এপ্রিল মাসে ৪.২৩ শতাংশ। জরিপে দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে বেশি হারে। ২০২২-এর এপ্রিলে শহরাঞ্চলে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হার ৭.০৯ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলে ছিল ৮.৩৮ শতাংশ। অবাক ব্যাপার হলো, পাহাড়ি এলাকায় মূল্যবৃদ্ধির হার আরও বেশি।
আবার সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার অনেক বেশিগ্রামে ৮.৫ শতাংশ আর শহরে ৮.০৯ শতাংশ। অর্থাৎ, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিই মূলত খুচরো বাজারে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হারটাকে ঠেলে তুলে দিচ্ছে। বছর বছর পণ্যের দাম যেমন বাড়ছে, তেমনি একবার কোনো কিছুর দাম বাড়লে আর তা কমে না। চাল, ডাল, আটা, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যেরই দাম বেড়েই চলেছে আর টাকার মূল্য যাচ্ছে কমে।
আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে নিজেদের অযোগ্যতা, দায়িত্ব অবহেলা এবং দুর্নীতিকে আড়াল করার চেষ্টা করে থাকে ক্ষমতাসীনরা। বিশ্ববাজারের প্রভাবটি অমূলক নয়। তবে দায় স্বীকারের উদাহরণ দেওয়া হয় না। যেমন অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়ায় ব্রিটেনে তিন মাসের মধ্যে তিনজন প্রধানমন্ত্রীর পেয়েছে তারা। প্রথমে বরিস জনসন পদত্যাগ করলেন; ৪৫ দিন ক্ষমতায় থাকার পর লিজ ট্রাস আত্মসম্মান রক্ষার্থে পদত্যাগ করলেন। এরপর এ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন ঋষি সুনাক। কিন্তু আমাদের দেশে দায়গ্রহণ ও পদত্যাগের এ রকম কোনো নজির নেই। মূল্যবৃদ্ধি সত্ত্বেও ক্ষমতাসীনরা তাদের সাফল্যের বর্ণনা দেন, আর জনগণ অমøান বদনে শুনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন।
তাই তো দীর্ঘ ৫০ বছরেও নানা সূচকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হলেও বণ্টনজনিত বৈষম্যের কারণে দুর্দশা ও দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি ছাড়া জনগণ খুব বেশি কিছু পায়নি। উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করেছে এবং করছে একটি ক্ষুদ্র শ্রেণি। মাত্র দুজন কোটিপতি দিয়ে যাত্রা শুরু করা স্বাধীন বাংলাদেশে এখন কোটিপতির সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, বৃদ্ধি পেয়েছে পুঁজির কেন্দ্রিকতা আর আয়-বৈষম্য। এর ফলে ২০২২ সালেও মূল্যস্ফীতির প্রচণ্ড চাপের মধ্যে অতিবাহিত করেছে বাংলাদেশ। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে অসহনীয়ভাবে। দুটি কারণে এমনটি হয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে বাজার তদারকির ব্যর্থতা। ফলে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণহীনভাবে দাম বাড়িয়েছে। অন্য কারণটি হলো টাকার অবমূল্যায়ন। তাই বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি আক্রমণ করেছে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমতে শুরু করেছে, জ্বালানি তেলের দামও নিম্নমুখী। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের নেতিবাচক দিকটিও গেল বছরের মতো প্রতিফলিত হবে না। তবুও দাম কমবে বলে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু দেখা যাচ্ছে না।
কৃষির সাফল্য নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও কৃষির ভালো অবস্থা কিংবা ভালো ফলন মানেই কৃষি মজুরের ভালো অবস্থা নয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) এবং ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইরি) যৌথ এক গবেষণা প্রতিবেদনে কৃষি মজুরদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে। তারা ক্রয়ক্ষমতা পরিমাপক হিসেবে চাল ক্রয়ের সক্ষমতাকে বিবেচনা করেছেন। তাদের ২০১৯ সালের পর থেকে গত চার বছরে দৈনিক মজুরিভিত্তিক কৃষিশ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা ৩৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ কমে গেছে। ২০১৫ সাল থেকে কৃষি মজুরের ক্রয়ক্ষমতা বাড়তে থাকে এবং ২০১৯ সালে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। এরপর থেকে ক্রয়ক্ষমতা কমতে কমতে বর্তমানে ২০১৫ সালেরও নিচে নেমে গেছে। ২০১৫ সালে একজন শ্রমিক তার দৈনিক শ্রমলব্ধ মজুরি দিয়ে ১০ দশমিক ১ কেজি চাল কিনতে পারতেন। ২০১৬ সালে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং দৈনিক মজুরি দিয়ে তা ১০ দশমিক ৬ কেজিতে উন্নীত হয়। এভাবেই ২০১৯ সালে তা সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৪ কেজিতে দাঁড়ায়। এর পরের বছর থেকেই কমতে থাকে কৃষিশ্রমিকের ক্রয়ক্ষমতা। ২০২০ সালে একজন কৃষিশ্রমিক দৈনিক মজুরি দিয়ে চাল কিনতে পারতেন ৯ দশমিক ১ কেজি; ২০২১ সালে তা নেমে আসে ৮ দশমিক ৬ কেজিতে আর ২০২২ সালে তা ৮ দশমিক ৫ কেজিতে নেমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে খানাপ্রতি বার্ষিক ব্যয়ের প্রায় ৩৪ শতাংশ যায় খাদ্যের পেছনে। এ খাদ্যব্যয়ের ৪১ শতাংশের বেশি ব্যয় হয় চাল কেনা বাবদ। গত তিন বছরে দেশে চালের দাম বেড়েছে ৬৭ শতাংশ, যা গোটা এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। তাই চালের মূল্যবৃদ্ধি নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে কমিয়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ নিয়েই ২০২২ সাল শেষ হয়েছে। গত বছর প্রতি মাসে গড়ে ১ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ কমে গেছে। গত এক দশকে এটাই ছিল অর্থনীতির ওপর সবচেয়ে বড় চাপ। সেই আশঙ্কা এখনো কাটাতে পারছি না আমরা। যদিও অর্থমন্ত্রী আশ্বস্ত করে বলেছেন, রিজার্ভ এখন ৩৪ বিলিয়ন ডলার। উন্নয়ন সহযোগীদের হিসাব মতে, কমপক্ষে তিন মাসের আমদানিব্যয় মেটানোর রিজার্ভ থাকতে হয়। এ কথায় আশ্বস্ত হতে পারলে ভালো লাগত, কিন্তু তা হওয়া কঠিন। রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব উল্লিখিত অঙ্কের চেয়ে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কম হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। রিজার্ভের পরিমাণ তো এক বছর আগেও ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৩ হাজার ২৫৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এর বিপরীতে রপ্তানি করা হয়েছে ২ হাজার ৭৪ কোটি ডলার। এর অর্থ হলো, ১ হাজার ১৭৯ কোটি বা ১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়বে জনজীবনে প্রকটভাবে। এর সঙ্গে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে দুর্দশা আরও বাড়িয়ে তুলবে।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট
‘সদা সত্য কথা বলবে’, ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ’, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’এমন কিছু ভালো ভালো কথা বাসার খাতায় লিখে আমাদের হাতের লেখা ঠিক করতে হতো সেই ছোটবেলায়। এর ফলে যেমন হাতের লেখা ভালো হয়েছে, তেমন আমাদের সতর্ক করা হয়েছে কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ। ভালো বন্ধু একজন ব্যক্তির জীবনে ভালো প্রভাব ফেলে। এই কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, সবকিছুই যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বাবা-মা সারা দিন তাদের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন। সেজন্য সন্তানদের সময় দেওয়া তাদের পক্ষে অনেকটাই অসম্ভব। সমাজের নানান কারণে কিশোর-কিশোরীরা আজ হতাশায় নিমজ্জিত। ফলে সেই হতাশা থেকেই তারা নানান নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে, তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে আজ একে অন্যের সঙ্গে খুব দ্রুত মিশে যেতে পারছে, দ্রুত আদান-প্রদান হচ্ছে তথ্য। ফলে নষ্ট হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি। বাবা-মা চাইলেও তাদের পাহারা দিয়ে রাখতে পারছেন না। অনেক পরিবার চাইলেও সারাক্ষণ সন্তানের সঙ্গে লেগে থাকতেও পারছেন না। আবার লেগে থাকলেও দেখা যাচ্ছে যে সন্তানরা নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। একা একা তারা কোনো কাজ করতে পারে না বা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। শুধু বাংলাদেশ না, সারা বিশ্বের মানুষ এখন কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে চিন্তিত।
কে কখন কবে কার সঙ্গে মিশে নষ্ট হবে সেই চিন্তা সব বাবা-মার। বাবা-মা ভাবেন কিশোর-কিশোরীদের যদি একটা ভিত্তির ওপরে দাঁড় করানো যায়, তাহলেই তাদের জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সুযোগ আসে এবং জীবন সঠিক পথে চলতে পারে। জীবনে চলার পথে কখনো কখনো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এর জন্য একটি উপদেশ বার্তা সমাজে প্রচলিত যে, ‘নিজেকে মূল্যায়ন করো, সুন্দর বাছাইগুলো সম্পন্ন করো।’ এসব পছন্দের মধ্যে জীবনের অনেক দিক অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত হবেজাগতিক, আধ্যাত্মিক, আবেগবিষয়ক, সামাজিক, সততাবিষয়ক ইত্যাদি। জীবনের কঠিন পরিস্থিতিগুলোর জন্য অনেক সময় শিশু-কিশোরদের দায়ী করা হয়। কিন্তু কেন তারা এ অবস্থায় পড়েছে, সেটি আমরা চিন্তাভাবনা করি না।
আমরা যারা নিজেদের সামাজিক অবস্থানকে অপব্যবহার করি এবং ভুল আচরণ করি, তারা শুধু শিশুদের চেতনাই নষ্ট করি না, বরং শিশু-কিশোর-তরুণদের সামনে মূল্যবোধের নেতিবাচক আদর্শ গঠন কখন করি নিজেরাই টের পাই না। এর ফলে তাদের গোটা জীবনটাই ভুল মূল্যবোধ ও নেতিবাচক পথে চালিত হওয়ার আশঙ্কা এবং সুযোগ তৈরি হয়। আমাদের আশপাশে এমন অনেক ছেলেমেয়েকে দেখি, যারা বেঁচে থাকার জন্য এবং জীবিকার জন্য বছরের পর বছর ধরে ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তা ও দেশের অন্যান্য স্থানে বাস করছে। তাদের ঘরে এবং বাইরে অর্থাৎ সামাজিকভাবে নানা রকম নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়। এরা রাস্তায় গিয়ে নেশাদ্রব্য কিনে মাদক সেবন শুরু করে এক ধরনের হতাশা থেকে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ শিশুদের জীবনের মৌলিক ভিত্তি গড়তে শুধু তাদের শিক্ষার বন্দোবস্ত করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন, কিন্তু তাদের সঠিক আচার-আচরণ ও অহিংস প্রতিক্রিয়া ও ক্রিয়া শেখাচ্ছেন না। এই শিশু-কিশোররা কখনো কখনো প্রান্তিক শিশু হয়ে রাস্তায় বসবাস করে বেঁচে থাকে। দেশে শিশু সুরক্ষা আইন রয়েছে, কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ আছে কি?
এ কথা ধ্রুব সত্য যে, ‘যেখানে যন্ত্রণা নেই, সেখানে অর্জনও নেই’। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে মাদক কখনো কোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। মাদক সেবন করে সমস্যার সমাধান করতে গেলে সেই সমস্যা শুধু আরও জটিল, কঠিন ও বিধ্বংসী রূপ নেয়। কোনো সমস্যা মোকাবিলার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে মা-বাবা, কোনো শিক্ষক বা নির্ভরযোগ্য অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সেটি নিয়ে আলোচনা করা, যার সামর্থ্য রয়েছে সমস্যাটি সমাধানে প্রয়োজনীয় সাহায্য করার।
সুন্দর জীবনের পথে অত্যন্ত মূল্যবান সোপান হিসেবে আরেকটি সেøাগান রয়েছে : ‘অসৎ সঙ্গ পরিত্যাগ করো’। শিশু-কিশোরদের বেড়ে ওঠার অংশ হিসেবে তাদের সঙ্গে সমবয়সী বন্ধু-বান্ধবের যোগাযোগ ঘরে-বাইরে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। পরিবারকে শিশু-কিশোরদের সতর্ক হতে সহায়তা করতে হবে, তা না হলে তারা কখনো কখনো এমন কারও দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, যাকে ভালো বন্ধু বলে মনে হলেও আসলে সে একটি ‘অসৎ সঙ্গ’। একজন সত্যিকারের বন্ধু অন্যকে সৎ সহায়তা ও ভাবনাবিনিময়ের মাধ্যমে বড় হয়ে উঠতে সাহায্য করে। আমাদের সজাগ থাকতে হবে নিজেদের আচার-আচরণ, ভাষা, প্রতিক্রিয়া ও বন্ধুদের সম্পর্কে। এ ছাড়া যেসব স্থানে আমরা যাতায়াত করি, তার ব্যাপারে সত্যিকারের ‘উপকারী বন্ধুর’ বক্তব্যও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। আমার জীবনে মা-বাবা ছাড়া তিন-চারজন সত্যিকারের উপকারী বন্ধু ও শিক্ষক রয়েছেন, যাদের কাছ থেকে আমি শিখেছি অনেক মূল্যবোধ ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে। আমি এখনো তাদের স্মরণ করি এবং সবচেয়ে মূল্যবান ‘উপকারী বন্ধু’ বলে মনে করি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসব বন্ধু বা উপদেশদাতার সংখ্যা অনেক কমেছে। তরুণ বয়সে অনেকেই খুব আদর্শবাদী এবং অপরের জন্যও কিছু করতে কঠোর মনোবল নিয়ে কাজ করতে চায়। কখনো কখনো তাদের কেউ বড় হয়। তখন তারা অন্যকে সহায়তার মতো তরুণ বয়সের বিভিন্ন আদর্শ ভুলে যেতে শুরু করে এবং স্বার্থকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে থাকে। তারা অভাবগ্রস্ত মানুষের সহায়তার পরিবর্তে খ্যাতি ও নামের মোহে আটকা পড়ে। আমি তরুণদের আদর্শবাদী লক্ষ্যে অবিচল থাকতে উৎসাহ জোগাতে চাই।
যেসব মূল্যবোধ ও নীতি কেউ তরুণ বয়সে গ্রহণ করতে পারে এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে চর্চা শুরু করে, সেগুলো তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তি হয়ে যায় এবং সেই জীবনের সহযোগিতা নিয়ে তাদের পরিবার, সম্প্রদায়, দেশ এবং অন্যরা সমৃদ্ধ হয়। আমি শেষ করছি এ কথা দিয়ে : ‘যদি প্রথমেই সাফল্য না পাও, চেষ্টা করো, চেষ্টা করো এবং চেষ্টা করো বারবার এবং আগে হোক, পরে হোক, সফল তুমি হবেই।’
লেখক : ব্যাংকার ও গবেষক
যেকোনো জাতির গতিপ্রবাহের সব বাঁক নির্ধারণ করেন রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকরা। স্রোতোধারা তথা আমজনতা জানেই না সামনের বাঁকটির পর কী অপেক্ষা করছে। জীবন-নদীর মানচিত্র তৈরি হয় নীতিনির্ধারক দ্বারা। তাই সমাজের চরম অবক্ষয়ের দায় তাদের ওপরই বর্তায়। এই ক্রান্তিলগ্নে করোনার হিংস্র থাবা আর ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ব মানচিত্র আজ রক্তাক্ত-ক্ষতবিক্ষত। বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতির চাকা থমকে আছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও বিশ্ব রাজনীতির খেলা থেমে নেই। চীনের উত্থানের কারণে সমগ্র এশিয়া মহাদেশে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বব্যাপী অনেক দেশের অর্থনৈতিক সফলতার মিথগুলোও উলঙ্গ হয়ে পড়ছিল। সে তালিকায় আছে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশও। নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এত দিন এসব দেশকে টাইগার হিসেবে দেখাচ্ছিল। অথচ এখন আইএমএফের কাছে তাদের হাঁটুমুড়ে প্রার্থনায় বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কা ছাড়াও অন্তত আরও দুটি দেশ বিদেশি দেনার ফাঁদে আছে এ অঞ্চলে। এসব দেশের নীতিনির্ধারকরা পরিস্থিতির জন্য ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করে যাচ্ছেন ক্রমাগত।
কিন্তু যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে এসব দেশের বাজার সিন্ডিকেটগুলো নতুন উদ্যমে সাধারণদের পকেট কেটে যাচ্ছে। ঠিক এ কারণেই আঙ্কটাডের হিসাবে এ বছর বিশ্ববাজার প্রায় ৩২ ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করলেও আন্তর্জাতিক অর্থনীতির গতি বিপজ্জনকভাবে নিম্নমুখী। গত ১০ মাসে ইউক্রেন যুদ্ধে ৪২ হাজার ৩০০ মানুষ মারা গেছেন, নিখোঁজ আরও ১৫ হাজার। যুদ্ধই ছিল গত বছরের বড় খবর। ইউরোপবাসীকে নানা ধরনের জ্বালানি সংকটে নাস্তানাবুদ করেছে যুদ্ধ। ৭০ লাখ শরণার্থীও গ্রহণ করতে হয়েছে তাদের। বিশ্বের প্রতিটি রান্নাঘরকে এ যুদ্ধ বিপদে ফেলেছে। এ লড়াই বিশ্বের অন্যতম বড় সামরিক শক্তি রাশিয়াকে লজ্জায়ও ফেলেছে। ইউক্রেনের প্রচুর ক্ষতি করতে পারলেও দেশটিকে পদানত করতে সফল হয়নি তারা।
অন্যদিকে, এই দুর্যোগের ভেতর ইউরোপ-আমেরিকা-চীনের সামরিক শিল্পে দারুণ প্রবৃদ্ধিও ঘটে যায়। যুদ্ধাস্ত্রের বৈশ্বিক বাজারের আকার আগের বছরে ছিল ৪৭৫ বিলিয়ন। ২০২২-এ হলো ৫১৪ বিলিয়ন। বৃদ্ধি প্রায় ৮ ভাগ। সরবরাহ ব্যবস্থায় নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেই তাদের এই প্রবৃদ্ধি চলছে। অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের অগ্রযাত্রা থামাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাধা-নিষেধ কিছুটা কাজ করলেও পশ্চিমের অবরোধে রাশিয়া প্রত্যাশামতো বিপদে পড়েনি এ বছর। বরং ওয়াশিংটনের চাপ মস্কো-পেইচিংকে কাছাকাছি এনেছে। বহুকাল অর্থনৈতিক গোলকায়নের শোরগোল দেখেছে বিশ্ব। এখন শেষমেশ অর্থনৈতিক-জাতীয়তাবাদ মদদ পাচ্ছে বড় শক্তিদের কাছে। কিছু দেশ চেষ্টা করছে ডলারভিত্তিক লেনদেনের পরাধীন দুনিয়া থেকে মুক্ত হতে। কিন্তু প্রায় সব অর্থনীতিবিদের অনুমান, আগামী বছর বিশ্ব অর্থনীতি খারাপ হবে। একের পর এক অর্থনৈতিক দুঃসংবাদের পাশাপাশি অবিশ্বাস্য গতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ঠা-া যুদ্ধের রণধ্বনিও বাড়ছিল এ বছর। তাইওয়ানকে ঘিরে ওয়াশিংটন ও পেইচিং নিয়মিত বাগ্বিতণ্ডায় লিপ্ত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের শাসকরা অতীতের অস্পষ্টতা এড়িয়ে এ বছর খোলাখুলিভাবে তাইওয়ানের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। চীন তার উত্তর দিয়েছে নিয়মিত তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘনের জন্য যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে। তৃতীয় মেয়াদে দল ও সরকারপ্রধান হয়ে চীনের নেতা সি চিন পিংয়ের সামনে তাইওয়ানকে আয়ত্তে আনাই যেন প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। একই সময় যুক্তরাষ্ট্রের চীননীতিও আমূল বদলে গেছে। এ বছরে ভূরাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এটা। সেই সূত্রে আন্তর্জাতিক উত্তেজনার যাবতীয় উপাদান ক্রমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জড়ো হচ্ছে। তার আঁচ লেগেছে বাংলাদেশের গায়েও। শক্তিধর দেশগুলোর ঢাকায় অবস্থিত দূতাবাসের প্রচার-প্রচারণাতেও ঠা-া যুদ্ধের উত্তপ্ত আলামত দেখা যাচ্ছিল বছর শেষে। ইউক্রেন ও ইরানের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার ঘটনাবলিও এ বছর বিশ্ব মনোযোগ পেয়েছে। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে নিয়মিত।
যুদ্ধের পরিস্থিতি তো সর্বত্রই বিদ্যমান। বাণিজ্যযুদ্ধ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বেধেছে আমেরিকা ও তার মিত্রদেশগুলোর। ভুক্তভোগী হচ্ছে ইউক্রেনের মানুষ। শুধু ইউক্রেনের কেন, বিশ্বের সব মানুষই নিদারুণ কষ্টে পড়েছে। জ্বালানি সংকট, খাদ্য উৎপাদন হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি, মাদক, পর্নোগ্রাফিসবকিছু আঘাত করছে মানুষকে। লাভ হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। আর অত্যাশ্চর্য সব রাজনৈতিক ঘটনা তো ঘটেই চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইতালিতে মুসোলিনিপন্থিরা আবার রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তগত করবেএটা এর আগে কি ভাবা গেছে? টালমাটাল ঘটনা ঘটেছে গ্রেট ব্রিটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসেও। তিন মাসে সেখানে তিনজন প্রধানমন্ত্রী দৃশ্যমান হয়েছেন। বরিস জনসন বিদায় নেন নানা অভিযোগের বোঝা মাথায় নিয়ে। এলেন এক নারী; বয়স তার অল্পই, কিন্তু টিকলেন মাত্র ৪৫ দিন। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করার ব্যর্থতার মুখে বিদায় হলেন আত্মসম্মান রক্ষা করে। এবার তার চেয়েও কম বয়সের এমন একজন এসেছেন, জাতি দাম্ভিক ইংরেজদের রাষ্ট্রশাসনের ইতিহাসে যার প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা এত দিন পর্যন্ত ছিল একেবারেই অকল্পনীয়। কিন্তু তাই বলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, এমনটা কোনো ইংরেজ কবে ভেবেছিল? তবে এটাই তো বাস্তবতা, নইলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন কেন? আর তিনি যে অযোগ্য, তাও নিশ্চয়ই নয়। অযোগ্য হলে তাকে বেছে নেওয়া কেন? অবশ্যই যোগ্য। বয়স যার মাত্র ৪২। কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী হলেন তিনি। এদিকে ব্রিটিশ লেবার পার্টিতে বামপন্থি যারা ছিলেন, তারা এখন ঠেলাধাক্কার মধ্যে রয়েছেন। বছরের শেষ প্রান্তে ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সেই নেতানিয়াহু, যার বিরুদ্ধে দেশের আদালতে দুর্নীতির মামলা এখনো চলমান। নিজে তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণেই দক্ষিণপন্থি।
সুইডেন তো এতকাল তার উদারনীতির জন্যই বিশ্বখ্যাত ছিল। কিন্তু সেখানেও দক্ষিণপন্থিরা ক্ষমতায় বসে গেছে। ঘটনা একই। পুঁজির হাতে মেহনতিদের লাঞ্ছনা; মুনাফালিপ্সার কাছে মনুষ্যত্বের পরাজয়। সর্বত্র ওই একই ব্যাপার। বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদের যে উন্নয়ন ঘটেছে, তাতে মেহনতিদের দশা তো হয়েছে তেলাপোকার মতোই।
বিশ্বে শীর্ষ ধনীদের একজন হচ্ছেন ইলন মাস্ক। তিনি টুইটার প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেন। নিয়েই ঠিক করেন প্রতিষ্ঠানের আরও উন্নতি ঘটাবেন। তার জন্য প্রথম চোটেই অর্ধেক কর্মচারীকে ছাঁটাইয়ের নোটিস দিয়ে দেন। অন্যদের বলেন, কর্মঘণ্টা বাড়াতে হবে। সবকিছুই অবশ্য উন্নয়নের স্বার্থে। আর উন্নয়নের অর্থ হচ্ছে মালিকের মুনাফার স্বার্থ নিশ্চিত করা। অর্থনৈতিক সংকটে সহিংসতা বাড়ছে।
বাংলাদেশেও মানুষের ওই একই দশা। মেহনতিরা শ্রম করে, সুবিধাভোগীরা শ্রমের ফসল হাতিয়ে নেয়, কিছুটা ভোগবিলাসে খরচ করে বাকিটা পাচার করে দেয়। আরব মূল্যবোধ সঙ্গে নিয়েই কাতার, আরব আমিরাত ও সৌদি আরব বিশ্ব পরিসরে বড় ভূমিকা নিতে চাইছে। সামাজিক এ রূপান্তরকে এগিয়ে নিতে কাতারকে ২২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হলো। বিশ্বকাপের পাশাপাশি বিগত বছরের বড় প্রাপ্তি ছিল মহামারীর হয়রানি থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত হওয়ার সুযোগ। যদিও কভিড-১৯ একেবারে বিলীন হয়নি, কিন্তু বিধিনিষেধ অনেকটাই এখন স্মৃতি। মৃত্যুর নিয়তি নয়, মানুষ আবার বিশ্বসংসারের লাগাম নিতে পারল। তবে এর মধ্যে শ্রেণিযুদ্ধটাও বহাল তবিয়তে আছে। ব্রাজিলে বামপন্থি লুলা দ্য সিলভার ফিরে আসা মোকাবিলা হলো একই অক্টোবরে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক কর্র্তৃক ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে টুইটার কিনে নিয়ে। মাঠের লড়াই বনাম বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের চলমান এসব সংঘাত বিশ্বজুড়ে আরও নানা চেহারায় হাজির ছিল ২০২২ সালে। রাশিয়ার লৌহমানব পুতিন দীর্ঘদিন ধরেই দেশটির একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে আছেন। সমাজতান্ত্রিক চেহারার এ দেশে কার্যত অন্য দলের সক্রিয়তার খবর খুব একটা পাওয়া যায় না।
বিশ্বের সামগ্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটের মূলে কাজ করছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। সম্প্রতি প্রকাশিত অক্সফামের রিপোর্টে দেখা গেছে বিশ্বের ৮২ ভাগ সম্পদের মালিক ধনিক শ্রেণিভুক্ত মাত্র একভাগ মানুষ। আর এই ধনকুবেরদের ঠিকুজি খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, বিশ্বের বেশিরভাগ সম্পদ গুটিকয়েক পরিবারের হাতে। পুঁজিবাদের অনিয়ন্ত্রিত ও বল্গাহীন বিকাশের কারণে একই প্রকার সামাজিক ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার আওতায় থেকেও মানুষে মানুষে ব্যাপক পার্থক্য এবং বঞ্চনাবোধের মনোজাগতিক বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যে নতুন মানবিক সত্তার জন্ম হয়েছিল সে সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা না থাকলে অর্থনৈতিক সংকট ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ অসম্ভব হবে।
বিশ্বরাজনীতিতে আজ দেখা দিয়েছে এক নতুন মেরুকরণের। বিশ্বায়ন-অনুসৃত এ পরিবর্তন অবশ্য একমাত্র পরিবর্তন নয়, পাশাপাশি চোখে পড়ে তার আরও এক রূপ, সেটি হলো নিরাপত্তাহীনতা। আবেগকেন্দ্রিক বিশ্লেষণের রেওয়াজ যে একেবারে আকস্মিক, তা কিন্তু নয়। অতীতে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতির বিশ্লেষণে অনেকেই আবেগের প্রভাবে সম্মোহিত হয়েছেন। আবেগের তীব্র অনুভূতির সামাজিক ও শৈল্পিক মূল্য সম্পর্কে উল্লেখ আছে প্লেটো থেকে হবস ও কান্ট থেকে হেগেলের ভাববাদী দর্শনে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্পবিপ্লব এবং প্রজ্ঞার বিজয় দিয়ে যে আধুনিক সমাজের জন্ম হয়, এর অতিমাত্রিকতায় ক্লান্ত হয়ে অনেক কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিক আবেগভিত্তিক নতুন আন্দোলন গড়ে তোলেন প্রজ্ঞার রাহু থেকে মুক্তির আশায়।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত নাট্যকার সেলিম আল দীন। তিনি ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট সীমান্তবর্তী ফেনী জেলার অন্তর্গত সোনাগাজী উপজেলার সেনেরখিল গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘদিন বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করার পর ১৯৮৬ সালে তিনি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে যোগদান এবং ওই বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের বিচিত্র শ্রমজীবী, পেশাজীবী, বাঙালি ও বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সমাজজীবন ও তাদের আবহমানকালের সংস্কৃতিকে তিনি তার নাটকে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিদান করেছেন। জীবদ্দশায় তিনি একজন নাট্যকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও সমকালীন বিশ্বের শিল্পধারায় নতুন নন-জেনরিক শিল্পধারার প্রবর্তনে সচেষ্ট ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গঠন করেন ঢাকা থিয়েটার ও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার। তার রচিত হরগজ নাটকটি সুইডিশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এ নাটকটি ভারতের রঙ্গকর্মী নাট্যদল কর্র্তৃক হিন্দি ভাষায় মঞ্চস্থ হয়েছে। সেলিম আল দীনের নাটক ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। তার উল্লেখযোগ্য নাটক ও নাট্যগ্রন্থসর্পবিষয়ক গল্প ও অন্যান্য নাটক, জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, বাসন, তিনটি মঞ্চ নাটক : মুনতাসির, শকুন্তলা ও কিত্তনখোলা; কেরামতমঙ্গল, প্রাচ্য ইত্যাদি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য কেবল শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পাঠ দেওয়া নয়; বরং জ্ঞানচর্চা করা, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিবিড় আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে সেই জ্ঞানের চর্চা হবে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণার মধ্য দিয়ে নতুন জ্ঞান বিকাশের পথ তৈরি হবে। এ জন্য শ্রেণিকক্ষের মতো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও মুক্ত পরিসর সমান জরুরি। এই মুক্ত পরিসর কেবল ভৌত অর্থে স্থান নয়; বরং সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক জ্ঞানতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিসর। কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একদিকে গবেষণাহীনতার কারণে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে পারছে না আর অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন মুক্ত পরিসরও ক্রমাগতই সংকুচিত হচ্ছে। বলা ভালো সংকুচিত হতে হতে তা বিশ্ববিদ্যালয়-সংক্রান্ত মৌলিক ধারণাকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এসব কারণেই সম্ভবত সাম্প্রতিককালে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর মুখেই এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল যে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?’ কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, এই প্রশ্নের কারণে তাকে হেনস্তার শিকার হতে হলেও বিদ্বৎসমাজ কিংবা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারক মহলে বিষয়টি নিয়ে কোনো গুরুতর আলোচনা আমরা দেখিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজসংক্রান্ত এই মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা না হলেও বাস্তবতা যে খুবই করুণ, তা দেশ রূপান্তরের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। শুক্রবার ‘প্রায় পাঠশালা ৮২ বিশ্ববিদ্যালয়’ শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশের সরকারি-বেসরকারি ১৫৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৩টি গবেষণায় এক টাকাও ব্যয় করেনি। আর ৪৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার নামে ১০ লাখ টাকার নিচে লোক দেখানো ব্যয় করেছে। এমনকি একটি শিক্ষাবর্ষে ৫৭টি বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রকাশনাও বের করতে পারেনি। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার এই চিত্র অত্যন্ত হতাশাজনক বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, গবেষণায় এক টাকাও ব্যয় না করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ৬টি সরকারি ও ২৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আর ১০ লাখ টাকার নিচে ব্যয় করেছে ৭টি সরকারি ও ৪২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরে কোনো গবেষণা নিবন্ধ বের হয়নি। বেসরকারির ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ৪২। তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই গবেষণার খাতায় নাম ওঠাতে লোকদেখানো ব্যয় করেছে। যাতে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয় না, এ কথা কেউ বলতে না পারে। এ জন্য তারা ছলচাতুরী করে গবেষণা খাতে ৫০ হাজার, ১ লাখ, ২ লাখ টাকার মতো ব্যয় করে ইউজিসির তালিকায় নাম তুলেছে। এই বাস্তবতা সম্পর্কে শিক্ষাবিদরা যে মন্তব্য করেছেন তা যথার্থই বলতে হবে। তারা বলছেন যে গবেষণাহীন বিশ্ববিদ্যালয়কে পাঠশালা বলাই শ্রেয়। ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা না হওয়াটা দুঃখজনক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কম-বেশি গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ হয়। বিজ্ঞান ও কৃষিতে আমাদের ভালো গবেষণা হয়। আর বেসরকারি ১৫ থেকে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় ভালো; অর্থাৎ বাকি ৭০ থেকে ৮০টি বিশ্ববিদ্যালয় হলো পাঠশালা। প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করলে আরও দেখা যাচ্ছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গবেষণায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তবে টাকার অঙ্কে তা মাত্র ৮ কোটি। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ২০২১ সালে ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় মোট ব্যয় ছিল ৭৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ফলে বাকি অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও গবেষণায় নামমাত্র ব্যয় করেই দায় সেরেছে। অন্যদিকে, গবেষণার দিক দিয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ছাড়িয়ে অনেক দূরে গেছে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বোচ্চ ৫৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা গবেষণায় ব্যয় করে সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষে স্থান নিয়েছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া গবেষণায় উল্লেখযোগ্য ব্যয় করেছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি এবং আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।
প্রশ্ন হলো, বিপুল ব্যয়ে একের পর এক এমন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত কাজ শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে না কেন? সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যদি ইউজিসির গবেষণা বরাদ্দের গড় করা হয়, তাহলে প্রতিটি প্রকল্পের জন্য গড়ে বরাদ্দ মাত্র সাড়ে ১৭ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে গবেষণা হয় না। তাই শিক্ষকরা বরাদ্দ নিলেও বেশির ভাগই প্রকৃত অর্থে কোনো গবেষণা না করে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়ে দায় সারেন। দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দই সবচেয়ে কম। জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বাজেট বরাদ্দ মাত্র ২ শতাংশ। যদিও ইউনেসকোর পরামর্শ, দেশগুলো যেন শিক্ষা খাতে কমপক্ষে জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়। এর ওপর যদি অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয়েই শিক্ষা খাতের বরাদ্দের সিংহ ভাগ চলে যায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণা করবেন কীভাবে? আর গবেষণাহীন বিশ্ববিদ্যালয় দেশকে কী দেবে?
ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈলে জেলেখা বেগম নামে এক বৃদ্ধাকে মৃত দেখিয়ে তার বয়স্ক ভাতার কার্ড বাতিল করা হয়েছে। বিগত ৫ মাস যাবৎ তিনি বয়স্ক ভাতা বঞ্চিত রয়েছেন বলে জানা গেছে। অপরদিকে তার নাম পরিবর্তন করে আমিনা নামে অন্যজনকে বয়স্ক ভাতার কার্ড বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় মেম্বার বাদশার বিরুদ্ধে।
রানীশংকৈল উপজেলার নন্দুয়ার ইউনিয়নের সাতঘরিয়া গ্রাম এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জেলেখা বেগম নন্দুয়ার ইউনিয়নের সাতঘরিয়া গ্রামের আ. রহিমের স্ত্রী। পূর্বের চেয়ারম্যান ওই বৃদ্ধার নামে বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দেন।
ভুক্তভোগী বলেন, আমি ভাতার কার্ড পাওয়ার পর থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর ১৫০০ টাকা করে পেয়েছিলাম। কিন্তু গত তারিখে আমার টাকার কোনো মেসেজ না আসায় আমি উপজেলা সমাজসেবা অফিসে গিয়ে জানতে পারি আমাকে মৃত দেখিয়ে আমিনা নামে ভাতার কার্ড করে দিয়েছেন মেম্বার বাদশাহ।
ইউনিয়ন পরিষদে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৃত্যুর নিবন্ধন বইয়ের ২০২১ সালের রেজিস্ট্রারে বৃদ্ধার মৃত্যু নিবন্ধিত নেই। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এমন একটি সনদ দেওয়ায় তার ভাতাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তিনি এ বিষয়ে আরও বলেন, আমি জীবিত থাকার পরও মেম্বার বাদশাহ আমাকে মৃত দেখিয়ে আরেকজনের নামে কিভাবে টাকা খেয়ে ভাতার টাকা পরিবর্তন করে দেয়! আমি জীবিত থাকার পরও মেম্বার আমাকে মৃত দেখাল। আমি গরিব মানুষ। আমার কোনো ছেলেমেয়ে নাই। এই টাকা দিয়ে ওষুধ খেয়ে বেঁচে আছি। আমি এর বিচার চাই।
মেম্বার বাদশাহ বলেন, প্রথমবারের মতো এমন ভুল করেছি। সামনের দিকে সর্তকতার সাথে কাজ করব।
নন্দুয়ার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল বারী বলেন, জীবিত মানুষ মৃত দেখিয়ে ভাতার কার্ড পরিবর্তনের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তবে মেম্বার যদি করে থাকেন তাহলে খুবই খারাপ করেছেন।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুর রহিম বলেন, ইউপি চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরিত একটি প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে জানতে পারি, জেলেখা বেগম ৭ ডিসেম্বর ২০২১ এ মৃত্যু বরণ করেন। তাই ভাতাটি বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ওয়েবসাইটে মৃত্যু সনদ যাচাই ছাড়া সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর কাউকে মৃত দেখাতে পারবে না- সাংবাদিকের এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের এভাবেই হয়। আমরা এভাবেই করে থাকি, প্রত্যায়নপত্র দেখে প্রতিস্থাপন করে থাকি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমাজসেবা অফিসে প্রেরিত প্রত্যায়নটির কোনো তথ্য ইউনিয়ন পরিষদের ফাইলে সংরক্ষণ করা হয়নি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহেল সুলতান জুলকার নাইন কবির বলেন, এটি সংশোধনের কার্যক্রম চলমান। তদন্ত করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান বলেন, এটি একটি গুরুতর অভিযোগ। আমরা তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেব।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত করা, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠাসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে আজ রোববার ঢাকা ছাড়া সব মহানগরে পদযাত্রা কর্মসূচি করবে বিএনপি। আজকের পদযাত্রা কর্মসূচির মাধ্যমে সপ্তাহব্যাপী সরকারবিরোধী কর্মসূচির প্রথম ধাপ শেষ হচ্ছে দলটির।
এর আগে, গত ২৩ মে দেশের ১১টি মহানগরে ‘পদযাত্রা’ করে বিএনপি। ঢাকার বাইরে মহানগরগুলোতে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থাকবেন।
সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের ১০ দফাসহ দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, হয়রানি, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ ও অন্যান্য জনগুরুত্বপূর্ণ দাবিতে এই কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে দলটি।
সরকারের পদত্যাগ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন ও সংবিধান সংস্কারসহ ১৪ দফা দাবিতে আজ রোববার (২৮ মে) পদযাত্রা করবে ৬ দলীয় জোট (দল ও সংগঠন) গণতন্ত্র মঞ্চ। এদিন বেলা ১১টায় রাজধানীর মালিবাগ থেকে এই পদযাত্রা শুরু হবে, যা শেষ হবে বাড্ডায়।
গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রোববার ১১টায় রাজধানীর মালিবাগ রেলগেট থেকে বাড্ডা পর্যন্ত গণতন্ত্র মঞ্চের ঢাকা উত্তরের পদযাত্রা শুরু হবে। অবৈধ সরকারের পদত্যাগ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন ও সংবিধান সংস্কারসহ ১৪ দফা দাবিতে এ পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। মালিবাগ রেলগেটে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পদযাত্রা শেষ হবে।
পদযাত্রায় অংশ নেবেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম, জেএসডির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন পাটোয়ারীসহ গণতন্ত্র মঞ্চের কেন্দ্রীয় নেতারা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব শান্তির পক্ষে সোচ্চার ছিলেন এবং মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।
বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদক প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় তিনি এ কথা বলেন।
ড. মোমেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদক প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তি উৎসব আমাদের বিদেশস্থ সকল মিশনে উদযাপন করছি। জুলিও কুরি পদক ছিল জাতির পিতার কর্মের স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান।
তিনি বলেন, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে কারাবরণ করেন বঙ্গবন্ধু। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন বঙ্গবন্ধু মেনে নিতে পারেননি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলার নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে স্বাধীনতার ডাক দেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলার মানুষ দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর “সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বৈরীতা নয়”- এই বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু তার শান্তির বার্তা নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতিসংঘে এক নম্বর শান্তিরক্ষী দেশের মর্যাদা পেয়েছে। দেশে দেশে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে ‘শান্তির সংস্কৃতি’ চালু করেছে।
‘বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদক প্রাপ্তির ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনে আমাদের অঙ্গীকার হবে বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করে যাওয়া। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অর্জিত হবে’।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে।
অপারেশন ছাড়াই সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলায় আব্দুল মোতালেব হোসেন (৩৫) নামের এক মানসিক রোগীর পেট থেকে ১৫টি কলম বের করেছেন চিকিৎসক।
এ কাজ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সিরাজগঞ্জের শহীদ এম.মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুই চিকিৎসক। তাদের এই সাফল্যে রীতিমত হৈচৈ পড়ে গেছে নেট দুনিয়ায়।
এ বিষয়ে আব্দুল মোতালেবের মা লাইলী খাতুন বলেন, তার ছেলে মোতালেব খুব ভাল ছাত্র ছিল। ২টি লেটার মার্ক নিয়ে এসএসসি পাস করে কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। এরপর খারাপ সঙ্গদোষে সে আস্তে আস্তে মাদকাসক্ত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এরপর থেকে পথে ঘাটে ঘুরে বেড়ানোর সময় কুড়িয়ে পাওয়া কলমগুলি খাদ্য মনে করে খেয়ে ফেলে। বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। গত এক বছর ধরে তার শরীরে জ্বর ও পেটে ব্যথা শুরু হয়। অনেক চিকিৎসার পরও তা ভালো হচ্ছিল না। অবশেষে গত ১৬ মে তাকে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম. মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনে ভর্তি করি। এখানে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তার অসুখের কারণ ধরা পড়ে। পরে চিকিৎসকরা তার পেটের ভিতর থেকে বিনা অপারেশনে কলমগুলো বের করে।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. আমিনুল ইসলাম খান বলেন, মোতালেব হোসেন প্রথমে পেটে ব্যথা নিয়ে মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়। মেডিসিন ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা এক্সরে ও আল্ট্রাসনোগ্রাম করেও পেটে কি সমস্যা সেটা শনাক্ত করতে পারছিলেন না। ফলে রোগীটিকে আমার কাছে রেফার্ড করেন। এন্ডোস্কপির মাধ্যমে পরীক্ষা করে তার পেটের ভেতর ১৫টি কলম দেখে প্রথমে চমকে যাই। এটা কীভাবে সম্ভব। পরে এন্ডোস্কপির মাধ্যমেই অপারেশন ছাড়াই আমরা কলমগুলো বের করার সিদ্ধান্ত নেই। তিনি আরও বলেন, কাজটি আমাদের জন্য দারুণ চ্যালেঞ্জিং ছিল। কলমগুলো একে একে পাকস্থলীতে সেট হয়ে গিয়েছিল। কলমগুলো বের করতে আমাদের প্রথমে মাথায় চিন্তা ছিল যেন, কলমগুলোর কারণে কোনোভাবেই শ্বাসনালিতে গিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ না হয়ে যায়। এছাড়াও রক্তক্ষরণের একটা চিন্তাও মাথায় ছিল। অতঃপর প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আমরা কলমগুলো বের করে নিয়ে আসতে সক্ষম হই।
শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. জাহিদুল ইসলাম বলেন, এন্ডোস্কপি করা ব্যক্তি মানসিক অসুস্থ হওয়ায় তার কলম খাওয়ার অভ্যাস ছিল। এভাবে খেতে খেতে সে অনেক কলম খেয়ে ফেলে। কলমগুলো তার পেটের মধ্যে জমা হয়েছিল। আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে তার পেটের ভিতর ১৫টি কলম থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হই। এবং অপারেশন ছাড়াই এন্ডোস্কপির মাধ্যমে তার পেটের ভেতর থেকে একে একে ১৫টি আস্ত কলম বের করে আনি। বর্তমানে রোগীটি সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকদের অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং সুস্থ আছেন।
তিনি আরও বলেন, এন্ডোস্কপির মাধ্যমে মানুষের পেট থেকে কলম বের করার মতো ঘটনা বাংলাদেশে এটাই প্রথম। তাও আবার একটি-দু‘টি নয় ১৫টি কলম। এর আগে ঢাকা মেডিকেলে এক ব্যক্তির পেট থেকে এন্ডোসকপির মাধ্যমে একটি মোবাইল বের করেছেন চিকিৎসকরা।
এ বিষয়ে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে এমন সাফল্য এটাই প্রথম। আমরা অত্যাধুনিক ভিডিও এন্ডোস্কপি মেশিনের মাধ্যমে এবং আমাদের দক্ষ ডাক্তার দ্বারা অপারেশন ছাড়াই শুধু এন্ডোস্কপির মাধ্যমে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের পেট থেকে ১৫টি কলম বের করে আনতে সক্ষম হয়েছি। শুধু এটাই নয়, আমরা বিনা অপারেশনে পেটের পাথর, কিডনিতে পাথর থেকে শুরু করে অনেক কিছুই অপারেশন ছাড়াই সেগুলো অপসারণের কাজ করে যাচ্ছি।
বিরতি কাটিয়ে আবারও আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফিরছে আর্জেন্টিনা। গত মার্চে ঘরের মাঠে সবশেষ আকাশী-নীলদের দেখা গিয়েছিল তিন মাস পর আগামী জুনে তারা আসছে এশিয়া সফরে। সফরকালে ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচও খেলবেন লিওনেল মেসিরা।
আগামী ১৫ জুন বেইজিংয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে নামবে আর্জেন্টিনা। চারদিন পর ১৯ জুন জাকার্তায় ইন্দোনেশিয়ার মুখোমুখি হবেন তারা। সেই ম্যাচ দুটিকে সামনে রেখে আজ দল ঘোষণা করেছেন দেশটির কোচ লিওনেল স্কালোনি। লিওনেল মেসিকে অধিনায়ক করে ২৭ সদস্যের দল ঘোষণা করা হয়েছে।
বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু নাম। এই দলে এই দলে চমক হিসেবে রয়েছে আলেজান্দ্রো গার্নাচো। যিনি বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনার প্রথম প্রীতি ম্যাচের দলে ছিলেন। তবে চোটের কারণে অভিষেকের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে আলো ছড়িয়েছেন গার্নাচো। গত বছরের জুলাইয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মূল দলে জায়গা হয় তার। এখন পর্যন্ত ক্লাবটির হয়ে ৩৫ ম্যাচ খেলেছেন এই লেফট উইঙ্গার। এখন পর্যন্ত নিজে করেছেন ছয়টি গোল, করিয়েছেন আরও ছয়টি। এমন পারফরম্যান্স নজর এড়ায়নি স্কালোনির। তাই জাতীয় দলে জায়গা পেতে বেগ পেতে হয়নি।
দলের তৃতীয় গোলকিপার হিসেবে জায়গা পেয়েছেন ওয়াল্টার বেতিনেজ। এছাড়া বেশ কয়েক বছর পর দলে ফিরেছেন লিওনার্দো বলের্দি। ফরাসি ক্লাব মার্সেইয়ের হয়ে চলতি মৌসুমে তিনি দুর্দান্ত খেলছেন। তবে স্কোয়াডের মাঝ মাঠের ফুটবলারদের নিয়ে কোনো চমক নেই।
তবে এই স্কোয়াডে নেই লাউতারো মার্তিনেজের নাম। গোড়ালির চোটের কারণে এই দুই প্রীতি ম্যাচে তাকে পাচ্ছে না আর্জেন্টিনা। তবে তার জায়গায় মাঠ মাতাতে দেখা যাবে জিওভানি সিমিওনেকে।
আর্জেন্টিনার ২৭ সদস্যের দল
গোলরক্ষক:
এমিলিয়ানো মার্টিনেজ (অ্যাস্টন ভিলা), জেরনিমো রুলি (আয়াক্স), ওয়াল্টার বেনিটেজ (পিএসভি)।
ডিফেন্ডার:
নাহুয়েল মোলিনা (অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ), গঞ্জালো মন্তিয়েল (সেভিয়া), জার্মান পেজেল্লা (রিয়েল বেটিস), ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো (টটেনহ্যাম হটস্পার), লিওনার্দো বলের্দি (অলিম্পিক মার্সেই), নিকোলাস ওতামেন্ডি (বেনফিকা), ফ্যাকুন্ডো মদিনা (আরসি লেন্স), নিকোলাস তাগলিয়াফিকো (লিয়ন), মার্কোস অ্যাকুনা (সেভিলা)।
মিডফিল্ডার:
লিয়ান্দ্রো পেরেদেস (জুভেন্তাস), এনজো ফার্নান্দেজ (চেলসি), গুইডো রদ্রিগেজ (রিয়েল বেটিস), রদ্রিগো ডি পল (অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ), এজেকিয়েল পালাসিওস (বেয়ার লেভারকুসেন), অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার (ব্রাইটন), থিয়াগো আলমাদা (আটলান্টা ইউনাইটেড), জিওভানি লো সেলসো (ভিলারিয়াল)।
ফরোয়ার্ড:
লুকাস ওকাম্পোস (সেভিয়া), অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া (জুভেন্তাস), লিওনেল মেসি (পিএসজি), জুলিয়ান আলভারেজ (ম্যানচেস্টার সিটি), জিওভানি সিমিওনে (নাপোলি), আলেজান্দ্রো গার্নাচো (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), নিকোলাস গঞ্জালেজ (ফিওরেন্টিনা)।
নতুন পে-স্কেল কিংবা মহার্ঘ ভাতা নয়, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়বে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট অনুযায়ী। তাদের বেতন প্রতি বছর যতটা বাড়ার কথা এবার তার চেয়ে বেশি বাড়বে। আর তা চলতি বছরের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে বাড়ানো হবে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়মিত ইনক্রিমেন্ট ৫ শতাংশের বাইরে বাড়ানো হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত প্রায় এক বছর ধরে দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষ কষ্টে আছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের বেশিরভাগের একমাত্র আয় বেতন-ভাতা। বৈশি^ক মন্দার কারণে সরকারও খানিকটা সংকটে আছে। এ পরিস্থিতিতে পে-স্কেল দেওয়ার মতো বড় ধরনের ব্যয় বাড়ানো সরকারের পক্ষে কঠিন হবে। ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হলে সরকারের ওপর চাপ বেশি হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সরকারি কর্মরতদের খানিকটা স্বস্তি দিতে কোন খাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় এমন প্রস্তাব চাওয়া হয়। একই সঙ্গে বাজেটবিষয়ক বিভিন্ন বৈঠকে সরকারি নীতিনির্ধারকরাও এ বিষয়ে আলোচনা করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যাচাই-বাছাই করে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করে। চলতি মাসে গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী এ বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী ওই বৈঠকে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে কত বাড়তি ব্যয় হবে তা হিসাব করে পরের বৈঠকে উপস্থাপন করতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বড় ধরনের ব্যয় না বাড়িয়ে একটা উপায় বের করতেও বলেন। শেষ পর্যন্ত ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যা চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে নিজেই জানিয়েছেন।
বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা ২০১৫ সালের বেতন কমিশন অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এ বেতন কমিশন প্রণীত হয়েছিল। এ কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, আর নতুন বেতন কমিশন গঠন করা হবে না। প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট বা বেতন বাড়ানো হবে। এ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তা হয়ে আসছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি হিসাব অনুযায়ী, দেশে সরকারি কর্মচারী ১৪ লাখ। বিভিন্ন করপোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিয়ে হিসাব করলে প্রায় ২২ লাখ।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে নিয়মিত ইনক্রিমেন্টের বাইরে আরও কতটা বাড়ানো যায় তা হিসাব করে নির্ধারণ করা হবে। এ কাজ করতে বাজেট প্রস্তাব পেশ করার পর আলাদা কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে যাচাই-বাছাই শেষে ইনক্রিমেন্টের হার সুপারিশ করবে। এ ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে বিদ্যমান ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে প্রতি মাসে বেতন বাড়ানো হবে, নাকি গড় মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনা করে ইনক্রিমেন্টের হার বাড়ানো হবে, তা খতিয়ে দেখা হবে। ২০তম গ্রেড থেকে প্রথম গ্রেড পর্যন্ত সবার জন্য একই হারে বেতন বাড়নো হবে কি না, তা আরও খতিয়ে দেখা হবে। চূড়ান্ত হিসাব অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শেষে প্রকাশ করা হবে। যে তারিখেই প্রকাশ করা হোক না কেন, আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকরী ধরা হবে।
এখানে মহার্ঘ ভাতা ১০ শতাংশ দেওয়া হলে এ হিসাবে ৪ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। ১৫ শতাংশ দেওয়া হলে ৬ হাজার কোটি এবং ২০ শতাংশ দেওয়া হলে ৮ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। অর্থাৎ মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে আগামী অর্থবছরে সরকারের ব্যয় বাড়বে। আর এতে সরকার ব্যয় কমিয়েও সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তুষ্টিতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো পথে হেঁটেছে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতা বাবদ রাখা হয়েছে ছিল ৭৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। খরচ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ১ হাজার ৯৩ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা বাজেট হওয়ার কথা আছে। এ বাজেট সরকারি কর্মরতদের বেতন-ভাতার জন্য বরাদ্দ ৭৭ হাজার কোটি টাকা রাখা হতে পারে। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেক পদ এখনো খালি আছে। এতে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানো হলেও সরকারের ব্যয়ে বড় ধরনের চাপ বাড়বে না।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন জায়েদা খাতুন।
তিনি ঘড়ি প্রতীকে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাতে রির্টানিং কর্মকর্তা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
নির্বাচনের অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ ৭ হাজার ২০৬ ভোট, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন-অর-রশীদ ২ হাজার ৪২৬ ভোট এবং হাতি প্রতীকের সরকার শাহনূর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) নির্মিত হয়েছে বিশেষ কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘ও ভোরের পাখি’। ঈমাম হোসাইনের প্রযোজনায় এটি উপস্থাপনা করেছেন তামান্ন তিথি। অনুষ্ঠানটিতে আবৃত্তি করেছেন আশরাফুল আলম, মীর বরকত, রফিকুল ইসলাম, পলি পারভিন, শাকিলা মতিন মৃদুলা, মাসকুর-এ সাত্তার কল্লোল, আসলাম শিশির, সংগীতা চৌধুরী, আহসান উল্লাহ তমাল। প্রচারিত হয় ২৫ মে সকাল সাড়ে ৯টায়।
এছাড়াও নির্মিত হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘আমারে দেবো না ভুলিতে’। অনুষ্ঠানটিতে গান, কবিতা ও আলোচনার সমন্বয়ে কবিকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও বাচিকশিল্পীদের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। ইয়াসমিন মুসতারী, সালাউদ্দিন আহমেদ, শেলু বড়ুয়া, ছন্দা চক্রবর্ত্তী ও ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছেন প্রফেসর মুন্সী আবু সাইফ। মনিরুল হাসানের প্রযোজনায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছে ২৫ মে দুপুর ১ টা ০৫ মিনিটে। আরও প্রচারিত হবে সংগীতানুষ্ঠান ‘দোলনচাঁপা’ ও ‘সন্ধ্যামালতী’। রাত ৯টায় প্রচারিত হবে নাটক ‘বনের পাপিয়া’ (পুনপ্রচার)।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোট শেষ হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এখন পর্যন্ত ৪৫০টি কেন্দ্রের প্রাথমিক ফল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নৌকা প্রতীকে আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩৭৯ ভোট এবং টেবিলঘড়ি প্রতীকে জায়েদা খাতুন পেয়েছেন ২ লাখ ৫ হাজার ৪১৩ ভোট।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
গাজীপুর সিটিতে মেয়র পদে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা খান এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের মধ্যে। দুজনই জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। অপরদিকে ভোটের পরিবেশ ভালো বলে জানান আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহনূর ইসলাম রনি।
কোটা পদ্ধতি তুলে দেওয়ার পরও বিসিএস পরীক্ষায় নারীদের চাকরি পাওয়ার হার প্রায় একই রয়েছে। ১০ শতাংশ কোটা থাকা অবস্থায় তারা যে পরিমাণ চাকরি পাচ্ছিলেন, কোটা তুলে দেওয়ার পরও প্রায় একই হারে চাকরি পাচ্ছেন। সাধারণ ক্যাডার বা কারিগরি ক্যাডারে পিছিয়ে পড়লেও শিক্ষার মতো পেশাগত ক্যাডারগুলোতে এগিয়ে গিয়ে বিসিএসে মোট চাকরি পাওয়ার হারে প্রায় একই অবস্থান ধরে রেখেছেন নারীরা।
অথচ কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় বলা হয়েছিল, কোটা তুলে দিলে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। প্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণের গ্রাফ নিম্নমুখী হবে। আসলে তা হয়নি। কোটা তুলে দেওয়ার পরও তারা প্রায় সমানতালে এগিয়ে চলছেন।
৪০তম বিসিএস দিয়ে চাকরিতে ঢুকে বর্তমানে ঢাকা বিভাগে কর্মরত একজন নারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে বয়সে ছেলেরা চাকরির জন্য প্রতিযোগিতা করে সেই বয়সে অধিকাংশ নারীকেই বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করতে হয়। সংসার করে, সন্তান লালনপালন করে নারীরা ভালো প্রস্তুতি নিতে পারে না। ফলে অনেক মেধাবী নারী প্রতিযোগিতায় উতরে যেতে পারেন না। অনেক নারী পারিবারিক কারণে বিয়ের পর চাকরির আবেদনই করেন না। বিয়ের পর পরীক্ষায় অংশ নিতে বাধা আসে। এসব কাটিয়ে উঠে চাকরিতে প্রবেশ করা কঠিন। আর বিসিএসের চাকরি মানেই বদলিযোগ্য। সংসার-সন্তান রেখে বদলিকৃত পদে যোগ দেওয়া কঠিন বিষয়। সবকিছু মিলিয়ে নারীদের জন্য এ চাকরি সহজ নয়। একজন পুরুষ বেকার নারী বিয়ে করে, কিন্তু একজন নারী বেকার পুরুষ বিয়ে করে না। এ বিষয়টাও ছেলেদের প্রস্তুত হতে সাহায্য করে। এ বাস্তবতা থেকেও পুরুষ প্রতিযোগী বেশি হয়। অন্যদিকে যোগ্য হলেও অনেক নারী প্রতিযোগিতাই করে না।
একজন নারী ইউএনও বলেন, পরীক্ষার হলে বা মৌখিক পরীক্ষার সময় অনেক নারীকে দুগ্ধপোষ্য সন্তানকে সঙ্গে আনতে হয়। এগুলোও অনেক সময় নারীকে চাকরির ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে। ঘরে ঘরে বাধা পায় নারীর অগ্রযাত্রার নানা চেষ্টা। নগর-জীবনে নারীর অস্তিত্ব অনেকটা স্বচ্ছন্দের। কিন্তু নগরসভ্যতার বাইরে বিশাল বিস্তৃত গ্রামীণ জনজীবনে পুরুষতন্ত্রের নানা ধরনের অনাকাক্সিক্ষত বেষ্টনী এখনো নারীকে ধরাশায়ী করে রাখে। হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথ হাঁটছে নারী-পুরুষ। তবু তাদের মধ্যে ভারসাম্য নেই।
কোটা না থাকার পরও নারীরা তাদের অবস্থান কীভাবে ধরে রাখলেন জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নারী শিক্ষায় বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। প্রাথমিকের পর মাধ্যমিকেও মেয়েরা অনেক এগিয়েছে। উচ্চশিক্ষায়ও মেয়েদের অংশগ্রহণের হার বেড়েছে। সবকিছু মিলে বিসিএসে এর প্রতিফল ঘটেছে। যে পরিমাণ মেয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে, সেই তুলনায় চাকরিতে প্রবেশের হার বেশি। উচ্চশিক্ষায় যায় হয়তো ৮০ ভাগ ছেলে। আর মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার হার ৩০ বা ৩৫ শতাংশ। তাদের মধ্যে ২৬ বা ২৭ শতাংশ মেয়ে বিসিএস দিয়ে চাকরি পাচ্ছে। এদিক দিয়ে চিন্তা করলে মেয়েরা অনেক ভালো করছে।’
এক প্রশ্নের জবাব ড. ইমতিয়াজ বলেন, ‘মেয়েদের কাছে শিক্ষা এখনো অপরচুনিটি (সুযোগ) আর ছেলেদের কাছে অধিকার। মেয়েরা যখন এ সুযোগটা পায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা কাজে লাগাতে চায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরিবারের ছেলেসন্তানের জন্য যে বিনিয়োগ, মেয়েসন্তানের জন্য এখনো তার চেয়ে অনেক কম। এখনো মনে করা হয় মেয়ে তো অন্যের ঘরে চলে যাবে। অথচ মজার বিষয় হচ্ছে, পরিবারের দায়িত্ব উচ্চশিক্ষিত ছেলের তুলনায় উচ্চশিক্ষিত মেয়ে অনেক বেশি বহন করে। এসব প্রতিবন্ধকতা হাজার বছরে তৈরি হয়েছে। এগুলো দূর হতে আরও সময় লাগবে।’
অন্যান্য কোটার মতো প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা ছিল। নারীরা যোগ্যতা অনুযায়ী মেধা কোটায়ও নিয়োগ পেতেন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে মেধাভিত্তিক জেলা কোটার পাশাপাশি ১৫ শতাংশ নারী কোটা রয়েছে এখনো। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক জেলা কোটার পাশাপাশি ৬০ শতাংশ নারী কোটা সংরক্ষিত রেখে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে নারীরা সরকারি চাকরিতে পুরুষ প্রার্থীর সঙ্গে মেধা কোটায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিয়োগ লাভের পাশাপাশি সংরক্ষিত কোটায়ও নিয়োগ লাভের সুবিধা পেয়ে থাকেন।
শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে ছাত্রীর হার বাড়ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এক দশকের বেশি সময় ধরে ছাত্রের চেয়ে ছাত্রীর হার বেশি। কলেজ পর্যায়ে ছাত্র ও ছাত্রীর হার প্রায় সমান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর হার ৩৬ শতাংশের বেশি।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে সরকার। ৪০তম সাধারণ বিসিএস হচ্ছে কোটামুক্ত প্রথম বিসিএস। ধাপে ধাপে বাছাই করে গত বছর ৩০ মার্চ এই বিসিএসের চূড়ান্ত সুপারিশ করে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। প্রায় ১৩ মাস পর গত মাসে সেই সুপারিশের বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে পিএসসি। সেখানে বলা হয়েছে, ৪০তম বিসিএসে মোট ২৬ দশমিক ০৩ শতাংশ নারী চূড়ান্তভাবে সুপারিশ পেয়েছেন। যা কোটাযুক্ত ৩৮তম বিসিএসে ২৬ দশমিক ৯১ ও ৩৭তমে ২৪ দশমিক ৬০ শতাংশ ছিল। গত ১ নভেম্বর এ বিসিএসের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দিয়েছেন।
পিএসসির একজন সাবেক চেয়ারম্যান বলেছেন, কোটামুক্ত একটি সাধারণ বিসিএসে ২৬ দশমিক ০৩ শতাংশ নারী চূড়ান্তভাবে সুপারিশ পেয়েছেন এটা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নারীদের শক্ত সক্ষমতা প্রকাশ করে। কারণ এর আগে কোটাযুক্ত ৩৮তম বিসিএসের তুলনায় মাত্র দশমিক ৮৮ শতাংশ কম। অর্থাৎ কোটা তুলে দেওয়ার পরও নারীরা ১ শতাংশও পিছিয়ে পড়েননি। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, প্রত্যেক বিসিএসে নারীদের আবেদনের হার অর্থাৎ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের হার পুরুষের তুলনায় কম অর্থাৎ গড় হার কম। পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতেও নারী প্রার্থীদের পুরুষের তুলনায় অনেক কম চোখে পড়ে। এমনকি কোনো কোনো কক্ষে নারী প্রার্থী থাকেই না। একই সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ধাপগুলো অতিক্রম করার ক্ষেত্রে নারীদের অনুত্তীর্ণ হওয়ার পরিমাণ বেশি থাকে। ৪০তম বিসিএসে যোগ্য আবেদনকারী নারী ছিলেন ৩৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তাদের মধ্যে ১৯ দশমিক ১৯ শতাংশ নারী প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হন। অথচ পুরুষদের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র। যোগ্য আবেদনকারী পুরুষ ছিলেন ৬১ দশমিক ৬২ শতাংশ। প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ পুরুষের হার ৮০ দশমিক ৮১ শতাংশ।
৪০তম বিসিএসের সাধারণ ক্যাডারে ২১ দশমিক ০৮ শতাংশ নারী সুপারিশ পেয়েছেন। এই হার ৩৮ ও ৩৭তম বিসিএসে ছিল যথাক্রমে ২৪ দশমিক ১৪ ও ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
৪০তম বিসিএসের কারিগরি ক্যাডারে ২৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ নারী সুপারিশ পেয়েছেন। এই হার ৩৮ ও ৩৭তম বিসিএসে ছিল যথাক্রমে ২৯ দশমিক ৫৩ ও ২৫ দশমিক ২ শতাংশ।
সাধারণ এবং কারিগরি ক্যাডারে নারীরা পিছিয়ে পড়লেও শিক্ষার মতো পেশাগত ক্যাডারে এগিয়েছেন। ৪০তম বিসিএসে ২৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ নারী সুপারিশ পেয়েছেন। যা ৩৮তমে ২৬ দশমিক ৩০ এবং ৩৭তমে ২৫ দশমিক ২ শতাংশ ছিল।
পুরোপুরি মেধার ভিত্তিতে নেওয়া ৪০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারেও নারীরা পিছিয়েছেন। জেলা কোটাও না থাকায় নাটোর, ভোলা, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি থেকে প্রশাসন ক্যাডারে কেউ সুপারিশ পাননি।
গত বছর প্রকাশিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি চাকরিজীবীদের তথ্যসংক্রান্ত ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস’ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সিভিল প্রশাসনের ১৪ লাখ সরকারি কর্মচারীর মধ্যে ২৬ শতাংশ নারী। সরকারি দপ্তরের মধ্যে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করেন সবচেয়ে কমসংখ্যক নারী। মন্ত্রণালয়ের মোট জনবলের ১৯, অধিদপ্তরের ৩১, বিভাগীয় কমিশনার ও ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয়ের ১২ এবং আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ১২ শতাংশ কর্মী নারী।